লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
এর আগে আমরা জেনেছি যে প্রত্যেক কার্যের পিছনে কোন না কোন কারণ বিদ্যমান থাকে। কারণ ছাড়া কার্য সম্পাদন হতে পারে না। তাই স্বতস্ফুর্তভাবে কোন কিছুই হতে পারে না। সেটা জানতে পড়ুন “যুক্তির বিচারে মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ”।
তাই নাস্তিক রা একথা প্রায়ই বলে, “স্বতস্ফুর্তভাবে কোন কিছুই হতে পারে না। তাহলে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা স্বতস্ফুর্তভাবে হলেন কি করে। তাহলে তাঁকে কে সৃষ্টি করল? তিনি যদি স্বয়ম্ভু অর্থাৎ নিজেই অস্তিত্ববান হতে পারেন, তাহলে এই বিশ্বই বা স্বয়ম্ভু হতে পারবে না কেন? আর বিশ্ব যদি অস্তিত্ববান হওয়ার জন্য কারও মুখাপেক্ষি হয়, তবে আল্লাহও অস্তিত্ব লাভের জন্য কারও মুখাপেক্ষী হবেন। সুতরাং আল্লাহকে কে সৃষ্টি করলেন?”
এই জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর হল, প্রতিটি কর্মের পিছনে কর্তা অবশ্যই থাকবে, কর্তা ছাড়া কর্ম কখনো সম্পন্ন হয় না। তার মানে এই নয় যে, প্রত্যেক কর্তার পিছনে আবার কর্তা থাকবে। কর্তার পিছনে যদি আবার কর্তা থাকে তাহলে, তবে কর্তা আর কর্তা থাকে না। কর্তা তখন কর্মের পর্যায়ে নেমে আসে। এসেইজন্য কবি ছাড়া কবিতা অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। কিন্তু কবির অস্তিত্বের জন্য আর কোন কবির প্রয়োজন নেই। কবির অস্তিত্বের জন্য যদি আবার একজন কবির প্রয়োজন পড়ে, তবে কবি আর কবি থাকেন না। তিনি তখন কবিতায় পর্যবসিত হন, আর শেষ জনই হবেন আসল কবি। ঠিক তেমনি, শিল্পের পিছনে শিল্পীর দরকার, কিন্তু শিল্পীর অস্তিত্বের জন্য আর কোন শিল্পীর দরকার হয় না। আর যদি দরকার হয়, তবে শিল্পী তখন শিল্পী থাকে না শিল্পের পর্যায়ে নেমে আসে। তখন কর্তা হয়ে যায় কর্ম।
অনুরুপ ভাবে মহাবিশ্ব হচ্ছে সৃষ্ট পদার্থ অর্থাৎ কর্ম, আর আল্লাহ হচ্ছেন তার স্রষ্টা অর্থাৎ কর্তা। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। কিন্তু স্রষ্টার জন্য আর কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয় না। তার প্রয়োজন হলে স্রষ্টা আর স্রষ্টা থাকেন না, তখন তিনি সৃষ্টিতে পরিণত হন। আর স্রষ্টার স্রষ্টা তখন মূল কর্তা বা আল্লাহ হয়ে পড়েন।
এইভাবে প্রশ্ন করতে থাকলে আবার প্রশ্ন আসবে, তাঁর আবার স্রষ্টা কে? সুতরাং এই প্রশ্নের শেষ নেই। এই ধরণের প্রশ্নকে ‘মানতিক’ অর্থাৎ তর্কবিদ্যার ভাষায় ‘তাসালসুলে দওর লাজেম’ অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি মূলক অবান্তর প্রশ্ন’ বলে । এ প্রশ্ন বোকার প্রশ্ন। তাছাড়া ঐভাবে প্রশ্ন করতে করতে এক জায়গায় কোথাও অবশ্যই শেষ হবে। আর শেষ প্রশ্নের উত্তরে যে স্রষ্টা পরিণত হবেন, তাঁকেই আমরা আল্লাহ বলি। বাকিরা আল্লাহ নন, তারা আল্লাহর সৃষ্টি।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। তা হচ্ছে- মহাবিশ্বে দু’রকম সত্ত্বা রয়েছে। একটাকে বলা হয় ‘জাতি’ বা মৌলিক, আর দ্বিতীয়টাকে বলা হয় ‘আরেজী’ অর্থাৎ কৃত্রিম। কৃত্রিম সত্ত্বা সব সময় মৌলিক সত্ত্বার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু মৌলিক সত্ত্বা কারও উপর নির্ভশীল নয়। কৃত্রিম সত্ত্ব মৌলিক সত্ত্বা ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না, কিন্তু মৌলিক সত্ত্বা নিজে নিজেই অস্তিত্ববান। এ কারও কাছে ঋণী নয়।
যেমন একটি রৌদ্রতপ্ত লোহার বলের উত্তাপটা কৃত্রিম, বলটা এই তাপ সূর্যের কাছে পেয়েছে, সে সূর্যের কাছে ঋণী। কিন্তু সূর্য কারো কাছে তাপ নিয়ে গরম হয়নি, তার তাপ নিজস্ব ও মৌলিক। সে কেবল অপরকে তাপ দেয়, কিন্তু কারো কাছে তাপ নেয় না।
তেমনি, কোন বস্তুকে রাখার জন্য একটি জায়গা বা স্থানের প্রয়োজন, কিন্তু স্থানকে রাখার জন্য কোন স্থানের প্রয়োজন পড়ে না। স্থান হচ্ছে মৌলিক। এ অন্য বস্তুকে ধারণ করে, কিন্তু নিজে কারো উপর ভর করেনা।
আমরা কলম দ্বারা লেখি। কলমকে চালায় আঙ্গুল, আঙ্গুলকে চালায় হাত, হাতকে চালায় শরীরের পেশী, আর পেশীকে চালায় প্রাণ। এবার যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রাণকে কে চালায়? তবে আর উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, প্রাণ হচ্ছে মৌলিক এবং কলম, হাত ও পেশী হচ্ছে কৃত্রিম। কলম, হাত ও পেশী পরিচালক ছাড়া চলতে পারে না, কিন্তু প্রাণ নিজেই চলে, বরং অপরকে চালায়।
আমরা জানি, মুরগী ছাড়া ডিম পাওয়া যায় না, আর ডিম ছাড়া মুরগীও জন্ম নিতে পারে না। এটা প্রকৃতিক নিয়ম। কিন্তু পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ডিম এসেছিল না মুরগী – এ প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি উত্তরে বলা হয়-মুরগী, তবে প্রশ্ন আসবে, সেটা কোন ডিমের বাচ্চা? আর যদি বলা হয়-ডিম, তবে প্রশ্ন হবে, সেটা কোন মুরগীর ডিম? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সকলকেই মেনে নিতে হবে যে, মুরগী কিংবা ডিম দুটোর মধ্যে যে কোন একটার প্রথম উদ্ভব হয়েছিল। যদি প্রথমে ডিম এসেছিল, তবে সেটা বিনা মুরগীর ডিম। আর যদি মুরগী এসেছিল, তবে সেটা বিনা ডিমের মুরগী। ঐ সর্বপ্রথম ডিমটা বা মুরগীটা হচ্ছে মৌলিক, আর বর্তমান মুরগী ও ডিমগুলো হচ্ছে কৃত্রিম। বর্তমান ডিম ও মুরগীগুলো পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতাই কৃত্রিম। আর সর্বপ্রথম ডিমটা বা মুরগীটা কারও উপর নির্ভরশীল ছিল না তাই ওটা মৌলিক।
এইভাবে গাছ ও বীজের প্রশ্নটাও আসে। গাছ আগে না বীজ আগে? ঐ সূত্র অনুযায়ী বর্তমান গাছ ও বীজগুলি কৃত্রিম, তাই গাছ বীজের উপর ও বীজ গাছের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পৃথিবীতে প্রথম যে গাছ অথবা বীজটা এসেছিল, সেটা ছিল মৌলিক, তাই সেটা অন্য কিছুর উপর নির্ভশীল ছিল না। সেটা বিনা বীজে কিংবা বিনা গাছে উদ্ভুত।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, কৃত্রিম সত্তা অপরের মুখাপেক্ষী, কিন্তু মৌলিক সত্তা কারও মুখাপেক্ষী নয়। আমরা তথা সারা বিশ্ব হচ্ছে কৃত্রিম । তাই সৃষ্টির ব্যাপারে আমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী, আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা। কিন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মৌলিক সত্ত্বা, তাই তাঁকে সৃষ্টি করার জন্য কারও প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ম্ভু। বরং তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ।
এতক্ষন পর্যন্ত আমি সুর্যের তাপকে, স্থানকে, প্রাণকে এবং প্রথম ডিম মুরগী, গাছ ও বীজকে মৌলিক সত্ত্বা বলে এলাম-এ কেবল উদাহরণের জন্য। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ওগুলোও মৌলিক সত্ত্বা নয়। সূর্যের তাপ, প্রাণের শক্তি, প্রথম ডিম, মুরগী, গাছ ও বীজ – সবই আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং এই মহাবিশ্বে প্রকৃত মৌলিক সত্তা একমাত্র আল্লাহ। তাছাড়া সারা বিশ্বই হচ্ছে কৃত্রিম ও আল্লাহর সৃষ্টি। সবাই আল্লাহর কাছে ঋণী। আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, আর সবই সৃষ্টি। আল্লাহই একমাত্র কর্তা, বাকী সবই কর্ম।
বর্ণিত আছে, নাস্তিক রা একবার ধর্মের বিরুদ্ধে একটি সভা করে। তাদের একজন বক্তা আস্তিকদের বিরুদ্ধে চারটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। যথাঃ
১) আল্লাহ এখন কি করছেন?
২) আল্লাহ এখন কোথায় আছেন?
৩) আল্লাহর মুখ কোন দিকে?
৪) আল্লাহর আগে কে ছিল ?
তারপর নাস্তিক টি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলল, কোন ধর্মগুরু যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে দিতে পারে, তবে আমি মুসলমান হয়ে যাব।
সেই সভায় ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) গোপনে যোগদান করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন শুনে তৎক্ষনাৎ মঞ্চে গিয়ে বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব ইনশাল্লাহ। বক্তা বলল, উত্তর দিন। তিনি বললেন, উত্তর দেওয়ার আগে একটি কথা আছে। তা হচ্ছে- তুমি প্রশ্ন করেছে, আর আমি উত্তর দেব। আমরা জানি, প্রশ্ন করে ছাত্র, আর উত্তর দেয় গুরু। সুতরাং এ ব্যাপারে আমি তোমার গুরু।
অতএব আমি তোমাকে জ্ঞান দেব, অথচ তুমি চেয়ারে বসে থাকবে, আর আমি দাঁড়িয়ে উত্তর দেব- এটা শোভা পায় না। সুতরাং প্রথমে তুমি ছাত্রের মতো হয়ে নীচে নেমে বস, তারপর আমি গুরুর মত চেয়ারে বসে উত্তর দেব। নাস্তিক বেচারা এই অকাট্য যুক্তি কাটতে না পেরে নীচে নেমে বসল, আর ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) চেয়ারে উঠে বসলেন।
তারপর তিনি উত্তর দিতে শুরু করলেন।
বললেন, ১ম প্রশ্নঃ আল্লাহ এখন কি করছেন?- এর উত্তরে আমি বলব, আল্লাহ তায়ালা এইমাত্র একজন সম্মানী মানুষকে সম্মান দিয়ে চেয়ারে বসালেন ও একজন নিকৃষ্ট মানুষকে অপমান করে চেয়ার থেকে নামিয়ে নীচে বসালেন। এটাই এখন করলেন।
২য় প্রশ্ন : আল্লাহ এখন কোথায় আছেন?- এর উত্তরে আমি প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞাসা করছি, তার প্রাণটা কোথায়? হাতে, না পায়ে, চোখে, না মাথায়? নাস্তিক টি বলল, প্রাণ শরীরের সমস্ত অঙ্গেই সমান ভাবে বিরাজমান। ইমাম সাহেব বললেন, তেমনি আমার আল্লাহও মহা বিশ্বের সব জায়গায় সমানভাবে বিরাজমান।
৩য় প্রশ্নঃ আল্লাহর মুখ কোন দিকে?- এর উত্তরে ইমাম সাহেব একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রশ্নকারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, মোমবাতির মুখ কোন দিকে? প্রশ্নকারী বলল, এর মুখ বা আলো চারিদিকেই। তিনি বললেন, তেমনি আল্লাহও হচ্ছেন নুর, তাঁর নুরের আলো সবদিকেই।
৪র্থ প্রশ্নঃ আল্লাহর আগে কে ছিল?- এর উত্তরে আমি প্রশ্নকারীকে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো উল্টোদিকে গুনতে বলছি। নাস্তিক টি বলতে লাগল।
১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭ – – – – ৫, ৪, ৩, ২, ১। তারপর সেই নাস্তিক চুপ হয়ে গেল। ইমাম সাহেব বললেন, চুপ হলে কেন? একের আগে কি আছে গুনতে থাক। প্রশ্নকারী বলল, একের আগে তো কিছু নেই, এক থেকেই তো শুরু। ইমাম সাহেব বললেন, তেমনি আল্লাহ হচ্ছেন এক, তাঁর থেকেই সব শুরু। সুতরাং তাঁর আগে আবার কে থাকবে? তখন নাস্তিক বেচারা পরাজয় স্বীকার করল ও মুসলমান হয়ে গেল।
তখন নাস্তিক রা পুনরায় বলে, “ঠিক আছে, তোমার কথা বুঝা গেল, আল্লাহ বলে একজন অবশ্যই আছেন এবং তিনি স্বয়ম্ভু। কিন্তু তিনিই যে এই বিশ্বের পরিচালক- সেটা তুমি অনুমান করলে কিভাবে? তুমি তো দেখতে পাচ্ছ, জগতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তার পিছনে কোন না কোন একটা প্রাকৃতিক কারণ কাজ করছে। বিজ্ঞানীরাও বলেছে, প্রাকৃতিক নিয়মেই সবকিছু সংঘটিত হচ্ছে। যেমন, বৃষ্টি হওয়ার কারণ মেঘমালা, ঝড় হওয়ার কারণে গভীর নিমচাপ, জ্বর হওয়ার কারণ ঠান্ডা লাগা, রোগ ভালো হওয়ার কারণ ঐষধ, বাচ্চা জন্ম হওয়ার কারণ নর-নারীর মিলন। সুতরাং এখানে কাজের কারণটাই হবে তার কর্তা। তবু তুমি আল্লাহকেই পরিচালক বা কর্তা বলছ কোন হিসাবে?
এর উত্তর হল, আল্লাহ তায়ালা তাঁর এবং কাজের মাঝখানে কারণকে পর্দা বা মাধ্যম হিসাবে রেখেছেন। তিনি এই পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছেন বান্দার ইমান পরীক্ষা করার জন্য। তাই প্রতিটি ঘটনার পিছনে কারণ অবশ্যই থাকবে। তা বলে কারণ কখলো কর্তা হতে পারে না। কেননা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কারণের পিছনে আবার কারণ পাওয়া যায়, তারও আবার কারণ থাকে। এইভাবে চলতে চলতে যে কারণের কোন কারণ থাকে না, সেটাই হবে মূল কারণ। আর মূল কারণকে কারণ না বলে কারক অর্থাৎ কর্তা। বলাই ঠিক। আর সেই কর্তাই হচ্ছেন আল্লাহ।
যে কারণের পিছনে আবার কারণ পাওয়া যায়, তা কর্ম পদ। আর যে কারণের পিছনে আর কোন কারণ থাকে না, তা কর্তৃ পদ। কেননা, কর্ম হচ্ছে কারণে অবশ্যম্ভাবী ফল। সুতরাং যে কারণের পিছনে আবার একটি কারণ থাকে, সেই কারণটা পুর্ব কারণের অবশ্যম্ভাবী ফল। তার মানেই পূর্ব কারণের ফলে সংঘটিত কার্য। যেমন, ফসল ভালো হওয়ার কারণ ভালো বৃষ্টিপাত, আর ভালো বৃষ্টিপাতের কারণ নিমচাপ। এখানে বৃষ্টিপাত একদিকে ফসল ভালো হওয়ার কারণ, অপরদিকে নিম্নচাপের ফল অর্থাৎ নিম্নচাপের কারণে সংঘটিত কার্য। তাই বলছিলাম, যে কারণের পিছনে আবার কারণ পাওয়া যায়, তা আর কারণ না থেকে কার্যের পর্যায়ে নেমে আসে। কিন্তু যে কারণ শেষ কারণ, যার পিছনে আর কোন কারণ থাকে না, তাই হচ্ছে মূল কারণ, আর তাকেই তখন কারণ না বলে কারক বা কর্তা বলাই ঠিক। সুতরাং প্রমাণিত হল, কারণ হচ্ছে কর্মপদ, আর মূল কারণ বা কারক হচ্ছে কর্তৃপদ ।
আমি ইতিপূর্বে ‘স্রষ্টার স্রষ্টা কে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে প্রমাণ করেছি যে, কর্মের জন্য কর্তার প্রয়োজন, কিন্তু কর্তার জন্য আর কোন কর্তার প্রয়োজন হয় না। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। স্রষ্টার জন্য আর কোন স্রষ্টার দরকার হয়না। স্রষ্টা হচ্ছেন ‘জাতি’ বা মৌলিক সত্ত্বা, আর সৃষ্টি হচ্ছে ‘আরেজী’ বা কৃত্রিম সত্ত্বা। কৃত্রিম সত্ত্বা মৌলিক সত্ত্বার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু মৌলিক সত্ত্বা কারও উপর নির্ভরশীল নয়। তেমনি কারণ হচ্ছে কর্মপদ, তাই কৃত্রিম, আর কারক হচ্ছে কর্তৃপদ, তাই মৌলিক। এইজন্য কারণের জন্য কারক বা কর্তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কর্তার জন্য আর কোন কর্তার দরকার নেই। সেই জন্য সব কাজের ও সব কারণের মূল কারক আল্লাহ, তিনিই মৌলিক, তিনিই অনাদি-অনন্ত, তিনিই কর্তা, তিনিই পরিচালক।
আল্লাহ তায়ালা কোন কাজ করার ইচ্ছা করলে প্রথমে ফেরেস্তাকে তার নির্দেশ দেন। তখন সেই কাজ সংঘটিত হওয়ার জন্য যে কারণ দরকার, নির্দেশপ্রাপ্ত। ফেরেস্তা সেই কারণ প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে সৃষ্টি করে দেন। তারপর ঐ কাজটি সংঘটিত হয়। ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পন্ন নাস্তিক বিজ্ঞানীরা কাজের পিছনে কেবল প্রাথমিক কারণটাই দেখতে পায়। তার উপরের দিকে আর তাদের দৃষ্টি যায় না। তাই তারা প্রাথমিক কারণকে অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মকেই মূল কারণ অর্থাৎ কর্তা মনে করে। কিন্তু প্রাথমিক কারণ অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মের পিছনে আবার কার হাত আছে- তা তারা দেখতে পায় না। তাদের দৃষ্টান্ত ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পন্ন একটি পিপীলিকার মত ।
যেমন, একটি পিপড়ে খাতার উপর চলতে চলতে দেখতে পেল- কাগজের উপর একটি সুন্দর ফুল অঙ্কিত হচ্ছে। সে এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্য উপর দিকে মাথা তুলল, একটি কলমের দ্বারা এটা অঙ্কিত হচ্ছে। তখন সে ফুল অঙ্কনের। জন্য কলমকেই মূল কারণ অর্থাৎ কর্তা বলে ঘোষনা করল। কিন্তু কলম চালিত হওয়ার পিছনেও যে একজন মানুষের হাত রয়েছে, সেটা সে দেখতে পেল না। কারণ, অতটুকু মাথা তোলার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু বড় প্রাণীরা দেখতে পাবে। যে, ফুল অঙ্কনের মূল কারণ বা কর্তা হচ্ছে একজন মানুষ। অদুরদর্শী বিজ্ঞানীরাও ঠিক ঐ পিঁপড়ের মত যে কোন ঘটনার প্রাথমিক কারণ বা কারণসমূহকে আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে, মূল কারণে পৌঁছাতে পারে নি। এই জন্য বিজ্ঞানীদের কথাকে সম্পূর্ণ সত্যও বলা যাবে না, আর সম্পূর্ণ মিথ্যাও বলা যাবে না। বরং তাকে আংশিক সত্য বলা যায়। তাদের অনুমান অন্ধের হস্তী-দর্শনের ন্যয় ….
এবার হয়ত কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আল্লাহ যেহেতু সারা বিশ্বের মূল পরিচালক এবং তিনি সর্বশক্তিমান, তাহলে তিনি কাজগুলিকে সরাসরি নিজের কুদরতে সম্পন্ন না করে কারণের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন কেন?
তার উত্তরে বলব, আল্লাহ তায়ালা ইহলোককে ‘দারুল আসবাব’ করে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি কার্যই কার্য-কারণ সম্পর্কের সাথে জড়িত। আল্লাহ তায়ালা যে কোন কাজকে বিনা করণেও সরাসরি সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু তিনি তা না করে সেই কাজটাকে কারণের উপর মওকুফ রেখেছেন। এ নিয়ম জগতের সর্বত্র বিরাজমান। আর এর কারণ হচ্ছে দুটি। যথাঃ
১) আল্লাহ যদি প্রতিটি কাজকে কারণের উপর মওকুফ না রাখতেন, তাহলে ইমানদার বেইমান অর্থাৎ আস্তিক – নাস্তিক এর পরীক্ষা হত না। কারণ তখন সকলেই আল্লাহর অসীম কুদরতের সন্ধান পেয়ে তার উপর বিশ্বাস করে ইমানদার হয়ে যেত। ফলে জাহান্নামের আর প্রয়োজন হত না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি কাজের বা ঘটনার পিছনে একটি করে কারণকে অবশ্যই বিদ্যমান রেখেছেন। একেই কার্য-কারণ সম্পর্ক বা প্রাকৃতিক নিয়ম বলে। আর নাস্তিকরা ঐ কারণ বা নিয়মকেই কাজের বা ঘটনার মূল হোতা বলে মনে করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে। কিন্তু কারণের বা নিয়মের মূল হোতা যে আল্লাহ, সেটা তারা বুঝতে পারেনা। নাস্তিকদের নজর থেকে আল্লাহ তায়ালা কারণের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। কিন্তু সৌভাগ্যবান আস্তিক ব্যাক্তিদের কলবের নুর কারণের পর্দা ভেদ করে (রঞ্জন রশ্মির মত) আল্লাহর অদৃশ্য হাতের সন্ধান পায় ও প্রতিটি ঘটনার মূল কর্তা হিসাবে আল্লাহকেই দেখতে পায়। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা নাস্তিক ও আস্তিকদের পৃথক করেন ।
২) আল্লাহ যদি এই নিয়মকে ভেঙ্গে দিয়ে নিজের কুদরতেই সবকিছু সম্পন্ন করেন, তবে জগতের স্বাভাবিক গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে। দুনিয়া আর দুনিয়া থাকবে না ।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হবে। একদা মুসা (আঃ)-এর পেট ব্যাথা করছিল। তিনি তুর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহকে এ ব্যাপারে জানালে আল্লাহ বলেন, মুসা, তুমি (একটা গাছের নাম করে) অমুক গাছের শিকড় খেয়ে নাও, ভালো হয়ে যাবে। মুসা (আঃ) তাই করাতে তাঁর পেট ব্যাথা সেরে গেল।
কিছুদিন পর আবার পেট ব্যাথা করতে লাগল। মুসা (আঃ) আর আল্লাহকে জিজ্ঞাসা না করেই ঐ জড়ি (ঐষধ) খেয়ে নিলেন। কিন্তু ব্যা সারল না। মুসা (আঃ) এ ব্যাপারে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলে আল্লাহ উত্তরে বললেন, “হে মুসা, তুমি কি ভাবছো- ওষুধেই রোগ সারে? তা সারে না। আমি যখন ওষুধকে বলি, কাজ কর, তখন সে কাজ করে। আর যখন হুকুম না করি, তখন ওষুধ কাজ করে না। যা হয়, আমার হুকুমেই হয়। ওষুধের কোন ক্ষমতা নেই।’
কিছুদিন পর মুসা (আঃ) এর দারুন পায়খানা হতে লাগল । লোকেরা বলল, আপনি অমুক ওষুধ খান, ভালো হয়ে যাবেন। তিনি বললেন, আমি ওষুধ খাব না, কারণ, ওষুধের কোন ক্ষমতা নেই। আল্লাহর হুকুম হলে এমনিই ভালো হয়ে যাবে। আমি তার উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করলাম।
এদিকে পায়খানা উত্তরোত্তর বেড়ে গিয়ে তিনি মরণাপন্ন হয়ে পড়লেন। তখন জিব্রাইল (আঃ) এসে বললেন, “ইয়া কালি-মাল্লা-হ, আল্লাহ আপনাকে ঐ ওষুধটা খেতে নির্দেশ দিয়েছেন। ওতেই আপনার পায়খানা ভালো হবে। তা না খেলে আল্লাহ আপনার পায়খানা ভালো করবেন না। আর ঐ ওষুধ না খেয়ে মারা গেলে আপনি আত্মহত্যার পাপে জড়িত হবেন। তখন মুসা (আঃ) বাধ্য হয়ে ঐ ওষুধ খেয়ে আরোগ্য লাভ করলেন।
তরপর মুসা (আঃ) আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আয় আল্লাহ, তোমার ভেদ কিছু বুঝলাম না। তুমি নিজেই বললে, ওষুধের কোন ক্ষমতা নেই, যা করি আমিই করি। আবার ওষুধ না খেয়ে তোমার উপর তাওয়াক্কুল করলেও তুমি নারাজ হচ্ছ। এর রহস্য কি?
আল্লাহ জবাবে বললেন, হে মুসা, তুমি কি তোমার তাওয়াক্কুলের দ্বারা আমার এই দুনিয়ার নাট্যশালার নাটকের গতিকে স্তব্ধ করে দিতে চাও? অর্থাৎ আল্লাহ যদি কার্যকে কারণের উপর মওকুফ না রেখে নিজের কুদরতে সরাসরি সবকিছু সম্পন্ন করেন, তাহলে দুনিয়ার যাবতীয় কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। যেমন, তিনি যদি বিনা ওষুধে অসুখ ভালো করে দেন, তাহলে ডাক্তারী ও ঔষধের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি যদি স্বামী – স্ত্রীর মাধ্যমে ছেলে – মেয়ে না দিয়ে নিজের কুদরতে আদম (আঃ) এর মত সবাইকে সৃষ্টি করেন, তাহলে বিয়ে শাদী, ঘর সংসার কেউ করবে না। তিনি যদি বিনা পরিশ্রমে রুজি দান করেন, তাহলে চাষ – আবাদ, ব্যাবসা বানিজ্য, শিল্পকলা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি যদি আসমান থেকে কাপড় দান করেন, তাহলে কাপড়ের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এই দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ তার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র হারিয়ে ফেলবে। তখন দুনিয়া আর দুনিয়া না থেকে অন্য জগতে পরিণত হবে।”
এখানে আরও একটি সুক্ষ্ণ তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ ‘হুয়াল আওয়ালো ওয়াল আখেরো ওয়াজ জা-হেরো ওয়াল বাতেন’ অর্থাৎ তিনি অনাদি, তিনি অনন্ত, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গোপনীয়।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আল্লাহ প্রকাশ্য ও গোপনীয়-দুটোই একই সঙ্গে কিভাবে ও কেন?
তার উত্তরে বলব, আল্লাহ তায়ালা বান্দার কাছে সম্পূর্ণ প্রকাশ্যও নন। আর। সম্পূর্ণ গোপনীয়ও নন। বরং দুটোর মাঝামাঝি। কিছুটা গোপন, কিছুটা প্রকাশমান অর্থাৎ তাঁর ‘জাত’ বা সত্ত্বা হচ্ছে গোপন, আর ‘সিফত’ অর্থাৎ গুণাবলী হচ্ছে প্রকাশ্য । সিফাতের মাধ্যমে তাঁকে আবিস্কার করতে হয়। আর তাঁর সিফত অর্থাৎ গুনাবলী বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। সৃষ্টি কৌশল নিয়ে চিন্তা গবেষনা করলে তাঁর গুণাবলী ও গুণাবলীর মাধ্যমে তাঁর সত্ত্বাকে উপলব্ধি করা যায়। গুণাবলী দর্শনের দ্বারা গুণাকরকে চিনতে পারা যায়। যেমন কবিতার দ্বারা কবিকে, শিল্পের দ্বারা শিল্পীকে, কর্মের দ্বারা কর্মীকে, সাহিত্যের দ্বারা সাহিত্যিককে চেনা যায়, তেমনি সৃষ্টির দ্বারা স্রষ্টাকে আবিস্কার করা যায়। প্রাকৃতিক নিয়মের পর্দার আড়ালে থেকে তিনি সারা জগতকে অদৃশ্য আঙ্গুলের ইশারায় পরিচালনা করছেন।
এখানে হয়ত নাস্তিক রা বলবেন, আল্লাহ তায়ালা পর্দার আড়ালে না থেকে বরং সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে থাকলেই ভালো হত, তাতে সবাই ইমানদার হয়ে জান্নাতে যেতে পারত। কিংবা সম্পূর্ণ গোপন থাকলেও হত, তাতে মানুষ ইমান আনার দায় থেকে মুক্তি পেত।
উত্তরে বলব, আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণ প্রকাশ্য বা সম্পূর্ণ গোপনীয় হওয়ার দুটি কারণ আছে। যথাঃ
১) কে আল্লাহকে না দেখে সিফাতের মাধ্যমে তার জাতকে মেনে নেয়? তার পরীক্ষা হত না।
২) সিফাত বা গুণাবলির মাধ্যমে স্রষ্টার জাতকে আবিস্কার করার একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যেত। একটা দৃষ্টান্তের মাধ্যমে কথাটা পরিস্কার করা যাক।
আমরা ছোট বেলায় একটা খেলা খেলতাম। তার নাম ‘লুকলুকানি’ খেলা। এই খেলায় দুটি পক্ষ থাকে। প্রথম পক্ষ লুকিয়ে পড়ে, দ্বিতীয় পক্ষ খুঁজে বের করে। যখন প্রথম পক্ষকে খুঁজে বের করতে দ্বিতীয় পক্ষের খুব কষ্ট হয়, তখন দ্বিতীয় পক্ষ চিৎকার করে বলে, একটা কুক বা সাড়া দিবি তো দে, নয়তো খেলবই না। তখন প্রথম পক্ষ সরু গলায় একটা কুক দেয়। দ্বিতীয় পক্ষ কুক শুনে তার রা (শব্দ) এর অনুসরণ করে খুঁজতে থাকে। অবশেষে তাকে ফোপন জায়গা থেকে বের করে ফেলে। যেই বের করে ফেলে, অমনি দ্বিতীয় পক্ষ ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি বলে আনন্দে ও উল্লাসে চিৎকার করে উঠে।
এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ প্রথম পক্ষের আসল ইচ্ছাটা কি? লুকিয়ে থাকা না আবিস্কৃত হওয়া। যদি বলে লুকিয়ে থাকা, তবে প্রশ্ন করব, সে কুক দিল কেন? আর যদি বলে, আবিস্কৃত হওয়া, তবে প্রশ্ন করব, সে কুক না দিয়ে সরাসরি বেরিয়ে এল না কেন ?
এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, প্রথম পক্ষের ইচ্ছাটা সম্পূর্ণ লুকিয়ে থাকাও নয়, আর হঠাৎ প্রকাশ হওয়াও নয়। বরং তার ইচ্ছা এই যে, দ্বিতীয় পক্ষ তার কুক শুনে বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক পরিশ্রমের পর তাকে আবিস্কার করবে। তাতে সকলেরই আনন্দ হবে। এখানেই খেলায় সার্থকতা।
অনুরুপ ভাবে, আল্লাহ তায়ালা বান্দার কাছ থেকে সম্পূর্ণ গোপন থাকতেও চান না, আর হঠাৎ করে প্রকাশ হতেও চান না। তিনি চান, বান্দা তাঁর কুক অর্থাৎ সৃষ্টি কৌশল ও সিফাত নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে বহু পরিশ্রমের পর তার জাত বা সত্তাকে আবিস্কার করবে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভক্তির আবেগে সে বলে উঠবে, “আশহাদো আল্লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ” অর্থাৎ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই।” আর তিনিই সৃষ্টিলীলার সার্থকতা।
অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর
পাশ্চাত্যের নাস্তিক দার্শনিকগণ বলেছেন, ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে তাই প্রত্যক্ষ করা যায়। যেহেতু পাশ্চাত্ব দার্শনিকগণ আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করেননি সেজন্য তাঁরা আল্লাহকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন।
বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) অস্তিত্বকে পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। সেগুলি হলঃ
১) ‘অজুদে যাতী’ অর্থাৎ প্রকৃত অস্তিত্ব যা প্রকাশ্য বিদ্যমান। যে সব জিনিস আমরা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকাশ্যে অনুভব করতে পারি।
২) ‘অজুদে হিসসী’ অর্থাৎ অনুভব অস্তিত্ব যা কেবল অনুভব শক্তির মাধ্যমে যা বোঝা যায়। যেমন – আমরা স্বপ্নে যা দেখি, তা অনুভব শক্তির দ্বারাই দেখে থাকি। পীড়িতাবস্থায়ও মানুষ অনুভব শক্তির দ্বারা বহু কিছু দেখতে পায়।
৩) ‘অজুদে খেয়ালী’ বা কাল্পনিক অস্তিত্ব; যেমন – বন্ধুকে কেউ একবার মাত্র দেখে সে চক্ষু বন্ধ করে রইল। তথাপি কল্পনার চোখে বন্ধুর যে আকৃতিটা তার অন্তরে ভেসে রইল তারই নাম ‘অজুদে খেয়ালী’।
৪) ‘অজুদে আকলী’ অর্থাৎ যৌক্তিক অস্তিত্ব। কোন বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বরুপের নাম ‘অজুদে আকলী’ বা যৌক্তিক অস্তিত্ব। যেমন – আমার আয়ত্বের কোন একটি বস্তুকে লক্ষ্য করে আমি বললাম যে, এ এখন সম্পূর্ণরুপে আমার হাতে। তার উদ্দেশ্য হাতে হওয়া নয় বরং শক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রকাশ করা। সুতরাং ঐ শক্তি ও মালিকানা স্বত্বই হল হাতের ‘অজুদে আকলী’।
৫) ‘অজুদে শেবহী’ অর্থাৎ অনুরুপ অস্তিত্ব; অর্থাৎ মূল বস্তুটি নাই অথচ ঠিক তারই মতো অন্য একটি আছে।
পাশ্চাত্যের নাস্তিক দার্শনিকগণ বলেছেন, ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর’ অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে তাই প্রত্যক্ষ করা যায়। যেহেতু পাশ্চাত্ব নাস্তিক দার্শনিকগণ আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করেননি সেজন্য তাঁরা আল্লাহকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন।
এইবার দেখি পাশ্চাত্যের নাস্তিক দার্শনিকগণ যে বলেছেন, “অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর’ তাই আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করা যায় কিনা। হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) অস্তিত্বকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন তা উপরে উল্লিখিত করা হল। ২ নং বলা হয়েছে ‘অজুদে হিসসী’ অনুভব অস্তিত্ব অর্থাৎ কেবল অনুভব শক্তির মাধ্যমে যা বোঝা যায়। সৃষ্টি বৈচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় আল্লাহর অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্বকে ‘অজুদে হিসসী’ বা অনুভব অস্তিত্বের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যায়।
৪ নং এ বলা হয়েছে ‘অজুদে আকলী’ অর্থাৎ যৌক্তিক অস্তিত্ব। এখন দেখুন এই ‘অজুদে আকলী’ অর্থাৎ যৌক্তিক অস্তিত্বের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যায় কিনা। যুক্তিবিদ্যার দ্বারাও আল্লাহর অস্তিত্বও এর আগে প্রমাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর’ হলেও আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
- ১) ইবলিসের বিষাক্ত ছোবল ও তার প্রতিকার – হজরত মাওলানা নজরুল হক
- ২) ইয়াহইয়াহ উলুমিদ দ্বীন – হজরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
- ৩) ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর বিভিন্ন গ্রন্থ।
আগের পর্বটি পড়ুন
যুক্তির বিচারে মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।