লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
আজ থেকে ৩০০ বছর আগে মহান বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছিলেন, সময় হল পরম, অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের সকল স্থানেই সময় একই হারে বয়ে চলেছে। আমরা পৃথিবী, চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহ যেখানেই থাকি না কেন সময় একটি ধ্রুব গতিতে চলতে থাকবে। তাঁর মতে স্থানের সাথে সময়ের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ‘জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি’ থিওরীর মধ্যমে প্রমাণ করেছেন, সময় সব ক্ষেত্রে ধ্রুব গতিতে চলে না, একমাত্র আলোই একটি ধ্রুব গতিতে চলে। আলোর গতি সকল স্থানে সমান থাকবে। অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের একটি স্থানে সময়ের গতি এক এক রকমের। অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ডে যত গ্রহ বা নক্ষত্র রয়েছে সেই গ্রহ বা নক্ষত্রের সময়ের গতি ভিন্ন। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় Time Dilation. এবার আসি টাইম ট্র্যাভেলের বিষয়ে, আইনস্টাইনের মতে ব্রহ্মাণ্ডের সব থেকে দ্রুত গতিশীল বস্তু হল আলো। এখন যদি এমন কোন রকেট বা যান আবিস্কার করা হয় যা আলোর থেকে গতিবেগ বেশী বা তার কাছাকাছি তাহলে টাইম ট্র্যাভেল করা সম্ভব। ধরা যাক উক্ত রকেটটির স্পিড আলোর বেগের ৮৭% তাহলে সময় ২ গুণ ধীর হয়ে যাবে। আর যদি রকেটের স্পিড আলোর বেগের ৯৯.৯৯% হয় তাহলে সময় ৭০ গুণ ধীর হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেই রকেটে চড়ে যদি মহাকাশে ১ বছর ভ্রমণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসে তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীতে কেটে গেছে ৭০ বছর। আর রকেটের গতিবেগ যদি আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯% হয় তাহলে পৃথিবীতে ফিরে এসে দেখা যাবে পৃথিবীতে কেটে গেছে ৭০৭ বছর। আর একটি ব্যাপার শুনলে অবাক লাগবে আমাদের মহাকাশচারীরা মহাকাশ স্টেশনে এক বছর মিশন সম্পন্ন করে যখন তাঁরা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তখন তাঁরা সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরিমাণ ভবিষ্যতে ভ্রমণ করেন। যেহেতু তাঁরা প্রতি ঘন্টায় ২৮৯৬৮ কিলোমিটার বেগে ভ্রমণ করতে পারেন। তাই ভবিষ্যতে টাইম ট্র্যাভেল করা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
হিন্দু পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থেও এই টাইম ট্র্যাভেল এর ব্যাপারে স্পষ্ট বলা আছে। ঘটনাটি উল্লেখ আছে মহাভারতে। মহাভারত হল মূলত প্রাচীন মহাকাব্য। তবে হিন্দুদের অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এটাকে ধর্মগ্রন্থ বলেই বিশ্বাস করে। গবেষকদের মতে মহাভারত রচনা হয়েছে খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০ সালের কাছাকাছি কোনও একটা সময়ে। মহাভারতে যুগকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। পৃথিবী সৃষ্টির পরের সময় থেকেই সত্যযুগের সূচনা হয়। সত্য যুগের ঠিক মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন কুকুম্বি রৈবতের রেভতি নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল কুশস্থলি। মহারাজ রৈবতের রেভতি নামের এক সুন্দরী কন্যা ছিল। রেভতি শুধু রূপেই শ্রেষ্ঠ ছিল তা নয় বরং তার কোন দিক থেকেই কোন প্রতিদ্বন্দী ছিল না। মহারাজ রৈরত তাঁর সেই গুণবতী ও রূপবতী মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিলেন না। তাই মহারাজ রৈরত উপায় না দেখে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভেবেছিলেন ব্রহ্মা নিশ্চয় কোন না কোন উপায় বলে দেবেন। তাই তিনি মেয়ে রেভতিকে নিয়ে ব্রহ্মলোকে পাড়ি দিলেন। মহারাজ রৈবত ব্রহ্মলোকে পৌঁছে দেখলেন ব্রহ্মা তখন গান্ধর্বদের সঙ্গীত শুনতে ব্যস্ত। তাই তিনি বাধ্য হয়ে সঙ্গীত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। সঙ্গীত শেষ হবার পর মহারাজ যখন ব্রহ্মাকে ব্রহ্মলোকে আসার সব কথা খুলে বললেন তখন ব্রহ্মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ব্রহ্মা বললেন, হে রাজা, তুমি ও তোমার কন্যা যখন সঙ্গীত শুনছিলে, এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে কেটে গেছে শত সহস্র বছর। তোমার যুগের রাজপুত্রেরা তো গত হয়েছেই, এমনকি তাদের পুত্র – প্রপৌত্র এবং তস্য তস্য পুত্ররাও গত হয়েছে সহস্র বছর আগেই। একথা শুনে মহারাজ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি এখানে বসে মাত্র দুই একটা সঙ্গীত শুনলেন আর এর মধ্যেই শত সহস্র বছর কী করে কেটে গেল। রাজার মনের এই অবস্থা দেখে ব্রহ্মা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, মহাবিশ্বে বিভিন্ন স্থানে সময়ের গতি ভিন্ন। পৃথিবীতে সময় যে গতিতে বয়ে চলেছে, মহাবিশ্বের অন্য স্থানে সে গতিতে চলে না। প্রত্যেক গ্রহ নক্ষত্রের সময়ের গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর ব্রহ্মলোকের কয়েক মুহূর্তে পৃথিবীর শত শত বছর পার হয়ে গেছে। তাই পৃথিবীতে এখন দ্বাপর যুগের শেষ সময় চলছে। মহারাজ রৈবত ও তার কন্যা রেভতি যখন পৃথিবীতে ফিরে এলেন তখন সত্য সত্যিই দেখলেন যে পৃথিবীতে সত্য যুগ ও ত্রেতা যুগ পার হয়ে দ্বাপর যুগের শেষভাগ চলছে। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছে। পরে ব্রহ্মার কথামত রাজা রৈবত তাঁর কন্যার বিয়ে দেন শ্রীকৃষ্ণের ভাই বলরামের সাথে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে টাইম ট্র্যাভেলের ব্যাপারে আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ব্রহ্মলোকের সম্পূর্ণ দিন রাত পৃথিবীর ৮.৬৮ ট্রিলিয়ন বছর কেটে যায়। একে ‘কল্প’ বলা হয়। হিন্দুধর্ম মতে আবার চার যুগকেও ‘কল্প’ বলা হয়।
যাইহোক আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরী অফ রিলেটিভিটির সাথে আশ্চর্যজনকভাবে এই পৌরাণিক গল্পটি মিলে যাচ্ছে না? শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থেই নয় ইসলাম ধর্মেও টাইম ট্র্যাভেলের ব্যাপারে বলা আছে। কুরআন শরীফে আসহাবে কাহাফের ঘটনায় উল্লেখ আছে যে সাতজন যুবক একটি গুহার ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে ৩০৯ বছর পর জাগে। ঘুমের মধ্যে তারা ৩০৯ বছর ভবিষ্যত ভ্রমণ করেছিল। হাদীস শরীফেও বর্ণিত আছে, হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যে মেরাজে গিয়েছিলেন সেটা ছিল তাঁর টাইম ট্র্যাভেল। শুধু তাই নয় ইসলাম ধর্মে উল্লেখ আছে যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর এক দিন, পৃথিবীর মানুষের হাজার বছরের সমান।