লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
শিক্ষাদানের মাধ্যমে ইতিহাস চর্চার মধ্যে যে এক বিরাট সামাজিক দায়িত্ব নিহিত আছে সে বিষয়ে আমরা অনেকেই সম্যক অবহিত নই। মনে রাখা প্রয়োজন শিক্ষিত সমাজের এক বিরাট অংশের সাথে ইতিহাসের পরিচয় বিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর সেই পুঁথিগত বিদ্যা সম্বল করেই তিনি তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর অনেকটা তৈরী করেন। ফলে ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক বা পাঠদানের জলাশয়ে অতি সহজে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতার কীটানু। আর এ কারণেই পাঠ্যপুস্তক বা Text Book এর গুরুত্ব অন্য পাঁচটা গবেষণা পুস্তকের চেয়ে অনেক বেশী তাৎপর্য বহন করে। অনেকে অবশ্য পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে যাত্রা, নাটক, গল্প ও কবিতাকে সাম্প্রদায়িকতার বাহন হিসাবে আরও দ্রুতগামী ও মারাত্মক মনে করেন। কারণ এগুলি অতি সহজে সরলমনা অশিক্ষিত মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুললে চলবে না এগুলির রচয়িতারা সবাই শিক্ষিত এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাথমিক ভিত্তিটি তৈরি হয়েছিল ওই পাঠ্যপুস্তক থেকেই। টডের রাজস্থানের ইতিহাস পড়েই অনেক বিখ্যাত লেখা বাংলায় লেখা হয়েছে এবং সেগুলি আবার ইতিহাসের পরিপর্তে সাহিত্যের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে আর আলোচনায় অনেক শিক্ষক এর মধ্যে প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান পেয়ে যান। যা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টির এক মারাত্মক উপাদান। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস শুরু হল গজনীর সুলতান মাহমুদ গযনবীর মন্দির লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। সৃষ্টি হল শিশু মানসিকতায় এক ঘৃণার বাতাবরণ। অথচ বলা হল না লুণ্ঠনকারীর বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধের অক্ষমতার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, সামাজিক অন্যায়, আর্থিক বঞ্চনা, জনসংখ্যার অপ্রতুলতা, যোগাযোগের অব্যবস্থা এবং সর্বোপরি উৎপাদনের নতুন হাতিয়ার আবিস্কারের ব্যর্থতা। আবার এও জানানো হয় না যে সুলতান মাহমুদ গাযনবীই ভারতের ইতিহাসের প্রথম নরপতি নন, যিনি কোনো উপাসনালয় ধ্বংস করেছেন। প্রাচীন ভাবতের ইতিহাসেও মন্দির ভাঙার অনেক উদাহরণ আছে। তবে সুলতান মাহমুদ শুধু হিন্দুদের রক্তপাত ঘটান নি, তিনি মুলতানের মুসলমান শাসকদেরও রেহাই দেন নি। লুঠেরারা লুঠ বোঝে, ধর্ম সেখানে অজুহাত মাত্র। তৈমুরলঙ জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতার অবসান ঘটাবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে দাঁড়ালেন তুঘলক রাজবংশের পতনের অন্যতম কারণ। ধর্মীয় নীতির আওয়াজ তুলে ভারতে প্রথম যে রাজ্যটি তাঁর আক্রমণের শিকার হল, ঝিলাম নদীর তীরবর্তী সেই ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মুবারক। সুলতান মাহমুদের মন্দির ধ্বংসের ব্যাপারে এও বলা হয়না তাঁর ভারত আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার। হিন্দুদের জলদস্যু দলের এক আড্ডাখানা ছিল সোমনাথ মন্দির। সিন্ধু উপকূলবর্তী এলাকায় আরব মুসলমান বনিকদের ধন – সম্পদ লুণ্ঠন করে এনে তারা যে সোমনাথ মন্দিরে জমা করতো – আর সে জন্যই যে সুলতান মাহমুদের লক্ষস্থলে পরিণত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী বিখ্যাত ঐতিহাসিক লিখেছেন, “বিদেশী বনিকদের কাছে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত সামগ্রির বিক্রয়লব্ধ অর্থে যে সমস্ত হিন্দুরা ধনী হয়েছিল, তাদের দানের প্রাচুর্য দিয়েই এই সমস্ত ধনরত্ন সঞ্চিত হয়েছিল।” (আল বিরুনীর ভারততত্ত্ব)
অতএব সুলতান মাহমুদ ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণেই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এটা আদৌ সত্য নয়।
স্যার ডব্লিউ হেইগ বলেন, “His religious policy was based on toletarion and through zealous for Islam, he maintained large body of Hindu troops and there was no reason to believe that conversion way a condition of their servieces.”
ঐতিহাসিক ইরফান হাবীব বলেছেন, “The non-religious character his extedition will abvious to the critic who has grasped the salient feathres of the age. It is impossible to read a religious motive in them.”
সুতরাং সুলতান মাহমুদ ধর্মীয় কারণে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেন নি। প্রকৃতপক্ষে সোমনাথ মন্দিরকে কোন মন্দিরই বলা যায় না। কারণ সেখানে কোন দেব দেবীর পুজা হত না। তাই সেখানে মুসলমানদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ সুলতান মাহমুদ লুন্ঠন করেছিলেন অর্থাৎ নিজেদের অপহৃত সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। অথচ সিলেবাসের ইতিহাসে এ কথা শেখানো হয় না। সিলেবাসে ইতিহাসে যাই বলুক কিছু ঐতিহাসিক সুলতান মাহমুদকে মহান নরপতি বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন ঐতিহাসিক গীবন বলেছেন, “The Sultan of Ghazani surpassed the limits of conquest of Alexander.” [Gibbon, Vol. XI, P. 241]
Mr. Keene তো এও বলেছেন, “মাহমুদ যেমন বিরাট রাজ্য জয় করতেন, তেমনি বিজ্ঞতার সঙ্গে সুশাসন করতেও সক্ষম হয়েছেন।”
ডাঃ নাসিম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রবন্ধ লিখে P.hd উপাধী পেয়েছিলেন, তাতে তিনি লিখেছেন, “সুলতান মাহমুদ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা।”
ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার তো সুলতান মাহমুদের মন্দির ভাঙার পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, “There wa a story…..once extensivly belived, but now discovered to be nature….. the whole story about Muhammed and hos breaking of the image is a fabricatoin…..” [Story of India]
অন্যদিকে জিজিয়া কর নিয়েও সিলেবাসে ইতিহাসে কম হুলুস্থুল ফেলা হয়নি। মধ্যযুগের কর ব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে হিন্দুদের উপর সঠিকভাবেই জিজিয়া কর চাপানোর কথা বলা হয়। কিন্তু এ কথা কি ব্যখ্যা করে বলা হয় যে জিজিয়া হিন্দুদের জন্য এক বিশেষ রক্ষাকবচ ছিল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ, নির্ধন এবং ব্রাহ্মণদের এই জিজিয়া কর দিতে হত না। আর সেই সাথে দিতে হত না জাকাত – যা কেবল মুসলমানদেরই দিতে হত।
যেসব বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিঃ
১) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম মৌলবাদঃ ঐতিহাসিক গৌতম রায়।
২) ইতিসাহের অন্তরালেঃ ড শ্যামাপ্রসাদ বসু।
৩) সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনাঃ ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার ও বিপানচন্দ্র।
৪) উল্টা বুঝিল রামঃ মোহাম্মাদ আবু তাহের বর্ধ্বমানী।
আধুনিক ভারতের জনক মহাত্মা রামমোহন