লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর রামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলী খান। মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান। ফলে তিনি তাঁর বিখ্যাত মাতা ‘বি – আম্মা’র কাছে লেখাপড়া শিখেন। পরে তিনি মক্তব ও স্কুলে ভর্তী হন। তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেন এবং বি এতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি লণ্ডনে যান এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অক্সফোর্ডে ভর্তী হন। লণ্ডনে থাকাকালীন তিনি ‘নওবতন’ নামে একটি সমতি গঠন করেন। অক্সফোর্ড থেকে তিনি বি এ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাজ্যের প্রধান শিক্ষা – কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগের চাকুরী গ্রহণ করেন।
তিনি দেশে ফেরার পর ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারী কলকাতা থেকে ইংরেজী ভাষায় সাপ্তাহিক ‘কমরেড’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কমরেড পত্রিকার মূল মন্ত্র ছিল “Comrade of all and partisan of non.” অর্থাৎ আমরা কোন দলগত মতবাদে বিশ্বাসী নয়। আমরা সকলের বন্ধু। ১৯১৪ খ্রীষ্টাবে ২৬ অক্টোবর Choice of the Turks নামক লেখার জন্য তাঁর কাগজ এবং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯১৫ খ্রীষ্টাবে তাঁকে এবং তাঁর বড় ভাই মাওলানা শওকত আলীকে বন্দী করা হয়। দীর্ঘ ৪ বছর শাস্তি ভোগ করার পর ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর তাঁদেরকে মুক্ত করা হয়। মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর অনুপস্থিতিতেই ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে লিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি করা হয়। জেল থেকে মুক্ত হবার পর আলী ভ্রাতৃদ্বয় অমৃতসরে সরাসরি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন। এই অধিবেশনেই তিনি খিলাফত আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ১লা আগষ্ট থেকে শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। ফলে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। করাচীর আদালতে তাঁর বিচার হয়। এই মামলায় তিনি আসামীর জবানবন্দীতে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যটি হলঃ-
“আমি একজন অসহযোগী বলে এই বিচারের কোন কাজে যোগ দিই নিই। কেবল আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি দিন দিন কিভাবে ফুটে উঠেছে তা বুঝতে চেষ্টা করেছি। সে জন্য আমার বিরুদ্ধে যেসব সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গতি বা উপযোগিতা সম্বন্ধে কিছুমাত্র না বলে বা জেরা না করে সেগুলিকে অবাধে চলতে দিয়েছি। আমরা অসহযোগী বলে কোন অভিযোগে আদালতে আনিত হলে গভর্ণমেন্টের সঙ্গে অসহযোগজনীতি বশত প্রকৃত ঘটনার বিবরণটি মাত্র দেওয়া ছাড়া তৎসংক্রান্ত বিচারের অন্য কোন বিচারে যোগ দেওয়া আমাদের ইচ্ছা – বিরুদ্ধ।
বর্তমান অভিযোগটির সম্বন্ধে আমার এরুপ উক্তি করার কোন প্রয়োজনই নেই। তবে হয়তো এর আবশ্যকতা এই হতে পারে যে, এর দ্বারা কতকগুলি অনাবশ্যক সাক্ষীর কাজে কথার মারপ্যাচ থামানো যেতে পারে। এই সাক্ষীগুলি সুস্পষ্ট বিষয় সম্ভ্রমান করতে আনিত হয়ে বিষয়টিকে হয়ত অস্পষ্ট করতে সফল হওয়া যাবে।
তোমরা ভ্রাতা ও অন্যান্য কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে আমি করাচীতে এসেছিলাম। কন্যাশালাতে অবস্থান করেছিলাম। সেখানে থাকাকালে হাজার হাজার লোক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত। তারা প্রায় দিনের বেলাতেই আসত। কখনো কখনো সরকারী বিদ্যালয়ের পাঠ, সরকারী আদালতে ওকালতি, সরকারী উপাধি গ্রহণ এবং সরকারের অধিনে কি সাধারণ বা সামরিক সকল রকম কাজ এসমস্ত বর্জনেরই বিষয় ছিল। কিন্তু তার এতদিন পরে করাচী কনফারেন্সের প্রস্তাবে ভারতীয় সৈন্যগণের রাজভক্তি নাশের ষড়যন্ত্র সাধিত হয়েছিল বলে গভর্ণমেন্টের এই বিলম্বিত আবিস্কারটি অতিব হাস্যজনক। সরকার তার শেষ ‘কমিউনিক’ আমাদের প্রতি অভিপ্রেত অভিযোগের প্রসঙ্গে রাজভক্ত সৈন্যগণের প্রশংসা করে তাদের লাঘব করেছেন। এই প্রশংসা যে পরিমান তাদের উপযোগী বলে বিবেচিত হবে, যে পরিমান তাদের ধর্মত নৈতিক অবনতি ঘটেছে বুঝতে হবে। ধর্মবুদ্ধির এই ন্যূন্যতা বিধর্মী সরকারের প্রভাবের ফল। আর এই প্রশংসা যদি যথোপযুক্তই হয়ে থাকে, তবে তা আমাদেরই কর্মফল প্রয়োজন কালে আমাদের শাস্তি বিধানের জন্য আসছে। আমাদের যে সকল ধর্মীয় ভ্রাতা ভারতীয় সৈন্য বিভাগের অন্তর্ভূক্ত তাদের অভাবের প্রতি আমরা অবহেলা করেছি, এই কর্তব্য ত্রুটিরই এই কর্মফল। কিন্তু আমাদের ক্ষুৎপীড়িত বল বুদ্ধিহীন ভ্রাতৃগণকে আর অবহেলা আমরা করতে পারি না। মুসলমান সৈন্যদিগের নিকট যে মুদ্রিত কাগজ প্রেরিত হয়েছিল তা আমি আদৌ অবগত ছিলাম না। শ্রুতিমধুর হবে বলে এই মুসলমান সৈন্যদিগকে অফিসার বলা হয়েছে। উলেমা সম্প্রদায় যে এতদিন পরে ঈশ্বরের বাণী ভারতীয় সৈন্যগণের নিকট আনয়ন করেছেন এতে আমরা আনন্দিত। আমার একটু ভুল হয়েছে সংশোধন করে বলি জমাত – উল – উলেমা উক্ত প্রকার কাগজ সৈন্যদলে প্রেরণ করার কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এই হল ব্যাপারটা শীঘ্রই সত্যে পরিণত হবে।
১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এদেশে ভারতীয় সৈন্য সম্বন্ধে যে একটা বিদ্রোহ ঘটেছিল, ধর্মবিষয়ক কথাই তার প্রধান বিরোধের ব্যাপার। বিদ্রোহের অবসানে মহারানী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং সাম্রাজ্যভার গ্রহণ করে যে বিখ্যাত ঘোষণাপত্র প্রচার করেন, তাতে ইংলণ্ডীয় সম্রাট ভারতীয় প্রজার ধর্ম – বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবেন না একথা সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে। তাতে কথিত আছে – “এটা আমাদের রাজকীয় ইচ্ছা ও অভিমত যে, প্রজাবর্গের মধ্যে কেউই তাঁর ধর্মমত বা ধর্ম – কাজের নিমিত্ত কোনো প্রকার অনুন্যগৃহীত অথবা বিড়ম্বিত কি নির্যাতিত হবেন না। কিন্তু সকলেই সমানভাবে পক্ষপাত বিবর্জিত রাজ – বিধানের আশ্রয় লাভ করতে পারবেন। যাঁরা আমাদের প্রতিনিধি রূপে কাজ করবেন তাঁদেরকে আমরা স্পষ্টত এই আদেশ ও উপদেশ দিচ্ছি যে, আমাদের যে কোন প্রজার ধর্ম – বিশ্বাসে ও ধর্মোপসনায় হস্তক্ষেপ হতে তাঁরা সর্বোতভাবে বিরত থাকবেন। এর অন্যথা হলে তাঁরা আমাদের অত্যন্ত অসন্তোষের জন্য দায়ী থাকবেন।”
এই ঘোষণাপত্রে যে রাজপ্রতিনিধিগণের কথা উল্লিখিত হয়েছে ভারতের বড়লাটই তাঁদের মধ্যে প্রথম স্থানীয়। কিন্তু আমি অবগত আছি যে, সেই বড়লাটেরই সম্মতিক্রমে আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের জন্য আমরা এইরুপ বিড়ম্বিত এবং নির্যাতিত হচ্ছি। আর মহারানীর যে ঘোষণা বাণী –
“রাজপক্ষীয় কোন সংস্কার ধারণা কোনো প্রজার উপরে উপস্থাপন করা হবে না – ‘তার পরিবর্তে আমারদের উপর অপরজাতীয় যে সকল ধারণা এখন উপনীত করার চেষ্টা হচ্ছে, তা ভারতী দণ্ডবিধির কতকগুলি ধারাই হবে।
আমাদের এই অমূল্য অভিযোগের অর্থ কি? ভারতের হিন্দু – মুসলমান আমরা এই ধারণানুসারে চালিত হব। আমি মুসলমান হিসাবে বলি – আমি যদি ন্যায় পথে বিচলিত হয়ে থাকি, তবে আমাকে আমার ভ্রমটি বুঝিয়ে দিতে বলে তার একটিমাত্র পদ্ধতি আছে আমরা কাজ আমাদের পবিত্র কুরআন কিংবা পয়গম্বর মহম্মদের (সাঃ) চরিতাবলী অথবা অতীত বা বর্তমান মুসলমান পীরগণের ধর্মোপদেশের বিরোধী। ইসলাম ধর্মের ন্যায় – অন্যায় বিচারে এই কয়েকটিই একমাত্র প্রমাণ। আমি সাহস করে বলছি, আমি ভ্রান্ত নই, কারণ ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় আমি ধর্মানুরোধে যে কাজ করেছি, ইসলাম ধর্মের প্রামাণ্যোপদেশ আমাকে ঠিক সেই কাজ করতেই আদেশ করে। অথচ ঠিক এই কাজের জন্যই সরকার আজ আমাকে অভিযুক্ত করছে, অথচ এই সরকার শয়তানী নামে অভিহিত হতে ইচ্ছা করে না। বর্তমান ক্ষেত্রে আমি যে বিষয় উপেক্ষা করব তা আমার পক্ষে সাংঘাতিক পাপ হবে, অথচ আবার উপেক্ষা না করলে রাজ দরবারে আমার অপরাধ হবে, তবে এদেশে কিরুপ আমি আমার কার্য সম্বন্ধে বিবেচনা করব? হয় আমি ধর্মত পাপী হব না হয় রাজদ্বারে অপরাধী হব। এই উভয়সঙ্কটকস্থলে ইংলন্ডের একজন প্রধানমন্ত্রীর এবং তার জাতীয় বর্তমান ভারত রাজ ও বড়লাটের দৃষ্টান্তরূপে আমি ‘ঐশীদূত’ দিগের পক্ষেই থাকতে ইচ্ছা করি।
ইসলাম একজন মাত্র প্রভুর প্রভুত্ব স্বীকার করে, তা হলো প্রভুর প্রভুর প্রভুত্ব। এই ঐশ্বরিক আধিপত্য অপ্রতিহত অখণ্ডনীয় ও অপরিত্যজ্য। একমাত্র ঈশ্বর ব্যতীত আর কোন প্রভু নাই। তিনি আদেশ করেছেন একমাত্র তাঁকে ব্যতীত আর কারো সেবা করবে না। এটাই প্রকৃত সত্য ধর্ম । কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা অবগত নয়। ঈশ্বরের এই প্রভুত্ব তাঁরই পবিত্র নামে কালে কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁর প্রেরিত পয়গম্বরগণের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল। যখন ঈশ্বরের অনুগৃহীত পয়গম্বর হযরত মহম্মদ (সাঃ) মনুষ্যজাতির মধ্যে শান্তির বাণী প্রচার করে শেষে এই নরাধাম ত্যাগ করে গেলেন, তাঁর উত্তরাধিকারী খলিফাগণ তাঁর ধর্মের অনুসারীদের উপদেষ্টা রুপে কাজ করে আসছেন। এই ধর্ম বিশ্বাসমতে তুর্কীর সুলতান বাহাদুর ইসলাম ধর্মের বর্তমান অধ্যক্ষ। কোন মুসলমান তিনি সৈনিক হোন বা সিভিলিয়ান হোন মুসলমান রাজার রাজত্বে বা অপধর্মের রাজত্বেই বাস করুন – ঈশ্বরের প্রভুত্বই স্বীকার করবেন এবং পূর্বোক্ত মুসলমান পয়গম্বর বা পীর ও তাঁদের উত্তরাধীকারী ধর্মোপদেষ্টাদের আদেশ মান্য করবেন। এটাই কুরআনের আদেশ। এটাই ইসলাম ধর্মের মর্মকথা। ইসলাম ধর্মে সুপ্রসিদ্ধ ‘কলমা’ এই আল্লাহ ছাড়া আর কোন ঈশ্বর নেই এবং মহম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত পুরুষ।
বর্তমান কালে পূর্বেও মুসলমানগণ ভিনধর্মী রাজার শান্তি – প্রিয় প্রজা রূপে বাস করেছে। কিন্তু সর্বত্রই তারা এই অপরিবর্তনীয় নিয়ম অনুসারে চলেছে যে, তাদের পার্থিব রাজার যে সকল বিধি ও আদেশ আল্লাহর আদেশের বিরোধী নহে, তারা কেবল সেগুলিই মান্য করবে। কারণ কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশানুসারে একমাত্র আল্লাহই সর্বময় কর্তা। ইসলাম ধর্মের এই সুনির্দিষ্ট নিয়ম শুধু ভিন্ন ধর্মী রাজার রাজত্বে প্রযোজ্য নহে – মুসলমান শাসক সম্প্রদায়কেও এ নিয়ম মান্য করতে হবে। এ নিয়ম কোন মতে সম্প্রসারণ বা সঙ্কুচিত করা চলবে না। এই হেতু আমার নিজ রাজার রামপুরের নবাব বাহাদুর কিংবা হায়দারাবাদের নিজাম মহোদয়, এমনকি স্বয়ং তুর্কীর সুলতান ও মুসলমান প্রজাবর্গকে ইসলাম ধর্মের বিরোধী কোন রাজকীয় আদেশ পালন করতে বাধ্য করতে পারেন না।
যে বিধান মান্য করতে হলে ঈশ্বরের বিধান অমান্য করতে হয়, সে বিধান পালন করতে কোন মুসলমানই বাধ্য নহে। যা ন্যায়সঙ্গত, কেবল তাই মাননীয়। মহাত্মা মহম্মদ (সাঃ) বলেছেন – ঈশ্বরের সৃষ্ট কোন মানুষকে মান্য করতে হলে যে স্থানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেই অমান্য করতে হয় সে স্থলে সে মানবের কথা মানা যেতে পারে না। এই যুক্তি অখণ্ডনীয়। লয়েড জর্জ মহোদয়ের সরকার ইসলাম ধর্মের বিরোধী, খেলাফতের বিরোধী যে রাজনীতির অনুসরণ করেছিলেন তার শেষ পরিণাম কি যে হবে তা ভারতের মুসলমানগণ তাঁকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধি যে খেলাফত সমিতি এই বিষয় তাঁকে জানাতে ইংলণ্ড গিয়েছিল, সে সমিতির অধ্যক্ষতার ভার এই অধিনের উপরই ন্যস্ত ছিল।
এইজন্য ভারতের মুসলমানগণের কাজে সাধারণত এমন কিছুই নেই যাতে সরকার বিস্মিত হতে পারেন। ঈশ্বরের প্রতি আমাদের একটু কর্তব্য ছিল। ঈশ্বরের বিশ্বব্যপী আধিপত্যের প্রতি কর্তব্যের বিরোধী হয়ে পড়ল। তখন আমরা মুসলমান বলে কেবলমাত্র ঈশ্বরকেই মান্য করতে পারি। মুসলমানের অনুরাগ বিরাগ ঈশ্বরের অভিপ্রায় অনুসারেই নিয়মিত হয়।……
আমার পিতামহ সিপাহী বিদ্রোহের সময় সরকারকে সংকট হতে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তখন ভারতের মুসলমানগণ স্পষ্টই বুঝতে পেরেছেন যে, গত দশ বৎসর হতে সরকার ইসলামী রাজ্য সমূহ ও অধুনা বিশেষত খেলাফত সম্বন্ধে যে নীতি অনুসরণ করেছেন তাতে সরকার ইসলাম ধর্মের ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি শত্রুচরণই করেছেন। খেলাফতকে মান্য করা মুসলমানগণের ধর্মীয় নির্দেশ স্বরুপ। সরকার খেলাফত সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি যেমন সহজেই ভঙ্গ করেছেন তেমনি সহজেই ইসলাম ধর্মের নিয়ম ভঙ্গে ভারতীয় মুসলমানগণকে খলিফার মুসলমান সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছেন। জেহাদ ঘোষণা হবার পরেই এই কাজ করা হয়। এই ‘ধর্মযুদ্ধ’ এখনও চলছে। গ্রীক গণকে খাড়া করে তুরাক রাজ্য আক্রমণে সরকার সম্বন্ধেও পরোক্ষ দায়ী হয়েছেন। আমি প্রত্যেক মুসলমানের নিকট আশা করি যে, তিনি ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য সর্বপ্রথমে পালন করেছেন। তারপর রাজার প্রতি কর্তব্য করবেন। এটাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ। যে ধর্মের নিয়ম বন্ধনে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয়েছে, আমি তাই বুঝিয়ে বলছি। সরকার এই অভিযোগের জন্য আমাকেই তো দণ্ড দিতে হবে। স্মার্ট সাহেব এই অভিযোগের জন্য ফাঁসি যাবেন না, আমাকেই ফাঁসির মঞ্চে যেতে হবে। আমি ঈশ্বরের অনুসরণ করব না সরকারের আইন অনুসারে চলব? মহারানী ভিক্টোরিয়া সম্রাট এডওয়ার্ডও সম্রাট জর্জের ঘোষণাপত্রগুলি কি বাজে কাগজের টুকরোমাত্র।”
মাওলামা মুহাম্মাদ আলী তাঁর প্রকাশিত The Comrade পত্রিকায় লেখেন,
Stand upright, Speak thy thoughts, declare
The truth thou hast, that all may share,
Behold, proclaim it everywhere,
They only live who dare.
মাওলানা মুহাম্মাদ আলীই দিল্লীতে জামিয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে এবং তার Vice Chanceller হন। H.G. Well বলেছেন,
“Md. Ali was gited with heart of Nepeau, the thunge of Edmond Barke, and the pen of Macaulay.”
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ইংলণ্ডের গোল টেবিল বৈঠকে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার দাবী তোলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন,
“I fefuse to go back my country either you give me the key of freedom in my hands or give me six but of your earth to bury my body in.”
তিনি আরও বলেন,
“আমি হিন্দুস্তান ফিরে যাব না। আমি আমার মাতৃভূমিকে স্বাধীনতার অলঙ্কার পরাব কিংবা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব এবং সাত সমুদ্র ওপারের এই বৃটেন থেকে আমার লাশ কবরের পথে যাত্রা করবে।”
স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শীর্ষ নেতা মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর মুখ থেকে এই কথাগুলি বের হয়েছিল। ইংরেজদের গোলামীর ঘোর বিরোধীতা এবং নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর শিরা উপশিরায় বিরাজমান ছিল। তিনি একদিকে যেমন ইসলামী জগতের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন অনুরুপ ইংরেজী শিক্ষায়ও তিনি ছিলেন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আর এ ব্যাপারে এক ইংরেজী কমিশনের সামনে তিনি যে, দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা ইংরেজীতে বক্তৃতা করেন তাই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দিল্লীর জামেয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে চির স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গের অন্যতম। তিনি শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদের হাতকে শক্তিশালী করতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের আনাচে – কানাচে ইংরেজ বিরোধী জনমত গঠনে ছড়িয়ে পড়েন এবং ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করতে থাকেন।
তিনি ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের বলকান যুদ্ধের সময় একটি প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র হয়ে বলকান গমন করেন। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দের লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় মুসলমানদের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও তাদের জন্য অপমানকর বক্তব্যসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তখন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী দিল্লী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘হামদর্দ’ এবং সাপ্তাহিক ‘কমরেড’ পত্রিকায় ঐ প্রতিবেদনের জবাবে এমন অগ্নিঝরা বিবৃতি দেওয়া শুরু করেন যে শেষ পর্যন্ত ঐ ইংরেজ প্রতিবেদকের জীবন নিয়ে পালানোই দুস্কর হয়ে পড়ে। মাওলানা মুহাম্মাদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের তিনি এই বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করেন। তিনি ইংরেজ দুঃশাসন থেকে নিপীড়িত মানবতাকে মুক্ত করার জন্য দিন – রাত এক করে ফেলেন। তিনি সুশ্রী মুখায়বয়ব, উত্তম চরিত্র, অতিথি পরায়নতা, দেশ প্রেম, নির্ভিক সত্যবাদীতা এবং সৎ চরিত্র ও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। মাওলানা মুহাম্মাদ আলী তাঁর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নকীবে হামদর্দ’ এর মাধ্যমে ইংরেজ দুঃশাসনের হোতা, তাদের চামচা এবং অত্যাচারী পদস্থ কর্মকর্তা – কর্মচারীদেরকে চরম নাকানি চুবানি খাইয়ে দেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর দীর্ঘ জেহাদী কার্যক্রমের মধ্যে তাঁর সেই কীর্তিও অন্যতম যা তিনি কানপুর দাঙ্গার সময় আঞ্জাম দিয়েছিলেন। বিষয়টি এই যে, কানপুরের একটি মসজিদের আংশিক ধ্বংস সাধন করা হয় এবং তাতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। তখন তিনি ইংলন্ড সফরে যান এবং সেখানে সরকারী মুখপাত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কক্তৃতা – বিবৃতি দেন। পাশাপাশি শহীদের ক্ষতি পুরণসহ কানপুরের মুসলমানদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা বলে ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান ইবনে সাউদ আহুত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহা সম্মেলন বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ভারতের ইতিহাসের পাতায় আজও মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর নাম দীপ্তিমান হয়ে আছে। তাঁর অসাধারণ এবং চিরস্মরণীয় কীর্তিগুলোর মধ্যে ‘খেলাফত কনফারেন্স ও অল পার্টি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করা, সাইমন কমিশনে শৌর্য্য – বীর্য প্রদর্শন, নেহেরু রিপোর্টে আন্তর্জাতিক ভূমিকা’ ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি গোল টেবিল বৈঠকের ৪র্থ সম্মেলনে মুহাম্মাদ আলী বলেছিলেন –
“আমার হাতে যদি স্বাধীনতার স্বত্ব তুলে দেন তাহলে আমি আমার দেশে ফিরে যাব আর যদি না দেন তাহলে আমি গোলামীর দেশে ফিরে যাব না। একটা স্বাধীন বিদেশ ভূমিতেও আমি মরতে রাজি এবং আপনারা যদি ভারতের স্বাধীনতা না দেন তাহলে আমার কবরের জন্য একটু জায়গা দিন।”
সত্যিই এই আজাদী পাগল মাওলানা মুহাম্মাদ আলী আর পরাধীন ভারতে ফিরে আসেন নি, তিনি ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারী তিনি লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর লাশ জেরুজালেমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুফতীয়ে আজমের নির্দেশে মসজিদুল আকসায় তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর জানাযায় কয়েক লক্ষ লোক উপস্থিত ছিলেন।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।