লিখেছেঃ রমণী সামন্ত
জওহরলাল নেহরু ও হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরএসএস- সঙ্ঘ পরিবার “দেশদ্রোহিতা”-র নতুন মানে সমাজে জোরের সাথে হাজির করে দিয়েছে। এবং তার মধ্যে দিয়ে, এটা বাস্তব সত্য যে তাদের হাজির করা মানের ভিত্তিতে সমাজে একটা মাত্রায় বিভাজনও তারা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে মন্দির মসজিদ বিতর্কের ভিত্তিতে আমজনতাকে আর নতুনভাবে বিভাজিত করার সুযােগ আপাতত কিছুটা যে কম, এটা আর এস এস-সঙ্ঘ পরিবার ভালােভাবেই বুঝতে পারছে। সেই অবস্থায় মােদীকে সামনে রেখে ২০১৪-য় একক শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারী ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হওয়ার পর থেকে তারা দাবার খুঁটি সাজাতে শুরু করেছে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে। পানসারে-দাভােলকরদের মতাে যুক্তিবাদীদের খুন করা, গােহত্যার অজুহাতে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে হত্যাকাণ্ড, গােমাংস ভক্ষণের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মুম্বাই শহরে পাকিস্তানী গজল সঙ্গীতশিল্পী গুলাম আলির কনসার্টের ওপর শিবসেনার নিষেধাজ্ঞা, বিজেপি-র পক্ষ থেকে চলচ্চিত্রশিল্পী শাহরুখ খানকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলা – এইভাবে ধীরে ধীরে একটার পর একটা হামলা নামাতে নামাতে অবশেষে তারা হামলাকে কেন্দ্রীভূত করেছে। “দেশপ্রেম” ”জাতীয়তাবাদ”-এর প্রশ্নকে কেন্দ্র করে, বলাই বাহুল্য শেষ পর্যন্ত সঙ্ঘপরিবারের হিন্দুত্ববাদী অভিযানকে জনগণের মধ্যে আরাে ব্যাপকতায় প্রসারিত করার উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতা নিয়ে তারা যে হঠাৎ বাজার গরম করার কাজে নেমে পড়েছে তার মূল উদ্দেশ্য – ব্যাপক পশ্চাৎপদ জনগণের মধ্যে বিরাজমান দেশপ্রেম, দেশভক্তি বা জাতীয়তাবাদের আবেগ ও অনুভূতিকে নিজেদের স্বার্থে সুচতুর দক্ষতায় কাজে লাগানাে।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে “দেশপ্রেম” ও “জাতীয়তাবাদ”এর ধারণা বিকশিত হয় ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকে। এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার সর্বোচ্চ রূপ গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ শাসনের উৎখাতের দাবীকে কেন্দ্র করে। কাজেই, এখন আমরা দেখার চেষ্টা করবাে এই সংগ্রামে আর এস এসের ভূমিকা ঠিক কি রকম ছিল, যাতে যারা আজকে “দেশদ্রোহিতা” নিয়ে সবচেয়ে বেশী শােরগােল তুলছে, তাদের আসল “দেশপ্রেমিক” ও “জাতীয়তাবাদী” চরিত্রের স্বরূপটা আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
ক. জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আর এস এস-এর ভূমিকা
১৯১৯-১৯২১ পর্বের উত্তাল জনজাগরণের ইতিহাস সম্পর্কে যারাই মােটের ওপর খবর রাখেন তারাই এটা স্বীকার করবেন যে, এই পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সামনে রেখে ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষক-গরীব মানুষ শুধু ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থারই অবসান চান নি, তারা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঔপনিবেশিক ও সামন্ততাল্টিক অর্থনৈতিক শােষণ-বঞ্চনার অবসানের চাহিদাকে সজোরে সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার প্রয়ােজনে সংগ্রামের এই পর্যায়ে তারা নিজেদের ধর্মীয় বিভাজনকে সাময়িকভাবে পিছনে সরিয়ে রেখে নিজেদের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলছিলেন।
আরএসএস-র প্রতিষ্ঠাতারা এই জনজোয়ারকে কিভাবে দেখেছিল
আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগেওয়ার সেই সময় একজন কংগ্রেস সদস্য হিসেবে খুব অল্প সময়ের জন্য। হলেও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর এস এসর পক্ষ থেকে তার যে জীবনী প্রকাশ করা হয় তাতে লেখা আছেঃ “এই পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই জায়গা থেকে তার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন হাজির হয়। তিনি অনুভব করতে থাকেন যে অন্য কোন রাস্তা খুঁজে পেতে হবে। তার মনে উদয় হওয়া প্রশ্ন এবং রাস্তা খোঁজার ধরনটা কেমন? এই পর্যায়ের জনজোয়ার সম্পর্কে ডাঃ হেডগেওয়ারের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আর এস এস প্রকাশিত অন্য একটি সূত্রে বলা হচ্ছেঃ “মহাত্মা গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনের ফলে দেশে জাতীয়তাবাদের জন্য আগ্রহ কমে যাচ্ছিল এবং এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সামাজিক জীবনের যে বিষগুলি জন্ম নিয়েছিল তা কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছিল।…
অসহযােগ আন্দোলনের ফলে পুষ্ট যবন-সাপ তাদের বিষাক্ত ছােবলের মধ্যে দিয়ে দেশজুড়ে দাঙ্গা বাধাতে সচেষ্ট হল।… ১৯২১-র আন্দোলনের পরবর্তী ঘটনাবলী ডাক্তারজীর কাছে ধাক হিসেবে হাজির হল। … গােটা পরিবেশ মুসলিম উন্মাদনায় ভরে গেল। ভারতমাতা কি জয়-এর বদলে আল্লাহ হাে আকবর বনি সব জায়গা থেকে শােনা যেতে থাকল। শীঘ্রই বনু, কোহট, মুলতান, নাগপুর, কানপুর ও অন্যত্র মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। তার মনে হল, এগুলাে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নয়, এগুলাে মুসলমান দাঙ্গা; কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারাই দাঙ্গা শুরু করেছে এবং আক্রমণ করেছে। এই দাঙ্গা পরিণতি পেল মােপলা সসের মধ্যে দিয়ে, যেখানে লুঠতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ এবং গায়ের জোরে ধর্মান্তরকরণ ঘটানাে হল। … এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে হিন্দুরাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে জাতি এবং হিন্দুত্বই হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ত্ব। যখন বিভিন্ন চিন্তাবিদরা জাতীয় রাজনৈতিক উন্মাদনার ভেতরকার লিখন দেখতে অস্বীকার করছিলেন, বাস্তববাদী ডাঃ হেডগেওয়ার কল্পনার স্বপ্নের জগতে বিচরণ করাকে পরিত্যাগ করলেন। সত্য প্রকাশ্যে চলে এল। একমাত্র হিন্দুরাই হিন্দুস্থানকে মুক্ত করতে পারে এবং একমাত্র তারাই হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারে। একমাত্র হিন্দুশক্তিই দেশকে রক্ষা করতে পারবে। ঘটনার যুক্তি থেকে বেরােনাের কোন উপায় নেই। হিন্দু যুবকদের ব্যক্তিগত চরিত্র ও দেশমাতৃকার জন্য চূড়ান্ত ভালবাসার ভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই। এই মহাত্মার উৎকা আত্মপ্রকাশিত হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ গঠনের মধ্যে দিয়ে”।
মন্তব্য নিষ্প্রয়ােজন। তবু, কিছু কথা একটু পরিস্কার করা যাক। আমরা এটাই দেখলাম যে আরএসএস-এর প্রবর্তক হেডগেওয়ার প্রথম হিন্দু জাতি- হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা নিয়ে এলেন। তার মতে, যদি ‘হিন্দুরাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে জাতি এবং একমাত্র হিন্দুরাই হিন্দুস্থানকে মুক্ত করতে পারে তার মানে তাে এটাই দাঁড়ায় যে বিদেশী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতীয় জনগণের কম-বেশী অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে গােটা দেশজুড়ে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা নিয়েও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল তাকে দ্বিখণ্ডিত করা, দুর্বল করা। দ্বিতীয়ত, হিন্দুস্থানকে (দেশটাকে ভারত না বলে হিন্দুস্থান বলাটাই আরএসএস বেশী পছন্দ করে) মুক্ত করা বলতে কার থেকে মুক্ত করা – ‘যবন সাপের বিষাক্ত ছােবল থেকে না কি ভারতবাসীর বুকের ওপর চেপে বসে থাকা ব্রিটিশ শাসন। থেকে? সমগ্র জাতীয়তাবাদকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জায়গায় নামিয়ে আনার আর কি অর্থ থাকতে পারে? গভীর বিশ্লেষণে না গিয়েও একথা বলা যায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনশােষণের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের জনগণের যে বিক্ষোভ -বিদ্রোহ জেগে উঠেছিল তাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্রীয়ত্ব তথা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমান জনগণকে দেশ থেকে উৎখাত করা বা তাদেরকে পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখাই ছিল হেডগেওয়ার ও তার সঙ্গীসাথীদের প্রথম লক্ষ্য এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা গৌণ। সম্ভবত এটাই কারণ যে আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে বা কংগ্রেসকে সামনে রেখে দেশজোড়া যে জাতীয় আন্দোলন বিস্তার লাভ করছিল তার সাথে নিজেদের যুক্ত করে নি। আমরা জানি সিপাহী বিদ্রোহ, যেখানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের সিপাহীরা একসঙ্গে লড়েছিল, তা ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃত। সেই সময় আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, সুচতুর ধূর্ত ব্রিটিশ শাসকরা সেটা বুঝেছিল। তখন থেকেই তারা শুরু করে ভাগ করে শাসন করার নীতি এবং নানাভাবে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চক্রান্ত। হেডগেওয়ার তথা আরএসএস হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজা উড়িয়ে ব্রিটিশবিরােধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দ্বিখণ্ডিত করে ব্রিটিশ শাসন কায়েম করার পক্ষেই কাজ করেছিল।
ত্রিশের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও আরএসএসের অগ্রগতি জন্মলগ্ন থেকে আর এস এস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী। সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, তার কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। বরং শুরুর দিকে এদের মূল ভূমিকা থেকেছে। মহারাষ্ট্রের শহুরে মধ্যবিত্ত হিন্দু কিশােরদের শাখার মধ্যে দিয়ে সংগঠিত করা এবং তাদের মধ্যে একদিকে সংখ্যালঘু। জনগােষ্ঠীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্ম দেওয়া ও অন্যদিকে শরীরচর্চা, বশংবদ-সংগঠিত-নিয়মানুবর্তীনিয়তি জীবনযাপন ও অশিক্ষা – এটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী উত্তাল গণআন্দোলনের বিপরীতে “দেশমাতৃকা”-কে রক্ষা করার “বাস্তববাদী” হেডগেওয়ারের বিকল্প কর্মসূচী। যে কারণে ১৯২৭-এ সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবশ্রমিকদের যে স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ রাজপথে ফেটে পড়ে, যার ওপর দাঁড়িয়ে এমনকি কংগ্রেস পর্যন্ত “পূর্ণ স্বাধীনতা”-র দাবীকে সামনে হাজির করতে বাধ্য হয়, সেই গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও আর এস এস কোন কথা বলে নি। উলেদিকে, এই একই সময়ে সেপেম্বর ১৯২৭-এ আর এস এসের উদ্যোগে নাগপুর শহরে একটা বড়াে রকমের দাঙ্গা সংগঠিত করা হয়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে মহারাষ্ট্রে উচ্চবর্ণের হিন্দু জনগােষ্ঠীর মধ্যে আর এস এস তার গণভিত্তি বেশ খানিকটা বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং মহারাষ্ট্রের বাইরে সংগঠন বিস্তারের কাজ হাতে নেয়।
ডিসেম্বর ১৯২৯-এ কংগ্রেস “পূর্ণ স্বরাজ”-এর দাবীকে সামনে তুলে আনে। এর তিন মাস বাদে গান্ধী ডান্ডি অভিযান ও আইন অমান্য আন্দোলন কর্মসূচী ঘােষণা করেন। আর এস এস এই গােটা কর্মসূচী থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে। এই প্রসঙ্গে আকর্ষণীয় তথ্য হল – আরএসএস সংগঠনগতভাবে এই কর্মসূচী থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখলেও হেডগেওয়ার ব্যক্তিগতভাবে ডান্ডি অভিযানে অংশ নেন এবং জেলে যান। যদিও এই কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার পেছনে তার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল, আর এস এস তথ্যসূত্রে তা এভাবেই লিখিত আছেঃ “ডাঃ সাহেবের এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে জেলে তার সাথে স্বাধীনতাপ্রেমী, আত্মত্যাগী এবং নামজাদা লােকজন থাকার ফলে তাদের সাথে তিনি সঙ্ঘের বিষয় নিয়ে আলােচনা করতে পারবেন এবং তার ভাবনার দিকে তাদের টেনে আনতে পারবেন। … জেলে ডাঃ সাহেব এক মুহূর্তও তার মাথা থেকে সঙ্ঘের কাজকে সরে যেতে দেন নি। তিনি কংগ্রেসের যে সমস্ত নেতা ও কর্মীরা তার সাথে জেলে ছিলেন তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তােলেন, তাদের সঙ্গে কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেন এবং তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যতে সঙ্ঘের কাজে সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।” এটা পরিস্যার যে এই পর্যায়ে গান্ধীর ভাবনা ও কর্মসূচীর সঙ্গে সহমত হয়ে হেডগেওয়ার এই কর্মসূচীতে অংশ নেন নি, তিনি অংশ নিয়েছিলেন এই সুযােগে কংগ্রেসের কর্মীবাহিনীর মধ্যে ভাঙন ধরানাের লক্ষ্য নিয়ে। এবং এই লক্ষ্যপূরণে তিনি যে একটা মাত্রায় সফলও হয়েছিলেন, তা বােঝা যায় ১৯৩৪-এ সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি এই মর্মে একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যে কোন কংগ্রেস কর্মী আর এস এস-হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লীগের সদস্য হতে পারবে না। এখানে আরাে যেটা উল্লেখ করা দরকার তা হল, “পূর্ণ স্বরাজ”-এর দাবীকে সামনে রেখে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ১৯৩০-র ২৬ জানুয়ারীকে “স্বাধীনতা দিবস” হিসাবে উদ্যাপন করা এবং ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করার আহ্বান রাখা হয়। এই আহ্বানকে সামনে রেখে আর এস এস-এর সরসঘচালক হিসেবে হেডগেওয়ার একটি সার্কুলার দেন। তার মূল বক্তব্য হল – “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যকে গ্রহণ করেছে”! তিনি আর এস
এস-র শাখাগুলিকে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের নির্দেশ দেন, কিন্তু ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলনের বদলে “জাতীয় পতাকা, অর্থাৎ গেরুয়া ঝান্ডা”-কে “পূজা” করার মধ্যে দিয়ে। এইভাবে কংগ্রেসের দেওয়া আহ্বানকে আরএসএস আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে, সেই সময় জনগণের মধ্যেকার তীব্র স্বাধীনতার আকাঙ্খকে নিজেদের স্বার্থে তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এটাও প্রাসঙ্গিক যে এর পর থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রত্যেক বছর ২৬ জানুয়ারী স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে যখন ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ প্রত্যেক বছর একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল, তখন আর এস এস-এর পক্ষ থেকে একমাত্র ১৯৩০-এই একবারই মাত্র এভাবে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করা হয়।
এর পর এই প্রসঙ্গে আরএসএস-এর ইতিহাসে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাদের মতাদর্শগত অবস্থানকে আরও সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও উন্নত করা। যারই প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৯৩৮ সালে গুরু গােলওয়ালকরের লেখা “We, or Our Nationhood Defined” বইয়ের মধ্যে দিয়ে। এর মাধ্যমে আরএসএস-এর পক্ষ থেকে প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে “সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ”-এর ধারণাকে স্পষ্টভাবে সামনে আনা হল।
গােলওয়ালকর ও “সাংতিক জাতীয়তাবাদ”-এর ধারণাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানাে
আমরা দেখতে পাচ্ছি “We, or Our Nationhood Defined” বইতে গােলওয়ালকর লিখছেঃ “জার্মান জাতীয় গর্ব এখন রােজকার আলােচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি ও তার সংহতির শুদ্ধতা রক্ষার জন্য জার্মানরা তাদের দেশ থেকে সেমিটিক রেস ইহুদিদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে গােটা পৃথিবীকে জোর ধাক্কা দিয়েছে। জাতীয় গর্বের উচ্চতম রূপ এখানে প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানী এটাও দেখিয়েছে যদি বিভিন্ন রেস ও সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক কোন ফারাক থাকে, তাহলে তাদের অঙ্গীভূত হয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ সমগ্রে পরিণত হওয়া কী পরিমাণে অসম্ভব। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের হিন্দুস্থানে শেখার ও তার থেকে লাভবান হওয়ার আছে।” এই শিক্ষার ও লাভবান হওয়ার দিকগুলি কি ? গােলওয়ালকর এরপর লিখছেঃ “ধূর্ত পুরােনাে জাতিগুলির দ্বারা অনুমােদিত অবস্থান এটাই দেখায় যে হিন্দুস্থানে অ-হিন্দু জনগণ হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করুক, হিন্দু ধর্মকে পবিত্র মনে করুক, তাকে শ্রদ্ধা করুক,
হিন্দু জাতির মহত্ত্ব ছাড়া অন্য কোন ধারণাকে আদৌ প্রশ্রয় না দিক ইত্যাদি … এক কথায় হয় তারা বিদেশী অবস্থান ত্যাগ করুক অথবা হিন্দু জাতির কাছে সম্পূর্ণ অধীনস্থ থেকে, কোন কিছু দাবী না করে, কোনরকম কোন সুবিধা আশা না করে, … এমনকি নাগরিকত্বের অধিকারকেও ত্যাগ করে এদেশে থাকুক।” সুতরাং, এটা বলার অবকাশ রাখে না, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে গােলওয়ালকর তথা আর এস এস-এর মতাদর্শগত অবস্থানের সাথে জার্মান নাজী পার্টির অবস্থানের কোন ফারাক নেই এবং তাদের জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়বস্তু হিন্দুরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আর সেকারণেই গােলওয়ালকরের হাজির করা চিন্তার। মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার কোন লক্ষ্যবস্তু থাকার কথাও নয়, এবং সেদিন ছিলও না। এবং সেটা স্পষ্টভাষায় প্রকাশ করার ব্যাপারে গােলওয়ালকরের মধ্যে বিন্দুমাত্রও জড়তা নেই। গােলওয়ালকরের লেখা অন্য একটি বই “Bunch of Thoughts” থেকে আমরা জানতে পারছিঃ “সীমানাগত জাতীয়তাবাদ ও সাধারণ বিপদের তত্ত্ব, যা জাতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণার মূল ভিত্তি, আমাদেরকে প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধনাত্মক ও অনুপ্রাণিত করার মতাে বিষয়বস্তু থেকে আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছে এবং বহু ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-কে কার্যত ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রামে পরিণত করেছে। ব্রিটিশ বিরােধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থকে পরিণত করা হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরাে পর্বের ওপর, তার নেতা ও সাধারণ জনগণের ওপর এক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে”। এই একই বইতে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করে বলা হয়েছেঃ “এই সমস্ত ব্যক্তিদের আমাদের সমাজে আদর্শ। হিসেবে হাজির করা উচিত নয়। আমরা তাদের জীবন। বলিদানকে মানুষ কামনা করতে পারে এরকম কোন সর্বোত্তম মহত্ত্ব হিসেবে দেখি না। কারণ, শেষ পর্যন্ত, তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতাই দেখিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে একটা কোন বড় রকমের ভুল রয়েছে”। (বিজেপি আরএসএস-এর ভণ্ডামিটা একবার দেখুন। একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের সম্পর্কে গুরু গােলওয়ালকরের এরকম অবমাননাকর উক্তি, অন্যদিকে তারাই এখন ঢাকঢােল পিটিয়ে শহীদ ভগৎ সিং-এর জন্মদিন পালন করছে। শুধু তাই নয়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষ একের পর এক ব্রিটিশ বিরােধী জাতীয়তাবাদী। আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে “ভারত ছাড়াে”, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম, নৌ-বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই প্রতিটি আন্দোলনেই আরএসএস সম্পূর্ণ নিস্ট্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। বরং, এই পর্যায়ে তারা মুসলমান বিরােধী দাঙ্গা সংগঠিত করার কাজে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে নিয়ােজিত করেছে। এখানে আরাে যেটা বলার যে, যে “দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভর করে ভারত ভাগ করা হয় সেই “দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে মূলত মুসলিম লীগের দিকে আঙুল তােলা হয়, কিন্তু যা অনেকেরই চোখের আড়ালে থেকে গেছে তা হল হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস উভয়েই উল্টো দিক থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের” পক্ষে কাজ করে গেছে; ফলে দেশভাগের জন্য মুসলিম লীগ যেমনভাবে দায়ী, হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস-ও সমানভাবে দায়ী।
ওপরের আলােচনা থেকে আমরা শুধুমাত্র এটাই দেখানাের চেষ্টা করি নি যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আর এস এস কোন ভূমিকা নেয় নি; বরং আমরা এটাই দেখানাের চেষ্টা করেছি যে এই গােটা পর্যায়ে তারা জনগণকে হিন্দু-মুসলমান পরিচয়ে বিভাজিত করা, হিন্দু জনগণকে মুসলমান জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলা, দরকারমতাে দাঙ্গা সংগঠিত করা – এই কাজেই একমাত্র লিপ্ত থেকেছে। এই কাজকেই আরাে ভালভাবে করার জন্য তারা জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে “সাংতিক জাতীয়তাবাদ”-এর ধারণাকে বিকশিত করেছে, এবং তাদের এই কাজের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিমাণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে হিটলারের নাজি পার্টির কার্যকলাপ। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের গােটা পর্যায়ে তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসত্ব করে গেছে।
খ. ১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদ প্রশ্নে আর এস এস-সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থান
১৯৪৭-র স্বাধীনতা আদতে যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামন্ততকে টিকিয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল থেকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা একটা মাত্রায় অর্জিত হওয়া তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে, ভারতীয় অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকেই গেল এবং গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরু থেকে এই নির্ভরশীলতা আরও বাড়তে শুরু করল, নব্বই দশকে এসে বিশ্বায়ন উদারীকরণ-এর নীতি গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে আরাে অনেক বেশী গভীর ও তীব্র হল। ফলে, সাম্রাজ্যবাদী শােষণলুনের অবসানের বিষয়টি ১৯৪৭ থেকে শুরু করে আজ অবধি একই ভাবে বহাল থেকে গেছে। সেক্ষেত্রে, এই পর্যায়েও আমরা যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখবাে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের ওপর বাড়তি নির্ভরশীলতার নীতিগুলাে একের পর এক যখন লাগু হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, সেগুলি সম্পর্কে তারা কার্যত কোন কথা বলে না (একমাত্র ব্যতিক্রম “স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ”কে সামনে রেখে মাঝে-সাঝে সাধারণ দু-চারটে কথা বলা)। উলেদিকে, যখন আটের দশকের শুরুতে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণী আই এম এফ-বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে হাত পাতা বাড়িয়ে চলেছে, সেই পর্যায়ে ১৯৮৩-র ১৬ই নভেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর আর এস এস বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে সামনে রেখে “একাত্মতা যাত্রা” কর্মসূচী নিচ্ছে, যার মূল শ্লোগান হচ্ছে ও হিন্দুত্ব বিপন্ন। সুতরাং, হিন্দুত্বকে রক্ষা করার জন্য “জাতীয় ঐক্য” ও “জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য “একাত্মতা যাত্রা”। সেই সময় এই “একাত্মতা যাত্রা”-য় অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল তাতে “জাতীয় ঐক্য” ও “জাতীয় সংহতি”-র আসল মানে যে “হিন্দু ঐক্য” ও “হিন্দু সংহতি” তা স্পষ্টভাবেই সামনে উঠে এসেছিল। প্রসঙ্গত, এটাও বলা দরকার যে এই পর্বে আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে হাত পাতার বিরুদ্ধে কোন কথা নেই, এটা যেমন একটা দিক, আর একটা দিক হল ঠিক ওই সময়েই কেন “একাত্মতা যাত্রা” কর্মসূচী নিয়ে “বিপন্ন হিন্দুত্বের” রক্ষার জন্য সঙ্ঘ পরিবারকে মাঠে নামতে হচ্ছে ? তার কারণ সেই সময় একদিকে আসাম ও পাঞ্জাবে আত্মনিয়ণের অধিকারের দাবী নিয়ে অসমীয়া ও পাঞ্জাবী জনগণ সােচ্চার, অন্যদিকে কাশীরামের নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশে দলিতরা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় হচ্ছে। ফলে, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার কোন প্রশ্ন তাে নেই-ই, উল্টো গণতন্ত্রের দাবীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যখন রাস্তায় নামছে, তখন তাকে বিরােধিতার জন্য সঙ্ঘ পরিবার রাস্তায় নামছে “হিন্দুত্ব বিপন্ন”-র আওয়াজ তুলে।
একইভাবে নরসিংহ রাও ও মনমােহন সিংয়ের হাত ধরে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণী যখন ১৯৯১-এ “নয়া অর্থনৈতিক নীতি”-কে লাগু করার মধ্যে দিয়ে দেশকে সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিকিয়ে দেওয়ার আয়ােজন করছে, তখন তার বিরুদ্ধে একটা কথাও না বলে সঙ্ঘ পরিবার রাম জন্মভূমি উদ্ধারে ব্যস্ত এবং ব্যস্ত শুধু নয়, বাবরি মসজিদ ধ্ববংস করার মধ্যে দিয়ে দেশে একটা চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাকে জাগিয়ে তুলছে, সাধারণ মানুষের চোখকে সরিয়ে দিচ্ছে “নয়া অর্থনৈতিক নীতি”-র হামলা থেকে। ২০০১ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার ক্ষমতায় এসে “দ্বিতীয় দফার সংসার কর্মসূচী”-র নাম করে আরাে জোর কদমে বিশ্বায়ন-উদারীকরণ-এর নীতিকে কার্যকরী করছে, যার অন্যতম প্রধান একটা ধাপ হল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কারখানাগুলাে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের কাছে জলের দরে বেচে দেওয়া। আজকে মােদী ক্ষমতায় এসে একদিকে “মেক ইন ইন্ডিয়া”-র শ্লোগানের আড়ালে আরেকদফা দেশের শ্রমশক্তিকে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর দেশীয় বড় পুঁজিপতিদের কাছে জলের দরে বেচে দেওয়ার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের মাটি-জল-খনিজ সম্পদ, এমনকি সামরিক ক্ষেত্রকেও যখন তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে, তখন সেই তারাই আবার অন্যদিকে “দেশদ্রোহিতা”-র ধুয়াে তুলে নিজেদেরকে ‘দেশপ্রেমিক’ সাজাচ্ছে এবং বাস্তবত সমস্ত ধরনের গণতাকি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের টুটি চিপে ধরছে। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের পায়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এবং একই সাথে নিজেকে সদর্পে দেশপ্রেমিক বলে জাহির করার নির্লজ্জতা একমাত্র বিজেপি-আরএসএস-এর পক্ষেই দেখানাে সম্ভব। এই তাে এদের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী “জাতীয়তাবাদ” ও “দেশপ্রেম”-এর নমুনা!
গ. এদের “জাতীয়তাবাদ” ও “দেশপ্রেম” এর মােড়কের আসল সত্যিটা কি?
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট যে আজকে এদের “দেশপ্রেম”-এর ধারণার মূল কথা হল পাকিস্তান বিরােধিতা; পাকিস্তানের বিরােধিতার আসল কারণ পাকিস্তান মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। তার মানে আসলে মুসলমান বিরােধিতা। এরা যে ধারণাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে তা হল মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী, কাজেই সন্ত্রাসবাদের বিরােধিতার নাম করে মুসলমানদের বিরােধিতাই তাদের “দেশপ্রেম”-এর ধারণার সার কথা। তাদের ধারণা অনুযায়ী, “দেশপ্রেম”-এর প্রকাশ ঘটাতে হবে। কি ভাবে? “ভারতমাতা কি জয়” আওয়াজ তােলার মধ্যে দিয়ে। যারাই “ভারতমাতা কি জয়”শ্লোগান দিতে অস্বীকার করবে, তারাই এদের চোখে “দেশদ্রোহী”! আর “দেশদ্রোহী” কারা? প্রথমত, যারা বিজেপি সঙ্ঘপরিবারের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরােধিতা করে গণতনের এই প্রগতির পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তারাই ওদের কাছে দেশদ্রোহী। তাছাড়া, যে বা যারাই মুসলমান জনগােষ্ঠীর একটা কোন অংশ বা ব্যক্তির পক্ষ অবলম্বন করে কোন কথা বলবে, সে বা তারা সবাই। যার প্রমাণ আমরা দেখলাম হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির বিরােধিতা করার “অপরাধে” পাঁচজন দলিত ছাত্রের ওপর নেমে আসা হামলার মধ্যে দিয়ে এবং জে এন ইউ-তে আফজল গুরুর ফাঁসির বিরােধিতার জন্য ছাত্র সংসদের সভাপতি সহ আটজন ছাত্রকে গ্রেফতার করার মধ্যে দিয়ে। এর সর্বশেষ প্রকাশ কাশ্মীর এনআইটি-তে ছাত্রদের ওপর নেমে আসা পুলিশী হামলার মধ্যে দিয়ে। এবং প্রতিটি ঘটনাতেই এটাও স্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে শুধুমাত্র সরকারী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই এরা হামলাগুলাে নামাচ্ছে এমন নয়; প্রতিটি ক্ষেত্রেই এদের মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনীও স্বাধীনভাবে ময়দানে নেমে পড়ছে। “দেশদ্রোহী”-দের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
প্রাক্-১৯৪৭ পর্বের কথা তাে এই লেখায় আলাদা করেই আলােচনা করা হয়েছে, তাছাড়াও গত শতাব্দীর নবইয়ের দশকের অভিজ্ঞতা যদি আমরা দেখি, সেখানেও আমরা দেখবাে যে মন্দির-মসজিদ বিতর্ককে সামনে তুলে আনা, এদের উন্মত্ত গুন্ডাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বাবরি মসজিদের মতাে একটা ঐতিহাসিক সৌধকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া, গ্রাহাম সয়ার্ট সেইনকে পুড়িয়ে মারা ও মহিলা খ্রীসান মিশনারীদের ধর্ষণ করা, এদের মতাদর্শ দিয়ে সংগঠিত ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকদের ব্যবহার করে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিকৃতি ঘটানাে – এই সমস্ত কিছুর। মধ্যে দিয়ে এরা বাস্তবে বার বার এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে যে ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ, এখানে হিন্দু বাদ দিয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী লােকজনকে বাঁচতে হবে। হিন্দুধর্মবিশ্বাসী জনগণের অধীনস্থ হয়ে; এদের দ্বিতীয় সরসঙ্চালক গুরু গােলওয়ালকরের ভাষায়ঃ তাদেরকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে মূল race-র সঙ্গে একীভূত হলেই হবে না, ধর্ম-সংস্কৃতি ও ভাষাগতভাবেও তাদের একীভূত হতে হবে, অন্যথায় এই ধরনের বৈদেশিক জনগােষ্ঠীকে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন রাজনৈতিক কারণে বড় জোর একটি রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু কোন জাতীয় কাঠামাের অংশীদার তারা হতে পারবে না। এই জায়গা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা “দেশ”- “জাতি”- ”জাতীয়তাবাদ”-এর ঐতিহাসিকভাবে সমাজে স্বীকৃত ধারণাকে স্বীকার করে না অর্থাৎ তারা এভাবে। দেখে না। কিভাবে দেখে তা অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও আমরা যদি এই বিষয়ে এদের কোন লিখিত প্রামাণ্য দলিল খুঁজে বের করতে চাই তবে সেক্ষেত্রে প্রধানতম সমস্যা হল, প্রথমত এদের ক্ষেত্রে প্রামাণ্য লিখিত দলিল জোগাড় করা খুবই সমস্যার; এবং দ্বিতীয়ত, এদের স্বভাব পরিস্থিতি অনুযায়ী পুরােনাে লিখিত দলিলকে অস্বীকার করা। যাই হােক, এই প্রসঙ্গে গােলওয়ালকরের লেখা “We, or Our Nationhood Defined” বইটিতে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তত্ত্ব পাওয়া যায়। ফলে, এই বইটিতে “জাতি” সম্পর্কে যে ধারণা হাজির করা হয়েছে, সেটাকে এবার আমরা খুব সংক্ষেপে একটু দেখবাে। গােলওয়ালকর-এর জাতিতত্ত্বা এই বইটিতে গােলওয়ালকর Nation বা জাতির কি ধারণা সামনে এনেছে? “জাতি এই শব্দটির মধ্যে যে ধারণাকে ধারণ করা হয়েছে তা পাঁচটি স্বত বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক অবিমিশ্র ঐক্যবদ্ধ সামগ্রিকতা। এই বিখ্যাত পাঁচটি ঐক্য হল – ভৌগােলিক (দেশ), Racial (race), ধর্মীয় (ধর্ম), সাংতিক (সংস্কৃতি) এবং ভাষাগত (ভাষা)”। এরপর গােলওয়ালকর ঐকের এই পাঁচটি স্বতদিক ধরে নিজের মতাে করে আলােচনা করেছে। এরপর যেটা আকর্ষণীয় তা হল, গােলওয়ালকর উপরে উল্লিখিত পাঁচটি ঐক্যের মধ্যে ধর্ম ও সংতিকে একসাথে আলােচনা করেছে। এবং তার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছে – “যেখানে ধর্ম মানুষের প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের স্রষ্টা, যেখানে এটি ব্যক্তি ও সামগ্রিকভাবে সমাজের প্রতিটি কার্যক্রমকে পরিচালিত করে, সংক্ষেপে জাগতিক ও পারমার্থিক সমস্ত কার্যক্রমের একমাত্র উদ্দীপক, সেখানে এই দুটি বিষয়কে (ধর্ম ও সংতি – লেখক) স্পষ্টভাবে পৃথক করা খুব কঠিন। দুয়ে মিলে এটা একে পরিণত হয়। যেহেতু সংতি বহু দিনের প্রথা, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি এবং বিশেষভাবে সামাজিক জীবনে ধর্মীয় বিশ্বাস ও তার আনুষঙ্গিক দর্শনের (যেখানে সেরকম কোন দর্শনের অস্তিত্ব আছে) পুঞ্জীভূত ফল, যার মধ্যে দিয়ে এটা একটা বিচিত্র ধরনের Race Spirit (যা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন) তৈরী করে, ফলে এটা মূলত ঐ ধর্ম ও দর্শনের ফসল যা বংশপরম্পরায় সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্ৰণ করে, একে চেহারা দেয়, যার মধ্যে দিয়ে এটা race consciousness-এর ওপরে একটা বৈশিষ্ট্যসূচক রূপ আরােপ করে দেয়।” এই সাধারণ তত্ত্বায়নের ওপর দাঁড়িয়ে বিশেষভাবে ভারতবর্ষে জাতির ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে গােলওয়ালকর বলছেঃ “অন্যদিকে, হিন্দুস্থানে ধর্ম একটা সর্বব্যাপী অস্তিত্ব নিয়ে উপস্থিত। … আমাদের ক্ষেত্রে জীবনের প্রতিটি কার্যক্রম, তা সে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক যা-ই হােক না কেন, ধর্মের নির্দেশে পরিচালিত। … কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেটাই যা আমাদের মহান ধর্ম আমাদের তৈরী করেছে। আমাদের Race spirit আমাদের ধর্ম থেকে সস্তৃত, কাজেই আমাদের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি সর্বব্যাপ্ত ধর্মের সন্তান ছাড়া আর কিছুই নয়, এর শরীরের একটি অঙ্গ, এর থেকে পৃথক কিছু নয়। … জাতির প্রতিটি শাখা একটি জাতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে স্বীকার করে ও মানে, জাতি সম্পর্কে ধারণাকে সম্পূর্ণ করার জন্য এটা আবশ্যিক।”
ঘ. ধর্ম ও জাতিকে কি এভাবে একসাথে গােলানাে যায়?
এখানে এটা বলা দরকার যে কোন একটা বিশেষ ধর্মবিশ্বাসী জনগােষ্ঠী, Race, Tribe ও জাতি – এই প্রত্যেকটা সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা বর্গ, যারা সচেতনভাবে। এগুলােকে মিলিয়ে দেয়, তারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এটা করে। প্রথমত, একটা জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন থাকতে পারে, আবার একটা বিশেষ ধর্মবিশ্বাসী
ভাষাও অবিকশিত, স্থানীয় কথ্য ভাষা দিয়েই রােজকার কাজ চলে যায়; সংতিও স্থানকেন্দ্রিক। আর এই গ্রামব্যবস্থার বাইরে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন নগর গড়ে উঠেছে। এবং সেখানে শিল্পভিত্তিক পণ্য উৎপাদন কিছু পরিমাণে বিকাশলাভ করে চলেছে। এবং এই পণ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যেরও ধীরে ধীরে বিস্তারলাভ ঘটে চলেছে, যদিও পুঁজিবাদের পর্বের তুলনায় তা নিতান্তই প্রাথমিক স্তরে। পুঁজিবাদ এসে এই নিশ্চল জীবনযাপনকে ভেঙে তছনছ করে দিল। প্রতিষ্ঠা করল এমন এক ব্যবস্থা যেখানে পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ই সমাজের একমাত্র চালিকাশক্তি হয়ে গেল। পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ের তাগিদ যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশকে সূচিত করল, এই বিকাশ আবার পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ের জগতেও নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করে দিল। উৎপাদিকা শক্তির এক অভূতপূর্ব বিকাশ পণ্য উৎপাদনের জগতে যেমন বিপ্লব আনল, সাথে সাথে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রীর প্রয়ােজনে ঘটতে থাকল বাজারের বিস্তার। বাজারের প্রয়ােজন উন্নতি ঘটাল যােগাযােগব্যবস্থার। পণ্য উৎপাদনের পূর্ণ বিজয়ের জন্য পুঁজিবাদের প্রয়ােজন পড়ল দেশীয় বাজারের ওপর পূর্ণ নিয়ণ, পরিণতিতে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একটি বিস্তীর্ণ এলাকা যা ভৌগােলিক সীমানা দ্বারা নির্ধারিত, যেখানকার লােকজন একটা সাধারণ ভাষায় শুধু কথা বলে তাই নয়, তারা একটা সাধারণ লেখ্য ভাষার ভিত্তিতে সম্পৃক্ত, যাতে বাজারের সাথে প্রতিটি উৎপাদক, ক্রেতা ও বিক্রেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। বাজারের প্রয়ােজনে গড়ে ওঠা এই ঐক্য এই বিস্তীর্ণ এলাকার জনগােষ্ঠীর মধ্যেকার স্থানিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটা নতুন সংতিরও উন্মেষ ঘটাল। এই সমস্ত কিছুর যােগফল এই ভৌগােলিক সীমারেখায় আবদ্ধ জনগােষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট জাতি হিসেবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করল। এই ব্যবস্থাকে কার্যকরী রাখতে পুরােনাে শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন যে সংগঠিত ও পরিকল্পিত শাসনকাঠামাে গড়ে উঠল, তা পরিচিত হল জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে। ইতিহাসে এই প্রক্রিয়া প্রথম দেখা গেল পশ্চিম ইউরােপে, সেখানে সামন্ততকে উৎখাত করে পুঁজিবাদ ও তার জন্য প্রয়ােজনীয় জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই অর্জিত হল এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর একটা লম্বা সময় ধরে পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন প্রান্তে এই সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হল। এই সংগ্রামের একটি নির্দিষ্ট ফসল হল রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ, জাতীয় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল ধর্মনিরপেক্ষতা। সামন্ততরে যুগে আমজনতা ধর্মের ভিত্তিতে আবদ্ধ ছিল, এই পর্বে এসে তার বন্ধনের মূল ভিত্তি হল ধর্মকে অতিক্রম করে জাতীয় রাষ্ট্র।
পুঁজিবাদ তার নিজের নিয়মেই অগ্রগতির পথে দেশীয় বাজারের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারল না, দেশীয় সীমানা ছাড়িয়ে তাকে নামতে হল পৃথিবী জুড়ে নতুন নতুন বাজারের সন্ধানে। এই পর্যায়ে পুঁজিবাদের ইতিহাস তৃতীয় দুনিয়ার দেশে দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস। অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলােতে ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ ইত্যাদিদের উপনিবেশগুলাে একের পর এক গড়ে উঠল। সামন্ততথ্যের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে ইউরােপীয় পুঁজিবাদ সামন্ততলের সঙ্গে সমঝােতা করে সংসারের মধ্যে দিয়ে ধীরগতিতে পুঁজিবাদী সংসারের কর্মসূচী নিতে থাকল। এবং পরিণতিতে এই সমস্ত দেশগুলিতেও জাতি গঠনের প্রক্রিয়া গতিপ্রাপ্ত হল। কোন কোন দেশে এই প্রক্রিয়া প্রকাশ পেলাে একটি জাতি গঠনের মধ্যে দিয়ে, কোন কোন দেশে গড়ে উঠতে শুরু করল একগুচ্ছ স্বত জাতি। সংস্কারের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় ঔপনিবেশিক দেশগুলােতে ছােট দেশীয় পুঁজিপতিশ্রেণীর উদ্ভব ঘটলাে, যারাই প্রতিনিধি হয়ে উঠল এই নতুন বিকাশমান জাতির/জাতিগুলির। দেশীয় পুঁজি যেমন একদিকে জন্মলগ্ন থেকেই ঔপনিবেশিক (পরের দিকে সাম্রাজ্যবাদী) পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করল, আবার একই সাথে এই পুঁজির সাথে তার বিরােধের দিকগুলিও দিন দিন প্রকট হতে থাকল। বিরােধের মূল কারণ দেশীয় বাজারে বিদেশী পুঁজির তুলনায় তার পিছিয়ে থাকা অবস্থান। উদীয়মান দেশীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর এই বিরােধিতাই মতাদর্শগত জায়গা থেকে “জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ও রাজনৈতিকভাবে “জাতীয়তাবাদী দল গড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে এই দেশগুলিতে সামনে উঠে এল।
এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা প্রয়ােজনীয় যে “জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ঔপনিবেশিক দেশগুলির। উদীয়মান দেশীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর মতাদর্শ হলেও দ্রুতই তা এই সমস্ত দেশের তুলাকার নিপীড়িত সাধারণ মানুষদের চেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হল। তার মূল কারণ, একদিকে যেমন তাদের কাছে তাদের ওপর জারী থাকা শােষণ-জুলুম-অত্যাচারের মূল কারিগর ছিল বিদেশী শক্তি, সাথে সাথে এই শক্তি যেভাবে ঝড়ের গতিতে তাদের এতদিনকার নিস্তরঙ্গ জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে অঙ্গীভূত পুরােনাে আর্থ-সামাজিক সমস্ত দিকগুলিকে ভেঙে তছনছ করে দিল, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সমস্ত কিছুকে চুরমার করে দিতে থাকল, তার বিরুদ্ধে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ-বিদ্রোহ ভাষা পেল জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণাআন্দোলন সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে। প্রসঙ্গত, এটাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে ওপরের আলােচনায় যদিও আমরা “জাতীয়তাবাদ”-এর ধারণার বিকাশকে মূলত ঔপনিবেশিক/সাম্রাজ্যবাদী শােষণ শাসনের বিরুদ্ধে দেশীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্বে সমস্ত নিপীড়িত জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষোভ-বিদ্রোহের প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত করে হাজির করলাম, কিন্তু সাথে সাথে এটাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে নিপীড়িত সংখ্যালঘু জাতিগুলির মধ্যে “জাতীয়তাবাদ”-র ধারণার বিকাশ এর থেকে স্বতন্ঠ কোন পথে বিকশিত হয় নি, শুধু সেখানে ঔপনিবেশিক/সাম্রাজ্যবাদী শােষণের পাশাপাশি বিকশিত সংখ্যাগুরু ও অপেক্ষাকৃত উন্নত জাতির পুঁজিপতিশ্রেণীর শােষণ-উৎপীড়ন-আধিপত্য ইত্যাদি নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। যাই হােক, ওপরের এই আলােচনার মধ্যে দিয়ে আমরা এটাই হাজির করার চেষ্টা করলাম যে জাতি-জাতীয় রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের ধারণা কারাে মস্তিপ্রসূত ধারণা নয়, ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে সামন্তত থেকে পুঁজিবাদের উত্তরণের পর্যায়ে এগুলির বিকাশ, এক বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্কের উদ্ভবের সাথে এই ধারণাগুলির উদ্ভব সম্পর্কিত। আরাে নির্দিষ্ট করে বললে, বিশেষভাবে “জাতীয়তাবাদ”-এর ধারণার সাথে উপনিবেশ/ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের ও অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্রে উৎপীড়ক জাতির বিরুদ্ধে নিপীড়িত জাতির জনগণের বিক্ষোভ-বিদ্রোহ প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত।
সুতরাং জাতির পরিচয়কে যারা ধর্মের পরিচয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখানাের চেষ্টা করে, তারা আসলে ইতিহাসের বস্তুগত বিকাশকে জেনেশুনে অস্বীকার করে, অস্বীকার করে নিজেদের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের ভিত্তিতে তলাকার সাধারণ মানুষকে ভাগাভাগি করার জন্য।
কিছু ঐতিহাসিক সত্য যে দিকনির্দেশ করছে
ভারতবর্ষের বুকে সঙ্ঘ পরিবারের আজকের এতটা বাড়বাড়ন্ত ও দাপাদাপির পেছনে কয়েকটি বাস্তব ঐতিহাসিক সত্য বিদ্যমান, সেটা আমরা যদি না খেয়াল রাখি, তাহলে আমরা এইরকম একটা চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারব না, এবং সেক্ষেত্রে এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকেও আমরা অনেক সঙ্কীর্ণ জায়গা থেকে বিচার করব।
(১) ব্রিটিশদের “ভাগ করে শাসন করা”-র নীতি, দেশভাগ ও তার পর সরকারী ক্ষমতালােভী প্রতিটি রাজনৈতিক পার্টির এতদিনকার কার্যকলাপের ফসল হিসেবে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে বাস্তবে বিভাজন অত্যন্ত গভীর, যেটা আসলে দুই সম্প্রদায়েরই মৌলবাদী শক্তিগুলাের আসল হাতিয়ার।
(২) সাম্রাজ্যবাদ এতদিন ধরে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠতরাজের যে নীতি চালিয়ে এসেছে, তারই প্রতিক্রিয়ায় বিশেষভাবে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিদের উত্থান, এবং শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার।
নিজের স্বার্থে এই অঞ্চলে একগুচ্ছ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের জন্ম দিয়েছে; পরবর্তীতে সেগুলি ফ্র্যাঙ্কেনস্টান হয়ে উঠলে। ২০০২ সাল থেকে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার নাম। করে গােটা পৃথিবীর মুসলমান জনগােষ্ঠীকেই যেভাবে তারা সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়ায় যেভাবে আবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম মৌলবাদী ও সাসবাদী সংগঠনগুলির কার্যকলাপ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযােগ যেভাবে সুচতুর দক্ষতায় পাকিস্তানের জনগণের ওপর আরােপিত করা হচ্ছে— এই সমস্ত কিছু আবার ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের ভেতর আগের থেকেই তৈরী হওয়া মুসলমান জনগণ সম্পর্কে সন্দেহ-অবিশ্বাসকে আরাে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। ফলে, সজ্ঞা পরিবার বর্তমানে একটা অত্যন্ত উর্বর জমি পেয়ে গেছে তাদের ফ্যাসিস] অ্যাজেন্ডাকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। যে জায়গা থেকে আফজল গুরুর ফাঁসির বিরােধিতাকে সঙ্ীরা যখন “দেশদ্রোহিতা”র তকমা লাগায়, তখন ব্যাপক তুলাকার সাধারণ মানুষ সেই প্রচারে প্রভাবিত হয়, আফজল গুরু পার্লামেনের ওপর হামলাতে সত্যি সত্যি ছিল কি না, তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ। না থাকা সত্ত্বেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেভাবে রাতের অন্ধকারে তাকে ফাঁসিতে লটকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তা ঠিক হয়েছিল কি না – এই সব প্রশ্ন তুলাকার ব্যাপক। সাধারণ মানুষের বিচারের পরিধির মধ্যে আসে না।
(৩) আর আসল প্রশ্ন হল, তলাকার শ্রমিক-কৃষক সহ ব্যাপক সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন। এর মােকাবিলা বাস্তবে হয় শ্রেণীসংগ্রামের ময়দানে। চীন-রাশিয়ার পরাজয়, সরকারী বামপন্থী রাজনৈতিক পার্টিগুলাের শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতিতে আজ বাস্তবে শ্রেণীসংগ্রাম অত্যন্ত নীচু লয়ে রয়েছে। শ্রমিক-কৃষকের সঙ্ঘবদ্ধ পরিচয়ের হাতিয়ার যে। তার নিজের স্বত রাজনৈতিক সংগঠন, তা আজ নেই, ফলে সে আজকে বাঁচছে সমষ্টিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, তাকে বাঁচতে হচ্ছে ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে। সেখানে তার শ্রেণী পরিচয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার ধর্মের, জাতের বা জাতির ভিত্তিতে পরিচয়। এটা সঙ্ঘ পরিবার সহ মৌলবাদী শক্তিদের আরেক উর্বর ক্ষেত্র। যে জায়গা থেকে হুগলীর বন্ধ জুট মিলের মুসলমান শ্রমিক মহল্লাতে হিন্দু শ্রমিকরা রাম নবমীতে তরােয়াল-খাড়া হাতে মিছিল করে এবং শ্রমিকস্বার্থের পক্ষ নিয়ে যারা কথা বলে তাদের “অ্যান্টি-ন্যাশনাল” বলে গাল পাড়তে তাদের আপাতত আটকায় না বা, দিল্লীতে জে এন ইউ-র ছাত্রছাত্রীরা যখন কানহাইয়া কুমারদের মুক্তির দাবীতে আন্দোলন করে, তখন জে এন ইউ-র আশপাশের গরীব মহল্লাগুলােতে সঙ্ঘীরা জেএনইউ “দেশদ্রোহী” তৈরীর কারখানা – এই প্রচারের ভিত্তিতে গরীব মানুষগুলােকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় এবং জে এন ইউ-র ছাত্রছাত্রীরা যে সব বাড়িতে ভাড়া নিয়ে থাকে, বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে চাপ দেয়।
এই ঐতিহাসিক সত্যগুলােকে সামনে আনা হল এ কথাকে উপলব্ধি করানাের জন্য যে আজকে সঙ্ঘ পরিবারের আসল শক্তি অনেক গভীরে, তুলাকার সাধারণ শ্রমিককৃষকের মধ্যে; এবং সেটাকে বিচারের পরিধির মধ্যে রেখেই আমাদের ঠিক করা দরকার, সঙ্ পরিবারের এই ধরনের ফ্যাসিবাদী অভিযানের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা কোন্ পথে। আমাদের করতে হবে। ফলে, আজকে যখন তলাকার শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অত্যন্ত তলার দিকে, তখন সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রচার ও বিক্ষোভ এমনভাবেই ধৈর্যশীল প্রক্রিয়ায় এবং তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে। মিলিয়ে লাগাতারভাবে চালাতে হবে যাতে তা তলাকার শ্রমিক-কৃষককে স্পর্শ করতে পারে এবং একটা মাত্রায় প্রভাবিত করতে পারে। সাথে সাথে এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এতদসত্ত্বেও যতক্ষণ না তলাকার স্বাধীন সংগ্রামগুলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, ততক্ষণ আমাদের শত প্রচার সত্ত্বেও এইভাবে সঙ্ঘ পরিবার বারবার তলাকার মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়ে যাবে; আজ “দেশদ্রোহিতা”-র প্রশ্নে তারা শ্রমিক-কৃষককে বিভাজিত করছে, কাল অন্য কোন প্রশ্ন হাজির করবে। সাথে সাথে এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে সঙ্ঘ পরিবারের এই ধরনের ফ্যাসিবাদী অভিযান প্রতিহত হওয়ার প্রকৃত রাস্তা তৈরী হবে একমাত্র শ্রেণীসংগ্রাম বিকাশের মধ্যে দিয়ে, তলাকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের তার নিজস্ব রুটিরুজি-মুক্তির দাবীতে স্বাধীনভাবে মাথা তুলে ব্যাপক সংখ্যায় সংগঠিতভাবে দাঁড়াতে পারার মধ্যে দিয়ে। আমরা বিশ্বাস করি, আজ না হােক কাল এই ঘটনা ঘটবে, ঘটবেই এবং সেটা যাতে ত্বরান্বিত হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করাটাই আজকের প্রধান কাজ।
সাথে সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে যে গত কয়েক বছর ধরে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই দক্ষিণপন্থী রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে। বিশ্ব সমাজতথ্যের আন্দোলনের প্রথম অভিযানের পরাজয়, পৃথিবী জুড়েই শ্রমিকশ্রেণীর ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া, কোন দেশেই শ্রমিকশ্রেণীর প্রকৃত পার্টি গড়ে উঠতে না পারা, এবং অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সঙ্কট ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকা, এবং তার চাপ জনগণের ওপর ফেলে দেওয়ায় জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসা, স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ মাঝে মধ্যেই ফেটে পড়া – এরকমই এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে দেশে দেশে শাসকশ্রেণী গণতরে বুকের ওপর চেপে বসে ক্রমশ চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘটনা এটাই যে পশ্চাৎপদ জনগণের এমন কি শ্রমিকদের এক অংশ নিজেদের শােচনীয় দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির অন্ধ তাগিদে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। আমেরিকা সহ ইউরােপের উন্নত ধনতাকি দেশগুলিতে এই প্রবণতা ভালমাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জার্মানীতে জাতিদম্ভকে আশ্রয় করে যেভাবে ফ্যাসিস সংগঠন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তা নাজী আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ যাই থাক, আরব দুনিয়ায় ইসলামিক রাষ্ট্রের ধর্মীয় উন্মত্ততা (fanaticism), বর্তমান যুগের আধুনিকতাবাদ, প্রগতি ও গণতন্ত্রের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, যা ভারতে হিন্দু মৌলবাদী শক্তিকে বাড়িয়ে তুলছে। কাজেই আমাদের একথা বুঝে নিতে হবে যে আমাদের দেশে সঙ্ঘপরিবারের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী অভিযানের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী তথা জনগণের সংগ্রাম, ইউরােপ আমেরিকায় জনগণের ওপর চেপে বসা শাসকশ্রেণীর দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শাসনশােষণের বিরুদ্ধে সেখানকার শ্রমিকশ্রেণী তথা জনগণের সংগ্রাম, ইসলামিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরব দুনিয়ার গণতাকি মানুষের সংগ্রাম এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের ‘বিশ্বায়নী’ শােষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে দেশে দেশে জনগণের সংগ্রাম- এ সবই আজ এক ও অবিচ্ছেদ্য সুতােয় বাঁধা। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণীকে মােকাবিলা করতে হবে বিজেপি সঙ্পরিবারের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী অভিযানকে, পৃথিবীব্যাপী সংগ্রামী শ্রমিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
তথ্যসূত্রঃ
- (১) “সঙ্ঘবৃক্ষ কে বীজঃ ডাঃ কেশবরাও হেডগেওয়ার, সি পি ভিসিকার, নিউ দিল্লী, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৯।
- (২) “কেশবঃ সঙ্ঘনির্মাতা”, সি পি ভিসিকার, পুণে, ১৯৭৯, পৃঃ ৭।
- (৩) সূত্র ১, পৃঃ ২০-২১।
- (৪) “Khaki Shorts Saffron Flags”, by Tapan Basu etc, p. 231
- এছাড়া বিশেষভাবে যে বই/লেখাগুলাে ভাবনাকে। সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে, সেগুলি হল –
- (১) “আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭”, সুমিত সরকার; কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা – ১২
- (২) “Hindu Nationalism: Origins, Ideologies And Modern Myths” by Chetan Bhatt; Oxford, 2001
- (৩) “Khaki Shorts Saffron Flags”, by Tapan Basu etc
- (৪) “The Freedom Movement & The RSS: A Story of Betrayal” by Shamsul Islam; JoshiAdhikari Institute of Social Studies
- (৫) “Vishva Hindu Parishad and Indian Politics”, by Manjari Katju; Orient Blackswan
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।