লিখেছেনঃ অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ন ঝা
গোহত্যা এবং গােমাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকা হিন্দুদের পরিচয় এবং গােমাংস ভক্ষণ একান্তভাবেই মুসলিম পরিচয় একথা যে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা প্রচার করে তা আমরা জানি। যারা গরুকে দেবত্বে উন্নীত করেছেন তারা আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছেন, দেশের সামাজিক বুনােটের ক্ষতি করেছেন এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও গোঁড়ামির শক্তিকেই জোরদার করেছেন।
এক
“গােমাতা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের চেয়ে শ্রেয়তর। আমাদের মা বছর দুয়েক স্তনদান করে আশা করেন। যে বড় হয়ে আমরা তার সেবা করব। গােমাতা ঘাস ও শস্যদানা ছাড়া আমাদের কাছ থেকে কিছুই চায় না। মা প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাদের সেবা পাওয়ার আকাঙ্খ করেন। গােমাতা কদাচিৎ অসুস্থ হয়। আমাদের মায়ের মৃত্যু মানে কবর দেওয়া বা দাহ করার খরচ। গােমাতা মৃতাবস্থায় জীবন্তের মতই উপযােগী।” গরুর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে এই কথাগুলি বলেছেন মহাত্মা গান্ধী। কোনােপ্রকার ধর্মীয় বাগাড়ম্বর ছাড়াই তার ব্যাখ্যা খুবই সহজ: কোনাে কৃষিপ্রধান সমাজে গরু গুরুত্বপূর্ণ তার সম্পদমূল্যের কারণে। ঐ সমাজের মানুষরা নিজেদের রসদে অনেকটাই আহরণ করে তার দুধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত বস্তু থেকে। কিন্তু গান্ধী স্ব-বিরােধিতা করছেন যখন তিনি বলছেন, “ হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় বিষয় হলাে গাে-সংরক্ষণ… হিন্দুধর্মে বিধৃত গাে-সংরক্ষণের আদর্শ পশ্চিমের ডেয়ারি’র আদর্শের তুলনায় ত মূলগতভাবে ভিন্ন, এবং বহুধা বিস্তৃত। পশ্চিম আদর্শ গড়ে উঠেছে আর্থিক মূল্যকে ভিত্তি করে, পক্ষান্তরে হিন্দু ধর্ম জোর দিয়েছে এর … আধ্যাত্মিক দিক, যেমন, গরু যে শহীদসুলভ প্রতীক, তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত ও আত্মোৎসর্গের ধারণার কি ওপর…।”
গান্ধীর এই দুটি উক্তির মধ্যে পরেরটি আগেরটির থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলাদা, কারণ এটিতে গাে-সংরক্ষণে ধর্মীয় দায়িত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আজ অধিকাংশ হিন্দু গাে-সংরক্ষণের পিছনে নিজেদের ধর্মীয় ভাবনা ও উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হন। তাই বর্তমানের একজন গড়পরতা ভারতীয় তাঁর সনাতন হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যে বদ্ধমূল হয়ে থাকেন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, তাঁর পূর্বপুরুষরা, বিশেষত বৈদিক আর্যরা গরুর অন্তনিহিত ‘পবিত্রতার জন্য গরুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঠাহর করেছেন। যে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গােমাংস ভােজী মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত বলে প্রায়শই কল্পনা করা হয়, তাদের কৌম সত্তার প্রতীক হিসাবে ‘পবিত্র’ গরুকে ভেবে নেওয়া হয়েছে। তাই গরুর পবিত্রতাকে বজ্রনির্ঘোষে ঘােষণা করা হয়েছে, এবং ভ্রান্তিকরভাবে এই পবিত্রতার উৎস খোঁজা হয়েছে বেদে, যে বেদকে দৈবসৃষ্ট ও সকল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস বলে কল্পনা করা হয়। অন্য ভাবে বলা যায় যে, ভারতীয় সমাজের কোন কোন অংশ ‘পবিত্র’ গরুর ধারণাকে সেই যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন যখন গরুকে বলি দেওয়া হত এবং তার মাংস ভােজন করা হত।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলাে, শাসকদের হাতে বিভিন্ন সময়ে গরু একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা গেছে। বলা হয় যে, মুঘল সম্রাটরা (যেমন বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর ও ঔরঙ্গজেব প্রমুখ) গরুর প্রতি জৈন ও ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধাশীল মনােভাবকে মর্যাদা প্রদান ও গাে-প্রেম প্রদর্শনের জন্য গােহত্যার ওপর নিয়ন্ত্রিত নিযেধাজ্ঞা লাগু করেছিলেন। একইরকমভাবে শিবাজী—যাঁকে অনেক ক্ষেত্রে গাে ও ব্রাহ্মণের প্রতিপালনের জন্য পৃথিবীতে ঈশ্বরপ্রেরিত অবতার বলে মনে করা হয়—তিনি এরকম ঘােষণা করেছিলেন বলে বর্ণিত হয়েছে: “আমরা হিন্দু এবং এই রাজ্যের ন্যায়সঙ্গত অধিপতি। গােহত্যা এবং ব্রাহ্মণদের ওপর নির্যাচন প্রত্যক্ষ করা আমাদের পক্ষে উচিত নয়। কিন্তু গরু গণ-রাজনৈতিক সংহতির হাতিয়ার হয়ে উছল ১৮৭০ সাল নাগাদ, যখন পাঞ্জাবে শিখ কুকা (বা নামধারী) সম্প্রদায় এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীকালে তা জোরদার হয়েছিল ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতীর দ্বারা প্রথম গােরক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠার পর। কার্যত, এই প্রাণীটিকে ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতীক রূপে ও মুসলমানদের মধ্যে চালু গাে-নিধন প্রথার বিরােধিতা করার জন্য ব্যবহার করা হলাে; ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকে পর পর কয়েকটি ঘােরতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পিছনে উসকানি দেওয়া হলাে। এর আগে থেকেই গগাহত্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী ক্রমশ কঠোর হতে থাকলেও গাে-সংরক্ষণ আন্দোলন ‘নাটকীয় ভাবে তীব্র রূপ’ পেল ১৮৮৮ সালে, যখন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের উচ্চ ন্যায়ালয় ঘােষণা করল যে গরু কোনাে পবিত্র বস্তু নয়। এটি বিস্ময়কর নয় যে গোহত্যা প্রায়শই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ক্ষেত্রে অছিলা হিসাবে কাজ করেছে, বিশেষত ১৮৯৩ সালে আজমগড় জেলায়, যখন দেশের বিভিন্ন অংশে শতাধিক লােক দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন। একইভাবে, ১৯১২-১৯১৩ সালের হিংসাত্মক ঘটনায় অযােধ্যা কেঁপে ওঠে, এবং কয়েক বছর পর ১৯১৭ সালে সাহাবাদ বিধ্বংসী সাম্প্রদায়িকতার দাবানল প্রত্যক্ষ করল।
যদিও বহু রাজ্যের আইনসভা গােহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছে এবং ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিসমূহে ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে “গরু, গোবৎস এবং দুগ্ধপ্ৰদায়ী ও মালবাহী অন্যান্য পশুদের হত্যা প্রতিহত করার জন্য… পদক্ষেপ গ্রহণ করার..,” তথাপি স্বাধীন ভারতেও রাজনীতির অঙ্গনে গােহত্যা বারংবার সমস্যাসংকুল প্রসঙ্গ হিসাবে উখিত হয়েছে। যেমন, ভারতে স্বাধীনতার প্রায় দুই দশক পর ১৯৬৬ সালে প্রায় সব ভারতীয় সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনগুলাে গােহত্যার ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা আরােপের দাবীতে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাবেশের পরিকল্পনা করে, যার ফলে ভারতীয় সংসদের সামনে হিংসাত্মক সংঘর্ষ ঘটে, যাতে অন্তত আট জনের মৃত্যু ঘটে এবং আরও অনেকে আহত হন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে আচার্য বিনােবা ভাবে, যাকে মহাত্মা গান্ধীর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী বলে প্রায়শই মনে করা হয়, তিনি সারা দেশে গােহত্যা নিষিদ্ধ করার দাবীকে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য অনশন শুরু করেন, এবং পাঁচদিন পর তা তুলে নেন প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাইয়ের এই অস্পষ্ট আশ্বাস পেয়ে যে তার সরকার গােহত্যা নিবারণী আইন বলবৎ করতে দ্রুত উদ্যোগী হবে। তার পর থেকে বহু বছর ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে গরু গুরুত্বহীন হয়ে ছিল, যদিও সমাজতত্ত্ববিদ, নৃতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ ও নানা স্তরের নীতিনির্ধারকদের কাছে গােসম্পদ ব্যবহারের প্রসঙ্গটি অ্যাকাডেমিক বিতর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভারতের সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কাছে এটি বরাবরই হুজ্জতি বাঁধাবার বিষয় হয়ে থেকেছে। এই প্রাণীটির প্রতি শ্রদ্ধা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক সত্তার প্রতীকে। সংকীর্ণ ও অন্ধ মৌলবাদী শক্তিদের এ কথা মেনে নিতে ঘােরতর আপত্তি যে বৈদিক ও পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যবাদী ও অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্য ‘পবিত্র’ গরু সবসময় পবিত্র ছিল না, এবং গােমাংস প্রায়শই অন্যান্য ধরনের মাংসের মতােই প্রাচীন ভারতের অভিজাত রন্ধন শৈলীর অংশবিশেষ ছিল। পাকিস্তানের দুর্দিস্তানের শিন মুসলমানরা গরুকে সেভাবে দেখেন সেইভাবে যেভাবে অন্যান্য মুসলমানরা শূকরকে দেখে থাকেন। তারা গরুর সঙ্গে প্রত্যঙ্গ সংযােগ এড়িয়ে চলেন, গরুর দুধ পান করেন না বা ইন্ধন হিসাবে গােবর (ঘুঁটে) ব্যবহার করেন না, এবং গােমাংস খান না। তা সত্ত্বেও অস্তিত্বহীন ‘একশিলাভূত’ হিন্দুধর্মের স্ব-ঘােষিত রক্ষকরা দাবী, করেন যে ভারতে গােমাংস খাওয়ার রীতি প্রথম চালু করেন ইসলামের উপাসকরা, যাঁরা ছিলেন বহিরাগত। এরা বুঝতেই চান না এদের বৈদিক পূর্বসূরীরাও বহিরাগত ছিলেন এবং তাঁরা গরু ও অন্যান্য প্রাণীর মাংস খেতেন। তথ্যের তুলনায় যখন অন্ধ মােহ প্রাধান্য লাভ করে তখন বিস্ময় লাগে না রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তাদের অসংখ্য সংগঠনগুলাের কর্মসূচীতে গােহত্যার ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা স্থান পেয়েছে, এবং গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী (কেশুভাই পটেল) কয়েক বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন যে গাে-পালন ও হিন্দু মন্দির পরিচালনার জন্য একটি পৃথক বিভাগ চালু করা হবে। আধুনিক হিন্দুত্বের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে গােমাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকার প্রচার এতটাই ছড়িয়েছে যে আর.এস.এস শিখদের হিন্দু বলে দাবী করলে শিখদের পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিবাদ ওঠে এবং জনৈক শিখ যুবনেতা প্রস্তাব করেন, “একটা গরু জবাই করে গুরুদোয়ারা’র লঙ্গর-এ তার মাংস কেন বিতরণ করা হবে না?”
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা গরু নিয়ে শােরগােল করে থাকেন তারা এ কথা বােঝেন না যে ভারতে দীর্ঘকাল ধরে গােমাংস ভক্ষণের রীতি সাধারণ ব্যাপার ছিল, এবং তার বহুল প্রচলনের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া যায় আমাদেরই নিজস্ব শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থের থেকে আহরিত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। ভারতীয় খাদ্যরীতি প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার জবাব বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণায় ভদ্রভাবেই দেওয়া হয়েছে এবং গবেষকরা গােমাংস ভক্ষণের সপক্ষে প্রাপ্ত লিখিত প্রমাণগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যার প্রারম্ভিক উল্লেখ মিলবে প্রাচীনতম ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদে, যে গ্রন্থটিকে অপৌরুষেয় (ঈশ্বরসৃষ্ট) মনে করা হয়। উনিশ শতকের প্রথমার্থে এইচ.এইচ. উইলসন দাবী করেছিলেন যে “ঘােড়া বা গরুকে বলিদান গােমেধ বা অশ্বমেধ–প্রাচীনতম হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলিত ছিল।” ইন্দো-আর্যদের মধ্যে যে গবাদি পশু হত্যা ও তার মাংস খাওয়ার রীতির প্রচলন ছিল সে বিষয়ে সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠভাবে মত রেখেছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র তার একটি প্রবন্ধে, যেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল-এ এবং পরবর্তীকালে ১৮৯১ সালে প্রকাশিত তার দ্য ইন্দো-আরিয়ানস গ্রন্থে একটি অধ্যায় হিসাবে সেটি সংযােজিত হয়। ১৮৯৪ সালে জনৈক ব্রিটিশ সার্ভেন্ট উইলিয়াম ক্রুক লােকায়ত ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত প্রচুর নৃতাত্ত্বিক তথ্য তার দু’খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে সংকলন করেন এবং তার একটি পূর্ণ অধ্যায় গরু ও অন্যান্য গবাদি পশুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে ব্যয় করেছেন।
পরবর্তীকালে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গরুর পবিত্রতা প্রসঙ্গে একটি তথ্যধর্মী রচনা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাতেও তিনি নিজের সমকালে গােমাংস খাওয়ার প্রাচীন রীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৯২৭ সালে এল. এল.সুন্দর রাম হিন্দুধর্মসহ অন্যান্য নানা ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থকে প্রমাণ হিসাবে দেখিয়ে জোরালােভাবে গাে-রক্ষার দাবী করেন। তবে তিনি অস্বীকার করেন নি যে বৈদিক যুগের মানুষরা গােমাংস খেত, যদিও গােহত্যার জন্য তিনি মুসলমানদের দোষ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে চল্লিশের দশকের গােড়ায় পি.ভি. কানে তাঁর পাঁচ-খণ্ডের বিখ্যাত হিস্ট্রি অফ ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থে কিছু বৈদিক ও প্রথম দিকের ধর্মশাস্ত্রগুলির রচনাংশের উল্লেখ করেছেন যেগুলিতে গােহত্যা ও গােমাংস ভক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এইচ.ডি, সাংকালিয়া প্রাচীন ভারতে গবাদি পশুর মাংস খাওয়ার সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একইভাবে, সংস্কৃতে তর্কাতীত পাণ্ডিত্যের অধিকারী লক্ষ্মণ শাস্ত্রী যােশী ধর্মশাস্ত্রের প্রতি আকর্ষণ করেছেন, যেখানে প্রাচীন ভারতে গােমাংস সহ অন্যান্য মাসে খাদ্য রূপে গ্রহণের রীতির প্রচলনের সমর্থনে প্রমাণ মিলবে।
বলা বাহুল্য, উপরি-উক্ত পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য সন্দেহের উর্ধে এবং তাদের কেউ কোনাে ধরণের হিন্দু-বিরােধী আদর্শের ধারক-বাহক নন। এদের কেউই মার্ক্সবাদী নন, যে মার্ক্সবাদীরা প্রাচীন কালের গােমাংস ও অন্যান্য প্রাণীজ খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এঁদেরই গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর নির্ভর করেন এবং যাদের সঙ্ঘ পরিবার ও গেরুয়া-প্রভাবিত সাংবাদিক ও প্রচারকারীরা ইতিহাস-বিকৃতির দোষে অভিযুক্ত করেন। উদাহরণস্বরূপ ধরুন এইচ. এইচ. উইলসনকে, যিনি ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ডে সংস্কৃতের অধ্যাপক-পদের প্রথম অধিকারী ছিলেন এবং অন্যান্য বহ সাম্রাজ্যবাদী পণ্ডিতদের মত ঘোরতর ভারত-বিরোধী ছিলেন না। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন বাংলার নবজাগরণের ফসল এবং রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ভারতের বৌদ্ধিক জীবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, ম্যাক্সমুলার তাঁকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ জীবিত ভারততত্ত্ববিদ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে “সরস্বতীর বরপুত্র” বলে আখ্যা দিয়েছেন। উইলিয়াম ক্রুক ছিলেন একজন নামজাদা ঔপনিবেশক নৃতত্ত্ববিদ যিনি হিন্দুধর্মের প্রতি কোনাে ধরণের পূর্বনির্ধারিত বিদ্বেষ ছাড়াই কৃষকদের জীবন ও লৌকিক ধর্ম নিয়ে লিখেছেন। কিছুটা পরিমাণে মুসলিম-বিরােধী মনােভাব সত্ত্বেও এল.এল. সুন্দর রাম মানবিক বিবেচনাবােধ দ্বারা প্রেরণা লাভ করেছিলেন। মহামহােপাধ্যায় পি.ভি কানে ছিলেন একজন রক্ষণশীল মারাঠী ব্রাহ্মণ এবং একমাত্র সংস্কৃতও যাঁকে ভারতরত্ন উপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে। এইচ.ডি. সাংকালিয়া তাঁর তুলনাহীন প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষায় গভীর জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিলেন। এই পণ্ডিতরা ছাড়াও বহু ভারতীয় সংস্কৃতজ্ঞ ও ভারততত্ত্ববিদ—বেশ কিছু পশ্চিমী পণ্ডিতদের কথা যদি ছেড়েও দিই—সকলেই প্রাচীন ভারতের গরু ও অন্যান্য ধরনের প্রাণীজ মাংস খাওয়ার শাস্ত্রীয় প্রমাণের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মজার ব্যাপার হলাে যে সঙ্ঘ পরিবার, ‘ভদ্রজনােচিত শিক্ষা থেকে যারা বিপুলভাবে বঞ্চিত, তারা কখনও এই সব পণ্ডিতদের আক্রমণ করেনি, তারা আক্রমণের লক্ষ্য করেছে সেইসব ঐতিহাসিকদের যাঁরা উপরিউক্ত স্বনামধন্য পণ্ডিতদের গবেষণার ওপরেই প্রধানত নির্ভরশীল।
দুই
প্রথম যুগের আর্যরা এক অর্ধ-যাযাবর গােষ্ঠী হিসাবে ভারতে এসেছিল, যাদের অর্থনীতি ছিল প্রধানত পশুচারণের অর্থনীতি যাতে পশু পালন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত এবং কৃষির স্থান ছিল গৌণ। তারা পশুচারণের অর্থনীতির উত্তরাধিকার লাভ করেছিল তাদের ইন্দো-ইউরােপীয় অতীত থেকে, যার সুস্পষ্ট নিদর্শন মিলবে তাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে, বিশেষত তাদের ধর্মবিশ্বাস ও রীতিনীতিতে। পশুচারণের মত তারা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছিল পশু তথা গবাদি পশু হত্যার রীতি যা প্রথম দিকে আর্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত ছিল। ভাষাগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করে বলা হয়েছে যে বৈদিক যুগের গবাদি পশুবলির রীতি, যার নাম পশুবন্ধ, তার উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে পূর্ব-ইউরােপের প্রাচীনতর স্তেপ সংস্কৃতির। তুলনামূলকভাবে ঘরের কাছে প্রাচীন ইরানে, যে অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ইন্দো-ইউরােপীয়দের পূর্ব শাখাটি ভারতে পরিযান করে আসে, সেখানকার আবেস্তা গ্রন্থে পশুবলির যথেষ্ট নিদর্শন রয়েছে এবং আবেস্তাতে বৈদিক যজ্ঞ শব্দটি যখন বলে উল্লেখিত হয়েছে। এই গ্রন্থে ১০০ ঘােড়া, ১০,০০০ ভেড়া বা ছাগল ও ১০০০ উট ছাড়াও যাড় এবং ১০০০ ক্ষুদ্র গবাদি পশু বলির কথা বলা হয়েছে, ঠিক যেভাবে বৈদিক গ্রন্থগুলিতে প্রায়শই গবাদি পশু, ঘােড়া, ভেড়া, ছাগল ও শকূর প্রভৃতি বলির উল্লেখ থাকে।
ঋকবেদের প্রায়শই বলদের মাংস রান্না করে দেবতাদের বিশেষত বৈদিক দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের উদ্দেশে উৎসর্গ করার উল্লেখ রয়েছে। এক স্থানে বলা হচ্ছে যে তিনি (ইন্দ্র) বলেছেন, “তারা আমার জন্য কুড়িটি অপেক্ষাও ১৫টি অধিক বলীবর্দ রন্ধন করে।” অন্য কয়েকটি স্থানে বলা হচ্ছে যে তিনি যাঁড়ের মাংস, এক বা একশাে মহিষের মাংস, অগ্নিপক্ক ৩০০ মহিষ, অথবা এক হাজার মহিষ ভক্ষণ করেন। ইন্দ্রের পরেই গুরুত্বের দিক থেকে দ্বিতীয় হলেন অগ্নি, যার সম্পর্কে ঋকবেদে ২০০টি স্তোত্র রয়েছে। পৌরাণিক জনক-জননী দ্যৌ ও পৃথ্বীর সন্তান অগ্নি ইন্দ্রের ন্যায় অসচ্চরিত্র ছিলেন না, তিনি স্বল্প পরিমাণে সােমরস পান করতেন, তার প্রধান খাদ্য হলাে ঘি। সকল মানবের রক্ষাকর্তা এ হেন অগ্নির সম্পর্কে ঋকবেদে বর্ণনা করা হয়েছে যার খাদ্য হলাে বলদ ও বন্ধ্যা গাভী’। ঋকবেদে এমন কিছুই নেই থেকে মনে হয় যে গবাদি বা অন্যান্য পশুর মাংসের প্রতি তার বিরূপ মনােভাব ছিল। বরং, অশ্ব, ঋষভ, উক্ষাণ (বলদ বশা (বন্ধ্যা গাভী) ও মেষ বলি দেওয়া হত তাঁর উদ্দেশে। মৃতের সৎকার প্রসঙ্গে একটি অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে, “ছাগল পােড়ানাের যা অগ্নির প্রাপ্য এবং গােমাংসের ব্যবহার যা দেহকে অগ্নিশিখা থেকে রক্ষা করবে।” তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হল সােমদেব, যার নাম এসেছে মত্ততা সৃষ্টিকারী এক পানীয়ের উৎস উদ্ভিদের নাম থেকে। এ কথা বলা হয় যে বৈদিক যজ্ঞ গুলির মধ্যে মৌলিক ও আদর্শ যজ্ঞের নিদর্শন হলাে সােমের উদ্দেশে সাধিত যজ্ঞ, যাতে গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঋগ্বৈদিক দেবতাদের খাদ্যসূচীতে বিশেষ বৈচিত্র্য নেই। দুধ, মাখন, যব, বলীবর্দ, ছাগ ও মেষ ছিল তাদের স্বাভাবিক খাদ্য, যদিও তাদের মধ্যে কারও নিজস্ব পছন্দ থাকত। যেমন, ইন্দ্র বিশেষ করে যাঁড় পছন্দ করতেন এবং পথের রক্ষাকর্তা পূষন দন্তবিহীন হওয়ায যা পেতেন তাই নরম মণ্ড করে খেতেন।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ আছে ও প্রায়শই আচার-অনুষ্ঠানে গবাদি পশু হত্যার উল্লেখ আছে এবং কেবল গােপথ ব্রাহ্মণেই একুশটি যজ্ঞের উল্লেখ রয়েছে, যদিও তার সবকটিতে হয়তাে পশুহত্যা হয়নি। ইন্দ্রের উদ্দেশে একটি বৃষভ, মরুৎদের উদ্দেশে একটি গরু এবং অশ্বিনদের উদ্দেশে একটি তাম্রবর্ণ গরু উৎসর্গ করা হয়েছিল। মিত্র ও বরুণকে একটি ছােপ ছােপ গাত্রবর্ণবিশিষ্ট গরু উৎসর্গ করা হয়েছিল। অধিকাংশ বারােয়ারি যজ্ঞেই (যেমন, অশ্বমেধ, রাজসূয় এবং বাজপেয়) নানা ধরণের পশুর মাংস, বিশেষত গরু/বলুদ/ষাঁড়ের মাংস প্রয়ােজন হতাে। সকল বারােয়ারি পূর্বেই অগ্ন্যাধেয় নামক প্রস্তুতি পর্বে একটি গরুকে হত্যা করা হতাে এবং বলা হয় যে অদ্ধর্য পুরােহিত যাঁড়ের বাদামী চামড়ার ওপর…চার পাত্রপূর্ণ চাল… সরিয়ে রেখেছে। বৈদিক বারােয়ারি যজ্ঞগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধতম অশ্বমেধ যজ্ঞ, যার উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ঋকবেদে এবং ব্রাহ্মণগুলিতে যার সম্বন্ধে আলােচনা আছে, সেটিতে ৬০০-র অধিক পশু (যার মধ্যে বরাহ প্রভৃতি বন্য পশু থাকত) এবং পাখি নিহত হতাে এবং এটির অন্তিম পর্বে ২১টি নির্বীজকৃত গরুকে বলি দেওয়া হতাে, যদিও তৈত্তিরীয় সংহিতায় (পঞ্চম, ৬.১১-২০) ঘােড়া, যাঁড়, গরু, ছাগল, হরিণ নীলগাইসহ ১৮০টি পশুকে গণনা করে দেখানাে হয়েছে। রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞগুলিতে গােসব (গাে-বলি) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে পরবর্তীকালে বলা হচ্ছে যে একটি নির্বীজকৃত ছিট-ছিট দাগবিশিষ্ট গরুকে মরুৎদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। একইভাবে, অগ্নিস্টোম যজ্ঞে একটি নির্বীজকৃত গরুকে বলি দেওয়া হতাে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ অনুসারে পঞ্চশারদীয়াসব (দর্শপূর্ণমাস) যজ্ঞানুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলাে তিন বছরের কম বয়সী সতেরােটি গাভীকে অগ্নিদগ্ধ করা। যজ্ঞের আগের দিন যজ্ঞকর্তা বন্য ফলমূল খেয়ে থাকতেন। গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর হত্যার নিদর্শন মিলবে চাতুর্মাস্য, সৌভ্রামণি প্রভৃতি যজ্ঞ ও অন্যান্য একক বলিদান কর্ম যেমন পশুবন্ধ বা নিরুপশুবদ্ধ প্রভৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে।
আদি ও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে যজ্ঞে গাে-বলি প্রদানের যে ব্যাপক গুরুত্ব ছিল তার বহু প্রমাণ রয়েছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে দ্ব্যর্থহীনভাবে যজ্ঞে গাে-বলির উল্লেখ রয়েছে, যা খাদ্য হিসাবেই গ্রহণ করা হতাে (অথাে অন্নং বৈ গৌঃ), তাছাড়া অগস্ত্যকে একশত ষাঁড় বলি দেওয়ার জন্য প্রশংসা করা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে মানুষ, ঘােড়া, যাঁড় (বলদ) ছাগল ও ভেড়া বলিদানের যােগ্য প্রাণী, এবং কিমপুরুষ, গৌরমৃগ গবয়, উট এবং শরভের (তরুণ হস্তী) মাংস যজ্ঞ -বলির উপযুক্ত নয় এবং তা খাওয়া উচিত নয়। অবশ্য এ বিষয়টি খুবই সন্দেহজনক যে এই ধরণের নিষেধাজ্ঞা বাস্বব জীবনে কার্যকরী ছিল কিনা, কারণ বেদে বর্ণিত ২৫০টি পশুর মধ্যে ৫০টি যজ্ঞে বলি দেওয়ার তথা মাংস খাওয়ার উপযুক্ত ছিল। এই প্রেক্ষিতে এ কথা মনে রাখা প্রয়ােজন যে বৈদিক আর্যদের মতাে মূলত পশুচারণশীল সমাজে এটি খুবই স্বাভাবিক যে নিহত পশুর মাংস সকলে খাবেন, যদিও কুকুর প্রভৃতি পশুর মাংস অসুরদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া হতাে। বলিদত্ত পশুর মাংস যে সাধারণত মানুষের খাদ্য ছিল তা পরিষ্কার বােঝা যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতায় একটি অনুচ্ছেদ থেকে।
যেখানে বলা হচ্ছে কিভাবে বলিপ্রদত্ত দগ্ধ পশুটিতে কাটা হবে। এর থেকে তার মাংস কিভাবে বিতরিত হবে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। অথর্ববেদের গােপথ ব্রাহ্মণ এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট, এতে বলা হয়েছে যে পশুটিকে শ্বাসরােধ করে হত্যাকারী সমিতার কর্তৃক মৃত পশুর দেহটি ছত্রিশটি ভাগে বিভক্ত করা হবে। সুতরাং, এ ধরনের প্রমাণ রয়েছে যে নানা বর্গের মানুষেরা বলিদত্ত পশুর মাংস খেতেন। “যে দেবতাদের উদ্দেশে বলি উৎসর্গ করা হচ্ছে তারা যদি ভয়ানক হন..তবে সেই বলির মাংস খাওয়ার উপযুক্ত নয়,”—– এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী থাকা সত্ত্বেও এটি সত্য যে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত বস্তুগুলি সকল খাদ্যের প্রতীক। শতপথ ব্রাহ্মণ যেখানে মাংসকে শ্রেষ্ঠ খাদ্য বলা হয়েছে, সেটি ও অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থ থেকে এই বিষয়টি প্রমাণিত হয়। বস্তুত বৈদিক সাহিত্য যজ্ঞের বলিকে শুধুমাত্র সকল প্রাণীর প্রাথমিক উৎস এবং ‘সকল খাদ্যের উৎসের কেন্দ্র’ বলে ভাবে নি, বরং “খাদ্য হিসাবেই” দেখেছে।
কেবল যজ্ঞানুষ্ঠানগুলিতেই নয়, দৈনন্দির জীবনের সাধারণ, ঘরােয়া অনুষ্ঠানেও গবাদি ও অন্যান্য পশু হত্যা করা হতাে। পরবর্তী বৈদিক ও বৈদিকোত্তর গ্রন্থরাজিতে কৃষি ও অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু আচার ও অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে, এবং তাদের কয়েকটিতে গবাদি ও অন্যান্য পশু হত্যা করা বাধ্যতামূলক ছিল। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচারগুলিযেগুলির পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে স্থায়ী রূপ নিতে শুরু করে—সেগুলির মধ্যে শূলগব-র (‘শলাকাবিদ্ধ ষাঁড়’-কে, যজ্ঞে বলি দেওয়া) উল্লেখ করা হয়েছে বেশ কিছু গৃহ্যসূত্রে। এই যজ্ঞে রুদ্রের জন্য একটি শলাকাবিদ্ধ যাঁড়কে হত্যা করা হয়, তার লেজ ও চামড়া আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, এবং সাপেদের জন্য তার রক্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয় কুশ বা দর্ভ ঘাসের ওপর। কৃষিকার্যের উদ্ভব জন্ম দিয়েছিল স্থায়ী বসতির, যার জন্য আবাস, নির্মাণের বিশদ ও জটিল নিয়মাবলীর প্রেক্ষাপট তৈরী হয়, যার উল্লেখ রয়েছে শাস্ত্রে। বহু নিয়মের মধ্যে অন্ততদুটি ছিল একটি কালাে গরু বা সাদা ছাগল বলি দেওয়া।
পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে শাস্ত্রে একটি আগ্রহ উদ্রেককারী আচারের কথা ক্রমাগত উল্লেখিত হচ্ছে, যেটি অতিথিদের আপ্যায়নের সঙ্গে যুক্ত এবং সেটির নাম অর্ঘ্য, বা চলতি কথায়, মধুপর্ক। প্রাচীন কাল থেকেই অতিথিদের সম্মানে পশুহত্যা চলে এসেছে। ঋগ্বেদে (দশম, ৬৮.৩) অতিথিনীর গাঃ শব্দের উল্লেখ আছে, যার অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে-‘অতিথিদের (খাদ্যের) পক্ষে উপযােগী গরু, এবং অন্তত একজন বৈদিক বীরের—অতিথি-নাম করা হয়েছে যে নামটির আক্ষরিক অর্থ হলাে ‘অতিথিদের জন্য গরু বধ’। বিয়ের মত আনন্দানুষ্ঠানেও গরু হত্যা করা হতাে। যেমন, একটি ঋগ্বৈদিক স্তোত্রে বিবাহানুষ্ঠানে গাে-বধের উল্লেখ করা আছে, এবং পরবর্তীকালে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে যে “রাজা বা সম্মানীয় কোনাে ব্যক্তি অতিথি হয়ে এলে লােকে একটি যাঁড় বা গরু হত্যা করে।” মধুপর্ক শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈমিনিয় উপনিষদ-ব্রাহ্মণে এবং বেশ কয়েকটি গৃহ্যসূত্রে তা বিশদে আলােচনা করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি, যেমন, শিক্ষাগুরু, পুরােহিত, স্নাতক, শ্বশুর পিতৃকুল বা মাতৃকুলের গুরুজন, বন্ধু ও রাজার সম্মানে এটি অনুষ্ঠিত হতাে।
তাদের অভ্যর্থনায় কেবল দই ও মধুর সংমিশ্রণ (যা থেরে মধুপর্ক নামটি এসেছে) দেওয়া হতাে না, আরও গুরুত্বপূর্ণ হলাে একটি গরুকে ঝলসানাে হতাে বা অতিথিদের ইচ্ছানুসারে সেটিকে ছেড়ে দেওয়া হতাে, যদিও কোনাে অবস্থাতেই গােমাংস বা অন্য প্রকারের মাংস ছাড়া অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হতাে না। বেশ কয়েকটি গৃহসূত্রে মধুপর্ক অনুষ্ঠানটির স্বাধীন বর্ণনা রয়েছে বা বিবাহের অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে পাণিনি অতিথি অর্থে গােঘ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
গৃহসূত্র গুলিতে ঘরােয়া অনুষ্ঠান, যেমন গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে পালনীয় সীমন্তোন্নয়ন (সংশ্লিষ্ট নারীর সীমন্তরেখা বরাবর কেশবিন্যাস করা), বা উপনয়ন (ব্রহ্মচর্যের সূচনায় পালনীয়) অনুষ্ঠানে যাঁড় বা বলদের চামড়ার ব্যবহার গবাদি পশু হত্যার পরিচায়ক। এমন অনেক ক্ষেত্রে গবাদিপশু হত্যা করা হতাে যা আমাদের কাছে তুচ্ছ কারণ বলে মনে হয়। জ্ঞানী, দীর্ঘজীবী পুত্রসন্তান লাভের আশায় কোনাে ব্যক্তি ঔপনিষদিক নিদান অনুযায়ী ভেড়া, গরু বা অন্য প্রাণীর মাংস ঘি-ভাত সহযােগে খেতেন, এমনকী জন্মের ছয় মাস পরে সেই শিশুটিও পাখির (যেমন ভারদ্বাজী, তিত্তিব, কৃকষা ইত্যাদি) মাংস ও মাছ খেতে পারত।
গবাদি পশু হত্যার রীতি মৃতের সৎকারের ক্ষেত্রেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যেমন, সকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেষ কয়েকটি ঋগ্বৈদিক স্তোত্রের একটিতে মৃতদেহ একটি ষাঁড়ের কথা বলা হয়েছে যেটিকে “সম্ভবত মৃতের সঙ্গে দাহ করা হচ্ছে। যাতে সেটি স্বৰ্গযাত্রা করতে পারে।” গৃহসূত্রগুলিতে বিশদে সকার-কার্যের বিবরণ আছে, যা থেকে সৎকারের সময় গবাদি পশু হত্যা ও মৃতের দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গের ওপর পশুটির বিভিন্ন অঙ্গ স্থাপনের বিবরণ পাওয়া যায়। দাহকার্যের পর পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মার সম্মানে একাধিক আচার পালন করা হতাে, যা পিতৃযজ্ঞ, মহাপিতাযজ্ঞ ও অষ্টকা নামে বৈদিক স্তোত্রে এবং গৃহসূত্র প্রমুখ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য শ্রাদ্ধ নামে আলােচিত হয়েছে।
বিভিন্ন প্রকারের শ্রাদ্ধের বিশদ নিয়মাবলীর আলােচনা এখানে দীর্ঘায়িত করার প্রয়ােজন নেই, কারণ মূল বিষয়টি হলাে পূর্বপুরুষদের আত্মার উদরপূর্তি করা এবং তা করতে হলে তাদের উদ্দেশে গােমাংস উৎসর্গ করা প্রায়ােজন। সুতরাং পুত্রসন্তানের জন্ম অথবা পুত্র বা কন্যার বিবাহ প্রভৃতি আনন্দানুষ্ঠানের শুরুতে অন্যান্য পশু ছাড়াও গরু বা ষাঁড় বা উভয়ই শ্রাদ্ধে বলি দেওয়া হতাে, যেখানে আভ্যুদায়িক (নান্দীমুখ-ও বলা হয়) করা হতাে পূর্বপুরুষদের আত্মাকে খুশী করার জন্য। আরেক ধরনের শ্রাদ্ধ, যাকে বলা হতাে অষ্টকা বা একাষ্টকা, এবং যেগুলির সম্পর্কে গৃহসূত্রগুলিতে বিশদ আলােচনা আছে, যেগুলির ক্ষেত্রে গােহত্যার কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। এ কথা বলা হয়েছে যে অষ্টকা পালনকারী ব্যক্তি বলির জন্য গরুটিকে প্রস্তুত করেন এবং রান্না করা মেদচ্ছটি পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে উৎসর্গ করেন, যদিও শ্রাদ্ধে’কোন প্রাণীকে উৎসর্গ করা হচ্ছে তার ওপর কখনাে কখনাে তাঁদের সন্তুষ্টি নির্ভর করত। একথা বলা হয়েছে যে, গােমাংস দ্বারা পিতৃকুল (মৃত পূর্বপুরুষ) এক বৎসর সন্তুষ্ট থাকেন (সংবৎসরম গাব্যেন প্রীতিঃ); মহিষ, বন্য পশু (যেমন খরগােশ) এবং গৃহপালিত (অর্থাৎ গ্রামীণ) পশু যেমন ছাগল বৎসরাধিক কাল তাদের খুশী রাখে। পূর্বপুরুষের আত্মা অনন্তকাল সন্তুষ্ট থাকেন যদি গণ্ডার, শতবলি (এক জাতীয় মাছ) এবং বার্দ্বীণস তাঁদের উৎসর্গ করা হয়। তবে, সব কিছু তাঁদের পছন্দ বা আগ্রহের উপর নির্ভর করত না এবং গােমাংসের প্রতি সাধারণভাবে প্রশ্নাতীত আগ্রহ ছিল। কারণ, পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্টি বিধান ছাড়াও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছিল সমাজের সকলের জন্য আয়ােজিত ভােজ, বিশেষত ব্রাহ্মণদের জন্য, যাদের গােমাংসের প্রতি আগ্রহ শাস্ত্রে পরিষ্কার বলা আছে। কোনাে কারণে মাংস না পাওয়া গেলে তবেই কেবল পিতৃপুরুষকে শাকসবজি উৎসর্গ করা যেত।
শ্রাদ্ধের মতােই অন্যান্য অনুষ্ঠানেও গবাদি পশু বলি দেওয়া হতাে সমাজের সকলের জন্য। যেমন, ব্রাহ্মণদের দ্বারা পালিত গবাময়ন নামক বৎসররের একটি নির্দিষ্ট সময়ের যজ্ঞানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য ছিল পশুবলি। এটি পরিসমাপ্তি ঘটতাে এক জাঁকজমকপূর্ণ মজাদার উৎসব মহাব্রত পালনের মধ্য দিয়ে, যেখানে মিত্রাবরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশে তিনটি বন্ধ্যা গাভী উৎসর্গ করা হতাে। এই খুশী-মজা-হুল্লোড়ের উৎসবটির শাস্ত্রীয় বর্ণনা থেকে মনে হয় যে আরও অনেক বেশি গবাদি পশু বলি দেওয়া হতাে। একই ভাবে, বিভিন্ন শ্রৌতসূত্র গুলিতে আলােচিত এবং পূর্বেকার ও পরেকার আচারগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত গৃহমেধ অনুষ্ঠানটি ছিল এক ধরনের প্রাচুর্যময় সামাজিক ভােজের অনুষ্ঠান যাতে কঠোরভাবে আচারগত বিধিনিষেধ না মেনেই নৃশংসভাবে ও অপবিত্র ভাবে অসংখ্য গরু হত্যা করা হতাে। বিশদ সাহিত্যিক প্রমাণাদি বিচার করে বলা যায়। যে এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই যে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের আদি আর্যরা এবং মধ্যগাঙ্গেয় অববাহিকায় তাদের উত্তরসূরীরা গরুসহ অন্যান্য গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীদের নিধন করত এবং প্রবল আয়েশ করে সেগুলির মাংস আহার করত। কোনাে একজন বৈদিক আচার্যের দ্বারা উপকর্মও উৎসর্জনের মধ্যবর্তী মাসগুলিতে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও, একটি ধর্মসূত্র অনুসারে গরু ও ষাঁড়ের মাংস পবিত্র এবং তা খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং, এটি বিস্ময়কর নয় যে মিথিলার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের প্রিয় খাদ্য ছিল গােমাংস। বলা হয়, তিনি এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন যে তিনি গরু ও যাঁড়ের মাংস ভক্ষণ করবেন ততদিন, যতদিন তা নরম (অংসল) থাকবে। যদিও তার কঠোর মনোভাব এও বুঝিয়ে দেয় যে ইতিমধ্যেই তার সময়ে গােমাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে অভিমত গড়ে উঠছিল।
অনেকগুলি প্রামাণিক সূত্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী গােমাংসসহ অন্যান্য গবাদি পশুর মাংস সাধারণভাবে আইনসঙ্গত খাদ্য ছিল। একটি শাস্ত্র অনুসারে যাঁড়ের মাংস উৎসর্গ করার উপযুক্ত, আরেকটি শাস্ত্র অনুসারে “ধর্মের কারণে বলিপ্রদত্ত পশুদের” পুরােহিতগণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণরা উভয়েই খেতে পারে। তবে এক স্থানে বলা হচ্ছে যে দুগ্ধবতী গাভী ও পূর্ণবয়স্ক ষাঁড়কে বিনা কারণে হত্যার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এজন্য একথা জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে যে সেসময়ে একমাত্র যজ্ঞে উৎসর্গকৃত, পবিত্র গােমাংস ও অন্যান্য পশুর মাংসই খাওয়া চলত। কিন্তু এ নিয়েও সংশয় আছে।
ঋকবেদে উল্লেখিত, শসন শব্দের অর্থ ‘জবাই করা’ বা ‘হত্যা করা’, এবং এই শব্দটির দ্বারা কসাইখানাকেই বােঝানাে হয়েছে, যার দ্বারা এ কথা বােঝানাে যায় যে দুগ্ধবতী গাভীসহ নানা ধরনের অপবিত্র মাংসও খাওয়া চলত।
বৈদিক আর্যরা পবিত্র ভেবে বা যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত রূপে যেভাবেই গােমাংস ও অন্যান্য পশুর মাংস আহার করুন বা না করুন, মূল ব্যাপার হলাে বৈদিক ও বৈদিকোত্তর যুগে গরুসহ অন্যান্য দুগ্ধবতী গবাদি পশু পবিত্র হিসাবে গণ্য হতাে না। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের অগ্ন্য/অগ্ন্যা (যাকে হত্যা করা হবে না) শব্দটি চারটি স্থানে “পুংলিঙ্গ বাচক বিশেষ্য পদ হিসাবে” যার দ্বারা যাঁড় বা বলদকে বােঝানাে হয়েছে এবং বিয়াল্লিশ বার গাভী অর্থে স্ত্রীলিঙ্গবাচক পদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বোত্তম ধর্মীয় তাৎপর্যবাহী সত্তা প্রসঙ্গে বিশেষ অভিধা, বা উপমা ও রূপক অলংকার হিসাবে গরু-বাচক শব্দের ব্যবহারের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যদিও এসবের দ্বারা প্রকৃত পশুটির প্রসঙ্গে প্রাথমিক ধ্যানধারণা গড়ে ওঠে না। দুই ধরনের প্রমাণের কোনটিই বৈদিক গরুর পবিত্রতার সাক্ষ্যবাহী নয়। অর্থাৎ এগুলি গরুর মুলত অ-হননযােগ্য প্রকৃতির প্রতি নির্দেশ করে না। বিপরীতক্রমে, এই উদাহরণগুলি গরুর অর্থনৈতিক মূল্যের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। বলিদত্ত গরু সাধারণ মানুষ ও তাদের পুরােহিতদের খাদ্য জোগায়, এবং শতপথ ব্রাহ্মণ দ্বিধাহীনভাবে জানাচ্ছে যে “মাংসই শ্রেষ্ঠ খাদ্য।” দোহন করলে গরু শুধু দুধের মধ্যে দিয়েই নয়, নানাবিধ দুগ্ধজাত দ্রব্যের মধ্য দিয়েও পুষ্টি জোগায়, এগুলি মানুষের খাদ্যের তথা বৈদিক যজ্ঞের নৈবেদ্যের (হবিয্য) অঙ্গ। গরু বলদের জন্ম দেয়, যা ভারবাহী পশু হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গবাদি পশুর চামড়া নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। গরুর চামড়ার দড়ি দিয়ে ধনুকের জ্যা তৈরী হতাে—এই অভ্যাস পরবর্তীকালে সম্ভবত চালু ছিল। রথের অংশ চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা হতাে, দড়ি দিয়ে রথদণ্ডের সঙ্গে তীরও বেঁধে রাখা হতাে। পশু চামড়ার জন্য ব্যবহৃত অঙ্কুশ তৈরী হতাে গরুর চামড়া ও লেজ দিয়ে। চামড়ার সরু তার দিয়ে কেবল ফাঁদ-ই তৈরী হতো না, তৈরী হতাে‘গােধা’ নামক এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। গবাদি পশুর উপযােগিতা ও গুরুত্ব যােদ্ধাদের যুদ্ধের (‘গবিষ্টি’) প্রেরণা জোগাত। সম্ভবত, বিজিত গােষ্ঠীগুলির গােসম্পদের একাংশ অভিযানগুলিতে নিহত হতাে। সমগ্র বৈদিক যুগে গরু অক্ষত থাকত এ জাতীয় জনপ্রিয় ধারণার বিরােধী এই তথ্যগুলি এবং এগুলি প্রমাণ করে যে যজ্ঞের প্রয়ােজনে, খাদ্য হিসাবে এবং অন্যান্য প্রয়ােজনে গরুকে হত্যা করা হতাে, যদিও অথর্ববেদের কিছু অংশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এইভাবে যে, “গোহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জোরালাে ছিল।”
সম্ভবত, ব্রাহ্মণের অধিকারভুক্ত হলে গরু অক্ষত থাকার কিছুটা সুবিধা অর্জন করতে পেরেছিল। এ কথা সুবিদিত যে ব্রাহ্মণ পুরােহিততে প্রদানের জন্য গরু-ই ছিল আদর্শ দক্ষিণা। দক্ষিণার (উত্তম দুগ্ধবতী গাভী) প্রতি বৈদিক ব্রাহ্মণের আগ্রহের বহু নিদর্শন আছে, যিনি এটি (দক্ষিণ) আটকে রাখবেন, বা এর ক্ষতি করবেন, বা বলপূর্বক ভােগদখল করবেন তার সর্বনাশ হবে, এবং যিনি এই দান করবেন তার সমধিক পুণ্যলাভ ঘটবে। অথর্ববেদের এক স্থানে আমরা একটি সর্তকবাণী লক্ষ করি: “রাজন (নৃপতি), দেবতাগণ তােমাকে ওটা (গরু) ভক্ষণের নিমিত্ত দেন নি, হে যােদ্ধা (রাজন্য), ব্রাহ্মণের গরু ভক্ষণের আশা কোরাে না, (গরুটি) ভক্ষণের নিমিত্ত নয়। (অনাদ্যম)।” সুতরাং মনে হয়, যদি গরুর মালিক হতেন কোনাে ব্রাহ্মণ বা তাঁকে দক্ষিণা হিসাবে তা দেওয়া হতাে, সেক্ষেত্রেই একমাত্র গরুটি কিছু পরিমাণ অক্ষত থাকতে পারত, যদিও যমজ শাবক প্রসবিনী গরুকে (যমিনী) অথর্ববেদে অশুভ মনে হয়েছে এবং কোনাে ব্রাহ্মণকে দেওয়া, হলে তাকে হত্যা করে যজ্ঞে উৎসর্গ করা হয়েছে। যাহােক, ব্রাহ্মণের গরু বিশেষ গুরুত্ব পেলেও তার দ্বারা বৈদিক গরুমাত্রই নির্বিশেষে পবিত্র তেমনটা বলা যায় না।
গরুসহ গবাদি পশু হত্যার বিষয়টি বিস্তৃত স্থান ও কালের ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ দ্বারা সমর্থিত হয়। ভারতের প্রখ্যাততম প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রয়াত এইচ.ডি. সাংকালিয়া’র মতানুসারে এক লক্ষ বছর থেকে দশ হাজার বছর পূর্বের প্লিস্টোসিন যুগের সমগ্র সময়কাল জুড়ে “অন্যান্য যে কোনাে পশুর তুলনায় গরু/যাঁড় বা বলদের হাড় অনেক বেশি পরিমাণে এবং বেশি স্থানে নদী ও অন্যান্য সঞ্চয়স্থলে আবিষ্কার করা গেছে।” পাথরের হাতিয়ারের সঙ্গে পাওয়া যাওয়ার এইসব হাড় সূচিত করে যে আদিম মানুষ খাদ্যের জন্য তাদের শিকার করত। এমনকি ভারতের মানুষ সভ্যতার একটি স্তরে পৌঁছে গিয়েও উদরপূর্তির প্রয়ােজনে তাদের শিকার করত। খননকার্য থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে হরপ্পা সভ্যতার । সৃষ্টিকর্তারা গবাদি পশুর মাংস খেত, যার স্বপক্ষে প্রাসঙ্গিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সিন্ধু প্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র এবং তটবর্তী গুজরাতে। হরপ্পার সাংস্কৃতিক এলাকার বাইরে প্রচুর পরিমাণে অবশেষ পাওয়া যায় যেগুলি তাম্রপ্রস্তর যুগের খাদ্য-সংস্কৃতির প্রতি দিক নির্দেশ করে, এগুলি গােমাংসসহ অন্যান্য গবাদি পশুর মাংস বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বৈদিক যুগ ও তার পরেও এই অভ্যাসের ধারাবাহিকতাকে প্রমাণ করে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা যে স্থানগুলিকে চিত্রিত ধূসরবর্ণের মৃৎপাত্রের প্রত্নক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করেছেন, এবং যে স্থানগুলির সাংস্কৃতিক সংগ্রহ প্রধানত পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্যরা ইন্দো-গাঙ্গেয় অববাহিকায় স্থিত হয়েছে, সেগুলি এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার ধারণা দেয়। যেমন, হস্তিনাপুরে (মীরাট) মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর, হাতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবাদি পশু যেগুলি আজকের মতােই ক্ষুদ্রাকৃতি, কূৰ্জ-বিহীন, ছােট আকারের শিঙ-বিশিষ্ট হতাে, তাদের অস্থি-অবশে মিলেছে। সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু খ্রিষ্টপূর্ব ১১শ শতক থেকে প্রায় খ্রি.পূ.৩য় শতকের মধ্যেকার। বহু অস্থি-অবশেষই হয় পুড়ে গিয়েছে অথবা সুনির্দিষ্ট কাটা-দাগবিশিষ্ট, যা থেকে মনে হয় এই পশুদের খাদ্যের জন্য জবাই করা হয়েছিল। আল্লাপুরে (মীরাট) প্রাপ্ত পরবর্তী বৈদিক যুদের বসতির খননকার্য থেকে পােড়া হাড়সহ শিঙ পাওয়া গেছে। এই ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ আরাে ভালােভাবে পাওয়া গেছে অত্রঞ্জিখেরা (এটা জেলা) অঞ্চলে, যেখানে প্রাপ্ত মােট দগ্ধ অস্থি-অবশেষের সংখ্যা ৯২৭। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ গরুর হাড়, সেগুলি প্রায়শই কাটা দাগবিশিষ্ট এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের। সুতরাং, মনে হয় যে গােমাংস একটি পছন্দসই খাদ্য ছিল, অবশ্য এর সঙ্গে অন্যান্য ধরনের মাংসও খাওয়া হতাে। হরিয়ানার ভগবানপুর (কুরুক্ষেত্র জেলা) অঞ্চলে গবাদি পশুর পােড়া হাড় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবে রােপার এলাকার চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির যুগের পরবর্তী পর্যায়ের (৬০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বসতিগুলিতে সম্প্রতি গৃহপালিত গবাদি পশু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর, ঘােড়া, কুকুর, মুরগি, কচ্ছপ ও চিতলের (হরিণ) হাড় মিলেছে যেগুলিতে কাটা দাগ ও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে, যার অর্থ হলাে মানুষের খাদ্যের প্রয়ােজনে এরা ব্যবহৃত হতাে। কৌতুহলের বিষয় হলাে, গবাদি পশুর রক্ষাকর্তা কৃষ্ণের নাম জড়িত মথুরার দ্বিতীয় পর্যায়ের মানব বসতি (আনুমানিক ৪০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকেও এই ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ মিলেছে। বস্তুত, এ পর্যন্ত খননকার্য হওয়া চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রগুলিতে সকল প্রকার অস্থিগত অবশেষের মধ্যে গবাদিপশুর হাড় সর্বাধিক মাত্রায় পাওয়া যাওয়ায় এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি যে খাদ্যের প্রয়ােজনে এবং খাদ্য-ভিন্ন অন্য অর্থনৈতিক ব্যবহারের জন্য গবাদিপশুকে গৃহস্থালিতে পালন করা হতাে। একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবস্তু রূপে গবাদি পশুর মাংসের ব্যবহারের যে নিদর্শন বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায় তার সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ খুব ভালােভাবে মিলে যায়।
বৈদিক ভারতীয়দের মধ্যে গবাদি পশুর হত্যা ও গােমাংসসহ অন্য প্রাণীর মাংস খাওয়ার রীতির যথেষ্ট থাকলেও যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত পশুর বিকল্প সন্ধানের ধারণা বৈদিক যুগেই গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। ঋকবেদের আমরা গবাদি পশুর আনুষ্ঠানিক হত্যার বিকল্প সন্ধানের প্রয়াস সম্পর্কে সূত্র পেয়ে থাকি। উপনিষদীয় গ্রন্থগুলিতে পশু বলিদানের ঈপ্সিত ফললাভ সম্পর্কে প্রশ্ন তোেলা হয়েছে এবং আত্মােপলব্ধি অর্জনের পন্থা হিসাবে কঠোর তপস্যাকে প্রাথমিক স্থান দেওয়া হচ্ছে। উপনিষদে যভঃবলির নূতন অর্থ সন্ধান করা হয়েছে এবং অহিংসা’র ধারণার প্রচলন করা হয়েছে, যদিও কোনাে কোনাে উপনিষদে যজ্ঞবলির রীতির প্রতি বন্ধুসুলভ মনােভাব দেখানাে হয়েছে, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বৈদিক বলিদানের প্রতি কোনাে ধরনের ব্যতিক্রমহীন বিরূপতা ছিল না।
কিন্তু, বৈদিক ও বৈদিকোত্তর সাহিত্যে আনুষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ডের সম্পর্কে মিশ্র ধরনের ধারণা থাকলেও সাধারণভাবে আনুষ্ঠানিক পশুহত্যার বিরুদ্ধে ঔপনিষদিক ধারণা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং তা সম্ভবত অহিংসার নীতি হিসাবে পূর্ণতা লাভ করল, যা বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ কথা সুবিদিত যে এই দুটি ধর্ম বৈদিক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে গবাদিসহ অন্যান্য পশুর বলিদানপ্রথার বিরুদ্ধে জোরালাে আপত্তি জানায় এবং স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক বসতি, রাষ্ট্রীয় সমাজ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। অবশ্য ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক যাগযজ্ঞাদি কমে গেলেও ভারতীয় খাদ্য তালিকা থেকে গবাদি পশুর মাংস বা অন্যান্য মাংসের সম্পূর্ণ অপসারণ ঘটেনি।
গরু সম্পর্কে অহিংসা নীতির প্রয়ােগ প্রসঙ্গে খুব বেশি কিছু বলা যায় না। গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর অহিংসার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন, যার প্রথম প্রকাশ সম্ভবত উপনিষদীয় ভাবনা ও সাহিত্যেও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বৈদিক পশুবলির তারা ঘােরতর বিরােধী হলেও তাদের কেউই অথবা তাদের শিষ্যরা মাংস খাওয়ার বিরােধী ছিলেন না।
জানা যায় যে বুদ্ধ গরু ও শূকরের মাংস খেতেন এবং সাহিত্যে প্রভূত প্রমাণ রয়েছে যে বৌদ্ধ-রসনায় মাংস ভালােভাবেই স্থান করে নিয়েছিল। পশুদের প্রতি যে অশােকের করুণার কথা অনস্বীকার্য, তিনিও তাঁর রন্ধনশালার জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট পশুর হত্যাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। বস্তুত, অশােকের অবধ্য পশুর তালিকায় কিংবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গরুকে অ-হননযােগ্য বলা হয়নি। সমগ্র মৌর্য যুগে খাদ্যের জন্য গবাদি পশু হত্যা করা হতাে।
বৌদ্ধধর্মের মতাে জৈনধর্মও অহিংসার পক্ষে সওয়াল করেছিল। কিন্তু বৈদিক ও বৈদিকোত্তর যুগে মাংসভক্ষণ এতই সাধারণ ছিল যে কথিত আছে জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর একবার একটি গৃহপালিত বাচ্চা মােরগের মাংস খেয়েছিলেন। সম্ভবত আদি জৈনরা কঠোরভাবে নিরামিষাশী ছিলেন না। অষ্টম শতকের মহান জৈন তার্কিক হরিভদ্রসূরি আমাদের জানাচ্ছেন যে গৃহস্থরা যে মাছ-মাংস দিতেন সেগুলি খাওয়ার প্রতি সন্ন্যাসীরা কোনাে আপত্তি ছিল না, যদিও জৈনধর্মে বিশ্বাসীদের মাংসাহার সম্পর্কে কঠোর নিষেধাজ্ঞার স্বপক্ষে অকাট্য সাহিত্যিক উদাহরণ রয়েছে। মাংসভক্ষণের বিরুদ্ধে জৈন মনােভঙ্গীর কঠোরতার শিকন জৈন দর্শনের মূল আদর্শগুলির মধ্যে গভীরভাবে নিহিত রয়েছে, যা অন্তত তত্ত্বগতভাবে, সকল প্রাণীকেই সমান চোখে দেখে এবং এতে গরুকে কোনাে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। অতএব, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম উভয়েই অহিংসা নীতির বিকাশে অবদান রাখলেও এ দুটির কোনটিই, স্বতন্ত্রভাবে ‘পবিত্র গরুর’ ধারণা গড়ে তােলেনি।
তিন
অহিংসার পক্ষে উপনিষদীয়, বৌদ্ধ ও জৈন সওয়াল সত্ত্বেও মৌর্য-পরবর্তী শতকগুলিতে আনুষ্ঠানিক প্রয়ােজন ও নির্বিচারে গবাদি পশুহত্যার অভ্যাস বজায় ছিল। স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রধানতম মনুস্মৃতিতে (খ্রি.পূ.২০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দে) আইনসঙ্গত ও নিষিদ্ধ খাদ্য সম্বন্ধে বহু আলােচনা রয়েছে, এতে পূর্বেকার স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মতােই ভক্ষণযােগ্য পশুমাংসের উল্লেখ রয়েছে। মনুর তালিকায় রয়েছে শজারু, গােসাপ, গণ্ডার, কচ্ছপ, খরগােশ ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু যেগুলির মাত্র একটি চোয়ালে দাঁত আছে, একমাত্র ব্যতিক্রম হলাে উট (পঞ্চম, ১৮)। তাৎপর্যপূর্ণ যে আহারযােগ্য পশুদের তালিকা থেকে গরুকেও বাদ রাখা হয়নি। মনুর মতে, বলিদানের জন্যই পশুদের সৃষ্টি হয়েছে, আনুষ্ঠানিক কর্মে পশুবধ হত্যা নয়, এবং বেদ-সমর্থিত হিংসা (বেদবিহিতহিংসা) যা আদতে হিংসা নয় (পঞ্চম, ৪৪)। দুর্যোগপূর্ণ সময়ের নিয়মাবলী সংক্রান্ত অধ্যায়ে মনু অতি প্রাচীন কালের সবচেয়ে ধার্মিক ব্রাহ্মণদের কিংবদন্তীসম উদাহরণগুলি স্মরণ করেছেন, যারা অনাহার-জনিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে বলদ ও কুকুরের মাংস খেতেন (দশম, ১০৫-৯)। মাংস-ভক্ষণ, মদ্যপান এবং যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মতাে। স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তিকে স্বীকৃতি দানের মধ্য দিয়ে মনুর খােলামেলা মনােভঙ্গী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যদিও তাঁর মতে সংযম পালনে বিপুল পুণ্যার্জন ঘটে (পঞ্চম, ৫৬)। মনু যেহেতু গােমাংস খাওয়াকে নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করেননি, তাই সিদ্ধান্ত করাই যায় যে তিনি গরুকে পবিত্র বলে মনে করেননি। অহিংসাকে গভীর প্রশংসা করে মনু নিজের মন্তব্যেরই বিরােধিতা করেছেন (দশম, ৬৩), কিন্তু এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই যে তিনি অন্তত উৎসব-অনুষ্ঠানে (মধুপর্ক, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি) মাংস খাওয়াকে অনুমােদন দিয়েছেন, যখন বৈদিক ও বৈদিকোত্তর রীতি বিধি অনুযায়ী গরুসহ অন্যান্য গবাদি পশুর মাংস (গোব্যজমাংস খাওয়া হতাে বলে তার (মনু’র) ব্যাখ্যাকর মেধাতিথি (নবম শতক) বর্ণনা করেছেন।
যাজ্ঞবল্ক্য (১০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দে) মনুর মতােই বিধিসম্মত ও নিষিদ্ধ খাদ্য সম্পর্কে নিয়মাবলী আলােচনা করেছেন। এ বিষয়ে তার আলােচনা সংক্ষিপ্ত হলেও মনুর থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলাদা কিছু তিনি বলেননি। যাজ্ঞবল্ক্য নির্দিষ্ট কয়েকটি পশু (হরিণ, ভেড়া, ছাগল, বরাহ, গণ্ডার প্রভৃতি) এবং পাখির (যেমন তিতির) উল্লেখ করেছেন, যাদের মাংস পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সন্তুষ্ট করত (প্রথম, ২৫৮-৬১)। তাঁর মতে, শিক্ষার্থী, শিক্ষাগুরু, রাজা, সুহৃদ এবং জামাতাকে প্রতি বৎসর অর্ঘ্য দান করা উচিত এবং পুরােহিতকে সকল আচার অনুষ্ঠানে মধুপর্ক দান করা উচিত (প্রথম,১১০)। তিনি আরাে নির্দেশ দিয়েছেন যে একজন জ্ঞানী ব্রাহ্মণকে (শ্রোত্রিয়া) একটি বৃহদাকৃতি বলদ বা ছাগল (মহােক্ষম বা মহাজম, বা শ্ৰোত্রিয়াযযাপকল্পয়েৎ), উপাদেয় খাদ্য এবং সুমিষ্ট ভাষণ দ্বারা অভ্যর্থনা করা উচিত। বেদ অনুমােদিত সব ধরনের পশুবলিকেই শাস্ত্রকাররা সাধারণভাবে বিধিসম্মত বলে মনে করেছেন। আমরা দেখেছি যে, গৃহপালিত গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীকে বলিদানকর্ম বৈদিক রীতিসম্মত ছিল এবং সেইজন্য খ্রিষ্টিয় শতকগুলির প্রথম দিকে এমনকি খ্রিস্টিয় প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগেও দীর্ঘকাল ব্রাহ্মণ্যবাদী মহলে তা যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। সুতরাং, এটি ধরে নেওয়া মােটেই বাস্তবােচিত হবে না যে আচার-অনুষ্ঠানে পশুবলি নিয়ন্ত্রণের ধর্মীয় উপদেশ ব্রাহ্মণরা, যাদের জন্য শাস্ত্রীয় নির্দেশ প্রযােজ্য ছিল, এবং সমাজের অন্যান্য অংশ সবসময় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছিল। অতএব বিস্ময়ের কিছু নেই যে স্থানীয় রীতিনীতি আলােচনা প্রসঙ্গে বৃহস্পতি বলেছেন যে, মধ্যদেশে কারিগররা গােমাংস খেয়ে থাকে (মধ্যদেশে কর্মকারাঃ শিল্পিনশ্চ গবাসিনঃ)।
মহাকাব্যের সাক্ষ্যপ্রমাণও এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন। মহাভারতের অধিকাংশ চরিত্রই মাংসভােজী, আরাে বলার কথা হলাে যে, রাজা রন্তিদেব, যার রন্ধনশালায় দৈনিক দুই হাজার গরু জবাই করা হতাে এবং তার মাংস ও শস্যদানা ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করা হতাে, সেই ঘটনা প্রশংসাসূচকভাবে বর্ণিত হয়েছে (তৃতীয়, ২০৮,৮-৯)। একইভাবে, বাল্মীকির রামায়ণে প্রায়শই খাদ্য ও যজ্ঞের প্রয়ােজনে গরু ও অন্যান্য প্রাণীহত্যার উল্লেখ রয়েছে। ধর্মশাস্ত্রঅনুসারে রামের জন্ম হয় পিতা দশরথের দ্বারা এক বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠানের পর, যাতে ভক্ষণীয় বলে ঘােষিত প্রচুর পশুকে জবাই করা হয়। বস্তুত ধর্মশাস্ত্র কর্তৃক আচার অনুষ্ঠানের পশুহত্যার অনুমােদন রয়েছে। যমুনা নদী পার হওয়ার সময় সীতা তাঁকে (যমুনাকে) আশ্বস্ত করেন যে রাম পিতৃসত্য পালন করতে সক্ষম হলে তিনি (সীতা) তাকে (যমুনাকে) এক সহস্র গাভী ও একশত পাত্র সুরা সহযােগে উপাসনা করবেন হরিণের মাংসের প্রতি সীতার আকর্ষণ এতই বেশি ছিল।
যে তিনি মৃগরূপী মারীচকে হত্যার জন্য তার স্বামীকে উত্তেজিত করেন। ভরদ্বাজ রামকে অভ্যর্থনা জানান তার সম্মানে একটি নধর বাছুরকে নিধন করে।
আমিযাশী খাদ্যরীতি প্রথমদিকে ভারতীয় চিকিৎসাসংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে স্থান করে নিয়েছে, যেগুলির সময়কাল মােটামুটিভাবে মনু ও যাজ্ঞবন্ধ্যের স্মৃতি ও দুটি মহাকাব্যের সময়কালের সঙ্গে মিলে যায়। চরক (খ্রি. ১ম-২য় শতক), সুশ্রুত (খ্রি. ৩য়-৪র্থ শতক) ও বাগভট্ট (খ্রি.৭ম শতক) নানা ধরনের মাছ ও মাংসের এক চিত্তাকর্ষক তালিকা দিয়েছেন এবং এরা তিনজনেই রােগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে গাে-মাংসের ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-নিরপেক্ষ সাহিত্যেও অনেককাল পরে পর্যন্ত গবাদি পশু ও অন্যান্য পশুর মাংস খাওয়ার নিদর্শন রয়েছে। গুপ্ত যুগে কালিদাস রন্তিদেবের কাহিনীর প্রসঙ্গ টেনেছেন, যিনি তাঁর রন্ধনশালায় দৈনিক অগণিত গরু হত্যা করতেন। দুশাে বছর পরে ভবভূতি ( ৭০০ খ্রিস্টাব্দে) অতিথি সৎকারের দুটি উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে একটি বাছুরকে হত্যা করা হয়েছিল। রাজশেখর (খ্রি. ১০ম শতক) অতিথির সম্মানে একটি বলদ বা একটি ছাগল হত্যা করার রীতির উল্লেখ করেছেন এবং সােমদেব (খ্রি.১১শ শতক) সাতজন ব্রাহ্মণ বলকের গল্প বলেছেন যারা একটি গরু খেয়েছিল (য. ১১৭-১; স্বাদশ শতকে শ্রীহর্য একটি চোখ-ধাঁধানাে বিবাহির ভোজসভায় পরিবেশিত বিভিন্ন ধরনের আমিষ পদের উল্লেখ করেছেন এবং গাে-হত্যার দুটি আগ্রহজনক নিদর্শনের উল্লেখ করেছেন, যদিও সেই শতকেই সােমেশ্বর অন্যান্য মাংসর তুলনায় শূকর-মাংসের প্রতি তার সুস্পষ্ট পছন্দ জানিয়েছেন।
চার
সংখ্যায় কম হলেও উপরিউক্ত নিদর্শনগুলি দেখিয়ে দেয় যে আনুমানিক দ্বাদশ শতক পর্যন্ত খাদ্যের জন্য পশুহত্যার প্রাচীন রীতি জারি ছিল। কাব্য সাহিত্যের ও প্রথম দিকের ধর্মশাস্ত্রগুলির ভাষাগুলি থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখায় যে অনেক পরের সময়কাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকরা এসব কথা স্মরণে রেখেছিলেন। ধর্ম-নিরপেক্ষ সাহিত্যের ভায্যকারদের মধ্যে গুজরাতের চাণ্ডুপণ্ডিত (১৩শ শতকের শেষভাগ), অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানার নরহরি (১৪শ শতক) এবং মল্লিনাথ (১৪শ-১৫শ শতক), যিনি বিদ্যানগরের (বিজয়নগর) রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে প্রাচীনকালে আচার অনুষ্ঠান তথা খাদ্যের জন্য গাে-নিধন করা হতাে। অনেক পরে ১৮শ শতকে তাঞ্জোরের জনৈক মন্ত্রী ঘনশ্যাম বলেছেন যে অতিথির সম্মানে গােহত্যা একটি প্রাচীন বিধি।
এইভাবে, নবম শতক থেকে ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্য ও ধর্মীয় সংহিতাগুলির রচয়িতারা গােমাংস ভক্ষণের প্রাচীন প্রথার স্মৃতিকে জাগরুক রেখেছেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ পরিস্থিতিতে গরুর মাংস খাওয়াকে অনুমােদন করেছেন। যেমন, মেধাতিথি (৯ম শতক), যিনি সম্ভবত একজন কাশ্মিরী ব্রাহ্মণ ছিলেন, বলেছেন যে কোনাে রাজা বা অন্য কোনাে সম্মানীয় ব্যক্তির সম্মানে একটি ষাঁড় বা বলদ হত্যা করা হত, এবং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে আচার অনুষ্ঠানে গােমাংস ভােজন (গােব্যজমাংসম) অনুমােদন করেছেন।
ধর্মশাস্ত্রের টীকা-ভাষ্য রচয়িতারা খ্রিষ্টিয় নবম শতক এবং তার পরেও গােমাংস ভােজনের স্মৃতি সদা জাগরুক রেখেছেন এমনকি তাদের কয়েকজন বিশেষ ক্ষেত্রে গাে-মাংস খাওয়া অনুমােদনও করেছেন। মালবের জনৈক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ (৯ম শতক), যিনি সম্ভবত শঙ্করের শিষ্য ছিলেন; আধুনিক কর্ণাটকের কল্যাণের নিকটবর্তী স্থানের অধিবাসী বিজ্ঞানেশ্বর (১১শ শতক); আরেকজন দক্ষিণী (দাক্ষিণাত্য) হরদত্ত (১২ শতক); গহড়বাল রাজার জনৈক মন্ত্রী লক্ষ্মীধর (১২শ শতক); দেবগিরির যাদবদের একজন মন্ত্রী হেমাদ্রি (১৩শ শতকের শেষার্ধ); সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের লােক নরসিংহ/ নৃসিংহ(১৪শ শতক) এবং গােপাচলের (গােয়ালিয়র) মিত্র মিত্র (১৭শ শতক) প্রাচীন যুগে অতিথি-আপ্যায়ন ও শ্রদ্ধের মতাে কোনে অনুষ্ঠানের গােহত্যার প্রথাকে সমর্থন করেছেন। সম্প্রতি ২০শ শতকে মিথিলার মদন উপাধ্যায় সুপ্রাচীনকালে আচার অনুষ্ঠানের দুগ্ধবতী গাভী হত্যার নিদর্শন তুলে ধরেছেন। সুতরাং, ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যাকাররা গােহত্যার প্রতি বিরাগ দেখালেও তারা সাধারণভাবে মেনে নিয়েছেন যে এটি একটি প্রাচীন প্রথা যা কলিযুগে পরিহার করা দরকার।
পাঁচ
উপরিউক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ গােমাংস ভােজনের প্রথার ধারাবাহিকতার নির্দেশক। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগ থেকে শাস্ত্রবিদরা এই প্রথার প্রতি অনুৎসাহ দেখাচ্ছিলেন। ওই সময় থেকে ভারতীয় সমাজ ধীরে ধীরে সামন্ততান্ত্রিক হয়ে পড়েছিল যার পরিণতিতে বড়সড় সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। রূপান্তরের এই পর্বটিতে, যেটিকে মহাকাব্য ও পৌরাণিক রচনায় কলিযুগ বলে প্রথম বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সময় বহু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এবং সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কারের রূপান্তর ঘটে। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে পূর্বতন। বহু প্রথা সম্পর্কে আলােচনা করা হয় যেগুলি কলিযুগে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল, এই প্রথাগুলি কলিবর্জ্য নামে পরিচিত হলাে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলিবর্জ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল, প্রাসঙ্গিক গ্রন্থগুলির অধিকাংশগুলিতেই কলিতে গােহত্যা নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করা হলাে। কোনাে কোনাে আদি মধ্যযুগীয় শাস্ত্রবিদের মতে গােহত্যাকারী হলাে অস্পৃশ্য, এমনকি তার সঙ্গে কথা বললেও কোনাে ব্যক্তির পাপ হয়। তবে, উল্লেখযােগ্য যে তাদের অনেকে এই সব কাজকে হাতের আঙুল দিয়ে দাঁত মাজা, এবং কেবল নুন বা মাটি খাওয়ার মতাে ছােটখাটো ব্যবহারগত বিচ্যুতি ছাড়া বিশেষ কিছু মনে করেননি।
বস্তুত লক্ষ্যনীয় বিষয় যে প্রায় সকল শাস্ত্রীয় বচনেই গরু হত্যাকে লঘু পাপ (উপপাতক) হিসাবে দেখেছে, এদের কোনটিই এই কাজকে গুরু পাপ (মহাপাতক) বলে বর্ণনা করেনি। উপরন্তু, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত গােহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হতে স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে, প্রায়শ্চিত্তের সহজ পথ খুলে রাখা হয়েছে। এর অর্থ হতে পারে এই যে, গবাদি পশু হত্যা সমাজে অপ্রচলিত ছিল না, গবাদি পশুর মাংস খাওয়া থেকে মানুষকে অনুৎসাহিত করতেই কেবল প্রায়শ্চিত্তের কথা বলা হত। ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ কতদূর কার্যকর ছিল তা অনুমানের বিষয়, কারণ কিছু লােক গােপনে গােমাংস খেত এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছয়
আদিমধ্যযুগ থেকে গােহত্যা ও গােমাংস ভক্ষণ ক্রমশ পাপ এবং দূষণের উৎস হিসাবে দেখা হলেও গরু ও গাে-জাত বস্তুগুলি (দুধ, দই, ঘি, গােবর ও গােচানা) বা তাদের মিশ্রণ, যাকে পঞ্চগব্য বলা হতাে, বহুপূর্ব থেকেই শােধনকারী-ভূমিকা অর্জন করেছিল। বৈদিক সাহিত্যে আচার-অনুষ্ঠানে গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহারের উল্লেখ থাকলেও বৌধায়ন ধর্মসূত্রে প্রথম পঞ্চগব্য শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে। মনু, বিষ্ণু, বশিষ্ঠ, যাজ্ঞবল্ক্য এবং পরবর্তীকালের একাধিক ধর্মশাস্ত্রও যেমন অত্রি, দেবল ও পরাশরের বিধানে শােধন ও প্রায়শ্চিত্তের জন্য গরুর দ্রব্যের মিশ্রণ ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। ভাষ্য ও ধর্মীয় টীকাগুলি, যা অধিকাংশই মধ্যযুগে রচিত, পঞ্চগব্যের শােধনকারী ভূমিকা সম্বন্ধে ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত ধারণাটি হলাে পঞ্চগব্য পবিত্র বস্তু। কয়েকটি নারী ও নিম্ন বর্ণের দ্বারা এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কোনাে শূদ্র যদি পঞ্চগব্য পান করে তাকে সে নরকে যাবে।
কৌতুহলের বিষয় যে উপদেশমূলক শাস্ত্রগ্রন্থে, যেখানে গরুর শােধনকারী ভূমিকা সম্পর্কে বারংবার উল্লেখ আছে, সেগুলি এই প্রাণীটির সঙ্গে দূষণ ও অশুদ্ধতার ধারণার বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছে। মনু’র (পঞ্চম, ১২৫) মতে, গরুতে যে খাদ্য শুঁকেছে তাকে শােধন করতে হবে। অন্যান্য শাস্ত্রবিদ যেমন, বিষ্ণু (ত্রয়োবিংশ, ৩৮) ও যাজ্ঞবল্ক্য (প্রথম, ১৮৯) একই ধরণের মত প্রকাশ করেছেন। বস্তুত দ্বিতীয় জন (যাজ্ঞবল্ক্য) বলেছেন যে ছাগল ও ঘােড়ার মুখ শুদ্ধ হলেও গরুর মুখ শুদ্ধ নয়। অঙ্গীরস, পারশর, ব্যাস প্রমুখের রচিত পরবর্তী ধর্মবিদানগুলির গরুর মুখ যে অশুদ্ধ তা সমর্থন করে। শাস্ত্রবিদ শঙ্খ নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে মুখ ছাড়া গরুর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শুদ্ধ। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রগুলির ভাষ্যগুলিও গরুর মুখের অশুদ্ধতার ধারণাকে পুষ্ট করে। এসবই গরুর শােধনকারী ভূমিকার ধারণার বিপরীতে যায়।
গােরুর সম্পর্কে দ্ব্যর্থক ও পরস্পরবিরােধী মন্তব্য সত্ত্বেও এর পবিত্রতা ও অ-হননযােগ্যতাকে ‘হিন্দুধর্মে’র চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য বলে হিন্দুত্ববাদী শক্তি ঢাক পেটাচ্ছে। ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশের কার্যকরিতার প্রসঙ্গটি অনুমানের বিষয়, কিন্তু সমাজের কিছু লােক যে গােমাংস খেত তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক কালে উনিশ শতকের শেষদিকে স্বামী বিবেকানন্দের বিরুদ্ধে আমেরিকা প্রবাসকালে গােমাংস ভােজনের অভিযােগ করা হয়েছিল, যদিও তিনি জোরালােভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। একইভাবে, বিংশ শতকের গােড়ার দিকে মহাত্মা গান্ধী হিন্দুদের ভণ্ডামির কথা বলেছেন যারা “অসুস্থতার সময়… চিকিৎসকরা গােমাংস-মিশ্রিত চা পানের উপদেশ দিলে তা নিয়ে বিশেষ দ্বিধা বা প্রশ্ন করেন না।” আজও সারা দেশজুড়ে দলিতদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে, যে কারণে দেশের বহু স্থানে উচ্চ বর্ণের লােকেরা একে অশুদ্ধ ও দূষণীয় বলে মনে করেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে গােমাংস একটি প্রচলিত খাদ্য সামগ্রী,ঐ অঞ্চলে এটিকে দূষণকারী বলে মনে করা হয় না। একথাও অনেকাংশে সত্যি যে সর্বদক্ষিণের কেরল রাজ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ, যার মধ্যে ৭২টি হিন্দু সম্প্রদায় রয়েছে (ব্রাহ্মণরা ছাড়া), ব্যয়বহুল ভেড়া বা ছাগলের মাংসের তুলনায় গরুর মাংস বেশি পছন্দ করেন, যদিও হিন্দুত্ববাদীরা তাদের এ বিষয়ে বিরত থাকতে বলে। ২০০০ সালের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে যে মাংস বৎসরে সর্বাধিক উৎপাদিত হয় তা হলাে গরুর মাংস (১৪ লক্ষ ৪০ হাজার টন) এবং মহিষের মাংস (১৪ লক্ষ ২০ হাজার টন) এবং ভারতে থাপিছু গােমাংস/মহিষ-মাংস খাওয়ার পরিমাণ ২.৮ কেজি, যা মাছ খাওয়ার পরিমাণের অর্ধেক হলেও ভেড়ার মাংস, শুকর মাংস ও হাঁস-মুরগীর মাংসের গড়পড়তা পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি। এটি নির্দেশ করে যে হিন্দুসহ সকল ধর্মের মাংসভােজীদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়া বেশ চালু ব্যাপার—এই তথ্যটি দেশের বিভিন্ন অংশের কসাইদের মধ্যে করা সমীক্ষা দ্বারা সমর্থিত হয়।
সুতরাং, বলাই বাহুল্য, ভারতীয় সাহিত্যিক ঐতিহ্য, বিশেষত ব্রাহ্মণবাদী—ধর্মশাস্ত্রীয় রচনাবলীতে, কয়েক শতক ধরে গরুর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তা বহুমাত্রিক। কয়েক সহস্ৰআব্দ ধরে গড়ে ওঠা এর গল্পে নানা অসঙ্গতি রয়েছে এবং তা সবসময় সমাজে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গরুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তা হত্যা হিসাবে গণ্য করা হয়নি। যখন একে হত্যা করা হয়নি তখন ব্রাহ্মণরা একে হত্যা করার প্রাচীন প্রথার কথা ভেবে সন্তোষ লাভ করেছেন। পাঁচটি গব্য পদার্থ যার মধ্যে মলমূত্র রয়েছে, তা পবিত্র, কিন্তু গরুর মুখকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়নি। তা সত্ত্বেও এই ধরনের অসংগতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভ্রান্তিকর স্ববিরােধের মধ্য দিয়ে ভারতীয় গরু কষ্টকর ভাবে পবিত্রতা অর্জন করেছে এবং এর প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধাকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি “হিন্দুধর্মের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য” হিসাবে দেখিয়েছে, যদিও গরু কোনাে দেবীর মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এবং তার সম্মানে কোনাে মন্দিরও নির্মাণ করা হয়নি। বরং বিপরীতক্রমে, প্রায়শই একে সাধারণ মােটরগাড়ি, বিলাসবহুল লিমুজিনের মধ্যে এলােমেলাে চলে যানজট সৃষ্টি করতে এবং আবর্জনার স্তুপ ঘাঁটতে দেখা যায়। তাই বিস্ময়কর নয় যে গরুর পবিত্রতা হল হিন্দু সত্তার মতােই মরীচিকা মাত্র।
[দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা হলেন ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। এর সাথে তিনি Indian Council of Historical Research এর একজন সম্মানীয় সদস্য। দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস খাওয়া নিয়ে ‘Myth of the Holy Cow’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটি লেখার জন্য হিন্দু মৌলবাদীরা তাঁকে খুনের হুমকিও দিয়েছিল। সকলকে অবশ্যই দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা এর Myth of the Holy Cow বইটি পড়া উচিত যাঁরা মনে করেন হিন্দুধর্মে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ]