লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
এই রফয়ে ইয়াদাইন করার পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচুর কিতাবপত্র লেখা হয়েছে। হানাফীদের পক্ষ থেকে হাদীসের হাওয়ালা দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন না করার দলীল মজবুত। কিন্তু অধিকাংশই চরমপন্থী লা মাযহাবীরা তা মানতে অস্বীকার করে থাকেন। নামাযে বার বার রফয়ে ইয়াদাইন না করার হাদীসগুলিকে জাল-যয়ীফ বলে পাল্লা ঝাড়তে চান। লা মাযহাবী আনওয়ারুল হক ফাইযীও ‘হানাফী কেল্লার পোষ্ট মর্টেম’ কিতাবের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন যে,
“রফউল ইয়াদায়েন না করে তাঁর ও যাঁদের ব্যাপারেই বর্ণনা করা হয়েছে তার একটিও সহীহ নয়, বরং যয়ীফ, জাল ও দেওবন্দী জালিয়াতি, যা আমার ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।” (হানাফী কেল্লার পোষ্ট মর্টেম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩১)
সুতরাং গায়ের মুকাল্লিদরা এটা মানতে চান না যে হাদীসে একটাও রফয়ে ইয়াদাইন না করার সহীহ হাদীস আছে যদিও হাদীসের গ্রন্থে রফয়ে ইয়াদাইন না করার হাদীসে ভরপুর।
গায়ের মুকাল্লিদরা হাদীসকে যয়ীফ বলে দূরে ছুঁড়ে দিলেও কুরআনকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন না। কেননা কোন মু’মিন মুসলমান কুরআনকে অস্বীকার করতে পারেন না। কুরআনকে অস্বীকার করলেই ঈমান চলে যাবে এবং বেইমান হয়ে মারা যাবে। তাই নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন না করার কথা যে কুরআন শরীফে রয়েছে তা প্রামাণ জন্যই আমার এই লেখা।
কুরআন শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে নামাযে বার বার রফয়ে ইয়াদাইন করা যাবে নাঃ
আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফের মধ্যে বলেছেন,
তরজমাঃ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাযে। (সূরা মু’মিনুন, আয়াত ১-২)
এই আয়াতের তফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,
অর্থাৎ “নামাযে বিনম্র বলতে সেই সব লোকদের কথা বলা হয়েছে যারা নামাযে ধ্যানমগ্ন থাকে এবং একাগ্রতা বজায় রাখে। এবং তারা ডানদিকে এবং বামদিকে তাকায় না এবং নামাযে রফয়ে ইয়াদাইনও করে না।” (তফসীরে ইবনে আব্বাস, পৃষ্ঠা-২০১)
এখানে ইবনে আব্বাস (রাঃ) স্পষ্ট ভাষায় কুরআনের উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, তকবীরে তাহরীমা ছাড়া রফয়ে ইয়াদাইন করা যাবে না। এই ইবনে আব্বাস সেই সাহাবী যাঁকে নবী করীম (সাঃ) তফসীরের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলেন। আর সেই দুয়ার বরকতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) কুরআনের তফসীর ‘তফসীরে ইবনে আব্বাস’ রচনা করেন। সেখানেই তিনি বলেন, তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া রফয়ে ইয়াদাইন করা যাবে না। তাই আমাদেরও নামাযে তকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কোথাও রফয়ে ইয়াদাইন করা উচিৎ নয়।
স্কেন পেজঃ
১ নং অভিযোগঃ
পাকিস্তানের জুবাইর আলী যাই এর উপর অভিযোগ করে লিখেছেন, “সুরা মু’মিনুন এর দুটি আয়াত লেখা হয়েছে। এর মধ্যে (রুকুর আগে এবং রুকুর পরে) রফয়ে ইয়াদাইন না করার কোন বর্ণনায় নেই।” (মসরুবে হক, পৃষ্ঠা-২১-৩১)
আমাদের জাবাবঃ
প্রথমতঃ এই দুই আয়াতের নিচে দেখুন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এই আয়াতের তফসীরে স্পষ্ট মওজুদ আছে যে, (লা ইয়ারফাউন আইদিহীম ফিস স্বালাত) অর্থাৎ “নামাযে রফয়ে ইয়াদাইনও করে না” কথাটি স্পষ্ট লেখা আছে।
দ্বিতীয়তঃ (লা ইয়ারফাউন আইদিহীম ফিস স্বালাত) শব্দ দ্বারা নামাযের ভিতরে পাওয়া প্রত্যেক রফয়ে ইয়াদাইনকে নিশিদ্ধ করা হয়েছে। আর সেটা রুকুর আগে হোক বা রুকুর পরে হোক, সিজদার সময় হোক বা তৃতীয় রাকআতের শুরুতে হোক। আলাদাভাবে প্রত্যেকের উল্লখ করা জরুরী নয়। যেমন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”তে “লা” দ্বারা প্রত্যেক বাতিল মাবুদের (উপাস্যের) অস্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেই বাতিল মাবুদ (উপাস্য) লাত হোক অথবা উজ্জা হোক, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বর্ণনা করা জরুরী নয়। সুতরাং এখানেও প্রত্যেক রফয়ে ইয়াদাইনের আলাদা আলাদা বর্ণনা করাও জরুরী নয়। তাই জুবাইর আলী যাই এর উচিৎ উসুলের কিছু কিতাব পড়া তারপর জবাব দেওয়া।
২ নং অভিযোগঃ
জুবাইর আলী যাই আরও একটি অভিযোগ করে লিখেছেন, “এর (তফসীরে ইবনে আব্বাস) মারকাজী রাবী মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস সাদী বড়ই মিথ্যাবাদী এবং এর অন্য সনদের সিলসিলাও মিথ্যা।”
এরপর তিনি শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী (মুদ্দাযিল্লুহু) এর হাওয়ালা দিয়ে লিখেছেন, “এর সনদের সিলসিলাকে মুহাদ্দিসরা মিথ্যা বলেছেন।” (মসরুবে হক, পৃষ্ঠা-২১-৩১-৩২)
আমাদের জবাবঃ
এর জবাব দেওয়ার আগে মূলনীতি জেনে নেওয়া উচিৎ। যেমন,
১) এটা সম্ভব যে একজন ব্যাক্তি বা রাবী একটি শাস্ত্রে পণ্ডিত, সিক্বাহ এবং গ্রহণযোগ্য কিন্তু সেই রাবীই অন্য শাস্ত্রে যয়ীফ, মতরুক, বরং মিথ্যাবাদীও হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটা শাস্ত্রে পণ্ডিত হলে এটা জরুরী নয় যে সে অন্য শাস্ত্রেও পণ্ডিত হবে। আসমাউর রিজালের কিতাব উঠালে আমরা এটাই দেখতে পাই। যেমন,
(ক) ইমাম বুখারী (রহঃ) – হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) লেখা ‘তারিখে কাবীর’ ইতিহাসের উপর লেখা কিতাব। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রের উপর লেখা কিতাব বুখারী শরীফের যে মর্তবা রয়েছে কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে ‘তারিখে কাবীর’ সেই মর্তবা হাসিল হয় নি। বোঝা গেল ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীস শাস্ত্রে যে কৃতিত্ত্ব দেখিয়েছেন সেই কৃতিত্ত্ব ইতিহাসের উপর দেখাতে পারেন নি। অতএব ইমাম বুখারী (রহঃ) বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন কিন্তু এত ভাল ঐতিহাসিক ছিলেন না।
(খ) মুহাম্মাদ বিন ইসহাক বিন ইয়াসির – হাদীস শাস্ত্রে আয়েম্মায়ে কিরামগণ মুহাম্মাদ বিন ইসহাক ইয়াসিরকে ‘কাজ্জাব’ ‘শক্তিশালী নয়’ ‘অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। (আয যুআফা ওয়াল মতরুকিন লি ইবনুল জাওযী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪১)
এই মুহাম্মাদ বিন ইসহাককে মাগাযীর অধ্যায়ের ‘ইমাম’ এবং গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে। (তাযকিরা লিয যাহাবী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩০)
এই মুহাম্মাদ বিন ইসহাককে ইমাম মালিক (রহঃ) দাজ্জাল বলেছেন এবং বিভিন্ন মুহাদ্দিসরা তাঁকে শিয়া বলেছেন। তবুও মাগাযীর অধ্যায়ের ইমাম হওয়ার জন্য ইমাম বুখারী (রহঃ) এর হাদীসকে বুখারী শরীফের মাগাযীর অধ্যায়ে এনেছেন।
(গ) আসিম বিন আবী আল খজুদ আল কুফী- এর ব্যাপারে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেছেন যে, কিন্তু কিরাত শাস্ত্রে তাঁকে হুজ্জত বলা হয়েছে। (তাকরীবুত তাহযীব, পৃষ্ঠা-৪৭১)
অর্থাৎ হাদীসের ব্যাপারে আসিম বিন আবী আল খজুদ আল কুফী যয়ীফ হলেও কিরাতের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য।
(ঘ) হাফস বিন সুলাইমান আল সাদী- ইমাম যাহাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে আয়েম্মায়ে কেরামদের জেরা উল্লেখ করার পর বলেছেন যে, কিরাতের ব্যাপারে সিক্কাহ, এবং সংরক্ষণকারী কিন্তু অন্যদিকে হাদীসের ব্যাপারে সে এমন নয়। (মাআরেফাতুল কিরাআল কুব্বার, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪০)
এর ব্যাপারে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেছেন, “মতরুকুল হাদীস, কিন্তু কিরাতের ইমাম।” (তাকরীব লি ইবনে হাজার, পৃষ্ঠা-২৫৭)
(ঙ) ইসা বিন মিনা আল মাদানী- ইমাম যাহাবী (রহঃ) এর ব্যাপারে বলেছেন যে, কিরাত শাস্ত্রে সে গ্রহণযোগ্য ছিল হাদীসের ব্যাপারে সে গ্রহণযোগ্য ছিল না। (মিযানুল এ’তেদাল, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩২৭)
(চ) মুকাতিল বিন সুলাইমান- হাফিয খলীলী বলেছেন যে, তিনি তফসীরের আলেমদের মধ্যে আজিমুস শান মাকাম ও মর্তাবার মালিক ছিলেন। কিন্তু হাদীসের হুফফাযগণ তাঁকে রেওয়াতের ব্যাপারে যয়ীফ বলেছেন। (আল ইরশাদ লিল খালীলী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৯২৮)
২) জাদীদ মুহাদ্দিসদের মধ্যে ইমাম বাইহাকী (রহঃ), ইমাম যাহাবী (রহঃ), হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ), ইমামুল জারাহ ওয়া তাদিলের ইমাম ইয়াহইয়া বিন সায়ীদুনিল কাত্ত্বান (রহঃ) এর হাওয়ালা দিয়ে লিখেছেন,
অর্থাৎ “আয়েম্মায়ে কেরামগণ তফসীর শাস্ত্রে এমন ব্যাক্তিদের (বর্ণনার ব্যাপারে) নরম পন্থা গ্রহণ করেছেন যাঁদেরকে হাদীসের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য বলা হয়নি। এরপর (ইয়াহইয়া বিন সায়ীদুনিল কাত্ত্বান) লাইস বিন আবী সালীম, জাওইবর বিন সায়ীদ এবং মুহাম্মাদ বিন আস সাইব আল কাবীর নাম নিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তাঁদের মত ব্যাক্তিদের উল্লেখ করা হাদীস তো প্রশংসার যোগ্য নয় তবে তাদের তফসীর লেখা যেতে পারে।” (দালায়েলুল নাবুয়াহ লিল বাইহাকী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৩, মীযানুল এ’তেদাল লিয যাহাবী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৯১, তরজুমা জুবাইর বিন সায়ীদ, তাহযীবুত তাহযীত লিল ইবনে হাজার, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫৯৪)
৩) সেইসব আয়েম্মা যাঁরা তফসীর শাস্ত্রে খ্যাতিসম্পন্ন, হয় তাঁরা (রেওয়াতের) বর্ণনার দিক থেকে খ্যাতিসম্পন্ন না হয় (দিরায়াত) বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে। মুহাদ্দিসরা যদি তাঁদের বর্ণনার দিক দিয়ে কালাম করেছেন তার মানে এটা জরুরী নয় যে তাঁদের দিরায়াতকেও অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। বরং তাঁর দিরায়াতের উপর দৃষ্টিপাত করা হবে। মুহাদ্দিসদের কালাম করাতে তাঁর দিরায়াতের কারণটা কার্যকারীতা হবে না। (আরশিফে মুলতাকা আহলিল তাফসীর, সংখ্যা-১, পৃষ্ঠা-১৫৮৮ থেকে ১৫৯৫)
৪) রিওয়ায়েতকে মিথ্যা বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কিন্তু দিরায়াতকে মিথ্যা বলা যেতে পারে না । বরং সেটাকে ভূল অথবা সাওয়াব বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। (প্রাগুপ্ত)
এই মূলনীতির পর আমাদের জবাবঃ
১ নং জবাবঃ
তফসীরে ইবনে আব্বাস এর রাবী মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস সাদী আস সাগীরের উপর হাদীস শাস্ত্রের দিকে জেরা করা হয়েছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর ব্যাপারে বলেছেন, (মীযানুল এ’তেদাল, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৬৩)
অর্থাৎ তাঁর হাদীস একেবারেই লেখা যাবে না তবে সে ‘সাহেবে তফসীর’ এবং ‘মুফাসসির’ বলা হয়েছে। (মাগানিউল আখইয়ার, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪২৯, সুজারাতুয যাহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩১৮)
অন্য বর্ণনায় আল কাবী এবং আবু সালেহকে মুফাসসির বলে বর্ণনা করা হয়েছে। (আল কামিল লি ইবনে আদী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-২১৩২, মীযানুল এ’তেদাল, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫৫৬, মাআরেফাতুস সিক্বাত লিল ইজলী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৪২)
বরং আল কাবীর তফসীর নেওয়াকে ইমাম ইয়াহইয়া বিন সায়ীদুনিল কাত্ত্বান (রহঃ) জায়েয বলেছেন। (দালায়েলুন নাবুয়াহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৩) এবং আবু সালেহকে ‘সিক্বাহ’ বলেছেন। (মাআরেফাতুস সিক্বাত লিল ইজলী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯২)
সুতরাং ১ নং এবং ২ নং মূলনীতি অনুযায়ী এদের তফসীর দলীলযোগ্য।
২ নং জবাবঃ
জুবাইর আলী যাই যে এর সনদের সিসিলার উপর জেরা করেছেন তা ৪ নং মূলনীতি অনুযায়ী তাফসীরী রাওয়ায়েতকে গ্রহণ করা যায় না।
৩ নং জবাবঃ
এই সনদের সিলসিলাকে বর্ণনার দিক দিয়ে কালাম করা হয়েছে কিন্তু ৩ নং মূলনীতি অনুযায়ী দিরায়াতের দিক দিয়ে কোন অসুবিধা নেই। দিরায়াতের দিক দিয়ে এই আয়াতে রফয়ে ইয়াদাইন না করার প্রমাণ রয়েছে। তার কারণ যে, এই আয়াতে কামিয়াব (সফল) মু’মিনদের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এই গুণাবলীর মধ্যে একটি গুণ হল, (নামাযে ধ্যানমগ্ন থাকে এবং একাগ্রতা বজায় রাখে।) “ধ্যানমগ্ন থাকে এবং একাগ্রতা” এর ব্যাপারে মুফাসসিরগণ বর্ণনা করেছেন যে,
অর্থাৎ “ধ্যানমগ্ন থাকে এবং একাগ্রতার প্রভাব যেন শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও প্রকাশ পায় এবং নামায যাতে শান্তিময় হয়। তারা এটা জানে যে, তারা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।” (তফসীরে আল ওয়াসীত, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-১২)
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) বলেছেন যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর (রাঃ) এর মত ব্যাক্তি নামাযে এমনভাবে দাঁড়াতেন যেন মাটিতে খুঁটি পোঁতা আছে। (সুনানে কুবরা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৫৮)
এইসব বর্ণনার অবস্থা হল যথার্থভাবে নড়ানড়ি থেকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং শান্তিভাবে নামায পড়তে হবে। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন, অর্থাৎ আমার জিকিরের জন্য নামায কায়েম কর।
রুকুতে যাওয়ার সময়, রুকু থেকে উঠার সময় এবং তৃতীয় রাকআতের শুরুতে যে রফয়ে ইয়াদাইন করা হয় সেই রফয়ে ইয়াদাইন যেহেতু জিকির থেকে খালি তাই সেই সময়ের নড়ানড়ি ধ্যানমগ্নতা এবং একাগ্রতার বিপরীত তাই (খাসিউন) রফয়ে ইয়াদাইন না করার প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। সুতরাং দিরায়াতের দিক দিয়ে রফয়ে ইয়াদাইন না করার প্রমাণিত হল। ওয়াল্লাহু আলামু বিস সাওয়াব।
১ নং পর্যালোচনাঃ
এই তফসীরের সমর্থনে আরো তফসীর রয়েছে। যেমন বিখ্যাত ‘সিক্বাহ’ তাবেয়ীন হযরত হাসান বসরী (রহঃ) [মৃত্যু ১১০ হিজরী সন] এই তফসীর করেছেন। তিনি কুরআন মজীদের উক্ত আয়াত (আল্লাযীনাহুম ফি স্বালাতিহিম খাসিউন) এর তফসীরে বলেছেন,
অর্থাৎ “এখানে (খাসিউন) বলতে সেইসব লোকদেরকে বলা হয়েছে যারা প্রথম তকবীরে রফয়ে ইয়াদাইন করেন।” (তফসীরে সমরকন্দী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪০৮)
এখানে প্রথম তকবীরে রফয়ে ইয়াদাইন করতে বলা হয়েছে। বাকি নামাযের রুকুতে যাওয়ার সময়, রুকু থেকে উঠার সময় এবং তৃতীয় রাকআতের শুরুতে যে রফয়ে ইয়াদাইন করার কথা বলা হয়নি। সুতরাং একমাত্র তকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন নেই।
২ নং পর্যালোচনাঃ
হযরত জাবির বিন সামুরাহ (রাঃ) এর হাদীসেও নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং শান্তিতে নামায পড়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এটা সমর্থন করে যে, এই রফয়ে ইয়াদাইন মু’মিনদের গুণাবলী (খাসিউন) এর বিপরীত।
হাদীসঃ হযরত জাবির বিন সামুরাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন লোকেদেরকে রফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখে বললেনঃ “তারা নিদেদের হাতকে উদ্ধত্ত্ব ঘোড়া লেজের মত উঠাচ্ছে। তোমরা নামাযে একাগ্রতা বজায় রাখ। (অর্থাৎ রফয়ে ইয়াদাইন করবে না ।)” [মুসলিম শরীফ]
৩ নং পর্যালোচনাঃ
জুবাইর আলী যাই হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর থেকে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যার বিপরীতে জুজ রফয়ে ইয়াদাইনের হাওয়ালা দিয়ে লিখেছেন, “এটা প্রমাণিত যে সাইয়েদেনা ইবনে আব্বাস (রাঃ) রুকুর আগে এবং রুকুর পরে রফয়ে ইয়াদাইন করতেন।” (মসরুবে হক, পৃষ্ঠা-২১-৩১)
১ নং জবাবঃ
জুজ রফয়ে ইয়াদানের মধ্যে এই বর্ণনাটি এইভাবে বর্ণিত আছে যে,
অর্থাৎ “আবু হামরাহ থেকে বর্ণিত যে, আমি ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে দেখেছি যে তিনি যখন তকবীর বলতেন এবং রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখন রফয়ে ইয়াদাইন করতেন।” (জুজ রফয়ে ইয়াদাইন লিল বুখারী, হাদীস নং ২১)
এই হাদীস দ্বারা গায়ের মুকাল্লিদদের মাযহাব কিভাবে প্রমাণিত হয়? তার কারণ, এই হাদীসের সনদে আবু হামরাহ ‘মজহুল’ (অজ্ঞাত) রাবী। তাই এই সনদটা সহীহ নয়। (দিল্লীর নুসখা, পৃষ্ঠা-২৭)
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে গায়ের মুকাল্লিদরা বিকৃত করে (আবু হামরাহকে) আবু হামযাহ বানিয়ে দিয়েছে। (জুজ রফয়ে ইয়াদাইন লিল বুখারী, তরজমা হযরত আমীন সফদর ওকাড়বী, পৃষ্ঠা-২৭৯)
২ নং জবাবঃ
গায়ের মুকাল্লিদদের মতবাদ হল, রুকুতে যাওয়ার সময়, রুকু থেকে উঠার সময় এবং তৃতীয় রাকআতের শুরুতে যে রফয়ে ইয়াদাইন করা প্রয়োজন। এতে ১০ বার রফয়ে ইয়াদাইন হয়।
- ১) তারা চার রাকআত নামাযে ১০ জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইন করে। প্রথম ও তৃতীয় রাকআতের শুরুতে। চার রুকুর পুর্বে ও পরে।
- ২) তারা ১৮ জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইন করেনা। দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাকআতের শুরুতে। ৮ সেজদাহর পূর্বে ও পরে।
- ৪) তাদের দাবী হলো, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জীবনের শেষ পর্যন্ত এ আমল করেছেন। অর্থাৎ ১০ জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইন করেছেন আর বাকি ১৮ জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইন করেন নি।
- ৫) যারা রফয়ে ইয়াদাইন করে না তাদের নামায বাতিল। তারা বেনামাযী।
কিন্তু যদি এই আবু হামরাহ থেকে বর্ণিত আসারকে সহীহ ধরেও নেওয়া হয় তাহলে বোঝা যায় ইবনে আব্বাস (রাঃ) ৪ রাকআত নামাযে ৫ বার রফয়ে ইয়াদাইন করতেন এবং ৫ বার করতেন না। সুতরাং ৪ রাকআত নামাযে ৫টি সুন্নাত ছেড়ে দিতেন। তাহলে এই আসার গায়ের মুকাল্লিদদের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে। জুবাইর আলী যাইকে দেখে নেওয়া উচিৎ যে তিনি কি দাবী করছেন আর কি দলীল পেশ করছেন। আর সেই দলীল তাঁর দাবীর পক্ষে রয়েছে কিনা? জানি না এই তথাকথিত ‘মুহাক্কিক’ সাহেবের এমন বর্ণনা সংগ্রহ করার এবং সেখান থেকে এস্তেদলাল করার প্রবঞ্চনাময় জুনুন (পাগলাগিরী) কোথা থেকে আসে?
৩ নং জবাবঃ
এই যয়ীফ হাদীসের বিপরীতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে,
অর্থাৎ “সাত জায়গায় হাত উঠানো হয়। প্রথম যখন নামায শুরু করা হয়।” (মাজমুউল কাবীর, হাদীস নং ১১৯০৪)
অথচ এইসব জায়গায় হাত উঠানোতে যেসব জায়গার উল্লেখ রয়েছে সেইসব জায়গায় গায়ের মুকাল্লিদরা হাত উঠায় না।
সুতরাং এই তিনটি জাবাব দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেল যে জুবাইর আলী যাই এর উক্ত আসার থেকে এস্তেদলাল করা বাতিল।
পরিশিষ্ট
সুতরাং এতক্ষণ দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে গেল যে কুরআন শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী নামাযে বার বার রফয়ে ইয়াদাইন করা যাবে না। কিন্তু গায়ের মুকাল্লিদরা কুরআন মানে কোথায়? ছলে বলে কৌশলে তাঁরা তাদের মতের বিপক্ষের হাদীস ও কুরআনকে অস্বীকার করে থাকেন। আর তাদের মতের পক্ষের জাল, যয়ীফ হাদীসকেও গ্রহণ করে থাকেন।
এই লেখায় প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে যে নামাযে বার বার রফয়ে ইয়াদাইন না করার কথা কুরআন শরীফে রয়েছে। দেখি আনওয়ারুল হক ফাইযীরা এর কি জবাব দেন।