লিখেছেনঃ সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমি তসলিমা নাসরিন-এর লেখা ব্যাপকভাবে পড়িনি। তবে যেটুকু পড়েছি, তা থেকে প্রথমেই মনে হয়েছে যে উনি নিজের লেখায় বিভিন্ন সময় সুকুমারী ভট্টাচার্যের রচনার অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কখনও তার উৎস উল্লেখ করেননি। কেউ যদি কারও গবেষণালব্ধ, কাজ নিজের প্রযয়োজনে ব্যবহার করেন, তাহলে সেটা উল্লেখ করে দেওয়াটাই রীতি। যদি কেউ সেটা না মানেন, তাহলে আমার মতে তিনি ঠিক কাজ করছেন না। তবে ওঁর সাহসিকতার আমি ভক্ত। আমাদের দেশকাল-পরিস্থিতির মধ্যে থেকে উনি যে আদৌ কোন কথা বলছেন সেটাই প্রশংসার। আর তাঁর কথাগুলো যে সর্বৈব ভুল, তাও নয়। সত্যিই তো আমাদের সমাজে পুরুষ শাসন, নিপীড়ন সবই আছে। এর বিরুদ্ধে বলার লোকও খুব বেশি নেই। কেন নেই, সেটা অবশ্য অন্য প্রশ্ন। তারজন্য প্রচার মাধ্যম, বিজ্ঞাপন জগৎ, অনেককিছুই দায়ী হতে পারে। তবে তসলিমা যে চুপ করে থাকেননি, অন্তত কিছু কথা বলেছেন, সেটুকু নিশ্চিতভাবে প্রশংসাযোগ্য। আর এটুকু কথা বলার জন্যও তো তাঁকে কিছু লোকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে, হয়তো বা কারুর কারুর আক্রমণের শিকারও হয়েছেন।
তবে এসব কিছু সত্ত্বেও একটা ব্যাপার আমি উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, তসলিমা নাসরিন-এর, প্রয়াসের সঙ্গে একটা বিজ্ঞাপনের ব্যাপার জড়িয়ে পড়ছে। কোন একটি প্রতিষ্ঠান তসলিমাকে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছে। তিনি তার যোগ্য কিনা সে প্রশ্নের বিচারক আমি সাজতে চাই না। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজে শাসন ও শোষণের যে কাঠামো, তার বিরুদ্ধে তো নীরবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন আরও কেউ কেউ। যেমন, এই প্রসঙ্গে আমি। বলব, প্রাক্তন যৌনকর্মী মিনু দের কথা। আমাদের এই কলকাতা শহরে বসেই মানবতা, সৎসাহস এবং নিঃস্বার্থ সংগ্রামের যে নজির তিনি দেখিয়েছেন, নারী হিসাবে অন্য নারীর পাশে সরাসরি এসে দাঁড়ানোর যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার। অথচ তাঁর সম্পর্কে এই প্রতিষ্ঠানধরা যাক আনন্দবাজার পত্রিকা-কিন্তু তেমন ভাবে সরব নয়। তসলিমা নাসরিন এর সম্পর্কে ব্যাপক লেখালিখি, ছবি ছাপা-নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু এখানেই আটকে থাকলে সন্দেহ হয়। মিনুদেকে নিয়ে যখন তেমন কোন আন্দোলনই হয় না, লেখক-লেখিকা, বিদগ্ধ ব্যক্তিরা কোনরকম বিতর্কের ঝড় তোলেন, তখন সন্দেহটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় বলেছে যে, রামমোহন রায় নারী শিক্ষার প্রসার চেয়েছিলেন, কারণ তিনি শিক্ষিত শয্যাসঙ্গিনী কামনা করতেন—আমার উদ্ধৃতি হয়তো পুরোপুরি সঠিক হলনা। কিন্তু আমি বলতে চাইছি কথাটা এই মর্মে বলা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেখিকার কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন তসলিমা কি ঢাকার কোন রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঘর করতে চাইবেন, যিনি তাঁর লেখা কখনও পড়েননি? অথবা তিনি কি কখনও কোন নিরক্ষরের প্রেমে পড়েছে এবং তার সঙ্গে থেকেছে? আমি আমার দেশকে ভাল ভাবে চিনিনা। আমার মনে হয়, তসলিমাও চেনেন না। আমার মতই তিনি একজন ভণ্ড, শ্রেণীসুবিধা-ভোগী মানুষ। তবে তসলিমা যদি নিজের দেশ এবং আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে আরও একটু বেশি মিশতেন, তাহলে তিনি বুঝতে পারতেন যে, এদেশের শ্রমজীবী শ্রেণীর মহিলারা অনেক বেশি স্বাধীন। তথাকথিত আধুনিকতার জিগির তুলে সেই স্বাধীনতার প্রচার তাদের করতে হয় না। এর পাশাপাশি আরও একটা কথা না বলে পারছি না। আমাদের মত উপমহাদেশে যেখানে বেশীরভাগ মানুষ কষ্টে আছে, দুঃখে আছে, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ (আমার বা ওঁর। মত) যাঁরা শ্ৰেণী আনুকূল্যের জোরে ভাল থাকি, তারা কি এভাবে পুরুষ বা নারী কাউকেই দায়ী করতে পারি ? নাকি আমাদের দায়ী করা উচিত এই সামাজিক কাঠামোতে? এভাবে সারাক্ষণ অপরকে দায়ী করার প্রবণতা থাকলে বোধহয় স্থানকালের প্রতি সুবিচার করা। হয় না। তসলিমা এবং আমি যে-শ্রেণীর সন্তান, সেখানে তো মেয়েরা এখন অনেক। সুযোগই পান। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, শিল্প-সাহিত্য সর্বত্রই তারা আজ নিজেদের স্থান অধিকার করেছেন। কিন্তু তাদেরও তো দায় আছে সময়ের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং মানুষের প্রতি? এই দায়বদ্ধতার ব্যাপারে তারা কতটা সক্রিয়? আমার প্রশ্ন দোষটা কি শুধুই পুরুষদের, নাকি এই সুবিধাভোগী শ্রেণীর?
আমাদের দেশের যা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে কোন কথা প্রকাশ্যে লেখার আগে কিছুটা বিবেচনা করে লেখাই ভাল। তসলিমা নাসরিনের লেখা আজ হিন্দু মৌলবাদীদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এব্যাপারে তিনি আরও একটু সতর্ক হলে পারতেন। তবে মৌলবাদীরা তাঁকে খুনের হুমকি দিয়েছে বলে যে প্রাণনাশের আশঙ্কা করা হচ্ছে, আমার মনে হয় (হুমকিকে খাটো না করেই) সেটা অমূলক। মৌলবাদীরা তাঁকে মারবেন না।
প্রসঙ্গত বলি, বাংলাদেশের এক পুরুষ লেখক হুমায়ুন আজাদের লেখা একটি বই ‘নারী’ আমি পড়েছি। সেখানেও মেয়েদের ওপর ধর্মের শোষণ এবং শাসনের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আছে তিনি এখানে হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, সব ধর্মের কথাই বলেছেন। এই বইটির বিরুদ্ধে কিন্তু মৌলবাদীরা আদৌ সোচ্চার হননি। তাহলে কি বলতে হয় হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে মৌলবাদীদের আঁতাত আছে? তসলিমার বইকে হাতিয়ার করেছে হিন্দু মৌলবাদীরা। আমি মনে করি, পৃথিবীর সমস্ত মৌলবাদীরাও পরস্পর পরস্পরের বন্ধু সেখানে হিন্দু মহাসভা আর জামাত-ই ইসলাম ভাই ভাই। তাই শঙ্কর গুহ নিয়োগীকে খুন করা হবে চিরকালই, কিন্তু হুমকি দিলেও তসলিমাকে কেউ হত্যা করবেন না। ভয় নেই।
তসলিমা-সম্পর্কিত আলোচনা পড়ে আমার বারবারই মনে হচ্ছে যে, তার লেখালিখি শেষপর্যন্ত নারী প্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বিদেশে বেড়াতে যেতে পারছেন না, সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না—এগুলো নিশ্চিত দুঃখের ব্যাপার, অত্যন্ত অন্যায় কাজ। কিন্তু এ প্রশ্ন তো উঠছে না, যাঁদের উনি প্রবক্তা তারা দেশের বাইরে তো দূরের কথা, নিজের গ্রামের বাইরেও সারাজীবনেও একবার যাওয়ার সুযোগ পাননা, তাদের কারুরই হয়তো বা পাসপোর্ট নেই? তসলিমার অসহিষ্ণুতা এই কারণেই যে সবদেশে, সবকালে সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষ সে সুযোগ পেয়ে থাকেন, তার থেকে তিনি সাময়িক ভাবে বঞ্চিত হয়েছে—তাঁর লেখালিখির বিষয়ের সঙ্গে বোধহয় এটা আদৌ সম্পর্কিত নয়। বিতর্ক আর বেশিদূর গড়ানোর আগে তসলিমা যদি নিজের শ্রেণী অবস্থানকে সনাক্ত করে নিতে পারেন, তাহলেই বোধহয় সবথেকে ভাল হয়।
(সৌজন্যে : আলোকপাত ডিসেম্বর ১৯৯৩)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।