লিখেছেনঃ মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী
ঈদের চাঁদের পহেলা তারিখ থেকে (শওয়াল মাস একটি, অপরটি হল যিলক্কাদা, তারপর হল যিলহিজ্বা হজ্বের মাস। এর দশ তারিখে অর্থাৎ দু’মাস দশ দিনের মাথায় ঈদুল আযহা পৰ্ব পালন করার নিয়ম শরীয়তে দেওয়া হয়েছে। ঈদের অর্থ হল খুশি, আনন্দ। আযহার অর্থ হল পশুকে কুরবানি দেওয়া, জবাই করা। অর্থাৎ পশু কুরবানির মাধ্যমে খুশির ঈদ পালন করা। যিলহিজ্ব মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখের আসর পর্যন্ত (তিনদিন) কুরবানি দেওয়া চলবে।
যাঁদের নামে কুরবানি দেওয়া হয় যিলহিজ্বার প্রথম তারিখ থেকে কুরবানি দেওয়া পর্যন্ত তাদের নখ, চুল, গোঁফ, দাড়ি কাটা ঠিক নয়। ইসলামী পরিভাষায় একে মুস্তাহাব বলে। কুরবানির পশু জবাই করার পরে তার নখ, চুল কাটার অনুমতি দেওয়া আছে। কুরবানির দিনে আরেকটি নির্দেশ দেওয়া আছে, যাদের নামে কুরবানি দেওয়া হয় তারা ঈদুল আযহার দিনে যতক্ষণ পর্যন্ত না পশু কুরবানি দেওয়া হবে তাঁরা না খেয়ে উপবাস পালন করবেন। কুরবানি দেওয়ার পর গােস্তের কিছু অংশ নিয়ে চটজলদি রান্না করে তার গােস্ত কিংবা ঝােল ব্যবহার করে ইফতার করবেন। এটাও মুস্তাহাব। ছােট পশু যেমন- ছাগল, ভেড়ার ক্ষেত্রে পশুপ্রতি একজন কুরবানি দেবেন। বড় জন্তু যেমন- উট, গরু, মােষ বা মােষের ছােট প্রজাতি কাটরার ক্ষেত্রে ৭ জন ব্যক্তির নামে কুরবানি দেওয়া যাবে। কুরবানির পশুর যখন গলায় ছুরি রেখে জবাই করতে হয়, তার পবিত্র দুয়া পবিত্র কুরআন মজীদে লিপিবদ্ধ আছে। সেটা হল– “ইন্না স্বলাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রব্বিল আলামীন…। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর” —অর্থাৎ আমার নামায ও কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ, কেবল আল্লাহরই জন্য। আল্লাহর পবিত্র নাম উচ্চারণ করে জবাই করছি। এই দুয়া পড়ে এইভাবে জবাই করবেন। জবাই করার ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি জবাই হয় সেটা শ্রেয়। ছুরি যেন শানানাে থাকে যাতে দ্রুত জবাই করা যায়। ভোতা বা অকেজো ছুরি দিয়ে পশুকে কষ্ট দেওয়া নিষেধ আছে। যাঁর নামে কুরবানি হবে ওই কুরবানি জবাই হওয়ার সাথে সাথে নিয়ত বা ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করতে হবে। এই কুরবানি আমি ৭ জনের পক্ষে অমুক অমুক নামের থেকে আল্লাহর নামে কুরবানি দিলাম। নবীজি (সা.) -এর ওসীলায় এই কুরবানি কবুল করে নিন। যাঁরা হজ করেন তাদের জনপ্রতি একটি বড় পশু কুরবানি দিতে হবে। এক সাথে ৭ জন হজ আদায়কারীদের কুরবানির নির্দেশ নেই। কুরবানি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে পবিত্র কুরআন মজীদে ও হাদীস শরীফে যে বিবরণ রয়েছে, তার সারসংক্ষেপ— আল্লাহর প্রিয় পয়গম্বর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) একদা স্বপ্নে দেখলেন যে, আমি আমার প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানি দিচ্ছি (পয়গম্বরের স্বপ্ন সঠিক হয় সেটাও নির্দেশ)। আল্লাহ তাকে বলেন, তুমি তােমার সবথেকে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর নামে কুরবানি দাও। এই স্বপ্ন পবিত্র কুরআনে আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে, যা চির শাশ্বত ও সত্য। হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর আদরের সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.) -কে বললেন যে, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, করুণাময় আল্লাহ তােমাকে কুরবানি দিতে বলেছেন। আমি স্বহস্তে তােমাকে কুরবানি দিতে চাইছি। তােমার কিছু বলার আছে। হযরত ইসমাঈল (আ.) বলেন, এটা যখন আল্লাহর নির্দেশ। আমার জীবনের প্রতি আমার কোনাে মায়া নেই। আল্লাহ যদি আমাকে কুরবানি দিতে বলেন, আমি প্রস্তুত আছি। আমি গলা পেতে দেব। আল্লাহ চাইলে আপনি দেখবেন, আমি কত ধৈর্যশীল। সেই মােতাবেক হযরত ইবরাহীম (আ.) ছুরি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছনে তাঁর সন্তান। রাস্তার মধ্যে শয়তান হযরত ইসমাঈল (আ.)- এর কাছে কোথায় যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে হযরত ইসমাইল (আ.) তাঁকে বলেন যে, আমার আব্বা স্বপ্নে দেখেছেন যে, আল্লাহ আমাকে কুরবানী দেওয়ার জন্য বলেছেন। তাই আমরা সেজন্য যাচ্ছি। শয়তান তাঁকে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে আপ্রাণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়। হযরত ইসমাইল (আ.) শয়তানকে পাথর মেরে শেষ করে। এই ঘটনা পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটে মিনা নামক স্থানে সংঘটিত হয়।
এরপর কুরবানির স্থানে পৌঁছে হযরত ইসমাঈলের (আ.) চোখে পট্টি বাঁধেন; তাঁকে শােয়ানাে হয়। এরপর হযরত ইবরাহীম (আ.) হযরত ইসমাঈলের (আ.) গলায় শানিত ছুরি ধরে জবাই করার চেষ্টা করেন; ছুরি চালাতে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ছুরির ধার একেবারে ভোতা। গলায় ছুরি চলছে। অথচ চামড়া কাটতে পারছে না। এরপরে আল্লাহর পবিত্র ফিরিশতারা একটি দুম্বা এনে হযরত ইসমাঈলের (আ.) স্থানে রেখে দেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে, ওগাে ইবরাহীম! আপনি পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। আপনার অন্তরে কোনাে দ্বিধা ছিল না। নিজের প্রিয়তম সন্তান হযরত ইসমাঈলকে (আ.) কুরবানী দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই দুম্বা জবাই করুন। হযরত ইসমাঈল (আ.) -কে ছেড়ে দিন। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা এই আত্মত্যাগ, বলিদান, সবকিছু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার সদিচ্ছাকে কবুল করেন। এই আত্মত্যাগ, বলিদান খােদার নির্দেশ মেনে পালন করে আল্লাহর নামে পশু জবাই করা আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য চিরতরে হুকুম হয়ে যায়। সেই নিয়ম এভাবেই মক্কা-মদীনা হয়ে আরব জাহান হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা ইসলামী সারা-শরীয়তের মাধ্যমে। হযরত ইব্রাহীম ও তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিমুস সালাতি ওয়া সালামের পর থেকে এই পশু কুরবানির নিয়ম কমবেশি পাঁচ হাজার বছর ধরে অবিচ্ছেদ্যভাবে চলে আসছে। কাদের জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব বা অপরিহার্য- পুরুষ বা নারী যে ব্যক্তির কাছে সাড়ে সাত ভরি সােনা বা সাড়ে বাহান্ন ভরি চাদি বা সমমূল্যের নগদ অর্থ আছে তাদের জন্য পশু কুরবানী দেওয়া অনিবার্য কুরবানী (ওয়াজিব)। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বড় পশুর ক্ষেত্রে সাত ব্যক্তি শরিক হতে পারে; ছােট পশুর ক্ষেত্রে একজন। উল্লেখ্য, মৃত ব্যক্তিদের নামেও কুরবানী করা যাবে (পিতা, মাতা, পীর, পয়গম্বর, স্বামী, স্ত্রী ইত্যাদি)। কুরবানী দিলে পশুর শরীরে যত পরিমাণ লােম আছে তত পরিমাণ নেকী (পুণ্য) ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে।
দয়ার নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দশ হিজরীতে বিদায় হজ্বের সময় (হিজরী সনের হিসাবে ১৪৩২ বছর আগে) ঈদুল আযহার জামাতের দু রাকাত নামায ও খুতবা পাঠ করে মিনা পার্শ্ববর্তী ময়দানে পশু কুরবানিও দিয়েছেন। হাদীস শাস্ত্র বিশারদরা বলেছেন যে, প্রিয় নবী (সা.) পবিত্র স্বহস্তে ৬৩টি পশু কুরবানী দিয়েছেন (এই ধরণীতে দয়ার নবী সা ৬৩ বছর বেঁচে ছিলেন; এজন্য হয়ত ৬৩ সংখ্যা পছন্দ করেছেন) এবং জামাতা হযরত আলী (রা.) কে দিয়ে ৩৭টি পশু কুরবানী দিয়েছেন। অর্থাৎ মােট ১০০টি পশু তিনি কুরবানী দিয়েছেন। এর মধ্যে উট, গরুও ছিল। কুরবানি দেওয়ার পর কুরবানির গােস্ত রান্না করার পরে তার ঝােলও তিনি পান করেছেন, এসবের অকাট্য প্রমাণ কিতাবে মজুদ রয়েছে।
ঈদুল আযহার নামাযের পূর্বে কেউ যদি পশু জবাই করে সেটা কুরবানী হবে না। নামাযের পরে কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, নিজের অর্থ দিয়ে আল্লাহর নামে কুরবানী দাও। পয়সার মােহ না করে কুরবানি দাও। পবিত্র কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার কুরবানি দেওয়া, আমার জীবন-মরণ ওগাে করুণাময় আল্লাহ আপনার জন্য উৎসর্গ। গােস্ত নয় এই আত্মত্যাগই কুরবানির মূল বিষয়। গােস্ত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ যদি কুরবানি করে তাহলে সে কুরবানি কবুল হবে না।
কুরবানির গােস্তকে তিনভাগ করে একভাগ গরীব, অসহায় মানুষদের দিতে হবে, অপর ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দিতে হবে, আরেকটি ভাগ নিজে ব্যবহার করার জন্য রাখতে হবে। কুরবানির চামড়া পাকিয়ে কেউ যদি নামাযপাটি করেন, তাহলে তা ব্যবহার তার জন্য বৈধ। কিন্তু বিক্রি করলে ওই টাকা নিজে ব্যবহার না করে গরীব মানুষদের দিতে হবে। কুরবানি না করে, কুরবানির পশুর দামের সমান অর্থ দান করলে কুরবানি হবে না।
[বিশেষ দ্রষ্টাব্যঃ এই প্রবন্ধের বেশ কয়েক জায়গায় মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী সাহেব লিখেছেন যে, “যাঁদের নামে কুরবানি দেওয়া হবে” কথা “যাঁদের নামে” হবে না কথাটি হবে “যাঁদের পক্ষ থেকে” কারণ কুরবানী একমাত্র আল্লাহর নামেই দেওয়া হয়, তবে বিভিন্ন ব্যাক্তির পক্ষ থেকে হয়। সম্ভবত “যাঁদের পক্ষ থেকে” শব্দটাকে ভূলবশত চৌধুরী সাহেব “যাঁদের নামে” করে ফেলেছেন]
(ভারতে ঈদ-উল-আযহা পালিত হবে ১ আগস্ট, ২০২০। ঈদ-উল-আযহার মূল পয়গাম হচ্ছে খােদাভীরুতা, ঈশ্বরপ্রেম, আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের প্রাণপ্রিয় সবকিছু কুরবানি করার প্রস্তুতি, ত্যাগ ও তিতিক্ষা। লেখক: মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী ঈদ-উল-আযহার তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন এই নিবন্ধ।) [মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের রাজ্য সভাপতি, জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার]
আরও পড়ুন,
অমুসলিমদের অধিকার ও সুরক্ষার ব্যাপারে ইসলামের নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত