লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মানুষের চিন্তাজগতে সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব একটি মৌলিক ও অনিবার্য প্রশ্ন। মানুষ যখন নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে, তখন তার বুদ্ধির ভেতরে প্রথম যে আলোড়ন তৈরি হয়, তা কেবল আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় আরও গভীর একটি জিজ্ঞাসা—আমি কেন আছি, এই জগৎ কেন আছে, আর কিছুই কেন নেই। এই প্রশ্ন মানবচিন্তার ইতিহাসে বারবার ফিরে এসেছে নানান রূপে, নানান ভাষায়। আদিম মানুষের বিস্ময়, গ্রিক দার্শনিকদের অনুসন্ধান, মধ্যযুগীয় ধর্মতাত্ত্বিকদের যুক্তিবিদ্যা এবং আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল—সবকিছুর গভীরে এই প্রশ্নটি একইভাবে বিদ্যমান। ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য এই প্রশ্নকে এড়িয়ে যায়নি; বরং একে যুক্তি, ওহি ও অভিজ্ঞতার আলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে। এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই ইলমে কালামের জন্ম, এবং সেই কালামি ঐতিহ্যের ভেতরেই বিকশিত হয়েছে দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব, যা পাশ্চাত্য দর্শনে Argument of Contingency নামে পরিচিত।
এই যুক্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে আবেগের আশ্রয় নেয় না, আবার কেবল ধর্মীয় কর্তৃত্বের দোহাইও দেয় না। এটি অলৌকিক ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে নেই, কিংবা জগতের জটিল নকশাকে একমাত্র ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। বরং এই যুক্তি অস্তিত্বের ধারণাটিকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এটি আমাদের জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য করে—যা কিছু আছে, তার অস্তিত্ব কি একই প্রকৃতির, নাকি অস্তিত্বের মধ্যেই এমন একটি মৌলিক বিভাজন রয়েছে, যা আমাদের চিন্তাকে একটি অপরিহার্য সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। এই যুক্তি বিশ্বাসকে যুক্তির শত্রু বানায় না; বরং যুক্তিকেই বিশ্বাসের পথে সহযাত্রী হিসেবে দাঁড় করায়।
দর্শনের পরিভাষায় contingent being বলতে এমন সত্তাকে বোঝানো হয়, যার অস্তিত্ব অপরিহার্য নয়। অর্থাৎ সেই সত্তা থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তার না-থাকা কল্পনা করলে কোনো যুক্তিগত অসঙ্গতি তৈরি হয় না। একটি নির্দিষ্ট মানুষ জন্ম না নিলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভেঙে পড়ে না, কোনো নির্দিষ্ট পাহাড় বা নদী না থাকলেও অস্তিত্বের ধারণা বাতিল হয়ে যায় না। এই ধরনের সত্তার অস্তিত্ব সম্ভাব্য, আবশ্যিক নয়। ইসলামি ইলমে কালামে এই সত্তাকে বলা হয় মুমকিনুল ওজুদ। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, পাহাড়, নদী, নক্ষত্র, গ্রহ, এমনকি পুরো মহাবিশ্ব—সবই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের অস্তিত্ব নিজের ভেতরে এমন কোনো বাধ্যতামূলক গুণ বহন করে না, যার কারণে তাদের না-থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বরং এদের অস্তিত্ব সর্বদাই কোনো না কোনো কারণ, শর্ত বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।
এই ধারণার বিপরীতে যে অস্তিত্বটি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বলা হয় ওয়াজিবুল ওজুদ। এই সত্তার অস্তিত্ব অপরিহার্য; তার না-থাকা কল্পনাই করা যায় না। সে কোনো কারণের ফল নয়, বরং সব কারণের শেষ ভিত্তি। তার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং অন্য সব অস্তিত্ব তার ওপর নির্ভরশীল। এই পার্থক্যটি কেবল শব্দগত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয় নয়; এটি অস্তিত্বের প্রকৃতি বোঝার জন্য এক মৌলিক দার্শনিক বিভাজন। দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব এই বিভাজনকেই কেন্দ্র করে ধাপে ধাপে তার যুক্তি নির্মাণ করে।
মানুষ যে জগতে বাস করে, সেই জগৎ সম্পূর্ণভাবে কারণ-নির্ভর। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা প্রতিনিয়ত এই সত্যের মুখোমুখি হই। একটি গাছ বীজ ছাড়া জন্মায় না, একটি শিশু পিতামাতা ছাড়া আসে না, একটি আগুন জ্বলে ওঠে কোনো প্রজ্বালক ছাড়া নয়। বিজ্ঞান এই কারণ-কার্য সম্পর্ককে আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে, কিন্তু অস্বীকার করে না। এই কারণ-নির্ভরতা কেবল অভিজ্ঞতাগত নয়; এটি অস্তিত্বগত। কারণ মুমকিন সত্তার অস্তিত্ব নিজের ভেতরে এমন কোনো শক্তি বহন করে না, যার দ্বারা সে নিজেকে অস্তিত্ব দিতে পারে। যদি কোনো সত্তা নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারণ হতো, তাহলে তাকে অস্তিত্ব লাভের আগেই অস্তিত্বশীল হতে হতো, যা যুক্তিগতভাবে স্ববিরোধী। এই কারণেই দর্শনে আত্মকারণ বা self-causation ধারণাকে অসম্ভব বলে গণ্য করা হয়।
এই জায়গা থেকেই দলীল আল-ইমকান একটি গভীর প্রশ্ন তোলে। যদি প্রতিটি মুমকিন সত্তার জন্য কোনো না কোনো কারণ প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই কারণেরও কি আবার কারণ থাকবে? যদি থাকে, তাহলে সেই কারণেরও কি আরেকটি কারণ প্রয়োজন হবে? এভাবে কারণের পর কারণ যদি চলতেই থাকে, তবে আমরা একে বলি অসীম পশ্চাৎগমন বা infinite regress। প্রথম দর্শনে অনেকের কাছে এই ধারণাটি গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু যখন আমরা বাস্তব অস্তিত্বের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি, তখন এই ধারণা টেকে না। কারণ যদি বর্তমান অস্তিত্ব বাস্তবায়িত হতে অসীম সংখ্যক পূর্ববর্তী কারণের প্রয়োজন হয়, তবে বাস্তবে বর্তমান অস্তিত্ব কখনোই অর্জিত হতো না।
এই বিষয়টি বোঝাতে দার্শনিকরা প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনের সহজ উদাহরণ ব্যবহার করেন। যদি একটি বাতি জ্বালাতে অসীম সংখ্যক সুইচ চাপতে হয়, তবে বাস্তবে সেই বাতি কখনোই জ্বলবে না। কারণ অসীম সংখ্যক কাজ সম্পন্ন না করে কোনো চূড়ান্ত ফল অর্জন সম্ভব নয়। তেমনি, যদি বর্তমান অস্তিত্বের জন্য অসীম সংখ্যক কারণ অতিক্রম করতে হয়, তবে বর্তমান অস্তিত্বের বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বোঝা দরকার। গণিতে অসীম একটি ধারণাগত নির্মাণ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব অস্তিত্বের ক্ষেত্রে অসীম কারণ-শৃঙ্খল কার্যকর নয়। সম্ভাব্য অসীমতা আর বাস্তব অসীমতা এক জিনিস নয়।
এই যুক্তিগত অচলাবস্থা থেকেই দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব একটি অনিবার্য সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যায়। কারণ-নির্ভর শৃঙ্খলকে এমন এক বিন্দুতে এসে থামতে হবে, যেখানে আর কোনো বাহ্যিক কারণের প্রয়োজন নেই। সেই বিন্দুটি হলো এমন এক সত্তা, যার অস্তিত্ব নিজস্ব, অপরিহার্য এবং অকারণ। এই সত্তার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং অন্য সব অস্তিত্ব তার ওপর নির্ভরশীল। এই সত্তাই ওয়াজিবুল ওজুদ। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এই ওয়াজিবুল ওজুদই আল্লাহ।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনো আবেগী লাফ নয়। এটি যুক্তির ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার ফল। প্রথমে আমরা মুমকিন সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করি, তারপর তাদের কারণ-নির্ভরতা মেনে নিই, এরপর অসীম কারণ-শৃঙ্খলের অসম্ভবতা উপলব্ধি করি, এবং শেষ পর্যন্ত একটি অপরিহার্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তার প্রয়োজনীয়তায় উপনীত হই। এই পুরো প্রক্রিয়াটি বিশ্বাসের চেয়ে যুক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল, যদিও বিশ্বাস এখানে তার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে হাজির হয়।
ইসলামি দর্শনের ইতিহাসে এই যুক্তিকে সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও সুসংহত রূপ দেন ইবন সিনা। তিনি অস্তিত্ব ও সারবত্তার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে দেখান যে মুমকিন সত্তার সারবত্তা থাকতে পারে, কিন্তু তার অস্তিত্ব আবশ্যক নয়। একটি ঘোড়ার ধারণা আমাদের মনে থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে কোনো ঘোড়া নাও থাকতে পারে। এখানে অস্তিত্ব সারবত্তার ওপর আরোপিত হয়। কেবল ওয়াজিবুল ওজুদের ক্ষেত্রেই সারবত্তা ও অস্তিত্ব একাকার। এই বিশ্লেষণ দলীল আল-ইমকানকে কেবল ধর্মীয় যুক্তি নয়, বরং এক শক্তিশালী অস্তিত্বতাত্ত্বিক প্রমাণে পরিণত করে।
এই জায়গায় এসে মানুষের বুদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমার মুখোমুখি হয়। যদি সবকিছুই মুমকিন হয়, তবে অস্তিত্বের কোনো চূড়ান্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মুমকিন সত্তা অন্য মুমকিন সত্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন একটি ভিত্তি প্রয়োজন, যা নিজে মুমকিন নয়। এই ভিত্তি ছাড়া পুরো অস্তিত্বব্যবস্থা ঝুলে থাকে ব্যাখ্যাহীনভাবে। এই ব্যাখ্যাহীনতাই দলীল আল-ইমকানকে আরও অনিবার্য করে তোলে।
এই পর্যায়ে এসে যুক্তি আমাদের এমন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়, যেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কেবল বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং যুক্তিবুদ্ধির দাবি হয়ে ওঠে। এখানে ঈশ্বর কোনো কল্পিত ধারণা নন, বরং অস্তিত্বের কাঠামো বোঝার জন্য অপরিহার্য এক বাস্তবতা। এই উপলব্ধি মানুষকে চিন্তার এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে বিশ্বাস আর যুক্তি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক।
ইবন সিনার দার্শনিক বিশ্লেষণের পর দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব ইসলামি চিন্তাজগতে কেবল দর্শনের স্তরে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা ইলমে কালামের কেন্দ্রীয় যুক্তিতে পরিণত হয়। এই রূপান্তরের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইমাম গাজ্জালি (রহঃ)। তিনি এমন এক সময়কালেই আবির্ভূত হন, যখন ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে দর্শন ও কালামের মধ্যে এক গভীর টানাপোড়েন চলছিল। একদিকে ছিলেন দার্শনিকরা, যারা গ্রিক দর্শনের আলোকে অস্তিত্ব ও জগতের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন; অন্যদিকে ছিলেন কালামি চিন্তাবিদরা, যারা ওহিভিত্তিক আকিদাকে যুক্তির মাধ্যমে রক্ষা করতে চাইছিলেন। গাজ্জালির কৃতিত্ব হলো—তিনি এই দুই ধারার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করেন, যেখানে যুক্তি তার সীমা অতিক্রম করে না, আবার বিশ্বাসও অন্ধ হয়ে পড়ে না।
গাজ্জালির দৃষ্টিতে মুমকিন ও ওয়াজিব সত্তার পার্থক্য কেবল দার্শনিক শ্রেণিবিভাগ নয়; বরং এটি বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তিনি দেখান যে কারণ-কার্য সম্পর্ক অস্বীকার করলে শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয় না, বরং জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিজ্ঞান—সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ যদি কোনো ঘটনার পেছনে কারণ না থাকে, তবে আমরা কোনো কিছুকেই নিশ্চিতভাবে জানার দাবি করতে পারি না। এই যুক্তির মাধ্যমে তিনি দাহরিয়া ও চরম যুক্তিবাদী দার্শনিকদের মোকাবিলা করেন, যারা কখনো কখনো কারণ-কার্য সম্পর্ককে আপেক্ষিক বা অপ্রয়োজনীয় বলে দেখাতে চেয়েছিলেন।
গাজ্জালির কালামে ওয়াজিবুল ওজুদ কোনো বিমূর্ত নৈর্ব্যক্তিক ধারণা নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে অপরিহার্য সত্তা শুধু অস্তিত্বের প্রথম বিন্দু নয়; তিনি ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন, জ্ঞানসম্পন্ন এবং ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্রষ্টা। এই জায়গায় এসে দলীল আল-ইমকান একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। ইবন সিনার বিশ্লেষণে যেখানে ওয়াজিবুল ওজুদ অনেক সময় দার্শনিক পরিভাষার মধ্যে আবদ্ধ থাকে, গাজ্জালির হাতে তা হয়ে ওঠে জীবন্ত ঈমানি বাস্তবতা। যুক্তি এখানে বিশ্বাসকে ধ্বংস করে না, বরং তাকে আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে।
এই কালামি পুনর্গঠনের ফলে দলীল আল-ইমকান শুধু আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি হিসেবেই নয়, বরং একটি সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ, যদি সবকিছুই মুমকিন ও নির্ভরশীল হয়, তবে মানুষের নিজের অস্তিত্বও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মানুষ নিজেকে কেন্দ্র করে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই উপলব্ধি মানুষের অহংকারকে ভেঙে দেয় এবং তাকে এক বৃহত্তর বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়। এখানে ঈমান অস্তিত্বগত বিনয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বচ্ছতার প্রকাশ হয়ে ওঠে।
এই যুক্তির সঙ্গে কুরআনিক চিন্তার গভীর সাযুজ্য রয়েছে। কুরআন দার্শনিক গ্রন্থ নয়, কিন্তু এটি মানুষের বুদ্ধিকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, যা সরাসরি দলীল আল-ইমকানের মর্মে পৌঁছে যায়। কুরআন যখন প্রশ্ন তোলে—সৃষ্টি কি নিজে নিজেই হয়েছে, না কি তাদের কোনো স্রষ্টা আছে—তখন তা আসলে মানুষকে মুমকিন সত্তার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করাতে চায়। এই প্রশ্নের মধ্যে কোনো অলঙ্কার নেই, কোনো জটিল পরিভাষাও নেই; কিন্তু এর প্রভাব গভীর। মানুষ বাধ্য হয় ভাবতে—যা কিছু আছে, তা কি সত্যিই নিজের অস্তিত্ব নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে?
কুরআনের এই প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআন মানুষকে বলে না—এই সিদ্ধান্ত মেনে নাও, কারণ তা বলা হয়েছে। বরং কুরআন মানুষকে প্রশ্ন করে, চিন্তা করতে বাধ্য করে, যুক্তির পথ খুলে দেয়। এই দিক থেকে দলীল আল-ইমকান কুরআনিক চিন্তার একটি যুক্তিবদ্ধ সম্প্রসারণ।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করা যায়। কুরআন যখন সৃষ্টি ও স্রষ্টার কথা বলে, তখন তা কখনো স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে একাকার করে না। স্রষ্টা সৃষ্টির অংশ নন, আবার সৃষ্টির মতো অনিত্যও নন। এই ভেদরেখাই মুমকিন ও ওয়াজিব সত্তার পার্থক্যের মূল। সৃষ্ট জগত পরিবর্তনশীল, সময়সাপেক্ষ এবং নশ্বর। এর প্রতিটি অংশ আসে ও যায়। কিন্তু স্রষ্টা পরিবর্তনশীল নন, তিনি সময়ের অধীন নন। এই দৃষ্টিভঙ্গি দলীল আল-ইমকানকে কেবল যুক্তির স্তরে নয়, বরং একটি সামগ্রিক ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোর ভেতরে স্থাপন করে।
আধুনিক যুগে এসে এই যুক্তির প্রয়োজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আধুনিক মানুষের চিন্তা বিজ্ঞান দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। বিজ্ঞান মহাবিশ্বের সূচনা, গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছে। কিন্তু এই তথ্যগুলো অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্তও করেছে। কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু বিজ্ঞান অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে, তাই ঈশ্বরের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই ধারণা বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে এক গভীর ভুল বোঝাবুঝির ফল।
বিজ্ঞান মূলত প্রশ্ন করে—কীভাবে ঘটনা ঘটে। এটি প্রাকৃতিক নিয়ম, কারণ-কার্য সম্পর্ক ও পরিমাপযোগ্য তথ্যের মাধ্যমে বাস্তবতার ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু বিজ্ঞান প্রশ্ন করে না—কেন এই নিয়মগুলো আছে, কেন কিছু আছে, কিছুই কেন নেই। এই প্রশ্ন বিজ্ঞানের পদ্ধতির বাইরে। এখানেই দর্শন ও কালামের ভূমিকা শুরু হয়। দলীল আল-ইমকান এই শূন্যস্থান পূরণ করে। এটি বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘর্ষে যায় না; বরং বিজ্ঞানের সীমা চিহ্নিত করে দেয়।
আধুনিক নাস্তিক চিন্তাধারায় প্রায়ই দাবি করা হয় যে মহাবিশ্বই চূড়ান্ত বাস্তবতা। কিন্তু মহাবিশ্ব নিজেই পরিবর্তনশীল। এর শুরু আছে, এর ভেতরে পরিবর্তন ঘটে, এবং ভবিষ্যতে এর পরিণতি সম্পর্কে নানা তত্ত্ব রয়েছে। যা পরিবর্তনশীল, তা অপরিহার্য হতে পারে না। মহাবিশ্বের না-থাকা কল্পনা করলে কোনো যুক্তিগত স্ববিরোধ তৈরি হয় না। ফলে মহাবিশ্ব নিজে ওয়াজিবুল ওজুদ হতে পারে না। এই সত্য স্বীকার করলে আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন ফিরে আসে—তাহলে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা কী?
কিছু আধুনিক তত্ত্ব কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বা শূন্যতা থেকে সৃষ্টির কথা বলে। কিন্তু এখানে শূন্যতা বলতে যা বোঝানো হয়, তা প্রকৃত শূন্যতা নয়। এটি একটি নির্দিষ্ট ভৌত কাঠামো, নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন একটি অবস্থা। এই কাঠামো নিজেই ব্যাখ্যার দাবি করে। ফলে প্রশ্নটি কেবল এক ধাপ পিছিয়ে যায়, কিন্তু বিলুপ্ত হয় না। দলীল আল-ইমকান এই অসীম পিছিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে থামিয়ে দেয় এবং দেখায় যে শেষ পর্যন্ত একটি অপরিহার্য ভিত্তি ছাড়া কোনো ব্যাখ্যাই সম্পূর্ণ হয় না।
এই পর্যায়ে এসে মানুষের বুদ্ধি আবার একটি মৌলিক উপলব্ধির মুখোমুখি হয়। যদি সবকিছুই ব্যাখ্যার দাবিদার হয়, তবে ব্যাখ্যারও একটি শেষ বিন্দু প্রয়োজন। সেই বিন্দু এমন কিছু হতে পারে না, যা নিজেই আবার ব্যাখ্যার দাবি করে। সেই বিন্দুটি হতে হবে এমন এক সত্তা, যার অস্তিত্ব নিজেই তার ব্যাখ্যা। এই ধারণাই ওয়াজিবুল ওজুদ। এই ধারণা ছাড়া অস্তিত্বের প্রশ্ন ঝুলে থাকে এক অনির্দিষ্ট অস্পষ্টতায়।
এই উপলব্ধি মানুষের চিন্তাকে একটি নৈতিক ও অস্তিত্বগত দিকেও নিয়ে যায়। যদি মানুষের অস্তিত্ব নিজেই মুমকিন ও নির্ভরশীল হয়, তবে মানুষ তার জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিজে নিজে নির্ধারণ করতে পারে না। অর্থ ও উদ্দেশ্যের প্রশ্নও শেষ পর্যন্ত সেই অপরিহার্য বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, যিনি সবকিছুর ভিত্তি। এই জায়গায় দলীল আল-ইমকান কেবল ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি থাকে না; বরং এটি মানুষের জীবনদর্শনের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
এই অংশে আমরা দেখলাম কীভাবে দার্শনিক বিশ্লেষণ কালামি পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোতে রূপ নেয়, কীভাবে কুরআনিক চিন্তার সঙ্গে এই যুক্তির গভীর সাযুজ্য তৈরি হয়, এবং কীভাবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে এই যুক্তি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এখান থেকেই আলোচনা আরও গভীর স্তরে প্রবেশ করবে, যেখানে মানুষের বুদ্ধির সীমা, আধুনিক নাস্তিক আপত্তির বিশদ বিশ্লেষণ এবং ঈমান ও যুক্তির চূড়ান্ত সমন্বয়ের প্রশ্ন সামনে আসবে।
এই পর্যায়ে এসে মানুষের বুদ্ধি আরেকটি গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, যা দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুবকে কেবল একটি তাত্ত্বিক যুক্তি না রেখে অস্তিত্বগত অনুসন্ধানে রূপ দেয়। সেই প্রশ্নটি হলো—মানুষের বুদ্ধির নিজস্ব সীমা কোথায়, এবং সেই সীমার ভেতরে থেকে কি অস্তিত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব? আধুনিক যুগে অনেকেই মনে করেন, মানববুদ্ধি ও বিজ্ঞান একসময় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। কিন্তু এই ধারণা নিজেই এক ধরনের বিশ্বাস, যা প্রমাণের চেয়ে প্রত্যাশার ওপর বেশি দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ইতিহাস দেখায়, যতই জ্ঞান বাড়ে, ততই নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়। অস্তিত্বের প্রশ্ন সেইসব প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে গভীর, যা প্রতিবারই মানুষের বুদ্ধিকে তার সীমা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই সীমা বোঝার জায়গাটিতেই দলীল আল-ইমকান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বলে না যে মানববুদ্ধি অকার্যকর; বরং এটি দেখায় যে বুদ্ধি নিজে নিজে চূড়ান্ত ব্যাখ্যায় পৌঁছাতে পারে না, যদি না সে এমন এক বাস্তবতাকে স্বীকার করে, যা নিজে ব্যাখ্যার দাবি করে না। মুমকিন সত্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধি সর্বদা প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়—এর কারণ কী? কিন্তু যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বুদ্ধি অসীম পশ্চাৎগমনে আটকে যায়, তবে তা আর ব্যাখ্যা থাকে না, বরং কেবল প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়ে ওঠে। এই পুনরাবৃত্তি থামাতে হলে বুদ্ধিকে এমন এক বিন্দুতে পৌঁছাতে হয়, যেখানে প্রশ্নটি আর প্রযোজ্য নয়। সেই বিন্দুটিই ওয়াজিবুল ওজুদ।
আধুনিক নাস্তিক চিন্তাধারার একটি বড় অংশ এই জায়গাতেই আপত্তি তোলে। তারা বলেন, কেন এই শৃঙ্খলকে থামাতেই হবে? কেন অসীম কারণ-শৃঙ্খল মেনে নেওয়া যাবে না? এই প্রশ্নটি প্রথম দর্শনে যুক্তিসংগত মনে হলেও গভীর বিশ্লেষণে এটি নিজের মধ্যেই সমস্যাযুক্ত। কারণ অসীম কারণ-শৃঙ্খল বাস্তব অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করে না, বরং ব্যাখ্যাকে স্থগিত করে রাখে। এটি এমন এক ব্যাখ্যা, যা কোনো দিনই সম্পূর্ণ হয় না। বাস্তব জগতে কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ ঘটনাই প্রত্যক্ষ করি—এই মুহূর্তে আমরা আছি, ঘটনা ঘটছে, পরিবর্তন হচ্ছে। এই বাস্তবতা ব্যাখ্যার দাবি করে, আর সেই ব্যাখ্যা অনন্তকালের জন্য স্থগিত রাখা যায় না।
এখানে আরেকটি সূক্ষ্ম বিষয় লক্ষ করা দরকার। অনেক সময় অসীম কারণ-শৃঙ্খলের পক্ষে বলা হয় যে, যেহেতু সময় নিজেই অনন্ত হতে পারে, তাই কারণও অনন্ত হতে পারে। কিন্তু সময়ের ধারণা নিজেই পরিবর্তনশীল ও নির্ভরশীল বাস্তবতার অংশ। সময় কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা নয়; বরং এটি ঘটনার ধারাবাহিকতার একটি পরিমাপ। যদি ঘটনা নিজেই ব্যাখ্যার দাবিদার হয়, তবে সময়ও সেই ব্যাখ্যার অংশ হয়ে পড়ে। ফলে সময়কে ভিত্তি ধরে অসীম কারণ-শৃঙ্খলকে রক্ষা করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
এই পর্যায়ে এসে দলীল আল-ইমকান একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক অবস্থান গ্রহণ করে। এটি বলে যে অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিতে হলে এমন এক বাস্তবতার প্রয়োজন, যা সময়ের ভেতরে বন্দী নয়, পরিবর্তনের অধীন নয় এবং যার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়। এই বাস্তবতা সময়ের আগেও থাকতে পারে, সময়ের বাইরেও থাকতে পারে। এই ধারণা অনেক আধুনিক চিন্তকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়, কারণ তারা সময় ও স্থান ছাড়া কোনো বাস্তবতা কল্পনা করতে অভ্যস্ত নন। কিন্তু এই অস্বস্তিই আসলে মানুষের কল্পনাশক্তির সীমার পরিচায়ক, বাস্তবতার সীমার নয়।
এখানে ঈমান ও যুক্তির সম্পর্ক একটি নতুন আলোয় ধরা দেয়। অনেকেই মনে করেন, ঈমান মানে যুক্তির পরাজয়। কিন্তু দলীল আল-ইমকান ঠিক উল্টো কথা বলে। এটি দেখায় যে যুক্তি নিজেই এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে, যেখানে ঈমান ছাড়া সামনে এগোনো সম্ভব নয়। তবে এই ঈমান অন্ধ নয়; এটি যুক্তিরই পরিণতি। যুক্তি এখানে নিজেকে অস্বীকার করে না, নিজের সীমা স্বীকার করে। এই স্বীকারোক্তিই ঈমানকে অর্থবহ করে তোলে।
এই জায়গায় এসে মানুষের অস্তিত্ববোধে একটি নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটে। যদি মানুষ বুঝতে পারে যে তার অস্তিত্ব মুমকিন, নির্ভরশীল এবং অপরিহার্য নয়, তবে তার আত্মকেন্দ্রিকতা স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়ে। সে নিজেকে আর চূড়ান্ত বাস্তবতার কেন্দ্র হিসেবে দেখতে পারে না। এই উপলব্ধি মানুষের অহংকারকে সংযত করে এবং তাকে বিনয়ের দিকে নিয়ে যায়। এই বিনয় কেবল নৈতিক গুণ নয়; এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান।
আধুনিক নাস্তিক আপত্তিগুলোর আরেকটি রূপ হলো—যদি ওয়াজিবুল ওজুদকে মেনে নিতে হয়, তবে কেন সেই সত্তাকে আল্লাহ বলা হবে? কেন তাকে ব্যক্তিসত্তা, জ্ঞান ও ইচ্ছাসম্পন্ন হিসেবে কল্পনা করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দলীল আল-ইমকানের ভেতরেই নিহিত। কারণ যদি ওয়াজিবুল ওজুদ কেবল একটি নৈর্ব্যক্তিক নীতি বা অচেতন শক্তি হতো, তবে তার থেকে সুশৃঙ্খল, নিয়মবদ্ধ এবং অর্থবহ বাস্তবতার উদ্ভব ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ত। নিয়মের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করে জ্ঞানের দিকে, উদ্দেশ্যপূর্ণ কাঠামো ইঙ্গিত করে ইচ্ছার দিকে। এই যুক্তি দিয়ে কালামি চিন্তাবিদরা দেখিয়েছেন যে অপরিহার্য সত্তা কেবল অস্তিত্বের ভিত্তি নয়, বরং জ্ঞান ও ইচ্ছার আধার।
এই যুক্তি কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। কুরআনে আল্লাহকে কখনোই কেবল এক বিমূর্ত শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং তাঁকে জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়, ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গুণাবলি যুক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যায় না; যুক্তির পরিণতিতে অর্থবহ হয়ে ওঠে। দলীল আল-ইমকান এখানে একটি সেতুর মতো কাজ করে—একদিকে অস্তিত্বতত্ত্ব, অন্যদিকে ধর্মতত্ত্ব।
এই পর্যায়ে এসে মানুষের চিন্তা আবারও আধুনিক বিজ্ঞানের দিকে ফিরে যায়। বিজ্ঞান আমাদের বলে দেয়, মহাবিশ্বের ভেতরে নিয়ম আছে, ধ্রুবক আছে, সূক্ষ্ম ভারসাম্য আছে। কেউ কেউ এই তথ্যকে ঈশ্বরের অনুপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যেন নিয়ম থাকলেই নিয়ন্তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই যুক্তি নিজেই দুর্বল। কারণ নিয়ম নিজেই ব্যাখ্যার দাবি করে। নিয়ম থাকা মানে স্বয়ংক্রিয়তা নয়; বরং নিয়মের অস্তিত্ব নিজেই একটি বাস্তবতা, যা প্রশ্ন তোলে—কেন এই নিয়ম, কেন এই ভারসাম্য?
দলীল আল-ইমকান এই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে না। এটি বলে, নিয়মবদ্ধতা মুমকিন বাস্তবতার অংশ। নিয়ম নিজে ওয়াজিব নয়। নিয়ম ভাঙতেও পারে, পরিবর্তিত হতেও পারে। কিন্তু যে সত্তা নিয়মকে অস্তিত্ব দেয়, তিনি নিজে নিয়মের অধীন নন। এই ধারণা বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে একটি সুস্থ পার্থক্য স্থাপন করে। বিজ্ঞান নিয়মের ভেতরে কাজ করে, আর কালাম নিয়মের ভিত্তি অনুসন্ধান করে।
এই অংশে এসে আমরা দেখতে পাই যে দলীল আল-ইমকান একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এটি মানুষকে শেখায় কীভাবে অস্তিত্বকে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যার সীমা আলাদা করতে হয়, এবং কীভাবে যুক্তির পরিণতিতে ঈমানকে গ্রহণ করতে হয়। এটি এমন একটি পথ দেখায়, যেখানে চিন্তা থেমে যায় না, আবার চিন্তা নিজেই চূড়ান্ত হয়ে ওঠার দাবিও করে না।
এই পর্যায়ে মানুষের সামনে একটি অস্তিত্বগত সিদ্ধান্ত হাজির হয়। হয় সে অস্তিত্বকে ব্যাখ্যাহীনভাবে মেনে নেবে, অথবা এমন এক অপরিহার্য বাস্তবতাকে স্বীকার করবে, যা অস্তিত্বকে অর্থ দেয়। প্রথম পথটি বুদ্ধিবৃত্তিক অলসতার দিকে নিয়ে যায়, দ্বিতীয় পথটি বিনয়ী কিন্তু দৃঢ় চিন্তার দিকে। দলীল আল-ইমকান দ্বিতীয় পথটিকেই যুক্তিসংগত বলে তুলে ধরে।
এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঈমান আর কেবল ঐতিহ্যগত বিশ্বাস থাকে না; বরং তা হয়ে ওঠে চিন্তাশীল ঈমান। এই ঈমান প্রশ্নকে ভয় পায় না, কারণ সে জানে যে প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত তাকে এক গভীরতর সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। এই জায়গায় এসে ইলমে কালামের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বিশ্বাসকে যুক্তির আলোয় দৃঢ় করা, এবং যুক্তিকে বিশ্বাসের গভীরতায় পৌঁছে দেওয়া।
এই পর্যায়ে এসে দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব মানুষের চিন্তাকে একটি চূড়ান্ত সমন্বয়ের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও ঈমান আর আলাদা আলাদা পথে হাঁটে না, বরং একই বাস্তবতার বিভিন্ন দিক উন্মোচন করে। এতক্ষণ যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মূল বক্তব্যটি অত্যন্ত সরল হলেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। যা কিছু আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা অনিত্য, পরিবর্তনশীল ও নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নয়; বরং এটি সৃষ্ট বাস্তবতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যই আমাদের বাধ্য করে এমন এক বাস্তবতার কথা ভাবতে, যা নিজে নির্ভরশীল নয়। এই বাধ্যবাধকতা কল্পনার ফল নয়, বরং যুক্তিরই দাবি।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিষ্কার করা প্রয়োজন। অনেক সময় মনে করা হয়, ঈশ্বরকে মেনে নেওয়া মানে প্রশ্নের সমাপ্তি। কিন্তু দলীল আল-ইমকান দেখায় যে ঈশ্বরকে মেনে নেওয়া আসলে প্রশ্নের সমাপ্তি নয়, বরং প্রশ্নের সঠিক অবস্থানে পৌঁছানো। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ মুমকিন বাস্তবতার ভেতরেই ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকে, ততক্ষণ তার প্রশ্ন কখনোই শেষ হয় না। প্রতিটি উত্তর নতুন প্রশ্ন জন্ম দেয়। কিন্তু যখন সে এমন এক সত্তাকে স্বীকার করে, যার অস্তিত্ব নিজেই ব্যাখ্যা, তখন প্রশ্ন থামে না—বরং তার চরিত্র বদলায়। তখন মানুষ আর জিজ্ঞাসা করে না, “কেন কিছু আছে”, বরং জিজ্ঞাসা করে, “এই অস্তিত্বের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী”, “এই বাস্তবতার আলোকে আমার জীবন কীভাবে অর্থবহ হতে পারে।”
এই পরিবর্তনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কেবল একটি তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত থাকে না; বরং তা মানুষের অস্তিত্ববোধকে রূপান্তরিত করে। মানুষ বুঝতে পারে যে সে কোনো দুর্ঘটনাজনিত সত্তা নয়, আবার নিজেও চূড়ান্ত বাস্তবতা নয়। সে একটি নির্ভরশীল সত্তা, যার অস্তিত্ব একটি বৃহত্তর, অপরিহার্য বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। এই উপলব্ধি মানুষের জীবনদৃষ্টিকে বদলে দেয়। অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা ও অস্তিত্বগত শূন্যতা এখানে জায়গা হারাতে শুরু করে।
এই পর্যায়ে এসে আধুনিক নাস্তিকতার একটি মৌলিক দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আধুনিক নাস্তিক চিন্তাধারা প্রায়ই ধরে নেয় যে অস্তিত্বকে যেমন আছে তেমনই মেনে নেওয়াই যথেষ্ট, এর কোনো চূড়ান্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই অবস্থানটি নিজেই একটি দার্শনিক সিদ্ধান্ত, যদিও তা প্রায়ই অস্বীকার করা হয়। অস্তিত্বকে ব্যাখ্যাহীন বলে মেনে নেওয়া মানে আসলে যুক্তির একটি মৌলিক দাবি পরিত্যাগ করা। কারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ব্যাখ্যা চায়। সে যদি এই ব্যাখ্যাচেষ্টাকে এক জায়গায় এসে থামিয়ে দেয়, তবে সেটি যুক্তির সীমা নয়, বরং যুক্তির প্রতি অনাগ্রহের প্রকাশ।
দলীল আল-ইমকান এই অনাগ্রহকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি বলে, যদি আমরা ব্যাখ্যা চাই, তবে আমাদের সৎভাবে সেই ব্যাখ্যার পরিণতি মেনে নিতে হবে। ব্যাখ্যার পরিণতি হলো—সব ব্যাখ্যা এমন এক বিন্দুতে গিয়ে শেষ হবে, যা নিজে ব্যাখ্যার দাবিদার নয়। এই বিন্দুটিকে অস্বীকার করা মানে ব্যাখ্যাকে চিরকাল অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়া। এই অসম্পূর্ণতা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কৃতিত্ব নয়; একটি অপূর্ণতা।
এই জায়গায় এসে কেউ কেউ বলেন, ওয়াজিবুল ওজুদকে স্বীকার করলেও তাকে আল্লাহ বলা কেন প্রয়োজন? কেন তাকে ধর্মীয় কাঠামোর ভেতরে আনতে হবে? এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর উত্তরও দলীল আল-ইমকানের ভেতরেই নিহিত। যদি অপরিহার্য সত্তা কেবল একটি নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা হতো, তবে তার সঙ্গে মানুষের কোনো সম্পর্ক স্থাপন করা যেত না। কিন্তু মানুষ যে অর্থ, উদ্দেশ্য ও নৈতিকতার প্রশ্ন তোলে, তা দেখায় যে সে এমন এক বাস্তবতার সন্ধান করছে, যা কেবল অস্তিত্বের ভিত্তি নয়, বরং অর্থেরও ভিত্তি। এই অর্থ ও উদ্দেশ্যের ধারণা অচেতন, নৈর্ব্যক্তিক শক্তি থেকে উদ্ভূত হওয়া যুক্তিগতভাবে দুর্বল। বরং তা ইঙ্গিত করে জ্ঞান, ইচ্ছা ও প্রজ্ঞার দিকে।
এই যুক্তি কালামি ঐতিহ্যে গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে। অপরিহার্য সত্তার অস্তিত্ব যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে তার গুণাবলিও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পরিবর্তনশীল সত্তা গুণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু অপরিহার্য সত্তা পরিবর্তনের অধীন নয়। সুতরাং তার গুণাবলি এমন হতে হবে, যা তার অস্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান, ক্ষমতা ও ইচ্ছা অপরিহার্য সত্তার সঙ্গে অসঙ্গত নয়; বরং সৃষ্ট বাস্তবতার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে এগুলো প্রয়োজনীয়। এই বিশ্লেষণ ঈশ্বরকে কোনো মানবসদৃশ সত্তা বানায় না, বরং তাঁকে এমন এক বাস্তবতা হিসেবে তুলে ধরে, যার সঙ্গে মানুষের অভিজ্ঞ বাস্তবতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে দলীল আল-ইমকান শুধুমাত্র দর্শন বা কালামের বিষয় থাকে না; এটি মানুষের অস্তিত্বগত সংকটের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যায়। আধুনিক মানুষ প্রায়ই এক ধরনের শূন্যতার ভেতর বাস করে। তার কাছে প্রযুক্তি আছে, জ্ঞান আছে, কিন্তু অর্থের অভাব রয়েছে। সে জানে কীভাবে বাঁচতে হয়, কিন্তু কেন বাঁচতে হয়—এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে অস্পষ্ট। এই শূন্যতা কেবল সামাজিক বা মানসিক নয়; এটি অস্তিত্বগত। দলীল আল-ইমকান এই শূন্যতাকে সরাসরি পূরণ না করলেও এর ভিত্তি ব্যাখ্যা করে। এটি দেখায় যে অর্থহীনতা আসলে কোনো চূড়ান্ত বাস্তবতার অনুপস্থিতির ফল নয়, বরং সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার ফল।
এই যুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এটি মানুষের স্বাধীনতাকে নাকচ করে না। অনেকেই মনে করেন, যদি সবকিছুর পেছনে একটি অপরিহার্য সত্তা থাকে, তবে মানুষের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। কিন্তু এই ধারণা একটি ভুল দ্বন্দ্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মুমকিন সত্তা হিসেবে মানুষের অস্তিত্ব নির্ভরশীল হলেও তার কার্যকলাপের ভেতরে স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র থাকতে পারে। এই স্বাধীনতা আবার চূড়ান্ত স্বাধীনতা নয়, বরং সৃষ্ট স্বাধীনতা। এই ধারণা মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে, কারণ সে বুঝতে পারে যে তার কাজের অর্থ আছে, এবং সেই অর্থ একটি বৃহত্তর বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত।
এই পর্যায়ে এসে ঈমান ও যুক্তির সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঈমান এখানে কোনো অযৌক্তিক লাফ নয়, বরং যুক্তির একটি স্বাভাবিক পরিণতি। যুক্তি মানুষকে দেখায় যে অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য ভিত্তি আছে; ঈমান সেই ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সম্পর্ক স্থাপন মানে যুক্তিকে পরিত্যাগ করা নয়, বরং যুক্তির আলোকে জীবনযাপন করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইলমে কালামের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই পুরো বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব কোনো বিচ্ছিন্ন যুক্তি নয়, যা কেবল একটি বিতর্ক জেতার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা অস্তিত্ব, জ্ঞান, নৈতিকতা ও অর্থ—সবকিছুকে একটি কাঠামোর ভেতরে এনে দাঁড় করায়। এটি মানুষকে শেখায় কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, আবার কীভাবে প্রশ্নের সীমা বুঝতে হয়। এটি দেখায় যে যুক্তি ও ঈমান পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একই সত্যের দুইটি দিক।
শেষ পর্যন্ত এই যুক্তি মানুষকে একটি বিনয়ী কিন্তু দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করায়। বিনয়ী, কারণ মানুষ বুঝতে পারে যে সে চূড়ান্ত বাস্তবতা নয়। দৃঢ়, কারণ সে জানে যে বাস্তবতা অর্থহীন নয়। এই দুইয়ের সমন্বয়ই একজন চিন্তাশীল বিশ্বাসীর পরিচয়। দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব এই পরিচয় গঠনে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে।
এইভাবে দলীল আল-ইমকান ওয়াল-উজুব কেবল আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের একটি যুক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি মানুষের অস্তিত্ববোধের ভিত্তি হয়ে ওঠে। এটি দেখায় যে সব সৃষ্ট বস্তু অনিত্য ও নির্ভরশীল, এবং এই নির্ভরশীলতার ব্যাখ্যা কেবল একটি অপরিহার্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন সত্তার মাধ্যমেই সম্ভব। সেই সত্তাই আল্লাহ। এই উপলব্ধি মানুষকে অন্ধ বিশ্বাসে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক দৃঢ়তার সঙ্গে ঈমানের পথে নিয়ে যায়। এখানেই এই যুক্তির চূড়ান্ত সার্থকতা।
নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা




