মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে উচ্চ ন্যায়ালয় অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবে মুসলিম শিক্ষিত মহলে হইচই পড়ে গেছে। পশ্চিম বাংলার বুকে প্রায় সোয়া ছয়শত সরকার পোষিত মাদ্রাসা রয়েছে। প্রধানত এই মাদ্রাসাসমূহেই কমিশন থেকে নিয়োগ হয়। বিগত ১৯৯৬-৯৭ থেকে প্রথমে স্কুল সার্ভিস কমিশন পরে ২০০৮ থেকে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষক পাঠাচ্ছে। প্রাক্তন মাদ্রাসা মন্ত্রী বলেছেন, কমিশন শুধুমাত্র শিক্ষকের নাম পাঠায় সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার পূর্ণ অধিকার রয়েছে উক্ত শিক্ষককে নেওয়া বা না-নেওয়ার। রাজনৈতিক নেতার বাকচাতুর্যে বহু মানুষ মোহিত হতে পারেন। কিন্তু শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষ জানেন তাঁর কথার মধ্যে কৌশল আছে বাস্তবতার কণামাত্র নেই। প্রকৃত তথ্য হল স্কুল সার্ভিস বা মাদ্রাসা সার্ভিস যেই শিক্ষক পাঠাক সংশ্লিষ্ট স্কুল বা মাদ্রাসা সেই শিক্ষককে নিতে বাধ্য হত বা হয়। তিনটি কারণ, প্রথমটি হল প্রে নারিত শিক্ষক মহাশয়কে না নিলে অনুদান বন্ধের হুমকি দেওয়া থাকত। ছা-পোষা শিক্ষককুল বেতন বন্ধের ভয়ে উক্ত শিক্ষককেই নিতে বাধ্য হত। আরও একটি কারণ দীর্ঘদিন শিক্ষক না থাকায় (না থাকাটা এক থেকে তিন বছর বা আরও বেশি সময় ধরে হতে পারত বা পারে) স্কুল-মাদ্রাসায় লেখা-পড়া শিকেয় উঠে যেত। এখন হাতের কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা কমিশন প্রেরিত শিক্ষককেই নিতে বাধ্য হত। এরও উপর ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার চাপ এই রাজনৈতিক চারটি উপেক্ষা করার মত এত বুকের পাটা কোন সুপারিনটেনডেন্ট, হেড মোদাররেস বা প্রধান শিক্ষকের ছিল না। প্রকৃতপক্ষে উক্ত প্রধান প্রধান নিজেও এক রাজনৈতিক মতাদর্শগত নিয়োগের ফসল তাই তাঁর পক্ষে কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকত না। কৃতজ্ঞতা জানানোর পাত্রটি হেড মোদাররেস থেকে হেডমাস্টার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সাধারণ শিক্ষক নিয়োগে বিভিন্ন সার্ভিস কমিশন কে সামনে রেখে বাম শিক্ষক সংগঠনগুলি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই তাদের প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত সজাগ জনতার কাছে এরকম ভূরি ভূরি দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। তাই যাঁরা ভাবছেন কমিশন মানেই স্বচ্ছতা তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। বরং বলা যায় পরিচালন কমিটির কালো হাতের প্রভাব সরকারের কালো হাতে তুলনায় কম কৌশলী এবং অবশ্যই কম প্রভাবশালী।
যারা মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন এর স্বপক্ষে বলছেন তাঁদের মূল অভিযোগ হল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির দূর্নীতি ও স্বজন-পোষণ। এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং মেধায় পরিপূর্ণ এক যোগ্য শিক্ষকের জন্যই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের প্রয়োজন। ধরে নেওয়া যেতে পারে এই যোগ্য শিক্ষককুলের যোগ্যতা পূর্ণ শিক্ষাদানের ফলে মুসলিম এলাকার মাদ্রাসায় শিক্ষারত ছাত্রছাত্রীরা একটা দিগগজে পরিণত হয়েছে বা হবে। বিগত ১৭ বছর ধরে কমিশন প্রেরিত সুযোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে মুসলিম এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত কোন ছাত্র এই দিগগজ হওয়ার নিম্নতম সিঁড়িতে পৌঁছেছে কিনা তা নিয়ে প্রবল সংশয় রয়েছে। মাদ্রাসায় যে সকল মুসলিম (কিছু দলিত) ছেলে-মেয়েরা পড়তে যায়, হাই মাদ্রাসা ও খারেজি মাদ্রাসার ধরলে ৪ (চার) শতাংশের বেশি হবে না। সাধারণত এইসকল ছেলেমেয়েরা দরিদ্র, শিক্ষা সচেতন নন এমন পরিবার থেকে এসে থাকে। ব্যতিক্রমকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাদান করে দিগগজ বানানোর জন্য বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন। ছাত্র ভারে ভারাক্রান্ত স্কুল বা মাদ্রাসায় ১১-৪ টা নিয়ম বাঁধা চাকরি করতে আসা এবং চাকরি শেষে নিজের কোটরে ফিরে যাওয়া (সাধারণত নিকটবর্তী কোন শহর বা উন্নত এলাকা) শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয় এই বিশেষ পরিচর্যা করার। এই ছেলে-মেয়েদের প্রকৃত শিক্ষা হয় টিউশন করানো চাকরি না পাওয়া স্থানীয় কোন শিক্ষিত ছেলের চাটাইয়ে বসে, চেয়ার-টেবিল বেঞ্চে বসে নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একটু তলিয়ে ভাবলেই এই ধরনের কমিশন ও কমিশন প্রেরিত শিক্ষকের অসারতা চোখে পড়বে।
সার্ভিস কমিশন তৈরি হওয়ার আগে মুসলিম এলাকার বা অন্যত্র শিক্ষালয়গুলিতে স্থানীয় বা আশপাশের চাটাই বিছিয়ে টিউশন করা মানুষগুলিই চাকরি পেত। ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে। কমিশন তৈরি হওয়ার পর উন্নত ও শহুরে মানুষের দল এই স্থান পূরণ করে। পরিচালন কমিটি হাত ধরে নিয়োগ ‘৮০-র দশক থেকে শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন চালু হওয়ার পর থেকে বাঁধনহারা দুর্নীতির শিকার হয়ে পড়ে। স্থানীয় মানুষের চাকরি বহু ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের কাছে উপকারী। প্রথমত লেখাপড়া শিখে চাকরি পেলে আশ-পাশের মানুষ লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহিত হয়। উল্টোটা হলে লেখাপড়ার প্রতি অনীহা জাগে যা বিগত ১৭ বছর ধরে স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হওয়ার পর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অনীহা থেকে জাগে হতাশা, হতাশা মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয় নয়ত বেপরোয়া করে তোলে। এই বেপরোয়া ভাব থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম এলাকায় রাজনৈতিক খুনোখুনি, ধর্ষণ ও যাবতীয় অপরাধের আধিক্য বলে সমাজবিজ্ঞানীরা নিদান দিয়েছেন যা চাকরি না পাওয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সচ্ছল মুসলিম যাকাত ফিতরার মাধ্যমে অনেকটাই দারিদ্র দূর করে। কমিশনের বদৌলতে স্থানীয় মানুষ স্কুলে চাকরি থেকে হাত ধুয়ে ফেলায় দরিদ্র মানুষ এসব থেকেও বঞ্চিত হয়। পরিচালন কমিটির হাত ধরে নিয়োগগুলি যে সবসময় অযোগ্য শিক্ষক এনেছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নয়। যাঁরা এখন যোগ্য শিক্ষকের জন্য কমিশনের উপযোগিতা নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন বুক ঠুকে বলা যায় তারাও এই সকল শিক্ষকদের পরিশ্রমের ফসল।
বেশি মেধাবী ছাত্রকে শিক্ষকতা চাকরিতে নিয়োগ করলে অন্য বিপদও আছে। শিক্ষকটি শিক্ষকতার চাকরিটিকে তার উন্নতির সোপান হিসেবে দেখতে পারে এবং স্বয়ং আমি তিনটি এই ধরনের ঘটনার সাক্ষী। তিনটি ছেলেই এসএসসি-র মাধ্যমে নিযুক্ত হন। তিনজনই শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। একজন কাস্টমসে, দুজন পুলিশে। জনি শিক্ষকতা চাকরিতে শান্ত নিরুপদ্রব জীবন-যাপন করা যায়, বেতন ভালো, সম্মানও পাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেতে গেলে ভিন্ন চাকরিতে যেতে হয়। পুলিশে যাওয়া দুজনের একজন পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস দিয়ে উচ্চপদে গেলেও অপরজন কম বেতনের সাব ইন্সপেক্টর পদে যোগ দিয়েছেন শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বাদ পেতে।
ভাবতে হবে, কোনটা বেশি জরুরী। কিছু উন্নত চাকরি? না কিছু মানুষকে প্রকৃত শিক্ষাদানের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ তৈরি করা? তেলা মাথায় তেল দেওয়া না শিক্ষা প্রসার? তাই স্থানীয় মানুষের চাকরিটাই প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ। কারণ, একজন বহিরাগত অপেক্ষাকৃত মেধাবী যোগ্য শিক্ষক এলাকার মানুষকে লেখাপড়ায় যত না উৎসাহিত করবে তার থেকে বেশি উৎসাহিত করে পাশের বাড়ির ছেলেটি চাকরি পেলে। পরিচালন কমিটির দুর্নীতি রোধের জন্য কেন্দ্রীভূত সার্ভিস কমিশনের পরিবর্তে স্থানীয় সৎ, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের হাতে নিয়োগ ক্ষমতাটি থাকা উচিৎ বলে মনে হয়।
মুসলমান নারীদের বঞ্চনা প্রসঙ্গে সাচার কমিটির রিপাের্ট