লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
বিশেষ কারণে হঠাৎ রাঁচি যেতে হয়েছিল। কিছু অভিজ্ঞতা হল যার থেকে মনে এল অনেক কথা।
নরতাত্ত্বিকরা মনে করেন ভারতীয় মানুষ তৈরি হয়েছে মূলত চারটি নরগোষ্ঠীর মিশ্রণে। এই গোষ্ঠী চারটিকে সাধারণভাবে আর্য জাতি, দ্রাবিড় জাতি, মোঙ্গলয়েড বা কিরাত জাতি আর অস্ট্রোলয়েড বা নিষাদ জাতি বলা হয়। যাদের নাম শেষে বলেছি তারাই ভারতের প্রথম অধিবাসী, তাই তাদেরকে আদিবাসীও বলা হয়। আর সবার আগে যাদের নাম করেছি তারাই এখানে সবার শেষে এসেছে অস্ত্রবিদ্যায় উন্নত আগ্রাসী রূপে, তারা আর্যভাষী নামেও পরিচিত। ঘটনাচক্রে আদিবাসীরা হয়েছে বনবাসী আর আগ্রাসীরা বন উচ্ছেদ করে পত্তন করেছে নগরের, হয়েছে নগরবাসী, তাদের ভাষাই। ক্রমশ সংস্কৃত ভাষা রূপে বিকশিত হয়। ব্রিটিশ আমলে সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় সংস্কৃতি সমার্থক হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে ধারণা গড়ে ওঠে মূলস্রোতের।
কিন্তু একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ রচিত ভারততীর্থ-তে আছে মিশ্রস্রোতের কথা— ‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমদ্রে হল হারা।’ অনেক নিয়ে একতার ভাবনাতে গড়ে উঠেছে ভারততীর্থ। কিন্তু বিশেষত বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকে মূলস্রোতের ভাবনা এবং তার মধ্যে আবার শুদ্ধ মূলস্রোতের আহ্বান উচ্চকিত হয়ে উঠতে থাকে ভারতবর্ষে। ওই শুদ্ধ মূলস্রোতের চিন্তাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় এক নতুন জাতির তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যখন নিজেদের এক মহান জাতি বলে দাবি করল তখন অহিন্দুরা কতদিন অতিথি সম্প্রদায় হয়ে থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেরিয়ে ভারতবাসী ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ড করে ফেলল। দেশভাগ করেই পাওয়া গিয়েছে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষ্যে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ছবির বিষয় হল ‘ভারতঃ তখন ও এখন’। রাঁচির হাটিয়া অঞ্চলে এখন যেখানে হেভি ইঞ্জিনীয়ারিং কর্পোরেশন সেখানে স্বাধীনতার পঁচিশ বছর আগে কীরকম জীবন ছিল সেটাই প্রথমে দেখানো হবে প্রস্তাবিত ছবিটির প্রথমার্ধে। এই ছবির জন্য লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে পৌছলাম রাঁচি-চক্রধরপুর রোডে বাঁধগাঁও গির্জা স্কুলের ভোদ্রা মাস্টারের গ্রামে। হঠাৎ বিকেলে শুরু হল ঝড়ের তাণ্ডব। বড় বড় গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে গেল বাস-লরি ইত্যাদির চলাচল। থেকে যেতে হল ভোদ্র মাস্টারের গ্রামে মেহমান হয়ে। ফিরে এসে সে বৃত্তান্ত লিখেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ভোদ্রা মাস্টার’ শিরোনামে।
রাত্রে খানপানের সময় ভোদ্রামাস্টার অন্তরঙ্গভাবে বললেন, একবার তার ঠাকুর্দা ভিন্ন গাঁয়ে যাওয়ার সময় যে ধুতিটা পরেছিলেন সেটা নেমে গেছিল হাঁটুর নিচে। সেই অপরাধে রাজাঠাকুরের বাড়িতে তাকে ডেকে নিয়ে মেরে বেহুশ করে ফেলে, তারপর ফেলে দিয়ে যায় জঙ্গলের ধারে। এক পাদরি তাকে তুলে এনে বাঁচান। তখন গ্রামসুন্ধু লোক খ্রিস্টান হয়ে যায়। বাঁধগাঁও পাহাড়ের মাথায় বানানো হয় গির্জা। সুরক্ষা দেয় ইংরেজ সরকার। এখন ইংরেজ সরকার নেই, রাজাঠাকুরও নেই, কিন্তু খুঁটি শহর থেকে লোকজন এসে বলছে, আমাদেরকে যিশু ছেড়ে হিন্দু হতে হবে, ফিরে আসতে হবে মেনস্ট্রিমে। বাঁধগাঁও গির্জার পাদরি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন বটে, কিন্তু গ্রামবাসীরা বাস করছে আতঙ্কে। পরের কাহিনি আমি জানি না।
পঁয়ত্রিশ বছর পরে আবার গেছিলাম রাঁচিতে। শরীরে সে সামর্থ্য নেই, যে বাঁধগাঁও যাব। তাই কোজাগরী রাতে গেছলাম হাটিয়ার কাছে পাহানটোলাতে। উঠোনে ফুটফুটে জ্যোৎস্না, কিন্তু বসলাম ঘরের ভেতর কাঠের চেয়ারে, কারণ বাইরে ওস পড়বে মাথায়। ছাদের কড়ি থেকে বোলানো তারের মাথায় মিটমিট জ্বলছে ইলেট্রিক বালব। চা এল কাপে করে। জিজ্ঞেস করলাম, “আজ লক্ষ্মীপূজো নেই?’ জানলাম, ব্রাহ্মণদের কোনও দেবদেবী এঁদের নেই। সর হুল পরবে এঁরা সরনা থানে পুজো করেন সাখুয়া গাছের। প্রশ্ন করলাম, তার মানে কি আপনারা হিন্দু নন?’ সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা কোলে তরুণী বউটি জবাব দিলেন, ‘না, না আমরা হিন্দু। আমার কপালে সিঁদুর দেখতে পাচ্ছেন না?’ তখন পাশের বৃদ্ধা ও আরও-বৃদ্ধা দুজনের প্রথম জন সেই আরও বৃদ্ধাকে দেখিয়ে জানালেন, ওঁদের আমলে সিঁদুর দেওয়ার প্রথা ছিল না, তার নিজের জমানা থেকে এই প্রথার শুরু।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার গোত্র কী?’ প্রথমে তারা গোত্র ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। আমার স্থানীয় সঙ্গী ত্রিবেদী ব্রাহ্মণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাণ্ডিল্য, ভরদ্বাজ, মুদগল— এইসব মুনিদের কার বংশে তোমাদের জন্ম?’ জবাবে বৃদ্ধ বললেন, ‘আমাদের কোনও মুনিবংশ নয়, আমাদের নাগবংশ।’ তখন ত্রিবেদীজি জানালেন যে, এঁদের ভাষা নাগপুরি, তাই এই পাহাড়িয়ালের নাম ছোটোনাগপুর, বরাবর এঁরা নাগপুরেই বাস করছেন। কিন্তু আজকাল এঁদের ছেলেমেয়েরাও নানারকম ক্রিম সোপ মেখে মিসেস ত্রিবেদীর মতো ফর্সা হতে চাইছে। কিছুক্ষণ ধরে আরও-বৃদ্ধা কী যেন বিড় বিড় করছেন। জানতে চাইলাম, ‘কী বলছেন উনি?’ ঘরের যুবকটি এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘বুড়ামার বহোত এতরাজ, বহোত গুসসা— আমরা সব নাকি বরবাদ। কিন্তু আমাদের তো বাড়তে হবে। জঙ্গলে পড়ে থাকলে চলবে? কিছু লাগিয়ে যদি আমার জেনানা ফর্সা হয় তো কী লোকসান?’

বুঝলাম কিছু আদিবাসীর মনে বনে বাস সম্বন্ধে শুধু নয়, গায়ের রং সম্বন্ধেও লজ্জা আছে, তারা শহুরে হতে চায়, ফর্সা হতে চায়, বউয়ের মাথায় সিঁদুর পরাতে চায়, ধনতরাস মানতে চায়। আমার সমর্থন পেলাম ঘরে এসে হিমাচলকন্যা মিসেস ত্রিবেদীর কথায়। তিনি বললেন, পাহানটোলার হাটে গেলে দেখবেন লিপস্টিক নেলপালিস ঢেলে বিকোচ্ছে। আসলে ওরা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক ভাগ চাইছে মেনস্ট্রিমে আসতে, দোসরা চাইছে আইডেনটিটি বহাল রাখতে। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘এটা মেনস্ট্রিম বনাম মাওস্ট্রিম নাকি?’ দুজনেই হেসে উঠলেন। ত্রিবেদীজি বললেন, ‘ওরা মাও-মাও করে, কিন্তু মাও যে কে তা ওরা জানে নাকি? ওরা মাওসেতুং জানে না, মাও-এক-বুডুং জানে, যে ওদের জান-জঙ্গল পাহারা দিচ্ছে।’
তখন ত্রিবেদী দম্পতিকে আমার ১৯৭১ সালের একটা অভিজ্ঞতার কথা বললাম। টাটাগোষ্ঠীর জন্য তথ্যচিত্র বানাবার কাজে শুটিং করতে গিয়েছিলাম ওড়িশা ঘেঁষে বিহারের এক আদিবাসী গ্রামে। সব রেডি। শট নেওয়ার ঠিক আগে এক মাতাল এসে হাজির, তারও পিকচার তুলে দিতে হবে। যেই শুনল আমরা টাটাদের হয়ে ছবি তুলতে এসেছি অমনই ছবি গেল উল্টে। সে এক লম্বা লেকচার ঝাড়ল। সত্তর বছর আগে সব জঙ্গল ছিল, জঙ্গলে শান্তি ছিল। টাটারা এল লোহা আর কয়লার লোভে। শুরু হল সাফাই। জঙ্গল সাফ, আমন সাফ, ইমান সাফ। কায়েম হল নোকররাজ। নোকরির ক্যায়া তামাশা। কিন্তু আসল তামাশা হল ওই লেকচারের ঠেলায় গ্রামবাসীদের কাছে আমরা হয়ে গেলাম দুশমন।
এবার ত্রিবেদীজি বললেন, ‘আমি নেতা নই, টাটা-আম্বানি নই, পি এম-এইচএমদের জানি না, একটু ডাক্তারি জানি, তাই দিয়ে গরিবের সেবা করি। মাও-এর নাম জানি, তার বেশি জানি না। আর এটুকু জানি, মাতালটার সব কথা সত্যি, কিন্তু আরও সত্যি আছে। আদিবাসী সমাজ এখন সত্যিই দু’ভাগ। এক ভাগ চাইছে ওদের জঙ্গল ওদের থাক, জঙ্গলে জল রোটি থাকলেই হল, আলো-সড়ক পেলে ভালো, তার সঙ্গে হেলথ এডুকেশন পেলে আরও ভালো। আর এক দল শহর-ননাকরি, টিভি-সিনেমা থেকে নেতাগিরি মিনিস্টারি চাইছে। যেমন আগে ছিল ব্রিটিশ পার্টি আর আজাদি পার্টি। বললাম, ‘নেতাগিরি থেকে তো শিবু সোরেন মধু কোডা হচ্ছে।’ ত্রিবেদীজি হেসে বললেন, ‘ছোকরা কী বলল বুঝলেন না? তার বউ ফর্সা হলে কী লোকসান? এতগুলো ঝাড়খণ্ডী থেকে দু একজন শিবু মধুতে দোষ কী?’
অভিজ্ঞতার শেষ নেই। এক সন্ধেতে হাটিয়া থেকে উঠলাম প্ল্যাটফর্মে লাগিয়ে রাখা ট্রেনে। আমারও আগে উঠেছেন একজন, সঙ্গে এক মহিলা ও এক বালিকা। এসি টু-টায়ারে আদিবাসী পরিবারকে দেখে আন্দাজে জিজ্ঞেস করলাম, রেলওয়ে অফিসার?’ ভদ্রলোক ‘হ্যাঁ’ বলে হেসে শুধোলেন, ‘ক্যায়সে মালুম?’ এই কামরাতে এঁদের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত, তবু যখন সপরিবার চলেছেন তখন বোধহয় রেলচাকরির সুবাদেই। আমার উত্তর শুনে শুধোলেন, ‘আপনি বাঙালি?’ তাই এমন জবার দিলেন! আমি পাল্টা শুধোলাম, ‘আপনি কী?’ জবাবে বললেন, ‘আমরা মুণ্ডারি, কিন্তু বাংলা ভালোই জানি।’ তখনও কামরাতে আমরা শুধু চারজন। কথায় কথায় বললেন, ‘আমাদের হয়েছে বিপদ। মেনস্ট্রিমের ফ্যামিলিরা আমাদের সঙ্গে মেশে না। ট্রাইবাল কি না। হয়তো আমরা মাওবাদী। আর মাওবাদীদের কাছে আমারা কোলাবরেটর। ম্যাসিভ প্রবলেম। আর্মি পুলিশ দিয়ে এর সলিউশন হতে পারে না।’
আমি বললাম, ‘মাওবাদীরা নিরীহ লোকদের কেন খুন করছে?’ সহযাত্রী হেসে বললেন, ‘ওটাই তো! আর জিন্দাল টাটা পসকো বেদান্ত কেন ইনোসেন্ট গ্রামগুলোর উপর হামলা করছে? সেই যে স্যার টাটা ফান্ডামেন্টাল অ্যাগ্রেশন শুরু করলেন তা আজও জারি আছে, আরও হিউজ হয়েছে। কাসটা কী জানেন। ট্রাইবালদের ঘরের নীচে মিলিয়ন মিলিয়নের ট্রেজার চাপা আছে। এমন সময় কামরাতে আরও প্যাসেঞ্জার এলেন। তাই দেখে তিনি বললেন, ‘এসব কথা থাক। যাদের মাটির নীচে লিকুইডগোল্ড আছে তাদের যা কার্স আমাদেরও সেই কার্স। এটা ট্রাইবালদের আইডেনটিটিকে চ্যালেঞ্জ করা।’ বলে তিনি মাথার উপর কম্বল টেনে নিলেন। আবার মুখ বের করে বললেন, ‘গুড নাইট।’
দারুণ একটা অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে ঘুমিয়ে পড়াই তার পছন্দ নাকি নতুন সহযাত্রীদের মুখোমুখি হতে তার অনিচ্ছে বুঝতে পারলাম না। আদিবাসীদের মনের কথা কি মেনস্ট্রিমের বোঝা সম্ভব? আগুন দিয়ে কি আগুন নেবানো যাবে?
মহাত্মা গান্ধীর সন্ধান – ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পূনর্মূল্যায়ন