লিখেছনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
স্তব্ধ রাস্তা। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এই পিচ্ছিল রাস্তাতেই দ্রুত গতিতে যানবাহন ছুটে চলেছে শোঁ শোঁ করে। রাস্তার দুইধারে বিশালাকার বৃক্ষগুলি দৌত্যের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃক্ষগুলি রাস্তার দিকে এমনভাবে হেলে রয়েছে তাতে এক রোমাঞ্চকর ভয়াবহ ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
মৃতপ্রায় বিকেল। বিকেলের এই অন্তিম মুহুর্তে আয়ান তার সুন্দরী স্ত্রী পুজাকে মোটর বাইকে নিয়ে দ্রুত গতিতে রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। আয়ানের বয়স আঠাশের কাছাকাছি আর পুজার বয়স প্রায় বাইশ থেকে তেইশের মধ্যেই। সদ্য বিবাহ হয়েছে তাদের। সিনেমা দেখে ফিরছিল তাই তাদের মন এখন চনমনে।
এমন সময় আয়ান বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল। বাইক শোঁ শোঁ করে ছুটতে লাগল। পুজা ভয় পেয়ে বলল, “আরে একি করছ, গাড়ি আস্তে চালাও, আমার ভয় করছে।”
আয়ান বলল, “এই তোমাদের মত মেয়েদের না, বাইকে না চড়ায় উচিৎ, অল্পতেই ভয়ে কাবু হয়ে যাও।”
“এই আমার না খুব ভয় করছে, গাড়ি আস্তে চালাও না প্লিজ।” ভয়ে ভয়ে পুজা বলল।
“চুপচাপ বসে থাকো তো, কই বিয়ের আগে যখন গাড়িতে বসতে তখন তো ভয় লাগতো না, তখনও তো এই গতিতেই গাড়ি চালাতাম, তখন তো খুব মজা লাগত আর বিয়ের দশ দিন যেতে না যেতেই জ্ঞান দিতে শুরু করলে?”
আয়ান আর পুজার মধ্যে এই কথা কাটাকাটি চলছিল এমন সময় একটি টাটাসুমো গাড়ি টার্নিং থেকে এসে আয়ানের মোটর বাইকে সজোরে ধাক্কা দিল। আয়ান ও পুজা গাড়ি থেকে পড়ে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। মোটর বাইকটা দূরে থেকেই এক অদ্ভুত ধাতব আর্তনাদ করতে লাগল এবং ইঞ্জিন থেকে ধুঁয়া বেরোতে লাগল। আয়ান ও পুজা অজ্ঞান ও রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার ধারে পড়ে রইল। টাটাসুমো গাড়ির ড্রাইভার গতি খারাপ বুঝে গাড়ি নিয়ে কেটে পড়ল।
আয়ান ও পুজা অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পড়ে রইল। সুনসান রাস্তা। শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকেলের আলো মিলিয়ে ঘন কালো অন্ধকার পরিবেশকে গ্রাস করে নেবে। এমন সময় একটা দমকা বাতাস পুজার রক্তাক্ত মুখের উপর বয়ে চলে গেল। হঠাৎ পুজা চোখ মেলে তাকাল, দেখল চারিদিকে ঘনঘটা অন্ধকার। ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে আর দূর থেকে কুকুরের করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। সে ভেবেই পেল না কি হয়েছে। এমন সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই টাটাসুমো গাড়ির সাথে দুর্ঘটনার দৃশ্য। কি করে সে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়েছিল তা মনে করে চমকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল, দেখল আয়ান নেই। কিছুটা দূরে মোটর বাইকটা নিস্তেজ হয়ে মরে পড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে ধোঁয়ার সাথে তার প্রাণ বায়ুও বেরিয়ে বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছে।
পুজা খুব কষ্টে উঠে বসল। দেখলো দূরে তার রক্তমাখা চপ্পল দুটি পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখল একটি চপ্পলের বেড়িটা পুরো ছিঁড়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে খালি পায়েই রাস্তার উপর হাঁটতে লাগল আর ভাবতে লাগল, আয়ান গেল কোথায়? নাকি পুজাকে মৃত মনে করে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাবস্থা করতে গেছে? ফোন করেও তো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাবস্থা করতে পারত। এমনটাও হতে পারে যে এই নির্জন জঙ্গলময় রাস্তায় নেটওয়ার্ক পরিসেবা পায়নি তাই পায়ে হেঁটেই কোথাও কিছু ব্যাবস্থা করতে গেছে। কিন্তু এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া কি তার ঠিক হয়েছে? পুজা ভেবে কিছু কুল কিনারা করতে পারল না। তাই সে নিরুপায় হয়ে রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদুর গিয়ে দেখল একটি পায়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। সে আর আগে পিছু না ভেবে রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ল।
জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই পুজার শরীরটা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। দমকা বাতাসে পুজার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ব্যাঙের শব্দ, প্যাঁচার কর্কশ ডাকে পুজার শরীরে অজানা এক শিহরণ জেগে উঠল। চুলগুলো গুছিয়ে পুজা হাঁটতে আরম্ভ করল। এমন সময় কোন একদিক থেকে অজানা গম্ভীর কণ্ঠে ফিসফিসেনি কথা শোনা গেলঃ “পুজা।” এই জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গ গভীর জঙ্গলের মধ্যে গম্ভীর শব্দ শুনে পুজা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল একটি ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তী দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ঙ্কর একটি চিৎকার করে ছায়ামুর্তীটি সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে গেল। ছায়ামুর্তীটি দেখে পুজা চমকে চিৎকার করে উঠল। সে আর মুহুর্তক্ষণ বিলম্ব না করে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে কিছুদুর গিয়ে একটি পাথরে পা লেগে মুখের ভরে উপুড় হয়ে পড়ল। উঠে বসে দেখলো কেউ কোথাও নেই। আবার সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পুজা দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল একটি গাছের আড়ালে কে যেন উলটো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটির পরিহিত পোষাক দেখে অস্ফুট স্বরে বলল, “আয়ান!” কথাটি বলে একটু একটু করে লোকটির দিকে পুজা এগিয়ে যেতে লাগল। পুজা লোকটির পিছন দিক থেকে স্পর্শ করতেই লোকটি ঘুরে দাঁড়াল। পুজা দেখল সে আয়ান নয় বরং সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তিটি। আবার সেই ছায়ামুর্তিটি ভয়ঙ্কর গম্ভীর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। ছায়ামুর্তিটির চিৎকার শুনে পুজা আবার মাটিতে পড়ে গেল। আবার সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল এবং লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগল। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সে অনুভব করল কে যেন গাছের আড়ালে রয়েছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। এরপর সে গুটি গুটি পায়ে খোড়াতে খোড়াতে জঙ্গলের ভিতর হাঁটতে লাগল।
কিছুদুর এগিয়ে যেতেই একটি করুণ কণ্ঠে গান শুনতে পেয়ে পুজা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল নিশ্চয় আশেপাশে কেউ আছে। গানটিকে অনুসরণ করে পুজা এগোতে লাগল। দেখল সামনেই একটি বহুকালের প্রাচীন পোড়ো বাড়ি। পুজা ভেবে অবাক হল যে এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি কেন, আর এত রাতে কেই বা বাড়ির মধ্যে গান করছে। একটু অবাক হলেও সে ভাবতে লাগল, কোন লোক থাকলে অন্ততঃ তার আশ্রয়দাতা হিসাবে কাউকে পেয়ে যাবে, তাই সে আর আগে পিছু না ভেবে গুটি গুটি পায়ে বাড়িটির দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎ আবার পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলঃ “পুজা।” পুজা চমকে তাকিয়ে দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুজা দৌড়ে গিয়ে আয়ানকে জড়িয়ে ধরল। পুজা রেগে বলল, “আমাকে রক্তাক্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি?”
আয়ান অবাক হয়ে বলল, “আমি তোমাকে কোথায় ছেয়ে চলে এসেছিলাম, তুমিই তো আমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলে, আমি জ্ঞান ফিরে দেখি তুমি সেখানে ছিলে না।”
“কি যাতা পাগলের মত বলছ? আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছিলাম?” পুজা অবাক হয়ে বলল।
আয়ান রেগে বলল, “তাহলে কি আমি তোমাকে ফেলে এসেছিলাম?”
“হ্যাঁ তুমিই আমাকে ঐ অবস্থায় ফেলে এসেছিল, আর তুমি এরকম কাজ করতে পারলে? তোমার বিবেকে একটুও বাধল না?”
পুজা আর আয়ানের মধ্যে এই বাক বিতণ্ডা চলছিল এমন সময় গম্ভীর কণ্ঠে কে যেন তিনবার ডেকে উঠল, “পুজা, পুজা, পুজা।” এই জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গ গভীর জঙ্গলের মধ্যে গম্ভীর শব্দ শুনে ভয়ে পুজা আয়ানকে জাপটে ধরল। আয়ান অনুভব করল তার পিছনে একটি ছায়ামুর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আয়ান পিছন ফিরে তাকাতেই ছায়ামুর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আয়ান পুজাকে বলল, “এই অভিশপ্ত জঙ্গলে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। এর চেয়ে বরং আমরা দেখি এই জঙ্গল থেকে কিভাবে বেরিয়ে পড়া যায়।”
পুজা সায় দিয়ে বলল, “চল।”
কিছু দূর এগিয়ে দেখল কে যেন গাছের আড়ালে বসে ঢুকরে ঢুকরে কান্না করছে। দুজনে কাছে গিয়ে দেখল একটি দশ বারো বছরের ছেলে মাথা নিচু করে বসে কাঁদছে। আয়ান ও পুজা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। আয়ান অবাক হয়ে বলল, “এত রাতে এই গভীর জঙ্গলে ছেলেটা কাঁদছে কেন? নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। চল জিজ্ঞাসা করে দেখি।”
পুজা ভয়ে ভয়ে বলল, “আমার না খুব ভয় করছে।”
“আরে ভয় পাবার কিছু নেই, দেখি না জিজ্ঞাসা করে।” আয়ান পুজাকে আশ্বাস দিয়ে বলল।
আয়ান ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে বাবু তোমার? এত রাতে এই জঙ্গলে কি করছ?”
ছেলেটি বলল, “আমার মায়ের প্রচণ্ড অসুখ, মনে হয় বাঁচবে না।”
“তোমার মা কোথায়?” আয়ান জিজ্ঞাসা করল।
“ঐ বাড়িতে।” বলে ছেলেটি সেই বহুকালের প্রাচীন পোড়ো বাড়িটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল। আয়ান ও পুজা অবাক নয়নে বাড়িটির দিকে তাকাল। বাড়ির ভিতর থেকে অল্প আলো দেখা যাচ্ছে। এরকম নির্জন গভীর জঙ্গলে এরকম বাড়ি খুব কমই থাকে। হঠাৎ এরকম বাড়ির মধ্যে যাওয়াও কম বিপজ্জনক নয়। তবে ছেলেটিকে দেখে কেমন যেন মায়া হল। তাই ভয়ভীতির কথা চিন্তা না করে আয়ান বলল, “চল।”
ছেলেটি আগে আগে এবং আয়ান ও পুজা পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল। জঙ্গলের ভিতর সরু একটি পথ। অন্ধকারে ভাল করে কিছুই দেখা যায় না। তাই ছেলেটার পিছু পিছু মিনিট দশেক হেঁটে আয়ান ও পুজা বাড়িটির দরজার সম্মুখে উপস্থিত হল। ছেলেটি দরজা ঠেলে দিতেই দরজাটি খুলে গেল। পাশের একটি রুমে আলো দেখা যাচ্ছে। সেই রুমের দিকে দেখিয়ে ছেলেটি বলল, “ঐ ঘরেই আমার মা শুয়ে আছে, আপনি যান আমি জল নিয়ে এখুনি আসছি।” বলে ছেলেটি চলে গেল। আয়ান ও পুজা গুটি গুটি পায়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। ঘরটি প্রশস্থ, তবে বেশ এলোমেলোভাবে আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দরজার মুখোমুখি একটি বৃহৎ জানালা। সেই জানালার ধারেই দেওয়ালে টাঙ্গানো কেরোসিনের লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে। সেই কেরোসিনের অস্পষ্ট আলোতেই দেখা গেল জানালার ধারে ক্ষুদ্র তক্তোপোশের উপর অত্যন্ত শীর্ণ এক ভদ্রমহিলা শুয়ে রয়েছেন। দুইজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই ভদ্রমহিলা ক্ষীণস্বরে বললেন, “তাহলে আমার ছেলে কাউকে পেয়েছে, আসুন আসুন, চেয়ারে বসুন।”
তক্তোপোশের পাশেই একটি কাঠের চেয়ার ছিল, সেখানে হেলান দিয়ে আয়ান বসে পড়ল এবং পুজা ভদ্রমহিলার পাশেই তক্তোপোশের এক কোনে বসে পড়ল। আয়ান বলল, “আপনার ছেলের মুখে শুনলাম আপনার নাকি অসুখ হয়েছে, তো আমরা এখন আপনার কি করতে পারি বলুন।”
ভদ্রমহিলা বলল, “কি আর করবেন, আপনারা আমার আর কিছু করতে পারবেন না, তবে একটু সাহায্যের জন্য ডেকেছি।”
“কি সাহায্য?” আয়ান ভ্রু কুচকিয়ে বলল।
“আসলে কি জানেন, আমি ভাল ভাবেই জানি আপনারা আমাকে আর বাঁচাতে পারবেন না, কোন ঔষধই আমার জীবন বাঁচাতে পারবে না। তবে একটি সামান্য সাহায্যের জন্য আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি।” ভদ্রমহিলা ক্ষীণ স্বরে কথাগুলি বলে গেলেন।
আয়ান বলল, “কি সাহায্য সেটা বলবেন তো, না বললে সাহায্য করব কি করে?”
ভদ্রমহিলা বলল, “তাহলে শুনুন” বলে ভদ্রমহিলা পাশের ঘরের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে পাশের ঘরটা দেখছেন সেখানে একটি কোনে ছোট্ট একটি বাক্স পাবেন, বাক্স খুলে দেখবেন ভিতরে একটি পুটুলি রয়েছে, পুটুলির মধ্যে আবার একটি ছোট পিতলের কলসি পাবেন, তাতে আছে কিছু পোড়া অস্থি। সেগুলি নিয়ে দয়া করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবেন তাহলে যার অস্থি তার আত্মা মুক্তি পাবে। শতাধিক বছর ধরে অস্থিগুলি সেখানেই পড়ে রয়েছে তাই সেই মহিলার আত্মা এই জঙ্গলেই ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর জঙ্গলের মধ্যে যে ছায়ামূর্তিটি দেখেছিলেন সেটা তারই অস্থি ওগুলি। তার আত্মা শান্তি পাচ্ছে না তাই এই জনমানবশূন্য গভীর জঙ্গলে বিচরণ করছে। বলুন অস্থিগুলি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন তো?”
আয়ান অবাক হয়ে শুনছিল। অবাক হয়ে সে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, “সে নাহয় ঠিক আছে তবে আপনি জানলেন কি করে জঙ্গলের মধ্যে যে আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল তারই অস্থি ঐ পুটুলির মধ্যে বাঁধা রয়েছে। আর একথায় বা বানলেন কি করে জঙ্গলের মধ্যে আমাদের কেউ ভয় দেখাচ্ছিল।”
শুনে ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বলল, “আমি সব জানি বাবু, এই জঙ্গলের মধ্যে আমি বহুকাল ধরে বসবাস করছি। আমি জানব না তো আর কে জানবে?”
আয়ান আর কথা না বাড়িয়ে পুজাকে বলল, “তুমি এখানে বস আমি ও ঘর থেকে অস্থিগুলি নিয়ে আসছি।”
পুজা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
আয়ান ঘরটির মধ্যে প্রবেশ করল। ঘরটিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আয়ানের শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠল। ঘরটির অবস্থা দেখে মনে হল ঘরটি যেন কয়েকশো বছরের প্রাচীন। দেওয়াল থেকে পলেস্তরা ছেড়ে এমনভাবে ইঁটগুলো বেরিয়ে পড়েছে যেন দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছরের প্রাচীন কোন নরকঙ্কাল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরটিতে ঢুকেই আয়ান লক্ষ্য করল ঘরের কোনেই একটি বাক্স রয়েছে। ভদ্রমহিলা যে স্থানে বলেছিল ঠিক সেই স্থানেই রয়েছে। আয়ান বাক্সটিকে খুলল, দেখল একটি পুটুলি রয়েছে। পুটুলিটি খুলে দেখল সত্যিই তাতে ছোট কলসির মধ্যে অস্থিগুঁড়ো রয়েছে। আয়ান কলসিটিকে পুটুলির মধ্যে ভরে পুটুলিটিকে আবার শক্ত করে বেঁধে দিল। আয়ান পুটুলিটিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসছিল, এমন সময় দেওয়ালে একটি ছবি টাঙানো দেখে চমকে উঠল। আরে এতো সেই ভদ্রমহিলার ছবি যে পাশের বাড়িতেই রুগ্ন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। ছবিতে মালার মত করে সুতো জড়ানো রয়েছে। মনে হচ্ছে ছবিতে মালা দেওয়া ছিল, ফুলগুলি সব শুকিয়ে ঝরে পড়েছে এবং শুধু সুতোর অবশিষ্টই রয়ে গেছে। ছবির নিচে লেখা রয়েছে ভদ্রমহিলার জন্ম ও মৃত্যু সন। জন্ম সন ১৮৬১ এবং মৃত্যু সন ১৯১০। লেখাটি দেখে আয়ানের রক্ত হিম হয়ে গেল। তার শরীর থেকে ঝর ঝর করে ঘাম ঝরতে লাগল। এমন সময় পাশের ঘর থেকে পুজা চিৎকার করে উঠল। আয়ান দৌড়ে পাশের ঘরে পুজার কাছে গেল। দেখল রুগ্ন ভদ্রমহিলা সেখানে নেই। পুজা আয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দেখোনা ভদ্রমহিলা হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।”
আয়ান আর কিছু না বলে পুজার হাত ধরে দৌড়ে বাইরে বেরোতে যাচ্ছিল। দেখল সেই ছেলেটি যে তাদেরকে এখানে এনেছে সে সিঁড়ির উপর বসে রয়েছে এবং তার চোখ দুটি জ্বল জ্বল করছে। দুজনে আর কিছু না বলে ভয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। ছেলেটিও পিছু পিছু ছুটতে লাগল এবং বলতে লাগল, “দয়া করে অস্থিগুলো কোথাও ফেলে দেবেন না, অস্থিগুলো গঙ্গায় বিসর্জন না করলে আমার আর আমার মায়ের আত্মার মুক্তি হবে হবে না। চিরকাল এই জঙ্গলের মধ্যেই আমাদের বিচরণ করতে হবে।”
কথাগুলি বলতে বলতে ছেলেটি আয়ান ও পুজার পিছু পিছু ছুটছিল এবং তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠছিল। এই সময় হঠাৎ এক গগনভেদী চিৎকারে আকাশ বাতাস আলোড়িত করে তুলল। এই জনমানবশূন্য গভীর জঙ্গলে সেই কণ্ঠস্বর আবার তিনবার ডেকে উঠল, “পুজা, পুজা, পুজা।”
আয়ান ও পুজা আর কোনদিকে কর্ণপাত না করে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতেই লাগল। ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে হাজির হল। তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল ভোরের আভা ফুটে উঠেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য্যের আলো পরিবেশকে পরিপূর্ণভাবে গ্রাস করে নেবে। আয়ান ও পুজা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তার উপর উঠে এল। দেখল এ তো সেই রাস্তা যে রাস্তা দিয়ে তারা বাইক চালিয়ে আসছিল এবং দুর্ঘটনা হয়েছিল। আয়ান লক্ষ্য করল কিছুটা দূরে তার বাইকটা পড়ে রয়েছে। দুজনে এগিয়ে বাইকের কাছে গেল। দেখল বাইকের সব ক্রিয়া একেবারে বন্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে মরে পড়ে রয়েছে। বাইকের আরো কাছে এসেই আয়ান ও পুজার রক্ত একেবারে হিম হয়ে গেল। শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। দেখল আয়ান ও পুজার লাশ সেখানে পড়ে রয়েছে। দুজনে অদ্ভুত নয়নে লাশ দুটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তারা ভাবতে লাগল, তাহলে কি তারা সেই দুর্ঘটনাতেই মারা গেছে? এটা কি করে সম্ভব? আমরা তো সারা রাত জঙ্গলের মধ্যে বিচরণ করছিলাম। আমরা মারা গেলে সারা রাত জঙ্গলের মধ্যে কারা ছিল? নাকি আমাদের আত্মা? না না এটা হতে পারে না। ভাবতে ভাবতে আয়ান আয়ানের লাশ ও পুজা পুজার লাশ স্পর্শ করতে গেল। দেখল স্পর্শ করা যাচ্ছে না। হাত এপার ওপার হয়ে যাচ্ছে। আয়ান সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে হাত স্পর্শ করে দেখল, হৎপিণ্ডের স্পন্দন একেবারে স্তব্ধ। সে তাড়াতাড়ি পুজার বুকে হাত স্পর্শ করে দেখল তারও হৎপিণ্ডের স্পন্দন একেবারে স্তব্ধ। বুঝতে আর বাকি রইল না তারা দুজনেই সেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে এবং জীবনের সমস্ত ক্রিয়া একেবার স্তব্ধ হয়ে গেছে। পুজার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো। তার মনে পড়ে গেল সেই দুর্ঘটনার দৃশ্য, কি করে বাইক থেকে আছড়ে পড়েছিল, তার মনে পড়তে লাগল বুকের কাছে এক অদ্ভুত মৃত্যুযন্ত্রণা, শ্বাসরোধের মুহুর্ত। এসব দৃশ্য মনে করে পুজা একেবারে পাগলের মত হয়ে গেল। পুজা এবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। আয়ান ও পুজার চোখ দুটি একবার জ্বল জ্বল করে উঠল। তারা দুজনে একসাথেই সজোরে গম্ভীর স্বরে চিৎকার করে উঠল। তাদের চিৎকার শুনে দূরে কুকুরগুলি আর্তনাদ করে উঠল এবং এক ঝাঁক নিশাচর পাখি উড়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য্য উদিত হয়ে পরিবেশকে গ্রাস করে নিল। আয়ান ও পুজা তাদের লাশের পাশেই একটি ঢিবির উপর বসে লাশ দুটিকে পাহারা দিতে লাগল। তারা বসেই রইল। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন পুলিশ ও একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হল। আম্বুলেন্স থেকে কয়েকজন লোক নেমে লাশ দুটিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে তারা চলে গেল।
দিন গত হয়ে আবার রাত্রি ঘনিয়ে এল। চারিদিক ঘনঘটা অন্ধকার। ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে আর দূর থেকে কুকুরের করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। এমন সময় পুজার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সেই পোড়ো বাড়ির ভিতর থাকা রূগ্ন ভদ্রমহিলা এবং সেই ছেলেটি। ভদ্রমহিলাটি গম্ভীর কণ্ঠে তিনবার ডেকে উঠল, “পুজা, পুজা, পুজা।”
পুজাও গম্ভীর স্বরে বলল, “আসছি মাসিমা, আজ থেকে তো আমাদের আপনাদের সাথেই থাকতে হবে।”
ঢিবির পাশেই রাখা ছিল পোড়ো বাড়ি থেকে আনা পুটুলিটি। পুটুলিটি আয়ান হাতে তুলে বলল, “আর আপনার এই আমানতও তো আপনাকে ফেরত দিতে হবে। আপনারা ভেবেছিলেন আমরা হয়তো কোন জীবন্ত মানব সন্তান। তাই আমাদেরকে এসব দিয়েছিলেন গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে যাতে আপনাদের আত্মার শান্তি হয়। কিন্তু আমরা কবে কখন আপনাদের দলভুক্ত হয়ে গেছি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনি।”চ
বলে আয়ান পুটুলিটি ভদ্রমহিলার হাতে তুলে দিল। ভদ্রমহিলা সেটি নিয়ে ছেলেটির সাথে গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। পিছু পিছু আয়ান ও পুজা জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চারজনেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
অন্য একটি ছোটগল্প – ডায়েরী।