লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজ পরামর্শক কৌটিল্য বলেছিলেন, “প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দাও, দরকার হলে গুপ্তহত্যা করেও।”
কৌটিল্যের এই বাক্যটিকে গ্রহণ করেছিল মোর্য শাসক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। কৌটিল্যের এই পরামর্শ মেনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুপ্ত ঘাতকেরা মহাবীর আলেক্সান্ডারের দুই জেনারেল জেনারেল নিকানর ও ফিলিপকে হত্যা করেছিল।
একটি রাষ্ট্রকে ক্ষমতা বিস্তার ও আগ্রাসনের জন্য এই নৃশংস পদ্ধতি ও কূটনীতি দিয়ে গিয়েছিলেন কৌটিল্য। যা যুগে যুগে রাষ্ট্রনায়করা ব্যবহার করে নিজেদের রাজ্য সম্প্রসারণ করে ক্ষমতা বিস্তার করেছেন।
বর্তমান যুগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গুপ্তচর সংস্থা হল ইজরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। ফিলিস্তিনের ভুখন্ড অবৈধভাবে দখল করে ইজরাইল রাষ্ট্র গঠন করে জায়নবাদী ইহুদীরা। রাষ্ট্র গঠনের পরই তারা মোসাদের ভিত্তি স্থাপন করে। যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিন দখল করে তারা নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করে তাই তাদের প্রধান টার্গেট হয় ফিলিস্তিনের সেইসব মেধাবী বিজ্ঞানীরা যাঁরা ইজরাইল বিরোধী শক্তি হামাসকে সাহায্য করছিলেন যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইজরাইলের বিরুদ্ধে কোন শক্তিশালী প্রতিরোধ না গড়ে তুলতে পারে। মোসাদ শুধুমাত্র ফিলিস্তিন তথা মুক্তি আন্দোলন সংগঠন হামাসই নয় এমনকি বন্ধুরাষ্ট্রের নেতাদেরকেও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে খুন করেছে ইজরাইলের স্বার্থবিরোধী কাজ করার জন্য। মোসাদ তাদের গুপ্তহত্যাকে এমন নিখুঁতভাবে করেছে যে মৃতদেহ ছাড়া আর কোন প্রমাণ পাওয়া যেত না, সব প্রমাণ তারা লোপাট করে দিত।
ক্যাসেরিয়া ইউনিট : ক্যাসেরিয়া হল মোসাদের অভ্যন্তরীণ একটি ইউনিট। প্রধানত আরব বিশ্বে গুপ্ত অভিযান পরিচালনার স্বার্থে ৭০-এর দশকে গঠিত এই ইউনিট বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে গোয়েন্দা মোতায়েন ও পরিচালনা করে থাকে। ২০০০ সালে অধিকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনি জাতিমুক্তি আন্দোলন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল ৫ শতাধিক গুপ্তহত্যার অভিযান চালিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়ে ইসরায়েল এক হাজারের বেশি অভিযান চালিয়েছে তার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে। তখন থেকে ইসরায়েল আরও অন্তত ৮০০ অভিযান চালায়, যার লক্ষ্য ছিল গাজা উপত্যকার ভিতর বাইরে হামাসের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বকে হত্যা।
বর্তমান যুগে শক্তিশালী হওয়ার সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি হল নিজেদেরকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেসব রাষ্ট্র প্রযুক্তির দিক এগিয়ে নিয়ে গেছে তাদেরকেই লক্ষ্য বানিয়েছে মোসাদ। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসকে যেসব বিজ্ঞানী পারমানবিকভাবে শক্তিশালী বানানোর জন্য সাহায্য করেছে তাদেরকে শিকার বানিয়েছে মোসাদ। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিজ্ঞানী ও গবেষকের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ
অপারেশন ডেমোক্লিস
এই সাংঘাতিক অপারেশনের মাধ্যমে ইজরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ ব্যাপক হারে প্রতিপক্ষের বিজ্ঞানীদেকে নিধনযজ্ঞ অভিযান শুরু করে।
ইজরাইলের কাছে পর পর কয়েকটি যুদ্ধে মারাত্মকভাবে হেরে যায় মিশর। তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারেন প্রযুক্তির দিক থেকে নিজেদের উন্নত না করলে প্রতিপক্ষ ইজরাইলকে পর্যুদস্ত করা যাবেনা। সেজন্য তিনি নাৎসি জার্মানির ভি-টু রকেট প্রজেক্টে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে মিশর নিজেদের রকেট প্রোজেক্ট শুরু করে।
প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার পর যখন মিশর ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে নতুন রকেটের সফলভাবে পরীক্ষা করে তখন প্রমাদ গোনে সারা বিশ্ব। ইজরাইলও নড়ে চড়ে বসে। সেই প্রোজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীদের পরিবারকে মোসাদ ক্রমাগত হুমকি থাকে। ২৭ নভেম্বর রকেট বিজ্ঞানী ওলফগ্যাং পাইলজের একটি পার্সেল বোমা পাঠায় মোসাদ। এই বিস্ফোরণে বিজ্ঞানী ওলফগ্যাং পাইলজের সহকারী আহত হন। মিশরে মিলিটারি হার্ডওয়ার সরবরাহ করতেন হেইঞ্জ ক্রুগ। মোসাদের গুপ্তচরেরা তাকে অপহরণ করে খুন করে। হেইঞ্জ ক্রুগকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মোসাদ পুনরায় মিশরের একটি রকেট কারখানায় পার্সেল বোমা পাঠায়। এই বিস্ফোরণে নিহত হয় ৫ জন কর্মী। মোসাদের এজেন্ট মিশরে অবস্থিত বেশ কয়েকজন কর্মীর উপর গুলি করে। ফলে মিশরকে যেসব বিজ্ঞানী প্রযুক্তিগতভাবে সাহায্য করছিলেন তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ ১৯৬৩ সালে মিশর ছেড়ে ইউরোপ ফেরত চলে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় এই রকেট প্রজেক্ট।
মোহাম্মদ জাওয়ারি
১০ বছর ধরে ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। হামাসের আল কাসসাম ব্রিগেডের হয়ে কাজ করা সামরিক বিশেষজ্ঞ ৪৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ জাওয়ারি একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং তিনি ‘আবাবিল’ নামের একটি ড্রোন তৈরি করছিলেন। ২০১৪ সালে আবাবিল প্রথম কম পরিমানে ব্যবহার করা হলেও এতে কোনো অস্ত্র ছিল না। মোহাম্মদ জাওয়ারি আবাবিলকে অস্ত্র বহনের উপযোগী করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল জাজিরার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা ছিলেন।
২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বরে তিউনিশিয়ার সফক্স শহরে গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ করেই মোসাদের এজেন্ট একটি ট্রাক নিয়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক থেকে পরপর ২০টি গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি ক্যাফে ছিল। তার সিসিটিভিতে সবকিছু ধরা পড়ে। কিন্তু পরে দেখা যায়, অজ্ঞাত কোনো হ্যাকার ক্যাফের সিসিটিভিটি অচল করে রেখেছে এবং সব ফুটেজ ডিলিট করে দিয়েছে। সাংবাদিক ছদ্মবেশে একজন মোসাদ এজেন্ট তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ইসরাইল তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
জাওয়ারির সহকারী অল্পের জন্য সেখান থেকে বেঁচে যান। তবে ধারণা করা হয়, একজন প্রত্যক্ষদর্শী রাখতেই মোসাদ তার সহকারীকে প্রাণে মারেনি, যাতে এই হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সবাই জানতে পারে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে যাবার সাহস না পায়।
ড. মাজিদ শাহরিয়ারি ও ড. আব্বাস–দাভানি
নিউট্রন বিশেষজ্ঞ মাজিদ শাহরিয়ারি ছিলেন ইরানের এক প্রতিভাবান পরমাণু বিজ্ঞানী। তিনি ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।
অপরদিকে পদার্থবিজ্ঞানী ড. আব্বাসি ইরানের আণবিক সংস্থার তৎকালীন প্রধান ছিলেন। অস্ত্রকে আরও উন্নত করার জন্য লেজার প্রযুক্তি নিয়েও তিনি গবেষণা করতেন। লেজার প্রযুক্তি গোলা বা রকেটের লক্ষ্য ভেদ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এছাড়াও তিনি ইরানের হাতে গোনা কয়েকজন আইসোটোপ পৃথকীকরণ বিশেষজ্ঞের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। আব্বাসি পরমাণু পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পরমাণু গবেষণায় কর্মরত বলে জানায় মাশরেগনিউজ ওয়েবসাইট।
ডঃ মাজিদ শাহরিয়ারি ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর নিজে গাড়ি চালিয়ে তাঁর কর্মস্থল শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম ছিল। সেজন্য তাঁর গাড়ির গতি কমে যায়। এমন সময় হঠাৎ মোটরবাইকে চড়া গুপ্তঘাতক এসে চুম্বক লাগানো সি-৪ বোমা তাঁর গাড়ির দরজায় আটকে দেয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে এবং ৪৫ বছর বয়স্ক শাহরিয়ারি সাথে সাথেই মারা যান। পাশের আসনে বসেছিলেন ড. মাজিদের স্ত্রী। তিনি এই হামলায় মারাত্মকভাবে জখম হন।
এই ঘটনাটি ঘটার ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটি হামলা হয়। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ড. আব্বাসির গাড়ি লক্ষ্য করেও একইভাবে হামলা করা হয়। তিনি আহত হলেও শেষপর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনাটি ঘটিয়েছিল মোসাদ। যদিও তেহরান পুলিশ মোসাদের সেইসব গুপ্তঘাতকদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “ইহুদি রাষ্ট্রের গুপ্তচররা ইরানের দুই খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের ওপর হামলা করেছে।”
ইহুদি রাষ্ট্র বলতে ইসরায়েলকে বুঝিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই অধ্যাপকরা নিজেদের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হামলার শিকার হয়েছেন।
ইয়াহিয়া এল মাশাদ
মিশর, ব্রিটেন ও রাশিয়া থেকে তিনি প্রযুক্তিবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর তিনি গবেষক হিসেবে মিশরের আনবিক সংস্থায় যোগদান করেন। তৃতীয় আরব-ইজরাইল যুদ্ধের পর মিশরের বেশামরিক আনবিক কর্মসূচী বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দের পর ইয়াহিয়া এল মাশাদ ইরাকে বসবাস করা শুরু করেন এবং সেখানে আনবিক সংস্থায় যোগদান করেন। রিঅ্যাক্টরের জন্য তাঁকে প্রচুর খুচরা যন্ত্রপাতি ইউরোপ থেকে ইরাকে আমদানি করতে হতো। সেজন্য ইরাক ইয়াহিয়া এল মাশাদকে ফ্রান্সে নিজেদের খুচরো যন্ত্রপাতি কেনাকাটার সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ করে। মোসাদ যখন আনবিক বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া এল মাশাদের ব্যাপারে জানতে পারে তখন তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। প্যারিসের লা মেরিডিয়ান হোটেলে তার মৃতদেহ গলা কাটা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া এল মাশাদের হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত থাকা এক নারীও আত্মহত্যা করে। তবে প্যারিস পুলিশের ধারণা সেই নারীটি আত্মহত্যা করেনি যেহেতু হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সব জেনে গেছিল সেজন্য প্রমাণ লোপাটের জন্য মোসাদই তার সহকর্মী হত্যাকাণ্ডে জড়িত নারীটিকে হত্যা করে।
দারিউশ রেজায়ি
৩৫ বছর বয়সী দারিউশ রেজায়ি ইরানের বুশেহর পরমাণু প্রকল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এছাড়াও তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি ফেরার সময় মোসাদের দুই এজেন্ট তাঁকে অনুসরণ করে। দক্ষিণ তেহরানের অভিজাত এলাকা বনি হাশেম স্ট্রিটে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মোসাদের দুই এজেন্ট তাঁকে উদ্দেশ্য করে চোখের পলকে পিস্তলের ট্রিগার চেপ চম্পট দেয়। ইরান হারায় একজন অত্যন্ত মেধাবী একজন বিজ্ঞানী ও অধ্যাপককে।
জেরাল্ড বুল
জেরাল্ড বুল এক খ্যাপাটে প্রকৃতির বিজ্ঞানী ছিলেন। দূরপাল্লার কামান নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি ইরাকের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। তিনি সাদ্দামকে পশ্চিমা আর্টিলারির আদলে কয়েকটি মডেলের ক্ষেপনাস্ত্র কামান তৈরি করে দেন। শেষমেশ ‘ব্যবিলন’ নামের দুই ধরনের সুপার গান তৈরির কাজে হাত দেন। সাদ্দাম হোসেন তাকে এই কাজে অর্থ দিয়ে যাহায্য করেছিলেন এবং ইসরায়েলের ধারণা ছিল বুল যদি সফল হন তাহলে ইজরাইলের ভূখণ্ড ব্যবিলনের দখলে চলে আসবে।
১৯৯০ সালের ২০ মার্চ। দরজায় ঘণ্টা বাজলে বুল দরজা খুলতে যান। দরজা খুলতেই মোসাদের এজেন্টরা একঝাঁক গুলি করে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।
মাসুদ আলী মোহাম্মদী
মাসুদ আলী মোহাম্মাদী ইরানের বিখ্যাত শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পরে তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে বেশ ভালোভাবেই যুক্ত ছিলেন। ইরানের অভিজাত রেভ্যলুশনারি গার্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে বলে শোনা যায়। ২০০৯ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তিনি প্রথম বুঝতে পারেন, কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে।
হজ দেশে ফিরে ভেবেছিলেন, ইরানের তিনি জন্য নিরাপদে থাকবেন। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের এই স্বনামধন্য অধ্যাপক মাসুদ আলী মোহাম্মাদী উত্তর তেহরানের শারিয়াত স্ট্রিটে তার নিজের বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন। সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। গাড়ি স্টার্ট করার মুহূর্তের মধ্যে বিকট শব্দে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন-বিজ্ঞানী মাসুদ আলী মোহাম্মাদীর নিথর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। পাশের এক মোটরবাইকের সাথে একটি শক্তিশালী বোমা বাঁধা ছিল। সেটি এতই শক্তিশালী ছিল যে আশেপাশের বাড়ির কাঁচ পর্যন্ত শক-ওয়েভে ভেঙে যায়। বিজ্ঞানী মোহাম্মদী শুধু একজন প্রতিভাবান অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইরানের অভিজাত রেভ্যুলুশনারী গার্ডের একজন সম্মানীয় সদস্য। তার মৃত্যুতে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের চরম ক্ষতি হয়।
২০০৯ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা এক মার্কিন তারবার্তা বিশ্লেষণ করে ইরান সন্দেহভাজন একজনকে আটক করে। আটক মজিদ জামালি মোসাদের সাথে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে এবং ২০১১ সালে তার ফাঁসি হয়।
ইরানের বিজ্ঞানীদের ওপর এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী মোসাদের বহু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের একটি ক্ষুদ্র অংশ। মুসলিম বিশ্বকে সংঘাতে জড়িয়ে রাখার জন্য মোসাদ গত ৬০ বছর যাবত অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশির দশকে ইরাকের একচ্ছত্র নায়ক সাদ্দাম হোসেন যখন বাগদাদের কাছে ওসিরাক অ্যাটমিক রি-অ্যাক্টর চালু করেছিলেন, তখন মোসাদ সেই প্রকল্পের প্রধান তিনজন বিজ্ঞানীকে খুন করে। তিনজন বিজ্ঞানী ওই প্রকল্পের সাথে এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন যে মোসাদের হাতে খুন হবার পর সাদ্দাম হোসেন আর পরমাণু প্রকল্পের কাজই চালিয়ে নিতে পারেননি।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শত্রুদেরকে শক্তিহীন করার ক্ষেত্রে মোসাদের ষড়যন্ত্রের কোনো তুলনা নাই। ইসরাইলের অপ্রতিহত অগ্রযাত্রার মূলে রয়েছে মোসাদের নৃশংসতা ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ।
মোস্তফা আহমাদ রোশান
মাত্র ৩২ বছর বয়সী মোস্তফা আহমাদ রোশান ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণু কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি মাসে প্রতিদিনকার মতো উত্তর তেহরানের রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেল থেকে দুজন লোক কিছু একটা গাড়িতে চুম্বক সংযুক্ত বোমা বসিয়ে দেয়। কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ তাঁর গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। প্রত্যক্ষদশীরা জানায়, পরে নিশ্চিত হয় যে, ইরানের বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠী মুজাহিদিন-ই খালকের সহায়তায় এই বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে মোসাদ। সে সময় ইরানের পুলিশ এবং গোয়েন্দা দপ্তরের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া বিভিন্ন বার্তায়ও আড়ি পেতেছিল মোসাদ এজেন্টরা।
মেধাবী রকেট বিজ্ঞানী ফাদি আল-বাত্শ
সদাহাস্য মিষ্টি স্বভাবের ফাদি মোহাম্মদ আল-বাত্শ ২১ এপ্রিল ভোর বেলা ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তার জানা ছিল না, তাকে হত্যা করার জন্য মসজিদের কাছেই মোটরসাইকেলের উপর বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিল কুখ্যাত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই গুপ্ত ঘাতক। ফাদি মোহাম্মদ আল-বাত্শ তাদের নিকটে আসতেই পিস্তল বের করল মোসাদের এজেন্ট দুজন। পর পর ১০টি গুলি চালায় তাকে লক্ষ্য করে। এর মধ্যে ৪টি গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মেধাবী অ্যাকাডেমিক, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং রকেট বিজ্ঞানী ফাদি মোহাম্মদ আল-বাৎশের। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে দেখা যায়, বিজ্ঞানী ফাদি মুহাম্মাদের আসার জন্য মোসাদের সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থলে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করেছে।
ফাদি মোহাম্মদ আল-বাত্শের জন্ম ১৯৮৩ সালে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার জাবালিয়া গ্রামে। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ গাজা থেকে ২০০৬ সালে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং ২০০৯ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি গবেষণার জন্য মালয়েশিয়া যান এবং সেখানকার কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি অফ মালায়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
তিনি মাতৃভূমি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার অধিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন। পিএইচডিতে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন।
তাঁর সহপাঠিতে বক্তব্য অনুযায়ী তিনি প্রায়ই বলতেন, সর্বদা বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে থাকা গাজার জন্য তিনি একসময় অফুরন্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিবেন। তিনি মালয়েশিয়ান সভেরিন ওয়েলথ ফান্ডের বৃত্তি পাওয়া প্রথম আরবীয় সন্তান। ২০১৬ সালে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি বিশেষ পুরস্কারও লাভ করেন।
ফাদি বিদ্যুৎ ছাড়াও ফাদি ড্রোন এবং রকেট নিয়েও গবেষণা করতেন। বিজ্ঞান ও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর একাধিক গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সালে তিনি ড্রোন প্রযুক্তির উপরও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, হামাসের পক্ষ থেকেই তাকে ড্রোন এবং রকেট প্রযুক্তির উপর গবেষণার জন্য মালয়েশিয়াতে পাঠানো হয়েছিল।
হামাসের সাথে সম্পৃক্ততার কারণেই ফাদি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নজরে পড়েন। মালয়েশিয়াতে যাওয়ার আগে গাজায় থাকা অবস্থায়ও মোসাদ তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। তাঁর চাচা তাইসির আল-বাত্শ ছিলেন গাজার পুলিশ বাহিনীর প্রধান, তাঁকে হত্যা করার জন্যও ইসরাইল ২০১৪ সালে বিমান হামলা চালিয়েছিল। সে সময়ের ইজরাইলের আক্রমণে বাত্শ পরিবারের ১৮ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছিল। সেবারের জন্য ফাদি আল-বাত্শ বেঁচে গেছিলেন।
বিজ্ঞানী ফাদি আল-বাৎশের হত্যাকান্ড মোসাদের প্রধান ইওসি কোহেনের নির্দেশে চলমান একটি বৃহত্তর অপারেশনেরই ধারাবাহিকতা, যার আওতায় হামাসের সেরা সেরা ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা করেছে মোসাদ, হামাস যাদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছে অস্ত্র সম্পর্কে আরো বিস্তৃত জ্ঞান লাভ করার জন্য তাঁদেরকেই গুপ্তভাবে হত্যা করেছে মোসাদ।
আসলে ইসরাইলের জন্য ফিলিস্তিন সমর্থক এইসব বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা বেশ বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ। কারণ এদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে হামাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠবে। তখন হামাসকে পরাজিত করা ইসরায়েলের পক্ষে সহজ না-ও হতে পারে। মোসাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন রকেট এবং ড্রোন বিশেষজ্ঞ ফাদি আল-বাৎশ।
গাজাবাসী বা গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস যেন ইজরাইলের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়তে না পারে, সেজন্য গুপ্তহত্যার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত তাদের মেধাবী বিজ্ঞানীদেরকে হত্যার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে।
সিরিয়ান রকেট বিজ্ঞানী ড. আজিজ আসবার
সিরিয়ান রকেট বিজ্ঞানী ড. আজিজ আসবার। সিরিয়ার হামা প্রদেশে অবস্থিত সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটি (SSRC) প্রকল্পটির একজন স্বনামধন্য পরিচালক। তিনি ৪ আগস্ট, শনিবার উক্ত প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই এক গাড়িবোমা হামলায় প্রাণ হারান।
তার মৃত্যুর দুই দিন পরে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যপ্রাচ্যের এক গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ইজরাইলি সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যান দাবি করেন, রকেট বিজ্ঞানী ড. আজিজ আসবারকে হত্যা করেছে ইজরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা, মোসাদ।
ড. আজিজ আসবারকে মোসাদ টার্গেট বানিয়েছিল কারণ তিনি গত বছর ইজরাইলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় সিরিয়ার একটি অস্ত্রভাণ্ডার। সেটিকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ড. আজিজ আসবার। তিনি সিরিয়ার সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটি, এসএসআরসির একটি টপ সিক্রেট ইউনিট, সেক্টর ফোরের প্রধান ছিলেন। এই গোপন ইউনিটটির কাজ ছিল নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদে সক্ষম এরকম মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (রকেট) প্রস্তুত করা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে ইজরাইল ভীত ছিল, তারণ মাসিয়াফের রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে তাঁর তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন এই মিসাইলগুলো ও ক্ষেপনাস্ত্রগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ইজরাইলের ভেতরে যে কোন স্থানে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল।
সিরিয়ার সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটি ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক, জৈব, রাসায়নিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা। গৃহযুদ্ধের পূর্বে এটিই ছিল সিরিয়ার প্রধান রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র। এখানে অন্তত হাজার দশেক কর্মচারী নিয়োজিত ছিল।
মোসাদ অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই ড. আসবারের উপর নজরদারি করে আসছিল। সিরিয়ার মিসাইল প্রোগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১১ সালের যুদ্ধের আগে থেকেই মোসাদ তাকে হত্যার চেষ্টা করে আসছিল বলে। এছাড়াও সিরিয়ার আল-ওয়াতান পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, মোসাদ এজেন্টরা এর আগেও অন্তত দুইবার ড. আসবারকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। মোসাদ বার বার তাঁকে হামলা করলেও তিনি কোনক্রমে বেঁচে যান।
বিদেশের মাটিতে বিশেষ করে মুসলিম দেশে পারমানবিক অস্ত্র নির্মাণের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করা ইজরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের জন্য অনেকটা নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোসাদ অন্তত ছয়জন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। এছাড়াও মোসাদ ২০০৮ সালে সিরিয়ার তারতুসে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের সাথে জড়িত এক সিরিয়ান জেনারেলকে, ২০১০ সালে দুবাইয়ে ইরানের কাছ থেকে মিসাইল ক্রয়ের কাজে নিযুক্ত হামাসের এক কর্মকর্তাকে, ২০১৩ সালে বৈরুতে হেজবুল্লাহ্র রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধানকে, ২০১৬ সালে তিউনিসিয়ায় হামাসের দুইজন বিজ্ঞানীকে এবং এ বছর এপ্রিলে কুয়ালালামপুরে হামাসের এক রকেট বিজ্ঞানীকে হত্যা করার পেছনেও মোসাদ দায়ী ছিল।
মোসাদের ভয়ঙ্করতম গুপ্তচর নারী
মতি কাফির নামের এক লেখক ইসরায়েলি গুপ্তচর সিলভিয়া রাফায়েলের ওপর একটি বই লিখেছেন। মোসাদ বাহিনীতে একজন নারী হিসেবে যোগদান, অতঃপর উত্থান ও মৃত্যু পর্যন্ত পুরো ঘটনাপ্রবাহ এই বইয়ে উল্লেখ করা আছে। সিলভিয়া রাফায়েলকে এখনও বিশ্বের গুপ্তচরদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বলে উল্লেখ করা হয়।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ, বেলা সাড়ে চারটা। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত আট জনের একটি বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এক গ্রামে। ইসরায়েলি কোয়ার্টার ভেঙে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে আসা তিন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদকে বের করে আনা হয়। দুইজনকে হত্যা করা হয়, একজনকে করা হয় জিম্মি। আক্রমণকারী বাহিনীর অপর দুই সদস্য আলী সালামেহ এবং আবু দাউদ বেড়ার বাইরে থেকে হামলার দৃশ্য দেখছিলেন। যখন তারা গুলির শব্দ শুনতে পান, তখনই বুঝতে পারেন যে অপারেশন সফল হয়েছে, এবার পালাতে হবে। নিকটবর্তী অপেক্ষারত গাড়িতে করে তারা কাছের বিমানবন্দরে চলে যান। সেখান থেকে তারা ভুয়া পাসপোর্টে সোজা চলে যান রোমে। রোম থেকে সালামেহ চলে যান বৈরুতে এবং আবু দাউদ চলে যান বেলগ্রেডে।
ওদিকে জার্মান নিরাপত্তারক্ষীরা গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছিল না, ঠিক কী ঘটছে সেখানে। তারা কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছিল না, কারণ তাতে যদি জিম্মি ইসরায়েলিদের কেউ আহত হন। এ অবস্থায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন তারা। মোসাদের প্রধান জাভি জামির দ্রুত মিউনিখে চলে আসেন এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জার্মানির মধ্যস্থতা ইস্যুতে ভূমিকা পালন করতে চান। যুদ্ধে জামিরের অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। জামিরের এই প্রস্তাবে জার্মানী সোজা তাকে জানিয়ে দেয়, বাইরের কারো হস্তক্ষেপ তারা আশা করছে না।
মধ্যস্থতার এক পর্যায়ে জার্মান কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী দলটিকে প্রস্তাব দেন, ইসরায়েলি জিম্মি ক্রীড়াবিদকে ছেড়ে দিতে হবে এবং বিনিময়ে তাদের একটি বিমানযোগে নির্বিঘ্নে উড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। দলটি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা বিমানে ওঠার পর জিম্মীকে ছেড়ে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে জার্মান বাহিনী তাদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। পুরে বিষয়টিই ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ। জার্মান বাহিনীর গুলিতে দলটির পাঁচজন মারা যায়, একজনকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সালামেহ ততক্ষণে বৈরুতে অবস্থিত ফিলিস্তিনি গুপ্তচর সংস্থা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদরদপ্তরে পৌছে গেছেন। সেখানে পৌঁছে জানতে পারেন জার্মান বাহিনী কিভাবে তার দলের অন্য সদস্যদের হত্যা করেছে। সেদিন রাতেই ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের হত্যা করার আনন্দ উদযাপন করছিল ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির। বলা হয়ে থাকে, সেসময় ইয়াসির আরাফাত হাসতে হাসতে আলী সালামেহকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলে, তুমি আমার ছেলে।’ আলী সালামেহ তার অফিসে চলে আসেন এবং নতুন নতুন হামলার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
পুরো বিষয়টি প্যারিসের একটি ফ্ল্যাটে বসে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছিলেন কেউ। তিনি হলেন ইসরায়েলি গুপ্তচর সিলভিয়া রাফায়েল। টেলিভিশনের পর্দায় মুখোশধারী সন্ত্রাসী ও জার্মান বাহিনীর নৃশংসতা দেখছিলেন তিনি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে কোনো নাগরিকের ওপর হামলাকে সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এর আগে আরও অনেক হামলার পরিকল্পনা মোসাদ নষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু অলিম্পিকের মতো একটি অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের ওপর হামলা হবে এটা মোসাদ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। হামলার পরের দিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হেরাল্ড ট্রিবিউনের শিরোনামে ছাপা হয়, আলী সালামেহর নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটিয়েছে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর। প্যারিসে নিজের পরিচয় সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে অন্যান্য কোনো মোসাদ এজেন্টের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না সিলভিয়ার। শুধু তার উর্ধ্বতন এজেন্ট ডেভিডের সঙ্গে তার অল্প যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর ডেভিডও ইসরায়েল চলে যায়। তারপরও সিলভিয়া ডেভিডকে ফোন করে দেখা করতে চান। দু’জনের দেখা হলে সিলভিয়া ডেভিডকে হেরাল্ড ট্রিব্রিউনের নিবন্ধটি দেখান এবং বলেন, ‘আমার মনে হয়, সালামেহই এখন আমাদের মূল টার্গেট।’ প্রতিউত্তরে ডেভিড বলেন, ‘আমারও তাই মনে হয়।’ সিলভিয়া ডেভিডের মাধ্যমে মোসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বলে পাঠান, এর বিপরীতে যেন ইসরায়েলি গুপ্তচরদের একটি দল প্রেরণ করা হয়।
ডেভিড মোসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো ইতিবাচক সাড়া পান না। কারণ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের কোন কোন সদস্যের ওপর আঘাত হানা হবে সেবিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য তখনও মোসাদের কাছে ছিল না। আর এই ফাঁকা জায়গাতেই মঞ্চে প্রবেশ করেন সিলভিয়া। তার কাছে থাকা তথ্যদি তিনি তত্কালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে সরবরাহ করেন। এরপর গোল্ডা মেয়ারের তত্ত্বাবধানে মোসাদের একটি বিশেষ বাহিনীকে ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’ নামের একটি অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এই পুরো অপারেশনটির নকশা করেন সিলভিয়া। আর মোসাদের ওই গোপন দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন মাইক হারিরি। মোট পাঁচটি স্কোয়াডে ভাগ করা হয় দলটিকে। প্রতি স্কোয়াডে ছির ১৫ জন সদস্য।
অপারেশনের অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর মোসাদ বাহিনী রোমে ফিলিস্তিনের একজন অনুবাদক ও পিএলও’র প্রতিনিধি আতিয়ারকে হত্যা করে। আতিয়ার যখন রাতের খাবার শেষ করে বাসায় ফিরছিল তখন তার ওপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। গুণে গুণে বারোটি গুলি করা হয় তাকে। এরপর একই বছরের ৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য মাহমুদ হামশারিকে টোলিফোন বোমায় হত্যা করে মোসাদ। অপারেশনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ফাতাহ’র প্রতিনিধি হুসেইন আর বশিরকে হত্যা করা হয় সাইপ্রাসে। একই বছরের ৬ এপ্রিল বৈরতে বাসিল আল কুবাসিকেও আতিয়ারের মতো ১২বার গুলি করে হত্যা করা হয়। টানা বিশ বছর এই অভিযান চালিয়ে যায় ইসরায়েল।
অপারেশন চলাকালীন সময় ‘রেড প্রিন্স’ নামে খ্যাত আলী সালামেহকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালান সিলভিয়া। কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে সালামেহ ভেবে আহমেদ বুশিকি নামের এক মরক্কোর নাগরিককে হত্যা করেন সিলভিয়া। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নরওয়ে আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন, যদিও ১১ মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর তিনি মুক্ত হয়ে যান। যে আইনজীবি তাকে কারাগার থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করেছিল সেই আইনজীবিকেই বিয়ে করে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়।
এতো গেলো কেবল একটি ঘটনার খণ্ডাংশ। মোসাদের পক্ষে পরিচালিত এমন আরও অসংখ্য অপারেশনের পরিকল্পনা করেছেন এই গুপ্তচর নারী। ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে মারা যান। [তথ্যসূত্রঃ ডেইলী হান্ট]
সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার চেষ্টা
১৯৭০ সালে সাদ্দাম হোসেনের বিরোধী কুর্দিদের সমর্থন করে ইসরাইল। কারণ ইসরাইল তৎকালীন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সবথেকে বড় শত্রু মনে করত ইসরাইল। সেজন্য মোসাদের একটি গুপ্ত ঘাতকের দল সাদ্দামকে হত্যা করার জন্য একটি বিস্ফোরক মেশানো বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়। সাদ্দাম সেই বইটির পৃষ্ঠা খুলতেই যাতে বিস্ফোরণ ঘটে মারা যায় তার পুরো ব্যবস্থা করে রেখেছিল মোসাদ। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায় এবং সেযাত্রায় বেঁচে যান সাদ্দাম হোসেন।
কাহিনী এখানেই সমাপ্ত নয় মোসাদ মিসর, ইরাকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সামরিক সহায়তা করা ঠেকাতে জার্মানি, উরুগুয়ে, কানাডার নাগরিকদেরও হত্যা করেছে।
নাইন ইলেভেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল এ নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। যদিও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সিআইএ’র এক সময়ের বিশ্বস্ত ওসামা বিন লাদেন ও তালেবানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ ইসরাইল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জেরুজালেম পোস্টের ইন্টারনেট সংস্করণে বলা হয়, যেদিন নাইন ইনেভেনে হামলা হয় যেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে ৪ হাজার ইহুদি কাজ করত। কিন্তু সেদিনের বিমান হামলায় মাত্র একজন ইহুদী মারা গেছে। যদিও পরে আরো দু’জন ইহুদি নিহতের জানা যায়। তাহলে ওই দিন এত বিপুলসংখ্যক ইহুদি কিভাবে নিরাপদে ছিল তার জবাব আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি বা দেয়নি। অথচ যে সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জঙ্গী হামলা হয়েছে প্রতিদিন ওই সময়ে অনেক ইহুদি অফিসে উপস্থিত থাকত। উপস্থিত থাকেনি শুধু হামলার দিন। তাহলে কি প্রমাণ হয়না যে মোসাদ তথা ইহুদিরাই উক্ত দিনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে জঙ্গী হামলা চালিয়েছিল এবং বলির পাঁঠা বানিয়েছে উসামা বিন লাদেনকে। মোসাদ এই হামলার পরিকল্পনাকারী নয় এর পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ সিআইএ বা মোসাদ দেয়নি। নাইন ইলেভেন সম্পর্কে লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদদাতা রবার্ট ফিস্ক বলেছেন, ‘৯/১১ সম্পর্কে যে সরকারি ভাষ্য দেয়া হয়েছে তার সামঞ্জস্যহীনতা নিয়ে আমি ক্রমেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছি। এটা স্পষ্ট নয়, পেন্টাগনে হামলা চালানো বিমানের অংশগুলো (ইঞ্জিন ইত্যাদি) কোথায় গেল? ইউনাইটেড-৯৩ বিমানের (যা পেনসিলভানিয়ায় বিধ্বস্ত হয়েছে) সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মুখ কেন বন্ধ করে দেয়া হলো? এই বিমানের ধ্বংসাবশেষ কেন কয়েক মাইল দূরে ছড়িয়ে ছিল? একটি মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার পর এটির তো অখণ্ড থাকার কথা ছিল।’ স্বাভাবিকভাবে মোসাদকেই উক্ত জঙ্গী হামলার জন্য সন্দেহ করা হয়।
ইজরাইলের বিখ্যাত সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান তাঁর ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশনস’ বইয়ে মোসাদের অনেক গোপন রহস্য ফাঁস করেছেন। তিনি তাঁর বইয়ে ইসরায়েলের গত ৭০ বছরে অবৈধ দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার পথে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যেসব গুপ্তহত্যা সম্পন্ন করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এই বইয়ে বার্গম্যান জানান, প্রতিষ্ঠার পর ২ হাজার ৭০০ জনকে মোসাদ তথা ইসরায়েল রাষ্ট্র হত্যা করেছে। বেশির ভাগই ছিলেন ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের পিএলও নেতা শান্তিতে নোবেলজয়ী ইয়াসির আরাফাতও রয়েছেন। তাঁকে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে বলে বার্গম্যান তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। বার্গম্যান তাঁর এই বই লেখার জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, শিন বেত ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক হাজারের বেশি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি এই বই প্রকাশ করতে গিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বাধার বাধার সম্মুখীন হন। বার্গম্যানকে ইজরাইল হুমকি দিয়ে বলে, এই ধরনের গবেষণা ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে বার্গম্যান ইজরাইলের হুমকিতে থেমে যাননি। তিনি বইটি প্রকাশ করেছেন এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন।
যত দূর জানা যায়, ১৯৫৬ সালের মিসরের লে. কর্নেল মোস্তফা হাফেজকে পার্সেল বোমা পাঠিয়ে হত্যা করে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। মোস্তফা হাফেজ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বাছাই করতেন। গুপ্তহত্যার বড় ধরনের অভিযান ইসরায়েলিরা পরিচালনা করে ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। মিউনিখ অলিম্পিক ভিলেজে হামলা করে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের অ্যাথলেটদের জিম্মি করে। ইসরায়েলি কমান্ডোরা তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করলেও কাউকেই আটক করতে পারেনি। পরে দীর্ঘ সময় নিয়ে ওই হামলায় অংশ নেওয়া সবাইকে বৈরুত, প্যারিস, অসলো ও যুক্তরাষ্ট্রে হত্যা করে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। এর মধ্যে বৈরুতে হামলা করে ১৯৭৩ সালের ৯ এপ্রিল। ওই সময় পিএলওর শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতাকে হত্যা করে তারা। ১৯৮৮ সালে তিউনিসে হত্যা করা হয় ফাতাহ আন্দোলনের নেতা আবু জিহাদকে। লিবিয়া থেকে সিরিয়ায় যাওয়ার পথে ১৯৯৫ সালের মাল্টার ডিপ্লোম্যাট হোটেলের সামনে ফাতিহ সাকিকিকে গুলি করে হত্যা করে মোসাদের সদস্যরা। ছদ্মনাম ড. ইব্রাহিম ধারণ করে বিভিন্ন দেশে আনাগোনা করতেন সাকিকি। কিন্তু মোসাদের গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে পারেননি। [সূত্রঃ প্রথম আলো]
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রাবিন নিহত হওয়ার পর হামাসের বোমা স্কোয়াডের সদস্য ইয়াহইয়া আয়েশের খোঁজে ছিল ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত। ১৯৯৬ সালে তাঁকে গাজায় হত্যা করা হয়। আয়েশকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বন্ধুর চাচা কামিল হামাদকে এক মিলিয়ন ডলার, ভুয়া ইসরায়েলি পাসপোর্ট ও মার্কিন ভিসা জোগাড় করে দেওয়া হয়। আয়েশকে হত্যার কিছুদিন পরেই চারটি আত্মঘাতী হামলা করে ৬০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করে হামাস।
প্রায় ১২০০ জন দক্ষ গোয়েন্দা নিয়ে গঠিত মোসাদ ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মকান্ডে সফল হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৭৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর চিলির প্রাক্তন মন্ত্রী অরল্যান্ডো লেটেলারকে ওয়াশিংটন ডিসিতে গাড়ি বোমায় হত্যা, ১৯৬৫ সালে নাযি ওয়ারে অভিযুক্ত লাটভিয়ার বৈমানিক হার্বার্টস কুকার্সকে উরুগুয়ে থেকে ফ্রান্স হয়ে ব্রাজিল যাওয়ার পথে হত্যা, বসনিয়া যুদ্ধের সময় বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়ার রাজধানী সারাজেভো থেকে বিমান ও স্থলপথে ইহুদিদের ইসরায়েলে স্থানান্তর, পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ ইরানকে হুমকি মনে করে ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সে দেশের প্রধান পারমাণবিক বিজ্ঞানী ড. আরদেশির হোসেনপুরকে হত্যা ইত্যাদি।
মোসাদের স্লোগান হচ্ছে, ‘ফর বাই ওয়াইজ গাইডেন্স ইয়উ ক্যান ওয়েজ ইউর ওয়ার’ (For by wise guidance you can wage your war)। এটা পবিত্র বাইবেলের বহুপরিচিত একটি বাণী।
‘মোসাদ’ শব্দটি হিব্রু। যার অর্থ ‘ইন্সিটিটিউট’ বা ‘প্রতিষ্ঠান’। হিব্রুতে এর পুরো নাম হল- ‘হামোসাদ লেমোদি তাফকোদিম মেয়ুহাদিম’। যার অর্থ ‘দ্য ইন্সিটিটিউট অফ ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস’। ইসরাইলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধেও কাজ করে ‘মোসাদ’। এ ছাড়া যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না, সেই সব দেশ থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে সরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্বও মোসাদের।
অন্যদিকে বিদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য সংগ্রহ, পরিকল্পিত গুপ্তহত্যা, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর নজরদারি রাখা, বৈদেশিক নীতি-নির্ধারণে সহায়তা করা, সাইবার ওয়ারফেয়ার পরিচালনা করা, নতুন নতুন ড্রোন আক্রমণ, প্রযুক্তির আবিষ্কার, বিদেশি বিভিন্নসংস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং গুপ্ত কারাগার পরিচালনাও সংস্থাটির বিশেষ কর্মকাণ্ডের পরিচায়ক।
দুর্দান্ত সক্রিয় এই সংস্থা পরিচালিত হয় ইসরায়েলি সামরিক ও অসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের বাছাই করা কর্মকর্তাদের দিয়ে। আর সংস্থাটির সম্পূর্ণ কর্মকাণ্ড এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। কারণ এর কাজের রিপোর্ট ও গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হয়।
এখন প্রশ্ন হল ইসরায়েল কেন বেছে বেছে প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুপ্তভাবে হত্যা করছে? কেনইবা গোপন হত্যাকাণ্ডের অবৈধ নীতি অবলম্বন করে টিকে থাকতে চাইছে? বার্গম্যানের তাঁর বইয়ে জানিয়েছেন যে, ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রাচীন গ্রন্থ ‘তালমুদ’ উপদেশে অনুপ্রাণিত হয়েই বেছে বেছে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছে। এবং জায়নবাদী ইহুদী সন্ত্রাসবাদী সংস্থা মোসাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই কারণ ‘তালমুদ’ অনুসারে কেউ যদি তোমাকে হত্যা করতে আসে, তবে নিজেকে তৈরি করে প্রতিপক্ষকে হত্যা করো। কিন্তু এখানে বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল রাষ্ট্র নিজেই অবৈধ দখলদার অবৈধভাবে মুসলিমদের ভূখণ্ড দখল করেছে এবং তারা অসংখ্য নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। সুতরাং তাদের আত্মরক্ষার্থে তালমুদের বাণীর ব্যবহার এক বড় ধরনের ভাঁওতাবাজি। ইসরায়েলিদের কেউ হত্যা করতে আসেনি। বরং জায়নবাদী ইহুদীরা রক্তের সাগরে ভেলা ভাসিয়ে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি দখলের স্বপ্নে বিভোর, তারা পুরো জেরুজালেম ও মুসলিমদের পবিত্র ভূমি মসজিদুল আকসা দখল করার জন্য বদ্ধপরিকর। ফিলিস্তিনিরা তার প্রতিরোধ করতে চাইছে মাত্র। তাতে রক্ত ঝরছে উভয় পক্ষেই।
বার্গম্যানের বই সেই রক্তঝরার ইতিহাসকেই সামনে তুলে এনেছে। ইসরায়েলের এই গুপ্তহত্যাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই বলে অনেকে বৈধ করার চেষ্টা করেন। তবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে জায়নবাদী ইহুদীরা অবৈধভাবে ফিলিস্তিনের ভুখণ্ড দখল করেছে সে ব্যবাপারে সবাই নীরব। হামাস তথা ফিলিস্তিনের সকল মুক্তিকামী আন্দোলন কোনদিনই সন্ত্রাসবাদ নয় এটা আমাদের বুঝতে হবে। হামাস ইজরাইলের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে মোকাবিলা করছে মাত্র।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।