লিখেছেনঃ উত্তম সরকার
সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ সংবাদের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে। এরপর মুদ্রণের আবিষ্কারের পর থেকে ভাবা হয় সংবাদপত্রের কথা যার মাধ্যমে সংবাদের আদান-প্রদান করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই উদ্ভব মিডিয়ার। মিডিয়ার প্রকৃত অর্থ মাধ্যম, আর যে মাধ্যমের মারফত আমরা সংবাদ পেয়ে থাকি সেটাই সংবাদ মাধ্যম বা News Media. সংবাদপত্রের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের পুরােনাে। সেই সময় শুধুমাত্র Print Media-র উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমানে Print Media-র উন্নতিলাভ এবং Electronic Media-র সূচনা ঘটে গেছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির হাত ধরে। Electronic Media দুই প্রকারের। প্রথমটি হল বেতার মাধ্যম যার মাধ্যমে শুধু সংবাদ শােনা যায় এবং আরেকটি হল Television যার মাধ্যমে সংবাদ দেখা ও শােনা উভয় কাজই সম্পন্ন হয়। এরপর বিজ্ঞানের অবদান এভাবেই শেষ হয়নি, আরও এসে গেছে আধুনিককালে কম্পিউটারভিত্তিক অন লাইন সাংবাদিকতা। এইভাবেই বিজ্ঞানের হাত ধরে মিডিয়া জগতে চলে আসে। সন্ত্রাসবাদের কালাে ছায়া।
Electronic Media-র মূল ভিত্তি হল Television অথবা কম্পিউটার। এদের যুগ্ম প্রচেষ্টায় মিডিয়ার জগতে চলে আসে Total revolution. এটা যেমন আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়েছে ঠিক তেমনভাবেই অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিশাপই সন্ত্রাসবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি ‘আতঙ্ক’ শব্দ থেকে। সন্ত্রাসবাদ মানে শুধু এই নয় যে হানাহানি, রক্তপাত, ভয়ংকর কোনাে আর্তনাদ—এর মানে কখনও বাইরেও তার প্রকাশ ঘটে যেতে পারে। আগে আমরা খুব সীমিত পরিমাণে সংবাদ জানতে পারতাম, কিন্তু বর্তমানে মিডিয়ার উন্নতির সাথে সাথে আমরা এত বেশি জানতে পেরে যাচ্ছি যে, তা কোনাে কোনাে সময় বিপদের কারণ হয়ে যায়। কোনাে সময় কোনাে সংবাদ এত বেশি পরিমানে মিডিয়ার প্রকাশ পায় যে তা থেকে মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে যায়। অনেক সময় মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে ও জানতে পারি কোনাে হৃদয়হননকারী ঘটনা বা কোনাে লজ্জার ঘটনা যা দেখে হয়তাে আমাদের মনে সৃষ্টি হতে পারে কালােছায়ার বাতাবরণ। এইভাবে ক্রমশ যতবেশি এইসমস্ত ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকব ততবেশি পরিমাণে সুস্থ মানবিক বােধের হ্রাস পেতে থাকব। শুধু এই ভাবা ভুল হবে যে Electronic Media-ই শুধু সন্ত্রাসবাদে সাহায্য করছে, কারণ। অনেকসময় সংবাদপত্র ও এই বিষয়ে পিছিয়ে থাকে না। সংবাদপত্রও অনেক সময় শুধুমাত্র শক্তিশালী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ও অর্থ তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়। কিছু উঁইফোঁড় মালিকের আবির্ভাব সংবাদপত্রের সমাজকল্যাণমূলক গতি প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। প্রথম প্রেস কমিশন ভারতীয় সংবাদপত্রের এই ভুঁইফোঁড় মালিক সম্পাদকের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনঃ “Some of the persons at present owning or controlling newspapers, have had no previous connection with or training in journalism. There are others, who while conducting newspapers, are primarily interested in other activities. There are some who are generally reputed to have indulged in anti-social activities.”
এইভাবে সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা সংবাদপত্র কলুষিত হয়ে পড়ছে। সমগ্র মিডিয়া জগই মাঝে মধ্যে এইভাবে সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসাবে কাজ করে থাকে।
মিডিয়া যে পথে সন্ত্রাসবাদ ঘটিয়ে থাকে তার কিছু নমুনা দেওয়া হল,
- (ক) কখনাে রক্তাক্ত কাহিনী দেখিয়ে মানুষের মনে এর বিভীষিকা ঢুকিয়ে দেওয়া। সংবাদপত্রগুলিতে একই Headline বারবার প্রকাশ পায়। এই ব্যাপারে Electronic media-র অসামান্য অবদান। সব সময় News chanel-এ দেখা যায় একই বিষয় নিয়ে সমালােচনা হতে অথবা একই ঘটনার দৃশ্য পুনঃপ্রচার হতে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া নন্দিগ্রামের দৃশ্য সবসময় Television-এর প্রধনা ও মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। নন্দিগ্রামের রক্তাক্ত কাহিনি এত বার দেখানাে হয়েছে যে তার বিভীষিকা মানুষের মনে অবশ্যই প্রবেশ করেছে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে মানুষের মনে সন্ত্রাসবাদ দানা বাঁধতে থাকে।
- (খ) আবার কিছু ঘটনা দেখে মানুষজন হিংসাত্মক কাজকর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় নিদর্শন 21 Nov. 2007-এ ঘটে যাওয়া তসলিমা নাসরিনের ঘটনা। এর জন্য মিডিয়াই ছিল পরােক্ষভাবে দায়ী। মিডিয়াতে এ ব্যাপারে এত বেশি পরিমাণে দেখানাে ও শােনানাে হয়েছে যে মানুষজন বিদ্রোহী হয়ে পড়ে। যারা এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল তাদের অধিকাংশ মানুষজনেরা এই তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ পড়েইনি! তারা মিডিয়ার জন্যই এমনটি করেছিল।
- (গ) কিছু নােংরা ঘটনা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাজবিরােধীর পথে ঠেলে দেওয়া হয়। এইরকমটা হয়ে থাকে বিভিন্ন অপহরণ, মার্ডার-এর কাহিনি, অথবা শ্লীলতাহানির মতাে নােংরা কাহিনি বেশি পরিমাণে প্রকাশের জন্য। Elec tronic Media-তে এটা বেশি ঘটে থাকে।
- (ঘ) মাঝে মধ্যে জাতি বৈষম্য বাড়িয়ে তােলা হয়। এখানে তসলিমার ঘটনা উল্লেখযােগ্য।
- (ঙ) Electronic Media-তে বেশ কিছু news live telecast করা হয়, যে সমস্ত ঘটনা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সেইসব দৃশ্যে থাকতে পারে কোনাে ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই বা গােলাগুলি বা সংঘর্ষের সরাসরি প্রচার।
- (চ) বর্তমানে রাজনীতির ফাঁদে আটকে গেছে কিছু মিডিয়া। তারা বিপরীত পার্টির অপকর্মের ঘটনা জানাতেই ব্যস্ত। এতে তাদের পার্টির লােকেরা মনে বিপরীত পার্টির ললাকের প্রতি ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। রাজনীতির খবর প্রচুর পরিমাণে ও জঘন্যভাবে পরিবেশিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের মনে সন্ত্রাস জেগে ওঠে। সেই মনের সন্ত্রাসটাই কিছু সময় বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায়।
- (ছ) এখন আমরা সবধরনের crime জানতে পারছি। রেপ করার মতাে নোংরা কাজের পর কীভাবে নিজেকে বাঁচানাে যায় তার বিবরণও জানা যাচ্ছে মিডিয়াতে। কিডন্যাপ কীভাবে করছে তার ছকও জানা যাচ্ছে। এতে পরে যারা এই সমস্ত কাজ করবে তারা খুব সহজেই পথগুলি অনুসরণ করতে পারবে। নীচে একটা ঘটনা ও তার ছক দেখানাে হল যেটা একটা Newspaper print করা হয়েছিল।
Gas Plot to kill Tenants
ছকটিতে দেখানাে হয়েছে কাউকে বা কোনাে পরিবার ধ্বংসের পরিকল্পনা। এরপর যারা এই নােংরা কাজ করার ইচ্ছায় থাকবে তারা খুব সহজেই এই পথ অবলম্বন করতে পারবে। এইভাবেই ক্রমশ সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়বে।
মিডিয়াকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সুপ্ত ভূমিকায় থাকতে হবে, তবেই এই সমস্যার হাত থেকে রক্ষাপাওয়া যাবে। কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়া তে শান্তির বাণী প্রচার করা প্রয়ােজন। প্রত্যেকে যদি শান্তির পথ অবলম্বন করে এগিয়ে যায় তবেই বাঁচবে এই সুন্দর পৃথিবী। সংবিধানের নিয়মানুসারে প্রতিটা মানুষই স্বাধীন। কিন্তু কোথায় আমরা স্বাধীন? সবসময় পরাধীনতার ছােবল আমাদের উপর এসে পড়ছে। প্রতিটা সময় নিজেদেরকে অসহায় মনে হয়। এটাই কি স্বাধীন থাকা, নাকি পরাধীনতার মধ্যে থেকে স্বাধীন থাকার উন্মাদনা। একমাত্র মিডিয়াই পারে এর সমাধান করতে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মােকাবিলা করতে। মিডিয়া নিজেকে বাণিজ্যের শাখা মনে না করে, দল ও সরকার নিরপেক্ষ হয়ে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্ভুল সংবাদ পরিবেশনার মাধ্যমে গণমুখী (man based) হয়েই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সকলের প্রচেস্টা, আকাঙ্খ ও মনােবলের মাধ্যমে মিডিয়াকে উন্নত করে সন্ত্রাসবাদের রক্তাক্ত ছােবল-এর হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারব।
[লেখক সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক]
Download the Nobojagaran App