বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে নালন্দা বিবিদ্যালয়েও যেসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত সেগুলি সে যুগের প্রায় সমগ্র জ্ঞান পরিধিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ, ধর্মীয়-লৌকিক, দার্শনিক-ব্যবহারিক, বিজ্ঞান-কলা প্রভৃতি সকল জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল—চতুর্বেদ, বৌদ্ধ হীনযান পুস্তক, মহাযান ও অষ্টাদশ শাখার (মহাসাঙিঘক ৭ ও থেরবাদী ১১) তত্ত্বনিচয়, হেতুবিদ্যা বা ন্যায়শাস্ত্র, শব্দবিদ্যা বা ব্যাকরণ, রসায়ন শাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, যাদুবিদ্যা, যােগশাস্ত্র, সাংখ্য, সংস্কৃত, পাণিনি, জ্যোতিষ্ক বিদ্যা, ব্যবহারিক শাস্ত্র, শিল্পস্থানবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, তান্ত্রিক বৌদ্ধশাস্ত্র প্রভৃতি। মহাযানবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অঘােষের (২য়) ভূততত্ত্ব, নাগবােধির মন্ত্রনও পড়ানাে হত। হিউয়েন সাঙ ও ইৎসিংয়ের বর্ণনায় নালন্দার পাঠ্যসূচির বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। পণ্ডিতগণ কুড়িটি বৃহৎ সূত্র-সংগ্রহের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করতে পারতেন। প্রায় পাঁচশাে পণ্ডিত এরূপ ত্রিশটি সংগ্রহের ব্যাখ্যা জানতেন এবং অন্তত দশজন পণ্ডিত পঞ্চাশটি সূত্র-সংগ্রহের ব্যাখ্যায় সুনিপুণ ছিলেন। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন,
“এখানে সকল মহাযানী শাস্ত্র, ১৮টি হীনযান মতধারার সব শাস্ত্র, বেদ ও অন্যান্য ধ্রুপদী সাহিত্য শিক্ষার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া ছিল ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, অংকশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্র। শিার্থী ভিক্ষুদের মধ্যে এক হাজার জন ২০টি শাস্ত্র, ৫০০ জন ৩০টি শাস্ত্র এবং দশ জন ৫০টি শাস্ত্র রপ্ত করতে সমর্থ হন। এক মাত্র আচার্য শীলভদ্র সকল শাস্ত্র আয়ত্ত করে সকলের অবিসংবাদিত মহাগুরু বা আচাৰ্য্য হয়েছিলেন।”৫২
অমলানন্দ ঘােষের ‘নালন্দা’ গ্রন্থ হতে জানা যায়, নালন্দা খননের ফলে অনুমান হয় যে, ৬ নং বিহারের উপরতলার প্রাঙ্গণে যে উনানগুলি দেখা যেত তাতে ছাত্রদের রসায়নবিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল।৫৩ ১৩ নং চৈত্যের উত্তরে যে উনানগুলি ছিল তা ধাতু গলাবার জন্য ব্যবহৃত হত।৫৪ কিন্তু ওই যুগের বিশেষ কোনাে ধাতু নির্মিত দ্রব্য পাওয়া যায়নি।
পাঠ্যসূচিতে চিকিৎসাবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি দুর্ভাগ্যক্রমে লাভজনক হয়নি। কেননা এর ফলে চিকিৎসাশাস্ত্র ক্রমশ তত্ত্বনির্ভর হয়ে পড়ল, সেজন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনাে উন্নতি হতে পারেনি। এযুগের প্রধান চিকিৎসাশাস্ত্র ছিল আগের যুগের বইগুলিরই সংকলন। নতুন কোনাে অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায় না। তবু এর মধ্যেও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এযুগে পশু চিকিৎসা সম্পর্কে বই লেখা হল প্রথম। প্রধানত সেনাবাহিনীর সুবিধার্থে ঘােড়া ও হাতির চিকিৎসা সম্পর্কে বই বেরােলাে। ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা পশ্চিম জগতেও ছড়িয়ে পড়ল এবং পশ্চিম এশিয়ার চিকিৎসকদের কৌতুহল জাগ্রত করল। ষষ্ঠ শতকে অন্যান্য অনেকের মধ্যে একজন পারস্যদেশীয় চিকিৎসকও ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে আসেন।
নালন্দার শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের (ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্র) আলােচনা ও বিতর্কের ব্যবস্থা থাকায় শিক্ষণীয় বিষয়ে উপলব্ধির উপরেই বেশি জোর দেওয়া হত। আবৃত্তির উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হত। মৌলিক প্রবন্ধাদি রচনায় নালন্দা-পদ্ধতি বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছিল। বক্তৃতা-অভ্যাসের উপরে বেশি জোর দেওয়া হত। নালন্দায় দৈনিক একশােটি বক্তৃতার ব্যবস্থা ছিল একশাে বিষয়বস্তুর উপরে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্রকে দর্শনের সকল শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হত। এবং সেইসঙ্গে তাকে বৌদ্ধধর্মের সপথে যুক্তি দর্শিয়ে অন্যান্য মত খণ্ডন করতে হত। পঠনপাঠনের জন্য আট টি বৃহৎ হলঘর এবং তিনশাে করে বর্ণনা ইৎ-সিংয়ের লেখায় পাওয়া যায়। নালন্দায় উপযুক্ত পরীক্ষার পরে উপাধিদানের ব্যবস্থা ছিল। মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের রীতিও প্রচলিত ছিল। তবে পরীক্ষণীয় বিষয়সমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ছাত্রের বিদ্যাদান দাতা বিশেষ করে বিহার ‘প্রধান কুলপতি’ আখ্যা পেতেন বেদবিহিত জ্ঞানভাস্বর ব্যক্তির উপাধি ছিল ‘পণ্ডিত’।
নালন্দায় ছাত্রগণ বিনাব্যয়ে অধ্যয়ন করত। অর্থাৎ নালন্দায় শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। নালন্দার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির আয়েতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হত। জীবন ধারণের জন্য চারটি মৌল প্রয়ােজন—যথা খাদ্য, বস্ত্র, শয্যা ও ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হত। জীবনযাত্রার মান ভিক্ষু, গণের দ্বারা বিভিন্নভাবে স্থিরীকৃত হত। হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় নালন্দায় থাকাকালীন তার দৈনিক খাদ্যের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সেকালে মগধে উৎপন্ন মহাশালী ‘তন্তুল’ রাজপরিবার ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ব্যতীত সাধারণের ভাগ্যে জুটত না। হিউয়েন সাঙ দৈনিক ১ পেক বা ৭ ছটাক মহাশালী ‘তন্তুল’ নিজের আহারের জন্য পেতেন। তাছাড়া বিশটি বাদাম জাতীয় ফল, এক আউন্স কন্টুর এবং প্রচুর দুগ্ধ-মাখন পেতেন। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন,
“তাকে অতি উৎকৃষ্ট চালের ভাত সহ অন্যান্য খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হতাে। ভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন দুধ, মাখন ও যা প্রয়ােজন তা নিতে পারতেন। তার পরিচর্যার জন্য এক ভৃত্য ও এক ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করা হয়। তাকে বিহারের দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।”৫৫
যাইহােক, এই খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য রসদ ছাড়াও হিউয়েন সাঙকে প্রতি মাসে তার প্রয়ােজন অনুযায়ী অন্যান্য দ্রব্য ও উপহার দেওয়া হত। জীবন ধারণের জন্য উল্লেখিত প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা না থাকায় শিক্ষার্থীগণ সর্বান্তকরণে অধ্যয়ন ও আত্মশুদ্ধিতে মনােনিবেশ করতে পারত। তারা তাদের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যে পূর্ণতায় পৌঁছতে পেরেছিল তার উৎস ছিল এটাই। ইৎ-সিং এর লেখাতে এ বিষয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য রয়েছে।
নালন্দায় স্নাতকোত্তর স্তরের বিশেষীকরণের শিক্ষা দেওয়া হত। ভর্তির বয়স ছিল কুড়ি বছর। তবে নালন্দায় প্রবেশাধিকার পাওয়া সহজ ছিল না। নালন্দায় প্রবেশিকা পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন ছিল, সেই পরীক্ষায় নালন্দায় অধ্যয়নের মতােই কঠিন ছিল। প্রথম ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্য লাভের তুলনায় অকৃতকার্যের শতকরা অনুপাত অনেক বেশী ছিল। হিউয়েন সাঙ বলেছেন, শতকরা বিশ ভাগ ছাত্র এই পরীক্ষায় কৃতকার্য হত। তাছাড়া দ্বারপণ্ডিতের কাছে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত। তা সত্ত্বেও সমগ্র ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বহির্ভারত থেকে শিক্ষার্থীরা আসত নালন্দার দিকে, ছাত্রের অভাব হত না। উচ্চমানের নৈতিক শিক্ষা। ছিল বলেই নালন্দার শিক্ষার্থীগণ উত্তর-জীবনে প্রসিদ্ধি অর্জন করত। বৌদ্ধ মঠে শিক্ষাকাল ছিল ১০ বছর, তবে কোনাে ছাত্র সন্ন্যাসী হতে চাইলে তার শিক্ষা সমাপ্ত করতে আরও সময় লাগত। ইৎ-সিং বলেছেন, ১৫ বছর বয়সের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হত, তবে সেক্ষেত্রে পাঁচ বছর লাগত বিশেষ প্রস্তুতি পাঠের জন্য। ১৫ বছরে বৃত্তি-সূত্র পাঠ করতে হত যা শেষ হত ২০ বছর বয়সে। তারপর সে দুই অথবা তিন বছরের জন্য দর্শন পড়ত নালন্দায়। একইসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, এত বেশি বয়সে ভর্তি হওয়া যেত শুধুমাত্র নালন্দার স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ও একমাত্র অগ্রবর্তী এবং বহিরাগত শিক্ষার্থীদেরই গ্রহণ করা হত। নালন্দার অধীনে মাধ্যমিক শিক্ষাবিভাগও ছিল, নিয়মিত অভ্যন্তরীণ শিক্ষার্থীদের জন্য যাঁদের উপর উল্লেখিত পরীক্ষাগুলি প্রয়ােগ করা হত না। নবীন বালক শিার্থীদের ভর্তি করা হত, এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ব্রহ্মচারী।
নালন্দায় অধ্যয়ন স্থানে প্রত্যহ বিদ্যার্থীরা বিলম্ব না করে উপস্থিত হত। নালন্দায় যাঁরা থাকতেন তারা সকলেই স্বভাবত এখানকার গাম্ভীর্য ও সম্ভ্রম রক্ষা করতেন। দেশের রাজা এদের ভক্তি এবং সম্মান করতেন। আর নালন্দার ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজা একশাে মুদ্রা দান করতেন। বিদ্যার্থীরা ছিলেন অন্ত্যেবাসী অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বিহারে থেকে অধ্যয়ন করতে হত। নালন্দার ধ্বংসাবশেষ খনন করার পর এখানে ১৩টি ছাত্রাবাস পাওয়া গেছে, সেগুলি ছিল দোতলা। কোনাে ঘরে একজন, কোনাে ঘরে দু’জন ছাত্র থাকত। প্রত্যেক ঘরে পাথরের তৈরি খাট ও কক্ষ মধ্যে বই, আলাে প্রভৃতি রাখার জন্য কুলুঙ্গি ছিল।
নালন্দা বিধবিদ্যালয়ে পরীক্ষা ও উপাধিদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। শিক্ষা শেষ হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের কৃতিত্বের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রাজসভাতে উপস্থিত হত। রাজসভা থেকে কৃতী শিক্ষার্থী উপাধি ও ভূমি লাভ করত। তাছাড়া কৃতিত্বের নিদর্শন স্বরূপ শিক্ষার্থীর নাম সিংহদ্বারে লিখিত হত। শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থী ইচ্ছা করলে গৃহে ফিরে যেতে পারত অথবা ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করে বিহারে থেকে যেতে পারত।
[৬]
নালন্দা বিহারে যে কয়েক সহস্র পণ্ডিত, বিদ্যার্থী ও শ্রমণ বাস করতেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনে তাদের প্রত্যেকেরই বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল এবং সমগ্র ভারতের বিদ্বৎসমাজে তারা বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক জীবন মানসম্পন্ন এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে সমান উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল। সেই জীবন সম্পর্কে হিউয়েন সাঙ লিখেছেন,
“In the establishment were some thousands of Brethren, all men of great ability & learning, several hundreds being highly esteemed & famous; learning & discussing they found the day too short; day & night they admonished each other, juniors & seniors mutually helping to perfection. The average standard of intellectual equipment learning of the Nalanda students is thus indicated by our pilgrim : If among them were any who did not talk of the mysteries of the Tripitaka, such persons, being ashamed, lived aloof.”
নালন্দার শিক্ষা ছিল শুধু তত্ত্বগত নয়, সৃজনশীলও বটে। নালন্দার নিজস্ব সাহিত্য কীর্তিতে নালন্দার পণ্ডিত ও গবেষকদের ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তক্ষশিলার মতাে নালন্দার শিক্ষক খ্যাতিও ছিল অনন্য। শিক্ষকগণ শিষ্যদের উৎসাহিত করতেন ও বশে রেখে সুকৌশলে তাদের পরিচালিত করতেন। শিক্ষা সমাপ্ত হলে ও তিরিশ বছর বয়ঃপ্রাপ্ত হলে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠিত ও জ্ঞান পূর্ণতাপ্রাপ্ত হত। পুরাতত্ত্বে অভিজ্ঞ অনেকে বিহারেই জীবন কাটাতেন এবং সংসার হতে নিজেদের দূরে রাখতেন (যেমন শীলভদ্র নিজেই)। পার্থিব বিষয়ের প্রতি শিক্ষকদের কোনাে মােহ ছিল না। নিন্দা বা প্রশংসায় তারা প্রভাবিত হতেন না। শিক্ষকদের সুযশ দিগ-দিগন্তে বিস্তৃত হওয়ায় রাজন্যবর্গ তাদের যথেষ্ট সম্মান করতেন, কিন্তু তারা কখনও রাজসভায় উপস্থিত হতেন না। সাধারণ প্রজাবৃন্দও তাদের কার্যাবলির প্রশংসা করতেন। ফলে পণ্ডিঙ্গণ দৃঢ়তা ও উৎসাহ সহকারে বিদ্যা দানে অক্লান্তভাবে সময় ব্যয় করতে পারতেন। শিক্ষকদের মধ্যে নাগার্জুন, আর্যদেব, ধর্মপাল, শীলভদ্র, অঙ্গ, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, চন্দ্রগােবিন, কমলশীল, পদ্মসম্ভব, চন্দ্রপাল (চন্দ্রকীর্তি), গুণমতি, স্থিরমতি, ধর্মকীর্তি, বুদ্ধভদ্র, জয়সেন, জ্ঞানচন্দ্র, রত্নসিংহ, সাগরমতি, সিংহরমি, প্রজ্ঞারমি, চন্দ্রদাস, জয়দেব, শান্তিদেব, শান্তরক্ষিত, প্রভামিত্র, জিনমিত্র, জিনপ্রভা, বিশেষ মিত্র প্রমুখ ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও ছিলেন কুমারী, কর্ণপতি, কর্ণশ্রী, সুমতি সেন, কুমারজীব, পরমার্থ, শুভঙ্কর সিংহ, ধর্মদেব, ইন্দ্রদেব, বুদ্ধপালিত, ভাববিবেক, বীরদেব, রাহুল ভদ্র, সংঘরক্কত, রত্নাকর শান্তি, দিগ, শংকর স্বামী, নন্দ, বিমলচন্দ্র, বন্ধুপ্রভা প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই জ্ঞান-জগতের এক একজন দিকপাল ছিলেন। নালন্দার বিধজোড়া সুনাম ও খ্যাতির পশ্চাতে ছিল এইসব প্রতিভাবান পণ্ডিতদের একনিষ্ঠ সাধনা।
নাগার্জুন মহাযান মতের খ্রিস্ট না হলেও কমপক্ষে তাঁকে সেন্ট পল মনে করা হয়। তিনি সংস্কৃত ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতা নামে বৌদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে স্বল্পাক্ষরা থেকে একশত পঞ্চাশ, সাতশত, পনেরশত, আট হাজার, দশ হাজার, পঁচিশ হাজার, একলক্ষ পঁচিশ হাজার পর্যন্ত শ্লোক রয়েছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন, মূল রচনাটি এক লক্ষ শ্লোকে রচিত। নাগার্জুনের কিছু পরে মৈত্রেয়নাথ ‘অভিসময়ালঙ্কার কারিকা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা যােগাচার মত প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই কারিকা অনুযায়ী ‘অষ্টসাহত্রিকা’ প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের কিছু পরিবর্তন করা হয়। পরে তা আরও বিস্তারিত করে কারিকা অনুযায়ী আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে পঁচিশ হাজার শ্লোকে রচনা করা হয়। এইসব কারিকা গ্রন্থের শেষে বলা হয়েছে যে, নাগার্জুন উত্তর ভূখণ্ড থেকে ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ উদ্ধার করেন। প্রজ্ঞাপারমিতার অর্থ জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা। সেটা কী? সর্বজ্ঞান। সর্বজ্ঞান কী? জগতপ্রপঞ্চের অস্তিত্ব যে শূন্য সে সম্বন্ধে জ্ঞান।
মহাচার্য আর্যদেব শূন্যবাদমার্গানুসারী মহাযান মতাবলম্বী বৌদ্ধভিক্ষু, ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম। তিব্বতীয় উৎস হতে জানা যায় যে, আর্যদেব পরমাচার্য নাগার্জুনের প্রধান শিষ্য ছিলেন। চিনারা তাকে গ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী বলে মনে করে। আর্যদেব রচিত গ্রন্থগুলি হল—শতকশাস্ত্র, ব্রহ্মপ্রমথন, মাধ্যমক, চিত্তবিশুদ্ধিপ্রকরণ ও চতুঃশতিকা। তৃতীয় গ্রন্থটি নালন্দায় রচিত হয় ও পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর গ্রন্থটি তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন। চিত্তবিশুদ্ধিপ্রকরণ মহাযান মতের ধারক। চতুঃশতিকায় সাংখ্য ও বৈশেষিক মতের বিরুদ্ধে আর্যদেব তাঁর নিজের মত প্রকাশ করেছেন। নাগার্জুন ও আর্যদের বৌদ্ধ দর্শনের মাধ্যমিক শাখার প্রতিষ্ঠা করেন। তারা একই সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মহাযান মতের বােধিসত্ত্বযানেরও প্রতিষ্ঠা করেন।
আর্যদেবের পর নালন্দার পরবর্তী সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন পণ্ডিত ধর্মপাল (৫৩০-৫৬১)। তিনি মাদ্রাজের কাঞ্চিপুরমে জন্মগ্রহণ করেন। নালন্দা মহাবিহারে ভিক্ষু জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি বৌদ্ধধর্মে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের শব্দপ্রকরণ, যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার উপর গ্রন্থ রচনা করেন। মহাযান বিদ্যার প্রয়ােগবিধি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তার ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রাসিদ্ধিশাস্ত্রে’, যেখানে তিনি ‘প্রবর্তনা স্তর’ সম্পর্কে কিছু আলােচনা করেছেন। পঞ্চম প্রবর্তনা স্তর খুবই নিচ প্রকৃতির স্তর। এখানে যন্ত্রণাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, কিন্তু নির্বাণ ও আত্মশূন্যতার সত্য উপলব্ধিকে স্বীকার করা হয়। ষষ্ঠ প্রবর্তনা স্তর হচ্ছে খুব উৎকৃষ্ট শ্রেণির স্তর। এখানে নিজের কিংবা অপরের জন্য মহাযানীরা জন্ম-মৃত্যুকে ঘৃণাও করেন না, বা নির্বাণও কামনা করেন না। কিন্তু তারা ‘আত্মশূন্যতা’ ও ‘ধর্মশূন্যতা’ অর্জনের জন্য লালায়িত। মহাযানে রয়েছে উচ্চ জ্ঞানের অন্বেষণ। অন্য সব মতবাদকে মহাযান মানবকল্যাণে ধ্বংস করতে পারে। এসব গুণের সাহায্যে যে কেউ উচ্চমানের নির্বাণ লাভ করতে পারবে সেইসঙ্গে জন্ম-মৃত্যুর তীব্র যন্ত্রণাকেও দমন করতে পারবে।
মহাপণ্ডিত ধর্মপালের রচনাবলীতে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়। ‘অর্থকথা’ রচনায় তিনি বুদ্ধঘােষের প্রায় সমকক্ষ। আচার্য ধর্মপালের রচিত ‘অর্থকথা’ থেকে তদানীন্তন দক্ষিণভারত ও সিংহলের মধ্যেকার ধর্মীয় অবস্থার সহায়ক তথ্য জানতে পারা যায়। সম্ভবত এই তথ্য দক্ষিভারতীয় দ্রাবিড় সভ্যতার ভাষ্য রচনায় ব্যবহার করা হয়েছে। এটা বলা হয় যে, আচার্য ধর্মপাল ত্রিপিটক বহির্ভূত সাহিত্যের ভাষ্য ‘নেত্তি’ রচনা করেন। তিনি এই ভাষ্য ধর্মরক্ষিত থেরের অনুরােধে রচনা করেন। এটা উল্লেখ্য যে, আচার্য ধর্মপাল দক্ষিণ ভারতের নাগপট্টনে ধর্মাশােকের নির্মিত বিহারে বাস করতেন। পালিভাষ্য রচনার পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত ভাষ্য ও টীকা রচনা করেন। তিনি ভারতীয় সাহিত্যের ভাষ্য রচনার সঙ্গে তুলনামূলক পালি ‘অর্থকথা’গুলি রচনা করেন। তিনি মূল বিষয়ে ব্যাখ্যামূলক অর্থ, অর্থকথা, ঐতিহাসিক তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব সমৃদ্ধ লেখা লিখতেন। পালিভাষ্যকারগণ এরকম ঐতিহাসিক তথ্য তাদের ভাষ্য রচনায় ব্যবহার করতেন। অতএব অর্থকথাচার্য হিসেবে আচার্য ধর্মপাল থেরবাদী বৌদ্ধদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। আচার্য ধর্মপাল শুধু ত্রিপিটকশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন তা নয়, তিনি ত্রিপিটক বর্ণিত ধ্যানবিষয়েও অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি যে যােগশাস্ত্র বিষয়ে সুপণ্ডিত ছিলেন তা তাঁর শিষ্য আচার্য শীলভত্রের জীবনচর্যা থেকে জানা যায়। আচার্য ধর্মপালকে স্থানীয় লােকেরা বােধিসত্ব হিসাবে জানতেন। তার পিতা ছিলেন রাজ্যের পল্লববংশীয় একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে রাজ্যের রাজা তার সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিতে চাইলে বিবাহে অনিচ্ছুক মন্ত্রীপুত্র ধর্মপাল বুদ্ধের কাছে কাতর প্রার্থনা জানালেন। অমনি দেবতাদের এক রাজা তাকে কয়েকশত লি দূরের পার্বত্য বিহারে পৌঁছে দেন। বিহারে তার দীক্ষা গ্রহণ ও পঠন-পাঠন হয়। তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে তদানীন্তন অনেক হিন্দু পণ্ডিতকে তর্কে পরাস্ত করেন। অবশেষে তিনি নালন্দায় এসে উপস্থিত হন এবং উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন। আচার্য ধর্মপালের নালন্দায় অধ্যক্ষ্য পদ অলংকরণের কথা বি.এন. দাশ তার ‘হিস্ট্রি অফ এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৩) উল্লেখ করেছেন। পূর্বোক্ত গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি আচার্য ধর্মপাল শব্দবিদ্যা-সংযুক্ত শাস্ত্র’, ‘শতশাস্ত্র বৈপুল্য’ এবং ‘হেতুবিদ্যাশাস্ত্র’ প্রভৃতি গ্রন্থও রচনা করেন।
ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্রের অন্যতম বৌদ্ধ প্রবর্তক ছিলেন পণ্ডিত ধর্মকীর্তি। নালন্দা মহাবিহারে যে বৌদ্ধ পরমাণুবাদ শিক্ষা দেওয়া হত তার অন্যতম আদি তাত্ত্বিক ছিলেন তিনি।৫৬
হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণকালে তথা নালন্দা আগমনকালে মহাপণ্ডিত শীলভদ্র (৫২৯-৬৪৫) নালন্দার প্রধান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৬৩৭ সালে হিউয়েন সাঙ প্রথমবার নালন্দায় এসেছিলেন। এরপর ৬৪২ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নালন্দায় আসেন। নালন্দার মঠে তিনি প্রায় দু’বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন। নালন্দায় তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানাে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, নালন্দায় তার ভারতীয় নামকরণ করা হয়েছিল—‘মোক্ষদেব’। নালন্দার তৎকালীন অধ্যক্ষ শীলভদ্রের অধীনে তিনি সেখানে অধ্যয়ন করেন। প্রথমে হিউয়েন সাঙ মহাযান মতের সমস্ত মূলগ্রন্থ পাঠ করতে লাগলেন। বিশেষ করে অধ্যয়ন করতে ব্যস্ত থাকলেন মহাযান মতের যােগাচার দর্শন নিয়ে। সেসময় নালন্দায় সর্বশাস্ত্র বিশারদ একমাত্র আচার্য ছিলেন অধ্যক্ষ শীলভদ্র। তাঁকে চৈনিক পরিভাষায় ‘ঝেঙ-ফা-জেঙ’ বলা হত। যিনি অন্তত পঞ্চাশটি শাস্ত্রগ্রন্থ অধ্যয়ন করে অর্থ নির্ণয় করতে পেরেছেন তাকে ‘সান-জ্যাঙ’ উপাধিতে ভূষিত করা হত। সেসময় নালন্দায় নয়জন এমন আচার্য বিদ্যমান ছিলেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অনুসারে অন্তত দশজন ‘সান-জ্যাঙ’ থাকা বাঞ্ছনীয়। সতেরাে মাস ধরে হিউয়েন সাঙ আচার্যের কাছে। যােগাচারভূমিশাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। তারপর প্রচুর পরিশ্রম সহকারে অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে তিনিও ‘সান-জ্যাঙ’ উপাধি অর্জন করতে সক্ষম হন।
হিউয়েন সাঙ বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ ব্যতীত সংস্কৃত ভাষা, ব্রাহ্মণ্য দর্শন অধ্যয়ন করেন। পাঠ করেন হেতুবিদ্যা (লজিক), মহাযান সূত্রালঙ্কার এবং মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শন। নাগার্জুনের মতবাদ আসলে সর্বাস্তিবাদের বাস্তবতা ও যােগাচার সম্প্রদায়ের মতবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছিল। হিউয়েন সাঙ নালন্দার আচার্যগণের সম্মতিতে ওই দুই দার্শনিক ভাবধারার মিলন ঘটিয়ে ‘হুই-জোঙ-লুন’ (নীতি সমন্বয়) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নালন্দায় বসে তিনি হিন্দুধর্মের সাংখ্য ও বৈশেষিক মতবাদের সমালােচনাও করেছেন। সমালােচনা করেছেন জৈন ধর্মেরও যা আসলে তার কাছে বৌদ্ধ ভাবনার বিকৃতি মাত্র বলে মনে হয়েছে। সে যুগে যােগাচার মতটি অংশত চিনে প্রচারিত হয়েছিল। হিউয়েন সাঙ মনে করতেন, শীলভদ্র যােগাচার বিষয়ে এক অতুলনীয় শিক্ষক ও তার কাছে শিক্ষা লাভ করতে পেরে তার বিদেশ যাত্রা সার্থক হয়েছে।
যিনি যােগ সাধনা করেন তাকে যােগাচারী বলা হত। তারা যােগ সাধনাকে একটি মাধ্যম মনে করলে, যার সাহায্যে এই পৃথিবীর খেলা থেকে চিরতরে মুক্তি অর্জন সম্ভব। যােগাচারের বিকল্প নাম হচ্ছে বিজ্ঞানবাদ, যার অর্থ হল বিজ্ঞান বা চেতনা দ্বারাই সব বাহ্যিক বিষয়গুলির অস্তিত্ব গঠিত। অসঙ্গ ও তার ভাই বসুবন্ধু কর্তৃক উদ্ভাসিত হয়েছিল যােগাচার পদ্ধতি। এই মতবাদের মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, শুধুমাত্র চেতনাই হল আসল বাস্তব। যােগাচার মতবাদ যােগের মাধ্যমে চেতনাকে পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ করার উপর জোর দেয়। যােগাচারীই পরে বিজ্ঞানবাদী হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানবাদীরা হচ্ছে অনুমানভিত্তিক এবং যােগাচারীরা। ব্যবহারিক ভিত্তিক। যেহেতু বিজ্ঞান শুধুমাত্র অস্তিত্বশীল, তাই এটি মিথ্যে ধারণা গ্রহণ করে, আর এই মিথ্যের দ্বৈতবাদ ও মরীচিকা থেকে বিজ্ঞানবাদকে পরিষ্কার করতে হয়। অসঙ্গের প্রধান পুস্তক ‘যােগাচার ভূমিশাস্ত্র’-এর উপর ভিত্তি করে এই মতবাদ গড়ে উঠেছে।
যােগাচার মতবাদ আদিম বুদ্ধমতের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে তা বিকাশের পথ খুলে দিয়েছিল। যেমন বজ্রযান বা তন্ত্রশাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ। এইসঙ্গে পূজার রীতিনীতি ও ‘যােগ’-এর সংমিশ্রণের ধারণা বজ্রযান পুরােপুরি নিয়েছিল যােগাচার মতবাদ থেকে। নালন্দায় এ সময় মহাযান অংশের সবচেয়ে রক্ষণশীল গ্রুপের যােগাচারের দার্শনিক পটভূমিকার নেতৃত্বে ছিলেন শীলভদ্র। শীলভদ্রের অনুগামীরা ‘তথাগত-গর্ব’ চিন্তাধারা এবং তান্ত্রিক অনুশীলনের বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন খুবই প্রবলভাবে। তৎকালে ‘তথাগত গর্ব’ লাইনে নতুন নতুন ভাবধারা গ্রহণের আবশ্যকতার কথা বলা হয়েছিল। প্রাচীন অভিধর্ম প্রােগ্রামটিকে নতুন করে জীবনীশক্তি দান করা হয়েছিল তার আমলে। এতে যােগাচারের চিন্তাধারা ও শূন্যতা সম্পর্কিত মহাযানের ধারণা নতুন আলােকে বিচার করা হয়েছিল।
যােগাচারী শীলভদ্র ছিলেন পণ্ডিত ধর্মপালের শিষ্য। হিউয়েন সাঙ, টাওলিন, সেঙ্গচি, ইৎ-সিং প্রভৃতি চিনা পরিব্রাজকের বক্তব্যানুযায়ী খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি বঙ্গদেশের অন্তর্গত সমতটের রাত বংশে নবদ্বীপ বা বিক্রমপুরের রামপাল নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ ও ভাষাভাষী হিসেবে বাঙালি। শীলভদ্র বৌদ্ধজগতে একজন শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার মাধ্যমে বাঙালির মনীষা বিকশিত হয়েছে তর্কশাস্ত্রে ও দার্শনিক চিন্তাভাবনায়। সেজন্য চোদ্দশত বছর পরে আজও প্রত্যেক বাঙালি তার জন্য গর্ববােধ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি তার যুগে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ আচার্য। নৈয়ায়িক রূপেও শীলভদ্রের খ্যাতি ছিল। কেবল একজন পণ্ডিত হিসেবে নয়, একজন শিক্ষা সংগঠক হিসেবেও দেশবিদেশে শীলভদ্রের খ্যাতি ছিল। শীলভদ্র সংঘারাম বিহার ছিল তার উজ্জ্বল সৃষ্টি। শীলভদ্র বৌদ্ধ দর্শনের শব্দাবলির ব্যুৎপত্তিতত্ত্ব, ন্যায়শাস্ত্র ও আধ্যাত্মতত্ত্বের উপর সংস্কৃতে ৬০টি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব পুস্তক তন্ত্রশাস্ত্ৰভূক্ত বলে মনে করা হয়।
নালন্দায় পাঁচ বছরের বেশি অধ্যয়ন করার সময় হিউয়েন সাঙ ১৬০০০ শ্লোকের বেশি সূত্র লিখে ৩টি বই লিখেছিলেন এবং ১টি শীলভদ্রকেও উপহার দিয়েছিলেন। হিউয়েন সাঙের ৫০টি বিষয়ের উপর দখল ছিল। তিনি যদি পাঁচ বছর সময়কালে ৩টি পুঁথি রচনা করতে পারেন তাহলে মহাপণ্ডিত শীলভদ্র তার ১০৫ বৎসরের দীর্ঘ কর্মময় জীবনে নিশ্চয়ই অনেক পুস্তক রচনা করেছিলেন। বিশেষ করে ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে পাঠ্যবই এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তির বই, সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা, মহাযানমতের প্রচারের জন্য এবং বিজ্ঞানবাদের ব্যাখ্যা সম্বলিত কয়েকশত বই তিনি রচনা করেছিলেন বলে বিজ্ঞজনের এই অভিমত। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত ওয়াটারস এর বরাত দিয়ে সৌত্রান্তিকদের বিভাষা শাস্ত্রের উপর লিখিত এক বইয়ের লেখক হিসেবে শীলভদ্রের নাম উল্লেখ করেছেন, তা ঠিক নয়। এটির লেখক অন্য এক পণ্ডিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার রচনার মধ্যে তিব্বতীয় তেঙ্গুরে ‘বুদ্ধভূমি ব্যাখ্যান’ নামে একটি মাত্র গ্রন্থের অনুবাদ রক্ষিত আছে। বুদ্ধভূমি সূত্রের ব্যাখ্যা সম্বলিত এই বইটি তিব্বতী মঠ আধিকারিক তালিকায় সংরথিত রয়েছে। বইটির জাপানি অনুবাদ রয়েছে (১৯৪০)। সেই সাথে তিব্বতী পাঠের পুনর্মুদ্রণও জাপানিরা করেছে। নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের সময় সম্ভবত অন্যান্য গ্রন্থাবলির সঙ্গে শীলভদ্রের পুস্তকগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়। তাছাড়া এই উপমহাদেশের জলীয় বাষ্পপূর্ণ আবহাওয়াও পুস্তক ধ্বংসের অনুকূল। নইলে হাজার বছরের প্রাচীন চর্যাপদও পাহাড়ী এলাকা নেপাল ও তিব্বত থেকে আমাদের উদ্ধার করতে হয়!
শীলভদ্রের মত গুরু পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা, হিউয়েন সাঙের সে সৌভাগ্য হয়েছিল। হিউয়েন সাঙকেও শিষ্যরূপে পেয়ে শীলভদ্র যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন, নইলে আজও এক বাঙালির এতখানি ইতিহাস রক্ষা পেত কী করে? সত্যি কথা কি হিউয়েন সাঙের জীবনী ও ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া আমরা শীলভদ্রের কোনাে খবরই পেতাম না আর তিব্বতীয় অনুবাদের তালিকাটি প্রথমে ফরাসি পরে ইংরেজিতে অনুদিত না হলে শীলভদ্রের একমাত্র টিকে যাওয়া বইয়ের খবরও আমরা পেতাম না।
চিনা ও জাপানি উৎস থেকে আমরা জানতে পারি যে, মতবাদের বিভিন্ন চরিত্রের রূপ অনুসারে বৌদ্ধধর্মকে শীলভদ্র তিনভাগে ভাগ করেছেন। তিনটি বিভাগ হচ্ছে,
- ১. অস্তিত্বশীলতার মতবাদ অর্থাৎ এমন মতবাদ যেখানে আণবিক মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় কিন্তু অহং-এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়।
- ২. শূন্যতা মতবাদ অর্থাৎ এমন মতবাদ যেখানে আণবিক মৌলিক পদার্থ কিংবা অহং কোনােটার অস্তিত্বই স্বীকার করে না।
- ৩. পথের মতবাদ অর্থাৎ এই মতবাদে অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় কিন্তু একই সাথে শূন্যতাকে অস্বীকার করা হয়। এদের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে হীনযান মতবাদ দ্বিতীয় ও তৃতীয় মতবাদ হচ্ছে মহাযানপন্থীদের।
এই তিনটি বিভাগের সাহায্যে শীলভদ্র হীনযান বৌদ্ধমতকে অবজ্ঞা করেন আর মহাযান মতবাদের উচ্চ প্রশংসা করেন। ইৎ-সিং মনে করতেন যে, যাঁরা বােধিসত্ত্বকে পূজা করে আর মহাযানসূত্রাবলি পাঠ করে তারা মহাযানবাদী (মাধ্যমিক এবং যােগবাদী)। আর যারা এসব করে না তারা সবাই হীনযানবাদী।
তিব্বতী পণ্ডিতদের কাছে শীলভদ্র শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাই তিব্বতের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে আর্যদেব, ধর্মপাল প্রভৃতি পণ্ডিতদের সঙ্গে বাঙালি শীলভদ্রও সেখানে সমানভাবে পূজিত এবং তাঁর গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুদিত হয়। তিব্বতের এক মন্ত্রী থােনমি সম্ভোট ছিলেন শীলভদ্রের শিষ্য। ওই মন্ত্রী হিউয়েন সাঙের সতীর্থ ছিলেন এবং তিব্বতের রাজাকে বৌদ্ধধর্মে দীথিত করে বৌদ্ধধর্মকে সর্বপ্রথম সরকারি ধর্মের মর্যাদাদানে সহায়তা করেন। নিঃসন্দেহেশীলভদ্র তার সমকালীন যুগে যােগ্যতম পণ্ডিত ছিলেন। তার পাণ্ডিত্য এত গভীর ও স্বীকৃত ছিল যে, নালন্দা মহাবিহারের অধিবাসীরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত কখনও তার নাম উচ্চরণ করত না। তারা শীলভদ্রকে ‘ধর্মনিধি’ নামে সম্বােধন করতেন। গভীর প্রজ্ঞা, পরিশীলিত গুণাবলি ও বয়সের জন্য বৌদ্ধ সংঘের মধ্যে শীলভদ্র ‘পিতামহ’-এর মতাে সম্মান পেতেন।
সূত্র ও অভিধর্মশাস্ত্রের গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন নালন্দার স্থিরমতি। তিনি বিজ্ঞান-বিষয়ে গবেষণা করতেন এবং তিব্বতেও প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমির চন্দ্রদ্বীপের অধিবাসী চন্দ্রগােবিন (৪৬৫-৫৪৪) ছিলেন নালন্দার অন্যতম খ্যাতনামা পণ্ডিত। তিনি বৌদ্ধাচার্য স্থিরমতির শিষ্য ছিলেন বলে অনেকে মত পােষণ করেন। নালন্দার প্রথিতনামা শিক্ষক চন্দ্রকীর্তির ছাত্র বলেও অনেকে তাকে চিহ্নিত করেন। ভর্তৃহরি তার ‘বাক্য-পদীয়’ ও কলহন তার ‘রাজতরঙ্গিনী’তে চন্দ্রাচার্য নামে যাঁর উল্লেখ করেছেন, তিনিই চন্দ্রগােবিন—এই মতবাদেও কেউ কেউ বিধাস করেন। চন্দ্রগােবিন বাংলায় এক নতুন বৈয়াকরণ মতবাদের প্রবর্তন করেন। তার নামানুসারে এই মতবাদ ‘চান্দ্র ব্যাকরণ’ নামে পরিচিত। অনুমান করা হয়, ৪৯৫ থেকে ৫৪৪ সালের মধ্যে কোনাে সময়ে তিনি তার চান্দ্র ব্যাকরণ এবং তার টীকা প্রণয়ন করেন। এই ব্যাকরণ কামীর, নেপাল, তিব্বত ও সিংহলে সমাদৃত ও প্রচলিত হয়েছিল। মাত্র ৩৫ সূত্র ব্যতীত এই ব্যাকরণে অ-পাণিনীয় কিছু নেই বটে, তবে এতে পাণিনিকে ঢেলে সাজানাের চেষ্টা করা হয়েছে। পাণিনির সংস্কার সাধনে ব্রতী হলেও চন্দ্রগােবিন তার ব্যাকরণে। কোনও মৌলিকতা প্রদর্শন করতে পারেননি। এই কারণে পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের ইতিহাসে চান্দ্র ব্যাকরণ অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে।
নালন্দার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত শান্তরক্ষিতের (৭০৫-৭৬৫) নাম তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সঙ্গে যুক্ত। তিনি তিব্বত-রাজ থিস্রোং দেচানের সময় তিব্বতে যান। কিন্তু সেদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তিনি তিব্বতের প্রাচীন পােন ধর্মের ভূত-প্রেতযক্ষার তীব্র বিরােধিতার সম্মুখীন হন। এই বিরুদ্ধতা এত তুঙ্গে উঠেছিল যে আচার্য শান্তরক্ষিতকে তিব্বত ছেড়ে ফিরে আসতে হয়। শান্তরক্ষিতের অনুরােধে তিব্বত-রাজ ৭৪৭ সালে নালন্দার যােগশাস্ত্রীয় পণ্ডিত পদ্মসম্ভবকে (শান্তরক্ষিতের ভগ্নীপতি) তিব্বতে আমন্ত্রণ করেন। তিনি অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের সাহায্যে উপদেবতার কোপ হতে তিব্বতকে রক্ষা করেছিলেন। এভাবে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচারে তিনি তিব্বতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকেই তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের (লামা সম্প্রদায়) প্রবর্তক মনে করা হয়।৫৭ পরে আচার্য শান্তরথিত আবার তিব্বতে যান ও বৌদ্ধধর্ম প্রসারে সহায়তা করেন। তিব্বত-রাজের সাহায্যে তিনি উদন্তপুরী মহাবিহারের অনুকরণে রাজধানী লাসায় ৭৪৯ সালে সামিয়ে বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে নতুন উদ্যমে বৌদ্ধধর্মের প্রসার শুরু হয়। তিব্বতীরা শান্তরক্ষিতকে বােধিসত্ত্ব উপাধি প্রদান করেছিলেন। তার প্রধান গ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহকারিকা’ একত্রিশ অধ্যায়ে বিভক্ত। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি হিন্দুশাস্ত্র, জৈনশাস্ত্র ও উপনিষদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মত আলােচনা ও খণ্ডন করে বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন।
কমলশীল নামক নালন্দার আর একজন পণ্ডিত তিব্বতে তার গুরু শান্তরক্ষিতের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি নালন্দায় তন্ত্রশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন। তিব্বত-রাজের আহ্বানে তিনিও তিব্বত গিয়েছিলেন। সেই সময় চিনা পণ্ডিত মহাযানী হােসাং পদ্মসম্ভব ও শান্তরক্ষিতের মত খণ্ডন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু কমলশীল তাকে তর্কে পরাস্ত করে নিজ গুরুর গৌরব রক্ষা করেছিলেন। নালন্দায় ও বিদেশে বাঙালি আচার্যদের এই ইতিবাচক ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন,
“বাংলার বাহিরে নালন্দা ও বিক্রমশীল এই দুই প্রসিদ্ধ বৌদ্ধবিহারে অনেক বাঙ্গালী আচার্য্য খ্যাতি লাভ করিয়াছেন ও সৰ্ব্বাধ্যক্ষ্যর পদ অলঙ্কৃত করিয়াছেন। চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাং যখন নালন্দায় যান, তখন বাংলার ব্রাহ্মণ-রাজবংশীয় শীলভদ্র এই মহাবিহারের প্রধান আচার্য্য ও অধ্যক্ষ ছিলেন। হুয়েন সাংয়ের বিবরণ হইতে শীলভদ্রের জীবনী সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারা যায়। শীলভদ্র ভারতের নানা স্থানে ঘুরিয়া বৌদ্ধধর্মে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নালন্দায় ভিক্ষুপ্রবর ধর্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাহার নিকট দীক্ষা লাভ করেন। তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দূরদেশেও বিস্তৃত হইয়াছিল। এই সময় দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মগধে আসিয়া ধর্মপালকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন। শীলভদ্রের বয়স তখন মাত্র ৩০ বৎসর, কিন্তু ধৰ্ম্মপাল তাহাকেই ব্রাহ্মণের সহিত তর্ক করিতে আদেশ দিলেন। শীলভদ্র ব্রাহ্মণকে পরাজিত করিলেন। মগধের রাজা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া শীলভদ্রকে একটি নগরের রাজস্ব উপহার দিলেন। ভিক্ষুর ধনলােভ উচিত নহে— এই যুক্তি দেখাইয়া শীলভদ্র প্রথমে ইহা প্রত্যাখ্যান করিলেন, কিন্তু রাজার সনির্বন্ধ অনুরােধ এড়াইতে না পারিয়া তিনি এই দান গ্রহণ করিলেন এবং ইহার দ্বারা একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করিলেন। কালক্রমে হুয়েন সাং ৬৩৭ অব্দে নালন্দায় গমন করেন। তখন এখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং বৌদ্ধগণের আঠারােটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ব্যতীত বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা ও সাংখ্য প্রভৃতি এখানে অধীত হইত। হুয়েন সাং বলেন যে, এক শীলভদ্রই একা এই সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। সংঘবাসীগণ তাহার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাহার নাম উচ্চারণ না করিয়া তাহাকে ‘ধর্মনিধি’ বলিয়া অভিহিত করিতেন। হুয়েন সাং চীনদেশ হইতে আসিয়াছেন শুনিয়া, শীলভদ্র তাহাকে সাদরে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন এবং যােগশাস্ত্র শিক্ষা দেন। ৬৫৪ অব্দে শীলভদ্রের মৃত্যু হয়।
শীলভদ্র ব্যতীত আরও দুইজন বাঙ্গালী-শান্তরথিত ও চন্দ্রগােমিন-নালন্দার আচাৰ্য্যপদ লাভ করিয়াছিলেন।…চন্দ্রগােমিন বরেন্দ্রে এক ক্ষত্রিয়বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, জ্যোতিষ, আয়ুৰ্বেদ, সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্পকলায়। বিশেষ বুৎপন্ন ছিলেন এবং আচাৰ্য্য অশােকের নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রথমে দাক্ষিণাত্য ও সিংহল-দ্বীপে বাস করেন এবং চান্দ্র-ব্যাকরণ নামে একখানি ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নালন্দায় গমন করিলে প্রথমে তথাকার আচাৰ্য্যগণ তাঁহার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন নাই। কিন্তু নালন্দার প্রধান আচাৰ্য্য চন্দ্রকীৰ্ত্তি তাহার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হন। তিনি নালন্দায় একটি শােভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন। ইহার সম্মুখভাগে তিনখানি রথ ছিল। ইহার একখানিতে চন্দ্রগােমিন আর একখানিতে মঞ্জুশ্রীর মূর্তি এবং তৃতীয়খানিতে স্বয়ং চন্দ্রকীৰ্ত্তি ছিলেন। ইহার পর হইতে নালন্দায় চন্দ্রগােমিনের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বাড়িয়া যায় এবং যােগচার-মতবাদ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্ক করিয়া তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।”৫৮
ভিয়েতনাম, চিন, কোরিয়া ও জাপানে অনুসৃত মহাযান সহ বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য শাখাগুলিও নালন্দা মহাবিহারেই বিকাশ লাভ করেছিল। গবেষকদের মতে, পূর্ব-এশিয় বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ‘সুরঙ্গমা সূত্র’ সহ কয়েকটি মহাযান ধর্মগ্রন্থ নালন্দায় প্রচলিত মতবাদের অনুসারী।৫৯ এই সূত্রের সাধারণ মতবাদটি অবশ্যই নালন্দায় গুপ্তযুগের শেষভাগে যে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত, তার অনুগামী। সেই সময়েই সূত্রটি অনুদিত হয়েছিল।
নালন্দার বিহার-জীবন ছিল গণতান্ত্রিক। নালন্দার সকল অধিবাসী ভিক্ষুর সম্মতি সাপেক্ষে কাজকর্ম ও প্রশাসন পরিচালনা সংত্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। একত্রে সমবেত হয়ে আলােচনার ভিত্তিতে যে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। মতানৈক্য হলে অধিকাংশের মতই গ্রহণীয় হত। নিয়মানুবর্তিতার প্রণের সমাধান ছাত্ররাই করত। তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত ছিল কঠোর অভ্যাসের মাধ্যমে। তাই নালন্দার গৌরবময় ইতিহাসে ছাত্র বিক্ষোভের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
ইৎ-সিংয়ের বর্ণনা পাঠে জানা যায় যে, নালন্দার ছাত্রগণ প্রতিদিন প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় অধ্যয়নের জন্য শিক্ষকের সমীপবর্তী হতেন। শিক্ষকের যাবতীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা ছাত্রকেই করতে হত। এমনকি তার শয়ন কক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও ছাত্রদের ছিল। অন্যদিকে পীড়িত ছাত্রের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষা শিক্ষককেই করতে হত। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, তার পাণ্ডিত্যে গভীর আস্থা যেমন ছাত্রকে অনুরক্ত করত—তেমনি শিক্ষকও স্বীয় অন্তরের স্নেহ প্রীতি ধারায় ছাত্রকে অভিষিক্ত করে তাঁকে আপন করে নিতেন।
নালন্দার প্রধান সচিবকে বলা হত সর্বাধ্যক্ষ। সর্বাধ্যক্ষ নিয়ােগ করার সময় তার জ্ঞান, সাধনা, পাণ্ডিত্য, বয়স, চরিত্র সমস্ত দিক বিবেচনা করে তারপর তাকে নির্বাচিত করা হত। এঁকে সহায়তা করার জন্য দু’জন সহকারী কর্মাধ্যক্ষ থাকতেন। একজন। হলেন ‘স্থবির’ ও অন্যজন ‘কর্মদান’। ‘স্থবির’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দিকটি দেখতেন অর্থাৎ ভর্তি, পাঠক্রম, শিক্ষক নির্বাচন, শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন, ক্লাসের ব্যবস্থা—এ সমস্ত করতেন। ‘কর্মদান’-এর দায়িত্ব ছিল শৃঙ্খলা রক্ষা, গৃহ নির্মাণ, প্রয়ােজনীয় মেরামত, খাদ্য সংগ্রহ ও ঠিকমত বন্টন, শ্ৰমণদের পােশাকের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার্থীদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
বাস্তবিকপথে বিভিন্ন মতাদর্শ, গােষ্ঠী ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয়ী যৌথ জীবনের সাফল্যই ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ গৌরব। নালন্দার এই সমন্বয়ী দর্শনই আকর্ষণ করেছিল বহির্ভারত তথা বহির্বিকে। বিদেশি পণ্ডিত, পর্যটক ও বিদ্যানুরাগীদের মধ্যে ইতিপূর্বে আমরা হিউয়েন সাঙ ও ইৎ-সিংয়ের নাম করেছি। বলা বাহুল্য, নালন্দার বিদেশি ছাত্র-তালিকা এই দুজনের মধ্যেই নিবদ্ধ নয়। হিউয়েন সাঙ ও ইৎ-সিং-এর আগমনের ত্রিশ বছরের মধ্যে চীন, কোরিয়া, তিব্বত, সিংহল, সুমাত্রা, যবদ্বীপ, টোখারা প্রভৃতি বহু দূর দেশ হতে বহু ছাত্র নালন্দায় বিদ্যার্জন ও দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য আসতেন। তিব্বত হতে ৭জন ব্যাক্তি এখানে অধ্যয়ন করেন। সুদূর কোরিয়া হতে এসেছিলেন আর্যবর্মা ও হিউই-ইয়েক্ষ টোখারা হতে বােধিধর্ম এবং চীন হতে টাও-হি, টাও শিং, ট্যাং, টাও লিন, হুই-টা ও আরও অনেক চিনা ভিক্ষু।৬০
খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতকে নালন্দায় পূর্ব-প্রচলিত মহাযান মতবাদের বিলক্ষণ বিবর্তন ঘটে। তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের প্রভাবে বজ্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান ও কালচক্রযান প্রভৃতি উপ-সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। ফলে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের টীকা-গ্রন্থাদিও রচিত হয়। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতে যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়—বিক্রমশীলা, সােমপুরী, জগদ্দল, উদন্তপুরী প্রভৃতি—পাল রাজাদের আমলে গড়ে উঠেছিল, সেগুলির উৎস বা প্রাণকেন্দ্র ছিল নালন্দা। নালন্দার পণ্ডিতরাই ওই সমস্ত বিধবিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হতেন। তাই নালন্দাকে ‘বৌদ্ধভারতের অক্সফোর্ড’ নামে অভিহিত করা হয়।
[৭]
হিউয়েন সাঙের ভ্রমণকাহিনি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তীর্থযাত্রী ইৎ-সিং সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন এবং ৬৭৩ সালে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি ভারতে ১৩ বছর অতিবাহিত করেছিলেন। এর মধ্যে ১০ বছর (৬৭৬-৮৫) তিনি কাটিয়েছিলেন নালন্দা মহাবিহারে। তিনি যখন চিনে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন সঙ্গে করে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে যান। পর পরই সেগুলাে অনুদিত হয়। হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণকাহিনিতে সপ্তম শতকের ভারতের ভৌগােলিক সাংস্কৃতিক চিত্র বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ইৎ-সিং তার বিবরণ নিবদ্ধ রেখেছিলেন মূলত বৌদ্ধধর্মের উৎসভূমি ভারতে সেই ধর্মের চর্চা ও মঠের ভিক্ষুদের প্রথা, রীতিনীতি ও নিয়ম-নির্দেশিকার বর্ণনার মধ্যেই। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, নালন্দা মহাবিহারে ৮টি সভাগৃহ ও প্রায় ৩০০টি কক্ষ ছিল। নালন্দার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিল সকলের দ্বারা আচরিত একাধিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন সকালে একটি ঘন্টাধ্বনির মাধ্যমে স্নানের সময় নির্দেশ করা হত। এই ঘন্টাধ্বনি শুনে শতাধিক বা সহস্রাধিক ভিক্ষু নিজ নিজ বিহার থেকে বেরিয়ে চত্বরের মধ্যস্থ বা পার্থস্থ একাধিক বিশালাকায় জলাধারে উপস্থিত হতেন এবং স্নান করতেন। এরপর আরেকটি ঘন্টাধ্বনির মাধ্যমে বুদ্ধপূজার সময় নির্দেশ করা হত। সন্ধ্যায় ‘চৈত্যবন্দনা’ অনুষ্ঠিত হত। চৈত্যবন্দনার অঙ্গ ছিল তিন পর্বের ‘সেবা’, নির্দিষ্ট স্তোত্র, শ্লোক ও ধর্মগ্রন্থের নির্বাচিত অংশ পাঠ। এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত মহাবিহারের কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত হত। তবে ই-সিং লিখেছেন যে, নালন্দার অধিবাসীদের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রতিদিন এক স্থানে সকলের সমাবেশ কঠিন ছিল। তাই একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়। এই অনুষ্ঠানে একজন পুরােহিত ধূপ ও পুষ্পবহনকারী সাধারণ ভৃত্য ও শিশুদের সঙ্গে করে একটি সভাগৃহ থেকে অন্য সভাগৃহে গিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানটি আয়ােজন করতেন। গােধূলির মধ্যেই এই অনুষ্ঠান শেষ হত।
নালন্দা মহাবিহারে জৈষ্ঠ্যতা, পাণ্ডিত্য এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণিতে আবাসিক শ্রমণদের বিভক্ত করা হত। ইৎ-সিং-এর বর্ণনা মতে সর্বোৎকৃষ্ট, মাঝারি এবং হীনযানের এই তিন ধরনের ভিড় ছিল নালন্দা মহাবিহারে। এসব মানদণ্ড ছাড়াও মঠে জৈষ্ঠ্যতা, ত্রিপিটকের উপর জ্ঞান এবং উচ্চ ‘শীল’ বা ‘মােরাল ক্যারেকটার’-এর বিশিষ্টতা এই তিন মাপকাঠিতে বিভক্ত করা হত মঠবাসীদের। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন নালন্দায় বৌদ্ধ পণ্ডিতদের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে। যিনি বৌদ্ধধর্মের ‘বিনয়’, ‘বিচার’, এবং ‘সুত্তপিটক’ এই সকল গ্রন্থের এক শ্রেণির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারেন, তাঁকে কর্মদানের শাসন থেকে মুক্তি দেওয়া হত। যদি তিনি দুই শ্রেণির ব্যাখ্যা করতে পারেন তবে তাকে দ্বিতীয় তলে বাসের জন্য আসবাব দেওয়া হত। যিনি তিন অংশ ব্যাখ্যা করতে পারেন তাকে পরিচর্যা করবার জন্য কয়েকজন ভৃত্য দেওয়া হত। যিনি চার অংশের ব্যাখ্যা করতে পারেন, তাঁকে উপাসক নিযুক্ত করা হত। যিনি পঞ্চাংশ ব্যাখ্যা করতে পারেন তাকে হস্তীযান দেওয়া হত। যিনি ছয় অংশের ব্যাখ্যা করতে পারেন তাঁকে শরীররী দেওয়া হত। যখন কারও সুযশ উচ্চসীমায় উপনীত হয়, তখন বিচারের জন্য তিনি সঙঘ আহ্বান করেন। যারা সভায় উপস্থিত হন, তিনি তাদের গুণের বিচার করেন। তিনি বুদ্ধিমানদিগকে প্রশংসা করেন এবং ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তিরস্কার করেন। সভায় যদি কেউ মার্জিত ভাষা, সূক্ষ্ম অনুসন্ধান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দেন তাহলে সুসজ্জিত হাতির পিঠে চড়িয়ে বহু সংখ্যক সহচর দিয়ে মঠের দ্বারদেশ পর্যন্ত আনা হয়। পক্ষান্তরে যদি কেউ বিচারকালীন অসাধু ভাষা প্রয়ােগ করেন, অথবা কুতর্ক অবলম্বন করেন, তাহলে সকলে তার মুখ লাল ও সাদা রঙে রঞ্জিত করে দেয়, সর্বাবয়বে ধূলি ও কাদা মাখিয়ে দেয় এবং পরে কোনাে নির্জন স্থানে বা পয়ঃপ্রণালিতে রেখে আসে। এ প্রকারে তারা গুণী ব্যক্তিকে সম্মান এবং গুণহীন ব্যক্তিকে অপদস্থ করে। ভােগ বিলাস সাংসারিক জীবনেই শােভা পায় এবং জ্ঞানার্জনই ধর্মজীবনের লক্ষণ। মহাবিহারের এমনি পরিবেশে পণ্ডিতদের জীবন কাটত।
নালন্দা মহাবিহারের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল। তাদের মালপত্র বহন করত অন্যান্য ভৃত্যরা। শ্রাবণ মাসের ১ তারিখে ‘বর্ষাবাস’ শুরু হত, তা চলত আর্বিন মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত। ৪০ দিনের বেশি কেউ বাইরে অবস্থান করতে পারত না। গ্রীষ্মকাল বা বর্ষায় তিন মাসের মতাে ‘বর্ষাবাস’ পালন করা হতাে। এই সময়ের শেষের দিকে ‘অর্পণ উৎসব’ পালিত হত। আরও উদ্যাপিত হত ‘প্রবর্ণা’ উৎসব। বিনয়ের বিপরীতে অপরাধের জন্য বিভিন্ন মাত্রার শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল, যেমন সতর্কীকরণ, অন্য ভিক্ষুদের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ, আর সবচেয়ে গুরুতর শাস্তি হল বিহার থেকে বহিষ্করণ যার ফলে ভিক্ষু জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটত।
উপবাসের দিন ছিল ‘উপােষ্ঠা’ যেদিন ধর্মীয় কাজ করা হত। পরিষ্কার সব কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র, সাজানাে চেয়ার টেবিল, দ্বিপ্রহরের সময় খাদ্য বিতরণ এসব শুরু হত উৎসবের দিন। ‘মা হারিতী’ ও ‘মহাকালা’কে খাদ্য উৎসর্গ করে খাওয়াদাওয়া শুরু হত। এসবের সুন্দর বর্ণনা রয়েছে যােশীর৬১ বইটির ৬৫ পৃষ্ঠা থেকে ৯০ পৃষ্ঠায় এবং হাজরার৬২ বইটির ৩নং অধ্যায়ের ২৭-৭৬ পৃষ্ঠায়।
খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে চাউল, ঘি, মাখন, দুধ, চিনি, ফল, স্যুপ এবং রুটি। খাওয়া-দাওয়ার পরে পুরােহিত অতিথিকে উপহার দেওয়া হত। অতিথিরা গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতনে আর ‘সুত্র’ থেকে কিছু ‘গাঁথা’ আবৃত্তি করতেন সেই সাথে আশীর্বাদ করতেন তাদের মঙ্গলের জন্য। ভিক্ষুরা বিহারে বা মঠে যাবার আগে তাদেরকে চিনি, জল বা সরবত ও সুপারী দেওয়া হত শেষ খাবার হিসেবে। সেকালে পান খাওয়া এবং চা পানও প্রচলিত ছিল। তবে পেঁয়াজ ও মাংস খাওয়া বারণ ছিল ভিক্ষুদের জন্য।
ইৎ-সিং ভারতীয় ভিক্ষুদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি আগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। শরীর, কাপড়, হাড়ি-পাতিল, জল, শােবার ঘর, সব ঝকঝকে তকতকে রাখা হত। খাবার আগে হাত পা ধােয়া, খাবার পর দাঁত-খিলানি ও দাঁত পরিষ্কার করা, হাত ধােয়ার জন্য বিশেষ পাউডার (সাবান) ব্যবহৃত হত। বাড়িঘর গােবর দিয়ে লেপা হত, খাবার টেবিলে এক কিউবিট দূরে দূরে আসন পাতা হত যাতে পরস্পরের দেহ স্পর্শ না করে। প্রতিটি সাধু বা ভিক্ষু দুটি জগ সাথে রাখতেন। একটি পটারী বা পােরসেলিনের ব্যবহার হত পান করার জল রাখার জন্য, অন্যটি ছিল লােহা, তামার যেখানে জল রাখা হত হাত পা ধােয়ার জন্য। ব্যবহারের পূর্বে জল ফিল্টার করা ছিল নিয়ম। মঠের প্রধান ভিক্ষুর দায়িত্ব ছিল জলের কুয়ার ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা এবং জলের পরিশােধনের ব্যবস্থা করা।
ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সাধারণত কমলা ‘রঙের কাসায়’ কাপড়, রেশম বা পশমি কাপড় দিয়ে গাউন তৈরি করতেন। ভিক্ষু তিনটি বস্ত্র বা চীবর রাখতেন সঙ্গে। ইৎ সিং-এর কাছে ভালাে লাগেনি ভিক্ষুদের কাপড়ে হিসেব-ছাড়া যেনতেন প্রকারের সেলাই দেবার পদ্ধতি দেখে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্তের কাপড় পরার মধ্যে সামান্য পার্থক্য রাখা হত। যেমন- মূল্যসর্বস্থিবাদীরা নিচের পরিধেয় বস্ত্রের কিনারা সােজাসুজিভাবে কাটাতাে, আর ‘সাম্মিতি’ ‘স্থবিরবাদীরা’ এবং ‘মহাসংঘিকা’রা কিনারা কাটাতাে অসমভাবে। মহাসংঘিকাদের কাপড় পরার ধরন ইৎ সিং-এর কাছে মনে হয়েছিল যেন ভারতীয় মহিলাদের অনুসরণ। অন্তর্বাস বা ‘নিবাসন’ পরার কায়দা মূল্যসর্বাস্থিবাদীদের আলাদা ছিল অন্যদের চেয়ে। অভিজাত ভারতীয়রা জোড়া সাদা নরম কাপড় পরতাে আর গরিবরা মাত্র ১টি লিনেনের কাপড় পরত। শুধু সন্ন্যাসীরা তিনটি বস্ত্র ও কাপড় পরতে পারতেন।
ভারতের সব বিহারে সৌরঘড়ি এবং জলঘড়ি সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হত, একটি কাঠির ছায়ানুসারে সৌরঘড়ির সময় নির্ণয় করা হত, এটার নাম ছিল ‘বেলাচক্র’। কাঠির ছায়া সর্বনিম্ন হলে দিন দুপুর বুঝত। নালন্দা মহাবিহারের জলঘড়ি খুব বিখ্যাত ছিল সে সময়ে।৬৩ তামার পাত্রে জল ভরে তাতে একটি তামার বাটি ভাসানাে হত, বাটিতে একটি পিনের আয়তনের ছিদ্র রাখা হত যা দিয়ে জল ঢুকতাে ভিতরে। পুরােপুরিভাবে জল ঢুকে বাটিটি ডুবে গেলে ড্রামের আওয়াজ করে জানিয়ে দেওয়া হত সময় কতটা পেরােল।
বিকেলে কক্ষ থেকে সব ভিক্ষুরা বেরিয়ে আসেন এবং একটি স্তুপের চতুর্দিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করেন, সাথে ধূপ ও ফুল ধুনা নিক্ষেপ করে থাকেন। এটাকে প্রদক্ষিণ বলা হয়। ‘স্তুপ’ বা ‘চৈত্যা’কে প্রদক্ষিণের সময় ভিক্ষুরা ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে থাকেন সুরলহরী তুলে, বিশুদ্ধ এবং গভীর ভাব নিনাদী (উচ্চস্বরে) কণ্ঠে দশ, বিশটি শ্লোক আওড়িয়ে আওড়িয়ে। প্রদক্ষিণের পর ভিক্ষুরা মঠের সাধারণ সভাকক্ষে ফিরে আসতেন। সবাই আসন গ্রহণ করলে ‘কুলপতির’ পাশে রাখা একটি সিংহাসনে বসে সূত্র আবৃত্তিকার একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় আবৃত্তি করতেন। অঘােষের ‘তিন অংশে বিভক্ত কার্যাবলি’ থেকে প্রায়ই আবৃত্তি করে শােনানাে হত। এর প্রথম অংশে ১০টি শ্লোকে বুদ্ধের প্রশস্তি থাকত, দ্বিতীয় অংশে থাকত বুদ্ধের কিছু বচন, তৃতীয় অংশে থাকত প্রার্থনা—মানুষের ভালাে অংশটুকু যেন পরিপক্কতা পায় এমন আবেদন সম্বলিত। আবৃত্তির শেষে প্রধান ভিক্ষু সিংহাসনকে ও অন্যান্য সাধুদের আসনকে প্রণতি জানাতেন, তাকে অনুসরণ করতেন পদমর্যাদানুযায়ী অন্যান্য ভিক্ষুরা।
নালন্দার বিশালত্বের দরুন ভজনগীতির অনুষ্ঠানটি হত এভাবে প্রতিদিন মঠের উপাসকমণ্ডলীর গায়কদলের প্রধান গায়ক এক বাসা থেকে অন্য বাসায় যেতেন ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে, তাকে অনুসরণ করতাে ‘বিশুদ্ধ মানুষ’ ভৃত্যরা, আর বালকেরা বহন করে নিয়ে যেত ধূয়া-ধুনা, বাতিদান এবং ফুল। প্রতিটি হলে সে ৩ থেকে ৫টি শ্লোক উচ্চস্বরে গাইত। তার কণ্ঠস্বর সর্বত্রই শােনা যেত। সন্ধ্যালােকের সময় তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যেত। এই প্রধান গায়ক তার কাজের জন্য বিশেষ উপহার পেত। রাত্রিতে মঠে নাগার্জুনের ‘সুহুলেখা’, চন্দ্রের ‘সুধন’, অঘােষের ‘বুদ্ধচরিত কাব্য’, মাতৃচেতার ‘বুদ্ধ-গীতি’ এবং আর্যসুয়ার ‘জাতকমালা’ পাঠ করা হত।
যাইহােক, ই-সিং যে সময়ে (৬৭৬-৮৫) নালন্দায় এসেছিলেন সে সময়েও নালন্দার গৌরব অব্যাহত ছিল। কিন্তু অষ্টম শতকের শেষ ভাগ থেকেই নালন্দার গৌরব হ্রাস পেতে থাকে, যদিও সে সময়ে তিব্বত ও গৌড়ের রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতা অব্যাহত ছিল। তবুও নালন্দার অতীত গৌরব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাল রাজত্বের শেষে (৭৫০-১১৭৪) নালন্দার গৌরবের দিনও শেষ হয়ে যায়। গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও অন্তর্কলহে নালন্দার আভ্যন্তরীণ আদর্শ তথা সমন্বয়ী বৈশিষ্টপূর্ণ জীবন যখন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে, তখনই বখতিয়ার খলজির বিহার অভিযান নালন্দার অবলুপ্তি ঘটায় বলে মনে করা হয়।
[৮]
বখতিয়ার খলজি মগধ অঞ্চলে ধ্বংস চালিয়েছিলেন, এর উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকদের একাংশ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়৬৪ তিনিই ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। উদন্তপুরী মহাবিহার ধ্বংসের দৃষ্টান্ত থেকেও বােধহয় নালন্দা ধ্বংসের জন্য বখতিয়ারকে দায়ী করা হয়। অনুমান নির্ভরতা ঐতিহাসিক সত্যের প্রমাণ হতে পারে না। প্রচলিত উপকথা ও জনশ্রুতির বিপরীতে এখানে বলে রাখা ভাল যে, নালন্দা মহাবিহার বখতিয়ারের বিহার অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নালন্দার ক্ষয়ক্ষতিগুলাে সবই প্রাক-ইসলামীয় যুগের। আর এক্ষেত্রে কয়েকবার যে অগ্নিকাণ্ড ঘটানাে হয় তার প্রমাণ। পােড়া চাল ও শীলমােহর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া যায়। অগ্নিকাণ্ডে বা অন্য কোনাে কারণে ধ্বংস হলেও তৎকালীন রাজন্যবর্গ, বিত্তশালী লােক ও ভিক্ষুদের সহায়তায় নালন্দা কয়েকবার পুনর্গঠিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সৌধগুলির তিনটি থেকে নয়টি পর্যন্ত পুনর্গঠনের স্তর পাওয়া যায়। দেখা যায় প্রতিবারই পূর্বের স্থাপত্যকর্মের ধ্বংসাবশেষের উপরই পুনর্নির্মিত ভবনগুলি গড়ে উঠেছে।
তবে কৌতুহলােদ্দীপক ঐতিহাসিক তথ্য হল এই যে, নালন্দা ধ্বংসের দায় বখতিয়ারের উপর চাপানাে হলেও তিনি কিন্তু নালন্দাতেই যাননি। তাহলে এই অপবাদ কেন? মূল ক্ষহল, ভারতে মুসলিম শাসন কতটা অসভ্য তা প্রমাণ করা। প্রচারণা এমনই যে, বখতিয়ার খলজি কতটা বর্বর হলে বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের মতাে এমন একটি জঘন্য কাজ করতে পারেন, গ্রন্থরাজিতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন! একই সঙ্গে এই বক্তব্যে আরও রং চড়িয়ে বলা হয় যে, মুসলিম শাসনের নিপীড়ন-অত্যাচারে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের আপাত অবলুপ্তি ঘটে। অথচ এমন বক্তব্য যে মিথ্যা ও প্রতারণাপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শত শত বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারে নিষ্পেষিত বৌদ্ধদের তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আড়াল করতে কী এই মিথ্যাচার? দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ঐতিহাসিক ডি এন ঝা মিনহাজের পুরাে বয়ান (যেটা রেভার্টিকৃত ইংরেজি সংস্করণ, পৃ. ৫৫১-৫২ হতে গৃহীত আবুল কালাম মােহাম্মদ যাকারিয়াকৃত বাংলা সংস্করণ, ২১১-১২ পৃষ্ঠাও পাঠক দেখতে পারেন) তুলে ধরেছেন এভাবে,
“He (Bakhtiyar Khalji) used to carry his depredations into those parts and that country until he organized an attack upon the fortified city of Bihar. Trustworthy persons have related on this wise, that he advanced to the gateway of the fortress of Bihar with two hundred horsemen in defensive armour, and suddenly attacked the place. There were two brothers of Farghanah, men of learning, one Nizam-ud-Din, the other Samsam-ud-Din (by name) in the service of Muhammad Bakht-yar; and the author of this book (Minhaj) met with at Lakhnawati in the year 641 Hizri, and this account is from him. These two wise brothers were soldiers among that band of holy warriors when they reached the gateway of the fortress and began the attack, at which time Muhammad-i-Bakhtiyar, by the force of his intrepidity, threw himself into the postern of the gateway of the place, and they captured the fortress and acquired great booty.The greater number of inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven; and they were all slain. There were a great number of books there; and, when all these books came under the observation of the Musalmans, they summoned a number of Hindus that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindus were killed.On becoming acquainted (with the contents of the books), it was found that the whole of that fortress and city was a college, and in the Hindui tongue, they call a college Bihar.”
অধ্যাপক ডি এন ঝা এরপর মন্তব্য করেন,
“The above account mentions the fortress of Bihar as the target of Bakhtiyar’s attack.The fortified monastery which Bakhtiyar captured was, known as Audand-Bihar or Odandapura-vihara’ (Odantapuri in Biharsharif then known simply as Bihar).This is the view of many historians but, most importantly, of Jadunath Sarkar, the high priest of communal historiography in India (History of Begal, Vol. 2, P.3-4).Minhaj does not refer to Nalanda at all : he merely speaks of the ransacking of the ‘fortress of Bihar’ (hisar-i-Bihar).”৬৫
বােঝায় যাচ্ছে, উদন্তপুরীকে ভুলে নালন্দা ভেবে ফেলা হয়েছে। বখতিয়ার নালন্দাতে যাননি।৬৬ তিনি অভিযান চালিয়েছেন উদন্তপুরে, কেননা এটাই ছিল সেসময়ের রাজধানী।
ঐতিহাসিক কে কে কানুনগাে ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল’-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্র দাশের ‘অ্যান্টিকু ইটি অফ চিটাগাঁও’ প্রবন্ধ থেকে জানাচ্ছেন যে, কাশ্মীরের বৌদ্ধ পণ্ডিত শাক্য শ্রীভদ্র ১২০০ সালে মগধে গিয়ে দেখেছিলেন বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার ভয়ঙ্করভাবে ক্ষিতিগ্রস্ত হয়েছে। তুর্কিদের ভয়ে শ্রীভদ্র ও ওই বিহার দুটির ভিক্ষুরা বগুড়া জেলার জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নেন।৬৭ কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশ তার উক্ত প্রবন্ধে এমন কথা বলেননি যে, ১২০০ সালে বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বরং তিনি তাঁর সম্পাদিত তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগ সাম জন জ্যাং’-এ (১৭৪৭ সালে সমাপ্ত)৬৮ বলেছেন, বিহার দুটি ধ্বংস হয়েছিল ১২০২ সালে। ফলে শাক্য শ্রীভদ্র জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা বখতিয়ারের বিহার অভিযানের (১২০৩) পুর্বেকার। আর এই বিহার অভিযানেও বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী মহাবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিহার দুটি ছিল বৌদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক মিনহাজ সিরাজী বিহার অভিযানের ৩৯ বছর পর লােকমুখে (১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানে অংশগ্রহণকারী দুই সৈনিক ছিলেন নিজামউদ্দিন ও সামসামউদ্দিন। এই দু-ভাই বিহার অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মুখে বিহার ও বাংলা অভিযানের কথা শুনেছিলেন মিনহাজ) শুনে সেই ঘটনা বর্ণনা করেন তার ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে। তার বর্ণনা মতে বােঝা যায় যে, বখতিয়ার সেই অপারেশনে ভুল করে উদন্ত পুরী মহাবিহারের উপর আক্রমণ চালান। কেননা মহাবিহারটি বাহির থেকে সামরিক দুর্গের মতাে দেখাচ্ছিল। পরে তিনি বুঝতে পারেন আসলে এটি ছিল একটা মহাবিহার তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই আক্রমণে প্রতিষ্ঠানের অধিবাসী বৌদ্ধ ছাত্র ও বৌদ্ধ ধর্মগুরু সকলে নিহত হয়। তবে কারাে মতে, সেই মঠটি ছিল নালন্দা। এও মনে করা হয়, যেহেতু দুটি মহাবিহারই কয়েক মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ছিল, সেহেতু উভয়ের ক্ষেত্রেই হয়তাে একই ঘটনা ঘটেছিল।৬৯
তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলির মধ্যে নালন্দার নাম নেই। মিনহাজ কেন অন্য কোনাে সূত্রেও নালন্দা ধ্বংসের কথা বলা হয়নি। ১২৩৪ সালে অর্থাৎ বখতিয়ারের বিহার জয়ের ৩০ বছর পর তিব্বতী সাধু ও জ্ঞানসাধক ধর্মস্বামী (১১৯৭-১২৬৪) মগধে আগমন করেন ও সেখানে অবস্থান করেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেটা কিনা বখতিয়ারের উদন্তপুর অভিযানের সময় ধ্বংস হয়েছিল, যেমনটা পণ্ডিতগণ অভিযােগ করেন। নালন্দা মঠকেও তিনি তখন চালু অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু অধ্যয়নে নিয়ােজিত ছিলেন।৭০ তাছাড়া ধর্মস্বামী লক্ষ করেন যে, বহু বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনও নালন্দা ও তার আশেপাশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।৭১ এমনকি নালন্দাও ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত যথাযথভাবে তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, বখতিয়ারের আক্রমণে ১২০৪ সালে নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে যে প্রচারণা ছিল ধর্মস্বামীর বিবরণে তার উল্লেখ নেই।৭২ তবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারকে ধ্বংস অবস্থায় ও উদন্তপুরীকে তুর্কি সামরিক ঘাঁটিরূপে দেখতে পান।
বখতিয়ার কি তাহলে উদন্তপুরীতে কী আছে জানার পরেও নালন্দা ও বিক্রমশীলা আক্রমণে এগিয়ে গিয়েছিলেন পর পর মহাবিহার তথা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দখল ও ধ্বংসের কালাপাহাড়ি লক্ষ্য নিয়ে? কিন্তু কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা এমন একথা বলব? মিনহাজউদ্দিন সিরাজী তাে স্পষ্টই লিখেছেন, বিহার বা সেকালের উদন্তপুরী অধিকারের পর বখতিয়ার দিল্লিতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের দরবারে ফিরে যান। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় উদন্তপুরী, বিক্রমশীলা এবং নালন্দা পরস্পরের কাছাকাছিই ছিল। উদন্তপুরী নালন্দা থেকে মাত্র ১৩ কিমি হওয়া সত্ত্বেও বখতিয়ার কেন নালন্দায় যাননি তার আর একটা কারণ, মুসলিম অভিযানের পথপরিক্রমা হতে নালন্দার অবস্থান ছিল বহুদূরে। দিল্লি হতে বাংলার পথনির্দেশিকা ছিল ভিন্ন রকম, সেখানে নালন্দার অস্তিত্বই ছিল না। এ প্রসঙ্গে ‘বায়ােগ্রাফি অব ধর্মস্বামী’ বইয়ের ভূমিকা-লেখক পাটনার কে পি জয়সােয়াল রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর অধ্যক্ষ Anant Sadashiv Altekar বলেছেন,
“Nalanda was not, like Vikramasila, on the highway leading from Delhi to Bengal, and so the work of completing its destruction required a special expedition.”৭৩
তিনি পরিষ্কার বলেছেন, এরকম আরও কিছু কারণের জন্যই নালন্দা তুর্কি আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় অন্য একটা চিত্র তুলে ধরেছেন ওয়াশিংটনের Kevin Alschuler University-এর রিলিজিয়াস স্টাডিজের প্রফেসর জোহান এলভার্সগ তাঁর ‘বুদ্ধইজম অ্যান্ড ইসলাম অন দ্য সিল্ক রােড’ বইয়ে। বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্কের কথা তিনি তুলে ধরে বলেছেন,
“This is problematic for many reasons, not the least being that the story of Nalanda is not true. For example, not only did local Buddhist rulers make deals with the new Muslim overlords and thus stay in power, but Nalanda also continued as a functioning institution of buddhist education well into the thirteenth century.One Indian master, for example, was trained and ordained at Nalanda before he travelled to the court of Khubilai Khan.We also know that Chinease monks continued to travel to India and obtain Buddhist texts in the late fourteenth century.”৭৪
অর্থাৎ বখতিয়ার খলজির অভিযানের প্রায় ১০০ বছর পরও নালন্দা সচল ছিল। তাহলে নালন্দা ধ্বংস হল কিভাবে? এটা হিন্দু ও বৌদ্ধ সংঘাতের ফলশ্রুতি নয় তাে? এর জমাটি উত্তর দিয়েছেন ঐতিহাসিক ডি এন ঝা। তিনি বলেছেন যে, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৌদ্ধদের মধ্যকার চলতে থাকা ঘাত-প্রতিঘাতেই নালন্দা ধ্বংস হয়। এই ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঝা অনেকগুলাে তিব্বতি রেফারেন্সও দিয়েছেন।৭৫
এখানে আর একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, বখতিয়ার খলজি কেন ভুলে উদন্তপুর বিহার আক্রমণ করলেন। তিব্বতী কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী তাঁর ‘ভাদ্রকল্পদ্রুম’-এ বলেন যে, সেসময় বৌদ্ধদের নিজেদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মত ও ধারা প্রচলিত ছিল। সেদিন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের মধ্যে কলহ-বিবাদ এতই উত্তেজনার শিখরে ওঠে যে তাদের একপক্ষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময়ে তুর্কির মুসলিম আক্রমণকারীদেরকে তাদের ওখানে আক্রমণ চালাতে প্রতিনিধি পাঠায়। লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে এই প্রেরিত প্রতিনিধিত্ব লক্ষ্মণ সেনেরই ইচ্ছার প্রকাশ ঘটায়। তিনি চেয়েছিলেন, বৌদ্ধদের (মতা সেখানে ভেঙে পড়ুক। এই উদ্দেশ্যে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিবাদের সূত্র লালন করেন ও দুই বিবাদীর একপক্ষকে বিদেশিদের সাহায্য নিতে উৎসাহ দান করেন। এতে তিনি তাদের দুর্বল করে ফায়দা নিতে চেয়েছিলেন। ফলাফল যেটা হল, বখতিয়ারকে যেভাবে গাইড করা হয়েছে সম্ভবত সেভাবেই তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। বিহার আক্রমণ প্রতিহত করতে যাঁরাই বাধা দিয়েছে তুর্কি সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করেছে। মিনহাজের বিবরণে স্পষ্ট হয় বখতিয়ার জানতেন না যে, উদন্তপুর ছিল বৌদ্ধদের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেখানে সারি সারি পুস্তক দেখে অনুসন্ধান করে জানেন যে, সেটা কোনাে সেনাদুর্গ ছিল না।৭৬ এই বক্তব্য প্রায় সমস্ত সাের্সই নিশ্চিত করেছে।
তাহলে কি তুর্কি সেনাবাহিনীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে? এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের অতি পুরাতন ও বহুল ব্যবহৃত কুটনীতি ও কৌশল যে, তারা স্থানীয় শত্তির মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরােধকে কাজে লাগিয়ে শত্রুর শত্রুকে দিয়ে নিজের শত্রুকে শায়েস্তা করেন। এ দৃষ্টিতে কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রীর বর্ণনাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় আবদুল মােমেন চৌধুরীর ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ বুদ্ধিজম ইন সাউথ এশিয়া’ গ্রন্থ৭৭ থেকে। তাছাড়া অধ্যাপক যােহান এলভার্সগ তার পূর্বোক্ত গ্রন্থে ভারতে বৌদ্ধ-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বৌদ্ধদের উপর মুসলিম সেনাপতি ও শাসকগণ অত্যাচার করেছেন এই ধারণাকে তিনি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের শত্রুতার প্রচলিত ধারণা পশ্চিমা জগতে তৈরি হয় এবং এটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয় আফগানিস্থানের তালিবান কর্তৃক ২০০১ সালে বিশাল বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে।৭৮
অন্যদিকে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পাল যুগের সমন্বিত মানবিক সমাজ সেন যুগে এসে শ্রেণি বৈষম্যে এবং বর্ণ বৈষম্যে একেবারেই ভেঙে পড়ে। ধর্ম পালনের অধিকার, সংস্কৃত এবং নিজ কথ্যভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে এসময়ে অনেক বৌদ্ধ, নাথ, সহযান প্রভৃতি উদারপন্থীরা প্রাণ-মান বাঁচাতে হিন্দুধর্মে ফিরে যায়। অনেকে তাদের জ্ঞান তথা সাহিত্য, দর্শনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। উল্লেখ্য যে, পালযুগে ব্রাহ্মণরা ভূ-সম্পত্তি দান হিসেবে লাভ করলেও সেন যুগে কোনাে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনাে ব্যক্তি বা পুরােহিতের ভূমি লাভের কোনাে প্রমাণাদি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পূজা-অর্চনার ক্ষেত্রেও মেলেনি কোনাে বৌদ্ধ বা সাধনবাদী দেব-দেবীর অস্তিত্ব। কৌম জীবন থেকে রাজ শাসনের আওতায় প্রবেশ পর্যন্ত দীর্ঘ হাজার বছরের মধ্যে বাংলা এরূপ সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে সংঘাতময় জীবন প্রত্যক্ষ করেনি বলেই জানা যায়। বস্তুত সেন যুগেই বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজ সাম্প্রদায়িক সংঘাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সমাজের সর্বত্র দেখা দেয় অতিমাত্রায় ভেদ বৈষম্য, ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত বৈষম্য এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত। যার অনিবার্য পরিণতি হল শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা সমাজের সর্বত্র অধােগতি।
[To Be Continued]
[প্রথম পর্ব] – [দ্বিতীয় পর্ব] [তৃতীয় পর্ব]
আরও পড়ুন,
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননিঃ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
তথ্যসূত্রঃ
- ৫২. জ্যোতিবিকশ বড়ুয়া সম্পাদিত, পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ, অ্যাডর্ন পাবলিশেন, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৪১।
- ৫৩. Amalananda Ghosh, ibid, P. 13.
- ৫৪. ভাস্করনাথ মিশ্র, নালন্দা সাের্সের্স অ্যান্ড ব্যাক গ্রাউন্ড, খণ্ড-৩, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩২।
- ৫৫. জ্যোতিবিকশ বড়ুয়া সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।
- ৫৬. র্যানডল কলিন্স, দ্য সােসিওলজি অফ ফিলােজফিজ এ শেবাল থিওরি অফ ইনটেলেকচুয়্যাল চেঞ্জ, ভলিউম-৩০, ইস্যু ২, ফিলােজফি অফ দ্য সােস্যাল সায়েন্সেস, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০০, পৃ. ২৪০।
- ৫৭. অমলানন্দ ঘােষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।
- ৫৮. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৬-২৭।
- ৫৯. সুকুমার দত্ত, বুদ্ধিস্টিক মঙ্কস অ্যান্ড মােনাস্টারিজ অফ ইন্ডিয়া দেয়ার হিস্টরি অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশন টু ইন্ডিয়ান চালচার, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড, লন্ডন, ১৯৮৮ (প্রথম প্রকাশনা, ১৯৬২), পৃ. ২৬৪। আরও দেখুন- সি হামফ্রেজ, দ্য উইসডম অফ বুদ্ধইজম, সাইকোলজি প্রেস লিমিটেড, লন্ডন, ১৯৮৭, পৃ. ১১১।
- ৬০. রাধাকুমুদ মুখার্জি, এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান এডুকেশন ব্রহ্মনিক্যাল অ্যান্ড বুদ্ধিজম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ম্যাকমিলন, লন্ডন, ১৯৫১, পৃ. ৫৭৯-৮০।
- ৬১. লালমনি যােশী, স্টাডিজ ইন দ্য বুদ্ধিস্টিক কালচার অফ ইন্ডিয়া, মতিলাল বানারসি দাস, প্রথম সংস্করণ, নিউ দিল্লি, ১৯৮৭।
- ৬২. কে এল হাজরা, বুদ্ধিজম ইন ইন্ডিয়া অ্যাজ ডেসত্র(ইভ বাই দ্য চাইনিজ পিলগ্রিম, মুন্সি মনােহরলাল, নিউ দিল্লি, ১৯৮৩, পৃ. ১১৬।
- ৬৩. জে তাকাকুসু (ট্রান্সলেটেড), প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪-৪৬।
- ৬৪. প্রসঙ্গত বলা যায় যে, নালন্দার পরিচিতি ছিল কেবল বিবিদ্যালয়ের কারণে, অথচ এরকম মহাবিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) তখন আরও ছিল। যেমন সৌরাষ্ট্রের বলভী বিশ্ববিদ্যালয়। এটাও নালন্দার মতােই ২০০ গ্রাম থেকে রাজস্ব পেত। (ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া এ কনসাইজ হিস্ট্রি, বাংলা সং- আদি ভারত একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ১৮০)। কাঞ্চির বিশ্ববিদ্যালয়ও নালন্দার মতই খ্যাতি পেয়েছিল (রােমিলা থাপার, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট লংমেন, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১৩৪)। সােমপুর মহাবিহারও সে সময়ে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “ভারতবর্ষে এ পর্যন্ত যত বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার মধ্যে এই সােমপুর মহাবিহারই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। এই বিহারটি যখন সম্পূর্ণ ছিল তখন ইহার বিশালত্ব ও সৌন্দর্য্য লােকের মনে বিস্ময় উৎপাদন করিত। একখানি সমসাময়িক লিপিতে ইহা ‘জগতাং নেকৈবিশ্রাম-ভূত’ (জগতের নয়নের একমাত্র বিরামস্থল অর্থাৎ দর্শনীয় বস্তু) বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহার ‘মহাবিহার’ নাম সার্থক ছিল।” (দেখুন-রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, খণ্ড-১, প্রথম দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ২০৫)। তাছাড়া আধুনিক গবেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, নালন্দা মহাবিহারকে আর যাই হােক আধুনিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা যায় না। নালন্দার ইতিহাস বৌদ্ধযুগের শেষ পর্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ, ইৎ-সিং, হুই-লি প্রমুখের লিখিত বিবরণ থেকে নালন্দা সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। নানাভাবে আর্থিক সাহায্য পুষ্ট হয়ে নালন্দায় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধদের এক বিশালায়তন মহাবিহার। একটা বিশাল শি(কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এখানে, যা প্রায় ৮০০ বছর (পঞ্চম থেকে ত্রয়ােদশ শতক) ধরে সমগ্র এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখানকার গ্রন্থাগারটিও ছিল বিখ্যাত। এমন সব তথ্যের ভিত্তিতে নালন্দার শিক্ষায়তনটিকে বিশ্ববিদ্যালয় ভেবে ফেলা হয়েছে। টোল-চতুষ্পঠী জাতীয় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগে ভারতে গড়ে উঠেছিল, একথা সত্যি। মুসলিম বাদশাহদের আমলেও বহু বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির মতাে শিক্ষায়তন প্রাচীন ও মধ্যযুগে শুধু ভারতে কেন ইউরােপেও গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠবার মত বাস্তব পরিস্থিতিও তখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। পঞ্চম থেকে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত ভারতে স্মৃতিশাস্ত্র অনুমােদিত জাতিভেদ প্রথা যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল তাতে এমনিতেই সমাজের তিন-চতুর্থাংশ লােকের বিদ্যাশিক্ষার কোনাে অধিকারই ছিল না। ব্রাহ্মণদেরও গরিষ্ঠ অংশ পূজাপাঠ-পৌরহিত্য-জ্যোতিষচর্চা করেই সন্তুষ্ট ছিল। সত্যি কথা বলতে উনিশ শতকের শেষ কিংবা বিশ শতকের গােড়া পর্যন্তও নালন্দা-তক্ষশীলা-বিক্রমপুরের মত প্রাচীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা কারাের মাথাতে আসেনি। তবে এটা মানতেই হবে যে, এই মহাবিহার তিনটি আদিযুগেও বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে বিদ্যাচর্চার (আদিযুগে যেমন হওয়া সম্ভব) ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছিল।
- ৬৫. ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৯ জুলাই, ২০১৪।
- ৬৬. ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৯ জুলাই, ২০১৪।
- ৬৭. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ৩২-৩৩, নীহাররঞ্জনরায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১১।
- ৬৮. ‘পাগ সাম জন জাং’ আঠারাে শতকের এক তিব্বতী পণ্ডিতের লেখা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। শরৎচন্দ্র দাস ১৯০৮ সালে ইংরেজি সূচিপত্র ও টীকাসহ এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। পাগ সাম জন জ্যাং হিস্টরি অফ দ্য রাইজ, প্রােগ্রেস অ্যান্ড ডাউনফল অফ বৌদ্ধইজম ইন ইন্ডিয়া, এডিটেড বাই শরৎচন্দ্র দাস, প্রেসিডেন্সি জেল প্রেস, কলকাতা, ১৯০৮। এই বইটির এখনও কদর আছে।
- ৬৯. এইচ ধীরাজ সাংকালিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, বি জি পাল অ্যান্ড কোম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯৩৪, পৃ. ২১২।
- ৭০. জর্জ রােয়েরিখ সম্পাদিত, বায়ােগ্রাফি অফ ধর্মস্বামী, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৫৯, ইনট্রোডাকশন, পৃ. XX.
- ৭১. জর্জ রােয়েরিখ সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, ইনট্রোডাকশন, পৃ. xix.
- ৭২. জর্জ রােয়েরিখ সম্পাদিত, ইনট্রোডাকশন, ভূমিকা, পৃ. xix. পণ্ডিত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ এই মত পােষণ করেন যে, মুসলমান আক্রমণের পরও সেখানে বহু মন্দির ও বিহার নির্মিত হয়েছিল। (রমেশচন্দ্র মিত্র, ডেকলাইন অফ বুদ্ধইজম ইন ইন্ডিয়া, শান্তিনিকেতন, ১৯৪৯, পৃ. ৪৬)। লামা তারানাথও তার বর্ণনায় গুজরাট, রাজপুতানায় মুসলমান বিজয়ের পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের পুনরুজ্জীবনের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বুদ্ধচরিত’ (১৯১১) নামে একটি পদ্য রচনার কথা বলা যায়, যেখানে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে। সুতরাং বৌদ্ধধর্মের প্রায়-অবলুপ্তির কোনাে নির্দিষ্ট তারিখ বা প্রকৃতির সঠিক বর্ণনা করা দুরুহ ব্যাপার।
- ৭৩. জর্জ রােয়েরিখ সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, ইনট্রোডাকশন, পৃ. XX.
- ৭৪. যােহান এলভাসকগ, বুদ্ধইজম অ্যান্ড ইসলাম অন দ্য সিল্ক রােড, ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া প্রেস, ২০১০, ইনট্রোডাকশন, পৃ. ২।
- ৭৫. ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৯ জুলাই, ২০১৪।
- ৭৬. জার্নাল অফ বরেন্দ্র রিসার্চ সােসাইটি, রাজশাহী, ১৯৪০। ৭৭. আবদুল মােমেন চৌধুরী, দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ বুদ্ধিজম ইন সাউথ এশিয়া, ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়া, লন্ডন, ২০০৮।
- ৭৮. যােহান এলভার্সকগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।