লিখেছেনঃ মোশারফ হোসেন
তুমি এত ভালাে বাংলা বলাে কীভাবে? প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। এরকম প্রশ্নও অবার কেউ করতে পারে নাকি! আগে তাে কোনওদিন শুনিনি। সাড়ে সতেরাে বছর বয়স। কলকাতার কলেজে পড়তে এসেছি। দু-চারজনের সঙ্গে খানিক চেনাজানা হয়েছে। তাদেরই একজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই বন্ধুই নিয়ে গিয়েছিল। চা খেতে খেতে কথাবার্তা বলছিলাম। মিনিট দশেক বাদে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বন্ধুর দিদি। কলেজ ছাত্রী। আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়।
আমি উত্তর দিলাম, বাঙালির ছেলে ভালাে বাংলা বলব, এতে অবাক হওয়ার কী আছে! পাল্টা প্রশ্ন সেই দিদির- তােমার নাম যা বললে, তাতে তুমি তাে মুসলমান ! তােমাদের ভাষা তাে উর্দু। এখন আবার নিজেকে বাঙালি বলছ কেন?
প্রায় হতবাক আমি বললাম, বললাম তাে আমি বাঙালি! ধ্যুৎ, তাই আবার হয় নাকি! মুসলমান কখনও বাঙালি হতে পারে?
আমি শিক্ষকের সন্তান। একটু মাস্টারির ঝোঁক বােধহয় রক্তের মধ্যেই ছিল। সেদিন সেই দিদিকে বােঝানাের চেষ্টা করেছিলাম বাঙালি বলতে কী বােঝায়। এখনও মনে পড়ে, বলেছিলাম, বাংলায় যারা বাস করে, বাংলা যাদের মাতৃভাষা- তারাই বাঙালি। সে হিন্দু হতে পারে অথবা মুসলমান । কিংবা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। আর, যদি ধর্মের কথা বলি তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশের মুসলিমদের হিসেবের মধ্যে আনলে সারা পৃথিবীতে মােট যত বাঙালি বাস করেন, সংখ্যার বিচারে তার বেশিরভাগটাই কিন্তু মুসলমান । শুধু তাই নয়, আমরা যে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা ভাষা দিবস পালন করি, তার মূলেও কিন্তু কয়েকজন তরুণের আত্মবলিদানের ঘটনা রয়েছে। সেই তরুণদের নাম রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার। সবাই-ই বাংলাভাষী মুসলিম।
সেদিনের সেই ঘটনার পর কতগুলাে বছর কেটে গেল। তবু এখনও মাঝে মাঝে মন্তব্য শুনতে হয়, আপনার চেহারা দেখে, কথাবার্তা শুনে কিন্তু আপনাকে বাঙালির মতােই মনে হয়। মুসলমানের মতাে নয়। যাঁদের কাছে শুনি তাঁরা রীতিমতাে লেখাপড়া জানা মানুষ। কলেজ তাে বটেই, অনেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও রয়েছে। তবে ওসব শুনে আজকাল আর অবাক হই না। বড়জোর বহুকাল আগে আলাপ হওয়া সেই দিদির কথা মনে পড়ে। ভাবি, অতগুলাে বছর আগে বছর কুড়ির সেই তরুণীর তাে কোনও অপরাধ ছিল না! সামনেরমানুষগুলাে সম্পর্কে মনে মনে বলি, ঈশ্বর এঁদের ক্ষমা কোরাে। এঁরা কত কী জানেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তের ইতিহাস, ভূগােল, সংস্কৃতি, ভাষা-কত কী না এঁদের জানার পরিধির মধ্যে রয়েছে, সেগুলাে নিয়ে রীতিমতাে চর্চা করেন। প্রয়ােজনে তর্ক-বিতর্ক করেন। অথচ, প্রায় হাজার বছর ধরে সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কতবড় অজ্ঞ! কত উদাসীন! কত অর্বাচীন!
কারও কারও মুখে এমনও শুনেছি, দেখুন, আমাদের বাঙালি কালচারের সঙ্গে আপনাদের মুসলমানি কালচার মিলবে না। এঁরা বাঙালি আর হিন্দুকে সমার্থক ধরে নেন। যেন বাঙালি হলে কেবল হিন্দুই হতে হবে। এই প্রসঙ্গেই পুরনাে আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাংবাদিকতা বিভাগটি ছিল কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের হার্ডিঞ্জ বিল্ডিংয়ে। এখনও সম্ভবত ওখানেই রয়েছে। ছাত্রাবস্থায় একদিন ধর্ম, সম্প্রদায় প্রভৃতি নিয়ে কথা বলতে বলতে ক্লাসরুমের মধ্যেই আমি একটা মজার খেলা খেলেছিলাম। পাঁচ-ছ’জন সহপাঠীকে বলেছিলাম, আমরা তাে ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া। দেশের অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই ইউনিভার্সিটি স্তর পর্যন্ত আসার সুযােগ পায়। তাদের চোখে আমরা শিক্ষিত তাে বটেই, সচেতন মানুষও। আমাদের সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি এক নিঃশ্বাসে হিন্দুদের দশটা ধর্মীয় উৎসব-পার্বণের নাম বলে যাচ্ছি, তােরা কে মুসlলমান -দের ক’টা উৎসবের নাম বলতে পারিস দেখ তাে! পাঁচজনের কেউই ঈদ আর মহরমের বেশি এগতে পারেনি।
মনে পড়ে, সেদিন বলেছিলাম, এই ধারণা, এই জ্ঞান নিয়ে তাে আমরা ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষ করে বিভিন্ন পেশায় যাব। কেউ সাংবাদিকতা, কেউ শিক্ষকতা আবার কেউবা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হব। যে রাজ্যের মােট বাসিন্দাদের চারভাগের একভাগেরও বেশি মানুষ মুসলমান, সেই রাজ্যে আমাদের ভাবনা, অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গিই তাে নানাভাবে প্রতিফলিত হবে। অথচ, আমরা আমাদের সামগ্রিক সমাজ সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ অথবা উদাসীন দেখ!
এসম্পর্কে শহুরে বাঙালি হিন্দু এবং গ্রাম বাংলার বাসিন্দা বাঙালি হিন্দুর মধ্যে অবশ্যই যথেষ্ট তফাত রয়েছে। আমার ওই অভিজ্ঞতাগুলি মূলত শহর বা শহরতলির বাসিন্দা বাঙালি হিন্দুদের কাছ থেকেই। বাঙালি সংস্কৃতি বলতে তাঁরা কেবল বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিকেই বােঝেন। আর, এই শহুরে মানুষগুলাের অজ্ঞতা বা উদাসীনতা নানা পথে সঞ্চারিত হতে থাকে গ্রামীণ মানুষগুলাের মধ্যেও। নানারকম ভুল ধারণা ক্রমশ দানা বাঁধে। এই ভুল ধারণাই বহু সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে। অনেকে আবার বহুজনের এই অস্বচ্ছ ধারণাকে হাতিয়ার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের চেষ্টা করেন। সব জেনেবুঝেও লাগাতার অসত্য বলে চলেন। এর একটি অত্যন্ত টাটকা উদাহরণ চলতি অনুপ্রবেশ ইস্যু। বিজেপি’র এক নামী বাঙালি নেতা ইদানীং দিনের পর দিন বলে চলেছেন, রাজ্যে নাকি দু’কোটি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। তাঁদের দলীয় আদর্শগত সংজ্ঞায়-বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা হিন্দুরা শরণার্থী। কিন্তু একইভাবে কোনও মুসলিম এপারে এসে থাকলে তিনি অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ তাঁর হিসেবে বাংলাদেশ থেকে দু’কোটি মুসলিম পশ্চিমবঙ্গে এসে ঘাঁটি গেড়েছে।
কিন্তু ইতিহাস সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিরাও জানেন, বাংলার মুসলিমরা বাংলাভাগ চাননি। বাংলাভাগের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কোনও ভােটাভুটিও হয়নি। কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিজেদের প্রয়ােজনে নিজেদের মতাে করে বাংলা ভাগ করেছিলেন (এই প্রভাবশালীদের প্রায় সবাই-ই হিন্দু)। যার জেরেই পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে সাত পুরুষের ভিটেমাটি ফেলে এপারে চলে আসতে হয়েছিল। হয়ত তৎকালীন পরিস্থিতিই ওই অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করেছিল (বাংলা ভাগের ঘােষণা না হলে পরিস্থিতি ওরকম নাও হতে পারত)। এটা যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে সত্য, ওপার বাংলা থেকে যত সংখ্যক হিন্দু বাংলাভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন, তার তুলনায় অনেক কম সংখ্যক মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিজেদের ভিটেমাটি, সামান্য চাষের জমি-জিরেত, চেনা পরিবেশ, প্রতিবেশী, পেশা প্রভৃতি ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দেন। যাঁরা গেছেন তাঁদের সিংহভাগই হয় সরকারি চাকুরে অথবা অবস্থাপন্ন বা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মানুষ। এরা ছাড়াও গিয়েছেন কলকাতা ও শহরতলির কিছু অবাঙালি মুসলিম। কিন্তু গ্রাম বাংলার সাধারণ মুসলিমদের শতকরা ৯০ ভাগকেই ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি এবং দীর্ঘকালের হিন্দুপ্রতিবেশীদের ওপর অগাঢ় আস্থাই তাঁদের নিজভূমে অবিচল থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিল। প্রতিবেশী হিন্দু সহ-নাগরিকদের কখনও নিজেদের বিপদের কারণ বলে মনে করেননি তাঁরা। ফলে, বাংলাভাগের দু-চার বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা মারাত্মক মাত্রায় কমে যায়নি। একইভাবে স্বাধীনতার পর তে ৭৩-৭৪ বছরে এরাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও স্বাভাবিকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণই রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে হওয়া জনগণনার রিপাের্টগুলি খুঁটিয়ে দেখলে পরিষ্কার বােঝা যায়, দেশের অন্য অংশে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ওই হারের আহামরি তফাৎ নেই। প্রচুর মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে এপারে এসে থাকলে পরিসংখ্যানই অন্য কথা বলত। এখন পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম বাসিন্দার মােট সংখ্যা তিন কোটির সামান্য বেশি। বিজেপি’র মহান নেতার কথা সত্যি হলে মাত্র এক কোটি মুসলিম পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা। বাকিরা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারী। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত বাসিন্দা বর্তমান এককোটি মুসলিমের সংখ্যা বাংলাভাগের সময় কত ছিল? বাংলার গ্রামাঞ্চলে একটু বিস্তারিত খোঁজখবর নিলে জানা যাবে শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলিমই বেশ কয়েক পুরুষ ধরে একই অঞ্চলে, অনেকে এক ভিটেয় বসবাস করছেন। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে হিন্দুদের একাংশের পেশার পরিবর্তন হয়েছে। চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, সন্তানদের লেখাপড়া প্রভৃতি কারণে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলের দিকে চলে এসেছেন। মুসলিমদের মধ্যেও একইরকম ঘটনা ঘটে গেছে। যদুর জানি, বিজেপি’র ওই মহা ক্ষমতাধর নেতার নিজের পরিবারও পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামাঞ্চলের দীর্ঘকালের বাসিন্দা। তাই বিষয়টি তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তবু রাজনৈতিক কারণেই হাজার হাজার মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে অসহিষ্ণু করে তােলার চেষ্টা করছেন। বিদ্বেষের মনােভাব গড়ে তােলাচ্ছেন। অসত্য কথা বলে বিপথে পরিচালিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। এর জেরে বাংলাভাষী সাধারণ মুসলিমমাত্রই বাংলাদেশ থেকে আসা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারী বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে শহুরে বাঙালি হিন্দুদের উল্লেখযােগ্য অংশ বাঙালি মুসলিমদের সম্পর্কে অবহিতনা থাকার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। নিজেদের অবচেতনেই তাঁরা অকারণে সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন হয়ে উঠছেন। যদিও আদতে তাঁরা সেরকম নন।
বাংলার মুসলিমদের সম্পর্কে সাধারণ হিন্দুরা তেমনভাবে অবহিত না থাকার সুযােগকে ব্যবহার করে তাঁদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনােভাব সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন গেরুয়া শিবিরের বহু ‘জ্ঞানপাপী’ নেতা। ওই দুষ্কর্মে তাঁরা যত সফল হবেন, তাঁদের ভােটের বাক্স ততই ভরে উঠবে। আর অন্যদিকে, বাংলায় তাঁদের প্রভাব যতবেশি বাড়বে, ভবিষ্যতে বাঙালির ভাষা, কৃষ্টি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজভাবনা ততই বিপন্ন হতে থাকবে। ঘাড়ের ওপর চেপে বসবে হিন্দি বলয় থেকে ধেয়ে আসা ভিন্ন সংস্কৃতি।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।