লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
বর্তমান যুগে গায়ের মুকাল্লিদ ও আহনাফ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত (দেওবন্দ) এর মধ্যে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এমন একটি মারাত্মক মতভেদী মাসআলা; যার উপর ভিত্তি করে গায়ের মুকাল্লিদরা উলামায়ে দেওবন্দকে কাফের ও মুশরিক বলে থাকে। যেমন পাকিস্তানের কুখ্যাত গায়ের মুকাল্লিদ মৌলবী তালিবুর রহমান যাইদী ‘দেওবন্দীয়াত তারিখ ও আকায়েদ’ নামক কিতাবে আহনাফ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত দেওবন্দকে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্টাতা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) সহ তাঁর প্রতিটি উস্তাদ এবং শিক্ষককে মাসআলা ওয়াহসাতুল ওজুদ মান্য করার জন্য কট্টর মুশরিক বলে গালিগালাজ করেছে। উক্ত কিতাবটিকে ‘শেরেকপুর্ণ দেওবন্দীয়াত নাম দিয়ে বঙ্গানুবাদ করেছে’ জয়নাল আবেদীন সরকার মুহাম্মাদী নামে এক বেয়াদব গায়ের মুকাল্লিদ। বর্তমানে সে দেওবন্দীদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ।
প্রকৃত পক্ষে ওয়াহদাতুল ওজুদ কোন শিরকিয়া আকিদা নয় যার উপর ভিত্তি করে উলামায়ে দেওবন্দকে মুশরিক ও কাফের বলা যেতে পারে। আর যারা ওয়াহদাতুল ওজুদের উপর ভিত্তি করে উলামায়ে দেওবন্দকে মুশরিক ও কাফের বলে সেটা তাদের ওহাহদাতুল ওজুদের সঠিক সংজ্ঞা না জানারই পরিণাম। ওহাহদাতুল ওজুদের সঠিক সংজ্ঞা সঠিক সংজ্ঞা জানলে এর উপর ভিত্তি করে কোনক্রমেই উলামায়ে দেওবন্দকে মুশরিক ও কাফের বলা সম্ভব নয়।
ওয়াহদাতুল ওজুদের সংজ্ঞা হল দুই প্রকার। একটি হল ওয়াহদাতুল ওজুদের সঠিক আকীদা অপরটি হল ওয়াহদাতুল ওজুদের ‘হুলুল’ বা ইত্তেহাদের আকীদা। ওয়াহদাতুল ওজুদের সঠি আকিদা পোষণ করা শিরক ও কুফরী নয় কিন্তু ওহাহদাতুল ওজুদের ‘হুলুল’ বা ইত্তেহাদের আকিদা পোষণ করা সম্পূর্ন কুফরী যার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এই হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা বহুঈশ্বরবাদী হিন্দুরা পোষণ করে। ওহাহদাতুল ওজুদের হুলুল কাকিদা হল বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই অর্থাৎ স্রষ্টা ও সৃষ্টিকর্তা এক ও অভিন্ন। যেমন হিন্দুদের ‘ঔঁ জয়িষ্ণু হিন্দু’ পুস্তকে স্বামী বেদানন্দ লিখেছেন, “ইসলাম ধর্মের সিদ্ধান্ত ভগবান তাঁর সৃষ্টি জগৎ থেকে পৃথক। কিন্তু বীর্যবান হিন্দুসাধক তপস্যার বলে বিশ্ববৈচিত্রের অন্তরালে অবস্থিত ঐক্যকে আবিস্কার পুর্বক সিদ্ধান্ত দিলেন-বিশ্বনাথ ও বিশ্বজগৎ এক অভিন্ন, যতো বা ইমানি বূতান্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎবিশস্তি তদব্রম্ভ। ভগবান হইতে ইহার উৎপ্ততি, ভগবানেই স্তিতি, ভগবানের মধ্যে ইহা বিলয়প্রাপ্ত হইয়াছে। হিন্দু ধর্ম ভিন্ন আর অন্য কোন ধর্মে এই সাধনার বীর্য্য, ভাব ও জ্ঞানের উচ্চতা, এরুপ উচ্চতম উপলব্ধির কল্পনাও দেখা যায় না, সাধনা তো দুরের কথা।” (ঔঁ জয়িষ্ণু হিন্দু, পৃষ্ঠা-১৮)
বলাবাহুল্য হিন্দুধর্মে বিশ্ব ও বিশ্বনাথ এক ও অভিন্ন। এককথায় হিন্দু ধর্মের মতে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার মাধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাদের মতে গাছপালা, নদীনালা, প্রভৃতি সমস্ত সৃষ্টি ও মহান সৃষ্টিকর্তা একই জিনিস। এটা হল ওহাহদাতুল ওজুদের হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা। এরকম আকিদা পোষণকারীরা মুসলমান নয়। তারা মুশরিক। কেননা ইসলাম ধর্মে সৃষ্টি ও মহান সৃষ্টিকর্তা আলাদা। মহান আল্লাহব সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ অনন্ত ও অসীম আর সৃষ্টি তা নয়। আল্লাহর আকার ও আয়তন বলে কিছু নেই। মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান কিন্তু সৃষ্টি সর্বত্র বিরাজমান নয়। সুতরাং এককথায় ইসলামে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা কোনদিনই এক নয়। এটা হল ওহাহদাতুল ওজুদের হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা। আর ওহাহদাতুল ওজুদের হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা গায়ের মুকাল্লিদরা দেওবন্দীদের উপর ফিট করে কাফের ও মুশরিক বলে ফতোয়া দেয়। এটা হল তাদের জালিয়াতির একটি নিকৃষ্ট নমূনা। কারন, দেওবন্দীরা ওহাহদাতুল ওজুদের হুলুল বা ইত্তেহাদের আকিদা মানে না। তারা ওহাহদাতুল ওজুদের সঠিক আকিদা মানে। আর ওহাহদাতুল ওজুদের সঠিক আকিদা যে কি তা পরে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ কেবলমাত্র দেওবন্দীরাই মানে না বরং গায়ের মুকাল্লিদদের বড় বড় আকাবির উলামায়ে কেরামরাও মান্য করতেন। যেমন, নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী, আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী, ইমাম শাওকানী প্রভৃতিরাও মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাঁরা মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের উপর যেসব অভিযোগ আপত্তি করা হয় তার দাঁতভাঙ্গা জবাবও দিয়েছেন, মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের স্বপক্ষে দুইমাস ধরে মুনাযারাও করেছেন এবং মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে এবং মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে শায়েখে আকবর, আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শন এবং খাতেমুল বিলায়াতুল মুহাম্মাদীয়া উপাধীতে ভুষিত করেছেন। আর আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের উপর ও শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর উপর যে অভিযোগ করেছেন তার জবাবও হায়ের মুকাল্লিদরাই দিয়েছেন।
এখন বর্তমানে তালিবুর রহমান যাইদী, তওসীফুর রহমান যাইদী, মিরাজ রাব্বানী, মতিউর রহমান মাদানী প্রভৃতিরা যে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ মান্য করার জন্য দেওবন্দীদেরকে মুশরিক ও কাফের বলেন তাদের উচিৎ নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী, আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী, ইমাম শাওকানী প্রভৃতিদেরকেও কাফের ও মুশরিক ফতোয়া দেওয়া। কারন, তাঁরাও ওয়াহদাতুল ওজুদ মানতেন এবং সারাজীবন ওয়াহদাতুল ওজুদের উপর অভিযোগের খন্ডন করেছেন। আমি গায়ের মুকাল্লিদদেরকে আহ্বান করে বলব, তাদের হিম্মৎ আছে নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী, আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান হায়দ্রাবাদী, ইমাম শাওকানী প্রভৃতিদেরকেও কাফের ও মুশরিক ফতোয়া দেওয়ার? গায়ের মুকাল্লিদরা তা করবে না কারন, তাঁরা সকলেই তাঁদের আকিদার লোক ছিলেন। কোন আকিদা দেওবন্দী আলেম রাখলে সেটা শিরক ও কুফরী হয়ে যায় আর ওই একই আকিদা গায়ের মুকাল্লিদ আলেমরা রাখলে তাঁরা সেটাকে মায়ের দুধ মনে করে হজম করে যান। সেখানে কোন ফতোয়াবাজী থাকে না। এই হল গায়ের মুকাল্লিদদের অবস্থা। সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবর্ষের দিকে লক্ষ্য করে সঠিক কথাই বলেছিলেন,
“সত্য সেলুকস! কি বিচিত্র এই দেশ।”
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ কি?
প্রথমেই জেনে রাখা উচিৎ মাসআলা ওয়াহদাতুল উজুদ কি যার উপর ভিত্তি করে আহলে হাদীস নামধারী গায়ের মুকাল্লিদ বা লা মাযহাবীরা উলামায়ে দেওবন্দকে কাফের ও মুশরিক বলে থাকে। আসলে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের বিরোধীতা করা প্রকৃতপক্ষে তার সঠিক সংজ্ঞা না জানারই ফল।
মাসআলা অয়াহদাতুল ওজুদ এর সংজ্ঞা বলার আগে জেনে রাখা উচিৎ যে ওয়াহদাতুল ওজুদ কোন আকিদা নয় এটা একধরনের মাসআলা। সেজন্য এই ওয়াহদাতুল ওজুদের ব্যাপারে আমাদের কোন আকিদার গ্রন্থে আলোচনা করা হয়নি। এর সম্পর্কে আমাদের মাসআলার গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। সেজন্য এটাকে আকিদা ওয়াহদাতুল ওজুদ না বলে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ বলাই সঠিক।
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের সঠিক সংজ্ঞা আল্লামা মুফতী জাস্টিস তাকি উসমানী মুদ্দযিল্লুহু (চীফ জাষ্টিস, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট, শরীয়াত বিভাগ) তাঁর ‘ফাতাওয়া উসমানী’ গ্রন্থে, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) ‘তালিমুদ্দীন’ কিতাবে দিয়েছেন। মুফতী তাকি উসমানী (মুদ্দাযিল্লুহু) লিখেছেন,
অর্থাৎ “ওয়াহদাতুল অজুদের সঠিক অর্থ হল এই যে এই বিশ্ব আসল এবং পরিপূর্ণ অস্তিত্ব কেবলমাত্র মহান আল্লাহ তাআলারই। তিনি ছাড়া সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব ধ্বংসশীল এবং অসম্পুর্ণ। তার কারণ এটাই যে সেসবগুলি একদিন বিলুপ্ত অর্থাৎ ফানা হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত’ প্রত্যেক জিনিসই মহান আল্লাহ তাআলার মোহতাজ অর্থাৎ মুখাপেক্ষী। সুতরাং যত জিনিসপত্র আমরা দেখতে পায় যদিও তাদের অস্তিত্ব আছে কিন্তু মহান আল্লাহর অস্তিত্বের মুকাবিলায় তাদের কোন মুল্যই নেই। কেননা তারা ধ্বংসশীল। এর একটি উদাহরণ হল, যেরকম দিনের বেলায় আকাশে সুর্য থাকার জন্য অন্যান্য নক্ষত্র দেখা যায় না। যদিও তারা আকাশে আছে কিন্তু সুর্যের উপস্থিতি এবংভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে সেই নক্ষত্রগুলি দেখা যায় না। ঠিক সেইরকম যে ব্যাক্তিকে আল্লাহ তাআলা আসল পরচিতি দান করেছেন তিনি যখন সেই বিশ্বে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের সান্যিদ্ধ লাভ করে তখন তাঁর নিক্ট সমস্ত অস্তিত্ব মূল্যহীন হয়ে যায় যা হযরত মজজুব রহমাতুল্লাহ আলাইহি (শায়খ ইবনে আরাবী) বলেছেন।
‘যব মেহের নুমাইয়া হো আসর ছুপ গয়ে সিতারে
তো মুঝকো ভরী বজম মে তনহা নযর আয়া।’
এটাই হল ওয়াহদাতুল ওজুদের পরিস্কার এবং সঠিক অর্থ। কিন্তু এর যা দার্শনিক অর্থ করা হয়েছেতা বড়ই ভয়ানক। আর এর মধ্যে যখন হুলুল চলে আসে তখন এই আকিদার সীমা কুফর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেজন্য একজন মুসলমানের এইরকম পঋস্কার আকিদা রাখা উচিৎ যে ব্রহ্মান্ডে আসল এবং পরিপূর্ণ অস্তিত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলারই। বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ এবং ধ্বংসশীল ।” (ফাতাওয়া উসমানী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৬)
স্কেন পেজঃ
অপরদিকে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) ওয়াহদাতুল ওজুদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “একথা সুস্পষ্ট যে, যাবতীয় গুনাবলী এবং ক্ষমতা প্রকৃত ভাবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার। তবে সৃষ্টজীবের ভিতরে যা কিছু ক্ষমতা বা গুন পরিলক্ষিত হয় সেগুলি তাদের নিজস্ব নয়, অন্যের নিকট হতে ধার করা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা দান করেছেন বলে তারা পেয়েছে এবং পুন তারা রক্ষা করেছেন বলে বিদ্যমান আছে। যে জিনিসেওর অস্তিত্ব এরুপ ধার করা অর্থাৎ নিজস্ব নয়, অন্যের নিকট নিকট হতে পাওয়া গেছে,তার অস্তিত্বকে পরিভাষায় ‘ওজুদে যিল্লি’ বা ‘ওজুদে আরেযী’ বলে । যিল্লি অর্থ ছায়া। অর্থাৎ ছায়ার মতো অস্থায়ী ও পরমুখাপেক্ষী ওজুদ। কিন্তু এখানে ছায়া অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ পাক কোন শরীরবিশিষ্ট জীব, আমরা তার ছায়া স্বরুপ। যিল্লির অর্থ ছায়া বটে, কিন্তু এই স্থানে এইরুপ অর্থ গ্রহন করা সম্পূর্ণ ভুল। এখানকার অর্থ এই যে, তাঁর দানে এবং কৃপায় আমরা ওজুদ (অস্তিত্ব) পেয়েছি। তাঁর অনুগ্রহে বর্তমান আছি, ভবিষ্যতেও তিনি ইচ্ছা করলে রাখতে পারেন বা যখন ইচ্ছা করেন বিনাক্লেশে কাল বিলম্ব না করে ধ্বংস করে দিতে পারেন। যেমন আমাদের ভাষায়ও সচরাচর বলা হয় যে, কোন গরীব লোক হয়তো কোন ধনীর আশ্রয়ে বাস করে। সে বলে, ‘আমি তো হুযুরেরই ছায়ায় বাস করি।’ এর অর্থ ছায়া নয় আশ্রয়। যখন মাখলুকের এই আরেযী ওজুদকে হিসাবে না ধরা হয়, তখন একমাত্র আল্লাহরই ওজুদ (অস্তিত্ব) থাকে। একেই ওয়াহদাতুল ওজুদ বা ‘হামাউস্ত’ (তিনিই সব) বা লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ব্যাতীত অন্য কারো অস্তিত্ব নেই) বলে। অতএব তিনিই সব এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ, পশু, বৃক্ষ, পর্বত সবই খোদা বা খোদার বিশ্লেষণ ও অংশ বের হয়ে এইসব হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহি মিন যালিক) এই অর্থ সম্পূর্ণ ভুল। এই অর্থ নিয়েই অনেক লোক কাফির ও বুতপরস্ত হয়ে গেছে। শুদ্ধ অর্থ এই যে, মানুষ, পশু পর্বত, ইত্যাদীর অস্তিত্ব আসল নিজস্ব অস্তিতক নয়। আল্লাহর দান করা অস্থায়ী মাত্র।” (তালিমুদ্দীন, দ্বিতীয় খন্ড)
এই হল অয়াহদাতুল ওজুদ এর সংজ্ঞা। এর মধ্যে কোন শিরক বা কুফর নেই যার উপর ভিত্তি করে উলামায়ে দেওবন্দকে কাফের বা মুশরিক বলা যাবে। অপরদিকে আহলে হাদীসদের যুবাইর আলী যাই কাজ্জাব গায়ের মুকাল্লিদ লিখেছে,
অর্থাৎ “দেওবন্দীরা সেই ওয়াহদাতুল অজুদকে মানে যাতে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি, আবিদ এবং মাবুদ, খুদা এবং বান্দার মধ্যে পার্থক্য মিটিয়ে দেওয়া হয়।” (বিদআতী কে পিছে নামায কা হুকুম, পৃষ্টা-১৬)
স্ক্রীন শট
(পাকিস্তানের আলবানী নামে খ্যাত জুবাইর আলী যাঈ তাঁর কিতাবে মহান আল্লাহ পাককে খুদা বলেছেন অথচ আমাদের পশ্চিম বঙ্গের লা মাযহাবীরা আল্লাহ্ পাককে খুদা মানতে অস্বীকার করে থাকেন। লা মাযহাবীদের খ্যাতনামা ইমাম আবু তাহের বর্ধ্বমানী সাহেব তাঁর বেশ কিছু কিতাবে আল্লাহকে খুদা বলার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। এখন লা মাযহাবীরা জুবাইর আলী যাঈকে কি ফতোয়া দিবেন। প্রায় প্রতি বছর লা মাযহাবীদের আকিদা, মাসআলা ও নামকরণের পরিবর্তন হয়। এটা বিদআতীদের নিদর্শন।)
অপর দিকে পশ্চিম বঙ্গের প্রথম শ্রেনীর দাজ্জাল মার্কা বক্তা মতিউর রহমান মাদানী তার বক্তৃতার বলেছে,
“প্রথম আকিদা যে আকিদা যে আকিদাটি ইসলামী আকিদা নয়, যে আকিদা শুধু বিদয়াতী আকিদা নয়, বরং কুফুরী, বিদয়াতী আকিদা। এই আকিদা মওজুদ রয়েছে, বিদ্যমান রয়েছে দেওবন্দীদের মধ্যে; সেই আকিদা হচ্ছে ওয়াহদাতুল উজুদের আকিদা। আরবীতে তাকে বলা হয়, ওয়াহদাতুল উজুদ। ওয়াহদা ওয়াহিদ থেকে। এক হয়ে যাওয়া। উজুদ মানে হচ্ছে অসিত্ব। পৃথিবীতে যা কিছু আছে আসমান–জমিন, আরশ কুরসী, আল্লাহ পাক, খালেক মাখলুক, আল্লাহর সৃষ্টিজগত, সৃষ্টিজগতের মধ্যে আবার যাদের জীবন আছে যেমন মানুষ জীন, পশু–প্রাণি, যতো রকমের হাইয়ান রয়েছে, জীবজন্তু রয়েছে, পাখি রয়েছে, ইত্যাদি, সমস্ত কিছু, এগুলো হচ্ছে অস্তিত্ব–উজুদ। সমস্ত সৃষ্টি ও স্রষ্টার অস্তিত্ব হচ্ছে, শুধু সৃষ্টির অস্তিত্ব নয়, সমস্ত সৃষ্টি ও স্রষ্টা আল্লাহর অস্তিত্ব হচ্ছে ওয়াহদা এক। এ হচ্ছে ওয়াহদাতুল উজুদের শাব্দিক অর্থ করলাম, আর এটি হচ্ছে তার ডিটেইলস বা বিস্তারিত। যা সংক্ষেপে আপনাদেরকে বোঝানোর জন্য বললাম। ওয়াহদাতুল উজদু মানে খালেক আর মাখলুকের অস্তিত্ব আলাদা আলাদা পৃথক পৃথক নয়, আল্লাহ এবং মাখলুক সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব আলাদা আলাদা পৃথক পৃথক নয়, বরং সব কিছুই হচ্ছে এক। সব কিছুই এক। অর্থাৎ যে কোন বস্তু দেখছেন, যে কোন মানুষকে দেখছেন, যে কোন প্রাণীকে দেখছেন, তাতেই আল্লাহ আছে। এ হচ্ছে ওয়াহদাতুল উজুদের আকিদা। ওয়াহদাতুল উজুদের আকিদায় এসে বেরলবী দেওবন্দী সবাই এসে এক সঙ্গমে সাক্ষাৎ করেছে। মিলে গেছে এসে। বোঝেন তো সঙ্গম? নাহ? দু’টো রাস্তা এসে এক জায়গায় এসে মিলে গেলো। দুইটি ফেরকা তো বেরিয়ে গেছে কিন্তু এখানে এসে এরা মিলে গেছে। বেরেলভীরাও বলে, ওয়াহদাতুল উজুদের প্রতি তাদের ইমান রয়েছে, আর দেওবন্দীদের কিতাবাদীতে ভরপুর রয়েছে, ওয়াহদাতুল উজুদ। ” (ইউটিউব থেকে সংগৃহীত)
দেখুন কতবড় মিত্যাচার। জুবাইর আলী যাই কাজ্জাব ও মতিউর রহমান মাদানী দাজ্জাল দুজনেই বলেছে যে উলামায়ে দেওবন্দ সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক মনে করতেন। অথচ এটা সম্পুর্ন মিথ্যা এবং ধোকাবাজী কথা কারণ দেওবন্দীরা সৃষ্টি এবং স্রষ্টা, আবিদ এবং মাবুদ, খোদা এবং বান্দাকে এক বলে মনে করে না। এরকম ধরনের কথা আমাদের কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ করা নেই। এটা হল ওয়াহ্দাতুল ওজুদের হুলুল বা ইত্তেহাদের আকীদা যা সম্পুর্ন কুফরী। আর এরকম আকিদা পোষণকারীরাও কাফের। কিন্তু ওয়াহ্দাতুল ওজুদের সঠিক আকিদা পোষন কারীরা মুশরিক ও কাফের নয়। কেননা এতে এই নিখিল বিশ্বে একমাত্র মহান আল্লাহর অস্তুত্বকে একমাত্র পরিপুর্ণ অস্তিত্ব বলে স্বীকার করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর মুকাবিলায় সমস্ত কিছুর অস্তিত্বকে হীন ও নগণ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী (রহঃ) লিখেছেন,
“আল্লাহ সর্ববৃহৎ ও সর্বশক্তিমান, তাঁর কাছে তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে গোলামীর মত। যেমন একজন চামারের মাথায় বাদশাহী টুপি পরিয়ে দেওয়া হল, এর থেকে বড় বেইনসাফি (অবিবেচনা) আর কি হতে পারে? দৃঢ়তার সাথে মান্য কর ব্যাক্তি যত বড়ই হোক অথবা ফিরিস্তা হোক না কেন তাঁর মর্যাদা মহান আল্লাহর মর্যাদার সম্মুখে চামার অপেক্ষা নিকৃষ্টতম।” (তাকবিয়াতুল ইমান, পৃষ্ঠা-৩৪)
স্কেন পেজঃ
এখানে শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী (রহঃ) মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ মান্য করে সমস্ত সৃষ্টিকে মহান আল্লাহর মর্যাদার সম্মুখে চামার অপেক্ষা নিকৃষ্ট বলেছেন। অপর দিকে আল্লামা যুরকানী (রহঃ) লিখেছেন,
“তাসাউফ তো এরই নাম যে দিল থেকে আল্লাহর মাহাত্মের কাছে সব কিছুকে তুচ্ছ, নিকৃষ্ট ভাববে। (অবশ্য এটা তার মাহাত্মের তুল নায় বটে) নতুবা নবীর মত কোন (মুকার্রাব) ব্যক্তিকে বান্দাকে নিকৃষ্ট ভাবা কুফর।” (মাওহেবে লাদুন্নিয়া, পৃষ্ঠা-১০২)
হযরত শেহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহঃ) লিখেছেন,
“সারা সৃষ্টি জগৎ, ফেরেস্তা, জিন্ন, মানুষ, আরশ, কুর্শী, লওহ, কলম, জমীন-আসমান ইত্যাদি মহামহীম আল্লাহর বুযর্গী ও মাহাত্মের তুলনায় সরসের দানার থেকেও তুচ্ছ, নগন্য।” (রওযুর রায়াহীন কবীর)
হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহঃ) লিখেছেন,
“কোন ব্যাক্তির ঈমান ততক্ষন পুর্ণ পরিনত হবে না যতক্ষন না সকল মানুষ তার দৃষ্টিতে (আল্লাহর মাহাত্মের মুকাবিলায়) উটের পায়খানার ন্যায় তুচ্ছ, নিকৃষ্ট প্রতিপন্ন না হয়।” (ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ, পৃষ্ঠা-৬১)
অপর দিকে সহীহ বুখারী শরীফ ও অন্যান্য হাদীস শরীফের কিতাবে বর্নিত আছে যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম হযরত খিজির আলাইহিস সালাম এর সঙ্গে নৌকায় চেপে সমুদ্রের সফর করছিলেন তখন একটি পাখি এল এবং সে একবার অথবা দুইবার সমুদ্রের মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল তখন হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে হযরত খিজির আলাইহিস সালাম বললেন,
‘আমার এবং আপনার জ্ঞান আল্লাহর মুকাবিলায় ঠিক সেই রকম যেরকম এই পাখি সমুদ্র থেকে পানি তুলতে পেরেছ’।”
সুতরাং সমস্ত বুযুর্গানে দ্বীনরা সমস্ত সৃষ্টজগৎ মহান আল্লাহর অস্তিত্ত্বের মুকাবিলায় সমস্ত সৃষ্টি যথা নবী, ওলী, জ্বিন, ফেরেস্তা হীন নগন্য ও তুচ্ছ, আল্লাহর অস্তিত্ত্বের মুকাবিলায় তাদের মুল্য একেবারেই ক্ষুদ্র। কেননা মহান আল্লাহর ক্ষমতা এমনই যে তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষনিকের মধ্যে ‘কুন’ শব্দ দ্বারা কোটি কোটি নবী, ওলী, জ্বিন, ফিরিস্তা, জিব্রাইল এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সমকক্ষ সৃষ্টি করতে করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছায় এক ফুৎকারে আরশ থেকে জমীন পর্যন্ত সবই ধ্বংস করে দ্বিতীয় জগৎ সৃষ্টি করে দিতেও পারেন। তাঁর ইচ্ছায় সব কিছুই সৃষ্টি হয়ে যায়, স্ত্রীজাতি ও অন্যান্য কোন জিনিসেরই প্রয়োজন হয় না। যদি আদম আলাইহিস সালাম থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষ এবং জিন, ফিরিস্তা ও পয়গম্বরের মতো হয়ে যায় তাহলেও তার কারনে তাঁর রাজত্ত্বের মধ্যে কোনওরুপ সৌন্দর্য্য বর্ধিত হবেনা। আবার অনুওরূপ সবাই যদি শয়তান ও দাজ্জাল হয়ে যায় তাহলেও তার কারনে তাঁর রাজত্ত্বের কোনরূপ সৌন্দর্য্য কোনওরুপ ব্যাঘাত ঘটবে না। তিনি সর্বাবস্থায় সমস্ত বড়দের বড় এবং বাদশাহের বাদশাহ। তাঁর কেউ কোনরুপ ক্ষতিও করতে পারবে না আবার কিছু সৃষ্টিও করতে পারেনা। কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মহান আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দাগন! তোমাদের মধ্যে যত মানুষ ও জিন জন্মগ্রহণ করবে যদি সবাই তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ও আল্লাহ ভীরুর ন্যায় ধার্মিক ও আল্লাহভীরু হয়, তাহলে মনে রাখো যে আমার রাজত্ত্বে কোনওরুপ শ্রীবৃদ্ধি ঘটল না, অনুরুপভাবে সবাই যদি সর্বাপেক্ষা খোদাদ্রোহী হয় তাহলেও আমার রাজত্ত্বের কোন ও ত্রুটি ঘটবে বা।” (মুসলিম শরীফ)
ওয়াহদাতুল ওজুদ ও শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ)
ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা হলেন শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ)। শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) ছিলেন বিখ্যাত সুফী ‘মসনবী শরীফ’ এর রচয়িতা আল্লামা জালালুদ্দিন রুমী (রহঃ) এর এর সমসাময়িক। তিনি ১১৫৬ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের দক্ষিণ মরসীয়াতে জন্মগ্রহন করেন। সেখান থেকে সেভাইলে যান সেখানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। অ্যারিষ্টটলীয় দর্শনের বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার অ্যাভারোজ ইবনে রুশদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় কর্ভোভাতে। ইবনে রুশদ ইন্তেকাল করেন ১১৯৮ খ্রীষ্টয়াব্দে আল মারাসুসে। রুমীর জন্মের বছর ১২০৭ খ্রীষ্টাব্দে ইবনে আরাবী কায়রোর বিচারকদের হুমকিতে মক্কায় চলে যান। সেখানে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর আনাতোলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে কেনিয়াতে তাঁর সাক্ষাত হল সফর উদ্দিন কেনাবীর সাথে। যিনি ছিলেন তাঁর শিষ্যদের সব থেকে বিখ্যাত। তিনি ইন্তেকাল করে দামাস্কাসে ১২৪০ খ্রীষ্টাব্দে। রুমীর বয়স তখন তেত্রিস বছর। ইবনে আরাবী তাঁর পূর্ববর্তী সমস্ত সূফী মনসুর হাল্লাজ, বায়াজীদ বোস্তামী, ইমাম গাজ্জালীদের অনুসরন করেছিলেন। তাই তাঁরা সকলে ওয়াহদাতুল ওজুদ মানতেন। আর আল্লামা জালালুদ্দিন রুমী (রহঃ) যে ‘মসনবী শরীফ’ রচনা করেছিলেন তা ছিল ইবনে আরাবীর মতবাদের কাব্যরুপ। আল্লামা রুমী (রহঃ) ইবনে আরাবীর মতবাদের কাব্যরুপ দিয়েছিলেন। তাই ওয়াহদাতুল ওজুদ যদি শিরকিয়া ধারনা হয় তাহলে আহলে হাদীসদের উচিৎ মাওলানা রুমী, ইবনে আরাবী, ইবনে মনসুর হাল্লাজ, বায়াজীদ বোস্তামী, ইমাম গাজ্জালী প্রত্যেকেকেই কাফের ফতোয়া দেওয়া।
ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে গায়ের মুকাল্লিদদের ধারণা
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে দুই রকমের ধারণা পোষনকারী রয়েছেন। একটি দল তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছে এবং তাঁর প্রতি যিন্দীক হবার হুকুম লাগিয়েছেন অন্য দল তাঁকে শায়খে আকবর, আওলিয়াদের মাথার মুকুট, আরিফে রাব্বানী এবং কুব্বারে আওলিয়াদের মধ্যে গনণা করেছেন এবং তাঁকে ‘খাতেমুল বিলায়াতুল মুহাম্মাদীয়া’ বলে স্মরন করেন আর মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এবং ফিরআউনের ইমানের ব্যাপারে তাবীল পেশ করে থাকেন।
এই দুটি দলের মধ্যে প্রথম থেকেই মতভেদ চলে আসছে এবং আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) সর্বপ্রথম ইবনে আরাবী (রহঃ) এর আকিদা এবং ব্যাক্তিত্ত্বের উপর কঠিন হামলা করেন। বর্তমান যুগের গায়ের মুকাল্লিদ আমেমরাশায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাপারে সেই ধারনা রাখেন যা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর ছিল। গায়ের মুকাল্লিদরা শায়খ ইবনে আরাবী ওয়াহদাতুল ওজুদের কঠিন বিরোধী। অর্থাৎ গায়ের মুকাল্লিদরা যে ইবনে আরাবীর উপর কুফরের ফতোয়া দেয় তা ইবনে তাইমিয়ার তকলীদ করেই দেয়। এমনিতে তারা তকলীদের বিরোধীতা করে কিন্তু ইবনে আরাবী (রহঃ)কে কাফের বলাতে তারা ইবনে তাইমিয়ার কঠিন গোঁড়া মুকাল্লিদ।
এখানে আমাদের দুটি দলের মধ্যে কারা সঠিক বা এবং কারা ভুল তা বিচার করা নয় বরং আমাদের উদ্দেশ্য হল শায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাপারে গায়ের মুকাল্লিদ আকাবির আলেম উলামাদের ধারনা পরিস্পুট করা যে তাঁরা শায়েখের ব্যাপারে কি মতামত ব্যাপ্ত করেছেন। শায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাপারে গায়ের মুকাল্লিদদের ধারনা আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর ধারনা বিপরীত এবং পরস্পরবিরোধী। গায়ের মুকাল্লিদদের আকাবির আলেমরা শায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাপারে ভাল মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ)কে ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’, “আল বাহরুযযাখারা ফিল মাআরিফিল ইলাহিয়া’, ‘হুজ্জাতুল্লাহিজ জাহিরা আয়াতিহিল বাহেরা’ উপাধিতে ভুষিত করেছেন।
শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবীর আকিদা
মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবী সাহেব গায়ের মুকাল্লিদদের আকাবির আলেম ছিলেন এবং তাঁকে শায়খুল কুল ফিল কুল উপাধীতে স্মরন করেন। এই মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী সাহেব শায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাপারে ভালো আকিদা রাখতেন এবনহ তাঁকে এবং তাঁকে ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ উপাধীতে স্মরন করতেন এবনহ তাঁর প্রসংসা করতেন। মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবীর জীবনী লিখেছেন মাওলানা ফাযলে হাসান বিহারী ‘আল হায়াত বা’দাল মামাত’ নামে। সেখানে লেখা আছে,
“(মাওলানা মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবী সাহেব) যখন ‘কিতাবুর রাকায়েক’ এর শিক্ষা দিতে এবং তাসাউফের সত্যতা বর্ননা করতেন তখন বলতেন, সাথীগন! এখানে জ্ঞানের সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। এই কারনেই তিনি উলামাদের তাবাকাতের মধ্যে শায়খ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীকে বড়ই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন এবং বলতেন শায়খ ইবনে আরাবী ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ ছিলেন।” (হায়াত বা’দাল মামাত, পৃষ্ঠা-১২৩)
স্কেন পেজঃ
এখানে উস্তাদ মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবী এবনহ তাঁর ছাত্ররা একমত যে মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহঃ) ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ ছিলেন। এবং ছাত্র একথা বাড়িয়ে বললেন, “প্রকাশ্য এবং গোপন জ্ঞান জমাকারী, একাকী শ্রেষ্ঠত্যের অধিকারী ছিলেন। ‘আল হায়াত বা’দাল মামাত’ এর মধ্যে আরও লেখা আছে,
“মাওলানা কাজী বশীরুদ্দীন কনৌজী শায়খ ইবনে আরাবীর বিরোধো ছিলেন। একবার মিঁয়া নাযীর হুসাইনের সঙ্গে শায়খে আকবর (ইবনে আরাবী) এর ব্যাপারে আকিদা নিয়ে দিল্লিতে মুনাযারা করতে এলেন এবং দুই মাস পর্যন্ত দিল্লীতে ছিলেন। প্রত্যেক দিন মুনাযারার মজলিস লাগত কিন্তু মিঁয়া সাহেব নিজের আগের ধ্যান-ধারনা থেকে পিছু হাটলেন না। শেষ পর্যন্ত কাজী সাবেব দুই মাস পর ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন।” (আল হায়াত বা’দাল মামাত, পৃষ্ঠা-১২৩)
সুতরাং গায়ের মুকাল্লিদ মাওলানা মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলবী সাহেব শায়েখ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে সম্মান করতেন এবং তিনি ওয়াহদাতুল ওজুদের বিরোধী ছিলেন না। এমনকি তিনি ওয়াহদাতুল ওজুদের স্বপক্ষে মুনাযারাও করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগের গায়ের মুকাল্লিদদেরকে বোঝাবে কে?
শায়খ ইবনে আরাবীর বাণী থেকে দলীল গ্রহন
শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) গায়ের মুকাল্লিদদের নিকট ইলম এবং মারেফফাতের উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেজন্য গায়ের মুকাল্লিদরা তাঁর (ইবনে আরাবী) বাণী থেকে নির্দিধায় দলীল গ্রহন করেছেন এবং বড়ই চাতুর্যতার সঙ্গে তাঁর বাণী থেকে দলীল গ্রহন করেছেন। ‘আল হায়াত বা’দাল মামাত ’ গ্রন্থে সেই দলীল গ্রহন করার উদাহারন মাওজুদ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থের লেখক লিখেছেন,
“খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া (শায়খ ইবনে আরাবী) ‘ফুতুহাতে মাক্কীয়া’ এর মধ্যে বলেছেন।” (আল হায়াত বা’দাল মামাত, পৃষ্ঠা-৩০২)
স্কেন পেজঃ
এর পর তিনি ‘ফুতুহাতে মাক্কীয়া’ থেকে একটি ইবারত নকল করেছে সেখান থেকে তকলিদের ব্যাপারে নিজেদের মাযহাবের দলীল কায়েম করেছেন। লেখক আরও লিখেছেন,
“আহকার এই উদ্দেশ্যে এখানে নিজেদের তরফ থেকে শায়খ ইবনে আরাবী রাজিয়াল্লাহু আনহু এর ‘ফুতুহাতে মাক্কীয়া’ এর অনেক ইবারত বৃদ্ধি করেছে যে তিনি ‘খাতেমুল বিলায়াতিল মুহাম্মাদীয়া’ ছিলেন।” (আল হায়াত বা’দাল মামাত, পৃষ্ঠা-৩০২)
এখানে আহলে হাদীসরা মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে ‘রাজিয়াল্লাহু আনহু’ বলে সম্মান জানিয়েছেন এবং তাঁর থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন।
ইবনে আরাবীর সঙ্গে হাশরের ময়দানে উঠার আকাঙ্খা
একথা সকলেই জানেন যে নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী গায়ের মুকাল্লিদদের আকাবির এবং তাঁদের জামাআতের বুনিয়াদী আলেমদের মধ্যে ছিলেন। মাযহাব এবং দ্বীনের ব্যাপারে গায়ের মুকাল্লিদরা তাঁর কথার উপর ভরষা করেন। ‘আর রহীকুল মাখতুম’ এর লেখক সফিউর রহমান মুবারকপুরী তাঁর প্রসংশায় লিখেছেন যে তিনি (নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী) ধরনীকের জ্ঞান এবং মারেফতে পুর্ন করে দিয়েছেন। এবং ‘শরীয়াতে মুহাম্মাদী (সাঃ)’ নামক বইএর লেখক মনসুর মুহাম্মাদী তো নবাব সিদ্দিক হাসান খানের জন্য বলেছেন, “কুরআন ও হাদীসের ‘সিরাজে মুনীর’ রুপে একটি দীপ্ত মশাল।” (পৃষ্ঠা-১৬৯)
এই ‘শরীয়াতে মুহাম্মাদী (সাঃ)’ বইটিকে পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত আহলে হাদীস আলেম আব্দুল্লাহ সালাফী সাহেব প্রসংশা করে অভিমত দিয়ে লিখেছেন, “জাতির পক্ষের দলীল দস্তাবেজ।” (পৃষ্ঠা – ৯)
সুতরাং এককথায় নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব গায়ের মুকাল্লিদদের নিকট একজন গ্রহনযোগ্য আলেম। এই নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালীও শায়েখে আকবর ইবনে আরাবী (রহঃ) এর অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন এবং তিনি আল্লাহর কাছে দুয়া করতেন যে তাঁর হাশর যেন শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এবং তাঁর দলবলের সঙ্গে হয়। এই মহান উদ্দেশ্যের জন্য তিনি নবী করীম সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মাহাত্মের ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুয়া করতেন। তিনি তাঁর কিতাব ‘আত্তাজুল মুকাল্লাল’ এর মধ্যে এর মধ্যে শায়খ ইবনে আরাবীর ব্যাক্তিত্যের উপর যেসব অভিযোগ করা হয় তিনি তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং সত্যই তিনি খুব সুন্দর জবাব দিয়েছেন কেননা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) তাঁর নিকট অনেক উঁচু পর্যায়ের মহান ব্যাক্তিত্যের অদিকারী ছিলেন। নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী লিখেছেন,
“তকলীদ তরক করার ব্যাপারে এবং দলীল মোতাবিক আমল করার ব্যাপারে শায়খ ইবনে আরাবীর বাণী অন্য ব্যাক্তির বানীর থেকে উত্তম এবং এই ব্যাপারে খোদাপ্রেমে আত্মহারা এবং আকর্ষনে ঘেরা বর্ননায় পরিপুর্ন। যাক আল্লাহ তাআলা আমাদের এবং আমাদের সমগ্র মুসলমানদের তরফ থেকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। তাঁর আলোকে যেন আমাদেরকে ফায়েজ দান করুন। তাঁর গোপন এবং বাতিনি পোষাক যেন আমাদের পরান। তাঁর জ্ঞানের মদীরার উত্তাপে যেন আমাদেরকে পুর্ণ করে দেন এবং তাঁর সাথীদের দলে আমাদের যেন হাশর দান করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মাহাত্মের সদকায় আমাদের এই দুয়া কবুল করুন।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল, পৃষ্ঠা-১৮০)
এখানে গায়ের মুকাল্লিদদের ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব মাসআলা ওয়াহ্দাতুল ওজুদের প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়েছেন এবং তাঁর জন্য নবী করীম (সাঃ) এর মাহাত্মের ওসীলা দিয়ে দুয়া করেছেন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে হাশরের ময়দানে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এবার বর্তমান যুগের গায়ের মুকাল্লিদরা বলুন আপনারা নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালীর উপর কি ফতোয়া জারী করবেন?
এখানে আরও একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যে বর্তমান যুগের কিছু লা মাযহাবী ওসীলা দিয়ে দুয়া চাওয়াকে নাজায়েজ ও হারাম বলে থাকেন কিন্তু নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী সাহেব “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মাহাত্মের সদকায় আমাদের এই দুয়া কবুল করুন” বলে নবী (সাঃ) এর ওসীলায় দুয়া প্রার্থণা করেছেন। এখন নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালীর উপর কি ফতোয়া দিবেন লা মাযহাবীরা?
ফিরাউনের ইমানের ব্যাপারে ইবনে আরাবীর কথার ব্যাখ্যা
আহলে হাদীসদের বিখ্যাত আলেম, কাজী শাওকানীর বিশিষ্ট ছাত্র নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান সাহেব শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ফিরআউনের ইমানের ব্যাপারে লিখেছেন,
“ফিরআউনের ইমানের ব্যাপারে শায়খ ইবনে আরাবীর কথার কিছু উলামা তাবিল করেছেন যে ফিরআউনের অর্থ হল নফস (প্রবৃত্তি)।”
সত্যিই ফিরআউনের ঈমানের ব্যাপারে শায়খ ইবনে আরাবীর বক্তব্যকে তাবিল না করে উপায় নেই। অনেকেই শায়খ ইবনে আরাবীকে এই বলে কুফরীর ফতোয়া লাগান যে শায়খ নাকি ফিরআউনকে ঈমানদার বলেছেন। একথা সম্পূর্ন মিথ্যা কেননা শায়খ ‘ফুতুহাতে মক্কিয়া’ এর অন্য জায়গায় ফিরআউনের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি ফিরআউন সম্পর্কে লিখেছেন,
ﻭﻗﺪ ﻧﺄﺧﺬ ﻓﺮﻋﻮﻥ ﻭﺃﻣﺜﺎﻟﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺘﻜﺒﺮﻳﻦ ﺩﻟﻴﻼ ﻋﻠﻰ ﻭﺟﻮﺩ ﺍﻟﺼﺎﻧﻊ ﻻﻧﻪ ﺻﻨﻌﺔ ﻭﺍﺗﻔﻖ ﺃﻥ ﻋﻴﻨﻪ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻻﻟﺔ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺨﺼﻮﺹ ﻻ ﻳﺠﺐ ﺍﺣﺘﺮﺍﻣﻪ ﺑﻞ ﻳﺠﺐ ﻣﻘﺘﻪ ﻭﻋﺪﻡ ﺣﺮﻣﺘﻪ
অর্থাৎ “ফিরআউন ও তার মতো দাম্ভিক অহংকারীদেরকে আমরা আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নিদশর্ন বলে বিশ্বাস করি। কেননা তাদের ধ্বংস আল্লাহর নিদশর্ন। এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, এরা আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ হওয়ার কারণে এদেরকে সম্মান করা জরুরি নয়। বরং এদেরকে অসম্মান ও লাঞ্ছিত করা আবশ্যক।” (ফুতুহাতে মক্কিয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১০৩৮)
তিনি আরও লিখেছেন,
ﻭﻻ ﻣﻮﺿﻊ ﺃﻗﺬﺭ ﻣﻦ ﻣﻮﺿﻊﻓﺮﻋﻮﻥ ﻓﺎﻥ ﺍﻟﻤﺸﺮﻙ ﻧﺠﺲ
অর্থাৎ “ফিরআউন অবস্থানের জায়গার চেয়ে নিকৃষ্ট ও নোংরা জায়গা আর নেই। কেননা মুশরিক হলো নাপাক।” (ফুতুহাতে মক্কিয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা- ৪৪৩৪)
শায়খে আকবার আরও লিখেছেন,
ﺿﻞ ﺍﻟﺤﺠﺮ ﺍﻻﺳﻮﺩ ﻣﻊ ﻛﻮﻧﻪ ﺟﻤﺎﺩﺍً ﻭﻫﻮ ﻳﻤﻴﻦ ﺍﻟﻠّﻪ ﻓﺎﻧﻈﺮ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﺮﺗﺒﺔ ﻭﻫﻮ ﺟﻤﺎﺩ ﻭﺍﻧﻈﺮ ﻓﻲ ﻓﺮﻋﻮﻥ ﻭﺃﺑﻲ ﺟﻬﻞ
অর্থাৎ “হাজরে আসওয়াদ একটি জড় বস্তু হওয়া সত্ত্বেও সেটি আল্লাহর ডান হাত। লক্ষ্য করো, একটি জড় বস্তুর কতো মাকাম ও মর্তবা। পাশাপাশি ফিরআউন ও আবু জাহেলের দিকে লক্ষ্য করো।” (ফুতুহাতে মক্কিয়া)
এখানে তিনি ফেরাউন ও আবু জাহিলকে একই সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি যদি ফেরাউনের মুমিন হওয়ার বিশ্বাস রাখতেন তাহলে লাঞ্ছনার বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে আবু জাহিল ও ফেরাউনকে একই পর্যায়ের বিশ্বাস করতেন না। ফেরাউনের মুশরিক, ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার ব্যাপারে ইবনে আরাবীর এধরণের সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ফেরাউনকে মু’মিন বলে বিশ্বাস রাখতেন বলে প্রচার করা সম্পুর্ন বাস্তব বিরোধী।
নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান সাহেব শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে আরও লিখেছেন,
ﻭﺍﻟﺬﻫﺐ ﺍﻟﺮﺍﺟﺢ ﻓﻴﻪ ﻋﻠﻰ ﻣﺎﺫﻫﺐ ﺍﻟﻴﻪ ﺍﻟﻌﻠﻤﺎﺀ ﺍﻟﻤﺤﻘﻘﻮﻥ ﺍﻟﺠﺎﻣﻌﻮﻥ ﺑﻴﻦ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻭﺍﻟﻌﻤﻞ ﻭﺍﻟﺸﺮﻉ ﻭﺍﻟﺴﻠﻮﻙ ” ﺍﻟﺴﻜﻮﺕ ﻓﻲ ﺷﺄﻧﻪ ” ، ﻭﺻﺮﻑ ﻛﻼﻣﻪ ﺍﻟﻤﺨﺎﻟﻒ ﻟﻈﺎﻫﺮ ﺍﻟﺸﺮﻉ ﺍﻟﻰ ﻣﺤﺎﻣﻞ ﺣﺴﻨﺔ ، ﻭﻛﻒ ﺍﻟﻠﺴﺎﻥ ﻋﻦ ﺗﻜﻔﻴﺮﻩ ﻭﺗﻜﻔﻴﺮ ﻏﻴﺮﻩ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺸﺎﺋﺦ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﺛﺒﺖ ﺗﻘﻮﺍﻫﻢ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻳﻦ ، ﻭﻇﻬﺮ ﻋﻠﻤﻬﻢ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﺑﻴﻦ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ ، ﻭﻛﺎﻧﻮﺍ ﺫﺭﻭﺓ ﻋﻠﻴﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺍﻟﺼﺎﻟﺢ ، ﻭﻣﻦ ﺛﻢ ﺭﺃﻳﺖ ﺷﻴﺨﻨﺎ ﺍﻻﻣﺎﻡ ﺍﻟﻌﻼﻣﺔ ﺍﻟﺸﻮﻛﺎﻧﻲ ﻓﻲ ﺍﻟﻔﺘﺢ ﺍﻟﺮﺑﺎﻧﻲ ﻣﺎﻝ ﺍﻟﻰ ﺫﻟﻚ ، ﻭﻗﺎﻝ : ” ﻟﻜﻼﻣﻪ ﻣﺤﺎﻣﻞ ، ﻭﺭﺟﻊ ﻋﻤﺎ ﻛﺘﺒﻪ ﻓﻲ ﺃﻭﻝ ﻋﻤﺮﻩ ﺑﻌﺪ ﺃﺭﺑﻌﻴﻦ ﺳﻨﺔ
অর্থাৎ “(ইবনে আরাবী ও অন্যান্যদের সম্পর্কে) সঠিক বক্তব্য সেটিই যা গ্রহণ করেছে শ্রেষ্ঠ আলেমগণ। যারা ইলম ও আমল ও তাসাউফের সমন্বয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন। তাদের অভিমত হলো, এসব সুফী ইমামদের সম্পর্কে চুপ থাকা। তাদের শরীয়ত বিরোধী কথাগুলোর সুন্দর ব্যাখ্যা দেয়া এবং তাদেরকে কাফের বলা থেকে বিরত থাকা। সাথে সাথে অন্যান্য সূফী শায়খদেরকে কাফের বলা থেকে বিরত থাকা, দ্বীনের ব্যাপারে যাদের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। যাদের ইলম মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নেক আমলের ক্ষেত্রে যারা ছিলেন সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাসীন। আমি আমার উস্তাদ শায়খ কাজী শাওকানীকে দেখেছি, তিনি এই মত গ্রহণ করেছেন। তিনি তাদের বক্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, তাদের বক্তব্যের সম্ভাব্য সঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব । তিনি তার প্রথম জীবনে তাদের সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, চল্লিশ বছর পরে সেগুলো প্রত্যাহার করে নেন।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল, পৃষ্ঠা-১৬৮-১৬৯)
এরপর নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান লিখেছেন,
ﻭﺃﻗﻮﻝ ﻓﻲ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ : ﺇﻥ ﺍﻟﺼﻮﺍﺏ ﻣﺎﺫﻫﺐ ﺍﻟﻴﻪ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﺃﺣﻤﺪ ﺍﻟﺴﻬﺮﻧﺪﻱ – ﻣﺠﺪﺩ ﺍﻻﻟﻒ ﺍﻟﺜﺎﻧﻲ – ، ﻭﺍﻟﺸﻴﺦ ﺍﻻﺟﻞ ﻣﺴﻨﺪ ﺍﻟﻮﻗﺖ ﺃﺣﻤﺪ ﻭﻟﻲ ﺍﻟﻠﻪ – ﺍﻟﻤﺤﺪﺙ ﺍﻟﺪﻫﻠﻮﻱ – ، ﻭﺍﻹﻣﺎﻡ ﺍﻟﻤﺠﺘﻬﺪ ﺍﻟﻜﺒﻴﺮ ﻣﺤﻤﺪ ﺍﻟﺸﻮﻛﺎﻧﻲ ﻣﻦ ﻗﺒﻮﻝ ﻛﻼﻣﻪ ﺍﻟﻤﻮﺍﻓﻖ ﻟﻈﺎﻫﺮ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ﻭﺍﻟﺴﻨﺔ ، ﻭﺗﺄﻭﻳﻞ ﻛﻼﻣﻪ ﺍﻟﺬﻱ ﻳﺨﺎﻟﻒ ﻇﺎﻫﺮﻫﻤﺎ ، ﺗﺄﻭﻳﻠﻪ ﺑﻤﺎ ﻳﺴﺘﺤﺴﻦ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺤﺎﻣﻞ ﺍﻟﺤﺴﻨﺔ ، ﻭﻋﺪﻡ ﺍﻟﺘﻔﻮﻩ ، ﻓﻴﻪ ﺑﻤﺎ ﻻ ﻳﻠﻴﻖ ، ﺑﺄﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻭﺍﻟﻬﺪﻯ ، ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺃﻋﻠﻢ ﺑﺴﺮﺍﺋﺮ ﺍﻟﺨﻠﻖ ﻭﺿﻤﺎﺋﺮﻫﻢ
অর্থাৎ “আমি তাদের সম্পর্কে বলবো, সঠিক মত হলো সেটিই যা গ্রহণ করেছেন, মুজাদ্দিদে আলফে সানী শায়খ আহমাদ সিরহিন্দী (রহ) যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী রহ এবং বিশিষ্ট ইমাম কাজী শাওকানী। তারা বলেছেন, মনসুর হাল্লাজ ও অন্যান্য সূফীদের যেসব কথা কুরআন ও সুন্নাহের অনুগামী, সেগুলো গ্রহণ করা উচিৎ এবং কুরআন ও সুন্নাহের বাহ্যিক বিধানের বিপরীত বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা করা উচিৎ। এগুলোর সঠিক-সুন্দর ব্যাখ্যা করা এবং এগুলো নিয়ে তাদের ব্যাপারে অন্যায় সমালোচনা না করা। কেননা আলেম ও বুজুর্গদের সম্পর্কে মন্দচারিতায় লিপ্ত হওয়া কখনও শোভনীয় নয়।” (আত্তাজুল মুকাল্লাল, পৃষ্ঠা-১৬৮-১৬৯)
এখানে আহলে হাদীসদের মহামান্য নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী সাহেব মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ এর প্রবক্তা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে কাফের বলতে নিষেধ করেছেন। অথচ বর্তমান যুগের তথাকথিত আহলে হাদীসদের দালাল গায়ের মুকাল্লিদ তওসীফুর রহমান যাইদী, তালিবুর রহমান যাইদী, মিরাজ রাব্বানী, মতিউর রহমান জাল মাদানী প্রভৃতিরা শায়খ ইবনে আরাবী (রহঃ) কে কাফের ফতোয়া দিয়ে নিজেদেরকে মুসলমান সমাজে কলঙ্কিত করেছে। অথচ তাদের আকাবির আলেম উলামারাও ওয়াহ্দাতুল ওজুদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদের প্রবক্তা হযরত শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহঃ) কে সীমাহীন শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর সঙ্গে হাশরের ময়দানে একসাথে থাকার ইচ্ছা পোষন করতেন। এর পরেও গায়ের মুকাল্লিদদের মাসআলা ওয়াহ্দাতুল ওজুদের বিপক্ষে মুখ খোলার কোন উপায় থাকে না। কিন্তু আধুনিক যুগের মডার্ন গায়ের মুকাল্লিদদের কে তা বোঝাবে কে?
দ্বিতীয় পর্বটি পড়ার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন,
মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ ও শায়খ ইবনে আরাবী রহঃ (২য় পর্ব)