• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Saturday, June 21, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

রামজন্মভূমি ও বর্তমান অযােধ্যাকাণ্ডের ইতিহাসঃ ঐতিহাসিক মূল্যায়ন

নবজাগরণ by নবজাগরণ
January 4, 2021
in রাজনীতি
2
রামজন্মভূমি ও বাবরী মসজিদ

চিত্রঃ বাবরী মসজিদ, Image Source: wikimedia

Share on FacebookShare on Twitter

লিখেছেনঃ অনিরুদ্ধ রায়

রামজন্মভূমি – বাবরি মসজিদ বিতর্ক একটি নতুন মাত্রা পায় ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ফলে ও পরবর্তীকালের মামলা, বিতর্ক ইত্যাদির ফলে। এটা একটা মােড় নেয় যখন এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের বিশেষ শাখা লক্ষ্ণৌ থেকে আদেশ দেন ২০০৩ সালের প্রথমে বাবরি মসজিদের তলায় খনন কার্য চালিয়ে দেখতে যে বিতর্কিত জমির তলায় কোনাে মন্দির আছে কিনা। এই আদেশের পিছনে একটা কারণ ছিল। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এর আগে দিল্লির তােজো-বিকাশ ইন্টারন্যাশনাল (প্রাইভেট) লিমিটেড কোম্পানিকে অনুরােধ জানিয়েছিলেন যে, ছবির সাহায্যে সমীক্ষা করে দেখবার জন্য। তারিখবিহীন একটি প্রতিবেদনে ওই কোম্পানি জানায় যে, ছবিতে কতকগুলি অসঙ্গতি ধরা পড়েছে, যার থেকে মনে হয় যে তলায় কতগুলি স্তম্ভের ভূমি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ওই প্রতিবেদনে (২৬ পৃষ্ঠা) এটাও বলা হচ্ছে যে, স্তম্ভের কথা বলা হলেও ওগুলি বড় পাথরের টুকরাে হতে পারে। (ইরফান হাবিবের লেখা, ‘হিন্দুস্থান টাইমস’, ৬ই জুলাই ২০০৩)।

এ সত্ত্বেও আদালত ৫ই মার্চ ২০০৩ সালে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ-কে আদেশ দেন খননকার্য করার জন্য। বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, এই ধরনের খননকার্যে বিভিন্ন স্তর থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি যথাযথভাবে নথিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা প্রয়ােজন যাতে বিভিন্নস্তরের তারিখ ও মানুষের সংস্কৃতির চিহ্ন সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়। এখানে বাবরি মসজিদের সুরকি পালিশ করা মেঝে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হলাে। অর্থাৎ করসেবকরা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে যা করতে পারেনি। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ, প্রত্নতত্ত্বের নিয়ম না মেনে সেই কাজ করে দিলেন। এই কাজকে আমেরিকার লব্ধ-প্রতিষ্ঠ প্রকাশনা আর্কিয়ােলজিতে (মে-জুন ২০০৩) বলা হচ্ছে ‘সঙ্কটপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব’ (Crisis Archaeology)।

অতি উৎসাহে ৫ই জুনের মধ্যে ৮২টা পরিখা খনন করা হয়। রামলালার মূর্তির ছােট একটা জায়গা ছাড়া, মসজিদ চত্বরের সব অংশই, যার মধ্যে রামচবুতরাও আছে, খুঁড়ে ফেলা হয় যার গভীরতা ছিল কয়েকমিটার পর্যন্ত। ২৪শে এপ্রিল ২০০৩ সাল পর্যন্ত খননকার্যের একটি প্রতিবেদন আদালতে পেশ করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে যে ৫২টি পরিখা (৪x৪ মিটার প্রত্যেকটি) খনন করা হয়েছে।

বােঝাই যায় যে ভারতীয় সর্বেক্ষণ সংস্থা কেবল চাইছিলেন যে মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পাথর ইটের, টুকরাে বা শিল্পকলার কোনাে নিদর্শন পেতে। যেসব কিছু পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ছিল মুসলিম উজ্জ্বল পত্র বা পশুর হাড়ের টুকরাে ইত্যাদি। সেগুলি নথিভুক্ত করা বা সংরক্ষণ করার কোনাে চেষ্টা করা হয়নি। আদালতকে এই উপেক্ষার কথা জানালে আদালত ২৬শে মার্চ আদেশ দেন যে, ওইসব নথিভুক্ত করে আলাদাভাবে রাখতে হবে। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ যে তিনটি প্রতিবেদন এ পর্যন্ত দাখিল করেছেন তার থেকে বােঝা যায় যে আদালতের ওই নির্দেশ তারা যত্নসহকারে মানছেন না। এর থেকে অনুমান করা যায় যে-সব প্রত্নসামগ্রী মন্দিরের পক্ষে অনুকূল নয়, সেগুলিকে উপেক্ষা করা হবে।

ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্থা তিনটি প্রতিবেদন পেশ করেন ২৪শে এপ্রিল, ৫ই জুন এবং ১৯শে জুন। তার মধ্যে মসজিদের প্রায় সব অংশেই খননকার্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। এগুলি থেকে কোনাে মন্দির বা কোনাে হিন্দু সৌধের সঙ্গে জড়িত কোনাে সামগ্রী পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গিয়েছে তাহলাে চুন-সুরকি, যা মুসলমান সৌধতে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। সব দেওয়ালগুলিতেই এগুলি পাওয়া গিয়েছে। বাবরি মসজিদের মেঝের নিচে যে মেঝেটি পাওয়া গিয়েছে, যার সঙ্গে খনন করা দেওয়ালের যােগ আছে, তার থেকে পুরনাে একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায় যার মধ্যে রয়েছে মিহরাজের ও তাকের কিছু অংশ। রামচবুতরার সব থেকে নীচের স্তরের ইটের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে চুন-সুরকি। হঠাৎ একটা শিলালেখ পাওয়া যায় কিন্তু এটি পরিষ্কার আধুনিক দেবনাগরীতে লেখা। অনুমান করা যেতে পারে যে এখানে সাম্প্রতিককালে রাখা হয়েছিল।

২৪শে এপ্রিলের (প্রথম) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, ‘কাঠামাের ভূমি’ পাওয়া গিয়েছে। পরের দুটি প্রতিবেদনে বলা হতে লাগলাে ‘স্তম্ভের ভূমি’। প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে এগুলি হচ্ছে চতুষ্কোণ বা গােলাকার পুরনাে পাথর যার নিচে তিন-চার স্তর ইট রয়েছে। আসলে এগুলির সঙ্গে স্তম্ভের কোনাে যোেগ নেই— এই স্তরে কোনাে স্তম্ভ বা স্তম্ভে-র কোনাে অংশ পাওয়া যায়নি। এই পাথরগুলির উপরে স্তম্ভ-র কোনাে ছাপ বা নিচু হয়ে যাওয়া অংশ নেই। এর তলায় যা পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হচ্ছে ইটের টুকরাের স্তুপ যা কোনােভাবেই কোনাে ভারী সৌধকে ধরে রাখতে পারবে না। যে সাতটি কালাে ব্যাসাল্ট পাথরের স্তম্ভ পাওয়া গিয়েছে সেগুলি বাবরি মসজিদের সঙ্গে লাগানাে ছিল। এগুলি মসজিদের সঙ্গে করসেবকরা ভেঙে ছিল। সুতরাং এই তথাকথিত ‘সৌধের ভূমি’ বা ‘স্তম্ভর ভূমি’ খুব সম্ভবত দোকান ঘরের চিহ্ন যেরকম পাথর জৌনপুর শহরের লাল দরওয়াজা মসজিদে পাওয়া গিয়েছে। আরও দেখা যায় যে, এগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে করা হয়েছিল।

খনন কার্যের দেখভাল করার জন্য সারা ভারত থেকে আদালতের অনুমােদন নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পর্যবেক্ষক হিসাবে আসেন। এঁরা ২১ মে আদালতে অভিযােগ করেন যে, মসজিদের মেঝেরতলায় পাথরের সঙ্গে ইটের টুকরােগুলি রাখা হয়েছিল মেঝেটিকে সুরক্ষা করার জন্য, সেগুলিকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ নতুন করে বিন্যাস করে ‘স্তম্ভের ভূমি’ হিসাবে দেখানাের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে পরিষ্কার যে ঐ ধরনের ‘স্তম্ভভূমি’ পুরনাে যুগের নয়। এসবের থেকে খুব পরিষ্কার যে টানা চার মাস খনন কার্য অবিশ্রান্তভাবে চালিয়ে মসজিদ চত্বরের তলায় কোনাে মন্দির বা কোনাে সৌধ ছিল না। অবশ্য এর পরও একদল লােক নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বলতে থাকবেন যে তাদের বিশ্বাস ওখানেই— ঠিক মসজিদের তলায় রাম জন্মেছিলেন। প্রত্নতত্ত্বের বিজ্ঞান যদি বলে ওখানে অর্থাৎ মসজিদ চত্বরের তলায় কোনাে হিন্দু সৌধ ছিল না, তাহলে কি ধরে নিতে হবে রাজা দশরথের পুত্র রাম খােলা মাঠে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? এই বিশ্বাস কবে থেকে কিভাবে শুরু হলাে। তার কৌতূহলােদ্দীপক ও রক্তাক্ত ইতিহাস আমরা পরবর্তী পর্যায়ে দেখবাে।

দুই

এটা বলা হচ্ছে বার বার যে বাবরি মসজিদের তলায় একটা একাদশ শতাব্দীর তিনশাে ষাটটি স্তম্ভ বিশিষ্ট মন্দির ছিল এবং ওখানেই রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাররের আদেশে ঐ মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়। আরও বলা হয় যে, হিন্দুদের এটাই বহু যুগের বিশ্বাস যে ওখানে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অযােধ্যার নাম আগে সাকেত ছিল কিনা এ বিতর্কে আমরা যাব না। ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, সরযূ নদীর ধারে অযােধ্যাই পুরনাে অযােধ্যা। কিন্তু এটা কতাে পুরনাে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন অধিকর্তা এস. আর. সিং যে-কাজ করেছিলেন তার থেকে দেখা যাচ্ছে যে দুটি জায়গা ছাড়া মণিপর্বত এবং সুগ্রীবপর্বত ছাড়া আর কোনাে জায়গাতেই খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগে থেকে বসেনি। সাম্প্রতিককালে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের অধিকর্তা বি. বি. পাল যে খনন কার্য করেছিলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর আগে অযােধ্যাতে লােকবসতি হয়নি। একটি পােড়ামাটির জৈন মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যেটা মৌর্য যুগের বলে ধরা হয় যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষ বা তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমের।

রামের ঐতিহাসিকতায় যারা বিশ্বাস করেন তারা রামের আগমনকে খ্রিস্টপূর্ব দুহাজার বলে ধরেছেন। এটা করা হয়েছে এইভাবে যে মহাভারত যুদ্ধের ৬৫ বংশ আগে রাম ও দশরথের আবির্ভাব হয়েছিল। সাধারণত এটাই ধরা হয় যে, মহাভারতের যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব নয়শত শতাব্দীতে হয়েছিল। এর ফলে রামের আবির্ভাব ও অযােধ্যার বসতির মধ্যে হাজার বছরের ফাঁক রয়ে গিয়েছে। এই অসুবিধার জন্য কেউ কেউ এই অযােধ্যাকে আফগানিস্তানের মধ্যে ফেলেছেন।

খ্রিস্টপূর্ব হাজার-আটশাে শতকের লেখা অথর্ব বেদে প্রথম অযােধ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে একে একটা ‘মনগড়া শহর’ বলে দেখানাে আছে। একে দেবতাদের শহর বলা হচ্ছে যার চারপাশে রয়েছে আলাের ছটা। খ্রিস্টপূর্ব তিনশাে শতকে লেখা একটি বৌদ্ধ-পালী গ্রন্থে (সংযুক্ত নিকায়) অযােধ্যাকে দেখানাে হচ্ছে। গঙ্গা নদীর উপর যার সঙ্গে সরযু নদীর উপরে অযােধ্যার কোনাে যােগ নেই। প্রথমদিকের পালী গ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন নদীর নাম আছে। সুতরাং সব নদীকেই সাধারণভাবে গঙ্গা বলা হচ্ছে এটা ভাববার কোনাে কারণ নেই। বাল্মীকির রামায়ণের উপর নির্ভর করে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধিকর্তা এম. সি. যােশী নির্ণয় করেছেন যে অযােধ্যা সরযূ নদী থেকে কিছু দূরে ছিল। ওই রামায়ণের উত্তরাখণ্ড ও বালখণ্ড থেকে ধরা হয়েছে যে, অযােধ্যা সরযু নদী থেকে প্রায় বারােমাইল দূরে ছিল। এতে আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে কারণ বর্তমান অযােধ্যা সরযু নদীর পাড়ে অবস্থিত।

সরযু নদী পূর্বদিকে যাবার পর বালিয়া জেলায় নাম নিয়েছিল ঘাঘরা বলে। সরণ জেলাতে গিয়ে এটি গঙ্গার সঙ্গে মিশে যায়। এরফলে অনেকে বালিয়া জেলার খয়রাদিহর সঙ্গে অযােধ্যাকে সমার্থক করেছেন। খ্রিস্টাব্দ সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর কথায় আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। উনি বলছেন যে, কানৌজ-এর পূর্ব-দক্ষিণ-পূবে প্রায় ১৯২ কি.মি. দূরে ছিল অযােধ্যা (৬০০ লি) এবং গঙ্গার দেড় কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত। এর সঙ্গে বৌদ্ধ পরম্পরার অর্থাৎ গঙ্গার উপরে বা নিকটে—সাদৃশ্য আছে। ওঁর মতে অযােধ্যার বৌদ্ধ শ্রমণের সংখ্যা তিন হাজার এবং অ-বৌদ্ধদের সংখ্যা খুবই কম। রাজধানীতে একটা বৌদ্ধ বিহার আছে বহুদিনের। অযােধ্যার দেশে একশটা বৌদ্ধ বিহার ও দশটা মন্দির আছে। এর আগে খ্রিস্টাব্দ পঞ্চম শতাব্দীতে ফা-হিয়েন বলেছিলেন যে, অযােধ্যা বৌদ্ধদের একটা তীর্থ। অযােধ্যা জৈনদেরও তীর্থক্ষেত্র কারণ মহাবীর এখানে এসেছিলেন এবং কয়েকজন তীর্থঙ্করের এখানে জন্ম হয়েছে। জৈনরা একে কোশল রাজাদের রাজধানী বলেছেন কিন্তু পরিষ্কারভাবে স্থান নির্ণয় করেননি। বর্তমানের রামের অযােধ্যার উল্লেখ গুপ্তযুগ থেকেই পাওয়া যায়। ঐ সময় থেকেই ওঁকে বিষ্ণুর অবতার বলে ধরা হতে থাকে। অযােধ্যা থেকে সীলমােহর, মুদ্রা বা শিলালেখ পাওয়া গিয়েছে তাতে গুপ্তযুগের আগে রাম-দশরথের অযােধ্যার কোনাে হদিস পাওয়া যায় না। . উত্তর ভারতে রাম মাহাত্ম বহুলভাবে প্রচারিত হয় প্রধানত তুলসীদাসের রামচরিতমানস থেকে। এটি বাল্মীকির রামায়ণের উপর নির্ভর করে লেখা। রামায়ণ মহাকাব্য কোনাে এক সময়ে লেখা হয়নি— বিভিন্ন সময়ে এটা পরিবর্ধিত করা হয়েছে। ছয় হাজার শ্লোক থেকে এটিকে চব্বিশ হাজার শ্লোকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নানান আলােচনার পর এটা ধরে নেওয়া হয় যে এটি চারটি পর্যায়ে বাড়ানাে হয়েছে এবং শেষ পর্যায়টি দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে লেখা। প্রথম পর্যায় হয়তাে চারশ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ লেখা হয়েছিল। এখানে রাজার ধর্ম হচ্ছে রাষ্ট্র, বর্ণ ও পুরুষশাসিত সমাজকে (যার মধ্যে শ্রেণী বিভাজন রয়েছে) রক্ষা করা। কিন্তু এর থেকে দশরথের অযােধ্যার স্থান নির্ণয় করা যায় না।

হিন্দুদের বিশ্বাস ধরলে অযােধ্যার তীর্থক্ষেত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে মধ্যযুগে। বিষ্ণুস্মৃতির (পরিচ্ছদ ৮৫) মধ্যে তীর্থক্ষেত্রর যে তালিকা রয়েছে তার মধ্যে অযােধ্যার কোনাে উল্লেখ নেই। এতে ৫২টি তীর্থের উল্লেখ আছে। এটি রচনা করা হয়েছিল আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে এবং তীর্থর তালিকাযুক্ত লেখার মধ্যে প্রথম ও সব থেকে পুরাতন। বলা দরকার যে, উত্তর প্রদেশে রামের কোনাে মন্দির ষষ্ঠদশ শতাব্দীর আগে পাওয়া যায় না। গড়বাল রাজার মন্ত্রী ভট্ট লক্ষ্মীধর তার বইতে (কৃত্যকল্পতরু) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তীর্থের তালিকা দিয়েছে। এটি একাদশ খ্রিস্টাব্দের রচনা। এর মধ্যে অযােধ্যার বা রামের জন্মস্থানের কোনাে উল্লেখ নেই।। হিন্দু বিশ্বাস ধরলে প্রয়াগ, বারাণসী ইত্যাদি অযােধ্যার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র ছিল। বর্তমানকালের ঠিক আগে অযােধ্যা সাতটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মধ্যে একটা বলে উল্লিখিত হতে থাকে। সুতরাং হিন্দুদের বহুপ্রাচীন কাল থেকে বিশ্বাস বলে বলা হচ্ছে সেটি ঐতিহাসিক সম্মত নয়।

তুলসীদাস তার রামচরিতমানস অযােধ্যায় লেখা শুরু করেছিলেন মঙ্গলবার ৯ই চৈত্র। ওইদিন রামের জন্মবৃত্তান্ত তীর্থযাত্রার সমান ফল পাওয়া যায় বলে বলেছেন। ওঁর লেখায় কোনাে উল্লেখ নেই এবং অযােধ্যা যে তীর্থ সেটাও বলেননি। অন্যদিকে হিন্দুদের সব থেকে বড় তীর্থ বলে অভিহিত করেছেন প্রয়াগকে।

তিন

ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হামিরপুর জেলায় রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের পােড়ামাটির মূর্তি পাওয়া যায়। কঁসি জেলার দশাবতার মন্দিরের গায়ে এদের মূর্তিও দেখা যায়। বিহারের নওদা জেলার আফসাদে সপ্তম খ্রিস্টাব্দে তৈরি মন্দিরের গায়ে এদের দেখা যায়। বক্সারে ওই সময়ের পােড়ামাটির মূর্তিও পাওয়া যায়। কেবলমাত্র রামমন্দির দ্বাদশ শতাব্দীতে তিনটি তৈরি হয়েছিল মধ্য প্রদেশে। কিন্তু ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শেষের আগে কোনাে রামমন্দির বা রাম জন্মভূমি মন্দির উত্তর প্রদেশে পাওয়া যায় না। সব থেকে পুরনাে রামমন্দির (কনকভবন বা কনকমণ্ডপ) সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি। ১৮০৪-০৫ সালে লেখা ‘শ্রীমহাজনচরিত’ বলছে যে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কনকভবন ও রত্নসিংহাসন রসিক গােষ্ঠীর তীর্থক্ষেত্র হিসাবে জমজমাট হয়েছিল। কনকভবনের এটাই সম্ভবত সব থেকে পুরানাে উল্লেখ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রামানন্দের প্রচারের পর থেকেই রামমাহাত্ম্য জনপ্রিয় হতে থাকে। ওর ভক্তদের লেখার মধ্যে রামমন্দিরের কোনাে উল্লেখ নেই। অযােধ্যার নবাবের দেওয়ানরা (হিন্দু ও মুসলমান) বহু হিন্দু মন্দিরকে টাকা দিয়েছে, কিন্তু কোথাও রামমন্দিরের উল্লেখ নেই।

মন্দিরবাদী দাবি করেছেন যে, বাবরি মসজিদে যে কালাে পাথরের স্তম্ভগুলি লাগানাে আছে, সেগুলি ওই বিষ্ণু মন্দির থেকে নেওয়া। অর্থাৎ নিচের রামমন্দির ভেঙে ঐগুলি লাগানাে হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রথমদিকে অযােধ্যায় শৈব মন্দির ও জৈন মন্দির ছিল। অযােধ্যা-মাহাত্ম, যা দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা হয়েছিল, অযােধ্যাতে শৈব ও শাক্ত মন্দিরের সংখ্যা বিষ্ণু মন্দিরের দ্বিগুণ ছিল বলে লিখছে। সুতরাং ঐ স্তম্ভগুলি শৈব বা জৈন মন্দিরেরও হতে পারে। এই ধরনের স্তম্ভ ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও লাগানাে হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় না যে মসজিদটি রামমন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে। এবং ওই স্তম্ভগুলি ঐ রামমন্দিরেই। অযােধ্যার বিভিন্ন জায়গায় ওই ধরনের স্তম্ভ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ওই স্তম্ভগুলি যে একই সময়ে তৈরি করা হয়নি সেটাও বেশ পরিষ্কার। স্তম্ভের গায়ের খােদাই থেকে বােঝা যায় যে কোন্ কোন্ স্তম্ভ নবম-দশম শতাব্দীর, আবার কোনটা একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর। মসজিদের কিছু দূরে একটি কবরখানায় এরকম কয়েকটা স্তম্ভ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। সুতরাং কোনাে একটা সৌধের স্তম্ভ এগুলি নয়। ভারতের ইতিহাসে এই ধরনের স্তম্ভ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবার কথা পাওয়া যায়। ফিরােজ শাহ তুঘলক মীরটি থেকে কিভাবে অশােক স্তম্ভ দিল্লিতে নিয়ে এসেছিলেন তার বিশদবর্ণনা আছে। তাঞ্জোরের চোল বৃহদিশবরা মন্দিরের একটা শিলালেখ থেকে জানা যায় যে এর কয়েকটি স্তম্ভ কর্ণাটকের নােলাম্বা মন্দির থেকে আনা হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পশ্চিম চালুক্যদের রাজধানী কল্যাণ থেকে দ্বারপালের মূর্তি চোলরা দোরসমুদ্রে নিয়ে এসেছিল। কয়েকটি মসজিদও ঐভাবে তৈরি করা হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পাটনার গুজরী মহল্লা মসজিদের পালদের কালাে ব্যাসাল্ট পাথরের দরজার খিলান করা হয়েছিল। ওই ধরনের পাথর পাটনার কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যায় না। সুতরাং এটা ভাবা সঙ্গত যে বাবরি মসজিদে ব্যবহৃত কালাে পাথরের স্তম্ভ বাইরে থেকে আনা হয়েছিল।

এটাও বলা হচ্ছে যে, স্তম্ভের কারুকার্যের মধ্য দিয়ে বােঝা যায় যে এগুলি বিষ্ণু মন্দিরের। কিন্তু ওইসব স্তম্ভগুলিতে বিষ্ণুর শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ইত্যাদি কিছুই নেই। আছে মালা (বর্ণমালা) যা অন্যান্য দেবদেবীর সঙ্গে যুক্ত। এই স্তম্ভগুলির উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট এবং মসজিদের দেওয়ালের খিলানযুক্ত প্রবেশ পথে লাগান। এগুলি কেবল সাজানাের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, ভারবহন করার জন্য নয়। ভারবহন করতে গেলে এগুলির উচ্চতা হওয়া উচিত ছিল অন্তত সাত ফুট এবং নিচের মূল জমির উপর দাঁড়ানাের কথা। খুব পরিষ্কার যে এগুলি তাদের নিজেদের জায়গায় নেই। এবং বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। খিলানে যে স্তম্ভগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি সব এক ধরনের নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে বি. বি. লাল ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের হয়ে যে খনন কার্য চালিয়েছিলেন ১৯৭৬-৭৭ এবং ১৯৭৯-৮০-তে। সেখানে প্রতিবেদনে বলছে যে, পরের মধ্যযুগীয় ইট-চুন-সুরকির মেঝে পাওয়া গিয়েছে যার মধ্যে কৌতূহলােদ্দীপক কিছু নেই বরঞ্চ যা পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হলাে উজ্জ্বলপাত্র যা মুসলমানরা ব্যবহার করে। এর থেকে দেখা যায় যে ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকেই মুসলমানরা অযােধ্যায় বাস করছিল।

খননকার্য থেকে বি. বি. লাল মন্দিরের অস্তিত্ব না পেয়ে জানিয়েছিলেন যে, মসজিদের তলায় মসজিদ আছে। ১৯৮৯ সালে শিলান্যাস করার জন্য মসজিদের সামনে পরিখা (৭ ফুট×৭ ফুট×৮ ফুট) খোঁড়া হয়। কিন্তু সেখান থেকেও কিছু পাওয়া যায়নি যার থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে এখানে একটা মন্দির ছিল।

১৫২৮-২৯ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকী যে মসজিদটি তৈরি করেন, তাকেই বাবরি মসজিদ বলে বলা হয়। তৈরি করার পর এতে একটি শিলালেখ লাগানাে হয় যার থেকে ওইসব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু ঐ শিলালেখতে কোথাও বলা নেই যে আগে একটি মন্দির ছিল এবং সেটি ভেঙে এই মসজিদ করা হয়েছে। মন্দির ভাঙলে মীর বাকী সেটা অতি পূণ্য কাজ মনে করে লিখে রাখতেন। কিন্তু সেরকম কোনাে ইঙ্গিতও ওই শিলালেখর মধ্যে পাওয়া যায় না।

চার

আমরা আগেই দেখেছি যে, ১৫৭৫-৭৬ সালে তুলসীদাস তার রামচরিতমানস লিখেছিলেন যার মধ্যে মন্দির ভাঙার কোনাে কথা নেই। ১৫৯৫-৯৬ সালে আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-অযােধ্যা’ যে রামের বাসস্থান ছিল বলেছেন। রামের জন্মভূমি বলেননি। উল্লেখযােগ্য যে, অযােধ্যাতে যে পরম্পরা রয়েছে দুজন ইহুদী নবীর কবর সম্পর্কে সে কথাও বলেছেন। রামের জন্মভূমিতে মসজিদ করা হয়েছে, এরকম কোনাে ইঙ্গিত এর মধ্যে নেই।

১৬০৮ থেকে ১৬১১ সালের মধ্যে উইলিয়াম ফিঞ্চ অযােধ্যাতে এসেছিলেন। উনি বলেছেন যে এখানে ওঁর দুর্গ ও বাড়ি আছে। ভারতীয়রা এঁকে দেবতার অবতার বলে বিশ্বাস করে। নদীর থেকে দু-মাইল দুরে একটা গুহা আছে, যেখানে ওঁর চিতাভস্ম রয়েছে বলে লােকে বিশ্বাস করে এবং জায়গাটা দেখার জন্য বহু লােক আসে। এখান থেকে কালাে হয়ে যাওয়া চাল নিয়ে যায় যেগুলি ওদের মতে ওই সময় থেকে ওখানে রয়েছে। উনি রামকোট (দুর্গ) ও স্বর্গদ্বারের কথা বলেছেন, কিন্তু রামের জন্মের কোনাে কথা বা মন্দিরের কথা বলেননি।

১৬৯৫-৯৬ সালে সুজন রায় ভাণ্ডারী তার বই (খুলসাৎ-ই-তত্তয়ারিখ) সমাপ্ত করেন যার মধ্যে ভারতের তীর্থক্ষেত্রগুলির ভৌগােলিক বিবরণ আছে। এর মধ্যে লঙ্কা থেকে রামের সীতা উদ্ধারের কথা রয়েছে। অযােধ্যা যে রামচন্দ্রর বাসস্থানের জন্য পূণ্যতীর্থ সে কথাও বলেছেন। ইহুদীদের কবরের কথাও বলেছেন। কিন্তু এর মধ্যে রামজন্মভূমি বা রামমন্দিরের কোনাে কথা নেই।

১৭৫০-৬০ সালে রাই চতুরম তার বই (চাজার গুলসান) শেষ করেন যার। মধ্যে ভারতের ভৌগােলিক বর্ণনা রয়েছে। যদুনাথ সরকার এর কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন। পুঁথির অন্য জায়গায় অযােধ্যার কথা রয়েছে। উনি বলেছেন যে অযােধ্যাকে রাজা দশরথের ছেলে রামচন্দ্রের জন্মস্থান বলে ধরা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বাবরি মসজিদ তৈরি হবার দু’শকুড়ি বছরের মধ্যে কোনাে ইঙ্গিত সমকালীন লেখার মধ্যে নেই যে ঠিক কোথায় রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল এবং মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়েছিল এরকম কোনাে ইঙ্গিত নেই। এ পর্যন্ত হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান— কারাে লেখাতেই এটা পাওয়া যায় না।

১৭৮৯ সালে জার্মান জেসুইট পাদ্রি জোসেফ টিফেন থালারের বই ফরাসি ভাষায় পণ্ডিত জে. বারমুলি অনুবাদ করে বার্লিন শহর থেকে প্রকাশ করেন। (Description historique et geographic de l’Inde) উনি বলেছেন যে সম্রাট আওরঙ্গজেব রামকোট (দুর্গ) ভেঙে দেন এবং ওই জায়গায় একটা তিন ছত্রীর মসজিদ বানান। অন্যরা মনে করেন যে এটা বাবর তৈরি করেছিলেন। পাদ্রি আরও বলছেন যে দুর্গের মধ্যে কালাে পাথরের চোদ্দটি স্তম্ভ (পাঁচ ফুট উচ্চতা) দেখা যায়। এর মধ্যে বারটি স্তম্ভ মসজিদের খিলানের সঙ্গে দেখা যায়। এর মধ্যে দুটি স্তম্ভ এক মুসলমানের কবরের সঙ্গে লাগানাে। এটা বলা হয় যে এই স্তম্ভগুলি বা স্তম্ভের অংশগুলি লঙ্কা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাঁদরের রাজা হনুমান এগুলি এনেছিলেন। এর বাঁদিকে একটা চুন দিয়ে ঢাকা মাটির বেদী আছে যেটি মাটি থেকে পাঁচ ইঞ্চি উপরে, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ও চার ইঞ্চি চওড়া। এটাই জন্মস্থান বলা হয়। এখানে একটা বাড়িতে রামচন্দ্র ও তার তিন ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। আওরঙ্গজেব বা অনেকের মতে বাবর, এই বাড়িটি ভেঙে দেন যাতে হিন্দুরা তাদের কুসংস্কার না করতে পারে। কিন্তু হিন্দুরা দু’জায়গাতেই তাদের কুসংস্কার চালাতে থাকে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এটাই রামচন্দ্রের জন্মস্থান। তারা এর চারপাশে তিনবার ঘুরে মাটিতে শুয়ে প্রণাম করে। দুটি জায়গাই একটা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনের একটা ছােট দরজা নিয়ে ভিতরে ঢােকা যায়।

টিফেনথালারের বর্ণনা থেকে বােঝা যায় যে তখন সবে পরম্পরা তৈরি হচ্ছে মসজিদ ও আশেপাশের এলাকাকে ঘিরে পূণ্যভূমি হিসাবে দেখার। কিন্তু সামনের মাটির ছােট বেদীকে রামজন্মস্থান বলে ধরা হচ্ছে। সমগ্র এলাকাটাই রামের দুর্গ বলে ধরা হচ্ছে এবং রামমন্দিরের কোনাে কথা নেই। মসজিদ তৈরি হবার প্রায় আড়াইশাে বছর পরেও স্থানীয় লােকের মনে বিশ্বাস ছিল না যে ওখানে একটা রামমন্দির ছিল।

এর বিশ বছর পরে এই বিশ্বাস জন্মাতে থাকে। ১৮১০ সালে ফ্রান্সিস বুখানন অযােধ্যায় এসে মন্দির ভাঙার কথা শােনেন। উনি বলেছেন যে অযােধ্যার লােকেরা ভাবছে যে বৃহদবালর মৃত্যুর পর অযােধ্যা পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা চলতে থাকে উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমের সময় অবধি যিনি পুণ্য শহর খুঁজতে এসেছিলেন। উনি রামকোট নামে একটা দুর্গ তৈরি করেন ও আশেপাশের জঙ্গল। কেটে তিনশাে যাটটা মন্দির বানান রামের অত্যাশ্চর্য কাজের জন্য। হিন্দুরা এই মন্দিরগুলি ভাঙার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতাকে দায়ী করে। বারাণসী ও মথুরার ভাঙার জন্যও আওরঙ্গজেবকে দায়ী করা হয়। আযােধ্যার মন্দির ভাঙার যে পরম্পরা রয়েছে তার ভিত্তি খুব কম। যে মসজিদটা পুরােটা দাঁড়িয়ে আছে এবং খুব আধুনিক বলে বােধ হয়, তার দেওয়ালের শিলালেখ থেকে দেখা যায় যে এটা বাবর তৈরি করিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব আসার পাঁচ বংশ আগে। ফলে বিক্রমের মন্দির তৈরি করার পরম্পরাতে সন্দেহ এসে যায়। স্তম্ভগুলি সম্বন্ধে বুকানন বলছেন যে, এগুলি ছয় ফিট উঁচু এবং সম্ভবত হিন্দু সৌধ থেকে নেওয়া হয়েছে। খুব সম্ভবত প্রাসাদ থেকে, মন্দির থেকে নয়। একদিকে যেমন হিন্দুদের বিশ্বাস সঙঘটিত হচ্ছে মন্দিরভাঙা নিয়ে, মুসলমানদের একটা অংশ বলতে থাকে যে মন্দির ভেঙেই মসজিদ করা হয়েছিল। অবশ্য বুকাননের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার নয় যে তিনি মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ করা হয়েছিল এটা বলছেন।

১৮৫০ সাল নাগাদ এই বিশ্বাস যে মসজিদ তৈরি করা হয়েছে রামমন্দির ভেঙে জোরালাে হয়ে ওঠে ও ক্রমশ আগ্রাসী চেহারা নেয়, যা আমরা পরে দেখব। এরই পরিপেক্ষিতে ১৮৫৫-৫৬ সালে (১২৭২ আল-হিজরী) মীর্জা জান তার বইতে সম্রাট বাহাদুর শাহের এক কন্যা বলে কথিত এক মহিলার লেখা তুলে ধরেন। মীর্জা জান দাবি করছেন যে, তিনি ১১ই জুলাই ১৮১৬ সালে সুলেমান সকোর ছেলে মীর্জা হাসান সুকোর মহাফেজখানায় এই বইটি পড়েছিলেন। এই বইতে বলা হচ্ছে যে, হিন্দুরা মথুরা, বারাণসী ও অযােধ্যাতে মন্দির তৈরি করেছে। এরা বিশ্বাস করে যে কৃষ্ণ এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বা এটা সীতার রসুই বা হনুমানের বাসস্থান। এখান থেকেই রাম লঙ্কা জয় করেছিলেন। এইসব জায়গায় মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়েছে।

মুসলমান সম্রাটের মেয়ের লেখা থেকে এটা পাবার পর মন্দিরবাসীরা এটাই উদ্ধৃত করতে থাকে। উল্লেখযােগ্য যে মীর্জা জান নিজেই বলছেন যে চল্লিশ বছর আগে তিনি এটা পড়েছিলেন এবং অংশটি নকল করেছিলেন। উল্লেখযােগ্য যে সম্রাটের মেয়ের কোনাে নাম দেওয়া হয়নি এবং সম্রাট বাহাদুর আলমগীর উপাধি দেওয়া হয়েছে। এই উপাধি আসলে ওঁকে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছিল আওরঙ্গজেবকে যিনি ১৭০৭ সালে মারা যান। এ পর্যন্ত কোনাে মহাফেজখানা বা কোথাও বাহাদুর শাহর মেয়ের লেখা এই বই পাওয়া যায়নি। পণ্ডিত ডি, এন, মার্শাল তার মূল বই-এর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার মধ্যেও এটা নেই।

এর থেকে বােঝা যায় এই অংশটি মীর্জা জানের কল্পনাপ্রসূত এবং বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জন করার জন্য তিনি এটা লিখেছিলেন। এছাড়াও বলা যায় যে, মীর্জা জান শুধু বলছে যে, ‘সীতা-কা-রসুই’র মন্দির (অযােধ্যা) ভাঙা হয়েছিল। উনি আরও বলছেন রামের জন্মস্থানের রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ করা হয়েছিল এবং এটা ‘সীতা-কা-রসুই’-এর কাছে বলে একে বলা হয়েছিল সীতাকা-রসুই। দেখা যাচ্ছে যে এই বিশ্বাস এতােই বেড়েছে যে রামজন্মস্থানের সঙ্গে সীতা-কা-রসুই যােগ করা হয়েছে। কয়েক বংশ আগে যে মন্দিরের কথা হিন্দু বা মুসলমানরা কেউই জানতাে না সেটা ভেঙে মীর্জা জান আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন।

মীর্জা জানের এই লেখার পর কয়েকটি উর্দু পত্রিকায় মন্দির ভেঙে মসজিদ করার কাহিনী বের হতে থাকে। ততদিনে অযােধ্যায় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ হয়ে গিয়েছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য চলতে থাকে।

পাঁচ

ষষ্ঠদশ শতাব্দীর পর উত্তর ভারতে কতকগুলি বই লেখা হয় তীর্থ মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্য। এর মধ্যে অযােধ্যা মাহাত্ম্য ছিল। বর্তমানে এই ধরনের বহু মাহাত্ম্য অযােধ্যায় বিক্রি হয় যার প্রায় সবগুলিই হিন্দিতে লেখা। এ পর্যন্ত এই ধরনের ছত্রিশটা পুঁথি পাওয়া যায়, যার প্রায় সবগুলিই ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা। সবগুলি মাহাত্ম্যই দাবি করে যে, সেগুলি স্কন্দপুরাণ, ব্রহ্মানদপুরাণ, পদ্মপুরাণ ও রামায়ণের উপর নির্ভর করে লেখা। এর মধ্যে সব থেকে প্রাচীন মাহাত্ম পুঁথি ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন রামনারায়ণ। এছাড়া স্কন্দপুরাণ, যার উপর মন্দিরবাদীরা প্রধানত নির্ভর করেছেন, বােম্বাই থেকে ১৯১০ সালে ছাপা হয়। এছাড়া এর অন্য দুটি পুঁথিও পাওয়া যায়। ওই মাহাত্ম্যটি প্রধানত স্কন্দপুরাণ থেকে নেওয়া।

১৯০২ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস ফৈজাবাদে আসবেন খবর পেয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় অযােধ্যার স্থানীয় লােকজনদের নিয়ে। ওঁর আসাটা বাতিল হয়ে গেলে কমিটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরােধ করে যে ওই উপলক্ষে সংগৃহীত টাকা অযােধ্যার বিভিন্ন জায়গায় পুণ্য জায়গাগুলিকে পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা হােক। এই প্রস্তাব মেনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরা আস্তানার মহান্ত রামমনােহর পর্ষদকে কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেন। কমিটি বাবরি মসজিদের পূর্ব দরজার সামনের জায়গাটা এক নম্বর রামজন্মভূমি বলে চিহ্নিত করে। কমিটি বলে যে তারা ওই অযােধ্যা মাহাত্ম্যর উপর নির্ভর করে ওই জায়গাটা চিহ্নিত করেছে রামের জন্মভূমি বলে। এইবার ঐ কমিটি আর একটা জায়গাকে পাঠ নম্বর চিহ্ন দিয়ে রামজন্মস্থান বলে বসে। রামজন্মভূমি ও রামজন্মস্থানের মধ্যে কি করে তফাত করা সেটা তারা পরিষ্কার করেনি। উল্লেখযােগ্য যে অযােধ্যা মাহাত্ম্য এই দুটির মধ্যে তফাত করেনি। এতে বলা হচ্ছে যে, জন্মভূমি হচ্ছে বিশ্বেশ্বর-এর পূর্বে বা বশিষ্ঠর বাড়ির উত্তরে বা বােমাসা ঋষির বাসস্থানের পশ্চিমে। সুতরাং বাবরি মসজিদের পূর্ব দরজার সামনে কমিটি জন্মভূমি বলে যে চিহ্ন দিয়েছেন অযােধ্যা মাহাত্ম্যে সেটি নেই। অযােধ্যা মাহাত্ম থেকে পরিষ্কার যে রামচন্দ্রের জন্মস্থান হচ্ছে কানাইয়া ভবন। আসলে অযােধ্যা মাহাত্ম্য থেকে অন্য জায়গাগুলি সনাক্ত করলেই রামজন্মভূমির স্থান নির্ণয় করা সহজ। কমিটি অযােধ্যা মাহাত্ম্যর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য কানাইয়া ভবনের সামনে পাঁচ নম্বর জন্মস্থান বলে চিহ্নিত করেছিলেন। দু’জায়গাকে এইভাবে চিহ্নিত করা থেকে বােঝা যায় যে অযােধ্যাতে তখন এই নিয়ে কি ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। কিছু লােকের চাপে তারা বাবরি মসজিদের সামনে জন্মভূমি করেছেন। আবার অযােধ্যা মাহাত্ম্য অনুযায়ী তারা কানাইয়া ভবনের সামনে জন্মস্থান বলে ধরেছেন।

অযােধ্যা মাহাত্মে বলা হচ্ছে যে, দশরথের ছেলেরা তাদের মায়েদের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে এবং ওই বাড়িগুলির নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছে। এর দশম খণ্ডে বলা হচ্ছে যে, সীতা-কা-রসুই জন্মভূমির উত্তর-পশ্চিমে। এর চল্লিশ গজ উত্তরে কৈকেয়ীর বাড়ি যেখানে ভরতের জন্ম হয়। এর ষাট গজ দক্ষিণে সুমিত্রার থেকে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নর জন্ম হয়। জন্মভূমির দক্ষিণ-পূর্বে সীতা কূপ যাকে জ্ঞান কুপ বলা। হয়। নির্দেশিকা থেকে খুব পরিষ্কার যে কৌশল্যাভবনে রামের জন্ম হয়। সীতা-কারসুই বাবরি মসজিদের উত্তরে। ‘সীতা-কা-রসুই’র স্থান কৌশল্যা ভবনের উত্তরপশ্চিমে। সুতরাং বাবরি মসজিদ-এর জায়গা এসব থেকে আলাদা এবং সম্পূর্ণ অন্য দিকে।

বর্তমানে অযােধ্যায় ওইসব বাড়িগুলি যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সঙ্গে অযােধ্যা মহাত্মের নির্দেশিকার কিছু তফাত আছে। বর্তমানে বিঘ্নেশ্বরের সঙ্গে কৌশল্যাভবন বা বাবরি মসজিদের দিক অযােধ্যা মাহাত্ম্যের দিকের সঙ্গে একেবারে মিলে যাবে না। বিঘ্নেশ্বরের বাসস্থান কৌশল্যা ভবনের উত্তর-পূর্বে এবং বাবরি মসজিদের থেকে আরও উত্তর-পূর্বে। কিন্তু অন্যান্য জায়গা থেকে অযােধ্যা। মাহাত্মতে রামজন্মভূমির যে দিক নির্ণয় করা আছে, তার সঙ্গে কৌশল্যাভবন মিলে যায়। বর্তমানে বােমাস ঋষির আশ্রমকে খােমাস আশ্রম বলে ধরা হয়। বােমাস ঋষির আশ্রম থেকে কৌশল্যাভবন ২০০ থেকে ২৫০ গজ পশ্চিমে। ওই আশ্রম থেকে বাবরি মসজিদ পশ্চিম-দক্ষিণে এবং ২৫০ থেকে ৩০০ গজ দুরে। অযােধ্যা মাহাত্ম্যর সঙ্গে বর্তমান কালের চিহ্নিত বাড়িগুলির সম্পর্ক বিশদ আলােচনা এই স্বল্প পরিসরে করার সুযােগ নেই। কিন্তু বিভিন্ন বাড়িগুলির সঙ্গে মাহাত্ম্য অনুযায়ী বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, কৌশল্যাভবনই জন্মস্থান বলে মাহাত্ম্যর দিকনির্দেশিকার কাছাকাছি আসে বাবরি মসজিদের থেকে। এটাও ভাবা দরকার যে দশরথের অন্যান্য ছেলেরা যখন তাদের মায়েদের বাড়িতে জন্ম নিয়েছিল, তখন সব থেকে বড় ছেলে রাম তার নিজের মায়ের বাড়ি কৌশল্যাভবনে জন্মগ্রহণ করবেন না কেন।

বলা হয়েছে যে, বিক্রমজিৎ অযােধ্যাতে ৩৩০টি মন্দির তৈরি করেছিলেন। মন্দিরবাদীরা বলছেন যে, বিক্রমজিৎ ৮৪ স্তম্ভের এক মন্দির তৈরি করেছিলেন, যদিও এটা পরিষ্কারভাবে বােঝানাে হয়নি। কিন্তু অযােধ্যা মাহাত্মতে মাত্র ১৩১টা মন্দিরের কথা বলা হয়েছে। দু-একটি ছাড়া এর সবগুলিই অযােধ্যার পুরনাে শহরের মধ্যে এবং মন্দিরগুলি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা অর্থাৎ দুর্গের পাঁচিলের মধ্যে। অযােধ্যার রাজার দুর্গ শহরের বাইরে। এই পাঁচিল ঘেরা পুরনাে শহরের সব জমিই সরকারি জমি (নজুল)। সুতরাং পুরনাে দুর্গের মধ্যেকারও সব মন্দির ও আশ্রমগুলি সরকারের অনুমতি নিয়ে করা হয়েছিল। ফৈজাবাদ জেলা গেজেটিয়ারে (বিংশ শতাব্দীর প্রথমে ছাপা) নেভিল লিখছেন যে সরকার এইসব জমি ধর্মীয় সংস্থা ও অন্যান্য লােকেদের লিজ দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৬২-৬৩ সালে লিখেছেন যে, বাবরি মসজিদ ও দুর্গের পাঁচিল ছাড়া মন্দির সমেত সব সৌধই আওরঙ্গজেবের সময়ে বা তার পরে তৈরি করা হয়েছিল।

কানিংহাম কোনাে মন্দিরকেই পুরনাে যুগের বলে স্বীকার করেননি। উনি দেখেছিলেন রামকোট-এর দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে অযােধ্যার পুরনাে শহরকে ঘিরে একটা উঁচু পাঁচিল রয়েছে। পূর্বদিকের পাঁচিলে কয়েকটা দরজা আছে। যেখানে অযােধ্যার নবাবদের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে, পূর্বদিকের দেওয়াল অতীতে কয়েকবার সরিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। কিন্তু নদীর ধারে বাঁধের মতাে পাচিলটাই কৌতুহলােদ্দীপক। এর কিছুটা অংশ শহরের উত্তরে ও পশ্চিমে দেখা যায়। এই পাঁচিলের অংশবিশেষ ভেঙে পড়ায় পাঁচিলের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের গাঁথনি দেখা যায়। কয়েকটি ভাঙা জায়গায় ইটের পাঁচিলের মধ্যে পােড়ামাটি লাগানাে হয়েছে, দেখা যায়। এই পােড়ামাটি গভীর কুয়াের মতাে করে। লাগানাে। এর ফলে এই অংশটির তারিখ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যে ফেলা যেতে পারে। এই পােড়ামাটির অংশের উপরে বিভিন্ন ধরনের পাথর ও ইট দিয়ে শক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে সুরকি রয়েছে। সুতরাং কয়েকটা জায়গায় এর সঙ্গে ত্রয়ােদশ খ্রিস্টাব্দের পরের তৈরি দুর্গের সঙ্গে মিলে যায়। কয়েকটা জায়গায় দেখা যায় যে, বাবরি মসজিদে যে ধরনের পাথর (১৩ ফুট x ১৯ ফুট) ও সুরকি লাগানাে হয়েছিল, সেই ধরনের পাথর ও সুরকি লাগানাে হয়েছে। এর থেকে মনে করা অসঙ্গত নয় যে বাবরি মসজিদ এই পাঁচিলের অংশের সমসাময়িক।

সুলতানী যুগের ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, অযােধ্যা সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। ওই সময়ে সৈন্যদের সঙ্গে মুসলমান আমলারাও এসেছিলেন যারা স্বাভাবতই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত হিন্দুদের বিশ্বাসে আঘাত না করার জন্যই হিন্দুদের শূন্য জায়গাগুলি থেকে কিছুটা দূরে একটা উঁচু জায়গার উপর মসজিদ করেন। তখন একেই জামী মসজিদ বলা হতাে যার অংশ বিশেষ বর্তমানের খনন কার্যে পাওয়া যাচ্ছে।

এসব থেকে খুব পরিষ্কার যে বাবরি মসজিদের তলায় কোনাে হিন্দু মন্দির ছিল না। প্রশ্ন হলাে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাহলে এই বিশ্বাস হিন্দুদের মনে জন্মালাে কেন ?

ছয়

অযােধ্যার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে এখানে বলার অবসর নেই ১৪২০ সালে বৃহস্পতি মিশ্র যে তীর্থের তালিকা দিয়েছে তার মধ্যে অযােধ্যা নেই। সম্ভবত ১৫৮৫ সালে আকবরের সেনাপতি টোডরমল কাশীর পণ্ডিতদের নিয়ে যে তীর্থ পরিক্রমা দেখান, তার মধ্যেও অযােধ্যার উল্লেখ নেই, যদিও বলা হয় যে টোডরমল কাশীতে তুলসীদাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অযােধ্যা তীর্থ হিসাবে প্রথম পাওয়া বীরমিত্রদয়ের দশম খণ্ডে তীর্থপরিক্রমায়। ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকেই অবশ্য রাম অবতার হিসাবে এসে গিয়েছিলেন। রামানুজের পরে রামানন্দ গােষ্ঠীর প্রচারের ফলে ও উত্তর ভারতে শৈবদের অবক্ষয়ের পরে রামভক্তি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে অযােধ্যা তীর্থ হিসাবে গুরুত্ব পেতে থাকে। অযােধ্যাতে শৈবদের সরিয়ে রামভক্তি শুরু হয়ে যায় যার পিছনে অযােধ্যার নবাবদের একটা উৎসাহ ছিল।

১৭৫০ সালে নবাব সফদারজং রাজধানী অযােধ্যা থেকে সরিয়ে ফৈজাবাদে নিয়ে আসেন। নভল রাই অযোধ্যা শাসন করতে থাকেন এবং রামানন্দ গােষ্ঠীকে মদত দেন। স্বর্গদ্বার ঘাটে উনি কয়েকটা সৌধ করে দেন যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ‘নগেস্কর’র মন্দির। সমকালীন ইংরেজরা মনে করেছিল যে, নভল রাই-এর অধীনে অযােধ্যা মুসলমান শহর থেকে হিন্দু শহরে পরিণত হচ্ছে। ১৭৫০ সালের পর অযােধ্যাতে অনেকগুলি হিন্দু আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৭৬৫ সালের পর ইংরাজরা চাইছিল আউধকে তাদের প্রেসিডেন্সি রক্ষাকবজ হিসাবে অগ্রগামী সুরক্ষা হিসাবে ব্যবহার করতে। এই উদ্দেশে তারা নবাবকে মুঘলদের পক্ষপুট থেকে নিজেদের আওতায় আনার চেষ্টা শুরু করে দেয়। সিয়া নবাবরাও সুন্নি মুঘলদের হাত থেকে বেরােনাের জন্য ওই হিন্দু জাগরণকে সমর্থন করতে থাকেন। নবাব আসফদুল্লা অযােধ্যার বহু আখড়াকে নানারকম দান করেছিলেন। একসময়ে তিনি রাজা টিকত রাইকে প্রধানমন্ত্রী (উজীর) করেন যিনি হনুমানগড়কে সাহায্য দিয়ে কেল্লার মতাে গড়ে তােলেন। কিন্তু নবাব আসফদুল্লার সঙ্গে তার মায়ের (বহু বেগম) জায়গীর নিয়ে গােলমাল হয় ও নবাব রাজধানী লক্ষ্ণৌতে সরিয়ে আনেন। বেগম ফৌজাবাদে তার বিশাল ধনরত্ন ও জমিজমা নিয়ে। থাকেন। নবাব আসফদুল্লার মৃত্যুর পরে ইংরেজরা ভিজির আলিকে নবাব করে। কিছুদিন বাদে তাকে সরিয়ে দিয়ে আসফদুল্লার ভাই সাদাত খানকে সিংহাসনে বসায়। ওর সঙ্গে ১৮০১ সালের চুক্তির পরে কার্যত নবাবের সৈন্যদল ইংরাজদের হাতে চলে যায়। ১৮১৬ সালে বহু বেগম ইংরাজদের সঙ্গে চুক্তি করেন যার ফলে অযােধ্যা হাভেলির মহলগুলি ইংরাজদের অধীনে চলে যাবে। তারা অযােধ্যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা রাখবে ও খাজনা আদায় করবে। এই সময়েই রামানন্দ গােষ্ঠী শৈবদের হঠিয়ে দিয়ে নতুন কয়েকটা আখড়া প্রতিষ্ঠিত করে। এই ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়াতেই লেইডেন বাবরের আত্মজীবনীর অনুবাদ করে বাবরি মসজিদ যে বাবরের তৈরি সেটি জনপ্রিয় করে দেন। এই সময়ে রামঘাটের ও গুপ্তারঘাটের নিরমমাজীর প্রচার করতে থাকে বাবরি মসজিদের উপর তাদের দাবি। এরাই বলতে থাকে যে বাবর রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ করেছে।

এই দাবির পিছনে ইংরাজদের একটা অভিসন্ধি খুঁজে পাওয়া শক্ত নয়। ১৮০১ সলের চুক্তির পর ১৮১৬ সালে ইংরাজরা নবাব রফৎ উদদ্দৌলাকে অযােধ্যার স্বাধীন রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। অর্থাৎ তিনি আর মুঘল সাম্রাজ্যের উজীর নন এবং আউধও মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। ১৮৪৮ সালে লক্ষৌয়ে ইংরাজ রেসিডেন্ট কর্নেল সীম্যানকে পাঠনাে হয় অযােধ্যার শান্তি-শৃঙ্খলা দেখার জন্য। এই প্রথম এক স্বাধীন রাজার দেশের অভ্যন্তরে একজনকে সরেজমিনে তদন্ত করার। জন্য পাঠানাে হলাে। তার প্রতিবেদনে তিনি জানালেন, যে আউধ-এর শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তার কয়েকটা দৃষ্টান্তও তিনি দিয়েছেন। কিন্তু বড় ধরনের সংঘর্ষ না হওয়ায় গভর্নর জেনারেল ডালহৌসি সরাসরি আউধকে নিতে পারছিলেন না। ১৮৩৭ সালের নবাবের স্বাধীন রাজা হওয়ার চুক্তি লঙঘন অনুমােদন করেনি। সুতরাং ডালহৌসি ১৮০১ সালের চুক্তিকে কাজে লাগানাের চেষ্টা করলেন। তার মধ্যে একটা শর্ত ছিল যে শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে ইংরেজরা ব্যবস্থা নেবে নবাবের ইচ্ছা অনুযায়ী। ১৮৫৫ সালের ঘটনা ইংরাজরা কাজে লাগালাে।

বাবরি মসজিদের উপর হিন্দুদের বিশেষ একটা গােষ্ঠীর দাবি উঠলে অযােধ্যার সুন্নি মুসলমানরা দাবি করতে থাকে যে হনুমানগড়ে আগে এটা মসজিদ ছিল যেটা ভেঙে মন্দির করা হয়েছে। এরপর উত্তেজিত মুসলমানদের একটা অংশ হনুমানগড় আক্রমণ করলে মেহদুর জমিদারির রাজা মানসিংহর সৈন্যরা বৈরাগীদের সঙ্গে মিলে আক্রমণ প্রতিহত করে। বহু হিন্দু-মুসলমান মারা যায়। এখবর লক্ষ্ণৌতে পৌঁছালে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ একজন হিন্দু, একজন মুসলমান ও একজন ইংরাজকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেন সত্য নির্ধারণের জন্য। কমিটি প্রতিবেদনে বলে যে, হনুমানগড়ে আগে কোনাে মসজিদ ছিল না এবং নবাব সেটি মেনে নেন।

কিন্তু এর আগের একটা ইতিহাস আছে। ১৮৫৩ সালে হনুমানগড়ের বৈরাগীরা বাবরি মসজিদ জোর করে দখল করে, যদিও তারা মসজিদের কোনাে ক্ষতি করেনি। এরপর ওরা ওদের এক মহান্তকে বাইরে বের করে দিলে মহান্ত লক্ষ্ণৌতে গিয়ে মৌলবী আমীর আলির সঙ্গে মিলিত হন। ওঁরা প্রচার করতে থাকেন যে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ দখল করেছে। মৌলবী আমেথিতে এসে লােজন জোগাড় করে অযােধ্যার দিকে এগােতে থাকেন। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ইংরাজদের ব্যবস্থা নিতে বলেন কারণ চুক্তি অনুযায়ী ইংরাজরা অযােধ্যায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। ইংরাজরা স্বভাবতই কোনাে ব্যবস্থা নিতে রাজি না হলে, নবাব নিজের সৈন্য পাঠান। রুদালিতে যুদ্ধে মৌলবী পরাজিত ও নিহত হলে তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপরে মুসলমানরা বাবরি মসজিদ থেকে হিন্দদের হঠিয়ে দিয়ে হনুমানগড় আক্রমণ করে।

দেখা যাচ্ছে যে, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ হিন্দুদের হনুমানগড় রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং মৌলবীর জেহাদী সৈন্যদের যুদ্ধ করে হঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে দুই সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতারা একত্রে বসে আলােচনা করে স্থির করে যে শান্তি থাকবে এবং দুই সম্প্রদায় একই জায়গায় বসে পূজা-প্রার্থনা করতে পারবে। ইংরাজ রেসিডেন্টকে সভাপতি করা হয়েছিল কারণ ১৮১৯ সালের চুক্তিতে অযােধ্যার শাসনভার ইংরাজদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। স্থির হয় যে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদের ভিতরে প্রার্থনা করবে এবং হিন্দুরা মসজিদের সামনে পুজো করবে। আউধের রাজ্যভার ইংরাজদের হাতে যাওয়া পর্যন্ত (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬) এই ব্যবস্থা চলছিল।

অযােধ্যার ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ গণ-বিপ্লবে পরিণত হলেও হনুমানগড়ের বৈরাগীরা ইংরাজদের পক্ষে ছিলেন। তারা ইংরাজ আমলা ও তাদের পরিবারবর্গকে পালাতে সাহায্য করে ১৮৫৮ সালের পর ইংরাজরা অযােধ্যার রাজা মানসিংহ ও বৈরাগীদের যথাযােগ্য পুরস্কার দিয়েছিলেন।

১৮৫৮-র পরে আবার দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গােলমাল বাঁধে এবার ইংরাজরা একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা নেয় যাতে দুই সম্প্রদায়ের ওই জায়গার উপর অধিকার থাকে। ইংরাজরা এবার দুই সম্প্রদায়ের জন্য জায়গা আলাদা করে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় ইংরাজ প্রশাসন ঠিক করে দেয় যে, মসজিদের সামনে একটা চবুতরা করে দেওয়া হবে যেখানে হিন্দু মহান্তরা পুজো দেবে। এর পিছনে একটা লােহার রেলিঙ করে মসজিদ থেকে এটা আলাদা করে দেওয়া হয়। হিন্দুরা মসজিদের ভিতরে যেতে পারবে না। মুসলিমরা মন্দিরে ঢুকবে উত্তরের দরজা দিয়ে যেটি ওই সময়ে তৈরি করে দেওয়া হয়। পূর্বদিকের দরজা ওদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। সুতরাং এটা খুব পরিষ্কার যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরােধ বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি চত্বর ঘিরে যেটি হয়েছিল ১৮৫৫ সালের পর থেকে। এর পর থেকেই দুই সম্প্রদায়ের যে মৈত্রী ও সম্প্রীতি ছিল সেটা ফৈজাবাদে নষ্ট হয়ে যায়।

বাইরে একটা বােঝাপড়া করলেও ইংরাজ লেখকরা বিরােধটি বারবার তুলতে থাকে। ১৮৬০ সালে এক ইংরাজ আমলা, পি. কার্নেগী, পরিষ্কার বলেন যে, ১৫২৮ সালে বাবর রামজন্মস্থান মন্দির ভেঙে মসজিদ করেছিলেন। উনি আরও বলেন যে, পুরনাে মন্দিরের উপাদান দিয়ে মসজিদ তৈরি হয়েছিল যার মধ্যে হিন্দু মন্দিরের স্তম্ভগুলি দেখা যায়। এর পরে কার্নেগী মন্তব্য করেন যে, ধর্মান্ধ মুসলমানরা এই ধরনের মন্দির ভেঙে তাদের ধর্মকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছে। এরপর উভয় সম্প্রদায় থেকে নানারকম গল্পকথা উভয় সম্প্রদায়ের দাবিকে জোরালাে করার জন্য পুস্তিকাকারে ছাপা হতে থাকে। উল্লেখযােগ্য যে মীর্জা জানের লেখায় মন্দির ভাঙার কথা থাকলেও, সব ফার্সি পুঁথিতে এটা পাওয়া যায় না। বরঞ্চ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যর কথাই পাওয়া যায়। ১৮২০ সালে মুহম্মদ ফৈজ বকস ‘তারিখ-ই-ফারাবক্স’ লেখেন যাতে তিনি ১৮১৯ পর্যন্ত ফৈজবাদের ইতিহাস লেখেন। এর মধ্যে রামমন্দির ভাঙার কোনাে কথা নেই এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরােধের কোনাে উল্লেখ নেই।

আমরা আগেই দেখেছি, যে বক্সারের যুদ্ধের পর (১৭৬৪ সাল) নবাব সুজাউদ্দৌলা আউধ থেকে মুঘল প্রভাব সরিয়ে দিতে থাকেন এবং ইংরাজরা এতে উৎসাহ দেয়। নবাবী সৈন্যদের মধ্য থেকে মেওয়াতীদের (ইসলামে ধর্মান্তরিত মেত উপজাতি), যারা প্রধানত সুন্নি ছিল, সরিয়ে সিয়া ও রাজপুতদের নেওয়া হতে থাকে। কিন্তু আউধে ব্রিটিশ-বিরােধী জনমত গড়ে ওঠে এবং ১৮১৬ সালে বেরিলী ও রােহিলখণ্ডে ইংরাজদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হয়। মুঘলদের সঙ্গে এই নবাবরা যাতে আর যুক্ত না থাকে সেজন্য আউধের নবাবের সঙ্গে ১৮১৯ সালে চুক্তি করে স্বাধীন রাজা করে দেওয়া হয়। সিংহাসনে বসার সময়ে অবশ্য God save the king বাজানাে হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই ইংরাজরা মুসলিম ধর্মীয় একতার সম্বন্ধে ভীত ছিল। ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহে বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে মেনে নেওয়া, মৌলবাদীদের অংশগ্রহণ, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ইত্যাদির ফলে ইংরাজরা হিন্দু ধর্মীয় জাগরণকে উৎসাহ দিতে থাকে। ওয়াহাবী আন্দোলনের ফলে ইংরাজদের নীতি পরিষ্কার হয়ে যায়। মুসলমানদের গোঁড়া ধর্মনীতির বিরুদ্ধে হিন্দুধর্ম জাগরণের মধ্য দিয়ে ইংরাজরা মােকাবিলা করতে চায়। ইংরাজ ঐতিহাসিক মিলের। ইতিহাস হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ ও ব্রিটিশ যুগ বলে ভারতের ইতিহাসকে ভাগ করে দিয়েছে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলা হতে থাকে যে গীবনের রােম সাম্রাজ্য পতনের বই-এর পরেই এটাই শ্রেষ্ঠ বই।

এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে মহামতি বেভারিজ-এর স্ত্রী এ. এস, বেভারিজ বাবরনামা তুর্কী থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেন। পরিশিষ্টে তিনি বাবরি মসজিদের শিলালেখর অনুবাদ করে মন্তব্য করেন যে, এখানে হিন্দুদের রামমন্দির ছিল যেটা বাবরের সেনাপতি ভেঙে মসজিদ করেছে বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটির জন্য তিনি নির্ভর করেছিলেন নেভিলের ফৈজাবাদ গেজেটিয়ার এর উপর। কিন্তু নেভিল এটা লেখেননি যে ওখানেই হিন্দু মন্দির ছিল যা বাবর ভেঙে ছিলেন। শিলালেখ অনুবাদের সঙ্গে টীকা এমনভাবে দেওয়া হলাে যে মন্দির ভাঙাও শিলালেখর মধ্যে আছে। প্রত্নতত্ত্বকে কুক্ষিগত করে ততদিনে ইংরাজরা মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতি লােপ করার প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রত্নতত্ত্ব কিভাবে করা উচিত সে সম্বন্ধে নানান শিক্ষা দিলেও নিজে সব জায়গায় নিজের নিয়ম মানেননি। মধ্যযুগের বাংলার রাজধানী গৌড় শহরের কাজ করার সময় তিনি লিখে গিয়েছে যে মুসলমানরা এই শহর হিন্দুদের লক্ষণাবতীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই বক্তব্যের সপক্ষে তিনি দু-একটা জায়গা হিন্দু নাম ছাড়া আর কোনাে প্রত্নতত্ত্বর সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি। ততদিনে অবশ্য মধ্যযুগকে মুসলমান যুগ বলে এটি যে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ এবং ইংরাজ শাসন যে ভারতীয়দের (পড়ন হিন্দুদের) ওই যন্ত্রণাদায়ক যুগ থেকে মুক্তি দিয়েছে সেটা বারংবার বলে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করেছে। বর্তমান অযােধ্যা কাণ্ড এই ইতিহাসের একটা অংশ।

সাত

এই ইতিহাস থেকে বর্তমান অযােধ্যাকাণ্ডের কতকগুলি সূত্র পাওয়া যায়। প্রথমত ষষ্ঠদশ শতকের শেষ থেকে অযােধ্যায় রামভক্তদের কথা পাওয়া যায়। অযােধ্যাও তীর্থ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। দ্বিতীয়ত, সপ্তদশ শতাব্দীর গােড়া থেকে বিদেশী পর্যটকদের লেখা থেকে অযােধ্যার রামভক্তির কথা পাওয়া গেলেও রামমন্দিরের কথা পাওয়া যায় না। তৃতীয়ত, ১৫২৮ সালে নির্মিত বাবরি মসজিদের বিস্তৃত শিলালেখতে রামমন্দির বা তার ভাঙার কথা নেই। চতুর্থত, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিদেশী পর্যটকের লেখায় মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হলেও বাবরি মসজিদ যে রামমন্দির করা হয়েছে একথা নেই। বরঞ্চ সীতা-কা-রসুই সম্পর্কে বলা আছে। পঞ্চমত, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে অযােধ্যার নবাব মুঘলদের হাত থেকে ইংরাজদের সাহায্যে স্বাধীন হবার পর ও অযােধ্যার শাসনভার ও খাজনা সংগ্রহ ইংরাজদের হাতে গেলে রামমন্দিরেরর ধারণা দানা বাঁধতে থাকে যা ইংরাজ পর্যবেক্ষকদের লেখায় পাওয়া যায়। ষষ্ঠত, ১৮৫০ সালের পর ইংরাজরা আউধ দখল করার পরিকল্পনা করে শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে এই ধারণার উপর নির্ভর করে। ১৮৫২-৫৩ থেকে দুই সম্প্রদায় লড়াই করলে নবাব গােলমাল থামিয়ে মিটমাট করান। সপ্তমত, ১৮৫৭-৫৮ সালের ইংরাজ-বিরােধী বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরাজরা রামজন্মভূমির দাবি মেনে নিয়ে জাগয়া চিহ্নিত করে দেয়। অযােধ্যা মাহাত্ম্যর উপর নির্ভর করে মন্দিরবাদীদের বক্তব্য বাড়তে থাকে যদি ঐ মাহাত্মের দিকনির্ণয়ে কৌশল্যাভবনকে রামের জন্মস্থান বােঝায়, বাবরি মসজিদ নয়। বিংশ শতাব্দীর গােড়ায় একটা কমিটি দুটি ভিন্ন জায়গাকে জন্মভূমি ও জন্মস্থান বলে চিহ্নিত করে দেয়। অষ্টমত, বিদ্রোহ ও ওয়াহাবী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গোঁড়া মুসলমান ধর্মীয় জাগরণের মােকাবিলা করতে ইংরাজরা হিন্দুধর্মীয় জাগরণকে উৎসাহ দিতে শুরু করলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরােধ বাধতে থাকে যা নবাবদের সময়ে ছিল না। এই সময়ে থেকেই ইংরাজদের লেখার মধ্যে হিন্দু যুগ ভালাে ও মধ্যযুগ বা মুসলমান যুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে প্রমাণিত করার চেষ্টা করা হয়। ইংরাজরাই যে ভারতবাসীকে উদ্ধার করে শান্তি-শৃঙ্খলা এনে দিয়েছে ও সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে বলা হতে থাকে। শেষে, বর্তমানকালে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের উৎখননের ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ধুলিসাৎ বাবরি মসজিদের তলায় কোনাে হিন্দুসৌধ বা মন্দির নেই। বরঞ্চ পুরনাে মসজিদ বা ইদগাহ’র অংশ পাওয়া গিয়েছে।

এই বিশ্বাস যে বাবরি মসজিদ রামমন্দির ভেঙে করা হয়েছে সেটি হিন্দুদের একটা অংশ ও ইংরাজ উপনিবেশিকদের রচনা। এর কোনাে ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং এই বিশ্বাস যে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে ছিল না সেটাও খুব পরিষ্কার।

 

Post Views: 6,265
Tags: AyodhyaRamJanmabhumiঅযােধ্যাঅযােধ্যাকাণ্ডনবজাগরণরামজন্মভূমি
ADVERTISEMENT

Related Posts

RAW-কে নিষিদ্ধ করার পিছনে আমেরিকা উদ্দেশ্য কি?
রাজনীতি

RAW-কে নিষিদ্ধ করার পিছনে আমেরিকা উদ্দেশ্য কি?

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম সাম্প্রতিক কালে ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’— সংক্ষেপে ‘র’ (RAW) —কে কেন্দ্র...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
June 19, 2025
রহস্য উদ্ঘাটন মূলক বিশ্বাস খ্রিস্টানদের ইজরাইল সমর্থনের বড় কারণ
ইসলাম

‘রহস্যউদ্ঘাটনমূলক’ বিশ্বাস আমেরিকান খ্রিস্টানদের ইহুদি ও ইজরাইল সমর্থনের বড় কারণ

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম রহস্য উদ্ঘাটন পন্থী খ্রিস্টান মৌলবাদীরা ‘বাইবেল সংক্রান্ত কারণে’ আরও ব্যপকভাবে ফিলিস্তিন-ইজরাইল সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। [Apocalypse...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
November 8, 2024
প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রজারাই অরক্ষিত : পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ
রাজনীতি

প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রজারাই অরক্ষিত : পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ

আমরা প্রতি বছর বেশ ঘটা করেই প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে থাকি, কিন্তু সেই প্রজারা তথা দেশের নাগরিকরা আজও কতটা...

by আমিনুল ইসলাম
January 26, 2023
চিত্তরঞ্জন দাশ
ভারতবর্ষের ইতিহাস

চিত্তরঞ্জন দাশঃ সত্যিকারের গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রবক্তা

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বপ্ন ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিতে এক সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন। তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দু- মুসলমানের মিলন ভিন্ন স্বরাজের...

by আমিনুল ইসলাম
January 21, 2023

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (27)
  • ইসলামিক ইতিহাস (23)
  • ইহুদী (2)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (24)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (195)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (68)
  • সিনেমা (17)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply