সাধারভাবে বলা হয়ে থাকে আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরমের মধ্যে জাতীয়তাবাদের মন্ত্র রয়েছে। আনন্দমঠ এর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এবং বন্দেমাতরম সঙ্গীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দেমাতরমের প্রেরণায় অগণিত জনগণ ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়। বন্দেমাতরম একটি জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত। তাই সর্বদা এই সঙ্গীত জাতীয়তাবাদের প্রেরণা জোগায় মানুষের মনে।
প্রথম প্রথম এই প্রচারে শামিল ছিল কংগ্রেস, কংগ্রেসের সমর্থকরা এবং হিন্দুত্ববাদী মনােভাবাপন্ন জনগণ। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রচারে শামিল হয়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ। এমনকি, বামপন্থীরাও আর পিছিয়ে থাকেনি। তারাও যুক্ত হয়ে পড়ে এই প্রচারে। এই প্রচার চলতে থাকে নিরন্তর। বন্দেমাতরমকে জাতীয়তাবাদের প্রেরণা ও একে জাতীয় সঙ্গীত প্রতিপন্ন করতে মাঝেমধ্যেই এই ইস্যুকে চাগিয়ে ভােলা হয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষে এবং বন্দেমাতরমের শতবর্ষে এই ইস্যুকে আবার খুব জোরদার করে চাগিয়ে তােলা হয়। কিছু বামপন্থী মিডিয়াও এতে মেতে ওঠে। বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত করার দাবি আবার জোরদার করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্দেমাতরম বাধ্যতামূলক করার দাবিও জোরেশারে উত্থাপন করা হয়। তবে এক্ষেত্রেও ভারত জুড়ে মুসলিমদের তরফ থেকে প্রতিবাদ সােচ্চার করা হয়।
এবার আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরমকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমে দেখা যাক এটা কতটা জাতীয়তাবাদী। বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে। সেই আনন্দমঠ উপন্যাসটি কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারক? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের নিদারুণ হতাশ হতে হয়। কারণ আনন্দমঠে প্রকৃত ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রাম প্রায় নেই বললেই চলে। এবং ব্রিটিশরাজকে মিত্ররাজ বলা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসককে হিন্দুত্বের রক্ষাকর্তা বলা হয়েছে।
প্রায় গােটা আনন্দমঠ জুড়েই দেখানাে হয়েছে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের লড়াই। আনন্দমঠ এর সন্তানেরা স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিবেদিত। কিন্তু আনন্দমঠ এর সন্তানেরা নিরন্তর লড়াই করে চলেছে ব্রিটিশ রাজ উৎখাতের জন্য নয়। তাদের আমরণ লড়াই মুসলিম শাসন উৎখাত করার জন্য। মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য। মুসলিমদের ধ্বংস করতে পারলেই সন্তানেরা খুশি। মুসলিমদের ধনদৌলত লুঠপাট করতে পারলেই মহােল্লাসে সন্তানদের উদরপূর্তি হয়। মুসলিমদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়াতেই সন্তানদের মহানন্দ। মুসলিমদের পরাভূত করে দেশ স্বাধীন করা সন্তানদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সাথে সাথে হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সন্তানদের মনের প্রবল বাসনা। মুসলিমদের মসজিদ ভেঙে হিন্দু-মন্দির নির্মাণ করতেও সন্তানদের প্রবল উৎসাহ। যবন, ম্লেচ্ছ, নেড়ে ইত্যাদি বলে মুসলিমদের যথেচ্ছ গালিগালাজ করতে সন্তানদের অপার আনন্দ। আনন্দমঠ এর মুসলিম বিদ্বেষমূলক এবং চরম উত্তেজক উদ্ধৃতিগুলাে পরপর সাজানাে যায় এভাবেঃ
এক
…দেখ সাপ মাটিতে বুক দিয়া হাঁটে, তাহা অপেক্ষা নীচ জীব আমি ত আর দেখি, সাপের ঘাড়ে পা দিলে সেও ফণা ধরিয়া উঠে। তােমার কি কিছুতেই ধৈর্য নষ্ট হয় না? দেখ, যত দেশ আছে মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর, কোন্ দেশের এমন দুর্দশা, কোন দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে খাস খায়? কাটা খায়? উইমাটি খায়? বনের লতা খায়? কোন দেশে মানুষ শিয়াল-কুকুর খায়, মড়া খায়? কোন দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সােয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সােয়ান্তি নাই ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সােয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সােয়াপ্তি নাই। পেট চিরে ছেলে বের করে। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের পর আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধৰ্ম্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল এখন ত প্ৰাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখাের নেড়েদের না তাড়াইলে আর হিন্দুয়ানী থাকে?
মহে। তাড়াবে কেমন করে?
ভবা। মেরে।
মহে। তুমি একা তাড়াবে? এক চড়ে নাকি?
দস্যু গারিলঃ !
“সপ্তকেটীকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে
দ্বিসপ্তকোটীভূজৈধূর্তখরকরবালে
অবলা কেন মা এত বলে!”
মহে। কিন্তু দেখিতেছি তুমি একা।
ভবা। কেন, এখনি ত দৃশ লোক দেখিয়াহ।
মহে। তাহারা কি সকলে সন্তান?
ভবা। সকলেই সন্তান।
মহে। আর কত অাছে?
ভবা। এমন হাজার হাজার, ক্রমে, আরও হবে।
মহে। না হয় দশ বিশ হাজার হল, তাতে কি মুসলমানকে রাজ্যচ্যুত করিতে পারিবে?১
দুই
জ্ঞানানন্দ বলিলেন, “কিছু গােলযোগ বােধ হইতেছে। কালিকার কাউন্টার জন্য নেড়েরা গেরুয়া কাপড় দেখিতেছে, আর ধরিতেছে। পরাপর সন্তানগণ আজ সকলেই গৈরিক বসন ত্যাগ করিয়াছে। কেবল সত্যানন্দ প্রভু গেরুয়া পরিয়া একা নগরাভিমুখে গিয়াছেন। কি জানি, যদি তিনি মুসলমানের হাতে পড়েন। ভবানন্দ বলিলেন, “তাহাকে আটক রাখে, এমন মুসলমান বাঙ্গালায় নাই। ধীরানন্দ তাহার পশ্চাদগামী হইয়াছেন জানি…”২
তিন
সন্ধ্যা না হইতেই সন্তানসম্প্রদায় সকলেই জানিতে পারিয়াছিল যে, সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী আর মহেন্দ্র, দুই জনে বন্দী হইয়া নগরের কারাগারে আবদ্ধ আছে। তখন একে একে, দুয়ে দুয়ে, দশে দশ, শতে শতে, সন্তানসম্প্রদায় আসিয়া সেই দেৱালয়বেষ্টনকারী অরণ্য পরিপূর্ণ করিতে লাগিল। সকলেই সশস্ত্র। নয়নে রােষাগ্নি, মুখে দম্ভ, অধরে প্রতিজ্ঞা। প্রথমে শত, পরে সহস্র, পরে দ্বিসহ। এইরূপে লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন মঠের দ্বারে দাঁড়াইয়া তরবারিহস্তে জ্ঞানানন্দ উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “আমরা অনেক দিন হইতে মনে করিয়াছি যে, এই বাবুইয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া, এই যবনপুরী ছারখার করিয়া, নদীর জলে ফেলিয়া দিব। এই শূয়রের খোয়াড় আগুনে পােড়াইয়া মাতা বসুমতীকে আবার পবিত্র করিব। ভাই, আজ সেই দিন আসিয়াছে। আমাদের গুরুর গুরু, পরম গুরু, যিনি অনন্তজ্ঞানময়, সৰ্ব্বদা শুদ্ধাচার, যিনি লােকহিতৈষী, যিনি দেশহিতৈষী, যিনি সনাতন ধর্মের পুনঃ প্রচার জন্য শরীরপাতন প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন— যাঁহাকে বিষ্ণুর অবতারস্বরূপ মনে করি, যিনি আমাদের মুক্তির উপায়, তিনি আজ মুসলমানের কারাগারে বন্দী। আমাদের তরবারে কি ধার নাই?” হস্ত প্রসারণ করিয়া জ্ঞানানন্দ বলিলেন, “এ বাহুতে কি বল নাই?”- বক্ষে করাঘাত করিয়া বলিলেন, “এ হৃদয়ে কি সাহস নাই?– ভাই, ডাক হরে মুরারে মধুকৈটভারে। যিনি মধুকৈটভ বিনাশ করিয়াছেন— যিনি হিরণ্যকশিপু, কংস, দন্তবক্র, শিশুপাল প্রভৃতি দুর্জয় অসুরগণের নিধন সাধন করিয়াছেন— যাঁহার চক্রের ঘর্ঘরনির্ঘোষে মৃত্যুঞ্জয় শম্ভুও ভীত হইয়াছিলেন— যিনি অজেয়, রণে জয়দাতা, আমরা তার উপাসক, তার বলে আমাদের বাহুতে অনন্ত বল- তিনি ইচ্ছাময়, ইচ্ছা করিলেই আমাদের রণজয় হইবে। চল, আমরা সেই যবনপুরী ভাঙ্গিয়া ধূলিগুড়ি করি। সেই শূকরনিবাস অগ্নিসংস্কৃত করিয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিই। সেই বাবুইয়ের বাসা ভাঙ্গিয়া খড়-কুটা বাতাসে উড়াইয়া দিই। বল- হরে মুরারে মধুকৈটভারে।”…
এদিকে সন্তানেরা প্রথমেই রাজকারাগারে গিয়া, কারাগার ভাঙ্গিয়া রক্ষিবর্গকে মারিয়া ফেলিল। এবং সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়া মস্তকে তুলিয়া নৃত্য আরম্ভ করিল। তখন অতিশয় হরিবােলের গােলযােগ পড়িয়া গেল। সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়াই, তাহারা যেখানে মুসলমানের গৃহ দেখিল, আগুন ধরাইয়া দিল।৩
চার
পরদিন আনন্দমঠ এর ভিতর নিভৃত কক্ষে বসিয়া ভগ্নোৎসাহ সন্তাননায়ক তিন জন কথােপকথন করিতেছিলেন। জীবানন্দ সত্যানন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! দেবতা আমাদিগের প্রতি এমন অপ্রসন্ন কেন? কি দোষে আমরা মুসলমানের নিকট পরাভূত হইলাম?”
সত্যানন্দ বলিলেন, “দেবতা অপ্রসন্ন নহেন। যুদ্ধে জয় পরাজয় উভয়ই আছে। সে দিন আমরা জয়ী হইয়াছিলাম, আজ পরাভূত হইয়াছি, শেষ জয়ই জয়। আমার নিশ্চিত ভরসা আছে যে, যিনি এত দিন আমাদিগকে দয়া করিয়াছেন, সেই শঙ্খচক্র-গদা-পদ্মধারী বনমালী পুনর্বার দয়া করিবেন। তাহার পাদস্পর্শ করিয়া যে মহাব্রতে আমরা ব্রতী হইয়াছি, অবশ্য সে ব্ৰত আমাদিগকে সাধন করিতে হইবে। বিমুখ হইলে আমরা অনন্ত নরক ভােগ করিব। আমাদের ভাবী মঙ্গলের বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই। কিন্তু যেমন দৈবানুগ্রহ ভিন্ন কোন কাৰ্য্য সিদ্ধ হইতে পারে না, তেমনি পুরুষকারও চাই। আমরা যে পরাভূত হইলাম, তাহার কারণ এই যে, আমরা নিরস্ত্র। গােলাগুলি বন্দুক কামানের কাছে লাঠি সােটা বল্লমে কি হইবে? অতএব আমাদিগের পুরুষকারের লাঘব ছিল বলিয়াই এই পরাভব হইয়াছে। এক্ষণে আমাদের কর্তব্য, যাহাতে আমাদিগেরও ঐরূপ অস্ত্রের অপ্রতুল না হয়।৪
পাঁচ
তার পর, তাহারা গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে, বলে, ভাই, বিষ্ণুপূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড় করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্বস্ব লুঠ করিয়া বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুঠের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লােকে প্রীত হইলে বিষ্ণুমন্দিরে আনিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লােকে দেখিল, সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে। বিশেষ মুসলমানরাজ্যের অরাজকতায় ও অশাসনে সকলে মুসলমানের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুধর্মের বিলােপে অনেক হিন্দুই হিন্দুত্ব স্থাপনের জন্য আগ্রহচিত্ত ছিল। অতএব দিনে দিনে সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবানন্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া দিগদিগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল। যেখানে রাজপুরুষ পায়, ধরিয়া মারপিট করে, কখন কখন প্রাণবধ করে, যেখানে সরকারী টাকা পায়, লুঠিয়া লইয়া ঘরে আনে, যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়, দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে। স্থানীয় রাজপুরুষগণ তখন সন্তানদিগের শাসনার্থে ভুরিভুরি সৈন্য প্রেরণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু এখন সন্তানেরা দলবদ্ধ, শস্ত্রযুক্ত এবং মহাদম্ভশালী। তাহাদিগের দর্পের সম্মুখে মুসলমান সৈন্য অগ্রসর হইতে পারে না। যদি অগ্রসর হয়, অমিতবলে সন্তানেরা তাহ্যাঁদিগের উপর পড়িয়া, তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া হরিধ্বনি করিতে থাকে। যদি কখনও কোন সন্তানের দলকে যবন সৈনিকেরা পরাস্ত করে, তখনই আর একদল সন্তান কোথা হইতে আসিয়া বিজেতাদিগের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া হরি হরি বলিতে বলিতে চলিয়া যায়।
ছয়
.. আজ সকলে কাণাকাণি করিতে লাগিল, “মহারাজের তপঃসিদ্ধি হইয়াছে— আমাদের রাজা হইবে।” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চিৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার।” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজুকি জয়’।” কেহ গায়িল “হরে মুরারে, মধুকৈটভারে।” “কেহ গায়িল “বন্দে মাতরম।” কেহ বলে— “ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?৬
সাত
…ভবানন্দ বলিলেন, “কাপ্তেন সাহেব, তােমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস- তােমার প্রাণদান। দিলাম, আপাততঃ তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তােমাদের সুহৃদ।”
আট
..সবাই লুঠিতে বাহির হইয়াছে। গ্রামসকল এখন অরক্ষিত। মুসলমানের গ্রাম আর রেশমের কুঠি লুঠিয়া সকলে ঘরে যাইবে। … হিন্দুর রাজ্য হইয়াছে শুনিলে, বহুতর সেনা সন্তানের নিশান উড়াইবে।”
নয়
“… সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল। গ্রাম্য লােকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াহয়া মারতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সৰ্ব্বস্ব লঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করলে বলিতে লগিল, ‘মুই হেঁদু’।
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল। চারি দিকে রাজপুরুষেরা ছটিল, অবশিষ্ট সিপাহী সুসজ্জিত হইয়া নগররক্ষার্থে শ্রেণীবদ্ধ হইল। নগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে প্রকোষ্ঠসকলে রক্ষকবর্গ সশস্ত্রে অতি সাবধানে দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত হইল। সমস্ত লােক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে লাগিল, “আসুক সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃস্টে সেই দিন হউক।”মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এ রােজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলাে; মােরা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ করি, তা এই তেলক কাটা হেঁদুর দল ফতে করতে পারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।৯
দশ
“যিনি আসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “তােমার কাৰ্য্য সিদ্ধ হইয়াছে, মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তােমার এখন কোন কাৰ্য্য নাই। অনর্থক প্রাণিহত্যার প্রয়ােজন নাই।”
সত্য। মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হয় নাই- এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।
তিনি। হিন্দুরাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না— তুমি থাকিলে এখন অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল।।
শুনিয়া সত্যানন্দ তীব্র মর্মপীড়ায় কাতর হইলেন। বলিলেন, ‘হে প্রভু! যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে?’
তিনি বলিলেন, ‘না, এখন ইংরেজ রাজা হইবে।
সত্যানন্দের দুই চক্ষে জলধারা বহিতে লাগিল। তিনি উপরিস্থিতা, মাতৃরূপা জন্মভূমি প্রতিমার দিকে ফিরিয়া জোড়হাতে বাস্পনিরুদ্ধস্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘হায় মা! তােমায় উদ্ধার করিতে পারিলাম না— আবার তুমি স্নেচ্ছের হাতে পড়িবে। সন্তানের অপরাধ লইও না। হায় মা! কেন আজ রণক্ষেত্রে আমার মৃত্যু হইল না।
চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তােমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।’….
… সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব। ইংরেজী শিক্ষায় এদেশীয় লােক বতি সশিক্ষিত হইয়া অন্তস্তত্ত্ব বুঝিতে সক্ষম হইবে। তখন সনাতনধর্ম প্রচারের আর বি থাকিবে না। তখন প্রকৃত ধর্ম আপনা আপনি পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। যতদিন না তা তা যত দিন না হিন্দু আবার জ্ঞানবান, গুণবান আর বলবান হয়, ততদিন ইংরেজবাজা অক্ষয় থাকিবে। ইংরেজরাজ্যে প্রজা সুখী হইবে- নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। অতএব হে বুদ্ধিমন- ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া আমায় অনুসরণ কর।”
…মহাপুরুষ বলিলেন, “ইংরেজ এক্ষণে বণিক- অর্থসংগ্রহেই মন, রাজ্যশাসনের ভার লইতে চাহে না। এই সন্তানবিদ্রোহের কারণে, তাহারা রাজ্যশাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে; কেন না, রাজ্যশাসন ব্যতীত অর্থসংগ্রহ হইবে না। ইংরেজ রাজ্যে অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তানবিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আইস— জ্ঞানলাভ করিয়া তুমি স্বয়ং সকল কথা বুঝিতে পারিবে।….
মহাপুরুষ। ব্ৰত সফল হইয়াছে মার মঙ্গল সাধন করিয়াছ ইংরেজরাজ্য স্থাপিত করিয়াছ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিত্যাগ কর, লােকে কৃষিকার্যে নিযুক্ত হউক, পৃথিবী শস্যশালিনী হউন, লােকের শ্রীবৃদ্ধি হউক।..
মহাপুরুষ। শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজা। আর ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে শেষ জয়ী হয়, এমন শক্তিও কাহারও নাই।”১০
এসব উদ্ধৃতিগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের বৃহৎঅংশ জুড়ে। এসব উদ্ধৃতিগুলাে থেকে প্রমাণিত হয় যে, আনন্দমঠ এর সন্তানেরা কোনমতেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মুসলমরাজ উৎখাত করা। মুসলিমদের ধ্বংস করা। মুসলিমদের দেশ থেকে তাড়িয়ে হিন্দুত্বের কাজ। ওড়ানাে এবং হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর এ লক্ষ্যেই ইংরেজদের মিত্ররাজ হিসাবে গ্রহণ করে মুসলিমদের শায়েস্তা করা। এসব কথা আগেই বলা হয়েছে। আর এসব কথা উপরাক্ত বড় বড় উদ্ধতিতে ফটেও উঠেছে। এবার আনন্দমঠকে আরো প্রশ্ন বিশ্লেষণ করা যাক। আনন্দমঠে কিভাবে মুসলিমদের উৎখাত করার কথা বলা হয়েছে, “ভাবে মুসলমানদের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে, কিভাবে মুসলমানদের তাড়ানাের কথা বলা হয়েছে, সেইসব সংশ্লিষ্ট উদ্ধতিগুলাে তুলে ধরা হচ্ছে একেবারে নির্দিষ্ট করে।
মুসলিম রাজত্বে দুর্দশার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক সন্তানের ক্ষোভের অশ্লীল বহিঃপ্রকাশ হয় এভাবে :
“এ নেশাখাের নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?”১১
সন্তানেরা এখানে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে এইরকম অশ্লীল ও কুৎসিত ভাষায় মুসলিমদের গালিগালাজ করে কথােপকথন করছে তখন কিভাবে মুসলিমদের তাড়ানাে হবে তাও ব্যক্ত হয়ে ওঠে। মহেন্দ্র নামক সন্তানের মুখে প্রশ্ন ভেসে আসে :
“তাড়াবে কেমন করে?”
সন্তান ভবানন্দ তখন উত্তর দেয়, “মেরে”।১২
আনন্দমঠ এর এক পর্যায়ে বন্দী সন্তান মহেন্দ্রকে মুক্ত করে সন্তানেরা মুসলমানদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিল :
“সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়াই, তাহারা যেখানে মুসলমানের গৃহ দেখিল, আগুন ধরাইয়া দিল।”১৩
এরপর দলবদ্ধ সন্তানেরা অগ্নিসংযােগ করে মুসলিম গ্রামে গ্রামে এবং মুসলিমদের সর্বস্ব লুঠ করে :
“তারপর তাহারা গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে, বলে ভাই বিষ্ণুপূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড় করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্বস্ব লুঠ করিয়া বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে।১৪
মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্ধিত সংখ্যায় সন্তানদের বীভৎসতা ও নিগ্রহ অব্যাহত দিনের পর দিন :
“দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবনান্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া দিগদিগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল।… যেখানে সরকারী টাকা পায়, লুঠিয়া লইয়া ঘরে আনে, যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়, দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে।”১৫
সংঘবদ্ধ, সশস্ত্র ও শক্তিশালী সন্তানেরা হরি হরি রবে হর্ষধ্বনিতে উন্মত্ত হয়ে যথেচ্ছভাবে মুসলিম সৈণিকদের মুণ্ডপাত করে :
“কিন্তু এখন সন্তানেরা দলবদ্ধ, শস্ত্রযুক্ত এবং মহাদশালী। তাহাদিগের দর্পের সম্মুখে মুসলমান সৈন্য অগ্রসর হইতে পারে না। যদি অগ্রসর হয়, অমিতবলে সন্তানেরা তাহাদিগের উপরে পড়িয়া, তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া হরিধ্বনি করিতে থাকে। যদি কখনও কোন সন্তানের দলকে যন সৈনিকেরা পরাস্ত করে, তখনই আর একদল সন্তান কোথা হইতে আসিয়া বিজেতাদিগের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া হরি হরি বলিতে বলিতে চলিয়া যায়।”১৬
মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আরাে কোলাহলপূর্ণ ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে বেপরওয়া-বিশৃঙ্খল সন্তানদের এইরকম বীভৎস ও অশ্লীল চিৎকারে : “মার, মার, নেড়ে মার।”১৭
সন্তাননায়ক মহেন্দ্রর কণ্ঠেও একইরকম বিষােগার :
“মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার।”১৭ক
এক সামান্য বিজয়ের স্বাদ পেয়ে সন্তানেরা হয়ে ওঠে বাঁধনহারা লুঠেরা। মুসলিম গ্রামে গ্রামে তাদের অব্যাহত তাণ্ডবলীলা :
“….সবাই লুঠিতে বাহির হইয়াছে। … মুসলমানের গ্রাম আর রেশমের কুঠি লুঠিয়া সকলে ঘরে যাইবে।”
সন্তানদের সেই তাণ্ডব আরাে ভয়াবহ ও বীভৎস হয়ে ওঠে। আর এর ফলস্বরূপ মুসলিম গ্রামসমূহের চিত্র ও মুসলিমদের অবস্থা হয়ে ওঠে কি করুণ :
“সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল।.. গ্রাম্য লােকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সৰ্ব্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, ‘মুই হেঁদু’।
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল।১৯
একথা বার বার প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে, মুসলিমরাজ ধ্বংস ও উৎখাত করাহ সন্তানদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাদের যাবতীয় বিদ্রোহ ও যুদ্ধ বিগ্রহ এ লক্ষ্যেই। তাই মুসলিমরাজ ধ্বংসের পরে সন্তানদের আর যুদ্ধ বিগ্রহের প্রয়ােজন নেই। সেকথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় জনৈক সন্তানের মুখে :
“যিনি আসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “তােমার কাৰ্য্য সিদ্ধ হইয়াছে, মুসলমান ধ্বংস হইয়াছে। আর তােমার এখন কোন কাৰ্য্য নাই। অনর্থক প্রাণিহত্যার প্রয়ােজন নাই।”২০
ধ্বংসযজ্ঞে উন্মত্ত সন্তানেরা শুধু মুসলিম উৎখাত করে, মুসলিমদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে, মুসলিমদের হত্যা করে, ধ্বংস করে এবং বিতাড়িত করেই তৃপ্ত হতে চায় না। মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণ না করা পর্যন্ত তাদের তাণ্ডবলীলা নিবৃত্ত হবার নয়:
“ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব।”২১
সুতরাং এর পরেও কি বলা যায় আনন্দমঠ এর সন্তানদের আন্দোলন জাতীয়তাবাদী? বরং তাদের বিদ্রোহ মারাত্মক সাম্প্রদায়িক বিষে বিষাক্ত। তাদের এই সাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাতে আর বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা থাকে না। উপরােক্ত আলােচনার পরে।
আনন্দমঠ এর সন্তানদের বিদ্রোহ যে জাতীয়তাবাদী নয়, বরং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত, একথা পূর্বোক্ত আলােচনায় দিবালােকের মত স্পষ্ট। অন্যদিকে, ইংরেজরা যে সন্তানদের শত্রু নয়, বরং মিত্র এবং ইংরেজরাজ সন্তানদের মিত্ররাজ— এসব কথা সন্তানদের মুখে ব্যক্ত হয়েছে বার বার। তাই যখন-তখন সন্তানদের মুখে ইংরেজদের জয়ধ্বনি প্রতিধ্বণিত :
“ভবানন্দ বলিলেন ‘কাপ্তেন সাহেব, তােমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস- তােমার প্রাণদান দিলাম, আপাততঃ তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তােমাদের সুহৃদ।”২২
মুসলিম রাজত্ব ধ্বংস করে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা যে সন্তানদের প্রধান লক্ষ্য ও স্বপ্ন তা স্পষ্ট জনৈক সন্তাননায়কের কথায়। সন্তানদল কর্তৃক মুসলমানরাজ্য ধ্বংসসাধনের পরে জনৈক সন্তানের প্রশ্ন :
‘হে প্রভু! যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে?’২৩
এর জবাবে জনৈক সন্তাননায়ক বললেন : ‘না, এখন ইংরেজ রাজা হইবে।”২৪
সন্তানদের প্রবল বিশ্বাস ইংরেজ রাজা হলে সনাতন হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার হবে। ইংরেজ রাজত্বে প্রজারা সুখী হবে। ধর্মাচরণ নিষ্কন্টক হবে। সুতরাং ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ নয়। ইংরেজকে রাজা করতে হবে। ইংরেজ রাজকে রক্ষা করতে হবে। এসব কথাই প্রতিধ্বনিত সন্তাননায়কের মুখে :
“ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।… সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব। ইংরেজী শিক্ষায় এদেশীয় লােক বহিস্তত্ত্বে সুশিক্ষিত হইয়া অন্তস্তত্ত্ব বুঝিতে সক্ষম হইবে। তখন সনাতনধর্ম প্রচারের আর বিঘ্ন থাকবে না। অন প্রকৃত ধর্ম আপনাআপনি পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। যত দিন না তা হয়, যত দিন না হিন্দ আবার জ্ঞানবান, গুণবান আর বলবান হয়, ততদিন ইংরেজরা অক্ষয় থাকিবে। ইংরেজরাজ্যে প্রজা সুখী হইবে— নিষ্টণ্টক ধর্মাচরণ করিবে। অতএব হে বুদ্ধিমন— ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া আমার অনুসরণ কর।”২৫
এখন এ বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই যে, গােটা আনন্দমঠে সন্তানদের যুদ্ধ মূলতঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তবে এক-দু’বার ইংরেজদের সঙ্গেও সন্তানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সে যুদ্ধ ইংরেজদের উৎখাত করার জন্য নয়। বরং ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সে যুদ্ধ। সেকথাই ব্যক্ত হয় সন্তান মহাপুরুষের কণ্ঠে :
“ইংরেজ এক্ষণে বণিক— অর্থসংগ্রহেই মন, রাজ্যশাসনের ভার লইতে চাহে না। এই সন্তানবিদ্রোহের কারণে, তাহারা রাজ্যশাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে; কেন না, রাজ্যশাসন ব্যতীত অর্থসংগ্রহ হইবে না। ইংরেজ রজ্যে অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তানবিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে।”২৬
এর আগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর একটি যুদ্ধেও একইরকম ঘটনা ঘটে। এই যুদ্ধে সন্তানদের হাতে ইংরেজ সেনা বিপর্যস্ত। কাপ্তেন টমাস সন্তানদের হাতে বন্দী। কিন্তু তারা কাপ্তেনকে শাস্তি দেয় না। বরং তার জীবনদান দেয় ইংরেজরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। বন্দী কাপ্তেনের সামনেই সন্তাননায়ক ইংরেজদের জয়ধ্বনি করে। ইংরেজদের বন্ধুত্ব স্বীকার করে। সাথে সাথে মুসলিমদের সহায় হওয়ার জন্য ইংরেজকে তিরস্কার করে। বন্দী কাপ্তেনের সামনে সন্তাননায়ক ভবানন্দের মন্তব্য :
‘কাপ্তেন সাহেব, তােমায় মারিব না, ইংরেজ তােমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস—তােমার প্রাণদান দিলাম, আপাতত তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তােমাদের সুহৃদ।”২৭
সন্তানদের ব্রত ও সংকল্প হল ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। সে ব্ৰত সফল হয়েছে। তাই আর যুদ্ধবিগ্রহের দরকার নেই। সন্তান মহাপুরুষের মুখে শােনা যায় সেই উপদেশ: ব্ৰত সফল হইয়াছে মার মঙ্গল সাধন করিয়াছ ইংরেজরাজ্য স্থাপিত করিয়াছ।
যুদ্ধবিগ্রহ পরিত্যাগ কর, লােকে কৃষিকার্যে নিযুক্ত হউক, পৃথিবী শস্যশালিনী হউন, লােকের শ্রীবৃদ্ধি হউক।”২৮
ইংরেজদের সঙ্গে সন্তানদের অটুট বন্ধুত্ব। ইংরেজরা সন্তানদের মিত্ররাজ। মহাপুরুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় :
“শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজ।”২৯
বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে আনন্দমঠ এর সন্তানদের মুখে সন্তানদের শত্রু মুসলিমরা কাপুরুষ, ভীরু, নিচ, যুদ্ধ-পলাতক হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। অন্যদিকে ইংরেজরা বীরপুরুষ, সাহসী, যুদ্ধজয়ী হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। কারণ ইংরেজরা সন্তানদের মিত্ররাজ। স্বপ্নের রাজশক্তি। তাই সন্তাননায়ক ভবানন্দের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় :
‘ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায়—শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ আছে যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলকাড়ি। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহীরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস কামানের গােলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না। সুতরাং একটা গােলা দেখে দুই শ জন পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গােলা দেখিলে মুসলমানের গােষ্ঠীশুদ্ধ পলায় — আর গােষ্ঠীশুদ্ধ গােলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।”৩০
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বন্দেমাতরম
এবার ‘বন্দেমাতরম’ গানটি নিয়ে বিশেষভাবে আলােচনা করা যাক। বন্দেমাতরমের ঐতিহাসিক বিতর্ক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন আধুনিক গবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এভাবেঃ
‘বন্দেমাতরম’ গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ওই রাখীবন্ধনের গান বাংলার মাটিবাংলার জলে’র মিল আছে। দুটি গানেরই অনুপ্রেরণা দেশপ্রেমিক; উভয় গানেই বাংলার নিজস্ব যে প্রকৃতি তার বর্ণনা রয়েছে, উল্লেখ আছে দেশের মানুষের। কিন্তু পার্থক্যও বড় কম নয়, পার্থক্যই বরঞ্চ অধিক। বঙ্কিমচন্দ্রের গানটিকে স্মরণ করা যাক,
বন্দে মাতরম্।
সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাম
শস্যশামলাং মাতরম্।
শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্।
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশােভিনীতম
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্।।
এখানে বাংলার প্রকৃতির যে-বর্ণনা আছে, তা রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’র বর্ণনার চেয়ে যে প্রাণস্পর্শী তাতে সন্দেহ কী! সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা তাে বাংলা প্রবচনে পর্যবসিত। প্রকৃতির বর্ণনার পর বাংলার মানুষের কথা আসছে, কেবল হিন্দুর কথা নয়, বাংলার সাত কোটি মানুষের কথা বটে –
সপ্তকোটীকণ্ঠ-কল-কল নিনাদকরালে
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখরকরবালে।
অবলা কেন মা এত বলে,
কি এই প্রশ্নের আবার সেই মাতৃমূর্তির কাছে যাওয়া।
তুমি বিদ্যা তুমি ধৰ্ম
তুমি হৃদি তুমি মৰ্ম্ম
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে।
—- —- —- —- —-
তােমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী।
কমলা কমল-দলবিহারিণী
মাতৃভূমির প্রতি যে গভীর ভালােবাসায় স্বদেশী আন্দোলনের মানুষেরা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন তার এমন প্রকাশ এর আগে কোনাে একটি গানে ঘটে নি। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালী পাঠকের চোখ মাতৃভূমির দিকে আকর্ষণ করেছেন, মাতার যে দুর্দশা তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আনন্দমঠ জুড়ে রয়েছে। উপন্যাসে সন্ন্যাসী ভবানন্দ যখন এ গান গায় আমরা দেখেছি সে ‘গায়িতে গায়িতে কাঁদিতে লাগিল’। ভবানন্দরা হচ্ছে দেশােদ্ধারে ব্রতী যোদ্ধা; ‘মায়ের সন্তান’, তাদের জন্য দেশছাড়া অন্য মাতা নেই। স্বদেশী আন্দোলনের অনেক তরুণ যােদ্ধার মনে এই ধরনের বােধ কাজ করেছে।
কিন্তু মাতা এখানে কেবল মাতা থাকেন নি, দেবীতে পরিণত হয়েছেন, সে-দেবী অন্য কেউ নয়, স্বয়ং দুর্গা, দশপ্রহরণধারিণী। ‘আমার দুর্গোৎসব’-এ কমলাকান্ত বলেছে,
স্বপ্নে মা দুর্গাকে সে দেখেছে, ‘সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা’ হিসাবে। ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতে ওই প্রতিমা অধিকতর জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ-এর স্বদেশী গানে মাতা আছেন, আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’তে তিনি অবশ্যই রয়েছেন, কিন্তু সে মা দেশই শুধ, প্রতিমা নন, মােটেই দেবী নন।
দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমমূলক গানগুলােতে ভাষা, স্বর ও সুর নম্র, কখনাে কখনােকরুণ; কিন্তু ‘বন্দেমাতরম’-এ ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখানে ভাষা কোথাও কোথাও সংস্কৃতের কাছাকাছি, যে জন্য তা বাংলা হলেও সর্বভারতীয় গ্রহণযােগ্যতা পেয়েছে; এতে প্রত্যয়ের ব্যবহার, এর সমসবাহুল্য, শব্দের গাম্ভীর্য, স্বর ও সুরের পৌরুষ, বিদ্রোহ ও যুদ্ধমনস্কতা একে প্রায় মন্ত্রে পরিণত করেছে। এবং সে জন্যই বিশেষ ভাবে এটি জনপ্রিয় হয়েছে; যেন গান নয়, মন্ত্রই। রণধ্বনি হিসাবে বন্দেমাতরম’ যে কতটা কার্যকর তা ১৯০৫-পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে; ওই ধ্বনি জনসভায় শােনা গেছে। উঠেছে মিছিলে, ধ্বনিত হয়েছে ফাঁসির মঞ্চে।
এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাে প্রথম জীবনে ওই গানের প্রভাববলয়ের ভেতরেই ছিলেন। ১৮৮৬ সালে, অর্থাৎ আনন্দমঠ প্রকাশের চার বছরের মধ্যেই কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে, যেটি ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশন, ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া হয়েছে; এর দশ বছর পর রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতটির প্রথম দুই স্তবকের সুর দিয়েছেন, এবং স্বকণ্ঠে গেয়েছেনও, কংগ্রেসরই আরেক অধিবেশনে।
১৯০৫ এর পর থেকে রবীন্দ্রনাথ বন্দেমারতম-এর বলয় থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছেন। ঘরে বাইরে উপন্যাসে তিনি ওই রণধ্বনির অপব্যবহার দেখিয়েছেন। কেবল তাই নয় কংগ্রেস যখন ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সঙ্গীত করতে চেয়েছে রবীন্দ্রনাথ তখন সে-প্রস্তাব সমর্থন করেন নি। এ বিষয়ে ১৯৩৭ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা তার চিঠিটি উদ্ধৃতিযােগ্য। গানটির ব্যবহারযােগ্যতা সম্পর্কে সুভাষ বসু রবীন্দ্রনাথের মত জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“বন্দেমাতরম গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব একথা এতই সুস্পষ্ট যে এনিয়ে তর্ক করা চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু না চান স্বদেশের এই দশভুজামুর্তিরূপের যে পূজা সে কোনাে মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না। এবারের পূজাসংখ্যার বহু সাময়িকপত্রেই দুর্গাপূজার প্রসঙ্গে বন্দেমাতরম গানের শ্লোকাংশের উদ্ধৃত করে দিয়েছে সহজেই দুর্গার স্তবরূপে একে গ্রহণ করেছে।… বাংলাদেশের একদল মুসলমানের মধ্যে এ যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাইতখন সেটা আমাদের কার পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আব্দার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার – বিষয় হয়ে ওঠে। বস্তুত এতে আমাদের পরাভব। পুঃ বাঙালী হিন্দুরা এই আলােচনা নিয়ে চঞ্চল হয়েছেন কিন্তু ব্যাপারটা একলা হিন্দুর মধ্যে বদ্ধ নয়।উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়ােজন আছে। রাষ্ট্রীয় সাধনায় আমাদের শান্তি চাই,ঐক্য চাই, শুভবুদ্ধি চাই – কোনাে এক পক্ষের জিদকে দুর্দৰ্ম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাইনে।”৩১
গানটি সম্পর্কে মুসলিম মধ্যবিত্তের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। গানটি যে উপন্যাসের অংশ তাকে মুসলিমবিদ্বেষী না-ভাববার কোনাে কারণ ছিলনা। উপন্যাস সম্পর্কে আপত্তি একসময়ে এমন স্তরে উঠেছিল, যে আনন্দমঠ এর বৎসব পর্যন্ত করা হয়েছে। এই গানটি সম্পর্কেসহনশীল পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি জিজ্ঞাসা, যেমন,
“বাঙ্গালা দেশে সপ্ত কোটি লােকের বাস। তাহার মধ্যে অর্ধাধিক মুসলমান। এই যে বিশাল বাঙ্গালী জাতি, যাহার মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুইটি আছে, তাহাদের জন্য যে জাতীয় সঙ্গীত রচিত হইয়াছে, তাহা হইতে মুসলমান বাদ পড়িল কেন?”৩২
খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে যদি ধরা যায় তাহলে মুসলমানরা, যাদের সংখ্যা অর্ধেকেরও অধিক, তারা কিন্তু বাদ পড়ে নি, গানে সাত কোটি বাঙালীর এবং তাদে কোটি বাহুর কথা পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তি বাদ দেণ্ড চাইতেও অগ্রহণযােগ্য। কেননা এতে মুসলমানদেরকে মুসলমান হিসাে – পূজারা হিসাবে, অর্থাৎ হিন্দু হিসাবেই উপস্থিত করা হয়েছে। মুসলমান এতে উৎফুল্ল হবে কেন; তার বিরূপ হবার কথাই, এবং সেটা সে ঠিকই হয়েছে। বাংলার সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে তাদেরকে বরঞ্চ দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়াই হয়েছে, একপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়, যারা দেবীর বন্দনা ও পূজা করে, অপরপক্ষে মুসলিম সম্প্রদায় যারা মূর্তিপূজাবিরােধী। সাম্প্রদায়িকতার জন্য পথ প্রশস্ত করার কাজে এভাবে? সহায়তা দান করা হয়েছে। সকল বাঙালীকে হিন্দু হিসাবে কল্পনা করাটা কোনাে পরিকল্পনাতেই বৈধ নয়। বঙ্কিমের মতাে বাস্তববাদী মানুষ এমনটা কল্পনা করছেন দেখে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, দেশপ্রেম তাকে খুবই অধীর করেছিল।
হিন্দু মধ্যবিত্তকে পরবর্তীকালে ‘বন্দেমাতরম’ রণধ্বনি যতই অনুপ্রাণিত করেছে ততই মুসলিম মধ্যবিত্তের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েছে, সেই সঙ্গে দু’পক্ষের দ্বন্দ্বটিও প্রবল হয়ে উঠেছে। মুসলিম পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছে, ‘আল্লা হু আকবরে’র। কালে সেটিও রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিকে একই সভায় উভয় আওয়াজ দেওয়া হতাে, শ্রমিকদের জমায়েতেও দুই আওয়াজই শােনা যেতাে; কিন্তু পরে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দু’য়ের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান আর টিকে থাকে নি, মাতৃবন্দনা এবং আল্লাহর মহত্ত্বের ধ্বনি এক অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
‘বন্দেমাতরম’-এর ব্যাপারে হিন্দুমধ্যবিত্ত কীভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল সে সম্পর্কে ইঙ্গিত পাই রবীন্দ্রনাথেরই আরেকটি চিঠি থেকে। প্রমথ চৌধুরীকে লেখা এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে বেশ বিরক্তই মনে হচ্ছে,
“আমি ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডাদের যদি আজ মাতে বসি তাহলে আমার জাত যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডারা শুধু পাণ্ডা নয়, তারা গুণ্ডা — অতএব মার খেতে হবে। তাই সই।”
উল্লেখ্য যে তাঁর সত্তর বৎসর-পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বাণীতে তিনি ‘বন্দেমাতরম’-এর পরিবর্তে ‘বন্দেভ্রাতরম্’ শ্লোগান গ্রহণের পক্ষে বলেছিলেন।৩৩ তেমন আহ্বান কার্যকর হবার কথা নয়, হয়ও নি। ক্ষেত্রবিশেষে সন্তানের মাতৃবন্দনা যে ভয়ঙ্কর হতে পারে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন। বন্দেমাতরমের ব্যাপারে শান্ত স্বভাবের বুদ্ধিদেব বসুও যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন সেটা বােঝা যায় তাকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য থেকে; রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
“শ্রীহর্ষে’ বন্দেমাতরমপন্থীর পক্ষে তােমার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি … তুমি আমাকে গাল দাও নি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়”, ইত্যাদি।৩৪
এবার বন্দেমাতরক বিতর্ক এবং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে জাহেদা আহমদের পর্যবেক্ষণ উপলব্ধি করা যাক:
বন্দেমাতরম বিতর্ক
একালের বঙ্কিম-গবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তার বঙ্কিম সাহিত্য নামক বইয়ে ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে যে গবেষণা করেছেন তাতে দেখি বঙ্কিম ‘বন্দেমাতরম’ গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন অনুজ পূর্ণচন্দ্র লিখিত এবং বঙ্গদর্শনের ১২৮১ বঙ্গাব্দের হকার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আমার দুর্গোৎসব’ নিবন্ধটি থেকে। বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদক : যােগেশচন্দ্র বাগলও বলছেন যে, আনন্দমঠ প্রকাশের বেশ আগে বঙ্গদর্শন সম্পাদনাকালে ১৮৭৫ সাল নাগাদ বঙ্কিমচন্দ্র এই গানটি রচনা করেন। বাগলের মতেও “বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্ত মারফত বাঙালীকে স্বদেশপ্রেম মন্ত্রে দীক্ষা দিতে অগ্রণী হইলেন।” ‘আমার দুর্গোৎসব’ নিবন্ধে কমলাকান্তের মুখ দিয়া মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে বলাইলেন :
চিনিলাম, এই আমার জননী জন্মভূমি— এই মৃন্ময়ী— মৃত্তিকারূপিণী—অনন্ত রত্নভূষিতা- এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্নমণ্ডিত দশভুজ— দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা শক্তি শােভিত; পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীরজন কেশরী শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত! এ মূৰ্ত্তি এখন দেখিব না— … কিন্তু একদিন দেখিব— দিগভুজা, নানা প্রহরণ প্রহারিণী, শত্রু মর্দিনী, বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী— দক্ষিণে লক্ষী ভাগ্যরূপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানমূৰ্ত্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোত মধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা।
এস এস ভাই সকল! আমরা এই অন্ধকার কালস্রোতে ঝাপ দিই। এস আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি।৩৮
অমিত্রসূদন আরাে জানিয়েছেন যে ১৮৯৬ সালে কলকাতায় যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয় তাতে রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম গানটি গেয়েছিলেন, কিন্তু তার দশ বছর আগে ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র নাকি বলেছিলেন, যে, দেশপ্রেমের দিক থেকে আনন্দমঠ ভালাে কিন্তু তাতে শিল্পগুণ কম। তার শ্রেষ্ঠ, উপন্যাস কোনটি এর উত্তরে তিনি কখনও কপালকুণ্ডলা, কখনও বিষবৃক্ষ, কখনও কৃষ্ণকান্তের উইল, এমনকি রাজসিংহেরও নাম করেছেন, কিন্তু আনন্দমঠ এর নাম কখনও করেননি। তা সত্ত্বেও ১৮৮২ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আনন্দমঠ বিক্রি সংখ্যায় এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাপকাঠিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। তার কারণ কী? ‘শিল্পগুণই’ যদি কম হয়ে তাকে, এবং তা স্বয়ং লেখকের মতে, তাহলে এই উপন্যাসের এমন সাফল্য, এমন সার্থকতার উৎস কী? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে একজন গবেষক বলছেন,
“কেন? দেশপ্রেমের আবেগ জাগায় বলে? ইংরেজকে অজেয় মিত্র মনে করাই কি দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা? নাকি মুসলমান বিদ্বেষেরই অপর নাম দেশপ্রেম? তবে কি মুসলমান বিদ্বেষের ভিত্তির উপরেই ইংরেজদের শিক্ষায় হিন্দুজাতি তত্ত্বের পরপ্রাসাদ গঠিত?”৩৫
বন্দেমাতরম গান নিয়ে বিতর্ক কিছু কম নয়। বিতর্কের মূল বিষয় হচ্ছে গানটিতে অতিমাত্রায় পৌত্তলিক ভাবকল্পনা ও রূপকের ব্যবহার। এই গানে দেশকে দেবী দুর্গারূপে কল্পনা করেছেন লেখক। স্বদেশী আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে বঙ্কিমভক্ত বাঙালী হিন্দুর দৃষ্টিতে পৌত্তলিকতার এদিকটি একেবারেই ধরা পড়েনি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বক্তব্য প্রণিধানযােগ্য,
“বঙ্কিমবাবু যাহা কিছু করিয়াছেন… সব গিয়া একপথে দাঁড়াইয়াছে। সে পথ জন্মভূমির উপাসনা জন্মভূমিকে মা বলা— জন্মভূমিকে ভালবাসা জন্মভূমিকে ভক্তি করা। তিনি যে এই কাৰ্য্য করিয়াছেন, ইহা ভারতবর্ষে আর কেহ করে নাই। সুতরাং তিনি আমাদের পূজ্য, তিনি আমাদের নমস্য, তিনি আমাদের আচার্য্য, তিনি আমাদের ঋষি, তিনি আমাদের মন্ত্ৰকৃৎ, তিনি আমাদের মন্ত্রদ্রষ্টা। সে মন্ত্র বন্দেমাতরম।”৩৬
এই গানের পৌত্তলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনাে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এই গানে বন্দিত দেশমাতা এক আদি অকৃত্রিম হিন্দু দেবীমূর্তি— ত্রিনয়নী, আক্রমণাত্মক, সশস্ত্র, দশপ্রহরণ ধারিণী। এ গান যখন উপন্যাসে প্রথম উচ্চারিত হয় সেই সময়ে মুসলমান সৈন্য ও হিন্দু জনতা পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হতে উদ্যত। দেশ যদি দেবীমূর্তি’র আঙ্গিকে মা হয় তখন তা আর ধর্মনির্বিশেষে সকল দেশবাসীর জন্মভূমি থাকে না, তা হয়ে ওঠে সেই ধর্মাবলম্বী বিশেষ সম্প্রদায়ের। এ গানের এই সম্প্রদায়ভিত্তিক তাৎপর্য বুঝেই রবীন্দ্রনাথ এর বিরােধিতায় নেমেছিলেন। অথচ আগে দেখেছি ১৮৯৬ সালে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি গানটি গেয়েছিলেন। এরও পরে বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনের প্রথম দিকে তিনি তাতে যােগও দিয়েছিলেন। এই দশকে (১৮৯০-১৯০৫) রবীন্দ্রনাথ যে সাহিত্য রচনা করেছিলেন তা ছিল বিশেষভাবে হিন্দু আদর্শে ও হিন্দুভাবনায় অনুপ্রাণিত। ওই সময়ে তাঁর অন্যতম রচনা শিবাজী উৎসব ১৯৪১-এ তাই দেখা যায় ‘এক ধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড-ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’ জাতীয় হিন্দুত্ববাদী উচ্চারণ। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওই অবস্থান থেকে তিনি সরেও আসেন। সুরজিৎ দাশগুপ্তের ভাষায় ‘হিন্দুত্বের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তথা ধর্মীয় প্রসঙ্গমুক্ত শিল্পসৃষ্টিও তার পক্ষে সম্ভব ছিল।৩৭ বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটিই যা আমরা আগেই দেখেছি। আর ঘােরতর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তাদের প্রতিটি শাখায় প্রতিদিন ‘বন্দেমাতরম’ বাধ্যতামূলকভাবে গীত হয়ে আসছে। তাদের মতে এই গানটিই রাষ্ট্রের প্রকৃত দেশাত্মবােধক গান। রবীন্দ্রনাথ রচিত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ গানটি তারা বদলে দিয়ে ‘বন্দেমাতরম’ কেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। আর এখন তাে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনাধীন ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের শ্লোগান হলাে ‘ভারত মে রহনা হ্যায় তাে বন্দেমাতরম কহনা হ্যায়’।
‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের এই উত্তেজনা-উন্মাদনা বুঝতে পারা কঠিন কাজ নয়। বিগত শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে বিতর্কে নেমেছিলেন তা আগেই বলেছি। স্বদেশী আন্দোলনে প্রথম দিকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও তিনি ধীরে ধীরে এ থেকে সরে আসেন বহু দূরে। এতে অরবিন্দ-বিপিন পালদের অনেক বিরূপ সমালােচনাও তাকে, সইতে হয়েছে। তার বন্দেমাতরম বিরােধিতার মূল কারণ তিনি প্রথম সবিস্তারে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান ১৯১৫ সালে প্রকাশিত তার ঘরে-বাইরে উপন্যাসে। এতে তিনি বারবার বন্দেমাতরম’ দলের নিন্দা করেছেন, দেবীমূর্তি কেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিরােধিতা করেছেন এর সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের কারণে। ঘরে-বাইরের নিখিলেশ ও সন্দীপকে তিনি দুই পরস্পরবিরােধী স্বদেশ ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতীকরূপে উপস্থাপন করেছেন। নিখিলেশের চোখে দেশ হচ্ছে লক্ষকোটি রক্ত মাংসের মানুষ নিয়ে গঠিত যাদের বেশীর ভাগই নিরক্ষর, দরিদ্র, বঞ্চিত ও উৎপীড়িত- পঞ্চু যাদের প্রতিনিধি। এই পঞ্চদের টিকে থাকার সমস্যাই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল; কোনাে প্রতিহিংসাপরায়ণ যুদ্ধবাজ নেতা তার রাষ্ট্রবাদের প্রতাক হতে পারেনি। তার স্বদেশ কোনাে দেবীমূর্তি নয়, বরং বহু মানুষের, সংস্কৃতির, জাতিগােষ্ঠীর মিলনস্থল। বন্দেমাতরম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরােধিতা আজীবন অব্যাহত ছিল। বিগত শতকে এ নিয়ে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মাতামাতিও ছিল তেমনি প্রবহমান। এরই এক পর্যায়ে, তার জীবনের শেষ দিকে, তিনি পুনরায় এব্যাপারে তার মতামত তুলে ধরেছেন কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি চিঠিতে। ১৯৩৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বরে লিখিত ওই চিঠিতে তিনি বলেন,
“বন্দেমাতরং ব্যাপারটা নিয়ে বাঙালী হিন্দু-সমাজে যে উন্মত্ত বিক্ষোভের ও আলােড়ন উঠেছে আমার বুদ্ধিতে এ আমি কখনাে কল্পনাও করিনি।… আমার দুঃখিত হবার দিন গেছে কিন্তু বিস্মিত হবার বােধশক্তি এখনাে ভোতা হয়নি। শ্রীহর্ষে বন্দেমাতরংবাদীর পক্ষে তােমার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি স্বীকার করি। …তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনাে গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয় কিন্তু মুসলমান খ্রীষ্টান— এমন কি ব্রাহ্মও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যােগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও, “ত্বং হি দুর্গা” “কমলা কমলদল বিহারিণী, বাণী বিদ্যাদায়িনী” ইত্যাদি হিন্দু দেবী-নামধারিণীদের স্তব, যাদের প্রতিমা পূজি মন্দিরে মন্দিরে”, সার্বজাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করাতেই হবে। হিন্দুর পক্ষে ওকালতি হচ্ছে এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ তাদের কাছে আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনাে অর্থই নেই। রাগ করে মাথা ঝাকানি দিয়ে বলতে পারাে এরকম মনােভাবকে আমরা মানব না।… এ মনােভাব যাদের আছে তারা আমাদের ন্যাশনালিটির একটা প্রধান অঙ্গ… ভারতের সর্বজনীন স্তবগানে দুর্গানাম বন্ধ রাখলে এতই কী অসহ্য দুঃখ এবং ক্ষতি।৩৮
হিন্দুত্ববাদীদের কাছে বন্দেমাতরম গানের গ্রহণযােগ্যতা তাই এত অধিক। অহিন্দু বিদ্বেষী সংঘপরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি, চেতনা ও দেশাত্মবােধ বঙ্কিমচন্দ্রের দেশচেতনার সঙ্গে এক মােহনায় মিলে গেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের গুরু সাভারকরের দৃষ্টিতে ভারত হচ্ছে কেবল সেই জনগােষ্ঠীর দেশ যাদের জন্মভূমি, কর্মস্থল ও পুণ্যভূমি ভারতের ভৌগােলিক সীমানায় আবদ্ধ। তার মানে ভারতীয় খ্রিস্টান, মুসলমান যাদের পুণ্যভূমি ধর্মস্থান ভারতের বাইরে তারা কেউ ভারতীয় নন। এহেন ভারত রাষ্ট্রের প্রতীক তাই হয়ে যায় এক দেবীপ্রতিমা যা সেই সঙ্গে প্রতীক হয়ে ওঠে কেবলমাত্র হিন্দু সমাজ ও হিন্দুরাষ্ট্রের। লেখক-গবেষক তনিকা সরকারের ভাষায়, বন্দেমাতরমের দ্বারা, এমন এক দেশাত্মবােধের কল্পনা করা হয় যা ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে কোনমতেই গ্রহণীয় নয়। না তারা দেবীবন্দনা করতে পারেন, না তারা আনন্দমঠ এর মুসলমানবিদ্বেষী কথা অগ্রাহ্য করতে পারেন। এই দেশাত্মবােধ সম্পূর্ণই হিন্দুরাষ্ট্রবাদ। এখানে যেমন মুসলমান নেই, তেমনই নেই সাধারণ মানুষ। এমনকি, দেশের মাটিও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। বন্দেমাতরমের গােড়ায় আছে সুজলা-সুফলা এক মােহন নিসর্গচিত্র। গানের মাঝখানে এই দেশ মিশে যায় এক যুদ্ধপরায়ণ দেবীমূর্তির মধ্যে। মিলিয়ে যায় মাটি, গাছপালা, আকাশ, জোৎস্না, শস্য ও অন্ন। সমস্তচোখ জুড়ে জেগে থাকে শুধুমাত্র এক বিশাল রক্তক্ষয় : করাল কালীমূর্তি, দশপ্রহরণধারিণী তারিণী। ভাষাও বদলে যায় : শুরুতে যেমন দীর্ঘপ্রলম্বিত সব মাত্রা ছিল, কোমল শব্দচয়ন ছিল, পরে তা কর্কশ, দ্রুত অস্ত্রনিনাদের মাত্রা নেয়।৩৯
বাংলা তথা ভারতে ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবােধের লালন-পালন ও সযত্ন প্রসারে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা একজন তীক্ষধী উচ্চশিক্ষিত তাত্ত্বিক এবং মন্ত্রণাদাতার। এ ব্যাপারে বঙ্কিমের দ্বিধাহীন স্বীকৃতি,
“I have certainly no serious hope of progress in India execpt in Hinduism, in Hinduism reformed, regenerated and purified.”২৭
পৃথিবীর সব ধর্মের মধ্যে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে, ভারতের জাতীয়জীবনের পুনরুজ্জীবনে এর ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে তাঁর পূর্বসূরী রাজনারায়ণ বসু বা তাঁর অনুসারীদের মতাে বঙ্কিমেরও, কোনাে দ্বিমত ছিল না।”
উপরােক্ত আলােচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরমে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজার রমরমা। দেশমাতৃকাকে দশভূজা দূর্গা ও কর্তিত মানবমুণ্ড পরিহিতা কালীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরমে উপরােক্ত প্রতিমারূপী দেশমাতাকে বন্দনা করতে বলা হয়েছে। যা পরিপূর্ণরূপে তাওহীদ ও ইসলাম বিরােধী।
উপরন্তু যদি দেশমাতাকে প্রতিমারূপী মায়ের সঙ্গে তুলনা নাও করা হয় তাও শুধু দেশমাতৃকাকে বন্দনা করাও তাওহীদ ও ইসলাম বিরােধী। ইসলামে গভীর ও নিবিড়ভাবে দেশপ্রেম করা যায়। তাই তারা স্ব স্ব দেশকে ভালবাসে ও দেশসেবা করে। যতপুর সম্ভব। আর মনে রাখা দরকার পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে মুসলমান নেই। স্বাভাবিকভাবেই তারা স্ব স্ব দেশের প্রতি গভীর প্রেম ও দেশসেবার প্রদর্শন করে। তাই বলে ইসলামে দেশবন্দনা কোনমতেই বৈধ নয়। কারণ ইসলামে আল্লাহ ছাড়া কাউকেই বন্দনা করা যায় না। আর এই বিধানে চুল পরিমানও ছাড় নেই।
সুতরাং বন্দেমাতরম সঙ্গীত ও স্লোগান মানা, গাওয়া ও উচ্চারণ করা কোন মুসলমানের পক্ষে জায়েয (বৈধ) নয়। যদি কেউ এমনটা করে তাহলে তার ইসলামের বাউন্ডারীর (সীমার) মধ্যে থাকাটা সন্দীহান হয়ে পড়ে। এমনকি খারিজুল ইসলাম (ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন) ও কাফির হয়ে যেতে পারে।
উল্লেখপঞ্জীঃ
- ১. আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ, বঙ্কিম রচনাবলী উপন্যাস সমগ্র, তুলি কলম, ১, কলেজ রাে, পৃ : ৬৮১
- ২. প্রাগুক্ত, সপ্তদশ পরিচ্ছেদ, পৃ : ৬৯৫
- ৩. প্রাগুক্ত, অষ্টদশ পরিচ্ছেদ, প ঃ ৬৯৬-৬৯৭
- ৪. প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭০১-৭০২
- ৫. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭১১-৭১২
- ৬. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭২২
- ৭. প্রাগুক্ত, দশম পরিচ্ছেদ, প : ৭২৫
- ৮. প্রাগুক্ত, দ্বাদশ পরিচ্ছেদ, পৃ: ৭২৯
- ৯. প্রাগুক্ত, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃ: ৭৩০
- ১০. প্রাগুক্ত, অষ্টম পরিচ্ছেদ, প : ৭৪০-৭৪২
- ১১. আনন্দমঠ, প্রাগুক্ত, প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৬৮১
- ১২. প্রাগুক্ত,
- ১৩. প্রাগুক্ত, প্রথম খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ: ৬৯৭।
- ১৪. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭১১
- ১৫. প্রাগুক্ত।
- ১৬. প্রাগুক্ত, পৃ : ৭১১-৭১২
- ১৭. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ ; ৭২২
- ১৭. ক. প্রাগুক্ত, চতুর্থখণ্ড, যষ্ঠ পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭৩৮
- ১৮. প্রাগুক্ত, দ্বাদশ পরিচ্ছেদ; পৃ: ৭২৯
- ১৯. প্রাগুক্ত, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭৩০
- ২০. প্রাগুক্ত, সপ্তম পরিচ্ছেদ, পৃ: ৭৪০
- ২১. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ ৭২২;
- ২২. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড দশম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৭২৫
- ২৩. প্রাগুক্ত, চতুর্থ খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ পৃ: ৭৪১
- ২৪. প্রাগুক্ত
- ২৫.. প্রাগুক্ত
- ২৬. প্রাগুক্ত
- ২৭. প্রগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ পৃ: ৭২৫
- ২৮. প্রাগুক্ত, চতুর্থ খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ প : ৭৪১
- ২৯. প্রাগুক্ত
- ৩০. প্রাগুক্ত, প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ, পৃ : ৬৮১
- ৩১. নেপাল মজুমদার, পৃ : ২৫৩
- ৩২. এস. এম. আকবর উদ্দীন, বি.এ., বর্তমান বাঙ্গালা সাহিত্য মুসলমানদের স্থান, আল এসলাম, দ্বিতীয় বর্ষ, দশম সংখ্যা, মাঘ ১৩২৩, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সঙ্কলিত, প্ৰাস্তক্ত, পৃ : ২৬১
- ৩৩. নেপাল মজুমদার, পৃ : ২৫১
- ৩৪. বুদ্ধদেব বসু, রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, ১৯৭৬, পৃ : ৫৯০-৯১
- ৩৫. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতীয় মুসলমানের সংকট, কলকাতা, পৃ : ৩৬
- ৩৬, বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ : ১/৪
- ৩৭. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৬
- ৩৮. বুদ্ধদেব বসুর রচনা সংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ : ৫৯০, কল, ১৯৭৬
- ৩৯.। তনিকা সরকার, আধুনিকতার দু-এক দিক, ধর্ম, সাহিত্য ও রাজনীতি, কলকাতা, ২০০১, পৃ : ১১
[সৌজন্যঃ তালিম পত্রিকা, সম্পাদক আবু রিদা, নভেম্বর ২০০৮-ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সংখ্যা]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।