লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
বঙ্গদেশের অন্তঃস্থলে অবস্থিত বীরভূম জেলার ভূপ্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস এক গভীর অন্তঃসার ধারণ করে আছে, যার প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন রাঢ়ভূমির স্মৃতি, সাধনার পরম্পরা এবং জনজীবনের নিরবিচ্ছিন্ন ছন্দ। এই জেলার নামের উৎপত্তি নিয়ে বহু মতপ্রকাশ থাকলেও প্রতিটি ধারণাই ইতিহাস ও লোকবিশ্বাসের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ। বীরভূম জেলার উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী, যার স্নিগ্ধ ধারা যেন ছুঁয়ে গেছে এ জেলার ইতিহাসের অজস্র অধ্যায়কে।
প্রথমত, ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার নিরিখে বীরভূম নামটির এক সম্ভাব্য উৎস খুঁজে পাওয়া যায় আদিবাসী মুণ্ডারি ভাষায়। এই ভাষায় ‘বির’ শব্দের অর্থ ‘জঙ্গল’—এ থেকেই ধারণা করা হয়, পূর্বে এই অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলবেষ্টিত, এবং সেই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই অঞ্চলটির নামকরণ হয়েছিল ‘বীরভূম’। আজও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বনভূমির অস্তিত্ব সেই ঐতিহাসিক দাবির সমর্থনে সাক্ষ্য দেয়। সম্ভবত এই কারণেই লোকমুখে বীরভূমকে “বীরভুঁইয়্যা” বা জঙ্গলময় ভূমি বলেও উল্লেখ করা হয়।
তবে শুধুমাত্র ভূপ্রকৃতি নয়, ধর্ম ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেও বীরভূম নামটির আরেকটি তাৎপর্য রয়েছে। একদা এই অঞ্চলে বীরাচার ভিত্তিক উপাসনাপদ্ধতি ও ধর্মানুষ্ঠানের বিস্তার ছিল লক্ষণীয়। তারাপীঠ, নলহাটির সিদ্ধপীঠ, লাভপুরের ফুল্লরা মন্দির প্রভৃতি ধর্মকেন্দ্রগুলি সেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ফলে অনেক ঐতিহাসিক ও জনবিশ্বাস অনুসারে, বীরাচার বা শাক্তাচারের বিস্তারের জন্যই এই অঞ্চলকে “বীরভূমি” বলা হতো, যা কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে ‘বীরভূম’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রামাণ্যগ্রন্থের আলোচনায় প্রথম ‘বীরভূম’ শব্দটির সাক্ষাৎ মেলে পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকে রচিত সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ‘ভবিষ্যপুরাণ’-এর ‘নাঢ়িকণ্ড’ অংশে। সেখানে “বীরভূম” নামটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে ধারণা করা যায়, এই নামটির প্রচলন বহু পূর্ব থেকেই ছিল। এরপর মুঘল আমলের এক গুরুত্বপূর্ণ নথি আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বীরভূম নামে একটি মহালের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময়ে এটি ছিল মাদারণ সরকারের অধীন এক সমৃদ্ধ প্রশাসনিক একক। সেখানে বলা হয়েছে, “মাদারণ সরকারের ষোলটি মহালের মধ্যে বীরভূম নামে একটি মহালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই মহাল থেকে দিল্লীর বাদশাহ আকবরকে ৪৯৫২২০ দাম রাজস্ব আদায় দেওয়া হত।”
এই সূত্র ধরে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শ্রীগৌরীহর মিত্র তাঁর ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন—
“পরবর্তী সময়ে এই বীরভূম মহালের সীমানা সঙ্কুচিত ও সম্প্রসারিত হইয়া তাণ্ডে সরকারের এব্রাহিমপুর, চোঙ্গ নদীয়া, দায়ুদ সাহী, স্বরূপ সিংহ, কুমার প্রতাপ, নওয়ানগর, জেন্নতাবাদ সরকারের সাহেজাদপুর, গোরাঘাট সরকারের ফতেপুর, সরিফাবাদ সরকারের সেরপুর আকবরসাহী এবং মাদারুন সরকারের বীরভূমি, নগর, সেনভূম প্রভৃতি মহাল লইয়া নূতন এবং স্বতন্ত্র জেলার সৃষ্টি হয়” (পৃ. ৫)।
এই তথ্যে স্পষ্ট হয়, বীরভূম একটি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং পরবর্তীকালে এর ভৌগোলিক সীমা বিভিন্ন শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়েছে।
অষ্টাদশ শতকে, বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭২৪-২৫ খ্রিঃ) বীরভূম পরিণত হয় মুর্শিদাবাদের অধীনে একটি প্রসিদ্ধ জমিদারির অংশে, যার মাধ্যমে আবারও তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভূপ্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নিরিখে বীরভূম ‘রাঢ়দেশ’-এর অন্তর্গত, বিশেষত ‘উত্তর রাঢ়’ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। প্রাচীন জৈন সাহিত্যে, বিশেষত ‘আচারাঙ্গ সূত্র’-এ এক বর্ণনায় জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর জিনের রাঢ়দেশে আগমন ও কষ্টের কথা বলা হয়েছে, যেখানে অঞ্চলটিকে বর্ণনা করা হয়েছে “বজ্রভূমি” নামে। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর অনন্য গবেষণাগ্রন্থ ‘বাঙ্গালির ইতিহাস, আদিপর্ব’-এ বলেন, “বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ভূমি যথার্থতই বজ্রভূমি” (পৃ. ৬০)। এই বজ্রভূমিই সম্ভবত কালক্রমে রূপান্তরিত হয়েছে ‘বীরভূমি’ নামকরণে।
ঐতিহাসিক ও ভূসাংস্কৃতিক বিকাশের আলোকে যে অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে, তা এক সময় পরিচিত ছিল ‘রাঢ়’ নামে, যা গঙ্গা ও ভাগীরথীর পশ্চিমপ্রবাহ অঞ্চল থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সপ্তম শতাব্দীর দিকে এই বিস্তৃত রাঢ় অঞ্চলকে ‘উত্তর রাঢ়’ ও ‘দক্ষিণ রাঢ়’ নামে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে বীরভূম উত্তর রাঢ়ের অংশ। গৌরীহর মিত্র তাঁর আলোচনায় প্রাচীন ‘কুলপঞ্জিকা’-এর একটি শ্লোক উল্লেখ করেন যেখানে বীরভূম অঞ্চলকে প্রাচীন কালে “কামকোটি” নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এইভাবে, নামের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সাহিত্য, ধর্ম, ভূপ্রকৃতি ও প্রশাসনিক ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে বীরভূম এক বহুমাত্রিক পরিচয়ের আধার হয়ে উঠেছে। আজকের বীরভূম শুধু একটি জেলা নয়—এ এক নিরব গাথা, যেখানে জঙ্গল, জনজীবন, সাধনা ও ইতিহাস এক অভিন্ন ছায়ারূপে বর্তমান।
পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বীরভূম জেলা একটি ইতিহাসপ্রবাহী জনপদ। এই জেলার নামকরণ ঘিরে যেভাবে নানান মত, বিশ্বাস, কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা পরিলক্ষিত হয়, তা একদিকে যেমন প্রাচীন বঙ্গের সাংস্কৃতিক বুননকে প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে ভাষাতত্ত্ব ও নৃগোষ্ঠীগত গতিপ্রবাহের দিক থেকেও তা এক অনন্য আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথমত, বীরভূম নামটির প্রাচীনতা ও প্রসারের ইঙ্গিত মেলে সংস্কৃত শাস্ত্র, প্রাচীন পুরাণ, মুঘল প্রশাসনিক দলিলপত্র, ও মধ্যযুগীয় হিন্দু রাজাদের দলিলাদিতে। বিশেষত মহেশ্বর বিরচিত ‘কুলপঞ্জিকা’ নামক গ্রন্থে একটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে, যা বীরভূম নামের উৎস নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন সূত্র সরবরাহ করে:
“বীরাভূঃ কামকোটিঃ স্যাৎ প্রাচ্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা আরণ্যকঃ প্রতীচ্যাঞ্চ দেশো দার্যদ উত্তরে। বিন্ধ্যাপাদোদ্ভবা নদ্যঃ দক্ষিণে বহবঃ স্থিতাঃ।”
এই শ্লোকের ভূগোলগত ব্যাখ্যায় বোঝা যায় যে পূর্বদিকে গঙ্গার সঙ্গে অজয় নদী মিলিত হয়েছে, পশ্চিমে ছিল ঘন অরণ্য তথা বর্তমান ঝাড়খণ্ডের বিস্তৃত বনভূমি, উত্তরে ছিল রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণে প্রবাহিত ছিল বিন্ধ্য পর্বত থেকে উৎপন্ন দামোদর নদী। এই বিবরণ অনুযায়ী “কামকোটি” ও “বীরাভূ” একই অঞ্চল নির্দেশ করে বলে মনে করা হয়। মহেশ্বর রচিত ‘কুলপঞ্জিকা’তেও স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে: “কামকোটি বীরভূম জানিবে নির্যাস।” অর্থাৎ কামকোটিই বীরভূম, এবং নামান্তরে এ দুটি একই ভূখণ্ড নির্দেশ করে।
তবে ইতিহাসের অনুসন্ধানী গবেষক শ্রীগৌরীহর মিত্র তাঁর ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে “কামকোটি” নামে বর্তমানে কোনও স্থানের অস্তিত্ব দৃশ্যমান নয়। এই ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ড. পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর একটি প্রবন্ধে (‘বীরভূমি’ পত্রিকা) জানিয়েছেন যে ‘দেউলী কাকোটি’ বা ‘কামকোটি’ নামে একটি গ্রাম ছিল, যা অজয় নদীর তীরে অবস্থিত এবং সেখানে গুপ্তযুগের নির্মিত শ্যামা কালী মূর্তি এখনও বর্তমান। তাঁর মতে, “কাম” শব্দটি “শ্রমণ” বা “শ্যামা”-র রূপান্তর, আর “কোটি” অর্থাৎ “কোট” হল দুর্গ। ফলে কামকোটি বলতে বোঝায় – এক ধর্মীয় দুর্গ বা কালীপূজাকেন্দ্র। এই মত অনুযায়ী, ‘বীরভূম’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে এক প্রাচীন ধর্মস্থলেরই অভিঘাত থেকে।
তবে বীরভূম নামটির আরেকটি সম্ভাব্য উৎস অনুসন্ধান করেন ইতিহাসবিদগণ সেন রাজবংশের উৎসলিপিগুলি থেকে। বল্লাল সেনের সীতাহাটি তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে যে এক চন্দ্রবংশীয় রাজা ‘বীরসেন’ এই অঞ্চলে শাসন করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর বংশধর বিজয় সেন, বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন বাংলার রাজ্যশাসনে অধিষ্ঠিত হন। অনেক পণ্ডিতের মতে, বীরসেনের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম হয় “বীরভূম”। এমনকি, প্রাচীন শাসনব্যবস্থার ধারা বিবেচনায় এই ব্যাখ্যাটি ইতিহাসসম্মত বলেই প্রতীয়মান।
তবে ইতিহাসের চিহ্নিত পরিসরে এক বিশেষ ব্যতিক্রমী মত পেশ করেন ইতিহাসবিদ ও ক্ষেত্রগবেষক ড. অর্ণব মজুমদার, যিনি ‘বীরভূম: ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামক তাঁর বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থে এ বিষয়ে নতুন আলো ফেলেছেন। গ্রন্থের ৩২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন:
“আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বীরভূমে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষী দুইজন ক্ষত্রিয় — বীরসিংহ ও চৈতন্য সিংহ। এই সময়ে লক্ষ্মণ সেনের প্রশাসন শিথিল হয়ে পড়েছিল। নানাস্থানে স্থানীয় শাসনকর্তারা প্রায় স্বাধীন হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে বীর ও চৈতন্য সিংহ বীরভূম ও বর্ধমান অঞ্চলে দুটি স্বাধীন কর্তৃত্ব গড়ে তুলেছিল। বর্তমান বর্ধমানের চৈতন্যপুর ছিল চৈতন্য সিংহের রাজধানী আর বীর সিংহের রাজধানী ছিল সিউড়ির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বীরসিংহপুর। পরবর্তীকালে তুর্কি আক্রমণে বীর সিংহ নিহত হলেও তাঁর উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন নগরে। বীরসিংহের এই বংশধরেরা পরিচিত ছিল বীররাজা হিসাবে। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত তাদের স্বাধীন কর্তৃত্ব বর্তমান ছিল। খুবই স্বাভাবিক ভাবেই বীররাজাদের রাজ্য পরিচিত হয়ে উঠেছিল বীরদেশ বা বীরভূম নামে। দ্বাদশ-এয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত নগরকে কেন্দ্র করে বর্তমান বীরভূমের এক বড় অংশ স্বাধীন শাসন পরিচালিত করেছিল বীররাজা নামে অভিহিত এক হিন্দু রাজবংশ। আর এই রাজবংশের নামে তাদের শাসিত দেশ বা ভূমি পরিচিত হয়ে উঠেছিল বীরভূম নামে।”
এই বিবরণে দেখা যায়, বীরভূম নামটির উৎপত্তি সরাসরি “বীর সিংহ” নামক ক্ষত্রিয় শাসকের নামের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর উত্তরপুরুষেরা নিজেদেরকে ‘বীররাজা’ বলে পরিচয় দিতেন এবং তাঁদের শাসনাধীন অঞ্চল পরিচিত হয় ‘বীরভূম’ নামে। এই মতটি অঞ্চলিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের একটি শক্তিশালী ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হয়, কারণ এতে অঞ্চলটির স্বাধীন সামন্তশাসনের একটি সাংগঠনিক কাঠামোর চিত্রও ভেসে ওঠে।
এই ব্যাখ্যাগুলির পাশাপাশি আরও একটি প্রচলিত মত বিশ্লেষণ করেন ড. অর্ণব মজুমদার, যেটি মূলত সাঁওতালি শব্দভাণ্ডারের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অনেক পণ্ডিতের মতে ‘বীর’ শব্দটি মুণ্ডারি বা সাঁওতালি ভাষার, যার অর্থ ‘জঙ্গল’। সেই অর্থে, ‘বীরভূম’ মানে ‘জঙ্গলভূমি’। কিন্তু ড. মজুমদার এই মতটি খণ্ডন করেন যুক্তির ভিত্তিতে। তাঁর মতে সাঁওতালরা বৃহত্তর বীরভূম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন আনুমানিক দুই-আড়াইশ বছর আগে, অর্থাৎ সতেরো শতকের মাঝামাঝি। তার বহু আগেই বীরভূম নামটির অস্তিত্ব দেখা যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নথিতে। সুতরাং, তাঁর মতে, “বীর” শব্দটি সাঁওতালি বা আদিবাসী উৎস থেকে উদ্ভূত হওয়ার তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য নয়।
এই প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ মহিমানিরঞ্জন চক্রবর্তী তাঁর ‘বীরভূম রাজবংশ’ গ্রন্থে যথার্থই মন্তব্য করেছেন:
“সাঁওতালগণ আপনাদের অসংস্কৃত ভাষায় ‘বীর’ শব্দের সঙ্গে যে সংস্কৃত ‘ভূমি’ বা ‘ভূম’ শব্দের মিশ্রণ করিয়াছিল তাহার সঙ্গত কারণ অনুমিত হয় না। সোজাসুজি নিজ ভাষাতেই সম্পূর্ণ নামটি রাখা স্বাভাবিক।”
অর্থাৎ যদি সাঁওতালরা নামটি দিয়ে থাকতেন, তবে তা তাঁদের নিজস্ব শব্দভাণ্ডারেই গঠিত হতো, সংস্কৃত উপসর্গযুক্ত হতো না। অতএব বীরভূম নামটির উৎস খুঁজতে গেলে প্রাচীন হিন্দু শাসনব্যবস্থা, ক্ষত্রিয় রাজবংশের উত্থান ও ধর্মীয় কেন্দ্রিকতা—এই তিনটি প্রধান ক্ষেত্রেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত।
সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, বীরভূম নামটি কেবল একটি ভৌগোলিক সত্তা নির্দেশ করে না; এটি বহুবর্ণ ও বহুস্তরবিশিষ্ট ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্মচর্চার সমাহারও বটে। নামের উৎস নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও প্রতিটি ব্যাখ্যা, প্রতিটি কিংবদন্তি ও প্রতিটি শাস্ত্রসূত্র বীরভূমের অতীত পরিচয়কে একটু একটু করে স্পষ্ট করে তোলে। ইতিহাসের পরতে পরতে নির্মিত এই নামের পেছনে আছে বীরত্ব, ভক্তি, বনভূমি ও বংশপরম্পরার গৌরবগাথা—যা আজকের বীরভূমের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বহন করে চলেছে এক নিরব অথচ দীপ্ত ধারায়।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির সন্ধানে বীরভূম: জৈন ও বৌদ্ধ প্রভাবের আলোকে
প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির বহুস্তরীয় প্রবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থান বীরভূম। এই জেলার অতীত শুধুমাত্র রাজা-রাজড়াদের রাজনৈতিক শাসনের ইতিহাস নয়, বরং নানা ধর্মতাত্ত্বিক অনুশীলনের, আধ্যাত্মিক সাধনার এবং লোকবিশ্বাসের দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ধারার সাক্ষ্যবাহী। বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব যুগে জৈন ও পরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব এই অঞ্চলে এক গভীর ছাপ ফেলে গেছে, যার চিহ্ন এখনও নানা প্রত্নস্থল, মূর্তি, জনজাতি ও লোকবিশ্বাসে টিকে আছে।
জৈন ধর্মের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাবীর জিন রাঢ় অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন। জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘আচারাঙ্গ’ সূত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এই অঞ্চল ছিল ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়দেশ’, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বর্তমান বীরভূম। গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, মহাবীর যখন এই অঞ্চলে নিঃসঙ্গতায় ধর্মপ্রচার করছিলেন, তখন এখানকার অনেক অধিবাসীই তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়, এমনকি কিছু কুকুরও তাঁকে কামড়াতে উদ্যত হয়, অথচ কেউ সেই কুকুরদের প্রতিহত করেনি। এই ‘বজ্জভূমি’ পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে ‘বৈরভূমি’, এবং ক্রমে তা রূপান্তরিত হয় ‘বীরভূম’ নামে।

এ প্রসঙ্গে ভূগোলগত অবস্থানের দিক থেকে দেখা যায়, ‘বঙ্গভূমি’র পূর্বসীমায় প্রবাহিত হয়েছে ভাগীরথী, দক্ষিণে সুহ্মভূমি বা সিংহভূমি, পশ্চিমে মল্লভূমি, গোপভূমি এবং বীরভূম। অর্থাৎ বীরভূম ছিল এক সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক সংযোগবিন্দু, যেখানে উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ের বৈচিত্র্য মিলেমিশে এক উর্বর ধর্মীয় ভূমি তৈরি করেছিল।
এতদঞ্চলের নানা জায়গায় জৈন ধর্মের প্রভাব আজও পরিলক্ষিত হয়। যেমন, মহম্মদ বাজার অঞ্চলের ‘মহাবীরপাহাড়ী’ নামটি নিঃসন্দেহে জৈন ধর্মের তীর্থঙ্কর মহাবীরের নাম থেকে উদ্ভূত। রাঢ় অঞ্চলের বিশিষ্ট গবেষক ড. সুধীর কুমার করণ তাঁর ‘সীমান্ত বাংলার লোক্যান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত মল্লারপুরে মল্লেশ্বর শিবমন্দিরের একটি কক্ষে ধ্যানমগ্ন এক দেবমূর্তি রয়েছে, যেটিকে তিনি জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি বলে অনুমান করেছেন। একই বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন:
“বীরভূমে যে সব মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলির অধিকাংশই ঋষভনাথ, আদিনাথ, শক্তিনাথ, সোমনাথ ও পার্শ্বনাথের। পার্শ্বনাথের মূর্তির সংখ্যাই বেশি।”
ড. পঞ্চানন মণ্ডলের মতে, মহাবীর বীরভূমের সাদীনপুর, পাইকর (জৈন সাহিত্যে উল্লিখিত ‘পওকালয়’), সুমারপুর, সাঁইথিয়া প্রভৃতি স্থানে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি ধর্মপ্রচারে অংশ নেন। ‘আচারাঙ্গ সূত্রে’ যে ‘শ্রাবক’ সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে, তাদের তিনি জৈন ধর্মগুরুদের অনুগামী বলে চিহ্নিত করেছেন। এই শ্রাবক সম্প্রদায়কেই অপভ্রংশে আজ ‘শরাক’ নামে ডাকা হয় এবং বীরভূমের বিভিন্ন গ্রামে এখনও এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বর্তমান।
বিগত শতাব্দীতে সরকারি জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে বীরভূমে জৈন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল ১৮১২ জন, যা ২০০১ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৪০৮ জনে। এই পরিসংখ্যান ধর্মীয় পরিচয় মুছে যাওয়ার ইতিহাসকে সামনে আনে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে জানা যায় যে, জৈন ধর্মের পতনের পর এ অঞ্চলে পার্শ্বনাথসহ বিভিন্ন তীর্থঙ্করের মূর্তি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে স্থানীয় হিন্দু দেবতা মনসা ও কালভৈরবে রূপান্তরিত হয়। “বীরভূমের নানা স্থানে মনসা ও কালভৈরব পূজিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে জৈনদের অবলুপ্তির পর পার্শ্বনাথসহ জৈন সাধকদের মূর্তিগুলি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে মনসা ও কালভৈরবে।”
জৈন ধর্মের পরবর্তী প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম বীরভূমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতক থেকেই এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান লক্ষ করা যায়। এক হাজার বছরেরও অধিক সময় ধরে বীরভূম ছিল বৌদ্ধ উপনিবেশের অংশ। এই প্রভাবের নিদর্শন আজও দৃশ্যমান। যেমন, লোহাপুর ব্লকের বারা গ্রামে বজ্রযানী বৌদ্ধদের একটি সিদ্ধক্ষেত্র ছিল। এখানে ও তীরগ্রামে একত্রিশটি বুদ্ধমূর্তি এবং একটি বৌদ্ধদেবী ভুবনেশ্বরীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া ময়ূরেশ্বর ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত কলেশ্বর গ্রামে একটি সাড়ে তিন হাত উচ্চ বাসুদেব মূর্তি আজও অপরূপ কারুকার্য সহকারে বর্তমান, যেটি বৌদ্ধ যুগের পরবর্তী হিন্দু রূপান্তরের দৃষ্টান্ত।
এই ধরনের রূপান্তরের আরও বহু নিদর্শন মেলে পাইকর, বীরচন্দ্রপুর, নন্দীগ্রাম, ঢেকা, ঘোষগ্রাম, রাংতরা, ভদ্রপুর প্রভৃতি গ্রামে। এগুলিতে বিষ্ণুমূর্তির আদলে একশোরও বেশি বাসুদেব মূর্তি পাওয়া গেছে, যেগুলি মূলত বৌদ্ধ বাসুদেব মূর্তির রূপান্তর। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ভদ্রপুর গ্রাম থেকে যে অবলোকিতেশ্বর মূর্তি উদ্ধার হয়েছে, তার শিরোভাগে অমিতাভ বুদ্ধের প্রতীক খচিত এবং তা সমাধি মুদ্রায় উপবিষ্ট।
“বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা একসময় যেমন ধর্মঠাকুরের পূজা করতেন তেমনি বহু বুদ্ধমূর্তিও বিভিন্ন স্থানে ধর্মঠাকুর হিসেবে বর্তমানে পূজিত হয়। এমনকি অনেক স্থানে বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মঠাকুরের পূজাও বৌদ্ধ প্রভাবজাত বলে কেউ কেউ মনে করেন।” অর্থাৎ ধর্মীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়েও বৌদ্ধ চেতনার রেশ আজও লোকবিশ্বাসে বিদ্যমান।
দশম শতক পর্যন্ত বীরভূমে বৌদ্ধধর্মের দুটি শাখা—বজ্রযান ও সহজযান—অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। বজ্রযানীরা কঠোর ধর্মানুশাসন অনুসরণ করলেও সহজযানীরা ছিলেন অনেক বেশি উদার ও মানবকেন্দ্রিক। সহজযানী সাধকেরা, বিশেষত সাহজিয়াদের উত্তরসূরিরা হিন্দু বৈষ্ণব পোশাকে, আলখাল্লা ও তিলক ধারণ করে বাউল দর্শনের মাধ্যমে এই মানবধর্ম চর্চা চালিয়ে যান।
এই সহজযানী ধারার প্রভাবে বীরভূমের চারিচন্দ্রভেদি অঞ্চলের বাউল সম্প্রদায় মানবতাবাদী চেতনার ধারক হয়ে ওঠে। তাঁদের জীবনদর্শনে প্রতিফলিত হয় সহজযানীয় বৌদ্ধদর্শন। তাঁদের মতে: “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” এই একটি বাণীতেই ধরা পড়ে বৌদ্ধ-সহজযানী সাধনার চূড়ান্ত মানবিক দর্শন যা আজও বীরভূমের সাংস্কৃতিক হৃদয়ে স্পন্দিত।
রাঢ় বঙ্গের ইতিহাসে বীরভূম এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও মৌর্য বা শুঙ্গ শাসনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ এ অঞ্চলে আজও আবিষ্কৃত হয়নি, তবে গুপ্তযুগীয় সভ্যতা যে বীরভূমে প্রসারিত ছিল, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত নেই। বিশেষ করে জেলার বারা ও নানুর অঞ্চলের নাম এই যুগের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়, কারণ এই দুই স্থান থেকেই গুপ্ত বংশের রাজা বালাদিত্য উপাধিধারী নরসিংহ গুপ্তের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা উদ্ধার হয়েছে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, এই মুদ্রা প্রমাণ করে যে, বালাদিত্য হয়তো বারাসহ সংলগ্ন অঞ্চল যেমন নগরা ও আশপাশের ভূমির অধিপতি ছিলেন।
বলা হয়ে থাকে, এই অঞ্চলেই চন্দ্রবর্মা নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি বসবাস করতেন যার অধস্তন উত্তরপুরুষরা পরে নলহাটি, নানুর এবং সন্ধিগড়া বাজারের আশপাশে বসতি স্থাপন করেন। এই সমস্ত তথ্য থেকেই অনুমান করা যায়, গুপ্ত-পরবর্তী যুগেও এই অঞ্চল একটি সক্রিয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল।
এরপরের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো শশাঙ্কের শাসন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার প্রথম ঐতিহাসিক হিন্দু রাজা শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণকে কেন্দ্র করে রাজ্য পরিচালনা করতেন, এবং সেই সময় বীরভূমের পূর্বাংশও তাঁর শাসনাধীন ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছু সময় পর চীনা পর্যটক হিউ-এন-সাঙ (Xuanzang) ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের পথে একটি জঙ্গলাকীর্ণ, লৌহ আকরসমৃদ্ধ ও ঊষর অঞ্চলের উল্লেখ করেন, যার নাম ছিল ‘ক-জঙ্গল’। বর্তমানে ঐ অঞ্চলটি বীরভূমের মুরারই, নলহাটি ও রামপুরহাট থানার আওতায় পড়ে।
এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাঝেই পাল রাজবংশের উত্থান ঘটে। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বীরভূমে পালদের শাসন ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। এর একটি শক্তিশালী প্রমাণ মেলে মুরারই থানার অন্তর্গত পাইকর গ্রামে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে। এই শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে চেদি রাজবংশের কর্ণদেব নয়পালের রাজধানী আক্রমণ করেন, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হন। পালরাজা নয়পাল ও চেদিপতি কর্ণদেবের মধ্যে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামক একজন বৌদ্ধ পণ্ডিতের মধ্যস্থতায় মিত্রতা স্থাপিত হয়। এই ঘটনার ঐতিহাসিক সাক্ষী হল মুরারই থানার অধীন বর্তমান ‘মিত্রপুর’ নামের এক নিঃশব্দ গ্রাম।
পালযুগে বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি শৈব ধর্মও বিস্তার লাভ করে। এই সময়েই বীরভূমের সুরথেশ্বর ও ডাবুকগ্রামের ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির নির্মিত হয় বলে জানা যায়। এই স্থাপত্য নিদর্শনগুলি পালযুগের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি।
পাল রাজত্বের শেষপর্বে সেন রাজবংশের উত্থান ঘটে। কর্ণাটক অঞ্চল থেকে আগত এক যোদ্ধা হেমন্ত সেন দামোদর-অজয় নদীর উপত্যকায় এক নতুন রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করেন, যা সেন সাম্রাজ্যের সূচনা নির্দেশ করে। তাঁর পুত্র বিজয় সেন পরে গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। কিংবদন্তী অনুসারে বিজয় সেন প্রথমে মুরারই থানার বীরনগরে বসবাস করতেন। বিজয় সেনের একজন বীর সেনানায়ক পাহি দত্তের নাম অনুসারেই ‘পাইকর’ নামের গ্রামটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এখানে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে উৎকীর্ণ রয়েছে “রাজেন্দ্র শ্রী বিজয় সেন” – যা নিশ্চিত করে যে এই অঞ্চলে বিজয় সেন দেবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেন যুগের আরেক স্মরণীয় নিদর্শন হলো বল্লাল সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বল্লারপুর গ্রাম। লক্ষ্মণ সেন ছিলেন এই বংশের শেষ প্রতাপশালী রাজা।
সেন বংশের পতনের পর শুরু হয় মুসলমান শাসন, তবে শুরুতেই মুঘলরা বীরভূমে তেমনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। বরং পাঠান শক্তির আবির্ভাব হয় এই অঞ্চলে। ষোড়শ শতকের আশির দশকে জোনেদ খাঁ নামক এক পাঠান শাসক নগরের বীররাজাকে পরাজিত করে রাজনগরের শাসন ক্ষমতা দখল করেন। পাঠান ফৌজদারদের রাজত্বকাল প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তাঁদের মধ্যে আলিনকি খাঁ ছিলেন একজন বিশিষ্ট বীর যিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বর্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কলকাতায় ইংরেজদের উপর আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন। পাঠানদের রাজধানী ছিল ‘লক্ষুর’ বা ‘নগর’, যা আজকের রাজনগর নামে পরিচিত।
রাজনগর পাঠান শাসনের সময় কামান ও গোলা তৈরির একটি কারখানা ছিল, যা এ অঞ্চলের সামরিক সামর্থ্য ও শিল্পচর্চার সাক্ষ্যবাহক। এই তোপখানা এখনও রাজনগরের ইতিহাস বহন করে চলেছে।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর শুরু হয় ব্রিটিশ শাসন। বীরভূমও এর ব্যতিক্রম নয়। কোম্পানি রাজ এই অঞ্চলে বিভিন্ন কুঠিবাড়ি স্থাপন করে—গুনুটিয়া, নারায়ণপুর, সুপুর, রায়পুর, ইটাণ্ডা, ইলামবাজার প্রভৃতি স্থানে। এই কুঠিগুলিকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশরা কৃষকদের উপর চরম শোষণ শুরু করে। এই অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে বীরভূমের মানুষ বিশেষত কৃষক ও উপজাতীয় সমাজের মানুষজন বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। ১৮৫৫ সালে ঘটে সাঁওতাল বিদ্রোহ, যা অনেক ঐতিহাসিকের মতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক রূপ। এই বিদ্রোহে সাঁওতালদের পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন অ-সাঁওতাল দরিদ্র কৃষক, তাঁতী সম্প্রদায়ের জোলা, কামার, গোয়ালা ও অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণির মানুষ। তাঁরা জমিদারি শোষণ, মহাজনি লুণ্ঠন এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিলেন। নারায়ণপুর গ্রামের কামারেরা বিদ্রোহীদের জন্য তিরের ফলা বানিয়েছিল, যা প্রমাণ করে এই বিদ্রোহ ছিল এক সর্বসমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদ।
রাজনগরের কুশকর্ণী ও সিদ্ধেশ্বরী নদীর তীরে ইংরেজদের সঙ্গে সাঁওতালদের প্রবল লড়াই হয়েছিল। বন্দুকের মুখে তির-ধনুক নিয়ে এই অসামান্য লড়াই আজও বীরভূমবাসীর গর্বের বিষয়। সাঁওতালরা এই লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন, অনেকে ধরা পড়ে কঠোর দণ্ড ভোগ করেছেন। জেলার নলহাটি, মহম্মদবাজার, রামপুরহাট, লাঙ্গুলিয়া ও রাজনগর প্রভৃতি গ্রাম কিছু সময়ের জন্য সাঁওতাল ও কৃষকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এই মহান বিদ্রোহের স্মৃতি আজ অনেকটাই বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতায় এবং বীরভূমের জনমানসে তা এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এটি ছিল কেবল একটি বিদ্রোহ নয়, বরং এক বৃহত্তর প্রতিবাদ—দেশীয় শোষণ, সামন্তবাদী নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বীরভূমবাসীর সম্মিলিত মানবিক প্রতিরোধ।
বাঙালির ইতিহাসে বীরভূম জেলার অবদান কতখানি, তা বিশ্লেষণ করলে সুপ্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘটনাক্রমে এক বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা নজরে আসে। এই অঞ্চলের জনমানস, প্রতিরোধচেতনা এবং সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য যুগে যুগে ইতিহাসকে দীপ্ত করেছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্পর্বে বীরভূম জেলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’—এই দুই বিপ্লবী সংগঠন জেলার বিভিন্ন অংশে তাঁদের গোপন কার্যক্রম বিস্তার করেছিল। জেলার ভালাস, যোগাই, জাজিগ্রাম ও ঝাউপাড়ার মতো গ্রামগুলি ছিল বিপ্লবীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। এখানে একদিকে যেমন বিপ্লবের পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়েছে স্থানীয় মানুষ, তেমনি অন্যদিকে এসব অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে সক্রিয়ভাবে সংগঠিত হয়েছেন বিপ্লবীরা। এই জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি নাম একেকটি প্রতীক—দুকড়িবালা, পান্নালাল দাশগুপ্ত, বিনয় চৌধুরী, নিশাপতি মাঝি, রাধানাথ চট্টোরাজ, হংসেশ্বর রায়, গোপিকা বিলাস সেন, লালবিহারী সিংহ, যুগলপদ দাস, কামদাকিংকর মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চক্রবর্তী, সমাদীশ রায়, প্রভাত ঘোষ, শরদীশ রায়, জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ আলি এবং আব্দুল হালিম প্রমুখ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের মুক্তির যজ্ঞে।
স্বাধীনতা-উত্তর কালেও বীরভূম রাজনৈতিক উষ্মা ও পরিবর্তনের পীঠভূমি হিসেবে পরিচিতি পায়। কৃষিজমি নিয়ে বাম কৃষক আন্দোলন জেলার নলহাটি থানার ধরমপুর এবং মহম্মদবাজার থানার ডামরার মতো গ্রামে প্রবলভাবে সংগঠিত হয়। ষাটের দশক থেকে যে নকশাল আন্দোলন বাঙলার গ্রামাঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বালায়, তার ঢেউ বীরভূমেও প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে। সামাজিক বৈষম্য, জমিদার ও মহাজনশ্রেণির দমননীতি এবং কৃষিজীবী মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন এক নতুন সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
তবে কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণেই নয়, প্রত্নতত্ত্বের নিরিখেও বীরভূম জেলা বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জেলার বোলপুর মহকুমার অন্তর্গত ইলামবাজার ব্লকের নিকটেই অবস্থিত এক ঐতিহাসিক স্থান—পাণ্ডুরাজার ঢিবি। এই স্থানটি শুধু প্রত্নপ্রেমীদের জন্য নয়, ইতিহাসবিদদের কাছেও এক অতুলনীয় সম্পদ। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে খননকার্যের ফলে যেসব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে, সেগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০/১২০০ অব্দের। অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন ইতিহাসের সজীব সাক্ষ্য বহন করছে এই স্থান।
এখানে আবিষ্কৃত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণ লোহিত মৃৎপাত্রের খণ্ড, নরকঙ্কালসহ কবর, ক্ষুদ্রাশ্ম নির্মিত যন্ত্র, শ্বেত রেখাঙ্কিত ধূসর মৃত্তিকাবয়ব, জলনালিযুক্ত পাত্র, পেঁচানো সাপের মতো আকৃতির অলংকার, আংটি, কাজলের কাঠি, তামার বঁড়শি, পোড়ামাটির বড় টালি, সূঁচ ও ছুঁচ জাতীয় যন্ত্রপাতি, লোহার তৈরি ছোট তরোয়াল এবং বুদ্ধময় নারীমূর্তি। এমনকি একাধিক গোল শিলমোহরও উদ্ধার হয়েছে, যা স্থানীয় জনসমাজের প্রশাসনিক কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়।
এই সকল নিদর্শন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পাণ্ডুরাজার ঢিবি কেবল বসতি নয়, বরং তা ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশের কেন্দ্র। এখানকার মানুষ শুধু পাথর নয়, তামারও ব্যবহার শুরু করেছিল। এই সমাজ কৃষিকাজে পারদর্শী, গৃহপালিত পশুপালনে রত, স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল এবং শিল্প-নৈপুণ্যে নিপুণ ছিল। সমাজবদ্ধ জীবনধারার প্রাথমিক বিন্যাস এখানেই দেখা যায়। নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই উল্লেখ করেছেন, “বাঙালির আদি ইতিহাসের রূপ, যা একদা শুরু হয়েছিল বীরভূম থেকে।”
বোলপুরের নিকটবর্তী কোপাই নদীর তীরবর্তী মহিষদল গ্রামেও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এক অভাবনীয় ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে। এই স্থান থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তু খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮০ অব্দ হতে ৮৫৫ অব্দের মধ্যবর্তী। মহিষদল গ্রামে পাওয়া গিয়েছে নলখাগড়া ও বাঁশের কাঠামোর দেওয়ালবিশিষ্ট গৃহাবশেষ, ধারালো পাথরের ফলক, তাম্র কুঠার, মৃত্তিকালিঙ্গ, হাড় নির্মিত বস্তু, অলঙ্কারযুক্ত চিরুনি, চুড়ি, তির-বর্শা ও খননের যন্ত্র। এ সকল বস্তু নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে তাম্র-প্রস্তর যুগেই এই অঞ্চলে বাঙালির প্রাচীনতম বসতির প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছিল।
এই প্রত্নবস্তু থেকে বোঝা যায়, এখানকার জনগণ কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালন এবং নির্মাণশিল্পে দক্ষ ছিল। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন ও শিল্প-সৃজনশীলতা এদের জীবনধারার মৌল বৈশিষ্ট্য। লোহার অস্ত্র ও ক্ষুদ্র প্রস্তর-আয়ুধের ব্যবহার ছিল এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলই বাঙালির প্রাচীন বসতির প্রথম কেন্দ্রস্থল—যেখানে মানুষ শস্য উৎপাদন, বাসস্থান নির্মাণ এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল।
পাণ্ডুরাজার ঢিবি ও মহিষদল ছাড়াও জেলার অন্যান্য অঞ্চলেও তাম্র-প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির নানা নিদর্শন মিলেছে। বোলপুর থানার দেউলী, নানুর থানার নানুর, কীর্ণাহার ও বেলুটি, ইলামবাজার থানার মুন্দিরা, সিউড়ি থানার হারাইপুর এবং ময়ূরেশ্বর থানার কোটাসুর প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে অতীতের সুপ্রাচীন মানবসমাজের কীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সমস্ত স্থান থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয়, তাম্র-প্রস্তর যুগ থেকেই বীরভূম ছিল এক জীবন্ত সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র। এখানকার মাটি শুধু জনসমাজের ইতিহাস নয়, বরং বাংলার প্রাচীনতর অস্তিত্বের ধারা বহন করে চলেছে।
বস্তুত, বীরভূম কেবলমাত্র এক ভৌগোলিক পরিচয় নয়; এটি এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, সংস্কৃতির পরম্পরা ও সংগ্রামের ইতিহাস। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঔপনিবেশিক শোষণ ও স্বাধীনতার সূর্যোদয় পর্যন্ত প্রতিটি পর্বে এই জেলা রেখেছে তার স্পষ্ট ছাপ। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনা, কৃষক সংগ্রামের প্রত্যয়, প্রত্নতত্ত্বের আদি ঐতিহ্য—সব মিলিয়ে বীরভূম হয়ে উঠেছে বাংলার ইতিহাসের এক সমুজ্জ্বল অধ্যায়।
ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী বীরভূম জেলার ভৌগোলিক পরিচিতি
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত বীরভূম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী, যা পশ্চিম থেকে পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত হয়ে জেলাটিকে উত্তর ও দক্ষিণ – এই দুই ভৌগোলিক খণ্ডে বিভক্ত করেছে। এই নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত অঞ্চলটি আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্র, যা সমৃদ্ধ ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতির নিরিখে এক অনন্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের গবেষণার পরিধি নির্ধারিত হয়েছে ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর অংশে, যার মধ্যে পড়ে রামপুরহাট মহকুমার বিস্তৃত একটি ভূখণ্ড এবং সিউড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত মহম্মদবাজার ব্লক এবং সাঁইথিয়া ব্লকের হরিসরা ও দেরিয়াপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ছাব্বিশটি গ্রাম। সমগ্র ক্ষেত্রটির ভৌগোলিক পরিসর ১৯১৩.৬৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।
রামপুরহাট মহকুমায় প্রশাসনিক দিক থেকে মোট আটটি ব্লক এবং পাঁচটি থানা রয়েছে। ব্লকগুলি হল— মুরারই ১ ও ২, নলহাটি ১ ও ২, রামপুরহাট ১ ও ২ এবং ময়ূরেশ্বর ১ ও ২। আর থানাগুলি হল— মুরারই, নলহাটি, রামপুরহাট, মাড়গ্রাম ও ময়ূরেশ্বর। আমাদের সমীক্ষা ক্ষেত্রে মহম্মদবাজার থানাও অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তরাংশে আনুমানিক আটশত আশিটি গ্রাম অবস্থিত। এই এলাকায় দুটি পৌরসভা আছে – একটি রামপুরহাট এবং অপরটি নলহাটি।
ভৌগোলিক দিক থেকে আমাদের সমীক্ষান্তর্গত ক্ষেত্রটির দক্ষিণে অবস্থিত বীরভূম জেলার অবশিষ্ট অংশ, যার মধ্যে পড়ে সাঁইথিয়া, লাভপুর ও সিউড়ি ১ নম্বর ব্লক। পশ্চিম দিকে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা জেলা, উত্তরে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা এবং পূর্ব দিকেও মুর্শিদাবাদ জেলা বিস্তৃত। ভূখণ্ডগত দিক থেকে এই অঞ্চলটি দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর দিকে উঠে এসে এক বিশেষ ত্রিভুজাকার কাঠামো নির্মাণ করেছে। এই সমগ্র ভূভাগকে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থের চিত্রসূচি ১-এ।
ভৌগোলিক গঠন ও ভূমিরূপ অনুসারে আলোচ্য অঞ্চলটিকে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায় – পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব। পশ্চিম ও মধ্য অংশের অর্ধেক এলাকা পূর্ব ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমির সম্প্রসারণস্বরূপ। ভূতাত্ত্বিক আলোড়নের ফলে সৃষ্ট এই মালভূমির প্রান্তভাগ এসে মিলেছে বীরভূম জেলার পশ্চিম সীমান্তে। আমাদের সমীক্ষা ক্ষেত্রের পশ্চিমাংশে যে উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো ভূমির বিস্তার দেখা যায়, তার নিচে নিহিত রয়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার স্তর। ভূবিজ্ঞানীদের মতে এই শিলার বয়স প্রায় নব্বই কোটি বছর, যা আরকিয়ান যুগের অঙ্গ।
আমাদের আলোচ্য এলাকার উত্তর-পশ্চিম অংশে রয়েছে জুরাসিক যুগের আগ্নেয়শিলা, যা প্লাইস্টোসীন পর্বের পুরা পলিভূমির (older alluvium) অন্তর্গত। এই আগ্নেয়শিলা পরবর্তী কালে ল্যাটেরাইট বা লালমাটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এই ল্যাটেরাইট মাটিকে বলা হয় ‘মুরাম’। মুরাম-এর নিচে প্রোথিত রয়েছে শক্ত কালো শিলা, যা স্থানীয়ভাবে ‘বেলেশ পাথর’ নামে পরিচিত। এই ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠন দেখা যায় রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লক এবং মহম্মদবাজার ব্লকের পশ্চিম অংশে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। একই সঙ্গে নলহাটি ব্লকের পশ্চিম অংশেও বেলেশ পাথরের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এই অঞ্চলগুলিতে যেখানে লালমাটি বা মুরাম প্রধান, সেইসব এলাকায় কৃষিকাজ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। এ ধরনের মাটি জলধারণে অক্ষম, বৃষ্টির পানি সহজেই নিচে চলে যায়, ফলে চাষাবাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সেচের ব্যবস্থা না থাকলে কৃষিকার্য ব্যাহত হয়। ফলে কৃষিনির্ভর জীবিকা এখানে একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, অন্যদিকে তেমনি লড়াই-জর্জর মানুষজনের পরিশ্রম ও মাটির সঙ্গে সহাবস্থানের এক অনন্য ইতিহাস তৈরি করেছে।
বহুমাত্রিক এই ভূমিরূপ ও ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য বীরভূম জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৃত্তিকা প্রকৃতি এবং ভূতাত্ত্বিক গঠনের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের জনজীবন, পেশাগত পরিকাঠামো, কৃষি ব্যবস্থা ও বসতি বিন্যাস গড়ে উঠেছে এক বিশেষ ধারায়। যার ফলে ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকজ জীবনের মধ্যেও এই ভূপ্রকৃতির প্রতিফলন স্পষ্ট।
আমাদের গবেষণা-পরিসরে যে সমস্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আমরা একদিকে যেমন পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম ভূগাঠনিক স্তরের সন্ধান পাই, তেমনি অন্যদিকে আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের পটভূমিতে এখানকার মানুষের শ্রম, প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই এবং জীবনযাত্রার বহুবর্ণ প্রতিচ্ছবিও অনুভব করতে পারি। ভৌগোলিকভাবে বিচিত্র হলেও এই অঞ্চল সমগ্র বীরভূম জেলার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেখানে ইতিহাস, ভূগোল এবং মানুষের জীবনযাপন এক অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে।
নদীর তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতা ও জনজীবনের ইতিহাস মানবজাতির বিবর্তনের এক চিরন্তন অধ্যায়। ঠিক তেমনই বাংলার বুক চিরে প্রবাহিত ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বীরভূম জেলার ভৌগোলিক সত্তা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় যেন প্রাচীনতার সঙ্গে নবজাগরণের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রটি ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তরাংশে বিস্তৃত, যার মধ্যে পড়ে রামপুরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা এবং সিউড়ি সদর মহকুমাভুক্ত মহম্মদবাজার ব্লক ও সাঁইথিয়া ব্লকের অন্তর্গত হরিসরা ও দেরিয়াপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ছাব্বিশটি গ্রাম। মোট আয়তন প্রায় ১৯১৩.৬৪ বর্গ কিমি।
প্রশাসনিক বিভাজনের দিক থেকে রামপুরহাট মহকুমায় রয়েছে আটটি ব্লক—মুরারই (১ ও ২), নলহাটি (১ ও ২), রামপুরহাট (১ ও ২), এবং ময়ূরেশ্বর (১ ও ২)। থানাগুলি হল মুরারই, নলহাটি, রামপুরহাট, মাড়গ্রাম এবং ময়ূরেশ্বর। পাশাপাশি, সমীক্ষা অঞ্চলে দুটি পৌরসভা—নলহাটি ও রামপুরহাট। এই অঞ্চলটির দক্ষিণ সীমায় রয়েছে বীরভূমের সাঁইথিয়া, লাভপুর ও সিউড়ি ব্লকসমূহ; পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলা; উত্তরে পাকুড় ও পূর্বে মুর্শিদাবাদ জেলা। সমগ্র অঞ্চলটি ভৌগোলিক মানচিত্রে ত্রিভুজাকৃতি এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড হিসেবে প্রতিভাত হয়।
ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী এই বিস্তীর্ণ এলাকা পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত। পশ্চিম এবং মধ্যভাগের বেশ কিছু অংশই পূর্বভারতের ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। প্রায় নব্বই কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি আরকিয়ান যুগের কঠিন পাথরের স্তর এই অঞ্চলের প্রাচীনতম ভূস্তর। জুরাসিক যুগের আগ্নেয় শিলা এবং প্লাইস্টোসীন পর্বের পুরা পলিভূমির (older alluvium) অবস্থানও এখানকার ভূতাত্ত্বিক গঠনকে বৈচিত্র্যময় করেছে। বিশেষত, রামপুরহাট থানার পশ্চিমাংশের শিয়ালডাঙ্গা, বারোমাসিয়া, সাগরবানডি, মলুটি ইত্যাদি গ্রামে এই প্রাচীন আগ্নেয় শিলার চিহ্ন সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
স্থানীয় মানুষজন এই শিলাগুলিকে ‘মুরাম’ নামে চিহ্নিত করেন—এটি ল্যাটেরাইট জাতীয় একটি মৃত্তিকা। এর নিচে থাকে কঠিন কালো পাথর, স্থানীয় ভাষায় ‘বেলেশ পাথর’। এই দুই ভূগঠনের অবস্থান বিশেষত লক্ষ্য করা যায় রামপুরহাট (১) ও মহম্মদবাজার ব্লকের পশ্চিমাঞ্চলে এবং নলহাটি ব্লকের বহু অংশে। এখানকার লালমাটিতে চাষাবাদ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও দুরূহ, তবু কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে চাষ ক্রমশ প্রসার লাভ করছে।
আমাদের আলোচ্য এলাকার মধ্যভাগ কিছুটা পাহাড়-টিলা ও অরণ্যঘেরা, যা স্বভাবতই কৃষির প্রসারে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তবে পূর্বদিকটা ভূপ্রকৃতিগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বীরভূম জেলার সর্বোৎকৃষ্ট অংশ বলে বিবেচিত। এখানে পাথুরে ভূস্তরের অবসান ঘটেছে। মাটি উর্বর, কিছুটা কাঁকর ও ‘ঘুটিং’ মিশ্রিত ধূসর প্রকৃতির। এই অঞ্চলে পুরনো পলি ‘ভাঙ্গার’ এবং নতুন পলি ‘খাদার’ স্তর একত্রে মিশে চাষের জন্য সহায়ক ভূমি নির্মাণ করেছে। জমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবাদযোগ্য এবং রয়েছে অসংখ্য দিঘি, পুকুর, খাল, বিল, নদী—যা সেচ ও জলসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বিশাল ভূমিকা পালন করছে। ধান এখানকার প্রধান ফসল, যার উৎপাদন এই অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
নদী বাংলা সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ময়ূরাক্ষী নদীর প্রবাহ যেমন ভূপ্রকৃতিকে নির্ধারণ করেছে, তেমনি নির্ধারণ করেছে জনজীবনের রূপ ও দিকনির্দেশ। এই নদী পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে গোটা বীরভূম জেলাকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষায় একে ‘মোর নদী’ বলা হয়। ও’ম্যালির ‘বীরভূম গেজেটিয়ার’-এও এই নদীকে ‘MOR’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। নদীটির উৎস ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ত্রিকূট পাহাড় অঞ্চলে, সেখান থেকে আমজোড়া গ্রামের কাছে বীরভূমে প্রবেশ করেছে। জেলার মধ্যে নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিমি।
ময়ূরাক্ষী নদীর সঙ্গে বীরভূমের গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই নদী শুধু ভূপ্রাকৃতিক নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সাক্ষী। ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় এই নদীর তীরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সাঁওতালদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। দিঘুলি গ্রামের পাশে অবস্থিত সেই রণক্ষেত্র এখনও ‘সাঁওতাল কাটার মাঠ’ নামে পরিচিত। নদীটির উপর নির্মিত ‘মিহিরলাল সেতু’ ও তিলপাড়া জলাধার শুধু আধুনিক সেচব্যবস্থার অংশ নয়, বীরভূমের উন্নয়নেরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও ময়ূরাক্ষী নদী বারংবার ফিরে এসেছে। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ লেখকের রচনায় এই নদী শুধু প্রকৃতি নয়, এক জীবন্ত চরিত্রেরূপে হাজির হয়েছে। নদীর উপনদী ‘মণিকর্ণিকা’ বা স্থানীয় ভাষায় ‘কাঁদর’ নামেও পরিচিত, যা ‘রাঢ়কেন্দ্র’ বা রাঢ়কেঁদ প্রত্নস্থানের নিকটে ময়ূরাক্ষীতে মিলিত হয়েছে। এই অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত তারাশঙ্করের গল্প ‘রসকলি’র কাহিনিও এই নদীর বাঁকে বসে রচিত হয়েছে।
ময়ূরাক্ষীর উত্তরাংশে প্রবাহিত দ্বারকা নদী তীরবর্তী তারাপীঠ, এক সুপ্রতিষ্ঠিত তীর্থস্থান। মাড়গ্রাম, যা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় গ্রাম হিসেবে পরিচিত, এই নদীর তীরেই অবস্থিত। দ্বারকা নদীর কিছুটা উত্তরে ব্রাহ্মণী নদী প্রবাহিত। ঝাড়খণ্ডের দুধুয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী মুরারই থানার নারায়ণপুরে বীরভূমে প্রবেশ করে। এক সময় এই নদীপথেই বেনেরা বাণিজ্য করত ঢাকাই মসলিন ও সিল্ক কাপড়ের। নারায়ণপুরে নদীতীরবর্তী কামারপল্লিরা আকরিক লোহা গলিয়ে অস্ত্র নির্মাণ করত। ব্রাহ্মণীর তীরে এখনও ইতিহাসের সেই নিঃশব্দ পদচিহ্ন বহন করে চলেছে গ্রামীণ জনজীবন।
ভূমি ও নদীর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুধু উৎপাদনের বিষয়েই নয়, একটি জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শন ও সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরে প্রোথিত থাকে। বীরভূমের উত্তর তীরবর্তী অঞ্চল তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, উর্বরতা, জনজীবন, ঐতিহাসিক স্মৃতি ও সাহিত্যচর্চার নিরিখে বাংলা ভূগোলের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক অংশ হিসেবে বিবেচিত। কৃষি, সেচ, যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি স্থানীয় ভূগঠনের প্রাচীনতা ও বৈচিত্র্য এই অঞ্চলকে করেছে প্রত্নতত্ত্ব ও ভূবিজ্ঞানের এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
এই নদীমাতৃক জনপদ—যার ইতিহাস শুধু সভ্যতার বিকাশ নয়, সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও সৃষ্টির ইতিহাস—সেই জনজীবনের স্বরূপ বুঝতে গেলে ময়ূরাক্ষী ও তার সঙ্গী নদী-উপনদীগুলিকে জানতে হবে গভীরভাবে। কারণ নদী শুধু ভূমিকে নয়, মননকেও গড়ে তোলে। এবং বীরভূমে ময়ূরাক্ষী ঠিক সে কাজই করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে।
বাংলার নদীমাতৃক সভ্যতা শুধু কৃষিকাজের আধার নয়, মানুষের মননের ভুবনকেও পুষ্ট করেছে যুগ যুগ ধরে। সেই অর্থে বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, নদ-নদী ও জলবায়ুর প্রেক্ষাপট একটি স্বতন্ত্র সামাজিক বাস্তবতাকে নির্মাণ করে। এ যেন ভূপ্রকৃতির ছায়ায় গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
ময়ূরাক্ষী নদী তো এই অঞ্চলের প্রাণ, কিন্তু একমাত্র সে-ই নয়—তার পাশে পাশে এই ভূমিকে সমৃদ্ধ করেছে আরও অনেক স্বল্পপরিচিত, তবুও গুরুত্বপূর্ণ নদী ও উপনদী। আমাদের আলোচ্য সমীক্ষা ক্ষেত্রজুড়ে বর্তমান রয়েছে বাঁশলৈ ও পাগলা নদী। এদের প্রবাহ হয়তো ময়ূরাক্ষীর মতো দীর্ঘ নয়, কিন্তু এরা স্থানীয় কৃষি, জলাধার সংস্থান এবং ভূগোলের বৈচিত্র্যকে গঠন করেছে নিঃশব্দে।
তদুপরি এই এলাকায় রয়েছে অজস্র ক্ষুদ্র জলপ্রবাহ—যাদেরকে স্থানীয় মানুষ “কাঁদর” বা “কাতার” নামে অভিহিত করেন। এসব কাঁদরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল পলাশী, গম্ভীরা, চিল্লা, গোনা, বন্দর, কালীদহ, ঘুটিংয়া, এবং যমুনা। নামগুলোর মধ্যেই যেন ধ্বনিত হচ্ছে নদীর গতি, স্থানীয় উচ্চারণ, জীবনের ছন্দ। এদের কেউ কেউ বর্ষায় স্বরূপে জেগে ওঠে, কেউবা চিরকালীন শান্তস্রোতা। তবে এক বিষয়ে তারা সবই একরকম—এই অঞ্চল বর্ষাভিত্তিক হাওয়াপ্রবাহ ও ঋতুচক্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় “বীরভূম জেলার সমস্ত নদী—কাঁদর সবই বর্ষার জলে পুষ্ট। একমাত্র বর্ষা ছাড়া সারাবছরই হেঁটে পারাপারের যোগ্য; তাতে হাঁটুজলও থাকে না।” এই এক কথাতেই ধরা পড়ে বীরভূমের জলবায়ু ও নদীর সম্পর্কের মৌলিক রূপ।
সত্যিই তো, বৃষ্টির ফোঁটাতেই জেগে ওঠে নদীর প্রাণ। সেইসঙ্গে কৃষিকাজে আসে প্রাণশক্তি। ফলে নদী যেমন ভূমিকে প্রাণবন্ত করে, তেমনই আবার বছরের অধিকাংশ সময় নদীশয্যা রয়ে যায় শুষ্ক, নদী যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করে তার বর্ষা-মাতৃকার আহ্বানের জন্য। এখানেই প্রাকৃতিক নির্ভরতার নিরালম্ব দিকটি ধরা দেয়।
ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী বীরভূম জেলার জলবায়ু প্রকৃতপক্ষে কর্কটক্রান্তি রেখার সংলগ্নতার কারণে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটি একধরনের উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ুর প্রতিচ্ছবি। গ্রীষ্মে এখানকার তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে ভূমি যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে বর্ষার ফোঁটার জন্য। “গরমকালে তীব্র গরম। গ্রীষ্মের দাবদাহে চারিদিক ঝলসে যায়। মার্চ মাসের শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা থাকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গ্রীষ্মের দাবদাহ এখানে ‘ঝলাস’ নামে পরিচিত।” এই শব্দটি ‘ঝলাস’ স্থানীয় ভাষায় শুধু একটি তাপপ্রবাহ নয়, এক বর্ণনাত্মক অভিধান—যেখানে সূর্য, ধুলো ও খরার সম্মিলন মানুষের মনে, শরীরে এবং জীবিকায় ছাপ ফেলে রাখে।
বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে এই অঞ্চলেরই একটি গ্রামে। “পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত ময়ূরেশ্বর গ্রাম।” এখানকার খরতপ্ত দিনগুলি এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও রুক্ষতার জন্ম দেয়, যা একদিকে যেমন জীবনকে কঠিন করে তোলে, তেমনই কৃষিজীবী মানুষদের মনোবল ও প্রকৃতিনির্ভর উদ্ভাবনী শক্তিকেও প্রকাশ করে।
কিন্তু প্রকৃতি একক কোনো চিত্রে আবদ্ধ নয়। যেমন গ্রীষ্মে দাবদাহ, তেমনি বর্ষা আসে তার উদার জলরাশির হাতছানি নিয়ে। জুন মাসের শেষাংশ থেকে আগস্টের শেষভাগ পর্যন্ত বীরভূম বর্ষার ছায়াতলে আবদ্ধ থাকে। “সারা বছরের মোট গড় বৃষ্টিপাত ১৪০০ মিলিমিটারের ৭৮ শতাংশই হয় এই সময়ে।” সেই সঙ্গে নদীগুলি পুনরুজ্জীবিত হয়, খাল-বিল-ডোবা গুলো জলভর্তি হয়ে ওঠে, মাঠে নেমে আসে কৃষক, শুরু হয় নতুন চাষের প্রস্তুতি। প্রকৃতি যেন নতুন রূপে ফিরে আসে।
আবার শীতেও এখানে ঋতুবৈচিত্র্য পূর্ণমাত্রায় উপলব্ধি করা যায়। মৃদু কুয়াশা, তীব্র ঠান্ডা ও সকালের শিশিরে ঘাসের মাথায় জমানো জলের বিন্দুতে যেমন শীতের সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, তেমনি কৃষক-শ্রমিকের হাত জমে যাওয়া, চুল্লির আগুনে বসে থাকা মুখগুলোয় শীতের প্রভাব ছায়াপাত করে। “২০০৪ এবং ২০০৬ সালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং ২০০৫ সালে ছিল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।” এই তাপমাত্রা বাংলার অন্যত্র তুলনামূলকভাবে বিরল।
এই আবহাওয়ার রূপ নিয়ে ও’ম্যালি তাঁর বিখ্যাত গেজেটিয়ারে মন্তব্য করেছিলেন—“The Climate of the district is generally dry, mild and healthy.” এ মন্তব্যের মধ্যেই ধরা পড়ে এখানকার আবহাওয়ার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। প্রকৃতি এখানে উগ্রও নয়, বরং মাঝে মাঝে ধৈর্যশীল ও প্রায়শই ক্লান্ত, কিন্তু জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতিও পাল্টে যায়। “নিয়ম মাফিক বাতাস, গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে, শীতকালে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এবং বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়।” এই বাতাস কখনও শুষ্কতা আনে, কখনও মেঘ বয়ে আনে, আবার কখনও নিয়ে আসে শীতের হিমেল পরশ। এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ।
এই ভূখণ্ডে জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির রূপ শুধু পরিবেশগত নয়, তা একটি বিস্তৃত সামাজিক পরিসরের নির্দেশক। নদী শুকিয়ে গেলে যেমন চাষে প্রভাব পড়ে, তেমনি শীতের তীব্রতা বহু শ্রমিকের কাজকে থামিয়ে দেয়। আবার বর্ষা যেমন আশীর্বাদ, তেমনি অতিবর্ষণে ভেঙে যায় মাটির রাস্তা, ভেসে যায় কাঁচা ঘর। তাই প্রকৃতির অনিয়মিত দানেই গড়ে ওঠে মানুষের জীবনচর্চার এক টানাপোড়েনময় অধ্যায়।
নদী, নালা, কাঁদর, কাতার—এসব যেন শুধু ভূগোল নয়, বেঁচে থাকার প্রতীক। তাদের প্রবাহ যতটা জলে, তার চেয়েও বেশি মানুষের স্মৃতিতে, সাহিত্যে ও স্বপ্নে। এখানে প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে গাঁথা আছে মানুষের জীবনের গভীরতম অনুভূতি, আর এই অনুভূতির মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী বীরভূম জেলার অনন্য ভূ-সামাজিক পরিচয়।
নদীমাতৃক বাংলার প্রাণস্পন্দন বহন করে চলা বীরভূম জেলার একটি স্বতন্ত্র জনজীবন গড়ে উঠেছে ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর তীরে। এই অঞ্চল শুধু ভৌগোলিক বৈচিত্র্যেই নয়, জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যেও অনন্য। ২০০১ সালের জনগণনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী রামপুরহাট মহকুমার লোকসংখ্যা ছিল ১২,৬৯,৭০২ জন এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনঘনত্ব ছিল ৮০৭ জন, যা এই অঞ্চলের ঘনবসতি ও কৃষিনির্ভর সামাজিক জীবনের একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
রামপুরহাট মহকুমার প্রশাসনিক কাঠামো আটটি ব্লক ও দুটি পৌরসভার মধ্যে বিস্তৃত। প্রতিটি ব্লকের জনসংখ্যা ছিল ভিন্ন ভিন্ন, তবে মোটামুটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিস্তার লক্ষ করা যায়। নলহাটি ১ নম্বর ব্লকের জনসংখ্যা ছিল ২,০৮,৬৪২ জন এবং ২ নম্বর ব্লকে ছিল ১,০৭,৬৫৮ জন। মুরারই ১ ও ২ নম্বর ব্লকে ছিল যথাক্রমে ১,৫৪,৩৪২ এবং ১,৭৭,৭৪৮ জন। ময়ূরেশ্বর ১ ও ২ নম্বর ব্লকে জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১,৩৯,৭৩৩ ও ১,১৩,০৩১ জন। রামপুরহাট ১ ও ২ নম্বর ব্লকে ছিল ১,৫৯,১৯৩ ও ১,৫৮,৭৪২ জন। এছাড়াও রামপুরহাট পৌরসভায় ৫০,৬১৩ জন এবং নলহাটি পৌরসভায় ৩৪,০৩৮ জন মানুষের বসবাস ছিল।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বীরভূম জেলার উত্তরাংশের একটি বড় অংশ মূলত গ্রামীণ জনবসতির অন্তর্ভুক্ত। যদিও দুটি পৌরসভা কিছুটা নগরায়িত পরিবেশের ইঙ্গিত দেয়, তবুও এখানে শহরের চেয়ে গ্রামই জনজীবনের প্রধান অবলম্বন। এই অঞ্চলের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোও সেই অনুযায়ী গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ এবং সংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে যুক্ত।
এই অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল হল সিউড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত মহম্মদবাজার ব্লক ও সাঁইথিয়া ব্লকের অংশবিশেষ। মহম্মদবাজার ব্লকের জনসংখ্যা ছিল ১,৩৯,৪৬৫ জন এবং সাঁইথিয়া ব্লকের অধীন দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের জনসংখ্যা ছিল ১৭,৮৫৭ জন। সব মিলিয়ে আমাদের আলোচ্য সমীক্ষা ক্ষেত্রের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪,৬১০৬২ জন।
এই বিপুল সংখ্যক জনগণের মধ্যে মাত্র ৫.৯৩ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করতেন, বাকিরা—অর্থাৎ প্রায় ৯৪.০৭ শতাংশ মানুষ—গ্রামেই বসবাস করতেন। এই অনুপাত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যকেই নির্দেশ করে, যেখানে জীবন ও জীবিকা প্রাকৃতিক নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে। কৃষিকাজ, পশুপালন, হস্তশিল্প এবং স্থানীয় বাজারে নির্ভরশীলতা এই সমাজের মূল ভিত্তি।
বসবাসের এমন একটি কাঠামো শুধু ভৌগোলিক নয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের জনজীবনে ভাষা, কৃষ্টি, উৎসব এবং প্রথাগুলি অধিক প্রাসঙ্গিক। শহর কেন্দ্রীক জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গন অনেকাংশেই গ্রামীণ অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যে আচ্ছন্ন। পাশাপাশি, শহরের সীমিত জনগোষ্ঠী সরকারি প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রীয় বিন্দু হিসেবে কাজ করে।
এই বৈসাদৃশ্য ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসে একটা ভারসাম্য তৈরি করে। যেখানে শহর কার্যকর কেন্দ্রীয় পরিষেবা সরবরাহ করে এবং গ্রাম সরবরাহ করে জনশক্তি ও কৃষিজ সম্পদ। এই সম্পর্ক গভীরতর হলে অঞ্চলটির সামগ্রিক উন্নয়ন সহজতর হয়।
রামপুরহাট মহকুমা ও আশেপাশের অঞ্চলগুলি জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। ফলে পরিবেশ, কৃষি, জলব্যবস্থাপনা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে, জনসংখ্যার এমন বিস্তার প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও নীতিমালার প্রয়োগ অপরিহার্য।
জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায় যে, ২০০১ সালের তুলনায় পরবর্তী দশকে এই জেলার জনসংখ্যা আরও বেড়েছে, এবং সেই বৃদ্ধি মূলত হয়েছে গ্রামীণ এলাকায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষির আধুনিকীকরণ এই জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
তথ্যগতভাবে এই অঞ্চলের জনবিন্যাস একদিকে যেমন ঘনবসতির ইঙ্গিত দেয়, তেমনি তা মানবসম্পদ ও উৎপাদনের সম্ভাবনার দিকটিও উন্মোচিত করে। গ্রামের প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি চাষি, প্রতিটি শ্রমজীবী ব্যক্তি এই জনশক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গ্রামীণ জনগণনার এই বিশ্লেষণ আমাদের উপলব্ধি করায় যে, বীরভূম জেলার উত্তর তীরবর্তী অংশটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জনসম্পদভিত্তিক এলাকা। এখানে মাটি ও মানুষ একে অপরের সম্পূরক। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিক কালের প্রান্তে এসে জনসংখ্যা শুধু সংখ্যা নয়, একটি জীবনব্যবস্থার ধারক ও বাহক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতএব, এই অঞ্চলের জনসংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা শুধু পরিসংখ্যানগত দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণযোগ্য। কারণ এই সংখ্যার ভিতরেই লুকিয়ে আছে একটি জীবন্ত ইতিহাস, একটি পরিবর্তনশীল বর্তমান এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
বীরভূম জেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মহম্মদবাজার ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, যেমন রসপুর, বৈদ্যনাথপুর, ডেউচা, ডামরা এবং গনপুর—এসব স্থানের জনজীবনে এক বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরেই টিকে আছে। এদের বলা হয় ঢেকারু। গ্রামীণ মেঠো জীবনের অঙ্গ হিসেবে ঢেকারুরা কেবল একটি জাতিগত পরিচয়ের বাহক নয়, বরং এক নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও আর্থসামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
ঢেকারুদের আবির্ভাব ঘটে মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পশ্চিম বিহার ও ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এরা বাঙলার ভূখণ্ডে, বিশেষ করে বীরভূমে প্রবেশ করে মূলত শিল্প ও খনিশ্রমিক হিসেবে। সেই সময় বীরভূম ছিল লৌহ আকর ও প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম কেন্দ্র। তাই এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল একাধিক লোহার খনি ও ক্ষুদ্র শিল্পকেন্দ্র, যার শ্রমিকরূপে ঢেকারুদের আগমন ঘটে।
তৎকালীন মহম্মদবাজার এলাকার একাধিক স্থানে—বিশেষত ডেউচা ও রসপুর অঞ্চলে—কারখানা ও খনিশিল্প বিকশিত হয়েছিল। ঢেকারুরা সেই শিল্পকেন্দ্রের মূল শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করত। শক্তিশালী শরীর, কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত মন ও অনুশাসন মেনে চলার সহজাত প্রবৃত্তির জন্য এরা অল্পদিনেই এই খনিশ্রমিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে। কিন্তু কালের নিয়মে সেই শিল্পব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কারখানাগুলি একের পর এক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঢেকারুদের জীবনেও নেমে আসে ঘোর সংকট।
শিল্প হারিয়ে গেলে জীবিকা হারানো ঢেকারুদের একটি অংশ মূলস্রোতের সমাজে আত্মস্থ হতে না পেরে বেছে নেয় দুর্ভাগ্যজনক এক পথ—দস্যুবৃত্তি। এটা যদিও একটি অস্থায়ী পর্যায়, কিন্তু সে সময় এই জাতিগোষ্ঠীর ওপর একটি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। ফলে আর্থসামাজিকভাবে এরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
তবে ঢেকারুরা নিজেদের অস্তিত্ব মুছে যেতে দেয়নি। জীবিকার জন্য আজকের দিনে তারা মজুর হিসেবে বিভিন্ন কৃষিকাজে যুক্ত। কেউ কেউ ভাগচাষ করে, আবার কেউ কেউ বনে-জঙ্গলে কাঠ, পাতার সংগ্ৰহ করে বাজারে বিক্রি করে দিন গুজরান করে। তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও টিকে আছে দৃঢ়ভাবে।
ঢেকারুদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য যে, তারা শারীরিকভাবে সাধারণত বলিষ্ঠ। পুরুষদের মতো নারীরাও দেহে সুঠাম গঠন এবং পরিশ্রমে পারদর্শী। এদের গায়ের রং সাধারণত কৃষ্ণবর্ণ। মুখাবয়বে আদিবাসী বৈশিষ্ট্য প্রবল। এদের অনেককেই সাঁওতাল, কোল বা ভিল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই সাদৃশ্য কেবল বাহ্যিক নয়, সাংস্কৃতিক চর্চাতেও স্পষ্ট।
টোটেমিক সংস্কৃতির একটি চিহ্ন এদের মধ্যেও স্পষ্ট। ঢেকারুদের টোটেম প্রাণী হল ভেড়া। এই কারণে তারা ভেড়ার মাংস খায় না। এটি কেবল নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং জাতিগত পরিচয়ের একটি দার্শনিক প্রতীক। আদিবাসী সমাজে টোটেমিক বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা জাতি, গোত্র এবং পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে। ঢেকারুদের এই বিশ্বাসও সেই ধারারই অন্তর্ভুক্ত।
বিয়ের ক্ষেত্রে ঢেকারুদের রীতিনীতিও অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন। ‘স্যাঙা’ প্রথা এই সমাজে বহুল প্রচলিত। অর্থাৎ, ছেলে ও মেয়েদের দ্বিতীয় বিবাহ সমাজে গৃহীত এবং সম্মানজনক। তারা বৈবাহিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে, যা স্থানীয় হিন্দু বা মুসলমান সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে মেলে না। এসব অনুষ্ঠান মূলত লোকাচার নির্ভর এবং প্রাচীনতর আদিবাসী রীতির ধারাবাহিকতা বহন করে।
ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ঢেকারু সমাজে এক বিশেষ ধরনের আধ্যাত্মিকতা পরিলক্ষিত হয়। এদের উপাস্য দেবী হলেন মনসা। তবে মনসার পূজায় মূর্তির স্থান নেই। এরা নিরাকার মনসার পূজা করে, যা একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক বিমূর্ততাকে নির্দেশ করে, অন্যদিকে তেমনি এক অন্তর্মুখী ধর্মচর্চার ইঙ্গিতও বহন করে। লোকবিশ্বাসে মনসা হলেন সাপের দেবী, রোগমুক্তির আশ্রয়। ঢেকারু সমাজে মনসা পূজা এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভক্তি-ভিত্তিক আচার-সংগৃহীত স্মৃতিচিহ্নের আধার।
ঢেকারুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। সরকারি পরিষেবাগুলি বিশেষত এই জাতিগোষ্ঠী পর্যন্ত পৌঁছায় না বললেই চলে। অনেকেই এখনো বিদ্যালয়-অসাক্ষর। শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্য সমস্যার প্রবণতা প্রবল। দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যালয়ছুটের হারও অত্যন্ত বেশি। এই সমস্ত সমস্যার উৎস নিহিত রয়েছে দীর্ঘদিনের সামাজিক বঞ্চনা এবং প্রশাসনিক অবহেলায়।
বর্তমানে ঢেকারু সমাজের কিছু অংশ বিভিন্ন এনজিও ও সরকারের তফসিলি জাতি কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় আসতে শুরু করেছে। তারা নানা রকম আত্মনির্ভর কর্মসূচিতে যুক্ত হচ্ছে, যেমন গবাদি পশু পালন, ক্ষুদ্র হস্তশিল্প বা বাগান ভিত্তিক জীবিকা। তবে এই উদ্যোগ এখনও খুব সীমিত পরিসরে। একটি সুপরিকল্পিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতির মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব।
বিভিন্ন পল্লী উন্নয়ন সমিতি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত চেষ্টায় ঢেকারু সমাজের মানুষ ধীরে ধীরে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ করে মূলস্রোতের সমাজে নিজস্ব স্থান তৈরি করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সততা এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের সহানুভূতি।
তাদের সম্পর্কে বহুদিন ধরে চলে আসা নেতিবাচক ধারণা ভাঙতে হবে, এবং তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও রীতিনীতিকে সম্মান জানিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ঢেকারু জাতিগোষ্ঠী কেবল বীরভূমের একটি গোষ্ঠী নয়, বাংলার বিস্মৃত ইতিহাসের একটি প্রান্তিক পাতা, যা আজও প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে ইতিহাসের নিষ্প্রভ আলোকছায়ায় হেঁটে চলেছে।
এইভাবে ঢেকারু সমাজের গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়—এরা প্রান্তিক হলেও প্রবল। লাঞ্ছিত হলেও লুপ্ত নয়। তারা ইতিহাসের মঞ্চে দৃশ্যমান না হলেও বেঁচে আছে বর্ণহীন, শব্দহীন এক জীবনের ভেতর, যেখানে প্রতিদিনের সংগ্রামই এক একটি অসমাপ্ত মহাকাব্য।
বীরভূম জেলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে যে কয়েকটি জাতি ও জনজাতি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাগদি, মাল, কৈবর্ত (অথবা ক্যাওট), এবং খয়রা। এই সম্প্রদায়গুলি শুধু মাত্র পরিসংখ্যানিক উপস্থিতি নয়, বরং এই জেলার ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক পরম্পরার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব জীবনচর্যা, পেশাগত পরিচয়, ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক আচরণবিধি এই অঞ্চলের বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অনন্য এক বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতির রেখা এঁকে গেছে।
বাগদি সম্প্রদায়কে অনেকে বীরভূমের অন্যতম প্রাচীন জনজাতি বলে মনে করেন। একাধিক পণ্ডিতমত অনুযায়ী, এই জনগোষ্ঠী প্রাচীন মল্ল রাজবংশ, বিশেষ করে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজদের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কিত হতে পারেন। অতীতে বাগদি সমাজে তেঁতুলে, ডুলে, কুসমেটো এবং মাহাত্তো—এই চারটি ‘থাক’ বা শ্রেণি বিদ্যমান ছিল। যদিও বর্তমানে সেই রকম শ্রেণিবিভাজনের কঠোরতা অনেকটাই লুপ্ত হয়েছে, তথাপি বয়োজ্যেষ্ঠদের স্মৃতিতে এর অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে।
বাগদিদের প্রধান জীবিকা মূলত মাছ ধরা হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পেশার পাশাপাশি তারা চৌকিদারি, পালকি বহন, কৃষিকাজ এবং দিনমজুরির মতো নানা কাজে যুক্ত হয়েছে। এই পেশাগুলির মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে এবং ধীরে ধীরে আঞ্চলিক অর্থনীতির অংশ হয়ে ওঠে। বাগদি বিবাহরীতিও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও অনন্য। বিবাহের সময় বর কনের বাড়িতে উপস্থিত হলে একটি প্রতীকী যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে কৃত্রিম যুদ্ধ হয়, যেখানে বরপক্ষের জয় নিশ্চিত করা হয় একটি ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি হিসেবে। এই যুদ্ধ ও তার মধ্য দিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার আচার একটি লোকজ সাংস্কৃতিক নাট্যরূপ বলেই বিবেচিত হতে পারে।
শারীরিকভাবে বাগদিরা বলিষ্ঠ ও কর্মঠ। সাধারণত এদের গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ, এবং মাথার গঠন তুলনায় মোটা। বর্তমানে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের প্রভাব দৃঢ় হয়েছে। দুর্গা, কালী, শিব ও ষষ্ঠীর মতো দেব-দেবীর পূজায় তারা অংশগ্রহণ করে। ধর্মরাজের পূজায় ভক্ত্য হিসেবে সম্পৃক্ত হওয়া এখনো একটি চলমান প্রথা।
মাল সম্প্রদায় বীরভূমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জনজাতি। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান অনুসারে, এদের ভেতরে ছয়টি ‘থাক’ বা শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায়—ছত্রধারী, রাজবংশী, মল্লিক, পাহাড়ি, কোল, এবং কাদর। এই শ্রেণিগুলির মধ্যে আন্তঃবিবাহ নিষিদ্ধ এবং তা আজও কিছুটা মান্যতা পায়। মালদের জীবিকা মূলত মাছ ধরা, কৃষিকাজ, দিনমজুরি ও চৌকিদারি কেন্দ্রিক। তারা একাধারে জলজীবী ও কৃষিজীবী উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
মাল সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে, যা তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মানসিকভাবে আধুনিক রূপের পরিচায়ক। ধর্মীয় চর্চায় এদের মধ্যে হিন্দু দেব-দেবীর উপাসনার চল বাড়ছে। তবে এদের নিজস্ব কিছু লোকবিশ্বাস ও রীতিও এখনো টিকে আছে, যেমন প্রেতপূজায় মুরগি বলির প্রথা। মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়, এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে এখনো কিছুটা ঐতিহ্যগত আচার অনুশীলিত হয়। ইদানিং শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সমাজগত উন্নয়নের ইঙ্গিতবাহী।
কৈবর্ত বা স্থানীয়ভাবে ‘ক্যাওট’ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীর বসবাস ময়ূরেশ্বর থানার বিভিন্ন গ্রামে দেখা যায়। ঐতিহাসিক ভাবে এদের উপাধি ছিল ‘ধীবর’, ‘গোঁড়’ ইত্যাদি, যা মূলত মৎস্যজীবী শ্রেণির পরিচয় বহন করে। মাছ ধরা ও বিক্রিই ছিল তাদের প্রধান পেশা, যদিও বর্তমানে তারা কৃষিকাজেও নিয়োজিত হয়েছে।
কৈবর্ত সমাজে একসময় বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকলেও, আধুনিককালে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিবাহের রেওয়াজ দেখা যায়। সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং উৎসবে ‘পচুই’ নামে পরিচিত দেশীয় মদ ব্যবহৃত হয়, যা এই সমাজের লোকসংস্কৃতির একটি অঙ্গ। উৎসব-অনুষ্ঠানে মদের ব্যবহার শুধু মাত্র আনন্দ বা ভোজনের অংশ নয়, বরং তা এক ধরণের আচারিক রূপে অধিষ্ঠিত।
খয়রা জনগোষ্ঠীর অবস্থান বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের দেরিয়াপুর, পুনুর ও দইকোটা গ্রামগুলিতে এবং মহম্মদবাজার ব্লকের কিছু অংশে। খয়রাদের মধ্যে দুটি উপশ্রেণি বিদ্যমান—একটি সাধারণ খয়রা, অন্যটি রাইখয়রা। ইতিহাস অনুসারে, তারা পূর্বে বিহারের অধিবাসী ছিল এবং সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বীরভূমে বসবাস শুরু করে।
রাইখয়রা সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘আখ্যান পূজা’ বা ‘ভূত পূজা’ নামে এক অনন্য ধর্মীয় আচার প্রচলিত রয়েছে। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিন, এই সম্প্রদায়ের সব বয়সের মানুষ একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয় এবং সেখানে পাঁঠা, মোরগ, ফলমূল, মদ ইত্যাদি উৎসর্গ করে। এই আচারিক অনুশীলনটি তাদের পূর্বপুরুষ ও অদৃশ্য শক্তির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। উৎসর্গের পর সবাই সেই প্রসাদ গ্রহণ করে এবং ধর্মীয় ভাবনায় দিনটি পালন করে।
খয়রা বিবাহরীতিতেও কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। বর এবং তার সঙ্গে আরও সাতজন মানুষ বিয়ের সাত দিন আগে থেকেই উপবাস পালন করে, শুধুমাত্র হবিষ্যান্ন গ্রহণ করে। বিবাহ শুধুমাত্র রবিবারে হয়। বিবাহের দিন সকাল থেকে পুরোহিত, নাপিত প্রভৃতি মানুষ পূজা পরিচালনা করেন। সেই দিনে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়, রান্না হয় এবং প্রসাদাদি যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা একটি নির্দিষ্ট মাপের গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। এই সমস্ত খাবার বাড়ির ভিতরে নেওয়া নিষিদ্ধ। এটা পরিষ্কারভাবে একটি শুদ্ধতার ধারণা এবং প্রাচীন ধর্মীয় ভাবনার অনুসরণ।
এই জনগোষ্ঠীতে কন্যাপণের বদলে বরপণ নেওয়ার প্রথাও এখন দেখা যায়, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চাপে, সামাজিক চাহিদার কারণে এবং আধুনিকতার সংস্পর্শে এই পরিবর্তন এসেছে।
উপসংহারে বলা যায়, বীরভূম জেলার এই জাতি ও জনজাতিগুলি তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে ক্রমশ মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। তবে সামাজিক, প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত সহায়তা ব্যতীত এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে না। এদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান—সব কিছুকে মর্যাদা দিয়ে ও সংরক্ষণ করে একটি সহাবস্থানমূলক উন্নয়ন মডেল গড়ে তোলা আজকের প্রয়োজন।
ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে অবস্থিত বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল ধরে নানা জাতি ও জনজাতির বসবাস লক্ষ করা যায়। তাদের সমাজজীবন, পেশা, আচার-আচরণ, উৎসব ও ধর্মীয় বিশ্বাস—সব মিলিয়ে বীরভূম জেলার এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচয় তুলে ধরে। এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সদগোপ, ভল্লভল্লা, লেট ও ধাঙ্গড় সম্প্রদায়। প্রত্যেকটির নিজস্ব পরিচিতি, ইতিহাস ও জীবনপদ্ধতি এই অঞ্চলের জাতিগত ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
সদগোপ সম্প্রদায় বীরভূম জেলার একটি সুপ্রাচীন ও প্রভাবশালী কৃষিজীবী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে বিস্তৃত বহু গ্রামাঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের বাস লক্ষ করা যায়। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনার ভিত্তিতে বিশিষ্ট গবেষক অতুল সুর মন্তব্য করেছেন—“সদগোপদের মোট সংখ্যার ৮৭ শতাংশ বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম ও হুগলী হাওড়ার বাসিন্দা ছিল। তাদের আদি বাসস্থান ছিল গোপভূমে বা বর্ধমান-বীরভূম জেলায়। সেখানে থেকেই তারা অন্যত্র গমন করেছে।” এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়, এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি এবং বিস্তারের কেন্দ্রস্থল ছিল বীরভূম ও সংলগ্ন অঞ্চল। কৃষিকাজই এদের প্রাথমিক পেশা, আর দীর্ঘকাল ধরেই তারা জমির মালিক হিসেবে পরিচিত। এই কারণে সমাজে একধরনের স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক অবস্থান বজায় রেখে এসেছে। বর্তমানকালে এদের মধ্যে ‘মণ্ডল’, ‘ঘোষ’, ‘রায়’, ‘রায়চৌধুরী’ প্রভৃতি উপাধি বহুল প্রচলিত। সামাজিক মর্যাদা ও আঞ্চলিক নেতৃত্বেও এদের উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে।
ভল্লভল্লা সম্প্রদায়ের দেখা মেলে ময়ূরেশ্বর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে। অতীতে এরা রাজপরিবার বা জমিদারদের অধীনে সেনাবাহিনী বা লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করত। সে সূত্রেই সমাজে এদের একধরনের শক্তিমান অবস্থান ছিল। ব্যক্তিগত স্বভাবে এরা কিছুটা রুক্ষ, কঠোর এবং দায়িত্ববান হিসেবে পরিচিত। গাত্রবর্ণ সাধারণত কৃষ্ণবর্ণ। সময়ের প্রবাহে সমাজে অস্ত্রধারী ভূমিকা থেকে সরে এসে বর্তমানে কৃষিকাজ, দিনমজুরির মতো পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজে নিযুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে মদ্যপানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা একদিকে সামাজিক রীতির অংশ, অন্যদিকে আর্থিক দুর্বলতার প্রতিফলনও বটে।
লেট জাতিগোষ্ঠী রামপুরহাট মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এদের গাত্রবর্ণ কালো, আর স্বভাবে কিছুটা কঠোর এবং একগুঁয়ে বলে স্থানীয় সমাজে পরিচিত। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খুঁজলে দেখা যায়, পূর্বে এদের একটি অংশ দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কালক্রমে তারা মূলস্রোতে ফিরে এসে দিনমজুরি, মাছ ধরা, জাল বোনা ইত্যাদি কাজে যুক্ত হয়েছে। বিশেষত ছোট মাছ ধরার কাজে এদের দক্ষতা অনস্বীকার্য। গোলাকৃতি জালি ব্যবহার করে মাছ ধরার যে কৌশল, তা এই সম্প্রদায়ের এক বিশেষ নিপুণতা। ধর্মীয় বিশ্বাসেও তারা বৈচিত্র্যময়। মনসা ও ধর্ম রাজা ছাড়াও হিন্দু দেবদেবীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি লক্ষ্য করা যায়। “প্যাট ভরলে ল্যাট রাজা”—এই প্রবাদবাক্যে ফুটে ওঠে এদের সহজ, সন্তুষ্ট জীবনের প্রতি এক অন্তর্নিহিত আস্থা।
ধাঙ্গড় গোষ্ঠী মূলত বিহার ও ঝাড়খণ্ডের আদি বাসিন্দা বলে বিবেচিত। অনেকে মনে করেন, পূর্বে তারা ওরাওঁ জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে ময়ূরেশ্বর থানার কিছু গ্রামে এদের বসবাস বিদ্যমান। এদের জীবনযাত্রা অনেকটাই কঠোর পরিশ্রম নির্ভর। সাধারণত মাটি কাটা, জমি চাষ, নির্মাণ কাজ বা দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। মহিলারাও অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং সংসার ও জীবিকার ভার বহনে পুরুষদের সঙ্গে সমান অংশীদার। এদের খাদ্যাভ্যাসে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ইঁদুর ভক্ষণ। স্থানীয় সংস্কৃতিতে যা একধরনের আলোচনার বিষয়ও বটে। পাশাপাশি সন্ধ্যায় প্রচুর মদ্যপান তাদের সামাজিক রীতির অন্তর্ভুক্ত, যা একদিকে শ্রমের পর তৃপ্তির উপায়, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনের নিদর্শন।
ধাঙ্গড় সমাজে বিবাহপ্রথায় এক বিশেষ রীতির প্রচলন আছে। বিয়ের সময় বর গাছের উপর চড়ে বসে, আর কনে নিচে দাঁড়িয়ে বরকে আহ্বান জানায় নেমে আসার জন্য। এই রীতির মধ্যে নিহিত রয়েছে একধরনের প্রতীকী লৌকিকতা ও সমাজ-সংকেত। এছাড়াও বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানে প্রচলিত থাকে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য ও গভীরতার একটি গর্ত তৈরি করা, যেখানে বিয়ের ভোজ শেষে অবশিষ্ট খাবার ও সামগ্রী ফেলে দেওয়া হয়। গৃহের ভিতরে এসব নিয়ে যাওয়া বারণ। এ থেকে বোঝা যায়, এদের বিয়ের রীতিতে একধরনের পবিত্রতা ও সামাজিক বিধি অনুসরণের প্রবণতা রয়েছে।
এদের মধ্যে আগে কন্যাপণের রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে বরপণের প্রথাও দেখা যায়। সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইসব রীতিতে পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। এই জাতিগোষ্ঠীগুলির আচার-আচরণ, উৎসব-পার্বণ, খাদ্যাভ্যাস, বিবাহরীতি, ধর্মবিশ্বাস, এমনকি ভাষাগত রীতিও বীরভূম জেলার গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদী রূপকে চিহ্নিত করে। এক একটি জাতিগোষ্ঠী যেন এক একটি নিজস্ব জগৎ নিয়ে উপস্থিত এই ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলে। তাদের জীবন সংগ্রাম, প্রাত্যহিক পরিশ্রম, সামাজিক রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক বোধ মিলিয়ে এক জটিল অথচ জীবন্ত সমাজচিত্র গড়ে উঠেছে এই জেলায়। বাঙালির বৃহত্তর ইতিহাস-চেতনার নিরিখে এদের সংযোজন ইতিহাসের গভীরে এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
তথ্যসূত্র, প্রাচীন দলিল, লোকবিশ্বাস ও আধুনিক জনগণনা ইত্যাদি অনুসারে এই সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত রচনা সম্ভব, যা একদিকে যেমন সমাজতাত্ত্বিক ও নৃবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার খোরাক, অন্যদিকে বীরভূম জেলার অতীত ও বর্তমানকে বুঝতে একটি নির্ভরযোগ্য ফ্রেমও প্রদান করে।
ভল্লভল্লা, লেট, ধাঙ্গড়, বাউরি ও মুচি—বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে এই জাতিগোষ্ঠীগুলি। প্রতিটি গোষ্ঠী, তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক পথপরিক্রমা, সংস্কৃতি ও জীবিকা-ভিত্তিক পরিচয় নিয়ে গড়ে তুলেছে একটি স্বতন্ত্র জীবনপদ্ধতির পরিসর।
ভল্লভল্লা সম্প্রদায় মূলত ময়ূরেশ্বর থানার বিভিন্ন গ্রামে কেন্দ্রীভূত। অতীতে এরা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক অঙ্গ ছিল—তৎকালীন রাজাদের অধীনে সৈন্য হিসেবে কাজ করত। রাজতন্ত্রের অবসানের পর জমিদারী প্রথার প্রেক্ষিতে এদের ভূমিকা হয় ‘লাঠিয়াল’—গ্রামীণ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। স্বভাবে সাহসী ও কিছুটা রূঢ় হলেও এদের জীবনের মূল সুর ছিল পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। গায়ের রঙ সাধারণত কৃষ্ণবর্ণ এবং দৈহিক কাঠামো বলিষ্ঠ। বর্তমান সময়ে এরা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি—এই দুই ক্ষেত্রে নিযুক্ত। একান্ত চিহ্ন হিসেবে তাদের জীবনে মদ্যপানের প্রবণতা প্রবলভাবে উপস্থিত।
লেট জাতি রামপুরহাট মহকুমার নানা গ্রামে ছড়িয়ে আছে। সামাজিক পরিচয়ে কিছুটা উগ্র ও আত্মপ্রত্যয়ী বলে তারা পরিচিত। ইতিহাসে এদের জীবনচিত্রে দস্যুবৃত্তির ছাপ থাকলেও কালের প্রবাহে তা বিলুপ্ত হয়েছে এবং এরা বর্তমানে কৃষিজীবী মজুর, জাল বোনার কারিগর ও মৎস্যজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিশেষভাবে এরা গোলাকার জাল দিয়ে নদী বা পুকুরের ছোট মাছ ধরায় পারদর্শী। ধর্মবিশ্বাসে মনসা, ধর্মঠাকুর ও হিন্দু দেবদেবীদের পূজা তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এই জাতির সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাদ, “প্যাট ভরলে ল্যাট রাজা”, এদের সহজসাধ্য জীবনের প্রতিফলন।
ধাঙ্গড় সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান বিহার ও ঝাড়খণ্ড অঞ্চল হলেও বর্তমানে তারা ময়ূরেশ্বর থানার একাধিক গ্রামে উপস্থিত। নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় কেউ কেউ তাদের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একটি শাখা মনে করেন। ধাঙ্গড়দের দৈনন্দিন জীবনে ইঁদুর একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। মদ্যপানে পারদর্শী এই জনগোষ্ঠী সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় মদ পান করে ক্লান্তি মোচনের প্রথা বজায় রেখেছে। মাটি কাটাই তাদের প্রাথমিক জীবিকা, পাশাপাশি অন্যের জমিতে ভাগচাষের প্রথাও রয়ে গেছে। ধাঙ্গড় মহিলারা পরিশ্রমে অনন্য। বিবাহ প্রথায় এদের একটি অনন্য আচরণ লক্ষ্যণীয়। বিয়ের সময় বর গাছের উপরে চড়ে বসে, আর কনে নিচে দাঁড়িয়ে আহ্বান জানায় তাকে নামার জন্য। এছাড়া কন্যাপণ ও বরপণ দুই-ই এই জাতিতে প্রচলিত। সমাজে কিশোর-কিশোরীদের বিবাহ দেওয়ার রীতি এখনও বিরাজমান।
বাউরি সম্প্রদায় এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের অন্যতম। নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তারা অনার্য গোত্রভুক্ত। দেহ গঠন সাধারণত মধ্যমাকৃতি। অতীতে তারা মূলত ঘর নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিল বলে তাদের পরিচয় ‘ঘরামি’। একটি প্রাচীন প্রবাদ—“এল ডাউরি, মোলো বাউরি”—এই জাতির পেশাভিত্তিক অস্তিত্ব সংকটের এক সাক্ষ্যবাহী দলিল। অতিবৃষ্টি হলে ঘর নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন জীবিকার অভাবে বাউরিরা দারিদ্র্যে জর্জরিত হত। বর্তমানে এরা হিন্দু সমাজের নানা রীতিনীতি মেনে চলে, হিন্দু দেব-দেবীর পূজায় অংশগ্রহণ করে।
মুচি সম্প্রদায় অতীতে সমাজে ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে গণ্য হলেও, তাদের কৌশল ও শ্রমজীবী দক্ষতা সর্বদাই গৃহীত হয়েছে। পূর্বে গোরুর মাংস ভক্ষণ করলেও বর্তমানে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের সংস্পর্শে তা থেকে দূরে সরে এসেছে। ধর্মীয় অনুশীলনে তারা কালী, দুর্গা প্রভৃতি দেবীর উপাসক। মুচিদের প্রাথমিক পেশা ছিল ঢাক বাজানো। এ বিষয়ে একটি প্রবাদ চালু আছে—“মুচি, ঢাক বাজিঙে পায় না লুচি”, যা তাদের সামাজিক অবমূল্যায়নের প্রতিবিম্ব বটে। তবু এই সম্প্রদায় চুপিসারে সমাজে নিজের স্থান করে নিতে চেয়েছে। পাশাপাশি জুতো তৈরি ও মেরামত, কৃষিকাজ, দিনমজুরি প্রভৃতি পেশার মাধ্যমেও তারা জীবিকা নির্বাহ করে।
এই সমস্ত জাতিগোষ্ঠীগুলির সমাজচিত্রে একদিকে যেমন রয়েছে ঐতিহ্যগত পেশা, ধর্মবিশ্বাস, ও আচার-আচরণ, তেমনই রয়েছে যুগানুগ পরিবর্তনের স্পষ্ট ছাপ। প্রথাগত জীবিকার বাইরে শিক্ষা, চাষবাস, বাণিজ্য বা শহরমুখী অভিপ্রায় তাদের সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে। বস্তুত, এই জনগোষ্ঠীগুলি বীরভূম জেলার লোকজ সংস্কৃতির শিকড়—যাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ কাঠামো।””
বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী একাধিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠী ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার দিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চলের সমাজ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে ভূমিকা রেখে আসছে এই সমস্ত জাতি ও জনজাতি।
এই অঞ্চলের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে কামার সম্প্রদায়টি একটি। মূলতঃ কামাররা লোহার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষিনির্ভর সমাজে লোহার তৈরি যন্ত্রপাতির অপরিহার্যতার কারণে কামারদের ভূমিকা সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত পরিশ্রমী, সুগঠিত ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা আজও নিজেদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। বর্তমান যুগে বিবাহ ও অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি হিন্দু সমাজের নিয়ম মেনেই পালিত হয়, যা সমাজে আত্মীকরণের পরিচয় বহন করে।
ঘাটোয়ালরা এই অঞ্চলের আরেকটি ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী, যারা সাঁওতালদের মতোই বন ও পাহাড়-ঘেরা পরিবেশে জীবনযাপন করতেন। মুসলিম শাসনামলে এদের দায়িত্ব ছিল নদীঘাট পাহারা দেওয়া। তাদের সামাজিক ভূমিকাটি এমনভাবে গঠিত ছিল যে, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের সময় অনেককে ‘ডাকাত’ আখ্যা দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক হান্টার লিখেছেন, “মুসলিম সৈন্য বাহিনীর আবর্জনা স্বরূপ কর্মচ্যুত সৈন্যদের (ঘাটোয়াল) ভ্রাম্যমান দলগুলিই ডাকাতি করে বেড়াত।” যদিও সময়ের পরিবর্তনে ঘাটোয়ালরা আজ জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। বর্তমানে তারা দিনমজুরি ও অন্যান্য শ্রমনির্ভর কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে।
পটুয়া বা স্থানীয় ভাষায় যাঁরা ‘বেদ্যা’ নামে পরিচিত, তাদেরও এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। বিশেষত নলহাটি থানার সরধা, মাড়গ্রামের বিষ্ণুপুর, চাঁদপাড়া, সাহাপুর এবং ময়ূরেশ্বর থানার ষাটপলশা, শিবগ্রাম প্রভৃতি গ্রামে এদের বাস। পটুয়ারা আদিতে এক ধরনের চিত্রশিল্পী, যারা গ্রামীণ বাংলার জীবন ও সংস্কৃতিকে পটচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতেন। পটুয়া সমাজে একটি দ্বৈত ধর্মীয় পরিচয়ের প্রচলন দেখা যায়—বিয়ের অনুষ্ঠান হিন্দু মতে হয়, আবার মৃত্যুর পরে মুসলমানদের মতো কবর দেওয়ার রীতি অনুসৃত হয়। ষাটপলশার বাঁকু পটুয়া এই সম্প্রদায়ের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ছিলেন, যিনি গ্রামীণ শিল্পের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বপরিসরে স্থান করে নিয়েছিলেন।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং সুসংবদ্ধ আদিবাসী গোষ্ঠী হল সাঁওতাল। বন-জঙ্গলবেষ্টিত অঞ্চলে এদের বহু বসতি গড়ে উঠেছে। আদিম অধিকার ও অরণ্যসংলগ্ন জীবনধারার প্রতি তাদের ভালোবাসা এখনও অনেকটা অক্ষুন্ন। সামাজিক রীতিনীতি, পূজা-পার্বণ, শিল্পচর্চা, নৃত্য-গান প্রভৃতি বিষয়গুলিতে সাঁওতাল সমাজ বিশেষভাবে সমৃদ্ধ ও ছন্দময়। হান্টার বলেন, হিন্দুদের চেয়ে সাঁওতালদের আচার-অনুষ্ঠান অনেক বেশি। এদের ধর্মবিশ্বাস, যেমন ‘মারাংবুরু’ উপাসনা, ডাইনি-বিশ্বাস, জানগুরুদের মাধ্যমে অপদেবতাদের তুষ্ট করার রীতি, সমাজে দীর্ঘকাল ধরেই প্রচলিত। প্রধান উৎসবগুলি যেমন—সোহরাই, বাদনা—মাদলের তালে, পালক গোঁজা মাথায়, রঙিন পোষাকে নৃত্য-গীতে ভরা রাত যেন জীবনের মূল আনন্দধারায় এক অবগাহন। এদের সমাজে এখনও পশু বলির রীতি বর্তমান; শূকর, সাদা ছাগল, পায়রা বলি দেওয়া হয়। জীবনযাত্রার দিক থেকে চাষবাস, পশুপালন, পাথর খাদানে শ্রমদান এখন তাদের প্রধান পেশা। কেউ কেউ মাটি কেটে, কেউ মজুরি খেটে, আবার কেউ কেউ সরকারি চাকরির মাধ্যমে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। তথাপি দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি—এই সমস্যাগুলি এখনও তাদের নিত্যসঙ্গী।
বিয়ের ক্ষেত্রে সাঁওতাল সমাজে কন্যাপণ প্রচলিত এবং অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে থাকে। ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করলেও, সিনেমা, টিভি ও আধুনিক সাংস্কৃতিক অনুকরণে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনেকটাই বিলুপ্তির মুখে।
এইভাবে দেখা যায়, ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী বীরভূম জেলার জনজাতীয় ও জাতিগত গঠন অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং তা বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে বহুস্তরে প্রভাবিত করেছে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস, পেশা ও রীতিনীতির মাধ্যমে স্থানীয় জনজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর, আন্তঃসম্পর্ক, সংগ্রাম ও অভিযোজন আমাদের সামাজিক অধ্যয়নের একটি অমূল্য অংশ।
ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে অবস্থিত বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে জাতি, উপজাতি ও পেশাভিত্তিক নানা সম্প্রদায়ের বসবাস বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে চলছে। ইতিহাস, ভূগোল, জলবায়ু এবং অর্থনৈতিক শর্তের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা এই জনসমষ্টি একদিকে যেমন সামাজিক বৈচিত্র্যের বাহক, তেমনি অন্যদিকে বয়ে আনে পেশা, সংস্কৃতি এবং বর্ণভিত্তিক শ্রেণি বিভাজনের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা।
এই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্যদের পাশাপাশি রয়েছে বহু প্রান্তিক ও অনগ্রসর জাতি, তপশিলি জাতি ও উপজাতি গোষ্ঠী। অঞ্চলটিতে বসবাসকারী জাতি ও পেশাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর একটি তালিকা দীর্ঘ এবং তা উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত: ব্রাহ্মণ, চামার, তাঁতি, পাটনি, কায়স্থ, ডোম, গন্ধবণিক, ময়রা, গোয়ালা, শুঁড়ি, বারুই, শাঁখারি, তিলি, তিয়র, কামার, সূত্রধর, বাউরি, মেথর, কুমোর, ধোপা, সদগোপ, কলু, বৈরাগী, বাইতি, নাপিত, কাহার, বাগদি, ভল্ল, হাড়ি, কৈবর্ত, চণ্ডাল, রাজবংশী, মুচি, সুবর্ণবণিক, ধীবর, কেওট, স্বর্ণকার, সাঁওতাল, কোড়া, মালপাহাড়িয়া, ঘাটোয়াল, হো, ওরাওঁ, ধাঙ্গড়, মুণ্ডা, বেদে, কোনাই, বায়েন, পটুয়া, লেট, ঢেকারু, দাই, মাল, খয়রা ইত্যাদি।
এই জনগোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব ভাষা, আচার, খাদ্যাভ্যাস, পরিধান এবং বিশ্বাসের জগৎ রয়েছে। কেউ কেউ মূলত কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, কেউবা মৎস্য শিকারী, কেউ কেউ আবার কারিগর বা হস্তশিল্পে পারদর্শী। তেমনই কেউ কেউ ধর্মীয় আচার পালন, সঙ্গীত বা শিল্পকলার মাধ্যমে সমাজে নিজস্ব অবস্থান গড়ে তুলেছে। পেশা এবং জাতি এখানে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এবং তা প্রজন্ম পরম্পরায় বহমান।
২০০১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে এই অঞ্চলটির জাতিগত গঠন আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। রামপুরহাট মহকুমায় তপশিলি জাতিভুক্ত (Scheduled Castes) পুরুষ জনসংখ্যা ছিল ১,৮৫,১৩০ জন এবং মহিলা সংখ্যা ছিল ১,৭৪,৬০৯ জন। এই মহকুমায় তপশিলি উপজাতিভুক্ত (Scheduled Tribes) পুরুষ সংখ্যা ছিল ২৮,৫৪৮ এবং মহিলা সংখ্যা ২৮,৪৪৭ জন। অন্যদিকে, সিউড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত মহম্মদবাজার ব্লকে তপশিলি জাতিভুক্ত পুরুষের সংখ্যা ৩৭,৩৬৮ জন এবং মহিলার সংখ্যা ১৮,১৮৯ জন। তপশিলি উপজাতিভুক্তদের মধ্যে এখানে পুরুষ ১৩,৩৮০ জন এবং মহিলা ১৩,৪২০ জন বাস করে।
এই সংখ্যাগুলি নিছক পরিসংখ্যান নয়; এগুলি সামাজিক বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির জনবিন্যাস, তাঁদের অবস্থান এবং তাঁদের ওপর নীতিনির্ধারণী কাঠামোর প্রভাব। সামাজিক ন্যায়, আর্থিক সমতা এবং জাতিভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাগুলি গভীর তাৎপর্য বহন করে।
যে সকল জাতি ও উপজাতি গোষ্ঠী এখানে বসবাস করে, তাদের অনেকের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি এবং স্বাস্থ্যগত সংকট এই জনগোষ্ঠীর একাংশকে প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত করে রাখে। বিশেষত আদিবাসী গোষ্ঠী যেমন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, কোড়া, মালপাহাড়িয়া প্রভৃতিরা তাঁদের প্রথাগত জ্ঞান, সংস্কৃতি ও জীবিকাকে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সংকটে পড়ে।
অনেক প্রাচীন পেশা আজ লুপ্তপ্রায়। জুতো বানানো, ঢাক বাজানো, শাঁখা তৈরি, জাল বোনা, চামড়ার কাজ ইত্যাদি পেশা যেগুলি কখনো এই সমাজে গৌরবের অধিকারী ছিল, বর্তমানে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবহেলিত, অনুন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে অস্থির।
অন্যদিকে, এই অঞ্চলের কিছু গোষ্ঠী কৃষিকাজে সাফল্যের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। সদগোপ, কায়স্থ, গোয়ালা, তিলি প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলি জমির মালিক ও চাষি হিসেবে অঞ্চলটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার কিছু গোষ্ঠী যেমন চামার, ধাঙ্গড়, ঢেকারু ইত্যাদি শ্রমশক্তির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করে মূল আর্থিক পরিকাঠামোকে সচল রাখে।
তবে সমাজতাত্ত্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এই বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত শ্রেণিগত ও বর্ণগত বৈষম্যও রয়ে গেছে। কিছু সম্প্রদায় সামাজিকভাবে উপরে এবং অন্যরা নীচে—এই অনুপাত আজও অনেক ক্ষেত্রেই বহাল। যদিও সরকারি নীতিমালা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং উন্নয়ন প্রকল্প কিছুটা ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছে, তবে সম্পূর্ণ সমতা এখনো অধরা।
এই অঞ্চলকে বুঝতে গেলে শুধুমাত্র জনগণনার পরিসংখ্যান যথেষ্ট নয়। বুঝতে হবে সমাজের অন্তর্গত ছন্দ, তাদের নৃতাত্ত্বিক পরম্পরা, তাদের বিশ্বাস, গোষ্ঠীগত সম্মান ও অবমাননার ইতিহাস। প্রতিটি গোষ্ঠী, প্রত্যেক নাম শুধুই একটি পরিচয় নয়, বরং একটি ইতিহাস, একটি সংগ্রাম, একটি সংস্কৃতি।
এইরকম একটি বহুবর্ণ, বহুস্তর ও বহুধা সমাজ কাঠামোকে শুধু গবেষণার জন্য নয়, উন্নয়নের জন্যও একটি ‘স্মার্ট মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যদি যথাযথভাবে তথ্য বিশ্লেষণ এবং কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা যায়। স্থানীয় মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে, তাঁদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিয়ে, শিক্ষার প্রসার এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে এই এলাকায় সত্যিকার সামাজিক উন্নয়নের পথ রচনা সম্ভব।
আমাদের সমীক্ষা ক্ষেত্রের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্রটি এখনও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। যদিও বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে, তথাপি নানা বাধা-বিপত্তি এখনো এই অঞ্চলকে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপ্রতুল পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিকভাবে কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা শিক্ষার পথকে যথেষ্ট বন্ধুর করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দারিদ্র্য, সামাজিক পশ্চাৎপদতা এবং পরিবারে শিক্ষার প্রতি উদাসীন মনোভাব, যা সর্বস্তরে শিক্ষার বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সমগ্র রামপুরহাট মহকুমার মধ্যে গ্রামীণ পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৬৮.১৯ শতাংশ, যেখানে নারীদের সাক্ষরতার হার মাত্র ৪৮.৯২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে সাক্ষরতার চিত্র তুলনামূলকভাবে কিছুটা আশাব্যঞ্জক। শহরে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৮৮.১৮ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে তা ৭৪.০৪ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও বহু পথ অতিক্রম করা বাকি, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে।
ব্লকভিত্তিক যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তবে দেখা যাবে:
- মুরারই ১নং ব্লকে গড় সাক্ষরতার হার ৪৬.৬ শতাংশ,
- মুরারই ২নং ব্লকে ৪৬.২ শতাংশ,
- নলহাটি ১নং ব্লকে ৬৩.৭ শতাংশ,
- নলহাটি ২নং ব্লকে ৬১.৬ শতাংশ,
- রামপুরহাট ১নং ব্লকে ৬১.৯ শতাংশ,
- রামপুরহাট ২নং ব্লকে ৬৩.৫ শতাংশ,
- ময়ূরেশ্বর ১নং ব্লকে ৬৫.৪ শতাংশ,
- ময়ূরেশ্বর ২নং ব্লকে ৬২.৮ শতাংশ এবং
- সিউড়ি মহকুমার অন্তর্গত মহম্মদবাজার ব্লকে ৫৫.১ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুরারই ১নং ও ২নং ব্লক সাক্ষরতার হারে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এতে বোঝা যায়, এই অঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে, ময়ূরেশ্বর ১নং ও ২নং ব্লকের চিত্র তুলনামূলকভাবে কিছুটা আশাব্যঞ্জক। তবে এই সাফল্যকে সুদৃঢ় ও সর্বব্যাপী করতে গেলে মৌলিক শিক্ষার পরিকাঠামোয় যথেষ্ট উন্নয়ন দরকার।
রামপুরহাট মহকুমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সংখ্যা এইরূপ:
- ৮৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
- ২৬টি মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়,
- ৯৩টি উচ্চ বিদ্যালয়,
- ৩৫টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়,
- ৬টি সাধারণ ডিগ্রি কলেজ এবং
- ১টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়।
মহম্মদবাজার ব্লকে:
- ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
- ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়,
- ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়,
- ৬টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং
- ১টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় রয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় যে, যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা সন্তোষজনক মনে হতে পারে, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগত ঘাটতি এখনও প্রকট। বিশেষত, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর ফলে বহু ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বা ঝরে পড়ছে।
আমাদের আলোচ্য অঞ্চলে ধর্ম ও পালাপার্বণের মিলনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীর ঘেঁষা এই এলাকাটি একাধারে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ। ১৯৯১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী ধর্ম অনুযায়ী মানুষের বিভাজন এইভাবে দেখা যায়:
নলহাটি ১নং ব্লকে:
- হিন্দু: ৮৩,১২৮ জন
- মুসলিম: ৯০,৩৪৪ জন
- খ্রিস্টান: ৯৮২ জন
- জৈন: ৭ জন
- অন্যান্য ধর্মাবলম্বী: ৮০ জন
নলহাটি ২নং ব্লকে:
- হিন্দু: ৩৬,৬১৯ জন
- মুসলিম: ৫৮,১৭৮ জন
- খ্রিস্টান: ৫০ জন
- জৈন: ৩ জন
- বৌদ্ধ: ৫ জন
- অন্যান্য ধর্মাবলম্বী: ৪১ জন
এই ধর্মীয় বৈচিত্র্য আমাদের সমীক্ষা ক্ষেত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এখানে যে কেবল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সহাবস্থান করছে তা নয়, বরং পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ও সংস্কৃতির বিনিময়ের মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের ধর্ম ও পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে। ধর্মীয় উৎসবগুলিকে কেন্দ্র করে এখানে সামাজিক মেলবন্ধনের এক অপূর্ব ছবি ফুটে ওঠে। হিন্দুদের দুর্গাপুজো, মুসলিমদের ঈদ, খ্রিস্টানদের বড়দিন কিংবা স্থানীয় আদিবাসী উৎসবগুলি—সবকিছুই এক সম্মিলিত সামাজিক সম্প্রীতির নজির হয়ে উঠেছে।
তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, সামাজিক প্রথা এবং সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। কাজেই শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা ও ধর্মীয় সহাবস্থান—এই দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের সমীক্ষা অঞ্চল এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন ঘটায় বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গ সমাজের। যেখানে একদিকে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে, অন্যদিকে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির বহুত্বকে রক্ষা করে চলতে হবে। এই দুই ক্ষেত্রেই একটি সুপরিকল্পিত সামাজিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য।
বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলের ধর্মীয় ও সামাজিক চিত্র অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক। আমাদের সমীক্ষা ক্ষেত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্লকগুলিতে ধর্মীয় জনসংখ্যা ও তাঁদের পালা-পার্বণের প্রথা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনুপম পরিচয় বহন করে।
মুরারই ১ নম্বর ব্লকে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছেন ৪৩,৯৪২ জন এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী ৭৮,৪৯৮ জন। এছাড়া এই ব্লকে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ৫৫ জন, শিখ ধর্মের ১৪ জন, জৈন ধর্মের ৩০ জন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আছেন ৫ জন। অপরদিকে মুরারই ২ নম্বর ব্লকে ৫১,৯৬১ জন হিন্দু, ৯২,৮২৩ জন মুসলিম, ৬৫ জন খ্রিস্টান, ১৭ জন শিখ, ৩ জন বৌদ্ধ, ৩৫ জন জৈন এবং ৪ জন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন।
ময়ূরেশ্বর ১ নম্বর ব্লকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছেন ৮৮,৪৪০ জন এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী ২৮,০০২ জন। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সংখ্যা এখানে ১০০ জন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ২ জন এবং জৈন ধর্মাবলম্বী ৪৮ জন। ময়ূরেশ্বর ২ নম্বর ব্লকে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী রয়েছেন ৭৪,৯৫৯ জন, মুসলিম ২৩,৭৩৩ জন, খ্রিস্টান ৮৪ জন, জৈন ৪০ জন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন ২ জন।
রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লকে ৮৪,৬২৪ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং ৪৯,১১০ জন মুসলিম ধর্মাবলম্বী বসবাস করেন। এখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৫৫৭ জন, জৈন ধর্মাবলম্বী ২১ জন এবং অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী ১৭ জন। রামপুরহাট ২ নম্বর ব্লকে হিন্দু ৮৭,২৪২ জন, মুসলিম ৫০,৭২০ জন, খ্রিস্টান ৪৮৭ জন, জৈন ১৯ জন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ১৭ জন।
সিউড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত মহম্মদবাজার ব্লকে ৮৫,০৮২ জন হিন্দু, ৩০,৮৪০ জন মুসলিম, ৩৩৪ জন খ্রিস্টান, ৩৪ জন শিখ, ২ জন বৌদ্ধ, ৯ জন জৈন এবং ১৮ জন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করছেন।
এই সমীক্ষা ক্ষেত্রের ধর্মীয় বৈচিত্র্য একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার আধিক্য নির্দেশ করে, তেমনই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের একটি বৃহৎ উপস্থিতিও প্রতিফলিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা যেমন সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পরিচিত, তেমনই ষষ্ঠী পূজা ও সংক্রান্তি উৎসবগুলি স্থানীয় জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ষষ্ঠী পূজার মধ্যে গাছ ষষ্ঠী, গাড়া ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী, লোটন ষষ্ঠী, শীতলা ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠীর মতো নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য দেখা যায়। এগুলির প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্দিষ্ট পারিবারিক, শস্যভিত্তিক বা ঋতুভিত্তিক প্রথা ও বিশ্বাস।
সংক্রান্তি উপলক্ষে পালিত নানা রকম কৃত্যানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবন ও বিশ্বাসের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আষাঢ়ের সংক্রান্তিতে ভোরবেলায় মসুর ডাল, রসুন ও কাকরোল জাতীয় ফল খাওয়া এবং ওই দিন নিরামিষ আহারের রীতি, অথবা আশ্বিন মাসে ডাক সংক্রান্তিতে জমির কোণে বাঁশ পুঁতে বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণের মতো প্রথাগুলি এই অঞ্চলের লোকবিশ্বাস ও কৃষিজীবনের সহাবস্থানের নিদর্শন।
কার্তিক মাসের মুঠিকাটা সংক্রান্তিতে বয়স্ক পুরুষ জমিতে গিয়ে এক মুঠো ধান কেটে নিরবভাবে ঘরে ফেরেন এবং তা পূজিত হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে লক্ষ্মীদেবীকে ঘরে আগলানোর মতো পৌরাণিক ইঙ্গিতবাহী অনুষ্ঠান এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে ধর্মরাজ পূজা বা শিবের গাজনের মতো উৎসব গৃহস্থ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-অযহা, মহরম, শব-ই-বরাত প্রভৃতি ধর্মীয় পার্বণ পালন করা হয় বিশেষ নিষ্ঠার সঙ্গে। শুক্রবার বা জুম্মাবারকে বিশেষ পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। রমজান মাস উপবাস, ইবাদত ও সামাজিক সহানুভূতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি এইসব উৎসব গোষ্ঠীগত সৌহার্দ্য ও সমাজের ঐক্যবদ্ধতাকেও চিহ্নিত করে।
এই অঞ্চলের ধর্মীয় জীবনের বৈচিত্র্য নিছক পরিসংখ্যান নয়; বরং তা এক বর্ণময়, আন্তঃসম্পর্কিত এবং সহাবস্থানে অভ্যস্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উৎসব ও প্রথার মধ্য দিয়ে দেখা যায় স্থানিক জীবন, বিশ্বাস, কৃষিজীবন ও লোকঐতিহ্যের মিশ্রধারা। এই ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও পালা-পার্বণের ধারা আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সহনশীলতার এক বলিষ্ঠ ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী গ্রামীণ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উৎসব-পার্বণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলের হিন্দু সমাজে দুর্গাপূজা, কালীপূজা বা সরস্বতীপূজার মতো সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও কিছু লোকায়ত উৎসব রয়েছে, যেগুলির শিকড় রোজকার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এরকম দুটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হল ‘নবান্ন’ এবং ‘সিজ্যানো’। এই উৎসবগুলোর ধারাবাহিকতা, আচারপ্রবাহ এবং মানসিক তাৎপর্য সমাজজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এই অঞ্চলে নবান্ন একমাত্র কৃষিভিত্তিক উৎসব হিসেবেই নয়, বরং পারিবারিক মিলনের, সমবেত আনন্দ উদ্যাপনের ও আধ্যাত্মিক তৃপ্তির এক বর্ণিল উপলক্ষ। নবান্ন শব্দটি বাংলার নানা জেলায় নানা নামে উচ্চারিত হয়, তবে বীরভূমে এটি স্থানীয়ভাবে ‘লবান’ নামে পরিচিত। অঘ্রাণ মাসে যখন মাঠে নতুন ধানের স্বর্ণালী শীষ ঝুঁকে পড়ে, তখন শুরু হয় এই উৎসবের পরিকল্পনা। গ্রামগুলিতে প্রবীণ ব্যক্তিরা কিংবা গ্রামের বটতলার বুড়োরা মিলে ঠিক করেন—অঘ্রাণ মাসের কোন দিনটিকে নবান্ন হিসেবে পালিত হবে। সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে গোটা গ্রামে উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।
নবান্ন পালনের মূল উদ্দেশ্য নতুন ধানের আগমনকে স্বাগত জানানো এবং দেবী অন্নপূর্ণা ও বাস্তুদেবতার উদ্দেশে সেই নতুন ধান নিবেদন করা। ‘নতুন লঘু’ বা ‘রামশাল’ জাতীয় ধানের চাল দিয়ে ঘরে ঘরে পায়েস তৈরি হয়। আবার অনেক বাড়িতে চাল গুঁড়িয়ে তাতে নারকেল, গুড় ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি হয় ‘গুলুনি’ বা ‘মলিদ্যা’ নামের একটি বিশেষ প্রস্তুতি। এইসব উপকরণ দিয়ে প্রথমে দেবতাকে নিবেদন, তারপরে আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সেই প্রসাদ ভাগ করে দেওয়া হয়। অনেক পরিবারে বিশেষ ভঙ্গিমায় এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়—অভুক্ত থেকে স্নান করে তবেই প্রসাদ গ্রহণ করা হয়।
নবান্নের দিন শুধু একটি নির্দিষ্ট খাবার গ্রহণ করাই নয়, বরং এটি হয়ে ওঠে ঘরোয়া ও সামাজিক মিলনের এক সুযোগ। বহু বাড়িতেই দুপুরবেলা বিস্তৃত ভোজের আয়োজন হয়—সাত প্রকারের ভাজা, তরকারি, মাছ, ডাল, পরমান্ন প্রভৃতি থাকেই। সন্ধ্যাবেলায় অনেকে গান-বাজনার আসর বসায়, অনেক গ্রামে যাত্রাপালা হয়, কখনো কবিগান, বাউল গানের দল, কীর্তনের দল নিমন্ত্রিত হয়ে আসে। এইসব উপাচার এই উৎসবকে শুধু ধর্মীয় নয়, একটি সাংস্কৃতিক সমাবেশেও পরিণত করে।
নবান্নের রাত্রিবেলায় বাড়ির প্রবীণ মহিলা—মা, ঠাকুমারা কাঁসার থালায় ‘ল-পুরন’ করেন। নতুন ধান ও পুরোনো ধান একত্র করে তাঁরা উচ্চারণ করেন—
“নতুন কাপড় পুরনো অন্ন
পরতে খেতে যায় যেন জন্ম জন্ম।”
তারপর সেই চাল পরিবারের প্রত্যেকের মাথায় ছুঁইয়ে দেওয়া হয়। এই আচারপদ্ধতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে গৃহস্থের সুখ-শান্তির প্রার্থনা। এ যেন এক প্রতীকী প্রার্থনা যাতে সংসার জীবন পরম্পরাগত ভাবেই চলমান থাকে।
নবান্নের পরদিন ‘পান্ত লবান’ নামে পরিচিত। এই দিনটি অরন্ধন—অর্থাৎ রান্না না করে পূর্বদিনের বাসি খাবার খাওয়ার নিয়ম। আর তার পরের দিন ‘ত্যা-পান্ত লবান’। এইভাবে তিন দিনব্যাপী নবান্ন উৎসব চলতে থাকে।
নবান্নের পাশাপাশি এই অঞ্চলে আর একটি বিশেষ ও ঐতিহ্যময় উৎসব পালিত হয়, সেটি হল ‘সিজ্যানো’। বসন্ত ঋতুর সূচনাকালে, বসন্ত পঞ্চমীর দিনে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। সিজ্যানোকে আবার কেউ কেউ ‘সিদ্ধ খাওয়া’ পরবও বলেন। এই দিনটি মূলত পরিবারের মা, ঠাকুমাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাঁরা ভোরে উঠে শুদ্ধ হয়ে ধৌত বস্ত্র পরিধান করে মাটির হাঁড়ি বা অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাঁড়িতে পুকুরের জল নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ডাল ও শাক-সবজি সিদ্ধ করেন। এঁর মধ্যে যে কয়েকটি উপকরণ অবশ্যই থাকে তা হল—মাসকলাই, বুটকলাই, মটরকলাই, বরবটি ও অড়হর। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বেগুন (পূর্ণাঙ্গ), শিকড়সহ রসুন, পাতাসহ বথুয়া শাক বা বোথো। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘুঁটে, কাঠ ও তুষ। ঘরোয়া উনুনে ধীরে ধীরে বহু সময় ধরে সিদ্ধ হয় এই মিশ্রণ।
এই সিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার সময় একটি বিশেষ লোকবিশ্বাস গ্রামীণ নারীদের মধ্যে প্রচলিত—যতক্ষণ পর্যন্ত সিজ্যানোর হাঁড়ি উনুনে বসানো থাকবে ততক্ষণ অন্য কোনো উনুনে কিছু রান্না করা যাবে না। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করে, তাহলে বাড়ির অমঙ্গল হবে—এমন বিশ্বাস এখনও প্রবল। সিদ্ধ হওয়া কলাই পরদিন ভোরে শীতলা ষষ্ঠীর দেবীকে নিবেদন করা হয়। এরপর সেই কলাই সিদ্ধ, মুড়ি ও ঠান্ডা ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়। এটি এক ধরনের অরন্ধন উৎসব, যেখানে শিলনোড়াও বিশ্রামে যায়।
বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে, সিজ্যানোই সবচেয়ে আরামদায়ক ও প্রিয় উৎসব। কারণ এতে বিশেষ রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই, আবার খাবার পেট ভরে খাওয়া যায়। শীতকালে ও ঋতুপরিবর্তনের প্রাক্কালে এই ধরনের ডাল-শাক-রসুনের মিশ্রণে তৈরি খাবার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক বলে মনে করা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই বিশেষ মিশ্রিত কলাইজল বসন্ত রোগ প্রতিরোধ করে, তাই শাস্ত্রীয় ধর্মাচরণের বাইরেও এই উৎসবটির একটি স্বাস্থ্য-সচেতনতামূলক দিক রয়েছে।
এইভাবে দেখা যায়, বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষী তীরবর্তী অঞ্চলের লোকজ উৎসবগুলি নিছক ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এইসব উৎসব সমাজজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে সামাজিক সংহতি, পারিবারিক মেলবন্ধন এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা পায়। নবান্ন ও সিজ্যানো উৎসব এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনে যেমন আনন্দের উপলক্ষ, তেমনি তা তাঁদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতির ধারকও। এইসব উৎসবই আমাদের বলে দেয় যে গ্রামীণ সমাজের প্রাণ এখনও গ্রামীণ ঐতিহ্যের মধ্যেই বেঁচে আছে—যতই শহুরে সভ্যতার ছায়া পড়ুক না কেন।
বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে লোকজ সংস্কৃতি ও কৃষিজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা দুই বিশেষ উৎসব—‘পালুনি’ ও ‘দাউনবড়া’—বাংলা গ্রামজীবনের সৌন্দর্য ও আনন্দের এক অনন্য ছবি উপস্থাপন করে।
গ্রামীণ জীবনযাত্রায় শরৎ এলে শুরু হয় ‘পালুনি’ উৎসব, যা মূলত একটি অরন্ধন বা নিরামিষাশ্রয় ভোগ উৎসব। শিবির হয় শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রথম শনিবার থেকে শুরু করে তিনদিনে। ওই তিনদিন কেউ শাক-সবজি খেতে পারে না, তাই বললে “শাকপালা” চলে—অর্থাৎ শাক না খাওয়া। এই তিনদিন শারীরিক ও আত্মিক নিয়ন্ত্রণের এক সহজ অবলম্বন। মঙ্গলবার আসে নিরামিষাশ্রয়ের বিরাম—অর্থাৎ শাক খাওয়ার পুনরায় শুরু। কিন্তু সামাজিক ধ্যান মনে রাখা হয় যে, সেই সপ্তাহের আগের শুক্রবার রাতে প্রয়োজন হয় বিশেষ ভোজনপ্রস্তুতি। পালনকারীরা ভাত, মুড়ি, খই, দই, আম ও মিষ্টান্নসহ নানা প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে সেদিন রাতের খাবার হিসেবে ঠান্ডা জমিয়ে রাখে।
কারণ শনিবার সকালে শাক-রান্না করা হয় না; বয়বয় বা ফ্রেশ রান্না না করেই আগে থেকে সঙ্গৃহীত খাবার খাওয়াই হয়—শীতল প্রাকৃতিক আহার। এমনকি الأحد[temp বা শিল-নোড়া ‘বিশ্রাম’ দেওয়া হয়। এতে ঘরে-দৌড়ে, হাঁসা-কাটারি ব্যবহার বন্ধ। পরিপাষিত এই প্রেমময় স্থিতভাব যেন থামিয়ে রাখে সামান্য যান্ত্রিকতা। উৎসবের কেন্দ্রে আসে শুভেচ্ছা ও অতিথিপরায়ণতা। সন্ধ্যায় পারিপার্শ্বিক বাড়ির মানুষদের ডেকে আনা হয়; তারা গায়ে ছেয়ে রাতের জমিয়ে রাখা খাবার খেয়ে প্রমত্ত হয়। এই উৎসবের সঙ্গে মেয়েদের দুই কাজ—পাশাপাশি ‘মনসা দেবীর স্মরণ ও পূজা’—অনায়াসে স্থান পায়, আর সেই সঙ্গে ওঠে উপাচারে ‘শিল’, ‘লাঙ্গল’, ‘গোরু’—সবই একদিন বিশ্রামের অধিকারী—তাই প্রাচীনরা মনে করেন, এটাই এক উৎসব যে সবনে সমাজবাদী সম্পর্ক ও শ্রদ্ধাশীল বসবাসকে সম্মান জানায়।
তৎপরতার আলোয় এই উৎসব বসন্ত–শরত পেরিয়ে কৃষিকাজের মাঝে চলে জাতীয় প্রখরতা—‘পালুনি উৎসব’ বলে সামাজিক ও কৃষিযান্নায় সংহতি উদযাপন। এখানে খাদ্য, স্থিতি ও শ্রমের একটি সহজ ভালোবাসার চিত্র ফুটে ওঠে।
আরও এক জনপ্রিয় উৎসব হলো ‘দাউনবড়া’। কৃষি বিভাগে ধান কাটার সময় মৌলিকভাবে এটি একটি নিস্পত্তির দিন। ধান কাটার শেষ দিনে এটি পালিত হয়। প্রথমে ধানক্ষেতে ক্ষেতের কোনে এক ধানের গোছা অকাটাই রাখা হয়। এই ‘দাউন’ নামক গোছা অর্ধকাটা ধান অন্য পাকা ধানের মধ্যে থেকে আলাদা হয়ে আশ্রিত হয়ে যায়। সেটি জলে ভিজিয়ে, ধূপ ও সিঁদুর দিয়ে কৃপণ ভাবে পূজিত হয়। মনে রাখা হয় ঈশান মূর্তি ও দেব-দেবীর উপস্থিতি—সেটি মাঠের দেবতা প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে সমাজের আভ্যন্তরীক সাধনা। তারপর কেটে ফেলার মূল দিন ‘ধান মাড়াইয়ের দিন’ আসে; তখন এই শীতল ধর্মীয় প্রতীক কুলে বা ডালের সঙ্গে নিয়ে ঘরে আনা হয়। ঘরে নিয়ে আসার দিনে ‘পঞ্চব্যঞ্জন’ সহ ভোজের আয়োজন করা হয়—লোকরা একত্রে খেতে এবং আনন্দে মেতে ওঠে। মাড়াই ক্ষেতে সৃষ্টোহীন, বস্ত্রহীন কিছু মুহূর্ত হাসিখুশির অণুপায়ে রইল—‘দাউনবড়া’ এক কৃষিজীবনের ছোট যত্নের স্মারক।
এই দুই উৎসবের মাধ্যমে ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে মানুষের কৃষিঋতু, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্ম ও সমাজবোধের এক নিখুঁত মিশ্রণ ফুটে ওঠে। প্রতিটি উৎসব শুধু জায়গার নির্দিষ্ট একটি রীতি নয়—বরং এটি তাদের জীবনের সমাবেশ, পারিবারিক মিলন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক ঐক্যের এক আন্তরিক অভিব্যক্তি। এই উৎসবগুলোতে অরন্ধন, খাদ্য-বাস্তবতা, আচারবিধি, লোকবিশ্বাস, সম্প্রীতি ও গ্রামীণ শ্রমের সব বৈশিষ্ট্য মিশে এক প্রাণবন্ত চিত্রের জন্ম দেয়। গ্রামীণ লোকসহজতার এবং সামাজিক বন্ধনকে উপস্থাপন করে নবান্ন, সিজ্যানো, পালুনি ও ডাউনবড়া—এই চারটি উৎসব একত্রে, ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরে এক জীবন্ত মানবিক চিত্র তৈরি করে; একথা বলা যায়, গ্রামীণ বীরভূম-এই উৎসবময় জীবনেই বেঁচে আছে।
দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে গাঁথা এই আচার অনুষ্ঠানগুলি শুধু ধর্মীয় রীতি নয় — এগুলো হল সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পারস্পরিক সংহতির জীবন্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক বহিঃপ্রকাশ। এখানে কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উপস্থিতি প্রয়োজন পড়ে না; বরং পরিবারের প্রত্যেক সদস্য—পুরুষ-মহিলা, সকলে মিলে নিজেদের হাতে অনুষ্ঠান পূর্ণ করে, যা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার।
গ্রাম্য সম্প্রীতি ও পেশা নিয়ে এক সংঘবদ্ধ জীবন—চাষ, উৎসব, আনন্দ, পরিশ্রম—এসব একত্রে গঠিত হয় সামাজিক বন্ধন ও আত্মিক সমৃদ্ধির এক সমন্বিত চিত্র। যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার পরও এখানকার মানুষ তাদের লোকসংস্কৃতি রক্ষা করেছে—আচার, গান, নাটক, ধাঁধা, প্রবাদ, মন্ত্র, লোকচিত্র, কারুশিল্প, গৃহনির্মাণ, চিকিৎসা রীতি—সব মিলিয়ে এরা থাকে না দূরকাল থেকে ওতপ্রোতভাবে এই জীবনের সঙ্গে যুক্ত।
লোকসংস্কৃতি শুধু আদিবাসী শিল্প নয়, বরং বিদ্যমান জীবনের প্রভাবিত প্রক্রিয়া, যেখানে ধাঁধা একটি যৌথ মানসিক খেলামাত্র নয়, এটি বুদ্ধির প্রতিফলন—যেমন:
“মামাদের কালো গাইটি… ভাঁক করলেথিং দিলে গোটা প্যাটটো ভরে।”
প্রতিটি আচার, শব্দ, গণচিন্তা ও কৌতুক এখানে সমাজের শরীর ও মনের এক চিরন্তন চিত্র স্থাপন করে। এর মধ্যে বাজে না কোনও শিরোনাম—শুধুই জীবনের নির্দিষ্ট প্রতিফলন, শান্তির সংগে মিলেমিশে এক কর্মকাণ্ডের আনন্দ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ।
বহুমাত্রিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় গঠিত ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরবর্তী বীরভূম—শুধু একটা ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং এক জীবন্ত পরিপ্রেক্ষিত, যেখানে কৃষিপ্রার্থনা, আচার অনুষ্ঠান, লোকসাহিত্য, মৌলিক বিশ্বাস এবং কৃষিজীবনের পরিপূরক চিত্র একত্রিত হয়ে এক জায়গায় অনন্য সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন গড়ে। এই অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা ছাড়াও নবান্ন, সিজ্যানো, পালুনি, ডাউনবড়া প্রভৃতি গ্রামীণ উৎসব উদ্যাপন করে, যেগুলো ধর্মীয় আচারই নয়, বরং সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশ ও শ্রম নির্ভর সামাজিক সম্মিলনের উৎস।
নবান্ন বা স্থানীয়ভাবে ‘লবান’ উৎসব কৃষিভিত্তিক সমাজে নতুন ধানের আগমনকে উদ্যাপন করে। অঘ্রাণ মাসে গ্রামের প্রবীণরা ঠিক করেন, কোন দিন হবে নবান্ন। সেই দিন বাড়িতে নতুন চালের ‘পায়েস’ এবং চাল-গুড় মিশিয়ে ‘গুলুনি’ প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে এটি বাস্তুদেবতা ও দেবী অন্নপূর্ণাকে ভোগ দেওয়া হয়, তারপর পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন সঙ্গে নিয়ে এক জমকালো গ্রহণের আয়োজন করা হয়। দুপুরে সাত রকম ভাজা, মাছ, পরমান্নসহ বড় ভোজনরীতি মেনে খাওয়া হয় এবং রাতে হয় গ্রাম্য সঙ্গীত, কবিগান, বাউল গান বা যাত্রাপালা। ‘ল-পুরন’ অনুষ্ঠানে পুরনো ও নতুন চালের মিশ্রণ থেকে তৈরি খাবার সামন্বয়ে ঘর-সংসারের স্থিতিশীলতা ঘোষিত হয়। পরবর্তী দুই দিন রান্না না করেই আগের দিনের খাবার ‘পান্ত লবান’ ও ‘ত্যা-পান্ত লবান’ অপুষ্টিতে ভোগের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এই তিন দিনের আচার চিরন্তন অনুশীলন ও কৃষিজীবনের সঙ্গে যুক্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক ধর্মীয় ও সামাজিক রূপান্তর।
‘সিজ্যানো’ উৎসব বসন্তের শুক্লা পঞ্চমীতে পালন হয়,য়ের অন্য নাম ‘সিদ্ধ খাওয়া’। মাটির হাঁড়িতে কালো কলাই, বুট, মটর, বরবটি, অড়হর ইত্যাদি সহ রসুন, বেগুন, শাক—এই সব উপাদান নিয়ে বিশেষ সিদ্ধ রান্নার আয়োজন হয়। শীতলা ষষ্ঠীর উদ্দেশে ভোগ দেওয়ার পর পরিবারের সদস্যেরা তাই ভক্ষণ করে। শিল-নোড়া ও উনুন ওই দিন নিষিদ্ধ; কারণ দেবীর আরাধনা অনুযায়ী রূপান্তর ও বিরতি জরুরি এই দিনে। এই উৎসবের মধ্যে আছে ঋতুবৈচিত্র্য এবং সেই সময়ের খাদ্য ও ঔষধগত প্রজ্ঞা—এক বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক চিত্তের সরল এক মিশ্রণ।
‘পালুনি’ বা ‘শাগপালা’ উৎসব শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রথম শনিবার থেকে শুরু হয়। পরের তিন দিনের জন্য শাকাবজি নিষিদ্ধ, কারণ শাকপালা চলমান থাকে। তারপর মঙ্গলবার শাকবিরতি ভেঙে সেই সপ্তাহের শুক্রবার খাবার প্রস্তুত করে রাখা হয়, আর শনিবার অরন্ধনে ঠাণ্ডা খাবার গ্রহণ করা হয়। শিল-নোড়া ও উনুন ব্যবহার বন্ধ থাকে। খই, দই, আম, ছোলা মিশিয়ে তৈরি মুড়ি দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরা আনন্দে এই উৎসব শেষ করে। এতে নিহিত রয়েছে শারীরিক ক্ষুধা–তৃষ্ণার বিরতি, অরন্ধন পালন ও সামাজিক সমন্বয়।
‘ডাউনবড়া’ উৎসব ধান-মাড়াইয়ের শেষ দিন উদ্যাপিত হয়। ক্ষেতের ঈশান কোণে একটি ‘দাউন’ গাছা রেখে সেটির পূজার করে একটি প্রথা অনুসরণ করা হয়। পরে মাড়াই শেষে সেই ধান ঘরে আনা হয় ও পঞ্চব্যঞ্জনের আয়োজন করে পাড়া-প্রতিবেশীদের নৈচ্ছিকভাবে খাওয়ানো হয়। ধান্য ধর্ম, পরম্পরা ও ঋতুচক্রের আত্মিক উদ্যাপন এ উৎসবে সমন্বিত হয়।
এই সমস্ত উৎসবে লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হলো—কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না; বাড়ির পুরুষ-মহিলারাই একত্রে আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। এতে জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকে অংশগ্রহণ করে—যা এক পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক।
লোকসংস্কৃতি এ অঞ্চলে বহুস্তরীয় আধার আরেঠি Realität। উৎসব ছাড়াও ভাষা, শিল্প, লোকবিশ্বাস, প্রবাদ, ছড়া, ধাঁধা, লোকসঙ্গীত—এসব এক সংগঠিত জীবনধারার প্রতিফলন। এখানে লোকধাঁধাগুলো বুদ্ধি খেলার সঙ্গে রসাত্মক পরিবেশ এনে দেয়। যেমন: “কালো গাই কালশা/দুদ দেয় এক মালসা।” (মেঘ ও বৃষ্টি) বা “মামাদের লাল গাই/হাত দিলে টাকা হয়।” (কলার থোড় ও কাঁচাকলা)—সেই মনোযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক ও অনুধাবনমূলক লোকসংস্কৃতির অংশ।
আলাপ-প্রবাদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী জীবনানুভবের সংক্ষিপ্ততা নিহিত। আশুতোষ ভট্টাচার্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী—“প্রবাদ…জাতির সুদীর্ঘ ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম রসাভিব্যক্তি”—মোহনীয় সত্য, যেখানে অতীত ও বর্তমান এক সঙ্গে প্রকাশ পায়। যেমন—“প্যাট ভরলে ল্যাট রাজা”, “কপালে নাইখো ঘি/ঠক্ঠকালে হবে কি” ইত্যাদি প্রবাদের মধ্যে নারী–পুরুষের সংবেদনশীল উপলব্ধি, অর্থনৈতিক সংকট, সমাজসচেতনতা ফুটে ওঠে।
ছড়ার ক্ষেত্রেও দেবতা–সমাজ–শিশু–ভাষার এক আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন—“শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই”—এ কথা ঠিক এই ছড়াগুলির মধ্যেই প্রতিফলিত। যেমন:
আঁচিরে পাঁচিরে ঝিঙ্যার লতা/ঝিঙা ক্যানে ধরে না/আমার ছেল্যাকে ব্যাড়াতে নিঙে গেলছে/মা চেনে না …
এতে প্রকাশ পায় শিশু-প্রেম, মাতৃ–দায়বোধ, এবং ভাষার আন্তরিক মাধুর্য।
সঙ্গে সাথে গ্রামীণ কাজের সঙ্গে লোকপদ্ধতির সম্পর্ক দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে কারুশিল্প, বস্ত্র, লোকচিত্র, গ্রামীণ চিকিৎসা ও লোকচার্যের মধ্য দিয়ে—সকলেই এক আত্মিক ও পরিবেশগত জ্ঞানসূত্রে আবদ্ধ। এই সব উপাদান একত্রে সমাজকে ঐতিহ্য–গত বীরত্ব ও সংস্কৃতির ধারক বানিয়ে রাখে।
আমরা দেখতে পাই এই অঞ্চলে লোকসংস্কৃতির চার প্রধান স্তম্ভ—
১. আদিবাসী–লোক–ইতিবৃত্ত ও উৎসব
২. লোকসাহিত্য—ধাঁধা, ছড়া, প্রবাদ
৩. করিঙ্গাসারণ ও কারুশিল্প
৪. লোকচিকিৎসা, সংস্কার ও দৈনন্দিন ব্যবহার
এই সমস্ত স্তম্ভ সমন্বয়ে, বীরভূমের গ্রামীণ সমাজ একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা গঠন করেছে, যেখানে ধর্ম, কাজ, বিশ্বাস এবং কলা এক হয়ে যায়। বেশি সংক্ষিপ্তকরণ বা আধুনিকতার ছাপ থাকলেও, এখানকার লোকসংস্কৃতি নিজেই তার ঐতিহ্য ও প্রাণবন্ততা দিয়ে আধুনিক সময়ের সঙ্গে সংযোগ রাখে। ফলে, প্রবাদ, ছড়া, উৎসব, আচার—সবই এখানে এক আত্মার আত্মপ্রকাশ, একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক চিত্র, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
গ্রামের নারী কিংবা পুরুষ যখন শিশুর কোল থেকে ছড়া দেন, তখন তা কেবল ঘুম পাড়ানো কর্মকাণ্ড নয়; এছাড়া এক সাংস্কৃতিক আঞ্চলিক ছবি, আস্ত ব্যক্তিগততা ও পরিবারের ভেতরের সংবেদনময় জীবনচিত্র ফুটে ওঠে। নিম্নোক্ত ছড়াটিতে ধারণা, শব্দ, বিন্যাস ও আবৃত্তির মধ্যে সমাজ ও পরিবার—সবকিছুই যেন নড়বড় করছে, রাসায়নিক যুক্ত—a subtle alchemy of regional worldview.
আলতা নুড়ি/গাছের গুঁড়ি,/জোড়পুথুলের বিহ্যা,/অ্যাতোটাকা লিলেন বাবা/দূরে দিলেন বিহ্যা।/অ্যাখোন ক্যানে কাঁন্ছেন বাবা/গামছা মুড়ি দিঙ্যা…
…
ব্যালা করে ঝিকিমিকি গলা করে কাট/কতোক্ষণে যাবো রে ভাই হরগৌরীর মাট…
এর মধ্যে পাওয়া যায়—
১. পারিবারিক রীতিনীতি: ‘জোড়পুথুলের বিহ্যা’ বা আলতা ও গামছা দিয়ে সাজানো ইঙ্গিত করে ছেলের বিবাহ বা ঘরোয়া আয়োজনের প্রাক-পর্ব, যেখানে বাবা মা, পাড়া প্রতিবেশী—সবাই মিশ্রিত।
২. সামাজিক অবস্থান: ‘শ্বশুরদের ঘরখানি…’ – সাংসারিক আদর্শ ও শাশুড়ির সম্ভাবিত ভূমিকা ইঙ্গিত করে, যেখানে মেয়ের নতুন ঘর-বাড়ির সূচনা হয়।
৩. যৌগল্যপূর্ণ আবেগ: বাবা মা– মেয়েকে নিয়ে মিশ্র স্নেহ, আশঙ্কা, উৎসাহ—যেমন ‘দূরে দিলেন বিহ্যা’, ‘অ্যাক খুড়িতে… মাকে যেঙি বলো…’ ইত্যাদি ভাষায় ফুটে ওঠে।
৪. সামাজিক মনস্তত্ব: ‘দাদা তো চণ্ডাল ব্যালা দ্যাখাছে…’—পরিবার বা পাড়াপড়শি দ্বারা মেয়েকে ঘিরে সামাজিক রোল আউট, বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস।
ছেলেধরা বা ঘুম পাড়ানোর ধরণের অনুষঙ্গগুলোও দেখায় কুম্ভ–পূর্ণ প্রথা। যেমন,
‘ঘুগুচু/প্যাটেফু।—কি ছেল্যা?/ব্যাটা ছেল্যা।…’
এই কথ্য বিন্যাসে আমরা দেখতে পাই—“কি ছেল্যা?”, “চিলে নিঙেছে?”—বাচ্চার ঘুমের স্থিতিশীলতা, মা–বাবা বা দিদিমার সাবধান স্নেহ ও সময়জ্ঞাপন। “সুনাদিকে” নামক কাল্পনিক চরিত্র—বাচ্চাকে নির্দিষ্ট অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা স্বরূপ শুইয়ে দেওয়া হয়।
গ্রামের বড় মহিলারা এসব ছড়ায় তুলে আনে ঘরের সমস্যা ও সমাজের দৈনন্দিন জীবন—যেমন:
- “গুদা পা তুলতে লারি,/ সেই ধান কুটা করাল্যা হরি।”
- “দুনিয়ায় কে সতী?/ জোটিল্যা কুটিল্যা বলে/ আমরা দুই মা বিটি।”
- “ব্যাটা নাই তো বিটি বাবু/দুধ নাইখো জলে সাবু!”
এই ছড়াগুলো প্রাঞ্জল, রসাত্মক আর সহজাত—এককথায় আধুনিকতা ও পুরানো মনের এক সেতুবন্ধন।
প্রথমে শিশু-কেন্দ্রিক কারুকার্য, আর দ্বিতীয়তঃ কার্য-জীবনধারার স্বতন্ত্র উপস্থাপনা।
এইসব স্বতন্ত্রতা ছড়ার মাধ্যমে সামাজিক বাস্তবতা—খাদ্যের অভাব, সন্তানের সঙ্গ, মা–বাবার দায়িত্ব বিচার—সবই উপস্থাপিত হয় সরল অথচ গভীর ভাষায়।
ছড়াগুলো যেন পরিবারের অন্তর্মূল্য তুলে ধরে—একটু কখনো ‘জোড়পুথুল’, কখনো ‘শ্বশুরের ঘর’, কখনো বা ‘বোলের মহিলারা’—সবই দেখায় পরিবারের পরিচিতি, দায়বদ্ধতা ও সমাজের নিয়মকানুন।
এগুলি কোনো বই থেকে শেখা হয়নি, বরং অভিজ্ঞতা—ঘরে, মাঠে, পাড়ায়—দৈনন্দিন জীবন থেকে সংগৃহীত।
এখানে ভাষাশৈলী ও প্রবাদ-প্রথার সংযোগও লক্ষণীয়—শিক্ষার সীমানা ছাড়িয়ে, সমাজ থেকে ঘরে ঐতিহ্য, সংগ্রহিত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা—সব কিছু যেন এই ছড়ায় মিলেমিশে এক শিল্পিত ছোঁয়া তৈরি করেছে।
এই প্রবন্ধে প্রাণ আছে—ছোট ছোট শব্দগুলো যেন মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, পরিবারের সঙ্গে গেঁথে আছে। শব্দের মিশ্রণ, রূপ, রীতিমতো ছড়াগুলোর ভেতর দিয়ে এমন এক পরিবেশ ভাসছে যেখানে সমাজ, বন্ধন, প্রচার, অভ্যাস, অনুভূতি সব কিছুই আমরা খুঁজে পাই।
এ সমস্ত উপাদান একত্রে—ঋতু, আচার, ভাষা, পরিবারের বিবাহ প্রথা, মায়ের মন্তব্য, শ্বশুর–ঘর—একভাবে একটি সামাজিক জীবনচিত্র হয়ে দাঁড়ায়। এতে যান্ত্রিকতা না থাকলেও, মানবিকতা ও সংস্কার জীবন্ত অবস্থায় প্রকাশ পায়। এই প্রবন্ধটা তাই শুধু ছড়ার আলোচনা নয়—বরং গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির এক ‘সংলাপ সংকলন’, যা শুধুমাত্র বাচ্চা ঘুমানোর সরল ভাষায়ও জীবন ও সমাজ ভাঙে এবং আবার গড়ে।
বীরভূম জেলার সংস্কৃতি ও লোকজীবন সম্পর্কে বলতে গেলে, সেখানে লোকসঙ্গীতের প্রভাব এবং বিস্তারকে অগ্রাহ্য করা একপ্রকার অসম্ভব। এই জেলার প্রতিটি অলিগলি, মাঠঘাট, নদীতীর, এমনকি প্রতিটি ঋতুও যেন লোকসঙ্গীতের সুরে সুর মেলায়। আর এই সাংস্কৃতিক বুননের প্রাণভোমরা হলেন বাউল, ফকির, কবিয়াল, ঝুমুর শিল্পী এবং আরও অনেক গ্রামীণ সঙ্গীতধারার বাহক।
বীরভূমকে বাউল ফকিরের দেশ বলা হয়ে থাকে, আর তা কেবলমাত্র কথার কথা নয়। এখানকার লালমাটি আর বাউলের আত্মা যেন পরস্পরের সহচর, একে অন্যের অন্তঃস্থলে রক্তের মতো প্রবাহিত। বাউলদের গেরুয়া পোশাক, মাথায় ‘ধমিল্ল’ করে বাঁধা চুল, পায়ে নূপুর আর বগলে গার্গুবা নিয়ে চলাফেরা—এই দৃশ্য বীরভূমের গ্রামবাংলায় একেবারেই চেনা ছবি। শুধু গান নয়, জীবনদর্শন, প্রেম, দেহতত্ত্ব ও সহজিয়া ভাববাদ—সবকিছুই বাউলগানকে করে তোলে এক অতুলনীয় দার্শনিক সম্পদ।
বছর জুড়ে এই জেলায় নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভেসে আসে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত। ভাদ্রমাসে ‘ভাদু গান’ ও ‘ভাজুই’ বা ‘ভাজো’, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ‘ধর্মরাজের বোলান’ বা ‘চিয়্যান’, চৈত্র-বৈশাখে শিবের গাজন—প্রতিটি পর্বই লোকগানের জন্য এক একটি মহোৎসব।
এছাড়া ‘কবি গান’, ‘আলকাপ’, ‘তরজা’, ‘বেহুলা ভাসান’, ‘ঝাঁপান’, ‘টহল’, ‘প্রভাতী সঙ্গীত’, ‘নগরকীর্তন’, ‘হরিনাম সংকীর্তন’, ‘হাপু গান’, ‘ঝুমুর’, ‘পটসঙ্গীত’, ‘গোয়ালিয়া গান’, ‘রামযাত্রা’, ‘ভাঁটের গান’—এসব সঙ্গীতধারা শুধুমাত্র গান নয়, বরং বাঙালির লোকজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলির প্রতিটিতে রয়েছে লোকজীবনের ইতিহাস, অনুভব, বিশ্বাস ও প্রতিবাদ।
একটি বাউল গানের অংশ নিচে উদ্ধৃত করা হল:
“আমার বাউল ঘরে জন্ম য্যানো/হয় গো বারে বার।/আমি চাই নারে সুক্/দাও ভরা দুক্/ওগো অন্তরে আমার।/আমার বাউল ঘরে জন্ম য্যানো/হয় গো বারে বার।/আমার একতারা হোক জীবনসঙ্গী/দুঃখ পারাবার/আমার কুঁড়েঘরে দারুণ শ্রাবণ/বাঁধে প্রীতির ঘর।”
এই গানটি কেবল বাউল দর্শনের অভিজ্ঞান নয়, একজন মানুষের অভ্যন্তরীণ আত্মসন্ধানেরও প্রতিফলন।
অন্যদিকে গোয়াল ও গোরুর গানেও ফুটে ওঠে কৃষিজীবনের ঘনিষ্ঠ চিত্র। গরু চরানো, হাল ধরা, মাঠের বলদ—এইসব চিত্রের মধ্য দিয়েই ধরা পড়ে লোকজীবনের নিরলস পরিশ্রম এবং তার সঙ্গে জড়িত বিশ্বাসব্যবস্থা:
“চালভাজা কলাই ভাজা গোই লে বসে খায়,/মাঠে মরে হালের বলদ ঘরে মরে গাই।…”
এই গানগুলো মূলতঃ একটি জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। শস্যদেবতা, লক্ষ্মী বা গৃহদেবীকে নিয়ে এইসব গানে দেখা যায় পরিশ্রম, প্রকৃতি এবং ঈশ্বরের এক চিরন্তন সংলাপ।
লোকসঙ্গীতের আর এক উল্লেখযোগ্য ধারা হল ব্যাঙের বিয়ের গান। এটি একাধারে রম্যরসাত্মক, আবার সামাজিক কল্পনারও শাখা। যেমন—
“উসকটি রে মারুয়া
ঝিঙের ফুলের সেহেরা
সইকে পাঠালছি গোহালপাড়া ।
…
আকাশেতে নাইরে পানি
কিসে হবে ধান
মত্যে নামরে নাম।”
এই ধারা মূলত মেঘ-বৃষ্টি ও কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যেখানে প্রাকৃতিক অসংগতিকে ব্যঙ্গ ও কল্পনার মিশেলে উৎসবে পরিণত করা হয়।
বীরভূমের মাটির গন্ধ পাওয়া যায় এইসব লোকগানেই। এখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে না, বরং মিশে যায়। তাদের গান, তাদের উচ্চারণ, তাদের তান ও তাল—সবকিছুই যেন প্রকৃতির ছন্দের অনুবাদ।
এইসব সঙ্গীতধারা কেবলমাত্র বিনোদন নয়, বরং একধরনের সামাজিক শিক্ষা, একধরনের আত্মানুসন্ধান, আবার কখনো কৃষি ও জীবনধারার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর এক উৎসব।
তাই গবেষণার পটভূমিতে এই লোকসঙ্গীতসমূহের ভূমিকা অপরিসীম। এগুলির মধ্য দিয়েই আমরা পৌঁছতে পারি সেই গ্রামীণ মানুষের অন্তর্লোকের কাছে, যার ভাষা নিরেট কিন্তু সংবেদনশীল, যার চিন্তা প্রাকৃতিক কিন্তু গভীর। এইসব সঙ্গীত গবেষণার আলোয় তুলে আনার পাশাপাশি সংরক্ষণ ও প্রচার করা জরুরি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আলোচনা করা হয়েছে—এই এলাকার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যরীতি, শব্দভাণ্ডার প্রভৃতি ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়ে। কারণ ভাষা এবং সঙ্গীত—দু’টোই লোকচেতনার গভীরে অবগাহন করে থাকে। আর সেই চেতনার স্বরূপ অনুধাবনের জন্য লোকসঙ্গীত ও লোকভাষার যুগ্ম পাঠ অত্যন্ত জরুরি।
উল্লেখপঞ্জি
- ১। ড. অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় – প্রসঙ্গঃ উত্তর রাঢ়, গ্রন্থের ৩৪২ পৃষ্ঠা থেকে নেওয়া
- ২। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী – রাঢ়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস
- ৩। শ্রীগৌরীহর মিত্র – বীরভূমের ইতিহাস, অখণ্ড সংস্করণ
- ৪। অতুল সুর – বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
- ৫। ড. সুধীর কুমার করণ – সীমান্ত বাংলার লোকযান
- ৬। রঞ্জন গুপ্ত – রাঢ়ের সমাজ অর্থনীতি ও গণবিদ্রোহ
- ৭। ডবলু. ডবলু. হান্টার; চট্টোপাধ্যায়, অসীম (অনুবাদক) – গ্রাম বাংলার ইতিকথা
- ৮। ড. দুলাল চৌধুরী (সম্পাদক) – লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ
- ৯। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (প্রকাশিত); চক্রবর্তী, মহিমানিরঞ্জন (সম্পাদিত) – বীরভূম বিবরণ, ১ম খণ্ড
- ১০। District Statistical Handbook, Birbhum – 2006, Govt. of West Bengal
- ১১। অর্ণব মজুমদার – বীরভূম : ইতিহাস ও সংস্কৃতি
- ১২। ‘পশ্চিমবঙ্গ’, বীরভূম জেলা সংখ্যা, ১৪১২
- ১৩। বাংলা পিডিয়া, চতুর্থ খণ্ড
- ১৪। নীহাররঞ্জন রায় – বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব
- ১৫। ড. বরুণ কুমার চক্রবর্তী (সম্পাদক), বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ-এর অন্তর্গত প্রবন্ধ
- ১৬। দেবকুমার চক্রবর্তী – বীরভূম জেলার পুরাকীর্তি
- ১৭। ‘বীরভূমি’ শতবর্ষ পূর্তিসংখ্যা (১৩০৬–১৪০৬ বঙ্গাব্দ)
- ১৮। ড. অমলেন্দু মিত্র – রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর
- ১৯। আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭/১২/২০০৯
- ২০। বরুণ রায় (সম্পাদক) – বীরভূমি বীরভূম
- ২১। O’Malley, L.S.S. – Bengal District Gazetteers, Birbhum
- ২২। ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায় – বীরভূম সমগ্র, ১ম ভাগ
- ২৩। নির্মলেন্দু ভৌমিক – বাংলা ধাঁধার ভূমিকা
- ২৪। ড. অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় – প্রসঙ্গ : উত্তর রাঢ়
- ২৫। বিনয় ঘোষ – পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি
- ২৬। নয়া প্রজন্ম, ১৯ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, ২৭/১/১০
- ২৭। অরুণ চৌধুরী – সাঁওতাল অভ্যুত্থান ও উপজাতীয়দের সংগ্রাম
- ২৮। Birbhum – 2006, Govt. of West Bengal, District Statistical Handbook
- ২৯। শঙ্করলাল রায় – ‘বীরভূম’ নামের উৎস সন্ধানে
- ৩০। ড. অর্ণব মজুমদার – বীরভূম : ইতিহাস ও সংস্কৃতি
- ৩১। District Statistical Handbook, Birbhum – 2006, Govt. of West Bengal
- ৩২। O’Malley, L.S.S. – Bengal District Gazetteers, Birbhum
- ৩৩। Birbhum – 2006, Govt. of West Bengal, District Statistical Handbook