লিখেছেনঃ গোলাম আহমাদ মোর্তাজা
গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুনা খাঁ ‘মুহাম্মদ বিন তুঘলক’ নাম দিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন ভারতের ইতিহাসে এক অতি উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন বাদশাহ। ধর্মের দিক দিয়ে তিনি যেমন স্বচ্ছ জ্ঞানের অনুসারী ছিলেন, তেমনি রাজনীতিতে বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত ছিল এবং হিদায়ার মত ফিকাহ শাস্ত্রের কঠিন গ্রন্থও কণ্ঠস্থ ছিল (মাসালিকুল আবসার, পৃষ্ঠা ৩৭ দ্রষ্টব্য)। তিনি উপদেশ দিতে গিয়ে কুরআনের শ্লোক উদ্ধৃত করতেন। বারণী লিখেছেন, যখন আজানের শব্দ তাঁর কানে যেত তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন এবং আযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ঐতিহাসিক ফিরিস্তা সুলতানের নফল এবং মুস্তাহাব (অতিরিক্ত উপাসনাসমূহ) আগ্রহের বর্ণনা দিয়েছেন। (দ্রষ্টব্যঃ রহিম, ১ম খণ্ড ৩৪৫ পৃষ্ঠা, ও তারিখি ফিরোজশাহী)
তিনি শুধুমাত্র রমযান মাসে নয়, অসুস্থ অবস্থাতে, গ্রীষ্মের দারণ ক্লান্তিতে ও মহরম মাসের দশ তারিখে রােযা রাখতেন। ছােটখাটো ব্যাপারেও ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতেন। শরীয়তসম্মত ভাবে যবেহ করা হয়নি বলে মনে হলে সে পশুর মাংস খেতেন না। (অজায়েবুল আসফার, ১৭৬ পৃষ্ঠা)। শায়খ আবদুল হক মােহাদ্দিস দেহলবীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, সিংহাসনে বসার পর তিনি কোন উপাধি ধারণ করেন নি। মুহাম্মদ নামই তাঁর কাছে মানব সন্তানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাম হিসেবে বিবেচিত ছিল। তবে তিনি নিজেকে মুহীয়ে সুনানে খাতামিন্নাবিইন অর্থাৎ শেষ নবীর সুন্নাতকে জীবিতকারক বলে অভিহিত করতেন। ব্যাভিচার ইত্যাদি অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র নজর দিতেন ও অপ্রয়ােজনীয়, অশ্লীল এবং কুৎসিত দ্রব্য থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। হারেমে প্রবেশের সময় মােহরেম অর্থাৎ যাদেরকে বিবাহ করা অবৈধ এমন মেয়েরা তাঁকে দেখে পর্দা করতেন এবং তিনিও তাঁদের প্রতি দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত দোষের মনে করতেন। (তারিখি ফিরােজশাহী, ৫০৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
সুলতান তার মাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, তাঁর কোন আদেশেরই তিনি বিরােধিতা করতেন না। মদের ঘাের শত্রু ছিলেন তিনি। মদ্যপানের অপরাধে একজন আমীরের তিনি সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। শাহাবুদ্দিন আল আমীর শিবলী বলেন, সে সময় দিল্লীতে প্রকাশে মদ পাওয়া যেত না। তিনি মসজিদে জামাতের সাথে নামায পড়ার জন্য খুব জোর দিতেন। ইবনে বতুতাও একথা স্বীকার করেছেন। জামাতের সাথে নামায না পড়ার অপরাধে তিনি তার একজন নিকট আত্মীয়কে কঠোর শাস্তি দান করেন। ভারতে ইনিই প্রথম বাদশাহ যিনি শাসন ব্যবস্থায় নামাযকে অঙ্গীভূত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নাচ গান করা মেয়েরাও নামাযে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তবলীগের সমর্থক এবং সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। সে যুগে তিনি সতীদাহ প্রথা তুলে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হিন্দু ধর্মের বিরােধিতা বা হস্তক্ষেপ হবে বলেই তা থেকে বিরত হন।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক কি পাগল ছিলেন?
মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন সর্বগুণের সমন্বয়ে এক অদৃশ্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, অতুলনীয় আল্লাহ ভক্ত এবং নিরলস সংগ্রামী বাদশাহ-অতএব এ রকম এক মধুর চরিত্র সম্রাটের ঘাড়ে ‘পাগল’, ‘বিকৃত’ আর রক্তলােলুপ এর স্ট্যাম্প না লাগালে ঐতিহাসিক হওয়া যাবে কি করে?
তাই তাঁকেও দুর্নামের শিকার হতে হয়েছে। অবশ্য একথা প্রকাশ দিবালােকের ন্যায় স্পষ্ট ছিল যে, ভারতীয় মুসলমান বংশধররা যেদিন ইসলামের ছায়াবলম্বনে গঠিত হবে, হযরত মুহাম্মদের আদর্শে আদর্শবান হবে, উন্নত আদর্শে রাজা বাদশাহদের চরিত্র মাধুর্যের রঙ রঙিন হবে, সেদিনই ভারতপ্রভু ইংরেজদের লােটা কম্বল কাঁধে নিয়ে এ ভারতভূমি ছেড়ে সুদূর পশ্চিমি দেশে পাড়ি দিতে হবে। তাই জেনে ইংরেজ প্রভু ও তাদের পােষ্যপুত্রের দল প্রায় সমস্ত আদর্শ মুসলিম রাজা বাদশাহদের চরিত্রেই কলঙ্কের বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়ােগ করেছেন, এমনকি অনেক স্থানে পবিত্র ইসলামের উপরেও নির্মম আঘাত হেনেছেন।
প্রধানতঃ চারটি কারণে মুহাম্মদ বিন তুঘলককে ইতিহাসে পাগল, নিষ্ঠুর এবং খামখেয়ালি অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। কারণগুলাে এরূপ—
(১) রাজ্যজ্যয়ের পরিকল্পনা,
(২) রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তরকরণ,
(৩) দোয়াব এলাকায় করভার স্থাপন ও
(৪) তাম্র মুদ্রার প্রচলন।
এবার কারণগুলাের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে কিছু আলােচনা করা যাক।
(১) ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণী লিখেছেন, খােরাসান অভিযানের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ৩৭০০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে অবশেষে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করেন, তাতে তার বাস্তব জ্ঞানের অভাব ও অদূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, বারণী সাহেবের লেখা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। কারণ তিনি তাঁর রচনায় খােরাসান জয়ের পরিকল্পনা কেন ত্যাগ করা হয়েছিল তা বলেননি। তবে সে তথ্য আমাদের হাতে জমা আছে-পাৱস্য ও মিশরের মধ্যে মনােমালিনের পরিপ্রেক্ষিতেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পারস্যের আবু সায়ীদ ও মিশরের আন নাসিরের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠে। তখন বাধ্য হয়েই মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। অতএব এক্ষত্রে তাঁর জ্ঞানের অভাব বা অদূরদর্শিতার পরিচয় তাে পাওয়া যায় না বরং তার শান্তিকামী মনের পরিচয় ফুটে ওঠে। তাছাড়া তাতে দেশের ক্ষতির পরিবর্তে যে বিরাট একটা লাভ হয়েছিল তা হচ্ছে এ যে, যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য অনভিজ্ঞ প্রজাবৃন্দের বিরাট একটা অংশ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিল, যা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে এক উল্লেখযােগ্য অবদান।
এছাড়া ঐতিহাসিক বারণী তাঁর রচনায় মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চীন অভিযানের অসত্য ঘটনাকে স্থান দিয়ে ইতিহাসকে দৃষিত করেছেন। অথচ বাস্তবে মুহাম্মদ বিন তুঘলক চীন অভিযান তাে করেনই নি, চীন অভিযানের পরিকল্পনাও তার মস্তিষ্কে কোনদিন স্থান লাভ করেনি। অবশ্য চীন ও ভারতের সীমান্তবর্তী কারাচল ও কুৰ্মাচলে তিনি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তার পশ্চাতেও যথেষ্ট বাস্তব যুক্তি রয়েছে-উদ্ধত পার্বত্য সর্দারকে আয়ত্তাধীনে আবার জন্যই তাঁর এ অভিযান। শুধু তাই নয় এ অভিযানের ফলস্বরূপ কারাচলের রাজা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন।
(২) দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ন্যায় এক অভিজ্ঞ, দূরদর্শী ও অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বে যেভাবে কলঙ্কের কালি ছিটান হয়েছে তাতে অনেক ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে পারেননি। রাজধানী পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা যেভাবে কল্পনার তুলি দিয়ে চমকপ্রদ উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন তাতে সভ্যতার লেশমাত্র নেই। তিনি বলেছেন, “দিল্লির লােকদিগকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি দাক্ষিণাত্যে তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।” কিন্তু এ উক্তি ভিত্তিহীন এবং প্রকৃতপক্ষে সত্যের অপলাপ। ঐতিহাসিক বারণীও অনুরূপ উপন্যাসিক কৃতিত্বের পরিচয় দিতে ভােলেননি। কিন্তু আসলকথা হচ্ছে এ যে, পিতার শাসনকালে বঙ্গল অভিযানে নিযুক্ত থাকার সময় মুহাম্মদ বিন তুঘলক দাক্ষিণাত্যের বিপজ্জনক সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তাই সিংহাসন লাভের পরেই এ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি দেবগিরিতে দৌলতাবাদ নামক একটি রাজধানী স্থাপন করতে প্রয়াসী হলেন। অবশ্য এর পিছনে কারণ ছিল, কেননা দেবগিরি ছিল সাম্রাজ্যের অপেক্ষাকৃত মধ্যবর্তী এবং দাক্ষিণাত্যের শাসন প্রণালী পর্যবেক্ষণ করবার অধিকতর নিকটবর্তী স্থান। সুদূর দিল্লিতে অবস্থান করে বৃহৎ সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতানের পক্ষে সমগ্র দেশ পরিচালনা করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল, তাছাড়া দিল্লী ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় মােঙ্গল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এসব নানান কারণে সুলতানের নতুন রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনাকে নিছক পাগলামী বলে উড়িয়ে দেয়া চলে না বরং এর পশ্চাতে তার যােগ্য শাসন ক্ষমতা ও দূরদর্শী মনের কৃতিত্ব লুকিয়ে রয়েছে।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্তমান গতানুগতিক ইতিহাসে পাওয়া যায়-তিনি নাকি জোর করে সমস্ত দিল্লীবাসীদের ঘটিবাটি শিশুসন্তানসহ ৭০০ মাইল পথ অতিক্রম করে দৌলতাবাদ যেতে বাধ্য করেছিলেন। ফলে অপারগ অনেক শিশু বৃদ্ধবৃদ্ধা নানা কষ্টে পথে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে বতুতার বর্ণনায়- “দিল্লী নগরী তখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন, “এক পঙ্গু ব্যক্তিকে পথে নিক্ষেপ করা হয় এবং একজন অন্ধকে দিল্লী হতে দৌলতাবাদে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এ সমস্ত উক্তি প্রকৃত সত্যের বিপরীত। ১৩২৭ এবং ১৩২৮ খৃস্টাব্দে দুটি সংস্কৃত অনুশীলন-লিপি হতে জানা যায়, সুলতান সাধারণ প্রজাবর্গ অথবা হিন্দুদের রাজধানী ত্যাগ করতে আদেশ দেননি। প্রকৃত ঘটনাবেশ কয়েক বছর পরে ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে এনে হাটুরে গল্পের ভিত্তিতে তিনি তার মত প্রকাশ করে গেলেন। দিল্লী কখনও জনপরিত্যক্ত ছিলনা অথবা কোন দিন রাজধানীর মর্যাদা হারায়নি, এ আমােঘ ঐতিহাসিক সত্য সমীক্ষাই তার উক্তির অসারতা ও অযৌক্তিকতা প্রমাণ করে। তাছাড়া ইবনে বতুতার উক্তি সঠিক হলে ১৩২৯ খৃস্টাব্দে মুলতানে যে বিদ্রোহ ঘােষিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে এক বিরাট শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করা এ জনশূন্য দিল্লী থেকে সুলতানের পক্ষে কোনমতেই সম্ভব ছিলনা।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে এ যে, রাজধানী পরিবর্তনের যে কথা খুব জোর দিয়ে প্রচার করা হয়ে থাকে সেটাই আসলে সঠিক নয়। তিনি রাজধানী পরিবর্তন করেননি। তবে শাসন কার্যের সুবিধার জন্য দৌলতাবাদকে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীতে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন মাত্র। আর দিল্লীবাসীকে দেবগিরি প্রেরণের পশ্চাতে আসল তথ্য হচ্ছে এ যে, দাক্ষিণাত্যের মুসলমানেরা সে সময় ধর্মবিমুখ হয়ে অত্যাচারী গােষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। তাই তাদেরকে ইসলামের আলাে দেখানোর জন্য দিল্লী হতে শুধুমাত্র একদল মুসলমানকেই দেবগিরি পাঠান হয়েছিল। এছাড়া আরও অন্যান্য অঞ্চলে তিনি প্রচারক দল পাঠিয়েছিলেন। বিখ্যাত আলেম শামসুদ্দিন ইয়াহইয়াকে ডেকে বলেছিলেন, আপনি এখানে বসে কি করছেন? কাশ্মীরে যান এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে স্রষ্টার দিকে ডাক দিন। তাই মনে হয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবে ইবনে বতুতা সাহেব কিংবদন্তীর ভিত্তিতেই এ সমস্ত উপাদানগুলােরকে বিকৃত ইতিহাস স্থান দিতে গিয়ে তালগােল পাকিয়ে বসেছেন।
তবে একথাও ঠিক যে ঐতিহাসিকরা কোন নবী বা অবতার নন, তাঁরাও রক্ত মাংসের মানুষ। অতএব ভুল ত্রুটি তাদেরও কিছু কিছু থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নয়; ঐতিহাসিক বারণী বা ইবনে বতুতার ক্ষেত্রেও এ সত্য প্রযােজ্য।
ইবনে বতুতা খ্যাতনামা ঐতিহাসিক হয়েও ইচ্ছাকৃতভাবে কেন অঘটন ঘটালেন তার উত্তরে বলা যায়, ইবনে বতুতা ১৩৩৩ খৃস্টাব্দে ভারতবর্ষে এসে প্রায় আটবছর কাল ধরে মুহাম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক দিল্লির প্রধান কাজী বা চিফ জাষ্টিসের পদে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু এমন এক অমার্জনীয় অপরাধ তার দ্বারা হয়ে যায়, যার বিচার সুলতানকেই করতে হয়। বিচারে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। কারামুক্তির পর যদিও তিনি সুলতানের প্রীতি ফিরে পেয়েছিলেন তথাপি শান্তির কথা ভুলতে পারেননি। তিনি তাঁর পুস্তকে সুলতানের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞাকে তিনি শত চেষ্টা করেও কোনমতে চাপা দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, অপরাপর পর্যটকদের মত তিনিও ঘটনার সাথে গল্পের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং অলীক জনশ্রুতিকেই অধিক প্রাধান্য দান করেছেন। কারণ অধিকাংশ ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ দেখার সুযােগ পাননি। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তবে তাঁর শােনা কথার তদন্ত না করার অপরাধকে অস্বীকার করা যায় না।
তবুও আমরা দ্বিধামুক্ত চিত্তে একথা বলতে পারি যে, তাঁর রচনায় সে যুগের অনেক মুল্যবান সংবাদ বা তথ্য ইতিহাসকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে।
(৩) নিরপরাধ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্রের নিষ্ঠুরতার আরও একটি অপবাদের আলেখ্য অঙ্কন করা হয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, দোয়াবে সুলতান দশ বিশ গুণ কর বৃদ্ধি করে রায়ত শ্ৰেণীকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করাতে বাধ্য করেন এবং কৃষক শ্রেণীর উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের স্টীমরােলার চালিয়ে গেছেন। বলা যেতে পারে, প্রবাদ বাক্যের মত এ মতকেই সাদরে গ্রহণ করে ইউরােপীয় ঐতিহাসিকেরা তাতে আরও কল্পনার রঙ চড়িয়ে প্রকৃত ইতিহাসকে হজম করে ফেলেছেন। কিন্তু তাঁরা তাে আর নীল কণ্ঠ নন, তাই আবার তার উদগিরণ শুরু হয়ে গেছে বর্তমান লেখনী জগতে। এও জানিয়ে রাখা ভাল যে, জিয়াউদ্দিন বারণী কদাচ সুলতানের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। তাছাড়া তার ইতিহাসের ঘটনাবিন্যাসও ধারাবাহিকভাবে নয়, যখন যে শােনা ঘটনা তার কল্পনাকে উদ্দিপ্ত করেছে তখন সেটাকেই তিনি অগ্রে স্থান দিয়েছেন। ফলে তার বর্ণনায় মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সমস্ত কার্যকলাপই কার্যকারণ নীতি-বিবর্জিত এক পাগলামি ক্রিয়াকাণ্ড বলে মনে হয়েছে।
খলজী বংশের পতনের পর অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে দোয়াব অঞ্চল হতে কর আদায়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, তাই মুহাম্মদ বিন মুঘলক আলাউদ্দিন খলজী অপেক্ষা কম হারে পূর্ব আরােপিত করের পুনঃপ্রবর্তন করেন মাত্র। যেমন স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে দু-দিন বছরের অনাদায়ীকৃত করকে এক সাথে আদায় করা হয়। এটা যদি শিক্ষিত যুগে শিক্ষিত মানুষের কাছে দোষণীয় না হয় তবে মুহাম্মদ বিন মুঘলকই বা দোষী হবেন কেন? কৃষি প্রধান রাষ্ট্রে পর পর দুবছর বৃষ্টিপাত না হলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সময়ে দোয়াব অঞ্চলে দু এক বছর নয়, পর পর সাত বছর অনাবৃষ্টি হয় এবং এর ফলে সেখানকার জনসাধারণকে এক দারুণ দুর্ভিক্ষের প্রকোপে পড়তে হয়েছিল। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মত এক উদারচেতা ও অসীম সাহসী বাদশাহের পক্ষেই এরকম ভীষণ সমস্যর মােকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল, কারণ তিনি এ বিপদে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত প্রজাদের সাহায্যের নিমিত্তে খাদ্য দান, ঋণ দান, কূপ খনন, চাষের বীজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে জনকল্যাণকামী মনােভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন। কথিত আছে, হাতেমতাঈ এবং অন্যেরা এক বছরে যা দান করতেন তিনি একবারেই তা করতেন। তাই ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ দুঃখ করে বলেছেন, “প্রায় এক যুগ স্থায়ী মারাত্মক দুর্ভিক্ষ তার রাজত্বের গৌরব অনেকখানি বিনষ্ট এবং প্রজাদিগকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তাঁকে নীরাে এবং ক্যালিগালের মত নিষ্ঠুর এবং রক্তপিপাসু দানব বলে অভিহিত করে তাঁর মহান প্রতিভার প্রতি অবিচার করা হয় এবং দুর্ভিক্ষের প্রতিরােধের জন্য তার প্রকৃত চেষ্টা ও বিভিন্ন উন্নতিমূলক সংস্কারের পরিকল্পনা হেতু মহান কৃতিত্বের দাবীকে অবজ্ঞা করা হয়।”
(৪) মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজত্বের প্রধান ভাগে স্বর্ণ রৌপ্যের পরিবর্তে তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। মিঃ টমাসের মতে তিনি ছিলেন Prince of Moneyers’ অর্থাৎ তঙ্কা নির্মাতার রাজা। তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রা নূতনত্ব এবং গঠন বৈচিত্যের দিক দিয়ে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। নমুনা এবং কার্যকারিতার দিক দিয়ে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। নমুনা এবং কার্যকারিতার দিক দিয়ে এ মুদ্রার শিল্পসম্মত পরিপূর্ণতা প্রশংসনীয়।”
সাধারণত এ কথাই বলা হয়ে থাকে যে, সুলতানের অপরিমিত উদারতা, দুর্ভিক্ষ, রাজধানী স্থানান্তরকরণজনিত ব্যয় বাহুল্য, দিল্লিতে পুনর্বাসনের ব্যয় প্রভৃতির ফলে রাজকোষ শূন্য প্রায় হয়ে পড়লে সুলতান এ সমস্যার সমাধানের জন্য তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু এ অভিযােগ সত্য নয়। কারণ তাম্র মুদ্রার অসাফল্যের ফলে সমস্ত তাম্র মুদ্রার বিনিময়ে জনসাধারণকে দেয়ার জন্য তখনও সুরতানের হাতে যথেষ্ট স্বর্ণ ছিল-যেহেতু তারপরেই স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিনিময়ে রাষ্ট্রের সমস্ত তাম্র মুদ্রাকে তিনি ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটা আজ নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এক অকল্পনীয় বিজ্ঞানময় কীর্তি।
এছাড়া আরও বলা যায়, তার যথার্থ সতর্কতা অবলম্বনের অভাব তাম্র মুদ্রা প্রচলনের কারণ, আমরা এ কথার সাথেও একমত নই। কেননা, যদি একথা সত্যিই হত, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি সমস্ত তাম্র মুদ্রা ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হলেন কিভাবে? বলাবাহুল্য, তার এ অভিনব পদ্ধতিতে জনসাধারণের ভুল বােঝাবুঝির কারণেই ছিল এ ব্যর্থতা। কিন্তু আজকের শিক্ষিত জনসাধারণ তার যুগের তদানীন্তন উৎকট মুদ্রাস্ফীতিকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আয়ত্বে আনার ঐতিহাসিক ঘটনার প্রশংসা না করে পারেন না।
মােটকথা মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সামগ্রিক জীবনী আলােচনা করে আমরা নিঃসংকোচে বলতে পারি, তিনি একদিকে যেমন আদর্শ বাদশাহ, উন্নতচরিত্র সাধক, প্রতিভাশালী শাসক, যুগােত্তীর্ণ পণ্ডিত, অসাধারণ বক্তা ও অতুলনীয় দাতা ছিলেন তেমনি অপর দিকে তর্ক শাস্ত্র জ্যেতিষবিদ্যা, দর্শন, গণিত এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও তাঁর বিস্ময়কর পাণ্ডিত্য ছিল। বারণী বলেছেন, পাণ্ডিত্য ও প্রতিভায় মুহাম্মদ ছিলেন সৃষ্টির বিষয়। বাদাউনী তাঁকে ‘বৈপরীত্যের সংমিশ্রণ’ বলেছেন। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন-‘Muhammad Tughlak was unguestionably the ablest man among he crowned heads of the Middle ages.’ অর্থাৎ মধ্যযুগের রাজা বাদশাহদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন মুঘলক প্রশ্নাতীতভাবে সর্বাধিক সুযােগ্য সুশাসক ছিলেন।
তাঁর সময়ের হিন্দুদের লেখা হতেও পরিষ্কার বােঝা যায় যে, তৎকালীন হিন্দু প্রজারা সুলতানের উপর খুব ভাল ধারণা পােষণ করতেন। চৌদ্দ শতকের শেষের দিতে বিহারের বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি ঠাকুরের লেখা বিখ্যাত বই ‘পুরুশা পরিশকা’তে মুহাম্মদ বিন মুঘলকের অত্যন্ত প্রশংসা করা হয়েছে। (Vidyapati Thakur’s Purusa Pariska P. 20-24)
১৩২৭ খৃষ্টাব্দের শ্রীরাধারানী ব্রাহ্মণের বই-এ মুহাম্মদ বিন মুঘলকের রাজত্বকে হীরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁকে সাকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। (Catalogue of the Delhi Museum of Archaeology: J. P. Vagel. Calcutta 1908, P. 29)
আজায়েবুল আসফার গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে সুলতান মুহাম্মাদের হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রয়াস ও উদারতার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের ৯ পৃষ্ঠা হতে জানা যায়, রতন নামে জনৈক হিউকে তিনি সিন্ধু প্রদেশের গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন।
এমনিভাবে মহাপণ্ডিত হাফেজে-কুরআন মুহাম্মদ বিন তুঘলক তার হিন্দু-মুসলিম প্রজাবৃন্দের মধ্যে এক মিলন ঐক্য গড়ে তুলে মূল ইতিহাসে চির অমর ও অক্ষয় হয়ে আছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সাধারণ ইতিহাসে তিনি আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
[সৌজন্যেঃ চেপে রাখা ইতিহাস, বক্তাসম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তাজা, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশণ]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।