আমরা জানি, ১৯৪৭-র ১৫ আগষ্ট আমাদের অখন্ড ভারত দ্বি-খন্ডিত হয়েছিল। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, ক্ষমতার মােহে আর নিছক ধর্মের জিগির তুলে দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বাধিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করে পাকিস্তানের জন্ম দিলেন যাঁরা, তাদেরই কেউ হলেন ভারতের রূপকার, কেউবা হলেন পাকিস্তানের জনক। তবে দেশভাগের এই কলঙ্কিত ইতিহাসকে তুলে ধরতে কেউ হয়ত বলবেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ভেদনীতিই এর জন্য দায়ী। কেউ বা বলবেন মোহাম্মদ আলি জিন্না বা কংগ্রেস নেতারাই হলেন ভারত ভাগের নায়ক। কিন্তু বিষয়টি যে এত সরল নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রয়াত রাজনীতিবিদ রামমনােহর লােহিয়া ‘গিল্টিমেন অফ ইন্ডিয়াজ পার্টিশান’ গ্রন্থে দেশভাগের জন্য নানাবিধ কারণ ও ব্যক্তির উল্লেখ করেছিলেন। মুসলিম অনেক লেখক পাকিস্তান দাবি সঙ্গ ত বলে ভাষ্য দিয়েছেন তা যেমন আদৌ সমর্থনীয় নয়, তেমনি হিন্দু-ঘেঁষা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সব দোষ মুসলিম লীগ বা গােটা মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দিলে, তা হবে অন্যায় এবং ইতিহাস-বিরােধী কাজ। অথচ এমন কাজ হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু পুরনাে ইতিহাসে ফিরে তাকাতে হলে চাই খােলা মন, ঘটনাকে স্বীকার করার সৎসাহস, ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠা।
এ কথা সত্য যে, মোহাম্মদ আলি জিন্না কখনও এমনকি ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে তাঁর পাকিস্তান দাবির স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি। জনগণের কাছে অতি পরিচিত লাহাের প্রস্তাবেও দেশভাগের কথা উল্লেখ করা হয়নি। আসলে ‘পাকিস্তান’ ধারণার অস্পষ্টতাই এই স্লোগানকে অত্যধিক শক্তিশালী করে তােলে। বিভিন্ন লােকের কাছে এর অর্থ বিভিন্নভাবে প্রতীয়মান হয় এবং বলতে গেলে মোহাম্মদ আলি জিন্নার যত অনুসারী ছিল পাকিস্তান সম্পর্কে প্রায় ততগুলাে ধারণা সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে হিন্দু এবং নির্দিষ্টভাবে কংগ্রেস পার্টির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমানভাবে দুঃখ-কষ্টের তীব্র অনুভূতি প্রকাশে এই স্লোগান যেভাবে ব্যাপক মুসলিম জনগােষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে তেমনভাবে আর কিছু কখনও তেমনটি করতে পারেনি।
(১)
আয়েসা জালাল তাঁর গ্রন্থে (‘দ্য সােল স্পােকসম্যান মোহাম্মদ আলি জিন্না, দ্য মুসলিম লীগ অ্যান্ড দ্য ডিমান্ড ফর পাকিস্তান’) যেমনটি মনে করেন, মোহাম্মদ আলি জিন্নার কাছে ‘পাকিস্তান’-এর অর্থ হল, ভারত ফেডারেশনের মধ্যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে মুসলমানদের জন্য ব্যাপক মাত্রায় রাজনৈতিক ক্ষমতা। আর তাঁর অনুসারীদের কাছে এর অর্থ আরও অনেক বেশি। মোহাম্মদ আলি জিন্নার অনুসারী। অধিকাংশ মুসলমানের কাছে পাকিস্তান হল একটা ধর্মীয় আদর্শ—পাকিস্তান হচ্ছে একটি ‘দার-উল-ইসলাম’-এর স্বপ্ন, একটি প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ভূমি, যেখানে ইসলাম তার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে বিকশিত হবে। এটা ছিল একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক স্লোগান—এর অঙ্গীকার ছিল ভারতে সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে অধঃস্তন অবস্থান থেকে মুসলমানদের মুক্তি। মোহাম্মদ আলি জিন্নার উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর রাজনীতি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একটা শক্তিশালী ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত জাতীয়তাবােধের চেতনা জাগ্রত করে তারা এমন এক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয় যা আবশ্যিকভাবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ, ঘৃণা ও উগ্রতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। যদি মোহাম্মদ আলি জিন্না নিজে সত্যিকারভাবে পাকিস্তান নাও চান, তাঁর অনুসারীরা চেয়েছিল এবং তিনি তাদেরকে শুধু পাকিস্তান দাবি করতেই উদ্বুদ্ধ করেননি, প্রয়ােজন হলে তার জন্যে লড়াই করতে বলেছিলেন।
জালালের গবেষণায় আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট এসব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়নি। এই অবহেলা তাঁর শক্তিশালী যুক্তির পরিধি সংকুচিত করেছে। রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের প্রতি অতি মাত্রায় মনােযােগ দেওয়ার কারণে তাঁর বিশ্লেষণে সুনির্দিষ্টভাবে এ প্ররে উত্তর পাওয়া যায় না—কে দেশবিভাগ চেয়েছে এবং কেন? এই প্রোপটে ঐ গবেষণা হয়ে পড়েছে দেশ-বিভাগের ওপর অধিকাংশ গতানুগতিক গবেষণা কাজের মতাে—যাতে আলােকপাত করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ে রাজনীতির বিষয়-আশয় এবং কতিপয় রাজনৈতিক নেতার মধ্যে কে কী জন্য দায়ী, তাদের প্রশংসা অথবা নিন্দা, যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময় ত্রিপক্ষীয় আলােচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছেন।১
শ্রীমতী জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড হিন্দু কমিউনালিজম্ অ্যান্ড পার্টিশান’ ১৯৩২-১৯৪৭’ গ্রন্থে দেশবিভাগের কাহিনীতে অন্য এক মাত্রা যােগ করা হয়েছে বাংলাদেশের জনগােষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ও সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে। এখানে বিশেষভাবে দেখানাে হয়েছে ১৯৪৭ এর পরিণতির ব্যাপারে বাঙালি হিন্দুদের ভূমিকা এবং সেই সব বিভিন্ন দল ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গ্রুপকে চিহিত করার চেষ্টা যারা প্রদেশের বিভক্ত চেয়েছিল। এটি করার ফলে হয়তাে দেশ-বিভাগ সম্পর্কে গবেষণায় শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিক ও মুসলিম রাজনীতি সম্পর্কে বিদ্যমান পক্ষ পাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে শুধরে নিতে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, ভারতীয় মুসলমানদের সকলে কিন্তু পাকিস্তানের দাবিতে গলা মেলাননি। মুশিরুল হাসান একটি গ্রন্থে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তানের উদ্ভব সম্পর্কে বলেছেন, সামান্য কয়েকজন লােক মিলে এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানের ভাগ্য নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলল, বিধের ইতিহাসে এর নজির নেই।২ তাছাড়া, গান্ধী নিজে যা-ই চেয়ে থাকুন, কংগ্রেসের একটা বড় অংশ সাতচল্লিশে দেশ ভাগ চেয়েছিল। হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাে হিন্দুদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশভাগের পক্ষে প্রবল সওয়াল করে যাচ্ছিল। এ সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য মিলবে পার্থসারথি গুপ্ত সম্পাদিত ‘টু ওয়ার্ডস ফ্রিডম’? ‘ডকুমেন্টস অন দি মুভমেন্ট ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স ইন ইন্ডিয়া ১৯৪৩-৪৪’ গ্রন্থে (তিন খন্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)। ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধান পরিষদ স্বাধীনতা আন্দোলনের নথিপত্র প্রকাশের যে উদ্যোগ নেয়, তার অনেকটাই ছিল কথার ফুলঝুরি। এরই মধ্যে শ্রীগুপ্ত, অশক্তি দেহে তার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। এ নিষ্ঠা বিরল বলেই শ্রদ্ধার্থ। এর তৃতীয় খন্ডে হিন্দু এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংগঠন সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি একত্রিত হয়েছে। বাংলার গােয়েন্দা বিভাগের নথিতেও দেখা যায়, ১৯৪৪ এর গােড়ায় সংঘ বাংলার নানা জেলায় গােপনে কাজ চালাচ্ছিল। ৪৭-এর প্রেক্ষিতে এসব তথ্য দেখলে দেশভাগের একপেশে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা বর্জন করা যায়।
লক্ষণীয় যে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আগা খান ও ঢাকার নবাব ভিখার-উল মুলুক। পরে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহােরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে ঘােষণা করা হয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় প্রদেশগুলিকে নিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ‘পাকিস্তান’ গঠনের দাবি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়াস মুসলিম লীগ গঠনের অনেক পরেই হয়েছিল। আর মুসলিম লীগও মোহাম্মদ আলি জিন্নার উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম সভাপতি হয়েছিলেন আগা খান। অবশ্য ঐ সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন না। পরে আগা খান ঠাট্টা করে বলেছিলেন “ঐ সময়ে লিগের সবচাইতে বিরােধী নেতা ছিলেন মুহাম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না। আমি এবং আমার বন্ধুরা যে কাজ করেছি, উনি তার বিরােধিতা করেছেন …তিনিই একমাত্র মুসলমান যিনি লীগের বিরােধী ছিলেন। কারণ মোহাম্মদ আলি জিন্না বিধাস করতেন, স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী দেশের পথে ক্ষতিকর হবে…।”৩
(২)
মোহাম্মদ আলি জিন্নার ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা বরাবরই ছিল অসাম্প্রদায়িক। পাশ্চাত্ত্য আদবকায়দায় লালিত। কখনও নামাজ পড়তেন না। গোঁড়া মুসলিমদের অপছন্দ করতেন। পাশ্চাত্ত্য ধারায় জীবন কাটাতেন। ছিলেন হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের দূত, প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী এক সাহসী ও চতুর ভারতীয়। ১৯২৪ সালে দিল্লীতে একবার মোহাম্মদ আলি জিন্না সাহেব কথা প্রসঙ্গে স্যার তেজবাহাদুর সাপ্লুকে এ মর্মে বলেছিলেন যে, হিন্দু গোঁড়া পুরােহিত শ্ৰেণীকে উৎখাত এবং গোঁড়া মােল্লাদের ধ্বংস করতে পারলে হিন্দু-মুসলিম মিলন সম্ভব।
এমনকি ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দেও মোহাম্মদ আলি জিন্না কট্টর ইসলাম অনুসারীদের কী পরিমাণ বিরােধী ছিলেন তার বিবরণ এক গ্রন্থে৪ পাওয়া গেছে। প্রবীণ লীগনেতা ও ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের মন্ত্রী এম.এ. হারুণ জানান যে ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে একবার মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে যখন বলা হয় যে তিনি ইসলাম সম্বন্ধে বলার সময় শরীয়তের উল্লেখ করেন না বলে উলেমারা তাঁর সমালােচক, তখন মোহাম্মদ আলি জিন্না তীব্র মন্তব্য করেনঃ “কার শরীয়ৎ? হানিফীদের? হামবলীদের? শাআফিদের? মালিকীদের? জাফরীদের? আমি নিজেকে এর মধ্যে জড়াতে চাই না। এই ক্ষেত্রে পদার্পণ মাত্র উলেমারা নিজেদের বিশেষজ্ঞরূপে দাবি করে অগ্রণীর ভূমিকা নেবেন এবং আমি আদৌ চাই না যে ব্যাপারটা উলেমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হােক। তাদের সমালােচনার কথা আমি জানি। কিন্তু আমি তাঁদের ফাঁদে পা দিতে চাই না।”৫
মোহাম্মদ আলি জিন্না সেকালের মুসলমান সমাজের গোঁড়ামিকে অগ্রাহ্য করে পর্দাবিহীন নিজ পত্নীকে সভা-সমিতি এবং এমনকি লাভবনেও নিয়ে যেতেন। মানসিক বিষাদ রােগে আক্রান্ত বেগম মোহাম্মদ আলি জিন্নার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ না হয়ে গেলে এবং অকালে তিনি পরলােকগমন। না করলে হয়তাে বা ভারতীয় মুসলমান নারীদের মধ্যে আধুনিকতা প্রবর্তনের নেত্রীও হতে পারতেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক বি শিবরাও শুনেছেন যে ১৯১৭ খ্রীঃ একদিন মোহাম্মদ আলি জিন্না ‘বােম্বে ক্রনিকাল’ দৈনিক পত্রিকার তদানীন্তন সম্পাদককে বলেছিলেন, “মুসলমানদের যে সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম তাঁরা দশাবতারে বিশ্বাসী এবং উত্তরাধিকার আইন ও সামাজিক প্রথার দিক থেকেও হিন্দুদের সঙ্গে তাঁদের বহুল সামঞ্জস্য আছে।”৬ আর এটা আদৌ অবিধাস্য নয়। কারণ বেশিরভাগ ভারতীয় মুসলিম হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বলে হিন্দু সমাজের রীতিনীতি, চালচলন ও প্রথার রেশ তাদের মধ্যে থেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
একসময় মোহাম্মদ আলি জিন্না বােম্বাইয়ের মুসলিম আসনের জন্যে প্রার্থী ছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার বিরুদ্ধে স্বরাজ পার্টি তাদের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। নির্বাচনের সময় একদিন মোহাম্মদ আলি জিন্না এবং তার সহকারী চাগলা লাঞ্চ খেতে বেরুচ্ছিলেন, এমনি সময় রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্না (মোহাম্মদ আলি জিন্নার স্ত্রী) এক টিফিন বাস্কেটে করে স্বামীর জন্যে লাঞ্চ খাবার নিয়ে এলেন। রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্না তার স্বামীকে আদর করে ‘জে’ বলে সম্বােধন করতেন। ‘জে’ আজ তােমার জন্যে ভাল খাবার নিয়ে এসেছি …বলতাে কী এনেছি? রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্না জিজ্ঞেস করলেন। আমি কী করে বলব? মোহাম্মদ আলি জিন্না উদাস কণ্ঠেই জবাব দিলেন। রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্না এবার গলার স্বর উঁচু করে বললেন, তােমার জন্যে ‘হ্যাম সান্ডউইচ এনেছি।’ রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্নার মুখে হ্যাম সান্ডউইচের নাম শুনে মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, ‘তুমি কি করেছ জান? আমি মুসলিম এলাকা থেকে মুসলিম প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছি। আমার মুসলমান ভােটাররা যদি জানতে পারে আমি হ্যাম সান্ডউইচ খাই, তাহলে ওরা আমাকে একটি ভােটও দেবে না (ইসলাম ধর্মে হ্যাম অর্থাৎ শুয়ােরের মাংস খাওয়া নিষেধ। অথচ এটি ছিল মোহাম্মদ আলি জিন্নার প্রিয় খাবার)। মোহাম্মদ আলি জিন্নার এই জবাব শুনে রােটি মোহাম্মদ আলি জিন্নার মুখ কালাে হয়ে গেল। তিনি স্বামীর দিকে না তাকিয়ে টিফিন বাস্কেট নিয়ে ফিরে চলে গেলেন।৭
মোহাম্মদ আলি জিন্নার স্বজন-বন্ধু মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব তার “Some Memories’ গ্রন্থে৮ এ মর্মে ১৯২৫ সালের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, মোহাম্মদ আলি জিন্না মনে করতেন তিনি প্রথমে ভারতবাসী ও পরে মুসলমান। (অথচ ১৯২৫ সালেই গান্ধী লিখেছেন, তিনি প্রথমে হিন্দু, তারপর ভারতীয়। এ তথ্য সুপ্রকাশ রায়ের ‘গান্ধীবাদের স্বরূপ’ গ্রন্থে রয়েছে) গােলটেবিল বৈঠকগুলির পরে প্রকাশিত শ্বেতপত্রের প্রতিক্রিয়াতেও তিনি নিজের পরিচয় দিলেন এই বলে “I am an Indian first and Muslim afterward.”
১৯২৫ সালে মােতিলাল নেহরুর গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবের সমর্থনে শাসকদের উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ আলি জিন্না বলেনঃ
“ভারত এক জাতি নয়, এখন একথা আমাদের বলা হচ্ছে। যখন মহাযুদ্ধ চলছিল এবং ভারতবাসীকে রক্ত ও অর্থ দেবার আবেদন জানানাে হয়েছিল, তখন আমরা এক জাতি ছিলাম। …যখন আমরা দায়িত্বশীল সরকার, সংসদীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্তির দিকে যথােচিত পরিমাণে অগ্রসর হবার দাবি জানাচ্ছি তখন শুনতে পাচ্ছি যে আমরা এক জাতি অথবা এক রাষ্ট্র নই।”৯
অথচ ১৯২০ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন, যে বিষয়টা পরে বিস্তারিত উল্লেখিত হবে।
শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ এর ১১ আগস্টে পাকিস্তান পরিষদ কক্ষে তিনি যে বক্তৃতা দিয়ে ছিলেন তাতেও অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন,
“You are free to go to your temples, you are free to go to your mosques or any other place of worship in this state…you may belong to any relegion, caste or creed—that has nothing to do with the fundamental principle that we are all citizens and equal citizens of one state …”
আরও বললেন, “এমন একটা যুগ আসবে যখন হিন্দুরা নিজেদের হিন্দু ও মুসলমানেরা নিজেদের মুসলমান বলে ভুলতে শিখবেন। ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে নয় কারণ ওটা হলাে ব্যক্তিগত বিচার এবং ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং দেশের নাগরিক হিসেবে তারা বসবাস করবেন।”১০ মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রসঙ্গে তাঁর এক কালের প্রবল সমালােচক জওহরলালের ১৯৪৪-এ লিখিত অভিমত বিবেচ্য—“তিনি ছিলেন যােগ্য ও দুর্ধর্ষ। পদের প্রলােভন দ্বারা তাঁকে বশীভূত করা সম্ভব নয় যা কিনা এত জনের এত বড় দুর্বলতা।”১১ মোহাম্মদ আলি জিন্না সম্পর্কে আম্বেদকর বলেছিলেন, তিনি ছিলেন ‘দূর্নীতির ঊর্ধ্বে’।১২
(৩)
১৯১৫ সালে বােম্বাই-এর তাজমহল হােটেলে লিগের অধিবেশনে মোহাম্মদ আলি জিন্না বক্তৃতা দেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলেন যার কাজ হবে দেশের অন্য দলের সঙ্গে এক হয়ে এক ‘অখন্ড ভারতের’ উন্নতিসাধন করা। মুসলিম লিগ মোহাম্মদ আলি জিন্নার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং ৭১ জন সদস্যকে নিয়ে এই কাজ করবার জন্যে এক কমিটি গঠন করা হল।১৩ ১৯১৫-এ গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে এলেন। তাঁকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্যে গুজরাত সােসাইটি এক গার্ডেন পার্টি দিয়েছিল। মোহাম্মদ আলি জিন্না ছিলেন এই গুজরাত সােসাইটির সভাপতি। গান্ধীজি তার বক্তৃতায় এক গুজরাতি মুসলমানকে এই সমিতির সভাপতিত্ব করতে দেখে আনন্দ প্রকাশ করলেন।১৪ এর আগে কেউ কখনও এত সুস্পষ্টভাবে মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে ‘মুসলমান’ বলে অভিবাদন করেননি। মোহাম্মদ আলি জিন্না নিজেকে সব সময়েই সাহেব বলে মনে করতেন। অতএব গান্ধীজি যখন তাকে ‘মুসলমান’ বলে সম্বােধন করলেন তখন তিনি অপমানিত বােধ করলেন।১৫
ভি পি মেনন তার ‘Transfer of Power in India’ গ্রন্থে (ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫৭) তাঁকে অভিহিত করেছেন— “আমার প্রজন্মের যথার্থ নায়ক’ রূপে। গান্ধীর সঙ্গে তার মতান্তরের প্রাথমিক কারণ এই যে, তাঁর প্রতীতি জন্মেছিল যে, গান্ধী কংগ্রেসে ধর্মীয়তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে চাইছেন। ১৯২৪ এর মুসলিম লীগ অধিবেশনে মোহাম্মদ আলি জিন্না ঘােষণা করেছিলেন যে, তিনি চান, “মুসলিম সম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে, হিন্দুদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে নয়, মাতৃভূমির স্বার্থে তাদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হতে, সহযােগিতা করতে৷” একটি চমৎকার প্রবন্ধে১৬ মধু লিমায়ে লিখেছিলেন, “মোহাম্মদ আলি জিন্না ছিলেন এমন এক নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদী, যাঁর নিষ্ঠা যথার্থ অর্থেই অপরিমেয়।” ১৯১৯ এ পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটিতে সাক্ষদান কালে মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে রাজনৈতিক বৈষম্যের সম্পূর্ণ উৎখাত তার কাম্য কিনা ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “অবশ্যই সেদিন যদি সত্যিই আসে, আমি হব সবচেয়ে সুখী।” যখন তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখনও কিন্তু ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঝিলিক তার মাথায় খেলেনি। ১৯৩৪ সালে কেমব্রিজ বিধবিদ্যালয়ের ছাত্র রহমত আলি লন্ডনের ওয়ালডরফ হােটেলে নৈশভােজের আয়ােজন করেন। সেখানে নিমন্ত্রিত মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে অনুরােধ করা হয় পাকিস্তানের উদ্যোক্তা হতে। মোহাম্মদ আলি জিন্না বলেন ওটা একটা অবাস্তব স্বপ্ন। তিনি তার পক্ষপাতী নন। কিন্তু এই মোহাম্মদ আলি জিন্নাই হয়েছিলেন পাকিস্তানের মুখ্য কারিগর!
আন্তরিকভাবে মোহাম্মদ আলি জিন্না সব সময় চাইতেন, ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত এবং এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেন দেশের সব সম্প্রদায় সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। সর্বদলীয় অধিবেশনে লীগের তরফ থেকে ১৯২৭এর ডিসেম্বরে মোহাম্মদ আলি জিন্না একবার বলেছিলেন :
“আজ আমি আপনাদের কাছে একজন মুসলমান নাগরিক হিসাবে নয়, একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বলছি, আপনারা কি সামান্য কয়েকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেলেই সন্তুষ্ট হবেন? আপনারা কি চান না, মুসলিম ভারত আপনাদের সঙ্গে এগিয়ে যাক। সংখ্যালঘুদের কি সংখ্যাগরিষ্ঠদের দেবার মত কিছুই নেই? …আমরা সবাই এই দেশের সন্তান, অতএব আমাদের একসঙ্গে বসবাস করতে হবে, কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে যতই বিভেদ থাক না কেন, ঝগড়া বিবাদ বাড়িয়ে কোনও ফল হবে না। আমরা যদি এই বিষয়ে একমত না হতে পারি, অন্তত আমাদের মধ্যে যে পার্থক্য আছে এই কথাটি স্বীকার করতে না পারি, বন্ধু হিসাবে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। বিশ্বাস করুন, যতদিন ভারতের হিন্দু-মুসলমান এক না হবে, ততদিন দেশের কোনও উন্নতি হবে না।”১৭ মোহাম্মদ আলি জিন্নার বক্তৃতার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অংশ হল, ‘বন্ধু হিসাবে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই’—এই কথাটি বলার সময় তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল।১৮
তাছাড়া গার্ডিয়ান মেজরের পত্রগুলিকেও বিশ্লেষণ করে মোহাম্মদ আলি জিন্নার চিন্তাভাবনার অপ্রকাশিত দিকগুলি উন্মােচিত হতে পারে। বিশিষ্ট সাংবাদিক বি শিবরাও ‘India’s Freedom Movement’ গ্রন্থে মোহাম্মদ আলি জিন্নার ১৯১১-১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়কালীন রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন। শিবরাও লিখেছেন,
“… শ্ৰীমতী বেসান্ত ও অন্যান্য লিবারালরা যে কারণে গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনকে বিপজ্জনক মনে করতেন, মোহাম্মদ আলি জিন্নাও সেই কারণে তার বিরােধী ছিলেন। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর খিলাফৎ আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে তার মনে দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। অজ্ঞ ও ধর্মান্ধ মুসলমানদের আন্দোলনের সহকর্মী করাকে তিনি অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করতেন।”
এম. সি. চাগলা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, খিলাফতের মধ্য দিয়ে গান্ধীজি যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন তা সম্পূর্ণ ভুল। তা চোরাবালিতে বাড়ি বানানাে। যতদিন ধর্মীয় নিশানা টিকে ছিল ততদিন ঐ ঐক্যও টিকে ছিল। যে মুহূর্তে তা দূর হয়ে গেল সেই মুহূর্তে ঐক্যে ফাটল দেখা দিল। সমস্ত খিলাফত-প্রেমী যারা কংগ্রেসে যােগ দিয়েছিল সেই মুহূর্তে তারা তাদের আসল স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলল দেখা গেল, নিজস্ব ধর্মের প্রতি তাদের যত অনুরাগ স্বদেশের প্রতি তার কিছুই নেই।১৯ এমনকি, যে আলি-ভাইরা গান্ধীজির বিস্ত সহকর্মী রূপে ১৯২০-২১ সনে অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয়। ভূমিক গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাও তাঁদের ধর্মের আবর্তে ফিরে গেলেন, গান্ধীজির নেতৃত্ব অস্বীকার করলেন। ১৯৩০ সনে বােম্বাইতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনে মহম্মদ আলি ঘােষণা করেন, আমরা গান্ধীর সঙ্গে যােগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখান করি কারণ, তাঁর আন্দোলন ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন নয়, তাঁর আন্দোলন সাত কোটি মুসলমানকে হিন্দু মহাসভার গােলাম বানানাের আন্দোলন। তিনি গােলটেবিল বৈঠকের সদস্যদের নিকট ভাষণে বলেন, ইসলাম শুধু ভারতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বলেন,
“সম আয়তনের দুটি চক্রে আমার অবস্থান, কিন্তু চক্র দুটির কেন্দ্রবিন্দু এক নয়। একটি হলাে ভারতবর্ষ, অপরটি মুসলিম দুনিয়া। আমরা জাতীয়তাবাদী নই, আমরা জাতীয়তাবাদীর বাড়া সুপার-জাতীয়তাবাদী।”
অসহযােগ আন্দোলনের সময়েও তাঁরা তাঁদের প্যান-ইসলামিজমের প্রতি আনুগত্যের কথা প্রচার করতে দ্বিধা করেননি।২০
তার ওপর কংগ্রেসের মধ্যে রক্ষণশীল গােষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান শক্তিতে লীগ নেতারা ক্রমশ শঙ্কিত হচ্ছিলেন, এটা তাে ইতিহাস। বিশেষকরে ত্রিপুরি কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতির পদে জয়লাভ করার পরে রক্ষণশীল গােষ্ঠীর হাতে সুভাষচন্দ্রের দুর্দশা লীগ নেতাদের আশঙ্কাকে দৃঢ়মূল করল। গান্ধীজিকে নামে সেনাপতির সম্মান দিলেও কার্যনিবাহক সমিতি প্রকৃতপথে তাকে শিখন্ডী রূপেই ব্যবহার করেছে। আর গান্ধীজিও পুরাে বিষয়কে ব্যক্তিগত অভিমানের বিষয় করে সহজে কংগ্রেসের ভেতরের কায়েমী স্বার্থের হাতে নিজেকে ত্রীড়নক হতে দিয়েছেন।
ঘটনা এই যে, ‘ত্রিপুরি সমস্যা’ গান্ধীজির শুভেচ্ছা ও কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ঐতিহাসিককে সঙ্গত কারণেই সন্দিগ্ধ করে তােলে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়ােজন যে, ‘বেঙ্গল দি ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট ১৮৭৬১৯৪০’ গ্রন্থে গর্ডন এ লিওনার্ড সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস ত্যাগ ও ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যােগদান ঘটনা দুটির পিছনে তৎকালীন কংগ্রেসী রাজনীতির একই ক্রীড়াকৌশল দেখেছেন—নিরুপায় হয়ে একজন একনায়কতন্ত্রে আর অন্যজন ‘এক ধর্ম এক রাষ্ট্র’ মতবাদের শরণাপন্ন হয়েছেন। আর ‘Last years of British India’ গ্রন্থে মাইকেল এডওয়ার্ডস ত্রিপুরির পরবর্তী ঘটনাবলীর জন্য গান্ধীজিকেই দায়ী করে লিখেছেন,
“Gandhi now turned the technigue non-cooperation, not against the British, but against Congress’s own president. Bose was forced to resign.”
‘মডার্ন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, গান্ধীভক্ত যে কংগ্রেসী হাইকমান্ড সুভাষচন্দ্রকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল, সেই হাইকমান্ডের সঙ্গে বিড়লা প্রমুখ মাড়ােয়ারী বণিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আর সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের পরে যে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়, সেই রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সুতরাং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বহুলাংশে কংগ্রেসের অন্তর্গত প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান ও হিন্দু মহাসভার হিন্দুজাতিতত্ত্ব সম্মিলিত শক্তি মুসলিম প্রগতিশীল অংশকেও পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করেছিল।
তবে পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলি, এ হেন অসাম্প্রদায়িক মোহাম্মদ আলি জিন্না কেন পরবর্তীকালে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জালে নিজেকে জড়াতে গেলেন, আর কেনই বা একদা কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় যাঁর রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি, যিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেতাদের একজন ছিলেন, সেই মোহাম্মদ আলি জিন্না কংগ্রেসের ওপর বিধাস হারিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। এ প্ররে উত্তর পাওয়া যাবে যদি আমরা প্রকৃত সত্যকে আড়াল না করে কংগ্রেস ও তার নেতৃবর্গের কাজের প্রকৃত মূল্যায়ণ করতে পারি।
(৪)
মোহাম্মদ আলি জিন্না জাতিতে ছিলেন গুজরাটি। এক ইসমাইলিয়া খােজা মুসলমান পরিবারের সন্তান। তাছাড়া মোহাম্মদ আলি জিন্না এবং গান্ধী ছিলেন একই বংশের লােক। গঙ্গানারায়ণ চন্দ্রের ভাষায়ঃ
“মিঃ মহম্মদ আলী মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও শ্রীমােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর পিতামহ ছিলেন এক সম্প্রদায়ভুক্ত গুজরাটি হিন্দু। কোন বিশেষ কারণে মিঃ মোহাম্মদ আলি জিন্নার পিতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে করাচীতে বসবাস করেন। ১৮৭৬ সালে বড়দিনের দিন মিঃ মোহাম্মদ আলি জিন্নার জন্ম।”২১
যাইহােক রাজনীতিতে মোহাম্মদ আলি জিন্নার হাতে খড়ি হয় ১৯০৭ সালে কংগ্রেস আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সময় থেকে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু, লীগে যােগ না দিয়ে মোহাম্মদ আলি জিন্না কংগ্রেসে যােগ দিলেন কেন? এই কথাটা বুঝে নেওয়ার খুবই প্রয়ােজন আছে।
একসময়ে মোহাম্মদ আলি জিন্না একান্তভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চাইতেন। সত্যিকার বুর্জোয়া গণতন্ত্র চাইতেন—পশ্চিম ইউরােপে যার রূপ তখন স্পষ্ট। স্বাধীনতার সংগ্রাম অহিংস হতেই হবে—এমন কোনও অসার, যুক্তিবিরােধী পূর্ব সংস্কারে তার মন বাঁধা ছিল না যেটা নেতাজিও চাইতেন। প্রথম যৌবনে কংগ্রেস নেতাদের মতাে তিনিও ভারতভূমির বহুজাতিক সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারতেন না—কংগ্রেস নেতাদের মতাে, আমাদের দেশের বুজোয়া বুদ্ধিজীবীদের মতাে, তিনিও বিশ্বাস করতেন ভারত-ভূখন্ডের সব মানুষ মিলেমিশে একটি মাত্র জাতি—তার নাম ভারতীয় জাতি। মুসলমান সম্প্রদায়কে মনে করতেন সেই এক ভারতীয় জাতিরই অন্তর্গত ভিন্নধর্মী এক অংশ। সেই কারণে মুসলিম লীগের কেবল মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযােগসুবিধা আদায়ের, পৃথক প্রতিনিধিত্ব অর্জনের প্রয়াসকে তিনি পছন্দ করতেন না, অনুমােদন করতেন না। সেই সময়ের মুসলিম লীগ নেতাদের চিন্তায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের কথাও থাকত না। এই কারণেও তিনি নিজেকে মুসলিম লীগ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বুঝতেন—রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া মুসলমান সমাজের কোনও প্রগতি সম্ভব নয়।
১৯১৩ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মুসলিম লীগের সদস্য পদ গ্রহণ করেন। লীগের সভায় যে দুজন সদস্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে মোহাম্মদ আলি জিন্না আগাম এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন যে, মুসলিম লীগ আর মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কোনওভাবেই (ভারতের) বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সাধনে পরিপন্থী হবে না।
কংগ্রেসের সদস্যপদে থেকেই মোহাম্মদ আলি জিন্না কেন একই সঙ্গে লীগের সদস্যপদও গ্রহণ করেছিলেন? এই প্রেের উত্তরও আমাদের বুঝে নিতে হবে। মোহাম্মদ আলি জিন্না স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন—ভারতের দুর্বল মুসলমান মধ্যশ্রেণী তথা মুসলমান সমাজ এককভাবে আন্দোলন করে তাঁদের লক্ষ অর্জনে সফল হতে পারবেন না। কংগ্রেসের সঙ্গে, হিন্দু জনসাধারণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি বড় ধরনের ব্রিটিশ বিরােধী যুক্ত মাের্চা গড়ে তুলতে পারলেই তারা সিদ্ধকাম হবেন, সর্বদিক দিয়ে ভারতের মুসলমান সমাজের মুক্তি আর প্রগতি সম্ভব হবে। তাই, লীগে যােগ দেওয়ার পর থেকে (তখনও তিনি কংগ্রেসেরও সক্রিয় সদস্য) মোহাম্মদ আলি জিন্নার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল—ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কী করে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, কংগ্রেস-লীগ ঐক্য গড়ে তােলা যায়।
মোহাম্মদ আলি জিন্না স্পষ্ট বুঝেছিলেন, পুরনাে কংগ্রেস দল যদি উদার চিত্তে প্রসন্ন মনে, যথার্থ স্বাদেশিক বােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পিছিয়ে-পড়া অধিকারহারা মুসলমান সমাজের যুক্তিসঙ্গত গণতান্ত্রিক দাবিগুলিকে স্বীকার করে নেয়, তাহলেই হিন্দু-মুসলমানের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণ-ঐক্য তৈরি হতে পারে। এই স্বপ্ন সফল করার জন্য মোহাম্মদ আলি জিন্না তখন থেকে অনলস চেষ্টা চালিয়ে যান।
এই স্বপ্ন সার্থক হয়ে ওঠে তিন বছর পরে, ১৯১৬ সালে, লখনউ শহরে— মূলত মোহাম্মদ আলি জিন্না ও তিলকের উদ্যোগে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বসে। সেখানে কংগ্রেস আর লীগ নেতারা একত্র বসে ‘লখনউ চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। চুক্তির শর্তগুলি ছিল এই (ক) কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনক্ষেত্র স্বীকার করে নিচ্ছে। (খ) মুসলিম-প্রধান প্রদেশগুলিতে মুসলমানেরা তাঁদের সংখ্যার অনুপাতে কম আসন পাবেন। বিনিময়ে হিন্দু-প্রধান প্রদেশগুলিতে তাঁদের সংখ্যার অনুপাতে একটু বেশি আসন পাবেন। সার্বিক ঐক্য গড়ে তােলার স্বার্থে এই দেওয়া-নেওয়ার যথেষ্ট প্রয়ােজন ছিল। কিছু মেকি-গণতান্ত্রিক, বানিয়া- উচ্চবর্ণ নেতা মন্তব্য করেন—ওদের বড্ড বেশি ‘তােষণ’ করা হল। উত্তরে বালগঙ্গাধর তিলক বললেন, হ্যাঁ, মুসলমান ভাইদের কিছু কনসেশন আমরা বুঝে শুনেই দিয়েছি। একটা বৃহৎ আদর্শের জন্য দিয়েছি। সেই আদর্শ হল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের সমবেত সংগ্রাম।
তিলক বলেছিলেন,
“It has been said, by some gentlemen, that we Hindus have yielded too much to our Mohammedan brethren. I am sure I represent the sense of the Hindu community all over when I say that we could not have yielded too much … When we have to fight against a third party, it is a very great thing,a very important event, that we stand on this platform united … That is the most important event of the day.’২২
এই সভায় মোহাম্মদ আলি জিন্না বললেন, “হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে শুভেচ্ছাপ্রণােদিত এবং ভ্রাতৃভাবাপন্ন। আমাদের চালক নীতি হবে দেশের স্বার্থে তাঁদের সঙ্গে সহযােগিতা। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম মহৎ সম্প্রদায়ের ভিতর যথার্থ এবং হৃদ্যতপূর্ণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হলেই ভারতবর্ষের যথার্থ প্রগতি সম্ভব হবে।” মোহাম্মদ আলি জিন্না আরও বলেছিলেন,
“It appears to me that the reproach of ‘separatism’ sometimes levelled at Mussalmans is singularly inept and out of the mark when I see a great communal organisation rapidly growing into a powerful factor for the birth of a united India. A minority must have, above everything else, a complete sense of security before its broader political sense can be evoked for cooperation and unity in national task.”২৩
এই কথাগুলি এক দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর আন্তরিক উচ্চারণ। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সরােজিনী নাইডু মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের দুত (‘অ্যামবাসাডর অব হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি’) বলে সম্বােধন করেন। সেই সময় মোহাম্মদ আলি জিন্নার যা মনের গড়ন, তাতে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনক্ষেত্র না হয়ে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নিবার্চন ক্ষেত্র হলেই মোহাম্মদ আলি জিন্না খুশি হতেন। কিন্তু বাস্তবতার বােধ থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কয়েকটি ঐতিহাসিক কারণে দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক বিকাশে একটা ব্যবধান থেকে গেছে। তাই বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে সাময়িকভাবে হলেও পৃথক নিবার্চনক্ষেত্র মেনে নেওয়া উচিত। এ ব্যবস্থা গণতন্ত্রসম্মতও বটে । যদি কোনও জনগােষ্ঠীর মধ্যে এক অংশ অন্যের চেয়ে দুর্বল থাকে, সেই অবস্থায় দুই অংশকে বিকাশের একই স্তরে নিয়ে আসার জন্য দুর্বল অংশকে কিছু দিনের জন্য কিছু বাড়তি সুযােগ দিতে হয়। দেওয়া। উচিত। এতে গণতান্ত্রিক আদর্শের গৌরবহানি হয় না। এই বিচার থেকেই মোহাম্মদ আলি জিন্না নিজে যৌথ নিবার্চনক্ষেত্রের পক্ষ পাতী হয়েও পৃথক নিবার্চন ক্ষেত্রের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন।
(৫)
আধুনিক ভারতে রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রথম রূপকার দুই ব্যক্তি বাল গঙ্গাধর তিলক আর মহম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না। খিলাফত আন্দোলন তখনও পাঁচ বছর দূরে। এই চুক্তি সারা ভারতে, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যেই প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করে। প্রথম বিধাযুদ্ধের দুঃসহ চাপ সাধারণ ভারতবাসী আর বইতে পারছিল। দুর্গত গরিব মানুষ প্রতিবাদ-প্রতিরােধের জন্য গজরাচ্ছিল। এই চুক্তির মধ্যে তারা মিলিত সংগ্রামের আহ্বান শুনতে পেল।
কিন্তু নানান কারণে এই ঐক্যপ্রয়াস বাস্তবে সার্থক হয়ে উঠতে পারল না। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা রাজনৈতিক বােঝাপড়ার দ্বিতীয় চেষ্টা হয় বাংলায়, ১৯২৩ সালে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রমুখ নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ বাঙালি মুসলমান নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনটি বিষয়ে ঐকমতে আসেন—‘বাংলা চুক্তি’ সম্পাদিত হয়।
- ১. স্থানীয় স্বয়ত্তশাসন-সংস্থায় (বাঙালি) মুসলমানদের জন ৬০ শতাংশ আসন নির্দিষ্ট থাকবে।
- ২. বাংলার নির্বাচিত বিধানসভায় মুসলমানেরা তাঁদের জনসংখ্যার অনুপাতে মােট আসনের ৫৫শতাংশ পাবেন।
- ৩. সরকারি চাকরিতেও তাঁরা ৫৫ শতাংশ পদ পাবেন।
জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙালি মুসলমানদের একটু বেশি সুযােগ দিয়ে উদার দেশপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাশ মনে করলেন না যে মুসলমানদের ‘তােষণ’ করা হল। উল্টে তিনি মনে করলেন যে এইটাই সত্যিকারের গণতন্ত্র। কারণ, সত্যিকার গণতন্ত্র অগ্রসরঅনগ্রসর দুই স্তরের মানুষকে বিকাশের একই স্তরে তুলে আনতে চায়। সেদিন অখন্ড বাংলায় মুসলমানের সংখ্যাগুরু হলেও সব দিক দিয়ে ছিলেন অনগ্রসর—শিক্ষার দিক দিয়ে অনগ্রসর, অর্থনীতির দিক দিয়েও অনগ্রসর।
অন্ধ্রের কোকনদ শহরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসল ডিসেম্বর মাসে। চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার ঐক্য প্রস্তাবটি অনুমােদনের জন্য সম্মেলনে উত্থাপন করলেন। প্রস্তাবের পথে ভােট পড়ল ৪৫৮, বিপক্ষে ৬৭৮। বিপীয়দের প্রধান নেতা ছিলেন পাঞ্জাবের লাজপত রায়। কংগ্রেসের উচ্চবর্ণ নেতারা ‘বাংলা চুক্তি’-কে ব্যর্থ করে দিলেন দুটি কারণে ও মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনক্ষেত্র দেওয়া চলবে না সরকারি চাকরিতেও তাঁরা নির্দিষ্টসংখ্যক পদ পাবেন না। প্রথম দাবিটি মানলে ‘গণতন্ত্রের ইজ্জত চলে যায়’, দ্বিতীয় দাবিটি মানলে ‘প্রশাসনিক দক্ষতার মান’ নেমে যায়!
এত দিন পর্যন্ত সমস্ত ঐক্যপ্রয়াস একটি বিষয়ে গিয়ে প্রতিহত হচ্ছিল মুসলমানদের পৃথক নিবাচন ক্ষেত্র স্বীকার করা বা না-করা। কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের বৃহত্তম অংশ মুসলমানদের এই বিশেষ সুবিধা দিতে একেবারেই রাজি নন আবার, মুসলমান নেতাদের বৃহত্তম অংশ তাঁদের সংখ্যালঘুত্ব আর সামাজিক অনগ্রসরতার কারণে এই বিশেষ অধিকার ছাড়তে প্রস্তুত নন। আধুনিক মনের মানুষ মোহাম্মদ আলি জিন্না যৌথ নিবার্চন ত্রেই পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, এই একটা বিষয়ে মতভেদের দরুণ ঐক্য প্রয়াস বারবার ভেঙে যাচ্ছে, তিনি তখন লীগ কাউন্সিলের বৃহত্তম-সংখ্যক সদস্যদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যৌথ নিবার্চনে রাজি করালেন। ১৯২৭ সালের ২০মার্চ লীগ কাউন্সিল নতুন যে ঐক্য-প্রস্তাব ভারতবাসীর সামনে রাখলেন, তার শর্তগুলি ছিল এই।
- ক) যৌথ নিবার্চন এই হবে, তবে হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের জন্য, আর মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলিতে হিন্দুদের জন্য কিছু আসন সংরথিত থাকবে।
- খ) সিন্ধু, বালুচিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে স্বতন্ত্র প্রদেশের মর্যাদা, অধিকার আর ক্ষমতা দেওয়া হবে।
- গ) পাঞ্জাব আর বাংলার বিধানসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব তাঁদের জনসংখ্যার অনুপাতে হবে।
- ঘ) দিল্লির কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব মােট সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের কম হবে না। (২৫ শতাংশ মানুষ ৩৩ শতাংশ আসন চায় কেন? ওই ২৫ শতাংশ মানুষের অধিকাংশেরই ভােট দেওয়ার অধিকার ছিল না—এই কারণে) এই প্রস্তাব দিল্লি প্রস্তাব নামে পরিচিত। ১৯২৭ সালের মে মাসে এ-আই-সি-সির অধিবেশনে এই দিল্লি প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হল, এবং ওই বছররেই ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজে কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ বার্ষিক অধিবেশনেও তা অনুমােদিত হল। এই তথ্যটি মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জানতে দেওয়া হয় না।
১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ওই দিল্লি প্রস্তাব আবার উত্থাপিত আর অনুমােদিত হল। লীগের এই সম্মেলনে সরােজিনী নাইডু আর অ্যানি বেসান্ত সম্মানিত অতিথিরূপে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির আসন থেকে মোহাম্মদ আলি জিন্না বললেন,
“পন্ডিত মালবীয়কে আমি স্বাগত জানাই এবং কংগ্রেস আর হিন্দু-মহাসভার মঞ্চ থেকে হিন্দু নেতারা আমাদের প্রতি যে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সে হাত আমি পরম সমাদরে গ্রহণ করছি। আমার কাছে তাদের এই প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া সমস্ত সুযােগ-সুবিধার চেয়েও বেশি মূল্যবান। সুতরাং তাঁদের বন্ধুত্বের হাত আমরা যেন গ্রহণ করি।”
মুসলিম লীগ বন্ধুত্বের প্রসারিত হাত পরম সমাদরেই গ্রহণ করেছিল, কিন্তু ওই বছরেই কংগ্রেস প্রসারিত হাত আবার গুটিয়ে নিল। যৌথ নির্বাচনের স্বীকৃতিও কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্বের মনে বদ্ধমূল তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষ তথা হিন্দু সমাজের নীচের তলার মানুষদের প্রতি ঘৃণার ভাব দূর করতে পারল না। (কথায় কথায় মেদিনীপুরের মাহিষ্য নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের প্রতি বাঙালি উচ্চবর্ণ নেতাদের অপমানকর আচরণের কথা মনে পড়ে গেল। তবে, সে কথা এখানে থাক)
১৯২৭-এর ডিসেম্বরে মাদ্রাজে অনুমােদিত লীগ প্রস্তাব ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় প্রত্যাখ্যাত হল। এই প্রত্যাখ্যানে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্তত তিন জনের নাম ভারতবাসীর ঐক্যের শত্রু হিসাবে চিহিত হওয়া উচিত মদনমােহন মালবীয়, লাজপত রায়, এম আর জয়াকর।
কলকাতা কংগ্রেস সম্মেলনের খুব কাছাকাছি সময়ে ভবিষ্যৎ ভারতের সংবিধানের মূলনীতিগুলি নির্ধারণের জন্য এই শহরেই এক সর্বদলীয় সম্মেলন বসেছিল। সেই সম্মেলনে মোহাম্মদ আলি জিন্না বলেছিলেন।
- ক) কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম হবে না।
- খ) (মােতিলাল) নেহরু রিপাের্টে প্রস্তাবিত প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার স্বীকৃত না হলে, বাংলা আর পাঞ্জাব জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পাবে, তার বেশি নয়। তবে দশ বছর পরে এর পুনর্বিচার করা যেতে পারে।
- গ) বাদবাকি সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির হাতে, কেন্দ্রের হাতে নয়।
এই সময়ে মোহাম্মদ আলি জিন্না শুধু আইনসভায় এক জাতীয়তাবাদী নেতা কিংবা আইনসভার বাইরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবত্তাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের বিরােধী মনােভাবাপন্ন এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্রিটিশ বিরােধী ভূমিকার কিছু দিক উল্লেখ করা যেতে পারে—
- ১) ১৯১২ সালের ১৯ শে মার্চ তিনি গােখলে কর্তৃক আইনসভায় উত্থাপিত প্রাথমিক শিক্ষা বিলকে সমর্থন করে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ সরকার যেহেতু ভারতের প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করেছেন তাই ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারকে উচ্ছেদ করা দরকার।
- ২) প্রথম বিধাযুদ্ধে অতি স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে তার উপনিবেশগুলি জড়িয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ডের নেতারা ভারতীয়দের যুদ্ধে যােগদানকে অভিনন্দন জানান। তাদের ব্যাখ্যায় ‘স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদ’ রক্ষার জন্য ভারত ইংল্যান্ডকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু মোহাম্মদ আলি জিন্না অন্যান্য ভারতীয় নেতাদের মত নিঃশর্ত সমর্থনের পক্ষপাতী ছিলেন না। মোহাম্মদ আলি জিন্নার এই মনােভাবকে ‘ভাইসরয়দরাদরি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্না এর উত্তরে ভাইসরয়কে পাল্টা প্র করেন “নিজের দেশে আমাকে ইওরােপীয় ব্রিটিশ প্রজাদের সমমর্যাদা দেওয়া হােক দাবি করা কি দরাদরি ?” বিধাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভাইসরয় দিল্লীতে যে যুদ্ধ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন তাতে মোহাম্মদ আলি জিন্না যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা সরকার বিরােধী বলে বাতিল হয়ে যায়। এই ঘটনা থেকেই বােঝা যায় তার ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব কতখানি তীব্র ছিল।
- ৩) ১৯১৭ সালের ৩০শে জুলাই বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্বন্ধে মোহাম্মদ আলি জিন্না ইংরেজ সরকারের তীব্র সমালােচনা করেছিলেন বােম্বাইয়ের এক জনসভায়।
- ৪) যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালােচনা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলি জিন্নার বকতব্য ছিল খুবই পরিষ্কার এবং তী। সরকারের নীতি যে কিরূপ ভ্রান্ত, ভারতীয়দের তারা যে কিরূপ অবিধাস করেন এবং ভারত তথা ব্রিটিশরাজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য তারা যে ভারতীয়দের হাতে অস্ত্র দিতে সাহস পাচ্ছেন না তা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেন।২৪ আইনসভায় দেশের পরিস্থিতির এরূপ এক সুন্দর আলেখ্য মোহাম্মদ আলি জিন্না সকলের সামনে তুলে ধরলে তাকে খন্ডন করার যুক্তি সরকারের ছিল না। মোহাম্মদ আলি জিন্নার এরূপ নির্ভীক বক্তব্য ও পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ণ ও সর্বোপরি ব্রিটিশ রাজের দ্বিমুখী নীতি সর্বসমক্ষে তুলে ধরার স্বীকৃতি হিসাবে বােম্বাইয়ের কংগ্রেস ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘মোহাম্মদ আলি জিন্না হল’ রাখা হয়।২৫ এই স্বীকৃতি মোহাম্মদ আলি জিন্নার ব্যক্তিত্বের অবশ্যই এক সঠিক মূল্যায়ন।
- ৫) রাওলাট আইনের মত কুখ্যাত আইনকে মোহাম্মদ আলি জিন্না কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি। এই আইনের বিরােধিতা স্বরূপ তিনি আইনসভার সভ্যপদ ত্যাগ করেছিলেন যা তার ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাবের বড় প্রমাণ। মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রতিটি সভা সমিতিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের নিন্দা ও ব্রিটিশ বিরােধী বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু অবাকের বিষয় হল গান্ধীজি পাঞ্জাবের এই হত্যাকান্ডকে বেশি গুরুত্ব দেননি। তাই বিপিন পাল মতিলাল নেহেরুকে লিখেছিলেন “তাঁর (গান্ধীজি) চিন্তায় ও কর্মে পাঞ্জাব ট্রাজেডির চেয়ে খিলাফৎ প্রাধান্য পেয়েছে। ঠিক এখানেই তাঁর দ্বারা আমাদের পরিচালিত হওয়া তে আমি গভীরভাবে বিপদ অনুভব করছি।”
- ৬) জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের স্মৃতিকে মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রতিবছর পালন করতেন এবং ব্রিটিশদের এই পাশবিক আচরণকে স্তম্ভাদির দ্বারা চিরস্থায়ী করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার অনুরােধে এই হত্যাকান্ডের স্মৃতিতে অনুষ্ঠিত একসভায় রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষণ লিখে পাঠান।২৬
আসলে ১৯১৫ থেকে ১৯২৮ একটানা বারাে বছর ধরে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে ভারতের সাধারণ মুসলমান জনকে কংগ্রেসের সঙ্গে এক মঞ্চে এনে দুবার এক স্বাধীনতা সংগ্রাম সৃষ্টি করার এই যে প্রয়াস, তা করুণ ব্যর্থতায় শেষ হল। ব্যর্থ হল, মোহাম্মদ আলি জিন্না বা অন্য-কোনও মুসলমান নেতার অগণতান্ত্রিক একগুঁয়েমির কারণে নয়—কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে সমাসীন বেশ কয়েক জন। উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্যত্তির তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষের কারণে। মুসলিম লীগের এক প্রমুখ নেতা চৌধুরী খালিক-উজ-জামান মন্তব্য করেন,
“হিন্দু নেতারা তাঁদের প্রিয় বিষয় যৌথ নিবার্চনের সুযােগ হারালেন। …ভারতের হিন্দু যুবকেরা যেন ভারত-বিভাজনের জন্য মুসলমানদের দায়ী করার আগে তাঁদের সেই সময়কার নেতাদের এই বিরাট ভ্রান্তির সম্বন্ধে চিন্তা করেন।”
গভীর দুঃখে হতাশায় মুহ্যমান মহম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না কলকাতা থেকে দিল্লি রওনা হওয়ার মুহুর্তে তাঁর এক পার্শি বন্ধুর হাত ধরে চোখের জলে বললেন, ‘জামশেদ, এবার আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল’। বস্তুত কংগ্রেস করতে করতে ১৯২০ সালে গান্ধীর সঙ্গে মোহাম্মদ আলি জিন্নার মতপার্থক্য হয় ‘অহিংসা’ ও ‘আবেদন’ ‘নিবেদন’- কে কেন্দ্র করে। মোহাম্মদ আলি জিন্না চেয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে—এই প্রস্তাবে কংগ্রেস কর্মীরা তাকে ‘মুসলমান’ বলে, ‘মােল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ বলে বিদ্রুপ করলেন। গান্ধীজী এ নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ উপভােগ করলেন, কোনও প্রতিবাদ করলেন না। মিঃ মোহাম্মদ আলি জিন্না ক্ষোভে দুঃখে কংগ্রেস ছাড়লেন।২৭
এই বিষয়টি একটু খুলে বলা ভাল। রাজনীতির মঞ্চে গান্ধীজির আবির্ভাবের পূর্বে মোহাম্মদ আলি জিন্নার কংগ্রেসে প্রভাব ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল। মোহাম্মদ আলি জিন্না গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু অসহযােগ নিয়ে মোহাম্মদ আলি জিন্নার সাথে যে গান্ধীজির মতপার্থক্য শুরু হয় তা হােমরুল লীগের নাম পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে পূর্ণ রূপ লাভ করে। ১৯২০ সালের ৩রা অক্টোবর গান্ধীজির সভাপতিত্বে বােম্বাইতে সারা ভারত হােমরুল লীগের সভ্যদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গান্ধীজির সুপারিশে হােমরুল লীগের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘স্বরাজ সভা’ এবং এর সংবিধান ও নীতিকে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধাঁচে পরিবর্তন করা হলে মোহাম্মদ আলি জিন্না তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সভা ত্যাগ করেন এবং ঐ মাস শেষ হওয়ার আগেই হােমরুল লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ পত্রে মোহাম্মদ আলি জিন্না যে যুক্তি তােলেন তাহল এরূপ “স্বরাজ সভায় যে সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছে তা ইতিপূর্বে হােমরুল লীগের অনুসৃত উদ্দেশ্য, লক্ষ ও কর্মপদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সংবধািনের এসব পরিবর্তন এমন পদ্ধতিতে করা হয়েছে যা লীগের নিয়মকানুনের বিরােধী। উক্ত পদ্ধতির সাপেক্ষে যে নতুন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা ভ্রান্ত।”২৮
মোহাম্মদ আলি জিন্নার আরও বক্তব্য হল, গান্ধীজি যেসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেখানেই বিভাজন এসেছিল। দেশের জনজীবনেও এর প্রতিফলন দেখা দিয়েছিল। শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয়, হিন্দু ও হিন্দু, মুসলমান ও মুসলমান, এমনকি পিতাপুত্রের মধ্যেও বিবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। এই কারণেই মোহাম্মদ আলি জিন্নার অভিমত ছিল জাতীয়তাবাদীদের সামনে একমাত্র পথ ছিল সম্মিলিত হয়ে যথাসম্ভব শীঘ্র পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বজনগ্রাহ্য কোনও কর্মসূচী অনুসারে কাজে লেগে পড়া। এ জাতীয় কর্মসূচি কোনও ব্যক্তি বিশেষ চাপিয়ে দিতে পারে না, দেশের তাবৎ জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনুমােদন ও সমর্থনের বিশেষ প্রয়ােজন ছিল এর পিছনে।
(৬)
তাছাড়া গান্ধীজির প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার পিছনে মোহাম্মদ আলি জিন্নার যথেষ্ট কারণ ছিল। ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে হােমরুল লীগের সভাপতি পদ থেকে শ্রীমতী বেসান্ত সরে দাঁড়ালে মোহাম্মদ আলি জিন্নার সমর্থনে ও চেষ্টায় গান্ধীজি সভাপতি হতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ গান্ধীর হােমরুল লীগের সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আলি জিন্নার প্রধান ভূমিকা ছিল। কিন্তু হােমরুল লীগকে নিয়ে গান্ধীজির এই রাজনীতি মোহাম্মদ আলি জিন্না সহ্য করতে পারেননি। শাসনতান্ত্রিক বহির্ভূত আন্দোলনে মৌলানা মহম্মদ আলি, সৌকৎ আলি ও তাঁদের মত সাম্প্রদায়িক ‘প্যান’ ইসলামবাদী নেতাদের গান্ধীজির প্রশ্রয় দেওয়াকে জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্না মেনে নিতে পারেন নি। এ ছাড়া ভারতের রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ গান্ধীজির নেতৃত্বকেও তিনি ঠিক মেনে নিতে রাজি হননি।২৯
এই পরিস্থিতিতে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন নাগপুরে অনুষ্ঠিত হয়। নাগপুর কংগ্রেসে অসহযােগের উপর গান্ধীজি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার প্রধান বিষয়গুলি ছিল নিম্নরূপ—১) আইনসভা বর্জন ২) আদালত বর্জন ৩) স্কুল কলেজ বর্জন ৪) উপাধি প্রত্যাখ্যান। অধিবেশনে প্রায় ৫০ হাজার শ্রোতার সামনে মোহাম্মদ আলি জিন্না ছিলেন একমাত্র প্রতিনিধি যিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবে অসম্মতি (সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথও এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিলেন) জানিয়েছিলেন। এই অধিবেশনে স্বরাজের প্রস্তাবিত লথের বিরােধিতা করেছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্না। কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের কোন আদৌ সম্পর্ক থাকবে কিনা তা প্রস্তাবের মধ্যে স্পষ্ট ছিল না। গান্ধীজি মনে করেছিলেন যে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তিনি স্বাধীনতা অর্জন করবেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলি জিন্নার বক্তব্য ছিল ভিন্ন। তিনি সন্দেহাতীত ছিলেন যে, রক্তপাত ছাড়া স্বাধীনতা আসতে পারে না। এভাবে প্রকারান্তরেই গান্ধী নির্দেশিত পথকে মোহাম্মদ আলি জিন্না সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলেই মনে করেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি ওঠে। তবে মোহাম্মদ আলি জিন্না তাঁর বক্তব্যে অটল থাকেন।
মোহাম্মদ আলি জিন্নার বক্তব্যে তাঁর বিরােধীরা তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করলে মোহাম্মদ আলি জিন্না সংক্ষেপে তার আপত্তিগুলিকে গুছিয়ে বলেন এবং ‘স্বরাজ’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাবি করেন। গান্ধীর মতে, ‘স্বরাজ’–এর অর্থ হল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা। কিন্তু গান্ধীজি তা পরিষ্কার। করে বলছেন না কেন? আসলে মোহাম্মদ আলি জিন্নার এই মনােভাব যা তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে স্পষ্ট করে তােলেন তা বিশেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, তিনি ব্যক্তি নির্ভর রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষক। এই সময়ে গান্ধী-নির্ভর যে রাজনীতি কংগ্রেসের মত জাতীয় প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিল তা মোহাম্মদ আলি জিন্না মেনে নিতে পারেননি। জনপ্রিয়তা সব রাজনীতিবিদই চান, গান্ধীও চেয়েছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলি জিন্না এর থেকে দূরে ছিলেন। তিনি ইমেজ তৈরি করার কোনও চেষ্টা করেননি বা কাউকে করতে দিতেও রাজি ছিলেন না।৩০
রাজনীতির সাথে ধর্মের সংমিশ্রণ যে মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে এটা মোহাম্মদ আলি জিন্না আগে থেকেই অনুধাবন করেছিলেন এবং একারণেই ভারতীয় জনগণকে তিনি সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন। এই অধিবেশন শেষে দুর্গা দাসকে মোহাম্মদ আলি জিন্না অতি ক্ষোভের সঙ্গে ই জানানঃ
“এই মিথ্যা ধর্মীয় বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটানােতে আমার কিছু করার নেই। আমি কংগ্রেস ও গান্ধীর সংশ্রব ত্যাগ করছি, আমি এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত জনগণকে বিশ্বাস করি না।”৩১
আহত অপমানিত মোহাম্মদ আলি জিন্না এই অধিবেশন থেকে বােঝেন যে কংগ্রেসে তার আর স্থান নেই। ফলে তিনি কংগ্রেস থেকে দুরে সরে যান।
আসলে কংগ্রেস-নেতৃত্বর মূল দুর্বলতা ছিল এটাই যে, শ্রেণীগতভাবে তারা যে বুর্জোয়া জমিদারশ্রেণী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে তারা ঐক্য স্থাপন করার আংশিক প্রচেষ্টাগুলিকেও সীমিত রেখেছিলেন মুসলমান বুজোয়া-জমিদার-পেশাদারশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সঙ্গেই মীমাংসা প্রচেষ্টার মধ্যে। নীচুতলার মেহনতী মুসলমানদের মধ্যে তাঁরা মূলত পৌঁছাতেই চাননি, ফলে ব্যাপক হিন্দু-মুসলমান জনতার ঐক্য তারা কখনও গড়েই তুলতে পারেন নি, বরং ক্রমে ব্যাপক মুসলমানদের কাছ থেকে তারা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। গান্ধী মূলত অসাম্প্রদায়িক হলেও ‘রামরাজ্য’ জাতীয় হিন্দুধর্মীয় রূপকল্পগুলির ক্রমাগত ব্যবহার, ধর্মীয় আবেদনের ওপর গুরুত্বপ্রদান, বণাশ্রম-জাতিভেদ ইত্যাদির প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থনের ফলে ব্যাপক মুসলমানদের পথে তাঁকে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিলাে। আর অন্যদিকে সৈয়দ আহমদ খান ও মহম্মদ মোহাম্মদ আলি জিন্না যথাক্রমে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা দুজনেই অসাম্প্রদায়িক ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরােধী ছিলেন, হিন্দুমুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ঐক্যের ভিত্তিতেই ভারতীয় জাতিগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কিন্তু কংগ্রেসের বিকাশের ও শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই মোহাম্মদ আলি জিন্না ক্রমশ নানা দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রবত্তা হয়ে উঠেছিলেন। বিপরীত দিক থেকে দেখতে গেলে, এই বিষয়টিই পরােক্ষ ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশে কংগ্রেসের ভূমিকাকে স্পষ্ট করে দেয়। আফ্রিকার ঐতিহাসিক রােনাল্ড শিগাল তাঁর ‘দ্য ক্রাইসিস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে (পৃ.১০৭) লিখেছেন, গান্ধীজির নেতৃত্বের মধ্যেই ছিল বিভেদের বীজ এবং তিনি কংগ্রেসকে হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত করেন এবং সেভাবে পরিচালনা করেন। পরিণামে তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেন। তাই গান্ধীজি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে সুদৃঢ় না করে তাদের মধ্যে ব্যবধানকে প্রমূর্ত করে রাখেন। গান্ধীজির এই নীতিগুলিকে মোহাম্মদ আলি জিন্না মানতে পারেননি, বিশেষ করে খিলাফৎ-অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনার বিভিন্ন দিককে। ১৯২০ সালের ৭ই নভেম্বর কলকাতায় তিনি ব্রিটিশ সরকারকে এই বলে হুঁশিয়ারী দেন যে সরকার যদি তাদের নীতি পরিবর্তন না করেন, তাহলে তাঁরা অসহযােগ নীতিকে অনুসরণ করবেন। তবে সেই অসহযােগ অবশ্যই গান্ধী প্রবর্তিত পথে নয়। সুতরাং গান্ধীজির অবলম্বিত রাজনীতি মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে এই আন্দোলন থেকে তথা কংগ্রেস থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
মোহাম্মদ আলি জিন্না কংগ্রেস ছাড়লেন কেন, এ বিষয়ে এম. সি. চাগলা খুবই প্রখর অনুসন্ধানী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন : মোহাম্মদ আলি জিন্না ছিলেন দারুণ অহংবােধে আবিষ্ট। তাঁকে নেতা হতেই হবে, আর সব কাজে তাঁরই হবে মুখ্য ভূমিকা। ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজির আবির্ভাবের পর তাঁর মনে হল দিনে দিনে তাঁর আপন গুরুত্ব কমে যাবে। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর পূর্ণ বৈপরীত্য। তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকে যখন তাঁর স্থান হল না তখনই মোহাম্মদ আলি জিন্না বুঝে গেলেন যে এই দুনিয়ায় যদি তাঁকে ঠাই করে নিতে হয় তাে তাঁকে সাম্প্রদায়িক তক্তের উপরই দাঁড়াতে হবে। তিনি এতই তুচ্ছ যে তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকে তাঁর স্থান হলাে না—এই মনােভঙ্গি থেকেই তাঁর রূপান্তরের আরম্ভ।৩২
যাইহােক, সমসাময়িক লেখকরা মোহাম্মদ আলি জিন্নার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাঁকে চূড়ান্ত বাস্তবতানিষ্ঠ, অহমিকাপূর্ণ, রগচটা, উন্নাসিক ও গজদন্ত-গােপুরম্-নিবাসী মনে হয়। অনেকে বলেন যে তাঁর ভিতর মানবীয় আবেগের ন্যূনতা ছিল। এমনকি তাঁর এককালের ঘনিষ্ঠ সহযােগী চাগলারও অভিমত হলঃ “মোহাম্মদ আলি জিন্নার মত এমন মানবীয় সংবেদনশীলতা বিবর্জিত আর কোনও মানুষের সম্পর্কে আমাকে আসতে হয় নি। তাঁর আচরণ ছিল হিমশীতল ভাবাবেগহীন। আইন এবং রাজনীতি ছাড়া অপর কোনও বিষয়ের প্রতি তাঁর অভিরুচি ছিল না।”৩৩ কিন্তু সত্যসত্যই কি তাই? এমন ঘটনার কি নজীর নেই যখন তিনি সাধারণ মানুষের মত আচরণ করছেন, যে মানুষ আবেগতাড়িত এবং ভালবাসতে ও ভালবাসা পেতে চায়? কতকগুলি ঘটনার কথা জানা গেছে যার কারণ মোহাম্মদ আলি জিন্নার হিমশীতল এবং মানুষের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবমূর্তি সম্বন্ধে পুনর্বিচার করার প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে।
মোহাম্মদ আলি জিন্নার স্ত্রীর শেষকৃত্যের সাথী হবার বিরল সুযােগ চাগলা পেয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার সেই সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেনঃ
“সেই একবার মাত্র আমি মোহাম্মদ আলি জিন্নার আচরণে মানবীয় দুর্বলতার ছায়া প্রত্যক্ষ করেছিলামঃ প্রত্যুত তার চক্ষে জলধারা প্রবাহিত হয়েছিল।”৩৪
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক প্রবন্ধে এই ঘটনা ব্যক্ত হয়েছে যে, মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলি জিন্না তাঁর মােটরগাড়ির বিধ্বস্ত চালক মহম্মদ হানিফ আজাদকে নিজের কামরায় ডেকে একটি বিশেষ আলমারি খুলে তাঁর পরলােকগত পত্নীর ব্যবহৃত কাপড়চোপড় বার করে তাঁর সামনে সাজিয়ে রাখতে আদেশ করতেন। দীর্ঘকাল নিঃশব্দে সেই বস্ত্রগুলির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর চক্ষে সজল হয়ে উঠত।৩৫
মোহাম্মদ আলি জিন্নার অন্যতম জীবনীকার হেক্টর বলিথাে তাঁর তরুণদের সান্নিধ্যপ্রেমের কথা লিখেছেন, যা এক নিঃসঙ্গ বয়স্ক ব্যক্তির ব্যর্থ পিতৃমানসিকতার পরিচায়ক। একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলছেন যে কোনও এক নিশীথে মোহাম্মদ আলি জিন্না, ‘এই কারণে ঘুমােতে পারেননি যে তার বাড়িতে অতিথি তাঁর এক বন্ধুপুত্র এবং তার সঙ্গী ‘তার পরদিবস চলে যাবে’। তাঁর জীবনীকার আরও লিখেছেন যে, বিখ্যাত হবার বহুদিন পরও মোহাম্মদ আলি জিন্না একবার কোনও এক বন্ধুর শিশুপুত্রের জন্য দোল খাওয়া কাঠের ঘােড়া কেনার উদ্দেশ্যে কেমনভাবে কোন দিকে দৃকপাত না করে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে খেলনার দোকানের দিকে ধাওয়া করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত অপর একটি প্রবন্ধে লেখক বসন্ত টি কৃপালনী৩৬ জানাচ্ছেন যে, তদানীন্তন বিখ্যাত নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্না কি ভাবে তাঁর ব্যস্ত কার্যক্রমের ভিতর থেকে সময় বার করে আগ্রায় গিয়ে এক নগর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি হিন্দু যুবকের পক্ষে সমর্থন করে তাকে বিপন্মুক্ত করেছিলেন। বােম্বের বিখ্যাত ব্যারিস্টার এই ঘটনার পাঁচ বৎসর পূর্বে আইনের পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করলেও একটি যুবকের ভবিষ্যৎ এবং তার পিতার মনােভাবের কথা উপলব্ধি করে মোহাম্মদ আলি জিন্না আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক ঐ কার্য করেছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার ব্যক্তিত্বের কিছু কিছু উল্লেখযােগ্য দিক বসন্ত কৃপালনীর আত্মস্মৃতিমূলক রচনায় ফুটে উঠেছে।৩৭
১৯৪২ সালের অক্টোবরের শেষভাগে মোহাম্মদ আলি জিন্না যখন হিন্দুবিদ্বেষীরূপে তীব্রভাবে নিন্দিত তখন তাঁর জন্মস্থান করাচীর এক হিন্দু বন্ধুর পুত্র বসন্ত কৃপালনীর অনুরােধে আগ্রার জনৈক হিন্দু ব্যবসায়ীর প্রতি কণাপরবশ হয়ে আদালতে তাঁর পুত্রের পক্ষে সমর্থন করার জন্য তিনি আগ্রা যান। যুবকটির বিরুদ্ধে সেখানকার সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষে এই জন্য সাজানাে মামলা দায়ের করেছিল যে সে তাদের উৎকোচ দিতে অস্বীকার করেছে। হিন্দু ভগবান ধােন্ডে তখন মোহাম্মদ আলি জিন্নার ব্যক্তিগত পরিচারক এবং কৃপালনীর মতে মোহাম্মদ আলি জিন্না “তাঁর প্রতি অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিলেন এবং সে ছিল তাঁর প্রায় সব সময়ের সহচর।” কৃপালনী আরও জানিয়েছেন যে, কেবল তাঁকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করার জন্য মোহাম্মদ আলি জিন্না তাঁকে নিজের ব্যক্তিগত সহায়কের পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে কৃপালনী স্বেচ্ছায় সে কাজ ছেড়ে দেন।৩৮
হেক্টর বলিথাের কাছে তার গুণগ্রাহী বন্ধু এবং দেশবিভাগের সময়ে করাচীর মেয়র পার্শী জামসেদ নসরওয়ানজী মোহাম্মদ আলি জিন্নার সম্বন্ধে বলেনঃ
“আমার সানুনয় মিনতি—বিধাস করুন শ্ৰীযুক্ত মোহাম্মদ আলি জিন্না মানব-দরদী ছিলেন। কোনদিনই তাঁর মধ্যে চোখের জল ফেলার প্রবণতা ছিল না – না, আদৌ না। কিন্তু দুবার আমি তাঁকে অমােচন করতে দেখেছি। একবার দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে। সে সময়ে আমি তাঁর সঙ্গে হিন্দুদের এক শিবিরে গিয়েছিলাম। এঁরা পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। শিবিরের বাসিন্দা সেই সব হিন্দুদের দুর্দশা দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁর গালের উপর দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে দেখেছি।”৩৯
A.G. Noorani-র লেখা থেকে জানা যায়ঃ ১৯৩৯ সালের ৩০মে মোহাম্মদ আলি জিন্না তাঁর শেষ ‘ইচ্ছাপত্র’ তৈরী করেছিলেন। ১৯৪০ সালের ২৫ অক্টোবর একটা ক্রোড়পত্র যুক্ত করে বােম্বে বিবিদ্যালয়কে ৫০,০০০ টাকা দান করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত হয়ে গেছে। পাকিস্তান জন্মের পর মোহাম্মদ আলি জিন্না অনায়াসে তার উইল বা ইচ্ছাপত্র পরিবর্তন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সহজাত উদারতা তাঁকে তা করতে দেয়নি। এ ধরনের উদারতা ভারতীয় অন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের থাকলে হয়তাে ‘দেশভাগ’ করার প্রয়ােজনীয়তা দেখাই দিত না।৪০
তাছাড়া সকলেরই নিশ্চয় জানা আছে ভগৎ সিং, রাজগুরু আর শুকদেবকে জগদ্বিখ্যাত ‘ব্রিটিশ-বিচার-ব্যবস্থার’ ধ্বংসাবশেষের ওপর হত্যা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার এদের বিচারের জন্য একটা বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচারের সময় ছয় মাসের মধ্যে সীমিত করে। আসামীদের প্রাপ্য সমস্ত সুযােগ-সুবিধা বাতিল করে, বিচার চলাকালীন অনমনীয় বিচারপতিকে পরিবর্তন করে এমনকি আসামীদের অনুপস্থিতিতে বিচার চালিয়ে, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ব্রিটিশ সরকার এতেও নিশ্চিন্ত হয়নি। এই ট্রাইবুনালের গঠন ‘দায়রা-আদালতের সমস্ত ক্ষমতাকে খর্ব করে।
কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভা এদের বিচারের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করতে অস্বীকার করলে, গভর্নর-জেনারেল তার বিশেষ খমতা বলে অর্ডিন্যান্স জারি করে, হাইকোর্টের (লাহাের হাইকোর্টের) এক্তিয়ারের বাইরে এই ‘ট্রাইবুনাল গঠন করে। যার অর্থ, এই ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সমস্ত পথ বন্ধ করা। এই বিচারের জন্য আইন প্রণয়নের চেষ্টায় রত গভর্নরস কাউন্সিলের স্বরাষ্ট্র সদস্যকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় মহম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না এককভাবে পর্যদস্ত করেন। সভার সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রথমেই ঘােষণা করেছিলে, মনে রাখবেন আমি ভগৎ সিং-এর কাজকে সমর্থন করি না। তবু যে মানুষ অনশন করতে পারে তার হৃদয় আছে। সে হৃদয়ের দ্বারা প্রভাবিত, নিজের উদ্দেশ্যের সম্পর্কে সে নিশ্চিত।
ভগৎ সিংদের জীবনযাত্রার মান ইওরােপীয় না হওয়াতে, তাদের জন্য জেলে শােভন ব্যবস্থা ছিল না। এবং তারই প্রতিবাদে তাঁরা অনশন করেন। মোহাম্মদ আলি জিন্না ব্রিটিশ সরকারের অপকর্মের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে বলেন, কেন আপনারা আসামীদের অনুপস্থিতিতে, সর্বপ্রকার ফৌজদারী বিচারের রীতিনীতিকে বিসর্জন দিয়ে বিচার চালাচ্ছেন। আপনারা আইনের ফাঁক বন্ধ করার অজুহাতে কেন ফৌজদারী বিচার-ব্যবস্থার ভিত্তিমূলে আঘাত করছেন। আপনার প্রশাসনের জন্য আরও ক্ষমতা, বিশেষ ক্ষমতার প্রয়ােজন তাে তাই বলুন, এই ভাবে ব্যবহার-শাস্ত্রের সমস্ত রীতিনীতিকে অসম্মান করবেন না।
পরিশেষে তিনি জানতে চান, আপনারা কি এদের বিচার করতে চান, না রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করতে চান? এই সময়েই সুভাষচন্দ্র প্রমুখ কংগ্রেসর যুব নেতৃত্বের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে, গান্ধী নাকি এই তিন দেশভক্ত বীরের জীবন বাঁচানাের জন্য আরউইনের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ.জি.নুরানী তার ‘দ্য ট্রেল অফ ভগৎ সিং : পলিটিক্স অফ জাসটিস’ গ্রন্থে সরকারি নথিপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, গান্ধী এই তিন দেশভক্ত বীরের জীবন বাঁচানাের জন্য কোনও প্রচেষ্টাই করেন নি।৪১ অথচ মোহাম্মদ আলি জিন্নার চেষ্টার অন্ত ছিল না ভগৎ সিংদের বাঁচাতে। কেবল মোহাম্মদ আলি জিন্নার বক্তৃতার কারণেই ভগৎ সিংরা আরও কয়েকটা দিন বেঁচে যান। যদিও ফাঁসি আটকানাে যায়নি। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী পারলে এই মহানুভবতা দেখাতে পারতেন। বিপ্লবীদের হয়ে লড়তে পারতেন!
(৭)
কিন্তু জাতীয় নেতৃত্বের স্ববিরােধী চরিত্র যতই প্রকট হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক মোহাম্মদ আলি জিন্নাও ধীরে ধীরে সরে যান ধর্মনিরপেক্ষ অখন্ড ভারতের ছত্রছায়া থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের আবেগময় আশ্রয়ে। ১৯৩৭ সালে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস এবং লীগ সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়। দুই দলের মধ্যে মােটামুটি বােঝাপােড়া ছিল যে, সম্মিলিতভাবে উভয় দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও লিগকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হবে। এই নির্বাচনে উভয় দল সম্মিলিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু খুবই দুভার্গের বিষয়, শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে জওহরলাল ও তার উত্তরপ্রদেশের কয়েকজন বংশবদ কংগ্রেসি নেতৃবর্গ লীগকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিলেন না। এর ফল হল মারাত্মক। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেছেন,
“উত্তরপ্রদেশের লিগ যেন নবজীবন পেল। ভারতবর্ষের রাজনীতির প্রত্যেক ছাত্রই জানেন যে, উত্তরপ্রদেশ থেকেই লিগ পুন সংগঠিত হয়। শ্ৰীযুক্ত মোহাম্মদ আলি জিন্না ঐ অবস্থার সুযােগ পূর্ণমাত্রায় নিলেন এবং এমন এক আক্রমণ শুরু করলেন যার পরিণামে পাকিস্তানের জন্ম হল।”৪২
এম. সি. চাগলা তার আত্মজীবনী রােজেজ ইন ডিসেম্বর’-তে লিখেছেন, উত্তরপ্রদেশ হলাে মুসলিম সংস্কৃতির পীঠস্থান যদি উত্তরপ্রদেশের মুসলমান নেতাদের জাতীয় অখণ্ডতার ভাবধারায় উজ্জীবিত করা যেত, এবং ১৯৩৭-৩৮ সালে তাদের সহযােগিতায় সে রাজ্যে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করা হতাে তাহলে হয়তাে পাকিস্তানের দাবি কখনও উঠতই না। তিনি আরও জানিয়েছেন, জওহরলাল তাকে বলেছিলেন যে, চৌধুরী খালিকুজ্জামান তাঁর (নেহরুর) সর্বোত্তম এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু অথচ এই খালিকুজ্জামানই উত্তরপ্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদিও মুসলিম জনসংখ্যা উত্তরপ্রদেশে খুবই সংখ্যালঘু ছিল, তবুও তাদের নেতাদের যদি জাতীয় কর্মধারায় সংযুক্ত করা হতাে বা যেত তা হলে তারা পাকিস্তান সমর্থন করতেন না।৪২ক
চাগলার এই সমালােচনা ও মন্তব্য অমূলক নয়। কারণ তিনি মোহাম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে তার প্রাসঙ্গিক আলােচনায় লিখেছেন যে, তিনি মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে বলেছিলেন,
“আপনি মুসলমান সংখাগুরু রাজ্যগুলাের জন্য পাকিস্তানের আন্দোলন করছেন, কিন্তু যেসব রাজ্যে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যায় খুবই সামান্য তাদের কী উপায় হবে। তিনি এ প্রণের উত্তরে যা বলেছিলেন তা আমি জীবনে কখনও ভুলব না। তিনি আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন এবং পরে বললেন, তারা নিজেরাই নিজের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাই না।”৪২খ
এই মনােভঙ্গি এবং কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠনের সিদ্ধান্তের পটভূমিতে উত্তরপ্রদেশে রাজনীতি কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে এবং কংগ্রেস নেতাদের রাষ্ট্রনীতিক অপটুত্ব কীভাবে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার একটি সুন্দর সুযােগ নষ্ট করে দিল তাও উপলব্ধি করা যাবে। ১৯৩৭ সনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য বিধানসভায় মােট সদস্য সংখ্যা ছিল ২২৮ তার মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরথিত আসন ৬৪। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৬৪-র মধ্যে ২৬টি আসন লাভ করে, কংগ্রেস সদস্য মুসলমান মাত্র ১টি, ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল পার্টি ৯ এবং বাকী আসন কটিতে জয়লাভ করেন নির্দল মুসলমান প্রার্থীরা। মন্ত্রীসভার পরামর্শ মেনে চলা হবে এবং তাদের কাজকর্মে অকারণ হস্তক্ষেপ করা হবে না, লাটসাহেবদের কাছ থেকে এইরূপ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনে সম্মত হয়। এই পরিস্থিতিতে, যখন মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রবলভাবে সােচ্চার হয়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানের দাবি নিছক বালখিল্যদের কল্পনা বলে হেসে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, তখন কংগ্রেসের নীতি নির্ধারকদের অত্যন্ত সতর্কতা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে নীতি প্রণয়ন করা কর্তব্য ছিল—যাতে ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদকে নিয়ন্ত্রণে। রাখা এবং পরিণামে সহৃদয়তা দিয়ে সম্পূর্ণ জয় করা যায়। দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা, অন্য অর্থে দেশ সেবার পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ হলাে, দেশের অখণ্ডতা বজায় ও সমগ্র জনসমষ্টির সামাজিক কল্যাণ-বৈষয়িক সমৃদ্ধি।
এখানে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি তথা কূটনীতি সম্পর্কে কিছু কথা স্মরণ রাখা প্রয়ােজন। ভারতবর্ষ এবং চীনের প্রাচীন ঋষিরা নির্দেশ দিয়েছেন, কাম্য জিনিসকে পেতে হলে তার উল্টো দিক থেকে কাজ শুরু করা উচিত, তার অর্থ কোন জিনিসকে ছােট করতে হলে প্রথমে তাকে বড়াে করতে হবে, প্রত্যাখ্যান করতে হলে মাথায় তুলতে হবে আগে। এই তত্ত্বজ্ঞানে যাঁরা শক্তিশালী তাঁদের অভিমত, যদি তুমি দাঁড়াতে চাও তাে প্রথমে ভেঙে পড়াে, যদি পূর্ণ হতে চাও তাে শূন্য হও, যদি নবীন হতে চাও তাে শ্রান্ত হও।’ বৈপরীত্যের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সার্থকতার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই নীতিতে স্থিত থেকে যদি জওহরলাল এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতা উত্তরপ্রদেশের মুসলিম লীগের দাবিদাওয়ার প্রতি নজর দিতেন, শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল হতেন, তাহলে লীগের প্রতিরােধ জয় করা সম্ভব হলেও হতে পারত।
কংগ্রেস নেতাগণ কৌশলগত ভুল করলেন মারাত্মক। উচিত ছিল মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করা। এই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল সাফল্যমন্ডিত হবার প্রবল সম্ভাবনাও ছিল। জওহরলাল এবং লীগের নেতা খালিকউজ-জামান পারস্পরিক প্রীতি ও বন্ধুতার বন্ধনে ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তাছাড়া উভয় দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রায় একই ধরনের জনকল্যাণকর কার্যসূচির কথা ঘােষণা করা হয়েছিল। এমন কি বহু ক্ষেত্রে একই মঞ্চ থেকে নির্বাচনী প্রচারও চালানাে হয়েছিল। অন্য কথায়, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সহযােগিতার পথে কোনও প্রতিবন্ধকতাই ছিল না। লােকাচার আর বাস্তব অভিজ্ঞতা তাে একথাও বলে, ক্ষমতার আসনে বসে জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের মােহ ও আনন্দ এবং এর আনুষঙ্গিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নমনীয় করে, পারস্পরিক সহযােগিতা উপলব্ধির বিস্তার ঘটায়। অনুভব ও যুক্তিনির্ভর মানসিকতাকে প্রসারিত করে। এই ব্যবহারিক জ্ঞানকে ভিত্তি করে অনায়াসেই মুসলিম লীগের বিধায়কদের শাসন ক্ষমতায় অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান করা যেত এবং তাঁদের দৃষ্টিপথে বৃহত্তর মহত্তর কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতিও উন্মােচন করা যেত। এই কর্মপন্থা গ্রহণ করলে অন্তত ইতিহাসের কাঠগড়ায় আজ আসামীর ভূমিকায় দাঁড়াতে হতাে না জওহরলাল এবং সংক্ষিষ্ট কংগ্রেস নেতাদের।
কিন্তু কংগ্রেস নেতাগণ অত্যন্ত কঠোর ও অনমনীয় একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আজ যাকে অপরিণামদর্শী ছাড়া অন্য কোনও নামে চিহ্নিত করা যায় না। বলা হল, একমাত্র কংগ্রেস দলভুক্ত মুসলমান সদস্যদেরই মন্ত্রীসভায় গ্রহণ করা হবে আরও ঘােষণা করা হল, যদি কোনও লীগ সদস্য মন্ত্রীসভার অন্তর্ভুক্ত হতে চান তাহলে তাঁকে নিজের দল ত্যাগ করে কংগ্রেসের প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে এবং সেভাবে কংগ্রেসের সদস্য হতে হবে। ক্ষমতায় বসা না-বসা অন্যদের গ্রহণ করা না-করা ইত্যাদি চিন্তাধারার কলরব চলার সময় জওহরলাল নাকি এমন মন্তব্যও করে বসেছিলেন, ‘দেশে মাত্র, দুটি দলই আছে—একটি কংগ্রেস এবং অপরটি ব্রিটিশ সরকার’।৪৩ এমন একটি ভাবাবেগতাড়িত হঠকারী মন্তব্য যে কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকে নির্গত হওয়া উচিত ছিল না, যে কোনও মানুষই তা স্বীকার করবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় অন্যান্য দলগুলােকে উত্তেজিত করার পক্ষে এই একটি মন্তব্যই যথেষ্ট—বিশেষত মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে, যাঁদের ধমনীতে শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত বাদশাহী মেজাজ ও রক্ত প্রবাহিত। এই উন্নাসিক অবজ্ঞা যদি তাঁদের বিচ্ছিন্নতার পথে উৎসাহিত করে থাকে তাে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
(৮)
শুধু কি তাই, কংগ্রেসের তরফ থেকে তখন প্রচার করা হতে থাকে, রাজনৈতিক ক্ষমতা, এর সমস্ত পৃষ্ঠপােষকতা ও প্রভাবসহ বর্তমানে কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত এবং সেখানেই থাকবে। কংগ্রেসের এ যাবৎ অনুসৃত নীতি অনুযায়ী কংগ্রেস মুসলমান সংখ্যালঘুদের মন্ত্রীপদ থেকে আরম্ভ করে নিম্ন পর্যায়ের পদে অংশীদার করবে, কিন্তু কংগ্রেসী মুসলমান ছাড়া অন্য কাউকে এই সুযােগ দেওয়া হবে এটা প্রত্যাশা করা যায় না। সুতরাং একজন মুসলমানের পক্ষে লীগের সদস্য থাকার অর্থ যাবজ্জীবন নিঃসঙ্গ জংলায় নির্বাসিত থাকার সামিল। সে অন্য পথ বেছে নিক, এবং দরজা খােলা থাকতে থাকতে এখুনি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পুরােপুরি কংগ্রেসী বলে পরিচিত হতে যদি তার আপত্তি থেকে থাকে তাে সে কংগ্রেসের সহযােগী কোন দলের—যেমন আহরার সদস্য হােক, যারা লীগের বিরােধী এবং যারা কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।৪৪ কংগ্রেস নেতাদের আত্মবিধাস এবং অহমিকা প্রায় আকাশস্পর্শী হয়ে উঠেছিল।
অরবিন্দ পােদ্দার এ প্রসঙ্গে একটি কৌতুককর স্মৃতিচারণার উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায় ও “স্বাধীনতা লাভের অল্প কয়েক বছর বাদে একদিন সন্ধ্যায় ইন্ডিয়ানা’য় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর সঙ্গে কিছুক্ষণ সরস আড্ডায় বসার সুযােগ হয়েছিল। তিনি সমবেত লিখিয়েদের প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তান কে করেছে? অন্যদের সমবেত উত্তর ছিল, কে আবার? মোহাম্মদ আলি জিন্না এবং তাঁর মুসলীম লীগ। অচিন্ত্যবাবু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বলেছিলেন, না, মোহাম্মদ আলি জিন্না বা মুসলমানরা নয়, পাকিস্তান করেছে হিন্দুরা। আলােচনায় এটা প্রকট হয়েছিল, হিন্দুদের হাতে মুসলমানরা এ যাবৎ যে সামাজিক লাঞ্ছনা ভােগ করে আসছে, মানবিক অধিকার থেকে যেভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছে, পেয়েছে অবজ্ঞা আর ঘৃণা, তারই পুঞ্জীভূত মেঘ সামাজিক রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে আজ ঝড়ের দাপটে আছড়ে পড়েছে বিচ্ছিন্নতার দাবি নিয়ে, চেয়েছে হিন্দু সামাজিক বিধায়কদের স্বৈরাচার থেকে মুক্তি। এই বিচারে ইতিহাসের কালে সংঘটিত হিন্দুদের সামাজিক আচরণই পাকিস্তানের জন্য দায়ী। এই যুক্তি রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রসারিত করলে এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, জওহরলালের ঔদ্ধতা, অদূরদর্শিতা এবং ব্যবহারিক প্রতারণাই মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে বিচ্ছিন্নতার অপ্রতিরােধ্য পথে ঠেলে দিয়েছে। অন্য কথায়, পরােক্ষ ভাবে জওহরলালই পাকিস্তানের জনক।”৪৫
শুধু উত্তরপ্রদেশে নয়, বােম্বায়েও কংগ্রেস নেতারা বির্বাস ভঙ্গের নীতি অনুসরণ করলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্না তখন বি জি খের মারফত গান্ধীকে একটি বার্তা পাঠান ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করতে। গান্ধী সেই আবেদন অগ্রাহ্য করেন। তাতেও নিরাশ না হয়ে মোহাম্মদ আলি জিন্না গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষৎ করতে চান ব্যাপারটি নিয়ে আলােচনা করতে। গান্ধীজি তাও অগ্রাহ্য করে মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে আজাদের সঙ্গে আলােচনা করতে বলেন। অপমানিত মোহাম্মদ আলি জিন্না আর আবেদন-নিবেদন না করে লখনউ-এ লীগের বার্ষিক অধিবেশন ডেকে ঘােষণা করেন যে, কংগ্রেস দেশ শাসনের অধিকার থেকে মুসলিমদের বঞ্চিত করে ভারতে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতে মুসলিমরা সেদিন তাদের ঘাের দুর্দিন আসছে বলেই বিধাস করেছিল। বাংলার ফজলুল হক ও পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খান, যাঁরা নিজ প্রদেশে লীগকে পরাস্ত করেছিলেন, তারাও লিগে যােগ দেন। ১৯৪০ সালে লাহােরে অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেই হক তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। তারপর একটানা এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্ব মানতে পারেননি।
দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরােধিতা করায় মুসলিম লীগপন্থীরা তাঁকে ‘গদ্দার’ বলতে থাকেন। তবুও সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দেন, “যারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ায় তারা ইসলামের শত্রু।” অথচ রাজাগােপালাচারি ও ভুলাভাই দেশাই মোহাম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। কংগ্রেসকে দিয়ে মানিয়ে নিতে চেয়েছেন, তা হিন্দু সংগঠন এবং মোহাম্মদ আলি জিন্নাই সকল মুসলমানের মুখপাত্র।৪৬ গদি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল গফফার খান ছাড়া সকলেই দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন।
তাছাড়া ১৯১৬ তে কংগ্রেসের সঙ্গে লীগের ‘লখনউ চুক্তি’ যখন সম্পন্ন হয় তখনও কি কেউ ভেবেছিল ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হবে? আদৌ তা মনে হয় না। অধ্যাপক মুসিরুল হাসান ‘দেশভাগ’ বিষয়ক একটি সংকলন গ্রন্থে চমৎকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। তার একটি মন্তব্য ইতিহাস-ভিত্তিক এবং অবশ্যই সমর্থনীয়। বক্তব্যটি এই,
“Inter community relations too were not greatly strained untill the post Khilafat and Non-Cooperation days. If anything, the lines of cleavage in North India were more sharply drawn between the Sunnis and the Shias than between Hindus and Muslims.”৪৭
লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের উদ্যোগে এবং মূলত ইতিহাসবিদ সিরিল হেনরি ফিলিপস-এর উৎসাহে যে আন্তর্জাতিক আলােচনাচত্র হয়েছিল, তা ১৯৭০-এ প্রকাশিত হয়েছিল ডঃ ফিলিপস্ এবং কুমারী মেরী ডােরিন ওয়েনরাইটের সম্পাদনায় ‘The Partition of India : Policies and Perspectives 1935-1947’ শিরােনামে।
বিশাল ঐ গ্রন্থে মাহমুদাবাদের রাজার স্মৃতিচারণ’ (‘Some Memories’) বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এখানে তিনি যা বলেছেন তাতে সত্যতা আছে বলেই মনে হয়। বক্তব্যটি এই—
“It is perhaps not fully realized that the Muslim League between 1937-47 was the first purely political movement of the Indian Muslims. Not only were Sir Syed Ahmed Khan’s effort concentrated on the educational and cultural improvement of the Muslims, but he went further and actually discouraged them from active political participation. The first Muslim mass movement was that of the Khilafat and it was predominantly religious in character though the politicians ran it. It was only after the rebirth of the League in 1937 that the Muslim masses awoke to political consciousness. Three factors helped to develop and sharpen this consciousness. One was the Congress attitude of indifference and, at times, hostality. Another was the leadership which, under Jinnah, broke new ground and fashioned new political strategy. Still another was the part played by religious appeal in the heightening of this consciousness. The leadership at the top was generally secular-minded and trained in political methods, but on the lower-levels and especially among the field workers propoganda on religious lines was the general practice.”
তাই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয় ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭-এর মধ্যে সমাজের নিচের তলায় ধর্মীয় আবেগ তথা সাম্প্রদায়িকতাকে সুড়সুড়ি দেওয়ার ফলেই দশ বছরের মধ্যে অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, দেশবিভাগ হয়ে পড়ল অনিবার্য।
তাহলে মােদ্দা ব্যপারটি এইভাবে বলা যেতে পারে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ঘটনার গতি কখনই এই পর্যায়ে চলে যায়নি যে ভবিষ্যতে দেশটাই ভাগ হয়ে যেতে পারে। হ্যা, স্বার্থরক্ষার কিংবা সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার নাম করে নেতৃবর্গের নিজস্ব (যার মধ্যে আবার অনেক বৈচিত্র্য আর ফারাক) স্বার্থ কায়েম রাখার চেষ্টা শতাব্দীর গােড়া থেকেই ছিল। এমনকি, মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে যেটাকে অনেক হিন্দুত্ববাদী লেখক বলার চেষ্টা করেন তাও কিন্তু রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। প্রকৃত বিচারে তা ছিল মুসলিমদের জন্য হয় ভারতের মধ্যেই স্বতন্ত্র রাজ্য বা কয়েকটি রাজ্যের সমষ্টি বা রাজ্যের পুনর্গঠন বা রাজ্যের মধ্যে সংরক্ষণ বা নিবাৰ্চনিক আসন সংরক্ষণ—যেটাই হােক, তা ভারতের মধ্যে থেকে। দেশভাগ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দশ বছরের আগে কখনওই কাম্য বলে তুলে ধরা হয়নি।
অনিতা ইন্দার সিং-এর অভিযােগ, পাকিস্তানের দাবী ওঠার পরেও কংগ্রেস ভাবতে পারেনি যে, লীগ সত্যি এ ব্যাপারে আন্তরিক, সুতরাং তাকে যথােচিত গুরুত্ব দেয়নি এবং তার মােকাবিলার জন্য কোন পাল্টা রণকৌশলও নেয়নি। এ ব্যাপারে সবটাই অবশ্য কংগ্রেসের দোষ নয়। ভারত ছাড়াে আন্দোলনের ফলে ওই সময় কংগ্রেস নেতারা ছিলেন জেলে। তাতে লীগ। ফঁকা মাঠ পেয়ে যায় (অনিতা ইন্দার সিং, ‘দ্য অরিজিনস অফ পার্টিসান অফ ইন্ডিয়া’)। অনিতা ইন্দার সিং ব্রিটিশের ওপর কংগ্রেসের অতি-নির্ভরতার কথা বলেছেন এবং আরাে বলেছেন যে, কংগ্রেসের দীর্ঘ মেয়াদী উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল তার স্বল্প মেয়াদী কৌশল। বিশেষ করে সমালােচনা করেছেন ১৯৪৬-এর নির্বাচনের পর সরকার গঠনের সিদ্ধান্তকে—
“In 1946, even more than in 1937, the acceptance of office by the Congress was its greatest tactical mistake, as it made the party the focus of popular Muslim discontent, even hatred, which eventually burst into civil war.”
(‘দ্য অরিজিনস অফ পার্টিসান অফ ইন্ডিয়া’) আর, কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা দোষের ব্যাপারটাও ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটা ঠিকই যে, হিন্দু মহাসভার মত সংগঠন আর কংগ্রেস এক নয়। বি ডি গ্রাহাম এবং অনিতা ইন্দার সিং দুজনেই এ কথাটাতে জোর দিয়েছেন। তবু এটাও তাে ঠিক যে, মদনমােহন মালব্যের মত হিন্দু মহাসভার নেতা কংগ্রেসেরও নেতা ছিলেন। বি ডি গ্রাহাম তঁার ‘দ্য কংগ্রেস অ্যান্ড হিন্দু কমিউনালিজম’-এ বলছেন, হিন্দু মহাসভাতেও হয়ত সবাই উগ্র হিন্দুত্ববাদী ছিল না—কেউ কেউ হয়ত রাষ্ট্রকে হিন্দু সম্প্রদায়ের আওতায় রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ কেউ হিন্দু ধর্মের সংরক্ষণই চেয়েছিল শুধু মদনমােহন মালব্য হয়ত দ্বিতীয় দলেই ছিলেন। কিন্তু এঁরা তাে প্রথমােক্তদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, আর কংগ্রেসও তার ফলে নিজেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিল। এতে কংগ্রেস মানেই হিন্দু এই সমীকরণ তৈরির সুযােগ পেয়ে যায় লীগ এবং লীগের এই প্রচার মুসলমানদের কংগ্রেস সম্পর্কে বিব্ধ করে। আবার উল্টো দিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কাছেও কংগ্রেস প্রায়ই এই আবেদন রাখত। পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী মেনে নেবার হেতুতেই এটা করতে হত। যেমন মুসলিম গরিষ্ঠ এলাকায় নির্বাচনে মুসলমান প্রার্থী দাঁড় করানাে অথবা নির্বাচনী প্রচারে মুসলিম প্রধান এলাকায় লীগের মতই সবুজ পতাকা ব্যবহার করা।
(৯)
আয়েষা জালালের প্রভাবে আরাে মারাত্মক সব কথা কংগ্রেস সম্পর্কে শােনা যাচ্ছে। লীগের লাহাের প্রস্তাবের সময় থেকেই নাকি দেশভাগের বাস্তব সুবিধার কথা নেহরুরা বুঝে গিয়েছিলেন এবং বুঝে সেই দিকেই এগিয়েছিলেন। বাইরে অবশ্য ঐক্যের কথাই বলে যাচ্ছিলেন। আসলে নাকি মোহাম্মদ আলি জিন্নার চালাকি তারা ধরে ফেলেছিলেন। তাই তারা চাইলেন—
“…to aim at Jinnah’s ‘Achille’s heel —his Pakistan demand, to oust him by conceding his professed and not real objective.”
নেহরু সেদিকেই এগােতে চাইছিলেন যেখানে ‘Jinnah was forced to take his Pakistan and leave the scene for good.’ আয়েষা জালালের বইটির আলােচনা প্রসঙ্গে এ কথা বলেছেন অসীম রায় তঁার ‘দ্য হাই পলিটিক্স অফ ইন্ডিয়াজ পার্টিশান রিভিজনিস্ট পারসপেকটিভ’-এ, জালালের বক্তব্যের পরিপূরক হিসেবে। আসলে মোহাম্মদ আলি জিন্নার মত নেহরুরাও একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। নেহরুর সমাজবাদের কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য হয়ত সেটা প্রয়ােজনীয় মনে হয়েছিল। প্যাটেলের কাছে হয়ত আবার শক্তিশালী কেন্দ্রের অনুষঙ্গ ছিল শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যাইহােক, শক্তিশালী কেন্দ্র ও ঐক্যের মধ্যে বেছে নেবার মত একটা পরিস্থিতি যখন লীগের দৌলতে তৈরী হল, তখন তারা দ্বিতীয়টিকে বলি দিয়ে প্রথমটিকেই বেছে নিলেন। শক্তিশালী কেন্দ্রকে সুনিশ্চিত করে মুসলিম সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানই একমাত্র উপায় বলে তাদের মনে হল। ১৯৪০-এর লহাের প্রস্তাব সম্পর্কে নেহরুর অবস্থান নাকি ছিল এইরকম—
“Pleased, not because he liked it on the contrary the considered it to be the most insane suggestion—but because it very much simplified the problem. They were now able to get rid of the demands about proportionate representation in legislatures, services, cabinets etc …[He] asserted that if people wanted such things as suggesed by the Muslim League, then one thing was clear, they and people like him could not live together in India. He would be prepared to face all consequences of it but he would not be prepared to live with such people.”
গান্ধিও তো লাহাের প্রস্তাবের পর তাকে একরকমের অনিচ্ছুক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন—
“We are at present a joint family. Any member may claim a division.”
প্যাটেলের ভাষা তাে খুবই কড়া। তিনি পচে যাওয়া অঙ্গ অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়ার সমীচীনতার কথা বলেছিলেন। তবু কি এঁরা কেউ সাগ্রহে সানন্দে মেনে নিয়েছিলেন দেশভাগ? তা নয়। নিতান্ত ঝামেলা এড়াতেই মেনেছিলেন। তাছাড়া মনের কোণে আশা ছিল—নেহরু একথা বলেছেন, আজাদও বলেছেন—দেশভাগ স্থায়ী হবে না, পাকিস্তান ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য।
সুতরাং দেশভাগের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের সুপ্রচুর আলাপ-আলােচনা থেকে শেষপর্যন্ত এটাই বােঝা গেল যে, দেশভাগ কোন দল বা কোন নেতাই ঠিক চাননি, তালেগােলে হয়ে গেছে। তাঁরা সবাই ‘dealt with each other at cross purposes’ এবং দোষের মধ্যে তারা বড় প্যাচালাে পথে চলেছিলেন। অসীম রায়ের কথায়,
“battle between Jinnah and the Congress in which both openly stood for what they did not want, said what they did not mean, and what they truly wanted was not stated publicly but only betrayed in their vital and purposive political decisions and actions.” (দ্য হাই পলিটিক্স অফ ইন্ডিয়াজ পার্টিশান রিভিজনিস্ট পারসপেকটিভ)।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ সরকারের স্টেশনারী অফিস ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিশদ বিবরণী “The Transfer of Power 1940-1947, ১২ খন্ডে প্রকাশ করে। তার প্রথম খন্ড বের হয় ১৯৭০ সালে এবং দ্বাদশ তথা শেষ খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। The Transfer of Power 1940-1947’-এর দ্বিতীয় খন্ডে তৎকালীন বিকানির রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কে এম পানিক্করের ১৯৪৫ সালের ১০ অক্টোবরের একটি স্মারকলিপি আছে—যাতে তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, পূর্বাহ্নে কংগ্রেস ও লীগের উপযুক্ত সমঝােতা না থাকলে সংবিধান পরিষদ বিফল হতে বাধ্য (…unless a procedure of bringing the parties together on some minimum basis of agreement is evolved before the Contituent assembly meets… there is some danger of the whole plane proving abortive.’)। যদি কংগ্রেস এই সাবধান বাণীকে একবছর বাদে অগ্রাহ্য না করত তাহলে দেশভাগের প্রয়ােজনীয়তাই দেখা দিত না।।
যাইহােক, ১৯৪৬-এর নিবার্চনে ১৯৩৭-এর তুলনায় লীগের প্রচন্ড সাফল্য (কেন্দ্রীয় আইনসভায় ৩০টি সংরথিত আসনের মধ্যে সব কটিতে এবং ৫০৯ টি প্রাদেশিক আসনের মধ্যে ৪৪২ টি) দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্পষ্ট এবং লীগ নেতৃত্বকে আরও বেপরােয়া করে তুলেছিল। তবুও লীগ ১৯৪৬-এ ভারত ভাগের দাবির বদলে বিভিন্ন প্রদেশকে তিনভাগে বিভক্ত করার ভিত্তিতে (ক বিভাগ, খ-বিভাগ, ও গ-বিভাগ) এক যুত্ত(রাষ্ট্রীয় অবিভক্ত ভারত গঠনের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত ছিল। কিন্তু কংগ্রেস বিশেষ করে নেহরু এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েও শেষ পর্যন্ত এই বিভাগগত বিভাজন মেনে চলার নিশ্চয়তা দিতে সম্মত না হওয়ায় ভারতকে অবিভক্তি রাখার সর্বশেষ প্রয়াসটুকুও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র পাকিস্তান গঠনের দাবিতে লীগ সূচিত ‘Direct Action’-এর পরিণতিতে ইংরেজ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ মদতপুষ্ট তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতৃত্ব নিজেকে অনন্যোপায় বলে ঘােষণা করে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ মূলত অন্ন রেখে ১৯৪৭-এ দেশভাগের বিনিময়ে কংগ্রেস ও লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
তাছাড়া ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবে যে কোনও প্রদেশের, প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তার বিভাগ থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার ছিল। কিন্তু ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে অপসারণের অধিকার ছিল না। এই ব্যবস্থায় ভারতের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব ছিল। প্রদেশগুলির সংবিধান পরিবর্তনের দাবি করার অধিকারও ছিল, তবে প্রথম দশ বছরের পর। ‘The Transfer of Power 1940-47’-এর নবম খন্ডে, ভারত ভাগের কয়েক মাস আগে (১৯৪৭-এর ১৯মার্চ) তৎকালীন ভাইসরয় ওয়াভেলের, পেথিক লরেন্সকে লেখা এক চিঠির বিবরণ পাওয়া যায়, যাতে ব্রিটিশ সাংবাদিক কলিন রীডের উল্লেখ করে ওয়াভেল লেখেন, রীড কয়েক দিন আগে মোহাম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রীডের মতে, মোহাম্মদ আলি জিন্না ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী হতে পারে, যদি কংগ্রেস দ্ব্যর্থহীনভাবে ওই পরিকল্পনাকে গ্রহণ করে। (Reed got the impression that he (Jinnah) might accept the Cabinet Mission Plan, if the Congress accepted it in unequivocal terms’.) পরে মাউন্টব্যাটেন ভারতে ভাইসরয় হয়ে এসে কংগ্রেস ও লীগকে এই প্রস্তাবে রাজী করার চেষ্টা চালান। কংগ্রেস কিন্তু লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবার থেকেও দেশভাগ করে ক্ষমতার একচ্ছত্রাধিপতি হওয়ায় বেশী আগ্রহী হয়। তাছাড়া আর জে মুরের ‘Escape from Empire’ গ্রন্থে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও মোহাম্মদ আলি জিন্নার মধ্যে ১৯৪২ সালে পত্রালাপের কথা জানা যায়। ‘পাকিস্তান’ দাবি লীগ সরকারিভাবে ১৯৪০ সালে তুললেও, ঐ পত্রালাপে নতুন ভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব ছিল মোহাম্মদ আলি জিন্নার।৪৮
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারত থেকে ব্রিটিশ শত্তি বিদায় নেবার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মোহাম্মদ আলি জিন্না ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারতের কল্পনাকে ফলবতী করবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। যাতে ভবিষ্যতে মুসলমান সম্প্রদায় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার পেয়েছিলেন সেই ১৯৪৬ এর ১৬মে তারিখের ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশন প্রস্তাব নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলি জিন্না এবং মুসলিম লীগ ভারত বিভাগকে একটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনামাত্র হিসেবে রেখেছিলেন, অবশ্যম্ভাবী বলে নয়। জওহরলাল নেহরুর একগুঁয়েমির জন্য এই মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব কার্যকরী করা যায়নি, যদি এই মন্ত্রীমিশন প্রস্তাব কংগ্রেস নেতারা আন্তরিকভাবে মেনে নিতেন, তাহলে মোহাম্মদ আলি জিন্না এবং মুসলিম লীগ হয়তাে ভারত থেকে মােটেই বিচ্ছিন্ন হতে চাইতেন না। ১২জুলাই ১৯৪২ এর হরিজনে’ লেখা গান্ধীজির একটি প্রবন্ধের উত্তরে মোহাম্মদ আলি জিন্না বলেছিলেন মুসলিম ভারতের কাছে পাকিস্তান একটি অঙ্গীকারের বস্তু …কিন্তু আপনারা একটি সম্মানজনক মীমাংসার জন্য আন্তরিকতা ও সরলতা প্রদর্শন করুন’। মোহাম্মদ আলি জিন্নার কাছে পাকিস্তানই শেষ কথা ছিল না। সুযােগ পেলে তিনি সম্মানজনক মীমাংসায় আসতে রাজি ছিলেন…কংগ্রেস নেতারা স্বার্থপরতার বশে প্রতিনিধিস্থানীয় মুসলমান নেতাদের। সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে অস্বীকার করায় মুসলমানরা বাধ্য হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাসভূমির দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।৪৯
আবুল কালাম আজাদও তার ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব (এই প্রস্তাব মেনে নিলে ভারতকে অখন্ড রাখা সম্ভব হত) পরিহার করে দেশভাগকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলার জন্য নেহরুকেই বিশেষভাবে দায়ী করেছেন।৫০ আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন,
“আজ এমন একটা অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দেশভাগের সমর্থনে আমরা হয়ে উঠেছি মোহাম্মদ আলি জিন্নারও বাড়া। জওহরলালকে আমি এই বলে সাবধান করে দিলাম যে, যদি আমরা দেশভাগে সম্মতি দিই তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। বিচারে রায় হবে যে, ভারত ভাগ করেছে মুসলিম লীগ নয়, করেছে কংগ্রেস।”৫১
১৯৪৬-এর বিভিন্ন দাঙ্গায় যদি সর্বমােট ১৫/২০ হাজার মানুষ নিহত হয়ে থাকে, তবে দেশভাগের ফলে (১৬ আগষ্ট ১৯৪৭ থেকে) অন্তত ৬ লক্ষ মানুষ দেশভাগজনিত দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিহত হয়। ২৪০০০০ মানুষ ছিন্নমূল হয়। প্রায় ৩ লক্ষ নারী অত্যাচারিত হয়। এছাড়া অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিন্ধু থেকে ৪ লক্ষ এবং পূর্ববঙ্গ থেকে ১২ লক্ষ মানুষ ভারতে প্রবেশ করে।৫২ দেশবিভাগ হলে হত্যালীলার বীভৎস প্রক্রিয়া যে চলবেই সেটা কারও অজানা ছিলনা। কাজেই দাঙ্গায় মৃত্যু সংখ্যার আধিক্য কংগ্রেসকে ভারতভাগ মেনে নিতে বাধ্য করেছিল—এ যুক্তি ধােপে টেকে না। তবে দেশভাগ না হলে সেদিন হয়ত গৃহযুদ্ধকে ঠেকানাে যেত না। বিপুল রক্তপাতও ঘটত। কিন্তু দেশের অখন্ডতা বজায় থাকত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আব্রাহাম লিঙ্কন দেশের অখন্ডতা বজায় রাখতে রক্তপাতের পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। অনেক প্রাণের বিনিময়ে দেশের অখন্ডতা তিনি রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেশভাগ করে কি রক্তপাত আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে ভারতবর্ষকে বাঁচানাে গিয়েছে? দেশ বিভাগের পর তিন তিনটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে লক্ষ লক্ষ প্রাণের আর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির বিনাশ ঘটেছে। দেশভাগ সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ ঘটায়নি বরং বৃদ্ধিই করেছে।
কিন্তু কৌতূহলােদ্দীপক বিষয় হল, ১৯৪৬-এর বিভিন্ন দাঙ্গা থামাবার জন্য ব্রিটিশ সরকার যে উপযুক্ত উদ্যোগ নেবার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে দাঙ্গার তীব্রতা বৃদ্ধির পথেই কাজ করেছিল, তা বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রমাণিত। আর কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন আলাপ আলােচনার ভিত্তিতে আপােষে ক্ষমতার মসনদ দখল করার জন্য এত ব্যস্ত ছিলেন যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাংগঠনিকভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে সেই দাঙ্গা থামাবার জন্য বা ব্রিটিশ সরকারকে প্রয়ােজনীয় পদপে নিতে বাধ্য করার জন্য মুলত কোনও পদক্ষেপ নেননি। তবে দাঙ্গা থামাতে গান্ধীজির ব্যক্তিগত উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয় ছিল। বিশেষ করে নােয়াখালির ক্ষেত্রে। কিন্তু বিহারে দাঙ্গার ক্ষেত্রে তিনি তেমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। অনেকে আশা করেছিলেন গান্ধীজি যে উদ্দেশ্যে নােয়াখালি গিয়েছিলেন সেই একই উদ্দেশ্যে বিহারে আর্ত-নিপীড়িত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসবেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সেখানে যেতে পারলেন না। মার্চের ৬ তারিখে গান্ধীজি যখন বিহারে গেলেন তখন (বিহারের দাঙ্গা শুরু হয় ১৯৪৬-এ অক্টোবরের শেষের দিকে) উন্মত্ত হিংসার বিধ্বংসী আগুন নিভে ছাই হয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক যে, পরে হলেও গান্ধীজি ও তার কর্মীরা দাঙ্গাপীড়িত বিহারে পুনর্বাসনের কাজে হাত দেবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার আক্রান্ত মানুষেরা অনেকটাই স্বস্তি পায়।
স্মত যে, সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ‘দিল্লি চলাে’ অভিযান, নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহ , উত্তাল ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদির প্রোপটে বৃটিশের পক্ষে ভারত শাসন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া শূন্য রাজকোষ নিয়ে সারা বিধা জুড়ে সাম্রাজ্যভােগ করার সামর্থ ও মানসিকতা ইংল্যান্ড হারিয়ে ফেলেছিল। তাই অন্য কোন উপায়ের সন্ধান না পেয়ে দ্বিতীয় বিযুদ্ধে সবদিক থেকে বিধ্বস্ত বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে অখন্ড ভারতকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে ভারতের স্বাধীনতা ৯ মাস এগিয়ে নিয়ে আসা হল কেন? কার চক্রান্তে বা কাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কিংবা কার বা কাদের দূরভিসন্ধিতে এমন কার্য সম্পাদন করা হল? তাছাড়া বৃটিশ সরকার যেখানে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার কথাই বলেছিলেন তখন ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে দুটি আলাদা রাষ্ট্র উদ্ভবের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া হল কেন? এক্ষেত্রে জাতীয় নেতৃত্ত্বের ভূমিকা কি সদর্থক ছিল? তারা কি আদর্শভ্রষ্ট হয়েছিলেন? কোনও ভাবে লােভের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন? অখন্ড ভারতের জন্য ৯ মাস আর অপেক্ষা করা গেল না?
(১০)
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৭-এর উত্তাল পরিস্থিতিতে লর্ড ওয়াভেলের পর ভারতে ভাইসরয় হয়ে আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। লিওনার্ড মােসলে তাঁর ‘দ্যা লাস্ট ডেজ অফ দ্যা বৃটিশ রাজ’ গ্রন্থে মাউন্টব্যাটেনকে ‘এক সুদক্ষ ফেরিওয়ালা বলেছেন। তিনি ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচনায় এই কথাটির উপর খুব বেশী জোর দিতে থাকেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হবে না, এই মুহুর্তেই, এখুনি তাঁরা ক্ষমতায় বসতে পারেন, ইংল্যান্ড ভারত শাসনের অধিকার ছেড়ে দেবে যদি ভারতীয় নেতারা ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি ডােমিনিয়নে বিভক্ত করে ক্ষমতা। ভাগাভাগি করে নিতে সম্মত থাকেন। ক্ষমতা-পিপাসু প্যাটেল-নেহেরু এতে প্রলুব্ধ হয়ে পড়েন এবং তারা মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব অনায়াসে গিলে নেন। এবার যদি গান্ধীজিকে এই দলে ম্যানেজ করা যায় তাহলে তাে কেল্লাফতে। ভারত বিভাগ সম্পর্কে গান্ধীজি একদা নিজেই বলেছিলেন, তাঁর মৃতদেহের ওপর ভারত ভাগ হবে। তিনি বললেন : ‘যতই রক্তপাত হােক, এক ইঞ্চি পাকিস্তানও আমি সমর্থন করব না। ৩রা জুন দেশবিভাগ প্রস্তাব ঘােষণার পর একজন পত্ৰলেখক গান্ধীজিকে বললেন? ‘আপনার প্রতিশ্রুতি মত এবার আমরণ অনশন আরম্ভ করে আপনি ভারত বিভাগ রােধ করুন’। গান্ধীজি বললেন, কংগ্রেস যদি পাগলের মত কাজ করে থাকে তার অর্থ এই নয় যে, আমাকে মরতে হবে। আমি যখন দেশ বিভাগে বাধা দিতে চেয়েছিলাম, তখন দেশের লােক বিভাগ চাইত না, সেই জন্য আমিও দেশ বিভাগের বিরােধী ছিলাম। এখন দেশের লােকেই বিভাগ চাইছে, আমার বাধা দেওয়া উচিত হবে না।৫৩ আগস্ট ১৯৪৭-এর প্রথম দিকে প্রখ্যাত গান্ধীবাদী নির্মলকুমার বসুর এক প্ররে উত্তরে মহাত্মা বলেছিলেন কাদের নিয়ে আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাবাে? তুমি বুঝতে পারছাে না এক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ভারতবর্ষে সমস্ত জনগণ সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে? সাম্প্রদায়িক প্রর্ম ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। তারা ক্লান্ত ও ভীত। সমগ্র জাতির এই মনােভাবকেই কংগ্রেস তুলে ধরেছে। আমি তা হলে কেমন করে তার বিরােধিতা করবাে।৫৪
আসলে গান্ধীজি সজ্ঞানেই ভারতভাগ মেনে নিয়েছিলেন। কেন তিনি ১৯৪৭ সালে ১৬ই জুন সারা ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে নিজে উপস্থিত থেকেও ভারত বিভাগ প্রস্তাবের বিরােধিতা করলেন না? কেন তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন? তিনি যদি বিরােধিতা করতেন, তা হলে ১৬ জুন কি প্রস্তাবটি পাস হতে পারত? কিন্তু আসল সময়ে তিনি ‘মৌনীবাবা’ সেজে বসলেন কেন? এমনকি সারা ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তিনি সবাইকে দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরামর্শই দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে ভারত বিভাগ প্রস্তাবের কঠোর সমালােচনা এবং তীব্র বিরােধিতা করেন চৈত্রাম গিদোয়ানী, পুরুষােত্তম দাস ট্যান্ডন, হাফিজুর রহমান, ডা.সাইফুদ্দিন কিচলু প্রমুখ নেতাগণ। ডা. কিচলু তাে বলেই বসলেন, পাকিস্তানের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থ সাম্প্রদায়িকতার নিকট জাতীয়তাবাদকে বলি দেওয়া। এই ধরনের সমালােচনা যখন তুঙ্গে তখন গান্ধীজি বক্তৃতা করতে উঠলেন, এবং তার সহজসিদ্ধ মােলায়েম ভাষায় বললেন, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তাঁদেরই প্রতিনিধি কমিটি যখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন তখন তাঁদের কর্তব্য ঐ প্রস্তাব সমর্থন করা। তিনি স্বয়ং ভারত বিভাগের বিরােধিতা করে এসেছেন, তথাপি এখন দেশ ভাগের প্রস্তাবের পক্ষে বলতে উঠেছেন কারণ পরিস্থিতি এমন যে কোনও কোনও সময় তিক্ত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়। এভাবে পাকিস্তান বিরােধিতা পাকিস্তান সমর্থনে পর্যবসিত হয়। আশ্চর্যের কথা, এই বৈঠকে গান্ধীজি কংগ্রেস কর্মীদের দেশভাগ মেনে নেওয়ার জন্যও নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
আরও অবাক লাগে, আমাদের জাতীয় নেতাদের চেয়ে ভারতবর্ষের প্রতি অধিক মমত্ববােধ প্রকাশ করে লিওনার্ড মােসলে তাঁর বইয়ে লিখতে পেরেছিলেন, এত তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেবার কোনই প্রয়ােজন ছিল না সহজেই এই বিপর্যয় এড়ানাে যেত। দরকার ছিল একটু খানি ধৈৰ্য্য, একটু সহিষ্ণুতা। সময়ের প্রভাবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় দাঙ্গা হাঙ্গামা রক্তারক্তি ইত্যাদি বন্ধ। হয়েই যেত। স্বাধীনতার জন্য এত বছর আন্দোলন করার পর মাত্র দশটা মাস অপেক্ষা করা গেল না? শুধু ভুল, ভুলের পর ভুল।
ভারতবাসী কিন্তু তখনও গান্ধীজিকে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবেই মনে করতেন। আর গান্ধীজিও সে কথা বিলক্ষণ জানতেন। আর তাই যদি হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রর্ন জাগে, তিনি জওহরলাল-প্যাটেলের কাছে নিজেকে সমর্পন না করে দেশবাসীর উদ্দেশ্য দেশভাগের বিপর্যয় ও কুফলকে তুলে ধরে দেশভাগের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের ডাক দিলেন না কেন? বিশেষত আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল গফফার খানের মত জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা যখন তার পাশে ছিলেন। সেটা করলে হয়ত দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে কয়েক বছর বিলম্ব ঘটত। আর জওহরলালদের ক্ষেত্রে দিল্লির ক্ষমতা লাভ করাও অত সহজ হত না। পরবর্তীকালে এক ব্রিটিশ ভাষ্যকারের প্রর্নের উত্তরে জওহরলালের উক্তিতেই তার ইঙ্গিত বহন করে—
“আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বয়সও হয়েছিল। আমাদের মধ্যে খুব কম লােকেরই আবার বন্দীজীবন সহ্য হত। অথচ অবিভক্তি ভারত চাইতে গেলে ওটা ছিল অপরিহার্য। পাঞ্জাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই ছিল। রােজই শুনছিলাম নরহত্যার কাহিনী। এ অবস্থায় ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ‘মুক্তির’ পথ দেখালাে। আমরা তাই মেনে নিলাম।”
তারপর গান্ধীজির প্রতি অভিযােগ করে নেহেরু বলেছিলেন “তিনি যদি বলতেন ঐ প্রস্তাব মানবে না তাহলে আমরা মানতাম না, সংগ্রামের পথই ধরতাম এবং প্রতীক্ষা করতাম। কিন্তু আমরা গ্রহণ করলাম। আমরা ভেবেছিলাম ভারতবিভাগ হবে ক্ষণস্থায়ী, পাকিস্তান আমাদের নিকট ফিরে আসতে বাধ্য হবে। কিন্তু খুনােখুনি ও কাশ্মীর আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কী রকম তিক্ত করে দিয়েছিল তা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।” ভবিষ্যৎ ভারত রূপকারের কি সুন্দর যুক্তি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কাছে দেশের স্বার্থ? ওটা তাে নিছক কেতাবি কথা!
এই নেহরুর জন্যই মাউন্টব্যাটেন কিন্তু ভারতে বড়লাট হয়ে আসতে পেরেছিলেন। শুধু ওয়াভেলের অপসারণ নয়, মাউন্টব্যাটেনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল নেহেরুরই অনুরােধে। ওয়াভেল তার দিনপঞ্জীতে ২৭শে মার্চ, ১৯৪৭-এ পরিস্কারভাবে তা উল্লেখও করেছেন।৫৫ নেহরু এই অভিযােগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু নেহরু অস্বীকার করলে কি হবে, লাপিয়ের ও কলিন্স লিখিত ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এ এই তথ্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- “পাছে মুসলিম লীগ জানতে পারে সেই জন্য সমস্ত ব্যাপারটা খুব কঠিনভাবে গােপন রাখা হয়েছিল।”৫৬ এ কথা ঐ গ্রন্থের অন্য স্থানেও বলা হয়েছে। বিমলানন্দ শাসমলের ‘ভারত কী করে ভাগ হলাে’ বইটিতেও মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুর গােপন আঁতাত নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। বিদায় নেবার পূর্বে ওয়াভেল নেহরুকে বলেছিলেন “আমি যেখানে বিফল হলাম, আমার পরবর্তী মাউন্টব্যাটেন…হয়তাে সেখানে সফল হতে পারবেন।”
মাউন্টব্যাটেন নিশ্চয় সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু সে গান্ধীজি, প্যাটেল ও নেহরুর কাছে। তিনি শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলেন ক্ষয়রােগগ্রস্ত মৃত্যুপথযাত্রী মোহাম্মদ আলি জিন্নার কাছে। “মাউন্টব্যাটেনের দুর্ভাগ্য তিনি জানতেন না, মোহাম্মদ আলি জিন্না যাঁকে বিাস করতেন, যাঁকে শেষ পর্যন্ত কথা দিয়েছিলেন, কংগ্রেস যদি ১৬ই মে-র (১৯৪৬-এর) ঘােষণা মত গ্রুপ গঠনে রাজি হয় তাহলে তিনি ভারত বিভাগ চাইবেন না, সেই সরল মানুষ সৈনিক ওয়াভেল বড়লাট প্রাসাদ থেকে চলে যাবার পর মোহাম্মদ আলি জিন্না ঠিকই করে ফেলেছিলেন, নেহরুর মনােনীত মাউন্টব্যাটেন যা বলবেন তাতে তিনি শুধু বলবেন ‘না’। ইতিহাস এটা লক্ষ করল না যে, ভারত-বিভাগ নাটকের শেষ যবনিকা পড়ে গেল সেইদিন, যেদিন জওহরলালের প্রচেষ্টায় ওয়াভেলকে নয়াদিল্লীর বড়লাট প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে হল এবং তার জায়গায় ঢুকলেন তাঁরই মনােনীত মাউন্টব্যাটেন।”৫৭
মাউন্টব্যাটেন ভারতে না এলে হয়তাে ভারত বিভাগ হতই না কিংবা এরকম লক্ষ লক্ষ লােকের মরণ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হত না। আসলে মোহাম্মদ আলি জিন্নার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে মাউন্টব্যাটেনকে আত্মসমর্পণ করতেই হল। তবে প্যাটেল কিন্তু ওয়াভেল বিদায় নেবার আগেই (১৭ ফেব্রুঃ ১৯৪৭) তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাকে পাকিস্তান করে দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হােক।
পূর্বে অবশ্য মোহাম্মদ আলি জিন্না বিখ্যাত ১৪-দফা প্রস্তাব ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী অভিজ্ঞতার আলােকে দেখা যায় যে, কংগ্রেস নেতারা এই দাবিগুলােকে অবহেলা করে ভুল করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল এই দাবির প্রস্তাবক মোহাম্মদ আলি জিন্নার ব্যক্তিগত খ্যাতি থাকলেও তাঁর পথে গণ-সমর্থন নেই। এই চিন্তাধারা ভীষণ ভুল ছিল।৫৮ পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্টের কয়েক দিন পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের সাথে গান্ধীজির মোহাম্মদ আলি জিন্নার ১৪-দফা দাবি নিয়ে আলােচনা হয়। আবুল হাশিম গান্ধীজিকে জিজ্ঞাসা করেন যে, পাকিস্তানের পরিবর্তে সেদিন যদি মোহাম্মদ আলি জিন্না তাকে পূর্বের ১৪-দফা দাবির প্রস্তাব দিত তাহলে তার সে সময়, মনােভাব কি হত? উত্তরে গান্ধীজি জানানঃ ‘আমি সাগ্রহে গ্রহণ করব। গান্ধীজির উত্তর শুনে হাশিম বলেছিলেন “মহাত্মাজি, আপনাকে তাহলে স্বীকার করতে হবে যে আপনি যখন মোহাম্মদ আলি জিন্নার ১৪-দফা দাবিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন সে সময়ে ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ আপনার দৃষ্টিগােচর হয়নি।”৫৯
আবুল হাশিমের এই মন্তব্য প্রমাণ করে দেয় যে, মোহাম্মদ আলি জিন্নার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ভবিষ্যৎ হিন্দু-মুসলিম প্রকে আলােচনার ব্যাপারে এই দাবি ছিল পথ প্রদর্শক। পক্ষপাতহীন মন নিয়ে বিচার করলে কোনও দাবিটিকেই বহুরূপাত্মক ভারতবর্ষের পটভূমিতে অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করা যায় না। ব্রিটিশ সরকার এই দাবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাইমন কমিশনের রিপাের্টে গােলটেবিল বৈঠকে, সিলেক্ট কমিটির আলােচনায় ও ১৯৩৫ সালের ভারত আইনে এই দাবিগুলি স্থান পেয়েছিল। মোহাম্মদ আলি জিন্নার চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের নীতি ‘ভারত আইনে’ স্বীকৃতি পেয়েছিল। সিন্ধুকে বােম্বাই থেকে পৃথক করা হয়েছিল এবং তাকে পৃথক রাজ্য হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। একই রকমভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বাস্তবিক পক্ষ ভবিষ্যৎ ভারত ইতিহাসে মোহাম্মদ আলি জিন্নার এই চৌদ্দ দফা দাবির ভূমিকা ছিল অনেক অর্থবহ তাতে সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কি,
“পাকিস্তানে তার (মোহাম্মদ আলি জিন্নার) বিশ্বাস ছিল না। খেলায় বাজি ধরে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা কংগ্রেসেরই কৌশলে।…ইংরেজ ভাগ করে দিয়ে গেল এটা পূর্ণ সত্য নয়। কংগ্রেস ভাগ করিয়ে নিল এটাও অনেকটা সত্য। কংগ্রেস নেতারাই গান্ধীজীকে বুঝিয়ে বাধাদানে নিবৃত্ত করেন। … তিনিই এ কাব্যের উপেক্ষিত। খান আব্দুল গফফর খান তাে বিড়ম্বিত। আমরা যেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাকেই পুরােপুরি দায়ী না করি। …মোহাম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের আত্মীয় না করে পর করে দেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের হিন্দু পুনরুজ্জীবনকামী শাখা। প্যান-ইসলামিজমের মতাে প্যান-হিন্দুইজম।”৫৯ক
উল্লেখ্য, মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্র স্থাপনের ভাবনার উদ্ভব সম্বন্ধে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক যেভাবে আলােচনা করেছেন তার একটি বিবরণ ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে-র ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মুসলিম লীগ’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যায়। শ্রী দে পাকিস্তানের করাচী থেকে প্রকাশিত ‘Hist. of the freedom Movement’ গ্রন্থ থেকে এই তথ্যগুলাে নিয়েছেন। কিন্তু শ্রীদে যা-ই বলুন না কেন, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পূর্ব থেকেই এই অবিভক্ত ভারতে শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত হিন্দু মানসিকতার একাংশেও দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ সুপ্তভাবে প্রচ্ছন্ন ছিল, যা দেশভাগের পথকে নানাভাবে প্রশস্ত করেছে। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
- ১) গভীর মানবতাবাদী রামমােহন রায় ১৮০৪ সালে ব্রিটিশ সম্রাটের কাছে তার বিখ্যাত আবেদনে (Appeal to the king in council) বলেছিলেনঃ কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসনাধীন ভারতের ‘মূল অধিবাসী’- দের পৌর ও ধর্মীয় অধিকার পদদলিত হয়েছে,—এখন ভগবৎকৃপায় সেই অত্যাচারীদের শাসনের জোয়াল উৎপাটিত হয়েছে, কাজেই প্রত্যাশা করা যায় মূল অধিবাসীরা এখন অধিকার ফিরে পাবে।৬০ এখানে স্পষ্ট যে, রামমােহন ভারতের ‘মূল অধিবাসী’— বলতে বুঝিয়েঝেন হিন্দুদের এবং হিন্দু ও মুসলমানদের স্পষ্টতই তিনি দুটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে ধর্ম ভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রাথমিক ইঙ্গিত কেউ খুঁজে পেলে তাকে কি খুব বেশী দোষ দেওয়া যাবে?৬১
- ২) ১৮১৭ সালে রামমােহন, ডেভিড হেয়ার, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হাইড ঈস্টের সহযােগিতায় ও অন্যান্য প্রভাবশালী হিন্দুদের উদ্যোগে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ। এখানে অহিন্দু ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এই সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু অবৈতনিক বিদ্যালয়, অ্যাংলাে হিন্দু স্কুল, হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়। ১৮৫৩ তে স্থাপিত হয় হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। ১৮৫৫ তে স্থাপিত হয় হিন্দু স্কুল। এখানে কেবল হিন্দু ছাত্ররাই পড়তে পারত। এই হিন্দু ও অহিন্দুর ধারণা নিশ্চয় দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রশ্রয় দেয়।
- ৩) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮২১-৫৯) ও রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৭) প্রমুখের বিভিন্ন কাব্যে ও লেখনীতে হিন্দু ও মুসলিম দ্বন্দ্ব বারবার এসেছে। তাদের রচনায় মুসলিমরা হীনভাবে চিত্রিত ও উপস্থাপিত।
- ৪) রাজনারায়ণ বসু, নবগােপাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্র নাথ, গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখের উদ্যোগ ও সহযােগিতায় ১৮৬৭-তে স্থাপিত হয় হিন্দুমেলা। এই মেলার উদ্দেশ্য ছিল—“বৎসব শেষে হিন্দুজাতিকে একত্রিত করা। আগেই স্থাপিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল পেপার’ (১৮৬৫), এরপর স্থাপিত হয় ‘জাতীয় সভা’ (১৮৭০), ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ (১৮৭২)। যে মেলা, সভা ও বিদ্যালয়ের কর্মতৎপরতা শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাকে ‘জাতীয়’ বলা যায় কিনা, সে প্রণ উঠলে নবগােপাল মিত্র তার ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ মন্তব্য করেন যে, “হিন্দু নি সন্দেহে একটি স্বতন্ত্র জাতি। কাজেই তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন সভাকে জাতীয় বলতে কোন বাধা নেই।” এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দিন উমর বলেন, “উনিশ শতকের নবগােপাল মিত্র বিশ শতকের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নার যথার্থ পূর্বসূরী।”
- ৫) স্যার সৈয়দ আহমদের পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র তার বিভিন্ন লেখায় হিন্দু-মুসলমান যে ধর্মের দিক থেকে দুই ভিন্নজাতি একথা জানাতে ভােলেন নি। (বঙ্কিম রচনাবলি, প্রবন্ধ খন্ড, প্রথম অংশ, পৃ ৩০২)। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘সীতারাম’ (১৮৮৭), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ‘আনন্দমঠ (১৮৮২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) প্রভৃতি উপন্যাসে হিন্দু, মুসলিম দুই জাতির কথা বারবার উল্লেখিত হয়েছে। তাই জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় দ্বিজাতিতত্ত্বের উৎস সম্পর্কে বলেছেন,
- “ঐতিহাসিক সত্য এই যে দ্বিজাতিতত্ত্ব এদেশে প্রথমে মুসলিমলীগ সৃষ্টি করেনি। ব্রাহ্ম সমাজের মধ্য থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্বের উৎপত্তি হয়েছিলাে, তারপর প্রথমে রাজনারায়ণ বসু এবং পরে বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারায় এবং সাহিত্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলাে।”৬২
- ৬) স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫-এ তাঁর প্রকাশিত সত্যার্থে প্রকাশ’ গ্রন্থে শুধু বেদকে অভ্রান্ত বলে ঘােষণা করলেন না, বললেন ভারতবর্ষ শুধু হিন্দুদের, মুসলমানদের নয়। ১৮৮২-এ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘গাে-হত্যা নিবারণী সভা’। ফলে মানুষের মনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে হিন্দু ও মুসলিম দুই পৃথক জাতিসত্ত্বা।
- ৭) মুসলিম লীগ সৃষ্টির অনেক আগে ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব প্রবাসী, বাঙালী নবীনচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপােষকতায় ও প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় লাহােরে ‘হিন্দুসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন তার প্রথম সম্পাদক।৬৩ তারপর ১৮৯৬-এ হিন্দু মহাসভা নামকরণ হয়। ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভা নামে সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই সংঘের মূল বক্তব্য ছিল—
- হিন্দু ও মুসলমান দুই পৃথক জাতি এবং পৃথক হিন্দু রাষ্ট্র গঠন।
- ৮) তিলকের বদ্ধমূল সংস্কার ছিল ধর্মই হল জাতি গঠনের ভিত্তি, সুতরাং হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তিনি হিন্দুত্বের আবেগে ইন্ধন যােগাবার জন্য গণপতি উৎসব (১৮৯৩) ও শিবাজী উৎসব (১৮৯৫) এর প্রচলন করেন মহারাষ্ট্রে। ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথম শিবাজী উৎসব হয় ও শিবাজীর উপাস্য ভবানী দেবীর পূজা হয়। এই সময় হিন্দুধর্মীয় উন্মাদনা ছিল লক্ষ করার মত। আসলে তিলকের জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষ হিন্দুত্ববাদ। তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমালােচনা করে মাইকেল এডওয়ার্ডস স্বীয় ‘The Last years of British India’ গ্রন্থে বলেছেন, “Tilak had been first to recognise the power of religious feeling as a weapon against the British, Jinnah learned the lesson and turned it against Congress.”
- ৯) ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতে সৃষ্টি করল দুটি জাতীয়তাবাদ—হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হল সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দুদের একাংশ নিজেদের একটা পৃথক জাতি হিসেবে গৌরববােধ করতে থাকে। হিন্দুরা আলাদা জাতি হলে মুসলমানরাও আলাদা জাতি। তাই যুক্তি দিয়ে ঘটনার পরম্পরা বিচার করে বলা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে ভারতীয় মুসলিমদের অবদান পরে যােজিত হয়, কেননা পাকিস্তানের প্রথম ভিত্তি রচিত হয় শিথিত মধ্যবিত্তদের হিন্দু জাতীয়তাবাদে।
প্রসঙ্গক্রমে মােহাম্মদ ইকবালকে নিয়ে কিছু বলা যেতে পারে। ইকবালকে ঘিরে মুসলিম সাম্প্রদায়িকদের জোরজবরদস্তি আর হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের মিথ্যা প্রচার—সেই গড্ডলিকা প্রবাহেই আজও আমরা গা ভাসিয়ে চলেছি। ইকবালকে ঘিরে এই ভুল সিদ্ধান্তগুলির ক্ষেত্রে যেমন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের-ই সাম্প্রদায়িক শক্তির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে তেমনি উপনিবেশিক ঐতিহাসিক এবং সাংবাদিকরাও ইকবাল সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা আজও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ইকবাল ভারতীয় যুক্তরাজ্যের ভিতরেই পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্থানকে নিয়ে একটি স্বায়ত্ত শাসিত রাজ্যের পক্ষে ছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর সারা ভারত মুসলীম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে এলাহাবাদে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়েও স্পষ্টভাবেই তিনি তার এই অভিমতের কথা বলেছিলেন। ইকবালের এই বক্তব্য যে মুসলমান সমাজে ও সেই সময়ে আদৌ কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি তা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় চৌধুরী খালিকুজ্জামান লিখে গেছেন। (‘পাথ ওয়ে টু পাকিস্তান’)। তিনি লিখছেন, ইকবালের এই বক্তৃতা সেই সময়ে কোনও প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করেনি এমনকী সম্মেলনের কার্যবিবরণীতেও তা লেখা হয়নি কিংবা সেটি কোনও প্রস্তাব আকারেও নেওয়া হয়নি। এর সঙ্গে পাকিস্থান ভাবনারও আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। বিষয়টিকে প্রথম গুলিয়ে দেন এডােয়ার্ড টমসন নামক এক বিশিষ্ট সমালােচক। তিনি ইকবালের বক্তৃতা সংগ্রহ ‘দ্য রিকনস্ট্রাকসন অফ রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’ (এই বইটি ১৯৩৪ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়) নামক গ্রন্থের একটি দীর্ঘ সমালােচনা লেখেন লন্ডনের বিখ্যাত অবজার্ভার’ কাগজে। সেখানে টমসন ইকবালের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের পরিকল্পনার সঙ্গে পাকিস্তান প্রস্তাবটিকে গুলিয়ে ফেলেন। সেই থেকেই সাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল—দুটি শিবিরেই ইকবালকে নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক শিবির প্রচার করতে থাকে ইকবাল তাদের বন্ধু আর প্রগতিশীল শিবির মনে করতে শুরু করে ইকবাল পাকিস্তান প্রস্তাবের অন্যতম উদগাতা।
লন্ডন অবজার্ভারের সমালােচনাটি পড়ে ইকবাল টমসনকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন পাকিস্তান পরিকল্পনার নায়ক হিসেবে আপনি আমাকে অভিহিত করেছেন। দেখুন, ‘পাকিস্তান’ কোনও অবস্থাতেই আমার পরিকল্পনা নয়। আমার বক্তৃতায় যে বিষয়টির উপরে আমি ইঙ্গিত করেছিলাম সেটি হল, একটি মুসলিম প্রদেশের সৃষ্টি করা। আমার প্রস্তাব ছিল, এটি এমন একটি অঞ্চলে করা হােক যেখানে মুসলমানদের জনসংখ্যা প্রবল রয়েছে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারতেই এই প্রদেশটি গঠিত হােক—এটাই ছিল আমার প্রস্তাব। আমার প্রস্তাব ছিল, এই নবগঠিত প্রদেশটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি অঙ্গ হবে।…পাকিস্তান প্রস্তাব পরিকল্পনার উদ্ভব কেমব্রিজে। এই পরিকল্পনার উদ্গাতারা বিশ্বাস করেন যে, আমরা মুসলমান গােলটেবিলওয়ালারা হিন্দু বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ফাঁসিকাঠে মুসলমানদের লেলিয়ে দিচ্ছি।৬৪
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা প্রথম ইকবালের মাথা থেকে আসেনি। ইকবালের ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত বক্তৃতার (১৯৩০, ২৯ ডিসেম্বর) অনেক আগে ১৯০৮ সালে লালা লাজপত রায় সম্পাদিত ‘পাঞ্জাবি’ পত্রিকায় হিন্দুদের কীভাবে দেশ গড়তে হবে তার পরিকল্পনায় বলা হয়-
“This can only be achieved by asserting purely Hindu interest, and not by an Indian propaganda. The consciousness must arise in the mind of each Hindu that he is a Hindu and not merely an Indian and when it does arise the newly awakened force is bound to bring its results.”
হিন্দুর উপর এই বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করার ফলে ভারতীয় জনগণকে অনিবার্যভাবেই মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীতে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার নীতি প্রতিষ্ঠা করা হল এবং একই সঙ্গে ভারতকে হিন্দুর দেশ, মুসলমানের দেশ প্রভৃতি নামে ভাগ করার পথ উন্মুক্ত করা হল।
সমকালে পাঞ্জাবের বণিক গােষ্ঠী ধর্মকে কীভাবে বাজারের পণ্য বানিয়ে মুসলিম মানসকে আহত করেছিল, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ আমরা পায় কেনেথ জোন্সের ‘আর্যধর্ম হিন্দু কনশাসনেস ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ইন পাঞ্জাব’ নামক গ্রন্থ থেকে। কেনেথের দেওয়া সব থেকে বড় তথ্য হল, লাজপত রায়ই ১৯২৫ সালে প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব আনেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘Struggle for Freedom’ গ্রন্থেও (পৃ ৫৩৮) এ ঘটনার উল্লেখ আছে। ‘পাঞ্জাবি’ পত্রিকাতে প্রতিনিয়ত যে ধরনের উস্কানি মূলক লেখা প্রকাশিত হয়, তা ঐ অঞ্চলের মুসলিম মানসে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা জাগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সেই বিচ্ছিন্নতার শিক্ষা পরবর্তীকালে খালিস্তানপন্থী শিখেরাই গ্রহণ করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাকিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা কোনও মুসলিম নেতা নন। এই অঞ্চলে পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে খালিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রকৃত নির্মাতা। হলেন সাম্প্রদায়িক স্বাদেশিকতার নিরিখে হিন্দু-মহাসভার অন্যতম জন্মদাতা লালা লালাদ। ‘আর্যধর্ম’ গ্রন্থে কেনেথ মন্তব্য করেছেন,
“Lal Chand’s letters marked a move from Arya Dharma to Hindu consciousness. They laid the foundation for Hindu politics, as an alternative to the “national politics of Congress.”
লালচাঁদের পরে হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা ভাই পরমানন্দও লাহােরে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার দুবছর আগে ১৯৩৮-এ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগের কথা বলেন।৬৫ শুধু তাই নয়, সাভারকরও তার রাজনীতি জীবনের শুরু থেকেই বলে আসছেন হিন্দু ও মুসলিম দুটি স্বতন্ত্র জাতি। হিন্দুস্থান শুধুই হিন্দুদের। ‘হিন্দুত্ব হু ইজ হিন্দু’ নামক পুস্তিকায় (১৯২৩) ও ‘হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন’ নামক গ্রন্থে তিনি বারবার তা বলেছেনও। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার বার্ষিক অধিবেশনে সাভারকর ‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে আসা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত’—এর কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং সেখানেও বলেছিলেন, ভারতে দুটি জাতি আছে হিন্দু ও মুসলমান। ১৯৩৮-এ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন,
‘The Hindu Muslim schism was a unpleasand fact. It could not be wished away or overcome by compromise. The only way to treat it was to recognise that all India was Hindustan, the land of Hindus, at once their father and holy land.’
এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি, হিন্দুদের জন্যে জাতীয় ভাষা দাবি করে বললেন ‘We Hindus are a nation by ourselves.’ সাভারকরের যুক্তির ধারা অনুসরণ করে মোহাম্মদ আলি জিন্না দাবি করলেন যে ভারতের মুসলিমরাও একটা জাতি। উদ্ভাবিত হল মোহাম্মদ আলি জিন্নার প্রসিদ্ধ দ্বিজাতিতত্ত্ব।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও গবেষক এ জি. নুরানি তাঁর ‘সাভারকর অ্যান্ড হিন্দুত্ব’ নামক বইতে তাই সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, মোহাম্মদ আলি জিন্না তাঁর বিষাক্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করা শুরু করেন ১৯৩৯ সালে ও ১৯৪০ সালে ভারতভাগের দাবি তােলেন। কিন্তু একই দাবি সাভারকর তুলেছিলেন দেড় দশক আগে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সাভারকর ছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নার পূর্বসূরী। সারা বিধা জুড়ে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন চলছে। নতুন হাওয়া উঠছে মজ্জাগত বিশ্বাস ও সেকেলে ভাবনা-চিন্তাকে খড়কুটোর মতাে উড়িয়ে নিতে যেতে। এদেশের পাঠ্য ও মননে তাই নতুন বিতর্ক উঠুক, শত চিন্তা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক। এভাবেই উন্মােচিত হবে প্রকৃত ইতিহাসের স্বরূপ।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. জয়া চ্যাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশান ১৯৩২-১৯৪৭, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৯৫, পৃ. ২৬৪-২৬৫।।
- ২. মুশিরুল হাসান, লিগ্যাসি অব আ ডিভাইডেড নেশন ইন্ডিয়াজ মুসলিমস সিন্স ইন্ডিপেন্ডেন্স, কলােরাডাে, ওয়েস্ট ভিউ প্রেস, ১৯৯৭।
- ৩. আগা খান, মেমােয়ার্স, ক্যাসেল অ্যান্ড কোম্পানী লিমিটেড, লন্ডন, ১৯৫৪, পৃ-১২১-১২৩।
- ৪. আফজল ইকবাল, ইসলামিজেশান অফ পাকিস্তান, ইদারাহ-ই-অদাবিয়ৎ-ই-দিল্লী, দিল্লী, ১৯৮৪, পৃ.২৫।
- ৫. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহাম্মদ আলি জিন্না পাকিস্তান—নতুন ভাবনা, মিত্র ও ঘােষ, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ৭-৮।
- ৬. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ.৪।
- ৭. বিক্রমাদিত্য, স্বাধীনতার অজানা কথা, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ.৯৬।
- ৮. রাজা অফ মাহমুদাবাদ, সাম মেমােরিজ দ্য পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৮৪, পৃ ৭৯।
- ৯. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩।
- ১০. স্ট্যানলি ওলপার্ট, মোহাম্মদ আলি জিন্না অফ পাকিস্তান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৮৪, পৃ. ৩৩৯।
- ১১. জওহরলাল নেহেরু, দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া, দিল্লী, পৃ. ৩৮৬।
- ১২. এ. জি. নুরানি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৭ নভেঃ ১৯৮৮, পৃ. ৫।
- ১৩. স্ট্যানলি ওলপার্ট, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪।
- ১৪. কালেক্টেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গান্ধী, খন্ড-১৩, নিউ দিল্লী, পৃ. ৯।
- ১৫. স্ট্যানলি ওলপার্ট, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮।
- ১৬. মধু লিমায়ে, ‘Jinnah the Liberal, Sunday, October 1983.
- ১৭. এম এইচ সৈয়দ, মহম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না, আসরাফ পাবলিকেশন, লাহাের, ১৯৪৫, পৃ ৪৩২-৩৫।
- ১৮. মাইকেল এডওয়ার্ডস, নেহেরু, দিল্লী, ১৯৮৭, পৃ ৭৩।
- ১৯. এম সি চাগলা, রােজেজ ইন ডিসেম্বর অ্যান অটোবায়ােগ্রাফি, ভারতীয় বিদ্যাভবন, মুম্বাই, ১৯৯০,পৃ. ৭৮।
- ২০. রমেশচন্দ্র মজুমদার, হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট, ৪র্থ খন্ড, অষ্টম অধ্যায়, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫।
- ২১. গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, অবিস্মরণীয়, ২য় খন্ড, কলকাতা, পৃ. ৫।।
- ২২. P.C. Joshi, “For the Final Bid for Power”, P.27.
- ২৩. এম এইচ সৈয়দ, মহম্মদ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না, আসরাফ পাবলিকেশন, লাহাের, ১৯৪৫, পৃ ৮৭৬।
- ২৪. কালেক্টেড ওয়ার্কস অফ কায়েদে আজম মহঃ আলি মোহাম্মদ আলি জিন্না, সম্পা. পীরজাদা, প্রথম খন্ড, করাচি, পৃ. ২৮৩।
- ২৫. যাদুগােপাল মুখােপাধ্যায়, বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃ. ৪৯২।
- ২৬. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনকথা, কলকাতা, ১৩৮১, পৃ. ১১০।
- ২৭. গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, অবিস্মরণীয়, ২য় খন্ড, কলকাতা, পৃ. ৬।
- ২৮. লিওনার্ড মােসলে, দ্য লাস্ট ডেজ অফ দ্য ব্রিটিশ রাজ, জয়কো পাবলিশিং হাউস, মুম্বাই, ১৯৭১, পৃ. ৭৭ জয়াকার, দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ, ১ম খন্ড, এশিয়া পাবলিশিং হাউস, মুম্বাই, ১৯৫৮, পৃ. ৪০৬।
- ২৯. লিওনার্ড মােসলে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।
- ৩০. এম কুরেশি, মোহাম্মদ আলি জিন্না অ্যান্ড দি মেকিং নেশান, লাহাের, ১৯৬৯, পৃ.৩৮।
- ৩১. দুর্গাদাস, ইন্ডিয়া ফ্রম কার্জন টু নেহেরু অ্যান্ড আফটার, কলকাতা, পৃ. ৭৬।
- ৩২. এম সি চাগলা, প্রাগুক্ত, পৃ.৭৯-৮০।
- ৩৩. এম সি চাগলা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।
- ৩৪. এম সি চাগলা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২১।
- ৩৫. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪-০৬-১৯৮১।
- ৩৬. বসন্ত টি কৃপালনী, মোহাম্মদ আলি জিন্না’স লাস্ট লিগাল ব্যাটল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৭-০৩-১৯৮৩।
- ৩৭. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫-৬।
- ৩৮. বসন্ত টি কৃপালনী, প্রাগুক্ত, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৭-০৩-১৯৮৩।
- ৩৯. হেক্টর বলিথাে, মোহাম্মদ আলি জিন্না—দ্য ক্রিয়েটার অফ পাকিস্তান, জন মারে প্রা লিমিটেড, লন্ডন, ১৯৫৪, পৃ.৯৫।
- ৪০. A.G. Noorani, Jinnah before Pakistan’, The Statesman, 03-09-1994.
- ৪১. সি. আর. ইরানী, ‘ডােনেটেড টু ইন্ডিয়া’, দ্য স্টেটসম্যান, ১২ ই জুলাই ১৯৯৬।
- ৪২. আবুল কালাম আজাদ, ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম, বাংলা সংস্করণ, অনুবাদ- সুভাষ মুখােপাধ্যায়, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ ১৫৬।
- ৪২ক. এম সি চাগলা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২।
- ৪২খ. এম সি চাগলা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০।
- ৪৩. রমেশচন্দ্র মজুমদার, হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট, ৪র্থ খন্ড, অষ্টম অধ্যায়, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, পৃ. ৫৬৩।
- ৪৪. স্যার রেজিন্যাল্ড কূপল্যান্ডের গ্রন্থ ‘দ্য কনস্টিটিউশন্যাল প্রবলেম ইন ইন্ডিয়া থেকে এই অংশটি উদ্ধার করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, দ্রঃ- রমেশচন্দ্র মজুমদার, হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট, ৪র্থ খন্ড, অষ্টম অধ্যায়।
- ৪৫. অরবিন্দ পােদ্দার, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার শত্রুরা, প্রত্যয়, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৮৫-৮৬।
- ৪৬. অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস, কলকাতা, পৃ ৫২।
- ৪৭. মুশিরুল হাসান (সম্পা.), ইন্ডিয়াজ পার্টিশন প্রসেস, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড মােবিলাইজেশন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লী, ১৯৯৩, পৃ ৫।
- ৪৮. A.G. Noorani, “Jinnah Before Pakistan’, The Statesman 03-09-1994.
- ৪৯. বিমলানন্দ শাসমল, ভারত কী করে ভাগ হলাে, হিন্দুস্থান বুক সার্ভিস, কলকাতা, ১৯৯১,পৃ ১৬৭-১৬৮।
- ৫০. আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ ১৮৪।
- ৫১. আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ ১৮৫।
- ৫২. রমেশচন্দ্র মজুমদার, হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট, খন্ড-৩, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, পৃ. ৬৭৯।
- ৫৩. বিমলানন্দ শাসমল, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯।
- ৫৪. নির্মলকুমার বসু, লেকচারস অন গান্ধীজম, আহমেদাবাদ, ১৯৭১, পৃ.১১১।
- ৫৫. পেন্ডেরাল মুন (সম্পা.), ওয়াভেল দ্য ভাইসরয়েজ জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, লন্ডন, ১৯৮৩, পৃ ৪৩৩।
- ৫৬. ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়ের, ফ্রিডম অ্যাট মিড নাইট, বিকাশ পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লী, ১৯৮৫, পৃ ৮।
- ৫৭. দ্রঃ-বিমলানন্দ শাসমল, প্রাগুক্ত, পৃ ১৫৭।
- ৫৮. আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩-০৬-১৯৯৩।।
- ৫৯. আবুল হাসিম, আমার জীবন ও বিভাগ-পূর্ব বাংলাদেশেরাজনীতি, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ ১৪৫।
- ৫৯ক. অন্নদাশঙ্কর রায়, ভূমিকা দ্রষ্টব্য—শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত।
- ৬০. রামমােহন রচনাবলি, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৩৮৭,পৃ ৫০৮-৫০৯।
- ৬১. দীপঙ্কর চক্রবর্তী, বাংলার রেনেসাঁ ও রামমােহন, অনীক, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ ৫৩।
- ৬২. জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকল্প নবজাগরণ, ন্যাশানাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ১০০।
- ৬৩. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, কলকাতা, পৃ ২৪৫।
- ৬৪. মজাফফর হুসেন বারনি, ইকবাল, অনুবাদ-দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য একাডেমি, দিল্লী, ১৯৯৮ পৃ. ১৩৭।
- ৬৫. Asgar Ali Engineer, Communalism in India, 1991, P. 83.
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।