আমরা যারা লেখাপড়া করি তারা প্রায় সকলেই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখেছি কি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি কে কোথায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? আপনি ভাবতে পারেন ইউরোপ-আমেরিকা বাসীরা। কিন্তু না, বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম বিশ্বে, এক মহীয়সী মুসলিম নারী দ্বারা। ভাবতেও অবাক লাগছে না? কিন্তু এটাই সত্য। আজকের নামকরা কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২০০ বছর আগে প্রতিষ্টিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড ও ইউনেস্কোর রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর আল কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয় যার শিক্ষা কার্যক্রম এখনও বজায় রয়েছে। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করা হয়। প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী এখান থেকে পাশ করে বার হয়েছেন।
৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমা আল ফিহরি আল কুরাইশী নাম্নি এক মহীয়সী মরক্কোর ফেজ-এ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ফাতেমার পরিচয় হল, তাঁর পুরো নাম-ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ আল ফিহরিয়া আল কুরায়শিয়া। জন্মেছিলেন ৮০০ খ্রিস্টাব্দের আশপাশে বর্তমান টিউনিশিয়ার কায়রোয়ান শহরে। কুরায়েশ নাম থেকে বোঝা যায় মক্কার অভিজাত কুরায়েশ বংশজাত ছিলেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য ফাতেমার পিতা মোহাম্মদ পরিবার-পরিজন নিয়ে কায়রোওয়ান থেকে মরক্কোর ফেজে এসে পৌঁছান। এখানে তিনি সফল ব্যবসায়ীরূপে প্রতিষ্ঠা পান এবং বিপুল সম্পদের মালিক হন। তিনি সন্তানদের সুশিক্ষারও ব্যবস্থা করেন। ফাতেমার বিবাহ দেন ফেজের স্থানীয় এক পরিবারে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ফাতেমা তাঁর পিতা, স্বামী ও ভাইদের হারান। ফাতেমা ও মরিয়ম এই দুই অনাথ বোন পিতার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদের মালিক হন।
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাহিনী
সেইসময় ফেজে বিপুল জন সমাগম হচ্ছিল। মসজিদ গুলিতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। ফাতেমা ও মরিয়ম সিদ্ধান্ত নেন মৃত পিতার নামে সাদকায়ে জারিয়া হিসাবে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ এবং জায়গা জমি ওয়াকফ করে রেখে যাবেন। দুই বোন কাছাকাছি এলাকায় দুটি রসায়ন মসজিদ নির্মাণ করেন। মরিয়ম প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি নাম দেওয়া হয় আন্দালুস। ফাতেমা মসজিদের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের বর্ধিত অংশে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন ও মসজিদ-মাদ্রাসার নাম তাঁদের জন্মস্থানের অনুরূপ কারাউয়িন রাখেন। এই মাদ্রাসায় ইসলাম শিক্ষার সাথে সাথে গণিত, জোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর পাঠ ও খেতাব দেপয়া হতো। এটি আফ্রিকা মহাদেশের ইসলামী শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয় শিক্ষার প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বিখ্যাত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র মুসলিমরাই পড়তেন বা পড়াতেন না। বহু মিনিট পনেরো কাটাতে পারলাম আপনার ইহুদি খ্রিস্টান ও অমুসলিম শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য হলেন পোপ সিলভেস্টার II ও মুসা বিন মায়মোন। পপ সিলভেস্টার II এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখানে যে সকল মুসলিম মনীষী অধ্যয়ন ও শিক্ষকতা করেছিলেন, ইবন খালদুন (দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ), আল ইদ্রিসি (ভূগোলবিদ), মহিউদ্দিন আল আরাবী (দার্শনিক), নুরুদ্দিন আল বিতরুজি (জ্যোতির্বিজ্ঞানী) ইত্যাদি।
অবশেষে আল কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউরোপীয় ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে। ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ এই ৪৪ বছর মরক্কো ফ্রান্সের দখলে চলে যায়। তখন কারাউবিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন, পরীক্ষা নেওয়া এবং খেতাব প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগুন দেওয়া হয় লাইব্রেরীতেও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরীর মধ্যে গণ্য করা হয়। লাইব্রেরীটি পুড়ে যাওয়ার পরও ৪০০০ প্রাচীনতম ও দুর্লভ পান্ডুলিপি উদ্ধার করা হয়।
মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়টি আফ্রিকা ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুবিশাল অবদান রেখেছে।
ফতেমা আল ফিহরি ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত আল কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরীটি মুসলিম বিশ্ব তথা সমস্ত বিশ্বকে এখনো জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করছে। ফাতেমা আল ফিহরির মত শত শত মুসলিম মহীয়সী নারী ইতিহাসের পাতায় রয়েছেন যাঁরা প্রমাণ করেছেন ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে। অথচ না জানার কারণে আমরা মনে করি ইসলামে নারী স্বাধীনতা নেই। ইসলাম নারীদের পিছিয়ে রেখেছে সর্বক্ষেত্রেই। আমাদের এই ভুল ধারণা দূরীভূত করা উচিৎ।
সম্পাদকের নোটঃ এখানে উল্লেখ্য যে পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করা হয় ভারতের বিহারে ৫০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যায়’-এর নাম। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নালান্দা অন্যতম। ৫০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৮০০ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলেছিল। বিহারে গড়ে ওঠা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন সময়ের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। বিহারের এই প্রাচীন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় পাটনা থেকে ৮৮ কি.মি. দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত। তবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায়। আল কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড ও ইউনেস্কোর রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর আল কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয় যার শিক্ষা কার্যক্রম এখনও বজায় রয়েছে।