লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ইসলামের দৃষ্টিতে কুরআন হচ্ছে আল্লাহর আইন, হাদিস হচ্ছে তার ব্যাখ্যা। আর অন্য ধর্মের মন্দির ভাঙ্গতে ইসলাম আদেশ দেয়নি তার প্রমাণ ইসলামিক শাস্ত্রে আছে এবং ইসলামের ইতিহাসেও এর নজির ভুরি ভুরি বিদ্যমান। হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনে অমুসলিমদের অধিকার এর সম্বন্ধে অজস্র প্রমাণ রয়েছে। তাঁর ২৩ বছরের নবুয়তের ইতিহাসে তিনি ৮০ টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হাতে একজনও নিহত হয়নি। বরং এই ৮০টি যুদ্ধে মারা গেছেন সর্বমোট ৯১৮ জন। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে অজস্র প্রমাণ রয়েছে যে এক একটি যুদ্ধেই মারা গেছে কোটি কোটি মানুষ।
ইসলামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় ইসলামীয় শাসকগণ অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করেছেন এবং অমুসলিমদের সাথে যথেষ্ট ন্যায় ব্যবহার করেছেন। মুসলিম জাহানের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান গণী (রাঃ) আবু জুবাইদ নামক এক খ্রীষ্টান কবিকে প্রতি মাসে বৃতি প্রদান করতেন। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) অমুসলিম তথা খ্রীষ্টান রোগীদের সাহায্য দিতেন। খলিফা আমীর মুআবিয়া (রাঃ) অসংখ্য খ্রীষ্টান কর্মচারি নিয়োগ করেছিলেন কোনো কোনো খলিফা খ্রীষ্টানদের নতুন গির্জা নির্মাণের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন এবং সাহায্য করেছিলেন। যোগ্যতা অনুসারে মুসলিম – অমুসলিম নির্বিশেষে খলিফারা উচ্চপদে তাদের নিযুক্ত করতেন। যেমন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের চিকিৎসক ছিলেন থিওডোকাস নামের একজন খ্রীষ্টান, পারস্যের শাসনকর্তা আব্দুস দাউলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নাসের ইবনে হারুন। তিনিও ধর্মে খ্রীষ্টান ছিলেন। খলিফা মুতাসিমের প্রধান সেক্রেটারি ছিলেন খ্রীষ্টান সালামুইয়া। গভর্নর আবু মুসার কর্মসচিব ছিলেন আখতাল তাগলিবী নামের একজন খ্রীষ্টান। খলিফা আব্দুর রহমান বিচারপতি রূপে নিযুক্ত করেছিলেন ওয়ালেদ ইবনে নাজতালাহ নামের একজন খ্রীষ্টানকে। খ্রীষ্টানধর্মের ইসমাইল ইবনে নাজতালাহ জীরাদ রাজদরবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খ্রীষ্টান ধর্মের নাসির ইবনে হারুন। খলিফা মুতা কুয়াল্লিলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খ্রীষ্টান ধর্মের আল তামাসী। খলিফা মুয়াহিজের সেনাপতি ছিলেন জাওয়ার আল মিকেলী নামের একজন খ্রীষ্টান। নিজার আল আজিজের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইসা ইবনে নাসতুক নামের একজন খ্রীষ্টান।
মহানবী (সঃ) বলেছেন, “কোন অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করলো বা তার অধিকার ক্ষুন্ন করলো বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করালো বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিলো কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে আমি হব তার বিপক্ষে মামলা দায়েরকারী।” তিনি আরো বলেন, “যে কোন অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার বাদী হব। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো কিয়ামতের দিনে আমি হবো বিজয়ী।” তিনি অন্যত্র বলেন, “যে সংখ্যালঘুকে উত্যক্ত করলো সে আমাকে উত্যক্ত করলো, আর যে আমাকে উত্যক্ত করলো আল্লাহকেই সে উত্যক্ত করলো।” অমুসলিম নাগারিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসুলে মকবুল (সঃ) বলেছেন, “যে কোন সংখ্যালঘুকে হত্যা করবে সে বেহেশতের ঘ্রাণও উপভোগ করতে পারবেনা। অথচ বেহেশতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যাবে।”
বিশ্ব মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন, “তাঁদের রক্ত আমাদের রক্তের মত এবং তাঁদের ধন সম্পদ আমাদের ধন সম্পদের মত।” অমুসলিমদের জান-মাল মুসলমানদের নিজের জানমালের ন্যায় পবিত্র ও নিরাপত্তাযোগ্য। মুহাম্মদ (সাঃ) এর এ ঘোষণার পর যারা অ-মুসলিমদের ধন সম্পদ লুন্ঠন করে, অর্পিত কিংবা ন্যস্ত সম্পত্তি জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করে রাখে, তারা কি নিজেদেরকে মুসলমান পরিচয় দিতে পারে?
মুহাম্মদ (সাঃ) একদিন মসজিদে নববীতে কতিপয় সাথীদের নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুইন এসে মসজিদের ভিতরে এক কোনে প্রস্রাব করছিলো। মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথীরা ওকে প্রহার করতে উদ্যত হলে মুহাম্মদ (সাঃ) তাদেরকে নিবৃত্ত করলেন। প্রস্রাব করা শেষ হলে শান্তির দূত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে বুঝিয়ে বললেন যে, “ওটা মুসলমানদের ইবাদতখানা, প্রস্রাবের স্থান এটা নয়।” এ-বলে তিনি তাকে বিদায় দিয়ে সাথীদের নিয়ে মসজিদের প্রস্রাব ধুয়ে দিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং কোরানে বলেছেন, “তোমার ধর্মের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেনি, তোমার বসতি থেকে তোমাকে উচ্ছেদ করেনি, তাদের প্রতি তোমার দয়ালু হওয়া উচিৎ এবং তাদের সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় ভালোবাসেন।” (৬০ঃ৮)
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে যখন মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে হযরত আমর ইবনুল আ’ স (রাঃ) দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় একদিন আলেক জান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ – চৈ পড়ে গেলো। কেউ একজন যিশু খ্রীষ্টের প্রস্তরনির্মিত মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলছে। খ্রীষ্টানরা ধরে নিল যে এটা মুসলমানদের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। খ্রীষ্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে আসলেন আমর ইবনুল আ’স এর কাছে। আমর শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিলো অন্যরকম। তারা চাইলো মুহাম্মদ (সাঃ) এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপভাবে নাক ভেঙ্গে দিতে। খ্রীষ্টানদের এ মতামত ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে নবী (সাঃ) আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সে নবীর মূর্তি তৈরীকে মুসলমানরা কিভাবে মেনে নিতে পারে? হযরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রীষ্টান বিশপকে বললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।” খ্রীষ্টান নেতারা সকলে এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রীষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রাঃ) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসন এর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারী গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।” একথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষ্ণধার তরবারী হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রীষ্টানেরা স্থম্বিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বললো, “আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোন অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি, এই, তা আমার হাতেই আছে। তবে মূর্তি ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিলোনা। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।” সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারীর নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিলো। স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তরবারী ছুঁড়ে দিয়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সঃ), যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভিক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যিশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। সেই মহান ও আদর্শ নবীকেও আমার সালাম জানাই।” পরধর্ম সহিষ্ণুতার এ জলন্ত উদাহরণ আজো বিশ্ববাসীকে হতবাক করে।
হযরত আলী (রাঃ) যখন মুসলিম জাহানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সে সময়ে একবার তাঁর ঢাল চুরি হলো। চুরি করলো একজন ইহুদী। হযরত আলী (রাঃ) আদালতের শরণাপন্ন হলেন। কাজী (বিচারপতি) খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে সাক্ষী চাইলেন। সাক্ষী হিসেবে খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলে এবং চাকরকে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আপন সন্তান ও চাকরের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় কাজী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন। মুসলিম জাহানের অধিপতি হয়েও তিনি কোন বিশেষ বিবেচনা পেলেন না। ইসলামী আইনে শাসক-শাসিত, উঁচু-নীচু, শত্রু-মিত্র সকলেই সমান। ইহুদী বিচার দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো, অপূর্ব এই বিচার, ধন্য সেই বিধান যা খলিফাকে পর্যন্ত খাতির করেনা আর ধন্য সেই নবী যার প্রেরণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। হে খলিফাতুল মুসলিমীন, ঢালটি সত্যই আপনার। আমিই তো চুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয় তার সাথে আমার জান-মাল, আমার সবকিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম।”
ইসলামী সমাজে অমুসলিমদের জীবনযাত্রা, ধন-প্রাণের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা মুসলিম নাগরিকদের সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নায়ক মহানবী (সঃ) এর মহানুভব অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শের অনুসারীদের আরো কিছু ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলোঃ-
- (ক) হযরত আলী (রাঃ) খেলাফত কালে জনৈক মুসলিম কর্তৃক একজন ‘জিম্মা’ নিহত হয়। হযরত আলী আততায়ী মুসলমানের প্রাণদন্ডের আদেশ দেন। হযরত আলী (রাঃ) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “আমরা যাদের ‘জিম্মি’ বা দায়িত্ব নিয়েছি, তাদের রক্ত আমাদের রক্ত তুল্য। তাদের রক্ততুল্য আমাদের রক্তমূল্য।
- (খ) উমাইয়া বংশের প্রবল প্রতাপান্বিত খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের বিরুদ্ধে জনৈক খ্রীষ্টান নাগরিক হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করে। অভিযোগ সম্বন্ধে নিজের বক্তব্য পেশ করার জন্য নির্র্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য খলিফাকে নির্দেশ দেয়া হয়। একজন সাধারণ লোকের অভিযোগের উত্তরে সাধারণেরই মত আদালতে হাজির হতে, আরও পাঁচজনের মত আসামীর নির্দিষ্ট আসনে দাঁড়াতে ও জবাবদিহি করতে খলিফা সংকোচ করেন। তাই তিনি উকিল নিযুক্ত করতে চান। কিন্তু উমর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “তোমার নিজের হাজির হতে হবে, নিজেকেই বলতে হবে নিজের কথা।” অগত্যা তাঁকে আদালতে হাজির হতে হয়। বিচারে খলিফা হিশামের বিরুদ্ধে ডিক্রী প্রদান করা হয়।
- (গ) মুসলিম সেনাবাহিনী সিরিয়ায় জনৈক অমুসলিম চাষীর ফসল নষ্ট করেছে বলে সে খলিফা উমর (রাঃ) কে জানায়। ক্ষতিপূরণ স্বরূপ খলিফা তাকে দশ সহস্র মুদ্রা প্রদান করেন।
ইসলাম কোন ধর্মীয় উন্মাদনা বিদ্বেষ, কিংবা পরধর্ম অসহিষ্ণুতার নাম নয়। ইসলাম মানববতা মনুষ্যত্ব সাম্য ও শুভেচ্ছার নাম। ইসলামের আবেদন দেশ-কাল-বর্ণ- ভাষা কিংবা গোত্রের সীমানায় আবদ্ধ নয়। এর প্রীতি সর্বজনীন ও শাশ্বত। মানবতা যেখানে বিধ্বস্ত, ইসলাম সেখানে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিয়ে হাজির হয়েছে। কুরআনের ভাষায়, “মানুষ আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা জীব”। এজন্যেই বেলালের (রাঃ) মতো নির্যাতিত কালো মানুষেরাও দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমবেত হয়েছিলেন।
একটি মুসলিম দেশে ইসলাম মুসলিমকে শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতেই বলে না, রাষ্ট্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহয় একাধিক স্থানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার তুলে ধরা হয়েছে। অমুসলিমরা নিজ নিজ উপাসনালয়ে উপাসনা করবেন। নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখবেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা সমান। তাদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ইসলাম বরদাশত করে না। যেসব অমুসলিমের সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই, যারা শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের সঙ্গে বসবাস করেন তাদের প্রতি বৈষম্য দেখানো নয়; ইনসাফ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: ‘আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয় নি। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।‘ {সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত : ৮}
আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবিদার প্রতিটি মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। আল্লাহ ইরশাদ করেন: ‘তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যেসব দেবতাদের উপাসনা করে (অর্থাৎ পুজা করে), সেই উপাস্য দেবতাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে।’ {সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ১০৮}
কোনো বিধর্মী উপসনালয়ে সাধারণ অবস্থা তো দূরের কথা যুদ্ধাবস্থায়ও হামলা করা যাবে না। কোনো পুরোহিত বা পাদ্রীর প্রতি অস্ত্র তাক করা যাবে না। কোনো উপসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া যাবে না। হাবীব ইবন অলীদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন: ‘তোমরা আল্লাহ ও আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা কর। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’ [মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক : ৯৪৩০]
এদিকে মুওতার যুদ্ধে রওনার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন: ‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’ [মুসলিম : ১৭৩১]
আরেক হাদীসে আছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কোনো বাহিনী প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের হত্যা করা নিষেধ অধ্যায়]
আবূ বকর (রাঃ) একই পথে হাঁটেন। আপন খিলাফতকালে প্রথম যুদ্ধের বাহিনী প্রেরণ করতে গিয়ে তিনি এর সেনাপতি উসামা ইবন যায়েদ (রাঃ) এর উদ্দেশে বলেন: ‘হে লোক সকল, দাঁড়াও আমি তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দেব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। কোনো খেয়ানত করবে না, বাড়াবাড়ি করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, (শত্রুদের) অনুরূপ করবে না, ছোট বাচ্চাকে হত্যা করবে না, বয়োবৃদ্ধকেও না আর নারীকেও না। খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়েও দেবে না। কোনো ফলবতী গাছ কাটবে না। আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই করবে না। আর তোমরা এমন কিছু লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে যারা গির্জাগুলোয় নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তোমরাও তাদেরকে তাদের এবং তারা যা ছেড়ে নিজেদের জন্য তাতে ছেড়ে দেবে।‘ [মুখতাসারু তারীখি দিমাশক : ১/৫২; তারীখুত তাবারী]
কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমদের অধিকার ক্ষুন্ন করেন এবং তাঁদের প্রতি অন্যায় করেন, তবে রোজ কিয়ামতে খোদ নবী (সাঃ) তার বিপক্ষে লড়বেন বলে হাদীসে এসেছে। একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’ [আবূ দাঊদ : ৩০৫২]
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘যে মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে।’ [বুখারী : ৩১৬৬]
আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবী বাকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ‘যে ব্যক্তি চুক্তিতে থাকা কোনো অমুসলিমকে অসময়ে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ [আবূ দাঊদ : ২৭৬০; নাসাঈ : ৪৭৪৭]
ঐতিহাসিক বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ ও রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মাতাপিতার হক, সন্তান-সন্ততির হক, আত্মীয়-স্বজনদের হক, অনাথ ও দরিদ্রদের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসাফিরের হক, চলার পথের সঙ্গী বা পথচারীর হক, দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানীর হক এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের হক সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে মুসলিমদের কাছে অমুসলিমদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিমদের তিনি অমুসলিমদের নিরাপত্তা দানের নির্দেশ দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের ইজ্জত-আব্রু ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ অমুসলিম জনগোষ্ঠী তারাও মানুষ, তারাও আল্লাহর বান্দা। ইসলাম সম্পর্কে তারা ভুল বা বিভ্রান্তির শিকার হলে তাদের প্রতি আক্রমণ না করে তাদেরকে মূল সত্য এবং ইসলামের মহানুভবতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিকোণে দুনিয়ায় মানুষের প্রাণ হরণ কিংবা জীবন নাশের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। পবিত্র কুরআনে তাই একজন মানুষের হত্যাকে পুরো মানবজাতির হত্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৩২}
মানুষের প্রাণহানী ঘটানোকে যেখানে বলা হয়েছে পুরো মানব জাতিকে হত্যার সমতুল্য, সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে গণ্য করা হয়েছে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: ‘আর ফিতনা হত্যার চেয়ে কঠিনতর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯১}
ইসলামি সমাজে অমুসলিমদের অধিকার অর্থাৎ তাঁদের জীবনযাত্রা, ধন-প্রাণের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা মুসলিম নাগরিকদের সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নায়ক মহানবী (সাঃ) এর মহানুভব অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শের অনুসারীদের আরো কিছু ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:
ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বহু অমুসলিম ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ধর্মান্তরিত না হয়েও বহু অমুসলিম ইসলামের কুরআনকে, মহানবী (সাঃ) কে ভালোবাসেন। ইসলাম কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা বিদ্বেষ, কিংবা পরমৎ অসহিষ্ণুতার নাম নয়। ইসলাম মানববতা মনুষ্যত্ব সাম্য ও শুভেচ্ছার নাম। ইসলামের আবেদন দেশ-কাল-বর্ণ- ভাষা কিংবা গোত্রের সীমানায় আবদ্ধ নয়। এর প্রীতি সর্বজনীন ও শাশ্বত। মানবতা যেখানে, বিধ্বস্ত, ইসলাম সেখানে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিয়ে হাজির হয়েছে। কুরআনের ভাষায়, ‘মানুষ আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা জীব।’
সাহাবী হযরত জাবের রা. বর্ণনা করেন, একদিন আমাদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা তাঁকে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো এক ইহুদির লাশ!’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন কোনো লাশ নিতে দেখবে, তখন দাঁড়াবে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩১১
আরেক হাদীসে এসেছে, হযরত সাহল ইবনে হুনাইফ ও হযরত কায়েস ইবনে সাদ রা. একদিন বসা ছিলেন। তারা তখন কাদিসিয়ায় থাকেন। পাশ দিয়ে একটি লাশ নেয়া হচ্ছিল। তা দেখে তারা দুজনই দাঁড়ালেন। উপস্থিত লোকেরা তাদেরকে জানাল, ‘এ এক অমুসলিমের লাশ।’ তাঁরা তখন শোনালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশ দিয়েও একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি যখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, অর্থাৎ ‘সে মানুষ ছিল তো?’ -সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩১২
অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা এবং সাথে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করার জন্যে ইসলাম যে উদার নির্দেশনা দেয়, উপরোক্ত হাদীসটিই তার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
ইসলামে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিধানও দেয়া হয়েছে- এ কথা ঠিক, তবে এও অনস্বীকার্য যে, যুদ্ধের ময়দানের বাইরে তাদের নিরাপত্তাদান, তাদের সাথে সৌজন্য বজায় রেখে উত্তম আচরণের কথাও বলা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধের মাঠেও যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদেরকে, বিশেষত নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর যেন হামলা করা না হয়- এ আদেশও দেয়া হয়েছে।
যদি কারও কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হল- তার সাথেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের হক রক্ষা করে চলতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ দুটি সম্পর্ক রক্ষা করার ওপর যথেষ্ট জোর দেয়া হয়েছে।
সাহাবী হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর ওপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে?
উত্তরে তিনি বললেন, ‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে। [খারায়েতী, তবারানী, আবুশ শায়খ- ফাতহুল বারী [2], খ. ১০, পৃ. ৫১৯, কিতাবুল আদব, বাব-৩১]
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিষয়ে নির্দেশনা তো আরও স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬১৩৮)
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নি – তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কিছু নির্দেশনা এমনও রয়েছে, যেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আনকাবুতের ভাষ্য-
আমি মানুষকে বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর আচরণের আদেশ করেছি। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না। – (সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৮)
সূরা লুকমানে একই প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে,
তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচরণ কর। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন কর, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে। -লুকমান, আয়াত : ১৫
কুরআনে কারীমের উক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, যদি কোনো মুশরিক বাবা-মা তাদের মুসলিম কোনো সন্তানকে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক করতে বলে, তাহলে তাদের এ আদেশ কখনো মানা যাবে না। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। বাবা-মায়ের হক আদায় করতে হবে।
প্রতিবেশীর অধিকার সম্বলিত যেসকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেসবে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি- সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে এখানে প্রতিবেশীর মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি যে সে মুসলিম না অমুসলিম।
সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর ঘটনা। একদিন তার ঘরে একটি বকরি জবাই করা হল। খাবার রান্না হলে তিনি তার গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ খাবার দিয়েছ?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরাইল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিলেন, আমি মনে করছিলাম, তিনি হয়ত তাদেরকে ওয়ারিশই বানিয়ে দেবেন।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯৪৩)
ইসলামী রাষ্ট্রে যে সকল অমুসলিম রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে বসবাস করবে, তারা সেখানে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে নিরাপদ জীবন যাপন করবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তারা তাদের নির্ধারিত সকল অধিকার পাবে। সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রের শান্তিশৃংখলা বজায় রাখার জন্যে এ বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অমুসলিমদের অধিকার এর ব্যাপারে ইসলাম অত্যান্ত দায়িত্বশীলতা পালন করে।
হযরত উমর (রাঃ) এর একটি ঘটনা। তিনি তখন খলীফাতুল মুসলিমীন। একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তখন তিনি ইহুদিকে লক্ষ করে বললেন,
আমরা তোমার ওপর ইনসাফ করতে পারিনি যদি তোমার যৌবনে আমরা তোমার নিকট থেকে জিয্য়া গ্রহণ করে থাকি আর তোমার বার্ধক্যে তোমাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেই। এরপর তিনি তার জন্যে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। (কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজূয়াহ্, ১/১৪৩, হাদীস ১৭৯)
হযরত উমর রা. বৃদ্ধ ইহুদির জন্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন- এটা তো তিনি শাসক হিসেবে করতেই পারেন। কিন্তু তিনি সেই ইহুদিকে লক্ষ করে যে কথাটি বললেন, তা আমাদের সামনে চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। যে সহানুভূতি তিনি প্রকাশ করেছেন এটাই ইসলামের সৌন্দর্য ও আসল চরিত্র। অমুসলিমদের অধিকার এর ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত দায়িত্ববান ছিলেন।
অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা এবং তাঁদের সাথে সুন্দর ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রক্ষার শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ইসলাম তাকিদের সাথে বারবার এ নির্দেশও দিয়েছে- ‘কোনো মুসলমান যেন কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে।’ এবং এ তাকিদও করেছে, সৌজন্য ও উদারতার নামে যেন নিজেদের দ্বীনদারি আক্রান্ত না হয়। দ্বীনের বিষয়ে আপোস করা কোনোক্রমেই বৈধ নয়। এমনিভাবে সদাচরণের ক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে মুসলিম ভাই থেকে প্রাধান্য দেওয়াও বৈধ নয়।
অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা এবং তাঁদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সূরা মুমতাহিনার এই নির্দেশনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য-
যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তো তোমাদের তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জালিম। (আল কুরআন, সূরা মুমতাহিনা : ৮-৯)
ইমাম বুখারী রহঃ ও খলকে কুরআন (কুরআন সৃষ্টি) এর বিবাদ