লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
পৃথিবীর পৃষ্ঠভূমিতে মোঙ্গল জাতি অর্থাৎ তাতারীরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার ইতিহাস পাঠ করলে আজও বুক কেঁপে ওঠে, শরীরের রোমকুপ খাড়া হয়ে যায়। যে দেশেই অভিযান চালিয়েছে সেই দেশে লাশের স্তুপ খাড়া করে লক্ষ লক্ষ বসতি জনমানবশূন্য অঞ্চলে পরিণত করে দিয়েছে এই নৃশংস তাতারীরা। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ যত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদের সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাবে মোঙ্গল অর্থাৎ তাতারীদের ধ্বংসযজ্ঞ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের রাজধানী ও সমগ্র মুসলিম জাহানের কেন্দ্রস্থল বাগদাদ নগরীকে এই দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গীজ খানের নাতি হালাকু খানের মোঙ্গল বাহিনী লাশের স্তুপে পরিণত করে দেয়। বাগদাদের আব্বাসী খেলাফতের পতন ঘটায়, হালাকু খান ১২৫৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আল মুস্তা‘ছিমকে কার্পেটে মুড়ে ঘোড়ার সাহায্যে পদদলিত করে হত্যা করে। খলিফার পরিবারকেও হত্যা করা হয়। খলিফার কনিষ্ঠ পুত্রকে বাঁচিয়ে রাখা হয় ও মঙ্গোলিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এক কন্যাকে হালাকু খানের হারেমে দাসি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়।
মোঙ্গলদের বাগদাদ ধ্বংসের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে অনেক কবিতা ও শোকগাঁথা রচনা করেন। বহু ঐতিহাসিক মোঙ্গলদের এই মুসলিম খেলাফত ধ্বংসের ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু মোঙ্গলদের ভয়াবহতার ইতিহাস বর্ণনা করে কেউ পরিসমাপ্তি টানতে পারেননি। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে যারাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তারা কমপক্ষে নিজেদের অনুসারীদের রেহাই দিয়েছে কিন্তু মোঙ্গল এমন এক রক্তপিপাসু জাতি হিসেবে ইতিহাসে বর্ণিত আছে, যারা নারী-পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এমনকি তারা গর্ভবতী রমণীদের গর্ভপাত ঘটিয়ে ভ্রূণকেও হত্যা করেছে। সেজন্য মুসলিম ইতিহাসবিদরা মোঙ্গল অর্থাৎ তাতারীদের এই ধ্বংসলীলাকে ইয়াজূজ-মাজূজের ধ্বংসলীলার সাথে তুলনা করেছেন।
তাতারীরা প্রথমে ছিল সূর্যের পূজারী। তারা কুকুর-শূকরসহ সকল প্রাণীর মাংস ভক্ষণ। তাতারীদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কোন স্থান ছিল না। তারা নারী-পুরুষ যে যার সাথে ইচ্ছা যৌনকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ত। সেজন্য তাদের সন্তানদের কোন পরিচয় ছিল না। মনে করা হয় এজন্যই তারা এত হিংস্র জাতিতে পরিণত হয়েছিল। তাতারীদের নারী সৈন্যরাও ছিল চরম হিংস্র। তাদের নারী সৈন্যরাও শত শত নীরিহ মানুষকে নির্বিচারে নৃশংসভাবে হত্যা করত। তাদের নারীরাও এমনভাবে যুদ্ধ কৌশলে দক্ষতা অর্জন করেছিল তা দেখে লোকেরা তাদেরকে পুরুষ মনে করত।
মোঙ্গল জাতির অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে ও কিংবদন্তী ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, একদা আমি তাতারদের শাসন আমলে কতিপয় সাথীসহ তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তারা মদ পান করছিল। আমার সঙ্গী-সাথীরা তাদেরকে তিরস্কার করল। আমি সাথীদের ধমক দিয়ে বললাম, আল্লাহ তো এজন্য মদ হারাম করেছেন যে, এটি আল্লাহর যিকির ও ছালাত আদায়ে বাধা দেয়। আর মদ এ সকল লোককে মানব হত্যা, সন্তানদের বন্দি ও সম্পদ লুণ্ঠন থেকে বিরত রেখেছে। এই তাতাররা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাদের অনেকে ইসলামের খিদমতে নিজেদের নিয়োজিত করে।
তাতারদের পরিচয় ও ইতিবৃত্ত
প্রকৃতপক্ষে তাতার তুর্কি জাতিগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত একটি বিশেষ উপজাতি। এরা ইউরোপ ও এশিয়ায় বসবাস করে। তাতাররা ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে মঙ্গোলীয় মালভূমির পাঁচটি প্রধান উপজাতির মধ্যে অন্যতম একটি উপজাতি। তাতার হল প্রকৃতপক্ষে যে জনগোষ্ঠী মূলত তুর্কি ভাষায় কথা বলে। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গীস খান ১২০৬ সালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে মোঙ্গল জাতিকে নিজের বশীভূত করে ফেলেন। চেঙ্গীস খানের নেতৃত্বে তাঁর পৌত্র বাটু খান (১২০৭ থেকে ১২৫৫ সাল) মোঙ্গল জাতিকে আরো পশ্চিমের রাশিয়ার সমভূমির দিকে চলে যেতে বাধ্য করেন। মঙ্গোল ও হাজারাদের মধ্যে এখনও তাতার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অনেক গোত্রের দেখতে পাওয়া যায়। এখনও মঙ্গোল ও তাদের শাসনভুক্ত তুর্কি জনগোষ্ঠীকে বুঝাতে রুশ ও ইউরোপীয়রা ‘তাতার’ শব্দটি ব্যবহার করে। পরবর্তীতে শব্দটি মোঙ্গল বা তুর্কি ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীকে তারা তাতার বলে অভিহিত করত।
তাতার ও মোগল বলতে সেইসব সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা উত্তর চীনের জূবী হীম-শিতল মরুভূমি অঞ্চলে বাস করত। মোঙ্গল জাতি হল আসলে তাতারদের একটি শাখা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত জাতি বিশেষ। অনুরূপ সালজুকী, তুর্কী, ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী তাতারদেরই অংশ বা শাখা। এদের শাসন করতেন চেঙ্গীস খান। তারা মোঙ্গল বা মোগল নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছিল। এরা সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তারা পূর্বে কোরিয়া থেকে পশ্চিমে ইসলামী সাম্রাজ্য খাওয়ারিযম এবং উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে চীন সাগর পর্যন্ত তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলে। চীন, মোঙ্গলিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও সাইবেরিয়ার কিছু অংশ থেকে লাউস, মায়ানমার, নেপাল ও ভুটান প্রভৃতি অঞ্চল মোঙ্গলদের অধীনেই ছিল।
মুসলিম ইতিহাসবিদ আলী মুহাম্মাদ আছ-সাল্লাবী (১৯৬৩) বলেন, পশ্চিমে ইউরোপ মহাদেশ, পূর্বে জাপান ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত এবং উত্তরে সাইবেরিয়া ও বাল্টিক সাগর, দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ, সিরিয়া ও ফিলিস্তীন পর্যন্ত তাতারদের রাজত্ব বিস্তার লাভ করে। তিনি আরো বলেছেন, হিজরী দ্বিতীয় শতকে তাতাররা প্রধানতঃ দু’টি দলে বিভক্ত ছিল। যাদের একটিতে নয়টি গোত্র বা কাবীলা ছিল। আর অপরটিতে ত্রিশটি কাবীলা ছিল বা গোত্র ।
সপ্তম হিজরী শতকে যখন মোগলরা একটার পর একটা দেশ জয় করে তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নিচ্ছিল তখন এই জাতী ‘তাতার’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছিল। চীন, ইসলামী ভূখন্ড বা ইউরোপে অথবা রাশিয়া সর্বত্রই মানুষ তাতারদের এক নামে চিনত। সেজন্য মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনুল আসীর (রহঃ) চেঙ্গীস খানের পূর্ব পুরুষদের তাতার বলে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে প্রাচীন জাপানীদের মধ্যে তাতারা সাকীছিয়া (Sacythia) বা সাকীতিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
দশম শতাব্দী অর্থাৎ ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের আগে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মোঙ্গল বা মোগল নামে কোন জাতির অস্তিত্ব ছিল না। ইতিহাসবিদদের মতে মোঙ্গল জাতি কোন জনৈক নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়, এবং ঐ নামেই তারা পরিচয় বহন করে। অতঃপর উক্ত নেতা নেতৃত্বে অন্য জাতির উপর ক্ষমতা বিস্তার করে এবং ‘মোগল’ নামটি পরিচিত হয়ে উঠে। এরপর একদল যোদ্ধা তাদেরকে ছেড়ে এশিয়া মায়নরে চলে যায়। যাদের পরবর্তীরাই তুর্কী তাতার বা কারা’তাতার নামে পরিচিতি লাভ করে। তারা তইমুর লঙের হামলার সময় আমাসীয়া ও কায়ছারিয়ার মধ্যে অবস্থিত গ্রাম-গঞ্জে যাযাবরী জীবন-যাপন শুরু করে। এ সময় সংখ্যায় তারা প্রায় তিন হাযার থেকে চার হাযারটি পরিবার ছিল। পরে তায়মুর লঙ তাদেরকে মধ্য এশিয়ায় বিতাড়িত করেন। উছমানীয় শাসক দ্বিতীয় বায়েযীদ তাদেরকে কাশগর ও খাওয়ারিযমে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। তায়মূর লঙের মৃত্যুর পরে এই তুর্কী তাতাররা পুনরায় এশিয়া মায়নরে ফিরে আসে এবং নতুনভাবে বসতী স্থাপন করে। এজন্য রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে বসবাসরত তাতার বলতে সকল তুর্কী জনগোষ্ঠীকে বুঝায়।
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন তাতাররা তুর্কীদেরই একটি বড় জনগোষ্ঠী। অন্যান্য গোত্র তাতারদের শাখা। ফলে তারা পুরো তুর্কী জাতিকে তাতার হিসাবে গণ্য করেন। অতএব মোগলরা তাতারদেরই একটি অংশ। বিশেষতঃ মানকূস (Manchos) জাতি। যেমনটি বর্তমানে চীনে তাদের অবস্থান। তুর্কী ঐতিহাসিকগণ বলেন, পূর্বযুগে আলানজা খান নামে তাতারদের একজন বাদশাহ ছিলেন। তাতারখান ও মোগল খান নামে তার দু’জন সন্তান ছিল। যেমনটি আরবে মুযার ও রাবী‘আ দু’জন ব্যক্তির নামে দু’টি গোত্র পরিচিতি লাভ করে। এভাবে তাদের জীবন ইতিহাস চলতে থাকে। এক পর্যায়ে মোগল সম্রাট ইলাখান ও মোঙ্গল সম্রাট সুনজু খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে রূপ নিলে মোঙ্গল সম্রাট সুনজু খান বিজয় লাভ করেন। মোঙ্গলরা পরাজিত হয়। এতে পুরো ক্ষমতা চলে আসে তাতারদের হাতে। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যায়নি। যুগের পর যুগ ধরে যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। অবশেষে চেঙ্গীস খানের পিতা ইয়াসুকী বাহাদুর খান ক্ষমতা লাভ করেন। [সূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
তাতারদের ধর্মীয় পরিচয়
তাতাররা এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর ধর্মের অনুসরণ করত। অনেকটা সম্রা্ট আকবরের বিভিন্ন ধর্মের সম্মিলিত দ্বীন-ই-ইলাহীর মত জগাখিচুড়ি ধর্মের মত ছিল। মোঙ্গল নেতা চেঙ্গীস খান ইসলাম ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু নিয়ম নীতি তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাতারদের জন্য উপস্থাপন করেন, এবং এই নতুন ধর্মের নাম দেন ‘আল-ইয়াসাক্ব’। চেঙ্গীস খান ধর্মের ব্যাপারে উদারনীতি অবলম্বন করেছিলেন। সেজন্য তাতারদের কেউ ইহুদী ধর্ম কেউবা খৃষ্টান ধর্ম আবার কেউ সবগুলো ধর্মই পালন করত। তাদের মধ্যে অনেকেই মূর্তিপূজার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করত। চেঙ্গীস খানের পুত্রদের মধ্যে যার যে ধর্ম পছন্দ সে সেই ধর্ম গ্রহণ করত পারবে। অন্যরা অন্যরা সেই ধর্ম পালন করতে বাধা দেবে না।
তাতারীরা ইচ্ছামত যে যার ধর্ম পালন করলেও তারা ব্যপকহারে ছিল তারকা পুজারী। ইসলাম গ্রহণের পূর্ব তাতাররা পূজা করত। সূর্য উদয়ের সময় তারা সুর্যকে সিজদা (প্রণিপাত) করত। সম্পর্কের বিধিনিষেধ অমান্য করে তারা অবাধে যে যার সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ত। তাদের মধ্যে বিবাহের ধারণায় ছিল না সেজন্য তাদের কোন পিতৃ পরিচয় ছিল না। অনেক মোগল-তাতারদের মধ্যে ‘শামানিয়া’ (Shamaniasm) নামে এক পুরাতন ধর্ম বিদ্যমান ছিল। তারা বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা ঐ সকল বিভিন্ন প্রাণীরও উপাসনা করত যেগুলোকে তারা তাদের মহাক্ষমতাধর উপাস্য দেবতার নামে উৎসর্গ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এগুলো বিপদের সময় তাদেরকে সাহায্য করবে। এছাড়াও তাতারীরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারও পুজা ও উপাসনা করত।
ইতিহাসবিদ ইবনে কাসীর, ইবনুল আসীর প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ তাতারীদের ধর্ম সম্পর্কে বলেন,
وَأَمَّا دِيَانَتُهُمْ، فَإِنَّهُمْ يَسْجُدُوْنَ لِلشَّمْسِ عِنْدَ طُلُوْعِهَا، وَلَا يُحَرِّمُوْنَ شَيْئًا، فَإِنَّهُمْ يَأْكُلُوْنَ جَمِيْعَ الدَّوَابِّ، حَتَّى الْكِلَابَ، وَالْخَنَازِيْرَ، وَغَيْرَهَا، وَلَا يَعْرِفُوْنَ نِكَاحًا بَلِ الْمَرْأَةُ يَأْتِيْهَا غَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ الرِّجَالِ، فَإِذَا جَاءَ الْوَلَدُ لَا يَعْرِفُ أَبَاهُ-
‘আর তাদের ধর্মকর্ম ছিল যে, তারা সূর্য উদয়ের সময় তাকে সিজদা করত। তারা কোন কিছুই হারাম মনে করত না। তারা সকল প্রাণীকে ভক্ষণ করত। এমনকি কুকুর, শূকর ইত্যাদি প্রাণীর গোশতও খেত। বিবাহের সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান ছিল না। বরং একজন নারীর কাছে বহু পুরুষের গমনাগমন হ’ত। ফলে সন্তান জন্মিলে পিতৃ পরিচয় মিলত না।’
হিজরী সপ্তম শতকের শুরুতে মুসলিম শাসিত রাজ্যগুলির অবস্থা
এ সময় ইসলমী সম্রাজ্য বিভিন্ন ছোট ছোট দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এর নেতারা অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই শাসকেরা খাওয়ারিযম রাজ্যর উপর ভয়ংকর মোগল সৈন্যদের হামালার পূর্বে তাদের রনকৌশল ও সমর দক্ষতা সম্পর্কে জানতে পারেননি। এদিকে রাজ্য জয়ে মোঙ্গল তাতারদের হামলা অব্যাহত থাকে। পরে চীন ও তুরকিস্তান এবং ভারত, ইরান, এশিয়া মায়নর ও পূর্ব ইউরোপের কিছু অংশ তারা দখল করে নেয়। এরপরেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত মুসলিম শাসকেরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার চিন্তা করেনি। যাতে তারা সর্বধ্বংসী মোগলীয় যুদ্ধ স্রোতকে প্রবল হওয়ার পূর্বে বাধা দিতে পারে। স্বয়ং বাগদাদে ক্ষমতা লোভী নেতারা স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্ব বিপদজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। দজলা নদীর প্লাবন অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইরাকের অর্ধভূমি ধ্বংসে নিপতিত হয়েছিল। আরো বলা যায় যে, আববাসীয় শাসনের দ্বিতীয় যুগের শুরু থেকেই রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ে। ইরাকের দক্ষিণ অঞ্চলের বহু এলাকা জলাভূমিতে পরিণত হয়। অথচ ইতিপূর্বে এই ভূমি ছিল আববাসীয় সম্রাজ্যের প্রাচুর্যের ভিত্তি এবং সভ্যতার ধারক। যেমন প্রথম দিকে প্রাচ্যের খাওয়ারিযমের বাদশাহগণ নিজেদের সৈন্যদেরকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে আববাসীয় খিলাফত রক্ষার কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কিন্তু পরে আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ খাওয়ারিযমশাহ বাগদাদ দখলে নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। যেমনটি ইতিপূর্বে বনু বুওয়াইহ ও সুলজুকীরা করেছিল। কিন্তু তিনি দু’টি কারণে তার ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হন। প্রথমতঃ প্রবল তুষার ঘূর্ণীঝড়ের কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়তঃ মোগল সৈন্যরা তার রাজ্যের উপর প্রচন্ড হামলা করে। অবশেষে তিনি কাযবীন সাগরে পলায়নে বাধ্য হন এবং কোন এক দ্বীপে ৬২০ হিজরী সনে মারা যান। এই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও প্রবল যুদ্ধের পর মোগলরা তাদের দেশে ফিরে আসে। অপরদিকে আলাউদ্দীন মুহাম্মাদের সন্তান জালালুদ্দীন মানকাবারতী ভারত থেকে ৬২২ হিজরী সনে নিজ দেশে ফিরে আসেন। তিনি ইতিপূর্বে চেঙ্গীস খানের সৈন্যের সামনে টিকতে না পেরে ভারতে পলায়ন করেছিলেন। দেশে ফিরে এসেই তিনি মোগলদের বিপদ দূর করার কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রথমেই তিনি তার পিতার সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করেন। অতঃপর ইরাকীয় আরব ও অনারবদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। তাদের ভূমি দখল ও সম্পদ লুণ্ঠন করেন। অবশেষে তিনি বাগদাদের জন্য বড় হুমকী হয়ে দাঁড়ান। এ কারণে মুসলিম নেতারা ঐ বছরই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এজন্য আশরাফ বিন মালাক আল-আদিল আয়ূবী ও রোমের শাসক কীফান বিন কায়খসরু ঐক্যবদ্ধ হয়ে জালালুদ্দীন মানকাবারতীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাকে পরাস্ত করেন। অপরদিকে ৬২৮ হিজরী (১২৩১/১২৩২) সনে মোগলররা জালালুদ্দীন মানকাবার্তীর উপর প্রচন্ড ও ন্যক্কারজনক আক্রমণ করে। এতে তিনি পাহাড়ের দিকে পলায়ন করেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। কোন এক কুর্দীর হাতে তিনি নিহত হন।
এতো ছিল পূর্ব ইসলামী বিশ্বের অবস্থা। কিন্তু অন্যান্য ইসলামী বিশ্বের অবস্থা ছিল ভিন্নতর। আরব উপদ্বীপ, মিসর এবং সিরিয়ার একটি বড় অংশ সুলতান ছালাহুদ্দীন আইউবীর কর্তৃত্বে ছিল। কিন্তু ৬১৫ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানরা রাজ্য ভাগ নিয়ে পরস্পরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে মুসলিম শক্তি দুর্বল হ’তে থাকে। অপরদিকে খৃষ্টান অপশক্তি বারংবার সিরিয়া, ফিলিস্তীন ও মিসরে আঘাত হানতে থাকে। মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও তাদের উপর খৃষ্টানদের অব্যাহত হামলা মোগলরা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তারা যখন বুঝতে পারে যে, মুসলমানগণ এখন পুরোপুরি দুর্বল তখনই তারা বাগদাদে হামলা করে ধ্বংসলীলা চালায়। [সূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
চেঙ্গীস খান
যাঁরা সামান্য হলেই ইতিহাসের কিছু পৃষ্ঠা পাঠ করেছেন তাঁদের মধ্যে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যাঁরা চেঙ্গীস খানের নাম শোনেনি। তার সমকক্ষ সেনাপতির সংখ্যা সামান্য কয়েকজন। চেঙ্গীস খানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এককভাবে জয় করেছিলেন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অঞ্চল এবং একই সাথে ৪ কোটি নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুর জন্যও এককভাবে দায়ী। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর মত নৃশংস শাসক জন্মগ্রহণ ইতিপূর্বে করেনি।
চেঙ্গীস খানের পিতা ইয়াসূজাঈ ছিলেন একজন আঞ্চলিক শাসক। ১১৫৮ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে ক্ষমতায় আসীন হন তাঁর ছোট ছেলে তেমুজীন।
অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর ১২০৬ সালে তেমুজিন সমগ্র মঙ্গোলিয়ান স্তেপের একছত্র অধিপতি হিসাবে আবির্ভূত হন তখন তাঁকে “চেঙ্গীস খান” উপাধি দেওয়া হয়। অনেকের মতে চেঙ্গীস খান নামটি তিনি নিজেই ধারণ করেন। চেঙ্গীস খান নামের বাংলা অর্থ সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি, অন্য একটি মতে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর দুর্দোণ্ড ধ্বংসযজ্ঞের একারণেই তাঁর পিতার দেওয়া নাম তেমুজিন কালের অতলে হারিয়ে যায় এবং চেঙ্গীস নামটি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের জন্য অক্ষয় হয়ে যায়।
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেই চেঙ্গীস খান বিভক্ত মোগল ও তাতারদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তিনি সফলও হন। তিনি ৪৩ বছর বয়স অবধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্য পরিচালনা করেন। চেঙ্গীস খান অভ্যন্তরীণ শত্রুদের থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করলে দেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের আওতায় আনতে সচেষ্ট হন। আর এজন্য ‘ইয়াসাক্ব’ বা ‘ইয়াসাহ’ নামে একটি নীতিগ্রন্থ রচনা করা হয়। ইয়াসাহ তুর্কী অর্থে ‘আল-কানূনুল মুজতামাঈ’ বা সামাজিক বিধিবিধান।
আগেই বর্ণনা করা হয়েছে যে তাতারীদের মধ্যে বিবাহ নামক কোন কনসেপ্টে বিশ্বাস করত না ফলে যে যার সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়ে পাইকারী হারে সন্তান জন্ম দিত এবং সেই সন্তানদের কোন পিতৃপরিচয় বহন করত না। চেঙ্গীস খান তাঁর গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন যে- আর অবাধে যৌনকর্মের লিপ্ত হওয়া যাবে না এবং যে ব্যভিচার করবে তাকে হত্যা করা হবে। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলবে, যাদুবিদ্যা করবে, কাউকে বিনা দোষে বন্দি করে রাখবে বা দ্বন্দ চলছে এমন দুই দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে একদলের পক্ষ নিবে ও সাহায্য করবে তাকে হত্যা করা হবে। যে ব্যক্তি জল বা ছাইয়ের মধ্যে পেশাব করবে তাকে হত্যা করা হবে। যাকে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে মালপত্র দেওয়া হ’ল তৃতীয়বারের পরেও যদি সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে। যদি কোন লোক কোন বন্দিকে সে গোত্রের অনুমতি ব্যতীত খাবার দেয় বা বস্ত্র দেয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে। যদি কোন দাস বা বন্দি পলায়ন করে অতঃপর অন্য কোন ব্যক্তি তাকে আশ্রয় দেয় ও মূল মালিককে ফিরিয়ে না দেয় তাহ’লে তাকে হত্যা করা হবে।
প্রাণী জবাই করার ব্যাপারে উক্ত গ্রন্থে বলা হয়, পশুটির চার পা শক্ত করে বেঁধে দিবে এরপর সেটি না মরা পর্যন্ত তার হার্টে আঘাত করতে থাকবে। কিন্তু কেউ যদি মুসলমানদের ন্যায় প্রাণী জবাই করবে তাকেও জবাই করা হবে। যুদ্ধের সময় যে ব্যক্তির বস্ত্র বা কোন মাল-সামান পড়ে যাবে। তার পিছনে থাকা ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হবে সেখানে নেমে তা কুড়িয়ে নেওয়া। এটি না করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড।
চেঙ্গীস খান মারা গেলে তাঁর সন্তান সন্ততি ও তাঁর অনুসারীরা তাদের সংবিধান ‘ইয়াসাক’ বা ‘ইয়সার’ বিধান সমাজে চালু করেন যেমনভাবে মুসলমানেরা কুরআনের বিধান ইসলামী দেশে বা সমাজে চালু করে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে চেঙ্গীস খানের প্রর্তিত নীতিগুলিকে এবং তাঁর প্রণীত গ্রন্থকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করে। এগুলো ছাড়াও অনেক নিয়ম-নীতি ছিল যেগুলোর কিছু ভাল, এবং কিছু অদ্ভুত প্রকৃতির। তাদের বিধানসমূহ ভালো-মন্দ যাই হৌক না কেন, সমাজে এর প্রচলন মোঙ্গল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যাপক সহায়তা করে। এ থেকেই তারা একের পর এক মুসলিম বিশ্বের উপর হামলা করে বহু মুসলিম এলাকা দখল করে নেয়।
কুরআনের ভাষ্যকার ও ইতিহাসবিদ ইবনে কাসীর লিখেছেন,
“তারা এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা করেছে, যার সঠিক সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। তারা শিশু ও নারীদের বন্দী করেছে। নারীদের সঙ্গে তাদের পরিবারের পরিজনের উপস্থিতিতে অশ্লীল কর্ম সাধন (ধর্ষণ) করেছে!! (পিতার উপস্থিতিতে মেয়ের সঙ্গে, স্বামীর উপস্থিতিতে স্ত্রীর সঙ্গে অপকর্ম করেছে!!!) যারা নিজেদের আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই করেছে, তাদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। বন্দীদের বিভিন্ন ধরণের শাস্তি প্রদান করেছে। শহরের আকাশ বাতাস নারী-পুরুষ ও শিশু – কিশোর আর্তনাদে কেঁপে উঠেছে। এরপর তারা বুখারার মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। শহর পুড়ে ভস্ম হয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়।” [আল বিদায়া ওয়ান হিহায়া, ইবনে কাসীর]
তাতারীদের ইতিহাস ধ্বংসযজ্ঞ বর্ণনা করতে গিয়ে ডঃ রাগেব সারজানী লিখেছেন,
“রাসুল (সাঃ) – এর আবির্ভাবের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৬১৭ হিজরীর চেয়ে অধিক ভয়াবহ ও মর্মান্তিক কোন বছর মুসলিম উম্মাহর উপর অতিক্রম হয়নি। সে বছর তাতারীদের গগন তারকা মধ্যাকাশে জ্বলজ্বল করছিল। মুসলিম সাম্রাজ্য তাতারী আগ্রাসনের থাবায় পরিণত হয়েছিল। যার নযীর (দৃষ্টান্ত) পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। তারা এমন সব অপকর্ম ও ভয়াবহ দুর্ঘটনার অবতারণ করেছে যে, যা কেউ শোনেনি, কেউ কখনো কল্পনাও করেনি।” [তাতারীদের ইতিহাস, ডঃ রাগেব সারজানী, অনুবাদঃ আব্দুল আলিম পৃষ্ঠা – ৪৮]
তাতারদের বিজয়াভিযান ও নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ
মোঙ্গলরা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ দখল করে নেয়। বাগদাদে পৌঁছানোর আগে তারা যেসব ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তার ভয়াবহতা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ইবনুল আসীর (রহঃ) আক্ষেপ করে বলেছিলেন,
فَيَا لَيْتَ أُمِّي لَمْ تَلِدْنِي، وَيَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ حُدُوثِهَا وَكُنْتُ نَسْيًا مَنْسِيًّا
‘হায়! আমার মা যদি আমাকে জন্ম না দিতেন! হায়! আমি যদি এই ঘটনার পূর্বে মৃত্যুবরণ করতাম এবং একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম’।
বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডারও চেঙ্গীস খানের মত এত দ্রুত বিশ্বজয় করতে সক্ষম হয়নি। তিনি বিশ্ব জয় করেন প্রায় দশ বছর ধরে অভিযান চালিয়ে। ইতিহাসবিদদের এতে তিনি কাউকে হত্যা করেননি। লোকেরা স্বেচ্ছায় তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। আর তাতাররা অর্থাৎ মোঙ্গলরা ছিল ঠিক তার বিপরীত। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রকে দখল করে মাত্র এক বছরে। তারা রাষ্ট্র দখল করতে গিয়ে যত ধরণের নৃশংসতা আছে তার প্রত্যেকটাই প্রয়োগ করে।
তাতার বা মোঙ্গল বাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে একটার পর একটা রাষ্ট্র শ্মশানে পরিণত করে তা মানব ইতিহাসে বিরল। তারা প্রথমিক পর্যায়ে মুসলিম বিশ্বের দিকে আগ্রাসন চালায়নি। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মুসলিম নেতৃবৃন্দের লোভ ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মোঙ্গলরা মুসলিম বিশ্বের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে।
তাতারীরা পূর্ব চীন সীমান্তের কাছে ত্বামগাজা নামক পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করত। মোঙ্গল ও মুসলিম বিশ্বের মাঝে দূরত্ব ছিল ছয় মাস পথের। খোয়ারিযম শাহ মুহাম্মাদ বিন তুকুস মা-ওয়ারাউন নাহার (বর্তমান আফগানিস্তান ও কাযাকিস্তান) রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হয়েই আশ-পাশের শহরগুলো দখল করে নেন এবং এর নেতাদের হত্যা করেন। শহরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- বুখারা, সামারকান্দ, বালাসাগুন, কাশগড় প্রভৃতি। এ শহরগুলো মূলতঃ মুসলমান ও তাতারদের মধ্যে একটি বড় প্রতিবন্ধক ছিল। কিন্তু এর শাসকদের হত্যা করা হ’লে পুরো এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব চলে আসে খোয়ারিযম শাহের উপর। যা সামাল দেওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কাশগড় ও বালাসাগুনের নেতারা খোয়ারিযম শাহের ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তাদের বিশ হাযারের একটি দল সমবেত হয়। যারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিল। যারা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিল। তারা তুর্কিস্তানে চলে যায়। সেখানে খোয়ারিযম শাহের সৈন্য ও কর্মকর্তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বহু শহর দখল করে নেয়। খোয়ারিযম শাহের অবশিষ্ট সৈন্যরা ফিরে আসে এবং তারা তাতারদের হাত থেকে রক্ষা পায়। এক্ষেত্রে তিনি ধৈর্যধারণ করেন। তাছাড়া তিনি দেখলেন যে, সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে তার রাজ্য বিস্তার সম্ভব নয়। এজন্য তিনি তুর্কিস্তানকে তাদের জন্য ছেড়ে দেন। তিনি দৃঢ়ভাবে এটি স্থির করে নেন যে, তুর্কিস্তান তাদের জন্যই। আর এটা ব্যতীত মা-ওয়ারাউন নাহারের অন্যান্য রাজ্য যেমন সামারকান্দ, বুখারা এবং অন্যান্য রাজ্যসমূহ খোয়ারিযম শাহের জন্য। এভাবে চার চারটি বছর অতিক্রান্ত হ’ল। অপরদিকে চেঙ্গীস খান চিন্তা করে দেখলেন যে, তাতারদের একটি অংশের নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ড নেই। তিনি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হ’লেন। তিনি সকলের নেতা হওয়ার মনস্কামনা করলেন। শুরু হ’ল বিজয়াভিযান। চীন সীমান্তে বসবাসরত সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে অভিযানে নেমে পড়লেন। অবশেষে তারা তুর্কিস্তানের সীমান্তে পৌঁছে যান এবং তথাকার সীমান্ত রক্ষীদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় লাভ করেন। [সূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
চেঙ্গীস খানের পৌত্র হালাকু খানের আবির্ভাব ও বাগদাদ আক্রমণ
এক সময় ক্ষমতার হস্তান্তর হতে হতে মোঙ্গল নেতা কুবলাই খান মোঙ্গলদের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি মোঙ্গলদের কাছে ‘মহান খানে’ (الخان الاعظم) পরিণত হন। তিনি পারস্য, শাম ও এশিয়ার শাসনকার্যের দায়িত্ব দেন চেঙ্গীস খানে নাতি ইতিহাসের আর এক নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞের কাণ্ডারী হালাকু খানকে। তার হাতেই মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরীর পতন ঘটে। হালাকু খান সেইসব অঞ্চলের দায়িত্ব পেয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি চাতুরতার সাথে মুসলমানদের এক অঞ্চল দখলের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অন্য মুসলিম এলাকার সহযোগিতা নিতে থাকেন। মুসলিম নেতারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে হালাকু খানকে সহযোগিতা করতে থাকেন। কিন্তু স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে পর পরবর্তী কালে হালাকু খান ঐ মুসলিম নেতাকে আক্রমণ করে বসতেন।
মোঙ্গল শাসক চেঙ্গীস খানের পৌত্র মুসলিমদের রক্তপিপাসু হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ আক্রমণ ও মুসলিম খেলাফত ধ্বংস পৃথিবীর ইতিহাস এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করার জন্য মোঙ্গলরা চীনের মোঙ্গলিয়া থেকে শুরু করে খাওয়ারিজম, বুখারা, সমরকন্দ, মারভ, রায়, হামদান, আজারবাইজান প্রভৃতি এলাকা একের পর এক দখল করে নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করতে থাকে। খোরাসান ও খাওয়ারিজমের পতন হ’লে মোঙ্গলরা ১২৫৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরী অবরোধ করে বসে। এ সময় বাগদাদের খলীফা ছিলেন আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ আল-মুস্তা’ছিম বিল্লাহ (৬০৯-৬৫৬ হি.)। তিনি ছিলেন বাগদাদের সর্বশেষ খলীফা। মোঙ্গলরা খলীফা মুস্তা’ছিম বিল্লাহ ও তাঁর পরিবারসহ প্রায় দু’লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। বহু মানুষ নিখোঁজ হয়। কিছু মানুষ জলে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার ধ্বংস করে বিরানভূমিতে পরিণত করে মোঙ্গল অর্থাৎ তাতারবাহিনী।
তাতারদের বাগদাদে প্রবেশ ও ধ্বংসযজ্ঞ
খোরাসানের পতনের কারণে হালাকু খানের জন্য বাগদাদ অভিযানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। হালাকু খান বাগদাদের দিকে দ্রুত ধাবিত হন। এ অভিযানে হালাকু খান সঙ্গে নেন মূছেলের শাসনকর্তা বদরুদ্দীন লুলু ও সাবেক ইসমাঈলী শিআ মন্ত্রী দার্শনিক নাছীরুদ্দীন তূসীকে। এদিকে মহিউদ্দীন ইবনুল খাওয়ারিজমী খাদ্য, বাহন ও অর্থ দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোক পাঠান। আবার মূছেলের সুলতানের পুত্র ছালেহ ইসমাঈলীও হালাকুর সঙ্গে যোগ দেন। সব মিলে দু’লক্ষ সৈন্য সাথে নিয়ে হালাকু খান বাগদাদের পথে রওয়ানা হন। হালাকুর সৈন্যদল পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিক দিয়ে বাগদাদের পথে রওয়ানা হয়। বাজুয়ানের নেতৃত্বে আরেক দল সৈন্য পশ্চিম দিক দিয়ে তিকরিতের পথ ধরে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হয়। হালাকু বাহিনীর ভয়ে লোকেরা নারী ও সন্তানদের নিয়ে দুজাইল, ইসহাক, নাহরে মালাক ও নাহরে ঈসা ত্যাগ করে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। তারা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় যেন নিজেদেরকে পানিতে নিক্ষেপ করছিল। মাঝিরা লোকদের পারাপার করার সময় ভাড়া হিসাবে স্বর্ণের চুড়ি, বালা ও বহু দীনার লাভ করছিল। যখন হালাকু খানের ত্রিশ হাযার অশ্বারোহী সৈন্য দুজাইল নগরীতে প্রবেশ করল তখন খলীফা মুস্তা‘ছিমের পক্ষ হ’তে তাদের প্রতিরোধের জন্য মুজাহিদুদ্দীন আয়বেক (দোওয়েদায়ে ছগীর নামে পরিচিত) ইযযুদ্দীন সামনে অগ্রসর হন। তিনি অল্প সংখক সৈন্য নিয়ে এক বিশাল বাহিনীর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। কিন্তু চেকস মোঙ্গল সৈন্যরা রাতে দজলা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দিলে মুসলিম সৈন্যরা দিশাহারা হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মোঙ্গল সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদের কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দি করতে সক্ষম হয়। এ থেকে কেবল তারাই রক্ষা পায় যারা নদীতে ঝাঁপ দেয় বা যারা মরুভূমি হয়ে সিরিয়ায় পলায়ন করে। সেনাপতি ইযযুদ্দীন দোওয়ায়েদার কোন মতে আত্মরক্ষা করে বাগদাদে চলে যান। আর হালাকুর সেনাপতি বাজু তার সৈন্যদের নিয়ে শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবেশ করে মুহাযিত-তাজের সামনে অবস্থান নেয়। তার সৈন্যরা মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। অপরদিকে মোঙ্গল বাহিনী পূর্ব পাশ দিয়ে ৪ঠা মুহাররম ৬৫৬ হিজরী বাগদাদের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান গ্রহণ করে। খলীফার সৈন্যরা ১৯শে মুহাররম ৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। অতঃপর তাতাররা বাগদাদের প্রাচীর ভেঙ্গে তীব্র গতিতে শহরে প্রবেশ করে নাগরীকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। লোকেরা ভয়ে বহুতল ভবন ও উঁচু মিনারে আশ্রয় গ্রহণ করে। হালাকু খান খলীফাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। খলীফা এতে কর্ণপাত না করলে তাতাররা বাগদাদ নগরী অবরোধ করে। খলীফা যখন দেখলেন আত্মসমর্পণ ব্যতীত গত্যন্তর নেই তখন তিনি যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য শারফুদ্দীন ইবনুল জাওযীকে হালাকুর নিকটে পাঠান। কিন্তু হালাকু বাহিনী চুক্তির অঙ্গীকার করে মুসলমানদের ধোঁকা দেয়। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, ইবনুল আলকামী তার পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হালাকুর নিকট গমন করে। অতঃপর খলীফাকে হালাকুর কাছে যাওয়ার ইঙ্গিত করে এবং তার সাথে সাক্ষাৎ করে সন্ধি করার পরামর্শ দেয়। যাতে বলা হয় অর্ধেক জিযিয়া হালাকুর জন্য হবে ও অর্ধেক হবে খলীফার জন্য।
খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর পুত্র আহমাদ, আব্দুর রহমান ও মুবারক এবং কাযী, ফক্বীহ, আলেম-ওলামা, ছূফী ও গণ্যমাণ্য ব্যক্তিসহ তিন হাযার অনুচরবর্গ জীবন রক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করতে হালাকু খানের নিকট যান। এই প্রতিনিধি দলটি যখন হালাকুর বাসস্থানের কাছে পৌঁছে তখন সতের জন ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে হত্যা করা হয়। খলীফা হালাকুর নিকটে পৌঁছলে সে খলীফাকে বলল, আপনি মেযবান আর আমরা মেহমান। অতএব আপনি আমাদের উপযুক্ত মেহেনদারী করুন। খলীফা তার ধনভান্ডরের তালা খুলে তার মেহমানদারী করার নির্দেশ দিলেন। এতে তার জন্য ত্রিশ হাযার পোশাক, দশ হাযার দীনার এবং অগণিত মুনি-মুক্তা হালাকুর সামনে উপস্থাপন করা হ’ল। কিন্তু হালাকু এগুলোর প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করে খলীফাকে বললেন, এগুলো আমার দাস ও সৈন্যদের জন্য। এগুলোতো প্রকাশ্য সম্পদ। কিন্তু গচ্ছিত ও রক্ষিত সম্পদ কোথায়? সেগুলোর সন্ধান দিন। খলীফা লুক্কায়িত সম্পদের কথা বলে দিলে তারা তা খনন করে দেখল যে, হাউয লাল স্বর্ণে পরিপূর্ণ। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হালাকু খান স্বয়ং খলীফার সাথে অতিশয় অপমান সূচক আচরণ করলেন। খলীফা লাঞ্ছিত, ভীত ও অপদস্ত অবস্থায় বাগদাদে ফিরে এলেন। খাজা নাছীরুদ্দীন তূসী ও খলীফার প্রধান মন্ত্রী ইবনুল আলকামীও খলীফার সাথে বাগদাদে ফিরে এলো। তাদের পরামর্শক্রমে খলীফা পুনরায় রাজকোষের সমুদয় স্বর্ণ, হীরক এবং মূল্যবান সামগ্রীসহ হালাকুর নিকট উপস্থিত হ’লেন। শী‘আ মন্ত্রীদ্বয়ের ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনার ফলে খলীফা মুস্তা‘ছিমের শত অনুনয়-বিনয় ও অনুরোধ সত্তেবও হালাকু খান খলীফার সাথে চুক্তি করতে সম্মত হননি। হালাকু খান খলীফার সাথে সন্ধি করতে চাইলে ইবনুল আলকামী হালাকু খানকে বলে, আপনি খলীফার সাথে চুক্তি করবেন না। কারণ তিনি এক বা দু’বছরের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গ করবেন। তিনি আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন। এভাবে ইবনুল আলকামী হালাকু খানকে খলীফার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে। তারপর হালাকুখান খলীফাকে বললেন, বাগদাদবাসীকে নির্দেশ দেন যাতে তারা অস্ত্র রেখে দিয়ে বাগদাদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। খলীফা তাই করলেন। ফলে লোকেরা নিরাপত্তার আশায় অস্ত্র ফেলে লাইন ধরে রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু এতেও বাগদাদ নগরী হালাকু খানের প্রমত্ত ধ্বংসযজ্ঞ হ’তে পরিত্রাণ পেল না। এসময় হালাকু তার সৈন্যদেরকে লাইনে থাকা নিরস্ত্র সাধারণ লোকদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। হত্যাকান্ড শেষ হ’লে হালাকু খান বাগদাদ নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খলীফা ও তার আত্মীয়-পরিজনসহ নগরীর অসংখ্য নর-নারীকে হত্যা করে। প্রাণভয়ে ভীত বাগদাদের অগণিত নারী-পুরুষের করুণ আর্তিকে উপেক্ষা করে মোঙ্গলবাহিনী বিভৎস হত্যাকান্ডের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। শুধু জীবননাশের মধ্য দিয়েই মোঙ্গলবাহিনীর অত্যাচার শেষ হয়নি, তাদের হাতে যুগ যুগ লালিত মুসলিম সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতিরও বিলুপ্তি ঘটে।
একদল লোক আত্মরক্ষার জন্য ঘরে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে মোঙ্গল বাহিনী তাদের কারো দরজা ভেঙ্গে এবং কারো দরজায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে। অতঃপর গৃহবাসীকে পাকড়াও করে উঁচু ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। আর তাদের রক্ত ছাদ হ’তে নালার মত হয়ে নীচে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
তাদের আক্রমণের প্রচন্ডতায় মুসলিম জাতির গৌরবকীর্তি, মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র বাগদাদ নগরী ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এভাবে আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী বাগদাদ তার সর্বস্ব হারায়। চল্লিশ দিন ধরে হালাকু বাহিনী তাদের ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখে। তাদের নির্মম হত্যাকান্ড হ’তে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ ও যুবক কেউ রেহাই পায়নি। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা কিছুই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কেবল ইহুদী-খৃষ্টান, শী‘আ-রাফেযী ইবনুল আলকামীর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণকারী ও কিছু ব্যবসায়ী যারা অর্থের নিরাপত্তা গ্রহণ করেছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল। তারা বহু অর্থ ব্যয় করে নিজেদের ও সম্পদের নিরাপত্তা লাভ করেছিল।
বাগদাদ ধ্বংসের বর্বরতা সম্পর্কে ব্রাউন বলেন,
“সম্ভবত কখনোই এত বড় ও সমৃদ্ধশালী একটি সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি।”
মোঙ্গলদের নিষ্ঠুর আক্রমণে অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, অট্টালিকা প্রভৃতি নিশ্চিহ্ন হ’ল। কেবল মুষ্টিমেয় শিল্পী, চিত্রকর প্রভৃতি এই আক্রমণের কবল থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল।
মোঙ্গল বাহিনীর চল্লিশ দিনের ধ্বংসলীলায় এক লাখ ষাট হাযার হ’তে প্রায় দু্’লাখ নারী-পুরুষ নিহত হয়। এই সংখ্যা সলিল সমাধিতে মৃত ও পলায়ন করে নিখোঁজদের ব্যতীত। [সূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
ইতিহাসবিদ ইবনে আসীর মোঙ্গল হামলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে তাঁর মনোবেদনা ও হৃদয়যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারেন নি। তিনি লিখেছেন –
“এ ঘটনা এমনই লােমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক যে, কয়েক বছর আমি লিখব কি লিখব না এই দ্বন্দেই ছিলাম। একবার ভাবি লিখব, আরেকবার ভাবি না, লিখব না। আসলে ইসলামের দুর্দশা এবং মুসলিম উম্মাহর সর্বনাশের কাহিনি লিখতে পারে এমন কলিজা কারই বা আছে। হায়! যদি আমার জন্মই না হতো, কিংবা এর আগেই আমি মরে যেতাম এবং আমার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে যেত। কিন্তু কিছু বন্ধুর দাবি, এ ঘটনা আমি যেন ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষণ করি। তবু দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম, না লেখার মধ্যেও কোনো ফায়েদা এ ছিল এমন বিপদ ও দুর্যোগ যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। যদিও এর প্রধান শিকার ছিল মুসলিম জাতি, তবুও এর বিস্তার ছিল অন্যান্য জাতি পর্যন্ত। কেউ যদি দাবি করে যে, আদম আ. থেকে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় এমন ঘটনা আর ঘটেনি, তাহলে তার দাবি মিথ্যা হবে না। কারণ, এর ধারে-কাছের ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় নেই এবং কেয়ামত পর্যন্ত সম্ভবত দুনিয়া এমন ঘটনা আর দেখবে না, ইয়াজুজমাজুজের ঘটনা ছাড়া। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কারও প্রতি এই পশুরা কোনো দয়া করেনি। যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করেছে, পেট ফেড়ে গর্ভের সন্তান পর্যন্ত। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। লা হাওলা ওয়ালাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিইয়িল আজীম। এ ফেতনা ছিল বিশ্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। যা এক ভয়ংকর তুফানের মতাে ধেয়ে এসেছিল এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।” [আল কামীল, ১৩/২০১-২০৩]
খলীফা ও তাঁর সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা
মোঙ্গল বাহিনী খলীফার বাসভবন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহ শত চেষ্টা করেও নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি। ইসলাম বিদ্বেষী দুই শিয়া মন্ত্রীর উস্কানীর ফলে শেষ পর্যন্ত হালাকু খান মুস্তাসিম বিল্লাহর প্রাণ ভিক্ষা দিতেও প্রস্তুত হ’লেন না।
হিংস্র মোঙ্গল বাহিনী খলীফাকে বস্তায় ভরে লাথি মারতে মারতে হত্যা করে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, খলিফাকে চটের বস্তার মধ্যে ভরে কুঠার দ্বারা আঘাত করে টুকরা টুকরা করে হত্যা করে। খলিফার সাথে তাঁর বড় ছেলে আবুল আব্বাস আহমাদ ও মেঝো ছেলে আব্দুর রহমানকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর ছোট ছেলে মুবরারক ও তাদের তিন বোন খাদীজা, মরিয়ম ও ফাতিমাকে বন্দী করে দাসে পরিণত করে। এছাড়া হাযার হাযার কুমারী নারীকে বন্দি করে প্রকাশ্যে তাদের ধর্ষণ করা হয়। এমনকি খলীফার স্ত্রীকেও ধর্ষণ করা হয় বলে বর্ণিত আছে।
ইসলাম জগতের অন্যতম খলীফাকে ১৪ই ছফর ৬৫৬ হিজরীতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর চার মাস। তাঁর খেলাফতকাল ছিল ১৫ বছর ৮ মাস।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে খালদূন (রহঃ) খলীফার হত্যাকাণ্ড বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তাতারীদের ধারণা ছিল খলিফাকে বস্তায় ভরে হত্যা করলে রক্ত মাটিতে না পতিত হবে না। কারণ তারা জানত যে, খলিফার রক্ত মাটিতে পতিত হ’লে তাতারীদের উপর অভিসম্পাত অবতীর্ণ হতে পারে। সেজন্য হালাকু খান প্রথমে খলীফাকে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিলে তাকে বলা হয়,
“যদি তাঁর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে তাহ’লে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে এবং আপনার রাজত্ব ধ্বংসের কারণ হবে। কারণ তিনি ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বংশধর এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলীফা।”
তখন প্রকাশ্য ইসলামের শত্রু শিয়া নাছীরুদ্দীন তূসী দাঁড়িয়ে বলল,
“তাঁকে এমনভাবে হত্যা করা হৌক যাতে রক্ত প্রবাহিত না হয়।”
তাঁকে হত্যার জন্য আনা হ’লে তিনি এমন জোরে চিৎকার দেন যে বাগদাদের আকাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ফলে তাকে বস্তায় ভরে লাথি মারতে মারতে হত্যা করা হয় যাতে খলিফার রক্ত মাটিতে না পড়ে। এর আগে খলীফাকে যখন তাতার বাহিনী তাবুতে অবরোধ করে রেখেছিল তখন তিনি মধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন।
হালাকু খানের বাহিনী চল্লিশ দিনে যে ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল তা বর্ণনাতীত। তারা তাদের সহযোগী মুসলমানদেরকেও মুক্তি দেয়নি। হালাকু খানের বাহিনী রমজান মাসে মুসলমানদেরকে শূকরের মাংস ও মদ্যপান করতে বাধ্য করে।
এছাড়া শায়খ ইবনুল জাওযী, তার তিন সন্তান আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, আব্দুল করীম, মুজাহিদুদ্দীন দোওয়ায়দায়ে ছগীর আয়বেক, শিহাবুদ্দীন সুলায়মান শাহ, ছাদরুদ্দীন আলী বিন নাইয়ার সহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অসংখ্য আলেম-ওলামা, হাফেযে কুরআন, বক্তা ও ইমামদের হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জামালুদ্দীন সুলায়মান বিন রতলায়ন বলেন, খলীফার সাথে যে ১৭ জন লোককে হালাকুর দরবারে উপস্থিত করা হয় তাদের মধ্যে আমার পিতাও ছিলেন। অন্যান্য সকলকে হত্যা করে। অন্যরা নিজেদের বাড়ি ফিরে এসে দেখল জনশূন্য বিরানভূমি। আমি আমার সঙ্গীহীন পিতার নিকট এসে দেখলাম, তিনি তার বন্ধুদের মধ্যে পড়ে আছেন। তাদের কেউ আমাকে চিনতে পারল না। তারা আমাকে বলল, আপনি কাকে চান? আমি বললাম, ফখরুদ্দীন বিন রতলায়নকে চাই। আমি তাকে চিনে ফেলেছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তার থেকে কি চাও? আমি বললাম, আমি তার সন্তান। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমার নিকট তখন কিছু খাদ্য ছিল তা তাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলাম। [সূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
ইবনে কাসীর লিখেছেন,
“একজন লোক খলীফার প্রাসাদে প্রবেশ করে আববাসের বংশধরগণকে আহবান করে সমবেত করল। অতঃপর তাদের সকলকে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে ছাগলের মত যবেহ করে হত্যা করল।” [আল বিদায়া ওয়ান নিয়ায়া, ১৩/২০৩]
মাসের পর মাস মসজিদসমূহ বন্ধ থাকে। জুম‘আ ও জামা‘আতে ছালাত আদায় বন্ধ হয়ে যায়। মোঙ্গল বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এখানেই সমাপ্ত হয়নি। ছয় শতাব্দী ধরে বাগদাদের গ্রন্থাগারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অমূল্য ভান্ডার সঞ্চিত হয়েছিল নিষ্ঠুর তাতাররা এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্তই দজলার পানিতে নিক্ষেপ তা নিঃশেষ করে দেয়। ইবনু কাসীর (রহঃ) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন, অদৃষ্টে যা ঘটার ছিল যখন তা ঘটে শেষ হ’ল তখন ইসলাম জগতের কেন্দ্র বাগদাদ নগরী পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। খুব অল্প লোকই সেখানে দেখা যেত। পথে ঘাটে লাশগুলো টিলার মতো পড়েছিল। বৃষ্টির কারণে লাশগুলো পঁচে আকাশ-বাতাশ দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছিল। বায়ু দূষিত হয়ে লাশের দুর্গন্ধ সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বায়ু দূষণের ফলে অসংখ্য প্রাণী মারা যায়। লোকদের মধ্যে প্লেগ ও মহামারীর মতো বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ে। [আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩; ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১ ইবনুল কূত্বী, আল-হাওয়াদিছুল জামে‘আতু ফী আ‘য়ানিল মিয়াতিস সাবে‘আ, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৩১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৫২।]
মোঙ্গল বাহিনীর এই ধ্বংসযজ্ঞ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর যখন বাগদাদ নগরীতে নিরাপত্তার ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন আত্মরক্ষার জন্য যারা বাঙ্কার, নির্জনভূমি ও কবরের ভিতর যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা এক এক করে বের হয়ে আসে। দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকার কারণে লোকদের পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়েছিল। যখন তাদেরকে কবর থেকে বের করা হ’ল তখন তারা একে অপরকে চিনতে অস্বীকার করে। এক পর্যায়ে তারা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। বাবা তার ছেলেকে এবং ভাই তার ভাইকে চিনতে পারছিল না। ভয়াবহ বিপদে ভীতবিহবল হয়ে পড়ে। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর, ১৩/২০৩]
ইসলামের ইতিহাসে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে বাগদাদ ধ্বংসের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। সেই ভয়ংকর ধ্বংসলীলা মুসলিম রাজ্যসমূহ এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র দুনিয়ার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তিনদিন ধরে শহরের পথে পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং টাইগ্রিস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদূনের মতে, তাতারদের আক্রমণের ফলে এক লক্ষ ষাট হাজার মুসলমান মৃত্যুবরণ করে। মতান্তরে দু’লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে এক লক্ষ ষাট হাজার মুসলমান মৃত্যুবরণ করে। কারো মতে আশি হাজার বা এক লক্ষ আশি হাজার মুসলিমকে নির্মমভাবে খুন করে হিংস্র তাতারবাহিনী।
হালাকু খানের এই আক্রমণের ফলে বাগদাদ নগরী মোঙ্গলদের অধিকারভুক্ত হয় এবং মুসলিম বিশ্ব তিন বছরের জন্য খলীফা শূন্য হয়ে পড়ে। বাগদাদ পতনের ফলে আব্বাসীয় খেলাফতের অর্থাৎ আব্বাসীয় শাসনের অবসান ঘটে। অবসান ঘটে ইসলামী খেলাফতের, এতদিন ধরে এই আব্বাসীয় খেলাফতের আশ্রয়ে ইসলামী বিশ্ব পরিচালিত হয়ে আসছিল। [শাযারাতুয যাহাব ৭/৪৭০; তারীখুল ইসলাম ৪/১৫৩।]
বাগদাদ আক্রমণের ফলে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাসাদ ও মসজিদ, মাদরাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অসংখ্য বই-পুস্তক বিনষ্ট হয় এবং বহু প্রখ্যাত পন্ডিত ও বৈজ্ঞানিক নিহত হন। এভাবে মুসলিম বিশ্বের স্বপ্নরাজ্য বাগদাদে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির যে দীপশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল তা মুহূর্তে নির্বাপিত হয়। তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির শীর্ষ কেন্দ্র বাগদাদ ধ্বংসের ফলে শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, বরং সারাবিশ্বের অগ্রগতিও ব্যাহত হয়েছিল।
মোঙ্গলদের ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস
মোঙ্গলরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিনাশসাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। অপরদিকে এই মোঙ্গলরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন তাদের ইসলামের সেবা ও ইসলাম প্রচার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তারা ইসলাম প্রচারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজিডি হল চেঙ্গীস খানের এক নাতি হালাকু খানের দ্বারা মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ও রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস করার পূর্বেই চেঙ্গীস খানের আরেক নাতি বারাকাত খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর ঈমানী তেজ এমনই ছিল যে তিনি ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। হালাকু খান যখন বাগদাদ ধ্বংস করেন এবং মুসলিম খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুসলিম বিশ্বকে খলিফা শূন্য করে দেন তখন বারাকাত খান এসব ঘটনা শুনে তিনি হালাকু খানকে চরমভাবে তিরষ্কার করেন এবং মুসলমানদের নির্মম পরিণতির প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হন। ফলে তাতাররা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বারাকাত খানকে কেন্দ্র করে তাতারদের দুটি বাহিনীর মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শুধু বারাকাত খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা নয় মুসলমানদের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া হিংস্র হালাকু খানের পুত্রও অলৌকিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে তাতারদের নেতাদের মধ্যে পাইকারী হারে ও ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেলে মোঙ্গলদের সাধারণ জনতা ও সৈন্যদের মধ্যেও কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামে দীক্ষিত হয়।
ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন, ইসলামের খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ও ওসমান বিন আফফান (রাঃ)-এর শাসনকালে বিশেষ করে হজরত ওসমান (রাঃ) সর্বপ্রথম ৩০/৩১ হিজরী সনে ইসলাম প্রচারের জন্য চীনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রতিনিধি দল চিনের তৎকালীন শাসক তানেগ পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ দেন। পরবর্তী কালে ৯৪ হিজরী সনে মুসলিম সেনাপতি কুতায়বা ইবনু মুসলিম যখন তৎকালীন চীনের রাজধানী কাশগর জয় করেন তারপর থেকে এশিয়ায় ইসলাম প্রচার হ’তে থাকে। [মুহাম্মাদ ফাৎহুল্লাহ যিয়াদী, যাহিরাত ইনতিশারিল ইসলাম, ২২২-২২৪ পৃঃ।]
এরপরে উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুল মালেক মোঙ্গলদের নিকট ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। ইয়াকূত আল-হামাবী বলেন, ‘হিশাম বিন আব্দুল মালেক তুর্কী রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। দূত বলেন, আমি রাজার দরবারে প্রবেশ করলাম তখন তিনি হাতে বাতি নিয়েছিলেন। তিনি দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? সে বলল, আরবের বাদশাহর দূত। তিনি বললেন, আমার গোলাম? সে বলল, হ্যাঁ। আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হ’ল যেখানে প্রচুর গোশত ও অল্প রুটি ছিল। এরপর আমাকে তলব করা হ’ল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার লক্ষ্য কী? আমি বিনয় প্রদর্শন করে বললাম, আমার বাদশাহ আপনাকে উপদেশ দিতে চান। তিনি মনে করেন, আপনি ভ্রান্ত পথের উপরে রয়েছেন। তিনি চান যেন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কি? তখন আমি ইসলামের শর্তসমূহ, ফরযিয়াত, হালাল-হারাম সকল বিষয় তুলে ধরলাম। অতঃপর এ অবস্থায় কয়েকদিন অতিবাহিত হ’ল। একদিন তিনি পতাকা ধারী দশজন সৈন্যের সাথে বের হ’লেন। আমাকেও সাথে নেওয়া হ’ল। অবশেষে এক টিলায় গিয়ে পৌঁছলাম। যার চার দিকে জঙ্গল ছিল। সূর্য উদিত হ’লে বাদশাহ তাদের একজনকে পতাকা উত্তোলন করে তা উদ্ভাসিত করার নির্দেশ দিলেন। পতাকা দেখে সেখানে সশস্ত্র দশ হাযার সৈন্য উপস্থিত হ’ল। এরা আবার প্রত্যেকে পতাকা উত্তোলন করে উদ্ভাসিত করল। তা দেখে এক লক্ষ সৈন্য টিলার চারপাশে সমবেত হ’ল। তখন বাদশাহ বললেন, ‘এই দূতকে বলে দাও, সে যেন তার নেতাকে বলে দেয় যে, এদের মধ্যে কোন হাজ্জাম, নাপিত এবং দর্জি নেই। এরা যখন ইসলাম গ্রহণ করবে এবং এর শর্তসমূহ জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখন তারা কোথায় রিযিক পাবে? [মু‘জামুল বুলদান ২/২৪, তথ্যসূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
ড. মুহাম্মাদ আলী আল-বার্র তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মোগল কবি আহমাদ ইউসাভীর হাতে এক লক্ষ তুর্কি জনগণ ইসলাম গ্রহণ করেন যেমন মোগলদের হাজার হাজার মানুষ তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মোগল বংশদ্ভূত এবং কাজাখস্তানের অধিবাসী। তিনি ৫৬২/১১৬৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন যা চেঙ্গীস খানের আবির্ভাবের দু’বছর পূর্বের ঘটনা। [মুহাম্মাদ আলী আল বার্র, কায়ফা আসলামা মোগল ১/৫৫]
একটি কুকুর ও ৪০ হাজার মোঙ্গল অর্থাৎ তাতারের ইসলাম গ্রহণ
তাতাররা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউবা ইসলাম ধর্মের সঠিক মর্ম উপলদ্ধি করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। হাদীসের ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, ঘটনাটি হলঃ
শায়খ জামালুদ্দীন ইবরাহীম জনসম্মুখে বলেন, আমি হালাকু খান ও তার সন্তান আবাকের অর্থমন্ত্রী সুনজাকের নিকট উপস্থিত ছিলাম। সুনজাক মোঙ্গল থেকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আমরা তখন তার তাঁবুতে উপস্থিত ছিলাম। তার কাছে একদল মোঙ্গল নেতা ও একদল খৃষ্টান ধর্মযাজকও উপস্থিত ছিল। দিনটা ঘন কুয়াশাপূর্ণ। এক অভিশপ্ত খৃষ্টান হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিয়ে কটাক্ষ করে বলল, ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিসের দাওয়াত দিতেন। তিনি তো ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে অবস্থান করতেন। তিনি তাদেরকে ধন-সম্পদ দিতেন এবং সে বিষয়ে বিরাগী করতেন। আর এভাবেই তাদেরকে নিজের দলে টেনে নিতেন’। এভাবে নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সে কটু কথা বলতে থাকে। তাঁদের সম্মুখেই একটি শিকারী কুকুর ছিল। কুকুরটিকে সোনার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছিল। এবং কুকুরটি সুনজাকের খুব বিশ্বস্থ ছিল। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে খ্রীষ্টান ব্যক্তিটির কটূক্তি ও কটাক্ষ শুনে কুকুরটি দাঁড়িয়ে গেল এবং শিকল ছিঁড়ে সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টানের উপর হামলা করে দিল। কুকুরটি খ্রীষ্ঠান লোকটিকে খামচিয়ে ক্ষতবিক্ষ করে দিল। আশেপাশের লোকজন কুকুরটিকে ধরে আবার শিকলে বেঁধে করল। তখন উপস্থিত জনতার মধ্যে কেউ কেউ বলল, এটা তোমার মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে বাজে কথা বলার ফল। খ্রীষ্টান লোকটি তাঁদের কথা অস্বীকার করে বলল, “তোমাদের ধারণা সম্পূর্ণভাবে ভুল। বরং কুকুরটি খুবই চালাক। সে আমাকে দেখে বুঝতে পেরে গেছিল যে আমি তাকে মারব। সেজন্য সে আমার উপর হামলা করে। এরপর আবার সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টান নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা শুরু করে। সেই সময় কুকুরটি আবার শিকল ছিঁড়ে সেই খ্রীষ্টান লোকটির উপর হামলা করে। শেষ পর্যন্ত কুকুরটি সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টান ব্যক্তিটির শাসনালী কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। এতে সে মারা যায়। ঘটনাটি মুখে মুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চল্লিশ হাজারর তাতার ইসলাম গ্রহণ করে। [হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, আদ-দুরারুল কামিনা ফী আ‘য়ানিল মিয়াতিছ ছামিনা ৪/১৫৩; যাহাবী, মু‘জামুশ শুয়ূখিল কাবীর ২/৫৬-৫৭; শায়খ আবু মু‘আবিয়া বায়রূতী বলেন, ঘটনাটির বর্ণনা সূত্র ছহীহ, আরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীছ ১৪৭/৩৩৫, তথ্যসূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
মুহাম্মাদ বারাকাহ খানের ইসলাম গ্রহণ
বারাকাহ খান প্রথম মোঙ্গল রাষ্ট্রপ্রধান যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। বারাকাহ খান ছিলেন চেঙ্গীস খানের পুত্র জুজীর সাতটি ছেলের মধ্যে একজন ও দুর্ধর্ষ হালাকু খানের চাচাত ভাই। বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করে বাগদাদের খলীফা মুস্তা’ছিম বিল্লাহর হাতে বায়’আত (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করেন। বারাকাহ খান সম্পর্কে ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেছেন,
وَهُوَ ابْنُ عَمِّ هُولَاكُو، وَقَدْ أَسْلَمَ بَرَكَةُ خَانَ هَذَا، وَكَانَ يُحِبُّ الْعُلَمَاءَ وَالصَّالِحِيْنَ وَمِنْ أَكْبَرِ حَسَنَاتِهِ كَسْرُهُ لِهُولَاكُوْ وَتَفْرِيْقُ جُنُودِهُ…
‘তিনি হালাকু’র চাচাত ভাই। এই বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আলেম-ওলামা ও সৎ ব্যক্তিদের পসন্দ করতেন। তার সর্বাধিক উত্তম কাজ ছিল হালাকু ও তার সৈন্যদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি ও বিভক্তি তৈরি করা। তিনি বাদশাহ যাহের বাইবার্সকে সম্মান ও তার দূতদের সমাদর করতেন। তার পরে তার পরিবারের মানকুতামুর (مَنْكُوتَمُرُ بْنُ طُغَانَ) শাসনভার গ্রহণ করেন যিনি বারাকাহ খানের পদাংক অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ’। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ১৩/২৪৯]
চেঙ্গীস খানের চার পুত্র ছিল। তাঁদের নাম যথাক্রমে জওজি খান, চুগতাই খান, ওগতাই খান (খাকান উপাধিধারী) এবং তোলাই খান। চেঙ্গীস খানের মৃত্যুর পর তার গোটা সাম্রাজ্য এ্র চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
- (১) জওজি খানের পুত্র বাতু খান পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের অধিপতি হন এবং ‘সিরাদারদা’র খান হিসেবে গণ্য হন।
- (২) চুগতাই খান মধ্য এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
- (৩) ওগতাই খান ‘খাকান’ হিসেবে পিতা চেঙ্গীস খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ তার মালিকানায় আসে। তার শাসনামল ১২২৯-১২৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ‘কিরগিজ’ নামক এক ইরানি শাসক প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন, পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
- (৪) তোলাই বা তাওয়াল্লি খান, তিনি ইরানের শাসক হন। তিনিই ছিলেন বাগদাদ নগরী ধ্বংসকারী এবং আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের মূল কাণ্ডারী কুখ্যাত হালাকু খানের পিতা। ইরানে তিনি ‘ইলখানি’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। হালাকু খানের পুত্র তাকুদার তার ভাই বারকাহ খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি ইলখানি রাষ্ট্রের প্রথম শাসক হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন।
চেঙ্গীস খানের বড় পুত্র জওজি খানের বংশে সর্বপ্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়, তার নাম বারকাহ খান অর্থাৎ চেঙ্গীস খানের জ্যেষ্ঠ পুত্রের পক্ষের প্রোপুত্র। অর্থাৎ মোগল শাসকদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।
১২৬২ সালে বারকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথমত, তার সমর্থক অনুসারীরা বিপুল সংখ্যায় পাইকারী হারে ইসলাম গ্রহণ করে। বারকাহ খান আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে আমণত্রণ করেন ইসলাম প্রচারের মিশন প্রেরণের জন্য। সুতরাং খলিফার আহ্বানে মোবাল্লেগিন, ব্যবসায়িকবৃন্দ, উলামা এবং ফকিহ (ইসমালী শাস্ত্রবিদ) গণের কয়েকটি দল ইসলামী দেশগুলো থেকে হিজরত করে কেরমে পৌঁছেন এবং সেইসব স্থানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সেই এলাকাটি ‘খাজানায়ে আলম’ অর্থাৎ বিশ্বের রত্মভান্ডার নামে বিখ্যাত।
বারকাহ খানের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এক বিচিত্রকর ঘটনা। একদিন বোখারা থেকে একটি দল বারকাহ খানের দরবারে এসে উপস্থিত হয়। দলটিতে দুইজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও যোগ্য আলেমও ছিলেন। বারকাহ খান তাদেরকে একটি নিরিবিলি স্থানে নিয়ে যান এবং একান্ত বৈঠক করেন। বারকাহ খান তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জানতে চান। তাঁরা খুব সুন্দরভাবে তাকে ইসলামের নিয়ম নীতি ও তার বাস্তবতা ও সত্যতার কথা অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা বুঝিয়ে দেন। বারকাহ খান ইসলামের কথা শুনে তাতে এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং সাথে সাথে তাঁর ছোট ভাইকেও ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন। অতঃপর বারাকাহ খানের ছোট ভাইও সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর বর্তমান রাশিয়ার সারাই ও সারাতোভ শহর দু’টি বারাকাহ খান প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সারাতোভই ছিল মোগলদের রাজধানী।
বারাকাহ খান মামলূক শাসকদের সাথে এক সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি মামলূক শাসক রুকনুদ্দীন যাহের বাইবার্সের সাথে নিয়মিত পত্র আদান-প্রদান করতেন। মামলুক শাসক বাইবার্স বারাকাহ খানকে তারই চাচাত ভাই ও ইসলামের জঘন্যতম শত্রু হালাকু খানকে হত্যা করতে উৎসাহিত করেন। তিনি বারাকার খানকে উপদেশ দিয়ে বলেন,
“ইসলাম তার শত্রুদের হত্যা করাকে আবশ্যক করে যদিও শত্রু আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্য হয়।”
বাস্তবেও বারাকাহ খান বাইবার্সকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং হালাকু খানকে হত্যার জন্য এবং ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের প্রতিশোধ নেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। সেজন্য তিনি হালাকু খানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
ইতিহাসবিদ ইবনে কাসীর বলেন,
‘বারাকাহ খান যাহেরকে সম্বোধন করে লিখলেন, قَدْ عَلِمْتَ مَحَبَّتِي للإسلام، وَعَلِمْتَ مَا فَعَلَ هُولَاكُو بِالْمُسْلِمِيْنَ، فَارْكَبْ أَنْتَ مِنْ نَاحِيَةِ حَتَّى آَتِيْهِ أَنَا مِنْ نَاحِيَةٍ حَتَّى نَصْطَلِمَهُ أَوْ نُخْرِجَهُ مِنَ الْبِلاَدِ وَأَعْطِيَكَ جَمِيعَ مَا كَانَ بِيَدِهِ مِنَ الْبِلَادِ، فَاسْتَصْوَبَ الظَّاهِرُ هَذَا الرَّأْيَ وَشَكَرَهُ وَخَلَعَ عَلَى رُسُلِهِ وَأَكْرَمَهُمْ-
অর্থাৎ ‘অবশ্যই আপনি ইসলামের প্রতি আমার ভালোবাসার বিষয়ে জানেন। এও জানেন যে, হালাকু মুসলমানদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছে। আপনি এক দিগন্ত হয়ে এগিয়ে যান, আমি আরেক দিগন্ত হয়ে এগিয়ে যাব। যাতে আমরা তার মূলোৎপাটন করতে পারি বা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারি। তার হাতে যে সকল রাজ্যের ক্ষমতা রয়েছে আমি আপনাকে সবগুলো দিয়ে দিব। যাহের এই মতে সম্মতি দিলেন এবং তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার দূতদের একান্ত নির্জনে মেহমানদারী করলেন’। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ১৩/২৪৯]
বারাকাহ খানের সাথে হালাকুর বিরোধের কারণ হিসেবে যেমন ধর্মীয় কারণ ছিল তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল। হালাকু খান এক সময় মুছেলসহ আশ-পাশের এলাকাগুলো দখল করে নেয়। তখন বারাকাহ খান হালাকুর লুণ্ঠিত সম্পদ, বন্দি ও অন্যান্য জিনিস পত্রের ভাগ চেয়ে হালাকু খানকে চিঠি লিখে পাঠান। এতে হালাকু ক্ষিপ্ত হয় যায় এবং বারাকাহ খানের বার্তাবাহক দূতকে হত্যা করে। হালাকু খানের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে বারাকাহ খান প্রচন্ডভাবে রাগান্বিত হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন এবং বারাকাহ খান ৬৬১ হিজরী সালে সুবিশাল এক মোঙ্গল বাহিনী নিয়ে হালাকুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন। এতে হালাকু খানের বাহিনীকে চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। হালাকু খানের অধিকাংশ সৈন্য মারা যায় এবং জীবিতদের মধ্যে বেশীরভাগই জলে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। হালাকু খান গতি খারাপ দেখে শেষ পর্যন্ত পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করে। এরপর বারাকাহ খান কনস্টান্টিনোপলসহ অন্যান্য রাজ্য জয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন।
হালাকু খান ৬৬৩ হিজরীতে মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাগা শহরে মৃত্যুবরণ করে। হালাকু খানকে একটি উচু টিলায় দাফন করা হয়। তার উপরে একটা গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। সেই গম্বুজকে কেন্দ্র করে হালাকু খান মারা যাবার পর তার ছেলে আবগার নেতৃত্বে মোঙ্গল সৈন্যরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রায়াস করে। বারাকাহ খান যখন তাতারীদের ঐক্যবদ্ধ হবার খবর জানতে পারেন তখন তিনি সৈন্য সামন্ত নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। হালাকুর গম্বুজ ভেঙ্গে ফেলেন এবং মোঙ্গল সৈন্যদের বিভক্ত করে দেন। এতে বাদশাহ যাহের খুশি হন। [তাতারীদের ইতিহাস, রাগেব সারজানী]
হালাকু খানের পতনের আগে থেকেই তাতারীদের মধ্যে যে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেছিল তা অব্যাহত থাকে। তাতারীদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তি কুরজুয ইসলাম গ্রহণ করেন। বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করলে তিনিও তাঁর সাথে ইসলামে দীক্ষিত হন। কুরজুযের অধিকাংশ সৈন্যরাও ইসলাম গ্রহণ করে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, কুরজুযের সকল সৈন্যই ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। তার ইসলাম গ্রহণই মিসরের সুলতান বায়বার্সের সাথে বারাকাহ খানের সুসম্পর্ক সুদৃঢ় করে। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [ড. মাহমূদ সাইয়েদ দাগীম, আত-তাতার ওয়াল মোগল, পৃঃ ১৫০-১৫৪; Paul Ratchnevsky, Thomas Nivison Haining, Genghis Khan: his life and legacy, p. 204,৩৩৮; The Cambridge history of Iran, Vol 5, By University of Cambridge, p. 204.]
হালাকু খানের পুত্র তাকুদার খানের ইসলাম গ্রহণ
মোঙ্গল ইতিহাসে সব থেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা হল ইসলামের চরম শত্রু হালাকু খানের পুত্রের তাকুদার খানের ইসলাম গ্রহণ। তাকুদার খান হালাকু খানের সপ্তম পুত্র ছিলেন। হালাকু খান যখন ইরাক, ইরান ও সিরিয়া প্রভৃতি একটার পর একটা মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস করে যাচ্ছিল সেই সময় তাকুদার খান চীনে অবস্থান করছিলেন।
হালাকু খানের স্ত্রী ছিলেন গোঁড়া খৃষ্টান সেজন্য পুত্র তাকুদার খান মায়ের আদর্শে খৃষ্টীয় আচার আচরণে বড় হয়ে উঠে। তাকুদার খান ক্ষমতায় আরোহণ করলে ৬৮০/৬৮১ হিজরী সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আহমাদ বিন হালাকু (হালাকুর পুত্র আহমাদ) নাম ধারণ করেন। তাকুদার খান ওরফে আহমাদ বিন হালাকু ইসলাম গ্রহণের পর নিজেকে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন এবং ইসলামী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন।
ইবনুল ইমাদ হাম্বলী বলেন,
وأمر ببناء المساجد والجوامع وإقامة الشّرع الشّريف على ما كان في زمن الخلفاء
অর্থাৎ ‘আর তিনি মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলে প্রতিষ্ঠিত শারঈ আইন চালু করারও নির্দেশ দেন’। [শাযারাতুয যাহাব ৭/৬৪৬]
এখানে উল্লেখ্য যে, হালাকু খানের পুত্র আহমাদ তাকুদার খান একাকী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারী বা তাতারদের তেমন কোন লোককে ইসলাম গ্রহণ করাতে সক্ষম হননি। ফলে তার নিকটতম ব্যক্তিরাই তাকে ৬৮৩ হিজরী সনে হত্যা করে। [যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫১/১৩৯-১৪০; ইবনুল ইবারী, তারীখু মুখতাছারিদ দুয়াল ১/২৮৯; তারীখুল খামীস ২/৩৮০; আবুল ফিদা, মুখতাছারু ফী আখবারিল বাশার ৪/১৬; আত-তাতার ওয়াল মুগোল, পৃঃ ১৫০-১৫৪]
মোঙ্গলদের আর এক অন্যমত প্রভাবশালী শাসক মাহমূদ কাযানও (১২৭১-১১ মে ১৩০৪) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইলাখানাতের সপ্তম শাসক। তিনি আরগুন ও কুতলুক খাতুনের সন্তান এবং চেঙ্গীস খানের বংশধর ছিলেন। ইলাখানদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। তিনি ১২৯৫/৬৯৩ হিঃ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একবছর পর ৬৯৪ হিজরী সনে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে কাসীর লিখেছেন,
‘আর এতে ক্বাযান বিন আরগূন ক্ষমতায় আসীন হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আমীর নওরোযের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। অতঃপর মোঙ্গল তাতার বা তাদের অধিকাংশ ইসলামে দীক্ষিত হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার দিন স্বর্ণ-রৌপ্য ও হিরা-যহরত লোকদের মাথার উপর ছিটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। নিজের নাম রাখেন মাহমূদ। তিনি জুম‘আ এবং খুৎবায় অংশ গ্রহণ করতেন। তিনি বহু গীর্জা ধ্বংস করেন এবং খৃষ্টানদের উপর কর আরোপ করেন। তিনি বাগদাদসহ বিভিন্ন শহরের জনগণ থেকে জবরদখলকৃত সম্পদ তাদের হাতে ফিরিয়ে দেন। তাতাররা বিভিন্ন তাসবীহ পাঠ করে এবং ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করে’। [আল-বিদায়াহ ১৩/৩৪০,৩৫১; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫২/৩৭; আল-ইবার মিন খাবরে গাবার ৩/৩৮৫; হুসাইন বিন মুহাম্মাদ, তারীখুল খামীস ২/৩৮১; ছালাহুদ্দীন, ফুয়াতুল ওয়াফিয়াত ৪/৯৭; শাওকানী, আল-বাদরুত তালে‘ ২/২।]
ক্বাযান খান খোরাসানের রায় শহরে ইসলামী শা‘বান মাসে ইসলামে দীক্ষিত হন। পরের রামজান মাস থেকেই তিনি রোজা রাখতে শুরু করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ভাল করে স্নান করে করে সাধারণ মজলিসে বসে হাসিমুখে কালেমা শাহাদত পাঠ করেন। এতে উপস্থিত আরব-অনারব ও মোঙ্গল সকলেই উচ্চকণ্ঠে সমস্বরে তাকবীর (নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর) ধ্বনি দেন। এরপর তাঁকে কুরআনের শিক্ষা দান করা হয়। তারপরেই তাতার সৈন্যরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে। কারণ তিনি খাঁটি মুসলিম ছিলেন। কুরআনের বহু অংশ, উপদেশাবলী ও যিকির-আযকার তার মুখস্থ ছিল। [যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫২/৩৮; তারীখু ইবনুল ওয়ারদী ২/২৩৩; তারীখুল খামীস ২/৩৮১]
এরপর চেঙ্গীস খানের বংশের সুলতান তুঘলক তাইমুরের ইসলাম গ্রহণ করেন। সুলতান কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং তিনি তাঁর প্রজাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করলেন। এভাবেই জুগতাঈ বিন চেঙ্গীস খানের সন্তানদের মাঝে ইসলামের আলো প্রবেশ করল। তিনি নিয়মিত নামাজ পাঠ করতেন এবং জুম‘আর নামাএ অংশগ্রহণ করতেন। তিনি বহু মাদরাসা ও মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [ড. সাইয়েদ বিন হুসাইন আল-আফানী, ছালাহুল উম্মাহ ফী উলুববীল হিম্মাহ ২/৬২; রুহ্বানুল লায়ল ১/৩৯; আবুল হাসান নাদভী, রাববানিয়াতান লা রুহবানিয়াতান ১/২৭-২৯; T. W. Arnold, Preching of Islam 1/235-236; Mirza Haider, Tarikh e Rashidi, p 14.]
সুলতান তুঘলক তাইমুর ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি শাসনকার্য চেঙ্গীস খানের বিচিত্র ধর্ম ও চেঙ্গীস খানের প্রণীত আল-ইয়াসা/ইয়াসেক সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে বিশিষ্ঠ মুসলিম ঐতিহাসিক আল্লামা সাখাভী, ইমাম শাওকানী, ইবনুল ইমাদ হাম্বলী ও ইবনু কাসীর প্রভৃতিরা তাঁর চরম সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ তাকে শিয়া বা রাফেযী বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে আবার তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটিকে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করে তাঁকে কাফের বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হল ইবনু আরব শাহ, আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ বুখারী, মুহাম্মাদ বাযাযী, হাফিযুদ্দীন প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ।
বিশিষ্ঠ ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন সুলতান তুঘলক তাইমুরের সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমি তাইমুরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পূর্বে তার নিকট ৩৫ দিন অবস্থান করেছিলাম। তিনি শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। লোকেরা তাকে জ্ঞানী বলে জানত। আহলে বায়তদের প্রতি অতি সম্মান করার কারণে আবার কেউ তাকে রাফেযী বলে তিরস্কার করত। আবার কেউ যাদুকরের অপবাদ দিত। অথচ তিনি,
وليس من ذلك كلّه في شيء، إنّما هو شديد الفطنة والذّكاء، كثير البحث واللّجاج بما يعلم وبما لا يعلم
অর্থাৎ ‘এগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। বরং তিনি খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন। বরং তিনি জানা-অজানা প্রতিটি বিষয়ে অধিক গবেষণা ও চিন্তা করতেন। [তারীখে ইবনু খালদূন ৭/৭৪১]
একদিকে মোঙ্গল বাহিনী যেমন ইসলামে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করছিল অন্য দিকে আর একদল ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু মোঙ্গল (তাতার) বাহিনীও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোতে থাকে। তাদেরকে কোনমতেই আটকানো সম্ভব হচ্ছিল না। সেইসব মোঙ্গল বাহিনী নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে ইহুদী ও খৃষ্টান শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই খ্রীষ্টান রমণীকে বিবাহ করে খ্রীষ্টানদেরকেও অবিরাম গতিতে তাদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তৎকালীন মিসরের সুলতান মুযাফফর কুতুয সেইসব দুর্ধর্ষ তাতারদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত গাযার যুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনী চুড়ান্তভাবে পরাস্ত হয় এবং তারপর তারা আইনে জালূতে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে থাকে। এইসব ইসলাম বিদ্বেষী তাতারীদের জব্দ করার জন্য এবং উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য সুলতান কুতুয সেনাপতি রুকনুদ্দীন বাইবার্সের নেতৃত্বে সুবিশাল এক বাহিনী গঠন করেন। শেষ পর্যন্ত দুর্দম গতিতে মুসলিম বাহিনী হালাকু বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।
এইভাবে ধীরে ধীরে ইসলামের শত্রু তাতারীরা ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের তাতারীরা অর্থাৎ মোঙ্গলরা ইসলামে দীক্ষিত হয়ে পুরোপুরিভাবে ইসলামের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।