আওরঙ্গজেবের জীবনীকার সাকি মুসতা’ইদ খান তার লিখিত মা’আসির ই আলমগীরী বা আলমগীর নামায় দৌলতাবাদ ও ইলোরা গুহামন্দিরের একটি বর্ণনা দিয়েছেন।
মুসতা’ইদ খান বলেছেন তিনি এলাকার কয়েকজন মুসলিম সন্ত ও ইলোরা গ্রামটির বর্ণনা দেবেন। আওরঙ্গাবাদ থেকে ৮ ক্রোশ দূরে এবং দৌলতাবাদ দুর্গ থেকে ৩ ক্রোশ দূরে শায়েখ বুরহান উদ্দিন, শায়েখ জয়নুল হক, শায়েখ মুনতাখাবউদ্দিন যার-বক্স, মীর হাসান, সৈয়দ রাজু এবং আরও বেশ কয়েকজন সন্তের সমাধি রয়েছে। এঁদের অনেকেই নিজামউদ্দিন আওলিয়ার শিষ্য ছিলেন। এঁরা বিদেশ থেকে এই এলাকায় আসেন এবং এখানেই সমাধিস্থ হন। কারণ, তুঘলকের পুত্র মহম্মদ শাহ মালিক জুনা (মুহাম্মদ বিন তুঘলকের নাম এইভাবেই লিখেছেন) ভেবেছিলেন দেবগিরি দুর্গটি তাঁর সাম্রাজ্যের এক্কেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। তাই তিনি এই এলাকার নাম দেন দৌলতাবাদ। ভেবেছিলেন রাজধানী দিল্লি থেকে এখানে সরিয়ে আনবেন। তিনি দিল্লির নাগরিকদের পরিবারসহ এখানে নিয়ে আসেন।

এখান থেকে অল্প কিছু দূরত্বে ইলোরা বলে একটি জায়গা রয়েছে। এখানে বহু যুগ আগে, দক্ষ খোদাইকারীগণ তাঁদের জাদু হাতের ছোঁয়ায় পাহাড় খোদাই করে দৈর্ঘ্যে এক ক্রোশ জায়গা জুড়ে প্রশস্ত ঘর বাড়ি তৈরি করেছিলেন। এখানকার প্রতিটি ছাদের ভিতর (সিলিং) ও দেওয়ালে বিভিন্ন মূর্তি খোদাই করা হয়েছে যাদের দেখে জীবন্ত মনে হয়। পাহাড়ের শীর্ষদেশটি দূর থেকে দেখে মনে হয় সমতল যাতে অভ্যন্তরের খোদাইকৃত অট্টালিকাগুলি না বোঝা যায়।
প্রাচীন কালে যখন পাপাচারী অবিশ্বাসীরা এই দেশে রাজত্ব করত তখন নিশ্চিতভাবেই তারা, কোন জিন নয়, গুহাসমূহ তৈরি করেছিলেন। যদিও বেশ কিছু জায়গায় পরম্পরাগত পার্থক্য রয়েছে (বৌদ্ধ, জৈন ও শৈব); এই স্থানটি ছিল ভুয়ো বিশ্বাসীদের উপাসনাস্থল। এই মুহূর্তে পাকাপোক্ত ভিত্তির উপর স্থাপিত হলেও এলাকাটি নির্জন; এটা শেষের সেদিনের সতর্কীকরণের জ্ঞান উন্মোচন করে যাঁরা ভবিষ্যতের চিন্তা-ভাবনা করেন। সব মরশুমেই, বিশেষ করে বর্ষার সময় (মনসুন) যখন এই পাহাড়, তার নীচের সমতলভূমি প্রচুর গাছপালা ও অঢেল পানির জন্য বাগান বলে মনে হয়, তখন দেখার জন্য জনতার ঢল নামে। একটি জলপ্রপাত প্রায় ১০০ গজের মত প্রশস্ত পাহাড় উপচে ঝরে পড়ে। এটি পদচারণার জন্য চমৎকার স্থান, চোখের পক্ষেও মনমুগ্ধকর। যতক্ষণ না কেউ দেখছে ততক্ষণ কোন লিখিত বর্ণনা এর সঠিক চিত্রায়ন করতে পারবে না। কেমন করে আমার কলম আমার বর্ণনার পাতাটিকে শোভিত করবে?

সৌভাগ্যবশত ২০০৪ শীতে সমগ্র স্থানটি ভ্রমণ করেছিলাম। খান সাহেবের বর্ণনা মতই স্থানটি এখনও রয়েছে। তবে দৌলতাবাদ দুর্গের মসজিদটির মিম্বারে ভবানী মূর্তি এবং স্বাভাবিকভাবেই খুলনাবাদে আওরঙ্গজেবের সাদামাটা সমাধিস্থলের বর্ণনা ইলোরার বর্ণনার সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সাকি মুসতা’ইদ খান সম্রাটের জীবনীর শেষ দিকে সম্রাটের ইহলোক ত্যাগ ত্যাগ ও তাঁর সমাধিস্থ হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, সম্রাট ২১ ফেব্রুয়ারি ১৭০৭, শুক্রবার ইহলোক ত্যাগ করেন। শনিবার ২৫ ক্রোশ দূর থেকে শাহজাদা মোহাম্মদ আজম এসে পৌঁছালেন। সম্রাটের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় শায়েখ জৈনুদ্দিনের সমাধিস্থলের চত্বরে। স্থানটি আওরঙ্গাবাদ থেকে ৮ ক্রোশ দূরে এবং দৌলতাবাদ থেকে ৩ ক্রোশ দূরে। লাল পাথরের একটি চতুষ্কোণ (চবুতরা) প্ল্যাটফর্ম, দৈর্ঘ্যে তিন গজ ও প্রস্থে আড়াই গজ সমাধির উপর স্থাপন করা হয়। প্রস্তর চবুতরাটির মাঝামাঝি জায়গায় প্রমাণ সাইজের কেটে বাদ দিয়ে কবরের মাটি দেখা যায় এবং সুগন্ধি ফুল গাছ রোপন করা হয়। আমি দেখেছিলাম বন তুলসীর চারা। উক্ত স্থানটির নাম খুলদাবাদ এবং আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থলকে বলা হয় খুলদ মকান।
নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা




