‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ভারতবর্ষের প্রতি বিদেশী পর্যটক তথা ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ প্রাচীনকাল থেকেই। ভ্রমণকাহিনিগুলাে পড়লেই বুঝতে পারা যায়, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও নতুন নতুন দেশ দেখার নেশা, ধর্ম প্রচার, ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা লাভ, দস্যুবৃত্তি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও অন্যান্য উদ্দেশ্য পরিভ্রমণের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ধর্মীয় ও বৈষয়িক মানসিকতা অবশ্য কোনাে কোনাে পর্যটকের মধ্যে একেবারেই ছিল না। জ্ঞান সংগ্রহ ও নিছক কৌতুহলই তাদেরকে ঘর ছাড়া করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতবর্ষে এসেছেন মেগাস্থিনিস, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে স্পিনি (Tamralipta), দ্বিতীয় শতকে টলেমি (Gangaridi), পঞ্চম শতকে ফা-হিয়েন (Tamralipta), ষষ্ঠ শতকে তারনাথ, সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫) ও ই-সিং, নবম শতকে সােলায়মান (৮৫১), দশম শতকে মাসুদী (৯১৫-১৬), আল ইসতাখরী, ইবনে হওকাল ও আবু জায়েদ, একাদশ শতকে আলবিরুনী, ত্রয়ােদশ শতকে মার্কোপােলাে, ফ্রান্সিস ফ্রিয়ার, মন্টেক ভিনাে, ফ্রেয়ার অডােরিক ও ফ্রেয়ার জর্ডানাস, চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতা (১৩৩৪-৪৭), পঞ্চদশ শতকে মা-হুয়েন (১৪০৯-১০), ডমিংগাে পাত্রস (১৪৯৯-১৫০২), আলবুকার্ক, নিকোলাে কন্তি (১৪২০), নিকিতিন, ভাস্কো-ডা-গামা (১৪৯৮), আবদুর রাজ্জাক (১৪৪২-৪৩) ও ফেইসিন (১৪১১-১৫), ষােড়শ শতকে হুয়ান সিং, ইয়েন সং, নুনিজ, জি ডি বেরস, মনসারেট (১৫৮০-৮৩), বারবােসা (১৫০০-১৫১৬), পিনহাইরাে, ভারথেমা (১৫০২-৬), সিজার ফ্রেডারিক (১৫৬৭-৮১), ফাদার বারতােলি ও র্যালফ ফিচ (১৫৮৩-৯১), সতের শতকে মির্জা নাথান, আব্দুল লতিফ (১৬০০-০৯), পেলসার্ট, ফিঞ্চ (১৬০৮-১৬১১), নিকোলাস পাইমেন্টা, ক্যাপ্টেন হকিন্স (১৬০৮-১৬১১), এডওয়ার্ড টেরি (১৬১৫), টমাস রাে (১৬১৫), পিয়েত্রে দেল্লাভাল্লে (১৬২৩), করেত, ব্রুটন, কার্টরাইট (১৬৩২), পিটার মান্ডি (১৬৩০-৪৩), জেরম জেভিয়ার (১৫৯৭-১৬১৭), ডে-লায়েট, আলবার্ট মান্ডেফ্লোর (১৬৩৮-৩৯), থেভনাে (১৬৬৭-৮৪), গ্যামেলী কেরি (১৬৯৫), মানরিক (১৬২৮-৪৩), মনুচি (১৬৫৩-১৭০৮), বার্নিয়ের (১৬৫৮-৬৮), টমাস বাওরি, ফ্রাসোঁয়া মাতার (১৬৬৮-১৭০৬), গােতিয়ার স্কুটেন, জন ফ্রায়ার, ওভিংটোন, ফাদার বােতেলহাে (১৬৪৮-৫৪), হেনরি মিডলটন (১৬১০১১), যােসেফ সালব্লাঙ্ক, দ্য লেত, উইথিংটন, জোরডিন, উইলিয়াম নরিস, জেমস ল্যানকাস্টার (১৬১০-১১), নিকেলাস ডাউটন (১৬১৪-১৫), টমাস বেস্ট (১৬১২-১৪) ও ভার্নিয়ে (১৬৪১-৬৭), আঠার শতকে যােসেফ টিফেনথেলার, জেমস রেনল, জেমস টড, লুই পােয়াতিয়ের, স্টাভােরিন ও মােদাভ (ফরাসি), উনিশ শতকে ভিক্টর জ্যাকমো ও আলেকজাণ্ডার সােমা দ্য কোরাস এসেছেন। জেনেছি তাদের ভ্রমণকথা, এমনকি ইডেন ভগিনীদ্বয়ের ভারত ভ্রমণকথাও আমরা অনেকে পড়েছি। না পড়ে থাকলেও সবাই জানেন তাদের নামেই ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম। কিন্তু ইংরেজ ভ্রমণকারী ফ্যানি পার্কসের (গ্রেট ব্রিটেনের ওয়েলস প্রদেশের কনওয়ে নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৪-এ। আসল নাম ফ্রান্সিস সুসান আর্চার। বাবা মেজর এডওয়ার্ড কলফিল্ড আর্চার, যিনি ছিলেন ‘টুরস ইন আপার ইণ্ডিয়া’ ১৮৩৩ গ্রন্থের লেখক, মা অ্যানি। মৃত্যু ১৮৭৫-এ) নাম আমরা শুনিনি বললেই চলে।
শুধু ফ্যানি পার্ক নয়, ওই সময় বেশ কয়েকজন ইংরেজ ললনা স্বাধীনভাবে জলদস্যু, পিণ্ডারী, আফ্রিকায় সিংহ, ভারতে বাঘ, আর সবচেয়ে বিপজ্জনক কট্টর কলােনিয়াল ইংলিশম্যান ইত্যাদি বিবিধ আপদ, উপদ্রব ও সংস্কারের বাধা অতিক্রম করে নানা মহাদেশ ও বহু দ্বীপপুঞ্জ পর্যটন করেছিলেন। এঁদের ছবি, ডায়েরি ও চিঠিপত্র নিয়ে ২০০৫-এ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলেত থেকে এক ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী এসেছিল যার নাম ছিল ‘ব্রিটিশ উইমেন এক্সরাের অফ দ্য আর্লি নাইনটিন সেঞ্চুরি’। কী সব ছবি! কিন্তু যেটা এই প্রদর্শনীতেও স্পষ্ট হয়নি তা হল ফ্যানি পার্কসের ভারত-ভ্রমণ সংক্রান্ত নথি। কেন এই উপেক্ষা? ব্ল-ব্লাডের অধিকারিনী নন বলে ইংরেজরা যে তাদেরই উপনিবেশিক আগ্রাসনের বড় সমালােচক ফ্যানিকে উপেক্ষা করবেন তাতে অবাকের কিছু নেই, কিন্তু আমরা অর্থাৎ ভারতীয় লেখককুল যাঁরা পূর্বোক্ত ভ্রমণকারীদের সমাদরে তাদের লেখায় অতি সামান্য হলেও স্থান দিয়েছি কিংবা তাদের ভ্রমণকথা নিয়ে আলােচনা করেছি, সেখানে ফ্যানি পার্কসের মত ভ্রমণকারী অপাংক্তেয় হয়ে থাকলেন কোন যুক্তিতে? ফ্যানি গভীর মমতায় যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমার্ধে সংস্কারমুক্ত মনে ভারতীয় কৃষ্টি সম্বন্ধে উচ্চধারণা পােষণ করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন, তাতে তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। অথচ তিনি বা তার ভ্রমণকথা আমাদের অজানা হয়ে রইল!
উনিশ শতকের প্রথমার্ধের গােড়ার দিক। মধুসূদন তখন ইংরেজি, ইতালিয়ান, ফরাসি ইত্যাদি সাহিত্য শুধু নয় গােটা ইউরােপীয় সভ্যতার প্রেমে বিভাের! প্রিন্স দ্বারকানাথ সমানে সমানে বাণিজ্য করছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে, গ্রীক হুন পাঠান মুঘলদের মত। ইংরেজদের তখন আহ্বান করা হচ্ছে ভারতে স্থায়ী বসবাস করতে। তখন রামমােহনের ব্যক্তিগত বন্ধু গভর্নর জেনারেল স্বয়ং। এরকম এক সময়ে চাকরি সূত্রে স্বামী চার্লস পার্কসের সঙ্গে ফ্যানি পার্কস ভারতবর্ষে আসেন (১৮২২), থাকেন ১৮৪৫ অবধি—প্রধানত কলকাতা, কানপুর ও এলাহাবাদে।
তখন ভারতবর্ষে ইংরেজ সবেমাত্র থাবা বসাচ্ছে, স্তিমিত হয়ে আসছে ভারতের উজ্জ্বল-অভিজাত তারকাদের জীবন। কিন্তু তখনাে তারা আছেন, রাজা-রানি-বাদশাহ-বেগমেরা, আছে দরবার হারেম সতীদাহ। এসব ছবি ধরা পড়েছে সাধারণ এক গৃহবধূর চোখে, যিনি ক্রমে সাধারণ থেকে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ফ্যানি মেমসাহেব পরিণত হচ্ছেন এক ভারতপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকে। আকৃষ্ট হলেন এখানকার কৃষ্টি, ইতিহাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদ, ধর্ম, ভাষা ও সর্বোপরি জনসমাজের প্রতি। তাঁর পুরাে সমর্থন ভারতের প্রতি, শিখেছেন হিন্দুস্থানী ও উর্দু ভাষা, পরেছেন ভারতীয় পােশাক ও গয়না, বাজাচ্ছেন সেতার, খাচ্ছেন হাত দিয়েই। বস্তুত তৎকালীন ভারত ও ভারতীয় সমাজ, ইতিহাস, রীতিনীতি, জীবনযাত্রা, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কার, সংস্কৃতি, পরিবেশ-আবহাওয়া ও অন্যান্য দিক যথা-ফসল, খাদ্যদ্রব্য, পােষাক, বিনােদন, উৎসব, বিবাহ ও নারী-ভাবনা, স্থাপত্য শিল্প, দুর্ভিক্ষ সবকিছুর একটি অনন্য সুন্দর ছবি ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’।
দীর্ঘদিনের ভারত ভ্রমণে এসে ফ্যানি ‘ভারতীয় হয়ে গিয়েছিলেন অজ্ঞাতসারেই। তাঁর গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ভারত প্রেমের প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রন্থে ভারতীয় পরিভাষা ও প্রবাদ বাক্যের অকাতর ব্যবহার অন্ততপক্ষে সেকথারই জানান দেয়। তিনি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলাে অনুধাবনে সচেষ্ট হয়েছেন। আগ্রহভরে সংগ্রহ করেছেন হিন্দু ভাস্কর্য ও স্মারক। সেইসঙ্গে কোন ভারতীয় প্রথা যখন তার বিতৃষ্ণা উদ্রেক করেছে তখন তিনি তার বিচার-বিশ্লেষণেও রত থেকেছেন বৌদ্ধিকভাবে। দেবনাগরী অক্ষরে ‘শ্রীগণেশ’ নামে একটি বহুবর্ণ চিত্র তার গ্রন্থের শােভাবর্ধন করেছে। ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন,
“শ্রী গণেশ পাক্কা হিন্দু হলেও কালাপানি পার হয়ে আমার সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে এসেছেন। তিনি তার হিন্দুত্বের সমস্ত মর্যাদা ও ঐধর্য নিয়ে আমার সামনে উপবেশন করে আছেন। আমার প্রেরণা ও ক্ষমতার উৎস তিনি।”
এই ‘শ্রীগণেশ’কে ‘সেলাম সেলাম’ বলে বন্দনা করে ফ্যানি পার্কস ইংল্যাণ্ডবাসিনী মায়ের জন্য ভ্রমণপঞ্জি লিখতে শুরু করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মাকে উৎসর্গকৃত এই গ্রন্থে উৎসর্গবাণীর নিচে ফ্যানি নিজে স্বাক্ষর করেছেন উর্দুতে।
ফ্যানি পার্কস স্বামীর সঙ্গে কলকাতা এলাহাবাদ ও কানপুরে বাস করেছেন, কিন্তু ফ্যানি ঘুরেছেন এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নৌকা, পালকি, ঘােড়ার গাড়ি ও ঘােড়ায় চড়ে। ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ স্বামী বিষয়ে তিনি প্রায় নীরব থেকেছেন। মাত্র দু’এক স্থানে স্বামীর উল্লেখ পাওয়া যায়। শীতকালে ফ্যানি পার্কসের স্বামী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন। ফ্যানির জীবন তাই খুব মসৃণ ছিল না। তবে তিনি নিজেকে ‘স্বাধীন নারী’ বলে বর্ণনা করতে পছন্দ করতেন। ভারতে ইংরেজদের আগ্রাসন যে তার কতাে খারাপ লাগছে তা বলতে দ্বিধা করেননি। সারা দেশের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে যেমন, তেমনই নবাব-বেগম-রাজা-রানির সঙ্গে তিনি করেছেন বন্ধুতা। এক গৃহবধূর দৃষ্টিতে দেখা ভারত ভ্রমণের এক ‘ইউনিক’ দলিল এই ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’। ১৮৫০ সালে ‘Wanderings of a pilgrim in search of the picturesque during four-and-twenty years in the East with Revalations of life in Zenana’ (Pehlam Richardson) নামে ফ্যানি পার্কসের দীর্ঘ ভারতবাসের বৃত্তান্তটি প্রথম প্রকাশিত হয় লণ্ডন হতে। মূল বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০০। ২০০২ সালে উইলিয়াম ডালরিম্পল কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বইটি ‘Begums, Thugs and White Mughals’ নামে ‘পেঙ্গুইন বুকস্’ হতে প্রকাশিত হয়েছে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৬১। কলকাতার ‘প্রতিভাস’ থেকেও মীনাক্ষী দত্ত অনূদিত ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’ প্রকাশিত হয়েছে ‘সাহেব বিবি বণিক হারেম’ (২০০৬) নামে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪০। এছাড়া ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’র ‘কলকাতা’ অংশ (১৮২২-২৮) আমরা পাই প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘােষের গ্রন্থে।
কলকাতা আগমন : ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন
ফ্যানি পার্কস কলকাতায় এসেছিলেন ১৮২২-এ। ইংল্যান্ড থেকে দেশ ভ্রমণে তিনি বেরিয়েছিলেন এবং নানা দেশ ঘুরে শেষে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। ১৩ জুন ১৮২২ ইংল্যাণ্ড হতে যাত্রা শুরু করে পার্ক দম্পতি জাহাজে করে প্রায় পাঁচ মাস পরে এসে পৌছলেন গঙ্গাসাগর। সেখান হতে স্টিমারে করে ফলতা, পরে বজবজ হয়ে কলকাতার চাদপাল ঘাট (১০ নভেম্বর)। ১৩ নভেম্বর চৌরঙ্গির পার্কস্ট্রীটে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। তখন এদেশে ইংরেজদের প্রধান ও প্রথম দর্শনীয় স্থান ছিল কলকাতা শহর। ফ্যানি পার্কস যখন কলকাতায় পদার্পণ করেন তখন ভারতে চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। এই কোম্পানির কর্মচারী (বরফ তৈরির) ছিলেন ফ্যানির স্বামী চার্লস পার্কস। কলকাতা তখন ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এবং বিত্তশীল সমাজের প্রাণকেন্দ্র।
ভারতবর্ষ : চমৎকার দেশ
ফ্যানির কাছে কলকাতাকে তখন জাঁকজমকের দিক দিয়ে যে কোনাে ইউরােপীয় নগরীর মতাে মনে হয়েছিল। কলকাতা দেখে ভারতকে তার সুন্দর দেশ বলে মনে হয়েছিল ‘Charmed with the Climate; the Weather was delicious’. মুক্তমনে এখানকার সংস্কৃতির তিনি উচ্চ প্রশংসাও করেছেন। ফ্যানি অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষ চমৎকার একটি দেশ, শুধু যদি যেসব প্রিয়জনকে ইংল্যাণ্ডে ফেলে এসেছি তাদের এখানে আনতে পারতাম, তবেই আমার সুখ সম্পূর্ণ হত।”
প্রাসাদ নগরী কলকাতা
কলকাতাকে ফ্যানি এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বলে বর্ণনা করেছেন। কলকাতা শহরের দৈর্ঘ্য গঙ্গানদীর পূর্ব তীর ধরে প্রায় সাত মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এর প্রস্থ বা চওড়ার পরিমাপ বিভিন্ন জায়গায় ছিল বিভিন্ন, কিন্তু কোথাও দুই মাইলের বেশী ছিল না। কলকাতার যে এলাকা ছিল ইউরােপীয়দের বসতি সেটি চৌরঙ্গী জুড়ে বিস্তৃত ছিল, সেখানকার ঘর বাড়ি ছিল সাধারণত বেশ বড় আকারের এবং প্রত্যেকটির সঙ্গে ছিল অনেক পরিমাণ জমি। গড়পড়তা একটি বাড়িতে দশটি বড় কামরা থাকতাে, যেগুলি এমনভাবে নির্মিত ছিল যাতে গৃহকর্তার বিলাসবাহুল্য প্রকাশিত হয় এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সবচেয়ে আকাঙ্খিত বস্তু অর্থাৎ ঘরের ভিতর মুক্তবাতাস চলাচলের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করা যায়। ফ্যানি আরও লিখেছেন,
“কলকাতাকে ‘প্রাসাদ নগরী’ বলা হয়, সত্যিই সার্থক নামা। নদীর কাছে ময়দানে গভর্নমেন্ট হাউস তার পেছনে সেন্ট এ্যান্ড্রুজ চার্চ ও শহর। বাঁ দিকে চৌরঙ্গি। চৌরঙ্গির উপরের বাড়িগুলি বাগান দিয়ে ঘেরা চওড়া থামের উপর বারান্দা, একতলা থেকে সর্বোচচতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। এই বারান্দা ও থামের জন্য বাড়িগুলির গঠনে একটা হালকা ভাব ও সৌন্দর্য এসেছে, তাছাড়া রােদ আর বৃষ্টির ছাঁট থেকেও বাঁচায়।”
ভারতীয় বাড়ির স্টাইল
ফ্যানি বলেছেন, “শহরের যে এলাকায় দেশীয়রা বাস করতাে সেখানে উচ্চশ্রেণির বাসিন্দাদের বাড়িগুলি ছিল সাধারণত চর্তুভুজাকৃতি। কোনাে কোনাে জমিদার ও ধনী বণিকদের শহরের উপকণ্ঠে বাগানবাড়ি ছিল, যেখানে তারা তাদের অবসর সময় কাটাতেন। কলকাতা ছিল একটি আদর্শ ইঙ্গ-ভারতীয় নগর, এর স্থাপত্য ছিল মিশ্র। এখানকার মসজিদ, মন্দির ও গীর্জা ঐতিহ্যিক স্থাপত্য শৈলী অনুসারে নির্মিত। সরকারী অট্টালিকা ও দফতরসমূহ এবং ইউরােপীয় ও এদেশীয় উচ্চশ্রেণির লােকদের বাড়িগুলির মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলীর মনােরম সমন্বয় পরিলথিত হত। তবে এদেশীয়দের অধিকাংশ বাড়ি কোনাে নির্দিষ্ট স্থাপত্য শৈলী অনুযায়ী নির্মিত হয়নি এগুলি কোনাে নন্দনতত্ত্বের নিরিখে নয়, উপযােগিতার কথা বিবেচনা করে তৈরী হয়েছিল। বােধহয় এই কারণেই ফ্যানি বলেছেন “ভারতীয় বাড়ীর স্টাইল ইংল্যাণ্ডের বাড়ির থেকে একেবারে আলাদা।”
বাই নাচ ও সেকালের কলকাতা
যদিও ইউরােপীয় ও এদেশীয় অধিবাসীরা শহরের দুই ভিন্ন এলাকায় বাস করতাে এবং এদের জীবনযাত্রার মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হতাে, তা সত্ত্বেও ইউরােপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে কোনাে যােগাযােগ ছিল না এ কথা বলা যায় না। বড়লাট এবং অন্যান্য ইংরেজ সরকারী কর্মকর্তা ও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দেওয়া জাঁকজমকপূর্ণ প্রীতিসম্মেলন ও ভােজসভায় ভারতীয় উচ্চশ্রেণির লােকেরা আমন্ত্রিত হতেন এবং তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখান হতাে। যেমন বিশপ হিবারের বিয়াল্লিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২১শে এপ্রিল ১৮২৪ তারিখে কলকাতা বিশপ ভবনে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠান ও ভােজসভার আয়ােজন করা হয়েছিল যেখানে বড়লাট লর্ড আমহার্স্ট ও লেডি আমহার্স্ট এবং ইংরেজ কর্মকর্তারা ছাড়া রাজা রাধাকান্ত দেব ও হরিমােহন ঠাকুরের মতাে বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ভারতীয় উপস্থিত ছিলেন। যদিও ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য তারা ইংরেজদের সঙ্গে বসে খাদ্য গ্রহণ করতে পারেননি, তারা পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন যখন বিদায় নেবার আগে বিশপ হিবারের স্ত্রী স্বয়ং ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী তাদেরকে পান, গােলাপ জল এবং গােলাপের সুগন্ধি আতর দিয়ে আপ্যায়িত করেন। বিত্তবান ভারতীয়রাও ইউরােপীয়দের নিমন্ত্রণ করতেন তাদের নিজের বাসভবনে যেখানে অতি পর্যাপ্তভাবে তাদের আপ্যায়ন করা হতাে এবং সেখানে। বাইজিদের দ্বারা নাচ পরিবেশন ছিল বিনােদনের অপরিহার্য অংশ।
বিলেতে নাচা আর কলকাতায় নাচা এক ব্যাপার নয়। কলকাতা শহরের প্রচণ্ড গরমে সাহেব মেমদের অসুবিধা হত খুব। সামান্য একটু নাচলে কুঁদলেই সমস্ত গা দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ত, ত্রীতদাসদের হাতপাখার বা টানাপাখার হাওয়ায় সে ঘাম সহজে শুকনাে হত না। অনেক সাহেব প্রথম যুগের এই নাচের কথা তাই দুঃখ করে লিখে গেছেন। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় ‘গাইডস টু হেলথ’ নির্দেশের মধ্যে সাহেবদের তাই জানানাে হয়,
“The Gentlemen are particularly entreated not eat above four pounds of solids at a meal, of drink above six bottles of claret. Dancing will be extremely fatal to the ladies, if taken more than three times a week, and they are positively forbid to were full dresses of either satin or velvet until the 1st November.”
চার পাউণ্ড সলিড বস্তু ও ছ’বােতল মদ খেতে বলা হলেও নাচ সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে সপ্তাহে তিনদিনের বেশি নাচলে লেডিদের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে, এবং নাচের সময় ভেলভেট বা সাটিনের পােষাক পরা একেবারে নিষেধ, অন্তত নভেম্বরে শীতের আমেজ না আসা পর্যন্ত। সব নগ্ন নাচের পােষাকের প্রচলন এর পর থেকে শুরু হয়। তার আগে আমাদের দেশের বাইজিদের পােষাক ইংরেজ লেডিরা নকল করবার চেষ্টা করতেন এবং তার ফলে গলদঘর্ম হয়ে নাচের মধ্যে তারা প্রায় দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন।
নাচের ভেতর দিয়ে এইভাবে পূর্ব-পশ্চিমের কালচারের লেনদেন চলতে থাকে। দেশী রাজা-মহারাজা ও নবাবরা যাঁরা সাহেবদের ভােজে নিমন্ত্রণ করতেন, তারা লখনউ বারাণসীর বিখ্যাত বাইজিদের নিয়ে এসে নাচ দেখাতেন। সাহেবরা তখন এদেশী বাইজি-নাচের রীতিমত ভক্ত ছিলেন। অবশ্য ভক্ত না হয়ে তখন উপায়ও ছিল না। কারণ, বিলেতী নাচওয়ালী তখন কলকাতা শহরে খুব বেশি আমদানি হয়নি। দেশীয় রাজাদের ভােজসভায় বাইজিদের নাচ দেখে জনৈক ফিরিঙ্গি কবি বর্ণনা করেছেন,
“Then suddenly sounded a loudclanging gong/And there burst on the eyes of the wondering throng/A bevy of girls/Dressed in bangles and pearls/And other rich gems,/With fat podgy limbs…/ Which affected your hair-”
অর্থাৎ বাইজিদের নাচ দেখে সাহেবদের মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠত। সেই নাচ ইংরেজ লেডিরা নকল করতে গিয়ে ঘেমে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। আর বাইজিরা কি করতেন? ভােজসভা থেকে যখন সাহেব মেমরা ফিটনে করে বাড়ি ফিরতেন, তখন হলঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইজিরা কৌতুক করে রাজা-মহারাজাদের বিলেতী নাচ নকল করে নেচে দেখাতেন। তাই নিয়ে হাসাহাসি ঠাট্টা-বিদ্রুপও চলত। ক্রমে যত দিন যেতে লাগল তত বাইজিরা বিলেতী নাচ ব্যঙ্গ করে নাচতে লাগলেন এবং ইংরেজ লেডিরা বাইজি-নাচ নকল করে ঘামতে আরম্ভ করলেন। উভয়পক্ষের নাচের অনুকরণ থেকে, বিলেতী ও দেশী নাচের ভঙ্গিমার লেনদেন থেকে এক বিচিত্র ইঙ্গবঙ্গ বা ইঙ্গ-ভারতীয় নাচের উৎপত্তি হল। এই অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ান নাচ হল ‘কলকাতা কালচারের’ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ফ্যানি তার ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ এক ধনিক হিন্দু বাড়ির নাচসভার (১৭ই এপ্রিল ১৮২৬) বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে,
“এদেশের জেনানামহল বা অন্তঃপুর সম্বন্ধে আমার কোনাে অভিজ্ঞতা নেই। প্রায় চার বছর হল ভারতবর্ষে এসেছি, কিন্তু নীচজাতের দাসী ও নাচিয়ে বাইজি ছাড়া সাধারণ ভদ্র পরিবারের কোনাে স্ত্রীলােকের মুখদর্শন করা সম্ভব হয়নি। বাইজির কথা বলতে একটি নাচসভার কথা মনে হচ্ছে। …কিছুদিন আগে কলকাতা শহরে এক ধনিক হিন্দু বাড়ির নাচসভায় নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রথম জাগলারদের খেলা দেখে বেশ আনন্দ পেলাম। তলােয়ারের খেলা তারা যা দেখালাে খুব চমৎকার। খেলা শেষ হবার পর পরিবারের কর্তামশায় বললেন, অন্দরমহলে গিয়ে আমি তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক কি না। অবশ্যই ইচ্ছুক, এই সুযােগটাই এতদিন খুঁজছিলাম। সম্মতি জানাতে ভদ্রলােক আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। সামনে বিরাট এক পর্দা ঝুলছে। পর্দা পার হয়ে ভিতরে গেলাম, বেশ ঘন অন্ধকার কোনদিকে কি বা কে আছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের ভিতর থেকে দুজন মহিলা (পরিচালিকা মনে হয়) এসে আমার হাত ধরলেন, এবং বিশাল সিড়ি পার হয়ে একটি সুসজ্জিত অলােকোজ্জ্বল ঘরে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলেন। সেই ঘরে গৃহস্বামীর স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলা আত্মীয়রা এসে আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।…বাইরে থেকে ভিতরে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু ভিতর থেকে বাইরে বেশ দেখা যায়। নিচের হলঘরের অতিথিদের উপর থেকে মহিলারা দেখতে পাচ্ছিলেন, নাচ দেখতেও তাদের কোনাে অসুবিধা হচ্ছিল না। সর্ববিষয়ে তাদের কৌতূহল বেশ সজাগ, সভার প্রায় প্রত্যেকটি লােককে তারা চেনেন দেখলাম। আমার স্বামীটিকে উপর থেকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তারা অনুরােধ করলেন এবং আমার সন্তানদিরও খুঁটিয়ে খোঁজ নিলেন। সম্রান্ত হিন্দু পরিবারের জেনানা মহল দেখার শখ অনেকদিন পরে মিটল বটে, কিন্তু দেখে তেমন খুশি হতে পারলাম না।”
দুর্গোৎসব ও সেকালের কলকাতা
অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় দুর্গোৎসবের অগ্রণী পথিক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের বাঙালি গােমস্তা, আমলা, উকিল ও মুনশী প্রভৃতিরা। ইংরেজদের সান্নিধ্যে এসে যেসব হঠাৎ ধনী হওয়া বাঙালিরা চরম বিলাসিতার স্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) এবং শােভাবাজারের তালুকদার (রাজা) নবকৃষষ্ণ দেব। তবে কৃষ্ণচন্দ্র বিলাসী হলেও গুণী মানুষ ছিলেন। তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। আর তিনি ছিলেন বাংলায় একাধিক পূজাপার্বণের প্রবর্তক। কথিত আছে যে কৃষ্ণচন্দ্র নিজের পরিবারেরই শুধু সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা করেননি, অন্য ভূস্বামীদেরও এই পূজা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সেকালে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পারিবারিক পূজাটিই ছিল সর্বাপেক্ষা ব্যয়বহুল। তবে সেখানে ভক্তিভাবের থেকে উৎসব, আমােদপ্রমােদ ও নানাপ্রকার বিনােদনের ব্যবস্থাই থাকত বেশি। এই বাড়ির পূজার উদ্বোধন ও প্রস্তুতি শুরু হত আষাঢ় মাসে উল্টোরথের দিন। ঐ দিন রায় বাড়িতে পূজার উদ্বোধনের অঙ্গ হিসেবে কামানের গােলা ফাটানাের শব্দ অন্যান্যদের কাছে পূজার প্রস্তুতি শুরু করার ইঙ্গিত বহন করত। দেবী দূর্গা রায় পরিবারে পুরুষের পােশাকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যােদ্ধার বেশে অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহরূপী বাহনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম কর্তৃক ১০৮টি পদ্ম দিয়ে দেবীকে অকালবােধনের রীতি অনুসরণ করে প্রতিমা নির্মাণ করা হত ১০৮ মণ মাটি দিয়ে। সপ্তমীর দিন ১০৮টি ঢাকের বাদ্য দিয়ে শুরু হত পূজানুষ্ঠান। ১০৮টি পাঠাবলির রক্তে ভেসে যেত পূজা চত্বর। আর ১০৮টি গাড়ি নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হত দেবীকে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম দুর্গাপূজা উপলক্ষে নাচ দেখানাের (বাইজি নাচ) ব্যবস্থাও করেছিলেন। দুর্গাপূজা ছিল অর্থের বিনিময়ে সেকালে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক বড় মাধ্যম।
উত্তর কলকাতার শােভাবাজারের তালুকদার নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজের জয়ে উল্লসিত হয়ে যে বিজয়ােৎসব করেন, সে উপলক্ষেই তার বাড়িতে ঠাকুর (দুর্গার) দালান প্রতিষ্ঠিত হয়। আর লর্ড ক্লাইভ সে উৎসবে ঝুড়ি ভর্তি ফল, কিছু টাকা এবং বলিদানের জন্য একটি পাঁঠাও উপহার দেন। শােভাবাজারের রাজবাড়িতে দূর্গাপূজা উপলক্ষে মােট ১০০১টি পশু বলি হত এবং কামানের গােলার শব্দে শুরু হত সন্ধি পূজা। আর পূজা উৎসবের কেন্দ্রস্থল অধিকার করে থাকত ইংরেজ কর্মচারীদের উপস্থিতি। তাদের খানাপিনা এবং বিভিন্ন দেশের নাচ ও অন্যান্য বিনােদনের ব্যবস্থা। উইলিয়ম কেরি রাজা নবকৃষ্ণের দুর্গোৎসব সম্বন্ধে লিখেছিলেন,
‘The mejority of Company croweded to Raja Nabakissen’s where several mimics attempted to imitate the manners of different nations.’
প্রকৃতপক্ষে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের অধিকার পাওয়ার পর থেকেই ধনী পরিবারে বাৎসরিক দূর্গাপূজার উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে এদেশের বাবু সম্প্রদায়ের অন্যতম মিলনস্থল। আর ১৭৫৭-এ ইংরেজরা বাংলায় রাজ্যপাট অধিকার করে বসার পর ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে বাঙালি বাবুদের সংযােগ স্বাভাবিকভাবেই আরও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ইংরেজ প্রভাবিত বাবু সংস্কৃতি ও সমাজের গভীরে বিস্তার লাভ করে। তখনকার দুর্গোৎসবও হয়ে উঠেছিল সেই বাবু সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দুর্গোৎসব উপলক্ষে ইংরেজদের আমন্ত্রণ এবং তাদের সােৎসাহ যােগদানই তার বড় প্রমাণ। কলকাতার নিকটবর্তী এক ইংরেজ ভূস্বামী J Z Holwell তাঁর ‘Important Historical Events’-এ ১৭৬৬-এ লিখেছিলেন,
‘Durga Pujah …is the grand general feast of the gentoos, usually visited by Europeans (by invitation) who are treated by the proprietor of the feast with fruits and flowers in season, and are entertained evey evening while the feast lasts, with bands of singers and dancers.’
আর বিনয় ঘােষের মতেও ক্লাইভ, হেস্টিংস, হলওয়েলের যুগে শােভাবাজারের নবকৃষ্ণ, আন্দুলের রাজা রামচন্দ্র রায়, ভূকৈলাসের দেওয়ান গােকুলচন্দ্র ঘােষাল, দেওয়ান গঙ্গাগােবিন্দ সিংহ প্রভৃতির পারিবারিক দুর্গোৎসব ‘গ্রান্ড জেনারেল ফিস্ট অফ দ্য জেন্টুস’-এ পরিণত হয়েছিল।
ভূস্বামী গােবিন্দরাম মিত্র উত্তর কলকাতার কুমারটুলিতে যে দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠান করতেন তার আয়ােজন শুরু হত পনেরাে দিন আগে থেকে। দেবী দুর্গা নাকি তার পুত্ররূপী কার্তিক-গণেশকে নিয়ে রূপাের সিংহাসনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর পূজার দিনগুলির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল বিরাট ভূরিভােজন ও গানের আসর। জোড়াসাঁকোর কয়লা ও লােহার ব্যবসায়ী শিবকৃষষ্ণ দাঁ তার দুর্গা-প্রতিমাকে নাকি সােনার অলংকার দিয়ে মুড়ে দিতেন। দেবীর অলংকারের মুত্তো ও পান্না বিশেষ বায়না দিয়ে প্যারিস থেকে আনানাে হত। আর তথাকথিত সাহেব ও মেমদের এসব পূজাবাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে বিনােদনে অংশগ্রহণ ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। মহারাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ২৫ সেপ্টেম্বরের ‘Calcutta Chronicle’-এ প্রকাশিত বক্তব্য,
‘The only novelty that rendered the entertainment different from last year was the introduction or rather the attempt to introduce some English tunes among the Hindoostanee music.’
এই মন্তব্য প্রমাণ করে যে তথাকথিত রাজা-মহারাজাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ‘সাহেব-মেমদের’ খুশি করার জন্য ইংরেজি সুরে ভারতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের চেষ্টাও করা হত। শুধু এই মাত্র নয়। এসব নব্য বাবুদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত দুর্গোৎসব প্রকৃতপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই পান-আহার ও বাইজি নাচের উৎসবে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিত্তবান বাবুরা দুর্গোৎসবের যে জোয়ার আনতে চেষ্টা করেছিলেন, তাতে পাঁক ও আবর্জনাই ছিল বেশি। ফ্যানির মতে, ফলে বাঙালির ধনীপরিবারে দুর্গাপূজা প্রধানত জাঁকজমক, নৃত্যগীত, পানভােজন এবং মহিলাদের অলংকার প্রদর্শনের উপলক্ষে মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৯৭-এ নবকৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর পর তার পুত্র গােপীমােহনও পিতার রীতি অনুসরণ করে জাঁকজমক, নৃত্য-গীত, পানীয় এবং বাইজি নাচ-গানের ব্যবস্থা রেখেই দুর্গোৎসবের ব্যবস্থা করতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতােম প্যাচার নক্সায় দেখি সেখানে পূজার শেষদিনে অর্থাৎ নবমীতে বিশেষ আয়ােজন থাকত বাই, খেমটা, কবিগান ও কীর্তনের। মেডেল পাওয়া শহরের বড় বড় বাইজিরা ও ‘খেমটাওয়ালীরা’ সেদিন দুর্গাপূজার আসর জমাতেন।
আঠারাে শতকের মধ্যভাগ থেকে, বিশেষত উনিশ শতকের শুরু থেকে পারিবারিক পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। হুতােম বলেছেন,
“পূৰ্ব্বে রাজা-রাজরা ও বনেদী বড় মানুষের বাড়ীতেই কেবল দুর্গোৎসব হত, কিন্তু আজকাল (ঊনিশ শতকে) অনেক পুঁটে তেলীকেও প্রতিমা আনতে দেখা যায়।”
তবে এসব উপলক্ষে প্রতিমার প্রতি ভক্তিভাব অথবা ধর্মভাব অপেক্ষা মাদকতাই থাকত বেশি। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮২৬ সালের ১২ অক্টোবর ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’ পত্রিকার খবর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন,
“বাবু গােপীমােহন দেবের বাড়িতে অনেক উচ্চপদস্থ সাহেব মেমের সমাগমে ভােজ ও মদ্যপান হইয়াছিল। মুসলমান বাঈজি ছাড়াও ব্রহ্মদেশীয় কয়েকটি নর্তকী ও গায়িকার আমদানি করা হইয়াছিল।”
সেকালের বাবুরা চূড়ান্ত মত্ততার সাথেই শুধু দুর্গাপূজা করতেন না, এই উপলক্ষে আমােদ-প্রমােদের বিবরণ রীতিমতাে পত্রিকায় প্রকাশ করে সে খবর সকলকে জানাতেন। উদাহরণস্বরূপ, হুগলী জেলার চুঁচুড়ার অধিবাসী প্রাণকৃষ্ণ হালদার ১৮২৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘গভর্ণমেন্ট গেজেট’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহেব মেম ও শিক্ষিত বাঙালি জনসাধারণকে জানিয়েছিলেন যে,
“যাঁরা নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছেন এবং যাঁরা পাননি সকলেই যেন তার বাড়িতে ২৭ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিশাল নৃত্যোৎসবে যােগদান করেন। এছাড়াও এই বিজ্ঞাপনে নারীপুরুষ সবাইকে আস্ত করা হয়েছিল যে তাদের জন্য টিফিন, ডিনার ও সুরাপানের উত্তম বন্দোবস্ত থাকবে।”
ইংরেজের সংস্পর্শে এসে মদ খাওয়াকে হিন্দুরা উচ্চতর সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গ বলে মনে করতে শিখেছিল এবং দুর্গাপূজাতেও তাই সুরার স্রোত বইয়ে দিতে কোন দ্বিধা করত না। ইংরেজের তাঁবেদারি করে, দেওয়ানগিরি ও মুনসিগিরি করে হঠাৎ ধনী হওয়া মানুষের পথে ইংরেজদের খুশি করার একটি উপায়ও ছিল মদ্যপান ও দেশি-বিদেশি নৃত্যগীতের প্রদর্শন করা। কিন্তু পূজা উপলক্ষে যে পাশবিক উল্লাসে পশুবলি হত, তা সে সময়কার পত্রিকায় সাধারণত প্রকাশ পেত না। সে সংবাদ পাওয়া যায় হুতােম প্যাচার নক্সা’য়। তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি একটি হিসেব অনুযায়ী কলকাতা শহরে দুর্গোৎসবের ব্যয় হত পঞ্চাশ লক্ষ্য টাকা, আর পাঁঠাবলি হত হাজারের বেশি।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে উনিশ শতকে নৃত্যগীতের ভূমিকা সম্বন্ধে সেকালের পত্র-পত্রিকায় কিছু কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। ১৮৫৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখের সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় লেখা হয়,
“বাই খামটাওয়ালী প্রভৃতি নর্তকীগণ দুর্গোৎসবের সময় বড় মানুষ বাবুদিগের বাটীতে স্বকীয়া মনমােহিনী বিশুদ্ধ তান লয় স্বরে গান করিয়া সকলের মনমােহন করিতে পারিবে এই নিমিত্ত সঙ্গীতশাস্ত্রের আলােচনা করিতেছে ..বারাঙ্গনাকুল দুর্গোৎসব উপলক্ষে চাতুরী করিয়া স্ব স্ব ক্রেতাদিগের মনােরঞ্জন করিতেছে…।”
আর ১৮৫৪ সালের সংবাদ প্রভাকরে’র বর্ণনা অনুযায়ী, “শােভাবাজারস্থ নৃপতিদিগের নিকেতনে নৃত্যগীতাদির মহাধুম হইয়াছিল, সাহেবরা নিমন্ত্রিত হইয়া সেই নাচের সভা উজ্জ্বল করিয়া ছিলেন” আর “জোড়াসাঁকো নিবাসী বাবু নবকৃষ্ণ মল্লিক মহাশয়ের বাড়িতে দেবী পূজায় নাচের মজলিস দর্শনে দর্শক মাত্রেরই চিত্র পুলকালােকে পরিদীপ্ত হইয়াছিল, গায়িকাগণের তানমান শ্রবণ ও সুন্দর অঙ্গ ভঙ্গিমা দর্শনে অনেকেই মােহিত হইয়াছিলেন, বিশেষত মধ্যে মধ্যে রণবাদ্যবৎ চিত্ত প্রফুল্লকর ইংলেন্ডীয় বাদ্যবাদন হইবায় সকলেই এক একবার মহাআনন্দ অনুভব করিয়াছেন।” সুতরাং একথা বললে বােধ হয় ভুল হবে না যে, আঠারাে এবং বিশেষত উনিশ শতকে পারিবারিক দুর্গোৎসব প্রধানত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিত্তবান বাবুদের ধন-ঐর্য প্রদর্শনের এবং মদ ও নারীসঙ্গ সমেত এক বিরাট বিনােদনের মাধ্যম।
ফ্যানি পার্ক এই সময়ে (১৮২৩) কলকাতার এক ধনিক বাঙালির গৃহে দুর্গোৎসবে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। উৎসবের যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা বিশেষ উপভােগ্য। একদিকের সারিসারি ঘরে নৈশভােজের আয়ােজন করা হয়েছিল। গান্টার অ্যাণ্ড হুপার কোম্পানি খাদ্য-সরবরাহের ভার নিয়েছিল। সাহেব অতিথিদের জন্য বরফ ও ফরাসী মদ্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর একদিকের ঘরে বাইজিদের নাচগান চলছিল পূর্ণোদ্যমে। সাহেব ও বাঙালিবাবুরা আরামকেদারায় বসে, মৌজ করে, হিন্দুস্থানী বাইজীদের গান শুনছিলেন। ফ্যানি পার্কস লিখেছেন,
“সেদিন দুর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম একজন ধনিক বাঙালীবাবুর বাড়ি। ‘দুর্গা’ নামে হিন্দুদের যে দেবী আছেন তারই ‘অনারে’ এই উৎসব হয়। বাবুর চারমহলা বাড়ি, মধ্যিখানে বিরাট উঠোন। সেই উঠোনের এক পাশে উঁচু মঞ্চের উপর দেবী দুর্গার সিংহাসন পাতা। সিংহাসনের উপর দুর্গার মাটির প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। মঞ্চের দুধারে সিঁড়িতে ব্রাহ্মণেরা উপবিষ্ট, পূজার অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। প্রতিমার হাত দশটি, যার জন্য দুর্গা দশভূজা বলে পরিচিত। একটি ডানহাত দিয়ে তিনি এক ভীষণাকৃতি অসুরকে বর্শবিদ্ধ করেছেন, বামহাতে একটি বিষাক্ত সাপের লেজসহ অসুরের ঝুঁটি ধরেছেন, সাপটি অসুরের বক্ষস্থল দংশন করছে। বাকি আটটি হাত ডাইনে-বামে প্রসারিত প্রত্যেক হাতে একটি করে মারণাস্ত্র। তার দক্ষিণ হাঁটুর কাছে একটি সিংহ এবং বাম হাঁটুর কাছে অসুর। সিংহ দেবীকে বহন করছে মনে হয়।
পূজামণ্ডপের পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানাে ছিল। সবই বাবুর ইয়ােরােপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গাণ্টার অ্যান্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও ফরাসী মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হল ঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজীদের নাচগান হচ্ছিল, এবং ইয়ােরােপ ও এদেশী ভদ্রলােকেরা সােফায় হেলান দিয়ে, চেয়ারে বসে সুরা-সহযােগে সেই দৃশ্য উপভােগ করছিলেন। বাইরেও বহু সাধারণ লােকের ভিড় হয়েছিল বাইজীদের গান শােনার জন্য। গানের হিন্দুস্থানী সুর মণ্ডপে সমাগত লােকজনদের মাতিয়ে তুলেছিল আনন্দে। …
দুর্গাপূজার কয়েকদিন আগে, বাড়ীর সরকার মশায়রা ছুটি নিয়ে দেশঘরে চলে যান। আর ধনিক বাঙালী বাবুরা পূজার সময় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন তার হিসেব নেই।”
সেকালের চড়ক
দুর্গাপূজার মতাে চড়ক পূজার কথাও আমরা জানতে পারি ফ্যানির ‘ভ্রমণ বৃত্তান্ত’ হতে।
“ধার্মিক হিন্দুগণ পৃষ্ঠদেশের মাংসপেশীতে হুক লাগিয়ে উঁচু খুঁটির উপর যন্ত্রণাদায়ক ঘূর্ণনে ব্যস্ত। নীচের জনতা তা দেখে আনন্দ উপভােগ করছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন কালীঘাটের কালীমন্দির দর্শন করতে বেরিয়ে পথে চড়কের এই দৃশ্য (২০ মার্চ ১৮২৩) দেখেছিলেন ফ্যানি পথে এক দৃশ্য দেখলাম, উৎসবের দৃশ্য, অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লােক রাস্তা ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের ভিড়?’ শুনলাম, চড়ক পূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটি কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়কপূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কতরকমের লােক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়াে হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এদেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরাে কাপড় জড়ানাে, প্রায় নগ্ন বলা চলে। …এই শ্রেণীর আত্মপীড়নদ সাধুকে সকলে খুব পূণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের পরম প্রিয়পাত্র না হলে এরকম কষ্টস্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি-গদগদচিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।
আরও কয়েকজন সাধু মাথার উপরে একহাত তুলে চক্ষু উলটে বসেছিল। একদল নীচজাতের হিন্দু বাহুর মাংসপেশী এফেঁড়ওফেঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের লাঠি ও লৌহশলাকা পুরে ঢােলের বাজনার তালে তালে বীভৎস ভঙ্গিতে তাণ্ডবনৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুড়ে বাহদুরি দেখাচ্ছিল জনতার কাছে। কয়েকগজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা এক-একটা খুঁটি, তার মাথায় আড়ে একটি বা দুটি করে বাঁশ বাঁধা। যে খুঁটির মাথায় একটি বাঁশ বাঁধা তার একদিকে একটি লােক ঝুলে রয়েছে, আর একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লােকজন খুঁটির চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লােকটিও তার ফলে ঘুরছে বন্ বন্ করে। যে খুঁটির মাথায় দুটি বাঁশ ক্রশ করে বাঁধা আছে তাতে আরও বেশি লােক ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, উপরের লােকগুলি হুকবিদ্ধ হয়ে ঝুলছে ও ঘুরছে এবং তাদের বুকে ও পিঠে সেই হুকগুলি বিঁধে রয়েছে। উপরের লােকটি খুঁটির মাথায়, বাঁশের ডগায় ঘুরছে তাে ঘুরছেই, আর নিচের লােকজন উন্মত্তের মতন তাদের পাক দিচ্ছে তাে দিচ্ছেই। ঘােরার শেষ নেই, পাকেরও শেষ নেই। উপরে ঘুরছে যারা তারা বােধ হয় বেশি পুণ্যবান, কারণ একটি থলি ভর্তি করে ফুলবাতাসা নিয়ে উপর থেকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিচের লােকজন মহা উল্লাসে সেগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে দেবতার প্রসাদের মতন। কেউ কেউ বুকে-পিঠে কাপড় না জড়িয়েই হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রচুর পরিমাণে নেশা করে, গাঁজা-আফিম খেয়ে তাদের চোখমুখের চেহারা পিশাচের মতন ভয়ংকর দেখাচ্ছিল।
নীচজাতের হিন্দুরা শুনেছি চড়কপূজার অত্যন্ত ভক্ত। পূজা-উৎসবে যােগদানকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এরকম একটা পৈশাচিক ভয়াবহ উৎসব আর কোথাও দেখিনি। এই ধরনের উৎসবে দুর্ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। চড়কপূজায় শতকরা তিন-চারজন লােক মারাও যায়। ধনীলােকেরা টাকা পয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়ক কাঠে চরকি পাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য। এইভাবে প্রসি দিয়েও নাকি পূণ্যলাভ করা যায়।”
এই উৎসবে গাড়ি ভর্তি করে অনেক বাইজিরাও এসেছিল। যেমন তাদের পােশাক, তেমনি তাদের নাচগানের ভঙ্গি। কিন্তু এই বাইজি নাচ দেখার জন্য হিন্দু ভদ্রলােকেরও ভীড় হয়েছিল উৎসবে।
কালীঘাটের মন্দির দর্শন
এ সময়ে ফ্যানি কালীঘাটের কালীমন্দির দর্শন করেছিলেন কিনা তার বর্ণনা তার গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তবে অনেক পরে ১৫ জানুয়ারি ১৮৩৭-এ তিনি এই মন্দির দর্শন করেছিলেন,
“সন্ধ্যাবেলা গেলাম বিখ্যাত বাঙালি দেবীমূর্তি কালী-মাই-এর মন্দিরে। আগে এখানে জনসমক্ষে নরবলি হতাে, এখনাে, ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া প্রহরা সত্ত্বেও, বলি হয় না এমন বলা যায় না। এমন অভাগা কাউকে যদি পায় যার জন্য খোঁজ করার কেউ নেই তবে লুকিয়ে চুরিয়ে নিশ্চয়ই বলি দেয়। মন্দিরটা কালিঘাটে, কলকাতা থেকে দুই মাইল। কালাে পাথরের এক বিশাল নারী মূর্তি, মস্ত মাথা ও বিস্ফারিত দুই চোখ চওড়া জিভ বুক পর্যন্ত ঝুলে আছে। বিকট এক মূর্তি। পুরােহিতকে এক টাকা দিলাম মূর্তি দেখানাের জন্য, তিনি সেটা ভক্তিভরে কালীমাকে নিবেদন করলেন। পুরােহিতরা যেভাবে এক কোপে মাথা কাটতে পারেন তা বেশ কৃতিত্বের ব্যাপার।”
রামমােহনের জীবনযাত্রা ও সেকালের বিনােদন
জীবনযাত্রা বিষয়ে শহরের অন্যান্য ধনিক বাবুদের সঙ্গে রামমােহনের কোন তফাৎ ছিল না। বহুমূল্য ইউরােপীয় আসবাবপত্রে মাণিকতলার বাড়িটি সুসজ্জিত করে রাজা রামমােহন কলকাতার জীবনযাত্রা শুরু করেছেন। কিন্তু হঠাৎ রাজাদের মতাে তার বিলাস-বৈভবপূর্ণ রাজসিক জীবনযাত্রা। উৎসবে-ভােজে, বাইজি নাচে অজস্র অর্থ ব্যয় করার তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্য তিনিও বহন করে চলেছিলেন। এমনকি তিনি সেকালের সেরা বাইজি নিকির নৃত্য উপভােগ করতেন, তাঁর বাড়িতে এই আধুনিক ‘বসন্তসেনা’ বহুবার নৃত্য প্রদর্শন করেছিল। ফ্যানি পার্ক ১৮২৩ সালে রামমােহনের মাণিকতলার বাগানবাড়িতে আয়ােজিত ভােজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার ভ্রমণ-ডায়রিতে ভােজসভার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন,
“একদিন এক ধনিক সম্ভ্রান্ত বাঙালীবাবুর বাড়ি ভােজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবুর নাম রামমােহন রায়। বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তার বাড়ি, ভােজের দিন নানাবর্ণের আলাে দিয়ে সাজানাে হয়েছিল। চমৎকার আতসবাজির খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলােয় আলােকিত হয়েছিল তার বাড়ি।
বাড়িতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাঈজী ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাঈজীদের পরণে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙিন মসলিনের ফ্রিক দেওয়া, তার উপর সােনারূপাের জরির কাজ করা। সাটিনের ঢিলে পায়জামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পােশাক ও আলােয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলংকারও ছিল নানারকমের। তারা নাচছিল। দলবেঁধে বৃত্তাকারে, পায়ের নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের তালে তালে। নাচের সময় মুখের, গ্রীবার ও চোখের ভাবপ্রকাশের তির্যক ভঙ্গিমা এত মাদকতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল যে তা বর্ণনা করতে পারব না। নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল, সারেঙ্গী মৃদঙ্গ তবলা। ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা।
গানের সুর ও ভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্যরকম, আমরা শুনিনি কখনও। মধ্যে মধ্যে মনে হয়, সুর কণ্ঠ থেকে নির্গত না হয়ে নাসিকার গহ্বর থেকে তরঙ্গায়িত হয়ে আসছে। কোনাে কোনাে সুর এত সূক্ষ্ম ও মিহি যে কণ্ঠের কেরামতির কথা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয়। বাঈজীদের মধ্যে একজনের নাম নিকী, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাঈজীদের মহারাণী সে, এবং তার নাচগান শুনতে পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের কথা।
বাঈজীদের নাচগান শােনার পর রাতের খাওয়া-দাওয়াও শেষ হল। তারপর এদেশের ভেলকিবাজ জাগলারদের অদ্ভুত সব ত্রীড়াকৌশল আরম্ভ হল। কেউ তলােয়ার লুফতে লুফতে হাঁ করে সেই ধারালাে অস্ত্রটা গিলে ফেললে, কেউ বা অনর্গল ধারায় আগুন ও ধোঁয়া বার করতে লাগল নাকমুখ দিয়ে। একজন শুধু ডান পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পিছন দিক দিয়ে বাঁ-পা তুলে ধরল কাঁধের উপর। এই ধরণের কৌশল দেখে নকল করার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক। বাড়ির ভিতর সুন্দর ও মূল্যবান আসবাবপত্র সাজানাে এবং সবই ইউরােপিয় স্টাইলে, কেবল বাড়ির মালিক হলেন বাঙালিবাবু (রামমােহন)।”
টিপু সুলতানের পুত্র রাজকুমার জামানউদ্দিনের রাজবাড়িতেও ফ্যানি আমন্ত্রিত ছিলেন,
“আমি নাচ দেখতে চেয়েছি শুনে রাজকুমার জামানউদ্দিন আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন। সে নাচ কিন্তু ভালাে লাগল না আমার তবে কিছু কিছু গানের সুর খুব ভালাে। কয়েকদিন পূর্বে অবশ্য জামানউদ্দিন ফ্যানির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। প্রায় ঘন্টা দুই বসে গল্প গুজব করেন। এই সুত্রেই ফ্যানির আমন্ত্রণ ছিল রাজবাড়িতে। উল্লেখ্য, জামান থাকতেন ফ্যানির বাসার কাছাকাছি।
আরও একটি ভােজসভার কথা বলেছেন ফ্যানি তার ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ। ১৬ ডিসেম্বর ১৮২২ তারিখের এই ভােজসভার আয়ােজক ছিলেন লর্ড হেস্টিংস। হেস্টিংস ১৬ ডিসেম্বর লাটবাড়ীতে এই ভােজসভার আয়ােজন করেছিলেন। সিভিল ও মিলিটারি অফিসারদের ও কলকাতার স্থানীয় অভিজাত বাসিন্দাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল এই ভােজসভায়। ফ্যানি ও তার স্বামী চার্লসও এখানে আমন্ত্রিত ছিলেন। নবাব, রাজা-মহারাজারা, মারাঠী, গ্রীক, তুর্কি আর্মেনিয়ান, হিন্দু ও মুসলমানরা, নানা রকমের বিচিত্র সব পােষাক পরে ভােজ সভায় এসেছিলেন। লাটবাড়ীতে রং-বেরঙের পােষাকের বিচিত্র এক প্রদর্শনীও হয়েছিল বলে ফ্যানি উল্লেখ করেছেন। এই সভায় লর্ড হেস্টিংসকে বিদায়ও জানানাে হয়েছিল সিভিল ও মিলিটারি অফিসারদের এবং কলকাতার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের পক্ষ হতে। এভাবে কলকাতায় এ সময়ে ফুর্তি ও আমােদের শেষ ছিল না-কলকাতার অভিজাতদের বাড়িতে নাচ গান ও মহাভােজ, গভর্ণমেন্ট হাউসে পার্টি ও নৈশ্যভােজ এবং নানা অনুষ্ঠান লেগেই থাকত।
গৃহভৃত্যদের রমরমা
কলকাতাকে সুন্দর শহর মনে হলেও এখানে বাস করতে হলে যে এত ভৃত্যের প্রয়ােজন হয় তা ফ্যানি আগে কখনও কল্পনা করতে পারেননি। চাকর-বাকরদের চাপে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠার মত অবস্থা। ভৃত্যদের শিরােমনি ছিল সরকার, তারপর ছিল খানসামাদের দাপট। সেকালে কলকাতায় খানসামাদের একটা স্ট্যাটাস ছিল। রাজা বাদশাহের যেমন ইতিহাস আছে, খানসামারও তেমনি একটা ইতিহাস আছে। জনৈক ইংরেজ শিল্পী সেকালে তার মাকে খানসামাদের সম্বন্ধে চিঠিতে লিখেছেন,
“Khansamanship like Malvoilo’s greatness, commeth in three wise : some are born’ Khansamans-some ‘achieve’ Khansamanship and other have Khansamanship thrust upon them.”
খানসামাগিরি তিন উপায়ে হতে পারে। কেউ খানসামা হয়ে জন্মায়, কেউ খানসামাগিরির যােগ্যতা অর্জন করে, আবার কারও উপর সেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। মােটকথা, খানসামাগিরি রীতিমত একটা লােভনীয় পেশা, যা ইংরেজ আমলে মুসলমানদেরই একচেটে ছিল। খানসামারাই ছিল ইংরেজ নবাবদের ঘরের গিন্নী। শুধু রান্নাঘরের নয়, ভাঁড়ারের চাবিকাঠিও তাদের হাতে থাকত। বাড়ির অন্যান্য চাকর-বাকর সকলে খানসামার হুকুমের অধীন থাকত এবং তার মন যুগিয়ে চলত। খিদমৎগার আর খানসামার তফাৎ আছে, পদমর্যাদার তফাৎ। খিদমৎগার খাদ্য-টেবিলের চাকর, সাহেবদের টেবিলে খাদ্য সার্ভ করাই তার প্রধান কাজ। কাজ করে সাহেব-প্রভুকে খুশি করতে পারলে খিদমৎগিরি থেকে খানসামাগিরিতে পদোন্নতি হত। ঘরের ব্যাপারে খানসামা হল মুখ্যমন্ত্রী, আর তার ডেপুটি হল খিদমৎগার। সুতরাং খানসামাকে কেবল খানসামা মনে করা ভুল। কলকাতার ইংরেজ নবাবদের অন্দরমহলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধীর ছিল খানসামা। তাকে দে-নবাব বললেও ভুল হয় না। সেকালের কোনাে মুনশি বা বেনিয়ানের চেয়ে সাহেবদের কাছে খানসামার প্রতিপত্তি কম ছিল না।
১৮৪১-র ‘বেঙ্গল অ্যাণ্ড আগ্রা অ্যানুয়াল গাইড অ্যাণ্ড গেজেটিয়ার’ থেকে গৃহভৃত্যদের বেতনের একটি তালিকা দেওয়া যেতে পারে—
খানসামা ১০ টাকা থেকে ১৬ টাকা
খিদগার ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা।
বাবুর্চি ৬ টাকা থেকে ৯ টাকা
দারােয়ান ৫ টাকা
হরকরা ৫ টাকা
কচুয়ান ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা
সহিস ৫ টাকা
মশালচি ৪ টাকা
সর্দার বেয়ারা ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা
সহকারী বেয়ারা ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা
পাংখা বেয়ারা ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা
মেথর ৪ টাকা।
ভিস্তি ৪ টাকা।
আবদার ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা।
আরও কিছু গৃহভৃত্যদের তালিকা নিম্নরূপ,
দর্জি ৮ টাকা
আয়া ১০ টাকা
ঝি ১০ টাকা
জমাদার ৪ টাকা
গােয়ালা রাখাল ৪ টাকা
মালি ৫ টাকা
কুলি ৩ টাকা।
ঘেসুড়ে ৩ টাকা।
ভিস্তিওয়ালা ৫ টাকা।
ছুতাের চৌকিদার ৪ টাকা।
চাপরাশি ৫ টাকা।
এছাড়া কেউ কেউ সরকার নিয়ােগ করতেন, মাসিক কুড়ি থেকে ত্রিশ টাকা বেতনে। সরকার ও খানসামার স্টেটাসের পার্থক্য ছিল, কর্তৃত্বেরও তারতম্য ছিল। কিন্তু দু’পয়সা উপার্জনের কৌশলে উভয়ের মধ্যে কোনােরকম তফাত ছিল না। ফ্যানি পার্ক তাঁর ‘ওয়াণ্ডারিংস অফ এ পিলগ্রিম’ গ্রন্থে সরকার মশায়ের যে সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন, তা উপভােগ্য। তার নিজের ভাষাতেই তা উদ্ধৃত করা উচিত,
“A very useful but expensive person in an establishment is a Sircar; the man attends every morning early in receive orders, he then proceeds to the bazaars, or to the Europe shops, and brings back for inspection and approval, furniture, books, dresses or whatever may have been ordered; his profit is a heavy percentage on all he purchases for the family.”
ফ্যানি, সরকার মশায়কে ‘useful’ কিন্তু ‘expensive’ ব্যক্তি বলেছেন। সাধারণত টাকায় দু’আনা করে দস্তুরি সরকারের প্রাপ্য বলে উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ সাড়ে-বারাে পার্সেন্ট। খানসামা মােটামুটি এর অর্ধেক পেত। এছাড়া সরকারের সঙ্গে খানসামার বিশেষ কোনাে তফাৎ ছিল না। সরকার মশায় ছিলেন ভদ্র-খানসামা, এই যা তফাৎ এবং তারা ছিল প্রধানত হিন্দু, খানসামারা মুসলমান। উভয়েই দস্তুরি নিয়ে কাজ করত।
ক্রীতদাসদের অবস্থা
সেকালের হঠাৎ বড়লােক হওয়া বাবুরা নবাবদের মত শতাধিক চাকর রাখতেন। বিখ্যাত ফ্রান্সিস সাহেবের শ্যালক মাকরাবি লিখে গেছেন,
“One hundred and ten servants to wait upon a family of four people, and yet we are economists.
অর্থাৎ আমাদের চারজনের পরিবারে একশ দশজন চাকর চাই, তবু আমরা নাকি ইকনমিস্ট। চাকরদের অবস্থা অনেকটা ত্রীতদাস-দাসীর মতাে ছিল। প্রভুদের অত্যাচারে মধ্যে মধ্যে তারা পালিয়ে যেত এবং ধরা পড়লে আদালত থেকে হুকুম জারী করা হত, দশঘা কি বিশঘা চাবুক মেরে তাদের মাস্টারদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য। চাকররা চুরি করলে সাহেব মাস্টাররা ব্রাহ্মণ পুরােহিত ডেকে তাদের চালপড়া খাওয়াতেন এবং পুরুত চালপড়ার পরীক্ষায় যাকে চোর বলে সাব্যস্ত করতেন তাকে ধরে সাহেব উত্তম-মধ্যম চাবুক মারতেন।
অপরাধী ধরার কৌশল
চোর ধরতে চালপড়া খাওয়ানাে সম্বন্ধে ফ্যানি পার্কসের বর্ণিত কাহিনি আমাদের বেশ হাসি জোগায়। কলকাতায় (উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে) থাকাকালীন সময়ে ফ্যানির বহু চাকরবাকর ছিল। একবার তার বাড়িতে চুরি হওয়াতে তিনি চালপড়া খাইয়ে চোর ধরবার চেষ্টা করেন। এ সম্বন্ধে তিনি নিজে লিখেছেন,
“(মুনশি) এক একজন করে ভৃত্যদের ডেকে হাতের মুঠোয় একভাগ করে চাল দিয়ে শপথ করতে বললেন এই বলে আমি চুরি করিনি, কে চুরি করেছে জানি না, চোরাই জিনিস সম্বন্ধেও খোঁজ রাখি না। প্রায় পঁয়ত্রিশজন ভৃত্য ছিল। সকলকে চাল খাওয়ানাে ও শপথ করানাে হয়ে গেলে মুনশী তাদের ডেকে বললেন, ‘তােমাদের মধ্যে কেউ মিথ্যা শপথ করেছ। যে মিথ্যা বলছ ভগবান তাদের শাস্তি দেবেন। এই চাল মুখের ভিতর দিয়ে চিবিয়ে তােমরা সামনের কলাপাতায় ফেলবে। যে মিথ্যা বলেছ, বা চুরি করেছ, বা চুরি সম্বন্ধে কিছু জান, তার মুখের চাল ভিজবে না, শুকনাে থাকবে।
প্রত্যেকে চাল চিবিয়ে কলাপাতায় ফেলল। তার মধ্যে বত্রিশজনের মুখের চাল দেখা গেল বেশ ভিজে ও লালাসিক্ত, আর বাকি তিনজনের একেবারে শুকনাে খটখটে। চেবানাের ফলে চাল গুঁড়াে হয়ে গেছে, কিন্তু একটুও ভেজেনি। মুশী তাদের দেখিয়ে বললেন, এরাই অপরাধী, ঘড়ি এরাই চুরি করেছে। বিনাদ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতকড়া দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। বাস্তবিকই যে তিনজনের মুখের চাল শুকনাে ছিল তারা আগেকার দাগী চোর। ঘড়ি পাই আর না পাই, কিছুদিনের জন্য চোরের হাত থেকে রেহাই পাব জেনে নিশ্চিন্ত হলাম।”
সাংস্কৃতিক আদান প্রদান
ফ্যানি যদি কেবল চালপড়ার বর্ণনা দিয়ে ক্ষান্ত হতেন, তাহলে আমাদের বলবার কিছু থাকত না। কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, চালপড়ার মাহাত্মে তার অগাধ আস্থা আছে (the ordeal by rice, in which I have firm faith’)। তবে এটাও ঠিক এই মাহাত্ম্যের মধ্যে কিছুটা হলেও বিজ্ঞান বা যুক্তি রয়েছে বলেও ফ্যানির মনে হয়। আসলে অপরাধী যে, সে ভয় পাবেই এবং ভয়ে ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে যাবেই।
এই ব্যাপারটা থেকে বােঝা যায় যে, সাহেবরা আমাদের দেশী কালচার কতদূর পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন। শুধু যে সাহেবরা কালীমন্দিরে মানত করতে যেতেন বা শালগ্রামশিলা রেখে পুজো করতেন তা নয়, চালপড়া-ঘটিচালা-নলচালা-কবচধারণবশীকরণও পর্যন্ত তারা বেশ রপ্ত করে ফেলেছিলেন। কালচারের ক্ষেত্রে এই দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়।
কলকাতা : শহুরে জীবন
কলকাতা শহরে বাস করার কতকগুলি বিশেষ সুবিধাও রয়েছে বলে ফ্যানি তার ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ উল্লেখ করেছেন। আগের চেয়ে রাস্তাঘাট একটু ভাল হয়েছে,
“প্রথম যখন কলকাতায় এলাম, একটাই ভাল রাস্তা ছিল গাড়িঘােড়ার জন্য, এখন গঙ্গারতীরে আর একটা রাস্তা হয়েছে, প্রায় দু’ মাইল লম্বা সন্ধ্যায় জাহাজের কাছ দিয়ে যেতে ভারি ভাল লাগে।”
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হেতু কলকাতার চাকরি পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। ইংল্যাণ্ডের সংবাদও কলকাতায় বসে সবার আগে পাওয়া যায় বা নেওয়া যায়। অসুখ-বিসুখ হলেও এখানে চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে। শীতকালে কলকাতার আবহাওয়া অতি মনােরম বলেও ফ্যানি বলেছেন। কিন্তু শহুরে জীবনের অসুবিধা যেগুলি তারও অভাব নেই। যেমন, বাড়িভাড়ার প্রচণ্ডতা আর নিত্যপ্রয়ােজনীয়ের খরচও অত্যধিক। তাছাড়া কলকাতার মশার উপদ্রব সম্বন্ধেও ফ্যানি উদ্বিগ্ন ছিলেন “গরম ঢের ভাল, কিন্তু মশা একেবারে অসহ্য।” ইঁদুরের উৎপাতও ফ্যানিকে ভাবিয়ে তুলেছিল “বাড়ির নিচের তলায় বিশালাকার ইঁদুরের রাজত্ব, যারা নিচে ঘুমােয় তাদের কামড়ায়।” শহরে মাঝে মধ্যেই জুরও মহামারি রূপে দেখা দিত “ভারতের জ্বর যে কী সাংঘাতিক! আজ আমার স্বামী জ্বরে পড়েছেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকা হল, কিন্তু ওষুধে কোনাে কাজ হল না, শরীরের ঘন্টায় ঘন্টায় অবনতি হচ্ছে।…জ্বরে পড়ার সতেরােদিন বাদে উনি প্রথম কিছু খেলেন।” জ্বরের প্রকোপে তখনকার আদালত, কাসটম হাউস, লটারি হাউস ও কলকাতার অন্যান্য সরকারি অফিস সব বন্ধ পর্যন্ত রাখতে হত। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এই সময় লর্ড আমহার্স্ট মারা যান। তাছাড়া এই সময় কলেরায় ও অত্যধিক গরমে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ জন লােক মারা যাচ্ছিল। সরকারি ব্যবস্থার ফলে ধীরে ধীরে অসুখের প্রকোপ কমে আসে।
ব্রিটিশের আগ্রাসন নীতি
ব্রিটিশ মহিলা হলেও ফ্যানি পার্ক ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধনীতিকে সমর্থন করেননি। সমর্থন করেননি তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে। অকারণ লােকক্ষয়েরও তিনি বিরােধী ছিলেন। বার্মায় ব্রিটিশ আগ্রাসনের তিনি নিন্দা করে বলেছেন,
“বার্মা যুদ্ধের কথা শােনা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই আমরা জয়ী। গতকাল একটা সােনার ও একটা রূপাের তলােয়ার দেখলাম, ভয়ঙ্কর দেখতে, বিশাল এক কশাই-এর ছুরি যেন। একটা নেকলেস (গলায় পেঁচিয়ে মারা হয় বলে ঐ নাম, সিল্কের দড়িতে সােনার পাত আটকানাে), তাতে ছােট ছােট দেবদেবীর মূর্তি কোনাে দেশীয় রাজার কাছ থেকে নেওয়া ত্রয়ােদশ বাহিনীর মেজর সেল এই রাজার সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন ও রাজার নিজের তলােয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করেন।
ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, কোম্পানীর ভারতে আর জায়গা জবরদখলের প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। …
শুনছি বার্মিজ যুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে। আশা করি সত্যি মানুষের প্রাণের কী অকারণ অপচয়, এই আবহাওয়ায় যুদ্ধ! সিক লিভে যাঁরা কলকাতায় আসেন তাদের কাছে শুনি কীভাবে এই আবহাওয়ার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হয়।”
বাঙালি মহিলার পােশাক
আধুনিকায়নের পূর্বে বাঙালি মহিলাদের পােশাক ছিল অতি সরল ও সাধারণ মাত্র একখানি পাঁচগজি শাড়ি, আর কিছু নয়। ফ্যানি পার্কসের গ্রন্থ থেকে মনে হয়, সেকালে শাড়ি খুবই দামি হতাে, কোনাে কোনাে শাড়ির পাড় হতাে সােনার কাজ করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বাঙালি মহিলারা একমাত্র শাড়িই পরিধান করতেন। ফ্যানি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, শাড়ির নিচে অন্য কোনাে বস্ত্রই ব্যবহার করা হয় না। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে এর মিল আছে। তিনি লিখেছেন যে, কেবল শীতকালেই মহিলারা সম্বৎসরের শাড়ির ওপর একটি চাদর পরতেন। (জ্ঞানদান্দিনী দেবী, স্মৃতিকথা’ দেখুন-ইন্দিরা দেবী সম্পাদিত, পুরাতনী, ইণ্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েটেড পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ১৪, ২৯)। অন্য কোনাে বস্ত্র অথবা জুতাে পরা মহিলাদের জন্যে পুরােপুরি নিষিদ্ধ ছিল। জুতােসহ মেয়েদের অন্য কোনাে বস্ত্র পরা সম্পর্কে সেকালের লােকেরা কেমন সংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন তা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা থেকে বােঝা যায়।
“আগে মেয়েগুলাে ছিলাে ভালাে, ব্রত-ধর্ম কর্তো সবে। একা ‘বেথুন’ এসে শেষ করেছে, আর কি তাদের তেমন পাবে। যত চুড়ীগুলাে তুড়ি মেরে, কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। তখন ‘এ বি’ শিখে, বিবি সেজে, বিলাতী বােল কবেই কবে।… সব কাঁটা চামচে ধােরবে শেষে, পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে।… এরা আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।…
বুঝি ‘হুট’ বলে ‘বুট’ পায়ে দিয়ে, চুরুট খুঁকে স্বর্গে যাবে।” স্ত্রীশিক্ষা এবং আধুনিকায়ন বাঙালি মহিলাদের যাবতীয় গুণ কিভাবে বিনষ্ট করবে তার বিবরণ দিতে গিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, আগামী দিনের আধুনিক’ ও ‘পুরুযালি’ মহিলারা হয়তাে নিজেরাই ঘােড়ার গাড়ি চালাবেন, চুরুট টানবেন এবং বুট পরবেন। ঈশ্বর গুপ্ত যদি বা একথা মহিলাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট মনােভাব নিয়েও লিখে থাকেন, তা হলেও একথা সত্যি যে, তখন মহিলাদের গাড়ি চড়া, ধূমপান করা অথবা জুতাে পরা নিষিদ্ধ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে গিয়ে স্ত্রীকে চিঠি লেখেন, তিনি সহানুভূতির সঙ্গে স্ত্রীর কাছে এই প্রণে রাখেন পায়ে মােজা বা পাদুকা পরিতে কি কোন কষ্টবােধ কর?’
আসলে মহিলাদের জুতাে পরার ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথের কোনাে সংস্কার ছিল না। তিনি চিঠিতে যা লেখেন তা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় যে, তখনকার জনপ্রিয় মনােভাব ছিল জুতাে পরার বিরুদ্ধে এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতাে অভিজাত পরিবারের মেয়েরাও তখন জুতাে পরতেন না। ১৮৬৭ সালে ‘বামাবােধিনী পত্রিকায় লেখা হয় যে, এক চাকরানি একজন ইউরােপীয় মহিলাকে পুরুষ বলে ভুল করে, কারণ এই মহিলার পায়ে জুতাে এবং পরনে সেলাই করা বস্ত্র ছিল।
বাঙালি মহিলাদের পােশাক যে অশােভন ছিল, একথা সেকালের বহু পুরুষ ও মহিলাই লিখেছেন। এ বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ তার স্ত্রীকে ১৮৬৩ সালে যা লেখেন তা হলাে বাঙালি মহিলারা এমন পােশাক পরেন যে, তা পােশাক না পরারই সামিল।
এমন মনে করার কারণ কী, তিনি অবশ্য তার ব্যাখ্যা দেননি। অবশ্য বাঙালি মহিলারা কী পােশাক পরতেন ফ্যানি পার্কস তার মােটামুটি বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে তাঁর মতামতও তিনি ব্যত্ত করেন। তার মতে, শাড়ি এত পাতলা ছিল যে, তাকে ‘স্বচ্ছ’ বলাই শ্রেয়। এবং তা আচ্ছাদন হিসেবে অর্থহীন। এর মধ্য দিয়ে অঙ্গপ্রতঙ্গের গঠন এবং চামড়ার রঙ দেখা যেতাে। সুতরাং তিনি বলেন, তাদের বস্ত্র দেখে আমি বুঝতে পারলাম কেন স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষদের অন্তঃপুরে যেতে দেওয়া হয় না। এরপর এ বিষয়ে আমার বিস্ময় দূরীভূত হয়।
ফ্যানি সেকালে মেয়েদের নদীতে স্নানের দৃশ্য, স্নান-প্রার্থনার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অনবদ্য। উত্তর ভারতীয় মহিলাদের চেয়ে বাঙালি মহিলারা যে অধিকতর সুশ্রী ছিলেন তাও লিখেছেন ফ্যানি,
“নদীতে মেয়েদের স্নানের দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছিলাম। নদীতে স্নান করে, কাপড় কাচে, তারপর সেই ভেজা কাপড়ই গায়ে জড়ায় জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে চুল ধােয়, গা ধােয়, কিন্তু সর্বদাই পােশাকের অর্ধাংশ গায়ে থাকে, তাদের চেহারায় একটা ক্লাসিকাল ভাব চুল চুড়াে করে মাথার উপর বাঁধা গ্রীক কায়দায়, নাকে বড় বড় রূপাের নােলক, হাত ভর্তি হাতির দাঁতের চুড়ি, খুব সম্ভব শাখা। মােটা রূপাের বালা, পায়ে রূপাের মল শাড়িও সাদা, তাতে রঙিন পাড় কারো পেতলের ঘড়া, কারো বা মাটির, স্নানের শেষে তাতে করে জল নিয়ে ঘরে যাবে। স্নান হয়ে গেলে তারা করজোড় করে আকাশের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে, তারপর হাতে করে জল নিয়ে নিয়ে বেশ কয়েকবার মুখে দিয়ে পূজা শেষ। করে তারা ভেজা কাপড়ে বাড়ি যায়, পথেই কাপড় গায়ে শুকিয়ে যায়। উত্তর ভারতের মেয়েদের চাইতে বাংলার মেয়েদের চামড়ার রঙ আরও সুন্দর বাঙালিনীরা ছােটখাটো, সুগঠিত ও তাদের চলা সুষমামণ্ডিত।”
রাজকুমার চন্দ্র ১৮৬৩ সালে যা লেখেন তা থেকে প্রায় ৩০ বছর পূর্বের ফ্যানি পার্কসের উৰ্ত্ত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়। রাজকুমার স্নানের পর সিক্ত বসনে এই মহিলাদের কেমন দেখাতাে তার একটি বর্ণনা দেন,
“এখন যে সকল বস্ত্র তাহারা পরিধান করে তাহা বস্ত্র না বলিলেও হয়। আর যখন স্নানান্তে জল হইতে তাহারা ওঠে তখন বস্ত্র পরিধান করিয়াছে কিনা তা হঠাৎ নয়নগােচর হয় না, আর বাবু ভেয়েরা যত সব কাপড় পান, ততই আনন্দপূর্বক যত দাম হউক না কেন, তাহা ক্রয় করিয়া আপন প্রণয়িনীগণকে দিয়া আপনাদিগকে চরিতার্থ ও কৃতকৃতাৰ্থ বােধ করিয়া থাকেন…।
কুসংস্কার ও সেকালের ভারত
ফ্যানির সময়ে ভারতীয় সমাজে যে লেখাপড়ার চল খুব একটা ছিল না তা বলা যায়। মারাঠা মহিলারা সাধারণত লেখাপড়া শেখেন না, তাদের শিখতে দেওয়া হয় না পাছে তারা নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ বলে মনে করতে শুরু করেন। তাদের শেখানাে হয়েছে যে, বড়াে ঘরের মেয়েদের লেখাপড়া শেখা শােভন নয়, তাদের হয়ে কাজ করে দেবেন মুন্সিরা।” নিরক্ষরতা হেতু সমাজে কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল। চন্দ্রগ্রহণের (২১ এপ্রিল ১৮৩৬) ফলে অসুখ, অসুস্থতা, মৃত্যু ও নানা অশুভ ব্যাপার ঘটে বলে। এদেশীয়দের দৃঢ় বির্বাস ছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত নানা অঞ্চলে যে বসন্ত ও পে-গ রােগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল তা নাকি এই চন্দ্রগ্রহণের ফল।
মহিলাদের অবস্থা : পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি
সেকালের নামকরা লেখিকা নগেন্দ্রবালা মুস্তাফী লেখেন যে, বাঙালি মহিলাদের অবস্থা পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতাে। তিনি বলেন, একেবারে বাল্যকাল থেকেই কঠোর পর্দাপ্রথার জন্যই, বঙ্গমহিলারা লেখাপড়া শিখতে পারেন না এবং তার ফলে তাদের মানসিক বৃত্তিসমূহের বিকাশও ঘটে না। সে যুগের মহিলাদের সামাজিক অবস্থা ছিল পুরােপুরি অধীনতার। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে, মহিলাদের সামাজিক অবস্থা সবচেয়ে অবনত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়াতেই এবং এই অবস্থাই স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত হয়।
নিম্নশ্রেণির মহিলাদের অবস্থা অবশ্য তুলনামূলকভাবে উন্নত ছিল—অন্তত উচ্চশ্রেণির মহিলাদের মতাে তারা অন্তঃপুরে বন্দী ছিলেন না অথবা সতীদাহ, কুলীন বহুবিবাহ, একান্নবর্তিতা ইত্যাদি মহিলা নির্যাতনমূলক প্রথার শিকার ছিলেন না। তাছাড়া, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ে তাদের বক্তব্য বিবেচিত হতাে। এর সবচেয়ে বড় কারণ বােধ হয় এই যে, তারা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সহায়তা করতেন। অপরপথে, ভদ্রলােক পরিবারের মহিলারা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন—এমন। প্রত্যাশিত ছিল না। ফলে, তাদের অন্তঃপুরের বাইরে আসার প্রয়ােজনও হতাে না। তারা ছিলেন বরং অলঙ্কারের মতাে—সযত্নে রক্ষিত অথবা এমন ‘পরিচারিকার’ মতাে যিনি সন্তান ধারণ ও লালন-পালন করবেন, সঙ্গ দেবেন এবং বড়জোর গৃহ রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। নিম্নশ্রেণির মহিলাদের যেটুকু স্বাধীনতা ছিল, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা নগণ্য হওয়ায় অথবা আদৌ তেমন কোনাে ভূমিকা না থাকায়, ভদ্রলােক পরিবারের মহিলাদের তাও ছিল না। এইচ এ ডি ফিলিপস্ নামক সে সময়কার একজন সিভিলিয়ন যথার্থই লক্ষ্য করেন,
“নিম্নশ্রেণির লােকেরা যখন ধনী ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে, তখনই মহিলাদেরকে অন্যের কাছ থেকে ঈর্ষার সঙ্গে রক্ষা করার প্রয়াস তথা পর্দা প্রথা কঠোর হয়ে ওঠে।…উচ্চশ্রেণির চাষীরা ক্রমশ কঠোরতর অবরােধ প্রথা চালু করছে। নিম্নশ্রেণির ব্যক্তিরা সচ্ছল হয়ে ওঠার পর প্রায় কোনাে ব্যতিক্রম ছাড়াই দেওয়াল-ঘেরা বাড়ি ও নিজস্ব শৌচাগার তৈরি করে এবং বাড়ির আঙিনার মধ্যে একটি কূপ খনন করে—যাতে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যেতে না হয়।”
অবরােধ প্রথা অবশ্য ভারতবর্ষীয় কোনাে একক আবিষ্কার নয়। বস্তুত, প্রাচীনকালে গ্রীক ও রােমান মহিলাদেরকে পুরুষদের কাছ থেকে আলাদা রাখার রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু উনিশ শতকীয় মহিলারা সম্ভবত সবচেয়ে কঠোর ও ভয়ানক ধরণের পর্দাপ্রথার শিকার হন। বালিকা-বধূসহ সকল বিবাহিত মহিলাকেই লম্বা ঘােমটার আড়ালে মুখ ঢেকে রাখতে হত। রাসসুন্দরী দেবী, যিনি বাঙালি মহিলাদের মধ্যে প্রথম আত্মজীবনী লেখেন, তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, বারাে বছর বয়সে বিবাহ হওয়ার অব্যবহিত পরেই কেমন করে তিনি পর্দার আড়ালে বন্দী হন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্দা প্রথার কঠোরতা হ্রাস পেয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এমনকি ১৮৯০-এর দশকে, নববিবাহিত বধুকে তার শাশুড়ির সঙ্গেও পর্দা মেনে চলতে হত। ইংরেজি শিক্ষিত কোনাে কোনাে ব্রাহ্ম-প্রভাবিত পরিবারের বেলাতেও, বিশেষত মফস্বলে, একথা খাটতাে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা দিয়েছেন যে, ১৮৮৭ সালের শেষ দিকে বিয়ের পর তার মাকে কেমন করে পর্দার নিয়ম মেনে চলতে হত “বিয়ের পর পুরাে পাঁচ বছর আমার মা তার শাশুড়ির সঙ্গে একটি কথাও বলেননি অথবা তার সামনে ঘােমটাও খােলেননি। ঘরের কর্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সমস্ত ‘আলাপ’ সারতে হতাে মাথা নেড়ে— উপরে নিচে নেড়ে সম্মতি এবং আড়াআড়ি নেড়ে অসম্মতি জানাতে হতাে। যতদিন না ঘরের অন্য কোনাে মহিলা দেখতে পেয়ে কর্তাকে না জানাতেন, ততােদিন তার কিছু আবশ্যক হলে, তা ছাড়াই সন্তুষ্ট থাকতে হতাে।” যদি নীরদচন্দ্র চৌধুরীদের মতাে শিক্ষিত ব্রাহ্ম-প্রভাবিত পরিবারেই পর্দার এত কড়াকড়ি থেকে থাকে, তাহলে ঐতিহ্যিক হিন্দু পরিবারে তা কতটা কঠোরভাবে পালিত হত, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
পুরুষ বা মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করার তুলনায় অনেক গুরুতর একটি অবিশ্বাস্য ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন বেগম রােকেয়া। এ থেকে বােঝা যায়, মহিলারা কেমন ধর্মীয় উৎসাহ নিয়ে পর্দা পালন করতেন। রােকেয়ার এক অভিজাত আত্মীয়া কিউল স্টেশনে ট্রেনে উঠছিলেন। তার পরনে ছিল একটি ভারী বােরখা এবং সঙ্গে ছিল এক দাসী। তিনি হঠাৎ টফর্ম এবং ট্রেনের মাঝখানকার চাপা জায়গাটার ভিতর পড়ে যান। দাসীটি বােরখা ধরে তাকে ট্রেনে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু বােরখাটি আটকে যায় এবং মহিলা উঠতে অসমর্থ হন। উপস্থিত কয়েকজন কুলি সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, কিন্তু দাসীটি কিছুতেই তাদেরকে সাহায্য করতে দিতে রাজি হয়নি। ট্রেন ছাড়ার সময় আগেই হয়ে গিয়েছিল তবু ট্রেনটি প্রায় আধঘন্টা বিলম্ব করে। কিন্তু তখনাে মহিলা উঠতে না পারায়, শেষ পর্যন্ত ট্রেনটি ছেড়ে দেয়। ফলে মহিলা সেখানেই পিষ্ট হয়ে মারা যান। এ ঘটনা সত্য হলে, এর থেকে ভয়াবহ ধরণের পর্দা আর কী হতে পারে? রােকেয়া তাঁর গ্রন্থে অবরােধবিষয়ক আরাে ৪৬টি রােমহর্ষক ঘটনার উল্লেখ করলেও, কোনােটিই এমন বীভৎস বা নিষ্ঠুর নয়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী এবং রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী যেভাবে গঙ্গার ‘পবিত্র’ জলে স্নান করতেন, তাকে অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু তা স্পষ্টত সেকালের অবরােধ প্রথার কঠোরতাকেই প্রমাণ করে। যখন সারদা দেবী গঙ্গাস্নান করতে চাইতেন, তখন পাল্কিবাহকরা তার পাল্কিটি পুরােপুরি গঙ্গায় চুবিয়ে নিয়ে আসতাে আর তিনি পাল্কির মধ্যে বসে থাকতেন। এ জাতীয় শারীরিক অবরােধকে সরাসরি কারাবাসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পর্দা মানা ছাড়া, মেয়েদের গাড়িতে চড়া বারণ ছিল। তঁাদের স্বাধীনভাবে ভাববার কোনাে মানসিক স্বাধীনতাও ছিল না। ১৮৬০-এর দশকের ব্রাহ্মরা দাবি করেন যে, তাদের। কোনােরূপ ধর্মীয় স্বাধীনতাও ছিল না।
কৈলাসবাসিনী দেবী তার ‘হিন্দু মহিলার হীনাবস্থা’ গ্রন্থে কৌলীন্য, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, পরিবারে মহিলাদের মর্যাদা এবং স্বামী ও এশুর বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মহিলাদের সম্পর্ক বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। সম্ভবত নিজে বিধবা না হওয়ার দরুণই তিনি বিধবাবিবাহ সম্পর্কেও নির্দ্বিধায় তার মতামত দেন। তিনি বৈধব্যের কষ্টকে অসহনীয় বলে গণ্য করেন। ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি লক্ষ্য করেন যে, যে প্রাচীন শাস্ত্রকারগণ দয়াকে মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ বলে অভিহিত করেন, সেই একই শাস্ত্রকারগণ নির্দয়ভাবে বালবিধবাসহ সকল বিধবার জন্যে বাধ্যতামূলক ব্রহ্মচর্য, উপবাস এবং অন্যান্য শারীরিক কৃচ্ছসাধনার বিধান দেন। বিধবাদের প্রতি কিরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হয় আর এক অজ্ঞাত মহিলা ১৮৭০ সালে তার একটি বিস্তারিত বিবরণ দেন। অসংখ্য কমবয়সী বিধবার দুঃখকষ্টের সমাধান পুনর্বিবাহের দ্বারাই হতে পারে—এ কথা স্পষ্টভাবে না বললেও, তিনি বিধবাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে চেষ্টা করেন।
এরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পূর্বে অর্থাৎ ফ্যানির ভ্রমণের সময়ে নারীদের অবস্থা যে ভয়াবহ ছিল তা তার ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’ হতে যেভাবে ধরা পড়ে তা যেন পূর্বোক্ত আলােচনাকেই মান্যতা দেয়,
১. উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম সমাজের নারীরা ছিলেন ভীষণভাবে অন্তঃপুরচারিনী।
২. সাধারণভাবে মেয়েদের ঘােড়ার গাড়ি চড়ে বেড়ানাে ছিল নিষিদ্ধ। তবে উচ্চবর্ণের হিন্দু মহিলারা ঘােমটা দিয়ে ঘােড়ার গাড়ি চড়তেন, কোন পথচারী তখন সেখান দিয়ে যেতে পারত না।
৩. মহিলারা কঠোর পর্দাপ্রথা বা অবরােধ প্রথায় আবদ্ধ ছিলেন। মারাঠা মহিলারা নৌকা বাইলেও সেখানেও ছিল পর্দার কড়াকড়ি।
৪. হিন্দু বিধবাদের অবস্থা ছিল আরও শােচনীয়। তরুণী হলেও বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি ছিল না। এটা কঠোরভাবে মান্য করা হত। বহু খাবার তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। গয়না পরাও নিষিদ্ধ। তাদের মেঝেতে শুতে হত, খাটে শােওয়াও তাদের বারণ। খ্রিস্টান বিধবাদের অবস্থাও সেকালে সন্তোষজনক ছিল না। খ্রিস্টান বিধবাদের নিজের বাড়িতে থাকার অধিকারই ছিল না।
৫. পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহের চল বেশ রমরমিয়ে চলত। এমনকি খ্রিস্টান স্ত্রীরাও যেন ছিল স্বামীর আইনসঙ্গত দাসী। সেকালের ভারতে মেয়ে জন্মানাে ছিল অভিশাপ আর ছেলে জন্মানাে ছিল যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ। এছাড়া পাহাড়ের মেয়েরা তাদের কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলে মেয়েদের জীবন অসহনীয় বলে। বৌ-এর জন্য অনেক টাকা লাগে, কারণ মেয়ের সংখ্যা কম এবং তাই বােধহয় এই বিশ্রী রীতি এদের মধ্যে।
এলাহাবাদে বদলি : বারাণসী—মন্দিরের শহর দর্শন
কলকাতায় প্রায় চার বছর চাকরীর পর চার্লস পার্ক এলাহাবাদে বরফ কারখানার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে বদলি হন। নদীপথে কলকাতা হতে এলাহাবাদ ৮০০ মাইল এবং স্থলপথে ৫০০ মাইল বলে পার্কস দম্পতি ঠিক করলেন জলপথে নৌকায় করে ভারী মালপত্র পাঠিয়ে নিজেরা গাড়িঘােড়া করে এলাহাবাদ যাবেন। ২২ নভেম্বর ১৮২৬ যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাঁকুড়া হাজারিবাগ শেরঘাটি সাসারাম নহবতপুর মােঘলসরাই হয়ে ২৫ ডিসেম্বর তারা বারাণসী পৌঁছলেন। এখানে আতিথ্য গ্রহণ করলেন সিভিলিয়ান এক বন্ধুর বাড়িতে। তারপর বারাণসী ঘুরে দেখার পালা। বারাণসী হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান। শহরটি ছােট, রাস্তাঘাট সরু এবং অলিগলি যুক্ত। এখানকার সামাজিক পরিবেশ যেন ধর্ম দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বারাণসী দেখার অভিজ্ঞতা ফ্যানির ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে,
“বারাণসী হল ভারতের হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থনগর, এর পথঘাট, ইটকাঠ, দেবদেউল, ঘাটমাঠ, এমনকি নাচিয়ে বাজিয়ে পর্যন্ত সবকিছু অতি পবিত্র। এ হেন প্রাচীন পবিত্র শহর দেখার লােভ আমি সম্বরণ করতে পারলাম না।
আগে কলকাতা শহরে থেকেছি, তাতে বারাণসীর মতন শহর সম্বন্ধে বিশেষ কোনাে ধারণা হয় না। কলকাতায় নানা জাতির লােকের বাস, প্রত্যেক জাতি ইচ্ছা করলে তাদের নিজস্ব সামাজিকতার মধ্যে কালযাপন করতে পারে। বারাণসীতে তা সম্ভব নয়। ধর্ম, পুণ্য, ভক্তি, পরকাল-চিন্তা, পূজাপার্বণ ইত্যাদি নিয়েই বারাণসীর সামাজিক পরিবেশ রচিত হয়। সেদিন হিন্দুদের একটি মন্দিরে পূজা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, হিন্দুদের ধর্মবিাসের যন্ত্রটি দেহের মধ্যে বােধ হয় ঈশ্বর একটু বিশেষ কারিগরি করে তৈরি করেছেন।
ভােরে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম আরম্ভ করার আগে প্রত্যেকটি লােক দেবদেবীর পূজার্চনা করতে যায়। তাদের হাতে একটি ছােট পিতলের পাত্রে তেল থাকে, একটিতে থাকে ভাত আর একটিতে গঙ্গাজল ও ফুল। মন্দিরে এসে দেবতার মাথায় তারা। সেগুলি ঢেলে দেয়, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে, এবং যাবার সময় সামনে ঝােলানাে একটি ছােট ঘন্টা তিনবার বাজিয়ে চলে যায়। পুরুষ ও মেয়ে সকলেই তাই করেন। এইটাই নাকি এখানকার প্রথা।
মন্দিরের ভিতরে বিচিত্র সব মূর্তি আছে, তার মধ্যে কালাে ও সাদা পাথরের তৈরি দুটি ষাঁড় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্দিরের বাইরে দুটি জ্যান্ত ষাঁড় প্রায় সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, শােনা যায় তারাও নাকি পবিত্রতার প্রতিমূর্তি এবং দেবতার মতনই আরাধ্য। ফল-ফুল, ভােগ-নৈবেদ্য ভক্তরা তাদেরও দিয়ে থাকেন।…আমি কতকগুলি পূজার পিতলের ঘটি সংগ্রহ করলাম। ইচ্ছা হল বাড়িতে ফিরে শিশুটিকে বিগ্রহ সাজিয়ে তার কোকড়ানাে চুলভরা মাথায় ঘটি করে তেল ফুল ও গঙ্গাজল ঢেলে হিন্দুদের মতন দেবপূজার মহড়া দেব।”
এলাহাবাদ : বরফ তৈরির কারখানা
ফ্যানির স্বামী এলাহাবাদে এলেন বরফের কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে। বরফ বানানাের পদ্ধতি ও বরফের অপরিহার্যতা সম্বন্ধে ফ্যানি আমাদের নানা তথ্য দিয়েছেন। জানুয়ারি ১৮২৮-এ প্রচণ্ড শীতের সময় রােজ রাতেই বাষ্পীভূত করে বরফ বানানাে হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি অবধি কাজ চলেছিল। তারপর বরফের খাদ মাটি দিয়ে বন্ধ করা হয়।
আবদারের উপর বরফ কারখানার ভার থাকে। সন্ধ্যাবেলা সে আবহাওয়া লক্ষ্য করে, বরফ বানানাে সম্ভব কিনা বােঝার চেষ্টা করে। এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কারণ বরফের গহ্বর ভর্তি করা ব্যয় সাপেক্ষ। পরের দিন সকালে বরফ তৈরি হবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তা করা যাবে না। বাতাসের গতি ও তাপ বুঝে কুলিদের জড়াে করে জল ঢেলে সমস্ত রেকাবি ভর্তি করা হয়। রাত যদি ঠাণ্ডা হয় কিন্তু হাওয়া না থাকে তাহলে দেড় ইঞ্চির মত সাধারণত বরফ জমে। ঠাণ্ডা বেশি ও জোরে বাতাস বইলে বরফের পরিমাণ বেশি হয়।
বরফের শক্ত সমতল চাই তৈরি হয়ে গেলে তার উপর মাদুর বিছিয়ে, মাদুরের উপর খড়ের স্তুপ চাপা দেওয়া হয় ও বরফ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাধারণত ১লা মে বরফের দরজা খােলা হয়। এই বরফ মােটামুটিভাবে আগস্ট পর্যন্ত চলে যায়। এলাহাবাদের প্রত্যেক সদস্যের জন্য একদিন অন্তর প্রায় কুড়ি কেজি বরফ বরাদ্দ। অত্যধিক গরমের জন্য (৯৩ ডিগ্রি) স্থানীয় লােকেদের বরফের সাহায্য না নিয়ে উপায় নেই। তারা নিজেরা বরফ বানিয়েও নেয়। প্রয়ােজনে তাদের ‘সাহেব’দের বরফ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
কলকাতায় প্রথম বরফ আসে ১৮৩৩ সালে। বিশাল বিশাল বরফের স্বচ্ছ চাই, দু’আনায় এক সের। ভারতে তৈরি বরফের চেয়ে এই বরফ অনেক উন্নতমানের, কারণ ভারতের বরফ পিটিয়ে গুঁড়াে করা হয় বলে তাড়াতাড়ি গলে যায়। শুধু বিলাসিতার জন্য নয়, এই গরমে বরফ খুবই কাজে লাগে—চিকিৎসার জন্য বরফ দরকার। জ্বর হলে মাথায় বরফ দিলে উপশম হয়।
এলাহাবাদ : ভারতের উনুন
গ্রীষ্মকালে এলাহাবাদের তাপমাত্রা ৯০/৯১ ডিগ্রি ফারেনহাইট—‘এলাহাবাদ সগর্বে ভারতের উনুন বলে দাবী করতে পারে। এই অসহনীয় গরমেই শুরু হয় মড়ক ও দুর্ভিক্ষ। ইউরােপীয়দের জ্বর, ম্যালেরিয়ার অন্ত ছিল না। তার উপরে রয়েছে। তাদের বাতের সমস্যা। দেশীয়দের মধ্যে কলেরার প্রকোপ বেশী। এই সময় এলাহাবাদে কলেরায় মারা গিয়েছিল ৭৬ জন। সবল সুস্থ লােক কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যাচ্ছেন। আসলে এই গরমে কোনােমতে বেঁচে থাকা যায় মাত্র। লােকে খেতে ভয় পেত। ধারণা পেট ভরে খেলেই কলেরা হয়। একটু বৃষ্টি হলে কলেরার প্রকোপ কমে, কিন্তু সে বৃষ্টিরও দেখা নেই। ফলে দেশীয়রা সেসময়ে এলাহাবাদ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।
এলাহাবাদ : জীবনযাত্রা
বারাণসী ঘুরে পাঁচ-ছদিন পরে ফ্যানি এলাহাবাদে পৌঁছলেন ১ জানুয়ারি ১৮২৭। এলাহাবাদ শহরকে বলা হয় ‘নেটিভদের শহর’। সুন্দর শহর এলাহাবাদ। পাকা দালান বেশি নেই। প্রাচ্যের ধনী ব্যবসায়ীদের লােকদেখানােপনা নেই। সাধারণত বাঁশ ও খড়ের চালের বাড়িতেই তারা থাকেন। শহরের পথঘাট চমৎকার। দুপাশে গাছের সারি। বেড়ানাের জায়গা প্রচুর। সুন্দর একটা সরাইখানা ও বিশাল এক দর্শনীয় কুয়াে আছে। সুলতান খসরুর কবরখানা ও বাগান খুবই ভাল। কেল্লাটা নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট আকবর ১৫৮১ সালে গঙ্গা-যমুনার মিলনস্থলে। এখানকার আবহাওয়াও বেশ চমৎকার। স্টীমবাথ বা বাষ্পস্নানের অভিনব পদ্ধতি ফ্যানিকে অবাক করেছিল। তবে এখানকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রা বেশ সহজ ও সরল। প্রতি বাড়িতে মহিষের পালন বিশেষভাবে লণীয়। মহিষের দুধ খুব ঘন, সাধারণত মাখনের চেয়ে ঘি-এর জন্যই বেশি ব্যবহৃত হয়। মহিষের ঘি দিয়ে রান্নাও হয়। মহিষ ছাড়াও গরু, ছাগলেরও সে সমাজে বেশ কদর ছিল। মাঝে মধ্যে দুম্বা, ভেড়াও দেখা যেত। তবে দুম্বাদের বাঁচিয়ে রাখার বড় বাধা ছিল এলাহাবাদের প্রতিকূল আবহাওয়া। দুম্বাদের লম্বা লেজ সুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত বলে ফ্যানি উল্লেখ করেছেন।
এলাহাবাদ : সবজি, ফুল
এলাহাবাদে সবজী চাষ খুব ভাল হত। বিশেষ করে পেটমােটা কড়াইশুটি, গাজর, কল্মিশালুক ইত্যাদি। এলাহাবাদের গাজর সে সময়ে ভারতে শ্রেষ্ঠ বলে খ্যাত। বাড়িতে রান্না ছাড়াও ঘােড়ার খাদ্য হিসেবে গাজর ব্যবহৃত হত। সজীর মরশুমে বাগানে বাগানে নানা রঙের ফুল ফুটত। বিশেষ করে করবী—ঘন লাল, সাদা, গােলাপী। এর পাতায় নাকি বিষ, মেয়েরা এই পাতা খেয়ে আত্মহত্যা করত, লিখেছেন ফ্যানি।
এলাহাবাদ : হিন্দুদের বিশ্বাস
সে সময়ে (জানুয়ারি ১৮২৮) এলাহাবাদের হিন্দু সমাজে পিপুল গাছকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হত। এর বড় বড় পাতা খুব সুন্দর ও পবিত্র। হিন্দুরা মনে করেন পিপুল গাছের প্রতিটি পাতায় বিষ্ণু বাস করেন, ওই পাতার মর্মরধ্বনি নাকি তার প্রিয় শব্দ। হিন্দু মেয়েরা পিপুল গাছের ফল খেত বন্ধ্যাত্ব ঘােচানাের জন্য। পিপুল তাই পবিত্র গাছ হিসেবে সম্মানিত হিন্দু নারীপুরুষ এই গাছের তলায় দেব-দেবীর মূর্তি রেখে ফুল দিয়ে পুজো করে জল ঢালত। ঠিক যেমন বাঙালি হিন্দুর তুলসি পুজোর মত। তাছাড়া পঞ্চায়েত বসে পিপুল গাছের তলায়। গাছের পাতা হাতে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি ভগবানের নাম নিয়ে সত্য বলার শপথ করে (সে যেমন ওই পাতাকে পিষে ফেলতে পারে, মিথ্যা বললে ভগবানও তেমনি তাকে যেন পিষে ফেলেন)। এছাড়া হিন্দুরা কার্তিক মাসে দেবতাদের সম্মানে বাঁশের ডগায় ডগায় আলাে জ্বালেন দেবতাদের সম্মানে। এমন বহু আচার ও সংস্কারকে ফ্যানি পার্ক মান্যতা দিলেও তার বন্ধুরা যে এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন তাও বলেছেন তিনি।
এলাহাবাদ : ধর্মীয় জীবন
এলাহাবাদের মানুষ যে খুব ধর্মপ্রাণ তা এখানে এসে বুঝলেন ফ্যানি। যেখানে সেখানে মন্দির, ধর্মশালা ইত্যাদি। শিব, রামসীতা, লক্ষ্মণ, হনুমান প্রভৃতি দেবতাদের মূর্তি রয়েছে মন্দিরে মন্দিরে। সেখানে তারা পূজিত হন। তবে হনুমান বেশি মান্যতা পায়। এলাহাবাদের ধর্মশালাটি বেশ সুন্দর, সেখানে ভিক্ষু দান করা হয়। ধর্মশালার দু’পাশে রয়েছে দুটি ছােট আটকোণা শিব মন্দির। তবে সে সময়ে (অক্টোবর ১৮২৯) ফ্যানিকে সবচেয়ে চমৎকৃত করেছিল এলাহাবাদের প্যারেড গ্রাউণ্ডের রামলীলা উৎসব তথা রাবণ পােড়ানাে উৎসব,
“প্যারেড গ্রাউণ্ডে গিয়েছিলাম রামলীলা উৎসব দেখতে। বীর রামকে সিপাইরা খুব সম্মান করে। বিরাট এক মূর্তি করা হয়েছে এখানে রাবণের, উইন্ডমিলের সমান, তার পেটের ভেতর নানারকম বাজি পােরা। রাম ঐ রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। প্যারেডে সিপাইরা অনেক রকম খেলা দেখালাে। নকল যুদ্ধ, কুস্তি, বাজি। দশ-বারাে বছরের দুটি বাচ্চাকে রামসীতা সাজানাে হয়েছিল, আর পেছনে ল্যাজ লাগিয়ে লােকে সেজেছিল বানর সেনানি ও তাদের নেতা হনুমান।
বেছে বেছে সবচাইতে সুন্দর বাচ্চাদেরই রামসীতা সাজানাে হয় এবং এরপর তারা নাকি এক বছরের বেশি বাঁচে না জানি—তবে লােকে বলে তাদের বিষ খাওয়ানাে হয়। তামাশার শেষে বিজয়ী বীর রাম রাবণকে পুড়িয়ে উড়িয়ে দিলেন।”
সতীদাহ প্রথা ও সেকালের ভারত
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। আইন পাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে সতীদাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তারপর অবশ্য কিছু কিছু ঘটনার কথা শােনা যায়। কিন্তু সেগুলি বিরল ব্যতিক্রম। ভারতের ইতিহাসে একটা কলঙ্ক চিহ্নের মতাে সতীদাহের কাহিনি চিরকাল বিধৃত হয়ে থাকবে। তবে তার স্মৃতি এখন ইতিহাসের পাতাতেই নিবদ্ধ। এই নিষ্ঠুর কলঙ্কজনক প্রথা বােধহয় আমরা একেবারে ভুলে যেতে পারলে স্বস্তি পাই। তাই সতীদাহের মতাে এত বড় একটি সামাজিক কু-প্রথা নিয়ে কোনও আলােচনা বড় একটা দেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যেও এতবড় একটি সামাজিক কলঙ্কের কথা বিশেষ কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি।
কোম্পানির আমল শুরু হবার পর থেকে ইংরেজরা ঘােষণা করে যে, দেশের প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি যতই নৃশংস হােক, তাতে বাধা দেওয়া হবে না। পাছে বাধা দেবার ফলে প্রজাদের মধ্যে কোনও বিদ্রোহ দেখা দেয়, এই ছিল কোম্পানির ভয়। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে নৃশংস সহমরণ প্রথা বাংলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি প্রচলিত হয়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের বিবরণ থেকে জানা যায় মুসলমান আমলে রাজ দরবারে বিরূপতার আশঙ্কায় সতীদাহের ঘটনা খুবই কমে গিয়েছিল। আকবর চেয়েছিলেন সহমরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে। ঔরঙ্গজেবের সময়েও সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিস্ক্রিয়তার সুযােগে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সহমরণের সংখ্যা বেড়েই চলল।
কলকাতা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে অনেক সহমরণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় বলে ফ্যানি তাঁর ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ উল্লেখ করেছেন। বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিতে সমাজ কেন উৎসাহিত করত তার সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ তিনটি সামাজিক কারণ উপস্থিত করেন। প্রথমত, সহমৃতার স্বামী ধনী ব্যক্তি হলে স্ত্রীর মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজনের পক্ষে সেই সম্পত্তি অধিকার করা সহজ হয়। দ্বিতীয়, যদি স্ত্রীলােকটি নিঃস্ব হয় তাহলে তাকে ভরণপােষণের দায়িত্ব থেকে পরিবারের লােকেরা মুক্তি পাবে। তৃতীয়ত, অল্পবয়সি বিধবাদের চরিত্র স্থলনের আশঙ্কা থাকে, সুতরাং সহমৃতা হলে পারিবারিক কলঙ্কের ভয় থাকে না।
অনেকের ধারণা আছে সতীদাহ বুঝি শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যে হত, তা ঠিক নয়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৫৭৫টি সতীদাহের ঘটনা জানা যায়। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ২৩৫ ক্ষত্রিয় ৩৪ বৈশ্য ১৪ এবং শূদ্র ২৯২। ওই বছর কলকাতার শহরতলিতে ৪৬ জন নারী সতী হয়েছিল, এদের মধ্যে ব্রাহ্মণের সংখ্যা ১৭, সবচেয়ে কম বয়সের সতী ছিল উনিশ বছরের তরুণী নিঃসন্তান। স্বামীর মিস্ত্রির কাজ থেকে মাসিক আয় ছিল দশ টাকা। ব্রাহ্মণ সতীদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ছিল পঞ্চাশ থেকে আশির মধ্যে। এদের মধ্যে কনিষ্ঠতমের বয়স ছাব্বিশ। স্বামীর নাম ব্রজগােপাল গােস্বামী যজমানী করে মাসিক আয় ছিল সাতান্ন টাকা। রামজীবনের স্ত্রী সত্তর বছর বয়সে সতী হয়। লােকের চুল দাড়ি কামিয়ে তার আয় হত মাসে তিন টাকা। ওই বছর কলকাতার শহরতলিতে যাদের স্ত্রী সতী হয়েছে তাদের মধ্যে রামজীবন ছিল দরিদ্রতম ব্যক্তি।
১৮১৭ সালের নিষেধাজ্ঞা বিধি জারি হবার পর রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করে। রাজা রাধাকান্তদেব ছিলেন ওই আন্দোলনের নেতা। তিনি সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন যেন ধর্মাচরণে সকলপ্রকার বাধা অপসারণ করা হয়। রাজা রামমােহন রায় উত্তরে একটি প্রতিবাদী আবেদনে নিষেধাজ্ঞা বিধি সমর্থন করেন। কেরী প্রমুখ পাদ্রীরা আর একটি নতুন আবেদন করে জানালেন সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ব্যবস্থা নেওয়া হােক, না হলে এই পাপ সমাজ থেকে উৎপাটন করা যাবে না।
এলাহাবাদ : সতীদাহের ঘটনা
সতীদাহ কলকাতায় অনেক দেখা গেলেও ফ্যানির স্বচক্ষে তা দেখার সুযােগ হয়নি অবস্থানগত প্রতিবন্ধকতার কারণে। কিন্তু এলাহাবাদে এসে ফ্যানি গঙ্গাতীরে নিজের চোখে সতীদাহ দেখলেন। এটা ঠিক, ফ্যানি অমানবিক প্রথা সতীদাহের বিরুদ্ধে খুব জোরালাে বক্তব্য রাখতে পারেননি। তবে তার দৃঢ় বিধাস ছিল যে সতীদাহ হতে মুক্ত হতে না পারলে কোনমতে সমাজের কল্যাণ হতে পারে না। ভারতের সমাজবেত্তারা তা যে বুঝতেন না তা নয়, কিন্তু তবুও রমরমিয়ে চলত সতীদাহ, সর্বসমক্ষে। এই সতীদাহের পেছনে আত্মীয়দের যে সম্পত্তি ভােগ দখলের প্রয়াসটাই মুখ্য ছিল সে বিষয়টিও ফ্যানি বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন। তিনি বলেছেন, কুচত্রী আত্মীয়দের তাড়নার শিকার হয়ে অসহায় নারীরা সহমরণে যেতে বাধ্য হত। তার বক্তব্য, প্রশাসন সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিলে ভারতে এত সতীদাহ ঘটত না। ফ্যানি এলাহাবাদে একটা সতী হওয়ার ঘটনার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তার ‘ভ্রমণ বৃত্তান্ত’-এ,
“আমাদের বাড়ির খুব খাছে একজন ধনিক বাস করত। তার ব্যবসা ছিল ধান-চাল-গমের। জাতিতে হিন্দু। একদিন শুনলাম সে মারা গেছে। সেদিন নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ। সকালে উঠে দেখি বাজারে খুব ভিড় হয়েছে, লােকজনের হল্লা হচ্ছে। ঢাকঢােল, ড্রাম, টমটম, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি মহানন্দে বাজানা হচ্ছে। হঠাৎ এত ধুমধাম করে বাজনা বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশের কারণ কি জানবার কৌতুহল হল। খোঁজ করে খবর পেলাম, মৃত বেনের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাবার সংকল্প করেছে। সতী হবে, সতী হবে একটা সােরগােল পড়ে গেছে। তারই জন্য এত আনন্দ।
স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট মহিলাকে ডেকে পাঠিয়ে যুক্তি দিয়ে বােঝাবার চেষ্টা করলেন যে সহমরণে কোন লাভ নেই। যে মৃত তার জন্য প্রাণ দিয়ে কোনাে পুণ্য সঞ্চয় করা যায় না। কিন্তু হাকিমের কোনাে যুক্তিতেই কাজ হল না, রমণীর সংকল্প অটল রইল। অবশেষে হাকিম তাকে টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তাতেও কিছু হল না। এসব কথার উত্তরে হিন্দু রমণীটি বললেন, হুজুর, আপনি যদি আমাকে আমার মৃত স্বামীর সঙ্গে সতী হতে বাধা দেন তাহলে আমি এই আদালতেই আপনার সামনে গলায় দড়ি দিয়ে মরব’। এই কথা বলে সে দু’হাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে লাগল। শাস্ত্রকাররা নাকি বলেন যে সতীর প্রার্থনা ও কামনা কখনও ব্যর্থ হয় না, দেবতারা পর্যন্ত তা শুনে বিচলিত হন। অতএব সেই রমণীর মুখ দিয়ে যখন সতী হবার বাসনা প্রকাশ পেয়েছে তখন তার কোনরকম নড়চড় করার সাধ্য নেই কারও, হাকিম তাে দূরের কথা দেবতারও নেই।
শাস্ত্রে আছে, পতির মৃত্যুর পর থেকে চিতায় সতী হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিধবা স্ত্রী জলস্পর্শ করতে পারবে না, করলে সে সতী হতে পারবে না। বেশীক্ষণ উপবাস করে থাকলে যদি রমণীটি (ধার তাড়নায় কিছু খেয়ে ফেলে এবং তার জন্য সতী হতে পারে এই আশায় হাকিম সেই বেনের মৃতদেহ ৪৮ ঘন্টা, অর্থাৎ পুরাে দুদিন আটকে রাখলেন। বিধবার কাছে প্রহরী বসিয়ে রাখা হল কিছু খায় কিনা দেখার জন্য, কিন্তু সে কিছুই খেল না। কাজেই সহমরণ নিবারণের সমস্ত উপায় একে একে ব্যর্থ হবার পর হাকিম সাহেবও হতাশ হলেন। পরদিন সতীদাহ দেখার জন্য গঙ্গার ঘাটে লােকের ভীড় হল খুব, প্রায় পাঁচহাজার লােক জমা হয়েছিল মনে হয়। আমার স্বামীও হাকিমের সঙ্গে সতীদাহ দেখার জন্য গঙ্গাতীরে গেলেন। তীরের উপর চিতা সাজানাে হল এবং তার উপর সেই বাসী মৃতদেহও চাপিয়ে দেওয়া হল। হাকিম চারিদিকে পাহারা দাঁড় করিয়ে দিলেন, যাতে কোনাে লােক জ্বলন্ত চিতার দিকে না আসতে পারে।
গঙ্গাস্নান করে বেনের বিধবা পত্নী একটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিল, স্বামীর চিতার চারপাশে ঘুরে বেড়াল তাই নিয়ে, এবং শেষে চিতায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার উপর হাসিমুখে উঠে বসল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল চিতায়, সে তার স্বামীর মাথাটি কোলের উপর তুলে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল আগুনের মধ্যে। মুখে কয়েকবার উচচরণ করল, রাম নাম সত্য, রাম নাম সত্য।
বাতাস লেগে আগুন যখন শিখা বিস্তার করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করল তখন সতী রমণী হাত-পা ছুঁড়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করতে আরম্ভ করল, চেষ্টা করল চিতার উপর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পাশে যে একজন হিন্দু পুলিশ দাঁড়িয়েছিল তার উপর অত্যাচার না করা হয় দেখার জন্য, শেষ পর্যন্ত সেই-ই তাকে লাঠি তুলে মারতে উদ্যত হল। ভয়ে শিউরে উঠে সতী আবার এগিয়ে গেল চিতার দিকে। তাই দেখে হাকিম হিন্দু পুলিশটিকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। সতী চিতার দিকে একটু এগিয়েই লাফ দিয়ে দৌড়ে পালাল, এবং ছুটতে ছুটতে গিয়ে কাছে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমবেত জনতা এবং মৃত বেনিয়ার আত্মীয়স্বজন ও ভাইরা, একডাকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ধরে আন হতভাগীকে, মেরে ফেল, কেটে ফেল, বাঁশের বাড়ি দে মাথায়, হাত-পা বেঁধে চিতায় ফেলে দে।’
এই কথা বলে হৈ হৈ করে দৌড়ে যখন তারা পলাতক সতীকে ধরতে গেল তখন উপস্থিত দু’চারজন ভদ্রলােক, হাকিম ও পুলিশ তাদের তাড়া করে বিদায় করে দিলেন।
সতী রমণী এবারে শান্ত হয়ে খানিকটা জল পান করল এবং তার লাল কাপড়ের আগুনও নিবিয়ে ফেলা হল। পরক্ষণে সে বলল, চিতায় তাকে উঠতেই হবে, সতী হতেই হবে, তা ছাড়া গতি নেই।
হাকিম ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত দিয়ে (তাতে অবশ্য সেই রমণী লােকের কাছে অপবিত্র হয়ে গেল) বললেন, শাস্ত্রমতে আর তােমার সতী হওয়া চলবে না। মা! আমি জানি একবার চিতায় উঠে ছেড়ে চলে এলে আর তাতে ওঠা যায় না। কাজেই আর তােমাকে সতী হতে আইনত আমি দিতে পারি না। জানি আজ থেকে তােমাকে হিন্দু-সমাজে একঘরে হয়ে বিনা দোষে কলঙ্কিত জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তার জন্য তােমাকে একটুও চিন্তা করতে হবে না। কোম্পানির গবর্নমেন্ট তােমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবেন, তােমার খােরাকপােশাকের অভাব হবে না।
এই কথা বলে হাকিম স্ত্রীলােকটিকে পালকি করে, সঙ্গে একজন পাহারাদার দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। জনতা পালকির পথ ছেড়ে দূরে সরে গেল অবজ্ঞায় মুখ ঘরিয়ে অপবিত্র, অ-সত্য রমণীর মুখ দর্শন করাও পাপ। হিন্দুরা যে যার বাড়ি গিয়ে পরম বিজ্ঞের মতন এই কথা আলােচনা করতে লাগল। মুসলমানরা বলল, ভালই হয়েছে, জেনানার জান বেঁচেছে, তবে সাহেবসুবাে হাকিম-হুজুরের জন্য এমন সুন্দর একটা তামাসা শেষ পর্যন্ত দেখা গেল না এই যা আফশােস!
বাস্তবিকই হাকিম ও কয়েকজন ইংরেজ ভদ্রলােক যদি সেখানে উপস্থিত না থাকতেন তাহলে হিন্দুরা স্ত্রীলােকটিকে মেরে কেটে যেভাবে হােক তার মৃত স্বামীর সঙ্গে ঐ চিতায় দাহ করত। তারপর বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াত যে, স্বেচ্ছায় সে সতী হয়েছে, তার মতন পুণ্যবতী রমণী আর কেউ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ত্রীলােকটি চিতায় উঠে বসার সময় শাস্ত্রসম্মত বিধান অনুযায়ী কয়েকবার বলেছিল, এর আগে আমি ছ’বার জন্মগ্রহণ করেছি এবং ছ’বার আমার মৃত পতির সঙ্গে সহমরণে সতী হয়েছি। যদি সপ্তমবারও সতী না হই তাহলে আমার মতন হতভাগী আর কে আছে!’ পাশের একজন লােক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কি লাভ হবে তােমার সহমরণে সতী হয়ে?” স্ত্রীলােকটি উত্তর দিয়েছিল, আমার স্বামীর পরিবারে বিবাহিতা স্ত্রীলােকরা সকলেই সতী হয়েছে, আমি যদি না হতে পারি তাহলে পরিবারের কলঙ্ক হবে। স্ত্রীলােকটির বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর। শােনা গেল তার কিছু সম্পত্তি আছে, এবং তার আত্মীয়স্বজন সেই জন্যই সহমরণের জন্য অত উদগ্রীব। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীটিকেও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারলে সম্পত্তি নিষ্কন্টক হয়ে যায়।
যদি অন্যান্য সহমরণ এই রকম যত্ন করে তদারক করা হত তাহলে আমার বির্বাস ভারতবর্ষে এত সতীদাহ কখনও ঘটত না। কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় তা হয় না, ক্ষিপ্ত জনতা ও কুচত্রী আত্মীয়দের তাড়নায় অসহায় অনাথ রমণীরা শেষ পর্যন্ত সহমরণ। বরণ করে সতী হতে বাধ্য হয়। যে স্ত্রীলােকটির কথা আমরা বলছি চিতার আগুনে তার হাত-পা সামান্য দগ্ধ হয়েছিল মাত্র। যদি সে সতী হত তা হলে হিন্দুরা নদীর তীরে তার একটি ছােট সমাধি-মন্দির তৈরী করে দিত। তার নাম সতী-মন্দির। গঙ্গাস্নানের সময় যাতায়াতের পথে হিন্দু নারীরা সেই মন্দিরে ভক্তিভরে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করত, ‘জন্মে জন্মান্তরে যেন তােমার মতাে পুণ্যবতী সতী হতে পারি।’..এখানে লােকজন নিশান উড়িয়ে, বাজনা বাজিয়ে শােভাযাত্রা করে সতীদাহের জন্য যাচ্ছিল, আমারই বাড়ির পাশ দিয়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শােভাযাত্রা দেখলাম। মধ্যিখানে বেনের স্ত্রী লালরঙের একটি কাপড় পরে হেঁটে চলেছে। আমার ভৃত্যরা সকলে দৌড়ে এল আমার অনুমতি নেবার জন্য, শােভাযাত্রার সঙ্গে। তারাও সতীদাহের তামাসা দেখতে যাবে। ব্যাপারটা সাধারণ লােকের কাছে সত্যিই একটা তামাসা বা খেলার মতন। অনুমতি দিতে তারা সকলে চলে গেল, কেবল যে টানাপাখা টানছিল তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হল না। সে বােধ হয় তার জন্য আমাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল। আমার সাহেব বলেছিলেন, স্ত্রীলােকটি নাকি বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, দেখে মনে হয়নি যে আগুনে পুড়ে মরতে সে ভয় পাবে। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত যে সে প্রাণে বেঁচেছে তাতে আমরা সকলে খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা হল, বেচারীকে এখন সমাজ-পরিত্যক্ত হয়ে একঘরে অবস্থায় বাস করতে হবে। তার হাতের ছোঁয়া তাে কেউ খাবেই না, মুখ পর্যন্ত দর্শন করবে না। তবু এরকম সতীদাহ থেকে মুক্তির দৃষ্টান্ত কিছু লােকচ র সামনে তুলে ধরতে পারলে সমাজের যথেষ্ট কল্যাণ হবে বলে মনে হয়। তবু রক্ষে যে স্ত্রীলােকটির কোনাে সন্তানাদি ছিল না। সম্পত্তির মধ্যে ছিল একটি ভাল বাড়ি এবং নগদ আট-ন’শ টাকা। সহমরণের উদ্দেশ্য সফল হলে তার দেবররা এই সম্পত্তিটুকু নিশ্চিন্তে ভােগদখল করতে পারত।”
কানপুরে বদলি : ঠগীদের অত্যাচার ও দমন
প্রায় তিন বছর এলাহাবাদে কর্মসূত্রে থাকার পর অস্থায়ী কালেক্টর হয়ে আট মাসের জন্য কানপুরে বদলি হন ফ্যানির স্বামী চার্লস পার্কস। এলাহাবাদ থেকে ১৫০ মাইল ও লখনউ থেকে ৫০ মাইলের পথ কানপুর। কানপুর যাওয়ার পথে ফতেপুরে ফ্যানি দম্পতি ঠগিদের কথা শুনলেন, যারা ঘুরে ঘুরে টাকা-পয়সা ছিনতাই করে আর গলা টিপে মেরে পথিকদের কুঁয়াের মধ্যে নিক্ষেপ করে। আগে ঠগিরা খুবই শক্তিশালী ছিল, কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় তাদের উপদ্রব এখন অনেকাংশে কমে গেছে, যদিও কানপুর ফতেপুর ও হামিরপুর অঞ্চলে তারা সম্প্রতি আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। অবশেষে লর্ড কর্ণওয়ালিসের তৎপরতায় ঠগিদের দমন সম্ভব হয়। ১৮৩০ সালের ১৬ অক্টোবর ১১ জন ঠগিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ঠগিদের অনেকে জেরার মুখে স্বীকার করেছে যে, সামান্য চার টাকার জন্যও তারা পথচারীদের খুন করেছে। একবার তারা ১২ জন সিপাহীকে মেরেছিল। আর একবার তারা ১১ জনকে মেরে মাটি চাপা দেয়। দেশীয় পথচারীরাই ঠগিদের আক্রমণের শিকার হত। তারা কখনও ইংরেজ বা ইউরােপিয়দের আক্রমণ করেনি।
কানপুর : পরিবেশ, আবহাওয়া ও ফসল
ফ্যানি কানপুর পৌঁছলেন ১৯ এপ্রিল ১৯৩০। শহরটি সমতল হলেও বৃক্ষহীন, ফলে গরম বেশি। বালুকাময় এই শহরটি বড়ই বিবর্ণ ও নিরানন্দও বটে। বাসা নেওয়া হল গঙ্গার ধারে উঁচু পাথরের টিলার উপর, কানপুর স্টেশন কাছেই। স্টেশনটি বেশ বড়, নিরাপত্তায় রয়েছে গােলন্দাজ বাহিনি, অর্থারােহী ও পদাতিক সৈন্যবাহিনি। বাইরে তাপমাত্রা এত বেশি যে সন্ধ্যাতেই বেরোনাে মুশকিল। পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেলেও আবহাওয়ার কোন হেরফের হয় না। তিন মাইল চওড়া গঙ্গার জল এই গরমের মরশুমে অনেক নিচে নেমে যায় বলে তরমুজ, শশা, গম এসবের ফলন ভাল হয় নদীর চরে। তরমুজ খুবই সুস্বাদু, সুগন্ধ আর খুব সস্তা। আঙ্গুরও চমৎকার, এক পাউণ্ডের দাম সাড়ে চার পেনি।
কানপুর : ধর্মীয় স্বাধীনতা
এখানে জুয়া খেলার চলন খুব বেশি। তরুণ আর্মি অফিসাররা খুব উঁচু বাজিতে তাস খেলেন। কিন্তু সরকারী কর্মচারীদের প্রচুর কাজহেতু জুয়া খেলার তারা অবকাশ পান না। দাবা খেলার অদ্ভুত নেশাও রয়েছে কানপুরের লােকেদের। কিন্তু মুসলিমরা যে দাবা খেলতে পারে তা আশ্চর্য ঠেকেছিল ফ্যানির কাছে, কেননা ইসলাম ধর্ম তথা হজরত মােহাম্মদ (সঃ) দাবা খেলা নিষিদ্ধ করেছেন। শাহ কুবেরউদ্দিনের মত ধর্মপরায়ণ ভদ্রলােক ফ্যানির সঙ্গে দাবা খেলতে চাওয়ায় ফ্যানি এসব বলেছেন। নবী হজরত মােহাম্মদ (সঃ) যে সুগন্ধি, মেহেন্দি পছন্দ করতেন তাও বলেছেন ফ্যানি। তাছাড়া হজরত মােহাম্মদ (সঃ) যে নারীদের খুব সম্মান করতেন তাও তঁার ‘ভ্রমণপঞ্জি’তে উঠে এসেছে। দিল্লির জুম্মা মসজিদ দর্শন প্রসঙ্গে নবী হজরত মােহাম্মদ (সঃ)-এর বাণী ফ্যানির মনে পড়েছিল মসজিদ হল বেহেস্তের বাগান, আল্লার নাম সে বাগানের ফলস্বরূপ। এ থেকে ইসলাম সম্বন্ধে ফ্যানির যে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল তা বােঝা যায়। কেবল হিন্দুদের মধ্যে জাতের বিচার রয়েছে, মুসলিমদের মধ্যে সে অর্থে উঁচু-নিচু বিচার নেই বলেও ফ্যানি তার ‘ভ্রমণপঞ্জি’তে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সে সময়ে মিশ্র বিবাহ মাঝেমধ্যে ঘটত, সেখানে ধর্মের কড়াকড়ি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বলেছেন ফ্যানি।
সম্প্রদায়গত সমস্যা সেকালে ছিল না। একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা উৎসবে যােগদান করতে মানুষ কার্পণ্য করত না। সে সময়ে ক্রিসমাস, মহরম, বকরি ইদ যথাযােগ্য মর্যাদায় পালিত হত, ফ্যানির ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’তে সেসবের উন্মাদনাও ধরা পড়েছে। যথারীতি। ক্রিসমাসে কলাগাছ, গােলাপ ও অন্যান্য উজ্জ্বল রঙের ফুল দিয়ে সুন্দর করে বাড়ি সাজানাে হত। কিন্তু ফ্যানির কাছে বিলেতের ক্রিসমাসের গুরুত্বই ছিল আলাদা। মহরম উৎসব পালিত হয় দুই শহীদ হাসান ও হােসেনের (রহঃ) স্মৃতিতে। উৎসব চলে দশ দিন ধরে, দশম দিনে তাজিয়া বের হত। উৎসবটি প্রধানত শিয়াদের হলেও, অনেক সুন্নিও তাজিয়া বের করেন এমনকি হিন্দুরাও, লিখেছেন ফ্যানি। বকরি ইদের দিন মুসলমানেরা নতুন জামাকাপড় পরে প্রার্থনা করতে যান। প্রার্থনা শেষে সামর্থ মত উট ছাগল ভেড়া বলি দেওয়া হত। এই বলি প্রসঙ্গে ফ্যানি লিখেছেন,
“ইব্রাহিমের ইজাককে (হজরত ইসহাক) বলি দেবার স্মরণে এই ধর্মীয় উৎসব। মুসলমান মতে ইজাক হয়ে গেছে ইসমাইল।”
এই তথ্য ভুল। হজরত ইব্রাহিমের (আঃ) পুত্র হজরত ইসমাইলকেই (আঃ) বলি দেবার স্মরণে এই ধর্মীয় উৎসব।
কানপুর : অস্বাস্থ্যকর শহর
এলাহাবাদের মত কানপুরও ফ্যানির কাছে স্বাস্থ্যকর বলে মনে হয়নি। কানপুরে হঠাৎ করে এলাহাবাদের মত বসন্তরােগের প্রাদুর্ভাব ফ্যানিকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছিল। ম্যাজিস্ট্রেট তিনদিনের বসন্তে মারা যান। শত শত শিশু আক্রান্ত অথচ সরকার টিকা দেওয়ার বিভাগটাই তুলে দিয়েছেন! পাশাপাশি রয়েছে রাত্রে পােকার উপদ্রব। সাদা পােকার জ্বালায় রাত্রে খাবার মুখে দেওয়া দায়। বছরের আগস্ট মাসেই এই পাখাওয়ালা পােকার আনাগােনা, আলাে জ্বাললে আর উপায় নেই। তাছাড়া টিকটিকি, ছুঁচো, ‘মােটকা’ ব্যাঙ, বনবিড়ালের উৎপাত তাে রয়েছেই। তার ওপর ইয়ােলাে ফিবারের খবর। তিনদিনে ১২ জন সেনা মারা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি ১৬০ জন। এই জ্বরে গায়ের চামড়া ও চোখ নাকি হলুদ হয়ে যায়। ফ্যানির ধারণা চোলাই মদ আর গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড তাপ এই অসুখের কারণ। তবে সুখের খবর, সেনারা দেশী সস্তা মদের দিকে যাতে ঝুঁকতে না পারে সেজন্য অবশ্য একটা গ্রন্থাগার করা হয়েছে। সাধু উদ্যোগ নিঃসন্দেহে।
কানপুর : দেওয়ালি উৎসব
কানপুরে,গঙ্গার ধারে যেখানে অন্তত ১৫টি হিন্দু মন্দির রয়েছে, বেশ জাঁকজমক সহকারে দেওয়ালি হয়। ফ্যানির দেখার সুযােগ হয়েছিল সেবারের (১৬ অক্টোবর ১৯৩০) দেওয়ালি উৎসব। ‘ভ্রমণপঞ্জি’তে উঠে এসেছে সেই দেওয়ালির অসাধারণ বর্ণনা,
“আজ দেওয়ালি, হিন্দুদের দেবী কালীর সম্মানে উৎসব, কালীপূজা। বারান্দার নীচে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলাম, একটা তুন-কাঠের গাছ দেখতে, নৌকায় রাখা ছিল, কিছু লােক নিয়ে এসেছে আমরা কিনবাে আশায়। শীর্ষ ঘাটে অনেক আলাে জ্বলতে দেখে মাঝিকে বললাম আমাকে নৌকা করে ওখানে নিয়ে যেতে এর আগে আমি আর নদীর বুকে নৌকা চড়িনি, ঐ ঘাটেও যাইনি যদিও আমাদের বাংলাের এত কাছে, ওটা ঠিক দেখা যায় না, জমি দিয়ে আড়াল করা।
ঘাটে পৌঁছে এত ভালাে লাগল, মনে হল পরীর দেশে এসেছি। গঙ্গার ধারে প্রায় সােয়া মাইল জায়গা জুড়ে বােধ হয় পঞ্চাশটা ছােটো ঘাট, নীচের ধাপগুলি জলে নেমে গেছে, নদী তাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ঘাটগুলির উপরে অন্তত পনেরােটা হিন্দু মন্দির, সাধারণ বাড়ি ঘর দোরও আছে, ছবির মতাে সুন্দর কিছু গাছ তাদের ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
দিনেরবেলা জায়গাটা নিশ্চয়ই আরও সুন্দর লাগে, কিন্তু রাতে, এই আলাে-উৎসবের রাতে এর সৌন্দর্য কল্পনা করুন। প্রতিটি মন্দিরে, প্রত্যেকটি ঘাটে, সিড়ির ধাপে ধাপে হাজার হাজার ছােটো ছােটো প্রদীপ জ্বলছে, ভিৎ থেকে ছাদ পর্যন্ত বাড়িগুলি আলাের রেখায় চিত্রিত।
অন্ধকার সন্ধ্যায় পুরাে দৃশ্যটি গঙ্গায় প্রতিফলিত হচ্ছে। শতশত হিন্দু সমবেত হয়েছেন পুজো করার জন। ঘাটের উপর আলাের বৃত্তে দাঁড়িয়ে কিছু লােক সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করছেন কেউ বা নদীতে দাঁড়িয়ে পুজা নিবেদন করছেন কেউ কেউ স্নান করছেন। মূর্তির সামনে ব্রাহ্মণেরা ঘন্টা বাজাচ্ছেন, পূজার্থীরা গঙ্গাজল, চাল, তেল ও ফুল ঢালছেন দেবদেবীর মূর্তির উপর।
অনেকে ঘাট থেকে ছােট ছােট কাগজের নৌকা করে প্রদীপ জলে ভাসাচ্ছেন, তাতে আরও মনােরম দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। মেয়েরা প্রদীপ ভাসিয়ে সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন চোখের বাইরে যাবার আগেই যদি আলাে নিভে যায় তবে ইচ্ছাপূরণ হবে না, বহু দূর যদি ভেসে ভেসে চলে যায় ঐ আলাের দ্বীপ, তবু নেভে না, তবেই পূর্ণ হবে মনকামনা। কত আশা আকাঙ্খ বুকে বেঁধে না মায়েরা তাকিয়ে আছেন, হয়তাে কারো সন্তান অসুস্থ! নদী ছােট ছােট আলােক বাহিনীতে ভরে উঠেছে।
পাথরে বাঁধানাে ঘাটগুলি নানা মাপ ও আকৃতির, কানপুরের ব্যবসায়ীরা যে যার সাধ্য মতাে বানিয়েছেন। কোনাে কোনােটি বৃহৎ ও সুন্দর, কোনাে কোনােটি এক গজের বেশি নয়। একটি তােরণশােভিত ভালাে ঘাট মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত, এখন আলােয় ঝলমল করছে। সারা শহরে বাড়িতে বাড়িতে আলাে জ্বালানাে হয়েছে। কিন্তু দেওয়ালি সবচাইতে উপভােগ্য অন্ধকারে গঙ্গাজির বুকে নৌকায় ভাসতে ভাসতে। আমার যে কী ভালাে লাগছিল এত প্রাচ্য, এত পরী-দেশ তুল্য দৃশ্য আমি ভারতে এর আগে দেখিনি, ভাবতেও পারিনি এই শুষ্ক কানপুরে এত রূপ লুকিয়ে আছে।”
এলাহাবাদে প্রত্যাবর্তন : ভারতপ্রেমী কর্নেল গার্ডনারের সঙ্গে পরিচয়
কানপুরে কয়েক মাস থাকার পর পার্ক দম্পতি আবার এলাহাবাদে ফিরে এলেন (২৪ ফেব্রুয়ারী ১৮৩২), চার্লস পার্কস কাজেও যােগ দিলেন। এ সময়ে অভিজাত গার্ডনার পরিবারের সন্তান কর্নেল গার্ডনার—যিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে এসেছিলেন, লেখাপড়া করেছেন ফ্রান্সে, তিনি অযােধ্যায় নবাব মহলে এলেন নবাবের আমন্ত্রণে, নবাব নাকি ব্রিজ তৈরী করবেন। নবাব ও মন্ত্রীর নেকনজরে থাকতে পারলে আখেরে তাঁরই লাভ। গার্ডনার ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করতেন। পরনে ইংরেজ পােশাক থাকলেও তার গায়ে জড়ানাে থাকত ভারতীয় শাল। ভারতের পুতুল নাচ তার খুব প্রিয় ছিল। ভারতে যে এখনও পুতুল নাচের আসর বসে, এটা জেনে তিনি গর্ববােধ করতেন। এই কর্নেল গার্ডনার এক ভারতীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। বেগমের বাবা ছিলেন মির্জা সুলেমান শিকো–খাস দিল্লীর রাজ পরিবারের সদস্য। গার্ডনারের মত ভদ্রলােক কম দেখা যায়। মৃদুভাষী, দয়ালু, মার্জিত রুচিসম্পন্ন গার্ডনারের সান্নিধ্য এই সময়ে লাভ করেছিলেন ফ্যানি।
মুসলিম জেনানা মহলের সাতকাহন
জেনানা মহলের সঙ্গে পরিচয়হেতু ফ্যানি গার্ডনারের কাছে জানতে চাইলেন নবাব মহলের হাঁড়ির খবর। কিভাবে মহিলারা ওখানে দিন কাটান? নবাব মহলের মেয়েরা পর্দানশীন বা চার দেওয়ালের মধ্যে থাকলেও তারা ছিলেন ইংরেজ মহিলাদের মত ভীষণ ফ্যাসন সচেতন ও স্বাধীন। তাঁদের পরণে থাকত বেনারসী শাড়ী। মহিলারা কোরআন পড়ার জন্য আরবি শিখতেন, প্রয়ােজনে পার্শিও শিখতেন। জেনানা মহলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও লেগে থাকত। স্বামীর উপর তারা কোনােদিন সন্তুষ্ট ছিলেন।
পুরুষের একাধিক বিবাহ তারা মেনে নিতে পারেনি। এরকম আরাে অনেক খবর উঠে এল গার্ডনারের বক্তব্যে। ফ্যানি তার ‘ভ্রমণপঞ্জি’তে (কর্নেল গার্ডনারের বক্তব্যানুসারে) অযােধ্যার জেনানা মহলের সেই চিত্র অঙ্কন করেছেন। ফ্যানি লিখেছেন,
“চারদেয়ালে ঘেরা এক আলাদা জগত। মেয়েরা সেখানে টাটু ঘােড়ায় চড়েন, কেউ কেউ খুব ভালাে অর্থচালিকা হন, আমার ছেলে জেমস-এর ঘােড়ায় চড়ার শিক্ষানবীশী হয়েছে এক মহিলার কাছে।
একটি রূপাের দোলনা পেলে মেয়েরা খুব খুশি হন। বৃষ্টি নামলে চুপচুপে হয়ে ভিজে তারা দোলনায় দোলেন। উঁচু উঁচু থাম পুঁতে দোলনা টাঙানাে হয়। জেনানা মহলে থাকলেও মেয়েরা অতিশয় ফ্যাশন সচেতন। নতুন কায়দার পােশাক নিয়ে ইংরেজ মহিলাদের মতােই তারা মাথা ঘামান। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমান মহিলারা আরবি শেখেন কোরান পড়বার জন্য, ও পার্শি শেখেন কোরানের ব্যাখ্যা পড়বার জন্য।
জেনানা মহলে পােড়া কফির দানা খুব প্রিয়। দল বেঁধে বসে তঁারা পােড়া কফির দানা খান। রাত এগারােটা কি বারােটার আগে এঁরা রাতের খাবার খান না সারা রাত হুঁকো টেনে এঁরা দিনেরবেলা ঘুমােন।
জেনানা মহলে যে ঝগড়া লেগে থাকে তার তুল্য কোথাও কিছু নেই। বেগমরা সারাক্ষণ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযােগ করছেন, বলছেন ‘ওই ডাইনি—কে তুক করেছে স্বামী যদি একজনকে কিছু দেন, এমনকি সেটা যদি এক ঝুড়ি আমের মতাে নগণ্য কিছুও হয়, তাহলেও সবাই সেটা না পাওয়া পর্যন্ত কাকচিল বসতে পারে না। স্বামীর উপর রেগে মেয়েরা প্রায়ই বলেন, ‘এর চেয়ে একটা ঘেষুড়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ভালাে হতাে’অর্থাৎ ঘেষুড়ে এতােই গরীব যে একটির বেশি বিয়ে করার ক্ষমতা নেই।
‘আমি একটাই বিয়ে করেছি, গত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে একজনের সঙ্গেই বিবাহিত আছি বলে আমি তাদের কাছে আদর্শস্বরূপ। একাধিক বিবাহ পুরুষদের কাছে যত প্রিয় রীতি মেয়েদের কাছে ততই অপ্রিয়। তিন চারজন সতীনের ঘর করতে কে চায়’?”
এছাড়া সেকালে জেনানা মহলে স্বামী বা আত্মীয় নয় এমন পুরুষের সঙ্গে একসাথে বসে খাওয়া তাে দূরের কথা, মুখ দেখানােও নিষেধ ছিল। তাছাড়া ‘জেনানা মহলে এখনাে বিজ্ঞান ঢােকেনি, প্রকৃতি ও কুসংস্কার সেখানে রাজত্ব করে।
নবাব মহলের বিয়ে
অযােধ্যায় নবাব মহলের সঙ্গে পরিচয় হেতু কর্নেল গার্ডনারের প্রথম পুত্র এ্যালেন গার্ডনার নবাব মহলেরই এক নবাবকন্যা মুলকা বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের দুই মেয়ের একজন হলেন সুসান ওরফে সুবিয়া। এই সুবিয়ার বিবাহ হয় নবাবপুত্র তরুণ উনজন শিকোহর সঙ্গে। ইসলাম ধর্মীয় মতে তাদের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। এই বিবাহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ফ্যানি। এই বিবরণ হতে সমকালের মুসলিম বিবাহের নিম্নলিখিত চিত্রগুলি উঠে আসে,
১. বর-কনে উভয়ের বয়স ২০ হলেও ভারতবর্ষে মেয়েদের বিয়ের পক্ষে এটা খুবই বেশি বয়স, কেননা ১১/১২ বছর বয়সেই মেয়েদের তখন বিয়ে হয়ে যেত।
২. সেকালেও বিয়ে খুব জাঁকজমক সহকারে হত এবং এ নিয়ে বর-কনে পক্ষ গর্ব করত। সারা গ্রাম আলােয় ঝলমল করত। তােরণদ্বার ও অসংখ্য পতাকা দিয়ে সারা এলাকা সাজানাে হত।
৩. বর্তমানের মত তখনও কনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত হলুদ তেল মাখানাে হত। কনের গায়ে মাখানাে তেল-হলুদ নিয়ে তা বরের জন্য পাঠানাে হত, বর সেটা গায়ে মেখে স্নান করত।
৪. বিয়ের দশদিন আগে থেকে কনেকে শুধু মিষ্টি খেয়েই থাকতে হত। টক খাওয়া নিষিদ্ধ, এমনকি পানও প্রায় নিষিদ্ধ। মিষ্টি খাওয়ার অর্থই বর-কনের সম্পর্কের মধ্যে যেন বরাবর মিষ্টতা থাকে।
৫. অঙ্গভঙ্গী করে বিয়ের গান গাওয়া হত বিয়ের মজলিসে। নর্তকীর দল অশ্লীলভাবে নাচগান করত। প্রভূত ব্যয়ে দেশের সেরা একশত নর্তকীকে এই বিবাহে আনা হয়েছিল।
৬. প্রথমে বরকে ও পরে বরযাত্রী তথা অন্যান্য অতিথিদের সরবৎ দেওয়ার রীতি ছিল। বাড়ির সামনে বিশাল সামিয়ানা টাঙানাে হত। সেখানে বরের সিংহাসন ও অতিথিদের জন্য ফরাস থাকত।
৭. বিয়ের চুক্তিপত্র বরকে পড়ে শােনানাে হত। এই চুক্তিপত্রে সই করার আগে কনের সম্মতি আবশ্যিক ছিল। চুক্তিপত্রে বর ও কনে উভয়কে সই করতে হত। কয়েকজন ইংরেজ ভদ্রলােক সাক্ষী হিসেবে সইও করেছিলেন।
৮. বরের পােষাকের বর্ণনাও দিয়েছেন ফ্যানি এভাবে “বর পরেছে সােনার পােষাক মাথায় মুত্তার মুকুট থেকে লম্বা ঝালর নেমে এসে মুখ ঢেকে রেখেছে, লালসিল্কের রুমাল দিয়ে মুখ বাঁধা যাতে শয়তান প্রবেশ করতে না পারে।”
৯. কনে চলে যাওয়ার মুহূর্তে সবার মুখ থমথমে, কান্নাকান্নাভাব। কর্নেল গার্ডনারকেও শােকার্ত দেখাচ্ছিল। কম্পিত দেহে তিনি প্রিয় নাতনিকে জড়িয়ে ধরলেন, চোখ ভরে জল এল, মনে হল যেন আর দাঁড়াতে পারছেন না। নাতজামাইকে ডেকে বললেন, “আমার নাতনির সঙ্গে ভাল ব্যবহার করাে, তুমি যা চাইবে তাই পাবে। কিন্তু খারাপ ব্যবহার করলে আমি শাস্তি দিতে ছাড়ব না।” সেকালের এই আবেগ যে সর্বকালীন তা বলাই বাহুল্য।
১০. কনে পক্ষ হতে যৌতুক দেওয়ার রীতি সেকালেও ছিল। এই বিয়েতে বরপক্ষকে যেসমস্ত যৌতুক দেওয়া হয়েছিল সেগুলি হল “সােনার পায়ার খাট, রূপাের পায়ার চৌকি, লাল কাপড়ে ঢাকা সিন্দুকের পর সিন্দুক, দুটো হাতি, বেশ কয়েকটা ঘােড়া, বেশ কয়েকটা রথ, সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র, বাসনকোসন, মশলাপাতি, খাবার দাবার, ফল, মিষ্টি, রূপটান, আতরদান, পানের ডিবে, সুর্মাদান, লেপ, কম্বল, বালিশ, কার্পেট, বাক্স, আলাে—অন্তহীন। এছাড়াও দাসদাসী। একটি কোরানও অবশ্যই।”
প্রয়াগের বিখ্যাত মেলা
প্রতি বছর প্রয়াগে মেলা হয়, এলাহবাদের বিখ্যাত মেলা। মারাঠা বাঁধ থেকে শুরু করে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত গঙ্গার বালুকাবেলা জুড়ে দু মাস ধরে এই মেলা বসে। কলকাতা, দিল্লী, লখনউ, জয়পুর সর্বত্র থেকে আসেন ব্যবসায়ীরা। হীরে, মুক্তো, প্রবাল, শাল, কাপড়, গরমের জামা, বাসন, খেলনা, দেবদেবীর মূতি, পশুর লােম ইত্যাদি সবই পাওয়া যায় এই মেলায়। সঙ্গমস্থলে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ সমবেত হন পুন্যস্নানের উদ্দেশ্যে। ব্রাহ্মণ, সাধু, ফকিরপ্রতি গােষ্ঠীর নিজস্ব পতাকা আছে। তারা পূজো করেন, চুল কামিয়ে ন্যাড়া হন, দান-ধ্যান করেন। গরীব বড়লােক সকলকে সেকালে ব্রিটিশ সরকারকে এক টাকা স্নান-কর দিতে হত। স্নানের ফলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যাবে, স্বর্গের দরজা খুলবে ও পরজন্মে উচ্চবংশে জন্ম হবে—এমন বিশ্বাস হিন্দুদের, লিখেছেন ফ্যানি।
তবে মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল সাধু সন্ন্যাসীর দলকে নিয়ে। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা স্থানে শত শত সন্ন্যাসী, আছেন গোঁসাইরারা শিবের ভক্ত, আছেন বৈরাগীরাদের উপাস্য বিষ্ণু। আছেন নানা জাতের হিন্দুর নানা রকম সন্ন্যাসী। পাশাপাশি আছেন মুসলমান ফকিরও। ঘুটের ছাই এদের পবিত্র অঙ্গশােভা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছাই মেখে সাদা-নীল ভূতের মত সব বসে থাকেন। তার সঙ্গে মিশেছে গঙ্গার মাটি। পরনে লেংটি ছাড়া কিছুই নেই এদের। এমন সব বিচিত্র সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে ফ্যানি লিখেছেন, “একজনকে দেখলাম, কঙ্কালসার চেহারা, চুলের দীর্ঘ জটা মাথায় পাগড়ির মতাে জড়ানাে। কপালে ছাই দিয়ে সমান্তরাল লাইন টানা, তার তলায় লাল গােলগােল দাগ, হয়তাে তার বিশেষ ধর্মীয় শাখার চিহ্ন। বাঁ হাতটা এত দীর্ঘ দিন ধরে সােজা করে রেখেছে যে শুকিয়ে কাঠির মতাে হয়ে গেছে, কোনােমতে চামড়া লেগে আছে হাড়ের গায়ে। হাতের মুঠি বন্ধ রাখা। নখ বেড়ে হাতের পাতা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে শিকারি পাখির নখের মতাে। তার টানটান হাতে একটা সাপের মতাে বাঁকা লাঠি ধরা, যার মাথাটা কেউটের মাথার মতাে। কাঁধে বাঘের ছাল। পরনে ল্যাঙ্গোট। খুব সম্ভব শিব-এর মতাে সেজেছে, সারা শরীরে ছাই মেখে মহাদেব নাকি মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন। লােকটির ডানহাতে একটা ফাঁকা লাউ-এর খােলা ও রুদ্রাক্ষের মালা। গলাতে ঝুলছে দুটো রুদ্রাক্ষর মালা। লােকটির সঙ্গী একটি অতি কোমল, ছােট্ট বামন-গরু। লাল কাপড়ে তার গা ঢাকা, তাতে কড়ির কাজ, গলায় ঘন্টা, মাথায় ময়ূরের পালকের মুকুট, পায়ে নূপুর। অনেক সাধুই দেখলাম এই সুসজ্জিত গরু নিয়ে মেলায় এসেছেন, এক একটা গরু এত ছােট প্রায় ইংলন্ডের ভেড়ার মতাে, মােটা আর বেঁটে। আত্মনিগ্রহ সন্ন্যাসীজীবনের একটা অঙ্গ, পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য নয়, পুণ্যসংগ্রহার্থে।”
তাজমহল দর্শন
ফ্যানির অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল শীত পড়লে পৃথিবীর আশ্চর্য বস্তুর একটি, তাজমহল দেখতে যাবেন। ৯ ডিসেম্বর ১৮৩৪ সী-গাল নামক নৌকা করে সদলবলে ফ্যানির প্রয়াগ থেকে যাত্রা শুরু হয়। আগ্রা পৌঁছাতে ৫১ দিন লাগল (৩০ জানুয়ারী, ১৮৩৫)। তাজমহল দেখলেন ফ্যানি। তাজের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া সাধ্যাতীত। অপার্থিব এর সৌন্দর্য। বিশালত্ব নয়, এর সৌষ্ঠব সুষমা সূক্ষ্মতা সারা পৃথিবীকে মােহিত করে রেখেছে এখনও। তেপাথরের তৈরী কবরটি চমৎকারভাবে সংরক্ষিত, যখন বানানাে হয়েছিল তখনকার মতই নিখুঁত ও অপরূপ। তেপাথরের মাঝে মাঝে ধূসর রেখাগুলি পাথরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। মনে হয় মর্মর নয়, মুক্তো তেপাথরের চারকোনা চত্বরের উপর মমতাজের সমাধিক্ষেত্র, চারকোনায় চারটি তেপাথরের তৈরী মিনার। বাইরে-ভেতরে সূক্ষ্ম কারুকার্য, তাতে রক্ত-লাল চুনী, পান্না, নীলা ইত্যাদি মণিরত্ন ফুলের মত যেন ফুটে আছে। কালােপাথরের খিলানে তে পাথরের কারুকার্য, তাতে আরবিতে কোরআনের আয়াত বা বাক্য লেখা। তাজের ডিম্বাকৃতি প্রধান গম্বুজ ও ছােট চারটি গম্বুজ সত্যিই নয়নাভিরাম। এর উপর সন্ধ্যাবেলা যখন ফোয়ারা জল ছেটায় তখন তাজের সৌন্দর্য সত্যিই আরােও দেখার মত মনে হত। তাছাড়া শব্দের প্রতিফলন কিংবা প্রতিধ্বনিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কাজে লাগানাে হয়েছে। তাজমহলে, তাও বলেছেন ফ্যানি। ফ্যানি লিখেছেন, “এমন কিছু আমি এ জীবনে আর কোথাও দেখিনি। তাজ নিজের চোখে দেখলে এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। ছবি দেখে কিছু বােঝা যায় না কারণ এদেশীয়রা তাজের যে-সব ছবি আঁকেন সবই বেশ স্কুল, তাজের একেবারে বিপরীত। তাজ প্রথম দেখার মুহূর্তটি অনন্য মৃদু ধর্মীয় আলাে, গমগমে গভীর-গম্ভীর প্রতিধ্বনি—প্রথমটায় মনে হয়েছিল পুরােহিতরা বুঝি উপরের ঘরে মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। যখন অনেক লােক একসঙ্গে কথা বলে বাজ ভেঙে পড়ার মতাে শব্দ হয় কঠিন, শক্তিশালী আওয়াজ। নেটিভরা ঐ শব্দকে বহু হাতির বৃংহণের সঙ্গে তুলনা করেন। গম্বুজকে তুমি যা বলবে সে তােমাকে তাই ফিরিয়ে দেখে। কবরের উপর প্রার্থনা করলে অরগ্যানের শব্দের মতাে, বা গিজার সুদূর ও গম্ভীর মন্ত্রপাঠের শব্দের মতাে তা বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
প্রতিটি খিলানে একটি করে জানালা, তাতে তেপাথরের ফ্রেম। তিন ইঞ্চি চৌকো কাচ বসানাে। ছাদের নীচে বন্ধ ঘরে বাদশা ও বেগমের সমাধি, অপূর্ব কারুকার্যময় চৌকো তেপাথরের। দুর্ভাগ্যবশত সমাধিতে লুট হওয়ার কারণে অংশত নষ্ট হয়ে গেছে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ছােট্ট দরজাটি আগে রূপাের তৈরী ছিল, এখন আম-কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।…
প্রবেশপথ তৈরী লাল এ্যানাইট পাথরে, তাতে তেপাথরের কাজ, মূল্যবান রত্নভূষিত প্রবেশদ্বারের খিলানের উপরে চারটি বড়াে ও বাইশটি ছােটো গম্বুজ, সবই তেপাথরের। প্রবেশ-অট্টালিকায় চারটি ঘর। সেখানে ইচ্ছে করলে অতিথিরা গ্রীষ্মকালে থাকতে পারেন। তাজের ঠিক উল্টোদিকে এই অট্টালিকার দোতলা থেকে তাজকে সবচাইতে ভালাে দেখা যায়।…
প্রবেশদ্বার থেকে সমাধি পর্যন্ত বাগানের কেন্দ্রে আছে চুরাশিটা ফোয়ারা, যার মধ্যে আশিটা একদম নিখুঁতভাবে কাজ করছে। বাইশটা জল ছিটোচ্ছে বাগানের মাঝখানে, দশটা কবরের পাশে মসজিদের চত্বরের সামনে, আর অন্যগুলি প্রবেশদ্বার থেকে কবর পর্যন্ত সার বেঁধে আছে। জল পাইপ দিয়ে আনা হয় যমুনা থেকে। সন্ধ্যাবেলা, যখন ফোয়ারা জল ছেটায় আর বাগানের ফুলের মনমাতানাে গন্ধ বয় তখন চর ও কর্ণ অলৌকিক আনন্দ লাভ করে এখানেই ভারতীয় স্বর্গ। …ইংরেজ রমণীর অতি সাধারণ কবরে আমার দেহাবশেষ মাটির নীচে না যাওয়া অবধি এই দর্শনের স্মৃতি আমার মন থেকে মুছে যাবে না।”
আগ্রার কেল্লা দর্শন
তাজ দর্শন উপলক্ষে আগ্রায় থাকাকালীন সময়ে ফ্যানিকে আগ্রার কেল্লা ও তার ভেতরকার প্রাসাদগুলিও বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। কেল্লা ও প্রাসাদের জীবন্ত চিত্র উঠে এসেছে ফ্যানির ‘ভ্রমণপঞ্জি’তে। এ থেকে সমকালীন স্থাপত্য-শিল্প সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। আগ্রার কেল্লার প্রাসাদগুলি তেপাথরের তৈরী এবং তা সম্রাট শাহজাহানের সময়ে নির্মিত। দেওয়ানি আম, জেনানামহল সর্বত্রই তেপাথর, মনি-মাণিক্য, অপূর্ব কারুকার্যময় এবং সেগুলি তাজমহলের ধাঁচে তৈরী। নূরজাহান মহল বর্তমানে ইউরােপীয়ান অফিসারের রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহৃত হলেও তার কারুকার্যময় ছাদ ও দেওয়াল ফ্যানিকে সেই অতীতের দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। ফ্যানি যেন কল্পনার চোখে দেখতে পান রূপসী নূরজাহানকে— ইতিহাসের সেই সুন্দরীতমার পরিত্যক্ত মহলে, স্বামী জাহাঙ্গীরের উপর ও পর্দার আড়াল থেকে সাম্রাজ্যের উপর যাঁর ছিল অপ্রতিহত আধিপত্য।
আগ্রাকেল্লার দেওয়াল ও অভ্যন্তরের লাল গ্রানাইটের প্রাসাদগুলি আকবরের বানানাে এবং বেতপাথরের প্রাসাদগুলি শাহজাহানের। শাহজাহানের বসবার আসনটি বিশাল কালােমার্বেল পাথরের, এখানে বসে বাদশাহ শাহজাহান নিচের জমিতে হিংস্র প্রাণীর লড়াই দেখতেন। প্রাসাদের নীচে যে আটকোণা স্নানের ঘর, হামাম সেগুলি শুধু মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ঘরগুলি তেপাথরের, মেঝেও কারুকার্যময় মার্বেলের আর ঝর্ণা থেকে টবে এসে পড়ত গরম জল। এসবই লর্ড হেস্টিংসের আমলে ভেঙে ইংল্যান্ডের প্রিন্স রিজেন্টসকে পাঠানাে হয়েছিল, পরে যিনি চতুর্থ জর্জ হন। এমন সব ইতিকথা ফ্যানিকে মােহাচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
দিল্লী দর্শন
আগ্রা দর্শনের কয়েক বছর পর ফ্যানি দিল্লিও ভ্রমণ করেন (১৮ ফেব্রুয়ারি-২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮)। শাহাজাহানের প্রাসাদ, দিল্লি গেট, দিল্লি গীর্জা, জুম্মা মসজিদ, নাহর-ই-বেহেস্ত বা স্বর্গের খাল (পানিপথ হতে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় ৯০ মাইল দীর্ঘ), হুমায়ূনের কবর, কাঠেীর গেট, ইন্দ্রপ্রস্থ—প্রাচীন হিন্দু রাজাদের রাজধানী, তৈমুর লঙের বংশধরদের সমাধিক্ষেত্র—বাহাদুর শাহ-শাহ আলম-আকবর শাহের কবর, সেকেন্দ্রায় আকবরের কবর, কুতুবমিনার, যন্তরমন্তর, শালিমার গার্ডেন্স, আজমির গেট ইত্যাদি ফ্যানিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্যানি লিখেছেন,
“যমুনার বালুকাবেলা থেকে দিল্লিকে প্রথম দেখা অতি মনােহর। কেল্লা, প্রাসাদ, মসজিদ, মিনারেট নদী তীরে ভিড় করে এক আশ্চর্য দৃশ্য তৈরি করেছে। হিজরা ১০৪১ (খৃষ্টাব্দ ১৯৩১-৩২) সালে সম্রাট শাজাহান বর্তমান শহর ও শাজাহানবাদের প্রাসাদ তৈরি করেন। …শহরের ব্যাস ৭ মাইল মতাে, তিনদিকে ইট ও পাথরের দেয়াল, দেয়ালের উপর দিয়ে পথ চলে গেছে, তাতে কোনাে কামান নেই। শহরে সাতটা গেট— লাহাের গেট, দিল্লি গেট, আজমির গেট, তুর্কৰ্মন গেট, মুর গেট, কাবুল গেট, কামির গেট, প্রতিটি দরওয়াজাই খুব সুদৃশ্য এবং প্রত্যেকটিতেই পাহারার ব্যবস্থা শহরকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টায়। …
সন্ধ্যায় দুটো হাতি এল আমার জন্য, একটা পাঠালেন বৈজা বাঈ-এর ভাই হিন্দু রাও, অন্যটা কর্নেল স্কিনার। তাতে চড়ে আমরা দিল্লি শহর ঘুরলাম। চাদনি চকের খুব নাম, চওড়া সুন্দর পথ। শাজাহানের আমলে, আলি মর্দন খান নামক এক ধনী ব্যক্তি নিজের খরচে পানিপথ থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় নব্বই মাইল লম্বা খাল কাটিয়েছিলেন—নাহর-ই-বেহেস্ত অথাৎ স্বর্গের খাল। যমুনা থেকে মাইল দশেক দূরে উত্তর থেকে দক্ষিণে এই জলস্রোত প্রবাহিত। আগে এর থেকে বছরে চৌদ্দ লাখ টাকা আয় হতাে, এখন খাল বুজে এসেছে, সারানাে হয় না। …জুম্মা মসজিদ ভারি সুন্দর …দিল্লির লােকেরা সাজতে জানে বটে! তাদের সুন্দর ঝলমলে সাজ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। পথের মােড়ে মােড়ে দেখা যায় হাতি ঘােড়ায় চড়ে বড়ােলােকেরা চলেছেন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। চঞ্চল, প্রাণ প্রাচুর্যে পূর্ণ শহর। তৎসত্ত্বেও, এইসব আপাত প্রাচুর্য সত্ত্বেও, শহরের ফাকা অহঙ্কারের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এ প্রবচনে ‘দিল্লি কি দিলওয়ালি / মুখ চিকনা পেট খালি। জুম্মা মসজিদ ছাড়িয়ে গেলে প্রাসাদের দেওয়াল অনবদ্য দেওয়াল আর প্রবেশপথ দেখে আমি মােহিত। … (১৮.০২.১৮৩৮)।
সন্ধ্যাবেলা পুরানা দিল্লির ধ্বংসস্তুপের মধ্য দিয়ে সম্রাট হুমায়ুনের কবর দেখতে গেলাম। পথ অনবদ্য, যেদিকে চাও দেখবে পুরােনাে ইতিহাসের স্বাক্ষর। হুমায়ুনের কবর দেখবার মতাে বটে! সযত্নে রাখাও হয়েছে। সমাধিক্ষেত্রে বেশ কটি বেত পাথরের স্তম্ভ। সম্রাটের কবরটি খুবই সাধারণ, কিছু লেখা নেই তাতে। ছাদে একটি চমৎকার মর্মর-স্তম্ভ, সূক্ষ্ম কারুকার্য, কোনাে এক বেগমের কবর এর তলায়। ছাদ থেকে পুরানা দিল্লির দৃশ্য মনােহর।… (২০.০২.১৮৩৮)
দিল্লির শেষ তিন নবাবের কবর দেখতে গেলাম, বাহাদুর শা, শাহ আলম ও আকবর শা। আকবর শা কয়েক সপ্তাহ আগে সমাধিস্থ হয়েছেন। শাহ আলমের কবর তে পাথরের। সম্রাট বাহাদুর শা-র কবর থেকে আঠারাে ইঞ্চি মতাে দূরে, বাহাদুর শার কবরের উপর একটি যুঁইলতা। কীভাবে ক্ষমতাবানেরা পতিত হন! হুমায়ুনের কবর দেখলাম, সেকেন্দ্রায় আকবরের কবরও দেখেছি—বিরাট ব্যাপার, অট্টালিকা, জমি, বাগান দেখে মুগ্ধ হয়েছি। শেষ আকবর শুয়ে আছেন পূর্বতন দুই সম্রাটের পাশাপাশি শেষ বিশ্রামে। তিনটি তে পাথরের কবর, বেত পাথরের দেয়ালে ঘেরা ছােট্ট একটি আঙিনায়। তৈমুর লঙের বংশধরদের এই হল সমাধিক্ষেত্র!… (২০.০২.১৮৩৮)।
নটার সময় গেলাম কুতুব মিনার দেখতে। সুন্দর রাত, চাদের আলাে নেই, নীল তারার আলােয় পথ চলা। দিনের বেলা কুতুব মিনার আশ্চর্যজনক, কিন্তু রাত্রে অবিৰ্বাস্য, অপার্থিব। স্থানীয়দের যদি জিজ্ঞাসা করা যায় ‘কুতুব কে বানিয়েছে?’ সাধারণত তাদের জবাব হবে, ‘ভগবান/আল্লা—আবার কে? আর কার এত ক্ষমতা? রাত্রে কুতুবের তলায় দাঁড়িয়ে সেইরকম মনে হয়।… (২২.০২.১৮৩৮)
বাড়ি ফেরার পথে, দিল্লি শহর থেকে দেড়মাইল দূরে যন্তর মন্তর দেখতে থাকলাম। রাজা জয় সিংহের নাম ইউরােপে অজানা নয়, কিন্তু বিজ্ঞানে তার অবদান যে কতখানি তা কেউ জানে না। সম্রাট মহম্মদ শার অনুরােধে তিনি ভারতীয় পঞ্জিকার নবীকরণ করেছেন, তার হিসেব অনুযায়ী আধুনিক ভারতীয় পঞ্জিকা চলছে।
জয়পুর, মথুরা, বেনারস, উজ্জয়িনী ও দিল্লি—এই পাঁচ জায়গায় রাজা জয়সিংহ মানমন্দির তৈরি করেছিলেন। এখনাে সেগুলি বেশ ভালাে অবস্থায় রয়েছে। যন্তর মন্তর দেখে দিল্লি ফিরলাম।… (২৩.০২.১৮৩৮)
শালিমার গার্ডেনস দেখার মতাে। সেখান থেকে দক্ষিণে দিল্লির পানে তাকালে শুধু চোখে পড়ে বড় বড় বাগান, মসজিদ ও সমাধিক্ষেত্রের ভগ্নাবশেষ। একদা যা ছিল জমজমাট এক শহর তা এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হতে চলেছে।…আজমির গেটের কাছে একটা মাদ্রাসা বানিয়েছিলেন নিজামউলমুলুকের ভাইপাে গাজুদ্দিন মস্ত চতুর্ভুজ অঙ্গনের মাঝখানে ফোয়ারা সামনে নিয়ে একটি লাল পাথরের বাড়ি। উপরের দিকে একটি সুন্দর মসজিদ, লাল পাথরের গায়ে তেপাথরের কারুকার্য। এখন এই বিদ্যালয় জনহীন।” (২৩.০২.১৮৩৮)
কনৌজের দুর্ভিক্ষ
পূর্বে (১৯৩৮) অবশ্য কনৌজের দুর্ভিক্ষ্য প্রত্যক্ষ্য করেছিলেন ফ্যানি। কনৌজ সেসময়ে ছিল এক প্রাণবন্ত সবুজ শহর জমিগুলি ছিল শস্য ভর্তি। নিচু জমির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী কনৌজকে করে রাখত শ্যামল। কিন্তু সেই কনৌজ আজ দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে মৃতপ্রায়। ক্ষেত এখন শস্যহীন। ঘাসেরও দেখা মেলা ভার। লতাপাতা শিকড় যা পাচ্ছে মানুষ তা-ই খাচ্ছে। দুটো খাদ্যের জন্য মানুষ পথে নেমেছে দলে দলে। সরকারী সাহায্য মিললেও তা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় খুবই কম। এছাড়া যে কোন উপায় নেই তা বলাই বাহুল্য। চারিদিকে চোখ মেললেই দেখা যায় চাষীদের হাহাকার। প্রায় ১লক্ষ্য লােক এই দুর্ভিক্ষে কনৌজ ছেড়ে চলে যায়—কনৌজ যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ যে অনেকাংশে ‘ম্যানমেড’ তাও বলতে দ্বিধা করেননি ফ্যানি। তিনি এই দুর্ভিক্ষের নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে,
“কনৌজের বাজার দিয়ে পথ চলা ভয়ানক ব্যাপার। দুর্ভিক্ষে মৃত একটি কঙ্কালসার নারীদেহ দেখলাম। তার কাপড়চোপড় গয়নাগাঁটি সবই বদমাইসরা চুরি করে নিয়ে গেছে, শুধু কানে দুটি মাকড়ি এখনাে আঁকড়ে আছে। তার পাশে আর এক রমনী। এখনাে মারা যায়নি। কিন্তু চলৎশক্তিহীন, কোনাে মতে শীর্ণ হাত তুলে খাদ্যভিক্ষা করছে। বুকে বাচ্চা নিয়ে ভিখারিনী, রুগ্নশীর্ণ বালক, জীবন্ত কঙ্কালের মতাে খাদ্যভিক্ষা করছে। আমার যা সামান্য টাকা ছিল তা ছাড়া আর কিছু দিতে পারলাম না, আর আমার চোখের জল। এখন লিখতে বসেও আমার চোখ ভরে জল আসছে, এমন দৃশ্য সওয়া যায় না। আজ বাজারে ছজন না খেতে পেয়ে মারা গেছে। লর্ড অকল্যান্ড রােজ পাঁচ ছশাে লােককে খাওয়ান ও কম্বল দেন, কিন্তু এমন দুর্ভিক্ষ তা কতটুকু? এটাকে বলা চলে দয়ার নিষ্ঠুরতা, কারণ এমন অবস্থায় আর দুদিন বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? বরং যত তাড়াতাড়ি ভবযন্ত্রণা শেষ হয় ততই ভালাে। বেঁচে থাকলে কষ্ট বাড়বে বৈ তাে নয়। এরা তাে কেউই ভিখারি নয়, সবাই কৃষক।
এর আগের বার যখন কনৌজে এসেছিলাম, কী সুন্দর, কী সবুজ ছিল! উজ্জ্বল সবুজ গাছের সারি, ক্ষেতভর্তি সােনার শস্য, সেই নীচু জমির মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর জল। সেইসব ক্ষেত এখন শূন্য। একটা ঘাসও দেখা যায় না। ডুমুর পাতা ছিড়ে ছিড়ে লােক খাচ্ছে ও পাঁচ ছদিনের মধ্যে শরীর ফুলে ঢােল হয়ে মরে যাচ্ছে। চাষীরা ক্ষেতের ধারে বসে তাদের নগ্ন দেহ দেখিয়ে হাহাকার করে, ‘খিদেয় মরছি’ বলে তারা কাঁদে। লতাপাতা শিকড় যা পায় খায়। কখনাে কোনাে সেপাইকে খেতে দেখলে সবাই মিলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবার কেড়ে নেবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তি নেই তাদের, ঠেলাঠেলিতে নিজেরাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রায় এক লাখ লােক কনৌজ ছেড়ে চলে গেছে। জায়গাটা মরুভূমিতে পরিণত হবে, শুধু থাকবে ধনী জোতদাররা যারা গােলাভর্তি শস্য মজুত করে রেখেছে। বর্ষা আসতে পাঁচমাস দেরি ততদিনে কী হাল হবে এখানে ভেবে শিউরে উঠছি।”
ফ্যানি এলাহাবাদ ছাড়লেন ১ ডিসেম্বর ১৮৩৮ এবং কলকাতা পৌঁছলেন ৬ জানুয়ারী ১৮৩৯। কলকাতায় আরও কয়েকবছর থাকার পর তিনি পরিবার পরিজনদের উদ্দেশ্যে স্বদেশ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু নিজভূমে তিনি যখন এলেন তখন। তার যেন স্বপ্নভঙ্গ হল, বিষাদ ও হতাশা তাকে গ্রাস করল,
“আমরা পৌছলাম সকাল ৬টায়। মে মাসের ফুল ও সূর্যালােক ছিল আমার কল্পনায়। কিন্তু বদলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ডাঙায় নামতে নামতে বৃষ্টি, বাতাস ও বরফের কুচি মুখে ঝাপটা মারল।…সবকিছুই যেন কুশ্রী, বিশেষত বাড়িগুলাে। স্লেট পাথরের তৈরি সব বাড়ি ঠাণ্ডা বিমর্য—দিন মন বিষাদে ভরে গেল।”
শেষে বলি, ভিক্টোরিয়া অধ্যায়ের অন্তিম পর্বে ও এডওয়ার্ডিয়াল অধ্যায়ে আমরা মানবীয় জীবনদর্শন ও বােধের একঘেয়েমির পরিচয় পাই। সাহিত্য-ইতিহাসবেত্তারা অন্তত তা-ই মনে করেন। কিন্তু ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য এখানে অনুপস্থিত। এখানে আমরা দেখতে পাই ভারতীয় জনজীবনের এক প্রাণময় প্রতিচ্ছবি। তবে পরিপূর্ণতার ও ধারাবাহিকতার দিক থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হলেও আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনায় ও ঐতিহ্যের পরিচয় সংগ্রহে ভারতপ্রেমী ফ্যানি পার্কসের ভারত ভ্রমণের এমন বৃত্তান্ত’ গবেষক ও তত্ত্বানুসন্ধানীদের কাছে মণিমুক্তার মত দুর্লভ ও দুমুল্য হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র :
- ১. বিনয় ঘােষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, প্রথম খন্ড, বাক সাহিত্য, কলকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ, ২০১০।
- ২. ফ্যানি পার্ক, সাহেব বিবি বণিক হারেম, বাংলা অনুবাদ-মীনাক্ষী দত্ত, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০০৬।
- ৩. G. R. Heber, Narative of a Journey through the upper Provinces of India from Calcutta to Bombay 1824-25; with an account of a Journey to Madras and Southern India, Londan.
- ৪. ক্যালকাটা গেজেট, ৯ অক্টোবর ১৭৮৮।
- ৫. বিমলচন্দ্র ঘােষ, দুর্গাপূজা সেকাল থেকে একাল, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট অফ রিসার্চ অ্যাণ্ড কালচার, কলকাতা, ১৯৪৬, পৃ. ১৯১-৯২।
- ৬. কালীপ্রসন্ন সিংহ, হুতােম প্যাচার নক্সা, প্রথম ভাগ, দেখুন-কাঞ্চন বসু সম্পাদিত, চিরায়ত সাহিত্য সংগ্রহ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ১৯৯২।
- ৭. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ২য় খন্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৭।
- ৮. ‘সংবাদ ভাস্কর’, ১৮৫৬-র ২০ সেপ্টেম্বর, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ২য় খন্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৭।
- ৯. ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দুর্ভিক্ষ, কবিতা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, কলকাতা, ১৮৮৫।
- ১০. জ্ঞানদান্দিনী দেবী, ‘স্মৃতিকথা’ দেখুন-ইন্দিরা দেবী সম্পাদিত, পুরাতনী, ইণ্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েটেড পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৫৭।
- ১১. ‘রহস্য’, বামাবােধিনী পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ ১২৭৩।
- ১২. Fanny Parkes, Wanderings of a pilgrim in search of the picturesque during four-and twenty years in the East with Revalations of life in Zenana, London, 1850, P.- 59, 60.
- ১৩. রাজকুমার চন্দ্র, দেখে শুনে আক্কেল গুড়ুম, কলকাতা, ১৮৬৩, পৃ. ৬-৭।
- ১৪. নগেন্দ্রবালা মুস্তাফী, ‘অবরােধে হীনাবস্থা’, বামাবােধিনী পত্রিকা, বৈশাখ ১২৭২।
- ১৫. Tapan Raychaudhuri, ‘Norms of Family Life and Personal Morality among the Bengali Hindu Elite, 1600-1850, in Aspects of Bengali History and Society, ed. by RVM Balmer, Hawai University Press, Hawai, 1974. 86. HAD Phillips, Our Administration in India with Special Reference to the Work and Duties of a District Officer in Bengal,W Thacker & Co., London, 1886.
- ১৬. রাসসুন্দরী দেবী, আমার জীবনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮৯৮ কলকাতা প্রথম সংস্করণ, ১৮৭৫, কলকাতা।
- ১৭. NC Chaudhuri, An Autobiography of an Unknown Indian, Bombay, Jaico Publishing House, 6th Jaico Impression, 1976
- ১৮. রােকেয়া সাখাওয়াৎ হােসেন, রােকেয়া রচনাবলী, আব্দুল কাদির সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৩।
- ১৯. স্বর্ণকুমারী দেবী, আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’, প্রদীপ, ভাদ্র ১৩০৬।
- ২০. কালীপ্রসন্ন ঘােষ, নারীজাতি বিষয়ক প্রস্তাব, কলকাতা কাব্য প্রকাশন প্রেস, ১৮৬৯।
- ২১. বামাবােধিনী পত্রিকা, চৈত্র ১২৭৭।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।