লিখেছেনঃ শমীক লাহিড়ী
সমগ্র দেশের জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জী অর্থাৎ এনআরসি তৈরী করতে উদ্যত বিজেপি সরকার। ৭০ বছর পরে নতুন করে দেশের ১৩৩ কোটি মানুষকে পরীক্ষা দিতে হবে যে তাঁরা দেশের নাগরিক কিনা। আনুমানিক প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এই তালিকা তৈরী কি আমাদের দেশের জন্য খুব প্রয়োজন?
আসামে এক ঐতিহাসিক কারণে ১৯৫০ এর দশকে নাগরিকপঞ্জী তৈরী হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতার সময় দুঃখজনকভাবে দেশ ভাগ হয়েছিল। দাঙ্গার আবহে দুই দেশের অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, ছাড়তে হয়েছিল নিজেদের ভিটে-মাটি। হারাতে হয়েছিল নিজেদের দেশ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত বহু মানুষ উদ্বাস্ত হয়ে আমাদের দেশে এসেছেন। আসামে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে একরাতে ১৯ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়েছে। এদের ভবিষ্যত কি? জেলখানাই কি এদের ভবিষ্যত? ভুলে ভরা এই তালিকায় দেশের প্রকৃত অনেক নাগরিক আজ রাষ্ট্রহীন।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হুংকার দিয়েছেন – পশ্চিমবাংলায় ২ কোটি ৭৫ লক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নাকি আছেন। এদের সবাইকে নাকি তাড়ানাে হবে। কোথা থেকে তিনি এই সংখ্যা পেলেন? আসলে আতঙ্ক ছড়ানাের জন্যই বিজেপি নাগরিকপঞ্জী তৈরীর হুংকার দিচ্ছে।
এ দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার মােদী সরকারের রাজত্বে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। দেশের কল-কারখানা বন্ধ হওয়ার মুখে। শ্রমিকের মজুরী বাড়ছে না। একই অবস্থা দেশের কৃষি ব্যবস্থার। কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছে না অথচ চাষ করার খরচ বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারী মুনাফাখােরদের হাতে। সব জিনিষের দাম বেড়েই চলেছে।
দেশের এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি ঘােরানাের জন্যই কখনও ৩৭০নং ধারা, কখনও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস, কখনও রাম মন্দির ইস্যুকে সামনে আনা হচ্ছে। এই কারণেই কি নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কথা বলা হচ্ছে?
আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর অভিজ্ঞতা এবং সারা দেশে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর প্রয়ােজনীয়তা আছে কিনা – সেই অনুসন্ধানের জন্যই এই পুস্তিকাটি লেখা। প্রথম সংস্করণে অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল ছিল, এই সংস্করণে সংশােধনের সাধ্যমত চেষ্টা করা হয়েছে এবং পাঠকদের পরামর্শে কিছু পরিবর্তন এবং সংযােজন করা হয়েছে।
প্রশ্ন : নাগরিকপঞ্জী (National Register of Citizens) কি?
উত্তর : জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) হলাে আমাদের দেশের বৈধ নাগরিকদের তালিকা। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর তৎকালীন ভারতবর্ষের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী সমগ জনসাধারণকে ১৯৫০ সালের ২৬শে নভেম্বর ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে যে সমস্ত করদ রাজ্য (Princely State) ভারতবর্ষে যােগদান করে, তাদের অর্ন্তভুক্ত সমগ্র জনসাধারণকে ১৯৫৫ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন (The Citizenship Act of India, 1955) অনুযায়ী ভারতের নাগরিক হিসাবে ঘােষণা করা হয়। ১৯৬১ সালের ২০শে ডিসেম্বর গােয়া, দমন-দিউ ও নগর হাভেলি, পর্তুগীজ উপনিবেশ থেকে ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্ত হয়। একইভাবে ফরাসী উপনিবেশ পুদুচ্চেরি (পন্ডিচেরী), কারাইকাল, মাহে, ইয়ানাম, চন্দননগর শহর ইত্যাদি স্থান ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ই মে সিকিম ভারতবর্ষে সংযুক্ত হয়। এছাড়াও বেশ কিছু ছিটমহল পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ভারতবর্ষের সাথে যুক্ত হয়।
ভারত সরকার উপরিউক্ত অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী জনগণকে ১৯৬২ সালে নাগরিকত্ব আইন সংক্রান্ত সরকারী নির্দেশিকা জারী করে ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে ঘােষণা করে। সিকিমে বসবাসকারী সকল জনসাধারণকে সংবিধানের 371-F(n) ধারা অনুযায়ী ভারতবর্ষের নাগরিক ঘােষণা করা হয়। দেশ বিভাজনের পরে যারা ১৯৫২ সালের ১লা অক্টোবরের আগে পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আসেন অর্থাৎ ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পাসপাের্ট-ভিসা ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পূর্বে, তাদেরও নাগরিক হিসাবে ঘােষণা করা হয়।
১৯৪৮ সালের জনগণনাকে ভিত্তি করে ১৯৫১ সালে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) তৈরী হয় এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হওয়া রাজ্য অথবা অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারীদের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রশ্ন : এই একই আইন অনুযায়ী কি এখনও ভারতবর্ষের নাগরিক হওয়া যায়?
উত্তর: ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন এখনও পর্যন্ত ৫ বার সংশোধিত হয়েছে – ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ এবং ২০১৫ সালে। আর একটি সংশােধনী বিল নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল, ২০১৬ (CAB) হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি এখনও পর্যন্ত।
১৯৮৬ সালের সংশােধনী অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই এর পর্বে যিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। এরপর যাদের জন্ম হয়েছে তাদের পিতা অথবা মাতা যে কোন একজনকে সন্তান জন্মগ্রহণ করবার সময় ভারতের নাগরিক হতে হবে। ২০০৩ সালের সংশােধনী অনুযায়ী যে সমস্ত শিশু ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের পিতা এবং মাতা উভয়কে ভারতবর্ষের নাগরিক হতে হবে, তবেই সেই শিশু ভারতের নাগরিক রূপে গণ্য হবে। বিদেশে জন্মগ্রহণকারী এবং বিদেশে বাসবাসকারী ভারতীয়দের ক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা নিয়ম আছে।
প্রশ্ন : আসামে নাগরিকপঞ্জী কেন?
উত্তর: এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আসামের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে হলেও জানা দরকার। ১৮২৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশরা তৎকালীন বার্মা সরকারের হাত থেকে আসাম সহ আরও কয়েকটি রাজ্য দখল করে ‘ইয়ানদাবাে চুক্তি’-র মাধ্যমে। ব্রিটিশরা তাদের শাসিত অন্যান্য অঞ্চলগুলির মানুষকে উৎসাহিত করে আসামে গিয়ে বসবাস করার জন্য। ফলে উনবিংশ এবং বিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসিত আসামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ যায়। স্বাধীনতার সময় দুঃখজনকভাবে দেশ বিভক্ত হয়। সৃষ্টি হয় ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে বহু মানুষ আসামে চলে আসতে বাধ্য হয়, যেহেতু পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে দেশ চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ১লা অক্টোবর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পাসপাের্ট এবং ভিসা ব্যবস্থা শুরু হয়। কিন্তু বহু মানুষ ১৯৫২ সালের পরেও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আসতে থাকে ভিসা অথবা পাসপাের্ট ছাড়া, মূলত ধর্মীয়, ভাষাগত এবং অর্থনৈতিক কারণে।
এর ফলে আসামের মূল বাসিন্দাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট হারিয়ে যেতে থাকে। এই অভিযােগের ভিত্তিতে ভারত সরকার ১৯৫০ সালে (Immigrants Expulsion from Assam) Act, 195) তৈরী করে। এই আইন ১৯৫০ সালের ১লা মার্চ থেকে কার্যকরী হয়। এই আইন অনুযায়ী যারা বেআইনী অনুপ্রবেশকারী তাদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়নের ব্যবস্থা করার কাজ শুরু হয়। এই কারণেই ১৯৫১ সালের জনগণনাকে ভিত্তি করে আসামের জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) ঘােষিত হয় এবং এটি কেবলমাত্র আসামের জন্যই প্রযােজ্য হয়, ভারতবর্ষের অন্য কোন রাজ্যের জন্য এটা নয়।।
প্রশ্ন : আসামে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর ইতিহাস কি?
উত্তর : ১৯৫১ সালে জনগণনার কাজ চূড়ান্ত করার সময় অসিমের প্রতিটি মানুষের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তথ্য সংগৃহীত হয়। কিন্তু সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ‘বেআইনী অনুপ্রবেশকারী’- দের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আসামের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত ২৬২ কি.মি. ব্যাপী বিস্তৃত। এই বিরাট সীমানা নজরদারী চালানাের মত কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে, বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানে (অধুনা পাকিস্তান) সরকারে অধিষ্ঠিত শাসকগােষ্ঠীর বাংলা ভাষা বিরােধী অবস্থানের জন্য এবং ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে। ১৯৬১ সালের জনগণনা রিপাের্টে উল্লেখ করা হয় ২লক্ষ ২০হাজার ৬৯১ জন উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশকারী আসামে ৬১-৫১ এই ১০ বছরে এসেছে।
এই রিপাের্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার। তৎকালীন আসামের রাজ্য সরকারকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী(NRC) তৈরীর কাজ দ্রুত শেষ করতে বলে এবং সিদ্ধান্ত নেয় আসামে বসবাসকারী সমস্ত ভারতীয়দের জন্য পরিচিতিপত্র প্রদান করা হবে। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করা বাস্তবে অসম্ভব, এই কথা আসাম রাজ্য সরকার জানানােয় ভারত সরকার এই প্রকল্প স্থগিত করে দেয়। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার একটি সরকারী আদেশে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আগে আসা উদ্বাস্তুদের জবরদস্তি ফেরত পাঠাতে নিষেধ করে আসাম সরকারকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বর্তমানে বিজেপি প্রচার করে কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে হিন্দুরা আসাম, ত্রিপুরা এবং বাংলায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু, উদ্বাস্তু হয়ে আসা এক বিরাট অংশ যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন তেমনই আর এক বিরাট অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এদের অনেকে যেমন ধর্ময় নিপীড়নের কারণে এসেছিলেন তেমনই বহু হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বা মানুষ ভাষার নিপীড়ন এবং অনুন্নত অর্থনীতি থেকে উন্নত অর্থনীতিতে প্রবেশ করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লক্ষ্যেও এসেছিলেন তৎকালান – পাকিস্তান থেকে।
১৯৭৯ সালে সারা আসাম স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন (AASU) এবং আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ (AAGSP) সমগ্র আসাম জুড়ে আন্দোলন ‘বিদেশী তাড়াও’ শ্লোগান তুলে। এই আন্দোলন ক্রমেই হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। এদের দাবী ছিল ১৯৫১ সালের পর যারাই ভারতবর্ষে এসেছেন, তাদের সবাইকে বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। এই আন্দোলনে বাঙালী-বিহারী-নেপালী সহ অনেকের উপর হিংসাত্মক আক্রমণ সংগঠিত হয়।
সি.পি.আই (এম) আসাম রাজ্য কমিটি এই আন্দোলনের বিরােধীতা করে বলে,
(১) অ-অসমীয়া জনগােষ্ঠীর উপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
(২) ১৯৫১ নয় ১৯৭১সালের ২৫শে মার্চ তারিখকে ভিত্তিবর্ষ হিসাবে ধরতে হবে।
এর ফলে সি.পি.আই (এম) সহ বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের উপর তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে আন্দোলনকারীরা। বহু বামপন্থী কর্মী খুন হন ঐ সময়। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে এই আন্দোলন চলার পর ১৯৮৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত সরকার এবং আমি রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ মধ্যরাতের পূর্বে যারা এসেছেন তারাই শর্তস্বাপেক্ষে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। এর পরে যারা এসেছেন তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত হবেন। এই পদ্ধতিতে নতুন নাগরিকপঞ্জী (কেবলমাত্র আসামের জন্য) তৈরী করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ই আগষ্ট, ১৯৮৫ এই চুক্তি দেশের সংসদের পেশ করা হয় এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশােধন করে নতুন একটি ধারা 6A ঐ আইনে যুক্ত করা হয়। এই ধারা অনুযায়ী যে সমস্ত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছেন এবং বসবাস করছেন ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের আগে থেকে, তাদের শর্তস্বাপেক্ষে নাগরিকত্ব দান করা হয়।
এই চুক্তি অনুযায়ী আসামে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য ১৯৬৬ সালের ১লা জানুয়ারীর পূর্বে আসা সমস্ত মানুষই নিঃশর্তভাবে আসাম তথা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবে। ১৯৬৬ সালে ২রা জানুয়ারী থেকে ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ মধ্যরাত (রাত ১২টা) পর্যন্ত যারা নতুন করে আসামে এসেছেন তাদের চিহ্নিতকরণ করা হবে ১৯৪৬ সালের বিদেশী আইন এবং ১৯৩৯ সালের বিদেশী (ট্রাইবুনাল) অর্ডার অনুযায়ী। যে জেলায় তাঁরা বসবাস – কৱেন এদের নাম সেই জেলায় নিবন্ধীকরণ করতে হবে। এরপর যদি এদের নথিপত্র বৈধ বলে ঘােষিত হয় তবে ১৯৯৫ সালের পর এদের নাম ভােটার তালিকায় উঠবে। সেই অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের ভােটার তালিকা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করে D’(Doubtfull/Dubious Voter) ভােটার সহ। অর্থাৎ এরা সন্দেহজনক ভােটার। তাই এদের নাম ভােটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে।
১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের পর যারা এসছেন তাঁদের চিহ্নিত করা হবে, ভােটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে এবং তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত হবে। আসামের জন্য নতুন নাগরিকপঞ্জী এর ভিত্তিতে তৈরী হবে। এই ছিল ১৯৮৫ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাক্ষরিত আসাম চুক্তির সারাংশ।
প্রশ্ন: ৭০ এর দশকে ‘আসাম আন্দোলন’ তৈরীহওয়ার প্রেক্ষাপট কি ছিল?
উত্তর : ১৯৭৮সালে তৎকালীন ‘মঙ্গলদৈ’ লােকসভা আসনের বিজয়ী প্রার্থী শ্রী হীরালাল পাটোয়ারীর মৃত্যুতে সেখানে উপনির্বাচনের দিন ঘােষণা করা হয়। এই সময় তৎকালীন ‘আসু’ নেতৃত্ব দাবী করে, নতুন করে বিদেশী বর্জিত ভােটার তালিকা তৈরী না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। এই দাবীতে আন্দোলন শুরু হয় এবং তা ক্রমেই হিংসাত্মক রূপ পেতে থাকে। ২৭শে নভেম্বর ১৯৭৯ ‘আসু’ এবং ‘আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’ যৌথভাবে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বনধ আহ্বান করে এবং সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তরগুলির সামনে অবরােধ শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকার এই আসনে কেউ মনােনয়নপত্র জমা দিতে পারে নি। এরপর এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উপত্যকায় এবং অভিযােগ খৰ্গেশ্বর তালুকদার নামে এক আসু নেতাকে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করে। ক্রমশ এই আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং অনেক অংশ থেকেই দাবী ওঠে ‘স্বাধীন আসাম’ গড়ে তােলার। ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী এক ভয়ংকর ঘটনা দেশের লােকসমক্ষে আসে। নওগাঁ জেলার নেলীর ১৪টি গ্রামে ২,১৯১ জন মানুষকে হত্যা করা হয় অনুপ্রবেশকারী এই অভিযােগে। একই অভিযােগে ১৯৭৯-১৯৮৫ এই সময়ে বিভিন্ন জাতি-উপজাতি এবং ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ১৫ হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই আন্দোলনে আনুমানিক ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, কিন্তু এই ঘটনাসমূহের কোনও তদন্ত করা হয়নি।
এই হিংসাত্মক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠার পিছনে এবং পরবর্তীকালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভূমিকার অভিযােগ বারবার সামনে এসেছে। ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য দপ্তর (USIS) ‘প্রজেক্ট ব্রক্ষ্মপুত্র’ শিরােনামে একটি নির্দেশিকা পাঠায় নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন আধিকারিকের কাছে। এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল-
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার (Special Operations ResearchOffice) এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষে অবস্থিত মার্কিন সংস্থাগুলির কাছে নির্দেশ পাঠাচ্ছে সিকিম ও ভূটান সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি সম্পর্কে সামাজিক গবেষণার কাজে সাহায্য করার জন্য। এই গবেষণার লক্ষ্য বর্তমান সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সরমতামত বুঝতে সাহায্য করা এবং এদের মতামতকে প্রভাবিত করার কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, তা নির্ণয় করা। এই কাজ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরাতে কর্মরত ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলিকে (মার্কিন) কাজে লাগাতে হবে। এছাড়াও স্থানীয় মানুষ এবং বিভিন্ন সংস্থা যাদের এই অঞ্চলগুলিতে যাওয়ার সুযােগ আছে তাদেরও কাজে লাগাতে হবে। মার্কিন সংস্থাগুলিকে এদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। আমাদের লক্ষ্যে পৌছানাের জন্য এই প্রশ্নে কোন শিক্ষাবিদ বা ছাত্রদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন আপত্তি নেই”।
এই মার্কিন নির্দেশিকা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসামে এই বিদেশী শক্তি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সময় পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরা এই ৩ রাজ্যে বামপন্থী শক্তির উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে বামপন্থীরা রাজ্যে সরকার গঠন করে। সমসাময়িক সময়ে আসামে সি.পি.আই (এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি আসাম বিধানসভায় ১২৬টি আসনের মধ্যে ২৭টি আসন দখল করে। বামপন্থীদের দখলে আসে অনেকগুলি পৌরসভাও। বামপন্থীদের অগ্রগতিকে ঠেকাতে অতীতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান তার কর্মজীবনের শেষে লেখা ‘A Dangerous Place’- বই এ উল্লেখ করেছেন মার্কিন সংস্থা CIA অন্তত ২বার কমিউনিস্টদের ক্ষমতাচ্যুত করতে অর্থ খরচ করেছে। প্রথমবার ১৯৫৯ সালে কেরালার ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিপাদ সরকার এবং পরবতীতে ৬০এর দশকে পশ্চিবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য। তাই আসামে বামপন্থীদের অগ্রগতি রােধ করতে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের জটিল পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ঘােলা জলে মাছ ধরতেই ছিল ‘প্রজেক্ট ব্রক্ষ্মপুত্র’ – এই ধারণার জোরালাে ভিত্তি আছে।
২০০৪ সালের ৫ই অক্টোবর তৎকালীন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন দূত ডেভিড সি মালফোর্ড আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি ফ্যাক্সে পাঠান। এই চিঠিতে তিনি মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা FBI কে আসামে কাজ করবার অনুরােধ জানান, যা ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্বের উপর অযাচিত এবং অপ্রয়ােজনীয় হস্তক্ষেপের সামিল। এই সব ঘটনা থেকে বারেবারে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার অভিযােগ উঠে এসেছে।
প্রশ্ন : আসামে নাগরিকপঞ্জী তৈরীতে এত দেরী কেন?
উত্তর : নতুন জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজ ‘আসাম চুক্তি’ সম্পাদনের পরেও বহু বছর কিছুই এগােয় নি। তবে ঐ চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকপঞ্জী গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসাবে ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে নির্বাচন কমিশন অদ্ভুত একটি ব্যবস্থাপনা তৈরী করে। উপযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ না দিয়ে প্রায় একতরফাভাবে ভােটার তালিকায় তারা ‘D’ ভােটার অর্থাৎ সন্দেহজনক ভােটার হিসাবে বহু মানুষকে চিহ্নিত করেন। এই পদ্ধতিতে যার বিরুদ্ধে অভিযােগ তােলা হচ্ছে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ভারতীয় নাগরিক। অথচ ১৯৪৬ সালের বিদেশী সংক্রান্ত আইন (Foreigners Act), অনুযায়ী বিদেশী চিহ্নিতকরণ ট্রাইবুনালে যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযােগ আনলে অভিযােগকারীকে প্রমাণ করতে হত অভিযােগের সত্যতা।
কিন্তু ২০০৫ সালের ১২ই জুলাই আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সােনয়ালের দায়ের করা একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয় ‘D’ ভােটারকেই প্রমাণ করতে হবে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযােগ অসত্য। এই রায়ের ভিত্তি ছিল ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের সময় আনা নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ১৭নং ধারার সংশােধনী। ১৭নং ধারা অনুযায়ী কেউ যদি বিদেশী সংক্রান্ত অসত্য অভিযােগ আনে তাহলে তার ৫ বছর জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুটোই হতে পারে। তৎকালীন বিজেপি সরকার এই আইনে সংশােধনী এনে ধারাটিকে কেবলমাত্র লঘু করেছিল তাই নয়, এফিডেবিট দায়ের করে জানিয়ে দেয় এই ধারা প্রয়ােগ করা হবে না অর্থাৎ যে কেউ ইচ্ছেমত যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদেশী বলে অভিযােগ আনতে পারেন, অভিযুক্তের দায়ভার থাকবে অভিযােগ অসত্য প্রমাণ করার। এইখানেই সাধারণ মানুষের হয়রানি শুরু হয়। কোথায় কাগজ পাবে, কি কি কাগজ লাগবে, বন্যায়-আগুনে বা অন্য কোন দুর্যোগে নষ্ট হয়ে যাওয়া নথিপত্র কিভাবে পাবে – পাগলের মত মানুষ দৌড়তে থাকে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ইলেকশন কমিশনের আনা অভিযােগের সারবত্তা নেই। এই অবস্থা চলতে থাকে ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (আসাম পাবলিক ওয়ার্কস) সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলায় অভিযােগ করে যে আসামে ৪০ লক্ষ ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ রয়েছে। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৩সালের ৬ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত নাগরিকপঞ্জীর তৈরীর নির্দেশ দেয়।
২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের সময়ে আনা নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী অনুযায়ী, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করার ব্যবস্থা থাকলেও, আসামে উল্টো পদ্ধতিতে এইকাজ করা হয়। আসামের ক্ষেত্রে সমস্ত ‘D’ ভােটারদের আবেদন কানাবার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ সরকার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কোন দায়িত্ব নিতে রাজী নয়। ২০১৫ সালের ১লা মে থেকে ৩১শে আগষ্ট এই ৩ মাসে মােট ৬৮ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৬০টি আবেদন পত্র জমা পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আসামের জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৬১ জন। এরমধ্যে বাদ পড়েন ৪০ লক্ষ ৭ হাজার ৭০৭ জন।
আবেদনকারীদের তথ্য প্রমাণের জন্য ১৩ ধরণের নথি দিতে বলা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ১৩টি নথির সংখ্যা কমিয়ে ৮টি নথিতে রূপান্তরিত করা হয়। ৫টি সহজলভ্য নথি গ্রহণে অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এগুলি হলাে –
- (১) মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট,
- (২) উদ্বাস্তু নিবন্ধীকরণ সার্টিফিকেট,
- (৩) নাগরিকত্ব রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট,
- (৪) রেশন কার্ড,
- (৫) ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ ভােটার তালিকা।
সি.পি.আই (এম) সহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই এই সিদ্ধান্তের বিরােধীতা করে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে NRC রাজ্য কোঅর্ডিনেটরের জারি করা এই নির্দেশ বাতিল হয়।
অন্য ৮টি নথি হল –
- (১) ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট,
- (২) পাসপাের্ট,
- (৩) জমির দলিল,
- (৪) চাকুরীর পরিচিতি পত্র,
- (৫) উচ্চশিক্ষার প্রমানপত্র,
- (৬) ড্রাইভিং লাইসেন্স,
- (৭) জন্ম সার্টিফিকেট,
- (৮) বীমার কাগজ।
৪ বছর ধরে এই নানা টানাপােড়েনের মধ্য দিয়ে অবশেষে ৩১শে আগষ্ট, ২০১৯ সালে ৩ কোটি, ১১ লক্ষ ২১ হাজার ৪ জনের নাম নাগরিকপঞ্জীতে ঠাঁই পায়। মােট ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়ে।
প্রশ্ন : আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী কি নির্ভুল?
উত্তর : একেবারেই নয়। এই নাগরিকপঞ্জীতে এমন অনেক মানুষের নাম বাদ গেছে যাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ ছিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি, কেউ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন অথবা কর্মরত, কেউ বর্তমান বিধায়ক বা কেউ প্রাক্তন, কেউ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারী দপ্তরে কাজ করেছেন অথবা করছেন এইরকম বহু মানুষের নাম বাদ পড়েছে এই তালিকা থেকে। বহু ক্ষেত্রে পিতা বা স্বামীর নাম আছে কিন্তু কন্যা বা স্ত্রীর নাম নেই। আবার পিতা মাতা দুজনের নাম আছে, অথচ তাদের সন্তানদের নাম নেই। আবার সন্তানদের নাম আছে অথচ পিতা/মাতার নাম নেই। এরকম ভূতুড়ে-আজগুবি-হযবরল তালিকা প্রকাশিত হয়েছে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করার নামে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও উদ্বাস্তু নিবন্ধীকরণ সার্টিফিকেট ও মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট গণ্য করেনি NRC রাজ্য কোঅর্ডিনেটর। যে পদ্ধতিতে এই তালিকা তৈরী হয়েছে তাতে ভুল থাকা অনিবার্য। ফলে বহু সংখ্যক প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক এক কলমের খোঁচায় রাষ্ট্রহীন হয়ে বন্দীশালায় যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তালিকায় নাম তােলার দায়িত্বে থাকা বেশ কয়েকজন অফিসার ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে কাজ করার অভিযােগ সেখানে লােকের মুখে মুখে ঘুরছে।
নাগরিকপঞ্জীতে নাম তােলার জন্য ২ ধরণের নথিপত্র চাওয়া হয়েছিল।
(১) তালিকা-ক (List-A) নথিপত্র,
(২) তালিকা-খ (List-B) নথিপত্র।
তালিকা-ক এ অন্তর্ভুক্ত ১৩টি নথির যে কোনও একটি জমা দিতে বলা হয়েছিল, যা আবেদনকারীর নিজের অথবা পূর্বপুরুষের নামের শংসাপত্র এবং যেগুলাে ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের পূর্বে প্রদান করা হয়েছিল। এই ১৩টি নথির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকা-ক (List-A) নথিপত্র যদি নিজের নামে না থাকে কিন্তু পূর্বপুরুষের নামে থাকে তাহলে ঐ আবেদনকারীকে তালিকা-খ (List-B) উল্লিখিত এমন নথিপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল যাতে পূর্বপুরুষের সাথে আবেদনকারীর সরাসরি রক্তের সম্পর্ক, অর্থাৎ বাবা-মা বা ঠাকুরদা-ঠাকুরমা অথবা ঠাকুরদার বাবা-ঠাকুরদার মা এর বংশধর হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করা সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মামা-মাসি-জেঠু-কাকু-ভাইবােন ইত্যাদি সম্পর্কগুলিকে অদ্ভুতভাবে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। তালিকা-খ (List-B) নথিপত্রগুলি হল –
- (১) জন্ম সার্টিফিকেট,
- (২) জমির দলিল,
- (৩) সরকার স্বীকৃত কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্র,
- (৪) ব্যাঙ্কাবীমা/ পােষ্ট অফিসের নথি,
- (৫) বিবাহিত মহিলাদের জন্য উপযুক্ত সরকারী আধিকারিকের শংসাপত্র,
- (৬) ১৯৭১সালের আগের ভােটার তালিকা,
- (৭) রেশনকার্ড,
- (৮) সরকার এবং আইন স্বীকৃত যে কোন নথি।
অর্থাৎ তালিকাক (List-A) বর্ণিত নথিপত্রে যদি পূর্বপুরুষের নাম থাকে, তাহলে আবেদনকারীর সাথে সরাসরি রক্তের সম্পর্ক প্রমান করবার জন্য তালিকা-খ (List-B)-এ উল্লিখিত নথিপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল।
কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আসামের নাগরিকপঞ্জী কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে।
প্রথমত – সেনাবাহিনী, সরকারী কর্মচারী, পুলিশ, বর্তমান বা প্রাক্তন বিধায়ক এদের নাম বাদ যায় কিভাবে? দ্বিতীয়ত – বংশপরিচয় ধরলে পিতা-মাতার নাম থাকলে সন্তানের নাম বাদ পড়ে কিভাবে? অথবা সন্তানের নাম থাকলে পিতা-মাতার নাম বাদ পড়ে কিভাবে? তৃতীয়ত – সবচাইতে গরীব-প্রান্তিক মানুষ তাদের কাছে উপরে বর্ণিত ১৩টি নথি থাকা কি সম্ভব এবং যাদের আকতিক দুর্যোগ, অগ্নিকান্ড অথবা অন্য কোন দুর্ঘটনায় নথিপত্র হারিয়ে গেছে তাদের প্রশ্নে নাগরিকপঞ্জী কর্তৃপক্ষ কি ব্যবস্থা নিয়েছে? চতুর্থত – সবচেয়ে বড় সমস্যা বিবাহিত মহিলাদের, বিশেষত: যারা বিবাহসূত্রে অন্য রাজ্য থেকে আসামে গেছেন। তাঁর জন্ম যে রাজ্যে হয়েছে, সেখান থেকে আসাম নাগরিকপঞ্জী কর্তৃপক্ষের পাঠাননা অনুসন্ধান পত্রের উত্তর সংশ্লিষ্ট রাজ্য না পাঠালে, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র তালিকায় সেই মহিলার নাম তুলে দেওয়া হয়েছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ১ লক্ষ ১১ হাজার ৪৮২ জনের নাম আসাম নাগরিকপঞ্জী কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাত্র ৫ হাজার ৮৫২ জন সম্পর্কে উত্তর পাঠিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার উত্তর না দেওয়ায় ১ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র তালিকায় উঠে গেছে। তৃণমূল সরকারের অপদার্থতায় যাদের নাম নাগরিপঞ্জীতে স্থান পেল না, তাদের দায়িত্ব কে নেবে? একইভাবে অন্য বেশকিছু রাজ্য সরকার আসাম নাগরিকপঞ্জী কর্তৃপক্ষের পাঠাননা অনুসন্ধানের জবাব না দেওয়ায় বহু মানুষের নাম ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র তালিকায় উঠে গেছে। এই ভুলের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে এবং সেই কারণে বিনা দোষে কাউকে রাষ্ট্রহীন করতে পারে? পঞ্চমত – মুসলমান মহিলাদের বিবাহের পর পদবী পাল্টে যায় হিন্দুদের মতই সাধারণভাবে। ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী পিতা-পুত্রের পদবী এক হয় না।* ফলে বংশতালিকায় উত্তরাধিকার প্রমাণ করা খুবই দুরূহ হয়ে ওঠে মুসলমান নাগরিকদের ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের রীতি কেন পৃথক করা হলাে না? ষষ্ঠত – ভােটার তালিকায় নামপিতার নাম-স্বামীর নামের বানানে অসংখ্য ভুল থাকে। নির্বাচন কমিশনের দয়ায় এমনকি স্বামী পিতা হয়ে যায়, পিতা সন্তান হয়ে যান। এমন ভুলে ভরা ভােটার তালিকা নিয়েই বছরের পর বছর নির্বাচন হয়েছে আমাদের দেশে। সেই সময়ের ভােটার তালিকা তৈরীতে নির্বাচন কমিশনের বা প্রশাসনের ভুলের খেসারত কেন দিতে হবে সাধারণ মানুষকে? এমন হাজারাে ভুল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নথিগুলােতে রয়ে গেছে। সরকারের ভুলের দায়ভার দেশের নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন?
এই পরিস্থিতিতে ১৯ লক্ষ মানুষ যাবেন কোথায়? বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন প্রত্যার্পন চুক্তি নেই। তাই কাউকে ফেরৎ নেওয়ার প্রশ্নও নেই। তাহলে এদের ভবিষ্যৎ কি জেলখানা?
প্রশ্ন : নাগরিকপঞ্জীতে অন্তর্ভুক্ত হননি, সেই মানুষ এখন কি করবেন?
উত্তর : আইন অনুযায়ী যাদের নাম বাদ গেছে তাদের নির্দিষ্ট ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হবে ট্রাইবুনাল গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে। এই ট্রাইবুনাল আবেদনকারীর বাসস্থানের জেলা শাসককে ঐ আবেদনপত্র পাঠাবে। আবেদনপত্র পাওয়ার ১ মাসের মধ্যে জেলা শাসককে রিপাের্ট ট্রাইবুন্যালকে পাঠাতে হবে। এই রিপাের্টের ভিত্তিতে একতরফাভাবে ট্রাইবুন্যাল ১ মাসের মধ্যে ঘােষণা করবে কোন আবেদনপত্রগুলি গৃহীত হল শুনানির জন্য। এটাই হচ্ছে মারাত্মক বিপদজনক ব্যবস্থা, যেখানে আবেদনকারী আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযােগ নাও পেতে পারেন। সি.পি.আই (এম) আসাম রাজ্য কমিটি এই পদ্ধতি বাতিলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরে ইতিমধ্যেই আবেদন করেছে। ৩০শে আগষ্ট, ২০১৯ বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একটি ভয়ঙ্কর আদেশ জারী করেছে। এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী একতরফাভাবে ট্রাইবুনাল যে আবেদনপত্রগুলি বাতিল ঘােষণা করবে, একই সাথে আবেদনকারী বিদেশী কিনা এই ঘােষণাও করতে হবে। অর্থাৎ দেশের হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার পূর্বেই ট্রাইবুনাল কর্তৃক বাতিল আবেদনকারী বিদেশী হিসাবে ঘােষিত হয়ে যাবেন। এর অর্থ তাকে জেলে পাঠানাে হবে। অর্থাৎ বিচার শেষ হওয়ার পূর্বেই শাস্তির ব্যবস্থা করছে ফ্যাসিস্ট মনােভাবাসম্পন্ন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।।
প্রশ্ন : আসামে নাগরিকপঞ্জী (NRC) তৈরীর খরচ কত?
উত্তর : ২০১৫ সালে আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যা বরাদ্দ করেছিল, ২০১৯ সালে তা ৫৪০% বেড়ে গিয়েছে। ২০১৫ সালে এই কাজের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এই বরাদ্দ বেড়ে ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচের জন্য আনুমানিক ১৬০২.৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দকৃত হয়েছে।
তথ্যসংগ্রহ এবং অন্যান্য কাজে শ্রমের মজুরী – ৬৬৮,৮১ কোটি।
বিভিন্নস্তরের NRC সেবা কেন্দ্র তৈরীর খরচ – ৩৩১.০১ কোটি টাকা।
কাজের তত্ত্ববধান বাবদ খরচ – ১৩৮.৯৮ কোটি টাকা।
সফটওয়ার ও ওয়েবপাের্টাল বাবদ খরচ ৮৭.৭৩ কোটি টাকা।
তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র বাবদ খরচ – ৭৮.৮২ কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ – ৫৯.৩৯ কোটি টাকা।
দপ্তর চালানাের খরচ – ৫৪.৭৫ কোটি টাকা।
নথিপত্র ছাপা বাবদ খরচ – ২২.৪৫ কোটি টাকা।
বায়ােমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ বাবদ খরচ – ১৬.৫০ কোটি টাকা।
সহায়তা কেন্দ্র বাবদ খরচ – ৭.৮০ কোটি টাকা।
এই বিপুল পরিমাণ খরচ করেও ভুলে ভরা একটি তালিকা তৈরী করেছে আসাম NRC কর্তৃপক্ষ। জনগণের করের অর্থ নষ্ট করার অধিকার এদের কে দিল? যদি ৩ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের জন্য ১৬০২.৬৬ কোটি টাকা লাগে তাহলে সমগ্র দেশের নাগরিকপঞ্জী গঠনে ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অর্থ খরচ হবে। আমাদের মত ধুকতে থাকা মন্দা অর্থনীতির উপর অনাবশ্যক এই ২ লক্ষ কোটি টাকার বােঝা চাপানাের কোন কারণ নেই।
প্রশ্ন : আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী গঠনে বিজেপির ভূমিকা কি?
উত্তর : আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি প্রচার করেছিল নাগরিকপঞ্জী হলে কোন হিন্দুর নাম বাদ যাবে না। এমনকি এই ধরণের ঘৃণ্য-বিভেদকামী-জঘন্য প্রচার করেছিল, নাগরিকপঞ্জী তৈরী করে সব মুসলমানকে তাড়ানাে হবে এবং সেই মুসলমানদের সম্পত্তি হিন্দুরা দখল করতে পারবে। দুঃখের হলেও এক বিরাট অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে বিজেপিকে ভােট দিয়েছিল এবং এর ফলে বিজেপি সরকার গঠন করতে পেরেছিল। কিন্তু নাগরিকপঞ্জীর ফল প্রকাশের পর উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। এখন নিজেদের পিঠ বাঁচানাের জন্য বিজেপি দুটো প্রচার করা শুরু করেছে।
(১) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী হচ্ছে, এক্ষেত্রে বিজেপির কোন হাত নেই।
(২) ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশােধনী বিল (CAB) পাশ করিয়ে হিন্দুদের এদেশে শরণার্থী হিসাবে রেখে দেওয়া হবে, তাই হিন্দুদের দেশ ছাড়া হওয়ার কোন ভয় নেই।
এই দুটি কথাই সর্বৈব অসত্য। প্রথমত-বর্তমানে আসাম বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সােনােয়াল সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেন। এবং তার আবেদনের ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালের ১২ই জুলাই বিদেশী অভিযােগ আনলে অভিযােগকারীকে প্রমাণ করতে হবে আভযােগের সত্যতা। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে এখন যার বিরুদ্ধে অভিযােগ, তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে অভিযােগ অসত্য। মানুষকে বিপদে ফেলার কাজ কে শুরু করেছিল এর থেকেই বােঝা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত-আসাম চুক্তি অনুযায়ী জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজ হচ্ছে না এই অভিযােগ জানিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও আসাম রাজ্যে সরকারের মতামত জানতে চায়। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার দুজনেই সম্মতি দেয় দ্রুত নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজকে শেষ করার পক্ষে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আসামে এই নাগরিকপঞ্জী গঠনের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এই সত্য বেমালুম গোপন করার চেষ্টা করছে বিজেপি।
তৃতীয়ত- ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল যা লােকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে, সেই আইন পাশ হলেও বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা কেবলমাত্র শরণার্থী রূপেই চিহ্নিত হবেন। ৬ বছর এদেশের থাকার সুযােগ পেলেও কোন সরকারী সুযােগসুবিধা, ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খােলা, রেশনকার্ড, সরকারী ভাতা, সরকারী বেসরকারী চাকুরী, ভােটার তালিকায় নাম তােলা সহ অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধার থেকে বঞ্চিত থাকবেন। ৬ বছর বাদে তারা নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন, কিন্তু নাগরিক হতে পারবেন কিনা এমন নিশ্চয়তা প্রস্তাবিত আইনে দেওয়া নেই। তাই ৬ বছর বসবাস করবার পরে এদের ভবিষ্যত কি, এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
এই প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী পাকিস্তান-বাংলাদেশ-আফগানিস্তান থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পার্সি-খ্রীষ্টান ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীরা অত্যাচারিত হয়ে ভারতবর্ষে আসলে এদেশে থাকতে পারবেন তবে কিছু শর্তের বিনিময়ে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী কেউ আসলে এই সুযােগ পাবেন না। এটা ভারতবর্ষের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই এই সংশােধনী পাশ হলে তা নিয়ে মামলা হবেই এবং সংবিধান বিরােধী এই সংশােধনী বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বামপন্থী দলগুলি সহ দেশের মূল বিবােধী রাজনৈতিক দলগুলিই কেবলমাত্র এই সংশােধনীর বিরুদ্ধে তাই নয়, বিজেপির শরিকদল উত্তর পূর্বাঞ্চলের অনেকগুলি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবিত এই সংশােধনীর – বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। এই সংশােধনীর প্রতিবাদে নাগাল্যান্ড ও বােমে সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানও তাঁরা বয়কট করেছে।
তবে ঐ ৩টি দেশের থেকে আগত ঐ ৬ ধরণের ধর্মাবলম্বীদের ভারতে স্থান পাওয়ার জন্য প্রমাণ করতে হবে যে ধর্মীয় কারণে তারা নিজেদের দেশে অভ্যাবিত হয়ে চলে এসছেন। কোন দেশের সরকার এমন কথা লিখে সার্টিফিকেট দেবেন? কেউ দেবে না। এছাড়াও প্রস্তাবিত এই আইনে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি কোথাও উল্লেখ করা নেই। তারা এদেশে থাকতে পারেন, কিন্তু নাগরিকত্ব পাবেন এমন সুযােগ নেই প্রস্তাবিত আইনে। অর্থাৎ বিজেপি হিন্দুদের যে নতুন আইনের মাধ্যমে নতুন করে নাগরিকত্বদানের কথা বলছে, তার সর্বৈব অসত্য। ফলে ১৯লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করার অপরাধ থেকে বিজেপি নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না।
প্রশ্ন : আসামে নাগরিকপঞ্জীতে ১২ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর নাম বাদ পড়েছে তাই কি বিরােধীতা? নাকি জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে প্রায় একতরফাভাবে ১৯ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার জন্য আপনি প্রতিবাদ করবেন?
উত্তর : আমাদের দেশ ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট। হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রীষ্টান-পার্সি-জৈনবৌদ্ধ-নাস্তিক সহ সব ভারতীয় এই সিদ্ধান্তের কারণেই ভারতবর্ষকে তার দেশ হিসাবে বেছে নিয়েছিল। পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকে নিজেদের ঐশ্লামিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘােষণা করা সত্ত্বেও, সেই দেশে না গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকেই নিজেদের মাতৃভূমি হিসাবে গ্রহণ করে এদেশের মুসলমানরা। একইভাবে নেপাল তৎকালীন সময় হিন্দু রাষ্ট্র থাকা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ ছেড়ে দলে দলে হিন্দু সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে নি। এর থেকেই স্পষ্ট হয় এই দেশটা ধর্মনিরপেক্ষ বলেই সব ধর্মমতের মানুষ এই দেশকে নিজের মাতৃভূমি রূপে গ্রহণ করেছে।
বিজেপি আসামের নাগরিকপঞ্জীকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ঘটানাের চক্রান্তে প্রথম থেকেই যুক্ত। দশকের পর দশক ধরে আসামে বসবাসকারী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের তাড়ানাের পরিকল্পনা কার স্বার্থে? এই বাদ পরার তালিকায় ১২ লক্ষ হিন্দুর নাম থাকায় এখন বিপদে পড়ে বিজেপি প্রচার করছে – “কিছু হিন্দু নিজেদের নথিপত্র ঠিকভাবে গুছিয়ে রাখতে পারে নি,তাই প্রমাণ পত্র দিতে পারে নি। এই জন্যই সুযােগ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের তাড়ানাে গেল না এই নির্বোধ হিন্দুদের জন্য।” বিজেপি শুধু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা লাগানােরই স্বপ্ন দেখে – সব মানুষকে নিয়ে দেশের উন্নয়নের কথা এরা বােঝে না।
বামপন্থীদের কাছে সমস্যাটা মানবিকতার-মানবতার। আধুনিক যুগে এক কলমের খোচায় ১৯ লক্ষ মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া বা জেলবন্দি করে রাখা কোন গণতান্ত্রিক সভ্য রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। এই ১৯ লক্ষ মানুষের জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম জেল বানাতে তৎপর বিজেপি। একেই ৩ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের জন্য নাগরিকপঞ্জী তৈরী করতে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ট্রাইবুন্যালের কাজ চালাতে আরাে কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। এরপর জেল বানাতে খরচ হবে ৪০০ কোটি। তারপর এই ১৯ লক্ষ কে যদি জেলে রেখে সরকারকে খাওয়াতে হয় তাহলে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১৯ কোটি টাকা কেবলমাত্র খাওয়ানাের জন্যই খরচ হবে। দেউলিয়া অর্থনীতির মন্দা বাজারে কোটি কোটি টাকার যােগান দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই। মানুষের পকেট কেটেই করের টাকা আদায় করা হবে। কোন সভ্য-ভদ্র-গণতান্ত্রিক বুদ্ধিমান সরকার এমন নির্বোধের কাজ করতে পারে, আসামের নাগরিকপঞ্জীর ঘটনা না ঘটলে এটা জানা যেত না। মানুষের মধ্যে ধর্ম-ভাষা-জাতের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরীর জন্য এর চাইতে সর্বনাশা কাজ আর কি হতে পারে।
এখন বিপদে পড়ে আসাম রাজ্যের বিজেপির নেতারা এই নাগরিকপঞ্জীর তালিকা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। বামপন্থীদের দাবী আসামে বাদ পড়া প্রতিটি মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিতে হবে। উদ্বাস্তু নিবন্ধীকরণ সার্টিফিকেট ও মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট সহ পূর্ব নির্ধারিত ১৩টি নথিকেই মান্যতা দিতে হবে। একতরফাভাবে অন্তবর্তী পর্যায়ে ট্রাইবুনাল কাউকে বিদেশী বলে ঘােষণা করতে পারবে না। ডিটেনশন ক্যাম্প বা জেলবন্দী করাটা কোন সমস্যার সমাধান নয়, আলােচনার মাধ্যমে সময় নিয়ে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসামে উদ্ভুত এই সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করতে হবে। ধর্ম-জাত-ভাষার নামে মানুষকে বিভক্ত করবার শক্তি বিজেপিকে পরাস্ত করা ব্যতিরেকে এই সমস্যার সমাধানের কোন শর্টকার্ট রাস্তা নেই।
প্রশ্ন : সারাদেশের জন্য কি নতুন করে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করা প্রয়ােজন?
উত্তর : দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিদিন হুঙ্কার ছাড়ছেন – গােটা দেশে নতুন করে নাগরিকপঞ্জী তৈরী হবে। ১লা অক্টোবর, ২০১৯ কলকাতায় এসে তিনি বলেছেন গােটা দেশে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করতে পরিকর তাদের সরকার। মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বী সব মানুষকে উদ্বাস্তুরূপে গ্রহণ করবে তাদের সরকার। প্রথমত- কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য এমন তীব্র বিদ্বেষমূলক কথা বলতে পারেন কি? তিনি কি দেশের সংবিধানেরও উর্ধে? দ্বিতীয়তজেনেবুঝে এইরকম চূড়ান্ত অসত্য কথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন কি? আগেই একটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, নাগরিক আইন সংশােধনী বিল, ২০১৬-এ কোথাও হিন্দু-শিখ-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন-পার্সি কাউকে সরাসরি নাগরিকত্ব দেওয়ার কোন সুযােগ এই প্রস্তাবিত আইনে নেই। আসামে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়ায় বিপদে পড়েছে বিজেপি। তাই এই চূড়ান্ত অসত্য প্রচার করছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এমন অসত্যবাদী, ঘৃণা ও বিভেদের প্রচারক দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে এই বহু ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি-খাদ্যাভ্যাসের দেশে ঐক্য ও সম্প্রীতি থাকবে কিভাবে?
দেশে ১৯৪৮ সালে জনগণনার রিপাের্টের ভিত্তিতে তৈরী ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী আমাদের দেশের নাগরিক তালিকা। প্রতি ১০ বছর অন্তর দেশে জনগণনা করা হয়। জনগণনার সময় নাগরিকদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্যই সংগ্রহ করা হয়। ৭০ বছর বাদে এখন নাকি এদেশের মানুষকে নতুন করে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি এই দেশের নাগরিক। ১৯৫১ সাল যদি ভিত্তিবৰ্ষ হয়, তাহলে ৭০ বছর আগের নথিপত্র কজন ভারতীয় নাগরিকের কাছে আছে? দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার সার্টিফিকেট খুঁজে না পাওয়ায় দেশের মানুষকে দেখাতে পারছেন না, আর দেশের কোটি কোটি ভূমিহীন গরীব মানুষ যাদের চালও নেই চুলােও নেই তারা প্রয়ােজনীয় নথিপত্র দেখাবেন এটা কি করে সম্ভব? বিশেষত: পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলােনীগুলিতে দলিল, পাট্টা দেওয়ার কাজ হয়েছে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর। অর্থাৎ ৫০-৬০ এর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী মানুষ জমির মালিকানা অথবা বৈধ কাগজপত্র পেয়েছেন ১৯৭৭ সালের পর। এরা কিভাবে ১৯৭১ বা ১৯৫১ সাল যেটাই ভিত্তিবৰ্ষ হােক না কেন, সেই সময়ের কাগজপত্র দেখাতে পারবেন?
হাজারাে সমস্যা দেশের। বিগত ৫ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারীর হার এখন দেশে। দেশের অর্থনীতি ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে। মােটরগাড়ী বস্ত্রশিল্প-সিমেন্ট সহ অসংখ্য শিল্পক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মুখােমুখী।
এমনকি ৫ টাকা দামের বিস্কুটের চাহিদা বাজারে কমায় ৮০ বছরের পুরানাে পার্লেজি কোম্পানীর ঝাপ বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের আয় ক্রমশ কমতে থাকায় আরও বহু কারখানার ঝাপ বন্ধ হবে। ব্যাঙ্কগুলির থেকে ১১ লক্ষ কোটি টাকা লােপাট করে দিয়েছে এদেশের কিছু ফোড়ে-দালাল-কর্পোরেট। ধুকতে থাকা ব্যাঙ্কগুলি বাঁচানাের জন্য সরকার এগুলির সংযুক্তিকরণের কাজ করছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যশালী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেশিরভাগই এখন রুগ্ন ও মৃতপ্রায় – সরকারের বেসরকারী কর্পোরেট তােষন নীতির জন্য। রেলগাড়ী পর্যন্ত বেসরকারী মুনাফাখখারদের হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপির সরকার। ধনীদের সুবিধার জন্য কপোরেট ট্যাক্স কমানাে হচ্ছে আর সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উপর ট্যাক্স বাড়ছে, রান্নার গ্যাসের উপর ভর্তুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে।
বাড়ছে পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দাম। বাড়ছে সব নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম। বিগত ১ বছর ধরে আম্বানীর দৈনিক সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা অথচ দেশের শ্রমিকদের মজুরী বাড়াতে রাজী নয় মোদীর সরকার। ধনীদের সম্পদের উপর ‘সম্পদ কর’ চাপিয়ে যে অর্থ আদায় করা সম্ভব, তাতে আমাদের দেশে সামাজিক সুরক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানাে যায় এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য- পি.এফ-ই.এস.আই ইত্যাদিতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের প্রভূত উপকার হতে পারে। কিন্তু সে রাস্তায় যেতে প্রস্তুত নয় বিজেপি সরকার। কারণ কপোরেটের অর্থেই বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে। তাই এদেশের ‘আচ্ছে দিন’ এখন কেবল আদানি-আম্বানী-রামদেব বাবাদের জন্য। দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি সামাল দেওয়ার নাম করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মজুত ভান্ডার থেকে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার জবরদস্তি তুলে নিয়ে, ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় অর্থাৎ ভর্তুকি দিয়েছে ধনীদের সুবিধার জন্য।
দেশের এই ভয়াবহ সঙ্গীন অবস্থার থেকে দৃষ্টি ঘােরানাের জন্যই কখনও কাশ্মীর, কখনও হিন্দি ভাষা আরােপ, কখনও NRC, কখনও রামমন্দির নির্মানের মত অপ্রয়ােজনীয় অথচ বিভেদকামী বিষয়বস্তু আমদানি করছে বিজেপি। সমগ্র দেশে বিভেদের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে বিজেপির সরকার। মানুষ কেন সরকার তৈরী করে? দেশে শান্তি-সম্প্রীতি-ঐক্য-উন্নয়নের জন্য নাকি দেশকে, দেশের মানুষকে জাত-ধর্মের জিগীর তুলে বিভক্ত করবার জন্য?
প্রশ্ন : সারাদেশের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর জন্য কি কি কাজ করতে চাইছে বিজেপি?
উত্তর : আমাদের দেশে ভােটার তালিকা সময়ােপযােগী করার জন্য সাধারণভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভােটার তালিকা সংশােধনীর কাজ করা হয়, যাকে নির্বাচন কমিশনের পরিভাষায় বলা হয় SRER (Summary Revision of Photo Electoral Roll)। এবার হঠাৎই নির্বাচন কমিশন EVP (Electors Verification programme) কর্মসূচী গ্রহণ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে এই কর্মসূচী নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করেনি। এই কর্মসূচী অনুযায়ী ভােটারদের নিজের নাম-বয়স, পিতা/ স্বামীর নাম ইত্যাদি তথ্যাবলী ভােটার তালিকায় যাচাই করার দায়িত্ব গ্রহন করতে বলা হয়েছে। অথচ সংবিধানে এই কাজ করার দায়িত্ব ন্যস্ত আছে নির্বাচন কমিশনের উপর। ভােটার তালিকা যাচাইয়ের এই কর্মসূচী নির্বাচন কমিশনের যে প্রস্তুতি নিয়ে করার কথা তা করে নি। ফলে এই কর্মসূচী ঘােষনার দেড় মাস পরেও ২০% ভােটারের নামও যাচাই করা হয়নি। ঘােষিত কর্মসূচী অনুযায়ী এই কাজ ১৫ই অক্টোবর শেষ হবে। যে পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে তাতে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটারের নাম যাচাই এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হবে না। তাহলে এদের কি হবে? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আসামে ‘D’ ভােটার চিহ্নিত করণের কাজ করেছিল নির্বাচন কমিশন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযােগ না দিয়েই এই কাজ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ভােটার তালিকায় এক কলমের খোচায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার জন। নাগরিকের নাম সন্দেহজনক তালিকায় নথিভুক্ত হয়েছিল।
২০২০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে জনগণনার কাজ শুরু হবে সেই অধ্যাদেশ ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার জারী করেছে। এই জনগণনার সময় সংগৃহীত তথ্যাবলীর মাধ্যমে নতুন একটি কার্ড তৈরী করা হবে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘােষণা করেছেন। ভারতীয় নাগরিকদের কাছে ভােটার কার্ড-রেশনকার্ড-আধারকার্ড-প্যানকার্ড সহ সরকার প্রদত্ত হরেক রকম কার্ড আছে। সরকারের ঘােষণা অনুযায়ী ৯৬%, অর্থাৎ ১২৩ কোটি ৪০ লক্ষ ভারতীয়দের হাতে আধার কার্ড পৌছে দেওয়া হয়েছে জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত। এই আধার কার্ড তৈরী করতে ২০০৯-১০ সাল থেকে ২০১৭-১৮ এই ৮ বছরে ৯,০৫৫.৭১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। মােট খরচ হবে ৯,৯৪২ কোটি টাকা। তাহলে আবার এই নতুন কার্ড তৈরীর কারণটা কি?
লােকসভা নির্বাচনের আগে অমিত শাহ উত্তরবঙ্গে সভা করতে এসে বলে গিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ২.৭৫ কোটি ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। আবার বিজেপির রাজ্য সভাপতি সম্প্রতি বলেছেন সারা দেশে নাকি ২ কোটি ‘অনুপ্রবেশকারী’ বাংলাভাষী মানুষ আছে। অনুপ্রবেশকারীদের এই সংখ্যা এরা কোথা থেকে পেলেন? বাংলাভাষীদের উপর অনর্থক সন্দেহ প্রকাশ করে দেশের নানা প্রান্তে আগেও বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার তাদের হেনস্থা করেছে বারবার বম্বে-দিল্লী সহ বিভিন্ন শহরে। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যােগী আদিত্যনাথ ঘােষণা করেছেন – সব বাংলাভাষীদের উপর নজরদারি রাখা হবে এবং তাদের বৈধ কাগজপত্র আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীও একই কথা ঘােষণা করেছেন। দেশজুড়ে বাংলাভাষীদেরই এবং বিশেষত বাংলাভাষী মুসলমানদের আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি। আর তাদের এই বিভেদকামী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শরিক হচ্ছে এই রাজ্যের বিজেপিও। এরা করবে বাংলার মানুষের উপকার – বিশ্বাস করেন আপনি?
বিজেপি রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করেই এইকথা ছুঁড়ে দিচ্ছে আতঙ্ক তৈরীর জন্যই। বিভেদ তৈরীর তাদের চিরাচরিত প্রথা বিজেপি এক্ষেত্রেও প্রয়ােগ করার চেষ্টা করছে। যারা এরাজ্যে বিজেপিকে ভােট দিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই আসামের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আসামে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বিজেপিকে ভােট দিয়েছিলেন তাদেরও অনেকেরই নাম তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। যারা ৫ই আগষ্ট ৩৭০নং ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরে জমি কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের অনেকেরই নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়ায় এখন নিজের জমি হারানাের মুখে দাঁড়িয়েছেন। এই বিজেপিকে আর বিশ্বাস করবেন?
প্রশ্ন : ভভাটার তালিকা যাচাইকর্মসূচী (EVP), জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী (NPR), নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল ২০১৬ (CAB) – এই কাজগুলি কি জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) তৈরীর প্রাথমিক পদক্ষেপ?
উত্তর : দেশের সংবিধান অনুযায়ী ৩টি কাজ আলাদা আলাদা। কিন্তু একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজগুলি বিজেপি শাসিত সরকার করতে চাইছে। মূল উদ্দেশ্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে দেশজুড়ে আতঙ্ক, বিভেদ তৈরী করা এবং দেশের মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া।
সম্প্রতি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ্ হঠাৎই ঘােষণা করেছেন আবার নতুন কার্ড নাগরিকদের জন্য তৈরী করা হবে। এইসব ঘােষণার থেকেই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে আশঙ্কা তৈরী হয়েছে যে বিজেপি সমগ্র দেশে নাগরিকপঞ্জী তৈরী করতে চাইছে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে।
৭০ বছর বাদে কাউকে যদি বলা হয় ১৯৫১ সাল অথবা তার পূর্ববর্তী কোন নথি নাগরিকত্বের প্রমাণ স্বরূপ উপস্থিত করতে হবে, তাহলে এর চাইতে অবাস্তব এবং হাস্যকর কাজ আর কিছু হতে পারে না। যেভাবে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নির্বিকার থেকে দেশে ভােটার তালিকা যাচাইয়ের কাজ করছে, তাতে নিশ্চিত দেশের ৯২ কোটি ভােটদাতাদের খুব বেশি হলে ২০-২৫% নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই কর্মসূচীতে সামিল হতে পারবে। কতজন ভারতবাসী কম্পিউটার বা স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তা কি নির্বাচন কমিশনের জানা নেই? আমাদের দেশে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ কোটি ৬০ লক্ষ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই সংখ্যা বেড়ে হতে পারে আনুমানিক ৬২ কোটি ৭০ লক্ষ। এই সংখ্যার মধ্যে অসংখ্য সরকারী-বেসরকারী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যুক্ত আছে। ফলে দেশের জনসংখ্যার ৪০%-র বেশী মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযােগ পান না। এরা কিভাবে ভােটার তালিকায় নিজেদের নামবয়স ইত্যাদি যাচাই করবেন? কি উত্তর দেবে নির্বাচন কমিশন?
তাহলে এই কাজ কি নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে বিজেপি সরকার নির্দিষ্টভাবে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ এবং অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত একটি বা দুটি সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়ার লক্ষ্যকে মাথায় রেখে করতে চাইছে? নির্দিষ্ট সময় অন্তর দেশের জনগণনা হয়। বাড়ী বাড়ী ঘুরে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এই কাজ হয়। ২০১১ সালের পর, ২০১৫ সালে এই তথ্যাবলী সময়ােপযােগী করা হয় এবং ২০২০ সালে ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর এই কাজ করার জন্য সরকারী নির্দেশনামা প্রকাশিত হয়ে গেছে। এতে কোন সমস্যা নেই। ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনে শ্রীঅটল বিহারী বাজপায়ীর সময় যে সংশােধনী আনা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী পরবর্তী সরকারও জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী তৈরীর কাজ করে।
কিন্তু দেশের ৯৬% মানুষ আধার কার্ড পেয়ে যাওয়ার পর এই কর্মসূচী গ্রহণের কোন বাস্তব কারণ নেই। আধার কার্ডে বর্ণিত তথ্যাবলীর বাইরে গিয়ে নতুন করে আবার সামগ্রিকভাবে জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জীর কাজ করা।
এখন অর্থের অপচয় মাত্র। বরং আধার কার্ডের আওতায় নেই এমন ৪% মানুষকে এর আওতাভুক্ত করা, নবজাতক এবং নতুন নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং বর্তমান আধার কার্ডের তথ্যাবলী সময়ােপযােগী করে তােলা অনেক বেশি জরুরী। সমগ্র জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী নতুন করে তৈরী করা এবং আর একটি নতুন কার্ডের প্রচলনের উদ্দেশ্য কি – একথা স্পষ্ট করে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে। একই সাথে নাগরিকত্ব আইন সংশােধনী বিল ২০১৬ আগামী সংসদের অধিবেশনে পাশ করাবার কথা শ্রী অমিত শাহ ইতিমধ্যেই ঘােষণা করেছেন, যা দেশের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই কারণেই বামপন্থী দলগুলি সহ দেশের মূল বিরােধী দলগুলি জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরী এবং নাগরিকত্ব আইন সংশােধনী বিল ২০১৬-এর বিরােধীতা করছে।
প্রশ্ন : তৃণমূল কংগ্রেস দল কি সত্যিই সারা ভারতে নাগরিকপঞ্জী (NRC) তৈরীর বিরুদ্ধে?
উত্তর : ২০০৫ সালের ৪ঠা আগষ্ট শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় সাংসদ পদত্যাগ করে পত্র পাঠান তৎকালীন লােকসভার অধ্যক্ষের দপ্তরে। যদিও উপাধ্যক্ষকে (Deputy Speaker) সম্বােধন করে ঐ পদত্যাগ পত্র লেখার জন্য সেটি গৃহীত হয়নি। কোন দাবীতে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, সেটা উল্লেখ করা প্রয়ােজন। তিনি অভিযােগ করেছিলেন – “বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের’ নিয়ে পশ্চিমবাংলায় ভােটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজ্য সরকার এই বিষয় কিছু করতে চায় না।” তাই তিনি অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি সংসদে উল্লেখ করতে চান। তিনি আরও বলেন – “‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’-দের বিষয়টি পশ্চিমবাংলায় এক ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী করেছে। আমার কাছে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষ দুই দেশেরই ভােটার তালিকা আছে। আমি জানতে চাই এই বিষয় সংসদে কবে আলােচনা হবে।” যেহেতু তিনি আইনসঙ্গত নােটিশ দেন নি তাই তৎকালীন উপাধ্যক্ষ শ্রী চরনজিৎ সিং আটওয়াল তাকে এই আলােচনার সুযােগ দেন নি। এই কারণে রাগে-ক্ষোভে তিনি সংসদের ওয়েলে ছুটে যান এবং অসংসদীয় কায়দায় হাতের কাগজপত্র উপাধ্যক্ষের আসনের দিকে ছুঁড়ে মারেন। সংসদের বাইরে এসে সাংবাদিকদের তিনি জানান যে পশ্চিমবাংলায় ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ অবিলম্বে তাড়াতে হবে এবং এই দাবীতে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই কথা তিনি কেবলমাত্র সেই দিনই বলেছেন তাই নয়, এর আগেও বহুবার এই একই অভিযােগ করেছেন। তাঁর ঐ সময়ের দাবী এবং এখন ভােটের কথা মাথায় রেখে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে এখন নাগরিকপঞ্জী তৈরীর বিরোধীতা – তাঁর সুবিধাবাদী অবস্থানকেই স্পষ্ট করে। বিজেপির সব নেতারাই শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপরের উক্তিকে হাতিয়ার করেই জাতীয় নাগরিকপঞ্জী গঠনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করছেন। সেদিন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল আর.এস.এস, এবং বিজেপির সাথেই। তাই আর.এস.এস. এবং বিজেপির কথাই সেদিন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তার কণ্ঠে।
পশ্চিমবাংলায় বর্তমানে তিনি উচ্চগ্রামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর। বিরােধিতা করছেন, মিছিল করছেন-সভা করছেন। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য কারণে ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর সাথে একান্ত বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সামনে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নিয়ে একটি কথাও উল্লেখ করলেন না। এক সাংবাদিকের প্রশ্নে উত্তরে অত্যন্ত দায়সারাভাবে বললেন – ওটা আসামের ব্যাপার। ওটা নিয়ে কিছু বলার নেই।
কলকাতায় লম্পঝম্প করছে তৃণমূল অথচ তাদের দলনেত্রী ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে উল্লেখ করার প্রয়ােজন মনে করলেন না। উল্টে ওটা আসামের ব্যাপার বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। আসলে তৃণমূল দলটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ। তাই জেলে পাঠানাের ভয় দেখিয়ে বিজেপি তাকে ইচ্ছেমত ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর বিরােধীতার প্রশ্নেও তাই তৃণমূল নেত্রী যে কোন সময় জেলযাত্রা বাঁচাতে বিজেপির পক্ষে অবস্থান নিতেই পারেন। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই।
প্রশ্ন : সারা ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরীর প্রশ্নে বামপন্থীদের বক্তব্য কি?
উত্তর : এখন EVP-র কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসন এই কাজে গা-ছাড়া মনােভাব নিয়ে চললেও ভােটার তালিকা যাচাইএর কর্মসূচীতে সর্বশক্তি নিয়ে নামতে হবে। প্রত্যেক ভােটারের তথ্য যাচাই করার জন্য ভােটারদের সচেতন করতে হবে এবং পাড়ায় পাড়ায় ভােটার তালিকা সহায়তা কেন্দ্র খুলতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন করতে হবে যাতে, তাদের নিজের-পিতা-স্বামী-স্ত্রী-সন্তানদের রেশনকার্ড-ভােটার তালিকা-জন্ম সার্টিফিকেট, আধার কার্ড সহ সরকারী নথিতে নামের বানান এবং অন্যান্য তথ্যাবলী যেন একই থাকে। তবে অযথা আতঙ্ক যাতে না ছড়ায় তার জন্যও মানুষকে সচেতন করতে হবে।
এই প্রশ্নে বিজেপি-তৃণমূল কাউকে বিশ্বাস করার অর্থ দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পােষা। এই ভুল যেন কোনমতেই না হয়। বিচ্ছিন্ন করতে হবে বিজেপিকে, যারা মানুষকে ভাগ করার জন্য এই অপরাধ করছে। এর আগে কালাে টাকা উদ্ধারের অসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে ৩ মাস ধরে লাইনে দাঁড় করিয়েছিল এই বিজেপি। ১ টাকাও উদ্ধার হয়নি বরং ধনীদের কালাে টাকা সাদা হয়েছে এই কর্মসূচীতে। এখন নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরী করে আবার নথি যােগাড় করার লাইনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বিজেপি।
আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরী হয়েছে ঐতিহাসিক কারণে। সারা দেশে নাগরিকপঞ্জী নতুন করে তৈরী করার কোন অর্থ নেই। আসামে যে ১৯ লক্ষ মানুষকে এক কলমের খোচায় রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়েছে তা অমানবিক। এদের প্রত্যেককে আবারও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিতে হবে এবং শুধুমাত্র বিদেশী ট্রাইবুনাল নয়, বিচার ব্যবস্থাকে যুক্ত করতে হবে নথি যাচাইয়ের প্রশ্নে। জেলবন্দী করা আধুনিক-সভ্য-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।
হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রীষ্টান-পার্সি-জৈন-বৌদ্ধ-নাস্তিক অর্থাৎ ধর্মজাতি-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলতে হবে – NO NRC.
তথ্যসূত্র :
- ১) NRC Official Website
- ২) Central Budget -2017-18, 2018-19, 2019-20.
- ৩) সংসদের কার্যবিবরণী
- ৪) Front Line, Oct.23-Nov.05, 2004
- ৫) A Dangerous Place-Daniel Patrick Moynihan, 1978
- ৬) ZEE News – September 24th, 2019
- ৭) Prabhat Patnaik, The Telegraph, August 9th, 2019
- কৃতজ্ঞতা: শ্রী সুপ্রকাশ তালুকদার (আসাম), শ্রী অলোকেশ দাস।