লিখেছেনঃ সন্তোষ রাণা
প্রাক বৃটিশ যুগে মােগল আমলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই সরকারি কাজকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। হিন্দুরা বেশির ভাগ জমিজমা ও ভূমি-রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং ব্যবসা বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। অপরদিকে মুসলমানরা প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনীতে আধিপত্য করতেন। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই হিন্দু বা মুসলমানের একক আধিপত্য ছিল না। রাষ্ট্র এ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য করত না।
পলাশি যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজরা প্রশাসন, বিচার-বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনীতে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে। তাছাড়া বহু মুসলমান জমিদারকেও কোনাে না কোনাে অজুহাতে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এই নীতিগুলির ফলে মুসলমান উচ্চ ও মধ্য শ্রেণী বিরাট আঘাত পান।
এছাড়া ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষকদের জীবনে অবর্ণনীয় দুর্দশা নামিয়ে আনে। এর ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী কৃষকেরাই সর্বস্বান্ত হন। বাংলার মুসলমানদের বড় অংশ ছিলেন কৃষক। ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার প্রবর্তন মুসলমানদের জীবনে বিরাট সর্বনাশ ডেকে আনে। তদুপরি ইংরাজ শাসকেরা শিক্ষাবিস্তার ও অন্যান্য সেবামূলক কাজে মুসলমান শাসকদের দেওয়া বহু নিষ্কর জমি কেড়ে নেয়। এর ফলে মুসলমান। সমাজের শিক্ষা প্রসারের কাজটি বিরাটভাবে ধাক্কা খায়।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে ভারতীয় হস্তশিল্পী, বিশেষত তঁতীদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ঔপনিবেশিক শাসকরা এ দেশকে বিদেশে তৈরি কাপড় ও অন্যান্য পণ্যের বাজারে পরিণত করে। যে হস্তশিল্পীরা বংশপরম্পরায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিলেন, তাঁরা এখন সর্বস্বান্ত হলেন। তাঁতীরা ছিলেন মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু। এইভাবে তাদের জীবনে আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে।
১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সরকারি কাজকর্মে ফার্সির বদলে ইংরাজি ভাষার প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে মুসলমানরা সরকারি চাকরি থেকে পুরােপুরি বাদ পড়ে যান। ১৮১৭ সালে ইংরাজি শিক্ষার মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠে হিন্দু কলেজ। তাতে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার ছিল না। মুসলমানরা বারংবার দাবি করার পর ১৮৫০ সালে ক্যালকাটা মাদ্রাসায় ইংরাজি শিক্ষার একটি বিভাগ খােলা হয়। এদিকে ১৮৪৪ সালে সমস্ত উচ্চপদ ইংরাজি জানা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ১৮৬৩ সাল থেকে দারােগা এবং মুন্সেফ পদের জন্যও ইংরাজিতে ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ফার্সির বদলে ইংরাজি চালু করার ফলে মুসলমানরা সরকারি চাকরি থেকে পুরােপুরি বাদ পড়ে যান। অপরদিকে, উচ্চবর্ণ হিন্দুরা বিশেষত বাংলার ভদ্রলােকশ্রেণী প্রথম থেকে ইংরাজি শিক্ষার সুযােগ নিতে থাকেন এবং ইংরাজরা প্রশাসনের যেটুকু জায়গা নেটিভদের জন্য ছাড়ে সেগুলি পূরণ করতে থাকেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটা স্থায়ী বিভাজন তৈরি করার নীতি ইংরেজরা সচেতনভাবেই অনুসরণ করে।
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ইংরাজদের নীতিতে কিছু বদল ঘটে। ভারতীয় মুসলমানরা শুধু ধর্মের কারণেই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে কি না তা অনুসন্ধান করার জন্য গভর্ণর জেনারেল মেয়াে, ডবলিউ, ডবলিউ. হান্টারকে নিয়ােগ করেন। ১৮৭১ সালে হান্টারের বই “দি ইন্ডিয়ান মুসলমান” প্রকাশিত হয়। তাতে হান্টার এই মত প্রকাশ করেন যে “ব্রিটিশ রাজত্বে এই জাতির সর্বনাশ হয়েছে, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা অত্যন্ত তীব্র” এবং “তারা যে কোনাে সময়ে যুদ্ধবিগ্রহের মত কার্যকলাপের মাধ্যমে এই চেতনার প্রকাশ ঘটাতে পারে।” হান্টারের রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ারর পর ইংরাজ সরকার মুসলমানদের মধ্যে থেকে একটি ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যশ্রেণী গড়ে তােলার দিকে মনােযােগ দেয়।
হান্টারের রিপাের্ট “দি ইন্ডিয়ান মুসলমান” ভারতে মুসলমানদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা অনুসন্ধানের প্রথম সরকারি উদ্যোগ। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে মুসলমানদের জন্য সমানাধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার কোন ইচ্ছা ইংরাজের ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করা।
২০০৫ সালে ভারত সরকার যখন ভারতে মুসলমানদের আর্থিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা নিয়ে পর্যালােচনার জন্য সাচার কমিটি নিয়ােগ করলেন, তখন তার পিছনে সৎ কোনাে উদ্দেশ্য ছিল, নাকি বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী অভ্যুত্থানে আতঙ্কিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার ভারতীয় দালালরা মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমনের একটা সেফটি-ভালব হিসাবে একে ব্যবহার করতে চাইছিলেন তা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু রিপাের্টটিতে রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের তথ্যভিত্তিক দলিল। সেকারণে রিপাের্টটি ভারতীয় জনসাধারণের কাছে পৌছনাে অত্যন্ত জরুরি। ৪৫০ পাতার ইংরাজিতে লেখা একটি রিপাের্ট খুব কম ভারতবাসীই পড়তে পারবেন। তাই আমরা সন্তোষ রাণার লেখা এর একটি সংক্ষিপ্তসার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় প্রকাশ করছি। লেখাটি শ্রী রাণা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তুত করেছিলেন ‘দিনকাল’ পত্রিকার জন্য। এটি পত্রিকাটির জানুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
নিম্নবর্ণ হিন্দু, তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও মুসলমান সহ পশ্চাদপদ জনগােষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সমানাধিকার জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজে গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার সংগ্রাম যাঁরা চালাচ্ছেন। তঁাদের যদি কিছু লাভ হয় তাহলেই আমাদের উদ্যোগ সার্থক হবে। [সাবির আহমেদ/সুমিত সিনহা]
সাচার রিপোর্টঃ মুসলিম বঞ্চনার দলিল
সরকারি নির্দেশনামা
৯ই মার্চ ২০০৫, ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এক উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে এবং ভারতে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার উপর এক রিপাের্ট তৈরি করার দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে অর্পণ করে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। কমিটির কাছে সরকারি বিজ্ঞপ্তি যে কাজগুলি করতে বলে সেগুলি হল : কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তর এবং রাজ্য সরকারি দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এবং প্রকাশিত সংখ্যাগণিত, গবেষণাপত্র ও পুস্তকাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে রাজ্য, অঞ্চল ও জেলা স্তরে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে মুসলমানদের আপেক্ষিক অবস্থা বিচার করা। এজন্য নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি করা হয় :
- ১। মুসলমানরা ভারতের কোন কোন রাজ্য, অঞ্চল ও জেলায় অধিক সংখ্যায় রয়েছেন?
- ২। তারা কী ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত?
- ৩। তাদের আয় ও সম্পত্তির পরিমাণ কী রকম?
- ৪। সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশের বিভিন্ন মাপকাঠিতে, যেমন সাক্ষরতার হার, স্কুল-ছুট-এর হার, প্রসূতির হার, শিশু মৃত্যুর হার, ইত্যাদিতে তাদের অবস্থা এবং অন্যান্য জনগােষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা।
- ৫। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্তিতে তাদের অংশ কতটা? এই প্রশ্নে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে তুলনা। নিযুক্তিতে তাদের অংশ কি জনসংখ্যার সমানুপাতিক? যদি না হয়, তাহলে কেন নয়?
- ৬। বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসিদের মধ্যে মুসলমান ওবিসিদের অংশ কতটা? সরকারি ক্ষেত্রের নিযুক্তিতে মুসলমান ওবিসিদের অংশ কতটা? কেন্দ্রীয় সংস্থায় এবং বিভিন্ন রাজ্য সংস্থায় তাদের পরিস্থিতি কী?
- ৭। মুসলমান সমাজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা কতটা পান, পৌরসভার দেওয়া সুযোগ সুবিধা কতটা পান এবং সরকারি ও ব্যাংক ঋণের সুযােগ কতটা পান?
- ৮। উপরােক্ত তথ্য সমূহ, একত্রিত ও সংহত করে সরকারি হস্তক্ষেপের সেইসব ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করা যেগুলি মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার সঙ্গে যুক্ত।
রিপাের্টের সাধারণ কাঠামাে
উপরােক্ত নির্দেশিকার ভিত্তিতে কমিটি তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলির বিশ্লেষণ করে এবং তাদের সুপারিশ সহ একটি রিপাের্ট প্রস্তুত করে। নভেম্বর ২০০৬-এ সেই রিপোের্ট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা পড়ে।
রিপাের্টটি খুব বড় প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠর। এর মধ্যে প্রথম ২৫০ পৃষ্ঠার মধ্যে রয়েছে ১২টি পরিচ্ছেদ। তারপরের ২০০ পৃষ্ঠায় সংযােজনী হিসাবে রয়েছে। বিভিন্ন সারণী, টীকা ও উল্লেখসমূহ।
প্রথম পরিচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে কমিটির কর্তব্য, এবং তা সম্পাদন করার জন্য গৃহীত প্রণালী ও পদ্ধতি। কমিটির তথ্যের জন্য যেসব উৎসের উপর নির্ভর করে, সেগুলি হল:
- ১। ২০০১ লােক গণনা রিপাের্ট : এই রিপাের্ট থেকে নেওয়া হয়েছে সমগ্র জনসংখ্যার তথ্য, মুসলমানদের জন্য তথ্য, তপশিলী জাতি ও জনজাতিদের জন্য তথ্য, অন্যান্য সংখ্যালঘু সংক্রান্ত তথ্য এবং কখনাে কখনাে সমস্ত হিন্দুদের জন্য তথ্য।
- ২। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংগঠনের ৫৫-তম ও ৬১-তম দফা থেকে প্রাপ্ত তথ্য। মুসলমান ওবিসি সম্পর্কে তথ্যও এখান থেকে নেওয়া।
- ৩। ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠন সম্পর্কে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য ছাড়াও নাবার্ড (NABARD), সিডবি (SIDBI) ও জাতীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগম (NMDFC) ইত্যাদির তথ্য।
- ৪। বিভিন্ন সরাকরি কমিশন যেমন জাতীয় পশ্চাদপদ শ্রেণী কমিশন, বিভিন্ন রাজ্যের পশ্চাদপদ শ্রেণী কমিশন, ইত্যাদির তথ্য।
- ৫। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সরবরাহ করা তথ্য।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে বিভিন্ন গণ-ধারণা সমূহ। যেমন : মুসলমানরা নিজেদের পরিস্থিতি সম্পর্কে কী ভাবেন বা অন্যান্য জনগােষ্ঠী তাদের। সম্পর্কে কী ভাবেন, ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি লিপিবদ্ধ করার সময় রিপাের্টে সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে যে, সব ধারণাগুলি সঠিক নাও হতে পারে। আবার এটাও বলা হয়েছে যে এই ধারণাগুলির কোনাে না কোনাে ভিত্তি আছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, জনসংখ্যার বয়স ও লিঙ্গভেদে বণ্টন, শহরে বাস, শিশু পুষ্টি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আলােচিত হয়েছে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদে মুসলমানদের শিক্ষাগত অবস্থা আলােচিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাক্ষরতার হার, স্কুল শিক্ষার হার, উচ্চশিক্ষার অবস্থা, মাদ্রাসা পরিস্থিতি এবং ভাষার সমস্যা।
পঞ্চম পরিচ্ছেদে অর্থনীতি ও কর্ম নিযুক্তিতে মুসলমানদের অবস্থার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যায় শ্রমিকদের অনুপাত (WPR), কাজের ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের বিভাজন, কর্ম নিযুক্তির নিশ্চয়তা এবং বিভিন্ন রাজ্যে এই অবস্থাগুলির তুলনা। সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে মুসলমানদের অংশটি একটি পৃথক পরিচ্ছেদে (নবম) বিস্তৃতভাবে আলােচনা করা হয়েছে।
যষ্ঠ পরিচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে মুসলমানদের পাওয়া ব্যাংক-ঋণের সুযােগ বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণের সুযােগ।
সপ্তম পরিচ্ছেদে রয়েছে সামাজিক পরিকাঠামােয় মুসলমানদের পাওয়া সুযােগ, তাদের গ্রামগুলির অবস্থা, জীবনধারণের অবস্থা, ইত্যাদি।
অষ্টম পরিচ্ছেদে দারিদ্র্য, উপভোেগ ও জীবনধারণের মান সম্পর্কিত অবস্থা আলােচিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অন্যান্য সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠী যেমন তপশিলী জাতি ও জনজাতিদের সঙ্গে মুসলমানদের তুলনা দেখানাে হয়েছে।
দশম পরিচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা ওবিসি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন তাদের অবস্থা। মুসলমান ওবিসিরা সংরক্ষণ বা অন্যান্য ব্যবস্থায় কতটুকু উপকৃত হয়েছেন সেটাও তুলে ধরা হয়েছে এবং বহু সংখ্যক মুসলমান যে এখানে ওবিসি তালিকাভুক্ত হননি তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
একাদশ পরিচ্ছেদে মুসলমান সমাজের নিজস্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন, ওয়াকফ-এর পরিস্থিতি আলােচনা করা হয়েছে। কি পরিমাণ সম্পত্তি ওয়াকফএর মধ্যে রয়েছে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে সেগুলির ব্যবহারে কী কী বাধা রয়েছে সেগুলি এখানে আলােচিত হয়েছে। এ দ্বাদশ পরিচ্ছেদে রয়েছে গােটা রিপাের্টের একটি সার-সংকলন ও সুপারিশ সমূহ। সরকার কোন কোন সাধারণ কর্মনীতি ও বিশেষ কর্মনীতি গ্রহণ করতে পারে সেগুলি আলােচিত হয়েছে।
মুলমানদের সাধারণ অবস্থা
২০০১ সালের লােকগণনায় ভারতের লােকসংখ্যা ছিল ১০২ কোটি ৮৬ লক্ষ, যার মধ্যে ১৩.৪ শতাংশ ছিল মুসলমানদের অংশ। অর্থাৎ ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৭৮ লক্ষ। এঁরা ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শুধু তাই নয় ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদ দিলে ভারতেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস। এই সুবিপুল জনগােষ্ঠী যদি স্থায়ী দারিদ্র, অশিক্ষা ও বুভুক্ষার মধ্যে বসবাস করেন তাহলে যে এক বিরাট মানব-সম্পদের অপচয় ঘটছে তাই নয়, একই সঙ্গে এই বিশাল জনগােষ্ঠীর নিজেদের “আলাদা” বলে ভাববার বাস্তব ভিত্তি থেকে যাচ্ছে। এতে জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সমাজের রূপান্তরের পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। অপরদিকে অন্য জনগােষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেও মুসলমানদের সম্পর্কে নানারকম বিদ্বেষমূলক ধারণা গড়ে উঠছে। এটা সবারই জানা যে ভারতীয় সমাজের মুসলমানরা বঞ্চনার শিকার। কিন্তু সেই জানা বিষয়টার একটা সরকারি হিসাব এতদিন অনুপস্থিত ছিল। ১৯৮২ সালে গােপাল সিং কমিটি মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে একটি রিপাের্ট দিয়েছিল কিন্তু সেই রিপাের্ট সাচার কমিটির তৈরি করা রিপাের্টের মত তথ্যসমৃদ্ধ ছিল না। সাচার কমিটির রিপোর্ট সেই অভাব পূরণ করল। একদিক থেকে বলা যায় যে এই রিপাের্ট হচ্ছে “বঞ্চনার জীবন্ত দলিল”।
জনসংখ্যা ও তার বন্টন
ভারতের সব রাজ্যে মুসলমানরা সমানভাবে ছড়িয়ে নেই। ভারতের ৫৯৩টি – জেলার মধ্যে ৯টি জেলায় (লাক্ষাদ্বীপ এবং জম্মু কাশ্মীরের ৮টি জেলা) মুসলমানরা মােট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি। ১১টি জেলায় (৬টি আসাম, ২টি জম্মু ও কাশ্মীর, একটি কেরালা, একটি বিহার ও একটি পশ্চিমবঙ্গ) তাদের জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ-র মধ্যে এবং ৩৮টি জেলায়। (উত্তরপ্রদেশে ১২টি, পশ্চিম বাংলায় ৫টি কেরালায় ৫টি, আসামে ৪টি, বিহারে ৩টি, ঝাড়খণ্ডে ২টি, দিল্লীতে ২টি এবং অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তরাঞ্চলে ১টি করে) তাদের জনসংখ্যা ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ-র মধ্যে। ১৮২টি জেলায় তাদের জনসংখ্যা ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ-র মধ্যে। রাজ্য হিসাবে দেখলে সবচেয়ে বেশি মুসলমানদের বাস উত্তরপ্রদেশে (৩ কোটি ১০ লক্ষ), পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মহারাষ্ট্রে (১ কোটির বেশি), তারপর কেরালা, . অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, জম্মু-কাশ্মীর ও কর্ণাটক (৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটির মধ্যে)।
১৯৬১ থেকে ২০০১ এই ৪০ বছরে ভারতের সকল জনগােষ্ঠী মিলিয়ে লােকসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতি দশকে ২০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত বেশি, প্রায় ৩০ শতাংশ। অবশ্য ১৯৯১-২০০১ দশকে এই বৃদ্ধির হার হিন্দু ও মুসলমান উভয় ক্ষেত্রেই কমেছে। বরং মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই হ্রাসের হার বেশি। আবার সব রাজ্যে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একরকম নয়। তামিলনাড়ু, কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশেরও কম। একথা বলা যায় যে যেসব রাজ্যে সব জনগােষ্ঠী মিলিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম সেই সব রাজ্যে মুসলমানদের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার কম।
ভারতীয় সমাজে স্ত্রী-পুরুষ অনুপাত (প্রতি ১০০০ পুরুষে নারীর সংখ্যা) বিপজ্জনকভাবে কমছে। ২০০১-এ এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৯৩৩। মুসলমানদের অবস্থা একটু ভাল, তাদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৯৩৬। তবে ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সকলের জন্য স্ত্রী-পুরুষ অনুপাত যখানে ৯২৭, সেখানে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৯৫০। এর থেকে বােঝা যায় যে জন্মের আগে বা পরে কন্যা শিশু মেরে ফেলার প্রবণতা মুসলমানদের মধ্যে অনেক কম।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির অভিজ্ঞতা দেখায় যে স্ত্রী-শিক্ষা বাড়লে এবং জীবনধারণের মান উন্নত হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিব হার কমে। ১৯৯১-২০০১ এই দশ বছরে কেরালায় মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৫.৮ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭.৯ শতাংশ ও তামিলনাড়ুতে ১৩.৭ শতাংশ; অথচ বিহারে সম্মিলিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৭.৩ শতাংশ ও উত্তর প্রদেশে ২৫.৬ শতাংশ। সুতরাং মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি আর হিন্দুদের কম এই ধরনের সাধারণীকরণের ভিত্তিতে মুসলমান সমাজকে অভিযুক্ত করার মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নেই। কোনাে জনগােষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত যে মাপকাঠি দিয়ে নির্ধারিত হয় তাকে TFR (Total Fertility Rate— সামগ্রিক বংশ বৃদ্ধির হার) বলা হয়। একজন নারী গড়পড়তায় তার জীবদ্দশায় যে কয়জন জীবন্ত শিশুর জন্ম দেন তাকে টি.এফ.আর বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে দেখা গেছে যে, টি.এফ.আর ২.২ হলে জনসংখ্যার স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। ভারতে টি.এফ.আর ইতিমধ্যে ৩-এ পৌঁছেছে। এবং বেশ কিছু রাজ্যে মুসলমানদের মধ্যে এটি ৩ এর নীচে নেমে গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজ এই ব্যাপারে এখনাে পিছিয়ে আছে, যা সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে বিযুক্ত নয়।
মুসলমানদের শিক্ষাগত অবস্থা
রিপাের্টে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ২১ (ক) ধারায় প্রদত্ত “চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থাটি নিশ্চিত না করার জন্য সাধারণভাবেই ভারতের শিশুরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। সেখানে মুসলমানরা এই সাধারণ বঞ্চনা ছাড়াও কিছু বিশেষ বঞ্চনার শিকার। রিপাের্টের মতে, “মুসলমানরা দু ধরনের অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। একদিকে শিক্ষার স্তর নিম্ন, অপরদিকে শিক্ষার গুণগত মানও নিম্ন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মুসলমানদের আপেক্ষিক অংশীদারি দীর্ঘকাল ধরে জাতিব্যবস্থার শিকার তপশিলি জাতির মানুষদের চেয়েও খারাপ।”
মুসলমানদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫৯.৯ শতাংশ। এটা জাতীয় গড় ৬৫.১ শতাংশ অপেক্ষা অনেক কম। তপশিলি জাতি-জনজাতিদের মধ্যে সাক্ষরতার হার আরাে কম (৫২.২ শতাংশ)। তপশিলি জাতি-জনজাতি এবং মুসলমান বাদে অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭০.৮ শতাংশ। এঁদের সঙ্গে মুসলমানদের ফারাক ১১ শতাংশ বিন্দুর। মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে সাক্ষরতার হার ৫ শতাংশ যা তপশিলি জাতি-জনজাতিদের চেয়ে অনেক বেশি।
রাজ্য হিসাবে, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাটে মুসলমানদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ওইসব রাজ্যের গড় হারের চেয়ে বেশি।
লােকগণনার তথ্যের ভিত্তিতে গড়পড়তা স্কুল পড়ার সময় (MYS-Mean Year of Schooling) হিসেব করা হয়েছে। তাদে দেখা যাচ্ছে যে ৭-১৬ বয়সের মধ্যে মুসলমান ছেলেমেয়েদের গড় স্কুলে পড়ার সময় প্রায় সব রাজ্যেই অন্যান্যদের চেয়ে অনেক কম। অপর দিকে, ৬-১৪ বছর বয়স্ক মুসলমান শিশুদের মধ্যে ২৫ শতাংশ হচ্ছে এমন শিশু যারা কোনােদিনই স্কুলে যায়নি বা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এই সংখ্যাটা অপর যে কোনাে সামাজিক ধর্মীয় গােষ্ঠী (তপশীলি জাতিজনজাতি সহ) অপেক্ষা বশি। শুধু স্কুল-ছুটদের সংখ্যা ধরলেও মুসলমানদের মধ্যে স্কুল-ছুট এর সংখ্যা খুব বেশি, প্রায় তপশিলি জাতি-জনজাতি-দের সমান। যাদের বয়স ১২-র বেশি, তাদের কত শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে, যাদের বয়স ১৫-র বেশি তাদের কত শতাংশ মিল স্কুল (অষ্টম শ্রেণী পাশ করেছে, যাদের বয়স ১৭-র বেশি তাদের কত শতাংশ ম্যাট্রিক পাশ করেছে এবং যাদের বয়স ১৯-র বেশি তাদের কত শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক (দ্বাদশ শ্রেণী) পাশ করেছে, বিভিন্ন সামাজিক ধর্মীয় গােষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই হিসাব রিপাের্টে সন্নিবেশিত হয়েছে। দেখা যায় যে প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলমানদের অবস্থা তপশিলি জাতি-জনজাতিদের সমান বা সামান্য ভাল, কিন্তু অন্যান্য সামাজিক ধর্মীয় গােষ্ঠী অপেক্ষা অনেক নিচে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন পশ্চিমবাংলায় মুসলমান নারীদের ক্ষেত্রে এই অবস্থান নিম্নমুখী। এটা স্পষ্ট যে উচ্চশিক্ষাতেও মুসলমানদের অবস্থা খুব খারাপ। সারা দেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতকের মধ্যে মুসলমান ৬.৩, তপশিলি জাতিজনজাতি ৮.২ এবং অন্যান্যরা ৮৫.৫। টেকনিক্যাল স্নাতকের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা আরাে খারাপ। আই. আই. এম (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টএর সবকটি শাখা মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১.৩ শতাংশ মুসলমান (৪৭৪৩ জনের মধ্যে মাত্র ৬৩ জন)। আই. আই. টি গুলিতে ২৭,১৬১ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৮৯৪ জন প্রায় ৩.৩ শতাংশ। স্নাতক স্তরে প্রতি ২৫ জনে ১ জন মুসলমান এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষায় প্রতি ৫০ জনে ১ জন।
রিপাের্ট দেখিয়েছে যে, ৬-১৩ বয়ঃসীমার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে বেশি পার্থক্য নেই বা পার্থক্য থাকলেও তা কমে আসছে। কিন্তু যতই শিক্ষার উচ্চতর স্তরের দিকে এগােনাে যায়, ততই বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য বাড়তে থাকে, তপশিলি জাতি-জনজাতি এবং মুসলমানদের অংশ কমতে থাকে ও সাধারণ হিন্দুদের অংশ বাড়তে থাকে।
অনেকের মধ্যে ধারণা আছে যে মুসলমানরা তাদের শিশুদের মাদ্রাসায় পাঠাতে চান এবং মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্যই তাদের ভালভাবে পড়াশােনা হয় না। কমিটি এই বিষয়টি খুঁটিয়ে দেখে মন্তব্য করেছে, সারা ভারতে স্কুলে যাওয়া মুসলমান শিশুদের মধ্যে মাত্র চার শতাংশ মাদ্রাসায় যায়। সুতরাং এই ধারণাটি ভিত্তিহীন। কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসাগুলিকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। কমিটি লক্ষ্য করেছে যে, যেখানে রাষ্ট্র শিশুদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করছে না, সেখানে মাদ্রাসাগুলি কিছু মানুষেব কাছে হলেও শিক্ষার আলাে পৌছে দিচ্ছে।
মুসলমানদের শিক্ষার প্রসঙ্গে কমিটি উর্দু ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সমস্যা বিচার করেছে এবং যে সব এলাকায় উর্দুভাষী মানুষের ঘনত্ব বেশি সে সব এলাকায় উর্দুভাষায় শিক্ষাদানের সুপারিশ করেছে।
অর্থনৈতিক অবস্থা ও কর্মনিযুক্তি
এই অধ্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে, WPR (জনসংখ্যার কত অংশ শ্রমে নিযুক্ত, কর্মহীনতার হার (UR) এবং শ্রমে নিযুক্ত লােকেরা কি ধরণের কাজে নিযুক্ত তার তুলনামূলক আলােচনা করা হয়েছ। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে মুসলমান শ্রমিকদের বেশিরভাগ ম্যানুফ্যাকচারিং (নিজের হাতে কিছু বানানাে) ও ব্যবসায় স্ব-নিযুক্ত। বেতনভুক স্থায়ী শ্রমিকদের কাজে তাদের অংশ অন্য যে, কোন সামাজিক ধর্মীয় গােষ্ঠীর লােকেদের চেয়ে কম। তারা যেটুকু কাজ পান তার বেশিভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং এক্ষেত্রে কাজের শর্ত অন্যান্য যে কোনাে সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠীর চেয়ে খারাপ। সরকারি চাকরি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বড় কোম্পানীর চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ খুবই কম। যেমন সংগঠিত ক্ষেত্রে (সরকারি দপ্তর, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বড় প্রাইভেট কোম্পানী)-র কর্মচারীদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় শহরাঞ্চলে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ২৮.৬ শতাংশ, তপশীলি জাতি-জনজাতিদেরর ২১.৫ শতাংশ এবং ওবিসিদের ১৭.৮ শতাংশ এই ক্ষেত্রে কর্মরত, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ৭.৯ অংশ এই ক্ষেত্রে কর্মরত। গ্রামাঞ্চলে এই অনুপাতগুলি হল যথাক্রমে ১৭.২, ১১.৯, ১০.২ ও ৫.৮। ভারতীয় সমাজে সংগঠিত ক্ষেত্রে ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। বিশেষত যাঁরা সরকারি চাকরি করেন বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কাজ করেন তাদের সবেতন ছুটি, কাজের অবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সর্বোপরি সামাজিক অবস্থান অসংগটিত ক্ষেত্রের কর্মীদের চেয়ে অনেক উপরে। সে কারণে, সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকরিতে মুসলমানদের নিম্নমাত্রায় উপস্থিতি (চিরাচরিত ভাবে অবনমনের শিকার তপশীলি জাতি-জনজাতিদের থেকেও কম) ভারতীয় সমাজে গুরুতর অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া সরকারির চাকরি নিছক চাকরি নয়, সেটি একই সঙ্গে ক্ষমতারও একটি অবস্থান। যে ব্যক্তি থানার অফিসার ইনচার্জ, বি.ডি.ও. বা ব্যাংকের ম্যানেজারের চাকরি করেন তিনি শুধু কেটি চাকরি করেন না, একই সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী। এই পদগুলিতে কোনাে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি যদি নিতান্তই কম হয়, তাহলে সেই সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শুধু উচ্চপদের চাকরি নয়, সরকারি অফিসগুলিতে সাধারণ কর্মচারিদের মধ্যেও মুসলমানদের অনুপস্থিতি বা নামমাত্র উপস্থিতি সকল সম্প্রদায়ের সমানাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া সমাজজীবনের সর্বস্তরে সব সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ ঘটলে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
ব্যাংক ঋণের সুযােগ
আগেই দেখা গেছে যে মুসলমানরা প্রধানত স্ব-নিযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত। সেক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের সুযােগ তাদের আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতি ঘটাতে সহায়ক হতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, তারা ব্যাংক ঋণের সুযােগ খুব কমই পেয়েছেন। সারা ভারতে মুসলমানরা জনসংখ্যার ১৩.৪ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১২.২ শতাংশ, কিন্তু তারা ঋণ। পেয়েছেন মাত্র ৪.৬ শতাংশ। পশ্চিমবাংলায় এই চিত্রটি আরাে খারাপ। এই রাজ্যে মুসলমানরা জনসংখ্যার ২৫.২ শতাংশ, তাঁদের অ্যাকাউন্ট হচ্ছে মােট অ্যাকাউন্টের ২৯.৩ শতাংশ কিন্তু তারা ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৯.২ শতাংশ। অ্যাকাউন্ট হােল্ডারদের মধ্যে মুসলমানদের উচ্চহার প্রমাণ করে যে তারা ব্যাংক ঋণ পেতে আগ্রহী। প্রায় সব রাজ্যেই এই ঘটনা দেখা যায়। এই বিশ্লেষণ থেকে কমিটি প্রস্তাব করেছে যে ব্যাংক ঋণের একটা সুনির্দিষ্ট অংশ মুসলমানদের জন্য চিহ্নিত করতে হবে, বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে তাদের মধ্যে যথাযথ প্রচার চালাতে হবে ও ব্যাংকগুলি সমস্ত সামাজিক-ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঠিকভাবে কাজ করছে কি না সে বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
বস্তুগত ও সামাজিক পরিকাঠামাে
মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে ডাক-তার যােগাযােগ, স্কুল, হাসপাতাল, পাকারাস্তা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা কি রকম, মুসলমানদের বাসস্থান কি রকম- এই প্রশ্নগুলি খুঁটিয়ে বিচার করে কমিটি দেখেছে যে, যে গ্রামে মুসলমানদের বাস যত বেশি, সই সব গ্রামে ডাক-তার যােগাযােগ, স্কুল, হাসপাতাল ও পাকা রাস্তার অস্তিত্ব তত কম। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে ১০০০ মুসলমান প্রধান গ্রাম রয়েছে যেগুলিতে কোনাে স্কুল নেই, উত্তরপ্রদেশে এই রকম গ্রামের সংখ্যা ১৯৪৩। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে ৩০০০ মুসলমান প্রধান গ্রামে কোনাে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, উত্তরপ্রদেশে এই রকম গ্রামের সংখ্যা ৫০০০। গ্রামাঞ্চলে গােটা দেশেই কলের জল পান খুব কমলােক—প্রায় এক চতুর্থাংশ। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা অন্যান্য সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠী অপেক্ষা অনেক কম।
কমিটি এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে :
- ১। মুসলমান প্রধান গ্রামগুলির এক-তৃতীয়াংশে, কোনাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই।
- ২। ৪০ শতাংশ মুসলমান প্রধান গ্রাম কোনাে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই।
- ৩। মুসলমানরা যে সব এলাকায় বসবাস করেন সেইসব এলাকায় পরিকাঠামাে অত্যন্ত দুর্বল।
- ৪। মুসলমানদের বাসগৃহের অবস্থা তপশীলি জাতি-জনজাতি এবং ওবিসিদের মতই। কলের জল, বিদ্যুৎ ও আধুনিক জ্বালানি (এল.পি.জি) ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে।
দারিদ্র্য, উপভােগ ও জীবনধারণের মান
১৯৯১ সালে সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করার পর থেকে ভারত সরকার এটা দেখানাের চেষ্টা করে আসছে যে মােট জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যের পরিমাণ কমে। এটা দেখানাের জন্য দারিদ্র রেখা নির্ধারণের মাপকাঠি পালটে ফেলা হয় এবং আয়ের পরিবর্তে ব্যয়ের মাপকাঠি MPCE (Monthly Per Capita Expenditure-মাথা পিছু গড় ব্যয়) ব্যবহার করা হয়। এই হিসাব করার সময়ও দেখা যায় যে পর্যবেক্ষণের আগের ৩ দিনের গড় ধরলে ২০০৪২০০৫ সালে দারিদ্ররেখার নিচে বসবাসকারী মানুষের অংশ দাঁড়ায় ২৮.৫ শতাংশ। সেটাই ৩৬৫ দিনের গড় ধরলে ২২.৭ শতাংশে দাঁড়ায়। আমরা দেখেছি, ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমনভাবে বি.পি.এল. তালিকা তৈরী করতে সরকারি নির্দেশ দেয় যেন ২৭ শতাংশের বেশি মানুষ বি.পি.এল. এর সীমার মধ্যে পড়েন। সেকারণে বি.পি.এল, দারিদ্র্য ও গড় উপভােগ সম্পর্কে কমিটি যে সব তথ্য ব্যবহার করেছে সেগুলিতে যে অনেক জল মেশানাে আছে সেটা প্রথমেই বুঝে নেওয়া ভাল। তাহলেও বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে তুলনার জন্য এই তথ্য ব্যবহার করা যায়।
সরকারি হিসাবে, ২০০৪-২০০৫ সালে গােটা দেশে সব জনগােষ্ঠী মিলিয়ে মাথাপিছু গড় ব্যয় ছিল ৭১২ টাকা, সাধারণ হিন্দুদের জন্যে ১০২৩ টাকা, হিন্দু ওবিসিদের জন্যে ৬৪৬ টাকা, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৬৩৫ টাকা এবং তপশীলি জাতি-জনজাতিদের ক্ষেত্রে ৫২০ টাকা। শহর এলাকায় সাধারণ হিন্দুদের গড় ব্যয় ১৪৬৯ টাকা এবং তপশীলি জাতি-জনজাতি ও মুসলমানদের ৮০ টাকা। ছােট ছােট শহরগুলিতে মুসলমানদের, গড় ব্যয় তপশীলি জাতি-জনজাতিদের চেয়েও কম। দারিদ্র্যের পরিমাপ করা হয় HCR বা মাথা গুনতি অনুপাত দিয়ে। কোন জনগােষ্ঠীর কত শতাংশ মানুষ দারিদ্ররেখার নিচে বাস করেন সেই গণনাকে HCR (Head Count Ratio) বলে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ৬১ তম দফার তথ্যের ভিত্তিতে ৩৬৫ দিনের হিসেব ধরে বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর দারিদ্র্যরেখার নিচে থাকা মানুষের শতাংশ নিচের সারণিত দেওয়া হল :
সারণী ১ : বিভিন্ন জন গােষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্য (শতাংশ হিসাবে)
শহর শহর | গ্রাম | |
সব জনগােষ্ঠী | ২২.৮ | ২২.৭ |
তপশীলি জাতি-জনজাতি | ৩৬.৪ | ৩৪.৮ |
ও বি সি | ২৫.১ | ১৯.৫ |
সাধারণ হিন্দু | ৮.৩ | ৯.০ |
মুসলমান | ৩৮.৪ | ২৬.৯ |
অন্যান্য সংখ্যালঘু | ১২.২ | ১৪.৩ |
শহরাঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে দারিদ্র্য তপশিলি জাতি-জনজাতি অপেক্ষাও বেশ; অবশ্য, গ্রামাঞ্চলে কম।
সরকারি দপ্তর ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরিতে মুসলমানরা
কর্মনিযুক্তির অধ্যায়ে এই বিষয়ে কিছু আলােচনা থাকলেও, সরকারি চাকরির গুরুত্ব বিবেচনা করে কমিটি এই প্রশ্নে একটি আলাদা অধ্যায় যুক্ত করেছে। ২০০৫-০৬ সালে ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মনিযুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ (৭০ শতাংশ) নিযুক্ত ছিলেন সরকারি দপ্তরে বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায়। এই চাকরিগুলিতে মুসলমানদের অবস্থা কি রকম?
সারণী ২ : সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার
চাকরিতে মুসলমানদের অংশ
শতাংশ | |
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি চাকরিতে (সব রাজা মিলিয়ে) | ৬.৩ |
রেলওয়ে | ৪.৫ |
ব্যাংকসমূহ ও রিজার্ভ ব্যাংকে | ২.২ |
নিরাপত্তারক্ষা বাহিনী। (সি.আর.পি; সি.আই.এস.এফ; এস.এস.পি, ইত্যাদি) | ৩.২ |
ডাকবিভাগ | ৫.০ |
বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ | ৪.৭ |
সব সরকারি চাকরি মিলিয়ে | ৪.৯ |
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় | ৩.৩ |
রাজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় | ১০.৮ |
দুটি মিলিয়ে | ৭.২ |
সিভিল সার্ভিস (আই.এ.এস/আই.এফ.এস/আই.পি.এস), | ৩.২ |
পশ্চিমবাংলায় সরকারি উচ্চপদে | ৪.৭ |
আর্মি নেভি এবং এয়ারফোর্সে মুসলমানদের অংশগ্রহণ কতটা সেই হিসাব রিপাের্টে নেই, কারণ ভারত সরকার সেই তথ্য সংগ্রহ করলেও তা প্রকাশ করতে বারণ করেছে। আবার বিচার বিভাগে মুসলমানদের অংশগ্রহণ সম্পর্কেও সাচার কমিটি নীরব।
বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অবস্থা কি রকম তা বুঝতে গেলে শুধু ঐ রাজ্যের কর্মচারীদের মধ্যে মুসলমানদের অংশ জানাটাই যথেষ্ট নয়। একটি হিসাব তপশিলি জাতি-জনজাতি কমিশন করে কিন্তু সাচার কমিটি করেনি এটি হচ্ছে সমতা-গুণাঙ্ক (Co-efficient of Equality)।
যেমন সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে মুসলমানদের সমতা গুণাঙ্ক হবে .
সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ/মােট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ x ১০০
কমিটির সংযােজিকায় দেওয়া সারণী (৯.৪) থেকে আমরা এই অঙ্কটা কষছি :
সারণী ৩ : সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা কতখানি সমতার অধিকারী
রাজ্য | জনসংখ্যায়
মুসলমানদের অংশ% |
সরকারি চাকরিতে
মুসলমানদের অংশ % |
সমতা-গুণাঙ্ক
(৩/২) x ১০০ |
পশ্চিমবঙ্গ | ২৫.২ | ২.১ | ৮.৩ |
কেরালা | ২৪.৭ | ১০.৪ | ৪২.১ |
উত্তরপ্রদেশ | ১৮.৫ | ৫.১ | ২৭.৬ |
বিহার | ১৬.৫ | ৭.৬ | ৪৬.১ |
আসাম | ৩০.৯ | ১১.২ | ৩৬.২ |
ঝাড়খণ্ড | ১৩.৮ | ৬.৭ | ৪৮.৫ |
কর্ণাটক | ১২.২ | ৮.৫ | ৬৯.৭ |
দিল্লী | ১১.৭ | ৩.২ | ২৭.৬ |
মহারাষ্ট্র | ১০.৬ | ৪.৪ | ৪১.৫ |
অন্ধ্রপ্রদেশ | ৯.২ | ৮.৮ | ৯৫.৬ |
গুজরাট | ৯.১ | ৫.৪ | ৫৯.৩ |
তামিলনাড়ু | ৫.৬ | ৩.২ | ৫৭.১ |
উপরের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সব রাজ্যেই সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ মােট জনসংখ্যায় তাদের অংশের অনুপাত হিসাবে কম। তবে রাজ্যগুলির মধ্যে প্রভেদ আছে। অন্ধ্রপ্রদেশের অবস্থা সবচেয়ে ভাল। সেখানে সমতা গুণাঙ্ক ৯৫.৬। এর অর্থ অন্ধ্রপ্রদেশে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ জনসংখ্যায় তাদের অংশের প্রায় কাছাকাছি। আর সবচয়ে খারাপ বা লজ্জাজনক পরিস্থিতি ধর্মনিরপেক্ষতার স্বর্গরাজ্য ৩০ বছর ধরে বাম শাসিত পশ্চিমবাংলায়। এখানে মুসমলানদের সমতা গুণাঙ্ক হচ্ছে ৮ অর্থাৎ বারাে ভাগের এক ভাগ! বিজেপি শাসিত গুজরাটেও সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ পশ্চিমবাংলার চেয়ে অনেক ভাল, সেখানে সমতা গুণাঙ্ক ৫৯.৩।
ও বি সি মুসলমান ও সংরক্ষণ
তত্ত্বগতভাবে ইসলামধর্ম জাতি ব্যবস্থা মানে না। কিন্তু ভারতীয় সমাজে জাতিব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং এর একটি অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু আছে। সেকারণে, ভারতে শুধু মুসলমান সমাজই নয়, খ্রীস্টান সমাজেও জাতি ব্যবস্থার অস্তিত্ব দেখা যায়।
১৯৭৮ সালে গঠিত মণ্ডল কমিশন কতকগুলি মুসলমান জাতিকে ও বি সি হিসাবে চিহ্নিত করে। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ আংশিক কার্যকর হওয়ার পর (কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ) কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরে মুসলমান ও বি সি-দের তালিকা তৈরী শুরু হয়। কিছু মুসলমান গােষ্ঠী কেন্দ্রীয় তালিকায় চিহ্নিত হয়েছে এবং কিছু গােষ্ঠী বিভিন্ন রাজ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। দুটি তালিকা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মেলে আবার কিছু ক্ষেত্রে মেলে না। এই সমস্যা শুধু মুসলমান ও বি সি নয়, হিন্দু ও বি সি দের ক্ষেত্রেও সত্য।
ভারতে দুটি রাজ্য কর্ণাটক ও কেরালা সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ দিয়েছে। আর একটি রাজ্য তামিলনাড়ু মুসলমান হিসাবে কোন সংরক্ষণ দেয়নি কিন্তু ৯৫ শতাংশ মুসলমানকে ও বি সি হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং এ বি সি-রা তামিলনাড়ুতে প্রায় ৭০ শতাংশ সংরক্ষণ পাওয়ায় মুসলমানরাও উপকৃত হয়েছেন। অন্য কোনাে রাজ্য মুসলমানদের কোনাে আলাদা কোটা দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ৯টি মুসলমান গােষ্ঠীকে ও বি সি তালিকাভুক্ত করেছে, কিন্তু এই রাজ্যে ও বি সি কোটাই মাত্র ৭ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় এখনও ওবিসি দের জন্য কোনাে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ওবিসি বা মুসলমান ওবিসি কেউই বিশেষ লাভবান হননি। কেরালার সংরক্ষণ ব্যবস্থা এইরকম : ওবিসি ৪০ শতাংশ (তার মধ্যে ইড়ওয়া ১৪ শতাংশ, মুসলমান ১২ শতাংশ, ল্যাটিন ক্যাথলিক ৪ শতাংশ, নাদার ২ শতাংশ তপশীলি জাতি থেকে ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান ১ শতাংশ, ধীবর ১ শতাংশ, অন্যান্য পশ্চাদপদ ৩ শতাংশ এবং বিশ্বকর্মা ৩ শতাংশ) এবং তপশীলি জাতি-জনজাতি ১০ শতাংশ।
বিহারে পশ্চাদপদদের দুভাগে ভাগ করা হয়েছে : বি.সি এবং এম.বি.সি। সংরক্ষণের মাত্রা ৩৪ শতাংশ (বি.সি ১৩ শতাংশ, এম.বি.সি ১৮ শতাংশ এবং ওবিসি নারী ৩ শতাংশ)। ৯টি মুসলমান গােষ্ঠী বি.সি. হিসাবে এবং ২৭ টি এম.বি.সি. হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। (বি.সি. = পশ্চাদপদ শ্রেণী, এম.বি.সি. = অতি পশ্চাদপদ শ্রেণী)।
১৯৩১ সালের পর যত লােকগণনা হয়েছে তার কোনােটিতে তপশীলি জাতিজনজাতি ছাড়া অপর কারাের জাতি-পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়নি। ওবিসি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বড় বাধা। এখন জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য ছাড়া অপর কোনাে উৎস নেই। এই তথ্যে শুধু তাদেরই ওবিসি বলে ধরা হয়েছে যাদের রাজ্য সরকার ওবিসি সার্টিফিকেট দিয়েছে। যেমন রিপাের্টের সারণী ১০.৩-এ দেখানাে হয়েছে যে পশ্চিমবাংলায় হিন্দুদের মধ্যে ৮.৪ শতাংশ এবং মুসলমানদের মধ্যে ২.৪ শতাংশ ওবিসি। এই তথ্যগুলি বাস্তব অবস্থার থেকে একেবারেই আলাদা। সারা ভারতে হিন্দুদের ৪৩ শতাংশ এবং মুসলমানদের ৪০.৭ শতাংশ ওবিসি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এঁরা মােট ওবিসিদের ১৫.৭ শতাংশ।
এমন কিছু জনগােষ্ঠী আছে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও এখনাে অস্পৃশ্য বা আদিবাসী জীবনে থেকে গেছে। যেমন উত্তরপ্রদেশে হিন্দু বানজারারা তপশিলি জাতি বলে চিহ্নিত হন কিন্তু মুসলমান বানজারারা হন না। তেমনি, কিছু মুসলমান গােষ্ঠীর তপশিলি জাতি হিসাবে চিহ্নিত হওয়া উচিৎ। সাচার কমিটি এই সুপারিশগুলি করেছে এবং ওবিসি চিহ্নিতকরণের কাজটি যথাযথভাবে করতে বলেছে। তবে লােকগণনায় জাতি পরিচয় লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত না হলে ওবিসি সম্পর্কে যথাযথ তথ্য পাওয়া যাবে না। কমিটির সেই সুপারিশ করা উচিৎ ছিল।
জনসংখ্যার অনুপাতে সব সম্প্রদায়ের জন্য কোটার নীতি যদি কার্যকর হয় তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়। পশ্চিমবাংলায় চাকরি ও শিক্ষায় মুসলমানদের জন্য যদি ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে এই ২৫ শতাংশের মধ্যে একটা অংশ পশ্চাদপদ মুসলমানদের জন্য আলাদা করা যেতে পারে। কিন্তু মুসলমান হিসাবে কোনাে সংরক্ষণ যদি না থাকে, তাহলে তাদের একটা অংশকে ওবিসি হিসাবে চিহ্নিত করে সাধারণ ওবিসি কোটার মধ্যে ফেলে দিলে মুসলমানরা কার্যত কোনাে সুযােগই পাবেন না। কমিটি যে সব তথ্য উপস্থিত করেছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তই বেরিয়ে আসে, কিন্তু তা সত্ত্বেও জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ – এই সুপারিশ কমিটি করেনি। গােটা রিপাের্ট পড়ে মনে হয়:-যেন কমিটি এই কথাটা বলার আগে থমকে গেছে।
জনগােষ্ঠীগত উদ্যোগ ও ওয়াকফ
ইসলামের ধর্মীয় রীতির অঙ্গ হল দান। যিনি ধনার্জন করবেন তিনি তার আয়ের একটা অংশ জনগণের এবং বিশেষত দরিদ্রদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা মেটানাের জন্য দান করবেন। এইভাবে দান করা সম্পত্তিই হল ওয়াকফ। এই সম্পত্তির আয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, স্কলারশিপ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মুসাফিরখানা, মসজিদ ও দরগা নির্মাণ এবং দরিদ্র বিধবাদের ভরণপােষণ, ইত্যাদির জন্য ব্যয় হওয়ার কথা। ইংরেজ রাজত্বের আগে ওয়াকফ সম্পত্তি নিষ্কর ছিল। ইংরেজ সেগুলােকে করের আওতায় নিয়ে আসে। শুধু বাংলাতেই আগে নিষ্কর ছিল এমন সম্পত্তির উপর ১১ লক্ষ পাউণ্ড কর চাপানাে হয় এবং এইভাবে মুসলমানদের চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্মম আঘাত হানা হয়।
ব্রিটিশ শাসন মুসলমানদের সাধারণ সম্পত্তিগুলি এভাবে ধ্বংস করার পরও এখনও বহু ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। গােটা দেশে ৪ লক্ষ ৯০ হাজার রেজিষ্ট্রীকৃত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। তার মধ্যে পশ্চিমবাংলায় রয়েছে ১,৪৮,২০০ এবং উত্তরপ্রদেশে ১,২২,৮৩৯ টি। ওয়াকফের অধীনস্থ মােট জমির পরিমাণ ৬ লক্ষ একর। সরকারি খাতায় এদের মূল্য ৬০০ কোটি টাকা হলেও এর বাজারদর অনেক বেশি। শুধুমাত্র দিল্লীর সম্পত্তির মূল্যই ৬০০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু এই বিপুল সম্পত্তি থেকে খুবই কম আয় হয়, মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা। তার ৭ শতাংশ ওয়াকফ বাের্ডগুলির জন্য খরচ হয়, বাকি টাকা বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক খাতে খরচ হয়। কমিটি লক্ষ করেছে যে ওয়াকফ রক্ষা করার আইন সত্ত্বেও এবং রাজ্য ওয়াকফ বাের্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল থাকা সত্ত্বেও ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও ব্যবহার ভালভাবে হচ্ছে না। কিছু মুত্তাওয়ালি (যারা ওয়াকফ সম্পত্তির দেখাশােনা করেন) ওয়াকফ সম্পত্তিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না বানিয়ে দোকান বানানাে হয় এবং মােটা টাকা খেয়ে অল্প টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। তাছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তির রেকর্ডও ভালভাবে রাখা হয় না। বহু ওয়াকফ সম্পত্তি জবর দখল হয়ে গেছে। জবরদখলকারীদের মধ্যে শুধু ব্যক্তি বিশেষ নয়, সরকারি সংস্থাও রয়েছে। বহু সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে। ১৯৯৬-২০০০ সময়কালে ওয়াকফ সম্পত্তির উপর যৌথ সংসদীয় কমিটি জবরদখল সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য কতকগুলি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেগুলি কার্যকর হয়নি।
কমিটি সুপারিশ করেছে যে, জবরদখল হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। তাছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তিকে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইনের (Rent Control Act) আওতার বাইরে নিয়ে আসতে হবে। ওয়াকফ সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহারের জন্য টেকনিক্যাল পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করতে হবে।
বিভিন্ন রাজ্যের মুসলমানদের অবস্থার তুলনা
এই বিষয়ে রিপাের্টে আলাদা কোনাে অধ্যায় নেই। কিন্তু প্রতি অধ্যায়ে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক তথ্য ও বিশ্লেষণ রয়েছে। শেষ অধ্যায়ে কমিটি মন্তব্য করেছে যে, “যে সব রাজ্যে অধিক সংখ্যক মুসলমান বসবাস করেন তাদের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও আসামে মুসলমানদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।”
কোনাে রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা কতটা খারাপ তা বােঝার জন্য বিভিন্নক্ষেত্রে মুসলমানদের শতকরা হিসাব যথেষ্ট নয়, একথা আমরা আগে বলেছি। সঠিকভাবে তুলনা করতে গেলে সেই ক্ষেত্রে সমতা গুণাঙ্ক হিসাব করা দরকার। রাজ্য সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের সমতা গুণাঙ্ক আমরা আগে দেখিয়েছি। তাতে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবাংলায় মুসলমানদের অবস্থা অন্যান্য সব রাজ্যের চেয়ে শুধু খারাপ নয়, বহুগুণ খারাপ। এবার আমরা ব্যাংক ঋণের হিসেবটা দেখছি। দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানরা সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছেন তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, জম্মু ও কাশ্মীর, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান মাঝামাঝি, জাতীয় গড়ের কাছাকাছি।
সারণী ৪ : ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে মুসলমানরা কতখানি সমতার অধিকারী?
রাজ্য | জনসংখ্যায়
মুসলমানদের অংশ% |
ব্যাঙ্ক ঋণে
মুসলমানদের অংশ % |
সমতা-গুণাঙ্ক
(৩/২) x ১০০ |
পশ্চিমবঙ্গ | ২৫.২ | ৯.২ | ৩৬.৫ |
কেরালা | ২৪.৭ | ১৫.৮ | ৬৪.০ |
উত্তরপ্রদেশ | ১৮.৫ | ৮.৬ | ৪৬.৪৮ |
বিহার | ১৫.৯ | ৭.০ | ৪৪.০২ |
আসাম | ৩০.৯ | ৭.৯ | ২৫.৫৬ |
জম্মু-কাশ্মীর | ৬৭.০ | ৫৪.৪ | ৮১.২ |
কর্ণাটক | ১২.২ | ৪.৭ | ৩৮.৫ |
দিল্লী | ১১.৯ | ০.৫ | ৮.৪ |
মহারাষ্ট্র | ১০.৬ | ২.০ | ১৮.৯ |
অন্ধ্রপ্রদেশ | ৯.২ | ২.৮ | ৩০.৪ |
গুজরাট | ৯.১ | ২.৬ | ২৮.৬ |
তামিলনাড়ু | ৫.৬ | ৩.২ | ৫৭.১ |
রাজস্থান | ৮.৫ | ৩.০ | ৩৫.২৯ |
মধ্যপ্রদেশ | ২.১ | ৩.১ | ৫৯.৬ |
হরিয়ানা | ৫.৮ | ০.৭ | ১২.১ |
তামিলনাডু | ৫.৬ | ৬.৬ | ১১৭.৮ |
উড়িষ্যা | ২.১ | ২.০ | ৯৫.২৩ |
হিমাচল প্রদেশ | ২.০ | ০.৬ | ৩০.০ |
পাঞ্জাব | ১.৬ | ০.৩ | ১৮.৮ |
অন্যান্য রাজ্য | ৫.৬ | ২.৮ | ৫০.০ |
সারা ভারত | ১৩.৪ | ৪.৬ | ৩৪.৩২ |
৭.১৬ বছর বয়স্ক শিশুরা গড়ে কত, বছর স্কুলে পড়ে তার রাজ্যগত হিসেব এইরকম : সারা ভারত ৩.২৬, পশ্চিমবঙ্গ ২.৮৪, কেরালা ৫.৬২, উত্তরপ্রদেশ ২.৬, বিহার ২.০৭, আসাম ২.৬৪, কর্ণাটক ৪.২৬, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বেশ খারাপ।
সব মিলিয়ে, মুসলমানদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে, যেখানে তারা জনসংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সারাংশ ও সুপারিশ
দ্বাদশ অধ্যায়ে রয়েছে কমিটির সুপারিশগুলি। মুসলমানদের “মূলস্রোতে” নিয়ে আসার জন্য এই সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলির মধ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ানাের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার সুযােগ বাড়ানাে, মাদ্রাসা শিক্ষার যথাযথ গুরুত্ব, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থায় ঋণের সুবন্দোবস্ত, সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ানাে এবং তাঁদের জন্য পরিকাঠামােগত সুযােগ-সুবিধা বাড়ানাে। আমাদের একথা বলতেই হচ্ছে যে, সুপারিশের এই অংশটি নৈরাশ্যজনক। রিপাের্টে যে বিপুল পরিমাণ মালমশলা তথ্যের আকারে উপস্থিত করা হয়েছে তার থেকে এটা স্পষ্ট যে মুসলমান সমাজ সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে সুবিধা-বঞ্চিত একটি গােষ্ঠী। এই পশ্চাদপদতা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসৃত বৈষম্যের নীতির ফল। রাষ্ট্র তার নীতি বদল না করলে এ পশ্চাদপদতা বা আপেক্ষিক পশ্চাদপদতা দূর হতে পারে না। প্রতিটি পশ্চাদপদ জনগােষ্ঠীর জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষা, চাকরি, ব্যাংক-ঋণ ও সামাজিক পরিষেবার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে এই বৈষম্যের নীতির অভিমুখ পাল্টে ফেলা যাবে না। কমিটি হয়ত বিতর্কিত প্রশ্ন তুলতে চায়নি, তাই সব কথা বলেও কর্ণাটক ও কেরালার মত মুসলমানদের পশ্চাদপদ জনগােষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের সুপারিশ করেনি। তবে কমিটি যে রিপাের্ট উপস্থিত করেছে, তাতে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এবং এর উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। রাষ্ট্র সেই সিদ্ধান্ত নেবে কি না তা নির্ভর করছে মুসলমান সমাজ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক মানুষ এই দাবিতে কতটা সরব হয়ে উঠতে পারেন তার, উপর। আমাদের মনে হয়, সাচার কমিটির রিপাের্ট যদি একটি গণ-আন্দোলনের দরজা খুলে দিতে পারে তবে সেটাই হবে এর সার্থকতা।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি/আধা-সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মুসলমানদের অংশ কতটা বা মোট ব্যাংক ঋণের কতটা অংশ মুসলমানরা পায় তা সাচার কমিটির রিপোর্ট দেখিয়েছে। এই হিসেবেটা হলাে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ২.১% এবং ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে ৯.২%। বৈষম্য মাপার যে মাপকাঠি এস.সি/এস.টি কমিশন দীর্ঘদিন ব্যবহার করে আসছেন সেই মাপকাঠিকে বলা হয় সমতা গুণাঙ্ক (Co-efficient of Equaligy)। যেমন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমতা গুণাঙ্ক হল।
সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ/মােট জনসংখ্যার মুসলমানদের অংশ x ১০০%
=২.১/২৫.২ x ১০০ = ৮.৩%
ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রের সমতা গুণাহ হল ৯.১/২৫.২ x ১০০ = ৩৬.৫% এই সংখ্যাটা ১০০র যত কাছাকাছি হবে ততই সেই জনগােষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের মাত্রা কমছে তা বােঝা যাবে। আবার কিছু কিছু জনগােষ্ঠীর ক্ষেত্রে যেমন পশ্চিমবাংলার বামুন, কায়েত ও বদ্যি প্রভৃতি উচ্চৰণ হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ১০০র অনেক বেশি, ২০০-৭৩০০ ও হতে পারে। এই সব জাতি হচ্ছে সুবিধাভােগী (Privileged)।
কোন সমাজে সরকারি চাকরি ও ব্যাংক ঋণ যদি বৈষম্য বা বিশেষাধিকারের একটা সূচক হয়, তাহলে আর একটা সূচক হল রাজনৈতিক জীবনে কোন জনগােষ্ঠীর অংশগ্রহণ।
আমরা ২০০৪ সালের লােকস নির্বাচন, বর্তমান রাজ্যসভা ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন ও .. সালের পৌর নির্বাচনের তথ্য পেয়েছি।
সেই তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন যার মধ্যে মুসলমান ২জন। ২জনই পুরুষ কোন মহিলা নেই। অর্থাৎ রাজ্যসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ২/১৫ x ১০০ = ১৩.৩৩%। এই ক্ষেত্রে সমতা-গুণাঙ্ক ১৩.৩৩/২৫.২ x ১০০ = ৫৩% (প্রায়) ২০০৪ সালের লােকসভায় ৪২ জন লােকসভা সদস্যের মধ্যে মুসলমান ৫ জন, সকলেই পুরুষ কোন মুসলমান মহিলা নেই।
লােকসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ৫/৪২ x ১০০ = ১১.৯% এই ক্ষেত্রে সমতা গুণাঙ্ক ১১.৯/২৫.২ x ১০০ = ৪৭% (প্রায়) প্রসঙ্গত লােকসভা নির্বাচনে মােট প্রার্থী ছিলেন ৩৫৮। যার মধ্যে মুসলমান প্রার্থী ৪৬ জন। শতকরা হিসাবে ১২.৮%।
২০০৬-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ জন বিধায়কের মধ্যে মুসলমান ৪৪ জন। অর্থাৎ মােট বিধায়কদের ১৫%। এমনকি ২০০৬ সালে যাঁরা প্রার্থী ছিলেন সেই ১৬৭৬ জন প্রার্থীর মধ্যেও মুসলমান ২৪৮ জন অর্থাৎ ১৪.৮%।
কলকাতা পৌর নিগমে বর্তমানে যে ১৪১ জন কাউন্সিলর রয়েছেন তার মধ্যে মুসলমান মাত্র ১৭জন, ১২.০৬ শতাংশ। তবে, ১৭জন মুসলমান কাউন্সিলর এর মধ্যে ১১ জন পুরুষ ও ৬ জন মহিলা। কাউন্সিলরদের মধ্যে মুসলমান মহিলাদের উপস্থিতির একটা কারণ অবশ্যই পৌরসভায় মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ। কলকাতার পাশেই যে বিধাননগর পৌর সভা তাতে কোন মুসলমান কাউন্সিলর নেই। সামগ্রিক দারিদ্রের সমুদ্রের মধ্যে যে সমৃদ্ধ দ্বীপখণ্ডগুলি উন্নয়নের প্রতীক হিসাবে গড়ে উঠছে তাতে মুসলমানদের যে কোন স্থান নেই তা বিধাননগর দেখলেই বােঝা যায়।
সাচার কমিটির রিপোর্ট ও সি.পি.আই (এম)
সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে সি.পি.আই এম-এর কেন্দ্রীয় কমিটি স্বীকার করেছে যে দেশজুড়ে মুসলমানরা বঞ্চনার শিকার। সেই বঞ্চনার অবসানের জন্য তারা একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি নিম্নরূপ:
(ক) উন্নয়ন :
- (১) আদিবাসীদের জন্য যেমন একটি tribal sub plan তৈরি করা হয় তেমনি মুসলমানদের জন্য একটি sub-plan (উপ-যােজনা) তৈরি করতে হবে এবং সারা দেশে মােট জনসংখ্যায় মুসলমানদের কতটা অংশ সেই অনুপাতে প্রতিটি বিভাজে যােজনা বরাদ্দের অর্থ এই উপ-যােজনা যাতে ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। একটি special component plan অনুযায়ী, রাজ্য সরকারগুলিকে তাদের রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যার অনুপাতে মুসলমানদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
- (২) সংখ্যলঘু উন্নয়নের চালু স্কীমগুলিকে ঠিকভাবে চালাতে হবে।
- (৩) ওয়াকয় সম্পত্তির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সদ্ব্যবহার করতে হবে।
- (৪) মুসলিম অধুষিত এলাকায় আই.সি.ডি.এস এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণে মনােযােগ দিতে হবে।
- (৫) গরীবদের গৃহনির্মাণে নজর দিতে হবে।
(খ) নিযুক্তি ও রােজগার যােজনা
- (১) দলিত মুসলমানদের সংরক্ষণ দিতে হবে।
- (২) ওবিসি মুসলমানরা যেন ওবিসি কোটচার যতাযথ অংশ পায় তা দেখতে হবে।
- ওবিসি সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।
- (৩) কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নিরাপত্তা বাহিনীতে মুসলমানদের যথাযথ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
- (৪) বিভিন্ন প্রার্থী নির্বাচন কমিটিতে যথাযথ সংখ্যায় মুসলিম প্রতিনিধি রাখতে হবে।
- (৫) মহিলা সহ সব মুসলমানরা যাতে যথাযথ ব্যাংক ঋণ পায় তা দেখতে হবে। মােট ঋণের ১৫ শতাংশ যাতে মুসলমানরা পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
- (৬) মহিলাদের স্ব-সহায়তা দল গড়ে তুলতে হবে।
(গ) শিক্ষা :
- (১) যে সব এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি সেই সব এলাকায় ছেলে ও মেয়েদের আধুনিক শিক্ষা দেয়ার জন্য আবাসিক স্কুল সহ যথেষ্ট স্কুল স্থাপন করতে হবে।
- (২) মেয়েদের শিক্ষায় উৎসাহী করতে হবে।
- (৩) ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক বেশি স্টাইপেণ্ড ও স্কলারশিপ দিতে হবে।
- (৪) উর্দুভাষী শিক্ষক নিয়ােগে নজর দিতে হবে।
- (৫) মাদ্রাসাগুলিতে বৈজ্ঞানিক ও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (মুসলিম ইন্ডিয়া, এপ্রিল ২০০৭, সংখ্যা থেকে গৃহীত)
সি.পি. (এম)-এর প্রস্তাবে এটা স্বীকার করা হয়েছে যে মুসলমানেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার স্বীকার। কিন্তু এটা স্বীকার করার পরও সেই বঞ্চনার অবসান ঘটানাের জন্য যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া দরকার সেগুলি সিপি(এম) এর প্রস্তাবের মধ্যে আসে নি।
যেমন পশ্চিমবাংলায় মুসলমানরা জনসংখ্যার ২৫.২ শতাংশ, কিন্তু সরকারি আধা-সরকারি চাকরিতে তাদের অংশ মাত্র ২.১ শতাংশ। স্বাধীনতার পরের ৬০ বছর ধরে মুসলমান সমাজ একনাগাড়ে বৈষম্যের শিকার হওয়ার ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সাচার কমিটি বলেছে যে সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে। কি সেই ব্যবস্থা? কোন একটা পশ্চাদপদ জনগােষ্ঠী যদি একনাগাড়ে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে তাদের পশ্চাদপদতা দূর করতে হলে সংরক্ষণ ছাড়া কোন রাস্তা। নেই। সি.পি. (এম)-এর প্রস্তাব দলিত মুসলমানদের সংরক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছে। দলিত মুসলমানরা গােটা মুসলমান সমাজের মাত্র ১.৩ শতাংশ। তাছাড়া কোন মুসলমান বা খ্রিশ্চান জনগােষ্ঠীকে দলিত হিসাবে চিহ্নিত করতে হলে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ (Presidential order) পালটানোের আইনী জটিলতা রয়েছে।
সি.পি. (এম)-এর প্রস্তাব বলেছে যে ওবিসি মুসলমানেরা যেন ওবিসি কোটার যথাযথ অংশ পায় তা দেখতে হবে। আমরা আগেই দেখিয়েছি যে পশ্চিমবঙ্গের সি.পি. (এম) সরকার হিন্দু-মুসলমান সব ওবিসি মিলিয়ে চাকরিক্ষেত্রে মাত্র ৭ শতাংশ সংরক্ষণ দিয়েছে এবং উচ্চশিক্ষায় এখনাে কোন সংরক্ষণ দেয় নি। এরপর তারা ওবিসি কোটার যথাযথ অংশ মুসলমানদের যদি দেয়ও তাহলেও মুসলমানরা বড় জোর ১ বা ২ শতাংশ চাকরি পাবেন। সেটা বর্তমানে তারা যেটুকু চাকরি পান (২.১ শতাংশ) তার চেয়ে কম হবে। সুতরাং একথা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে যে সংরক্ষণের প্রশ্নে সি.পি. (এম)-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশ বিন্দুমাত্র বাড়বে না। সি.পি.(এম) এটাই চায়। তারা মুসলমানদের জন্য অনেক ভাল ভাল কথা বলবে কিন্তু সরকারি প্রশাসনে মুসলমানদের কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। আর, সরাকরি প্রশাসনের ও আধা-সরকারি চাকরির বিভিন্ন স্তরে মুসলমানদের উপস্থিতি যদি নগণ্য হয়, তাহলে তাদের উন্নয়নের জন্য যত ভাল ভাল প্রস্তাব নেওয়া হােক না কেন, সেগুলাের কোনটাই কার্যকর হবে না।
আদিবাসীদের জন্য উপ-যােজনা (tribal sub-plan)-এর মত মুসলমানদের জন্য আলাদা উপ-যােজনা করার কথা সি.পি.(এম) বলেছে কিন্তু এটাতে তারা বিস্বাস করে না। তা যদি করত, তাহলে ২০০৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তার ২৫ শতাংশ মুসলমানদের বরাদ্দ করত কিন্তু তা তারা করে নি। রাজ্য বাজেটের কিছু খাতে তারা মুসলমানদের জন্য ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করেছে। ২৫ শতাংশ মানুষের জন্য মাত্র ১৫ শতাংশ কেন? সবচেয়ে বড় কথা এই যে এটুকুও মুসলমানদের কাছে পৌছবে না। কারণ সরকারি প্রশাসনে চাপরাশির স্তরে ও মুসলমানদের দেখা পাওয়া যাবে না। যে প্রশাসনে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না সেই প্রশাসন সকলের প্রতি সুবিচার করতে পারে না। সি.পি.(এম)-এর প্রস্তাবে ব্যাংক ঋণের ১৫ শতাংশ মুসলমান নারী ও পুরুষদের দেওয়ার কথা বলা হয়েছে কিন্তু ১৫ শতাংশ কেন? উড়িষ্যায় মুসলমানরা মােট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তারা ২৫.২ শতাংশ। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জন্য ২৫.২ শতাংশই বরাদ্দ করা উচিত।
সি.পি. (এম)-এর প্রস্তাবে ওয়াকস্ সম্পত্তির সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গত ৩০ বছরের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে ওয়াক সম্পত্তির কতটা সদ্ব্যবহার তারা করেছেন? তাঁদের আশ্রিত কিছু লােক ওয়াকস সম্পত্তি লুঠপাট করেছে এবং বহু সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে।
তাদের প্রস্তাবে মুসলমান ছেলেমেয়েদের জন্য আবাসিক স্কুল গড়ে তােলার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৩০ বছরে কয়টা আবাসিক স্কুল তারা স্থাপন করেছেন? কিছু মুসলমান সমাজসেবীর উদ্যোগে আল-আমিন জাতীয় কিছু বেসরকারি আবাসিক স্কুল হয়েছে এবং গত কয়েকবছরে এই স্কুলগুলির ছাত্র ছাত্রীরা মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষায় চমকপ্রদ ফল করেছে। রাজ্য সরকার যদি গত ৩০ বছরে আবাসিক স্কুল গড়ে তােলার উদ্যোগ নিতেন তাহলে বহু মুসলমান ছাত্রছাত্রী সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে ঢুকতে পারত। তা তারা করলেন না কেন? মুসলমানদের প্রতি যে বৈষম্য ও বঞ্চনা চলে আসছে তার অবসান ঘটাতে গেলে শিক্ষা ও চাকরির সর্বস্তরে মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে ১৫ শতাংশ ও পশ্চিমবঙ্গে ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করা দিয়ে শুরু করতে হবে। সমগ্রভাবে মুসলমান সমাজকে পশ্চাদপদ হিসাবে গণ্য করে এটা করা যায়। আবার মুসলমান সমাজের মধ্যে যারা বিশেষভাবে পশ্চাদপদ তাদের জন্য এই ২৫ শতাংশের একটা অংশ সংরক্ষিত করা যায়।
কিন্তু এটা করতে গেলে একটা আইনী বাধা দূর করতে হবে। সেই আইনী বাধা হল বালাজি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় যাতে মােট সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ শতাংশে বেঁধে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় তপসিলি জাতি। আদিবাসীরা মিলিতভাবে মােট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ এবং তাদের জন্য ২৮ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। এরপর মুসলমানদের জন্য ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ দিতে গেলে সংরক্ষণের মাত্রা ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর আবার ওবিসি আছে। সুতরাং বালাজি মামলার রায়ের আইনী বাধা দূর করতে হবে। একমাত্র শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এই বাধা দূর করা যায় যা তামিলনাড়ু করে দেখিয়েছে। ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ মেনে নেওয়ার জন্য সংবিধান সংশােধন করতে তারা ভারত সরকারকে বাধ্য করেছে। সমগ্র মুসলমান সমাজকে পশ্চাদপদ হিসেবে গণ্য করার নজির এদেশে রয়েছে। কর্ণাটক ও কেরালা সরকার তাঁদের রাজ্যে সমগ্র মুসলমান সমাজকে পশ্চাদপদ হিসাবে গণ্য করেছেন এবং সংরক্ষণ দিয়েছেন। তামিলনাড়ু সরকার ৯৫ শতাংশ মুসলমানকে ওবিসি হিসাবে গণ্য করেছে এবং সংরক্ষণ দিয়েছে। পশ্চিমবাংলায় মুসলমানদের অবস্থা ভারতের সব রাজ্যের চেয়ে খারাপ। সুতরাং এখান গােটা মুসলমান সমাজকেই ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত এবং জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের সংরক্ষণ দেওয়া উচিত।
পশ্চিমবঙ্গে এই দাবিতে একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তােলা সহজ কাজ নয়। তপসিলি জাতি, আদিবাসী, ওবিসি এবং মুসলমানদের একটি জোট যদি গঠন তােলা যায় শুধুমাত্র তাহলেই সকল জনগােষ্ঠীর জন্য সংখ্যানুপাতে সংরক্ষণের দাবিতে শক্তিশালী আন্দোলন হতে পারে। বাস্তবে এই ধরনের একটি জোট গঠনের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ২০০৬ সালের ৩০ শে মে কলকাতায় সংযুক্ত সংরক্ষণ মাের্চার আহ্বানে যে মহামিছিল হয় তাকে একটি ভাল সূচনা বলে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু অবদমিত ও বঞ্চিত জনগােষ্ঠীগুলির ঐক্য অর্জনের পথে আরাে বহুদূর যেতে হবে।
এটা বলাই বাহুল্য যে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা ও চাকরির সর্বস্তরে ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ দাবি করলে সি.পি.(এম) সর্বশক্তি দিয়ে সেই দাবির বিরােধিতা করবে। কিন্তু বিরােধিতা শুধু সি.পি (এম)-এর দিক থেকে আসবে এটা ভাবলে ভুল হবে। এখান কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী দলগুলির সঙ্গে সি.পি (এম), সি.পি.আই, আর.এস.পি, ফরওয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি তথাকথিত বামপন্থী দলগুলির কিছু মৌলিক মিল রয়েছে। এরা সবাই পশ্চিমবঙ্গে উচ্চবর্ণবাদী শাসন টিকিয়ে রাখার পক্ষে।
সেকারণে পশ্চিমবঙ্গে সমাজের গণতান্ত্রিকীকরণের আন্দোলন কঠিন ও জটিল হতে বাধ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গে তপসিলি জাতি, আদিবাসী, ওবিসি ও মুসলমানরা মিলে মােট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ। একবার যদি এদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি ভেঙে যাবে এবং এই দলগুলির নিচুতলার বহু কর্মী আন্দোলনের পক্ষে এসে দাঁড়াবেন। পশ্চিমবঙ্গে গত একবছরে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।