লিখেছেনঃ ড. নজরুল ইসলাম
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বাংলাও ভাগ হয়। অবিভক্ত বাংলার ৬২ শতাংশ (পূর্ব বাংলা) পাকিস্তানে যায়, তা পূর্ব পাকিস্তান, এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হয়। ৩৮ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হিসেবে ভারতবর্ষে থাকে। মাঝে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫০ সালে কোচবিহার রাজ্য একটা জেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৯৫৫ সালে চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিহারকে ধানবাদ অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে, পুরুলিয়া অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাকে ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা রাজ্যের সৃষ্টি করা, যেখানে উচ্চবর্ণের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু নেতাদের প্রাধান্য বজায় থাকবে। সে জন্যই অনেক হিন্দু নেতা ভারতে থাকলেও বাংলাকে অখণ্ড রাখতে রাজি ছিলেন না।১ সেই জন্যই, বিধানচন্দ্র রায় যখন বাংলাকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে এক রাজ্য করতে চেয়েছিলেন, তখন উচ্চবর্ণের প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরা তাঁর বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকদের সচেতনতা এবং সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার ফলে তামিলনাড়ু, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, প্রভৃতি রাজ্যের শাসন ক্ষমতা এখন তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকদের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী, বিশেষ করে সাম্যবাদী, আন্দোলনের সব থেকে বড় সাফল্য এই যে, এ রাজ্যে বামপন্থার নামে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের শাসন ক্ষমতা এখনও কায়েম আছে। তাই এখনও ২ শতাংশ ব্রাহ্মণ জনসংখ্যার পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভায় ৩৪.৯ শতাংশ ব্রাহ্মণ।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতারপর থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। স্বাধীনতার দিন থেকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৫-০৮-১৯৪৭–১৪-০১-১৯৪৮)।২ কয়েক মাসের মধ্যেই তার জায়গা নেন বিধানচন্দ্র রায় (১৪-০১-১৯৪৮-০১-০৭-১৯৬২)। তাঁর মৃত্যু হলে, কয়েক দিন (০১-০-১৯৬২ – ০৮-০৭-১৯৬২) রাষ্ট্রপতি শাসনের পর, মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র সেন (০৮-০৭-১৯৪৮ – ১৫-০৩-১৯৬৭)।
১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোট ২৮০টির মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ১২৭টি আসন পায়। অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন ‘প্রগেসিভ ইউনাইটেড লেট ফ্রন্ট’ ৬৩টি, এবং জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন লেট ফ্রন্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের (১৫-০৩-১৯৬৭-০২-১১-১৯৬৭) প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ নয়। কয়েক মাসের মধ্যেই তার জায়গায় আসে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মুখ্যমন্ত্রীত্বে (০২-১১-১৯৬৭–২০-০২-১৯৬৮) ‘নন পার্টি প্রগেসিভ ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ সরকার। এ সরকারও বেশিদিন টেকেনি। বছরখানেক (২০-০২-১৯৬৮ – ২৫-০২-৬৯) রাষ্ট্রপতির শাসন থাকে। ১৯৬৯-এর নির্বাচনে কংগ্রেস মাত্র ৫৫টি আসন পায়। সিপিআইএম ৮০টি, সিপিআই ৩০টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২১টি, এবং আরএসপি ১২টি। আসন পায়। বাম দলগুলির সমর্থনে বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জী দ্বিতীয়বার যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী (২৫-০২-১৯৬৯-১৯-০৩-১৯৭০) হন। এবারও তার মন্ত্রিসভা বেশি দিন টেকেনি। বছরখানেক (১৯-০৩-১৯৭০-২০-০৪-১৯৭১) রাষ্ট্রপতি শাসনের পর, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন বেড়ে হয় ১০৪। ১১৪টি আসন দখল করে সিপিআইএম আবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়। কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত করে অজয় মুখার্জী তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী (০২-০৪-১৯৭১-২৮-০৬-১৯৭১) হন। মাস দুয়েক পর আবার রাষ্ট্রপতি শাসন (২৮-০৬-১৯৭১-১৯-০৩-১৯৭২) জারি হয়।
১৯৭২-এর নির্বাচনে কংগ্রেস গরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী [১৯-০৩-১৯৭২ – ২১-০৬-১৯৭৭) হন।
জরুরি অবস্থার পর, ১৯৭৭-এর সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। সিপিআইএম ১৭৮টি আসন দখল করে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি দলগুলিও ভালো ফল করে। জ্যোতি বসু বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী (২১-০৬-১৯৭৭-০৬-১১-২০০০) হন। ১৯৮২, ১৯৮৭, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬-এর নির্বাচনগুলোতেও বামফ্রন্ট সাফল্য লাভ করে। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থেকে যান। ০৬-১১-২০০০ তারিখে জ্যোতি বসুকে সরিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ২০০১, এবং ২০০৬-এর নির্বাচনেও বামফ্রন্ট ভালো ফল করে এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থেকে যান।৩
গরিবদের জমি জোর করে কেড়ে নিয়ে ধনী শিল্পপতিদের দেওয়ার বিরুদ্ধে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সাধারণ মানুষদের মধ্যে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআইএম-এর জনপ্রিয়তা কমে যায়। ২০০৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস—এসইউসিআই-কংগ্রেস জোট দখল করে ২৬টি আসন। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনে ১টি আসন যায় বিজেপি-র দখলে। বামফ্রন্ট পায় মাত্র ১৫টি আসন। তার মধ্যে সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক প্রত্যেকে ২টি করে আসন পায়। সিপিআইএম-এর আসন দাঁড়ায় ৯। এর পরেই লোকের মনে হয় যে, ২০১১ সালের বিধানসভার ভোটে বামফ্রন্টের বিদায়ের সম্ভাবনা আরও শক্তিশালী হল। বামফ্রন্টের এই নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকেই মন্তব্য করে যে, রাজ্যে মুসলমানরা বামফ্রন্টের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যদি সত্যি হয়, তা হলে কেন? সাড়ে তিন দশকের সিপিআইএমএর নেতৃত্বাধীন বাম শাসনে বাংলার মুসলমানর কি পেয়েছে? কি পায়নি। কেন তারা সিপিআইএম-এর উপর এতটা অসন্তুষ্ট?
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ হয়েছিল মুসলিম লিগ নেতাদের দাবি অনুসারে। ফলে মুসলমানদের দেশভক্তি বড়ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ে। মুসলমানদের মধ্যে সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফফর খান এবং আবুল কালাম আজাদের মতো নেতারাও ছিলেন, যাঁরা দেশভাগের এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের অনুগামীদের দেশভক্তিও সন্দেহের সম্মুখীন হয়। নিরাপত্তাবোধ ও সমানাধিকার নিয়ে অনেক মুসলমানের মনে সন্দেহ জাগে। বহু সংখ্যক মুসলমান এ দেশে পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। পাকিস্তান থেকে বহু হিন্দু এ দেশে চলে আসে। যারা আসে তাদের একটা বড় অংশ মনে করত, মুসলমানদের জন্যই তাদের এ দশা হয়েছে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা আরও বৃদ্ধি পায়। এরকম অবস্থায় বামপন্থীরা যখন অসাম্প্রদায়িক এবং সাম্যবাদী রাজনীতির কথা বলে তা অনেক মুসলমানকেই আকৃষ্ট করে। অধিকাংশ মুসলমান গরিব শ্রমিক বা কৃষিমজুর। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘ন্যায্য মজুরি চাই’, এবং ‘লাঙল যার জমি তার’-এর মতো স্লোগান তাদের আকৃষ্ট করে। তারা বামপন্থীদের সমর্থক হয়ে পড়ে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি মুসলমানদের আরও বেশি করে মুসলমানদের বামপন্থীদের প্রতি ঠেলে দেয়। কেন্দ্রে এবং গুজরাতে যখন বিজেপি শাসন তখন সরকারে সহায়তায় গুজরাতে ২০০২ সালের মুসলমান নিধন মুসলমানদের বামপন্থীদের থেকে সরে আসা বিঘ্নিত করে। কিন্তু রাজারহাট, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনার পর আর কিছুই তাদের বামপন্থীদের প্রতি বিরূপ হওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি।
এ বামফ্রন্টের প্রতি সাধারণ গরিব মানুষের বিরূপ হওয়ার সব থেকে বড় কারণ গরিব মানুষদের জমি ছলেবলে কৌশলে কম দামে কেড়ে নিয়ে ধনীদের দেওয়া। সাধারণ মানুষের ধারণা, পাড়ার দাদারা যেমন পেশিশক্তির অপব্যবহার করে, গায়ের জোরে, ভয় দেখিয়ে, ‘রংদারি ট্যাক্স’ আদায় করে; ‘রাজ্যের শাসক দলের নেতারা’ তেমনি শাসন ক্ষমতার অপব্যবহার করে, জমি লেনদেন করে প্রভূত পয়সা কামিয়েছেন। না হলে সিঙ্গুরে টাটাদের সঙ্গে কী চুক্তি হয়েছে সেটা লোককে জানাতে এত আপত্তি হবে কেন? টাটাদের ব্যবসায়িক গোপনীয়তা রক্ষার দরকার থাকতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে নেতা-মন্ত্রীরা কী করছেন সেটা জনগণকে জানানোর দায়বদ্ধতা থাকবে না? জনগণ জানতে পারবে না, সরকারি পয়সায়, গরিব মানুষদের জোর করে দখল করা জমি, নেতারা নিজের পকেটে বা পার্টি ফাণ্ডে টাকা নিয়ে অত সহজ শর্তে উপঢৌকন দিচ্ছেন কি না? ফলে যাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তারা তো বটেই, অন্য গরিব মানুষেরাও বামপন্থীদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। বামপন্থী দলগুলি, বিশেষ করে সিপিআইএম অত্যন্ত সংগঠিত। প্রশাসনকে পার্টির কাজে অন্যায়ভাবে লাগাতে সিদ্ধহস্ত। ফলে লোকে বাম নেতাদের ভক্তি না করলেও ভয় করে। তাই রাজারহাটে তারা ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। সিঙ্গুরে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু নেতারা রাষ্ট্রশক্তি, বিশেষ করে পুলিশকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করে সে প্রতিরোধ প্রায় ভেঙে ফেলেছিল। কিন্তু নন্দীগ্রামের মানুষ প্রাণ দিয়েও তাদের জমি নেওয়া আটকে দিয়েছিল। তাই নন্দীগ্রাম যাকে বলে ‘টার্নিং পয়েন্ট’। নন্দীগ্রামের লোকদের সাফল্যের পরই সিঙ্গুরের আন্দোলন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জমি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে নন্দীগ্রামে লোকদের আন্দোলনের চালিয়ে যাওয়াকে অযৌক্তিক প্রমাণ করতে বাম নেতারা বারবার বলেছেন, যখন বলে দেওয়া হয়েছে জমি নেওয়া হবে না তখনও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কেন? নন্দীগ্রামের মানুষ কি প্রশ্ন করবে না, ‘তোমরা জমি অধিগ্রহণের কথা তো টিভিতে এসে বলোনি। তার জন্য একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলে। তা জমি যে আর নেবে না, সেটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি জাতি করে না বলে, টিভিতে ফাকা বুলি আওড়াতে এসেছ কেন?’ বিড়াল যদি বলে, ‘মাছ খাব না, আঁশ ছোঁব না, কাশী যাব’, কেউ বিশ্বাস করবে কি? না। বামফ্রন্টের নেতার, বিশেষ করে গরিবের জমিকাড়া মুখ্যমন্ত্রী, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। সেই জন্য গরিব মানুষের বড় অংশ বামফ্রন্টের থেকে সরে গেছে। এ রাজ্যের মুসলমানদের শিক্ষাগত এবং আর্থিক অবস্থা তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতির লোকদের থেকেও খারাপ। অধিকাংশ মুসলমান গরিব। কাজেই অধিকাংশ মুসলমান বামফ্রন্টের থেকে সরে গেছে।
আরও একটি কারণ আছে। এটা বহুলভাবে আলোচিত হয়েছে, গণমাধ্যমেও এসেছে যে, বামফ্রন্ট সরকার বেছে বেছে মুসলমান প্রধান এলাকায় জমি কাড়তে গিয়েছে। বামফ্রন্টের নেতারা, সত্যিই এ রকম কিছু ভেবে করেছেন কি না, তা তারাই বলতে পারবেন। তবে যে এলাকার জমি সরকার অধিগ্রহণ করতে গেছে —যেমন রাজারহাট, নন্দীগ্রাম —সে এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশ বেশি। শিল্পে-বাণিজ্যে পিছিয়ে। সরকারি চাকরি থেকে প্রায় বঞ্চিত। তার ওপর যে একটু জমি আছে তাও শিল্পপতিদের দেওয়ার জন্য যে দলের সরকার কেড়ে নিতে চায়, তাদের বিরোধিতা না করে কি পারা যায়?
বামপন্থী দলগুলি, বিশেষ করে সিপিআইএম, যে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার অন্যতম কারণ তারা যাদের সিলিং অতিরিক্ত জমি ছিল, তাদের সে জমি খাস করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করার দাবি করত। কিছু বিতরণও করেছিল। যারা অন্যের জমি ভাগে চাষ করে তাদের নাম বর্গাদার হিসেবে নথিভূক্ত করিয়েছিল। ফলে যাদের জমি ছিল না, যারা কৃষিমজুর হিসেবে কাজ করত, তারাও এক টুকরো জমির স্বপ্ন দেখত। এর ফলে গরিব মানুষেরা তাদের দল ভারী করেছিল। সেই দলের নেতারাই যখন গরিব মানুষের জমি কেড়ে নিয়ে, ধনীদের দিতে শুরু করেছেন, তখন গরিব মানুষেরা বিপন্ন বোধ করেছে এবং কালক্রমে বিরূপ হয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সরে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হল, পুলিশ-প্রশাসনকে পার্টির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত করে, পঙ্গু করে দিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন করে দেওয়া। বামফ্রন্টের পুলিশ-প্রশাসন কতটা অপদার্থ তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৪-০২-২০১১ রাতের বারাসাতের ঘটনা। একজন ভদ্রমহিলাকে তার ১৬ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাই সাইকেলে করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। যেখানে জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের (ডি.এম., এস.পি., অ্যাডিশনাল এসপি) বাসস্থানসমূহ।৪ তার খুব নিকটে তিনজন মাতাল তাদের আটকায়, কটুক্তি করে, মহিলার গায়ে মদ ঢেলে দেয় এবং অনুনয় করলে ভাইকে খুন করে। ভ্যানে করে যাওয়া লোকেরা, এমনকী জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের বাংলোতে নিযুক্ত পুলিশের লোকেরা মহিলার আকুল আবেদন সত্ত্বেও তার ভাইকে বাঁচাতে আসেনি।
হায়দরাবাদের ন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমির গেটের সামনে মহাভারতের একটি শ্লোক লেখা আছে। তার মর্মার্থ হল, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া কোলো মহিলা যদি সর্বালঙ্কারভূষিতা হয়ে রাতের বেলা নিশ্চিন্তে চলতে পারে তা হলে বুঝতে হবে, দেশের শাসকের শাসন আছে। বর্তমান ঘটনায়, মহিলা স্টেশন থেকে পুরুষসঙ্গী ছাড়া নিরাপদ মনে করতেন না বলেই প্রতিদিন কোলো পুরুষকে স্টেশনে গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে হত। সেদিনও স্টেশনে পৌছানোর অব্যবহিত আগে ভাইকে ডেকে নিতে হয়েছিল। আর দিদিকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ১৬ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাইকে গুণ্ডাদের হাতে খুন হতে হল। এর থেকে আপনাদের কী মনে হয়, দেশে কোনো শাসন আছে? থাকলে সেটা সুশাসন, না কুশাসন? কেন এই হাল?
১৮-০২-২০১১ তারিখে একটা দৈনিক পত্রিকা তার কারণ বিশ্লেষণ করে লিখেছে, “আলিমুদ্দিনের আনুগত্যেই’ আটকে পুলিশের ভবিতব্য”। লিখেছে, “দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা থেকে পাশের জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হবে এক আইপিএস কে। কারণ, সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি’ ওই জেলায় তাকেই চায়। আপত্তি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আলিমুদ্দিনের মারফত সংশ্লিষ্ট জেলা সম্পাদককে বলা হয়েছিল, ‘সিপিএমের পছন্দ নয়।’ সাফ জবাব এসেছিল তা হলে না-হয় উনি সিপিএম থাকবেন না। সিপিএম হলে এত পছন্দ-অপছন্দ থাকলে চলবে না।
“জেলা সম্পাদকের অভিমতই বহাল থেকেছে। পছন্দসই’ আইপিএস-কেই ওই জেলায় বহাল করা হয়েছে এসপি-র দায়িত্বে।
শুরু হয়েছিল জ্যোতি বসুর সময়ে। তারই উত্তরাধিকার বহন করছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
“এই ‘উত্তরাধিকার’ সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘আলিমুদ্দিনের কাছের লোক’ বসানোর। যার সম্ভবত বৃহত্তম ‘শিকার’ এ রাজ্যের পুলিশ। যেখানে ‘পেশাদারিত্ব’ ব্যতীত অগ্রাধিকার প্রায় ‘প্রশ্নাতীত’ রাজনৈতিক (আসলে সিপিএম) আনুগত্য। যেখানে নিয়োগের আগে দেখা হয় সংশ্লিষ্ট অফিসার শাসক দলের কোন নেতার কত ‘ঘনিষ্ঠ’।..
বস্তুত, গত ৩৪ বছরে বাম-আমলে পুলিশে বদলি আগাগোড়াই নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে দলীয় স্তরে আলিমুদ্দিন এবং প্রশাসনিক স্তরে মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত-সহায়কের মারফত। জ্যোতিবাবুর আমলে যে কাজ করতেন তার আপ্ত-সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ। তার পরে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সিপিএমের রাজ্যকমিটির সদস্য অভীক দত্ত। আপাতত সে দায়িত্বে মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত-সহায়ক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। ‘পছন্দমতো পোস্টিং’ পেতে তার কাছে যান আইপিএস-দের একাংশ। বাকিরা ‘দাদা’ ধরে আলিমুদ্দিনে। যেখানে পুলিশ ‘দেখভাল’ করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য রবীন দেব এবং দীপক দাশগুপ্ত। একটা সময় মৃদুল দে এবং মদন ঘোষের উপরেও এই দায়িত্ব ছিল। তবে এখন তা বর্তেছে কলকাতার ক্ষেত্রে রবীনবাবু এবং রাজ্যের ক্ষেত্রে দীপকবাবুর উপর। পুলিশ নিয়ে অবশ্য নিয়মিত ‘মাথা ঘামান’ রাজ্য মন্ত্রিসভার এক অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রীও।
“ঘটনাচক্রে, আলিমুদ্দিনের তরফে “আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সূর্যকান্ত মিশ্র।”৫ যাঁদের নাম উপরের প্রতিবেদনে এসেছে, তারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। একজন বলেছেন, “পুলিশ নিয়োগ থেকে বদলি — সব বিষয়েই নির্দিষ্ট আইন আছে। …সেখানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন অমূলক।”৬ দুয়েকটা উদাহরণ নেওয়া যাক!
বর্তমানে রাজ্য দূর্নীতি নিরোধ সংস্থার যিনি প্রধান, কিছুদিন আগে তিনি রাজ্য পুলিশের ডিজি ছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশ, নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখল’-এর জন্য, শাসকদলের লোকরা যাতে বিনা বাধায় বিপক্ষের লোকদের ব্রিজ দিয়ে গিয়ে আক্রমণ করতে পারে তার জন্য তিনি ব্রিজের উপর থাকা ‘পুলিশ পোস্ট’ তুলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে, ভবানী ভবনে আইপিএস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিঙে, তার উপস্থিতিতে বলেছিলাম, খবরের কাগজে, টিভিতে যখন এ রকম খবর বারবার প্রচারিত হচ্ছে তখন ডিজি যদি তা না করে থাকেন তা হলে সত্য যেটা উনি সেটা জানান। আর যদি তিনি এটা করে থাকেন, তা হলে সসম্মানে পদ ছাড়ুন। কারণ এটা ফৌজদারি অপরাধ এবং অপরাধ যিনি করেন, তার এ পদে থাকার কোনো অধিকার নেই। তিনি কোনো কথা – বলেননি। অবসরের পর তাকে মুখ্য সচিবের সমমর্যাদার পদে নিযয়োগ করা হয়েছে। এটা কোন্ ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে করা হয়েছে।
আরেকজন ডিজি-র উদাহরণ নেওয়া যাক। তিনি যখন ইবি-তে এডিজি ছিলেন, আমি আইজি ছিলাম। একদিন সিপিআইএম-এর একজন সাংসদ ফোন করলেন। জানালেন, কোনো কেস নেই। অভিযোগও নেই। তবু তার জানা একজন ব্যবসায়ীকে ইবি-র অফিসাররা হয়রান করছেন। তিনি একটা চিঠি লিখে সে ব্যবসায়ীকে আমার কাছে পাঠালেন। ব্যবসায়ী একই কথা বলল। তার বিরুদ্ধে কোনো কেস নেই। কেউ কোনো অভিযোগও করেনি। তবু তাকে বারবার ডেকে পাঠিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। সে যে ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়েছে সে ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট অফিসারদেরও ডেকে পাঠানো হচ্ছে। আমি ডিআইজি, এসপি এবং ভিএসপি-দের কাছে খোঁজ নিলাম। তারা কেউ কিছু জানেন না। আমি যে ইন্সপেক্টার এ সব করছিলেন, তাকে ডাকলাম। তিনি বললেন, এডিজি সাহেবের অর্ডার মতো করা হচ্ছে। আমি এডিজি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, মুখ্যমন্ত্রীর অর্ডার মতো করা হচ্ছে।
প্রশাসনের অবস্থার কথা চিন্তা করুন। মুখ্যমন্ত্রী অর্ডার দিয়েছে বলে এডিজি বলছেন। আর কোনো কেস শুরু না করে, কারওর কাছ থেকে কোনো অভিযোগও না নিয়ে ইন্সপেক্টার ব্যবসায়ীকে হয়রান করছে। মাঝেই আইজি, ডিআইজি, এসপি, ডিএসপি কিছু জানে না।
আমি বললাম, মুখ্যমন্ত্রী আদেশ দিলেও আমরা বেআইনি কাজ করব কেন? তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা শুরু করা হয়নি। কোনো অভিযোগও জমা পড়েনি। মুখ্যমন্ত্রী যদি চান তা হলে তিনি অভিযোগ জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আপনি কেস করুন। তারপর তদন্ত হবে। তা না করে, শুধু শুধু এরকম করলে তো লোকে অন্য কিছু ভাববে। শুধু মুখে বলে বসে না থেকে আমি এটা লিখিতভাবেও দিলাম। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও কথাটা পৌছানোর ব্যবস্থা করলাম। সেই সিপিআইএম সাংসদকেও বললাম, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খোঁজ নিন, তিনি এ রকম অন্যায় আদেশ দিয়েছেন কি না। এ ফলে, কিছুদিন বাদে, সেই এডিজে-কে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এডিজি, সিআইডি পদে নিয়োগ করা হল। কোন্ ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
এডিজি, সিআইডি হয়ে তিনি আইন না জানার চরম পরিচয় দিলেন। রিজওয়ানুর রহমান মামলায়, মৃতদেহের সুরতহাল (এনকোয়েস্ট)-এ সাক্ষী করার জন্য সিআরপিসি-র যে ধারায় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ময়নাতদন্ত (পোস্টমর্টেম) করে রিজওয়ানুরকে সমাধিস্ত করার পরও কোনো মামলা শুরু না করে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে, সেই ধারায় সাক্ষীদের ডেকে পাঠাতে থাকলেন। ফলে, সিআইডি-র তদন্তকে বেআইনি বলে, মাননীয় হাইকোর্টে মামলাটির তদন্তভার সিআইডি-র হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সিবিআইকে দেওয়ার আদেশ হল (২১-০৯-২০০৭)। তারপর তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল? তাকে রাজ্য পুলিশের ডিজি করা হল। কোন ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
শাসকদলের স্বার্থরক্ষা করার জন্য। যার জন্য জঙ্গলমহলে সিপিএম-এর সশস্ত্র ক্যাম্পের উপস্থিতির কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, সশস্ত্র ক্যাম্পের কোন প্রমাণ আছে? নেতাই কাণ্ড, এবং পরবর্তী রামেশ্বরপুরের ঘটনা পুরো প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কোন ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
১৯৮৩ সালে বোলপুরের এসডিপিও আমার প্রথম পোস্টিং হয়। স্থানীয় সিপিআইএম-এর এমএলএ এবং সিপিআইএম-এর এমপি-র পুত্রের নেতৃত্বে কয়েক হাজার সিপিআইএম সমর্থক পাটনীল গ্রামের কংগ্রেসের প্রধানের বাড়ি ঘেরাও করে, চাল ফেঁড়ে লোকদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে, বেধড়ক মারধর করে। মহিলাদের বিবস্ত্র করে। মারের চোটে মৃতপথযাত্রী জল চাইলে, তার মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া হয়। একজন লোক মারা যায়। অনেকে আহত হয়। কেসের তদন্ত করিয়ে, কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট নিয়ে, আমি এমএলএ এবং এমপি-র পুত্রকে গ্রেফতার করি। কোর্টে তুললে এমএলএ-কে জামিন দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তিন মাস তিনি ওই এলাকায় ঢুকবেন না এবং প্রতিদিন থানায় ফোন করে জানাবেন, তিনি কোথায় আছেন। এমপি-র পুত্রের জামিন নামঞ্জুর হয়। সম্পূর্ণ আইন মাফিক এই কাজ করার জন্য সিপিআইএম পার্টি আমাকে শিক্ষা দিতে নেমে পড়ে। ঘটনাস্থলের কাছে ডিএম, এসপি, এসডিও-র সঙ্গে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌছে দেখি, যে ঘরে আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছে সে ঘরের সামনে কয়েক হাজার লোক জড়ো করে সিপিআইএম নেতারা গরম গরম বক্তৃতা করে আমার চৌদ্দো পুরুষের ‘শ্রাদ্ধ’ করছেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছিলাম। সমাবেশের মধ্যে থেকে একে অপরের কাছে আমাদের পরিচয় জানতে চাইল। একজন আমাকে দেখাল। আরেক জন বলল, “আজ তো এরই বাঁশ হবে।” কে কথাটা বলছে, তাকে চিহ্নিত করার জন্য তাকাচ্ছিলাম। এসপি আমাকে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে উপরে উঠলেন। বাইরে নেতাদের দ্বারা আমার মুন্ডুপাত চলতে লাগল। আমাদের বসিয়ে রেখে, সিপিআইএম নেতা, মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ-রা আমার বিরুদ্ধে বলতে থাকলেন। সমবেত জনতাকে পুরোমাত্রায় উত্তেজিত করে, বাইরে তাদের জমা করে রেখে সিপিআইএম নেতা, মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ-রা আলোচনা করতে আসলেন। প্রথমে তারা নিজেদের পরিচয় দিলেন। দেখা গেল, স্থানীয় এমপি, জেলার আরেক এমপি ছাড়াও কোলকাতা থেকে এক মন্ত্রী, জনা পাঁচেক এমপি এসেছেন। (এখানে বলে রাখি, তাদের কারও আমার কাজ দেখার কোনো অধিকার ছিল না)। প্রথমে তারা আমার প্রার্থনা মতো, কোর্টের অন্যায় অর্ডারের ফলে, স্থানীয় এমএলএ যে ‘আলোচনায়’ আসতে পারেননি তার জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তারপর যাকে বলে একের পর এক নেতা আমাকে ধমকাতে থাকল। ডিএম এবং এসপি আমাকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যে, আমি যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো কথা না বলি। যা বলার তারাই বলবেন। কিন্তু দেখা গেল, তারাও কিছু বলছেন না। বসে বসে ধমকানো শুনছেন। সে ধমকানো প্রশাসনের লোকদের শোনা উচিত বলে আমি মনে করি না। যেমন কীভাবে আমাকে আঘাত করা যায় সেটা ঠিক না করতে পেরে একজন এমপি বললেন, “এমএলএ-ও হয়েছে তেমনি। আমাকে ধরতে গেলে। আমার একটা রিভভার আছে। আমি তাকে গুলি করে মারতাম।” আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ডিএম-এসপি কে বললাম, কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেন না। আমি বললাম, “প্রথমে গুলিতেই যদি মরে যেতাম, তা হলে কিছু করার ছিল না। না মরে গেলে আপনাকে গুলি করতাম, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এসে হাজতে ঢুকাতাম। কেস করে কোর্টে তুলতাম।” এ কথা। শুনে নেতা-মন্ত্রীরা সকলে একসঙ্গে রে রে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। তা হলে তো আর আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।
‘আলোচনা’ ভেঙে গেল। দু’দিনের মধ্যেই আমি বদলির অর্ডার পেলাম। কোন্ ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
আরও একটি কথা। নিরপেক্ষভাবে, সম্পূর্ণরূপে আইন অনুযায়ী কাজ করার পরও যদি সিপিআইএম-এর নেতারা হাজার লোক জড়ো করে একজন আইপিএস অফিসারকে প্রকাশ্যে ‘বাঁশ’ দেওয়ার এবং গুলি করে মারার হুমকি দেন, তা হলে, তা প্রত্যক্ষ করে নিচের সাব-ইন্সপেক্টর-কস্টেবলরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করার কথা কী করে ভাববে?
আমি যখন শিলিগুড়ির অ্যাডিশনাল এসপি ছিলাম, এক সিপিএম প্রধান রাস্তার উপর সাঁকো করার জন্য সরকারি সিমেন্ট গোডাউন থেকে তুলে নিজের অঞ্চলের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে গিয়ে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর দোকানে লরি থেকে নামাচ্ছিলেন। তা দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকেরা (তার মধ্যে সিপিআইএম-এর লোকও ছিল) আটকায়। থানা, সিআই, ডিএসপি কেউ তাদের অভিযোগ গ্রহণ না করলে তারা আমার কাছে আসে। আমি গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখি, তাদের অভিযোগ ঠিক। গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বলে আনলোড করার অজুহাত একদমই ঠিক নয়। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থানায় নিয়ে গেল। আর গাড়ি খারাপ হলে যেখান থেকে সিমেন্ট তোলা হয়েছে সেখান থেকে যেখানে যাবে তার মাঝখানে কোন জায়গায় খারাপ হবে। উল্টো দিকের রাস্তায় গিয়ে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর দোকানের সামনে খারাপ হবে কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না। ফলে আমি সিমেন্ট সিজ করে এসেন্সিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্টে কেস করলাম। প্রধান পালিয়ে গেল। সিপিআইএম-এর এটা সহ্য হল না। এমএলএ-কে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখাল, আমি কংগ্রেসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, সিপিআইএম পার্টিকে উৎখাত করতে চাচ্ছি। অভিযোগ গুরুতর। সৌভাগ্যবশত তখন ডিজি ছিলেন নিরুপম সোম। তিনি নিজে অনুসন্ধান করতে চলে গেলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিলেন, অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সিপিআইএম প্রধান সত্যি সত্যি সিমেন্ট ব্ল্যাক করছিলেন। কিন্তু তাতেও আমার বদলি আটকাল না। আমাকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই ব্যারাকপুরের ব্যাটেলিয়ানে বদলি করা হল। কোন্ ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
যদি সিপিআইএম প্রধানের সরকারি সিমেন্ট ব্ল্যাক আটকানোর জন্য অ্যাডিশনাল এসপি-র বদলি হতে পারে, তা হলে, সিপিআইএম এমএলএ, এমপি বা জেলা নেতাদের দুর্নীতির বন্ধ করতে যাওয়ার সাহস কে দেখাবে। যে অপরাধীরা তাদের স্নেহধন্য, যে অপরাধীরা তাদের সঙ্গে ওঠে-বসে তাদের অপরাধ ঠেকাতে যাওয়ার ঝুঁকি কে নেবে।
যে সিপিআইএম নেতা এই ‘নির্দিষ্ট আইন’-এর আড়ালে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই নেতার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগেরই একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর পূর্ব কলকাতার একটা জায়গায় একটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়। তাতে স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টারের মদতেরও অভিযোগ ওঠে। তুষার তালুকদার পুলিশ কমিশনার হয়ে আমাকে কোলকাতা পুলিশে নিয়ে আসেন। মাস তিনেক ৫ম বাহিনীতে রাখার পর ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের, স্পেশাল সেলের ডিসি করেন। অ্যান্টি-রাউডি সেকশান-এর অফিসাররা মূল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। কোর্টে তোলা হলে পুলিশ কাস্টোডির আদেশ হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানা যায়, তা অনেক সংঘর্ষেরই প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে সহায়ক হতে পারে। সে বলে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে ঝামেলা পাকালেও আসল উদ্দেশ্য ছিল, লোকদের বিতাড়িত করে জমিটা হাতিয়ে নেওয়া। আর স্থানীয় থানার বড়বাবু যে তাদের সাহায্য করেছিল, সেটা এই জন্য নয়। যে, আমরা হিন্দু। সাহায্য করেছিল এই জন্য যে, আমরা সিপিআইএম। আমি কমিশনারকে জানালাম। কমিশনার মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে থাকবেন।
পরের দিন অফিসাররা এসে বললেন, স্যার তা হলে ভালুককে কোর্টে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি বললাম, কেন? পুলিশ কাস্টোডি তো এখনও শেষ হয়নি।
ডিসি, ডিডি তো ডেকে তাই বলে দিলেন।
আমি ডিসি, ডিডি-কে ফোন করলাম।
আমার কিরকম সন্দেহ হল। আমি কমিশনারকে সব ব্যাপার যখন বললাম তখন তো কিছু বললেন না। আমি তার কাছে গিয়ে সব বললাম।
উনি বললেন, ডিসি, ডিডি আমাকে বলল, রবীন দেব ফোন করেছিল। আর ওকে রাখার দরকার নেই। কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে।।
আমি বললাম, কম্যুনাল রায়ট কেসের আসামি। কোর্ট পুলিশ কাস্টোডি দিয়েছে। সে অনেক গোপন কথা বলছে। তাতে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে পুলিশ অফিসারদের ইনভলমেন্টের কথাও আছে। আমাদের উচিত ওর কাছ থেকে যতটা বের করা যায় বের করে নেওয়া। তা না করে, কাস্টোডি শেষ হওয়ার আগেই কোর্টে পাঠিয়ে, ছেড়ে দিলে তো ভুল সিগন্যাল যাবে।
উনি আমার যুক্তি মেনে নিলেন। ডিসি, ডিডি-কে ফোনে ধরে বললেন, তুমি তো বলছিলে, ওকে আর রাখার দরকার নেই। কিন্তু নজরুল তো বলছে, ছেড়ে দিলে রং সিগন্যাল যাবে। ম
ফোন ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। কোর্টে পাঠাবার দরকার নেই।
কোর্টে পাঠানো হল না। কিন্তু অনুগত অফিসার যে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন, তার পুরস্কার পেলেন। তাকে পুলিশ কমিশনার করা হল। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তদ্বির এবং যে অফিসার ছেড়ে দিতে উদ্যত তাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো কোন ‘নির্দিষ্ট আইন’ অনুসারে?
১১প্রশাসনকে পার্টির পদানত করে, পার্টির নেতাদের দায়িত্বহীন ক্ষমতা ভোগের নীতি অনুসারে।
রাজ্য স্তরে যেমন সিপিআইএম-এর রাজ্য নেতা, জেলা স্তরে জেলা নেতা, তেমনি মহকুমা এবং থানা স্তরে সিপিআইএম-এর মহকুমা এবং থানা স্তরের নেতারাই ঠিক করেন কে কোন পদে থাকবে। কে কী করবে, কী করবে না। এই নেতাদের ক্ষমতার জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। অর্থাৎ এঁরা দায়িত্বহীন অসীম ক্ষমতা ভোগ করেন। আর দেশের আইন অনুসারে যাদের দায়িত্ব সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিজি, সিপি, এসপি, ওসি-দের কোনো ক্ষমতা থাকে না। সিপিআইএম-এর নেতারা যা আদেশ করেন, পুলিশের ডিজি, সিপি, এসপি, ওসি-রা তা-ই করেন।
যাঁদের সামান্যতম সম্মান এবং ন্যায়-অন্যায় বোধ আছে তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ফলে সৎ এবং আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন অফিসাররা দায়িত্বপূর্ণ পোস্টিং পান না। দলদাস অপদার্থরা দায়িত্বপূর্ণ পদে বসে, দলের চামচাগিরি করে। দলের প্রতি অনুগত ইউনিয়নের নেতাদেরও চামচাগিরি করে। কী রকম হয় এই দলদাসরা? নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য যে কোনো ধরনের বেআইনি কাজ করতে প্রস্তুত। নীতিবোধ, অধীনস্থ লোকদের স্বার্থ দেখা এদের কাছে বোকামি।
ফলে নিচের লোকেরা, যারা কোনো রাজনৈতিক চামচাগিরি না করে সোজাসুজি কাজটুকু করতে চায় তারা এ এই সব চামচা অফিসার এবং ইউনিয়নের পাণ্ডাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। তারা দেখে, প্রায় সব অপরাধীরাই হয় শাসক দলের স্নেহধন্য নয় অফিসারদের হপ্তাপ্রদানকারী। তাদের গায়ে হাত দেওয়া মানে হেনস্তার শিকার হওয়া। বারাসত কাণ্ডে, বাংলোতে পুলিশের লোকেদের মহিলার কাতর আবেদনে সাড়া না দেওয়ার কারণ সেটা কি না, তা দেখতে হবে। যারা কটুক্তি, শ্লীলতাহানি এবং খুন করেছে তারা যে শাসক দলের স্নেহধন্য তা তো জানাও গিয়েছে। পুলিশ চন্দন রায়কে গ্রেফতার করেছে। “পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকা দখল, প্রমোটারি এবং বিভিন্ন ভোটে চন্দনের দলবলকে কাজে লাগালোর অভিযোগ রয়েছে বলে সিপিএমের বিরুদ্ধে। বারাসাতের আশপাশের চোলাই কারবারিদের পিছনেও সিপিএম নেতাদের মদত রয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।”৭
প্রশাসনকে পার্টির নেতাদের পদানত এবং সাধারণ মানুষের জন্য পঙ্গু করে দেওয়ার সব থেকে বড় ফল হল নেতাই কাণ্ড। বিরোধী পক্ষের কোনো লোক বেআইনি অস্ত্রের ব্যবহার করলে, তাকে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। এলাকা দখলের জন্য সিপিআইএম-এর নেতারা বেআইনি অস্ত্র দিয়ে, বাইরের গুণ্ডা-বদমাশদের ভাড়া করে এনে, অস্ত্র শিবির করে রেখেছে। সেখানে গ্রামের লোকদের বেআইনি অস্ত্রে প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুলিশ জেনেশুনেও কিছু করছে না। আর বিরোধী পক্ষের লোকেরা তার নিরস্ত্র প্রতিবাদ করতে গেলেও তাদের গুলি কজে মেরে ফেলা হচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারে?
নেতাই গ্রামের সিপিআইএম নেতা রথীন দন্ডপাটের দোতলা বাড়িতে সিপিআইএম পার্টি সশস্ত্র শিবির করেছিল। সে শিবিরের লোকেরা গ্রামের লোকদের পালা করে পাহারা দেওয়া এবং তাদের রান্না করে দেওয়ার কাজ করতে বাধ্য করছিল। বাধ্য করছিল যুবকদের বেআইনি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে। এতে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। তাই গ্রামের লোকেরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করার ঘোর বিরোধী ছিল। বিরোধিতার আরও বড় কারণ ছিল।
অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের সিপিআইএম নেতারা বিভিন্ন জায়গায় এলাকা দখলের জন্য পাঠায়। তারা মারা গেলে, কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে, তাদের লাশ গায়েব করে দেয়। বাড়ির লোকেরা তার মরা মুখও দেখতে পায় না। সমাধিস্থ করার সুযোগও পায় না।
২৫-১২-২০১১ তারিখের একটা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়, “এতদিন ধরে গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক দুষ্কৃতীরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে ধরা পড়ে দাবি করত সিপিএমের নেতাদের চাপেই তারা যাবতীয় কুকীর্তি করতে বাধ্য হয়েছে। আর এবার সেটাই হাতেনাতে প্রমাণিত হল। সুনিয়াকে কেন্দ্র করে খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনর্দখল করার জন্য জঙ্গলমহল থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল সশস্ত্র হার্মাদদের। মানুষের প্রতিরোধে ভাড়াটে হার্মাদদের সঙ্গে সিপিএমের নিজস্ব হার্মাদ বাহিনী রীতিমতো পালিয়ে বেঁচেছিল। ধরা পড়ে ভাড়াটে হার্মাদরা যাতে জনসমক্ষে সিপিএমের অ্যাকশন প্ল্যান যাতে ফাঁস না করে দিতে পারে সে কারণে যাবতীয় প্রমাণ লোপাটের জন্য পরিকল্পনামাফিক তাদের খুন করে চরের মাটিতে পুঁতে রেখেছিল স্থানীয় সিপিএম হার্মাদরা। এবার মাটির নিচের পুঁতে রাখা সেই পচাগলা মৃতদেহগুলি তুলে শতাধিক টুকরো করে কুচিয়ে সুনিয়ার চরাভূমি ও রসুলপুর নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে কয়েকশো গ্রামবাসীর সামনেই বৃহস্পতিবার সকালে নৃশংস এইরকম ঘটনাটি ঘটেছে সশস্ত্র হার্মাদবাহিনীর নেতৃত্বে।”
ফলে গ্রামের লোকেরা যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠাতে রাজি ছিল না।
০৭-০১-২০১১ তারিখে সকলে মিলে শলাপরামর্শ করে গ্রামবাসীরা শিবিরে যায়। অনেক লোক জড়ো হতে দেখে বেআইনি আগ্নেয়অস্ত্রধারী দুষ্কৃতীরা বিপন্ন বোধ করে থাকবে। তারা নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। ৭ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়। একজন মহিলার মাথার খুপড়ি উড়ে যায়। প্রায় সব টিভি চ্যানেলে এবং খবরের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর হয়।৯ আহতদের মধ্যে আরও ২ জন পরে মারা যায়।
রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের পঙ্গুত্ব আরও বেশি করে প্রকট হয়ে পড়ে এই মামলার তদন্তের নামে শাসক দলের নেতাদের পদলেহন করতে। বিরোধীরা সিবিআই তদন্তের দাবি করে হাইকোর্টে আবেদন করেছিল। রাজ্য সরকার সিআইডিকে তদন্তভার তুলে দিয়েছিল। হাইকোর্ট প্রথমেই সিবিআই তদন্তের আদেশ দেয়নি। কিন্তু ছ’সপ্তাহে সিআইডি এরকম একটা (যাতে শাসক দল সিপিআইএম-এর আদেশে, বেআইনি অস্ত্র নিয়ে বেআইনি। শিবিরে থাকা সিপিআইএম-এর ভাড়াটে গুণ্ডাদের গুলিতে ৯জন নিহত এবং তার দ্বিগুণ লোক গুলিবিদ্ধ হয়েছে) মামলার তদন্ত যেভাবে করেছে তাতে হাইকোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি জে এন প্যাটেল এবং বিচারপতি এ কে রায়ের বেঞ্চ অসন্তোষ প্রকাশ করে মামলার তদন্তভার অনতিবিলম্বে সিবিআই-এর হাতে তুলে দিয়েছে। বেঞ্চের বিচারপতিদ্বয়ের মনে হয়েছে যে, সিপিআইএম-এর জড়িত থাকার যথেষ্ট তথ্য আছে, সিপিআইএম-এর লোকাল কমিটির নির্দেশেই সশস্ত্র শিবির করা হয়েছিল, অবনী ধরা পড়ার পরও সিআইডি শিবিরের লোকদের পরিচয় বের করতে পারেনি, বের করতে পারেনি রথীন দণ্ডপাটের বাড়িতে এত অস্ত্র কোথা থেকে কে নিয়ে এল, পুলিশ সক্রিয় ও নিরপেক্ষ নয়, পুলিশ ও সিআইডি নপুংসকের মতো কাজ করেছে, সিপিআইএমএর প্রভাবমুক্ত হয়ে সিআইডি তদন্ত করতে এবং সিপিআইএম-এর জড়িত নেতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।১০ এরপরেও মামলার তদন্তভার সিআইডি-র হাতে থাকলে আহত-নিহতরা বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বারাসাত কাণ্ডের পর, প্রশাসনের ব্যর্থতায় প্রলেপ লাগাতে, তড়িঘড়ি বারাসাতে নিহত রাজীব দাস ও লাঞ্ছিতা রিঙ্কু দাসদের বাড়িতে যান মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ নির্লজ্জ রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়েছে।১১ নেতাইয়ের ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তুলেছে, “নেতাইয়ে আসেননি কেন?১২
গুণ্ডা-বদমাশরা গুলি-বন্দুক নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে। অন্য লোকদের উপর জোর করবে। পুলিশ কোনো ব্যবস্থাই নেবে না। এই অবস্থাটা শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ পছন্দ করতে পারে না। দেশে আইনের শাসন না থাকলে, প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ, নিরপেক্ষ ও সক্রিয় না হলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব সাধারণ মানুষেরা, যাদের জন্য সুপারিশ করার কেউ নেই। তার জন্যই সাধারণ গরিব মানুষেরা বামফ্রন্টের থেকে সরে গেছে। মুসলমানদের অধিকাংশই গরিব। শিক্ষায় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠায় তারা তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির লোকদের থেকেও পিছিয়ে। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাও বামপন্থীদের থেকে সরে গেছে। তাদের ধারণা, সিপিআইএমএর শাসনে বিচার পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ।
মনে করার কারণও আছে। অপরাধীদের সঙ্গে সিপিআইএম নেতাদের দহরমমহরম এখন প্রকাশ্যেই। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এ রাজ্যের জেলাগুলিতে, অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে, এই জেলাগুলি থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার হয়। যদি পার্টি এবং প্রশাসন মনে করে, এটা সমর্থনযোগ্য নয়। বন্ধ করে দিন। আর যদি মনে করেন যে, বন্ধ করার দরকার নেই, তা হলে করতে দিন। তাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করবেন না। কিন্তু দুটোর একটাও না করে, যারা পাচার করছে, তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করার জন্য ‘ডাক মাস্টার’ নিযুক্ত করছেন। তারা পাচারকারীদের কাছ থেকে যে টাকা আদায় করে দিচ্ছে তার ৪০ শতাংশ পুলিশের নেতারা নিচ্ছেন। আর ৬০ শতাংশ নিচ্ছেন পার্টির নেতারা। পার্টি আর পুলিশের অনুমোদন পেয়ে ‘ডাক মাস্টার’রা প্রকাশ্য রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে সাধারণ লোকের সামনে ঘুষ আদায় করছে। যদি দেখতে চান, আমাদের গ্রামেই চলে যান। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সব মানুষই দেখছে। তারা কি মানতে রাজি হবে, পার্টি ও তার প্রশাসন মানবিক, ন্যায়? বামফ্রন্টের থেকে মুসলমানদের সরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল, মুসলমানদের একটা বড় অংশ মনে করে যে, মুসলমানদের সরকারি চাকরি এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের ২৫.২৫ শতাংশ লোক মুসলমান। মুসলমানরা যেহেতু শিক্ষায় এবং প্রতিষ্ঠার রাজ্যের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে তো বটেই, রাজ্যের তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির লোকদের থেকেও পিছিয়ে, তাদের বৃদ্ধির হার বেশি হবে। কাজেই ২০১১ সালে যে লোকগণনা হচ্ছে তাতে তাদের সংখ্যা ২৫.২৫-এর থেকে কম হবে না, বেশিই হবে। কিন্তু ২০০৬ সালে পেশ করা সাচার কমিটির রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরির মাত্র ২.১ শতাংশ মুসলমানদের হাতে। বামফ্রন্টের নেতারা প্রথমে বলার চেষ্টা করেছিল, সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পায়নি। সেটা প্রমাণ করার জন্য রাজ্য সরকারের নেতারা আলাদা সমীক্ষাও করায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের উদ্যোগে করা সমীক্ষা সাচার কমিটির রিপোর্টকে সত্য প্রমাণ করে।১৩
মুসলমানরা যে সরকারি চাকরি এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তা বোঝার জন্য সরকারি প্রতিবেদন দেখারও দরকার নেই। খোলা চোখেও দেখা যায়। রাজ্যে মুসলমানদের শতাংশ ২৫-এর বেশি। অর্থাৎ রাজ্যের চার জনের একজন মুসলমান। তা হলে, সমতা ও সমান অধিকারের পরিস্থিতিতে, প্রতি চারটি পদের একটিতে মুসলমানের থাকার কথা। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি বা কোলকাতা পুলিশের কমিশনার পদে কোনো মুসলমানকে কখনও দেখেছেন কি?
শুধু আসাম নয়, বিহার, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে মুসলমানদের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে। বিহারে স্বরাষ্ট্র সচিব, মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার, হায়দরাবাদের পুলিশ কমিশনার, এমনকী যে নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের জন্য এ রাজ্যের বাম নেতারা এত ব্যথা অনুভব করেন, সেই গুজরাটেও মুসলমানকে ডিজি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। এ রাজ্যের শাসক দলের লোকেরা সভাসমিতিতে বক্তৃতাতে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন। মুসলমানদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলেন। এমনকী সরকারি অর্থ ব্যয় করে খবরের কাগজে পাতা-ভরা এবং টিভির পর্দায় পর্দাভরা বিজ্ঞাপনও দেন। কিন্তু সেই পর্যন্তই। কাজে করেন তার উল্টো। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রাজ্য মন্ত্রিসভা।
সপ্তম বার ভোটে জিতে বামফ্রন্ট সে মন্ত্রিসভা গঠন করে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী সমেত ৪৩ জনের মন্ত্রিসভায় মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৫। অর্থাৎ মাত্র ১১.৬ শতাংশ। যা থাকার কথা ছিল তার অর্ধেকেরও কম। মুসলমান জনসংখ্যা ২৫.২৫ শতাংশ। মুসলমান মন্ত্রী ১১.৬ শতাংশ। কেন? মন্ত্রী করার জন্য তো কোনো উচ্চ ডিগ্রি লাগে না। তা হলে মন্ত্রিসভায় মুসলমানদের সংখ্যা এত কম কেন?
পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণদের ২ শতাংশেরও কম। কিন্তু ৪৩ জনের মন্ত্রিসভায় ১৫জন, অর্থাৎ ৩৪.৯ শতাংশ ব্রাহ্মণ। অর্থাৎ জনসংখ্যার অনুপাতে যা হওয়ার কথা তার ১৭.৫ গুণ। বৈদ্য-কায়স্থ ৯ জন, অর্থাৎ ২০.৯ শতাংশ। ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ মিলে ২৪ জন, অর্থাৎ ৫৫.৮ শতাংশ। যার জন্য শুধু মুসলমান নয়, তথাকথিত নিম্নবর্গের হিন্দুদের, তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং বিভিন্ন আদিবাসীদেরও সংখ্যার অনুপাতে মন্ত্রীসভায় স্থান হয়নি। সিপিএম তথা অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যে অসন্তোষ দানা বেধেছে, তার অন্যতম কারণ এই নিষ্ঠুর বঞ্চনা।
শুধু মন্ত্রী সভায় নয়, রাজ্যে এমএলএ-এমপি-দের মধ্যেও মুসলমানদের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক কম। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪ সদস্যের মধ্যে মুসলমান মাত্র ৪১ জন। অর্থাৎ মাত্র ১৩.৯ শতাংশ। মুসলমান জনসংখ্যা ২৫.২৫ শতাংশ। মুসলমান এমএলএ ১৩.৯ শতাংশ। বামফ্রন্টের ২৩৫ জন এমএলএ-এর মধ্যে মাত্র ৩১ জন, অর্থাৎ মাত্র ১৩.২ শতাংশ মুসলমান। তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেসের ৪৭ জন এমএলএ-এর মধ্যে ১০জন, অর্থাৎ ২১.৩ শতাংশ মুসলমান। রাজ্যের ৪২ জন লোকসভা সদস্যের মধ্যে, কবীর সুমনকে ধরে, ৭জন, অর্থাৎ ১৬.৬ শতাংশ মুসলমান। রাজ্যের ৪২ জন লোকসভা সদস্যের মধ্যে, কবীর সুমনকে ধরে, ৭ জন, অর্থাৎ ১৬.৬ শতাংশ মুসলমান। বামপন্থীদের ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন, অর্থাৎ ৬.৬ শতাংশ মুসলমান। তৃণমূল কংগ্রেস-এসইউসিআই-কংগ্রেসের ২৬ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন, অর্থাৎ ২৩.১ শতাংশ মুসলমান।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। তা হল এমএলএ এবং এমপি-দের মধ্যে মুসলমানদের হার তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস থেকে বামপন্থীদের মধ্যে অনেক অনেক কম। চার্টে দেখলে সংখ্যাগুলো নিম্নরূপ :
জনসংখ্যা/এমএলএ/এমপি মুসলমানদের শতাংশ
জনসংখ্যা | ২৫.২৫ |
এমএলএ | বামফ্রন্ট ১৩.২, তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেস ২১.৩ |
এমপি | বামফ্রন্ট ৬.৬, তৃণমূল কংগ্রেস-এসইউপিআই কংগ্রেস ২৩.১ |
শুধু তাই নয়। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে মুসলমানদের উপস্থিতি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মুর্শিদাবাদ জেলার কথা ধরা যাক।
মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০০১ সালের লোক গণনা অনুসারে এ জেলার ৬৩.৬৭ শতাংশ লোক মুসলমান। আর ভারতবর্ষের সব জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলায় সব থেকে বেশি সংখ্যক মুসলমান বাস করে। অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ জেলায় যত মুসলমান বাস করে, দেশের আর কোনো জেলায় তত বেশি মুসলমান বাস করে না। সেই জেলার রাজনৈতিক দলগুলির সর্বোচ্চ পদে কারা বসে আছেন? আমি নিচে নামগুলি দিচ্ছি :
রাজনৈতিক দলের নাম | সর্বোচ্চ পদাধিকারী (সভাপতি/সম্পাদক)১৪ |
সিপিআইএম | নৃপেন চৌধুরি (সম্পাদক) |
সিপিআই | হারাধন দাস (সম্পাদক) |
আরএসপি | বিশ্বনাথ ব্যানার্জী (সম্পাদক) |
ফরওয়ার্ড ব্লক | বিভাস চক্রবর্তী (সম্পাদক) |
জনবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক | জয়ন্ত রায় (সম্পাদক) |
সমাজবাদী পার্টি | তুষার চ্যাটার্জী (সম্পাদক) |
এসইউসিআই | সাধন রায় (সম্পাদক) |
তৃণমূল কংগ্রেস | সুব্রত সাহা (সভাপতি) |
কংগ্রেস | অধীর চৌধুরি (সভাপতি) |
বিজেপি | মালা ভট্টাচার্য (সভাপতি) |
যে জেলায় মুসলমানরা বহুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬৩.৬৭ শতাংশ), যে জেলায় সারা দেশের সমস্ত জেলার মধ্যে একটি জেলায় সব থেকে বেশি মুসলমান বাস করে, সেই জেলার ৭টি বামপন্থী ও ৩টি ডানপন্থী দলের কোনো একটি দলও সে দলের সর্বোচ্চ পদে বসানোর জন্য একজন মুসলমানকে যোগ্য মনে করতে পারেনি।
এ জেলার ডোমকল ব্লকে মুসলমানদের শতাংশ সবথেকে বেশি (৮৭.২৪ শতাংশ)। ব্লকে সিপিআইএম-এর সর্বোচ্চ নেতা নারায়ণ দাস, কংগ্রেসের শাঁওলি সিংহরায়। অথচ সিপিআইএম-কংগ্রেসে মারামারিতে যারা নিহত বা আহত হয়েছে তাদের অধিকাংশ মুসলমান। ১০-১২-২০১০ তারিখে ডোমকল ব্লকের গড়াইমারি গ্রামে কংগ্রেস-সিপিআইএম-এ যে মারামারি হয়, তাতে সিপিআইএম পক্ষে খুন হয় মুসলমান মানিক মণ্ডল, কংগ্রেসের পক্ষে খুন হয় মুসলমান আবুল হোসেন। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মুসলমানরা শাসক, বিরোধী উভয়পক্ষের লেঠেল বাহিনী হয়েছে। আর উভয়পক্ষের নেতা হয়েছেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা।
প্রণব মুখার্জী আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একই সভায় বসে একে অপরের প্রশংসা করছেন। একই সঙ্গে খানাপিনা করছেন। আর তাদের নেতা করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা মারামারি করে জীবজন্তুর মতো মরছে।
শাসক দলের লোকেরা এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ তাদের শাসনকালে যে ছেলেমেয়েরা জন্মেছে তারা এখন ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক-যুবতী। তাদের কোনো শুধু দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী বানিয়েই রাখা হয়েছে?
বামফ্রন্টের, বিশেষ করে সিপিআইএম-এর উপর সাধারণ মানুষ যে অত্যন্ত রুষ্ট তার অন্যতম কারণ হল, সিপিআইএম নেতারা সমাজের সর্বক্ষেত্রে তারা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, লুটেপুটে খেতে চান। কিছু করতে হলে তারাই করবেন। অন্তত তাঁদের অধীনতা মেনে নিয়ে করতে হবে। না হলে কিছু করতে দেওয়া হবে না।
যদি সিপিআইএম নেতাদের সভা-সমিতিতে যদি বক্তৃতা শোনেন, সরকারি অর্থ খরচ করে দেওয়া খবরের কাগজের পাতা-ভরা, আর টিভিতে পর্দা-ভরা বিজ্ঞাপন দেখেন। তা হলে আপনার মনে হবে যে, মুসলমানদের উন্নতির জন্য তারা এত চিন্তিত যে, রাত্রিতে ভালো করে ঘুমোতেও পারছেন না। ঘুমোলেও হাল্কা ঘুমের মধ্যে মুসলমানদের উন্নতির কথা চিন্তা করছেন। কিন্তু কাজে করছেন প্রতারণা। বরং কেউ কিছু করতে গেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।
সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলমানদের এতটা পশ্চাদপদতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক যুযোপযোগী শিক্ষার অভাবকে। রিপোর্ট অনুসারে, রাজ্যের মুসলমানরা তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতির লোকদের থেকেও শিক্ষায় পিছিয়ে। কতটা পিছিয়ে তা নিচের চার্টে একবার নজর রাখলেই বোঝা যাবে।১৫
শিক্ষার স্তর | সম্প্রদায় | শতাংশ |
প্রাথমিক উত্তীর্ণ | মুসলমান | ৫০.৩ |
তফসিলি জাতি/তফসিলি উপজাতি | ৫৪.৪ | |
উচ্চবর্ণের হিন্দু ও অন্যান্য | ৮০.৪ | |
উচ্চতর প্রাথমিক (৮ম মান) | মুসলমান | ২৬ |
তফসিলি জাতি/তফসিলি উপজাতি | ২৯.৯ | |
উচ্চবর্ণের হিন্দু ও অন্যান্য | ৫৮.১ | |
মাধ্যমিক | মুসলমান | ১১.৯ |
তফসিলি জাতি/তফসিলি উপজাতি | ১৩.১ | |
উচ্চবর্ণের হিন্দু ও অন্যান্য | ৩৮ | |
স্নাতক | মুসলমান | ৩ |
তফসিলি জাতি/তফসিলি উপজাতি | ৩.৫ | |
উচ্চবর্ণের হিন্দু ও অন্যান্য | ১৪ |
মুসলমানরা শিক্ষায় এত পিছিয়ে কেন? হাজার জনের হাজার মত থাকতে পারে। আমি একটি মুসলমান প্রধান এলাকার মুসলমান নিরক্ষর দরিদ্র পরিবারে জন্মে, তাদের সঙ্গে বেড়ে উঠে, উচ্চশিক্ষিত-প্রতিষ্ঠিত হয়েও তাদের সঙ্গ থেকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, মুসলমানদের শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার সব থেকে বড় কারণ মুসলমান প্রধান এলাকায় বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত অভাব এবং ছেলেমেয়েদের দূরে ছাত্রাবাসে রেখে পড়াশোর মতো আর্থিক সঙ্গতি অধিকাংশ মুসলমানদের না থাকা। আমি মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল ব্লকের বসন্তপুর গ্রামে জন্মেছি।
মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলমানদের শতাংশ ৬৩.৬৭। এ জেলায় তখনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, এখনও নেই। ডোমকল ব্লকে মুসলমানদের শতাংশ ৮৭.২৪। এ ব্লকে তখন কোনো মহাবিদ্যালয় ছিল না। আমরা একটা বেসরকারি উদ্যোগে করেছি। বসন্তপুর গ্রামে মুসলমানদের শতাংশ ১০০ গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অধিকাংশ মুসলমানই গরীব কৃষি মজুর, না হলে ভাগচাষি। এলাকার জমি ডোমকলের বা বাজিতপুরের বা ভাগীরথপুরের বাবুদের। মুসলমানদের পড়াশোনা হবে কী করে?
তাই আমি আমার সীমিত ক্ষমতায়, এলাকায় কিছু স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি করার প্রচেষ্টা করি। আমার আনন্দ পুরস্কারের টাকা এবং বইয়ের রয়্যালটির টাকা দিয়ে জমি কিনে প্রথমে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল করা হয়। কলেজ করতে এলাকার লোকেরা মুক্ত হস্তে সাহায্য করে। কলেজ হয়। ব্যাঙ্ক থেকে তিন কোটি টাকা লোন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পলিটেকনিক হয়। পিটিটিআই হয়। নার্সারি থেকে টুয়েলভ সায়েন্স পর্যন্ত রেসিডেন্সিয়াল স্কুল হয়। কিন্তু সিপিআইএম নেতারা তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। কীরকম বিরোধিতা? আমি দুয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। স্কুল-কলেজ-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজপলিটেকনিক-পিটিটিআই করার পর আমরা একটা বিএড কলেজ করার জন্য আবেদন করলাম। রাজ্য ‘হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল’-এর ইন্সপেকশান টিম আমাদের পক্ষে রিপোর্ট দিল। এবার এনসিটিই-র রিকগনিশনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে। তার জন্য তখন রাজ্য সরকারের নো অবজেকশান সার্টিফিকেট নিতে হত।১৬
‘নো অবজেকশান সার্টিফিকেট’-এর জন্য আমরা রাজ্য সরকারের কাছে দরখাস্ত করলাম। প্রথম বছর বহরমপুরে একটা কলেজ করার জন্য সিপিআইএম পার্টির এক নেতাকে দেওয়া হল। হায়ার এডুকেশন কাউন্সিলের অনুকূলে রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে দেওয়া হল না। পরের বছর এক সিপিআইএম নেতার অনুরোধে পাশের ব্লকের একটি সংস্থাকে দেওয়া হল। আমাদেরকে দেওয়া হল না। তৃতীয় বছরও যখন আমি উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সিএ-র সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তিনি আমাকে ইঙ্গিতে জেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। আমি প্রথমে ডোমকলের নেতাদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জেলা নেতার সঙ্গে কথা বলতে বললেন। আমি কয়েকদিন গিয়েও জেলা সম্পাদক নৃপেন চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। ফোন করলাম। প্রথমবার বললেন দেখবেন। আমি বিকাশভবনে গেলাম। জানলাম, জেলা থেকে সম্মতি আসেনি। আবার ফোন করলাম। জেলা নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, “আপনার মতো শুধু ডোমকল নিয়ে থাকলে আমাদের চলে না। আমাদের গোটা জেলা দেখতে হয়!” আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ডোমকলটাও জেলার মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না।
ওই সময় একটা ঘটনা উপলক্ষে সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার জন্য মন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লা আমাকে অনিল বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। সিপিআইএম-এর উপর আমার এত ক্ষোভ কেন তা জানতে চাইলে আমি অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে আমাদের বিএড কলেজ করার পথে পার্টির বাধার কথা উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, স্থানীয় পার্টির নেতারা আমাকে বলেছেন, ওখানে কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, পিটিটিআই, এরকম অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এরপর আবার বিএড কলেজ হলে অন্যান্য এলাকার লোকেরা অসন্তুষ্ট হচ্ছে। আমি তাকে বললাম, অন্যান্য এলাকায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং সে এলাকার লোকেরা চাইলে আমি তাদের সঙ্গে থেকে পরিশ্রম করে দিতেও রাজি আছি। আর ঘটনাচক্রে তার বাড়ি ছিল নদিয়া জেলা। আমি বললাম, নদিয়া জেলায় ইতিমধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি’র স্থানও ওই জেলার হরিণঘাটায় নির্বাচন করা হয়েছে। কই তখন তো আপনার পার্টির নেতারা বলছেন না যে, নদিয়া জেলায় ইতিমধ্যে দু-দুটো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, টেকননালজি বিশ্ববিদ্যালয় তা হলে মুর্শিদাবাদে হোক। তা ছাড়া আমরা যে বিএড কলেজ করতে যাচ্ছি তা বেসরকারি। তাতে সরকারের এক পয়সা খরচ নেই। বরং ফিজ বাবদ সরকারের কিছু রোজগার হবে। আমাদের স্বার্থ, স্কুল সার্ভিস কমিশনের নির্বাচনে বিএড-এর জন্য নম্বর আছে, এলাকার এমন ছেলেমেয়েদের বিএড পাস করলে সরকার অনুমোদিত স্কুলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। তাতে আপনাদের পার্টি নেতারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন কেন? তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “আমাকে তো এভাবে কেউ বলেনি। সত্যি তো, বাধা দেওয়া উচিত নয়।”
তিনি সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীকে ফোন করলেন। তাকে না পেয়ে তার সিএ শৈলেনবাবুকে ফোন করলেন। রাজ্য সরকারের ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’-এই বলা ছিল, এনসিটিই রিকগনিশন দিলে ইউনিভার্সিটি ইন্সপেক্শন করে অ্যাফিলিয়েশন দেবে। আমরা বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে ইন্সপেক্শনের জন্য পাঠানো হল না। অন্যদিকে, পাশের ব্লকে, যেখানে সিপিআইএম নেতার আশীর্বাদ আছে, সেখানকার কলেজ তখনও এনসিটিই-র রিকগনিশন পায়নি। কিন্তু কল্যাণী ইউনিভার্সিটি ইন্সপেকশন করে সে কলেজকে অ্যাফিলিয়েশন দিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, এনসিটিইর টিম যখন ইন্সপেক্শনে এল, ইউনিভার্সিটি তার প্রতিনিধি পাঠাল। আমাদের ইন্সপেকশনের সময় সনির্বন্ধ অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে ইউনিভার্সিটি কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। আমাদের কলেজ এনসিটিই রিকগনিশন পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের কলেজ ইন্সপেক্শন টিম পাঠায়নি। এতটা পক্ষপাতিত্ব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর পার্টির নেতাদের এতটা অন্যায় প্রভাব সাধারণ লোক কেন সহ্য করবে?
আমি ভাইস চ্যান্সেলরকে ফোন করে বললাম, কোনো পাবলিক পোস্টে বসে তিনি এ রকম জঘন্য অন্যায় কাজ করতে পারেন কি? তিনি সবিনয়ে আমাকে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বললেন। আমি ফোন করলাম। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী বললেন, “আমরা তো ‘নো অবজেকশান সর্টিফিকেট’ দিয়েই দিয়েছি। তাতে যা বলার বলেও দিয়েছি। আবার আমাদের বলছেন কেন?” এ কথা ঠিকই যে, ‘নো অবজেকশান সর্টিফিকেট’এ বলা আছে যে, এনসিটিই রিকগনিশন দিলে ইউনিভার্সিটি ইন্সপেকশন করে অ্যাফিলিয়েশন দেবে। আমি আবার ভিসি-কে ফোন করলাম। উনি আবার আমাকে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিলেন। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী আবার আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন।
আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ হল। মনে হল, মামলা করতে হবে। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বললেন, “মামলা করলে আমরা অবশ্যই শুধু হারব না, তিরস্কৃতও হব। আপনি জিতবেন। কিন্তু মামলা করার আগে আপনি একবার নেতাদের সঙ্গে কথা বলুন না।” তিনি দু’জনের নাম এবং টেলিফোন নম্বর দিলেন। কিন্তু তাদের কারওর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পর, বিমান বসু তখন সিপিআইএম পার্টির রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন। বিদ্যাসাগর মেলায় তিনি একবার আমাকে বলার জন্য ডেকেছিলেন। সেই থেকে আলাপ। আমি জানতে চাইলাম, তার সঙ্গে কথা বললে হবে কি না। তিনি বললেন, “অত উপরে যাবেন? নিচের দিকে কথা বললেই হয়ে যেত। দেখুন, আপনার ব্যাপার।”
আমি বিমানবাবুকে ফোন করে সব বললাম। শুনে তিনি আমার কাছে দু’দিন সময় চাইলেন। দু’দিন পরে ফোন করলাম। তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন। রাতের বেলা নিজেই ফোন করে জানালেন, আমি উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, ভিসি দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেছি। আশা করছি আর অসুবিধা হবে না। অসুবিধা হল না। দু’একদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে পাঠাল। অ্যাফিলিয়েশনও দিয়ে দিল।
কিন্তু কলেজের জন্য ‘নো অবজেকশান সার্টিফিকেট’ নিতে, ‘অ্যাফিলিয়েশন’ পেতে বারবার পার্টির নেতাদের কাছে মাথা ঘষটে মরতে হবে কেন? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো পদমর্যাদার লোকেরা ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে পার্টির নেতাদের অঙ্গুলি হেলনে শুধু অনৈতিক নয় বেআইনি কাজ করবেন? যদি করেন, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ লোক চলে যাবে না কেন?
২০০৭ সালের ১৩ মার্চ, আমাদের ‘বসন্তপুর এডুকেশন সোসাইটি’-র পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী, উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, এবং সংশ্লিষ্ট আর সকলের কাছে মুর্শিদাবাদ জেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য আবেদন করি। তাতে আমরা জানাই যে, রাজ্য সরকারের আর্থিক অসুবিধা থাকলে, আমরা নিজেরা নিজেদের জমিতে, নিজেদের খরচে বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে তৈরি আছি। আমাদের শুধু আইন পাস করে অনুমতিটা দেওয়া হোক। তার জন্য সরকার যে শর্ত দেবে, আমরা তা মেনে নেব। সরকারের কাছে আমরা এক কাঠা জমিও চাই না। এক টাকা অর্থ চাই না। শুধু অনুমতিটুকু চাই।
কোনো উত্তর না পেয়ে, ২০০৮ সালের ৪ জানুয়ারি আবার চিঠি দিই। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চাই। মুখ্যমন্ত্রী উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় চাই। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আবার মুখ্যমন্ত্রীর সময় চাই। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে তার প্রধান সচিব থেকে নিচের অনেক লোকের কাছে অনেকবার অনুরোধ করি। যে মুখ্যমন্ত্রী মুসলমানদের উন্নতি জন্য কাগজে টিভিতে, লক্ষ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, তিনি তাকে এক মিনিট সময় দিতে পারে না, যে মুর্শিদাবাদের মতো একটা পিছিয়ে থাকা মুসলমান প্রধান জেলায় নিজের খরচে বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাইছে।
তার মানে এই নয় যে, তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে তার সরকার মুম্বাইএর ধীরুভাই আম্বানি ট্রাস্টকে কল্যাণীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার অনুমতি দিয়ে আইন পাস করল। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য বিনা পয়সায় বা খুব কম পয়সায় তাদেরকে জমি দেওয়ারও একটা প্রস্তাবও আছে। আমি প্রস্তাবের কপি পেলাম না। আইনের কপি জোগাড় করলাম। আবার মুখ্যমন্ত্রী-উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা, করার চেষ্টা করলাম। কেউ দেখা করতে, এমনকী কথা বলতেও রাজি হলেন না। উচ্চশিক্ষামন্ত্রী শুধু এটুকু বললেন যে, মুর্শিদাবাদে আমরা ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’র একটা ক্যাম্পাস করছি। খবরের কাগজেও খবর বের হল যে, মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’র একটা ক্যাম্পাস করার মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন করেছে।
২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি, আমি মুখ্যমন্ত্রীকে আবার চিঠি লিখলাম। কোনো উত্তর পেলাম না।
বাধ্য হয়ে আমি মুখ্যসচিবের কাছে সময় চাইলাম। তার সঙ্গে দেখা করে, মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি করিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে উচ্চশিক্ষা সচিবের কাছে একটা আবেদন করতে পরামর্শ দিলেন। তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, তাঁকে তিনি বলে রাখবেন, যাতে উচ্চশিক্ষা সচিব আমার আবেদন সে বিভাগ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তা না করতে পারলে অন্তত একটা উত্তর দেন, যাতে তিনি ব্যাপারটা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
২০০৯ সালের ২১ মে আমি আবেদন করলাম। তাতে এ কথা পরিষ্কার করে জানালাম যে, সরকার যদি ওই জেলায় ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’র একটা ক্যাম্পাস করেও, তাতেও বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। নদিয়া জেলায় ২টি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ছিল। আরও একটা হচ্ছে। তারপরও আম্বানিদের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দেখাও করলাম। কোনো ফল হল না। তিনি আমাদের আবেদনের ভিত্তিতে কিছু করলেনও না। কোনো উত্তরও দিলেন না। সে মুখ্য সচিব অবসরে চলে গেলেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন মুখ্যমন্ত্রী, উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, উচ্চশিক্ষা সচিবের কাছে পড়ে থাকল।
আমি গত্যন্তর না দেখে বিমান বসুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। তিনি সেদিন সন্ধেবেলাতেই সময় দিলেন। দেখা করে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম। রাজ্য সরকার মুম্বই-এর একটা ট্রাস্টকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার অনুমতি দিয়ে ইতিমধ্যেই আইন পাস করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জমি দেওয়ারও প্রস্তাব আছে। আমরা এ রাজ্যের লোক। আমরা লিখিতভাবে দিয়েছি, আমরা জমি চাই না, টাকা চাই না। শুধু অনুমতিটুকু পেলেই নিজেরা জমি-টাকা জোগাড় করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ব। যেখানে ভিন রাজ্যের একটা ট্রাস্টকে এই অনুমোদন ইতিমধ্যেই দিয়েছে। তাদেরকে জমিও দিতে চাইছে, সেখানে এই রাজ্যে আমাদের এই অনুমতি না দেওয়া মার্কসবাদ বা সাম্যবাদ সুবিধাবাদ ছাড়া কোনো বাদ অনুসারে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমি তাকে এটাও ব্যাখা করে বললাম যে, জেলায় ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’র ক্যাম্পাস হলেও সরকারের কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কারণ, নদিয়ায় ইতিমধ্যে ২টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা এবং আরও একটি হতে থাকা জেলায় আম্বানিদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার অনুমতি দিতে সরকারের আপত্তি হয়নি। তিনি আমার যুক্তি অস্বীকার করতে পারলেন না। শুধু ক’দিন সময় চাইলেন। কদিন পরে ফোন করলে, তিনি তার অক্ষমতা প্রকাশ করলেন।
আমার বিনীত প্রশ্ন, মুম্বই-এর আম্বানিদের যদি এ রাজ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সুযোগ দিতে পারে তা হলে আমাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে কেন? এটা মার্কসবাদের বা সাম্যবাদের কোনো নীতি সমর্থন করে? আম্বানিদের অনেক টাকা আছে, তাদের সুযোগ দিলে পার্টির নেতাদের বা পার্টি ফাণ্ডে প্রাপ্তিযোগ আছে। আমাদের কাছ থেকে সে যোগ নাই। এইটাই যদি বামফ্রন্ট সরকারের নীতি হয়, তবে সে ফ্রন্টের সঙ্গে সাধারণ গরিব মানুষ থাকবে কেন?
অনেক পয়সা খরচ করে, টিভির পর্দায়, ঘনঘন বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরাও ওবিসি হিসেবে সংরক্ষণ পাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার নবতম সংযোজন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম ২৪-০৯-২০১০ তারিখ বিজ্ঞপ্তি জাতি করে যে সংরক্ষণের ঘোষণা করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু দরখাস্ত জমা হতে পারে। ওই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ওবিসি সার্টিফিকেট পেয়ে সরকারি চাকরি পেয়েছেন, এমন ঘটনা আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার কী উন্নতি হবে, সেটা বোধগম্য নয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য যে ক’টি আধুনিক পাঠক্রম চালু হয়েছে তাতে যে কোনো স্কুল-কলেজ থেকে পাস করা যে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ভর্তি হতে পারবে। মাদ্রাসা ছাত্রদের আলাদা কোনো সুবিধা হবে না। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সামান্য যে ক’টি পদ সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য যে কোনো স্কুল-কলেজইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে যে কোনো ছেলে বা মেয়ে আবেদন করতে পারবে। মাদ্রাসা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো আলাদা সুবিধা থাকবে না।
অনুরূপভাবে মুর্শিদাবাদে গঠিত ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’র ক্যাম্পাসের জন্য মুসলমানদের আলাদা কোনো সুবিধা হবে না। সেখানে ভর্তি বা চাকরিলাভে মুসলমানদের জন্য আলাদা কোনো সংরক্ষণ থাকবে না। বরং কিছু অসুবিধাই হবে। কীরকম? তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করা এক প্রার্থী চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে ঢুকে নমস্কার জানাল। বোর্ডের এক মেম্বার মন্তব্য করল, অলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। ওখানে সালাম দেওয়া শেখানো হয় না? সেখানে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’ থেকে পাস করা আরও এক প্রার্থী ছিল। আগের প্রার্থীর কাছ থেকে জানার ফলে সে ঢুকে সালাম জানাল। একজন মেম্বার মন্তব্য করল, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন বলে সালাম দিচ্ছেন? তা ওখানে এই সবই শেখানো হয়, না অন্য কিছুও? চাকরির জন্য যখন ছেলেমেয়েরা ইন্টারভিউ দিতে যায় তখন তারা সাধারণভাবে খুব ‘টেন্সড’ থাকে। তখন এ রকম মন্তব্য তাদের অশ্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। ইন্টারভিউ খারাপ হয়। তাই সেকুলার নামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হলে ভালো হত।
সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে যে অধিকাংশ মুসলমান সমেত সাধারণ গরিব মানুষের চলে যাচ্ছে তার আরেকটি কারণ, সিপিআইএম নেতারা সমাজজীবনের সর্বত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যায় কাজ করেন। কিন্তু কেউ সেটা শোধরাতে গেলে তার সর্বনাশে পার্টিকে এবং পদানত প্রশাসনকে পুরোপুরি লাগিয়ে দেন।
সিপিআইএম-এর পুলিশ সংগঠন ‘নন-গেজেটেড পুলিশ কর্মচারী সমিতি’র কর্মকর্তা ২০০৫ সালে তাদের মুখপত্র, মঙ্গলপথ-এর শারদীয় সংখ্যায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য আমাকে লিখিতবাবে অনুরোধ করে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু বারবার এসে মৌখিকভাবে অনুরোধ করলে, আমি লিখি। প্রবন্ধে আমি পুলিশকে পার্টির যন্ত্রে পরিণত না করে, ভোটের সময় কোনো নির্দিষ্ট পার্টির হয়ে কাজ না করিয়ে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ করার জন্য লিখি। এটাও লিখি যে, পুলিশের পক্ষে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা তখনই সম্ভব হবে, যখন যাঁদের অধীনে তারা কাজ করে, তারা সৎ ও স্বচ্ছ হবেন। কিন্তু বাস্তবে যাঁদের অধীনে কাজ করতে হয়, তাদের বিরুদ্ধে অসততার কীরকম অভিযোগ আছে আমি তারও উল্লেখ করি। সিপিআইএম নেতা ও মন্ত্রীর নাম সে উল্লেখে ছিল। ছিল নির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ। সে অভিযোগ মিথ্যা, তা এখন পর্যন্ত কেউ বলেননি। কিন্তু আমি কেন এসব লিখেছি, তা নিয়ে শাসকদলের নেতারা প্রচণ্ড হইচই শুরু করেন। অনেক হম্বিতম্বি গালমন্দ করার পর হোম সেক্রেটারিকে দিয়ে আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি আমাকে বলেন যে, সরকারি চাকরিতে থেকে আমি সরকারের নীতির সমালোচনা করতে পারি না। আমি বলেছিলাম, আমি সরকারি কোনো নীতির সমালোচনা করিনি। দূর্নীতির বিরোধিতা করেছি। সরকার যদি বলে দুর্নীতিই সরকারের নীতি, আমি যে কোনো সাজা নিতে প্রস্তুত আছি। সরকার তা বলতে পারেনি। আমাকে সাজা দিতে পারেনি।
সরকারি কোনো নির্দেশে বলা নেই যে, আমি সরকারের দুর্নীতির বিরোধিতা করতে পারব না। বরং বলা আছে, আমার সঙ্গে এবং অধীনস্থ সরকারি কর্মচারীরা যাতে সভাবে কাজ করে তার জন্য আমাকে সবরকম চেষ্টা করতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, আমি এক লাইন লিখে দিই যে, সরকারের অনুমতি ছাড়া ভবিষ্যতে এরকম লিখব না। আমি বলেছিলাম, আমি কোনো বেআইনি কাজ করিনি। ওরকম লিখে দিলে, লোকে ভাববে, আমি কিছু অন্যায় করেছি। মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি। তিনি পরে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সরকারই এক লাইন লিখে দেবে যে, ভবিষ্যতে সরকারের অনুমতি ছাড়া আমি এরকম লিখব না। আমি বলেছিলাম, তা হলে আমি উত্তর দিয়ে জানাব যে, আমি কোনো নিয়ম ভাঙিনি। ভবিষ্যতেও নিয়ম মেনে চলব। ফলে, আমাকে সেরকম কিছু লিখেও দেওয়া হয়নি। তবে আমাকে অন্যায়ভাবে বিস্তর হয়রান করা হয়েছে।
২০০৬ সালের ১৮ মার্চ। একটা টিভি চ্যানেলে খবর বেরিয়ে গেল, কলকাতায় বাড়ি করার জন্য আমার বিরুদ্ধে ভিজিল্যান্স শুরু হয়েছে। নিয়ম মেনে, নিজের পয়সা দিয়ে, নিজের জমিতে আমি বাড়ি করেছি। এটা কোনো অপরাধ হতে পারে না। আমি রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি লিখে জানতে চাইলাম, আমার বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো ভিজিল্যান্স অনুসন্ধান চলছে কি না? চললে, সেটা কীভাবে শুরু হয়েছে? সরকার শুরু করতে বলেছে? কমিশন নিজে থেকে শুরু করেছে? কারওর অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয়েছে? হলে, অভিযোগপত্রে তার নাম-ঠিকানা দেওয়া আছে কি না। থাকলে সেটা যাচাই করা হয়েছে কি না? হলে, তাকে পাওয়া গেছে কি না? পাওয়া গেলে, সে । অভিযোগ করার কথা স্বীকার করেছে কি না? আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী?
সরকার কোনো জবাব দিল না। সব খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে খবর হতে – থাকল। মে মাসে সরকারের কাছ থেকে চিঠি এল, আমি যেন ভিজিল্যান্স কমিশনের এক নির্দিষ্ট ডিএসপি-র সামনে খোলাখুলি তদন্তের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হই।
আমি সরকারকে লিখলাম, আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা শুরু হয়নি। হলে অভিযোগের কপি কোর্টে পাঠাতে হত। সে কপি আমিও পেতে পারতাম। আমার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অনুসন্ধানও শুরু হয়নি। হলে, চার্জের কপি আমাকে দিতে হত। কাজেই ভিজিল্যান্স কমিশনের আমাকে ডেকে পাঠামোর কোনো ক্ষমতা নেই। সরকারেরও কোনো ক্ষমতা নেই, যাতে আমাকে ভিজিল্যান্স কমিশনে হাজির হতে বলে। আমি গেলাম না। তখন ভিজিল্যান্স কমিশন চার-পাঁচটা গাড়িতে লোকজন নিয়ে আমার কলকাতার বাড়ি, মুর্শিদাবাদের গ্রামের বাড়ি আসতে লাগল। লোকেরা বলতে থাকল যে, আমার বিরুদ্ধে ভিজিল্যান্স এনকোয়ারির জন্য তারা এসেছে।
আমি সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলাম। শুনানি শুরু হলে, মাননীয় বিচারপতি সরকারকে এ সব বন্ধ রেখে এফিডেভিট দিতে বললেন। তখন সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বি কে সাহার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টে যে রায় হয়েছিল, তা দেখিয়ে সে রকম আদেশ প্রার্থনা করলেন। মাননীয় বিচারপতি এই আদেশ দিলেন যে, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা হোম সেক্রেটারির মাধ্যমে আমাকে জানাতে হবে। আমি তার কাছে সেটা ব্যাখ্যা করব।
২ বছর চলে গেল। সরকার কিছু জানাল না। আসলে জানানোর মতো কিছু ছিলই না, তো কী করে জানাবে? ইতিমধ্যে, আমি রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী দরখাস্ত করে, আপিল করে, ইনফর্মেশন কমিশন থেকে অর্ডার বের করে জানতে পারি যে, আমার বিরুদ্ধে যে ভিজিল্যান্স এনকোয়ারি শুরু হয়েছিল, সেটা একটা ভুয়া বেনামী চিঠির উপর ভিত্তি করে। এবং সে চিঠিটাও, খুব সম্ভবত, ভিজিল্যান্স কমিশনের লোকেরাই তৈরি করে নিয়েছিল। কারণ যে পোস্ট অফিস থেকে ভিজিল্যান্স কমিশন আমাকে চিঠি পোস্ট করেছিল, এ চিঠিটাও ভিজিল্যান্স কমিশনের নিকটবর্তী সেই সেচ ভবন পোস্ট অফিস থেকে পোস্ট করা।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, আইন অনুসারে, অনামী বা বেনামী চিঠির উপর ভিত্তি করে কোনো অনুসন্ধান শুরু করার ক্ষমতা ভিজিল্যান্স কমিশনের নেই। কাজেই ভিজিল্যান্স কমিশনের পদক্ষেপ শুধু অনৈতিক নয়, বেআইনিও বটে। সেটা লিখেও আমি সরকারকে চিঠি পাঠালাম। পাষাণ সরকারের কাছ থেকে কোনো উত্তর এল না।
বাধ্য হয়ে আমি দ্বিতীয়বার হাইকোর্টে গেলাম। মামলার নোটিস ২৭-০২-২০০৮ তারিখে সরকারের ওপর জারি হল। ০৭-০৩-২০০৮ তারিখে সরকার আমার বিরুদ্ধে ভিজিল্যান্স অনুসন্ধান বন্ধ করার আদেশ দিল। সেই আদেশে তৎকালনী হোম সেক্রেটারি, প্রসাদরঞ্জন রায় এমন দুটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন, যা আমার পক্ষে গিয়েছিল। প্রথমত তিনি লিখেছিলেন, আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান আইন মেনে শুরু হয়নি। দ্বিতীয়ত আমার বিরুদ্ধে অনুসন্দান চালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু নেই।
এই অর্ডারের কপি হাইকোর্টে জমা দিয়ে সরকারি আইনজীবী প্রার্থনা করলেন যে, অনুসন্ধান এখনই বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমার আইনজীবী শক্তিনাথ মুখার্জী, জয়দীপ কর এবং বিশ্বদল ভট্টাচার্য কিছু বলার আগেই মাননীয় বিচারপতি, এস পি তালুকদার প্রশ্ন করলেন, আপনাদের ইচ্ছে হল ভিজিল্যান্স এনকোয়ারি শুরু করে দিলেন। হাইকোর্ট এ অর্ডার দেওয়ার পরেও দু’বছর ধরে আপনারা জানালেনই না তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী। তার জন্য তাঁকে দ্বিতীয়বার হাইকোর্টে আসতে হল। এখন আপনারা এনকোয়ারি বন্ধ করে দিয়ে বলছেন, তার আবেদন খারিজ করে দেওয়া হোক। কিন্তু এই ইনকোয়্যারির জন্য তার যে হেনস্তা-হয়রানি হল তার জবাব কে দেবে? শক্তিবাবু বললেন, শুধু এনকোয়ারি নয়, মাই লর্ড! এমন কোনো খবরের কাগজ নেই, যাতে খবর করা হয়নি।
এমন কোনো টিভি চ্যানেল নেই, যাতে খবর দেখানো হয়নি। মাননীয় বিচারপতি জানতে চাইলেন, কী চান? শক্তিবাবু কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি বললেন, এক সপ্তাহ সময় নিন। এক সপ্তাহ পরে এসে বলুন, কী চান?
এক সপ্তাহ পরে, আমরা মাননীয় বিচারপতির কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ এক টাকা ‘কস্ট’ মঞ্জুর করা হোক। সরকারি পক্ষের আইনজীবী এফিডেভিট দিয়ে পরপর পাঁচদিন ‘আরগুমেন্ট’ করেও মাননীয় বিচারপতিকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন না যে, আমার প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করা হয়নি। ফলে মাননীয় বিচারপতি আদেশ দিলেন যে, আমার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে। তার স্বীকৃতি স্বরূপ ১ টাকা দিতে হবে। শুরু থেকে বেআইনি অনুসন্ধান শুরু করার জন্য যে দায়ী তা নির্ধারণ করে তার মাসিক বেতন থেকে এই টাকা কাটতে হবে।
সরকার এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করল। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস এস নিজ্জর এবং বিচারপতি সঞ্জীব বসুর ডিভিশন বেঞ্চ সে আপিল বাতিল করে দিল।
সরকার আমাকে এক টাকার চেক দিয়ে দিল। কিন্তু কে দায়ী সেটা বের করল না। তার জন্য আমাকে আবার হাইকোর্টে মামলা করতে হল। হাইকোর্টের চাপে সরকার জানাতে বাধ্য হল, বেআইনিভাবে এই এনকোয়্যারি শুরু করার জন্য দায়ী তৎকালীন ভিজিল্যান্স কমিশনার, শ্যামলকুমার দত্ত। যেহেতু তিনি ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন, তার পেনশন থেকে এক টাকা কাটার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে লেখা হল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামলকুমার দত্তকে রাজ্য পুলিশ কপ্লিমেন্ট অথরিটি-র একমাত্র নন-এক্স-অফিসিও মেম্বার দিয়েছে। রাজ্য সরকারের নিজস্ব অনুসন্ধান যাকে একজন আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধে বেআইনি অনুসন্ধান শুরু করার জন্য দায়ী করেছে এবং হাইকোর্টকে তা জানিয়েছে। হাইকোর্টকে জানিয়েছে, তার পেনশন থেকে এক টাকা কাটার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে লেখা হচ্ছে। সেই ব্যক্তিকেই আবার রাজ্যের সমস্ত আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুসন্ধান করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে ।
তা হলে সিপিআইএম ক্ষমতায় থাকলে কি এরকমই চলবে? এটাই প্রাপ্তি।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ০১-০৫-১৯৪৭ তারিখের চিঠি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা বিসি সিনহার ০৫-০৬-১৯৪৭ তারিখের চিঠি।
- ২. ১৪-০২-২০১১ তারিখের এইচটিটিপি://ইএনউইকিপেডিয়া
- ৩. পশ্চিমবঙ্গের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, ৩০ বামফ্রন্ট সরকার, কোলকাতা ২০০৬, পৃ. ২৫৮
- ৪. ফাইড পুলিসমেন অন ডিউটি ইন বাংলোজ অফ বিগ বসেস নট টু সেড এ বক্স, দি টেলিগ্রাফ, কোলকাতা ১৭-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ৩
- ৫. অনিন্দ্য জানা, আলিমুদ্দিনের ‘আনুগত্যে’ই আটকে পুলিশের ভবিতব্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা ১৮-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ২
- ৬, অনিন্দ্য জানা, আলিমুদ্দিনের ‘আনুগত্যে’ই আটকে পুলিশের ভবিতব্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা ১৮-০২-২০১১, পৃ. ৯, ক ৩
- ৭. কাঠগড়ায় সিপিএম, বর্তমান, কোলকাতা ১৮-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ৫
- ৮. সুকুমার মিত্র, ভাড়াটে হার্মাদদের খুন করে কবর থেকে তুলে কুচিয়ে নদীর জলে ফেলল সিপিএম, দৈনিক স্টেটসম্যান, কলকাতা, ২৫-১২-২০১০, পৃ. ১, ক ৪
- ৯. লজ্জা ও শোকের দিন : শিবির থেকে নির্বিচারে গুলি, নিহত ৭ গ্রামবাসী, আনন্দবাজার পত্রিকা, কোলকাতা ০৮-০১-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- সিপিএমের হার্মাদ ক্যাম্প থেকে গুলি, হত ৭, বর্তমান, কোলকাতা ০৮-০১-২০১১, পৃ.১, ক ১
- হার্মাদবাহিনীর গণহত্যা : ধরা পড়ার ভয়েই বেপরোয়া গুলিবৃষ্টি প্রতিদিন, কোলকাতা ০৮-০১-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- রক্তে লাল লালগড়, হত ৭, আজকাল, কোলকাতা ০৮-০১-২০১১, পৃ.১, ক ১
- ১০. আবার বিধল নেতাই কাটা : আনুগত্যে ক্ষুব্ধ আদালত ভার দিল সিবিআইকে, আনন্দবাজার পত্রিকা, কোলকাতা ১৯-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- সিআইডি-কে তীব্র ভৎসনা, সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব : সিপিএমে নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন, নেতাই কাণ্ডে প্রশ্ন হাইকোর্টের, বর্তমান, কোলকাতা ১৯-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- নেতা কাণ্ডের তদন্ত সিবিআই-এর হাতে, দৈনিক স্টেটসম্যান, কোলকাতা ১৯-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- নেতাই তদন্তে সিবিআই : হাইকোর্ট, প্রতিদিন, কোলকাতা ১৯-০২-২০১১, পৃ. ১, ক১
- সিআইডি ইম্পোটন্ট, নেতাই প্রোব গোজ টু সিবিআই, গভর্নমেন্ট সিল্ডিং কালপ্রিটস, সেজ হাইকোর্ট, দি টেলিগ্রাফ, কোলকাতা ১৯-০২-২০১১, পৃ. ৭, ক ২।
- ১১। নির্লজ্জ রাজনীতিক ধিক্কার : কোথায় ছিলেন? বাড়ি এসে নাম কিনতে চাইছেন? আনন্দবাজার পত্রিকা, কোলকাতা ১৭-০২-২০১১, পৃ. ১, ক ১
- ১২. নেতাইয়ে আসেননি কেন, বর্তমান, কোলকাতা ১৭-০২-২০১১, পৃ ১, ক ২।
- ১৩. স্টেট রিপোর্ট কনফার্মস্ সাচার ফান্ডিলংস, টাইমস, সিটি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, কোলকাতা ২০০৯-২০০৯, পৃ. ৭, ক ২.
- ১৪. সিপিআইএম, সিপিআই প্রভৃতি বামপন্থী দলগুলির সর্বোচ্চ পদ সম্পাদক, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস প্রভৃতি দলগুলির সর্বোচ্চ পদ সভাপতি।
- ১৫. পরিশিষ্ট, সাচার কমিটি রিপোর্ট, পৃ. ২৯৫-৩০২।
- ১৬. রাজ্য সরকারের পক্ষপাতমূলক ব্যবহারের জন্য এ নিয়ম এখন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন কোনো ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ ছাড়াই দরখাস্ত করা যায়। দরখাস্তের একটা কপি এনসিটিই রাজ্যের কাছে পাঠায়। রাজ্যকে ৬০ দিনের মধ্যে মতামত জানাতে হয়। না জানালে ধরে নেওয়া হয়, রাজ্যের কোনো আপত্তি নেই।
- লেখক প্রথম বাঙালি মুসলিম আইপিএস শুধু নন, একজন সু-সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারকও। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সর্বমোট ৬৭টি পুস্তকের তিনি রচয়িতা। আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে Islam 9/11 & Global Terrorism বইটি, আনন্দ পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কারে তিনি সম্মানিত। মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমার বসন্তপুর গ্রামের সন্তান। প্রাথমিক বিদ্যালয়-কলেজ, বিএড কলেজ, পিটিটিআই সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাঁর নির্ভীক লেখনি এবং আপোষহীন দেশ ভক্তির দায়বদ্ধতার সামনে কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা প্রমাদ গুনেছে। ক্ষমতার দম্ভে চরম অপমান অবহেলা করেছে বাম শাসকগণ। এক সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হয়েই যোগ্য সম্মান জানিয়ে ভারতীয় রেলের প্রতিরক্ষা বিভাগে এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর পদে দায়িত্ব দেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান : এক অগ্রপথিক ব্যক্তিত্ব এবং ভারতীয় মুসলিম সমাজ
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।