বাংলার প্রাচীন অধিবাসীরা প্রধানত দ্রাবিড় জাতির একটি শাখা ছিলেন বলে অনেক নৃতাত্ত্বিক মনে করেন। সিন্ধুনদের অববাহিকায় মহেঞ্জোদাড়াে ও হরপ্পার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দ্রাবিড় সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যবিলনীয় ও অ্যাসিরীয় নগর-সভ্যতার পতাকাবাহী দ্রাবিড়রা বাংলায় মাটিতেও একটি উন্নত সভ্যতার পত্তন করেছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে দ্রাবিড়রা ছিলেন একত্ববাদী আদর্শের উত্তর-পুরুষ। বাংলার সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন, এমনকি আরবদেশে হযরত মােহাম্মদের (সা.) ইসলাম প্রচারের (৬১০) পূর্বেই আরব বণিকরা বঙ্গদেশে এসেছিলেন। এলফিনস্টোন ‘হিস্টরি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বাণিজ্যিক যােগাযােগের ভিত্তিতে প্রাচীনকালেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন উপকূলে বহু আরব উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। একইভাবে আরবদের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় বসতি। ঐতিহাসিক খালিক আহমদ নিজামীর ‘আরব অ্যাকাউন্টস অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরর এবং বাংলার চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলে আরব জনগণের বসতি সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা করা হয়েছে।
সাত শতকের শেষের দিকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরব বণিকরা ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। সৈয়দ সুলাইমান নদভী তার ‘আরব নৌবহর’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আরব নাবিকগণ মালাবার উপকুল হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। এখানকার চট্টগ্রাম এবং সিলেটে তাদের বাণিজ্য বহর নােঙর করত। দীর্ঘ পথে পালতােলা জাহাজের পক্ষে একটানা যাত্রা সম্ভব ছিল না।
খালিক আহমদ নিজামী বিভিন্ন প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করেন, যােগাযােগ লেনদেনের পটভূমিতেই হজরত মােহাম্মদ (সা.) ভারতীয় এলাকা থেকে সুগন্ধি উপহার পেয়েছেন। একজন ভারতীয় রাজা তাকে আচার পাঠিয়েছেন। ভারতীয় চিকিৎসকগণ আরবে বিখ্যাত ছিলেন। হযরত মােহাম্মদের (সা.) স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা.) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার জন্য তখন আরবে অবস্থানকারী একজন ভারতীয় চিকিৎসকের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। হযরত ইমাম হুসাইন-এর (রা.) পুত্র হযরত ইমাম যায়নুল আবেদিন একজন ভারতীয় মায়ের সন্তান ছিলেন। মালাবারের অন্তর্গত মালবের রাজা চেরুমাল পেরুমাল হযরত মােহাম্মদের (সা.) সময় (৫৭০-৬৩২) ইসলাম গ্রহণ করে আবদুর রহমান নাম ধারণ করেন। তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কতিপয় নৃপতিও ইসলাম গ্রহণ করেন। পেরুমালের রাজধানী কেদলুরের অধিবাসীদের অনেকেই ইসলামে দীক্ষা নেন। দাক্ষিণাত্যের মালাবার উপকূলে স্থাপিত হল কয়েকটি আরব উপনিবেশ। মালাবার উপকূলে অন্তত এগারটি স্থানে খুব প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এগুলাে এই সময় নির্মিত হয়েছিল। পেরুমাল হযরত মােহাম্মদের (সা.) ইসলাম প্রচারের কথা জানতে পেরে হযরত মােহাম্মদের (সা.) কাছে দূত পাঠান। সরন্দ্বীপের (সিংহল) রাজাও এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন।
অষ্টম শতাব্দী থেকেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব ও পারসিক বণিকেরা বসবাস আরম্ভ করে। বাণিজ্য করেই তারা দেশে ফিরে যেতেন না, এ দেশের মেয়েদের বিয়ে করে ঘর-সংসার স্থাপন করতেন। এ দেশের রাজারা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ভূমিদান করে, মসজিদ তৈরি করে দিয়ে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য উৎসাহ দিতেন। মুসলমান বণিকদের সাথে আসতেন মুসলমান পির, দরবেশ, সুফি-সাধকরা ইসলাম প্রচারের জন্য। জৈনদের ‘পুরাতন প্রবন্ধগ্রন্থ’-এ দেখা যায়, দেবী অনুপমা ৮৪টি মসজিদ মুসলমানদের উপাসনার জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন। এতে বােঝা যায় যে, তখন ভারতের পশ্চিম উপকূলে বিদেশি এবং দীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল। নবম শতাব্দীর মধ্যে মুসলমান বণিক ও সুফি-সাধকরা পশ্চিম উপকূলে ছড়িয়ে পড়েন। হিন্দু সমাজের উপর তারা তখন থেকেই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছেন। ফলে সিন্ধু, কাথিওয়ার, গুজরাট এবং কোঙ্কন অঞ্চলসমূহে ইসলামের প্রবেশ ঘটতে থাকে।
৯১৬ সালে প্রতিহার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে উত্তর ভারত অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লে তুর্কি আক্রমণকারীরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এসে হানা দেয়। ৯১৬-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে ইসলামের পতাকা উড়তে থাকে। ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকে ইসলাম প্রচারকগণ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন। পাঞ্জাব থেকে আসাম, কাশ্মীর থেকে বিন্ধ্যাচল পর্যন্ত ইসলামের বাণী বিঘােষিত হতে থাকে। বাংলায় ও স্থাপিত হয় ইসলামের ঘাঁটি।
চীনা পরিব্রাজক মাহুয়ানের বিবরণ হতে জানা যায়, বর্তমান চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বন্দর নগরীতে খুব উন্নতমানের সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি হত। দূরপথে যাতায়াতকারী প্রতিটি জাহাজ এই বন্দরে যাত্রাবিরতি করে তাদের জাহাজ এখান থেকে মেরামত করত। উল্লেখ্য যে, হযরত মােহাম্মদের (সা.) মামা ও প্রত্যক্ষ অনুগামী (সাহাবি) আবু ওয়াক্কাসের (রা.) কাফেলার পথে বাংলার এই বন্দরে যাত্রাবিরতি না করে সুদূর চীনের পথে পাড়ি জমানাে অসম্ভব ছিল। এ কারণে অনেক গবেষক মনে করেন যে, হযরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) এবং তাঁর সাথীগণ অবশ্যই বাংলার ওই বন্দরে যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং এখানে একটি সঙ্গত সময় পর্যন্ত অবস্থান করে কিছু লােককে ইসলামে দীথিত করে গিয়েছিলেন। কোনাে কোনাে বর্ণনায় হযরত মােহাম্মদের (সা.) আমলে ওয়াক্কাস মালিক, কায়েস ইবনে সাইয়াদি, তামিম আনসারি, উরাহ ইবনে আসারা, আবু কায়েস প্রমুখের চট্টগ্রামে আগমনের উল্লেখ দেখা যায়। তাই বলা যায়, হযরত মােহাম্মদের (সা.) জীবদ্দশায় এমনকি মক্কায় তার ইসলাম প্রচারের সময়ই বাংলায় ইসলামের আলাে এসে পৌঁছেছিল। হযরত মােহাম্মদের (সা.) প্রয়াণের পর পরই আসেম ইবনে তামিমি, আবদুল্লাহ ইবনে উতবান, সুহাইল ইবনে আদি, হাকিম ইবনে আবিল আফাকি প্রমুখের চট্টগ্রামে উপস্থিতির কথা জানা যায়। এভাবে হযরত মােহাম্মদের (সা.) সাহাবিগণের হাতেই বাংলায় ইসলামি আদর্শের প্রচারধারার সূচনা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন খান লিখেছেন ,
১. খােদ রাসুলে করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় এমনকি সম্ভবত হিজরতের আগে বাংলার উপকূল অঞ্চলে ইসলামের আলাে বিস্তার লাভ করেছে।
২. বাংলায় সাহাবীর আগমন হয়েছে এবং তারা এদেশে যথেষ্ট সংখ্যক অনুসারী বা তাবেরী রেখে গেছেন।
৩. অসম্ভব নয় যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দূরবর্তী এলাকা এমনকি চীনে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানগণও অংশগ্রহণ করেছেন, কেননা হযরত আবু ওয়াক্কাসের (রা.) সুদীর্ঘ সফরে প্রতিটি যাত্রাবিরতি স্থান থেকেই পরবর্তী মনযিল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য লােক-লস্কর ও রসদাদি সংগ্রহ করার প্রয়ােজন নিশ্চয়ই হয়েছিল।
(২)
সমুদ্রপথে আসা এই আরবীয়রাই ছিলেন ভারতে স্থায়ী বসতি স্থাপনকারী মুসলমানদের পূর্বপুরুষ। তারা ভারতে অধিকাংশ বন্দরে একচেটিয়া আধিপত্য গড়ে তুলেছিলেন। এদের বাণিজ্য বসতি ধীরেধীরে বাংলা ও মায়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়। ফলে স্থানীয় অধিবাসী ও আরব বণিকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সহাবস্থান গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মতাে কোনাে সামরিক শক্তি আরবদের ছিল না। এ সময় তারা শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যেই বিধাসী ছিল। এরপর সাত শতক থেকে দু’একটি বিচ্ছিন্ন আরব অভিযানের ঘটনা ঘটতে থাকে। উল্লেখ্য, সপ্তম শতাব্দীতে আরবে ইসলামের অভ্যুদয় ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটা ছিল এমন এক অভূতপূর্ব ঘটনা বা এমন এক মহা বিপ্লব যা ফরাসি বিপ্লব থেকে অধিক শক্তিশালী, অধিক কার্যকর। এ বিবের মর্মকথা ছিল সাম্য, মৈত্রী ও মানবতা। এ বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল একদল কুসংস্কারমুক্ত সৈনিক। ইসলামি বিবের এই পতাকাবাহীরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের বিজয় নিশান উড়তে লাগল পারস্য-খােরাসান-আফগানিস্তানে, তারা দ্রুতবেগে ধাবিত হল ভারতবর্ষের দিকেও। ৬৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে তারা কিরমান ও মেকরান (বেলুচিস্তান) দখল করল। বাণিজ্য উপলক্ষে প্রাক-ইসলাম যুগের আরবদের পরিচয় ছিল সিন্ধুর দেবল বন্দরের সঙ্গে। এখন বাণিজ্য ছাড়াও ইসলাম প্রচার ও ইসলামের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হল তাদের উদ্দেশ্য। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মােহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে আরবদের সিন্ধু ও মুলতান অধিকারের মধ্য দিয়ে ভারত ভূখণ্ডে সরাসরি মুসলিম সামরিক শক্তি প্রবেশের সূত্রপাত ঘটে। এ বিজয় যদিও শুধুমাত্র সিন্ধু ও মুলতানের মধ্যে আটকে পড়েছিল, তবু এটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সর্বপ্রথম ইসলাম ভারতভূমিতে পেল বিজয়, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিংহ এবং অন্যান্য বহু সামন্ত, দীক্ষা নিল অত্যাচারিত জাট ও মেগণ। ভারতের মাটিতে মুসলিম সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ স্থাপিত হল, উন্মুক্ত হল ইসলাম প্রচারের পথ।
মােহাম্মদ বিন কাসিমের রাজ্যশাসন পদ্ধতি উদার ও সহনশীল ছিল। ব্রাহ্মণদের দেওয়া হল নিজ নিজ ধর্মচর্চার পূর্ণ অধিকার, রাজস্ব আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। আরবরা সিন্ধু শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দেশীয় হিন্দুদের উপরই ন্যস্ত করেছিল। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে সামাজিক ও মানসিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় ছিল। এছাড়াও বৌদ্ধিক বিকাশের ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আরবদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আরবরা ভারতীয়দের দ্বারা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করার সময় তারা এ কারণে ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকার দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসার ও আহরণের জন্য তারা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বলতে গেলে প্রায় শিষ্যত্বই গ্রহণ করে ফেলে এবং ভারতীয় দর্শন, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, রসায়ন প্রভৃতি শাস্ত্রে তারা দক্ষতা অর্জন করে। এর ফলশ্রুতিতে ব্রাহ্মণরা পর্যন্ত অন্তত তাদের কেউ কেউ ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এতে করে হিন্দু সমাজ প্রতিরােধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। নিপীড়িত জনগণ ইসলামের পতাকাতলে এসে ভিড় জমাল। ইসলাম তাদের দিল সামাজিক সমানাধিকার। এ অবস্থা কেবল সিন্ধুর ক্ষেত্রে নয়। ইসলামের অন্য সব বিজয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামি বৌদ্ধধর্মের কণ্ঠরােধ করলে ও নিম্নবর্ণের উপর অত্যাচার চললে অগণিত বৌদ্ধ ও হিন্দু একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলামকে জানাল সাদর সম্ভাষণ। পরবর্তীকালে যাঁদের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম ও শাসনের বিকাশ ঘটে তারা আরব নন, তুর্কি এবং তুর্কো-আফগান।
মােহাম্মদ বিন কাসিমের পর ভারতবর্ষে মুসলিম সামরিক অভিযান পরিচালিত হয় সবুক্তিগীন এবং সুলতান মাহমুদের দ্বারা। মাহমুদের সতেরাে বার অভিযানের মাধ্যমে স্থায়ী মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলেও ভারতে ভবিষ্যতে মুসলিম প্রাধান্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়। পরবর্তীকালে মােহাম্মদ ঘােরি ২য় তরাইনের যুদ্ধে (১১৯২) পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারতে প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
ভারতে ইসলাম প্রচারের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সিন্ধুতে মােহাম্মদ বিন কাসিমের সামরিক সাফল্যের পথ ধরে। অভিযােগ করা হয় এ সময় যােদ্ধারা বল প্রয়ােগে ধর্মান্তকরণের প্রচেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু বাংলার অবস্থাটা ছিল ভিন্ন। রাজশক্তি বা সামরিক শক্তি নয়—এখানে আরব বণিক ও তাদের সঙ্গে আসা ধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমেই চট্টগ্রাম ও তার সন্নিহিত অঞ্চলসমূহে প্রথমে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকে। ফলে এসব অঞ্চলে মুসলমান বসতি তথা আরবীয় উপনিবেশ স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছিল। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর ও কুমিল্লার ময়নামতীর বৌদ্ধ প্রত্নসম্পদের খননকালে বাগদাদের আব্বাসীয় যুগের রৌপ্য ও স্বর্ণ মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ মিলেছে। বিশ্বনন্দিত আব্বাসীয় বাদশাহ হারুন অল রশিদের শাসনামলের (৭৮৬-৮০৯) আরবিতে মুদ্রিত রৌপ্য মুদ্রাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কে এন দীক্ষিত বলেন যে, এ মুদ্রাটি ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মােহাম্মদীয়া টাকশালে মুদ্রিত হয়। ধারণা করা হয় যে, কোনও আরব বণিক বাণিজ্য করতে এদেশে আসেন এবং এ অঞ্চলে অর্থাৎ নওগাঁ এলাকায় অবস্থান করেন। কিন্তু খ্যাতনামা গবেষক এনামূল হক বলেন, হিন্দু-বৌদ্ধ সভ্যতার কোনাে প্রাচীন পাদপীঠে আব্বাসীয় যুগে কোনাে মুসলিম সাধক বা ধর্ম প্রচারক আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মুসলিম সাধক ধর্মান্ধ কোনাে বৌদ্ধভির হাতে প্রাণ হারান। ফলে রৌপ্য মুদ্রাটি বৌদ্ধভিক্ষুর হস্তগত হয় এবং আরবি হরফ বােধমগ্য না হওয়ায় মুদ্রাটি তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। পরবর্তী পর্যায়ে সােমপুর বিহার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলে এই মহামূল্যবান রৌপ্য মুদ্রাটিও মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। তাছাড়া এই মুদ্রাটি কোনাে বণিক বাণিজ্য উপলক্ষে পাহাড়পুরে আনেননি, কারণ অষ্টম-নবম শতাব্দীতে পাহাড়পুর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়েই ওঠেনি। যাইহােক, সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলায় আনীত সমসাময়িক (৭৮৮) রৌপ্য মুদ্রা ঐতিহাসিকভাবে অষ্টম-নবম শতাব্দীতে উত্তরবঙ্গে ইসলামের সম্বন্ধ সূচনা করে। এই মুদ্রা-সাক্ষ্যকে কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য চুড়ান্ত বলে গ্রহণ করেন না।
পাহাড়পুরের মত কুমিল্লার ময়নামতি অঞ্চল খননেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দুটি আব্বাসীয় যুগের মুদ্রা উদ্ধার করে। আরবিতে মুদ্রিত দুটির একটি রৌপ্য,অন্যটি স্বর্ণ। রৌপ্য মুদ্রাটির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে স্বর্ণ মুদ্রাটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে এ ধরনের রৌপ্য ও স্বর্ণ বাংলায় প্রচলিত ছিল না এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক-মুসলিম যুগে আরব দেশসমূহের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। অষ্টম শতকে বাংলায় আরবীয় মুসলমানদের যে আগমন ঘটেছিল মুদ্রাপ্রমাণ তা নিশ্চিত করেছে। এ প্রসঙ্গে মিনহাজউদ্দিনের ‘তবকত-ই-নাসিরি’ হতে আমরা একটি ঘটনা তুলে ধরতে পারি। মিনহাজ বলেন, বখতিয়ার খলজি ১৮ জন সৈন্য নিয়ে যখন ছদ্মবেশে বাংলার রাজধানী নদিয়ায় প্রবেশ করেন তখন নগরীর অধিবাসীরা তাঁকে আরবীয় ঘােড়া ব্যবসায়ী মনে করেছিল তারা যে নগর দখল করতে এসেছে এমন সন্দেহ তাদের হয়নি। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, ইসলাম-পূর্ব যুগেও বাংলার স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আরব বণিকদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ক যদি না-ই থাকত তাহলে বখতিয়ারকে কখনােই স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যবসায়ী হিসেবে মনে করত না।
রংপুর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের (কুড়িগ্রাম জেলার) রামদাস মৌজার ‘মজদের আড়া’ গ্রামে ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ সম্পর্কে ‘দৈনিক বাংলায় প্রথম খবর প্রকাশিত হয়।১৯ এরপর ‘দৈনিক সংগ্রাম’ ও ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এ সম্পর্কে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘মজদের আড়া’ নামে পরিচিত জমিতে একটি বাঁশঝাড়ের উঁচু মাটির ঢিলা সমতল করতে গিয়ে এ মসজিদটি আবিষ্কৃত হয়। ১৭ হাত দীর্ঘ ও ১৫ হাত প্রস্থের একটি দালানের ছাদ মাটির নীচে দেখা যায়। এটি মসজিদের ছাদ বলে মনে হয়।।
‘মজদের আড়া’ স্থানটি থেকে দু’শ গজ দূরে প্রায় দশগজ উচু প্রাচীরবেষ্টিত প্রায় এক হাজার গজ দীর্ঘ ও এক হাজার গজ প্রস্থ একটি গড় ছিল বলে জানা যায়। এই গড়টিকে এখন আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়েছে। গ্রামের নাম ‘মজদের আড়া’ আসলে ‘মসজিদের আড়া’র অপভ্রংশ বলে মনে হয়। আড়া মানে ঘাঁটি, ডাঙ্গা বা কিনারা। এই মসজিদকে ঘাঁটি করে ইসলাম প্রচারের প্রথম যুগে হয়তাে এখানে একটি মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল। সে থেকে এ অঞ্চলটি মসজিদের আড়া’ নামে পরিচিত হয়েছিল। এই স্থান থেকে সিকি মাইল দূরে ফকিরের ‘তকেয়া’ নামে একটি জায়গা এবং মস্তবীরহাট নামে একটি হাট রয়েছে। ‘মজদের আড়া’ গ্রামের চারিদিকে তিন-চার মাইলের মধ্যে অনেক প্রাচীন মাযার রয়েছে। মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের স্বীকৃতি মিললে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, মােহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের চব্বিশ বছর আগে উমাইয়া শাসক প্রথম মারওয়ানের পুত্র আবদুল মালেকের শাসন আমলেই বাংলার এই নিভৃত এলাকায় মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল। এই ধরনের মুসলিম জনপদ এবং তাদের ধর্মীয় কার্যক্রমের কেন্দ্ররূপে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সে আমলে মসজিদ প্রতিষ্ঠার খবর বিস্ময়কর হলেও তার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কিছু ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসবিদের দেওয়া একটা ধারণায় অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরাও প্রভাবিত হন। সেই ধারণাটি হল যে, তুর্কি বিজয়ের পরই কেবল বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রসার সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রভাবেই ইসলাম ধর্ম বাংলার গ্রামীণ মানুষের মধ্যে স্থান করে নিতে সক্ষম হতে পেরেছিল। প্রকারান্তরে বলা হল যে, বাংলায় তুর্কি বিজয় না হলে বাংলার মাটিতে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশ সম্ভব হত না।
কিন্তু এ ধারণাটা যে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় তার একাধিক অকাট্য পাথুরে প্রমাণ কিন্তু অতি সহজলভ্য। বখতিয়ার খলজির নদিয়া বা বঙ্গ বিজয়ের (১২০৪) পর তুর্কিরা সপ্তগ্রাম অধিকার করেছিল ১২৯৮ সালে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্য যে, দক্ষিণবঙ্গ তুর্কি বা অন্য কোনও মুসলমান শাসনের বাইরে ছিল ১২৯৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ তুর্কিদের বঙ্গ জয়ের ৯৪ বছর পর পর্যন্ত। কিন্তু পরম বিস্ময়ের বিষয় হল যে, বীরভূম জেলার বােলপুর থানার সিওয়ান গ্রাম থেকে একটা প্রস্তর লিপি পাওয়া গেছে যাতে আরবি ভাষায় লেখা আছে যে একদল সুফির বাসের জন্য ১২২১-র ২৯ জুলাই সেখানে একটি খানকাহ স্থাপিত হয়েছিল। এই লিপিযুক্ত প্রস্তর খণ্ডটি সেই খানকাহ-র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময়ে সেই গৃহে লাগান হয়েছিল। এটা তর্কাতীত যে, দক্ষিণবঙ্গ মুসলমান শাসনে আসার বহু বছর আগে বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে একদল সুফি ধর্মপ্রচারক বাস করতেন। সেই সুফি দলটি কিন্তু ১২২১ সালেই সে গ্রামে আস্তানা গাড়েনি। দীর্ঘকালের প্রচেষ্টার পর তারা যখন এখানকার মানুষদের তাদের ধর্মমতে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তখন সেই নব-মুসলিম জনগণের আর্থিক আনুকূল্যেই এই খানকাহটির উদ্বোধন হয়েছিল। এই খানকাহটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুফি ধর্ম প্রচারকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পৌনঃপুনিক ব্যয়ও যে ওই নবমুসলিমদের কাছ থেকে আসবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তারা ওই খানকাহটির প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এটা তাই নিশ্চিত সত্য যে, আরও কয়েক বছর আগে এমনকি বখতিয়ারের পূর্ব থেকেই ওই সুফি ধর্মপ্রচারকের দলটি সিওয়ান গ্রামে বাস করছিল। আর সুফিদের প্রভাবেই ওখানকার জনগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।
বীরভূম জেলায় এই খানকাটির প্রতিষ্ঠা যে একটি ব্যতিক্রমী অনন্য ঘটনা নয় তারও কিন্তু পাথুরে প্রমাণ রয়ে গেছে। ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে সপ্তগ্রাম বিজয়ী জাফর খান সপ্তগ্রামের নিকটবর্তী ত্রিবেণীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটির উৎসর্গ-লিপিতে খােদিত আছে, “সিংহদের মধ্যে সিংহশ্রেষ্ঠ জাফর খান আবির্ভূত হয়ে যে দিকেই অভিযান করেছিলেন সে দিকের ভারতীয় নগরগুলি তিনি জয় করেছিলেন এবং (সে সব অঞ্চলের) দুর্দশাগ্রস্ত দাতব্য নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলির পুনরুজ্জীবন করেন। তিনি তার তরবারী ও বল্লমের দ্বারা বিধর্মীদের মধ্যে যারা অদম্য তাদের ধ্বংস করেছিলেন এবং তার ধনাগার থেকে অঢেল অর্থ দিয়ে সেই দুর্দশাগ্রস্তদের (সাহায্য) দেন।” এই প্রশস্তি থেকে এ সিদ্ধান্ত মনে হয় তর্কাতীত যে, সপ্তগ্রাম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ওই দুর্দশাগ্রস্ত (ইসলামীয়) দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলি যে সব এলাকায় অবস্থিত ছিল সেগুলি তুর্কি শাসনের বাইরে ছিল। সে কারণেই সপ্তগ্রাম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সেগুলি তুর্কি শাসকদের অর্থানুকূল্য বঞ্চিত ছিল। উপরিল্লিখিত খানকাটিও সম্ভবত সেরকম এলাকাতেই অবস্থিত ছিল।
এটা সম্ভবত বলার অপো রাখে না যে, সারা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই এরকম বেশ কয়েকটি ইসলামধর্মীদের দাতব্য প্রতিষ্ঠান অথবা দাতব্য নির্ভর প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। সেগুলি জাফর খাঁর সপ্তগ্রাম তথা দক্ষিণবঙ্গ বিজয়ের বহু পূর্ব থেকেই দণিবাংলার গ্রামাঞ্চলের সেই নব দীথিত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা এবং তাদেরই আনুকূল্যে সেগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেহেতু বাংলার এই ধর্মাবলম্বীরা গ্রাম বাংলার দারিদ্র পীড়িত মানুষ ছিল সে কারণেই গ্রাম্য অর্থনীতির তৎকালীন সংকটে তাদের দ্বারা পৃষ্ঠপােষিত ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলিরও অর্থনৈতিক হাল শােচনীয় হয়ে উঠেছিল। সপ্তগ্রাম বিজয়ী জাফর খাঁ সে কারণেই তাদের অর্থ সাহায্য করতেন।
এই তথ্যই প্রমাণ করে যে বাংলার মানুষরা এমন কাপুরুষ ছিল না—যাঁরা ব্যবহার নয়, কেবল অস্ত্রের আস্ফালনেই তারা ভীত হয়ে দলে দলে ‘নীচ ধর্ম ত্যাগ করে বিজয়ী বাহিনীর ধর্মকে গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিল। এমন অভিমত যারা পােষণ করেন তারা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাংলার মানুষদের চরিত্রে কালিমা লেপন করেন। পাশাপাশি অবাকের কথা হল এই যে, এদের মধ্যে বেশ বড়াে একদল আছেন যারা তাদের অতল প্রাজ্ঞে রায় দেন যে, তুর্কি আক্রমণের ফলে গৌড়ের মানুষরা দলে দলে এলাকা পরিত্যাগ করে।
(৩)
প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলার মুসলমানদের আগমনের নির্ভরযােগ্য তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন আরব ভৌগােলিক ও ঐতিহাসিকদের রচনায়। তুর্কি বিজয়ের পূর্ব থেকেই আরবদের যে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় নয় শতকের মাঝপর্বের আরব ঐতিহাসিক সােলায়মান, দশম শতকের ঐতিহাসিক আল মাসুদী এবং এগার শতকের শেষ পর্বের ভৌগােলিক আল ইদরিসী প্রমুখের লেখনীতে। আরব বণিকগণ যে সমুদ্রপথে এদেশে আগমন করেন তাদের রচনায় তার উল্লেখ আছে। এ সমস্ত নির্ভীক সমুদ্রগামী আরব বণিকগণ বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপাঞ্চলে গমনের সময় বাংলার পূর্বাঞ্চল হয়ে যেতেন। ফলে বাংলার দণি উপকূল আরব বণিকদের ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়। তারা তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করত এবং বাংলার পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় করে নিয়ে যেত ব্যবসা-বাণিজ্য উপলথে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
যে সমস্ত আরব ভৌগােলিক প্রাক-মুসলিম যুগের আরব বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ করেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য সােলায়মান। ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে রচিত তার ‘সিলসিলাত-উত-তাওয়ারীখে’ এ ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উল্লেখ আছে। ভৌগােলিক ইবনে খুরদাদবিহ দশম শতাব্দীতে রচিত তাঁর ‘কিতাব উল মামালিক ওয়াল মাসালিক’এ আরব সাগরের উপকূল থেকে চীন উপকূল পর্যন্ত বাণিজ্যপথের প্রথম আলােচনা করেছেন। একথা বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, বাংলার সমুদ্রতট (মেঘনার মােহনা থেকে কক্সবাজার) দিয়ে এই সমুদ্র বাণিজ্য সম্প্রসারিত হত। এছাড়া আল মাসুদী ও আল ইদরিসী, খুরদাদবিহকে অনুসরণ করেই একই সমুদ্র বাণিজ্যপথের উল্লেখ করেন। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সময়ে আরব বণিকদের যে অসামান্য প্রাধান্য ছিল তা তাদের লেখনীতে ধরা পড়েছে।
আরব ভৌগােলিকদের বর্ণনা যে সম্পূর্ণ চাক্ষুসভিত্তিক তা বলা যাবে না, তবে তারা বাংলার যে সমস্ত বাণিজ্য কেন্দ্র ও নগরের উল্লেখ করেন তাতে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, তাদের বর্ণনা ছিল নির্ভরযােগ্য। তাদের বর্ণনায় দুটি তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথমত, যে সমস্ত দেশের সঙ্গে আরবীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত তাদের মধ্যে বাংলাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের বিবরণে বাংলার উপকুলের একটি সামুদ্রিক বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সােলায়মানের বর্ণনায় পাওয়া যায়, এদেশের লােকেরা মিহি পােষাক (মসলিন) তৈরি করতে পারত, ‘সােম’ নামে এক প্রকার মদ পান করত এবং কড়িই ছিল একমাত্র প্রচলিত মুদ্রা। সােলায়মানের বর্ণনার কিছু অংশ আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি রাহমী নামক একটি রাজ্যের সীমান্তে এ তিনটি রাজ্য (জুৰ্জু, বলহার ও তফক) অবস্থিত। রাহমীর সঙ্গে জুর্জ যুদ্ধে লিপ্ত। রাজা খুব সমাদৃত। নন। জুর্জের সঙ্গে তিনি যেমন যুদ্ধে লিপ্ত তেমনি বলহারের সঙ্গেও তিনি যুদ্ধে লিপ্ত। তার সৈন্য সংখ্যা বলহার, জুর্জ, তফকের রাজার মিলিত সৈন্য সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। কথিত আছে যে তিনি যখন যুদ্ধ যাত্রা করেন, প্রায় ৫০,০০০ হাতি তার অনুবর্তী হয়। হাতি তৃষ্ণা সহ্য করতে পারে না এবং কেবল শীতকালেই বাইরে যেতে পারে বলে তিনি শুধু শীতকালেই যুদ্ধযাত্রা করেন। কথিত আছে যে তার সৈন্যদলে দশ/পনেরাে হাজার লােক শুধু কাপড় তৈরি করার এবং কাপড় ধােলাইয়ের কাজে নিযুক্ত থাকে। তার দেশে এমন বস্ত্র তৈরি হয় যেটা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এটা এত সূক্ষ্ম ও মিহি যে, এ বস্ত্রে প্রস্তুত একটি পােশাক একটি মােহরাঙ্কিত আংটির ভেতর দিয়ে যেতে পারে। এটা সুতার তৈরি এবং আমরা এর একখণ্ড দেখেছি। কড়ি হচ্ছে দেশের প্রচলিত মুদ্রা এবং এর মাধ্যমেই ব্যবসা চলে। তাদের দেশে সােনা ও রূপা এবং চন্দন কাঠ আছে এবং সমারা (সােম) নামে একটি জিনিস আছে যা দিয়ে মাদক (উত্তেজক পানীয়) তৈরি হয়। ডােরাকাটা ভূষণ বা কারকদম এদেশে পাওয়া যায়। এ জন্তুটির কপালের মাঝখানে একটি মাত্র শিং আছে এবং এ শিংয়ে মানুষের প্রতিকৃতির মতাে একটি আকৃতি আছে।” সােলায়মান প্রদত্ত ‘রাহমী’ যে বাংলা সম্পর্কে প্রযােজ্য তাতে সন্দেহ রয়েছে। বলে মনে হয় না। হাতি, মিহি সুতিবস্ত্র, চন্দন কাঠ, গণ্ডার, ব্যবসার বিনিময় মাধ্যম কড়ি—এ সবই বাংলাকেই স্পষ্টায়িত করে। মিনহাজ উদ্দিন সিরাজী ও ইবন বতুতার মতাে পরবর্তীকালের লেখকগণ এবং বহু ইউরােপীয় পর্যটক বাংলা সম্পর্কে প্রায় একইরকম তথ্য পরিবেশন করে গেছেন।
ইবনে খুরদাদবিহও ‘রাহমী’-র এ সমস্ত পণ্য দ্রব্যাদির কথা বলেছেন। তিনি ‘রাহমী’ সম্পর্কে বলেন, রাহমী রাজ্য সমুদ্র তীরে অবস্থিত ছিল এবং রাহমী ও অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে তখন জাহাজ যােগে যাতায়াত চলত। রাহমী’র পরবর্তী রাজ্যকে ‘কামরুন’ (কামরূপ) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আল মাসুদী ‘রাহমা’ নামক যে স্থানের উল্লেখ করেন, তা যে বাংলার কোনাে অঞ্চল সম্বন্ধে প্রযােজ্য সে নিয়ে সন্দেহ নেই। আল মাসুদী লিখেছেন “রাহমা রাজ্য সমুদ্র ও অন্তর্বর্তী ভূভাগ উভয় দিকেই বিস্তৃত ছিল। অন্তবর্তী ভূভাগের দিকে কামন রাজ্য এই রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত। ‘কামন’ হচ্ছে কামরূপের ভিন্নরূপ। সুতরাং ‘রাহমা’কে বাংলা নামে সনাক্ত করা যেতে পারে।।
আধুনিক ঐতিহাসিক ‘রাহমী’ বা ‘রাহমা’ রাজ্যটি নতুন করে সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক এইচ হােদিওয়ালাই প্রথম প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, দরহমী শব্দ ভুল ক্রমে ‘রাহমী’ বা ‘রাহমা’ লেখা হয়। তিনি এভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “আমার মনে হয় যে মাসুদী যে ‘রাহমা’কে রাজার উপাধি বা নাম এবং তার রাজ্যের নাম বলে বলেছেন সেটাকে এ তথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে যে সােলায়মান ও মাসুদী তাদের জ্ঞানের জন্য যে মূল গ্রন্থের কাছে ঋণী সে গ্রন্থে এ রাজ্যকে মালিক-উদ-দরহমি বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এ শব্দগুলাে দ্ব্যর্থবােধক এবং এটা ধর্মের রাজ্যকে’ এবং রাজা ধর্মকেও বুঝাতে পারে। পরবর্তীকালে দলকে মনে করা হয়েছিল ‘রে’ এবং ‘রে’কে ‘ওয়া। ফলে এ শব্দগুচ্ছকে ‘রাহমী রাজ্য হিসেবে ভুল পড়া হয়েছিল।” হােদিওয়ালা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ‘রাহুমী’ রাজ্য পাল রাজা ধর্মপালের রাজ্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। বর্তমান পণ্ডিতগণ মােটামুটিভাবে একমত যে, ধর্মপাল ৭৭০-৮১০ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। এ সূত্রে ধর্মপালকে সােলায়মানের গ্রন্থের সমসাময়িক ধরা যায় এবং ‘রাহমী’ বা ‘রাহমা’ রাজ্য ধর্মপালের রাজ্যরূপে নির্দেশ করা যায়। ‘রাহমা’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে ‘রামু’ শব্দ থেকে, রামু বর্তমানে কক্সবাজারের একটি স্থান। এটি উপকূলীয় অঞ্চল ছিল বলে সরাসরি আরব বাণিজ্য জাহাজ এখানে আসত। এভাবে আরব বণিকরা বাংলার সাথে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেত।
প্রাচীনকাল থেকেই প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র বা বন্দর হিসেবে খ্যাত বাংলার চট্টগ্রামের সঙ্গে আরব সমুদ্র পথযাত্রী বণিকদের পরিচয় ছিল। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চাল ও গম প্রধান ছিল। আল ইদরিসীর বিবরণ হতে জানা যায়, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম বন্দর ‘সামনদার’ নামে পরিচিতি ছিল। আল ইদরিসী লিখেছেন “সামনদার একটি বড় শহর, বাণিজ্যকেন্দ্র এবং সমৃদ্ধিশালী স্থান যেখানে ব্যবসা করে অনেক লাভবান হওয়া যায়। এ বন্দর কনৌজের অধীন। কাশ্মীর দেশ থেকে আসা এক নদীর তীরে এটা অবস্থিত।” আহমদ হাসান দানী সনাক্তকরণের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে বলেন যে, আরব ভৌগােলিকদের সামনদার ছিল বাংলার উপকুলীয় কোনাে স্থানে, খুব সম্ভবত চট্টগ্রাম, যা কিনা মেঘনা মােহনায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম শব্দটি “চট্টলা ও চাটিগাঁ’ থেকে উৎপত্তি। চাট্টি অর্থ প্রদীপ, যা পির-দরবেশের মাজারে জ্বালানাে হত অর্থাৎ চট্টগ্রাম বারাে আউলিয়ার দেশ, যার মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী সাধক ছিলেন পির বদরে আলম। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, প্রাক-মুসলিম যুগেই চট্টগ্রামসহ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু মুসলিম সুফি-সাধক, পির, আউলিয়া ও ধর্ম প্রচারক আগমন করেন।
চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি থেকে অনুমান হয় যে, এ স্থানের সঙ্গে আরবদের দীর্ঘদিনের সম্বন্ধ ছিল। ইবনে বতুতা, চীনা লেখকগণ ও আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে বােঝা যায় যে, চট্টগ্রাম গঙ্গার মােহনার সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলে এর (চট্টগ্রাম) অবস্থানের দক্ষিন আরব বণিকরা চট্টগ্রামের নাম দিয়েছিল শাত-আল-গঙ্গা (বদ্বীপ বা চরম সীমা), যা কালক্রমে চাটগাঁও ও চট্টগ্রাম নামে রূপান্তরিত হয়। তখন চট্টগ্রাম ছিল একটি সমুদ্র উপকুলীয় নগরী। কোনাে কোনাে পণ্ডিতের অভিমত, চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি আরবি শব্দ শৎ’ (বদ্বীপ) এবং ‘গং’ (গঙ্গা) শব্দদ্বয় দ্বারা যা একত্রে শাতুলগং’= চিটাগং = গঙ্গার বদ্বীপ অর্থ প্রদান করে। উল্লেখ্য, এই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় প্রবেশ করেন এবং সিলেটে সুফি-সাধক শাহ জালালের (রহ.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানকার প্রাচীন অধিবাসীদের আঞ্চলিক ভাষায় আরবি ভাষার প্রভাব রয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ, ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ শব্দের ব্যবহার, চট্টগ্রামের কতিপয় স্থানের আরবি নাম যেমন-“আলকরণ-সুলক-বহর (সুলুক-উল বহল), বাকলিয়া’ এবং চট্টগ্রাম সমাজ-জীবনের উপর আরব সংস্কৃতির প্রভাব (যেমন- অনেক আরবীয় প্রথা, এমনকি বহু আরবি খেলাধূলা আজও পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রচলিত রয়েছে) ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, কোনাে কোনাে আরব বণিক তুর্কি বিজয়ের বহু পূর্ব থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাণিজ্য-হেতু স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন।
বাংলার এমনি আরও বহু জনপদ আজও আরব বণিকদের দেওয়া নাম ধারণ করছে। সােলায়মান এবং ইদরিসী বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ, কার্পাসখ্যাত কাপাসিয়ার টোক বন্দরকে ‘তওক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তওক বা গলার হারের মতাে বেঁকে ব্রহ্মপুত্রের কণ্ঠলগ্ন হয়েছিল বলে আরবরা তাদের প্রতিষ্ঠিত এই পােতাশ্রয়টিকে ‘তওক’ নামে অভিহিত করেছেন। আরবরা জাহাজে করে সাগর-মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে এসে দূর থেকে উত্তরবঙ্গের লালমাটির ভূখণ্ড দেখে চিৎকার করে উঠতেন ‘বাররি হিন্দ’ বলে। বার’ মানে মাটি। সেই থেকে উত্তরবঙ্গ ‘বররিন্দ’ বা ‘বরিন্দ’ নামে পরিচিত হয়েছে বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। মিনহাজউদ্দিন সিরাজী এ এলাকাটিকে ‘বররিন্দ’ নামেই উল্লেখ করেছেন। বাংলার অন্যতম প্রাচীন নদী বন্দর ভৈরবের নাম আরবদের দেওয়া ‘বহর-ই-আরব’ থেকে হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণীতে ‘সালাহাত’ ও ‘কামরুত’ নাম দুটি পাওয়া যায়। সালাহাত’ সিলেটের আরব প্রদত্ত নাম, যার অর্থ সদানুষ্ঠান। মিনহাজউদ্দিন সিরাজী কামরূপের নাম কামরুত লিখেছেন। ‘বাঙ্গালী যুগে যুগে’ নামক বইতে নাজির আহমেদ উল্লেখ করেন। যে, কামরুত নামটি ‘কওম-ই-হারুত’ থেকে এসেছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, যেসব নামের শুরুতে ‘কম’ বা ‘কুম’ আছে, সেগুলি আর্যভাষা থেকে উদ্ভূত নয়।।
অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে বাংলায় পালরাজা ধর্মপালের (৭৭০-৮১০) রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে ভােজ, মৎস, মদ্র, যবন (মুসলমান) প্রভৃতি দেশের রাজন্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এই যবন রাজ্যটি সম্ভবত সিন্ধুনদের তীরবর্তী কোনও মুসলমান রাজ্য ছিল। সুতরাং বলা যায় যে, বাংলার সাথে সিন্ধুর আরব রাজ্যের সুসম্পর্ক ছিল এবং সে সুবাদে আরব বণিকেরা অষ্টম ও নবম শতাব্দী থেকে জলপথে বাংলায় আসতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্যের কারণে কোনাে কোনাে আরব বণিক স্থানীয় রমণীদের বিবাহ করে সেখানেই তাদের বসতি গড়ে তােলেন। ফলে ওই সব অঞ্চলে মুসলমান সমাজ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। অষ্টম শতকে মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার যে ধারা শুরু হয়েছিল তা বিকশিত হয় সুফি-সাধকদের আগমনের পর থেকে।
(৪)
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। তুর্কি ও আরবি ঘােড়সওয়ার উত্তর-পশ্চিম বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বেই এদের পূর্বপু(যগণ ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। ধর্মপ্রচারক অর্থাৎ সুফি-দরবেশদের আগমন ঘটেছে স্থল ও নৌ উভয় পথেই। তবে সমুদ্রপথেই এঁদের অধিকাংশের আগমন ঘটেছিল। সুফিদের ভারত ও বাংলায় আসার অবশ্য সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি বাগদাদে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে আরব সংস্কৃতি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পারসীয় সংস্কৃতির ধারক ইরানী প্রাধান্য তখন খিলাফতকে গ্রাস করে। কিন্তু স্বাধীনতা ও অভিযানপ্রিয় আরবগণ ইরানী প্রাধান্য মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা নতুন দিগন্তের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।
বাংলায় সাধারণত এগার শতক থেকে সুফিদের আগমন সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, বণিকদের আগমনের পথ ধরে আরও অনেক পূর্ব থেকেই এ দেশে সুফিদের আগমন ঘটেছিল। ইসলামের ২য় খলিফা হযরত উমরের (রা.) খিলাফতকালে (৬৩৫-৪৫) একদল ইমাম প্রচারক বাংলায় আসেন। এই দলের নেতা ছিলেন হযরত মামুন ও হযরত মুহাইমিন। এই প্রচারকগণ ‘মুমিন’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১২ থেকে ২৪ হিজরির মধ্যে তাদের আগমন ঘটে।
ফরিদপুর শহরের গট্টিগ্রামের এক পীর পরিবারের পূর্বপুরুষদের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে, এঁরা হালাকু খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাগদাদ পরিত্যাগ করে সুদূর চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামের ‘বাজেবস্তান’ নামক অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন। তের শতকে মুসলিম বিজয়াভিযান প্রথমে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে হয়েছিল। তবুও এর অনেক আগে থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষ মুসলমানদের সংস্পর্শে আসে। এক্ষেত্রে সুফিদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। অবশ্য এর পিছনে তৎকালীন বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট অনুকূল ছিল।
মধ্যযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ মুসলিম রাজশক্তির প্রবেশের আগে সুফি-সাধকদের আগমন সীমিতভাবে হলেও বাংলা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের সম্প্রসারিত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন তরিকার সুফিগণ যাঁর যাঁর নিজস্ব সাধনরীতি নিয়েই বাংলায় প্রবেশ করেছিলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। শতাধিক সুফি তরিকার কথা জানা গেলেও বাংলায় যেসব তরিকার সুফিগণ আগমন করেন এবং ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এঁদের মধ্যে মূলধারার সুফিগণের মধ্যে সুহরাওয়ার্দিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ও কাদেরিয়া অন্যতম। এদের আবার অনেক শাখা-উপশাখা রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে।
উত্তর ভারতে সুফিদের আগমনের ধারাবাহিকতাতেই এক সময় উপরে উল্লিখিত ধারার সুফি-সাধকগণ বাংলায় আসতে থাকেন। পাল শাসনের (৭৫০-১১৬২) বিস্তীর্ণ অধ্যায়ে অল্প ক’জন ইসলাম প্রচারকের ত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনি এ যাবৎ ঐতিহাসিকগণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। বায়েজিদ বােস্তামী (চট্টগ্রাম, মৃত্যু ৮৭৪), শাহ নিয়ামতউল্লাহ (ঢাকা) ও শাহ মখদুম রূপােস (রাজশাহী, ১১৮৪) এ অধ্যায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম। ১৬৭১ সালে ফারসি ভাষায় লিখিত এক দলিল হতে জানা যায় যে, শাহ সুলতান রুমী বলখ হতে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহে আসেন। বর্তমান নেত্রকোনার মদনপুরে তার সমাধি রয়েছে। সমসাময়িক কোনাে এক রাজা শাহ সুলতান রুমীর আধ্যাত্মিক শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদনপুর গ্রামটি তাকে দান করেন।৩৯ সেন যুগে ১১৫৮-৭৯ কালপর্বে বিক্রমপুরে এসেছিলেন বাবা আদম শহীদ। বল্লাল সেনের হাতে ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি শহীদ হন। উত্তরবঙ্গে ১০৪৭-৪৯ সালে শাহ সুলতান মাহিসওয়ারের আগমন ঘটেছিল। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে তার সমাধি রয়েছে।
ফরিদউদ্দিন আত্তার লিখেছেন, অষ্টম কি নবম শতাব্দীতে একদল ইসলাম প্রচারক সমুদ্রপথে আরবদেশ থেকে এসে চট্টগ্রামের সাগরতীরে নামেন এবং কিছুকাল তথায় অবস্থান করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে নিমগ্ন হন। চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের পাশে পাহাড়ের আশেপাশে এরূপ কতিপয় নাম না জানা সেকালের ইসলাম প্রচারকের মাজার আছে। যদিও কবরের চিহ্ন আজ বিদ্যমান নেই, তবুও ঐতিহাসিক সত্য যে, হজরত শেখ আব্বাস বিন হামজা নিশাপুরী ঢাকাতেই ইসলাম প্রচার করতে করতে ৯০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। সােজা কথায়, মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার তিনশত বছর পূর্বেই ঢাকায় ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। দশম শতাব্দীতে ঢাকায় আরও যারা ইসলাম প্রচার করেন, তাদের মধ্যে শেখ আহমদ বিন মুহাম্মদ (খ্রিঃ ৯৫২), শেখ ইসমাইল বিন নাযাদ নিশাপুরী (খ্রিঃ ৭৯৫) প্রমুখ রয়েছেন। এ সমস্ত সুফি-সাধকের পুণ্য জীবন লােকগাঁথা হিসেবে প্রচলিত হয়ে রয়েছে। তাদের অলৌকিক কাহিনি স্থানীয় অমুসলমান সম্প্রদায়কে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করে, যা পক্ষান্তরে ইসলাম প্রচারে সহায়তা করে।
মিনহাজউদ্দিন সিরাজীর বিবরণ হতে জানা যায়, মধ্য এশিয়ার ফরঘনার অধিবাসী দুই ভাই নিজামউদ্দিন ও সামসামউদ্দিন বখতিয়ার খলজির অধীনে চাকরি করতেন। ১২৪২-এ মিনহাজের সঙ্গে এই দুই ভাইয়ের লক্ষ্মাবতীতে সাক্ষাৎ হয়। বাংলায় আগমনকারী বহু শান্তিপ্রিয় সুফি-সাধকদের খবর মিনহাজ অবগত হয়েছিল এই সামসামউদ্দিনের কাছ থেকে। মিনহাজ তার গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন, বখতিয়ার খলজি কয়েকটি মসজিদ, খানকাহ ও গৃহ নির্মাণ করেছিলেন সুফিদের জন্য। খানকাহ নির্মাণের কথা থেকে বােঝা যায় যে, বখতিয়ারের নদিয়া বা বঙ্গ বিজয়ের পূর্ব থেকেই এখানে কিছু সুফি-সাধক বসবাস করতেন এবং তাদের প্রয়ােজনে খানকাহ নির্মিত হয়েছিল। আর বখতিয়ারের পর সুফি-সাধকদের আনাগােনা আরও সহজ হয়ে যায়।
এভাবে গৌড় থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে মঙ্গলকোট পর্যন্ত সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে ইসলাম প্রচারকদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছিল। পাল শাসকদের সাংস্কৃতিক অসচেতনা ও বৌদ্ধ মতবাদের সামাজিক শক্তির অভাব ও দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ মানুষে মানুষে সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল। সেন রাজত্বকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সর্বদাই অন্তঃজ শ্রেণিকে অস্পৃশ্য করে রেখেছিল। তাদের ধর্মাচরণের অধিকার ছিল না। সমাজেও কোনােরকম প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। তাই তাদের কাছে মুসলিম বিজয় ধর্মের নব অভ্যুত্থান মনে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। অন্তত অপোকৃত ভাল আশ্রয়ের হাতছাড়ি তারা অনুভব করতে পারে। বৈদিক ব্রাহ্মণরা শুধু সামাজিক বিধান আরােপ করেই সাধারণ শ্রেণির জনগােষ্ঠীকে কোণঠাসা করে রাখেনি, বরং তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও এদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিলে বা তাদের হত্যা করলেও ব্রাহ্মণদের কোনাে দণ্ডভােগ করতে হতাে না। ব্রাহ্মণদের এই বৈষম্যমূলক সমাজ বিধান এবং হিংসাত্মক আচরণ অবহেলিত শ্রেণিকে বিব্ধ করে তুলেছিল। শুধু তাই নয়, বখতিয়ার খলজির অভিযানের পূর্বে সেন শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিও গণমানসে শাসক সম্প্রদায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। কারণ লক্ষ্মণ সেনের সময় সেন রাজার স্বৈরাচারী চরিত্র ফুটে ওঠে। শেখ শুভােদয়া’ নামে যে প্রাচীন পুঁথি পাওয়া গেছে তার। কাহিনিতে লক্ষ্মণ সেনের মহিষী বল্লভা ও রাজ শ্যালক কুমার দত্ত কর্তৃক সাধারণ মানুষের প্রতি অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওই অত্যাচারের মাত্র এত বেশি ছিল যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজসভার অমাত্যরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার আছে। প্রাচীনকালে থেকেই সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগােষ্ঠী উত্তর ও দক্ষিণপূর্ব বঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। বর্ণ হিন্দুদের মূল আস্তানা ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু সেন রাজত্বকালে উত্তর ও দণি-পূর্ব বাংলায় রক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের দাপটে সাধারণ বাঙালির মধ্যে নৈরাজ্য দেখা দেয়। ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী ছিল তার বি(দ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। ইসলাম প্রচারকদের সামনে রেখে তখন এ বাংলার নিপীড়িত ও দলিত জনতার একটা বড়াে অংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে সংগ্রামী কাফেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ফলে বাংলায় ১২শতকের মধ্যে রাজশক্তির পােষকতা ছাড়াই আংশিকভাবে মুসলিম সমাজ গঠনের প্রাথমিক প্রয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সুফি বা ধর্মপ্রচারকদের কার্যক্রমের ফলে প্রতিষ্ঠিত এই মুসলমান সমাজ পরবর্তীকালে মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় আরােহণকে অনেক সহজ করে দেয়। সুতরাং বলা যায় যে, বখতিয়ার খলজির সামরিক সাফল্যের অনেক আগে থেকেই মুসলিম সাধকদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপ্রচার চলছিল যা বাংলায় মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করেছিল।
(৫)
তাছাড়া আরাকানী উপাখ্যান ‘রদজায়েং’ থেকে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় এলাকায় আরব বণিকরা এসেছিলেন এবং চট্টগ্রামে তাঁদের একটি শক্তিশালী উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মােহর আলি দশম শতকে চট্টগ্রামে জনৈক মুসলিম শাসকের (সুলতান) উপস্থিতির কথা বলেছেন।
আর লক্ষ্মণ সেনের বিখ্যাত মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের ‘শেখ শুভােদয়া’র সাক্ষ্য অনুসারে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক নদিয়া তথা গৌড় জয়ের সামান্য আগে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভাতে এসেছিলেন শেখ জালালউদ্দিন তাবরেজি (১১৬২-১২২৫) , বাংলায় আগত প্রথম দরবেশ বলে তিনি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। শেখ শুভােদয়া’য় (অর্থাৎ শেখের শুভ উদয় বা আগমন) তারই মাহাত্ম কীর্তন করা হয়েছে। শেখ শুভােদয়া’ই প্রথম পীরকাব্য এবং রাজা লক্ষ্মণ সেনও তার ব্যক্তিত্বে ও কেরামতিতে মুগ্ধ ছিলেন। বাংলায় সুফিবাদ বিকাশে জালালউদ্দিন তাবরেজিকে উত্তর ভারতের রাজস্থানের আজমীরের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। জালালউদ্দিন ‘ধর্মযুদ্ধ করার জন্য আসেননি, এসেছিলেন শান্তির বাণী বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ (খণ্ড-২) গ্রন্থে সপ্তদশ অারােহী কর্তৃক নদীয়া জয়ের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার জন্য প্রচুর বাক্য ব্যয় করা হলেও ‘শেখ শুভােদয়া’ পুঁথিটির উল্লেখ করা হয় না।
লক্ষ্মণ সেন জালালউদ্দিন তাবরেজির জন্য একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং মসজিদ ও তার খানকার ব্যয়ভার বহনের জন্য তাঁকে কয়েকটি গ্রাম দান করেন। তিনি জনসেবায় নিয়ােজিত ছিলেন এবং হাজার হাজার লােক তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ‘শেখ শুভােদয়ায় তিনটি ছড়ায় বিষয়টি সহজেই ধরা পড়ে—
১. মকদম সেক শাহ জালাল তবরেজ
তব পাদে করে পরণাম।
চৌদীশ মধ্যে জানিবে যাঁহার নাম
বারেক রক্ষা কর মাের পণ (পণ্য) প্রাণ
দেশে গেলে দিব তােমার নামে অর্ধেক দান।
২. মধ্যে আছে পীরের মােকাম
তস্যোপরি বিদ্যতে প্রধান-পুরুষের স্থান।
তীয়াঞ্জলি তাহার নামে দান
- •• ••• ••• ••• ••• ••• •••
আমার মােকামে সাধিয়া অনেক লােক করিব প্রণাম
কেহ বাঞ্ছে ধন পুত্র কেহ আরওগ্য দান।
আমি তার করিব ত্রাণ।
৩. বনের শাক খায় সেক বনের গােনা
ঝিকরির পােটলি বান্ধিয়া দেয় সেক
হাটে বিকাইলে হয় সােনা।
অনেক শাসক তার রাজনৈতিক ভিত সম্প্রসারণের লক্ষে যেমন দরবেশদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতেন, তেমনি অনেক দরবেশ ইসলামের প্রচার ও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজদরবারের সংস্পর্শে এসেছিলেন। অবশ্য বাংলার দরবেশ এবং সুলতানদের মধ্যকার সম্পর্ক কখনও কখনও মারাত্মক তিক্ত হয়ে পড়ত। সাধারণভাবে যখন শাসকেরা রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতেন এবং বিশেষভাবে যখন তারা নতুন রাজবংশের সূচনা করতেন, তখন তারা ক্ষমতাবান দরবেশদের সক্রিয় সাহায্য কামনা করতেন। অন্যদিকে, একবার কোনাে রাজবংশ ক্ষমতায় নিরাপদে বহাল হতে পারলে অনেকে আর দরবেশদের কাছে তাদের স্বীকৃতি চাওয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতেন না।
বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য বিশ্লেষণ করে আহমদ শরিফ তুর্কি বিজয়ের আগে তথা রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলায় ‘শেখ শুভােদয়া’য় উল্লেখিত জালালউদ্দিন তাবরেজি নামক দরবেশের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। তার মতে, ‘শেখ শুভােদয়া’ লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রেরই রচনা। তবে এটি রচিত হয়েছিল তুর্কি বিজয়ের পর। লক্ষ্মণ সেনের অপর সভাকবি উমাপতি ধরও তুর্কি প্রভুর প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পীর-প্রীতিমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাজেই ‘শেখ শুভােদয়া’ গ্রন্থের অকৃত্রিমতায় সন্দেহ করা অমূলক। জালালউদ্দিন তাবরেজি ১২০০-১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়ে ছিলেন।
রাজা লক্ষ্মণ সেন ও শেখ জালালউদ্দিনের প্রথম সাক্ষাৎ দিয়েই ‘শেখ শুভােদয়া’র শুরু। বর্ণিত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে, শেখের প্রতি রাজা, মন্ত্রী, নটী ও অবিধাসীদের ক্রমশ আকৃষ্ট হবার চমকপ্রদ কাহিনি, রাজশ্যালক কুমার দত্ত-মাধবীমধুকর-রাণী বল্লভা সম্পৃক্ত ঘটনা, শেখের প্রথম জীবনের নানা অলৌকিক কাহিনি, বিজয় সেনের কাহিনি, কুশল তীরন্দাজ লক্ষ্মণ সেন-মদন-উমাপতি ধর সম্পর্কিত ঘটনা, বুঢ়ণ মিশ্র, পদ্মাবতী-জয়দেবের সঙ্গীত প্রতিযােগিতা, রাজা ও ধােপা সম্বাদ, ধােয়ী ও চার ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী-বিদ্যুৎপ্রভা সম্বাদ, শেখের মসজিদ নির্মাণ ও সম্পত্তি লাভ, নট গাঙ্গোর কাহিনি, বিদ্যুৎপ্রভা ও তাঁতি প্রভৃতির আখ্যায়িকা।
সুতরাং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে বলা যায় যে, মােহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযানের (১২০৪) বহু পূর্ব থেকেই বাংলায় আরব বণিক এবং সুফিদের আগমন, যােগাযােগ ও বসবাস শুরু হয়েছিল। তাদের কর্মকাণ্ডের জেরে বাংলায় মুসলমান সমাজের বিকাশের প্রাথমিক পথ তৈরি হতে থাকে। ফলে বাংলার সাগর তীরবর্তী কোনও কোনও জনপদে ছােটো ছােটো মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল মুসলিম বিজয়ের আগে থেকেই। সুখময় মুখােপাধ্যায় লিখেছেন, “বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলার অংশবিশেষ অধিকার করার আগে থাকতেই এদেশে মুসলমানরা আসত এবং তাদের অনেকে এদেশে বসতি স্থাপন করেছিল।”
তবে বাংলায় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ণতা আসে আরও পরে—বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের প্রায় ১০০ বছর পর।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. তারাচঁাদ, ইনফ্লুয়েন্স অফ ইসলাম অন ইন্ডিয়ান কালচার, বাংলা অনুবাদ-করুণাময় গােস্বামী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ২৬।
- ২. খালিক আহমদ নিজামী, আরব অ্যাকাউন্টস অফ ইন্ডিয়া, মােহাম্মদ যাকি সম্পাদিত, ১৯৫৭, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
- ৩. রাওল্যান্ডসন সম্পাদিত, প্রাগু, ভূমিকা দ্রষ্টব্য, ফ্রান্সিস ডে, দ্য ল্যান্ড অফ দ্য পেরুমলস, ১৯৫৬, পৃ. ৩৬৫।
- ৪. মাহুয়ানের বিবরণ, পি সি বাগচিকৃত ইংরেজি অনুবাদ, বিভারতী অ্যানালস্, ১৯৪৫।
- ৫. ইসলামি বিবকোষ, খণ্ড-২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০০, পৃ. ১৪৯।
- ৬. হাসান শরিফ, বাংলাদেশে ইসলাম, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১০, পৃ. ৭৮।
- ৭. মহিউদ্দিন খান, বাংলাদেশে ইসলাম কয়েকটি সূত্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, এপ্রিল-জুন, ১৯৮৮, ঢাকা।
- ৮. এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, মাওলা ব্রাদার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, ঢাকা, ২০০১, পৃ. ১০।
- ৯. FA Khan, Recent Archaeological Discoveries in East Pakistan, Karachi, P.-11
- ১০. কে এন দীক্ষিত, মেময়র্স অফ দ্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৯৩৮,নং-৫৫, পৃ. ৮৭, এনামূল হক, পূর্বপাকিস্তানে ইসলাম, পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ১০,
- ১১. এনামূল হক, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম, পৃ. ১২।
- ১২. মিনহাজউদ্দিন সিরাজী তবকৎ-ই-নাসিরী, এইচ জি র্যাভার্টি অনুদিত, খণ্ড-১, ওরিয়েন্টাল বুকস্, পুনর্মুদ্রণ, নিউদিল্লি, ১৯৭০, পৃ. ৫৫৭।
- ১৩. দৈনিক বাংলা, ২৩ এপ্রিল ১৯৮৬, ঢাকা।
- ১৪. আর এম ইটন, দ্য রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০, নয়াদিল্লি, ২০০২, পৃ. ৭২, পাদটীকা।
- ১৫. সামসুদ্দীন আহমেদ, ইনক্রিপসল্স অব বেঙ্গল, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, রাজশাহী, ১৯৬০, পৃ. ২০।
- ১৬. এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ১ম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ. ২৯।
- ১৭. ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস্ ওন হিস্টরিয়ান, খণ্ড-১, লন্ডন, ১৮৬৭,পৃ.
- ১৮. MH Nainar, Arab Geographers’ Knowledge of Southern India, Other Books, Calicut, Reprint, 2011, P.-16.
- ১৯. এস এইচ হােদিওয়ালা, স্টাডিজ ইন ইন্দো-মুসলিম হিস্টরি, বম্বে, ১৯৩৯, পৃ.৪।
- ২৮. আর সি মজুমদার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৩, পৃ. ১৭৬।
- ২০. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ১ম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ.৬৪।
- ২১. Dr. Ahmad Hasan Dani, Early Muslim Contact with Bengal, Proceedings of the Pakistan History Conference, Karachi, 1951, P.-195;M H Nainar, ibid, P.-12; ইলিয়ড ও ডওসন, প্রাগুত্ত, পৃ. ৯০, আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস ১২০০-১৮৫৭, বড়াল প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৫।
- ২২. ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, চট্টগ্রাম, পৃ. ১।
- ২৩. কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ১৪।
- ২৪. এনামূল হক, বঙ্গে সুফী প্রভাব, কলকাতা, ১৯৩৫, পৃ. ১৪৭।
- ২৫. গােলাম সাকলায়েন, বাংলাদেশের সুফী সাধক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সপ্তম সংস্করণ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ২১০।
- ২৬. District Gazetteer, Mymensingh, 1917, P.-152.
- ২৭. District Gazetteer, Bagura, 1990, P.-154-55.
- ২৮. ফরিদউদ্দিন আত্তার, তাজকিরাতুল আউলিয়া, আর এ নিকলসন সম্পাদিত ও অনুদিত, লন্ডন, ১৯০৫।
- ২৯. মােহর আলি, হিস্টরি অফ দ্য মুসলিমস অফ বেঙ্গল, খণ্ড-১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৩, পৃ. ৩৭-৩৮।
- ৩০. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড-১, ইস্টার্ন পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭৫, পৃ. ৭৮।
- ৩১. আহমদ শরিফ, বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য, খণ্ড-১, নিউ এজ পাবলিকেশন, পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৭৭-৭৮।
- ৩২. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ৫ম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ১১৩।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।