লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে, কোম্পানি শাসনের মধ্যভাগে, ভারতে বইপত্র ছাপা শুরুর সেই আদিপর্বে বাংলায় সতীদাহ প্রথার রমরমার কালে শাণ্ডিল্য গোত্রজাত রামমোহন রায় নামে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি কলকাতার মানিকতলায় এসে বাস শুরু করেন এবং ১৮১৮ সালে নিজের খরচে ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও কতকগুলি উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। বেদান্ত চর্চার মাঝখানে তিনি হঠাৎ, ১৮১৮ সালে ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ’ নামে একটি বই লিখে ফেললেন এবং তাতে সমাজপ্রিয় সতীদাহ প্রথাটির বিপক্ষে তীব্র সমালোচনা করে প্রথাটি নিবর্তন বা রদ করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন।
প্রত্যেক নারীর বেঁচে থাকার অধিকার আছে। যে নারীর স্বামী মারা গিয়েছে বা গেল, চলতি ভাষায় যাঁকে বিধবা বলে, অন্য সব নারীর মতো তারও বাঁচার অধিকার আছে— এই মূল সূত্রটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রামমোহন যে আন্দোলন শুরু করেন, তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই পুস্তিকার প্রকাশ ও বিবরণ। তখন রামমোহনের বক্তব্য খণ্ডন করে কাশীনাথ তর্কবাগীশ লিখলেন ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’ নামে একটি বই, আর তার উত্তরে রামমোহন লিখলেন আর একটি বই ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’। তখন সতীদাহ প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে বাঙালি সমাজ দু’ভাগ হয়ে গেল। এই প্রথা বহাল রাখার জন্য যারা আন্দোলন করছিলেন, তাদের ছিল সংখ্যার জোর, আর যাঁদের পুরোধা ছিলেন রামমোহন তাঁদের ছিল যুক্তির জোর।
আমরা সবাই জানি রামমোহনের আরব্ধ এই আন্দোলনের ফলে ১৮২৮-এর ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক এক আইন প্রণয়ন করে সতীদাহকে নিষিদ্ধ করেন। এতে সতীদাহবাদীরা নিরস্ত হল না, তারা ইংল্যাণ্ডেও সতীদাহ প্রথার পক্ষে আবেদন পাঠালে রামমোহন তার উত্তরে ১৮৩০ সালে লিখলেন Counter Petition to the House of Commons to the Memorial of the Avocates of the Suttee, syfte সহজ কথায় হাউস অফ কমন্সের উদ্দেশে প্রতি-আবেদন। শেষ পর্যন্ত সতীদাহ নিষিদ্ধকরণের আইনই বলবৎ হল।
রামমোহন অবশ্য আইন করে সতীদাহের নিবর্তন চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার দেশবাসী নিজেদের ন্যায় ও শুভবুদ্ধি থেকে এই অমানবিক প্রথার নিবর্তন করুক। তার অমতেই আইনটি ঘোষণার পরে প্রথাটি পুনঃপ্রবর্তনে প্রাচীনপন্থী তথা রক্ষণশীলদের তৎপরতা দেখে রামমোহন আইনটির পক্ষে সশরীর সমর্থন জানাবার জন্য খোদ ইংল্যাণ্ডেই চলে গেলেন।
প্রত্যেক নারীর বাঁচার অধিকার দাবি করেই রামমোহন বুঝেছিলেন, নারীকে শুধু প্রাণরক্ষার অধিকার দিলেই হবে না, তাকে প্রাণধারণের উপায়টার উপরেও অধিকার দিতে হবে। মনুসংহিতাতে বলা হয়েছে যে, নারী বালিকা অবস্থায় পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে, বার্ধক্যে পুত্রের বশে থাকবে স্বামী বা পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকবে না। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, পিতা বা পতি কি পুত্রের অনুভব অথবা অনুগ্রহ কিংবা কর্তব্যবোধ অনুসারে নারী লাভ করবে তার প্রাণধারণের উপায় অর্থাৎ আহার-আঁশয়-আবরণ! এই যেখানে শাস্ত্রের ব্যবস্থা, সেখানে নারীর জন্য আপন প্রাণধারণের উপায়টার উপরেও অধিকার অবশ্যই চাই, তা না হলে সতীদাহের থেকে রক্ষা পেয়েও সে প্রাণধারণ করতে পারবে না।
সতীদাহ নিবৃত্ত হলেও হিন্দু নারীকে কী ধরনের সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হবে সেটা অনুধাবন করেই ১৮২২ সালে রামমোহন লিখলেন আর একখানি বই, যেটার লম্বা শিরোনামটিকে কাটছাঁট করে বলতে পারি Rights of Females according to Hindoo Law of Inheritance, অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নারীর অধিকার। ওই অধিকারবলে সব নারীই, বিশেষত বিধবা নারী, আপন ঐহিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির অংশ থেকে। রামমোহন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই অংশ শুধু নারীর ঐহিক অস্তিত্বকেই রক্ষা করবে না, তার আত্মমর্যাদাকেও রক্ষা করবে। এবং এই মর্যাদা রক্ষার দাবির ভেতরেই নিহিত আছে। নারী-স্বাধীনতার চেতনা। এ কথা মনে করার সংগত কারণ আছে। ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল রামমোহনের রচনাবলির সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, আর নারী-স্বাধীনতা। সম্বন্ধে মিল-এর রচনাবলি রামমোহনের বক্তব্য ও যুক্তিপ্রণালী দিয়ে বিশেষভাবে আলোকিত।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশজুড়ে নারীর প্রাণ, মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব দেড়শো দুশো বছর আগের কথা মনে পড়ল। কারণ, যে আন্দোলনে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক উত্তাল, তার জন্ম হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। আবার স্বাধীনতার প্রথম দশ বছরের মধ্যে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দু-দুটি হিন্দু সমাজ সংস্কারমূলক আইন গৃহীত হয় সংসদে। তখনও রক্ষণশীল ভারতীয়দের পক্ষ থেকে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার অংশ সংক্রান্ত আইনটির অপেক্ষা পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার বিলোপ সংক্রান্ত আইনটির বিরুদ্ধতা হয়েছিল অনেক বেশি। তবে সাধারণভাবে দু’টি আইনই প্রচণ্ড বাধা পেয়েছিল রক্ষণশীলদের কাছ থেকে।
আসলে ভারতীয় নারী সম্বন্ধে ভারতীয় পুরুষের একটা বিশেষ প্রচার, একটা বিশেষ মানসিকতা ও একটা বিশেষ সংস্কৃতি আছে। এটা শুধু আজকের ব্যাপার নয়, বহু যুগের ধারা। রামায়ণের দৃষ্টান্তটাই বা কী? রামচন্দ্র যে সীতাকে উদ্ধার করে আনলেন, সে কি পত্নীপ্রেম থেকে? না কি নিজের পৌরুষ ও বীরত্ব প্রমাণ করার জন্য? উদ্ধার করার পরে রামচন্দ্র প্রথমে সীতাকে তার পছন্দমতো অন্য কোনও পুরুষকে বিয়ে করার কথা কি বলেননি? বার বার সীতার অগ্নিপরীক্ষা নেননি কি? শেষ পর্যন্ত নিগ্রহে নিগ্রহে জর্জরিতা সীতা কি পতিগৃহ ত্যাগ করে মাতৃক্রোড়েই আশ্রয় নেননি? নারী নির্যাতনের এক চরম উদাহরণ কি আমরা রামায়ণ মহাকাব্যে পাই না? প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলিতেও নারীর অবস্থান শোচনীয়—পুরুষের বুকের পাঁজর থেকে যদি নারী সৃষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তো মানতে হয় নারীর অস্তিত্বই নরনির্ভর ও নরাধীন। তাহলে দাঁড়াল স্ত্রীর জীবন পুরুষের দয়াসাপেক্ষ। এটাই সাধারণভাবে মানুষের। অতীত ইতিহাসের নির্গলিতার্থ।
বলেছি অতীত ইতিহাসের কথা। ২০১২-র ডিসেম্বরে দিল্লি কাণ্ডের খেই ধরে সারা দেশ জুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার আদর্শ ও উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনা। কেমন হবে সে ইতিহাস? সেখানে প্রত্যেক নারীকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে দেখবে প্রত্যেক পুরুষ, বিচার ও স্বীকার করবে, সেই অনুভব অনুসারে আচরণ করবে। এ এক নতুন সংস্কৃতি নির্মাণের কাজ। এর জন্য চাই বহু মানবের বহু শতাব্দীর বহু সংগ্রাম ও সাধনা। মনে রাখা প্রয়োজন যে এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটানো এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সে যেদিন ঘটবে সেদিন ঘটবে। আমরা কি ততদিন নিজের নিজের ঘরে চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকব?
দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপারের সঙ্গে চাই স্বল্পমেয়াদি ব্যাপার। এমন কর্মসূচি, যাতে প্রবৃত্তি বা সংস্কৃতির বশে নারী নিগ্রহের ঘটনাক্রমের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, পুরুষের যৌন প্রবৃত্তিকে বশে রাখা যায়। ড্যানিয়েল ডিফোর লেখার সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, তার আমলের লণ্ডনে খাবারের দোকানে খাওয়ার জিনিস চোখের সামনে সাজিয়ে রাখলে বুভুক্ষু ও ক্ষুধার্তরা সে খাবার লুঠ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়ত। আস্তে আস্তে লণ্ডনবাসীরা জেনেছে ও শিখেছে যে খাবার জিনিস দেখলেই তার উপর হামলে পড়াটা শুধু সভ্যতা বিগর্হিত নয়, আইনত দণ্ডনীয়ও বটে। প্রধানত আইনের শাসন প্রবর্তনের অর্থাৎ খাদ্যবস্তু দেখেই তা দখলের জন্য আগ্রাসের অভ্যাসের উপরে কঠোর দণ্ডবিধি প্রয়ােগের পাশাপাশি চাই প্রবৃত্তিকে দমনের জন্য নিরন্তর প্রশিক্ষণ ও মন্ত্রণা। অর্থাৎ নারী নিগ্রহের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি প্রদানের আইন চাই। আর, সে আইন প্রয়োগের জন্য চাই নিরপেক্ষ প্রশাসন।
কিন্তু প্রশাসন তো কোনও ব্যক্তি-সম্পৰ্করহিত নির্বস্তুক ব্যবস্থা নয়, ব্যক্তিবর্গের সমবায়ে ও সংযোগেই তা গঠিত এবং প্রশাসন তথা বিচার বিভাগের অন্তর্গত ব্যক্তিদের কার কীরকম মনস্তত্ত্ব বা সংস্কৃতি, তা বলা কঠিন। কারও কারও এটা সমস্যা যে বয়স নির্বিশেষে অরক্ষিত নারী দেখলেই তার পৌরুষ জেগে ওঠে এবং কখনও শারীরিকভাবে, কখনও প্রশ্নবাক্য দিয়ে, কখনও মন্তব্য দিয়ে সেই নারীকে মানসিকভাবে লজ্জিত করে তার পৌরুষ সুখবোধ করে। এ সব সত্ত্বেও আমরা যখন মনুষ্যসমাজে বাস করি, তখন একে আমাদের আরও বাসযোগ্য করে তোলার সংগ্রামে বিরাম দিলে চলবে না। এই সংগ্রামকে চালিয়ে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। আপাতত আমাদের প্রধান কর্তব্য হল দু’টি— একটি হল দেশের সব রাজ্যে জেলায় জেলায় দ্রুত নিষ্পত্তি সাধক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং অন্যটি- জামিন আযোগ্য ধারায় কঠোর শাস্তির জন্য মামলা দায়ের করার জন্য আইন প্রণয়ন।
দু’শতাব্দী আগেকার ও এখনকার চিত্র দু’টির তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখের নেতৃত্বে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের যোগদানে যে আন্দোলন প্রাণশক্তি পেয়েছে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যযামে জওহরলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখের সংগ্রামে ও সাহসে যে আন্দোলন পেয়েছে আইনি স্বীকৃতি, সেই আন্দোলন একবিংশ শতাব্দীতে এক আবেগের আগুনে পরিণত হয়েছে দেশব্যাপী কোটি কোটি তরুণতরুণীর নেতৃত্বে। এই আগুনকে ঘুমিয়ে পড়তে দিলে চলবে না, এর আগুনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, কারণ, রক্ষণশীলরা আশপাশে ঘাপটি মেরে আছে নতুন হামলা শানাবার জন্য।
সতীদাহ প্রথা ও রাজা রাম মোহন রায় সম্বন্ধে জানতে নিচের লেখাগুলি পড়ুন,
১) আধুনিক ভারতের জনক মহাত্মা রামমোহন
২) বিশ্বশান্তির ধর্ম নিয়ে রাধানগর থেকে ব্রিস্টল