সম্প্রতি বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার দুটি নতুন কৃষি আইন প্রবর্তন করেছে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন পরিবর্তন করেছে। এই ৩টি আইন’ই দেশের কৃষক সমাজের স্বার্থের পরিপন্থী। এই ৩টি আইনের মাধ্যমে আদানী-আম্বানী সহ দেশী-বিদেশী বৃহৎ কোম্পানীগুলির হাতে দেশের কৃষি ব্যবস্থা তুলে দিতে চাইছে নরেন্দ্র মােদীর সরকার। এর ফলে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে না – থাকবে না ক্ষুদ্র কৃষকের জমির অধিকার। ভাগচাষী, ক্ষেতমজুর কার্যত বন্ডের লেবার বা চুক্তি ভিত্তিক দাসে পরিণত হবে। চুক্তি চাষের অধিকার দানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র-মাঝারী কৃষকদের জমি হস্তগত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে বৃহৎ ধনী কোম্পানীগুলােকে। কৃষি পণ্যের বাজার ফড়ে দালালদের হাতে তুলে। দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই আইনে। অবাধ মজুত করবার অধিকার দানের মাধ্যমে মজুতদার কালােবাজারীদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যপণ্যের বাজার। এর ফলে বাজারে খাদ্যশস্য মজুত রেখে, বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে অবাধ কালােবাজারী ব্যবসা চলবে দেশে।
দেশের শ্রম আইনগুলির সংশােধনের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশের ৭০% কোম্পানী এবং সংগঠিত কলকারখানার মােট শ্রমিকদের ৭৪%-এর ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকবে না নতুন আইনে। ন্যূনতম মজুরী আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে কার্যত দেশের অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরী কমানাের অবাধ অধিকার দেওয়া হয়েছে মালিক পক্ষকে। শ্রমিক কর্মচারীদের পি.এফ. ই.এস.আই ইত্যাদি। প্রকল্পের অর্থ চুরি করেও মালিক পক্ষ রেহাই পেতে পারে এই আইনে।
মােদী সরকারের কৃষি এবং শ্রম সংক্রান্ত নতুন আইনগুলি আদানী-আম্বানী সহ দেশী-বিদেশী বৃহৎ কোম্পানীদের অবাধ লুঠের ব্যবস্থাকেই পােক্ত করবে। নয়া উদার অর্থনীতির অঙ্গ হিসাবেই এই আইনগত পরিবর্তনগুলি আনা হয়েছে।
দেশের শ্রমিক-কৃষক-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সহ সমগ্র অংশের মানুষকে গভীর বিপদে ফেলৰে এই নতুন আইন।
এর বিরুদ্ধে চাই সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই।
যে তিনটি কৃষি আইন বিজেপি সরকার আনল সেগুলি হলাে –
- ১. দি ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স (প্রমােশন এন্ড ফেসিলিটেশন আইন ২০২০ অথবা ‘কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ) আইন ২০২০’।
- ২. দি ফারমারস (এম্পায়ারমেন্ট এন্ড প্রােটেকশন এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস এসিওরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিসেস আইন ২০২০ অথবা ‘কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তির মূল্য নিশ্চিতকরণ ও খামার পরিষেবাদি আইন, ২০২০’।
- ৩. এসেনসিয়াল কমােডিটিস(আমেন্ডমেন্ট )আইন, ২০২০ অথবা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশােধন) আইন, ২০২০।
এই বিলগুলাে গায়ের জোরে গুন্ডামি করে সংসদে পাশ করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
প্রথমে বিজেপি সরকার এই বছরের জুন মাসে অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। তার পর থেকেই কৃষক সহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিল। তারা প্রশ্ন তুলেছে কেন কৃষকদের সঙ্গে, তাদের সংগঠনগুলির সঙ্গে আলােচনা ছাড়াই এই অর্ডিনান্স আনা হলাে?
এই অর্ডিন্যান্স কে আইনে পরিণত করেছে বিজেপি। নমূনতম সৌজন্য দেখায়নি রাজ্যগুলির সঙ্গে আলােচনা করার। অথচ কৃষি রাজ্য তালিকাভূক্ত। বিজেপি আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল সংসদে কাউকে প্রশ্ন করতে দেওয়া হবে না। তাই বিলের ওপরেও কাউকে আলােচনা করতে না দিয়ে জোর করে ধ্বনি ভােটে পাশ হ’লাে। রাজ্যসভায় রীতিমতাে গুন্ডামাে করে পাশ করানাে হলাে বিল। ২০শে সেপ্টেম্বর কৃষকের মৃত্যু পরােয়ানায় সই করল নরেন্দ্র মােদির সরকার। আর রাষ্ট্রপতি সেই মৃত্যু পরােয়ানায় স্বাক্ষর দিয়ে একে আইন বানিয়ে দিলেন ২৭শে সেপ্টেম্বর।
বিলের বিরােধিতা কেন?
ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে তাকে বাজারের ফড়েদের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা এই বিলে উঠে গেল। যদিও বিজেপির আমলে গঠিত শান্ত কুমার কমিটি বলেছিল কেবলমাত্র ৬ শতাংশ কৃষক সরকারের থেকে ফসলের ন্যনতম সহায়ক মূল্য পায়। এই বিলে সেটুকুও আর রইল না।
প্রকিওরমেন্ট অর্থাৎ সংগ্রহ যদি না থাকে তাহলে এফসিআই, নাফেড থাকবে কেন? উঠে যাবে। এফসিআই উঠলে রেশনও থাকবে না। খাদ্যের গণবণ্টন ব্যবস্থায় তালা লাগানাের পরিকল্পনা লগ্নীপুঁজির ধারক-বাহকদের দীর্ঘদিনের। কার্যকরী হতে আর বেশি সময় লাগবে না। গরিবের সন্তানের নুনে-ভাতেও ছাই দেবে এরা।
ফসল বিক্রির স্বাধীনতা?
বিজেপি সরকারের দাবি হল যে ‘কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ) বিল ২০২০’ আন্তরাজ্য ও অন্তরাজ্য ব্যবসা বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করবে। এর ফলে রাজ্য কৃষি উৎপাদন বিপণন আইনের আওতাভুক্ত ফসলের বর্তমান বাজারগুলাের বাইরেও ই-কর্মাসের দ্বারা কৃষকেরা উপকৃত হবে। এমন দাবিও করা হচ্ছে যে এই প্রথম কৃষকেরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে তাদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পেতে চলেছে। এটা বাস্তবে হবে না। এটা আসলে বিজেপির আকর্ষণীয় মােড়কে চূড়ান্ত অসত্য প্রচার। এই অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জোর গলায় প্রচার চালানাে হচ্ছে একেবারে হিটলারি কায়দায়। এটা ঠিকই যে বছরের পর বছর ধরে কৃষকদের হাতে থাকা বেশিরভাগ বিপণনযােগ্য উদ্বৃত্ত বিক্রি হয়েছিল কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (এপিএমসি)-র বাজার চত্বরের বাইরে। সর্বশেষ পরিস্থিতি মূল্যায়ণ সমীক্ষায় প্রকাশিত যে, সমীক্ষার আওতায় থাকা ৩১টি ফসলের মধ্যে ২৯টি ফসলের ক্ষেত্রে স্থানীয় বেসরকারী ব্যবসায়ীরা ছিল মূল ক্রেতা। শুধুমাত্র অড়হর ও ছােলার ডালের ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বাজারগুলাে (যার অনেকগুলােই আবার এপিএমসি আইনের আওতার বাইরে) ছিল বিক্রয়ের মূল জায়গা। সােয়াবিন বাদ দিয়ে অন্য সব শস্যের ২৫% এরও কম বিক্রি হয়েছে এপিএমসি বাজারে (রওশন কিশোর, “Why farmers are opposing pro-farmer reforms”, হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০)। এপিএমসি বাজারবিহীন রাজ্য হিসাবে কেরালা ও বিহারের উল্লেখ করছে বিজেপি। কিন্তু এই দুটো রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে কেরালাতে এপিএমসি বাজার না থাকলেও রাজ্য সরকার নিয়মিত কুপী সমস্যা নিরসনে হস্তক্ষেপ করে, সেখানে বিহারে এপিএমসি নারি তুলে দেওয়ার ফলে এল? কোনাে ধরণের সরকারি নরদারি না থাকায় ফিরে সালের উপযুক্ত মূল্য পায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমাদের রাজ্যে মন্ডির ধারণাটা কাকির নেই। যদিও বামফ্রন্ট সরকার রেগুলেটেড মার্কেট বা নিয়ন্ত্রিত বাজার কোঅপারেটিভ বা সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালনা করত। ২০১৭ সালে। তৃণমূল সরকার এই নিয়ন্ত্রিত বাজার অবলুপ্ত করে দেয়।
১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে এপিএমসি আইনগুলাে চালু করা হয়েছিল বড় ব্যবসাদার ও বড় ক্রেতাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরা দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে আইন বহির্ভূত উপায়ে দরিদ্র কৃষকদের থেকে স্বল্প মূল্যে ফসল কিনে নিত। ফসলের মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকদের শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যেই এই আইনগুলাে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সবক্ষেত্রে সর্বত্র কার্যকরভাবে প্রয়ােগ করা না হলেও, এপিএমসি আইনগুলাের ফলে নিলামের মাধ্যমে ফসল বিক্রির একটা পদ্ধতি শুরু হয়েছিল এবং প্রতিযােগিতার একটা পরিবেশ ছিল। এইরকম ব্যবস্থার পরেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করা যায়নি। নতুন আইনে বড় ব্যবসায়ী এবং বড় ক্রেতাদের সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নথীভুক্ত বাজারের বাইরে পণ্য কেনার অনুমতি দেওয়ার অর্থ, পণ্যটি কেনা হবে নিলাম ছাড়াই, বড় ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র কৃষকের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলােচনার মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী এবং তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষকেরা অনেক সময়েই তাদের ফসল অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয় ধার শােধ করার জন্য, পরিবারের খরচ চালাতে বা পরবতি মরসুমে চাষের খরচ জোগানের জন্য। তারা একটা অসম ব্যবস্থার মুখােমুখি হবে যখন কোন ধরণের সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে তারা বৃহৎ পুঁজির সামনে পড়বে।
এমনকি বর্তমান ব্যবস্থায় যেখানে চুক্তি চাষ চলছে, সেথা কৃষকদের প্রয়াশই পূর্বনির্ধারিত দাম দিতে অস্বীকার করা হয় নানা অজুহাত তুলে, যা সাধারণত অযৌক্তিকভাবে কম এবং সি২+৫০% (শ্রমের দাম সহ কৃষকের উৎপাদন খরচ + তার ৫০শতাংশ) ফর্মূলা মেনে চলা হয় না। যদিও প্রখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী শ্রী এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ ছিলাে এটাই। কখনও গুণমান অনুযায়ী বাছাইয়ের নাম করে বা ওজন কারচুপি করে। সহায়ক মূল্য আর থাকবে না এবং কৃষকদের অনিশ্চিত বিশ্ব বাজারে ফসলের দাম ওঠা পড়ার সামনে ছেড়ে দেওয়া হবে। বিশ্ব বাজারে ফসলের দাম কমলে তারা অতির সম্মুখীন হবে কিন্তু দাম বাড়লে তারা সেটা পাবে না, যেমন পেট্রোপণ্যের ক্ষেত্রে হয়েছে। এপিএমসি-কে দুর্বল করা, গণসংগ্রহ ও ন্যনতম সহায়ক মূল্য প্রদান ব্যবস্থাকে দুর্বল করার প্রথম পদক্ষেপ। একদেশ এককর ব্যবস্থার মতই ‘এক দেশ এক বাজার’-এর স্লোগানও আসলে কৃষি উৎপাদকদের অবস্থা আরাে সঙ্গীন করে তুলবে। কৃষকদের সমস্যার কারণ বিপণনের বিধিনিষেধ নয়। উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়া ও সরকার কতৃক শস্য সংগ্রহের অভাবই মূল সমস্যা। তিনটি বিলের কোথাও নির্ধারিত এমপি এর থেকে কম মূল্যে শস্য সংগ্রহ করা যাবে না, এই কথার উল্লেখ নেই। অথচ কৃষকের রক্ষাকবচ হতে পারত স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা। কৃষক স্বার্থ বিরােধী ঠিক উল্টো কথাই বলা আছে আইনে। এখানে বলা হয়েছে সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের বেশি দামে কেউ কৃষকের থেকে কৃষি পণ্য কিনতে পারবে না।
কৃষক হবে সর্বস্বান্ত – খাদ্যপণ্যের দাম হবে আকাশ ছোঁয়া
এই যখন পরিস্থিতি দেশের কৃষি বাজারের, তখন নতুন আইনকে হাতিয়ার করে নিঃসন্দেহে মহা ধনীরা কৃষকদের কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করবে এবং সাধারন কৃষক মরবে। মহা ধনীদের ফসল মজুত করতে এখন আর কোনাে উৰ্দ্ধসীমা বা সিলিং রইলাে না। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত বিনা বাধায় বড়পুঁজি দাপাদাপি করবে কৃষি বাজারে। ইচ্ছেমতাে যথেচ্ছ খাদ্যপণ্য মজুত করবে।
প্রথমে হয়তাে চাষীদের ফসল বেশি টাকা দিয়েই তারা কিনবে। তারপর চারিদিকে আর যখন কেনার লােক থাকবে না, তখন চাষীকে ফসলের অনেক কম দাম দিয়ে তাকে চেপে মারবে। ফসলের ওপর একচেটিয়া অধিকার তৈরি হবে একচেটিয়া লগ্নীপুজির। সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম লাগামছাড়া হবে বাধ্যতামূলক ভাবেই বাজারের নিজস্ব সূত্রেই।
মহা ধনী খেয়ালখুশিমতাে দাম বাড়াবে কৃষিপণ্যের। সাধারণ মানুষকে চড়া দামে কিনতে হবে খাদ্যপণ্য। দু’বেলার জায়গায় আধ বেলা খাতে মানুষ। আবার সেই ‘ফ্যান দাও’, ‘ফ্যান দাও’ খাদ্য সংকটের দিকে চলে যাবে মানুষ। সদ্য প্রকাশিত বিশ্বক্ষুধা সূচক তালিকায় ভারতের স্থান ১০২তম, মােট ১১৫টি দেশের মধ্যে।
তাই নয়া কৃষি আইন শুধুমাত্র দেশের কৃষিক্ষেত্র আর কৃষকের ব্যাপার না। কৃষিজীবী পরিবারের সংকট শুধু নয়। এর প্রভাবে সরাসরি সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, গরীব, খেটে খাওয়া মানুষের একটা বড় অংশের জীবনে নেমে আসবে গভীর সংকট।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশােধন কেন?
কালােবাজারী আর বেআইনি মজুতদারি বন্ধ করে খাদ্যশস্য আমজনতার নাগালে রাখার জন্যে ১৯৫৫ সালে তৈরি হয়েছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। চাল, গম, ডাল, তেল, চিনি, আলু সহ একাধিক নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য খেয়ালখুশিমতাে মজুত করার অধিকার কারুর ছিল না। এই আইন কার্যত: বাতিল করলাে বিজেপি। ২০টির বেশি দ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অবাধ মজুতদারীর আইনি অধিকার পেয়ে গেল মহা ধনী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি। ইচ্ছে করলেই মজুতদাররা এখন বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করবে। বাজারের নিয়ন্ত্রন চলে যাবে তাদের হাতে। তবে যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষর সময়ে তা করতে পারবে না, কারণ তখন নাকি সরকার হস্তক্ষেপ করবে। যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষ ক’বারই বা হয়?
আঘাত শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর
শ্রমিক কর্মচারীরা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা পেয়ে থাকেন। বেতন বা পেনশনের সাথে। এখন থেকে আর নতুন ডিএ পাওয়া যাবে না। কারণ যেসব বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়লে ডিএ দেওয়ার নিয়ম আছে, সেগুলো আর নতুন আইন অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে ধরা হবে না। তাই নতুন ডিএ পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিক কর্মচারীরা ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হবেন।
সহায়ক মূল্য কার্যত বাতিল
এই তিনটি আইন একসাথে পড়লেই বােঝা যায় যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ভর্তুকি হ্রাস, সরকারি মজুত কমানো ইত্যাদির শর্তগুলাে পূরণ করা জন্যই এই আইনগুলাে তৈরি করা হয়েছে। শান্ত কুমার কমিটিও সংগ্রহ ও মজুত ব্যবস্থার বেসরকারীকরণের সম্পর্কে একই ধরণের পরামর্শ দিয়েছিল এবং কেন্দ্রের সরকারের ভূমিকা হ্রাসের কথা উল্লেখ করেছিল। এই কমিটির আরও প্রস্তাব ছিল যে, রাজ্যগুলাের নিজস্ব গণবন্টন ব্যবস্থা (পিডিএস) ও অন্যান্য কল্যাণ প্রকল্পগুলাের জন্য প্রয়ােজনীয় পরিমাণের শস্যের বাইরে, অতিরিক্ত শস্য কেন্দ্রের সংগ্রহ করা উচিত নয় এবং এমএসপি এর ওপরে কোন অতিরিক্ত বােনাস দেওয়া থেকেও বিরত থাকা উচিত, এই নির্দেশ রাজ্যগুলােকে স্পষ্ট করে জানানাের সুপারিশ ছিল এই কমিটির । বিজেপি সরকার সেই অনুযায়ী চলছে। কেরালার মত রাজ্য যেখানে এলডিএফ সরকার ধান সংগ্রহ করছে ২৭৫০টাকা/কুইন্টাল দরে, যা কেন্দ্রের ঠিক করা দরের থেকে ৯০০টাকা/কুইন্টাল বেশি। সেখানে এই ধরণের সিদ্ধান্তে কৃষকদের জীবনে কি আঘাত হানবে, তা সহজেই অনুমেয়।
স্বাধীনতা কার – লগ্নিপুঁজি না কৃষক
বিজেপি প্রচার করছে এক্ষেত্রে তিনটি আইন পাশ করার ফলে কৃষকরা এমন স্বাধীনতা পাবে যা দেশের স্বাধীনতার পরে কখনাে তারা পায়নি। কি সেই স্বাধীনতা? বিজেপি, আরএসএস এবং তাদের কাছে বিকিয়ে যাওয়া প্রচার মাধ্যমগুলি প্রচার করছে এই বিলে কৃষক তার উৎপন্ন ফসল যে কাউকে বা যে কোন দামে যে কোনাে জায়গায় বিক্রি করতে পারবে। আচ্ছা, প্রচুর পুঁজি ছাড়া কারাের পক্ষে কি দেদার কৃষি পণ্য কিনে তা বিক্রি করা সম্ভব? দক্ষিণ ২৪পরগণার ৫/৭ বিঘা জমির মালিক গরীব চাষীদের কি পাঞ্জাবে তার কৃষিপণ্য বিক্রি করতে যাওয়ার মত অবস্থা আছে? না নেই। না। আদানী, উইলমার, পেপসিকো, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স ফ্রেশ ইত্যাদি দৈতাকৃতি কোম্পানি এসে তাে আর দক্ষিণ ২৪পরগণার কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনবে না। সে কিনবে ফড়েদের কাছ থেকে। তাহলে ফড়েদের মাতব্বরি কমবে নাকি আইনি স্বীকৃতি পেয়ে তা আরাে বাড়বে? তাহলে এটা কৃষকের স্বাধীনতা নয়, কর্পোরেট এবং বড় পুজির ফসল-জমি লুঠের স্বাধীনতা, তাদের মুনাফা বাড়াবার স্বাধীনতা। এতে কৃষক, সাধারণ মানুষের কোন স্বার্থ নেই। আদানী, উইলমার, পেপসিকো, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স ফ্রেশ ইত্যাদি সংস্থার মত বহুজাতিক সংস্থার পুষ্প বৃষ্টি ঝরে পড়ছে নরেন্দ্র মােদির মাথায়।
চুক্তি চাষে কার লাভ কৃষি বিলে চুক্তিচাষকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইন মােতাবেক কৃষি ব্যবসায়ী, কৃষিজ পণ্য রফতানিকারক, অথবা কৃষি প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা সরাসরি কৃষকের সাথে চুক্তি করতে পারবে ইচ্ছেমত চাষ করিয়ে নেওয়ার জন্যে। সরকার বলছে এর ফলে নাকি কৃষক লাভের নিশ্চিত অধিকার পাবে!
চাষীদের বােঝানাে হচ্ছে তােমাদের চিন্তার দিন শেষ। ফসলের দাম নিয়ে, সার-বীজ-ওষুধ নিয়ে আর চিন্তার দরকার নেই। মহা ধনীরা আসবে, চুক্তি করবে, চাষীদের জমি নেবে, বিনিময়ে প্রচুর টাকা দেবে, চাষ করবে ওরা। প্রয়ােজনে চাষীকে দিয়েও চাষ করাতে পারে, তার জন্যও টাকা পাবে চাষী। কিন্তু এই বিলে লেখা আছে খাদ্য ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতাে দামে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনতে পারবে। এটা বলছে না মােদি বা তার অনুগত মিডিয়া যে, কম সময়ে বেশি মুনাফা তুলতে গিয়ে সে যে জমির বারােটা বাজিয়ে দেবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? জমির বারােটা বেজে গেলে সেই জমির দাম কি আর পরে কৃষক পাবে? মহা ধনী তাে মানুষের প্রয়ােজন অনুযায়ী চাল, ডাল, আলু, গম, পেঁয়াজ, সজি চাষ করবে না। যেটায় লাভ সেটাই চাষ করাবে। ক্যাশক্রপ যেমন রাবার বা তুলাে ইত্যাদি। সেই নীল চাষের মতাে ব্যবস্থা। আবার সেই খাদ্য সংকটের প্রশ্ন। চুক্তির পর অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড় বা অন্য কোনাে কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কি হবে? সরকার দায় নেবেনা। কর্পোরেট টাকা ছাড়বে না। হয় আত্মহত্যা, নয় ঋণের ফাঁসে শেষ হবে চাষীর ভবিষ্যৎ। এতদিন ভােটের তাগিদে হলেও সরকার মাঝে মাঝে কৃষিঋণ মকুব করতে বাধ্য হয়েছে। চুক্তি চাষে সরকারের আর সে দায় থাকবে না। অর্থাৎ কৃষকের দায় থেকে সরকার হাত ধুয়ে ফেলল পাকাপাকি ভাবে।
বর্গদার-ভাগচাষীদের কি হবে?
যে জমিতে বর্গাদার, ভাগ চাষী আছে সেই জমিতে মালিকের সাথে চুক্তি হবে কিভাবে? বর্গাদার, ভাগ চাষী এদের সাথে তাে এইসব বহুজাতি কোম্পানী চুক্তি করবেনা। এর মানে ভাগচাষী-বর্গাদার উচ্ছেদ হবে নতুন করে। নতুন আইনে চুক্তিচাষের ক্ষেত্রে কোনও বিরােধ চাষী এবং কোম্পানির মধ্যে হলে আদালতের ক্ষমতার ওপরে গিয়ে বিবাদ নিস্পত্তির সমস্ত ক্ষমতা এস ডিএম-কে দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের আদালতে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির সাথে বিরােধের ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষকদের নির্ভর করতে হবে আমলাতন্ত্রের দয়ার ওপরে। বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট বাহিনী কৃষকদের স্থানচ্যুত করে কৃষির দখলদারি নেবে এবং কৃষির কর্পোরেটকরণ নিশ্চিত করবে। চুক্তি চাষে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে কৃষি ব্যবসাগুলির চাহিদা এবং প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী কৃষককে চাষ করতে হবে এবং আজীবন দাসত্ব করতে হবে। এই বিলের উদ্দেশ্য যদি প্রকৃত পক্ষে ছিল কৃষকদের ক্ষমতায়ন, সুরক্ষা এবং দামের নিশ্চয়তা প্রদান তাহলে বিলে কেন ফসলের মূল্যের নিশ্চয়তার কোন উল্লেখ নেই?
স্বাধীনতার সময় দেশে মােট ২ কোটি ৭৮ লক্ষ ভূমিহীন কৃষক ছিলাে। এখন এই সংখ্যা ২০ কোটি। এছাড়া আমাদের দেশের ৮৬ শতাংশ কৃষক প্রান্তিক। অর্থাৎ ক্ষুদ্র চাষী যাদের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম। আমাদের রাজ্যে ৭০ শতাংশ চাষীর জমিই ১একর। এরপর রয়েছে বহু বর্গাদার, ভাগচাষী যারা অন্যের জমিতে চাষ করে। এছাড়া রয়েছে কোটি কোটি মরশুমি কৃষি শ্রমিক। এরা নতুন বিলে সর্বস্বান্ত হয়ে কর্পোরেটের ক্রীতদাস বা বন্ডেড লেবারে পরিণত হবে। কৃষিতে লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশের সুচারু ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। করে দেওয়া হল যন্ত্রের অবাধ অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা। কৃষির সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষের কাজ চলে যাবে। যারা কাজ করবে তাদের মজুরিও কমবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দেশে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যার আড়াই গুণ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের ক্ষেত্রে। এখানে কিন্তু হিন্দু বলে কারাের ছাড় নেই। বিজেপি’র হিন্দুত্বটা ভােটের জন্য, গরিব মানুষকে বিপদের থেকে বাঁচানাের জন্য নয়।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাতিল কেন?
সরকার হাতেগোনা ৮/১০টি ফসলে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য দেয়। বাকি ফসলের ক্ষেত্রে কি হবে? কৃষক কি মরবে? কৃষিতে চাষীরা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসল উৎপাদনের দেড় গুণ দাম পাবে কিনা তা সরকারি কৃষি বিলে লেখা নেই, অথচ ২০১৪ সালে ইস্তাহারে একথা লিখেই বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল।
এখন কিছুটা চাপে পড়ে মােদি সরকার ননতম সহায়ক মূল্য চালু রাখার কথা ঘােষণা করলেও, বিলের কোথাও লেখা নেই কর্পোরেট সংস্থা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চাইতে কম দামে চাষীদের কাছ থেকে ফসল কিনতে পারবে না। বলা নেই যারা সহায়ক মূল্যের চাইতে কম দামে চাষীদের থেকে ফসল কিনবে তাদের শাস্তি হবে। বরং উল্টো বলা আছে। কেউ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে বাড়াতে পারবেনা। যেমন ধানে কেন্দ্রীয় সরকারের নমুনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ১৮৫০ টাকা। কেরলে তা কুইন্টাল পিছু ২৭৫০ টাকা। কেন্দ্রের চেয়ে ৯০০ টাকা বেশি। নতুন আইন অনুযায়ী কেরল সরকার কৃষককে এই বাড়তি নমূনতম সহায়ক মূল্য দিতে পারবে না। কৃষককে ফসলের দামের জন্য অনিশ্চিত খােলা বাজারেই অসম প্রতিযােগিতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত
এই বিলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে কৃষি রাজ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। রাজ্যের ভেতরের ব্যবসা-বাণিজ্যও রাজ্য এক্তিয়ারভুক্ত। অথচ রাজ্যগুলিকে অন্ধকারে রেখে এই আইন তৈরী করা হলাে। এখন যে কোনও রাজ্যের ভিতরে যে কেউ ঢুকে পরতে পারবে। কৃষিপণ্য কিনতে রাজ্যের কোন অনুমােদন লাগবে না। রাজ্যেগুলির কৃষি বাজার সংক্রান্ত আইন রয়েছে। তা আর এইসব বহুজাতিক কোম্পানি বা ফড়ে দালালদের মানতে হবে না। এই আইন দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে এবং রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের উপর আক্রমণ। কৃষিক্ষেত্র ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিলের রাজ্য তালিকার একটি অংশ এবং কৃষিতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল রাজ্য সরকারগুলােরই রয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাজ্যগুলােকে অগ্রাহ্য করে কর্পোরেট সংস্থাগুলােকে লাগামহীন ছাড় দিতে চাইছে।
নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য
এই আইনের মাধ্যমে ‘অবাধ পণ্য চলাচলের নামে রাজ্যগুলাের বিপ” ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হবে। লাইসেন্সের কোন বালাই থাকবে না। চুড়ান্ত নৈরাজ্যের মধ্যে কৃষিজাত পণ্যের বাজার ও বিপনন ব্যবস্থা প্রবেশ করবে। এমনকি কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য রপ্তানিতেও আর কোনো বিধি নিষেধ থাকবে না। অর্থাৎ দেশের জনগণের সামনে দিয়ে চিনি রপ্তানি হবে অন্য দেশে বেশি দামের জন্য, অথচ দেশের মানুষ চিনি পাবে না। রাজ্য তার রাজস্ব হারাবে। রাজ্যগুলাের অর্থনীতি আরো ভেঙে পড়বে। তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি। বিজেপি এটাই চায়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ।
আরও একটা ধাপ্পাবাজি
ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১৫ শতাংশ আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে। ১৩০ কোটি মানুষের দেশের অর্ধেক কাজ কৃষিতে। আমাদের দেশের কৃষকের সমস্যা ছােট জমি, কম উৎপাদনশীলতা, খাদ্য মজুত করার পরিকাঠামাের অভাব, প্রচুর ঋণে ডুবে থাকা। সেই দেশে সরকার বলছে – নতুন কৃষি আইনে নাকি বিনিয়ােগকারীরা আসবে, প্রযুক্তি আসবে, ফলে উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু তাতে চাষি এবং সাধারন মানুষের কি লাভ হবে তা বলা হয়নি। নােট বন্দি, জিএসটি বা যে কোন অর্থনৈতিক পদক্ষেপে মােদির ধাপ্পাবাজি স্পষ্ট হয়েছে বিগত ৬ বছরে।
প্রথমে জমি অধিগ্রহণ আইনে কৃষকের জমির সত্ব বা অধিকারের ওপর আঘাত এনেছে। ডিজেল শুধু ভর্তুকিহীন করেনি, তার দাম থেকে দ্বিগুন কর আদায় করে সরকারি কোষাগার ভরিয়েছে। তারপর বিদ্যুৎ (সংশােধনী) বিল ২০২০। চড়া দামে বিদ্যুৎ কেনার সরকারি নতুন পদ্ধতিতে কৃষক ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি হাঁটাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন শ্রম নীতি সংস্কার আইন। ৭৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। সাধারণের প্রতি রাষ্ট্রের ভূমিকা পৰ্বায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মার্চ মাসে ফোর্বসের বিলিওনারদের তালিকায় ভারতের ১১২ জন। করােনার সময় এর ৫ মাসে আরো ১৫ জুন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আম্বানীর সম্পদ এই সময় ৭৩% বেড়ে ৬,৮ লক্ষ কোটি টাকা এবং আদানি সম্পদ ৪৮% বেড়ে ১,৪০ ভাগ কোটি টাকা হয়েছে। মােদি সরকারের নীতি, ধনীকে মহাধনী করে তাতে গরীব আরও গরীব হলে কোনও আপত্তি নেই। সেই নীতিতেই দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির লুটের নতুন মৃগয়াক্ষেত্র হতে চলেছে ভারতের কৃষি। করােনার প্রকোপে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য সব লাটে উঠেছে। পড়ে রয়েছে কৃষিক্ষেত্র। তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে লগ্নী পুঁজি পরিচালিত কর্পোরেট কোম্পানি ও বড় জমির মালিকেরা। অথচ ভয়ঙ্কর নিম্নগামী জিডিপিকে স্থিতিশীল করার অন্যতম দাওয়াই হতে পারতাে কৃষিক্ষেত্র। কারণ কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষি বৃদ্ধির হার ধনাত্মক এই লকডাউনের বাজারেও। অথচ কৃষিতে কার্যত ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়ােগের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিতই আছে নতুন কৃষি আইনে। ধান্দার ধনতন্ত্রের এই সময়ের বড় নিদর্শন কৃষি বিল, শ্রম আইন সংস্কার বিল।
বাড়ছে প্রতিবাদ
তিনটি কৃষক বিরােধী আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা দেশজুড়েই ব্যাপক প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে। যদিও সরকার ও তার অনুগত সংবাদ মাধ্যম এই তিনটে আইনকে “কৃষক-দরদী” হিসাবে দাবি করছে। গােটা দেশ জুড়ে বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে তীব্র সংগ্রামের ফলে যে চাপ তৈরি হয়, তাতে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প মন্ত্রী শ্রীমতি হরস্রিাত কৌর বাদল “কৃষকবিরােধী আইন”-এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। এটা লক্ষণীয় যে বিজেপির অন্যতম পুরােনাে জোটসঙ্গী, যারা ২০১৪ সাল থেকে নােটবন্দী, ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, CAA/NPR/ NRC, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার সহ সমস্ত সিদ্ধান্তে মােদি সরকারের পাশে অবিচল ছিল, সেই শিরােমণি আকালি দল NDA ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সরকার তার নিকটতম রাজনৈতিক মিত্রদেরও তােয়াক্কা না করে বড় কর্পোরেট সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের লবিকে খুশি করতে ব্যস্ত।
কংগ্রেস পার্টি ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, “কংগ্রেস কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি আইন বাতিল করবে এবং কৃষি পণ্যের বাণিজ্য করবে রফতানি এবং আন্ত:রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাগুলিও তুলে দেবে।” কিন্তু আজ তারাও অবস্থান বদল করে বর্তমান প্রতিবাদের সমর্থনে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। কংগ্রেস সভানেত্রী শ্রীমতি সনিয়া গান্ধী কংগ্রেস পরিচালিত সবকটি রাজ্য সরকারকে এই নতুন কেন্দ্রীয় আইন যাতে রাজ্যগুলিতে প্রয়ােগ করতে না পারে, তার জন্য রাজ্যের নিজস্ব আইন প্রণয়ন করবার নির্দেশ দিয়েছেন।
এগুলি সিপিআই (এম) সহ অন্যান্য বামদলগুলির যে ধারাবাহিক আন্দোলনের এবং অবশ্যই সারা ভারত কৃষক সভার যে লাগাতার আন্দোলন তারই যথার্থতা প্রমাণ করে। যদি এই আইনগুলাে ‘কৃষকদরদী’ ই হয় যেমনটা শ্রী মােদি দাবি করেছেন তাহলে কেন কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের প্রতিটি আইন খুঁটিয়ে দেখার এবং তাদের প্রভাবগুলি বােঝার প্রয়ােজন। তৃণমূলের নয়া কৃষি আইনের বিরােধীতা করার কোনও অধিকার আছে? পার্লামেন্টে বিল পাসের দিনটিকে মমতা বন্দোপাধ্যায় “ব্ল্যাক সানডে” বললেও, ২০১৪ সালে আইন পাশ করে মাঠে ফসল কেনবার অধিকার বেসরকারি সংস্থাগুলােকে দিয়েছে তারই সরকার। এই আইনে যে কোনাে ব্যক্তি, কোম্পানী, সংস্থা, কো-অপারেটিভ সােসাইটি, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অথবা এজেন্সি-কে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছে (Sec-2, Clause-3 CA, CB)। এই আইনেই ‘কমিশন এজেন্ট’ নিয়ােগের অধিকারও দেওয়া হয়েছে ক্রেতাকে (Sec-2, Clause-4D)। অর্থাৎ দালালি ব্যবস্থাকে বৈধ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই আইনে। এমনকি সরাসরি বিদেশে রপ্তানি এবং বিদেশ থেকে আমদানি করার অধিকারও দেওয়া হয়েছে ২০১৪-র তৃণমূল সরকারের এই আইনে। এই আইন অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি বা কোম্পানী নিজে বাজার তৈরি করার লাইসেন্সও পেতে পারে। অর্থাৎ বৃহৎ কোম্পানী অথবা তার নিযুক্ত দালাল কেবলমাত্র কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছেমত দামে ফসল কিনতে পারবে তাই নয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ক্রমশ সমগ্র কৃষি বাজারকে নিয়ে আসার অধিকারও এই আইনে পেয়েছে।
এই আইনে কোথাও বলা হয়নি সরকার নির্ধারিত সহায়তা মূল্যের চাইতে কম মূল্যে কোন কোম্পানী বা ব্যক্তি চাষীর কাছ থেকে ফসল কিনতে পারবে না। অর্থাৎ বৃহৎ কোম্পানী অথবা তাদের নিযুক্ত দালালদেরই হাতে কৃষকের ফসলের দাম নির্ধারণ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কৃষক তার ফসলের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। যেমন আলু চাষী ৬/৬.৫০টাকা প্রতি কেজি দরে আলু বিক্রি করছে পেপসিকো কোম্পানীকে অথচ বাজারে আলুর দাম বর্তমানে ৩৫টাকা কেজি প্রতি।
খােলা বাজারের এই নীতির ফলে আলুর দাম কিন্তু চাষী নির্ধারণ করছে না, নির্ধারণ করছে বহুজাতিক কর্পোরেট অথবা দালালরা। একইভাবে দালালরা চাষীর কাছ থেকে ঐ দামে আলু কিনে হিমঘরে মজুত রেখে ৩৫টাকা কিলাে দরে বিক্রি করছে। অর্থাৎ কৃষকের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা এবং উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার স্বাধীনতা থাকবে বলে যে দাবী। নরেন্দ্র মােদী বা মমতা বন্দোপাধ্যায় করছেন, তা সর্বৈব অসত্য।
অবাধ দালাল রাজকে বৈধতা দিয়েছে তৃণমূল সরকার The West Bengal Agricultural Produce Marketing (Regulation) (Amendment) Act. XXVII 2014 (২০১৪ সালে বিধানসভায় পাশ করা আইন, ২১শে জানুয়ারী, ২০১৫ সালে গেজেট নােটিফিকেশন হয়) আইনের মাধ্যমে। ২০০৩ সালে তৎকালীন এন.ডি.এ. সরকার (যেখানে শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় মন্ত্রী ছিলেন) দেশের সব রাজ্য সরকারগুলির কাছে কৃষি সংক্রান্ত একটি মডেল আইন তৈরি করে পাঠিয়েছিল। তখনও বিজেপি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের কৃষি বিপনণ ব্যবস্থা দেশী-বিদেশী বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানীগুলির হাতে তুলে দেওয়া। ক্ষমতায় এসে এই আইন তৈরি করে বিজেপির সেই ইচ্ছা ২০১৪ সালে শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় কার্যকর করেন।
২০১৭ সালের ৩১শে মার্চ তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার আর একটি আইন কার্যকরী করে – The West Bengal Agricultural Produce Marketing (Regulation) (Amendment) Act, XVI 20171 93 STRET কৃষি পণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য ও বিক্রি বৈধ ঘােষণা করেছে রাজ্য সরকার। ১৯৭২ সালে APMC (Agricultural Produce Marketing Coimittee) আইন তৈরী করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কিন্তু এই আইনকে তারা কার্যকরী করেনি। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে এই আইন কার্যকর করে। APMC আইন মূলত তৈরী করা হয়েছিল কৃষিজাত পণ্যের বিপণ দালাল রাজের অপসারণ এবং কৃষকদের ফসলের উপযুক্ত দাম পাওয়ার ব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে। আমাদের রাজ্যেও নিয়তি বাজার ব্যবস্থা তৈরী করেছিল আমন্ট। যেহেতু এই বাজার সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং কৃষকদের অংশগ্রহণে পরিচালিত হতো, তাই একদিকে দালালদের দূরে রাখা সম্ভব হতাে এবং অপরদিকে কুষ ন্যায্য মূল্য পেতে পারত। আবার একই সাথে অন্য যে কোন বাজারে চাইলে কৃষক ফসল বিক্রি করতে পারত। একই সাথে বামফন্টের আমলে গড়ে ওঠে কয়েক হাজার কৃষি সমবায় সংস্থা গড়ে উঠেছিলো, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় কৃষকরাই। এরা কৃষকের কাছ থেকে ধাণ কিনে নিতা এবং সরকারের কাছে সরাসরি বিক্রি করত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারী সহায়তা মূল্য পেতে কৃষকদের সাহায্য করত। ক্ষমতায় এসে শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় কৃষি সমবায়গুলিসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারী অধ্যাদেশ মারফত বাতিল করেন। এর ফলে সমগ্র বাজার চলে যায় কিছু অর্থবান ক্ষমতাশালী দালালদের নিয়ন্ত্রণে। এরপর APMC আইনের পরিবর্তন করে রাজ্যের কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণনকে সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করলেন তিনি। এটা তিনি করেছিলেন কেন্দ্রের পাঠানাে ২০১৭ সালে মডেল আইন অনুসারে। এভাবেই রাজ্যে ঘুরপথে কৃষিপণ্য বিপনণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে দালাল ও বৃহৎ কোম্পানীর হাতে অনেক আগেই তুলে দিয়েছিলেন শ্রীমতি বন্দোপাধ্যায়।
এমনকি এই দুটি আইনের মাধ্যমে ঘুরপথে চুক্তি চাষের অনুমােদনও। দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার ধানের সংগ্রহ মূল্য ঠিক করে দেয়। শুনে মনে হয় কৃষকের ঠকে যাওয়ার দিন বােধহয় শেষ হয়ে গেছে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বুজে থাকে। ফলে রাজ্যে কেউই তা মানে না। ফড়েদের কাছে চোখের জলে জলের দামে বিকিয়ে দিতে হচ্ছে রক্তে ঘামে সৃষ্টি করা ফসল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় পাওয়া চাষির সরকারি (বাজনার চেয়ে পাওনা কম) ক্ষতিপূরণ চলে যাচ্ছে জমির মালিকের কাছে, ভাগ চাষী অর্থাৎ যারা প্রকৃত চাষ করছে সে কোনও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না।
রাজ্য সরকার সবসময়েই প্রচারের আলােয় থাকতে চায়। কিন্তু এখন রাজ্য সরকারকে পরিষ্কার বলতে হবে এবং বিধানসভায় আনতে হবে কেন্দ্রের কৃষি আইন বিরােধী প্রস্তাব। মমতা বন্দোপাধ্যায় কিন্তু এ রাজ্যে জমি চোর, মহাজন, ফড়েদের সুবিধার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধি আগে থেকেই করে দিয়েছেন। এমনকি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনও রাজ্যে ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়েছে। ফলে আলুচাষীর কাছ থেকে ৬/৬.৫০ টাকায় আলু কিনে হিমঘরে মজুত রেখে ফড়ে-দালাল বাজারে ৩৫টাকা কেজি বিক্রী করছে। রাজ্য সরকার নীরব দর্শক। কেন্দ্রের ঘােষিত কৃষি নীতির অনেক কিছুই অনেক আগেই অঘােষিতভাবে শুরু করে দিয়েছে। – তৃণমূল সরকার। তাই সেইজন্যে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরােধীতা এবং বামেদের লড়াই এক নয়। প্রথমটি ভােটের তাগিদে, দ্বিতীয়টি গরীব সাধারন মানুষের স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের বহতা ধারা।
আমাদের দাবী
অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে সমগ্র কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনগণের আয়ের বিশাল ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষের রােজগারের সহায়তা, ঋণ মকুব, খাদ্যশস্য সরবরাহ, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য সুবিধাদির বিষয়ে নজর না দিয়ে সরকার কেবল কর্পোরেটদের সীমাহীন ছাড় ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এই নীতির পরিবর্তন করতে হবে।
- কর্পোরেট লুটকে সুবিধা করে দেওয়া এবং বিদেশী বিনিয়োেগর ওপরে নির্ভর করার পরিবর্তে সরকারকে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সমবায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমবায় চাষ নিশ্চিত করতে হবে।
- শস্য সংগ্রহের নিশ্চয়তা সহ পারিশ্রমিক বাবদ সি২+৫০% হিসাবে সমস্ত ফসলের জন্য নমূনতম সহায়ক মূল্য দিতে হবে। ন্যনতম ৬০০টাকা/দিন হিসাবে সমস্ত ক্ষেতমজুরকে মজুরি দিতে হবে।
- বর্তমানে রােজগারবিহীন সব মানুষকে ৭,৫০০টাকা/মাস হিসাবে রােজগার সহায়তা প্রদান করতে হবে। মনরেগার আওতায় ৩০০টাকা/দিন হিসাবে কর্মহীনদের মজুরি দিতে হবে।
- পিএম-কিষাণ যােজনার টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে বছরে ১৮,০০০টাকা করতে হবে এবং এর আওতায় ভাগচাষীদের নিয়ে আসতে হবে। ভূমিহীন ভাগচাষী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সম্পূর্ণ ঋণ মকুব করতে হবে।
- খাদ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সব শ্রমজীবী মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
নতুন শ্রম আইন কোড ২০১৯-২০ কি ও কেন
আমাদের দেশে এতদিন পর্যন্ত শিল্প শ্রমিকদের নিয়ে ৩টে আইন ছিল।
- ১) দ্য ট্রেড ইউনিয়ন এ্যাক্ট ১৯২৬।
- ২) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার)এ্যাক্ট, ১৯৪৬।
- ৩) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট এ্যাক্ট ১৯৪৭।
এই ৩টি আইন পাল্টে এখন এর পরিবর্তে শ্রম আইন সংক্রান্ত ৩টি কোড তৈরি করল নরেন্দ্র মােদির সরকার ২০২০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর। এছাড়াও ২০১৯ সালে আলাদা একটি মজুরি সংক্রান্ত কোড আইন পাশ করা হয়েছিলাে। বর্তমানে ৩টি শ্রম আইন কোড হলাে –
- ১) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড-২০২০
- ২) দ্য অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ এ্যন্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড ২০২০
- ৩) দ্য সােশ্যাল সিকিউরিটি কোড-২০২০
২৬শে সেপ্টেম্বর বিরােধীশূন্য লােকসভা ও রাজ্যসভায় প্রায় বিনা বিতর্কে পাশ করালাে এই ৩টে আইন বিজেপি সরকার। এর আগে ২০১৯ সালের ৮ই আগষ্ট মজুরি সংক্রান্ত অতীতের ৪টে আইন একত্রিভূত করে মজুরি সংক্রান্ত কোড বিজেপি সরকার পাশ করিয়েছিল।
এত তাড়াহুড়াে কেন? দেশের প্রায় সব জাতীয় স্তরের ট্রেড ইউনিয়নগুলাের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেন বিনা বিতর্কে এই আইন তৈরি করা হলাে?
এটা ঠিক ৯৪ বছর আগে তৈরি আইন যুগপােযােগী করা দরকার। স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতার সমসাময়িক সময়ের আইনেও পরিবর্তিত পিরস্থিতির উপযােগী পরিবর্তন আনা দরকার। এই জন্যই ২০০২ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় জাতীয় লেবার কমিশনের সুপারিশ ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মজুরি, শ্রম, শ্রমবিরােধ ও শিল্পবিরােধ বিষয়ক আইনগুলাে এক জায়গায় সুসংবদ্ধভাবে যুগােপযােগী করে তােলা দরকার শ্রমিকের স্বার্থকে আরও সুরক্ষিত করার জন্য।
প্রশ্ন সেই কাজ কি এই ৪টি নতুন শ্রম কোড-র মাধ্যমে করা হলো? শ্রমিকদের স্বার্থ কি সুরক্ষিত থাকলাে?
মজুরি সংক্রান্ত কোড ২০১৯ কি?
আমাদের দেশে মজুরি সংক্রান্ত ৪টে আইন ছিল।
- ১) দ্য পেমেন্ট অন ওয়েজেস এ্যাক্ট ১৯৩৬।
- ২) দ্য মিনিমাম ওয়েজ এ্যাক্ট ১৯৪৮।
- ৩) দ্য পেমেন্ট অফ বােনাস এ্যাক্ট ১৯৬৫।
- ৪) দ্য ইকুয়্যাল রেমিউনারেশন এ্যাক্ট ১৯৭৬।
এই ৪টে আইনকে বাতিল করে ২০১৯ সালের ৮ই আগষ্ট আনা হ’লাে কোড অন ওয়েজেস ২০১৯। এই আইন অনুযায়ী এখন দেশের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, পেনশন, সাধারণ মজুরি ইত্যাদি নির্ধারিত হচ্ছে। আমাদের দেশে ৪৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন, যার ৪৯শতাংশই মজুরির ওপর নির্ভরশীল। নতুন ন্যূনতম মজুরি আইন এই আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার একটি সাধারণ গড় মজুরি সমগ্র দেশের জন্য নির্ধারণ করবে এবং বিভিন্ন রাজ্যে কয়েকটি অর্থনৈতিক মাপকাঠির উপর এই মজুরির পরিমাণ কিছুটা হেরফের হতে পারে। কিভাবে এই সাধারন গড় মজুরি নির্ধারিত হবে তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম বা ভিত্তির কথা এই আইনে উল্লিখিত নেই। যেমন এই নতুন ওয়েজ কোড অনুযায়ী দেশের গড় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ১৭৮ টাকা মাত্র, পূর্বের চাইতে যা মাত্র ২টাকা বেশি। কিভাবে এই ১৭৮ টাকা মজুরি নির্ধারিত হলাে, তার কোন ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক দেয়নি। একইভাবে রাজ্য সরকারগুলিও কোনও ভিত্তি ছাড়াই কার্যত একতরফাভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ ১৯৪৮ সালে তৈরি আইনে বলা হয়েছিল ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার মতাে মজুরি নয় বরং একজন শ্রমিক যাতে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে অর্থাৎ তার সামাজিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব যে মজুরিতে, তার ভিত্তিতেই ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে হবে। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও যাতে তিনি জীবনধারণের জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
১৯৫৭ সালে ১৫তম শ্রম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ৪টি বিষয়কে গণনার মধ্যে রাখতে হবে। (ক) খাদ্য, (খ) বস্ত্র, (গ) বাসস্থান, (ঘ) অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় খরচ বাবদ ৩জনের পরিবার চালাতে যা খরচ হয় তার ভিত্তিতে স্থির করতে হবে ন্যূনতম মজুরি।
১৯৮২ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে নির্দেশ দেয় যে শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উৎসবকালীন বিনােদনের খরচও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণ্য করতে হবে। ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘রাপ্টাকোস ব্রেট মামলায় স্পষ্ট নির্দেশ দেয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে – (ক) সমগ্র পরিবারের পুষ্টি, (খ) বস্ত্র, (গ) জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ, (গ) শিক্ষা, (ঘ) চিকিৎসা, (ঙ) বৃদ্ধ বয়সে জীবনযাপনের খরচ, এই ৫টি বিষয়কে গণনার মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে। একজন শ্রমিক কতটা দক্ষ বা অদক্ষ তার উপর ন্যূনতম মজুরি নির্ভর করবে না।
নতুন মজুরি সংক্রান্ত কোড ২০১৯-এ এই সমস্ত বিষয়গুলি গণনার মধ্যে রাখার কথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে প্রশাসক বা আমলারা তাদের ইচ্ছেমত ন্যূনতম মজুরি ঠিক করবে, উপরিউক্ত ৫টি বিষয় গণনার মধ্যে রাখার প্রয়ােজন নেই। যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করেছিল গড় জাতিয় ন্যূনতম মজুরি ৩৭৫ টাকা প্রতিদিন নির্ধারণ করার। এক্ষেত্রে ১৯৪৮সালের আইন, ১৯৮২ এবং ১৯৯৭ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং শ্রম সম্মেলনে গৃহীত নীতিগুলিকেই ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু শিল্পপতিদের খুশি করবার জন্য বিজেপির সরকার ন্যূনতম মানবিক এবং আইনগত ভিত্তিকে অস্বীকার করে মাত্র ১৭৮ টাকা প্রতিদিন মজুরি ঘােষণা করেছে।
দ্বিতীয়ত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে জাতীয় ন্যূনতম গড় মজুরির কমে মজুরি নির্ধারণ করবার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিল্পপতিদের আকৃষ্ট করবার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি কমানাের প্রবল প্রতিযােগিতা শুরু হবে। এই ঘটনা দিল্লীর ওখলা থেকে হরিয়াণা এবং উত্তরপ্রদেশে শিল্প তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। যেহেতু দিল্লীর চাইতে হরিয়াণা এবং উত্তরপ্রদেশের মজুরি কম তাই শিল্পপতিরা সেখানে চলে গেছে। নতুন এই মজুরি কোড দেশে অবাধ শ্রমিক শােষণের রাস্তাকেই পরিষ্কার করেছে।
তৃতীয়ত আগের আইনে শিল্প ভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি ঘােষণা করা হতাে। নতুন কোড অনুযায়ী এটা তুলে দিয়ে গড় ‘সময় ভিত্তিক এবং উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল হবে ন্যনতম মজুরি। একই ধরণের শিল্পের আলাদা আলাদা কারখানায় ইচ্ছেমত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে। সিডিউল শ্রমিক অর্থাৎ আইনে উল্লিখিত শিল্প শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ যে সব কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন শক্তিশালী নয় অথবা ট্রেড ইউনিয়ন নেই সেখানে ন্যূনতম মজুরি দক্ষ, অদক্ষ, অদক্ষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতাে নির্ধারিত হবে।
চতুর্থত ন্যূনতম মজুরি পরিদর্শকের অধিকার ঘেঁটে তাকে কার্যত ন্যূনতম মজুরি উপদেষ্টা (Facilitator) বানানাে হয়েছে। অতীতের আইনে কোন শিল্প মালিক ন্যূনতম মজুরি না দিলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযােগ ছিল। নতুন কোডে এটিকে দেওয়ানি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এইভাবে শ্রমিকদের অধিকার এবং শিল্পমালিকদের অপরাধকে লঘু করা হলাে। এর ফলে ন্যূনতম মজুরি না দিলে কার্যত শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়ার সুযােগ রাখা হলাে না। এই নতুন কোডে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে কোন অভিযােগ থাকলে আদালতে যাওয়ার রাস্তাও কার্যত বন্ধ করা হয়েছে। কেবলমাত্র একটি আধা-বিচার (Quasi-Judicial) ব্যবস্থার কাছে শ্রমিকরা আবেদন করতে পারবে, যেটি কার্যত আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
পঞ্চমত নতুন মজুরি কোড অনুযায়ী যেখানে ২০-র বেশি শ্রমিক আছে, সেখানেই এই আইন প্রযােজ্য হবে। এর ফলে বিশেষত ইনফরমাল সেক্টরে নিযুক্ত অসংখ্য শ্রমিক এই মজুরি আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। নিজেদের বাড়ীতে বসে যারা বিভিন্ন শিল্পের হয়ে কাজ করে তারা। কেউ এই আইনের আওতাভুক্ত থাকছে না। আজকে এই অস্থির।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়য়ি বেশিরভাগ শ্রমিকই ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করছে। এরা কেউ মজুরির বিষয়ে কোন আইনগত নিরাপত্তা পারে না। শিল্প মালিক পক্ষ এই সুযোগকে ব্যবহার করে কোন মধ্যস্থতাকারী কনট্রাক্টর নিয়ােগ করে বাড়ী বাড়ী উৎপাদন ব্যবস্থাকে চড়িয়ে দিয়ে সব শ্রমিককে এই মজুরি আইনের নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করবে। জুতাে তৈরি থেকে আই.টি. শিল্প সব জায়গাতে শ্রমিকের মজুরি নিরাপত্তা এই নতুন আইনে শিকেয় উঠবে।
দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড ২০২০ (IR Code-2020)
অতীতের ৩টি আইন ১) দ্য ট্রেড ইউনিয়ন এ্যাক্ট ১৯২৬, ২) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) এ্যাক্ট, ১৯৪৬, ৩) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট এ্যাক্ট ১৯৪৭ এখন একসাথে মিলে নতুন IR Code-2020 তৈরি হয়েছে।
প্রথমত এই নতুন আইন অনুযায়ী যেসব শ্রমিক ১৮ হাজার টাকার উপর বেতন পান তাদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এরা কেউ আর আইনের রক্ষা কবচ পাবেন না।
দ্বিতীয়ত এই নতুন আইনে সময় ভিত্তিক (Fixed Term) শ্রমিক নিয়ােগকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মালিক পক্ষ এখন থেকে কাউকে স্থায়ী নিয়ােগপত্র না দিয়ে ১ বছরের জন্য নিয়ােগ করতে পারবে। ফলে যে কোন শিল্প কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী শ্রমিকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সময় ভিত্তিক নিয়ােগপত্র থাকার কারণে কোন শ্রমিক আর মালিক পক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস দেখাবে না, যদি তার চাকরি পুর্নবীকরণ না হয় এই ভয়ে। যদিও এই আইনে বলা আছে। স্থায়ী শ্রমিকদের মতই মজুরী এবং অন্যান্য আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে এই সময় ভিত্তিক শ্রমিকদের, কিন্তু বাস্তবে তা কখনই হবে না।
এমনকি সরকারী সংস্থা ONGC তেও এই ধরণের সময় ভিত্তিক আমকরা স্থায়ী শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরী পায়। এই আইন অনুযায়ী দেশে স্থায়ী শ্রমিক ব্যবস্থা কার্যত উঠে যাবে এবং শ্রমিকদের মজুর-কাজের নিরাপত্তা আর থাকবে না। মালিক পক্ষের হাতে মজুরি *মানাের ক্ষমতা এবং ইচ্ছেমত সময় ভিত্তিক শ্রমিক নিয়ােগের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য তারা শ্রমিকের মজুরি ব্যাপক হারে কমিয়ে নিজেদের মুনাফা আরাে বাড়াতে পারবে।
তৃতীয়ত এই নতুন কোডের চতুর্থ এবং দশম অধ্যায়ে বলা হয়েছে। ৩০০-র কম সংখ্যক শ্রমিক আছে এমন সংস্থায় মালিকরা ইচ্ছেমত লে-অফ, ছাঁটাই এবং সংস্থা বন্ধ করে দিতে পারবে। অতীতের আইনে এই সংখ্যা ১০০ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলাে এবং লে-অফ, ছাঁটাই অথবা সংস্থা বন্ধ করতে গেলে সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হতাে, বর্তমান আইনে মালিক পক্ষকে এইসব ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোনাে অনুমতি নিতে হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দেশের ৭০% শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সংখ্যা ৩০০-র কম। এই ধরণের প্রতিষ্ঠানেই দেশের ৭৪% শ্রমিক কাজ করে। হায়ার এন্ড ফায়ার এই ব্যবস্থাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে শ্রমিকদের ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলাে বিজেপির সরকার। এই শ্রমিকদের কাজের সুরক্ষা, মজুরি সুরক্ষা কিছুই আর অবশিষ্ট থাকলাে না।
চতুর্থত এই নতুন কোডের ৬২নং এবং ৮৬ নং অধ্যায়ের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার, ধর্মঘটের অধিকারকে কার্যত আস্তাকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র জনস্বার্থে ব্যবহৃত জরুরী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি ছাড়া সর্বত্র শ্রমিকদের এই অধিকার ছিল। নতুন আইনে বলা হয়েছে কোথাও ধর্মঘট করতে হলে ৬০ দিন আগে নােটিশ দিতে হবে। নােটিশ দেওয়ার ১৪ দিনের আগে কোন ধর্মঘটে যাওয়া যাবে না। কিন্তু শ্রমিক-মালিক পক্ষের মধ্যে আলােচনা চলাকালিন কোন ধর্মঘট করা যাবে না। এমনকি আলােচনা শেষ হওয়ার ৭দিনের মধ্যেও কোন ধর্মঘট করা যাবে না। যে কোন শিল্প বিরােধ ট্রাইব্যুনালে মামলা থাকাকালীন কোন ধর্মঘট করা যাবে না। মামলার নিষ্পত্তির ৬০ দিনের মধ্যেও কোন ধর্মঘট করা যাবে না। যদি শ্রমিক এই আইন ভাঙে তাহলে তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ আর্থিক জরিমানা এবং কারাবাসের শাস্তি প্রযােজ্য হবে।
অর্থাৎ এককথায় মালিক পক্ষ যা ইচ্ছে করুক শ্রমিক ধর্মঘট করতে পারবে না। অপরদিকে মালিক পক্ষ লক-আউট ঘােষণার ক্ষেত্রে অনেকরকমের ছাড় পাবে এই নতুন আইনে। শ্রমিক ধর্মঘট করলে মালিক পক্ষ বিনা নােটিশে লক আউট ঘােষণা করতে পারবে। কারুর অনুমতি গ্রহণ করতে হবে না। মালিকপক্ষ যে দিন লক-ডাউন ঘােষণা হতে চায় সেদিনই ঘােষণা করতে পারবে। এককথায় মালিকের যথেচ্ছারের অবাধ অনুমতি দেওয়া হয়েছে এই আইনে।
পঞ্চমত নতুন কোডের চতুর্দশ অধ্যায়ে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করার আইনি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে একের অধিক ইউনিয়ন আছে সেখানে মালিকপক্ষ কেবলমাত্র যে ইউনিয়নের ৫১% শ্রমিকের সমর্থন আছে কেবল তাদের সাথেই আলােচনা করবে। কোন ইউনিয়নের প্রতি ৫১% শ্রমিকের সমর্থন আছে তা যাচাই করবার জন্য গােপন ব্যালটে ভােট গ্রহণের আইনকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বলা হয়েছে সরকার এই বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আরও বলা হয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকর্তাদের সর্বনিম্ন ৫০% কর্মরত শ্রমিক রাখা বাধ্যতামূলক হলেও সংগঠিত ক্ষেত্রের ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকর্তাদের ১/৩ ভাগ অথবা সংখ্যায় ৫ (যেটা সর্বনিম্ন হবে) এর বেশি সংস্থার বাইরের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী থাকতে পারবে না। সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যই এই ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
ষষ্ঠত এই নতুন শ্রম কোড এমনভাবে সাজানাে হয়েছে যাতে সংসদীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ লােকসভা – রাজ্যসভা অথবা রাজ্য বিধানসভাকে এড়িয়ে যে কোন সময় সরকার তার ইচ্ছেমত IR Code-2020 বদল করতে পারে। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের বদলে সরকারী আমলারা আইন ইচ্ছেমত পাল্টাবে বা তৈরী করবে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
সপ্তমত ১৯৪৭ সালের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট আইনে পঞ্চম অনুচ্ছেদটি বতমনি আইনে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী শ্রমিক-মালিক বিরােধের মীমাংসা না হলে সরকারী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রাইব্যুনালে পাঠাত। এর ফলে দুর্বল শ্রমিক সংগঠন আছে এমন সংস্থার নামকরাও সরকারী সহযােগিতা পেত। কিন্তু বর্তমান আইনে এই ব্যবস্থা রাখা হয় নি। বর্তমান আইনে বলা হয়েছে শ্রমিক অথবা মালিক পক্ষকে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে, যা অনেক শিল্প ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। এর ফলে ছাঁটাই সহ অন্যান্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের লড়াই এর সুযােগ অনেক কমে যাবে।
দ্য অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ এ্যন্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড
প্রথমত এই নতুন আইনের ২৭নং ধারায় অতিরিক্ত সময় কাজের (Overtime Work) উৰ্দ্ধসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে সরকার নির্ধারণ করবে Overtime Work-এর সময়সীমা। এর ফলে শ্রমিকদের কাছে অতিরিক্ত সময়ের কাজ আর ঐচ্ছিক থাকবে না, কার্যত বাধ্যতামুলক হবে এই কাজ। ৮ ঘন্টা কাজের পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হলাে আমাদের দেশে।
দ্বিতীয়ত কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের প্রয়ােজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছে কিনা এই বিষয় যে নজরদারীর ব্যবস্থা ছিল তাকে কার্যত নখদন্তহীন করে দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে ১০ম অধ্যায়ের ৩৪-৪২নং ধারায়। পরিদর্শকদের ক্ষমতা খর্ব করে তাদের উপদেষ্টার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। বলা হয়েছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধির বিষয় সরকারী পাের্টালে তথ্য আপলােড করবে। সেখান থেকে কিছু সংস্থাকে বেছে নিয়ে সেখানে পরিদর্শনে যাবে ইনসপেক্টর। তবে পরিদর্শনে যাওয়ার আগে সরকার থেকে তাকে অনুমতি নিতে হবে। কোন শ্রমিক অথবা ট্রেড ইউনিয়ন যদি অভিযােগ জানায় তাহলেও কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে না অভিযােগের নিষ্পত্তি করতে অথবা পরিদর্শকও তার ভিত্তিতে কোন কারখানায় গিয়ে এই নিয়ে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে পারবে না অভিযােগের নিষ্পত্তি করতে।
তৃতীয়ত এই নতুন আইনে ১৯৭৯ সালে তৈরি আন্ত:রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত আইন (কর্মসংস্থান এবং পরিষেবার শর্তাদি) বাতিল করা হয়েছে। পূর্বতন আইনে ৩৬টি অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আন্ত:রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুবিধা বিষয় উল্লেখ করা ছিলাে। এই আইন বাতিল করে মাত্র আধ পাতায় দায়সারা ভাবে পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত কিছু কথা বলা হয়েছে। ১৯৭৯ সালের আইনে ৫জন পরিযায়ী শ্রমিককে নিয়ােগ করলেই নিয়ােগকর্তাকে ঐ আইন মেনে চলতে হতাে। বর্তমান কোডে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১০জন করা হয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের কর্তৃপক্ষ কোন কনট্রাক্টারের মাধ্যমে নিয়ােগ করে। এই কোডেই বলা হয়েছে যে কোন কনট্রাক্টর বিনা লাইসেন্সে ৫০জনের নীচে শ্রমিক নিয়ােগ করতে পারবে। এর অর্থ এমনকি নতুন কোডে উল্লিখিত নিরাপত্তাও পাবে না পরিযায়ী শমিকরা। অর্থাৎ ১০জন নয় ৪৯জন শ্রমিককে কোন আইনি সুযােগ না দিয়ে কন্ট্রাক্টর নিয়ােগ করতে পারবে।
চতুর্থত ১৯৭৯সালের আইনে বলা হয়েছিল কেবলমাত্র কন্ট্রাক্টর নয়, মূল নিয়ােগকারী সংস্থাকেও পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্ত আইন মেনে চলতে হবে। তাদের পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে এবং সরকারকে এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে হবে। এর মধ্য দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা অনেক নিরাপত্তা পেত। বর্তমান কোডে এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কন্ট্রাক্টর, মূল নিয়ােগ কর্তা অথবা সরকার কারাের আর কোন দায়িত্ব রইল না আন্ত:রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।
পঞ্চমত আমাদের দেশে ১৯৭০ সালে তৈরি কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন এন্ড অ্যাবােলিশন) আইন অনুযায়ী স্থায়ী এবং সারা বছরে কাজ হয় এইরকম কাজে কন্ট্রাক্ট লেবার নিয়ােগ করা যায় না। কিন্তু দুঃখের কথা বেসরকারী তাে বটেই সরকারী ক্ষেত্রেও এই আইন কোথও মানা হয়, বিশেষত উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে। নতুন কোডে এই আইনটাই তুলে দেওয়া হলাে। ফলে যত সংখ্যায় ইচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ি সারা বছরে কাজেও এখন কন্ট্রাক্ট লেবার নিয়ােগ করতে পারবে মালিক কর্তৃপক্ষ। আবার নতুন আইন অনুযায়ী ৫০ জনের নীচে শ্রমিক নিয়ােগ করার জন্য কন্ট্রাক্টারদের কোনও লাইসেন্স নিতে হবে না। ফলে এমনকি ১ হাজার জন শ্রমিক আছে এমন শিল্প প্রতিষ্ঠানেও ২১/২২ জন কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিয়ােগ করা যেতে পারে এবং এই নতুন আইন অনুযায়ী কোন শ্রমিকের জন্যই এমনকি নতুন আইনে বর্ণিত কোন সুরক্ষা বিধি না মানলেও শ্রমিক কিছুই করতে পারবে না। স্থায়ী শ্রমিকের কাজ করিয়ে নিতে পারবে মালিক কর্তৃপক্ষ কন্ট্রাক্ট লেবারদের কোন সুযােগসুবিধা না দিয়েই। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি চুরি করার অবাধ লাইসেন্স তুলে দিল মালিকদের হাতে বিজেপি সরকার এই আইনের মাধ্যমে।
ষষ্ঠত আমাদের দেশে বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রের জন্য ১৩টি বিভিন্ন আইনে শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। যেমন বাগিচা শ্রমিকদের জন্য আইন ১৯৫১, খনি শ্রমিকদের আইন ১৯৫২, কর্মরত সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র কর্মীদের পরিষেবা দান সংক্রান্ত আইন ১৯৫৫ ও ১৯৬১, পরিবহন শ্রমিকদের জন্য আইন ১৯৬১, বিড়ি-সিগারেট শ্রমিকদের পরিষেবা দান সংক্রান্ত আইন ১৯৬৬, সেলস প্রমােশন কর্মচারীদের পরিষেবাদান সংক্রান্ত আইন ১৯৭৬, সিনেমা ও থিয়েটার কর্মীদের পরিষেবা দান সংক্রান্ত আইন ১৯৮১, বন্দর শ্রমিকদের নিরাপত্তা – স্বাস্থ্য – কল্যাণ সংক্রান্ত আইন ১৯৮৬, নির্মান শ্রমিকদের কর্মসংস্থান এবং পরিবেশ ও পরিষেবা সংক্রান্ত আইন ১৯৯৬ ইত্যাদি। নতুন কোডে এই সবকটি আইনকে কার্যত বাতিল করা হয়েছে। নতুন আইনে প্রত্যাহৃত উপরিউক্ত আইনগুলিতে শ্রমিককর্মচারীদের সুরক্ষার যে ব্যবস্থাপনা ছিলাে কার্যত তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
সপ্তমত এই আইনের সবচাইতে বিপজ্জনক দিক, সরকার যে কোন প্রতিষ্ঠানকে এই নতুন কোড বা আইনের আওতার বাইরে রাখতে পারে। অর্থাৎ সরকার মনে করলে যে কোন মালিকপক্ষকে কোনও আইন না মেনেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাবার অধিকার দিতে পারে। এই আইনে সরকারকে অধিকার দেওয়া হয়েছে ইচ্ছেমত যখন খুশি প্রশাসনিক নির্দেশে এই আইনের যে কোন অংশকে পরিবর্তন এবং বাতিল করার। ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম সম্মেলন এদের মতামতের তােয়াক্কা করতে হবে না সরকারকে। এমনকি সংসদের অনুমােদন নেওয়ারও প্রয়ােজন থাকবে না।
দ্য সােশ্যাল সিকিউরিটি কোড
আমাদের দেশের পূর্বের শ্রম আইনগুলিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয় অনেকগুলি ধারা বিভিন্ন সময় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যুক্ত হয়েছিল অতীতের সমস্ত আইনগুলিকে বাতিল করে বর্তমানে দ্য সােশ্যাল সিকিউরিটি কোড ২০২০ নামক নতুন আইন তৈরি করা হয়েছে।
প্রথমত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আইন না মানলে মালিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যে আইনগুলি ছিল, সেগুলিকে লঘু করা হয়েছে। যেমন শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধা যা তাদের প্রাপ্য সেগুলি না দিলে ফৌজদারি আইনে মালিক কর্তৃপক্ষের জেল হতাে। বর্তমান আইনে শ্রম আইন ভঙ্গকারী মালিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে জেলযাত্রা রদ করা হয়েছে। আইন ভাঙলে এখন কেবলমাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিলেই ছাড় পেয়ে যাবে। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা মজুরি বাবদ শ্রমিকের প্রাপ্য মেরে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিলেই মালিক কর্তৃপক্ষ ছাড় পেয়ে যাবে। লঠের অবাধ ব্যবস্থা করেছে মােদি সরকার নতুন আইনে।
দ্বিতীয়ত মালিক কর্তৃপক্ষকে বাধ্যতামূলকভাবে (Statutory Dues) শ্রমিকদের কিছু অর্থ এবং সুবিধা দিতে হয়, যেমন পি.এফ, গ্র্যাচুইটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদি। বারে বারে এই আইনগুলি ভঙ্গ করলে তাদের ৫ বছরের জন্য জেলবন্দীর শাস্তি ছিলাে এটা কমিয়ে ৩ বছর করা হয়েছে। এমনিতেই বর্তমান আইন থাকা স্বত্ত্বেও এইসব কারণে মালিক কর্তৃপক্ষকে জেলে পাঠানাে হয়েছে এমন ঘটনা আমাদের দেশে বিরল। আমাদের রাজ্যে চটকল মালিকরা পি.এফ, ই.এস.আই, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি বাবাদ শ্রমিকদের প্রাপ্য কোটি কোটি টাকা জমা দেওয়া স্বত্ত্বেও কোন শাস্তি তাে পায়ই না বরং রাজ্যের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের সাথে তাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এই নতুন আইনের ফলে মালিক কর্তৃপক্ষ আরও বেপরােয়া হয়ে উঠবে নি:সন্দেহে।
তৃতীয়ত ৯টি সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন বাতিল করে নতুন সােশ্যাল সিকিউরিটি কোড ২০২০ রচনা করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৪তম বছরে আমাদের দেশে ৪৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মাত্র ৯.৩% শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এই অসংগঠিত শ্রমিককর্মচারীদের ৯০.৭%ই সামাজিক সুরক্ষা পান না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি দাবী করেন তাঁর নেতৃত্বে ভারতবর্ষ নাকি পৃথিবীর উন্নতম ২০টি দেশের অন্যতম একটি দেশ হয়েছে। জি-২০ দেশগুলির অন্যতম ঘােষণা অসংগঠিত শ্রমিকদের ১০০%কেই সামাজিক সুরক্ষা বিধির আওতায় আনা হবে। ভারতবর্ষের নতুন সামাজিক সুরক্ষা কোডে এর কোন উল্লেখ এনই। অর্থাৎ সবাইকে সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করার কোন লক্ষ্য গরেন্দ্র মােদির নেই, কিন্তু বিলিয়নারের সংখ্যা তার আমলে বেড়েই চলেছে।
চতুর্থত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য গঠিত বিভিন্ন লগুলির অর্থ শ্রমিকদের কাছে পৌছাচ্ছে না বরং তা সরকারের হাতেই জমা পড়ে থাকছে। শ্রমিকদের প্রাপ্য এই অর্থ যাতে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের হাতে সরকার তুলে দেয়, তার জন্য কোন আইন করার কথাও এখানে বলা হয়নি।
পঞ্চমত ২০০৪ সালে জাতিয় পেনশন স্কিম ঘােষণার সময় বলা হয়েছিল সব অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য জাতিয় পেনশন স্কিম চালু করা হবে। এই লক্ষ্যে ২০০৮ সালে রচিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য জাতিয় পেনশন স্কিম গঠিত হলেও তা বিশেষ কার্যকরী হয়নি। নতুন সামাজিক সুরক্ষা কোডেও একে কার্যকরী করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের কোনও উল্লেখও নেই।
মােদি সরকারের শ্রম আইন সংশােধন করার মূল উদ্দেশ্য লগ্নীপুঁজির মুনাফা বাড়ানাের জন্য শ্রমিকের মজুরি কমাতে হবে। জিনিসের দাম বাড়বে কিন্তু মজুরি বাড়বে না উল্টে প্রকৃতপক্ষে কমবে এই নতুন শ্রমিক বিরােধী ৪টি নতুন শ্রম কোড বা শ্রম আইনে।
আমাদের দাবী
- এই ৪টি শ্রম আইনকেই বাতিল করতে হবে।
- দেশের ৪৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণের খরচের ভিত্তিতে তাদের ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ করতে হবে।
- শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার – লড়াইয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।
- সমাজের বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকদের কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আইন তৈরি করতে হবে।
- স্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি কাজে স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে, কনট্রাক্ট লেবার নিয়ােগ করা চলবে না।
- সকল সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক – আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে, পেনশন দিতে হবে।
- শ্রম আইন ভঙ্গকারী মালিক-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আইন তৈরা করতে হবে।