লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
১৯৪৭-এর আগস্টে দেশভাগের ফলে ঔপনিবেশিক আমলের বাংলার জনসংখ্যার এক বিপুল অংশের স্বদেশি বিদেশি সম্বন্ধে ধারণার মধ্যে এক বিপুল বিপর্যয় ঘটে যায়। সে বিপর্যয়ের সমস্তটা ধর্ম সম্পর্কিত নয়, অনেকটা ভাষা সম্পর্কিতও বটে।
ব্রিটিশ আমলেও অসম প্রদেশে বহু বাংলাভাষী বাস করত। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে অসমের অধিকাংশ মানুষ জুম চাষেই অভ্যস্ত ছিল, উন্নত কৃষিপ্রথা প্রচলনের জন্য চাষযোগ্য জমির মালিকদের স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে ও উদ্যোগে পূর্ববঙ্গের বহু কৃষক পরিবারকে সমাদরের সঙ্গে অসমে নিয়ে যাওয়া হয় ও সেখানে তাদের বাসের সুব্যবস্থা করা হয়। গঙ্গা-যমুনার অববাহিকা থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এই অভিবাসনের প্রক্রিয়া বহু বছরের প্রাচীন। অসমের কিছু বুদ্ধিজীবী বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এইরূপ অভিবাসনের বিরোধিতা করলেও কৃষক সমাজের প্রশ্রয়ে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাতে যেমন চাষযোগ্য জমির প্রাচুর্য ছিল তেমনি ছিল সে জমির উর্বরতা। এই দুটি কারণে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের মধ্যেও বিশেষ আগ্রহ ছিল জমির অভাবগ্রস্ত স্বদেশ ত্যাগ করে অসমে গিয়ে বাস করার দিকে। তাছাড়া অসম সরকারের কাজকর্ম করার জন্য যত শিক্ষিতের প্রয়ােজন ছিল তত শিক্ষিত স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ছিল না, ফলে ব্রিটিশ শাসকরা দলে দলে শিক্ষিত বাঙালিদের চাকরি দিয়ে অসমে নিয়ে যায়। একই ভাবে চা-শিল্পের ক্ষেত্রেও শ্বেতাঙ্গ বাগান মালিকদেরও ইংরেজি শিক্ষিত বাংলাভাষী কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল এবং তা মেটাতে বহু বাঙালি অসমে অভিবাসন করে।
অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কৃষিক্ষেত্রে ও চাকরিক্ষেত্রে উভয় ক্ষেত্রেই বহু বাংলাভাষী জীবিকার প্রয়োজনে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত অসমে বসবাস শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে অসমের জনসমষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বেশি। ব্রিটিশ সেনারা ১৮৩২ সাল থেকে নাগা পাহাড়গুলিতে অভিযান শুরু করে। অঙ্গামি ও লোহটা অধ্যুষিত পাহাড়গুলিতে ব্রিটিশ শাসন প্রথম স্থাপিত হয় ১৮৮১ সালে। সবগুলি নাগা পাহাড় ব্রিটিশ শাসনে আসে ১৯২৭ সালে। এর মধ্যে ১৯১৮ সালে নাগারা একত্র হয়ে গঠন করে নাগা ক্লাব। ইতিমধ্যে ব্রিটিশরা নাগাদেরকে নিজেদের ধর্ম ও ভাষা এমনভাবে শিখিয়ে দেয় যে প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যেই তারা। আধা-ইউরোপীয় হয়ে যায়। সেই শিক্ষার ফলেই তারা ১৯১৮-তে নাগা ক্লাব গঠন, করে আর ১৯২৯ সালে সাইমন কমিশনের কাছে নাগা ক্লাবের সভ্যরা এই দাবি রাখে যে ব্রিটিশরাই যখন নাগাদের প্রথম জয় করল তখন ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় যেন নাগাদের আগের অবস্থায় অর্থাৎ স্বাধীন অবস্থায় রেখে যায়। সাইমন কমিশনের কাছে এই বক্তব্য রাখার সময় থেকে নাগারা কবে আবার স্বাধীন অবস্থা ফিরে পাবে তার জন্য দিন গুনতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তখন নাগাদের একাংশ অঙ্গামি নাগা নেতা জাপুফিজোর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের শামিল হয়। কিন্তু মহাযুদ্ধের পূর্বরণাঙ্গনে ব্রিটিশরা জয়ী হলে আজাদ হিন্দ ফৌজ পশ্চাদপসরণ করলেও তাদের বিস্তর সমরাস্ত্র ফিজোর অনুগামীদের ও বিদ্রোহী বা স্বাধীনতা সংগ্রামী নাগাদের হাতে থেকে যায়। যুদ্ধোত্তর ভারতের গভর্নর জেনারল। লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে নাগারা জানায় যে তারা দশ বছর স্বাধীন ভারতের শাসনে থাকতে রাজি, কিন্তু তারপরে তারা চায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। অতঃপর ১৯৪৭-এর জুন মাসে তৎকালীন অসম গর্ভনর স্যার আকবর হাইদরির সঙ্গে নাগা ন্যাশনল কাউন্সিলের যে চুক্তি হয় অনেক নাগা নেতা তার ব্যাখ্যা করলেন যে দশ বছর পরে নাগারা ভারত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে পারবে। এর প্রায় তিন সপ্তাহ পরে, ১৯৪৭এর ১৯ জুলাই জাপু ফিজো দিল্লিতে এসে গান্ধিজির সঙ্গে ভাঙ্গি কলোনিতে দেখা করেন এবং তার সঙ্গে আলোচনার পরে গান্ধিজি বলেন, নাগাদের স্বাধীন হওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। পরের মাসেই ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দিল, কিন্তু নাগা পাহাড়গুলো থেকে গেল ভারতের অভ্যন্তরেই। ফিজো ১৯৫১-র মে মাসে এক জনমত সংগ্রহের অভিযান করেন, তাতে হাজার হাজার নাগা স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন, এর পরে স্বভাবতই স্বাধীনতার জন্য নাগাদের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় নাগারা নির্বাচনকে পুরোপুরি বয়কট করলেন। কোহিমা শহরে অজ্ঞাত কারণে জনতা ও সরকারি রক্ষীদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হল ১৯৫২ সালে। পরের বছর জওহরলাল নেহরু এলেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে। প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষার প্রশ্ন নিয়ে সৃষ্টি হল জনতা বাহিনী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে আর এক দফা দ্বন্দ্ব।
১৯৫৬ থেকে পুরোদস্তুর শুরু হয়ে গেল দুপক্ষের মধ্যে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পালা। গঠিত হল নাগা পিস কমিশন। গির্জার যাজকদের নেতৃবৃন্দ এগিয়ে এলেন। শান্তি স্থাপনের কাজে। প্রথম নাগা পিপলস কনভেনশন ডাকা হল ১৯৫৭-র আগস্টে, দ্বিতীয় কনভেনশন ডাকা হল ১৯৫৮-র মে মাসে এবং ১৯৫৯-এর অক্টোবরে মোকক্ষচঙে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কনভেনশনে স্থির হল যে নাগাদের জন্য একটা পৃথক রাজ্য গঠন করা হবে। পরের বছর জুলাই মাসে এক নাগা প্রতিনিধি দল দিল্লিতে গেল, প্রতিনিধি দল ও ভারত সরকারের মধ্যে ১৬ দফার এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হল এবং ১৯৬০-এর ১ আগস্ট জওহরলাল সংসদে এক নতুন রাজ্য সৃষ্টির কথা ঘোষণা করলেন। অবশেষে ১৯৬৩-র ১৩ ডিসেম্বর অসমের একাংশ কেটে নিয়ে গঠিত হল নাগাল্যান্ড রাজ্য। তেরো বছর আগে নাগা পরিস্থিতিতে ছিল দুটি পক্ষ নাগা জাতীয়তাবাদী গুপ্ত সংস্থার সদস্যবৃন্দ এবং ভারত সরকার। এবার হল তিনটি পক্ষ বিদ্রোহী নাগাদের গুপ্ত সংস্থা যারা ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বাধীন দেশের পক্ষ, ভারত সরকার এবং সরকারি ক্ষমতাপুষ্ট নাগপক্ষ অর্থাৎ নাগাল্যান্ড রাজ্যের সরকারি নাগা পক্ষ। তিন পক্ষের টানাপোড়েনে পরিস্থিতি হয়ে উঠল অত্যন্ত অশান্ত ও হিংস্র। গির্জার যাজকবৃন্দ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসে জয়প্রকাশ নারায়ণ, বি পি চালিহা ও রেভারেন্ড মাইকেল স্কটকে নিয়ে গঠন করলেন এক শান্তি মিশন। কিন্তু মাইকেল স্কট দেশে ফিরে যাওয়ার পরে নাগা পিস মিশনের হাত থেকে নাগাদের নেতৃত্ব চলে যায় ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অব নাগালিম নামক সংস্থার হাতে।
ঘটনা এই যে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নাগা পাহাড়গুলির অধিকাংশই ছিল স্বাধীন এবং অন্যের আইনকানুন, অন্যের ব্যবস্থা ও শাসন মেনে চলা তাদের ধাতে, তাদের রক্তে ছিল না। ফলে স্বাধীনতার জন্য দাবি উত্থাপনে নাগারা কখনও বিরাম দেয়নি। ব্রিটিশ আমলে তারা অনেকখানি পরের শাসন মেনে নেয়, কিন্তু ব্রিটিশরা শাসনকাজে শুধু বন্দুকধারীদের ব্যবহার করেনি, ধর্মযাজকদেরও পুরোদস্তুর ব্যবহার করেছে, বোধ হয় বেশিই করেছে। কিন্তু নাগাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির গভীরে স্বাধীনতার স্পৃহা ও স্বপ্ন কখনও শূন্য হয়ে যায়নি। বিশেষত মোককচঙের পাহাড়গুলিতে স্বাধীনতার সংগ্রামকে রানি গাইদালো আজীবন চালিয়ে যান। তার প্রয়াণে তার অনুগামীরা যে স্বাধীনতার দাবিকে ভুলে গেছে এমন মনে করার কারণ নেই। ইতিমধ্যে আর একজন প্রভাবশালী নাগা নেতার আবির্ভাব হয়, তার নাম যুঙ্গালি মুইভা এবং সূত্র অনুসারে তাঁর অধীনে আছে চিনে শিক্ষিত এক গেরিলা বাহিনী। এই স্বল্প তথ্যাবলি থেকে বোঝা যাবে যে নাগা পরিস্থিতি কত জটিল। সত্য বটে যে ১৯৭৫-এর ১১ নভেম্বর যে শিলং অ্যাকর্ড স্বাক্ষরিত হয় তাতে গুপ্ত নাগাবাহিনীর সদস্যরাও ভারতীয় সংবিধান স্বীকার করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নাগাল্যান্ডে বর্তমানে এক প্রকার অস্বস্তিকর শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে নাগাদের সমস্যা শুধু নাগাল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, কারণ নাগাল্যান্ড গঠনের সময় নাগা অধ্যুষিত অনেকগুলি পাহাড় থেকে যায় মণিপুরের অভ্যন্তরে। রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি যখন ১৯৫৬ সালে পূর্বোত্তর ভারতের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসে তখন মণিপুর নাগা কাউন্সিল গঠিত হয় এবং এই কাউন্সিল প্রকাশ্যে হিংসার বিরোধিতা করলেও তাদের সহানুভূতি ছিল নাগাদের গুপ্ত গোষ্ঠীর প্রতি আর তাদের দাবি ছিল নাগাল্যান্ডে ও মণিপুরে ছড়ানো সমস্ত নাগা পাহাড়গুলির সংহতি সাধন। এর উপরে ছিল কুকি ও নাগাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ বিরোধ যা। অনেকসময় সশস্ত্র সংঘর্ষের রূপ নিত। পাশাপাশি ছিল মণিপুরের নিজস্ব সমস্যা। একদা মণিপুর ছিল পরম বৈষ্ণব মহারাজার অধীনে সবুজ পান্নার মতো একটি রাজ্য। তবে ১৯৪৯-এর ২১ সেপ্টেম্বর মহারাজা ভারত ভুক্তির চুক্তিপত্রে সই করেন আর তারই পাশাপাশি মনিপুরের আদিবাসী তথা মেইতি ভাষীরা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পি এল এ নামে এক বাহিনী গড়ে তোলে। এই পি এল এর সদস্যরা গেরিলা যুদ্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল চিন নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের লাসা থেকে। মণিপুরের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়। ফলে ১৯৭৮-এর ২৬ অক্টোবর জারি হল রাষ্ট্রপতির শাসন। এখানে বলে রাখা ভালো যে মেইতিদের নিজস্ব লিপি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল, ফলে তাদের মধ্যে একপ্রকার গৌরবভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সহজেই জন্ম নেয় যা তাদেরকে বিপ্লবী চিন্তায় ও সংগঠনে উৎসাহিত করে। ‘রিভোলিউশনারি পিপলস’ ফ্রন্ট (আগে যার নাম ছিল ‘আমর্ড রিভোলিউশনারি গভর্নমেন্ট অব মণিপুর), পিপলস লিবারেশন আর্মি, পিপলস’ রিভোলিউশনারি পার্টি অব কাঙলেইপাক, রেড আর্মি প্রভৃতি অনেকগুলি দল গড়ে ওঠে, কিন্তু সবগুলোই রাষ্ট্রপতি শাসনের কালে নিষিদ্ধ হয়। এটাও উল্লেখযোগ্য যে মণিপুরি ভাষা ও সাহিত্য ভারতের জাতীয় সাহিত্য অকাদেমির তালিকাবদ্ধ ভাষাগুলির অন্যতম হলেও ভারতীয় সংবিধানের অন্তগর্ত ভাষাগুলির সারণিতে স্থান পায়নি। এতে মণিপুরিদের জাত্যাভিমান ক্ষুন্ন হয়। ফলে জমে ওঠে ভারতীয়তার প্রতি বিক্ষোভ। এই সঙ্গে রয়েছে চিনপন্থী মণিপুরি গেরিলা বাহিনীর ও পার্শ্ববর্তী মায়ানমারের লুটেরা বাহিনীর উৎপাত। এই অশান্তি হাঙ্গামা শাসনের জন্যে ভারত সরকার বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করে, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়, কারণ অচিরে ওই সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নারীধর্ষণের উপর্যুপরি ঘটনা মণিপুরবাসীদের ভারতবিরোধী করে তোলে। বিশেষত ২০০৪ সালের ১১ জুলাই থংজাম মনোরমাকে অসম রাইফেলসের তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে ১৫ জুলাই মণিপুর নারীদের ভারতীয় সেনারা এসো, আমাদেরও ধর্ষণ করো’ বলে নগ্ন মিছিল সারা বিশ্বে সাড়া তোলে। আবার শর্মিলা চানু ২০০২ সালের ২ নভেম্বর থেকে সেনাদের বিশেষ অধিকার দেওয়ার বিরুদ্ধে যেভাবে অহিংস প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন তা-ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে ভারতের ভাবমূর্তিকে আঘাত করেছে। এ বিষয়ে পরে ফিরে আসব।
প্রকৃতপক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারত শুধু ভারতের নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক প্রচণ্ড উপদ্রুত অঞ্চল। এই প্রসঙ্গে ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সেখানকার জনজাতিরা এককালে রবীন্দ্রনাথের কাছে বাংলায় ভাষণের জন্য দাবি তুলেছিল, কিন্তু বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে এই জনজাতিরাই বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে হাতে তুলে নিয়েছিল মারণাস্ত্র। ত্রিপুরা ছিল মাণিক্য রাজাদের শাসিত এক করদ রাজ্য। তার ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয় ১৯৪৯-এর ১৫ অক্টোবর। এখানকার জনজাতি ও তফশিলিদের স্বার্থ রক্ষা ও তাদের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য জওহরলাল নেহেরু ১৯৫২ সালে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। কিন্তু ত্রিপুরার জনজীবন বিপর্যস্ত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ত্রিপুরার স্থায়ী জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক শরণার্থীকে ত্রিপুরা আশ্রয় দিয়েছিল। বাংলাদেশ গঠনের পরে অনেক শরণার্থী স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু ত্রিপুরাতেও থেকে যায় বহু বাংলাভাষী। ত্রিপুরার ভূমিপুত্রদের থেকে শরণার্থীরা সংখ্যায় বেশি হয়ে যায়। জনচিত্র একেবারে পাল্টে যায় রাতারাতি। আত্মরক্ষার জন্য জনজাতিরা সংগঠন করে জনজাতি যুব সমিতি। ফলে জনজাতি ও অজনজাতির মধ্যে ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা শুরু হল আশির দশকে। তার জবাবে গত শতকের শেষ দিকে বাংলাভাষীরা গড়ে তুলল ইউনাইটেড বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। একদিকে জমির আর অন্যদিকে জীবিকার সংকট জনজাতি ও অজনজাতিকে যখন পরস্পরের শত্রুপ্রতিম করে তুলেছে তখন রাজ্য সরকার জনজাতিকে রবার চাষের উৎসাহ, শিক্ষা ও সুযোগ দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করে এক শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলে। রবার চাষ যখন জনজাতির জন্য এক নতুন অর্থকর জীবিকা তেমনই তাদের পরম্পরাগত জীবনধারার পরিপোষক হওয়াতে তারা আপনা থেকেই জঙ্গি কার্যকলাপে নিরুৎসাহী ও রবার চাষে উৎসাহী হয়ে উঠল। আবার একই সঙ্গে রবার চাষ রাজ্যের অর্থনৈতিক বিকাশকেও তুলতে লাগল উজ্জীবিত করে।
কিন্তু আপাত শান্ত ত্রিপুরার আড়ালে জঙ্গিগোষ্ঠী একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ত্রিপুরার প্রথম উল্লেখযোগ্য জঙ্গিগোষ্ঠী ছিল বিজয় রাংখেল সংগঠিত ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স তথা টি এন ভি আর তাদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে গোষ্ঠী সেই ইউনাইটেড লিবেরেশন ফ্রন্টের পেছনে ছিল আনন্দমার্গ প্রভাবিত আমরা বাঙালি গোষ্ঠী। নব্বইয়ের দশকে টি এন ভি-র থেকে বেরিয়ে এসে ধনঞ্জয় রিয়াং যে জঙ্গিদল সংগঠন করেন তার নাম ন্যাশনাল লিবারেশন ফন্ট অব ত্রিপুরা তথা এন এল এফ টি এবং বছর পাঁচ-ছয় পরে রিয়াং আবার এন এল এফ টি ছেড়ে গড়ে তোলেন ত্রিপুরা রেজারেকশন আর্মি তথা টি আর এ। অতঃপর এসব দলের ভাঙাচোরা অংশ নিয়ে গঠিত হয় বরাক ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ত্রিপুরা তথা বি এন সি টি । আবার অজনজাতিরাও চুপ করে বসে থাকে না, তারা জনজাতি সংগঠনগুলির প্রতিপক্ষ রূপে গঠন করেন অল ত্রিপুরা টাইগার ফোস তথা এটি টি এফ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর বছরগুলিতে আবার শুরু হয় জাতিদাঙ্গা। একটা হিসেব অনুসারে ১৯৯২ থেকে ২০০৩-এর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের মধ্যে জাতিদাঙ্গায় নিহত হয়েছে সাধারণ মানুষ ২২৭৪ জন। আর নিরাপত্তারক্ষী ৩৫৪ জন। এবং ২০০৮-এর গান্ধিজয়ন্তীর আগের দিন ১ অক্টোবর আগরতলাতে পরপর অনেকগুলি বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়াও এই বছরেই জঙ্গিদের হাতে স্পেশাল অফিসার ভজন ভৌমিকের এবং ৩ জন নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়।
এটা উল্লেখযোগ্য যে উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গিরা তথা বিচ্ছিন্নবাদী বা ভারতবিরোধীরা একদা প্রচুর সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল বাংলাদেশ থেকে, কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে উত্তর-পূর্ব ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপের মাত্রা উল্লেখযোগ্য রূপে হ্রাস পেয়েছে।
তবে অনেকে মনে করেন উত্তর-পূর্ব ভারতে অশান্তির একটা প্রধান কারণ বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি ও উৎপাত। সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইনটি ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে গৃহীত হয়। এই আইনের প্রস্তাবনাতে বলা হয় যে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে হিংসা একটা জীবনধারাতে পরিণত হয়েছে, সেজন্য অসম ও মণিপুরে শান্তি শৃঙ্খলা কায়েম করার জন্য এই আইনটি বলবত করা প্রয়োজন। এই আইন অনুসারে যে কোনও কমিশনড অফিসার, ওয়ারেন্ট অফিসার, নন-কমিশনড অফিসার কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর সমস্তরীয় যে কোনও অফিসার জন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গুলি চালাতে বা বলপ্রয়োগ করতে পারবে এবং অথবা যে কোনও অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম ধ্বংস করতে পারবে এবং/অথবা সন্দেহের বশে বিনা পরোয়ানায় যে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কিংবা যে কোনও গৃহে প্রবেশ করে তল্লাশি চালাতে পারবে। এই আইনকে বলে আমর্ড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট বা সংক্ষেপে আফসপা অ্যাক্ট। আইনটাকে বহাল রাখা নিয়ে ১৯৭২ থেকে সংসদে বহু বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই মনে করেন জুলুম ও হিংসাকে আইনসম্মত করার এটা একটা জঘন্য দৃষ্টান্ত। সন্ত্রাসবাদকে শাসন করার নামে এই আইনটা কার্যত সেনাদের দিয়েছে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অপূর্ব অজুহাত এবং তাই চানু শর্মিলা নামে এক মণিপুরি নারী অনেক বছর এই আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন করে অহিংস সংগ্রামের এক নতুন মহিমা স্থাপন করেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আগেই বলেছি যে দেশরক্ষার কাজে নিযুক্ত এই সেনারা কার্যত ভারতের ভাবমূর্তিকেই ধ্বংসের কাজে লিপ্ত।
অসমের আগের রাজধানী বর্তমান মেঘালয়ের রাজধানী শিলঙের থেকে মাইল বিশ-পঁচিশ দূরে স্মিট শহরে একটা মন্দির আছে। খাসিদের বিশ্বাস অনুসারে একদা এখানে একটা স্বর্গমর্ত জুড়ে সিঁড়ি ছিল, মানুষ তখন বিধাতা ও দেবতাদের সঙ্গে স্বর্গেই বাস করত, তবে মধ্যে মধ্যে নেমে আসত মতে। এক সন্ধ্যেতে বিধাতা দেখলেন, সাতজন মানুষ স্বর্গে ফেরেনি। পরের সন্ধেতে বিধাতাকে তারা জানাল, ওপরের স্বর্গের থেকে নীচের মর্ত্য আরও সুন্দর, তাই তারা রাতটাও কাটিয়ে এসেছে মতে। তখন বিধাতা রেগে বললেন, তা হলে তোমরা মর্তেই গিয়ে থাকো। মর্ত্যে এসে তারা সাতজনে এক একটা জায়গা বেছে নিয়ে বাস করতে লাগল আর কালক্রমে ওই সাতটা জায়গা পরিচিত হল হল অসম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি নামে। একদা সেই স্বর্গের চেয়ে সুন্দর উত্তর-পূর্ব ভারত নরকের মতো আগুনে জ্বলছে। কখনও দাউ দাউ করে, কখনও ধিকিধিকি করে। গত শতাব্দীর আশির দশকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী অসমিয়া কথাশিল্পী বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য আক্ষেপ করেছিলেন সমগ্র ভারতের ইতিহাসে উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাসের স্থান নেই, যেন উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতের অংশ নয়। হয়তো তাই উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা গোষ্ঠী ও নানা স্থান থেকে মধ্যে মধ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি শোনা যায়। কিন্তু সেজন্য তাদেরকে শাসন না করে তাদেরকে স্বজনরূপে আলিঙ্গন করা, তাদেরকে ভালোমন্দের সুখ-দুঃখের সঙ্গীরূপে গ্রহণ করার দায়দায়িত্ব প্রত্যেক সচেতন ভারতবাসীর। মনে রাখা দরকার পুবের পাড়াতে পাহাড়ে জনপদে জঙ্গলে যে আগুন জ্বলছে তার কোনও ফুলকি-ফুলিঙ্গ যে কোনও মুহূর্তে আমাদের পাড়াতেও আমাদের মাথাতেও উড়ে আসতে পারে।
সুরজিৎ দাশগুপ্তের আরও কয়েকটি লেখা পড়ুন,
১) ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ
২) আধুনিক ভারতের জনক মহাত্মা রামমোহন
৩) নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহ : বিশ্ব-ইতিহাসের শিকার
৫) বিশ্বশান্তির ধর্ম নিয়ে রাধানগর থেকে ব্রিস্টল
৬) ভাষা মানে জনগোষ্ঠীর আবেগ ও আত্মা
৭) তেলেঙ্গানা থেকে গোর্খাল্যাণ্ড
৮) আমাদের এক দেশ, আমরা এক জাতি
৯) ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ
১০) মহাত্মা গান্ধীর সন্ধান – ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পূনর্মূল্যায়ন
১১) সতীদাহ প্রথার মর্মান্তিক ইতিহাস: দু’শতাব্দী আগে ও এখন
১২) এন্ড্রুজ ও রবীন্দ্রনাথঃ আধুনিক যুগের দুই মহৎ ব্যক্তিত্বের সংলাপ ও সংযোগ
১৪) বাংলাভাষা – ভাষার জন্য প্রাণ দিতে জানে যারা
১৫) স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
১৬) সংস্কৃতি, না মূল্যবোধ? সংস্কৃতির নামে ভারতীয় উপমহাদেশে অপসংস্কৃতি