লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মানুষের ইতিহাসে যত দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তি ও চিন্তার ধারা প্রবাহিত হয়েছে, তার সবকিছুর শেষ গন্তব্য একটি মৌলিক প্রশ্নেই এসে থামে—এই মহাবিশ্ব কেন আছে? কেন কিছু আছে, কিছু না থাকার বদলে? এই প্রশ্নটি মানবচিন্তার গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসা এক অস্তিত্বমূলক আহ্বান। মানুষ শুধু বেঁচে থাকে না, সে জানে যে সে বেঁচে আছে। সে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে, বিশ্লেষণ করে, প্রশ্ন করে। এই আত্মসচেতনতা মানবজাতিকে জড় জগত ও অন্যান্য প্রাণী থেকে মৌলিকভাবে আলাদা করে দেয়।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছে—এই বিশাল নীল গম্বুজের ওপারে কী আছে? সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র—এসব কেবল আলো নয়, এগুলো মানুষের মনে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। প্রাচীন যুগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়েছে পুরাণে, ধর্মে ও কাব্যে। আধুনিক যুগে খোঁজা হয়েছে দর্শন ও বিজ্ঞানে। কিন্তু মাধ্যম বদলালেও প্রশ্নটি একই থেকেছে—অস্তিত্বের উৎস কী?
এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলে প্রথম যে সত্যটি আমাদের সামনে আসে, তা হলো—এই মহাবিশ্ব চিরন্তন নয়। একসময় মানুষের ধারণা ছিল, মহাবিশ্ব চিরকাল ছিল এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সেই ধারণাকে আমূল ভেঙে দিয়েছে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী, সময়, স্থান, শক্তি ও পদার্থ—সবকিছুই এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে অস্তিত্বে এসেছে। তার আগে কোনো সময় ছিল না, কোনো স্থান ছিল না, এমনকি ‘আগে’ বলার মতোও কিছু ছিল না। এই সত্যটি কেবল বৈজ্ঞানিক নয়, গভীর দার্শনিক তাৎপর্য বহন করে।
কারণ যদি মহাবিশ্বের একটি শুরু থাকে, তবে একটি মৌলিক প্রশ্ন অনিবার্যভাবে উঠে আসে—এই শুরুটি কীভাবে ঘটল? যা শুরু হয়েছে, তার অবশ্যই একটি কারণ থাকতে হবে। কারণ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটে না—এটি যুক্তির প্রথম নীতি। আমরা প্রতিদিনের জীবনে এই নীতির ওপরই নির্ভর করি। কোনো শব্দ শুনলে আমরা তার উৎস খুঁজি, কোনো ঘটনা ঘটলে তার কারণ অনুসন্ধান করি। এই নীতিকে অস্বীকার করলে চিন্তা ও বিজ্ঞান—দুটোই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো—এই মহাবিশ্বের কারণ কী? শূন্য কি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হতে পারে? সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থায় কি শক্তি, আইন, তথ্য ও গঠন জন্ম নিতে পারে? আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে কিছু বিজ্ঞানী যখন বলেন “nothing” থেকে মহাবিশ্ব এসেছে, তখন তারা প্রকৃত শূন্যতার কথা বলেন না। তারা বোঝান কোয়ান্টাম ক্ষেত্র, শক্তির সম্ভাবনা, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন—যেগুলো আদৌ শূন্য নয়। প্রকৃত শূন্যতা মানে কোনো কিছুই নেই—না স্থান, না সময়, না শক্তি, না সম্ভাবনা। এমন শূন্যতা থেকে কিছু সৃষ্টি হওয়া যুক্তিগতভাবে অসম্ভব।
অতএব, মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে এমন একটি কারণ থাকতে হবে, যিনি নিজে মহাবিশ্বের অংশ নন। যিনি সময়ের অধীন নন, কারণ সময় নিজেই মহাবিশ্বের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে। যিনি স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, কারণ স্থানও সৃষ্টি হয়েছে। যিনি পদার্থনির্ভর নন, কারণ পদার্থ তাঁরই সৃষ্টি। এই কারণকে যদি আবার কোনো কিছুর দ্বারা সৃষ্ট ধরা হয়, তবে প্রশ্নটি শুধু পেছাতে থাকবে। এই অসীম পশ্চাদপসরণ যুক্তিগতভাবে অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত এমন এক সত্তায় এসে থামতেই হয়, যিনি নিজেই অস্তিত্বের ভিত্তি—যিনি প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব, যাঁর না থাকার সম্ভাবনাই নেই।
এই ধারণাই দর্শনে পরিচিত ‘পরম সত্তা’ হিসেবে। ধর্মীয় ভাষায় যাঁকে বলা হয় সৃষ্টিকর্তা। তিনি এমন এক সত্তা, যাঁর অস্তিত্ব কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং সবকিছু তাঁর ওপর নির্ভরশীল। এই সত্তা ছাড়া মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা যায় না।
কিন্তু মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রশ্ন এখানেই শেষ হয় না। প্রশ্নটি আরও গভীর হয় যখন আমরা দেখি—এই মহাবিশ্ব কেবল অস্তিত্বে এসেছে তাই নয়, এটি এসেছে এক অবিশ্বাস্য সূক্ষ্মতা ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। মহাবিশ্বের প্রতিটি স্তরে আমরা নিয়ম, ভারসাম্য ও পরিমিতি দেখতে পাই। এই শৃঙ্খলা কোনো বিশৃঙ্খল বিস্ফোরণের স্বাভাবিক ফল হতে পারে না।
মানুষের বুদ্ধি যখন এই নিয়ম ও শৃঙ্খলার দিকে তাকায়, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করে—এই নিয়মগুলো এল কোথা থেকে? কেন প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে? কেন মহাবিশ্ব বিশৃঙ্খলায় ভেঙে পড়ে না? এই প্রশ্নগুলো আমাদের আবারও সেই একই সত্যের দিকে নিয়ে যায়—যেখানে নিয়ম আছে, সেখানে নিয়মদাতা থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
মানুষের চিন্তার ইতিহাসে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে। কেউ বলেছেন—সবকিছু কাকতালীয়। কেউ বলেছেন—এটাই প্রকৃতির স্বভাব। কিন্তু এই উত্তরগুলো প্রশ্নের গভীরতা স্পর্শ করে না। কাকতালীয়তা কখনোই নিয়মের ব্যাখ্যা হতে পারে না। প্রকৃতির স্বভাব বললেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই স্বভাব এল কোথা থেকে?
মানুষ শুধু বাহ্যিক মহাবিশ্ব নিয়ে প্রশ্ন করে না, সে নিজের ভেতরেও তাকায়। সে অনুভব করে—আমি কেবল পদার্থ নই। আমার চিন্তা আছে, অনুভূতি আছে, স্মৃতি আছে, অনুশোচনা আছে। আমি ভালোবাসি, ঘৃণা করি, ন্যায়বোধ অনুভব করি। এই অভ্যন্তরীণ জগত কেবল রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল হলে মানুষ কখনোই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এত গভীরভাবে ভাবত না। মানুষের এই প্রশ্ন করার ক্ষমতাই প্রমাণ করে—সে কেবল জড় বস্তু নয়।
এই অংশে আমরা যে সত্যটির মুখোমুখি হই, তা হলো—মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নিজেই এক গভীর প্রশ্ন, যার উত্তর বস্তুজগতের ভেতরে পাওয়া যায় না। এই উত্তর আমাদের নিয়ে যায় এমন এক সত্তার দিকে, যিনি মহাবিশ্বের বাইরে থেকেও মহাবিশ্বকে ধারণ করেন। এই অনুসন্ধান এখানেই শেষ নয়; বরং এখান থেকেই তা আরও গভীর হয়।
মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রশ্ন আমাদের প্রথমে যে সত্যটির মুখোমুখি করায়, তা হলো—এই মহাবিশ্ব চিরন্তন নয়। কিন্তু এই সত্যের পরেই আরও গভীর ও বিস্ময়কর একটি বাস্তবতা আমাদের সামনে আসে। এই মহাবিশ্ব কেবল সৃষ্টি হয়েছে তাই নয়, এটি সৃষ্টি হয়েছে এক আশ্চর্য রকমের সূক্ষ্মতা, ভারসাম্য ও নিখুঁত পরিমিতির মধ্য দিয়ে। এই নিখুঁততাই আধুনিক বিজ্ঞানে পরিচিত হয়েছে “fine-tuning” নামে। এই ধারণাটি যতটা বৈজ্ঞানিক, ততটাই দার্শনিক ও যুক্তিগতভাবে গভীর।
মহাবিশ্বের মৌলিক গঠন দাঁড়িয়ে আছে কিছু নির্দিষ্ট পদার্থবৈজ্ঞানিক ধ্রুবকের ওপর। এই ধ্রুবকগুলো যদি সামান্যতম পরিবর্তিত হতো, তবে আজকের মহাবিশ্ব তো দূরের কথা, কোনো কাঠামোবদ্ধ বাস্তবতাই অস্তিত্বে আসতে পারত না। মাধ্যাকর্ষণ ধ্রুবক সামান্য বেশি হলে মহাবিশ্ব মুহূর্তেই নিজের ভারে ধসে পড়ত। সামান্য কম হলে কোনো নক্ষত্র, কোনো গ্যালাক্সি, কোনো গ্রহ তৈরি হতো না। তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি যদি সামান্য দুর্বল হতো, তবে পরমাণু গঠন সম্ভব হতো না। আবার সামান্য বেশি হলে রাসায়নিক বিক্রিয়াই ঘটত না।
এর চেয়েও বিস্ময়কর হলো কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট। আধুনিক কসমোলজি অনুযায়ী, এই ধ্রুবকের মান এমন নিখুঁতভাবে নির্ধারিত যে এর মান ১-এর মধ্যে ১০¹²⁰ অংশের সামান্য বিচ্যুতিও মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ অচল করে দিত। এই সংখ্যাটি কেবল বড় নয়, মানববুদ্ধির কল্পনাশক্তিকেও অতিক্রম করে। পৃথিবীতে যত পরমাণু আছে, তার সংখ্যাও এই সংখ্যার কাছে তুচ্ছ। এমন সূক্ষ্ম পরিমিতি কাকতালীয়ভাবে নির্ধারিত হয়েছে—এ কথা বলা যুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সাংঘর্ষিক।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য এল কোথা থেকে? কেন ধ্রুবকগুলো ঠিক এমন মানেই নির্ধারিত হলো, যেখানে জীবন সম্ভব? কেন এমন কোনো মান হলো না, যেখানে কোনো কাঠামোই গড়ে ওঠে না? কেউ কেউ এর জবাবে “multiverse” বা বহু-মহাবিশ্ব তত্ত্বের কথা বলেন। তাদের দাবি—অসংখ্য মহাবিশ্ব আছে, আমরা কেবল সেই মহাবিশ্বে আছি যেখানে জীবন সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি সমস্যার সমাধান করে না, বরং সমস্যাকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়। প্রথমত, বহু-মহাবিশ্ব তত্ত্বের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, যদি অসংখ্য মহাবিশ্ব থেকেও থাকে, তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই পুরো ব্যবস্থাটিই বা এল কোথা থেকে? এই অসংখ্য মহাবিশ্বের নিয়ম, সম্ভাবনা ও কাঠামো কে নির্ধারণ করল? কাকতালীয়তার ওপর কাকতালীয়তা চাপিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তিকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। যুক্তি একসময় থামতে চায় একটি মৌলিক ব্যাখ্যায়।
এই সূক্ষ্ম সমন্বয় কেবল মহাজাগতিক স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি জীবনের স্তরেও একইভাবে বিদ্যমান। পৃথিবী সূর্য থেকে এমন এক দূরত্বে অবস্থিত, যেখানে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। এই দূরত্ব সামান্য কম হলে পৃথিবী জ্বলন্ত মরুভূমিতে পরিণত হতো, সামান্য বেশি হলে বরফে ঢাকা মৃত গ্রহে পরিণত হতো। পৃথিবীর অক্ষের সামান্য ঝুঁকি ঋতুচক্র সৃষ্টি করেছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ঠিক সেই অনুপাতে গঠিত, যাতে অক্সিজেন জীবন রক্ষা করে, আবার অতিরিক্ত হয়ে ধ্বংস ডেকে না আনে।
পানির বৈশিষ্ট্যও বিস্ময়কর। পানি জমে বরফ হলে উপরে ভাসে—এই একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য না থাকলে পৃথিবীর সমুদ্র ও নদী বরফে জমে জীবন ধ্বংস হয়ে যেত। কার্বনের বহুমুখী বন্ধন ক্ষমতা না থাকলে জৈব রসায়নই সম্ভব হতো না। এই প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদা করে দেখলেও বিস্ময়কর, আর সবকিছু একসঙ্গে বিবেচনা করলে তা আরও গভীর এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে।
এই সবকিছুকে একত্রে দেখলে একটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবে উঠে আসে—এই নিখুঁততা কি অন্ধ প্রক্রিয়ার ফল? বিশৃঙ্খল বিস্ফোরণ কি এমন পরিমিত শৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে? আমরা দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু দেখলে কীভাবে বিচার করি? যদি আমরা মরুভূমির মধ্যে একটি ঘড়ি পড়ে থাকতে দেখি, আমরা কি বলি—এটি বাতাসে বালির কণার সংঘর্ষে নিজে নিজে তৈরি হয়েছে? নাকি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই—এর পেছনে একজন নির্মাতা আছে?
এই যুক্তিকে কেউ কেউ অবহেলা করে বলেন—প্রকৃতি নিজেই এমন। কিন্তু এই উত্তর আসলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার নামান্তর। প্রকৃতি কী? প্রকৃতি মানে নিয়ম, শক্তি ও সম্পর্কের সমষ্টি। কিন্তু এই নিয়মগুলো কেন এমন? কেন প্রকৃতি বিশৃঙ্খলায় ভেঙে পড়ে না? নিয়ম মানেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো। নিয়ম নিজে নিজে তৈরি হয় না; নিয়ম আরোপিত হয়।
মানুষের বুদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই নকশা ও উদ্দেশ্য শনাক্ত করতে পারে। যখন আমরা অর্থবহ জটিলতা দেখি—যেখানে অংশগুলো একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে—তখন আমরা নকশার উপস্থিতি অনুমান করি। মহাবিশ্বে যে জটিলতা আমরা দেখি, তা কেবল জটিল নয়, অর্থবহ ও কার্যকর। এই অর্থবহ জটিলতা নকশারই ইঙ্গিত দেয়।
এই নকশা আবার কোনো সীমাবদ্ধ, অজ্ঞ বা পরীক্ষানির্ভর সত্তার কাজ হতে পারে না। কারণ একটি ভুলও এখানে সহনীয় ছিল না। এই নকশা এমন এক বুদ্ধিমত্তার ইঙ্গিত দেয়, যিনি শুরু থেকেই জানতেন—কী করলে মহাবিশ্ব টিকে থাকবে, কী করলে জীবন সম্ভব হবে। এই জ্ঞান ভবিষ্যৎনির্ভর, সর্বব্যাপী ও নির্ভুল।
এখানে এসে মানুষ আবার নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। কেন এই মহাবিশ্ব এমনভাবে গঠিত, যেখানে মানুষ প্রশ্ন করতে পারে? কেন মানুষের বুদ্ধি এই নিয়মগুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম? এই মিল কেবল আকস্মিক হতে পারে না। মানুষের বুদ্ধি যেন মহাবিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোর সঙ্গে সংলাপ করতে পারে—এটি নিজেই এক গভীর ইঙ্গিত।
অতএব, মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম সমন্বয় আমাদের এমন এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়, যা যুক্তি ও অভিজ্ঞতা—দুটোর সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মহাবিশ্ব কেবল দুর্ঘটনার ফল নয়। এটি উদ্দেশ্যহীন বিশৃঙ্খলার সন্তান নয়। এটি এমন এক সত্তার পরিকল্পনার ফল, যিনি জানেন, যিনি ইচ্ছা করেন, যিনি সৃষ্টি করেন।
এই অংশে আমরা দেখলাম—মহাবিশ্বের গঠন, ধ্রুবক, ভারসাম্য ও জীবনের অনুকূল পরিবেশ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একসঙ্গে মিলে একটি সুসংগত বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে। এই বাস্তবতা আমাদের বলে—মহাবিশ্ব কেবল আছে বলেই নেই, এটি এমনভাবে আছে, যাতে প্রশ্ন তোলা যায়, চিন্তা করা যায় এবং অর্থ খোঁজা যায়।
মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম গঠন ও নিখুঁত ভারসাম্য আমাদের যুক্তিকে এমন এক সত্তার দিকে নিয়ে যায়, যিনি পরিকল্পনা করতে পারেন, জানেন এবং ইচ্ছা করেন। কিন্তু এই অনুসন্ধান এখানেই থেমে যায় না। বরং এখান থেকেই প্রশ্নটি আরও গভীর স্তরে প্রবেশ করে—মানুষ নিজে কে? এই মহাবিশ্বে মানুষের অবস্থান কী? মানুষ কেন কেবল একটি জৈবিক যন্ত্র নয়, বরং এক সচেতন, চিন্তাশীল ও নৈতিক সত্তা?
মানুষের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো তার চেতনা। মানুষ জানে যে সে জানে। সে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন। সে প্রশ্ন করে—আমি কে? কেন আমি এখানে? মৃত্যুর পরে কী হবে? এই আত্মবোধ কোনো জৈবিক প্রক্রিয়ার সহজ ব্যাখ্যা নয়। আধুনিক বিজ্ঞান মস্তিষ্কের গঠন, নিউরনের কার্যকলাপ, রাসায়নিক সংকেত—এসব বিষয়ে অভূতপূর্ব অগ্রগতি করেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিজ্ঞান আজও একটি মৌলিক প্রশ্নের সামনে অসহায়—চেতনা আসলে কী?
মস্তিষ্ক একটি জৈবিক অঙ্গ। এটি পদার্থ দিয়ে তৈরি। নিউরনগুলো বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক সংকেত আদান–প্রদান করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া থেকে কীভাবে জন্ম নেয় অনুভূতি, চিন্তা, স্মৃতি, আত্মপরিচয়? কোনো নিউরনের ভেতরে ‘আমি’ নামের কোনো সত্তা নেই। কোনো কোষের মধ্যে ভালোবাসা বা অনুশোচনার অণু পাওয়া যায় না। তবু মানুষ ভালোবাসে, অনুতপ্ত হয়, স্বপ্ন দেখে, কষ্ট পায়। এই বাস্তবতা নির্দেশ করে—চেতনা কেবল পদার্থের উপজাত নয়।
যদি চেতনা কেবল রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল হতো, তবে পর্যাপ্ত জটিলতা থাকলেই যেকোনো ব্যবস্থা সচেতন হয়ে উঠত। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারও কখনো নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, ভাষা অনুকরণ করতে পারে, কিন্তু সে জানে না যে সে জানে। মানুষের চেতনার সঙ্গে যন্ত্রের প্রক্রিয়াগত বুদ্ধির মৌলিক পার্থক্য এখানেই।
এই পার্থক্য আমাদের একটি গভীর দার্শনিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়—জড় থেকে চেতনার জন্ম যুক্তিগতভাবে ব্যাখ্যাতীত। চেতনার উৎস হতে হবে চেতন। মানবচেতনা কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; এটি সেই চিরচেতন সত্তার প্রতিফলন, যিনি মহাবিশ্বের ভিত্তি। মানুষ কেবল সৃষ্টি নয়, সে সচেতন সৃষ্টি—এবং এই সচেতনতা তার সৃষ্টিকর্তারই এক ছাপ।
চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত আরেকটি বিষয় হলো নৈতিকতা। মানুষ কেবল জানে না যে সে আছে, সে জানে যে তার কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়। সে ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য বোঝে। এই নৈতিক বোধ মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে। পশু প্রয়োজনের তাগিদে কাজ করে, মানুষ নৈতিকতার আলোকে নিজের প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারে।
বিশ্বের সব সমাজ, সব সংস্কৃতি ও সব যুগে কিছু মৌলিক নৈতিক ধারণার আশ্চর্যজনক মিল দেখা যায়। নিরপরাধকে হত্যা করা অন্যায়, প্রতারণা নিন্দনীয়, দুর্বলকে রক্ষা করা প্রশংসনীয়—এই ধারণাগুলো সভ্যতাভেদে ভিন্ন হয়নি। আইন, সংস্কৃতি ও প্রথা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু নৈতিকতার মৌলিক কাঠামো একই থেকে গেছে। এই সার্বজনীনতা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়।
যদি নৈতিকতা কেবল সামাজিক চুক্তি বা বিবর্তনের ফল হতো, তবে তা কখনোই সার্বজনীন হতে পারত না। বিবর্তন শেখায় টিকে থাকার কৌশল, ন্যায়বোধ নয়। বিবর্তনের দৃষ্টিতে শক্তিশালী দুর্বলকে দমন করলে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের নৈতিক বোধ বলে—শক্তিশালী হলেও দুর্বলকে আঘাত করা অন্যায়। মানুষ এই নৈতিক বোধের জন্য নিজের সুবিধা, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়। ইতিহাস ভরা আছে এমন উদাহরণে।
এই বাস্তবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে—নৈতিকতার মানদণ্ড কোথা থেকে এলো? যদি ঈশ্বর না থাকেন, তবে নৈতিকতা হয়ে যায় আপেক্ষিক। যা এক সমাজে ন্যায়, অন্য সমাজে তা অন্যায় হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মানুষ কিছু কাজকে সর্বত্রই ভুল বলে জানে। এই “উচিত” ও “অনুচিত”-এর বোধ মানুষের তৈরি নয়; এটি তার ভেতরে প্রোথিত।
নৈতিক আইন মানেই একজন নৈতিক আইনদাতা। যেমন প্রাকৃতিক আইনের পেছনে আমরা বুদ্ধিমত্তার ছাপ দেখি, তেমনি নৈতিক আইনের পেছনেও এক পরম নৈতিক সত্তার উপস্থিতি যুক্তিসংগত। এই সত্তা কেবল শক্তিমান নন, তিনি ন্যায়পরায়ণ। তাঁর কাছ থেকেই মানুষের অন্তরে ন্যায়বোধের আলো জ্বলে ওঠে।
মানুষের নৈতিক অভিজ্ঞতা কেবল নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত অপরাধবোধ ও দায়বোধ। মানুষ ভুল করলে নিজেকে প্রশ্ন করে, অনুতপ্ত হয়। যদি নৈতিকতা কেবল সামাজিক চুক্তি হতো, তবে সমাজের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই অপরাধবোধের প্রয়োজন থাকত না। কিন্তু মানুষ একা থাকলেও নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এই অন্তর্গত বিচারক মানুষের তৈরি নয়; এটি তার ভেতরে আরোপিত।
চেতনা ও নৈতিকতার পাশাপাশি মানুষের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো অর্থের অনুসন্ধান। মানুষ শুধু বাঁচতে চায় না, সে জানতে চায় কেন বাঁচছে। সে জানতে চায় তার জীবনের উদ্দেশ্য কী। সুখ, দুঃখ, সাফল্য, ব্যর্থতা—সবকিছুকে সে অর্থের কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করতে চায়। যদি জীবন নিছক দুর্ঘটনা হতো, তবে এই অর্থের অনুসন্ধান অর্থহীন হতো। কিন্তু মানুষ জানে—তার অস্তিত্বের অর্থ আছে, যদিও সে সবসময় তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে না।
এই অর্থের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে ধর্ম, দর্শন, শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টি করতে প্ররোচিত করেছে। মানুষ গান গেয়েছে, কবিতা লিখেছে, মন্দির-মসজিদ-গির্জা তৈরি করেছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করেছে। এই অভিন্ন প্রবণতা কোনো বিচ্ছিন্ন সামাজিক অভ্যাস নয়; এটি মানবস্বভাবের গভীরে প্রোথিত। এই স্বভাব নির্দেশ করে—মানুষ এমন কিছুর সন্ধান করে, যা বস্তুজগতের সীমা অতিক্রম করে।
এখানেই আমরা বুঝতে পারি—মানুষ কেবল মহাবিশ্বের একটি অংশ নয়, সে মহাবিশ্বের সঙ্গে সংলাপ করতে পারে। সে নিয়ম আবিষ্কার করে, ন্যায় নিয়ে ভাবতে পারে, অর্থ খুঁজতে পারে। এই ক্ষমতাগুলো তাকে এমন এক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে, যা জড় জগতের বাইরে। এই বাস্তবতা সেই পরম সত্তারই প্রতিফলন, যিনি মানুষকে প্রশ্ন করার যোগ্য করে সৃষ্টি করেছেন।
এই অংশে আমরা দেখলাম—মানবচেতনা, নৈতিকতা ও অর্থের অনুসন্ধান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একসঙ্গে মিলে একটি সুসংগত সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। এই সত্য হলো—মানুষ কেবল পদার্থের সমষ্টি নয়। সে এক সচেতন, নৈতিক ও অর্থঅন্বেষী সত্তা, যার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা কেবল বস্তুজগতের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়।
এই অনুসন্ধান এখানেও শেষ হয় না। এখনও বাকি আছে নিয়ম, তথ্য, ইতিহাস ও মানবঅভিজ্ঞতার আরও গভীর স্তর।
মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম নকশা, মানবচেতনার গভীরতা ও নৈতিকতার সার্বজনীনতা আমাদের এমন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়, যেখানে বস্তুজগতের ব্যাখ্যা আর যথেষ্ট থাকে না। কিন্তু অনুসন্ধান এখানেই থামে না। কারণ মানুষ শুধু চেতনা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে না, সে প্রশ্ন করে নিয়ম নিয়ে, তথ্য নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে এবং নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই প্রশ্নগুলো একত্রে আমাদের অস্তিত্বের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায়, যেখানে সিদ্ধান্ত আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
প্রথমেই আসে প্রকৃতির নিয়মের প্রশ্ন। এই মহাবিশ্ব বিশৃঙ্খল নয়। এটি নিয়মে বাঁধা। প্রতিটি স্তরে আমরা নিয়ম দেখতে পাই—পরমাণুর ভেতর থেকে শুরু করে গ্যালাক্সির গতিপথ পর্যন্ত। আপেল গাছ থেকে পড়ে, আগুন জ্বলে, আলো নির্দিষ্ট গতিতে চলে, শক্তি নির্দিষ্ট নিয়মে রূপান্তরিত হয়। এই নিয়মগুলো কখনো ব্যতিক্রম করে না। প্রশ্ন হলো—কেন?
নিয়ম মানেই আইন। আর আইন নিজে নিজে সৃষ্টি হয় না। আইন সবসময়ই আরোপিত হয়। প্রকৃতি কোনো সচেতন সত্তা নয় যে সে নিজে নিয়ম বানাবে এবং নিজে তা মানবে। তবু প্রকৃতি অটলভাবে নিয়ম মানে। এই বাস্তবতা আমাদের যুক্তিকে আবারও সেই একই সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়—এই নিয়মগুলোর পেছনে এমন এক সত্তা আছেন, যিনি নিয়ম আরোপ করেছেন। এই সত্তা নিয়মের অধীন নন, বরং নিয়ম তাঁর অধীন।
বিজ্ঞানীরা এই নিয়মগুলো আবিষ্কার করেন, সৃষ্টি করেন না। নিউটন মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করেননি, আইনস্টাইন স্থান–কালের গঠন বানাননি। তাঁরা কেবল সেই নিয়মগুলো উন্মোচন করেছেন, যা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। এই বিদ্যমান নিয়মগুলো এমনভাবে গঠিত, যেন সেগুলো বোঝার জন্যই মানুষের বুদ্ধিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। মানুষের গণিত ও যুক্তি যেন মহাবিশ্বের গাণিতিক কাঠামোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলে। এই সামঞ্জস্য কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়।
এরপর আসে তথ্যের প্রশ্ন। আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে গভীর আবিষ্কারগুলোর একটি হলো—জীবনের ভিত্তি তথ্য। DNA কোনো সাধারণ রাসায়নিক নয়। এটি একটি কোড। তিন বিলিয়ন বর্ণের একটি জেনেটিক গ্রন্থ, যেখানে জীবের গঠন, বৃদ্ধি ও কার্যকারিতার সমস্ত নির্দেশনা সংরক্ষিত। এখানে তথ্য আছে, ভাষা আছে, নির্দেশ আছে। তথ্য কখনোই নিজে নিজে জন্মায় না। এলোমেলো প্রক্রিয়া থেকে কখনো অর্থবহ কোড তৈরি হয় না।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এটি খুব সহজেই বুঝি। কোনো বই দেখলে আমরা কখনো ভাবি না—কালি আর কাগজ দুর্ঘটনাবশত একত্রিত হয়ে এই অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করেছে। কোনো সফটওয়্যার দেখলে আমরা ধরে নিই—এর পেছনে একজন প্রোগ্রামার আছে। তাহলে DNA-এর মতো অসীমভাবে জটিল ও কার্যকর কোডের ক্ষেত্রে এই যুক্তি অস্বীকার করা হবে কেন? কোড মানেই কোডার। তথ্য মানেই তথ্যদাতা।
এখানে কেউ কেউ আবার বিবর্তনের কথা বলেন। কিন্তু বিবর্তন তথ্য ব্যাখ্যা করে না, বরং বিদ্যমান তথ্যের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করে। বিবর্তনের জন্য তথ্য আগে থেকেই থাকতে হয়। প্রশ্নটি তাই থেকেই যায়—এই মৌলিক তথ্য এল কোথা থেকে? এই প্রশ্নের কোনো বস্তুবাদী উত্তর আজ পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এরপর আসে মানুষের অভিজ্ঞতার প্রশ্ন। ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, যা বস্তুজগতের সীমার মধ্যে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। দোয়া কবুল হওয়া, বিপদে অপ্রত্যাশিত উদ্ধার, গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা—এসব ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও যুগে আশ্চর্যজনকভাবে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো কেবল ব্যক্তিগত কল্পনা হলে এমন সার্বজনীনতা দেখা যেত না।
মানুষ প্রার্থনা করে। সে এমন এক সত্তার দিকে মুখ ফেরায়, যাকে সে দেখতে পায় না, কিন্তু অনুভব করে। এই প্রার্থনার প্রবণতা কোনো সামাজিক আবিষ্কার নয়; এটি মানবস্বভাবের গভীরে প্রোথিত। মানুষ দুঃখে, বিপদে, একাকিত্বে স্বাভাবিকভাবেই সেই পরম সত্তার দিকে ফিরে যায়। এই প্রবণতা নির্দেশ করে—মানুষ এমন কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক অনুভব করে, যা বস্তুজগতের বাইরে।
এখানে এসে নাস্তিকেরা একটি পুরোনো আপত্তি তোলেন—যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে পৃথিবীতে এত দুঃখ কেন? এই প্রশ্নটি আবেগঘন, কিন্তু যুক্তিগতভাবে এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। দুঃখ–কষ্টের অস্তিত্ব আর ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরবিরোধী নয়। বরং দুঃখের ধারণাটিই নৈতিকতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আমরা দুঃখকে দুঃখ বলি, কারণ আমরা জানি—এটি হওয়া উচিত নয়। এই “উচিত নয়” বোধই নৈতিক মানদণ্ডের প্রমাণ।
মানুষকে যদি স্বাধীন ইচ্ছা দেওয়া না হতো, তবে নৈতিকতা অর্থহীন হয়ে যেত। স্বাধীন ইচ্ছা মানেই ভুল করার সম্ভাবনা। মানুষ ভুল করে, অন্যায় করে—এবং তার ফল ভোগ করে। দুঃখ অনেক সময় মানুষের নিজের কর্মের ফল, অনেক সময় পরীক্ষার অংশ, আবার অনেক সময় মানুষের বোধ ও সহানুভূতিকে জাগ্রত করার মাধ্যম। ঈশ্বর মানুষকে রোবট বানাননি। তিনি মানুষকে নৈতিক সত্তা বানিয়েছেন।
এছাড়া মানুষ যে দুঃখকে অন্যায় বলে চিহ্নিত করে, সেটিই প্রমাণ করে—মানুষের ভেতরে ন্যায়বোধ আছে। আর এই ন্যায়বোধ কোনো অন্ধ প্রকৃতির দান হতে পারে না। প্রকৃতি নিরপেক্ষ, কিন্তু মানুষ ন্যায়বিচার চায়। এই আকাঙ্ক্ষা নির্দেশ করে—চূড়ান্ত ন্যায়বিচারের একটি উৎস আছে, যদিও এই পৃথিবীতে তার পূর্ণ প্রকাশ আমরা সবসময় দেখি না।
এখানেই পরকাল ও বিচারবোধের ধারণা যুক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি এই জীবনই সব হতো, তবে অনেক অন্যায়ের কোনো ন্যায্য পরিণতি থাকত না। কিন্তু মানুষ জানে—সব হিসাব এখানেই শেষ হয় না। এই অনুভূতি কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নয়; এটি ন্যায়ের প্রতি মানুষের গভীর আস্থার প্রকাশ।
বিজ্ঞানকে প্রায়ই ঈশ্বরবাদের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু এই বিরোধ কৃত্রিম। বিজ্ঞান আমাদের বলে—কীভাবে ঘটনা ঘটে। ঈশ্বরবাদ আমাদের বলে—কেন ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞান আমাদের যন্ত্র দেয়, ঈশ্বরবাদ আমাদের অর্থ দেয়। বিজ্ঞান প্রেমের রাসায়নিক বিশ্লেষণ দিতে পারে, কিন্তু প্রেমের মানে দিতে পারে না। বিজ্ঞান চেতনার কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু চেতনার অভিজ্ঞতা দিতে পারে না। ঈশ্বরও তেমনই—তিনি পরীক্ষাগারে ধরা পড়েন না, কিন্তু বাস্তবতায় প্রতিফলিত হন।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি আবার ফিরে আসে সেই প্রথম বিন্দুতে—কেন কিছু আছে, কিছু না থাকার বদলে? শূন্যতা কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। বিশৃঙ্খলা নিয়ম তৈরি করতে পারে না। জড় চেতনা জন্ম দিতে পারে না। তথ্য নিজে নিজে জন্মায় না। নৈতিকতা অন্ধ প্রক্রিয়ার ফল হতে পারে না। অর্থ উদ্দেশ্যহীনতা থেকে আসে না।
এই সব যুক্তি একত্রে একটি সুসংগত বাস্তবতার দিকে নির্দেশ করে। এই বাস্তবতা হলো—মহাবিশ্ব, জীবন, চেতনা, নৈতিকতা, নিয়ম ও তথ্য—সবকিছুর উৎস একটি পরম, চিরন্তন, বুদ্ধিমান ও ন্যায়পরায়ণ সত্তা। তিনি আছেন—এটি কোনো আবেগগত দাবি নয়, বরং যুক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী উপসংহার।
মানুষ তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকে, বিভিন্ন ভাষায় স্মরণ করে। কিন্তু সত্য একটাই—এই মহাবিশ্ব অকারণ নয়, উদ্দেশ্যহীন নয়, অর্থহীন নয়। এর পেছনে একটি চূড়ান্ত অর্থ আছে। আর সেই অর্থের উৎস সেই সত্তা, যাঁকে আমরা সৃষ্টিকর্তা বলে ডাকি।
নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা




