সাধারণত মন্দির ধ্বংসের কারণ দেখার চেষ্টা করা হয়, তৎকালীন মুসলিম ইতিহাসকারদের বিবরণকে ভিত্তি করে। তারা মন্দির ধ্বংসের পিছনে রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণের চেয়ে ধর্মীয় কারণকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় মানুষরা মন্দির ধ্বংসকে কীভাবে দেখেছে তা খুব কমই আলােচনা করা হয়। রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্য পুরাণে’ দেখা যায় যে, স্থানীয় মানুষরা জাজনগরে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু মন্দির ধ্বংসকে স্বাগত জানিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, সুলতান মাহমুদ কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারতের মন্দিরগুলি ধ্বংসের বিবরণ সমকালীন স্থানীয় উপাদানে প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং আমরা পরবর্তীকালে যতই মাহমুদকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী ও অত্যাচারী বলে দেখাই না কেন, তৎকালীন মানুষের মনে মন্দির ধ্বংসের ছাপ বেশি পড়েনি। উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকা সত্বেও সম্ভবত কোনাে নতুন মন্দির স্থাপিত হয়নি। এরপর বারাণসীতে জাহাঙ্গীরের আমলে প্রায় ৭৬টি নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছিল। প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযােগে কোনাে কোনাে স্থানে এসময়ে মসজিদ ভেঙে মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের আমলে এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। তৎকালীন পাঞ্জাবের শহরতলি অঞ্চলের মাশায়েখদের একটি দল স্থানীয় হিন্দু দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শাহজাহানের সাহায্যপ্রার্থী হয়। কিছু কিছু দুরাচার দস্যু এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, ৭০ জন মুসলিম নারীদের অপহরণ করে এবং মসজিদগুলাে দখল করে নেয়। এ ব্যাপারে শেখ মাহমুদ গুজরাটিকে মহিলাদের উদ্ধারের জন্য নিযুক্ত করা হয়। হুকুমমতাে তিনি মুসলিম নারীদের উদ্ধার করেছিলেন। বাদশাহ শাহজাহান এই নারীদের বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমানদের আহ্বান করেন। এবং মসজিদ ভেঙে স্থাপিত মন্দিরগুলাে ভেঙে আবার মসজিদ নির্মাণ করেন। শাহজাহানের পর দারাশিকোর হাতে শাসনভার চলে গেলে দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ চরমে ওঠে। এই দুর্নীতি আওরঙ্গজেব শক্ত হাতে দমন করেন। মসজিদ ভেঙে যে মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছিল তিনি কেবল সেই মন্দিরগুলিই ভেঙে ফেলেন। এভাবে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংসের কাহিনিও বানােয়াট। বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংসের মূল কারণ হল: আওরঙ্গজেবের বাংলা অভিযানের সময় বহু হিন্দুরাজা তার সহযাত্রী হন। কাশীতে শিবির স্থাপন করা হলে হিন্দু রাজাদের রাণীরা গঙ্গ স্নান সেরে পূজা দিতে যান। পূজা দিয়ে ফেরার পথে দেখা যায় কচ্ছের রাণীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাশী তােলপাড় করে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্বনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহে ধর্ষিত অবস্থায়। ক্ষুব্ধ হিন্দু রাজারা এর প্রতিকার চান। আওরঙ্গজেব হিন্দু রাজাদের দাবি মেনেই বিগ্রহ সরিয়ে মন্দির ভূলুণ্ঠিত করেন ও পুরােহিতকে শাস্তি দেন। ঐতিহাসিক বি এন পাণ্ডে তার টইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেন: “..বাংলা অভিমুখে যাত্রাপথে আওরঙ্গজেব যখন বারাণসীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার অধীনস্থ রাজারা অনুরােধ করেন। যদি একদিনের যাত্রা বিরতি ঘটানাে যায় তাহলে রাজ-মহীষীরা বারাণসী গিয়ে গঙ্গাস্নান করে প্রভু বিশ্বনাথকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন। আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যান। বারাণসীর পাঁচ মাইল দূরে সেনাশিবির স্থাপিত হল। মহীষীরা…গঙ্গাস্নান সেরে গেলেন বিশ্বনাথ এর মন্দিরে। পূজার্চনা শেষে সবাই ফিরে এলেন। এলেন না শুধু কচ্ছের মহারাণী। মন্দির এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কোথাও পাওয়া গেল না।
এটি আওরঙ্গজেবের গােচরে আনা হলে তিনি ক্রুব্ধ হয়ে উঠলেন। রাণীর খোঁজে পাঠালেন ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের। শেষ পর্যন্ত ..তাঁরা নিখোঁজ রাণীকে দেখতে পেলেন ধর্ষিতা আর ক্রন্দনরত অবস্থায়। কক্ষটি ছিল প্রভু বিশ্বনাথ দেবের ঠিক নিচেই। রাজারা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন। অল্পরাধ যেহেতু জঘন্য অতএব তারা দণ্ডযােগ্য অবস্থা গ্রহণের দাবি জানালেন। আওরঙ্গজেব আদেশ দিলেন, বিশ্বনাথ যেহেতু কলুষিত হয়েছে, অতএব প্রভু বিশ্বনাথকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করে মন্দির ভূমিসাৎ হােক। আর মােহান্তকে বন্দী করে শাস্তি দেওয়া হােক।” (ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি, পৃ. ৪৮-৪৯)। পটুভি সীতারামাইয়াও প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে এই তথ্য তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন (সীতারামাইয়া, ফেদার্স অ্যান্ড স্টোনস, পদ্ম পাবলিকেশন, বম্বে, ১৯৪৬, পু, ১৭৭-৭৮। আরও দেখুন মণিশংকর আয়ার, কনফেসনস অফ এ সেকুলার ফান্ডামেন্টালিস্ট, পেঙ্গুইন বুকস, ২০০৬, পৃ. ৬৫)। এছাড়া তৎকালীন পাটনা মিউজিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর পি এন গুপ্তও এই সত্যতা স্বীকার করেছেন। কেউ কেউ অপবাদ দিয়ে থাকেন, আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে ওই স্থানেই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটা বানানাে, মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ভিন্ন সময়ে ভিন্ন জমিতে।
বারানসী ছিল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান। সেখানকার অধিকাংশ মনির আওরঙ্গজেবের সমগ্র রাজত্বকাল জুড়ে (১৬৫৮-১৭০৭) অক্ষত ছিল শুধু কয়েকটি মন্দির না ধ্বংস করে উপায় ছিল না। তাছাড়া মারাঠা ও রাজপুতদের ক্ষমতা প্রতিপত্তিদের তাঁদের অর্থাৎ বিদ্রোহীদের সাহস ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে দেশের নানা স্থানে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র ও বিপ্লববাদের সূত্রপাত হয়। হিন্দুদের বড় বড় মন্দিরসমূহ রাজদ্রোহীতা ও ষড়যন্ত্রের প্রধান কেন্দ্রস্থল হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের সময় অধিকাংশ স্থানে তারা দেব-মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করত। ইতিহাস খুললে দেখা যাবে—বারাণসী, উদয়পুর ও যােধপুরে রাষ্ট্রবিপ্লব ও বিদ্রোহ উপস্থিত হওয়াতেই আওরঙ্গজেব তাঁদের বিরুদ্ধে সৈন্য চালনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভীষণ বিপ্লব দমনকল্পে যে সমস্ত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংগঠিত হয় তাতেই হিন্দুদের কিছু মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। শ্রীরাম শর্মা বলেন যে, বারাণসীর হিন্দুরা ১৬৬৭ সালে একটি নির্মীয়মাণ মসজিদ ধ্বংস করে। এমনকি তারা মিস্ত্রিদেরও আহত করে। এজন্য মুসলমানেরা বারাণসীর কিছু মন্দির ধ্বংস করে। (দেখুন-শ্রীরাম শর্মা, দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৬২, পৃ. ১৩১)।
মথুরাই কেশব রাইয়ের যে মন্দিরটি আওরঙ্গজেব ধ্বংস করেন তার কারণও হিন্দু-বিদ্বেষ নয়। স্মর্তব্য যে, হিন্দুদের একাংশ আওরঙ্গজেবের রাজত্বলাভের পর্বে বেশ শক্তিশালী ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। আওরঙ্গজেব যখন অত্যাচার বন্ধ করতে এগিয়ে এলেন তখন তাদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিল। রাজ্যাভিষেকের দ্বাদশ বর্ষে (১৬৬৯) আওরঙ্গজেব যখন অবগত হলেন যে, ওই সমস্ত হিন্দুরা মুসলিম শিশুদেরকে সাম্প্রদায়িক বিদ্যাশিক্ষা দিচ্ছে এবং এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তিনি তখন সেগুলি বন্ধের আদেশ দিলেন। অথচ বিদ্বেষভাবাপন্ন ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, আওরঙ্গজেব হিন্দুদের সমস্ত শিক্ষালয় ও ধর্মীয় স্থানগুলি ভেঙে দিয়েছিলেন। ‘মাসের-ই-আলমগিরি’তে লেখা হয়েছে: “ধর্মপ্রাণ সম্রাট জানতে পারলেন যে, থাট্টা ও মুলতান সুবায় বিশেষত বেনারসে মিথ্যাচারী ব্রাহ্মণের দল অলীক গ্রন্থাদি স্কুলসমূহে পড়াতে লেগে গিয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম বিদ্যার্থীরা বহু দূরবর্তী পথ অতিক্রম করে উক্ত অভিশপ্ত বিদ্যা অর্জনকল্পে ওই ভ্রষ্টদলের নিকট আগমন করে। সুতরাং সমস্ত সুবার শাসনকর্তাদের নিকট আদেশ প্রেরণ করা হল যে, তারা যেন ওই ব্রাহ্মণদের বিদ্যালয় ও উপাসনালয়গুলাে স্বহস্তে ভেঙে দেন।”
এই বিবৃতি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, কি কারণে এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং এর উদ্দেশ্য কি ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কিছু ঐতিহাসিকরা এই বিশেষ আদেশটাকে সাধারণ আদেশের পর্যায়ে প্রচার করেছেন। যাইহােক, এই ঘটনার মাত্র মাস খানেক পর মথুরা অঞ্চলে হিন্দুরা বিদ্রোহ শুরু করে। ওই বিদ্রোহ দমনকল্পে আবদুন্নবী খান মথুরার ফৌজদার নিযুক্ত হলেন এবং নিহত হলেন। এই সময়ে মথুরার কেশব মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। রমিলা থাপার বলেছেন, বীরসিংহ বুন্দেলা মন্দিরটির মাধ্যমে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। মন্দিরটি ছিল যুদ্ধের আহ্বানের প্রতীক এবং তখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যাতে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এভাবে মন্দিরটি ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক লড়ায়ের অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। (Communalism and Historical Legacy: Some Facts, Social Scientist, June-July 1990, P.-13). মথুরার মন্দির ধ্বংস প্রসঙ্গে রমিলা থাপার আরও বলেছেন, মথুরায় মন্দির নির্মাণ ও ধ্বংসপ্রাপ্তি উভয়ের কারণ হিসেবে মুঘল সাম্রাজ্য বুন্দেলা রাজ্য শাসক ও রাজপুত রাজবংশের মধ্যেকার দীর্ঘকালীন জটিলতা সক্রিয় ছিল। (‘ধর্মস্থান ধ্বংসের পিছনে’, মার্কসবাদী পথ, ফেব্রু. ২০১৫)।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।