বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু—ইসরায়েলি রাজনীতির এক অনিবার্য নাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো কূটনীতিক, কখনো সংসদ সদস্য, আবার কখনো মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং বহুবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর রাজনৈতিক ভাষ্যের একটি অভিন্ন ও অবিচল উপাদান—ইরান। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি একটানা দাবি করে আসছেন যে, ইরান অচিরেই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সক্ষম হবে, এবং সেটি ইসরায়েলসহ গোটা বিশ্বের জন্য হবে মারাত্মক হুমকি।

এই ‘আসন্ন ধ্বংসের’ পূর্বাভাস শুধুই মুখের কথা ছিল না। নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, এমনকি যুদ্ধনীতিতেও বারবার এই আশঙ্কাকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি এই বক্তব্য সামনে এনে শুধুমাত্র ইসরায়েলি সমাজে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বেও ইরানবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর এই দীর্ঘস্থায়ী প্রচারণার শুরু ১৯৯২ সালে, যখন তিনি কনেসেটের (ইসরায়েলের সংসদ) সদস্য হিসেবে প্রথম বক্তব্যে বলেন, “ইরান আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে।” এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মুহূর্ত ছিল না, বরং ভবিষ্যতের একটি ধারাবাহিক ভাষ্য তৈরি করেছিল, যা তিনি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বই Fighting Terrorism-এ তিনি একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এবং সেখানে ইরানকে ‘চরমপন্থার কেন্দ্র’ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্বের প্রধান হুমকি হিসেবে তুলে ধরেন।
১৯৯৬ সালের ১০ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ইরান ও ইরাককে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন থেকে বিরত রাখার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষ্য ছিল, এই দুই দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে তা গোটা মানবসভ্যতার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।
২০০২ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে নেতানিয়াহু কংগ্রেসের এক কমিটির সামনে বলেন, ইরাক ও ইরান উভয়ই পরমাণু অস্ত্র তৈরির দৌড়ে নেমেছে। সে সময় তিনি সরাসরি ইরাক আক্রমণের পরামর্শ দেন। এই আহ্বানের মাত্র এক বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে সামরিক অভিযান চালায়। ইরাক যুদ্ধের অন্যতম কূটনৈতিক ভিত্তিই ছিল এই মিথ্যা অভিযোগ—‘সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে।’ যদিও পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। কিন্তু সেই মিথ্যার ফলস্বরূপ সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, ইরাকের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়ে, এবং মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয় দীর্ঘ অস্থিরতা ও সহিংসতার এক নতুন অধ্যায়।
২০০৯ সালে উইকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক তারবার্তায় দেখা যায়, নেতানিয়াহু মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বলছেন, ইরান এক বা দুই বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে।
২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘কার্টুন বোমা’ চিত্রের মাধ্যমে দাবি করেন, ইরান এখন যেকোনো সময় পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আগামী বসন্ত বা গ্রীষ্মের মধ্যেই ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে যাবে।”
তাঁর ভাষ্যে ৩০ বছর ধরে চলতে থাকা এই হুমকির ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ২০২4 সালেও। ১৩ জুন ইসরায়েল, ‘পারমাণবিক কর্মসূচির’ সন্দেহে আবারও ইরানে সামরিক হামলা চালায়। নেতানিয়াহু ফের বলেন, “ইরান যদি থামানো না হয়, তবে আগামী কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলবে।”
কিন্তু বাস্তবতা বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক, সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে—এই দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য নেই। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)–ও কখনো বলেনি, ইরান একটি পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
এই অবস্থায় নেতানিয়াহুর বারবারের দাবি, একই ভাষ্য, একই ভয়াবহতা আর একই সুর আজ অনেকের কাছে রূপ নিয়েছে একধরনের রাজনৈতিক প্রহসনে। ইরানের তরফ থেকে তাকে একসময় ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছিল—”সে সেই রাখাল ছেলে, যে বারবার ‘নেকড়ে এল!’ বলে চিৎকার করে সবাইকে ভয় দেখায়, অথচ নেকড়েটা কখনোই আসে না।”
অবশ্য নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য যে কেবল ইরানবিরোধিতা নয়, বরং এই ভাষ্যকে কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট আড়াল করা, নিজের জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধনীতিকে নৈতিকতা ও নিরাপত্তার মোড়কে পেশ করা—তা অনেক বিশ্লেষকের মতে স্পষ্ট। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এমন এক আশঙ্কার কথা বলে যাচ্ছেন, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি আজও পাওয়া যায়নি। তবুও তিনি থেমে যাননি। বরং প্রতি নতুন বছরে, প্রতি নতুন সঙ্কটে তিনি এই পুরোনো ভাষ্যকেই নতুন করে তুলে ধরছেন।
এই পুনরাবৃত্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক জটিল বাস্তবতা—রাজনীতি যখন ভয়ের বাণিজ্যে পরিণত হয়, তখন সত্যের চেয়ে গল্পই হয়ে ওঠে বড় অস্ত্র।
নব্বই দশকের শুরুর দিক থেকে যিনি ইসরায়েলি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছেন, সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু—নানা সময় নানা ভূমিকায় থেকেও এক বিষয়ে বরাবরই একরোখা ও আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছেন, তা হলো ইরান। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি আন্তর্জাতিক মহলকে সতর্ক করে আসছেন, ইরান নিকট ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে এবং সেই অস্ত্র ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠবে। অথচ এই দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই পুরনো সুর এখন অনেকের কাছেই বিরক্তিকর ও হাস্যকর ঠেকছে।
২০১১ সালে একটি কূটনৈতিক আলোচনার সময়ে নেতানিয়াহুর বিষয়ে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি। তখন তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে কথোপকথনে বলেছিলেন—”আমি আর ওকে সহ্য করতে পারি না, ও একজন মিথ্যাবাদী।” সারকোজির এ মন্তব্য তখন একটি অন-রেকর্ড মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় ওঠে। এর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়, শুধু মুসলিম দুনিয়াই নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও নেতানিয়াহুর প্রতি গভীর অবিশ্বাস ও বিরক্তি বিদ্যমান।
এরপর ২০১৮ সালে যখন নেতানিয়াহু আবারও দাবি করেন, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে, তখন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ কঠোর ভাষায় পাল্টা জবাব দেন। তিনি বলেন, “আপনি মানুষকে একবার বা দুইবার হয়তো বোকা বানাতে পারেন, কিন্তু বারবার নয়।” এই বক্তব্য শুধু নেতানিয়াহুর প্রতি তীব্র কটাক্ষই ছিল না, বরং গোটা আন্তর্জাতিক জনমতকে ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছিল যে, ইসরায়েলের এই পুরনো বুলি আজ আর কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
প্রশ্ন উঠেছে—তবে কোন অভ্যন্তরীণ বা ব্যক্তিগত উন্মাদনা থেকে নেতানিয়াহু এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন? বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে একাধিক স্তরের ব্যর্থতা, চাপ ও ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরার এক নিরুত্তর আকাঙ্ক্ষা। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি তাঁর সমর্থকদের কাছে ‘কিং বিবি’ নামে পরিচিত, গত কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সংকটে জর্জরিত। ঘুষ, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের একাধিক দুর্নীতির মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং আদালতের কাঠগড়াতেও তাঁকে হাজির হতে হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে তাঁর বয়সও হয়ে গেছে ৭৫ বছর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি যেন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ প্রয়াস চালাচ্ছেন—ইসরায়েলি ইতিহাসে নিজেকে ‘ইহুদি জাতির ত্রাণকর্তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষায়।
তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আকস্মিক ও ভয়াবহ আক্রমণ নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের ‘সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা’ হওয়ার ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তোলে। এই হামলা শুধু ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতাই প্রকাশ করেনি, বরং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের ওপর আস্থার এক অভূতপূর্ব পতনের সূচনা করে। জনমত জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক এই বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি তাকেই দায়ী করেছেন।
এই নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতা, রাজনৈতিক কোণঠাসা অবস্থান এবং বিচারিক চাপের সঙ্গে যুক্ত হয় ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বৈদেশিক সমালোচনা। এই জটিল পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু যেন ফের তার সেই পুরনো ‘কার্ড’টি খেলেছেন—ইরানকে হুমকি হিসেবে তুলে ধরা। অতীতেও দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ সংকট ঘনিয়ে এলে কিংবা তাঁর ভাবমূর্তি বিপন্ন হলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কোনো না কোনো সামরিক অভিযানে জড়িয়েছেন অথবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো আলোড়ন তোলার চেষ্টা করেছেন।
১৩ জুন ২০২৪ সালে ইরানে চালানো সাম্প্রতিক হামলাটিও অনেক বিশ্লেষকের মতে, এমনই এক প্রচেষ্টা—যেখানে উদ্দেশ্য আসলে ছিল নিজেকে আবারও একজন ‘সাহসী রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরা এবং অভ্যন্তরীণ দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই কৌশল যে চিরকাল চলতে পারে না, তা সময়ই বলে দেবে।
নেতানিয়াহুর ইরান-বিদ্বেষ, যার শুরু হয়েছিল কথিত ‘পারমাণবিক হুমকি’ দিয়ে, এখন রূপ নিয়েছে একধরনের অবসেশন বা বাতিকগ্রস্ত রাজনীতিতে। বাস্তবতা যাই বলুক, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যতই তাঁকে ভুল প্রমাণ করুক, তাঁর বয়ানে বারবার ফিরে আসে—“ইরানকে থামাতে হবে, নইলে পৃথিবী ধ্বংস হবে।”
এই দীর্ঘায়িত আশঙ্কা, বাস্তবতা ও বারবারের মিথ্যা দাবি—সব মিলিয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আজ হয়ে উঠেছেন এমন এক রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে অতীতের ভুল পূর্বাভাস আর বর্তমানের বেপরোয়া সিদ্ধান্ত একই সুরে মিশে গেছে। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই ‘ধর্মযুদ্ধের’ মুখোশের পেছনে সত্যি কি জাতীয় নিরাপত্তা? নাকি একক নেতার আত্মরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা?