লিখেছেনঃ ফ্রেডারিক এম ওয়াটকিনস
জার্মান সমাজতন্ত্রীরা উইমার রিপাবলিককে রক্ষা করার জন্য তাদের নিজেদের সংখ্যালঘু বৈপ্লবিক অংশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে, তাদের এ সিদ্ধান্ত শুধু তৎকালীন তাৎপর্যের দিক থেকে নয়, বরং অনাগত ঘটনার ইঙ্গিত হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় অনেকেই সেটাকে স্থানীয় সংঘাতের বেশী কিছু নয় মনে করেছিলেন। কিন্তু শীই সেটা উনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতির সবচেয়ে জটিল একনায়কত্ব ও গণতন্ত্রের সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। শাসনতান্ত্রিক সরকারের নীতি স্বীকার করে নিয়ে অধিকাংশ সমাজতন্ত্রী দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনসমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার আনুকুল্য করার জন্য অন্যান্য দলের সাথে যােগদান করে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রীদের সংখ্যালঘু অংশ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার সামান্য কিছু আগে বিপ্লবী মার্কসবাদীরা জারশাসিত রাশিয়ায় সরকার উৎখাতের কাজে সাফল্য লাভ করে। সেখানে তারা জনসমর্থনের ভিত্তির পরিবর্তে ক্ষুদ্র, সুসংগঠিত বুদ্ধিজীবীদল, কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিতে “সর্বহারার একনায়কত্ব” নামে পরিচিত নতুন সরকার গঠন করে। জার্মানীতে কমিউনিজম ব্যর্থ হলেও, রাশিয়ায় এর সাফল্যের ফলে সংখ্যালঘুদের বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে সরকার গঠনের বহু ভবিষ্যৎ পরীক্ষার ভিত্তি তৈয়ার হলাে। সে সময় থেকে শাসনতান্ত্রিক সরকার ও একনায়কত্বের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান কখনাে হয় নাই।
আধুনিক একনায়কত্বের প্রকৃতি ও তাৎপর্য বুঝার জন্য পাশ্চাত্য জগতের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র হতে বেরিয়ে উপনিবেশবাদের সমস্যা বিবেচনা করা প্রয়ােজন। শিল্প পবিপ্লবের অন্যতম সুদূরপ্রসারী পরিণতি হলো পাশ্চাত্য জগতের বাইরের জাতিসমূহকে দ্রুত, অথচ সক্ষম পাশ্চাত্মীকরণ। বিশ্বের আদিম অথবা চৰ্চাশীল কোন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পক্ষেই আধুনিক কারিগরি বিদ্যার শক্তির সামনে দীর্ঘকাল থাকা সম্ভব ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের অধিকাংশ লােকই ইউরােপীয় সভ্যতার চাহিদা অনুসারে জীবনধারাকে রূপান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিল। স্বল্প কয়টি দেশ, তাদের মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য জাপান, বিদেশী আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করে স্থানীয় নেতাদের পরিচালনাধীনে আধুনিক হয়ে উঠতে পেরেছিল। সাধারণভাবে শিল্পে অনপ্ৰসর দেশগুলি কোন-না-কোন ইউরােপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির নিকট পরাজয় স্বীকার করেছে এবং তাদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা একনায়কত্বেই অনুকুল। পাশ্চাত্য অথবা পাশ্চাত্যপ্রভাবান্বিত বুদ্ধিজীবীরা উন্নততর সভ্যতার নামে অবশিষ্ট জনসমষ্টির উপর স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করেছেন, এবং অনুন্নত ‘নেটিভ’দের আধুনিক শিল্পায়নের চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করেছেন। যে সময় পাশ্চাত্য দেশগুলো নিজেরা শাসনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, সে সময় অন্যান্য দেশে তারা যে-সব সরকার কায়েম করে, তা এক নতুন ধরনের স্বৈরতন্ত্র, পাশ্চাত্য প্রভাবান্বিত বুদ্ধিজীবীদের একনায়কত্ব।
॥ জারশাসিত রাশিয়ার অবস্থা ॥
যুদ্ধপূর্ব রাশিয়ায় জারতন্ত্র এ ধরনেরই এক সরকার ছিল। পিটার দি গ্রেটের সময় থেকে দু শতাব্দীরও বেশীকাল ধরে রাশিয়ায় পাশ্চাত্মীয়করণের চেষ্টা চলেছিল সত্য, তবে অবস্থার পূর্ণরূপান্তরের তখনাে অনেক বাকী ছিল। জাপানের ন্যায় রাশিয়া নিজের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখা, এমন কি বিশ্বরাজনীতিতে বৃহৎ শক্তির ভূমিকা গ্রহণের উপযােগী যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিল। অতীত শতাব্দীতে রাশিয়া টলস্টয় ও মেণ্ডেলীভের ন্যায় প্রতিভার জন্ম দিতে পেরেছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতায় তাদের সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক অবদান কাহারাে তুলনায় কম নয় বলে স্বীকৃত হয়েছিল। এসব সত্ত্বেও রাশিয়া তখনাে অনগ্রসর দেশ ছিল। রাশিয়ায় আধুনিক শিল্প তেমন ছিল না এবং যা ছিল সেটাও বিদেশী পুঁজিপতি ও কারিগরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। জনসমষ্টির অধিকাংশই পশ্চাদমুখী ও অক্ষর জ্ঞানহীন কৃষক ছিল। তাদের জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্পর্শ লাগে নাই। এ কৃষক সমাজের সাথে পাশ্চাত্যপন্থী উচচশ্রেণীর সৌসাদৃশ্য কিছুই ছিল না। জনশক্তির আওতার বাইরে ঔপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ন্যায়ই জারতান্ত্রিক সরকারের হাতে সমস্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল। সর্বোপরি অন্যতম পাশ্চাত্য জাতির মর্যাদা লাভের জন্য রাশিয়ার আরাে অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার ছিল।
রাজনৈতিক দিক থেকে এ পরিস্থিতিতে উচচশ্রেণীতে বৈপ্লবিক অনুপ্রেরণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছিল। কোন কোন জার রাশিয়াকে আধুনিকীকরণের আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তবে স্বৈরাচারী হিসাবে তাদের কর্তৃত্ব পুরানাে ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং আধুনিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশের ফলে তাদের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়া অবশ্য স্তাবী ছিল, ফলে তাঁদের অমূল সংস্থারের আগ্রহ সীমিত হয়ে থাকে। কাজেই, আধুনিকীকরণের কাজ চলতে থাকলে তার অধিক প্রগতিশীল রাশিয়ানদের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতে থাকেন, এবং রাজ্য শাসনের কাজ রক্ষণশীল অভিজাতদের উপর ন্যস্ত করতে থাকেন। এতে তাঁরা নৈরাশ্যজনক অবস্থায় গিয়ে পড়েন। জারের সরকার ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ার ক্ষয় রােধ করে প্রাচীনপন্থী শ্রেণীর আনুগত্য অক্ষুন্ন রাখার উপযােগী যথেষ্ট রক্ষণশীল ছিলেন না, অন্যদিকে রক্ষণশীলতার জন্য আধুনিকপন্থীদের সন্তুষ্ট রাখাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাশ্চাত্য জাতিসমূহের সাথে তুলনা করতে গিয়ে তারা নিজেদের দেশকে অনেক পশ্চাদপদ দেখতে পেত। সমকালীন সামরিক কলাকৌশলের ব্যবহারে সদ্য আধুনিকীকৃত জাপান সাম্রাজ্য রাশিয়া অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ, ১৯০৩ সালের রুশজাপান যুদ্ধে সেটা প্রমাণিত হওয়ার পর অসন্তোষ বিশেষভাবে তীব্র হয়ে ওঠে। এতে প্রগতিশীল রাশিয়ানরা ধিকৃত জার সরকার হতে বিচ্ছিন্ন এবং বিপ্লবী চিন্তাধারা গ্রহণের উপযােগী হয়ে ওঠে।
॥ রাশিয়ায় মার্কসবাদ ॥
তখনকার মনােভাবের ফলে উনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার পক্ষে পাশ্চাত্য দেশসমূহের দিকে জ্ঞানের জন্য তাকানাে স্বাভাবিক ছিল। ইউরােপীয় চরমপন্থী মতবাদের নতুন রূপ হিসাবে মার্কসবাদের উদ্ভব ঘটলে রাশিয়ায় অনেকে সাগ্রহে সেটাকে নিজেদের সমস্যার সমাধান হিসাবে গ্রহণ করলাে। মার্কস ও এ্যাঙ্গেলসের রচনাবলী প্রায় লেখার সাথে সাথে রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, এবং জারতন্ত্রী রাশিয়ায় কঠোর বাধানিষেধ থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল। কিছুসংখ্যক রাশিয়ান প্রথম দিকেই বিপ্লবী মার্কসবাদের সমর্থক হয়ে পড়ে। যুদ্ধপূর্বকালীন সমাজতন্ত্রী আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছােট হলেও ক্রমে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল।
দুর্ভাগ্যবশত রুশ দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে মার্কসবাদ নিরুৎসাহব্যঞ্জক তত্ত্ব ছিল। আধুনিক শিল্পবিপ্লবের পরিণত পর্যায়ে যে সব অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, সে সব অবস্থার উপর তারা তাদের ভবিষ্যতের আশা গড়ে তুলেছিল। পূর্ণবিকশিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অস্থিত্ব রয়েছে, এ ধারণা হতেই মার্কস তাঁর তত্ত্ব, শুরু করেছিলেন। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হতে এত অধিক সংখ্যক শ্রমিকের সৃষ্টি হবে যে সংখ্যায় তারা অন্য শ্রেণীকে অতিক্রম করে যাবে এবং নিছক এ সংখ্যাশক্তিতেই তারা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণীর উৎখাত সাধনে সক্ষম হবে। এ বিশ্বাসের ফলেই আসন্ন বিপ্লব সম্পর্কে মার্কস আস্থাশীল হয়ে উঠেন। যুদ্ধপূর্ব রাশিয়ায় এর কোনটাই প্রযােজ্য ছিল না, কারণ রাশিয়া তখনাে পুঁজিবাদ পূর্বকালীন অবস্থায় ছিল। কৃষক ও জমিদার পরিপূর্ণ রাশিয়ায় কারখানা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং পুঁজিপতিদের সংখ্যা আরাে নগণ্য ছিল। তাদের পক্ষে শাসকশ্রেণী হয়ে ওঠা ছিল বহুদূরের কথা। কাজেই দ্বান্দ্বিক নীতি অনুসারে দেখা যায় যে সেখানে সর্বহারা বিপ্লব সম্পর্কে আশাপােষণের পূর্বে পূজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করা দরকার ছিল। শ্রেণীহীন সমাজের জন্য আগ্রহশীল যে-কোন ব্যক্তির পক্ষে অবস্থাটি খুবই নৈরাশ্যজনক ছিল।
॥ লেনিনের আরিক্ৰিয়াঃ টোট্যালিটেরিয়ান পার্টি ॥
কিন্তু রুশ-বিপ্লবের নেতা, বৈপ্লবিক মার্কবাদী লেনিন এ অবস্থা স্বীকার করে নিলেন না। পুরোপুরি পাশ্চাত্য প্রভাবান্বিত মধ্যবিত্তশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী লেনিন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা ধ্বংস করার কাজে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, এবং তাঁর বৈপ্লবিক অভিলাষ খর্ব করার মতো যে-কোন কিছুর তিনি ঘাের বিরােধী ছিলেন। ঘটনাপ্রবাহের মাঝে দেখা গেছে যে সুকৌশল রাজনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের প্রতিভা তাঁর ছিল। তীক্ষ রাজনৈতিক বুদ্ধির ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বৈপ্লবিক সঙ্কট সৃষ্টিতে বিল করা যায় না। সত্য যে রুশ শ্রমিকরা দুর্বল, তবে পুঁজিবাদী শ্রেণীর মােকাবিলা করতে হবে, তারা আরাে দুর্বল। রুশ রাষ্ট্রশক্তির অবােগতির মাঝেই বিপ্লবের যথার্থ চাবিকাঠি রয়েছে। যুগযুগান্তরের অক্ষম স্বৈরাচারের ফলে জারসরকার তাদের শেষ সমর্থকদের নিরুৎসাহ অথবা বিরুদ্ধভাবাপন্ন করে তুলছেন। এমন নড়বড়ে সংগঠনের পতন ঘটাবার জন্য দুর্বল শক্তিই যথেষ্ট। একটি ছােট, অথচ নিষ্ঠাবান দল যদি বৈপ্লবিক কার্যক্রমের জন্য তৈয়ার হয়, তাহলে সরকারের পতন ঘটাবার অনুকূল সুযােগ হয়ত শীঘ্রই পেয়ে যেতে পারে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কার্যক্রমে অনভিজ্ঞ একটি দেশে এতে দীর্ঘস্থায়ী বিশৃংখলা চলতে পারে। এ অবস্থায় অত্যন্ত সুসংগঠিত থাকার ফলে একটি সংখ্যালঘু বৈপ্লবিক দল অন্তত সাময়িকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবে। এ পরিণতির জন্য প্রস্তুত হওয়াই রুশ মার্কসবাদের লক্ষ্য বলে লেনিন মনে করতেন।
এ চিন্তাধারা অনুসরণ করে লেনিন একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক দল, টোট্যালিটেরিয়ান পার্টি উদ্ভাবন করেন। গণ-নির্বাচকমণ্ডলীকে পরিচালিত করার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন অপরিহার্য বলে দীর্ঘকাল হতে স্বীকৃত হয়ে আসছিল। পশ্চিম ইউরােপে লক্ষ লক্ষ সমর্থক সমবায়ে গঠিত সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ সে সময় ছিল। রাশিয়ায় শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সংগঠনকে নির্মমভাবে দমন করা হত। কাজেই সেখানে বিরাট গণপ্রতিষ্ঠান গঠনের আশা পােষণের উপায় ছিল না। রাজনীতিতে লেনিনের মৌলিক অবদান এই যে ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে বিপ্লবী প্রয়ােজন ভালােভাবে হাসিল করা সম্ভব বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার প্রথম দিকের রচনা, ‘হোয়াট ইজ ট, বি ডান’-এ তিনি নতুন ও যথার্থ বৈপ্লবিক ধরনের রাজনৈতিক দলের কাঠামাে নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে দলের আয়তন প্রাথমিক বিবেচনার বিষয় নয়। রকমারি সমর্থকদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত না করে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পূর্ণরূপে বাছাই করা সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর সদস্য পেশাদার বিপ্লবীরা পার্টি প্রােগ্রামের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করবে এবং সুশিক্ষিত সেনাদলের ন্যায় পার্টি নেতাদের নির্দেশ বিনাবাক্যব্যয়ে পালন করবে। এ সুনিয়ন্ত্রিত বুদ্ধিজীবীদের কাজ হবে অন্য গণপ্রতিষ্ঠানে অনপ্রবেশ করে নেতৃত্ব গ্রহণের চেষ্টা করা এবং ক্ষমতা প্রয়ােগের জন্য সে সব দলকে ‘সংযােগসূত্র” হিসাবে ব্যবহার করা। এভাবে ছােট কেন্দ্রীভূত দল বাইরের বিপুলসংখ্যক লােকের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রিত করতে এবং বিপ্লবের পথে তাদের পরিচালিত করতে সমর্থ হবে। এটাই লেনিনের তত্ত্ব, এবং কাজের লােক হিসাবে এটাকে তিনি বাস্তবে প্রয়ােগ করতে অগ্রসর হন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বাধীনে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি আধুনিক টোট্যালিটেরিয়ান পার্টির প্রথম নিদর্শন হয়ে ওঠে।
॥ গোঁড়া মার্কসবাদের সাথে লেনিনবাদের সমন্বয়ের সমস্যা ॥
লেনিন বৈপ্লবিক উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সুশৃংখল স্বল্পসংখ্যক পার্টি সদস্যের উপর নির্ভর করায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দিকে সমকালীন প্রবণতার তিনি ঘাের বিরােধী। অবশ্য গণতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের নিজের মতের অস্পষ্টতার ফলে কমিউনিস্টদের পক্ষে লেনিনের নীতিকে গোড়া মার্কসবাদ অনুসারে ব্যাখ্যা সম্ভব হয়েছিল। যদিও পর্বে আমরা দেখেছি যে মার্কস ও এ্যাঙ্গেস আসন্ন বিপ্লবকে সাধারণত গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন, তবে তারা ভবিষ্যৎশহারা শাসনের প্রকৃতি বুঝাবার জন্য কখনাে কখনাে ‘একনায়কত্ব’ শব্দ, তাছাড়া ‘শ্রেণীসচেতন সর্বহারা’ ও ‘সর্বহারাদের অগ্রপথিক’ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন। এতে মনে হতে পারে, যে বৈপ্লবিক পদ্ধতির বাছাই-করা স্বল্পসংখ্যক মতের তার সমর্থক। লেনিন ও তার উত্তরাধিকারীরা মার্কসীয় তত্ত্বের এদিকটি গ্রহণ করেছেন, এবং এটা আরাে সম্প্রসারিত করেছেন। পেশাদার বিপ্লবী সমবায়ে গঠিত তাদের পার্টিকে সর্বহারাদের যথার্থ অগ্রপথিক বলে চিহ্নিত করে রুশ কমিউনিস্টরা দাবী করতে থাকে যে সর্বহারাশ্রেণীর সবচেয়ে অগ্রসর ও শ্রেণীসচেতন অংশ ছিসাবে গােটা সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষ হতে কথা বলার এবং সমগ্র সমাজের উপর সর্বহারার একনায়কত্বের কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করার অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। মার্কসবাদের এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে এটা প্রশ্ন করা বাহুল্য হয়ে ওঠে যে সর্বহারাশ্রেণীর জনসংখ্যার অধিকাংশ এর সমর্থন অর্জন করেছে কিনা, এমন কি, সর্বহারাশ্রেণীর মাঝে পাটি নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত কিনা। যা দরকার, সেটা হচ্ছে, পার্টির যথাযােগ্য বৈপ্লবিক সদস্যদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, এবং সর্বহারাদের পক্ষ হতে কার্যকরী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে সে-ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে হবে।
গোঁড়া মার্কসবাদের দিক থেকে অবশ্য একটি উদ্ভট প্রশ্নের জওয়াব এখনাে বাকী রয়ে গেছে। “বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের” মূলনীতি হলাে দ্বান্দ্বিক জড়বাদ এবং এ মূলনীতির ফলেই এটা নিছক কল্পনাবিলাসী সমাজবাদ হতে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। পরিপূর্ণরূপে বিকশিত পজিবাদী অর্থনীতির অস্তিত্বের উপরই অনিবার্য সর্বহারা বিপ্লব ও শ্ৰেণীহারা সমাজের অভুত্থানের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত। জারশাসিত রাশিয়ায় অর্থনীতি স্পষ্টত পূজিবাদপূর্বকালীন অবস্থায় ছিল। কাজেই এ সিদ্ধান্তই যুক্তিসঙ্গত মনে হবে যে সেদেশে বিপ্লবের উপযুক্ত সময় তখনও আসে নাই। কাজেই রুশ মার্কসবাদীরা তাদের নিজেদের মতবাদের একটি মৌলিক নীতি লংঘন করে কী করে বিপ্লবী তৎপরতায় আত্মনিয়ােগ করতে পারে ?
॥ সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব ॥
লেনিনের ‘সাম্রাজ্যবাদ’-এ রচনায় এ প্রশ্নের জওয়াব দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের অনেক আগে হতেই শিল্পে অত্যন্ত অগ্রসর ইউরােপীয় দেশসমূহ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। মার্কসীয় দিক হতে ব্যাখ্যা করে লেনিন বলেন যে এটা পুঁজিবাদের ক্ষয়ের বিশেষ লক্ষণ। ক্রমবর্ধমান হারে উৎপাদিত পণ্যের জন্য স্বদেশে বাজার না পেয়ে শিল্পােন্নত দেশসমূহ কিছুকাল উপনিবেশের বাজার দখল করে ঠিকে থাকবে। উপনিবেশের উদ্বৃত্ত শ্রম ব্যবহার করে পাশ্চাত্য পুঁজিপতিরা স্বদেশে শ্রমশক্তির উপর শােষণ না চালিয়েও মুনাফা অর্জনে সমর্থ। মার্কসের মূল ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে নিজেদের শ্রমিকদের মজুরী ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে না এনেও এভাবে পাশ্চাত্য পুঁজিপতিরা সম্প্রসারণে সক্ষম হচ্ছিল। “দারিদ্র বিদেশে চালান দিয়ে” তারা ইউরােপীয় সর্বহারাদের তুলনামূলকভাবে সুখী রাখতে এবং এভাবে শিল্পোন্নত দেশসমূহে যথার্থ শ্রেণীসচেতনতার সম্প্রসারণকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হচ্ছিল। এর সবটাই অবশ্য ক্রমান্বয়ে নতুন ঔপনিবেশিক বাজার পাওয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী সম্পসারণের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ থাকায় এ পদ্ধতি দীর্ঘকাল চলতে পারে না। কাজেই ক্রমসঙ্কুচিত ঔপনিবেশিক বাজারের উপর কর্তৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যসমূহ জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে, এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করবে। লেনিনের মতে, প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে প্রমাণিত হলাে যে অবশেষে সে পর্যায় শুরু হয়েছে, এবং সম্পূর্ণ পরিণত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য তৈয়ার হয়ে রয়েছে।
এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অনগ্রসর এলাকায় বৈপ্লবিক তৎপরতার এক নয়া ভিত্তির সন্ধান পাওয়া সম্ভব ছিল। জারশাসিত রাশিয়া নিজে পজিবাদী দেশ না হলেও, বাজার এবং সস্তা কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসাবে অনিবার্যভাবে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের অংশস্বরূপ। কোন রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে এসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও শােষণে পাশ্চাত্য দেশসমূহকে বিরত করা সম্ভব হলে, তাতে পরিণামে সামগ্রিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার দরুন এসব এলাকার শ্রমিকরা বিশ্বের অন্যান্য শ্রমিকের তুলনায় অনেক বেশী নির্যাতিত, কাজেই তাদের মাঝে বৈপ্লবিক বিক্ষোভ সৃষ্টির বিশেষ প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষেত্র রয়েছে। এ থেকে লেনিন সিদ্ধান্তে আসেন যে শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্রভূমি হতে না হয়ে পুঁজিবাদের পতন শুরু হবে পূজিবাদী দুনিয়ার ঔপনিবেশিক পরিধি হতে। জারতন্ত্রের বিশেষ দুর্বলতার ফলে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকরী আঘাত হেনে হয়ত রাশিয়ার মত দেশই বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের সূতিকাগার হয়ে ওঠার জন্য নিয়তিনিবন্ধে নির্ধারিত হয়ে আছে। তার নিজের দেশে পেশাদার বিপ্লবীদের দল গঠনের পিছনে এটাই লেনিনের যুক্তি ছিল।
॥ ১৯১৭ সালের বিপ্লব ॥
শীঘ্রই রুশ নেতার অভিমতের নির্ভুলতার পরীক্ষা আসলাে। রাশিয়ার প্রসঙ্গে বলতে গেলে তাঁর প্রত্যাশা যুক্তিসঙ্গত বলে প্রমাণিত হলাে। প্রথম মহাযুদ্ধের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে না পেরে বহুপূর্ব হতে ক্ষয়প্রাপ্ত জারতন্ত্রী সরকারের পতন ঘটলাে। ফলে যে বিশৃংখলার সৃষ্টি হলে তাতে কমিউনিস্টরা। পেশাদার বিপ্লবী হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার যথেষ্ট সুযােগ লাভ করে। প্রথম দিকে তাদের গােটা জনসমষ্টির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ বলে মনে না হলেও তাদের তুলনাবিহীন শৃংখলা ও সংযােগসূত্র কৌশলের সুদক্ষ প্রয়ােগের ফলে তারা সকল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে পরাভূত করতে এবং রাশিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকগােষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। স্বদেশে আসন্ন ঘটনাবলীর ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে লেনিনের সাফল্য প্রমাণিত হলেও, তাঁর ব্যাপকতর প্রত্যাশা করুণভাবে নিফল হলাে। রুশ বিপ্লবের ফলে বিশ্বব্যাপী বিপ্লব শুরু হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কার্যত সে রকম কিছুই হল না। লেনিনের ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করে দিয়ে পাশ্চাত্যের পূজিবাদী গণতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ ও বিপ্লবের আঘাত কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হলাে। কমিউনিজম রাশিয়ায়, এবং শুধু রাশিয়ায়ই সাফল্য লাভ করলো।
ফলে কমিউনিস্ট পার্টি তীব্র মতবাদগত সঙ্কটের সম্মুখীন হল। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন কায়েমকে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অংশ বলে যুক্তি প্রদর্শনের উপায় রইল না। কাজেই রাশিয়ার অর্থনীতির অনগ্রসরতা অমীমাংসিত সমস্যাই রয়ে গেল। দ্বান্দ্বিক জড়বাদের বিশ্বস্ত সমর্থক হিসাবে দেশের নয়া শাসকগােষ্ঠী কি স্বীকার করে নেবেন যে রাশিয়া কমিউনিজম এর উপযােগী হয় নাই, এবং সেখানে স্বাভাবিক পজিবাদ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রয়ােজনীয়তা আছে? বিশুদ্ধ তত্ত্বের দিক দিয়ে এটা যত যুক্তিসঙ্গত ও প্রয়ােজনীয়ই মনে হউক না কেন, বাস্তবে পজিবাদবিরােধী বৈপ্লবিক আন্দোলনের পক্ষে এ ধরনের অত্মবিলােপের নীতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। অথবা, পার্টি কি নিজের রাজনৈতিক মর্যাদার সুযােগ গ্রহণ করবে, এবং বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়ােগ করবে? বাঞ্ছনীয় বিবেচিত হলেও এটা মার্কসীয় রাজনীতির আগে অর্থনীতি তত্ত্বের ঘাের বিরােধী। গোঁড়া মার্কসবাদের সাথে এ নীতির সমন্বয়ও কঠিন কাজ।
॥ কমিউনিস্ট আদর্শে গোঁড়া মাকর্সবাদের সংশােধন ॥
দুটি সম্ভাব্য বিকপের মাঝে শেষেরটাই কমিউনিস্টরা বেছে নেয়। ত্বরিৎ বিশ্ববিপ্লবের আশা অনিচ্ছার সাথে ত্যাগ করে একটি দেশে কমিউনিজম সৃষ্টির কাজে মনোেযােগ ছিল। প্রথমে লেনিনের অধীনে ধীরে ধীরে এবং পরে স্ট্যালিনের অধীনে অতি দ্রুত তারা রাশিয়াকে আধুনিক টোট্যালিটেরিয়ান বা সর্বাত্মক রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিদর্শন হিসাবে গড়ে তােলে। কমিউনিস্ট পার্টির আত্মনিয়ােজিত নেতারা এই অত্যন্ত দৃঢ় ও কেন্দ্রীভূতভাবে সুশৃংখলদলকে সমগ্র জনসমষ্টির উপর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােগ করেন। ধারাবাহিক কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অনুন্নত কৃষিজীবী জনসাধারণকে আধুনিক শিল্পোন্নত জাতিতে পরিণত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করা হয়। অনেক দিক থেকে এটা ব্যয়বহুল ও অযােগ্য হলেও, এ নীতির ফলে মাত্র একপুরুষের মাঝে রাশিয়ার অর্থনীতির আমূল রূপান্তর ঘটে। দ্বান্দ্বিক জড়বাদের তত্ত্ব অনুসারে যে কাজটা শুধু পজিবাদের বিকাশের অনিবার্য ঐতিহাসিক স্তরেই সম্ভব, কমনিট পাট নির্মমভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার করে তার অধিকাংশ সম্পন্ন করে তোলে।
দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের এ সংশােধনের অর্থ অবশ্য এটা নয় যে লেনিন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা আর মার্কসপন্থী ছিলেন না। রাশিয়ানরা সব সময় অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে আসছে যে তারাই মার্কস ও এ্যাঙ্গেলসের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী এবং এ অব্যাহত বিশ্বাস হতেই কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তি, প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস লাভ করে আসছে। ভবিষ্যৎ শ্রেণীহীন সমাজে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সকল মানুষ অবাধে ও সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশ ভােগ করবে, এ বিশ্বাস হতে তারা প্রেরণা লাভ করে। লেনিনের রচনায় বিশেষ করে (রাষ্ট্র ও বিপ্লব) গ্রন্থে মার্কসীয় মতবাদের নৈরাজের দিকটা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়। মার্কস ও এ্যাঙ্গেলসের রচনায়ও এতটা পরিষ্কারভাবে সেটা বলা হয় নাই। তাছাড়া, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কমুনিস্টরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করলেও তারা ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে যেতে থাকে। পুঁজিবাদী দুনিয়া আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্ববিরােধের দরুন ভেঙে পড়তে বাধ্য এবং উৎপাদনযন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা রহিত করে কমনিট দুনিয়া যথার্থ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য চাবিকাঠি আবিষ্কার করতে পেরেছে, এ বিশ্বাস কমিউনিস্টদের একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কষ্টসাধ্য ও সময়বিশেষে সম্পূর্ণ নৈরাশ্যজনক প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত বােধ করছিল। কমিউনিজম তার অধিকাংশ মতবাদগত শক্তিই মার্কস ও এ্যাঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ হতে সংগ্রহ করেছে বলে লেনিন ও তার উত্তরাধিকারীরা দৃঢ়ভাবে দাবী করছিলেন।
এতে অবশ্য আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয় যে বিংশ শতাব্দীর কমিউনিজম বিভিন্ন মৌলিক দিক হতে পূর্ববর্তী মতবাদসমূহ হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি নতুন মতবাদ। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর মতবাদসমূহ তুলনামূলকভাবে আশাবাদী প্রকৃতির ছিল। মানবীয় অগ্রগতির অনিবার্যতা সম্পর্কে উচ্ছসিত বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা আশা করতো যে একক বৈপ্লবিক অভ্যুথানের মাঝে আকস্মিক ও চূড়ান্তভাবে মানবীয় উদ্ভাবনী ক্ষমতা মুক্তিলাভ করবে এবং বহুলাংশে বা সম্পূর্ণরূপে সরকারী জবরদস্তিমুক্ত ও স্বতপরিচালিত সমাজের উদ্ভব ঘটবে। কমিউনিস্টরা এ আশার অংশীদার হলেও এ পথকে কুসুমাস্তীর্ণ মনে করে না। সর্বহারার একনায়কত্বের মাধ্যমে বৈপ্লবিক মুক্তির লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে এবং সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব তাদের নিকট চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়, বরং দীর্ঘ ও ক্লান্তিজনক সংগ্রামবিশেষ। শ্ৰেণীহীন ও রাষ্ট্রহীন স্বর্গে ত্বরিৎ পৌঁছার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিবর্তে সর্বহারাশ্রেণীর বিজয় কঠিন সময় নিয়ে অাসবে। সে সময়ে কষ্ট স্বীকার ও আত্মত্যাগ করতে হবে। পুঁজিবাদের ক্ষয়াবশেষ বিনষ্ট এবং ভবিষ্যৎ প্রাচুর্যের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিকল্পনা করার জন্য তখনাে সর্বহারার রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার করতে হবে। এ সময়ে মূল দায়িত্ব বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও নিষ্ঠাবান পাটির উপর ন্যস্ত থাকবে। রাজনৈতিক দক্ষতার খাতিরে পার্টিকে কঠোর শৃংখলা মেনে চলতে হবে। উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং বৈপ্লবিক বুদ্ধিজীবীদের উদ্ভাবনী ভূমিকার উপর গুরুত্বদান করে কমুনিজম আধুনিক মতবাদসমূহের ইতিহাসে যুগান্তরের সূচনা করে। বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির প্রকৃতি বহুলাংশে এর উদাহরণ অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
[অনুবাদকঃ সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন]
আরও পড়ুন,
১। ফ্যাসিবাদ, জাতীয় সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রথম অভ্যুত্থান
২। দাস বিদ্রোহ : এই বিদ্রোহ কি নিছক ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা?
৩। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের ক্রীতদাস প্রথার মর্মান্তিক ইতিহাস
Download the Nobojagaran App