লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
আরবিতে এই এলাকাকে বলা হয় বিলাদ উশ শাম বা মাগরিবি আরাবিয়ী। হিব্রুতে বলা হতো কেনান এবং ইউরোপীয়রা একসময় ডাকত লেভান্ট নামে। ইতিহাস বলছে, বিভিন্ন সময়ে এর আয়তন বেড়েছে কমেছে। বর্তমানে যে সকল দেশ লেভান্তের অন্তর্গত তা হল লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডানের একাংশ এবং অবশ্যই ভুঁইফোড় রাষ্ট্র ইজরাইল।
এই এলাকা হল ইতিহাসের খনি, কেনান নামটি এসেছে আদম (আ.)-এর অবিশ্বাসী সন্তান কাবিল ( হিব্রুতে কেন) থেকে এবং সাম নামটি এসেছে নূহ (নোয়া-আ.)-এর পুত্র সামের নাম থেকে। ইহুদি খ্রিস্টান ও ইসলামের যাবতীয় নবী (আ.)-এর এক বৃহৎ অংশের কর্মক্ষেত্র ছিল এই ভূমি। ইব্রাহিম (আ.-আব্রাহাম)-এর সমাধি ভূমি রয়েছে ফিলিস্তিনের হেব্রনে। ইব্রাহিম (আ.)-এর ভাইপো লুৎ (আ.-লট) ও মরুসাগরের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রায় ৩৬০০ বছর আগে ইউসুফ (আ.- জোসেফ) তাঁর আরও ১১ ভাই ও পিতা ইয়াকুব (আ.-জ্যাকব) কে নিয়ে এই এলাকা থেকে পাড়ি দিয়ে মিশরে বসত করেন। সেই সময় ইব্রাহিম (আ.)-এর অপর পুত্র ইসহাক (আ.- আইজাক)-এর বংশধর যাদের বলা হত এডোমাইট বা ইদুমীয় তারাই এই এলাকার মূল বসবাসকারী ছিল। এই এলাকাকে নবীপুত্রের নামানুসারে মাদায়েন বা মিডিয়াও বলা হত। প্রায় ৩২০০- ৩৩০০ বছর আগে হিব্রু জাতিকে মুসা (আ.-মোজেস) পুনরায় এই এলাকায় ফিরিয়ে আনেন। মুসা (আ.) বিবাহ করেছিলেন মিডীয়দের নবী সোয়েব (আ.-জেথ্রো)-এর কন্যাকে। মুসা(আ.) জেরুজালেম এলাকায় প্রবেশ করতে পারেননি। তবে দূর থেকে ভবিষ্যৎ ইহুদি জাতির মন্দির যায়ন পর্বত এলাকা দেখেছিলেন। এই সময় থেকেই হিব্রু জাতি ইহুদী নামে পরিচিত হয়। যদিও ধর্ম ও জাতিত্ব পৃথক ছিল না।
১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সুলেমান (আ.-সোলমন)-এর তত্ত্বাবধানে জেরুজালেমে প্রধান ইহুদি মন্দির নির্মিত হয়। এই ইহুদি উপাসনা গৃহকে বলা হয় প্রথম মন্দির যা ৬১৯ খ্রিস্টপূর্বে ব্যাবিলনরাজ বখত নসর (নেবুচাদনেজ্জার) ধুলিস্যাৎ করে দেয় এবং নবী সহ সমস্ত ইহুদিদের ব্যাবিলনে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক ৫০ বছর পর পারস্যরাজ মহান খসরু (সাইরাস) সব ধরনের সাহায্য করে নবী (আ.) দের তত্ত্বাবধানে পুনরায় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই উপাসনা গৃহটিকে বলা হত দ্বিতীয় ইয়াদি মন্দির। এটিও ৭১ খ্রিস্টাব্দে মূর্তিপূজক পাগান রোমকরা ধ্বংস করে দেয় এবং বিদ্রোহ প্রবণ ইহুদিদের জেরুজালেম সহ সিরিয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা দেয়।
পরে রোমকরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও ‘ইহুদিদের জেরুজালেম প্রবেশ নিষিদ্ধ’ হুকুম নামাটি বজায় রাখে। দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক (রা.) ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৬ শত বছর পর জেরুজালেমে রক্তপাতহীন প্রবেশকালে প্রতিটি ধর্মকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেন এবং ইহুদিরা পুনরায় জেরুজালেমে প্রবেশ করে। সংখ্যাগুরু খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মুসলিম শাসনকে দুই হাত আবাহন করে। বিগত চার হাজার বছর ধরে বারংবার রক্তের হোলি খেলার মধ্যে পালাবদলের মধ্যে এটি ছিল রক্তপাতহীন পালাবদল। ইসলামের বৈপ্লবিক দিক, দুর্বল, দলিত, দরিদ্র মানুষের হয়ে আপোষহীন লড়াই ও আশ্রয়দানের দিকটি উদ্ভাসিত করে।
এরপরের ইতিহাস নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ও উন্নয়নের ইতিহাস হতে পারত। উমর ফারুক (রা.)-র জেরুজালেম প্রবেশের প্রায় ৫০০ বছর পর পশ্চিম ইউরোপের ফ্রেন্চ, ব্রিটিশ, জার্মান ইত্যাদি লাতিনো খ্রিষ্টানরা ক্রুসেড যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই তৎকালীন অনুন্নত জাতিগুলির বর্বরতা ও রক্ত পিপাসার সামনে সমস্ত লেভান্ট এলাকার স্থানীয় ইহুদী, মুসলিম এমনকি বিরুদ্ধ মতের খ্রিস্টানরাও হেরে ভূত হয়ে যায়। যদি এদের দুশো বছরের উৎপাত শেষ হয় বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর তত্ত্বাবধানে ল্যাটিনো খ্রিস্টানদের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ হলেও প্রতিহিংসা ছিল না। এরপর মোঙ্গল উৎপাতের পর পুনরায় নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ও উন্নয়নের ইতিহাস। মুসলিম শাসনে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সহাবস্থান ছিল আদর্শ।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই তুরস্কের মুসলিম শাসন তার ইউরোপীয় এলাকা, যেমন-গ্রিস, বুলগেরিয়া ইত্যাদির উপর অধিকার হারাতে থাকে। পশ্চিম ইউরোপের উজ্জীবিত শক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং পূর্ব ইউরোপের রাশিয়া ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ (Sick man of Europe) আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করে দেয়। এইসময় আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার শাসক ছিল তুরস্ক। ইউরোপ রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এবং সমস্ত বিশ্বকে নিজ ভাবধারায় দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে, জাতীয়তা বাদের এক সর্বনেশে বীজ বপন করে। উনবিংশ শতকের শেষদিকে ইহুদি জাতীয়তার নামে যায়নবাদের সূত্রপাত ঘটে, যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন অস্ট্রীয় ইহুদি থিওডোর হারজল। যদিও ফ্রান্স কেন্দ্রিক রথচাইল্ড পরিবার যায়নবাদের প্রচার ও প্রসারের আর্থিক দায়-দায়ীত্ব নিয়েছিল। একদিকে উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদ যায়নবাদকে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকলো, অন্যদিকে আরব জাতীয়তাবাদকে উস্কানি দেওয়া হতে থাকল। আরব জাতীয়তাবাদের সর্বেসর্বা বেছে নেওয়া হল মক্কা- মদিনার তত্ত্বাবধায়ক তথা হেজাজের শাসক শরিফ হুসাইন বিন আলিকে। আরব জাতীয়তা বাদকে উস্কানি দেওয়ার অগ্রণী ভূমিকা নেয় ব্রিটেনবাসী লরেন্স অফ আরবিয়া। সেইসময় বিখ্যাত আরব আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে আরব ছদ্মবেশ নিয়ে প্রচুর ইউরোপীয় আরব মুসলিম এলাকায় ঘুরে ঘুরে আরব জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয়, অবশ্যই প্রবল মুসলিম শক্তি তুরস্কের বিরুদ্ধে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও তুরস্ক জোট পরাজিত হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক তার আরব সাম্রাজ্যও ত্যাগ করে। পরবর্তী দুই বছরে বাঁদরের পিঠা ভাগের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাকে ফরাসি এলাকা ও ব্রিটিশ এলাকা এই দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়। গাল ভরা নাম হল প্রটেক্টরেট। আগেই ১৯১৭ নাগাদ বেলফুর ঘোষণাপত্রে বলা হলো ফিলিস্তিন এলাকায় এক ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলা হবে। এর আগেই যায়নবাদের অঙ্গ হিসাবে ১৮৮২ থেকে ধাপে ধাপে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে থাকে। ১৯১৬ ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। বেলফোর ঘোষণার পর ১৯২৩ নাগাদ ইহুদি অধিবাসীর সংখ্যা বেড়ে হল ১২ শতাংশ এবং ১৯৩৯ নাগাদ বহিরাগত ইহুদি সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩৫%-এ।
আন্তর্জাতিক চক্রান্তের পূর্ণতা পেল ১৯৪৮-এর মে মাসে। স্বাধীন ইহুদি ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হল প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও পরোক্ষভাবে তথাকথিত নাস্তিক স্টালীন শাসিত সোভিয়েত রাশিয়ার মদতে।
সমস্ত লেভান্ট এলাকা ছিল ধর্মীয় সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ফ্রান্স ও ব্রিটেনে আসার আগে সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলিমদের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইসমাইলি শিয়া, দ্রুজ, খ্রিস্টান ও ইহুদীরা শান্তিতে বসবাস করত। বর্তমান উক্ত এলাকার লেবাননে মেরোনাইট খ্রিস্টান রাষ্ট্রপতি, সুন্নি প্রধানমন্ত্রী ও শিয়া স্পিকার নিয়ে শাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যদিও সুন্নীরা সংখ্যাগুরু। ফিলিস্তিনের সিংহভাগ সুন্নি মুসলিমের নিজস্ব কোনো রাষ্ট্র নেই, দখলরত অংশে আসকেনজি ইহুদিদের যুদ্ধবাজ, নিপীড়নকারী সরকার বিদ্যমান। জর্ডানে সুন্নি পুতুল রাজতন্ত্র চলছে। আর সিরিয়াতে চলছে নুসাইরি রাজ। নুসাইরিদের সংখ্যা সমগ্র জনতার ১৫% এর বেশি নয়। রয়েছে শিয়া, দ্রুজ, খ্রিস্টান এবং প্রায় ৮০% সুন্নি মুসলিম।
নুসাইরি কারা? এদের কলমা বলে যা যা প্রচলিত তা হল ‘আলি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, মোহাম্মদ (সোয়াল্লালাহুআলায়হেসালাম) ছাড়া পর্দা নেই, সালমান ফারসি (রা.) ছাড়া কোন দ্বার নেই’-ইবন কাসির। পাঠক এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এরা আর যাই হোক মুসলিম নয়। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেছেন, ‘নুসাইরি রক্ত সম্বন্ধ টাকা পয়সা, বিবাহ, প্রাণী হত্যা,হালাল সকল ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী’। সুন্নি হাম্বলি আলেম ইবন তাইমিয়া (র.-১২৬৩-১৩৮৯) বলেছেন, ‘নুসাইরিরা ইহুদি ও খ্রিস্টান অপেক্ষা আরও অধিক ইসলাম বিরোধী। এমনকি বহুত্ববাদী অপেক্ষাও। তুর্কি (চেঙ্গিস খাঁ) ও যুদ্ধবাজ ধর্মবিরোধী অপেক্ষাও মুসলিমদের বহু বেশি ক্ষতি করেছে’। সাধারণ মুসলিমদের সামনে শিয়াদের মত আচরণ করলেও এরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর কিতাবের উপর বিশ্বাস রাখে না। ইবন বতুতা প্রখ্যাত পর্যটক এদের ব্যবহারের চাক্ষুষ বর্ণনা দিযেছেন, (লাটাকিয়ার পার্বত্য চঞ্চলে) মসজিদ তৈরীর সরকারি হুকুম এরা পালন করেছে। প্রতিটি জামে মসজিদ তৈরি হয়েছে গৃহসমষ্টি থেকে দূরে। যেখানে গ্রামের লোকেরা না প্রবেশ করে না রক্ষণাবেক্ষণ করে, আর সেখানে প্রায়ই গরু গাধার পাল রেখে দেয়। যখন কোন বহিরাগত গিয়ে নামাজের জন্য আযান দেয় তখনই তারা বলতে শুরু করে গাধার মত ডাক বন্ধ কর, তোমার জন্য দানাপানি নিয়ে যাচ্ছি। বেঞ্জামিন ডিজরেইলি বলেছেন, এরা কি মুসলিম? এরা মুসলিম নয়, খ্রিস্টান নয়, দ্রুজ নয়, ইহুদি এবং অগ্নিপূজকও নয়। শিয়া মতে এরা হল ঘুলাত অর্থাৎ সীমালংঘনকারী। হযরত আলী (রা.) বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে। নুসাইরি ধর্ম মতটির প্রতিষ্ঠাতা ইবন নুসায়ের। তিনি শিয়া ১২ ইমামি মত থেকে বিচ্যুত হয়ে নুসাইরি ধর্মমত সৃষ্টি করেন।
সিরিয়ার ২ কোটি ৫০ লক্ষ জনতার মধ্যে মাত্র ৩৫ লক্ষ নুসাইরি। এদের অধিকাংশই (৭৫%) থাকে লাটাাকিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। ১৯২০ নাগাদ মাত্র ৫ শতাংশ নুসাইরি নগরবাসী ছিল। তাই সিরিয়াতে গ্রাম্য, অশিক্ষিত বলতে বোঝায় ‘নুসাইরি’। ২০১২-১৩ নাগাদ নগরবাসী নুসাইরির সংখ্যা বেড়ে হয় ১৩%। এটাই শুধু নয়, শাসক ও শাসনযন্ত্রের এবং ব্যবসা ও প্রশাসনের উচ্চপদে নুসাইরিরাই সর্বেসর্বা। মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র মুসলিম ও অন্যান্য জনতা ফিলিস্তিনী জনতার উচ্ছেদ ও ইহুদি ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার তীব্র অভিঘাত নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সমস্ত এলাকার বঞ্চনার ও ষড়যন্ত্রের ইতিহাসকে লক্ষ্যই করেনি। যখন নজরে পড়ল তখন ফিলিস্তিন, সিরিয়াতো বটেই পার্শ্ববর্তী লেবাননেও রক্তস্রোত বয়ে চলেছে এমনকি মিশর ও ইরাকও বাদ যায়নি। সমস্ত এলাকা জুড়ে সংখ্যাগুরু সুন্নী জনতা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার শাসন ও বঞ্চনা শান্তিপূর্ণ সমাধান নেই দেখে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।
১৯২০ নাগাদ ফরাসি শাসকদল এক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে নুসাইরীদের আলাওয়ি (আলি-রা.-র অনুসারী) আখ্যা দিয়ে মুল ইসলামের এক উপদল রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়। এরপর (১৯২০-১৯৪৬) ফরাসি ম্যান্ডেট চলাকালে প্রত্যক্ষ ফরাসি মদতে সেনাদলের ও বাথ পার্টির বড় বড় পদগুলি পেয়ে যায়। অভিজাত সুন্নি ভূ-স্বামীর কাছে সৈনিক বৃত্তি সম্মানজনক মনে হত না। বস্তুত সমস্ত আরবদেশে নিয়মিত সেনাদল কোন কালেই উৎসাহিত হয়নি। সেখানে যারা চাষ করে, কলে কাজ করে অর্থাৎ সাধারণ মানুষ সংকটকালে অস্ত্র তুলে নিয়েছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে। বাথ পার্টির নাস্তিক ভাবধারা সুন্নি মুসলিমদের আকৃষ্ট করেনি। ফল হল নুসাইরি প্রাধান্য।
১৯৪৬-৬৩ এই পর্বে ফরাসি বিদায় কালে সংখ্যাগুরু সুন্নিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও রাজনীতি ও সামরিক জ্ঞানে পরিপক্ক নুসাইরিরা বারবার বিদ্রোহ করে অতিষ্ঠ করতে থাকে। যতবার বিদ্রোহ সফল হয় ততবার শাসক হিসাবে সুন্নি কমতে থাকে এবং নুসাইরি সেনাপতিরা সৈন্যদলে নুসাইরির সংখ্যা বাড়াতে থাকে। ১৯৬৩ সালে নুসাইরি, দ্রুজ, খ্রিষ্টান, ইসমাইলি সমৃদ্ধ বাথপার্টি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করে। বাথ পার্টির খ্রিষ্টান প্রতিষ্ঠাতা মিসেল আফলাক নুসাইরি রোষে পড়ে দেশছাড়া হন। যদিও চক্ষুলজ্জার খাতিরে প্রধান ছিলেন সুন্নি। ১৯৬৬ সেনাবাহিনী ও বাথ দলে প্রবল নুসাইরি প্রাধান্যর সুযোগ নিয়ে বিমানবাহিনীর প্রধান হন হাফেজ আল আসাদ। অপর নুসাইরি সালাহ জাদীদ ক্ষমতা ভাগাভাগি করে প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। ১৯৭০-এ জাদিদকে সরিয়ে হাফেজ আল আসাদ নিজে প্রেসিডেন্ট হন। হাফেজ আল আসাদ বিমান বাহিনীর প্রধান থাকলেও ১৯৬৭-র যুদ্ধে বিমান বাহিনীকে কাজে লাগায়নি এবং সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গোলান হাইটস রক্ষা ও পুনর্দখল করতে সর্বাপেক্ষা কার্যকরী বিমানবাহিনীকে বসিয়ে রেখে ইসরাইলকে পরোক্ষে সাহায্য করে।
হাফেজ আল আসাদের সাবরা ও শাতিলা হত্যাকান্ড এবং ফিলিস্তিনিদের লেবানন থেকে অপসারণের বিষয়ে সন্দেহজনক ভূমিকা রয়েছে। ইখওয়ানের হোমসের বিদ্রোহ দমনে নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিমানবহর ব্যবহার ও তাদমুর জেলে বিরোধী রাজনৈতিক বন্দীদের হত্যাকাণ্ড হাফেজের অত্যাচারী স্বৈরতান্ত্রিক রূপের প্রকাশ।
২০০০ শাল নাগাদ হাফেজ মারা গেলে তার পুত্র বাশার আল-আসাদ স্বৈরাচারের ব্যাটনটি ধরে। বাশার আল আসাদ পিতার মতোই দেশের সংখ্যাগুরু সুন্নিদের উপর দমন-পীড়ন চালাতে সক্রিয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার খন্ডাংশও সক্রিয় নন। ইরান ও লেবাননের হেজবুল্লাহ হল শিয়া দলভুক্ত। ইরাকের নূরি আল মালিকিও তাই। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই এলাকায় ভাতৃঘাতী যুদ্ধ চলছে। মিশরের মুরসি সরকার পতনের কারণ হিসাবে কোন এক মহল শিয়া, কপ্ট খিষ্টান ও ধর্মনিরপেক্ষ বাহিনীর যোগসাজশ আছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও প্রবল বিশ্বাস কট্টর ইখওয়ান বিরোধী আমিরাতও বাদ যায় না।
প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর যায়নবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার ষড়যন্ত্রের একটি অঙ্গ হল সমস্ত এলাকার বর্তমান শাসক দলের উত্থান। নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য বাশার আল আসাদ শিয়া হওয়ার চেষ্টা করছেন যা ‘তাকিয়া’র একটি অঙ্গ। হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নুসাইরিদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাকিয়া বা গোপনীয়তা ছেড়ে বেশি বেশি করে সুন্নিদের মত আচরন করতে। ছেলে বাশার সুন্নি বিরোধিতার সামনে পড়ে শিয়া ভ্রাতৃত্ব জাগাতে বলছে ‘ওহে নুসাইরি তোমরা বেশি করে শিয়া হও’। ইরান ও হেজবু ইসরাইল ও মার্কিন বিরোধিতার নামে সমস্ত এলাকাতে আপা দৃষ্টিতে সুন্নি বিরোধিতায় শামিল। তবে ইউরোপ ও মার্কিনিরা কোনমতেই ইসরাইলের স্বার্থ হানিকর সুন্নি প্রাধান্য চাইবে না। হলে তো ১০০-১৫০ বছরের ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়।
ধার্মিক মুসলিম ও খ্রিস্টান (ইভানজেলিকাল) চাইছে এলাকার জটিল পরিস্থিতি সরল করতে এক অথবা দুইই মহামানবের আবির্ভাব হোক। কোরআন-হাদিস বর্ণিত ইমাম মেহেদী (র.) ও ইসা (আ.)-এর আবির্ভাব ছাড়া এলাকার জটিল সমস্যার জট খুলতে আর কেউ পারবেন বলে মনে হয় না। তাই, অপেক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন,
১) আফগানিস্থান কি সাম্রাজ্যবাদীদের বধ্যভূমির পরীক্ষাগার হয়ে উঠছে?
২) দামাস্কাস ইস্পাতের ও কোফতাগরির প্রায় বিলুপ্তি কাঁচামালের অভাবে