লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
প্রথমেই বলে রাখি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ নিয়ে যা কিছুই চলছে তা এক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলের প্রোপাগাণ্ডা ছাড়া কিছুই নয়। এই মারকাজ সংলগ্ন বাংলাওয়ালী মসজিদের বয়স কম পক্ষে ১০০ বছর। তবে একথা বলে রাখি দ্বাদশ শতকে ভারতের বিখ্যাত সুফী চিশতিয়া তরিকার হজরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহঃ) [1238 – 3 April 1325] এর দরগার সাথে নিজামুদ্দিন মারকাজের কোন সম্পর্ক নেই। নিজামুদ্দিন মারকাজ অন্য স্থানে রয়েছে এবং নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরগাহ অন্য স্থানে রয়েছে। শুধু তাই নয় নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরগার যাঁরা দর্শন করতে বা জিয়ারত করতে যান তাঁদের অধিকাংশ মতাবম্বীর সাথে নিজামুদ্দিন মারকাজের তবলিগি জামাআতের মতবিরোধ রয়েছে। তাবলিগি জামাআত মাজারে গুম্বদ নির্মান করার ঘোর বিরোধী। তাবলিগি জামাআত হল এমন এক শরীয়াতপন্থী যাঁরা হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ছেড়ে যাওয়া ইসলামকে পুরোপুরি অনুসরণ করারা চেষ্টা করেন। অনেক অমুসলিম ভাই নিজামুদ্দীন মারকাজ ও নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরগাহ এক মনে করে ভুল করেন।এবার আসি নিজামুদ্দিন মারকাজে করোনা আক্রমণ প্রসঙ্গে। নিজামুদ্দিন মারকাজে যখন যখন তাবলিগি জামাআত শুরু হয় অর্থাৎ ১৩ ই মার্চ ঠিক সেইদিন ভারতের স্বাস্থ মন্ত্রালয় বলেন, “কোরোনা ভাইরাসের ফলে কোনোও প্রকারের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটার কোনোও আকস্মিক সঙ্কট নয়।” সুতরাং করোনা ভাইরাস নিয়ে কোন সরকারী ঘোষণার আগেই অর্থাৎ স্বাস্থ মন্ত্রালয়ের সংকটহীন অবস্থা বলার আগেই তবলিগি জামাআত শুরু হয়। তবলিগি জামাআত শেষ হয় ১৫ মার্চ। অর্থাৎ তখনও সরকারীভাবে করোনা নিয়ে ভারতে কোন নির্দেশিকা জারি হয়নি। মার্চ ১৬: দিল্লী সরকার সমস্ত ধার্মিক স্থল বন্ধ করার আদেশ দেন। তখনও সারা দেশ ব্যাপি লক ডাউনের ঘোষনা হয়নি। মনে রাখা প্রয়োজন এই দিনেই হিন্দু মহাসভা গোমূত্র পার্টি আয়োজন করলো কোরোনা রুখতে। মার্চ ১৭: তিরুপতি মন্দিরে ৪০,০০০ – শ্রদ্ধালুর নাম রেজিস্টার করা হয়। মার্চ ১৮: তিরুপতি মন্দিরে আরও ৪০,০০০ -এরও বেশী শ্রদ্ধালুর নাম রেজিস্টার করা হয়। অর্থাৎ মোট ৮০,০০০- শ্রদ্ধালুর নাম রেজিস্টার করা হয়। এসব হয়েছিল তবলিগি জামাআতের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর। এই ১৮ তারিখেই বসুন্ধরারাজের পুত্র দুশ্যন্ত সিং রাষ্ট্রপতির সাথে প্রাতঃরাশে মিলিত হন। ওইদিনই পর্যটন, পরিবহন ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত এক সংসদীয় কমিটির সভায় অংশগ্রহণ করেন, যেখানে ২০ জন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে তিনি কনিকা কাপুরের দেওয়া পার্টিতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং কনিকা কাপুর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। মার্চ ১৯: তিরুপতি মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই দিনেই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনতা কার্ফুর ঘোষণা করেন এবং তালি ও থালি বাজিয়ে নিজ নিজ বাড়ির ব্যালকনি থেকে ডাক্তারদেরকে শ্রদ্ধা জানানোর আবেদন করেন। মার্চ ২০: জনতা কার্ফু। এই জনতা কার্ফুর দিন সারা দেশ ব্যালকনি থেকে তালি ও থালি না বাজিয়ে রাস্তায় নামে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিয়ে চরম উন্মাদনার সাথে তালি ও থালি বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে। মনে রাখা প্রয়োজন এই সময় তবলিগি জামাআতের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছিলেন। তবে ২১-শে মার্চ থেকে যেহেতু ট্রেন বন্ধ ছিল। তাই জামাআতের লোকেরা সবাই বাড়ি ফিরে যেতে পারেন নি। অনেকেই আটকে গেছিলেন। ২৩-শে মার্চঃ বড় খবর হল মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় ৩০০ জনের জমায়েতে বিজেপি সরকার শপথ গ্রহণ করে। আগেই বলে রাখা উচিত যে এই সরকার গঠন করার জন্যই বিজেপি সরকার লক ডাউনের ঘোষণা করেনি। করলে সরকার গঠনের পুরো প্রক্রিয়াতেই জল ঢালা যেত। অর্থাৎ সরকারের কাছে সারা দেশকে করোনার মারাত্মক প্রকোপ থেকে বাঁচানোর চাইতে সরকার গঠন করে মধ্য প্রদেশে ক্ষমতা দখল করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মধ্য প্রদেশে যেমনি সরকার গঠন হয়ে গেল তার পরেই লক ডাউনের ঘোষণা হয়। ২৩-শে র্মাচ মাননীয় দিল্লী মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল লক ডাউন ঘোষণা করলে সড়ক পরিবহণও বন্ধ হয়ে যায়। তবুও নিজামুদ্দীন মারকাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নানান ব্যবস্থাপনায় ১৫০০ মুবাল্লেগ (জামাআতের লোক) চলে যান। এই দিনেই মৌলানা ইউসুফ S.H.O. কে চিঠি লিখে জানান যে আমরা ২৫০০ লোকের মধ্যে ১৫০০ লোককে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি, বাকি ১০০০ লোক লকডাউনের ফলে আটকে পড়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য যথাযথ প্রদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। এই ১০০০ জন লোককে প্রশাসন সরানোর ব্যবস্থা করুক। প্রশাসন করেনি। মসজিদে নামাজের উপর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বহু আগে থেকেই জারি ছিল। মার্চ ২৫: S.H.O পক্ষথেকে কোনো সাড়া মিলেনি অপরদিকে সারা ভারত লক ডাউন। মৌলানা ইউসুফ পুনরায় S.H.O. কে চিঠি পাঠিয়ে করে অনুরোধ করেন। লকডাউনের ফলে বিভিন্ন রাজ্যের শ্রমিকরা যেমন দিল্লিতে আটকে পড়েছে তেমনি জামাআতের লোকেরাও আটকে পড়েছে অর্থাৎ প্রশাসনের কাছে একাধিকবার আবেদন করার পরেও কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা হয়নি। উল্লেখ্য, এই দিনেই অযোধ্যায় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ লক ডাউন ভেঙে রামলালা যাত্রা করেন। এক কথায় তবলিগি জামাআত শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেসব কার্যক্রম চালু ছিল তা হল, বসুন্ধরারাজের পুত্র দুশ্যন্ত সিং রাষ্ট্রপতির সাথে প্রাতরাশে মিলিত হওয়া, পর্যটন, পরিবহন ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় অংশগ্রহণ যেখানে ২০ জন সাংসদের উপস্থিতি প্রভৃতি। এর আগে তিনি কনিকা কাপুরের দেওয়া পার্টিতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং কনিকা কাপুর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এসব হয়েছিল ১৮ মার্চ। জামাআত শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অর্থাৎ ১৯ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে বলেন ২০ মার্চ বিকাল ৫ টার মধ্যে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় কমলনাথকে শক্তি পরীক্ষা দিতে হবে। ২০ মার্চ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বেই কমলনাথের ইস্তফা। সারা মধ্যপ্রদেশ জুড়ে বিজেপির বিজয় উৎসব, শোভাযাত্রা সহকারে। এই দিনেইনির্ভয়া ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের ফাঁসি এবং ফাঁসি ‘উদযাপনে’র জন্য তিহার জেলের সামনে প্রচুর মানুষের সমাবেশ উৎসবের মেজাজে। ২৩ মার্চ কোন আলোচনা ছাড়াই সংসদে অর্থবিল পাশ। সংসদের অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা। এইসবই হয়েছিল তবলিগি জামাআত শেষ হয়ে যাবার পরে। সুতরাং এখানে ১৩ থেকে ১৫ মার্চ দিল্লির নিজামুদ্দিনে যখন ধর্মীয় জমায়েত হয়, তখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কারণে কোন জমায়েতের উপর কোন নিষেধ ছিলনা। এরপরেও বড় বড় জমায়েত হয়েছে। বসুন্ধরারাজের পুত্র করোনা আক্রান্তের পার্টি ঘুরে সংসদে যাওয়া, মধ্যপ্রদেশে ঘোড়া কেনাবেচা করে সরকার ফেলে দিয়ে বিজেপি রাস্তায় বিজয় উৎসবে চরম উল্লাসে মেতে ওঠা, ফাঁসি ‘উৎসবে’ তিহাড় জেলের সামনে দলে দলে লোক জমায়েত হওয়া প্রভৃতিতে কোন অপরাধ হয়না, এফ আই আর হয়না। এফ আই আর হল নিজামুদ্দিনের ঘটনায়। সুতরাং ক্রনোলজিটা বুঝুন।
দিল্লিতে ৫০,০০০ এরও বেশী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি আমাদের সামনে উঠে আসে এবং বিভিন্ন রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের পায়ে হেঁটে কয়েকশো কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করার ছবি সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় এবং ২৫ জনের বেশী লোক মারা যায়, এইসবের জন্য বিজেপি সরকার কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে চলে গেছিলে, তাই ফ্যাসিবাদী সরকারকে রক্ষা করার জন্য এবং জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য আর সরকারের ব্যার্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে জন্য সরকারের পোষ্য মিডিয়া নিজামুদ্দীন সম্পর্কে যা কিছুই বলেছে তা অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
চিনের উহানে লক ডাউন ঘোষণা করা হয় জানুয়ারীর ২৩ তারিখে। বিশ্ব জুড়ে ফেব্রুয়ারীতে সৌদি সহ খাড়ির দেশগুলিতে লক ডাউন, মসজিদ বন্ধ, এমনকি মুসলিমদের প্রধান তীর্থস্থান বা হজকেন্দ্র মক্কা শরীফেও ওমরাহ (একটি ধর্মীয় বিধান) বন্ধ করা হয় মার্চের মাঝামাঝি সময়ে। আর ভারতে তৎপরতা শুরু হয় মার্চের প্রায় শেষের দিকে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন বিজেপির আইটি সেল যে রাহুল গান্ধীকে ‘পাপ্পু’ বলে কটাক্ষ করে সেই রাহুল গান্ধী বহুদিন আগেই করোনা নিয়ে টুইট করে দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন অথচ সরকার কোন পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু তাই নয় আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই মাসের মার্চের ১১-১২ তারিখ প্রথমে স্কুল-কলেজ বন্ধ করেন, তবে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল। তখন তিনি বিরোধী পক্ষ ও কিছু স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর কাছে চরমভাবে আক্রমণের শিকার এবং সমালোচিত হন। সমালোচিত হন কারণ আমাদের কারও করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে চেতনা ছিল না। পরে ২০ তারিখ তিনি লকডাউন ঘোষণা করেন ৩১-শে মার্চ পর্যন্ত।
এবার মূল আলোচনায় ফিরে আসি। নিজামুদ্দিন মারকাজে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের জামাআতী মুবাল্লিগ (ধর্ম প্রচারক) ছিলেন। [*এখানে আর একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন এই মুবাল্লিগগণ কোন অমুসলিমের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য ধর্ম প্রচার করেন না, এঁদের মূল কাজ হল যে সমস্ত মুসলমান ধর্ম বিমুখ তাঁদেরকে ধর্মের প্রতি আহ্বান করা এবং ধর্মের মূল শিক্ষায় শিক্ষিত করা। যে সমস্ত মুসলমান নামাজ, রোজা ঠিক ঠাক পালন করতে পারেন না, তাঁদেরকে ভালভাবে শিক্ষা দান করা। এই মুবাল্লিগদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ মুসলমান। এঁদের মধ্যে রয়েছেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, প্রফেসার প্রভৃতি উচ্চশিক্ষিত মানুষ। আলেমদের তত্ত্বাবধানে সাধারণ মানুষই তবলিগি জামাআতে বেশী সক্রিয় ও তৎপর।]
উক্ত তবলিগি জামাআতে প্রায় সকল বিদেশী জামাআতীরা বিমানে ভারতে প্রবেশ করেছেন। এই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদেশি যাত্রী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমান নেমেছে। যেমন, নেপাল থেকে ১৯ জন, মালয়েশিয়া থেকে ২০ জন, আফগানিস্তান থেকে ১ জন, মায়ানমারথেকে ৩৩ জন, জিবুতি থেকে ১ জন, আলজেরিয়া থেকে ১ জন, কিরগিজস্তান থেকে ২৮ জন, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৭২ জন, থাইল্যান্ড থেকে ৭১ জন, শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৪ জন, বাংলাদেশ থেকে ১৯ জন, ইংল্যান্ড থেকে ১ জন, সিঙ্গাপুর থেকে ১ জন, ফিজি থেকে ৪ জন, কুয়েত থেকে ১ জন, ফ্রান্স থেকে ২ জন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ৩৬৯ জন, আসাম থেকে ৩০০। পশ্চিম বঙ্গের ছিলেন ৫০ জন। দিল্লি থেকে ২৪ জন, আন্দামান-নিকোবরের ১০ জন, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে ১১ জনের পজিটিভ করোনা পাওয়া গিয়েছে তেলেঙ্গানায় ৮ জন, কাশ্মিরে ১ জন মারা গেছে। কোয়েম্বাটোরের ৮২ জন, ইরোডের ১০ জন পজিটিভ পাওয়া গেছে। তবে বিদেশীদের কারো করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়নি। ২০০ জনের প্রত্যেকের নেগেটিভ এসেছে। ভাগ্য ক্রমে পাকিস্তান থেকে কেউ আসেনি। পাকিস্তানের কোন মুবাল্লিগ থাকলে মিডিয়ার প্রোপাগাণ্ডার ধরণটাই অন্যরকম হত।
সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মাওলানা ইউসুফ সাহেব বার বার প্রশাসনের কাছে একাধিকবার আবেদন করার পরেও কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা হয়নি। আজকে যে সংক্রমণের অজুহাত তুলে নিজামুদ্দিনকে অপরাধী ও মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তার জন্য শুধুমাত্র দিল্লি ও কেন্দ্র সরকার দায়ী! তারা শুরুতেই এইসব মানুষকে টেস্ট করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন তাহলে এই সংক্রমণ হতো না। প্রথম থেকেই সরকার কোন খোঁজ খবর নেয়নি, যখন কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজামুদ্দিনের ঐ কমিটি চিকিত্সার জন্য অনুরোধ জানান সরকারের কাছে। তখন ধরা পড়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছে কয়েকজন। এর পরেও এখন দোষ দেওয়া হচ্ছে নিজামুদ্দিন ও মুসলিমদের । কিন্তু কিছু ঘটনা সরকার ও মিডিয়া চেপে যাচ্ছে! এটা শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী সরকারের আঙ্গুলিহেলনে এবং সরকারের সমস্ত ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেওয়া জন্যই করছে তা বলা বাহুল্য।
আমার মনে হয়, মাওলানা ইউসুফ সাহেব যখন বার বার চিঠি লিখে প্রশাসনকে উক্ত ১০০০ জনকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবার জন্য আহ্বান করছিলেন তখন ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি যাতে ভারতে করোনা ছড়িয়ে দেবার জন্য একটি সম্প্রদায়কে টার্গেট বানানো যায় এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করা সহজসাধ্য হয়ে যায়।
আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন :
১) সারা বিশ্বে যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন তখন ভারতে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কেন?
২) রাহুল গান্ধী আগে থেকেই করোনা নিয়ে সচেতন করেছিলেন তবুও তাঁর কথাকে গ্রাহ্য না করে স্বাভাবিক ভাবে সরকারী কার্যক্রম চালু ছিল কেন?
৩) নিজামুদ্দিন, তিরুপতি, অযোধ্যা, মধ্যপ্রদেশে, কাঁসর ঘন্টা, ইত্যাদি বন্ধ করে নি কেন?
৪) এখনো পর্যন্ত যাঁরাই ভারতে করোনা এনেছেন তাঁরা কেউ গরিব শ্রেনীর নয়। প্রত্যেকেই ধনী ব্যক্তি। তাদেরকে জামাই আদর করে যখন ভারতে আনার ব্যবস্থা চলছিল তখন তাদের টেস্ট করে ভারতে প্রবেশ করানো হয়নি কেন?
৫) নিজামুদ্দিন মারকাজ থেকে বার বার মাওলানা ইউসুফ প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলছিলেন কিন্তু প্রশাসন নিয়ে এতোদিন কেন অবহেলা করছিল?
৬) যখন দেখা যাচ্ছে বহিরাগত বিমানযাত্রীদের জন্য ভারতে করোনা ছড়াচ্ছে তখন কেন বিশেষ বিমানে করে আবার তাদের দেশে ঢোকানো হচ্ছে?
৭) লক ডাউন ঘোষণার পরেও কেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ লক ডাউন ভেঙে সমাবেশ করলেন?
৮) ১লা এপ্রিল অর্থাৎ লক ডাউন চলাকালীন পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কেন হিন্দুরা রাম নবমীর জন্য পুজোর আয়োজন করলেন?
৯) ২ রা এপ্রিল অর্থাৎ লক ডাউন চলাকালীন হরিয়ানার বিভিন্ন বাজারে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হল?
১০) এছাড়াও সারা দেশে লক ডাউনের ধ্বজ্জিয়া উড়িয়ে সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কিভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রচুর লোকের সমাগম হচ্ছে?
১১) শিখ ধর্মগুরু বলদেভ সিং করোনা ভাইরাস শরীরে নিয়ে অন্তত ১২ টি গ্রাম ঘুরেছেন।এই ঘটনায় .১৫০০০ লোক কোয়ারেনটাইনে আছে। এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি যদিও বলদেভ সিং নিজেই মারা গেছেন। অথচ মিডিয়া এ বিষয়ে নীরব কেন?
এরা মুসলিম নয় বলে, নাকি এখানে ফ্যাসিবাদী সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবেনা বলে? গোদী মিডিয়ার কাছে এইসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আছে কি? সুধীর চৌধুরী, অর্নব গোস্বামী, অমিশ দেবগন, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, রুবিকা লিয়াকত, দীপক চৌরাশিয়া, সুরেশ চৌহান, রোহিত সারদানা সহ মেইন স্ট্রীম মিডিয়ার ফ্যাসিবাদী সরকারের পোষ্য ও পেড সাংবাদিকরা কোথায় শীত ঘুমে চলে গেছেন?
মিডিয়ার প্রোপাগান্ডাঃ
নিজামুদ্দিন মারকাজ নিয়ে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা দেখলে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। নিউজ চ্যানেলগুলোতে বড় বড় হেডলাইন করে ব্রেকিং নিউজে লেখা হচ্ছে, “এদিকে ১৫০০ মুসলিম দিল্লির নিজামুদ্দিনে লুকিয়ে রয়েছে”! অথচ কেউ লুকিয়ে থাকেন নি। মারকাজের মাওলানা ইউসুফ বার বার সেই ১৫০০ জনকে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছেন। অনুরোধ করার ১০ দিন পর পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। যা একটি ভিডিওতে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বৈষ্ণব দেবী মন্দিরে যখন ৫০০ জন শ্রদ্ধালু আটক রয়েছেন তখন এই মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজে লেখা রয়েছে “বৈষ্ণদেবী মন্দিরে ৫০০ দর্শনার্থী (ভক্তরা) আটকে পড়েছেন।” অর্থাৎ মুসলিমদের জন্য আলাদা ভাবে উস্কানীমূলক ব্রেকিং নিউজ। এই ধরনের নোংরা প্রচার থেকেই জন্ম নেয় মুসলিম বিদ্বেষ বা ইসলাম ফোবিয়া! যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পর্যাবসিত হয়।
মোদি ভক্ত গোদী মিডিয়া এখানেই ক্ষান্ত থাকেনি তারা এমন এমন ব্রেকিং নিউজ দেখিয়েছে তাতে জনমানসে চরম সাম্প্রদায়িকতার উদ্রেক হতে বাধ্য। সুদর্শন চ্যানেলের সুরেশ চৌহানের এক অভদ্র ও চরম সাম্প্রদায়িক সাংবাদিক ভারতকে করোনায় ধ্বংস করে দেবার জন্য ‘করোনা জিহাদ সে দেশ কো বাচাও’ বলে উল্লেখ করেছেন। এমন ভাবে মিডিয়া এটা নিয়ে প্রপোগান্ডা চালায় যাতে মনে হচ্ছিল নিজামুদ্দিন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল। মিডিয়া এখানেই ক্ষান্ত থাকেনি এমনভাবে খবর চালানো হয়েছে যাতে সারা ভারতের মুসলমানরা মিনে ভারতকে ইটালি বানাবার চেষ্টা করছে। সোসাল মিডিয়ার অনেকে তো আবার পোষ্ট দিয়েছেন যে নিজামুদ্দিনের ঘটনাটা নাকি ভারতবর্ষের সব থেকে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা। চিন্তা করুন এদের মানসিকতা কতটা জঘণ্য ও নিম্ন পর্যায়ের। আবার অন্যদিকে ভারতীয় গোদী মিডিয়া এবং বিজেপির আইটি সেলের কর্মকান্ড দেখলে মনে হয় করোনা ভাইরাস চিনের উহান শহর থেকে নয় বরং ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং এর জন্য শুধুমাত্র ভারতীয় মুসলিমরায় দায়ি।
মিডিয়াসহ বিজেপির আইটি সেল এও প্রচার করছে যে এর পেছনে পাকিস্তান দায়ি। যেমন প্রবীন সাংবাদিক অভিশার শর্মা বলেছেন, “একজন সাংবাদিক তাঁকে বলেছেন কি ভাবে নিজামুদ্দিনকে পাকিস্তানের সাথে সংযোগ আছে প্রমাণ করা যায় সেজন্য একটি চ্যানেল উঠেপড়ে তাঁকে জোর দিচ্ছে। শুধু তাই নয় নিজামুদ্দিনকে জোর করে পাকিস্তানি অ্যাঙ্গেল খোঁজার চেষ্টা করছে।” চিন্তা করুন মিডিয়া কতটা বিষাক্ত হলে এইরকম কর্মকাণ্ড করতে পারে। অথচ যতগুলো বিদেশী নিজামুদ্দিন মারকাজে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজনও পাকিস্তানি ছিল না এবং একজন বিদেশীর শরীরেও করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে “মিডিয়া” বিষয়টাকে হিন্দু মুসলিম ও রাজনৈতিক রং মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যা চরম নিন্দনীয়। মিডিয়া এখানেই ক্ষান্ত থাকেনি এমনভাবে খবর চালানো হয়েছে যাতে সারা ভারতের মুসলমানরা সকলে মিলে ভারতকে ইটালি বানাবার চেষ্টা করছে।
জামাতের লোকেরা কি ধোয়া তুলসী পাতা?
এখন প্রশ্ন হল যাঁরা জামাআতে ছিলেন তাঁরা কি সম্পূর্ণ নিরপরাধ? অবশ্যই না, নিজামুদ্দিন মারকাজে যতটা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল ততটা সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। করা হলে এত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না। আর যেভাবে কিছু জামাআতের লোক ডাক্তার ও পুলিশের উপর থুতু নিক্ষেপ করেছে তা চরম নিন্দনীয়। ঘটনা সত্য হলে এদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেওয়া প্রশাসনের কর্তব্য।
এবার আসি তবলিগি জামাআতের আমীর মাওলানা সাদ কন্ধলবী সাহেবের উপর। এই মাওলানা সাআত সাহেব এমন এক বিতর্কিত ব্যক্তি যাঁর কৃতকর্মের জন্য তাঁর উপর আজ থেকে ৫ বছর আগেই দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফতোয়া জারি করা হয় এবং তাঁকে পুরোপুরিভাবে বয়কট করা হয়। তাছাড়া তাঁর লেকচার শোনা যাবে না বলেও ফরমান জারি করা হয় এবং তবলিগি জামাআতের বড় বড় ইজতেমা থেকে তাঁকে বয়কট করা হয়। এই মাওলানা সাদ সাহেব সরকারের নির্দেশ অমান্য করে মসজিদে জামায়েত করার কথা বলেছেন। যখন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফতোয়া জারি করা হয় এই চরম মহামারীর সময় মসজিদে জমায়েত না হয়ে মানুষ বাড়িতে নামাজ পড়তে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সমস্ত মুসলিম দেশগুলি মসজিদ বন্ধের নির্দেশ জারি করেছে এমনকি মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র কাবা শরীফও বন্ধ তখন মাওলানা সাদ সাহেবের এরকম বক্তব্য নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। তাঁর বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এখন করণীয় কি?
এখন সরকারের করণীয় হল নিজামুদ্দিনে যাঁরা অংশ গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন তাঁদের খুঁজে বের করে চিকিৎসার জন্য পাঠানো। আর যেসব জামাআতীরা নিজামুদ্দিনে গেছিলেন তাঁদেরও উচিত সরকারকে সঠিক তথ্য দিয়ে চিকিৎসায় সাহায্য করা। নাহলে সারা দেশ চরম মহামারীর প্রকোপে পড়বে। আশা করি প্রত্যেকেই সরকারকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবেন। এই জামাআতীরা যদি সরকারকে সাহায্য না করে করে তাহলে পরবর্তীকালে ধরা পড়লে প্রশাসনের কর্তব্য হবে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনত পদক্ষেপ নেওয়া।
শুধু তাই নয় সারা পৃথিবী জুড়ে যেভাবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়েছে তখন ধর্মীয় অনুভুতিতে আবেগ তাড়িত হয়ে জনসমাবেশ না করাটা প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর আবশ্যিক কর্তব্য। মন্দির, মসজিদ, গুরুদোয়ারা, গির্জা বা যেকোন ধর্মীয় স্থানই হোক না যতদিন না পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর উচিত সরকারের সাথে থেকে সরকার ও প্রশাসনকে সাহায্য করা। মানুষ বাঁচলে ঠিক ধর্মপালন করা হবে। মানবজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলে ধর্মীয় বিধান মেনে মৃত্যুর পর শেষকৃত্য করার লোকও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাই আগে থেকেই আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
শেষ কথা, স্বেচ্ছায় কেউই নিজেকে বিপদে ফেলতে চায়না। এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য জামাআতী নিজেরাও দুঃখিত, বা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ৫০,০০০ শ্রমিকদের সমস্যার মতো এটাও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখজনক বিষয়। তাবলে এই সকলের পিছনে সাম্প্রদায়িক রং মেশানো, “করোনা জিহাদ” এবং “ভারতের সব মুসলিমরা মিলে করোনা মহামারীর দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঠেলে দিচ্ছে” বলাটা সত্যিই এটা দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জা জনক, দুঃখ জনক। একথা ভারতীয় গোদী মিডিয়ার বোঝা উচিত। তা নাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এটাই বলবে সারা বিশ্ব যখন করোনা নামক এক মহামারীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তখন ভারতের চরম ঘৃণ্য গোদী মিডিয়া এবং বিজেপির আইটি সেলের পাণ্ডাগুলো সারা দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানী দিয়ে জনগণের মনে ভীতির সঞ্চার করে ভারতকে মহামারীর থেকেও এক বড় ধ্বংসাত্মক পথের দিকে ঠেলে দেবার মারাত্ম চক্রান্ত করেছিল। যা করোনার ভাইরাসের থেকেও ভয়াবহ।
কট্টরপন্থার উত্থান, সাজানো পুলিশী সঙ্ঘর্ষ ও বিচারব্যবস্থা