১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর ইরান ও সৌদি আরবের স্নায়ুযুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। অন্যদিকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধও চলছিলো। ঠিক সে সময় আফগানিস্তানে একটি মেরু ভাল্লুক প্রবেশ করে। যার ফলে আন্তর্জাতিক শীতল যুদ্ধ ও মুসলিম বিশ্বের শীতল যুদ্ধে এক ঝড় উঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাঁর ঠান্ডা আবহাওয়া ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর জন্য মেরু ভাল্লুক বা পোলার বেয়ার বলা হতো। ইরানের বিপ্লবের পর সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার যে শত্রুতা শুরু হয়েছিলো আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের ফলে আফগানিস্তান সৌদি আরব ও ইরানের এক প্রক্সি যুদ্ধের জায়গা হয়ে উঠলো। আফগানিস্তান আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রক্সি যুদ্ধের ময়দান হওয়ার সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের দুই শক্তি ইরান ও সৌদি আরবের প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানও হয়ে উঠলো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আসলো কেন? আফগানিস্তানে তখন কমিউনিস্ট দল পিডিপিএ বা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তানের (People’s Democratic Party Of Afghanistan) সরকার ছিলো। যা সোভিয়েত ইউনিয়ন পন্থী ছিলো। পিডিপিএ এর একটি অংশ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট দাউদ খানকে হত্যা করে। পিডিপিএর হাফিজুল্লাহ আমিন (Hafizullah Amin) আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু আফগানিস্তানে হাফিজুল্লাহ আমিনের সরকার একটি দূর্বল সরকার ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সরকারকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তখন আফগানিস্তানে আফগান মুজাহিদেনের দল বেশ শক্তিশালী ছিলো। আর তারা কমিউনিস্ট শাসনের বিরোধী ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন আশংকা করলো আমেরিকা এদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই আমেরিকা কোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
১৯৭৯ সালের ক্রীসমাস বা ২৫ শে ডিসেম্বরে সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করলো। ২৭ শে ডিসেম্বর রাতে ৪৩ মিনিটের একটি ঐতিহাসিক অপারেশন স্ট্রম-৩৩৩ (Operation Storm-333) হলো আর হাফিজুল্লাহ আমিন তাঁর প্রাসাদে তাঁর সঙ্গীসহ নিহত হলো। হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিশস্ত কমিউনিস্ট আফগান রাজনৈতিক বাবরাক কারমালকে (Babrak Karmal) আফগানিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট বানায়। বাবরাক কারমাল একজন পুতুল শাসক হলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে তিনি ক্ষমতায় ঠিকে ছিলেন। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজের দিক থেকে পুরো সমস্যা সমাধান করে ফেলে ছিলো। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা ছিলো। আর তা হলো আমেরিকা এই পরিকল্পনা ও এই কাজ একদম পছন্দ করলো না। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই পরাশক্তি ছিলো। আর এই দুই শক্তির মধ্যে একটি চুক্তি ছিলো। সেই শক্তি অনুযায়ী আমেরিকা কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কোন দেশের সরকারের পতন ঘটাবে না ও সরকার গঠনও করাবে না। যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তা করে ফেলেছিলো। আর আমেরিকা এমনিতেও চাচ্ছিলো না যে, এশিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে চলে যাক। আর এটা তাদের মধ্যে হওয়া চুক্তিরও লঙ্ঘন। তাই আমেরিকা আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিক্ষা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ এমনিতেও কিছুদিন আগে আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে প্রচন্ড লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়ে ফিরে এসে ছিলো। যার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় ভূমিকা ছিলো। তো আমেরিকা তাঁর মুসলিম সহযোগী বন্ধু দেশ সৌদি আরবের সহায়তায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে।
প্রক্সি যুদ্ধ হলো এমন এক প্রকার যাতে বিবাদমান বিভিন্ন পক্ষকে বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে। আর সেই বিবাদমান পক্ষের কেউ জয়ী হয়। আর এই বৃহৎ শক্তি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাঁর বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে কিংবা নিজের স্বার্থ হাসিল করে। আফগানিস্তানের প্রক্সি যুদ্ধে আমেরিকার অস্ত্র, সৌদি আরব ও আমেরিকার অর্থ এবং প্রশিক্ষণ পাকিস্তানের আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করবে মুসলিম যুবকরা। মুসলিম যুবকরা যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ পেতো। এমনিতেই পাকিস্তান আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ। এছাড়া পাকিস্তানের যুবকদের আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর জন্য জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে একটি ডকট্রিন বা মতবাদ বিখ্যাত করে তোলা হয়। এই মতবাদকে – Hot Water Doctrine বলা হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের আসল লক্ষ্য আফগানিস্তান নয়। বরং এর আসল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর। যা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব সাগর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এই মতবাদের সত্যতার পক্ষে যুক্তি ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সব বন্দরই বছরের অধিকাংশ সময় বরফে ঢাকা থাকে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য গরম পানির বন্দর পাওয়ার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হলো পাকিস্তানের গোয়াদর দখল করা। এই মতবাদের বিপক্ষে যুক্তি ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বন্ধু সরকারকে রক্ষা করতে আফগানিস্তানে এসেছে। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দেশকে দখল করতে পারবে না। এমন দেশ যার পিছনে আমেরিকার সমর্থন রয়েছে। এই মতবাদের পক্ষ না বিপক্ষের যুক্তি সঠিক তা বিবেচনার দ্বায়িত্ব আপনাদের। তো যাই হোক পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্ট এবং ধর্মীয় নেতারা এই মতবাদকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। আর এই মতবাদ পুরো পাকিস্তানে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়।
পাকিস্তানের মুসলিম যুবকরা আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হতে প্রস্তুত হয়ে গেল। সারা পৃথিবী থেকে মুসলিম যুবকরা তাদের ক্যারিয়ার ও শিক্ষা অর্জনকে পিছনে ফেলে পাকিস্তান থেকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতো শুরু করলো। আমেরিকা ও সৌদি আরবের অর্থ, আমেরিকার অস্ত্র আর পাকিস্তানের প্রশিক্ষণের ফলে আফগান জিহাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। এর বদলে সৌদি আরব আমেরিকার নিরাপত্তা পাবে। জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসনকে আমেরিকা বৈধতা দেবে। এই সময় আমেরিকা পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গবেষণা কার্যক্রমকে না দেখার ভান করে৷ সৌদি আরব থেকে এজন্য অর্থ সহায়তা আসতে দেয়। আর এর মধ্যেই পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলে। পাকিস্তান ১৯৮৪ সালে প্রযুক্তির সাহায্যে কোল্ড টেস্ট করে। অর্থ্যাৎ পারমাণবিক অস্ত্রের সরাসরি পরীক্ষা না চালিয়ে অস্ত্রের কার্যকারিতা প্রযুক্তির সাহায্যে যাচাই করা। যার কৃতিত্ব জিয়াউল হক এবং তৎকালীন পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের। পাকিস্তান এ সময় আমেরিকা থেকে অর্থ সহায়তাও পেতো। তবে শুরুর দিকে অর্থ সহায়তা বেশ দিতে আমেরিকা প্রস্তাব করে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পাকিস্তানকে ৪০ কোটি ডলার সহায়তার প্রস্তাব দেয়। জবাবে জিয়াউল হক বলেন আপনার এই সামান্য চীনা বাদাম আপনার কাছেই রাখুন। উল্লেখ্য জিমি কার্টার চীনা বাদামের চাষী ছিলেন। জিয়াউল হকের এই বক্তব্য আমেরিকান মিডিয়া মসলা লাগিয়ে দারুণভাবে উপস্থাপন করে। তারপর ১৯৮১ রোনাল্ড রিগান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হন। যিনি একজন সেলস ম্যানের ছেলে ছিলেন। তিনি কুটনীতি বেশ ভালোই বুঝতেন। রোনাল্ড রিগান পাকিস্তানকে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা দেয়৷ পাকিস্তানকে এফ-১৬ বিমান বিক্রির অনুমতি দেন। এই সুযোগে পাকিস্তান ৩৪ টি এফ-১৬ বিমান এবং হারপুন মিসাইল কিনে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে পাকিস্তান জার্মানি ও ফ্রান্স থেকেও অস্ত্র কিনতে থাকে। তো সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রেট গ্রেমের ময়দান প্রস্তুত হলো।
সাথে সৌদি আরব ও ইরানের প্রক্সি যুদ্ধেরও। ইরান ও সৌদি আরব দুটি দেশই আফগানিস্তানের জন্য আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করে যার ফলে এই যুদ্ধ কিছুটা পাকিস্তানকেও প্রভাবিত করে। সৌদি আরবের অর্থ সহায়তায় পুরো পাকিস্তানে ওয়াহাবী মতবাদের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় যাতে আফগান মুজাহিদনের সাপ্লাই ঠিক থাকে। এত সবকিছুর পরও আফগান মুজাহিদিন সোভিয়েত বিমান বাহিনীকে পরাজিত করতে পারছিলো না। তখন আমেরিকা এমন এক অস্ত্র আবিষ্কার করে আফগান মুজাহিদিনের হাতে তুলে দিলো যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করলো।
১৯৮৩ সালে ৭ টি আফগান ইসলামি দলের একটি জোট গঠিত হয়। এই ৭ টি দলই সুন্নী মুসলিম ছিলো। আর একটি দল ছাড়া বাকীসব দলই পশতুন ছিলো। এই দলগুলো হলো – ১। হিজবে এ ইসলামি, ২। মাহাজ এ মিল্লী, ৩। জামিআত এ ইসলামি, ৪। ইত্তেহাদ ই ইসলামি, ৫। হিজবে এ ইসলামি খালিস, ৬। জেবহ ই নেজাত ই মিল্লী, ৭। হারকাত ই ইনকিলাব ই ইসলামি। এই জোটকে ইসলামি এলায়েন্স অফ আফগান মুজাহিদিন বা আফগান মুজাহিদিন বলা হতো। শুরুর দিকে আফগান মুজাহিদিনদের জন্য অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা সৌদি আরব থেকে আসতো। ফলে আফগান মুজাহিদিনের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ ওয়াহাবী মতবাদের অনুসারী হয়ে উঠে। এদের ওয়াহাবী বা সালাফি বলা হয়। আফগান মুজাহিদিন জোটের প্রধান হিসেবে সৌদি আরবে দীর্ঘকাল ধরে অবস্থানরত আব্দুল রসূল সাইআফকে (Abdul Rasul Sayyaf) নির্বাচিত করা হয়। আব্দুল রসূল সাইআফের দল ইত্তেহাদ-এ ইসলামি আফগানিস্তানে সক্রিয় ছিলো। আব্দুল রসূল সাইআফ ও তাঁর দল সৌদি অর্থ সহায়তা পায় এ ধরনের ধারণা ছিলো সকল গোষ্ঠীর। এই ধারণার কারণ ছিলো আব্দুল রসূল সাইআফ সৌদি রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি সৌদি রাজ পরিবারের আত্নীয়ও ছিলেন। আব্দুল রসূল সাইআফই সর্বপ্রথম ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আসতে এবং থাকতে পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। আব্দুল রসূল সাইআফ বর্তমানে সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে আফগান রাজনীতিতে সক্রিয় এবং অধিকাংশ সময় আফগানিস্তানেই থাকেন। আব্দুল রসূল সাইআফ ১৯৮৩ সালে পেশোয়ারে বসবাস করতে শুরু করলেন। আর পেশোয়ার থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মিশর থেকে অসংখ্য মুসলিম যুবক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিতো। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিলো। তবে পাকিস্তানে দেওবন্দী মাদরাসাগুলো থেকে অধিকাংশ ছাত্র আফগান জিহাদে যোগ দিতো। ১৯৭০ এর দশকে পাকিস্তানে মোট ৮৯৩ টি মাদরাসা ছিলো। তা জিয়াউল হকের সামরিক শাসনমালে মাদরাসার সংখ্যা ২৮০১ টি হয়৷
এই মাদরাসাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ মাদরাসা দেওবন্দী মাদরাসা ছিলো। আর এই মাদরাসা গুলো থেকেই আফগান জিহাদের অধিকাংশ মুজাহিদিন আফগানিস্তানে পৌঁছাতো। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করার জন্য সিআইএ তাঁর ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও কঠিন অপারেশন শুরু করলো। এই অপারেশনকে অপারেশন সাইক্লোনের নাম দেওয়া হয়। এই অপারেশন চলাকালীন সিআইএ প্রতি বছর আফগান মুজাহিদিনকে ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলার দিতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ চলাকালীন সময়ে আমেরিকার কাছে আফগান মুজাহিদিন এতটাই প্রিয় ছিলো যে, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ঐ সময় আফগান মুজাহিদিনদের হোয়াইট হাউসে ডেকে নিজের দুপাশে বসিয়ে দীর্ঘ বেঠক করতেন। যার ছবিগুলো তৎকালীন সময়ে বেশ বিখ্যাত হয়। ধীরে ধীরে আফগান মুজাহিদিনদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই অর্থের পরিমাণ আফগান জিহাদের শেষ বছরগুলোতে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ডলার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমেরিকা সব মিলিয়ে আফগান মুজাহিদিনদের ৩.২ বিলিয়ন ডলার দেয়। সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো আমেরিকা আফগান জিহাদে যত অর্থ খরচ করবে ঠিক ততটা অর্থ সৌদি আরবও খরচ করবে। সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলো। আমেরিকা, সৌদি আরব ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ সব মিলিয়ে ১০ বিলিয়ন ডলার দেয় আফগান মুজাহিদিনদের। এই অর্থ জিয়াউল হকের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদিনদের দেওয়া হতো। সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থা জিআইডি (GID) বা জেনারেল ইন্টিলিজেন্স ডাইরেক্টরেট আব্দুল রসূল সাইআফের দল ইত্তেহাদ-এ ইসলামি এর ব্যাংক একাউন্টে পাঠাতো। এছাড়া বিভিন্ন দোকানে, মসজিদে রাখা দান বাক্স ও সৌদি শাহজাদাদের দান আলাদাভাবে মুজাহিদিনদের কাছে পৌঁছাতো।
আমেরিকার অর্থ ও সমর্থন, সৌদি আরবের নিজের অর্থ নিয়ে সৌদি আরব আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদকে অনেকটা নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। অন্যদিকে ইরান কী করছিলো? সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে প্রবেশের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি এই পদক্ষেপের কঠোর নিন্দা করেন। তারপর ইরান আফগানিস্তানের জন্য একটি নিজস্ব পরিকল্পনা বানায়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইনকিলাব কাউন্সিলকে সমর্থন দেয়। এরা আফগানিস্তানের একেবারে মাঝখানে হাজারাজাতে নিজেদের কেন্দ্র তৈরি করে। এখানে হাজারা গোত্রের লোকেরা বসবাসকরত। ইরান এদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করতো। এই সংগঠনের সদরদপ্তর ইরানে ছিলো। কিন্তু হাজারা গোত্রের লোকেরা আফগানিস্তানে সংখ্যা লঘু ছিলো। আফগানিস্তানে ৪২ শতাংশ পশতুন, ২৭ শতাংশ তাজিক, আর হাজারা ছিলো ৯ থেকে ১০ শতাংশ। হাজার জাতির লোকেরা শিয়া ছিলো। এজন্য ইরান তাদের সমর্থন করছিলো। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও আমেরিকা আফগান মুজাহিদিনদের সমর্থন করছিলো। আর ইরান ইনকিলাব কাউন্সিলকে সমর্থন করতো। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণের ফলে ৩০ লক্ষ আফগান শরনার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। ঠিক তেমনি ১০ লক্ষ আফগান শরনার্থী ইরানেও আশ্রয় নেয়। যদিও ইরানে আশ্রয় নেওয়া সকল আফগান শরনার্থী শিয়া ছিলো না। পাকিস্তান ও ইরানে আফগান শরনার্থী আশ্রয় নেওয়ার ফলে আফগানিস্তানের এই খেলায় পাকিস্তান ও ইরান উভয়েই বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠে। পাকিস্তান সৌদি আরব ও আমেরিকা সমর্থনে শক্তিশালী খেলোয়াড় হলেও ইরানও তেলের সম্পদের সাথে কম শক্তিশালী খেলোয়াড় ছিলো না। মুসলিম বিশ্বে শুরু হওয়া শীতল যুদ্ধ আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন উপস্থিত থাকা অবস্থায় এতটা জোরদার হয় নি।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তান সক্রিয় ছিলো। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমান বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য আমেরিকা এমন একটি মিসাইল তৈরি করলো। যা ছুড়ার জন্য কোন লঞ্চার এর প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন হয় মানুষের কাঁধের। এই মিসাইলের নাম ছিলো স্টিংগার মিসাইল (Stinger Missile)। স্টিংগার মিসাইল সোভিয়েত বিমান বাহিনীকে আফগানিস্তানে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এই স্টিংগার মিসাইল পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদিনের কাছে পৌঁছানো হতো। আফগান মুজাহিদিনরা স্টিংগার মিসাইলের মাধ্যমে সোভিয়েত হেলিকপ্টার গুলোকে পোকা মাকড়ের মতো ভূপাতিত করতো। ৮ বছর ধরে চলা আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মনোবল এমনিতেই কমে গিয়েছিলো। পাকিস্তানের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, আফগান মুজাহিদিনদের হামলা আর আমেরিকা ও সৌদি আরবের অর্থ সহায়তার পর স্টিংগার মিসাইল সর্বশেষ উপকরণ যা আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোমর ভেঙ্গে দেয়। স্টিংগার মিসাইল শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই ধংসাত্তক ছিলো না। স্টিংগার মিসাইল পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়। যার মধ্যে রাওয়ালপিন্ডির ওজড়ি ক্যাম্প এলাকাও ছিলো। ১৯৮৮ সালের ১০ ই এপ্রিল একটি বিস্ফোরণে মিসাইলগুলি বিস্ফোরিত হয়। সে দিন রাওয়ালপিন্ডির অধিবাসীদের কাছে কেয়ামতের মতো ছিলো। চারিদিকে মিসাইল বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দ আর আগুনের বৃষ্টি। এই দূর্ঘটনায় রাওয়ালপিন্ডিতে ১০৩ জন নিহত হয়। যাদের মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ্ খাকান আব্বাসীর বাবাও ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশী ছিলো। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ১৯৮৮ সালের৷ এপ্রিল মাসে জেনেভায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কেউই অন্যের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাবে না। আফগান শরনার্থীদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর ভিতর আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তি মেনে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই জিয়াউল হকের শেষ সময় এসে যায়। ১৯৮৮ সালের ১৭ ই আগষ্ট জিয়াউল হক বিমান দূর্ঘটনায় মারা যান। তখন জিয়াউল হকের সাথে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এবং মিলিটারি অ্যাটাসেও বিমানে ছিলেন। আর তারাও জিয়াউল হকের সাথে নিহত হন। আমেরিকার উচ্চ পদস্থ দুজন কর্মকর্তার সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলেও আমেরিকার এই ব্যাপারে তেমন কোন তদন্ত করে নি। এজন্য অনেক পাকিস্তানি মনে করেন যে, জিয়াউল হকের মৃত্যুর পেছনে আমেরিকার হাত ছিলো। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান ত্যাগের পর আমেরিকাও আফগানিস্তান ত্যাগ করে। তারপর আফগান মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। আগেই বলেছি আফগানিস্তানে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তান মিলে আফগান মুজাহিদিন নামক একটি জোট গঠন করেছিল। ঠিক তেমনি ইরানও মুজাহিদিনদের এক নয়া জোট গঠন করে। যার নাম দেওয়া হিজবে ওয়াহদাদ। এই জোটের প্রধান ছিলো হাজারা জাতির কারিম খলিলি। কারিম খলিলি ইরান থেকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা পেতেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার আফগানিস্তান ত্যাগের পর বিভিন্ন আফগান গোষ্ঠীর কাছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকান ও সোভিয়েত অস্ত্রের বিশাল মজুদ ছিলো। তখন প্রশ্ন ছিলো যে, এবার আফগানিস্তানে কার সরকার হবে? কে আফগানিস্তান শাসন করবে? কারণ আফগানিস্তানের প্রত্যেক সশস্ত্র গোষ্ঠী মনে করতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বেশী। তাই তারা আফগানিস্তান শাসন করবে। কিংবা তাদের জোট। এর ফলে আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দিলো। যদিও আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী একটি অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হলেও তা আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে পারে নি।
ফলে একটি গৃহযুদ্ধ আফগানিস্তানে চলতে থাকে। আর এই গৃহযুদ্ধে দুইটি বড় মুসলিম দেশ সৌদি আরব ও ইরানের প্রক্সি যুদ্ধও চলছিলো। আর এই সব কিছু শেষ করলো মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে মাদরাসার ছাত্রদের একটি দল। যাদেরকে আজ তালেবান বলা হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সাহায্যে কাবুল দখল করে নেয়। তালেবান সদস্যদের পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ট্রেনিং দিয়েছিলো। তালেবানের সদস্যরা পাকিস্তানে দেওবন্দী মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা করতো। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরনার্থীদের অনেকেই তালেবানের সদস্য ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যাওয়ার পর গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তালেবান আফগানিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। যা আফগানিস্তানে সাময়িক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। তালেবান আফগানিস্তানে একটি সরকার গঠন করে। ফলে আফগানিস্তানে সাময়িক স্থিতিশীলতা আসে। সৌদি আরব ও পাকিস্তান তালেবানকে সমর্থন করছিলো। ফলে তালেবান আফগানিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হয়ে উঠে। পাকিস্তান ও সৌদি আরব তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সাময়িক সময়ের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতও তালেবানের সরকার স্বীকৃতি দেয়। এই ৩ টি দেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশ তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি। তারপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। যারা বন্ধু ছিলো তারা শত্রু হয়ে গেল। আর কিছু শত্রু বন্ধু হয়ে গেল। তালেবানের সাথে লড়াই করার জন্য কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বা আফগান জিহাদি গোষ্ঠীর একটি জোট গঠিত হয়৷ এই জোটকে উত্তর জোট বা নর্দান এলায়েন্স (Northern Alliance) নাম দেওয়া হয়। এই জোটে আহমাদ শাহ মাসুদের মতো কিংবদন্তী গেরিলা কমান্ডারও ছিলেন। আর এই জোটে ইরান সমর্থিতত কারিম খলিলির হিজবে ওয়াহদাদও ছিলো। আমেরিকা এবং ইরান তালেবান বিরোধী এই জোটকে সমর্থন করতো। অন্যদিকে সৌদি আরব আমেরিকার মিত্র হওয়া সত্ত্বেও তালেবানকে সমর্থন দেয়। অর্থ্যাৎ পূর্বের বন্ধু আমেরিকা শত্রু হয়ে যায়। আহমাদ শাহ মাসুদ একজন সুন্নী তাজিক কমান্ডার ছিলেন। আহমাদ শাহ মাসুদ সুন্নী হলেও তিনি একজন তাজিক ছিলেন। আর তাজিক ভাষা ও ফারসি ভাষা প্রায় কাছাকাছি ভাষা। এছাড়া তাজিকদের বসবাসের স্থান ইরানের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ইরান আহমাদ শাহ মাসুদকে সমর্থন করে।
আমেরিকা ও ইরান একে অপরকে শয়তান বললেও তারা উভয়েই নর্দান এলায়েন্সকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দেয়। আর ভারতও নর্দান এলায়েন্সকে অর্থ সহায়তা দিতো। আফগানিস্তানে সৌদি আরব ও ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ চলার সাথে সাথে এই প্রক্সি যুদ্ধ পাকিস্তানেও প্রবেশ করলো পাকিস্তানেও সৌদি আরব ও ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ চলতে লাগলো। তালেবানের বিরুদ্ধে নর্দান এলায়েন্স তেমন একটা সফল হয় নি এবং আফগানিস্তানের ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর ১৯৯৮ সালে আচমকা কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে হামলা হলো।
১৯৮৯ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ সেনাদল আমু নদী পার করে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে গেলেও তারা আফগানিস্তানকে এক ধংসস্তুপ হিসেবে ছেড়ে যায়। যেখানে অনেক ছোট বড় কমান্ডার আফগানিস্তানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছিলো। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের প্রক্সি যুদ্ধ শেষ করে নিজ দেশে ফিরে গেলেও আফগানিস্তান শান্ত হলো না। আমেরিকার দেওয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রেখে যাওয়া এত অস্ত্র আফগানিস্তানে ছিলো যা দিয়ে আগামী ১০ বছর অনায়াসে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই অবস্থায় পাকিস্তান ও সৌদি আরব আফগানিস্তানের বড় বড় কমান্ডারদের মক্কায় একত্র করলো। মসজিদুল হারামে ছায়ায় বসে একটি চুক্তি করা হলো। এই চুক্তি অনুযায়ী আফগান কমান্ডাররা নিজেদের ভিতর চলা যুদ্ধ শেষ করে দেবেন। আর বিপদজনক সোভিয়েত অস্ত্র ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু এটা হলো না। এর একটি কারণ ছিলো পশতুন ও তাজিকদের শতাব্দী পুরোনো শত্রুতা। পশতুন ও তাজিকদের মধ্যে যে লড়াই চলছিলো এর মধ্যে দুটি পক্ষ প্রধান ছিলো। তাজিকদের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানের কথিত রাষ্ট্রপতি বোরহান উদ্দিন রব্বানী এবং তাঁর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আহমাদ শাহ মাসুদ। পশতুনদের পক্ষ থেকে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। আরও একজন উজবেক কমান্ডার আব্দুর রশিদ দোস্তাম ছিলো। যে তাঁর ২০ হাজার যোদ্ধাসহ মাজার শরীফে ছিলো। যে আফগান জিহাদের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ছিলো। সে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখে নিজে তাঁর দল হিজবে এ ইসলামির সাথে যোগ দেয়। জালালেবাদে হাজী কাদির এর শাসন ছিলো। হেরাতে জেনারেল ইসমাইল এবং কান্দাহারে গুল আগার শাসন ছিলো। এরা কেউ কোন কেন্দ্রীয় সরকারকে মানতো না৷ আর প্রত্যেকেরই পুরো আফগানিস্তান শাসন করার দাবি ছিলো। এদের সকলের সাথে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের আফগান জিহাদের সময় থেকে যোগাযোগ ছিলো।
তবে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সাথে সবচেয়ে গভীর সম্পর্ক ছিলো। এর দুটি কারণ ছিলো। প্রথমত বিগত ৩০০ বছর যাবৎ আফগানিস্তানকে পশতুনরা শাসন করেছে। আর আফগানিস্তানে পশতুনরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের অধিকাংশ বাসিন্দাও পশতুন। ১৯৯৪ সালে রশিদ দোস্তাম এবং গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার কাবুল অবরোধ করেন। কাবুলের ভিতর বোরহান উদ্দিন রব্বানী এবং আহমাদ শাহ মাসুদ ছিলো। উভয় পক্ষ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রকেট ও বোমা হামলা চালানো হয়। যাতে হাজারো বেসামরিক নাগরিক ও উভয় পক্ষের যোদ্ধা নিহত হয়। তাও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও রশিদ দোস্তাম কাবুল জয় করতে পারে নি। ফলাফল দাঁড়ালো তাদের জোট ব্যর্থ। ফলে তাদের পিছু হটতে হলো। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আফগানিস্তানে টিকতে পারে নি। তাই তিনি তেহরানে আশ্রয় নেন। অন্যদিকে বিজয়ী বোরহান উদ্দিন রব্বানী এবং আহমাদ শাহ মাসুদ ভারত ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন শুরু করলো। যা পাকিস্তানের জন্য নয়া চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করলো। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান ত্যাগের পর আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠে কারণ ৩০ লক্ষ আফগান শরনার্থী তখনই আফগানিস্তান ফিরে যেতে পারতো যখন আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের পরাজয় ও আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ এ প্রক্রিয়ায় বাঁধার সৃষ্টি করছিলো। যা সৌদি আরবকেও হতাশ করেছিলো। আর এই হতাশা একটি অঘটন ঘটার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেলো। কান্দাহারে এক মাদরাসার ছাত্রীকে একজন স্থানীয় কমান্ডার ধর্ষন করে হত্যা করে। এরকম ঘটনা কন্যা শিশুদেরও সাথেও ঘটতে লাগলো। আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে। তবে কান্দাহারের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো।
কান্দাহার থেকে অনেক ছাত্র বেলুচিস্তানে মাওলানা ফজলুর রহমানের মাদরাসায় পড়াশোনা করতো। আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত থাকতো। এই মাদরাসার পড়ুয়ারা অপরিচিত ও চারবার সোভিয়েত ইউনিয়নের গুলি খেয়ে আহত হওয়া ৩৯ বছরের এক ব্যক্তিকে নিজেদের প্রধান নির্বাচিত করে। এই মাদরাসা পড়ুয়ারা নিজেদের তালেবান বলতো। আর তাদের এই প্রধানের নাম ছিলো মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। তালেবান ও মোল্লা মোহাম্মদ ওমর সেই কমান্ডার যে শিশুদের ধর্ষণ করতো তাঁর নিরাপত্তা সঙ্গীকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসে। আর সেই কমান্ডারকে হত্যা করে। সেই কমান্ডারের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি অস্ত্রের বিশাল মজুদ ছিলো যা তালেবান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। সেই কমান্ডারের নিরাপত্তা রক্ষী ও অস্ত্র পাওয়ার ফলে তালেবানের শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়। কান্দাহারে তালেবানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা চুক্তি করে যে, তারা নিরাপত্তার বদলে তালেবানকে অর্থ দেবে। এবার তালেবানের কাছে অর্থ, অস্ত্র ও সুনাম ছিলো। এ নিয়ে তালেবান এগিয়ে চলে। কান্দাহারে কয়েক কিলোমিটার পর পর এক কমান্ডার ছিলো। যারা সেখানকার মানুষদের থেকে চাঁদা আদায় করতো। তালেবান এসব এলাকা দখল করতে করতে এগিয়ে চলে। এর ফলে আফগানিস্তানের দক্ষিণ অংশে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তখন পাকিস্তানে ছিলেন। হামিদ কারজাই তাঁর এক ইন্টারভিউতে আহমেদ রশিদকে বলেন –
“শুরুতে তালেবানরা ভালো মানুষ ছিলো। তারা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছিলো। আমি নিজে তাদেকে ৫০ হাজার ডলার ও আফগান জিহাদের সময়কার অস্ত্র দিয়ে ছিলাম।”
তখনো মোল্লা ওমর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইের সাথে যোগাযোগ করে নি। বহিঃবিশ্বের জন্য মোল্লা ওমর ও তালেবান অপরিচিত ছিলো। তারপর এমন একটি ঘটনা ঘটলো। যার ফলে পাকিস্তানের তালেবানকে দরকার পড়লো। আর তালেবানের পাকিস্তানকে। কী ছিলো সেই ঘটনা?
পাকিস্তান সরকার মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতে চাইছিলো। যা আফগানিস্তানের রাস্তা দিয়ে হতো। পাকিস্তান তুর্কীমেনিস্তান থেকে তেল, গ্যাস ও তুলা আমদানি করতে চাচ্ছিলো। যা আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পৌঁছাবে। কিন্তু আফগানিস্তানে তো বিভিন্ন কমান্ডারের শাসন ও গৃহযুদ্ধ চলছে। তাও পাকিস্তান রাস্তা কতটা সুরক্ষিত তা পরীক্ষা করার জন্য তুর্কীমেনিস্তান থেকে পণ্যের প্রথম চালান অর্ডার করে। এই অর্ডার ছিলো তুলার। তুলা ভর্তি ৩০ টি ট্রাক তুর্কীমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। কিন্তু সেটাই হলো যার ভয় ছিলো। আফগানিস্তানে প্রবেশের পর অজানা সশস্ত্র গোষ্ঠী ট্রাকগুলোকে আটকে দেয়। পাকিস্তানের এই সমস্যার সমাধান এক ব্যক্তির কাছে ছিলো। যে তৎকালীন সময়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির জোট সঙ্গী, পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এবং জমিয়েতে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি। এই ব্যক্তি ছিলো মাওলানা ফজলুর রহমান। মাওলানা ফজলুর রহমানের মাদরাসা বেলুচিস্তানে ছিলো। যেখানে তালেবানের সদস্যরা পড়াশোনা করতো। মাওলানা ফজলুর রহমান জানতেন তালেবান এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। মাওলানা ফজলুর রহমানে এই কথা পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরকে জানান। নাসিরুল্লাহ বাবর আইএসআই এর মাধ্যমে তালেবানের সাথে যোগাযোগ করেন। তালেবান ভাবলো পাকিস্তানকে সহায়তা করলে একটি শক্তিশালী বন্ধু পাওয়া যাবে। তাই তালেবান পাকিস্তানকে সাহায্য করতে রাজি হলো। তালেবান একটি কমান্ডো দল গঠন করে সেই কমান্ডারের অবস্থান জেনে নেয় যে, পাকিস্তানি ট্রাক আটকে রেখেছিলো। তারপর তালেবানের সাথে লড়াইয়ে সেই কমান্ডার মারা যায়। আর তালেবানের নিরাপত্তায় ট্রাক পাকিস্তান পৌঁছায়। এটাই পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে প্রথম যোগাযোগ ছিলো। এরপর থেকে তালেবানের কাছে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সহায়তা আসতে শুরু করে।
সৌদি আরব আল কায়েদাকে তালেবানের সাথে যোগ দেওয়া থেকে আটকায় নি। এর ফলে তালেবান আল কায়দার অর্থ ও পাকিস্তানের সমর্থন লাভ করে। তালেবান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। তালেবান ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে কান্দাহার পরিপূর্ণভাবে দখল করে নেয়। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তালেবান তুর্কীমেনিস্তান সীমান্তের কাছের প্রদেশ হেরাত দখল করে নেয়। এরপর ১৯৯৬ সালে বেনজির ভুট্টোর শাসনামলেই তালেবান কাবুলে হামলা করে। এবার আহমাদ শাহ মাসুদ ও বোরহান উদ্দিন রব্বানীর যোদ্ধারা যুদ্ধে সফল হতে পারে নি৷ ফলে আহমাদ শাহ মাসুদের দল উত্তর দিকে পলায়ন করে। আর তালেবান কাবুলে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করে। তালেবান কাবুল জয় করার পর সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে গ্রেফতার করে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়। আহমাদ শাহ মাসুদের মত কিংবদন্তী গেরিলা কমান্ডার যাকে বিদেশী শক্তিও সমর্থন দিতো সে কেন তালেবানের কাছে হেরে গেল এবং কীভাবে তালেবান এত শক্তিশালী হয়ে উঠলো? এর দুটি কারণ ছিলো। প্রথমত তালেবানের অধিকাংশ সদস্য পশতুন ছিলো। আর পশতুনরা পশতুনদেরই শাসক বানাতে পছন্দ করে। দ্বিতীয় কারণ ছিলো শুধু পাকিস্তান ও সৌদি আরবই নয় আমেরিকাও তালেবানকে সমর্থন দিতো। আমেরিকার সমর্থনের কারণ ছিলো ব্যবসা। তুর্কীমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি পাইপলাইন প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছিলো। যার ঠিকাদারি পেয়ে ছিলো [Union Oil Company Of California -Unocal] নামক এক আমেরিকান কোম্পানি। এটি শুধু একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ছিলো না। এই প্রতিষ্ঠান আরও অনেক কাজ করতো। এই প্রতিষ্ঠানে আমেরিকার সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার অনেক লোক কাজ করতো। আর হয়তো এখনো করে।
এই কোম্পানি তালেবানের কাবুল জয়ের পূর্বে কান্দাহারে নিজেদের কার্যালয় নির্মাণ করে। যা কান্দাহারে ওসামা বিন লাদেনের কার্যালয়ের সামনে ছিলো। আহমাদ শাহ মাসুদ একবার এক নারী সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় বলেছিলেন আমেরিকার তেল কোম্পানি তালেবানকে অর্থ সহায়তা দেয়। ১৯৯০ এর দশকে যখন এই পাইপলাইনের কাজ চলছিলো তখন পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন রবিট অকলে। যিনি অবসর নেওয়ার পর এই তেল কোম্পানির পরামর্শক হন। পরবর্তীতে আল কায়দার কারণে আমেরিকা ও তালেবানের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে এই তেল পাইপলাইনের কাজ আর অগ্রসর হয় নি। ৯/১১ বা নাইন এলেবেনের পর তালেবান সরকারের পতনের পর ইউনিকোল কোম্পানির মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান পরামর্শককে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। যার নাম হামিদ কারজাই। আপনারা বলতে পারেন এটা কাকতালীয় ছিলো। কিংবা বলতে পারেন এই পুরো ব্যাপারটাই ব্যবসা ছিলো।
১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। সৌদি গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কী বিন ফয়সাল একটি জরুরী কাজে কান্দাহার গিয়েছিলেন। কান্দাহারে তাঁর সাথে মোল্লা ওমরের বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো। যেখানে মোল্লা ওমরের কাছে একটি দাবি করতেন। প্রিন্স তুর্কীর বিশ্বাস ছিলো তালেবানকে সৌদি আরব যত সাহায্য করেছে তাঁর কথা স্মরণ করে মোল্লা ওমর তাকে না বলবেন না। সেই সাহায্য কী ছিলো? সৌদি আরব তালেবানকে অনেক রকম সাহায্য করেছিলো। এর মধ্যে একটি হলো ১৯৯৬ সালে যখন তালেবান কাবুল আক্রমণ করে তখন প্রিন্স তুর্কী তালেবানকে ৪০০ টি পিকআপ ট্রাক দিয়েছিলেন। এছাড়া সৌদি সরকারের তরফ থেকে অর্থ সহায়তাও। সৌদি সহায়তা পাওয়ার পরই তালেবান কাবুল জয় করতে সক্ষম হয়। এছাড়া সৌদি আরবই পৃথিবীর সকল দেশকে তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলো। সৌদি আরবের আলেমরা তালেবানের সমর্থনে বক্তৃতা দিতো। জনগণ তালেবানের জন্য চাঁদাও দিতো। কিন্তু এসব কিছু সৌদি আরব বিনামূল্যে কিংবা নিস্বার্থভাবে করছিলো না। সৌদি আরবের এসব সাহায্যের বিনিময়ে তালেবান বোরহান উদ্দিন রব্বানী ও আহমাদ শাহ মাসুদের মতো ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের আফগানিস্তানের এক ছোট অংশে আটকে রাখে। আর পুরো আফগানিস্তান থেকে ইরানের প্রভাব শেষ করে দেয়। তখন আফগানিস্তানে সৌদি আরবের জোট সঙ্গী তালেবানের প্রভাব ছিলো। এ ব্যাপারে সৌদি আরব তালেবানকে সাহায্য করেছিলো। তাই তালেবানও সৌদি আরবকে সাহায্য করছিলো। আর এই সাহায্যটা ছিলো মুসলিম বিশ্বের শীতল যুদ্ধের অংশ। এই অনুগ্রহ বা সাহায্যের কথা ও নিজের হাতে থাকা এক ব্রিফকেসের ভরসায় প্রিন্স তুর্কী মোল্লা ওমরের সাথে বৈঠক করতে রওনা হন।
সৌদি আরবের অনুগ্রহের চাইতে প্রিন্স তুর্কীর তাঁর ব্রিফকেসের ওপর বেশী ভরসা ছিলো। তাঁর ব্রিফকেসে কিছু প্রমাণ ছিলো ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়দার বিরুদ্ধে। ওসামা বিন লাদেন তখন মোল্লা ওমরের আশ্রয়ে আফগানিস্তানে ছিলেন। প্রমাণ ছিলো আল কায়দা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে তানজানিয়া ও কেনিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে হামলা করেছিলো। প্রিন্স তুর্কীর বিশ্বাস ছিলো মোল্লা ওমর এই প্রমাণগুলো অস্বীকার করতে পারবেন না। দূতাবাসে হামলার ঘটনা ১৯৯৮ সালের ৭ ই আগষ্ট সংঘটিত হয়। সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা। কেনিয়া ও তানজানিয়ায় বারুদের বিস্ফোরণে আমেরিকার দূতাবাস কেঁপে উঠে। দুটি বারুদ ভর্তি ট্রাক দূতাবাসে আঘাত করে। দুটি দূতাবাসই ধংস হয়ে যায়। কেনিয়ায় কয়েক তলা উঁচু আমেরিকার দূতাবাস ধংস হয়ে যায়। কেনিয়ায় এই ঘটনায় ২০০ জন এবং তানজানিয়ায় ১১ জন নিহত হয়। আমেরিকা এই হামলার জন্য আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দ্বায়ী করে। তখন পৃথিবীর মানুষ সর্বপ্রথমবার জানতে পারে যে, ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার শত্রু। আমেরিকার তদন্ত সংস্থা এফবিআই ওসামা বিন লাদেনের নাম পৃথিবীর সবচেয়ে অনুসন্ধিত অপরাধীর তালিকায় যুক্ত করে। কিন্তু প্রশ্ন ছিলো ওসামা বিন লাদেন কোথায়? আমেরিকা খুব ভালো করে জানতো ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে তালেবানের আশ্রয়ে রয়েছে। তখন তালেবান মাজার ই শরীফ দখল করে প্রায় পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। আর মোল্লা ওমর ইসলামি আমিরাতে আফগানিস্তানের আমিরুল মুমিনুন ছিলেন। তো আমেরিকা আফগানিস্তানের আমিরুক মুমিনুনকে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে হস্তান্তর করতে বলে৷
তালেবানের পর আমেরিকার পাকিস্তানের সাহায্য দরকার ছিলো। কারণ তানজানিয়া ও কেনিয়ার হামলায় জড়িতরা পাকিস্তান ও ইরানের পথে আফগানিস্তান পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলো। এরকম এক ব্যক্তিকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আটক করে। এই ব্যক্তি সৌদি আরবের নাগরিক সাদিক হাবেদা ছিলো। পাকিস্তান এই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কেনিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। কারণ হামলা কেনিয়ায় করা হয়েছিলো। কিন্তু মোল্লা ওমর আমেরিকার দাবি মানতে অস্বীকার করেন৷ প্রথমে মোল্লা ওমর বলেন কেনিয়া ও তানজানিয়ায় হামলার ঘটনায় ওসামা বিন লাদেনের জড়িত থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু পাকিস্তান, সৌদি আরব ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ওসামা বিন লাদেনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। এছাড়া যেহতু পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা সাদিক হাবেদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। তাই পাকিস্তান এমন কিছু জানতো যা মোল্লা ওমর জানতো না। আমেরিকা মোল্লা ওমরের ওপরের চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি পাকিস্তান ও সৌদি আরবের ওপরও চাপ প্রয়োগ করে ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতার করার জন্য। আমেরিকা মোল্লা ওমরকে প্রস্তাব দেয় যে, যদি তালেবান ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে হস্তান্তর করে তাহলে আমেরিকা তালেবানের সরকারকে মেনে নিবে। পাকিস্তান ও সৌদি আরব মোল্লা ওমরকে এ ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করলেও মোল্লা ওমর তা প্রত্যাখান করেন। ইসলামি আমিরাতে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে হস্তান্তর করার কোন প্রশ্নই উঠে না। তালেবানের ওপর চাপ আরও বাড়লে ইসলামি আমিরাতে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে বলে আমরা কোরবান হয়ে যাবো। তাও ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে হস্তান্তর করবো না।
এর মাধ্যমে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকাকে এ বার্তা দিচ্ছিলো যে, আমেরিকা যেন ভুলেও আফগানিস্তানে হামলা না করে। যদি তা করে আমরা দেখে নিবো। তালেবানের সরকার প্রতিষ্ঠার তখন মাত্র ২ বছরই হয়েছিলো। আর এটা তাদের প্রথম ভুল ছিলো। তারা আমেরিকার প্রতিক্রিয়ার সঠিক অনুমান করতে পারে নি৷ ফলে সৌদি আরব আফগানিস্তানে সৌদি দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। আর আমেরিকা পাকিস্তানকে বিপদজনক দেশের তালিকায় যুক্ত করে তাঁর নাগরিকদের পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ৬০০ আমেরিকান কুটনৈতিক পাকিস্তান ছেড়ে যায় ১ দিনের মধ্যে। এটা পাকিস্তানের জন্য এক অদ্ভুত পরিস্থিতি ছিলো। যেখানে আমেরিকা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে সেখানে আমেরিকা কেন পাকিস্তানকে বিপদে ফেলছে? পাকিস্তান এই কেনর উত্তর জানতো। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এই কেন এর উত্তর বুঝতে পারছিলেন আর বোঝাচ্ছিলেনও। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভাবছিলেন আমেরিকা খুব শীঘ্রই পাকিস্তানের ওপর দিয়ে আফগানিস্তানে হামলা করবে। তাই তাঁর নাগরিকদের পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে নওয়াজ শরীফ আমেরিকাকে বলছিলো পাকিস্তান ইতিমধ্যে আমেরিকাকে সাহায্য করছে এবং বিপদের মধ্যে আছে। তাই নতুন করে পাকিস্তানকে যেন কোন বিপদে না ফেলা হয়। নওয়াজ শরীফ বলেন আজ আপনারা যাদের সন্ত্রাসী বলছেন, তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র কিন্তু আপনারাই দিয়েছেন। আর একটি তথ্য মনে রাখা প্রয়োজন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ব্যর্থ প্রেমের জ্বালায় কাতর ছিলেন। আর এই সময়েই তিনি আফগানিস্তানে হামলার আদেশ দেন। ২০ আগষ্ট ১৯৯৮।
আরব সাগরে পাকিস্তানের সমুদ্রসীমা থেকে খানিকটা দূরে আমেরিকার জাহাজ ও সাবমেরিন সন্দেহজনক আচরণ শুরু করে। পাকিস্তানের নৌ বাহিনী এই সন্দেহজনক কার্যক্রম শনাক্ত করে পাকিস্তানের সরকারকে জানিয়ে দেয়। আমেরিকা আফগানিস্তানের খোস্তে একটি ট্রেনিং ক্যাম্পে হামলা করতে চাচ্ছিলো। যার জন্য মিসাইলগুলোকে পাকিস্তানের আকাশসীমার উপর দিয়ে যেতে হতো। আর আমেরিকা জানতো যে, পাকিস্তান তাঁর ইচ্ছার কথা জেনে গেছে। তাও আমেরিকা তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী আফগানিস্তান ও সুদানে হামলা করে। মিসাইল ছুড়ার পর আমেরিকার তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই মিসাইলগুলো আমেরিকার। আর এই মিসাইলগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নয়। আফগানিস্তানে হামলা করা হয় আরব সাগর থেকে। সুদানে হামলা করা হয় লোহিত সাগর থেকে। এই হামলা টমাহক (Tomahawk Cruise Missile) ক্রুজ মিসাইল দিয়ে করা হয়েছিলো। কিন্তু এই হামলা একটি ব্যর্থ হামলা ছিলো। খোস্তে থাকা আল বদর ট্রেনিং ক্যাম্পে ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর কোন কমান্ডার তো দূরের কথা তালেবানেরও কোন সদস্য নিহত হয় নি। এছাড়া আমেরিকান জেনারেল জেনির বক্তব্য অনুযায়ী টমাহক মিসাইল তখন পুরোপুরি নির্ভুলভাবে নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম ছিলো না। তাই কিছু মিসাইল পাকিস্তানের সীমানার ভিতর পড়ে। আর পাকিস্তান সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ক্রুজ মিসাইল এর টেকনোলজি তৎকালীন পৃথিবীর অত্যন্ত আধুনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি ছিলো। যা পাকিস্তানের কাছে ছিলো না। তাই পাকিস্তান সেটাই করলো যা করা উচিত। পাকিস্তান ক্রুজ মিসাইল বানানোর কাজ শুরু করলো। আমেরিকা অনেক চেষ্টা করলো পাকিস্তান থেকে মিসাইল ফিরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু আমেরিকা তা ফিরিয়ে নিতে পারলো না। উল্টো পাকিস্তান আমেরিকার এ ধরনের কাজের প্রতিবাদ করলো।
আমেরিকার মিসাইল হামলার দ্বিতীয়ত লাভ হয়েছিলো আল কায়দার। আমেরিকার মিসাইল হামলার পর আগুনের মতো ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়দার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো। অগণিত পিতামাতা তাদের সন্তানের নাম ওসামা রাখতে শুরু করলো। আফ্রিকার শিশুরা ওসামা বিন লাদেনের ছবিযুক্ত টি শার্ট পরা শুরু করলো। বলা হয় এটাই সেই সময় ছিলো যখন আল কায়দা আমেরিকায় হামলার পরিকল্পনা করছিলো। সত্য অন্য কিছুও হতে পারে। তবে তৎকালীন সময়ের অবস্থায় তাই মনে হচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ আফগানিস্তান ও সুদানের ওপর হামলাকে স্বাধীনদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আখ্যা দেন এবং এর নিন্দা করেন। পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্গন করায় প্রতিবাদও করেন। পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার কথা বললো। আর চলেও গেল। রাশিয়া ও সকল মুসলিম দেশ আমেরিকার এই পদক্ষেপের সমালোচনা করলো। এবার বিল ক্লিনটনকে ক্ষমা চাইতেই হলো। বিল ক্লিনটম ফোন করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের কাছে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা চাইলো। এরপর এই উত্তেজান বেশিদূর যায় নি। টমাহক মিসাইল পাকিস্তান আছড়ে পড়ার ৭ বছর পর পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র বহনের সক্ষম ক্রুজ মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালায়। যার নাম বাবর-১। এছাড়া ২০১১ সালে যখন আমেরিকা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার জন্য অত্যাধুনিক স্টেলথ হেলিকপ্টার নিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে তখন একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়। যা আমেরিকা পাকিস্তানের কাছ থেকে ফেরত নিতে চেয়েও পারে নি। পূর্বেই বলেছি বিল ক্লিনটন ১৯৯৮ সালের আগষ্ট মাসে ব্যর্থ প্রেমের ব্যাথায় জর্জরিত ছিলেন। তাই আমেরিকার দূতাবাসে হামলার এক অন্য কারণ ও দৃশ্যপটও বর্ণিত আছে। ১৯৯৮ সালের ৭ ই আগষ্ট যখন কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে হামলা হচ্ছিল তখন বিল ক্লিনটনের গার্ল ফ্রেন্ড মনিকা তাঁর বয়ান রেকর্ড করাচ্ছিল।
এছাড়া সুদান ও আফগানিস্তানে হামলার দুই দিন পূর্বে বিল ক্লিনটন তাঁর ব্যর্থ প্রেমের কথা স্বীকার ক্ষমা চান। বলা হয়ে থাকে বিল ক্লিনটন নিজের ব্যর্থ প্রেম ঢাকতে ও পেন্টাগনের সমর্থনের জন্য তাড়াহুড়ো করে এই হামলার আদেশ দেন। হতে পারে এটা মিথ্যা কিংবা হতে পারে এটাই সত্যি। যাই হোক এই ঘটনা বিল ক্লিনটনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ধংসাত্নক প্রভাব বিস্তার করে। মিসাইল হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর আমেরিকা সৌদি আরবকে বলে যাতে তালেবান ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে হস্তান্তর করে কিংবা আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়। চমকপ্রদ তথ্য হলো আমেরিকার দূতাবাসে হামলার কিছুদিন পূর্বে প্রিন্স তুর্কীকে মোল্লা ওমর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সৌদি আরব চাইলে ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেবেন৷ এই প্রতিশ্রুতি ও পূর্বের অনুগ্রহের কারণে প্রিন্স তুর্কী মোল্লা ওমরের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে যেন আফগানিস্তান থেকে বের করে দেওয়া তাঁর দাবি জানাতে আসেন। কিন্তু প্রিন্স তুর্কীর জন্য সেই বৈঠকে একটি চমক অপেক্ষা করছিলো। প্রিন্স তুর্কীর মতে, মোল্লা ওমর এ ধরনের প্রতিশ্রুতির কথা অস্বীকার করেন এবং বলেন ওসামা বিন লাদেনের মতো মুজাহিদকে আমি কী করে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেবো? প্রিন্স তুর্কীর মতে, মোল্লা ওমর আরও বলেন সৌদি সরকার কেন পৃথিবীকে কাফেরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য কাজ করছে না? এসব অনেক শক্ত কথা ও অভিযোগ ছিলো। প্রিন্স তুর্কী ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করেন। মোল্লা ওমর সেগুলো মানতে অস্বীকার করে বলেন এগুলোতে শত্রুর দেওয়া জিনিস। আমি এগুলো বিশ্বাস করি না। এরপর প্রিন্স তুর্কী রাগ্বানিত হয়ে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে যান।
এরপর সৌদি আরব তালেবানের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে দিলেও তালেবানের অর্থ সহায়তা বন্ধ করে নি। কারণ যদি সৌদি আরব তা করতো তাহলে ইরান সমর্থিত নর্দান এলায়েন্স তালেবানের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতো। আর আফগানিস্তানে ইরানের প্রভাব বেড়ে যেতো। এছাড়া সৌদি আরব ওসামা বিন লাদেনের ব্যাপারে তালেবানকে চাপ প্রয়োগও বন্ধ করে দেয়। এটি সৌদি আরবের এমন একটি ভুল ছিলো যার মাসুল মুসলিম বিশ্ব আজও দিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবের এই ভুলই নাইন এলিভেনের ঘটনাকে জন্ম দেয়।
[জান্নাত খাতুন]
তথ্যসূত্রঃ
- Pakistani News Paper Of August 1998. Our Target Was Terror – Newsweek, August 30, 1998. Boots On Ground – The 9/11, Commission Report. Pakistan Test Fires Its First Cruise, Missile – August 12, 2005. MISSILE THEATRE, Osama Bin Laden Raid: Pakistan Hints, China Wants a Peek at Secret, Helicopter – May 10, 2011 – abc news. Clinton Admits Lewinsky Liaison To Jury; Tells Nation It Was Wrong, But, Private – August 18, 1998 – The New, York Times. Washington Was About to Explode : The Clinton Scandal 20 Years Later. By Keating Holland – August 21, 1998 – CNN. The 9/11 Commission Report, Page – 121-122. Cold War in Islamic World By Dilip, Hiro. Page – 170.
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।