লিখেছেনঃ আশরাফ উল ময়েজ
আমেরিকার ক্রীতদাস প্রথার সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, যা কখনােই সীমিত আকারে ছিল না বরং তার বিস্তৃতি ছিল বিশাল। অনেক ক্রীতদাসই এ-জাতীয় যৌন আক্রমণ প্রতিরােধ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছে আর যারা বেঁচেছিল তারা সবাই বহন করেছে আমৃত্যু মানসিক ও শারীরিক ক্ষত। আসলে সে আমলে ধর্ষণকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান ও কালাে চামড়ার মানুষের ওপর সাদা চামড়ার মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য।
ব্রিটিশ কলােনিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে আইন ছিল কোনাে কৃষ্ণাঙ্গ ও ইন্ডিয়ান সে আইনের সুবিধা নিতে পারতেন না। ইন্ডিয়ান, কৃষ্ণাঙ্গ ও তাদের সন্তানরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে এই আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন না, এই আইন ছিল কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য। যদি কোনাে ক্রীতদাস তার শ্বেতাঙ্গ মালিকের যৌনকামনায় সাড়া না দিতেন তবে তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করা হতাে এবং এ কাজে মালিকের সাথে মালিকের স্ত্রীও উৎসাহ নিয়ে ক্রীতদাসদের শাস্তি প্রদান করতেন। কোনাে শ্বেতাঙ্গের সাথে কোনাে কৃষ্ণাঙ্গ ও ইন্ডিয়ানদের যে কোনাে ধরনের লিয়াজো নিষিদ্ধ ছিল। শ্বেতাঙ্গ পুরুষের ঔরশে কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের গর্ভে জন্মানাে কন্যাসন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই দেখতে খুব আকর্ষণীয় হতেন। আর এই মিশ্র রঙের নারী ক্রীতদাসদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আকর্ষণও ছিল খুব তীব্র। এই মিশ্র রঙের কোনাে ক্রীতদাসীর সাথে যদি কোনাে শ্বেতাঙ্গের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যেত তবে তাকে পেতে হতাে সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাস্তি যদিও বা সম্পর্কটি শ্বেতাঙ্গ পুরুষ নিজেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তৈরি করেছেন। এই মিশ্র রঙের ক্রীতদাসীদের বলা হতাে সম্মােহনী নারী। গর্ভবতী হওয়াই ছিল এ জাতীয় সম্পর্কের শেষ প্রমাণ। আর এই সন্তান যখন জন্মগ্রহণ করত তখন তাকে মায়ের পদবি গ্রহণ করতে হতাে এবং সেও হয়ে যেত তার মায়ের মালিকের ক্রীতদাস। আর এভাবেই এ জাতীয় অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে সবদিক দিয়েই লাভবান হতেন শ্বেতাঙ্গ মালিক।
ব্রিটিশ আইনে সন্তানরা তার পিতার পরিচয়ে পরিচিত হবে এবং পিতার নাম গ্রহণ করবে এটাই নিয়ম। কিন্তু কলােনির শ্বেতাঙ্গরা এই নিয়মের পরিবর্তন আনে শুধুমাত্র নিজেদের সম্পদ আরাে বৃদ্ধি করার জন্য। একজন শ্বেতাঙ্গ কিছু অর্থ খরচ করে একজন ক্রীতদাসী ক্রয় করে তাকে দিয়ে শ্রম দেওয়াতে পারে এবং তার সাথে যৌন মিলন করে তাকে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য করে। এভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ক্রীতদাসীর পাশাপাশি যৌনদাসীতে পরিণত হয়, যার কাজ কেবল মালিকের জমিতে কাজ করা এবং মালিকের সাথে যৌন মিলন করা। আর সন্তান জন্ম নেওয়ার পর মালিকের ক্রীতদাসের সংখ্যা আরেকটি বৃদ্ধি পায়। সবদিক দিয়েই মালিকের লাভ।
আফ্রিকান-আমেরিকান লেখিকা হেরিয়েট এন জ্যাকবস (Harriet Ann Jacobs : ১৮১৩-১৮৯৭) ছিলেন মূলত একজন ক্রীতদাস, যিনি পালিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করার আন্দোলেন যােগ দিয়েছিলেন। তাঁর একটি মাত্র বই incidents in the Life of a Slave Girl ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয় কিন্তু বইটি তিনি তার ছদ্মনাম লিন্ডা ব্রেন্ট (Linda Brent) নাম ব্যবহার করেন। এই বইটিই ছিল কোনাে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস নারীর ক্রীতদাস জীবনের কাহিনী, যিনি মুক্তির জন্য মরিয়া ছিলেন। এই বইটিতে কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন তা অকপটে বর্ণনা করেছেন। হেরিয়েট পালিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করার আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন। হেরিয়েট জ্যাকব বর্ণনা করেন যে,
“আমার মালিক আমার সাথে যৌন মিলন করতে সব সময়ই উদগ্রীব থাকতেন। এ কারণে মালিকের স্ত্রী তাকে খুবই হিংসা করতেন সেই সাথে এবং ক্রোধের আক্রোশ মিটাতেন আমার ওপর। তিনি সব সময়ই আমাকেই দোষারােপ করতেন এবং বলতেন আমি কেন স্বামীর নিকট থেকে আমাকে নিরাপদে রাখতে পারছি না। এটি আমারই ব্যর্থতা।”
ক্রীতদাসদের কোয়ার্টার সব সময়ই ছিল মালিকের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। আর এ দূরে থাকার কারণে তারা সব সময়ই মালিক কিংবা ওভারসিয়ারের যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন। ক্রীতদাসদেরকে দূরে বিচ্ছিন্ন রাখার কারণেই নারী ক্রীতদসরা যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন বেশি।
আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটগুলােতে ধর্ষণের শাস্তির দ্বৈত নিয়ম ছিল। যদি কোনাে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্ষণ করত তবে তার শাস্তি ছিল ক্যাস্ট্রাশন (Castation) থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। অপরদিকে যদি কোনাে শ্বেতাঙ্গ কোনাে কৃষ্ণাঙ্গকে ক্রীতদাসকে ধর্ষণ করতেন তবে তার জন্য কোনাে শাস্তিই প্রযােজ্য ছিল না।
যৌন নির্যাতন কেবল নারী ক্রীতদাসদের উপরই হতাে তা নয়, পুরক্ষরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতাে। পুরুষদেরকেও নানা প্রকার এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকের বিকৃত যৌন লালসার শিকার হতেন। তা ছাড়া মালিকপক্ষের অনেক নারীই পুরুষ ক্রীতদাসদের তাঁর সাথে যৌনমিলনে বাধ্য করতেন। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন শ্বেতাঙ্গ মালিক কর্তৃক পুরুষ ক্রীতদাসের ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয়টি খুব একটা আলােচনায় না আসার কারণ নারী ক্রীতদাসদের ন্যায় পুরুষ ক্রীতদাসদের মিশ্র রঙের সন্তান জন্ম দিতে পারতেন না। আবার অনেক সময় মালিক ও মালিকের স্ত্রী উভয়েরই যৌন লালসার শিকার হতেন পুরুষ বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ক্রীতদাসগণ। আমেরিকার বর্ণবাদবিরােধী নেত্রী এঞ্জেলা ডেভিস (Angela Davis) বর্ণনা করেন যে,
“ক্রীতদাসদের ধর্ষণ করা অনেকটা মধ্যযুগীয় ফরাসি রীতি Droit du seigneur-এর মত ছিল যেখানে লর্ড তার অধীনস্থ যে কোনাে নারীর সাথেই যৌন মিলন করতে পারতেন। আর মালিকরা ইচ্ছা করেই এ কর্মটি করতেন নিজে আনন্দ পেতে ও নারীর স্বপ্রেরণা’ চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে তাদেরকে পশু শ্রেণিতে নামিয়ে আনতে।”
আমেরিকাতে বিশেষ করে দক্ষিণের স্টেটগুলােতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সকল নারী কি কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা শ্বেতাঙ্গ সবাইকেই সম্পত্তির মতাে গণ্য করা হতাে। বিশেষ করে দক্ষিণে শ্বেতাঙ্গ নারীদের সব সময়ই পুরুষের ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং তাদের নির্দেশমতাে নারীদের চলতে হতাে আর কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনটাই প্রতারণার মধ্যে ছিল। দক্ষিণে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে কালাে পুরুষের সাথে শ্বেতাঙ্গ নারীর সম্পর্ক নিষিদ্ধ থাকলেও পুরুষের জন্য তা ছিল উন্মুক্ত। আর এর ফলে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার মিশ্রবর্ণের সন্তান যাদেরকে মুলাটু (Mulatto) বলা হতাে। অসংখ্য কালাে নারী শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আর এ সকল নারীদেরকে তাদের পরিবারও রক্ষা করতে পারত না কারণ তার পরিবারও ছিল ক্রীতদাস। একটা সময়ে মিশ্রবর্ণের নারীরাই হয়ে উঠেন শ্বেতাঙ্গদের কামনার বড় শিকার। ক্রীতদাস মালিকের সম্পত্তি তিনি ইচ্ছামতাে তা ব্যবহার করতে পারেন, এটিই ছিল আইন।
ক্রীতদাস নারীদের মালিকের যৌন কামনায় নিয়মিত সাড়া দিতে হতাে। আরা যারা সাড়া দিত না কিংবা প্রতিরােধ করার চেষ্টা করত তাদের ওপর নেমে আসত অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। ফলে একটা সময় বাধ্য হয়েই ক্রীতদাস নারীকে তার মালিকের সাথে যৌনমিলন করতে হতো। এভাবেই অসংখ্য ক্রীতদাস হয়েছেন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কঙ্কুবাইন। আবার অনেক ক্রীতদাস মালিকরা তার কোনাে পছন্দসই ক্রীতদাসকে বিয়েও করত। এর ফলে সৃষ্টি হতাে আরেক ঝামেলা বাড়ির গৃহকত্রী ও ক্রীতদাস স্ত্রীর দ্বন্দ্ব। স্বাভাবিকভাবেই গৃহকত্রী এই সম্পর্ক মেনে নিতেন না। এ জাতীয় সম্পর্কের ফলে মিশ্রবর্ণের সন্তান জন্ম নিত। এই সন্তানরা তার পিতা মুক্ত না করা পর্যন্ত কোনােদিনই মুক্ত হতেন না। এই সন্তানরা সব সময়ই গৃহকত্রীর চক্ষুশূল ছিল এবং সব সময়ই তার স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করিয়ে দিত।
গৃহকর্তার যৌনকামনায় সাড়া দিয়ে নারী ক্রীতদাসরা গৃহকর্তীর অত্যাচারির কেমন শিকার হতেন তা বর্ণনা করেছেন আমেরিকার ক্রীতদাসবিরােধী আন্দোলনকর্মী ও লেখক স্ট্যানলি ফেস্টি (Stanley Felstei) tutaraq ota Once a Slave: The Slaves’ View of Slavery গ্রন্থে বর্ণনা করেন মারিয়া ছিল ১৩ বৎসরের এক ক্রীতদাস কিশােরি। একদিন গৃহকর্মীর ডাকে সাড়া না দিলে গৃহকত্রী তাকে খুঁজতে বের হন। মারিয়াকে খুঁজতে গিয়ে তিনি বাড়ির অর্ভ্যথনা কক্ষের দরজা খুলেই দেখতে পান তার স্বামী মারিয়ার সাথে যৌনমিলন করছেন। স্ত্রীকে দেখামাত্রই স্বামীটি লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ঘােড়ায় চড়ে কোনাে প্রকারে পালিয়ে বাঁচেন। নিজে পালিয়ে স্ত্রীর হাত থেকে বাঁচলেও তিনি জানতেন এখন এর সকল খেসারত দিতে হবে এই বালিকাকে। তার স্ত্রী মারিয়াকে প্রচণ্ড প্রহার করে তাকে মাছমাংস শুকানাের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরবর্তী দুই সপ্তাহ গৃহকর্ত্রী যখনই মনে করতেন তখনই তাকে চাবুক পেটা করতেন। বাড়ির কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি মারিয়ার পক্ষে এগিয়ে এসে গৃহকর্ত্রীকে বলেন এতে মারিয়ার চেয়ে দোষ তাে বেশি তার স্বামীর। মারিয়াকে একতরফা অভিযুক্ত করে শাস্তি দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্ত গৃহকর্তী উত্তর দেন : সে ভবিষ্যতে এই বিষয়টি বুঝতে পারবে এবং আর কখনােই এ-জাতীয় আচরণ করবে না, যদিও সে অজ্ঞতার কারণেই কাজটি করেছিল। গৃহকর্ত্রী তার স্বামীকে অভিযুক্ত না করে শাস্তি দিয়েছেন এই কিশােরী ক্রীতদাসীকে। গৃহকর্ত্রী নিঃসন্দেহে স্বামীর আচরণে খুবই হতাশ ছিলেন আর সে আক্রোশ মিটিয়েছেন কিশােরীর ওপর।
আসলে তখন দক্ষিণের স্টেটগুলােতে সব নারীরাই ছিলেন অসহায়। বিবাহ-বিচ্ছেদ খুব সহজ ছিল না, পুরুষ বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলে তা যত সহজ ছিল নারীর জন্য ততটা ছিল না। আর এ কারণেই কিশােরী ক্রীতদাসীরা গৃহকর্ত্রী ও স্বামীর অন্যায়ের মাসুল দিয়েছেন যুগ যুগ ধরে।
মালিক-ক্রীতদাসীর যৌন সম্পর্কে ক্রীতদাসীর স্বামীর তেমন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। আসল স্বামীর সাথে দাম্পত্য বন্ধন থাকলেও মালিকের ইচ্ছার নিকট সব সময়ই পরাস্ত হতেন ক্রীতদাস স্বামী। মালিকের যৌন কামনায় সাড়া না দিলে স্ত্রীসহ তার ওপর যেকোনাে সময়ে নেমে আসত শাস্তি। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মালিকের জোরপূর্বক অনৈতিক সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে মালিকের ওপর আক্রমণ করেছেন অনেক ক্রীতদাস আর যার পরিণাম হতাে ভয়ঙ্কর শাস্তি এমনকি মৃত্যু।
জোসিয়াহ হেনসন ছিলেন (Josiah Henson) আমেরিকার প্রথমজীবনে ক্রীতদাস ও পরবর্তিতে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তকরণের একজন সক্রিয় কর্মী, যিনি ওনটারিয়ােতে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের আইনি ও শ্রমবিষয়ক সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন। জোসিয়াহর সংগ্রামী জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ Uncle Tom’s Story of His Life: An Autobiography of the Rev. Josiah Henson এ জোসিয়াহ বর্ণনা করেন,
“…আমি চালর্স কাউন্টির এক কৃষিখামারে ১৭৮৯ সালের ১৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলাম। পাের্ট ট্যোবাকো হতে এক মাইল দূরবর্তী এই কৃষিখামারের মালিক ছিলেন মি. ফ্রান্সিস। আমার মা ছিলেন ডাক্তার জোসিয়া ম্যাকফারসনের একজন ক্রীতদাস কিন্তু তিনি তাকে মি. নিউম্যানের নিকট ভাড়া দেন; তার কারণও ছিল। কারণ আমার বাবা ছিলেন মি. নিউম্যানের একজন ক্রীতদাস। বাবার ক্রীতদাস জীবনের ভয়ঙ্কর একটি স্মৃতি আজও আমার মনে আছে যদিও তখন আমি অনেক ছােট। আমার মা তখন নিউম্যানের খামারে কর্মরত। একদিন আমার পিতা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত ও রক্তাক্ত পিঠ নিয়ে খামারে ফিরে এলেন। তখনও তার পাশে ছিলেন ক্রোধে উত্তেজিত ও মারাত্মক বিরক্ত মি. নিউম্যান। আমি তখন চারপাশের অপরাপর ক্রীতদাসদের মুখ থেকে যা শুনছিলাম তার অনেকটাই বুঝতে পারিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি যখন বড় হতে শুরু করলাম তখন বুঝে ছিলাম যে আমার মায়ের সাথে নিউম্যান তার পশুবৃত্তি নিবারণ করতে চেয়েছিল।
ওভারসিয়ার আমার মায়ের কর্মক্ষেত্র থেকে হঠাৎ করেই তাকে সরিয়ে দিয়ে তাকে দূরের নির্জন এক মাঠে কাজ করতে পাঠায়। সেখানে আমার মায়ের সাথে সে যৌনমিলন করতে উদ্যত হলে আমার মা তাকে বাধা দেন এবং চিৎকার শুরু করেন। অনেক দূরে হলেও আমার মায়ের চিৎকার আমার বাবার কানে আসে। তিনি গিয়ে দেখতে পান নিউম্যানের সাথে আমার মায়ের ধস্তাধস্তি চলছে। কালবিলম্ব না করে আমার বাবা নিউম্যানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে কৃষিখামারের ওভারসিয়ার এসে হাজির হন। তিনি আমার বাবাকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হন এবং সাথে সাথেই নিউম্যান আমার বাবার ওপর ক্রোধের ঝাল মেটান চাবুক দিয়ে পিটিয়ে। হয়তাে তিনি আমার মায়ের এ আচরণের কারণে আমার বাবাকে মেরেই ফেলতেন। ওভারসিয়ারের হস্তক্ষেপে হয়তাে তিনি বেঁচে যান। তবে এর শর্ত ছিল এ ঘটনা কাউকেই বলা যাবে না। আমার বাবা ও মা উভয়েই এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন ক্রীতদাস। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করেও তাদের উপায় ছিল না কারণ তাহলে কোনাে একজনকে কিংবা উভয়কেই হয়তাে মারা যেতে হতাে।”
মি. উইলিয়াম যখন আমাকে বলত যে আমার জন্য সে কিছু কিনে এনেছে তখনই আমি বুঝতাম আমাকে এখন তার শয্যাসঙ্গিনী হতে হবে। রাজী না হওয়া ছাড়া আমার আর কোনাে পথই খােলা নেই এবং এভাবেই আমাকে শেষ হয়ে যেতে হবে। আর এই অন্যায় কাজটির জন্য সব সময়ই আমাকে বিবেকের দংশনে ভুগতে হতাে। আমি মনেপ্রাণে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থন করতাম আমি যেন মরে যাই আর তাতে যেন আমার ধর্ম রক্ষা পায়।
সে অসুস্থ হওয়ার আগে আমার মধ্যে এই অনুভূতিগুলাে খুব মারাত্মকভাবে কাজ করত। সে অসুস্থ হওয়ার কয়েকদিন আগে আমাকে বলল, আমি যদি তার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যে আমি নিউ ইয়র্কে যাব না, তাহলে সে আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে মুক্তি দেবে। (নিউ ইয়র্কে তখন ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করার আন্দোলন তুঙ্গে) এর এক মাসের মধ্যেই উইলিয়াম মারা যায়। তার মৃত্যুতে আমি বিন্দু পরিমাণ দুঃখ পাইনি বরং আমি খুশীই হয়েছিলাম। আমি এখন মুক্ত, আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।”
অধিকাংশ ক্রীতদাস মালিকই তাদের ক্রীতদাসদের যৌন নির্যাতন করতেন যদিও অনেকে বলেন যে ক্রীতদাসদের সাথে যৌনমিলন সম্মতির ভিত্তিতেই হতাে। এই সম্মতি নিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তা হলাে তা কি আসলেই সত্য সম্মতি কি না। কারণ ক্রীতদাস হিসেবে তার যেখানে কোনাে অধিকারই ছিল না সেখানে পছন্দের বিষয়টি তাে খুবই গৌণ। সত্যি হলাে ক্রীতদাসকে তার মালিকের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কোনাে উপায় ছিল না। যদিও মালিক কর্তৃক গর্ভবতী হওয়া ছিল ক্রীতদাসীর জন্য একটি কঠিন শাস্তি কারণ তার সন্তানও তার মতাে ক্রীতদাস হবে।
১৯৩৭ সালে ম্যারিল্যান্ডের একজন মুক্ত ক্রীতদাস রিচার্ড ম্যাক বর্ণনা করেন,
“…অনেক মানুষের সমাগম হয় এ রকম একটি স্থানে একটি কালাে মায়ের গর্ভে জন্মানো সাদা চামড়ার কিশােরীকে বিক্রয়ের জন্য আনা হয়েছে। কিশােরীটির শারীরিক গঠন ছিল খুবই আকর্ষণীয় এবং তার চেহারাও ছিল বেশ সুন্দর। মেয়েটি ছিল খুবই দৃঢ়চেতা এবং এহেন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বদ্ধপরিকর। রাত্রিবেলা ব্যবসায়ী মেয়েটিকে তার রুমে নিয়ে যায় তার পশুবৃত্তি কামনা মেটানাের জন্য। মেয়েটি কোনাে কিছু বােঝার আগেই ব্যবসায়ী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মেয়েটি তার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তার সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে এবং এক সময় হাতের কাছে ব্যবসায়ীর ছুরিটি পেয়ে তা দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে তাকে খােজা বানিয়ে দেয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের পর পরদিন ক্রীতদাস ব্যবসায়ীটি মারা যায়। ক্রীতদাসের খানসামা এই সংবাদ পেয়ে সেখানে পুলিশ প্রেরণ করে এবং ম্যারিল্যান্ডের চার্লস কাউন্টি থেকে মেয়েটিকে ওয়াশিংটনে নিয়ে আসা হয়। সেখানে অবশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়…”।
মেয়েটির সৌন্দর্যই তার জন্য কাল হয়েছিল, এই মেয়েটি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় কিন্তু তার মতাে অসংখ্য মেয়ে মালিকের যৌনকামনায় সাড়া দিতে হয়েছিল আর এর ফলে কেউ হয়েছিল গর্ভবতী কিংবা কেউ বাদবাকি জীবন ঘৃণা নিয়েই বেঁচেছিল। আবার মালিকের যৌনমিলনে সাড়া না দেওয়ার কারণে অনেক ক্রীতদাস নারীকে জীবনও দিতে হয়েছিল।
অপর এক প্রাক্তন ক্রীতদাস বেঞ্জামিন ড্রিউ (Benjamin Drew) বর্ণনা করেন যে, ক্রীতদাস মালিকরা তখন আইনত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ এমন মেয়েদের সাথেও যৌন মিলন করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেমনক্রীতদাসীর কন্যা যে হয়তাে বা তারই ঔরশজাত তার সাথেও যৌনমিলন করতেন। বেঞ্জামিন আরাে বর্ণনা করেন যে,
“আমি একজন মানুষকে চিনতাম যে মিশ্রবর্ণের এক ক্রীতদাসী নিয়ে থাকতেন এবং তাদের ৬টি সন্তান ছিল। একদিন কোনাে কারণে তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হলে সে তার বড় কন্যাটি রেখে বাদবাকি পাঁচ সন্তানকে বিক্রয় করে দেয়। তারপর সে তার বড় মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এক সময় মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং তখন সে মেয়েটির মাকেও অপর একজনের নিকট বিক্রয় করে দেয়।”
১৬৬২ সালের আইনে ক্রীতদাসর সন্তানরা মায়ের স্ট্যাটাস পেত পিতার পরিচয় দিতে পারত না। ১৮২৪ সালে এসে এই আইন ইংলিশ কমন আইন থেকে বিদায় নিতে থাকে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় বিভিন্ন প্রদেশে এই আইন বিদায় নিতে থাকে ১৮২৪ সালে মিসিসিপি আইন পরিবর্তন করে। Partus Sequitur Ventrem আইন বিদায় নিলে ক্রীতদাসরা পিতার স্ট্যাটাস পায়। অনেক পিতাই তাদের সন্তানদেরকে মুক্ত ঘােষণা করেন আবার অনেকে করেননি। কিন্তু বাস্তবে ১৯ শতকেও আমেরিকাতে প্রচুর মিশ্র জাতির ক্রীতদাস ছিল।
লেখক হেরিয়েট জ্যাকব (Harriet Jacobs) পূর্বে ক্রীতদাস ছিলেন এবং পরবর্তীতে মুক্ত হয়েছেন এমনি একজন ক্রীতদাস কন্যার কথা বর্ণনা করেছেন তাঁর গ্রন্থে, যেখানে তিনি বর্ণনা করেন “আমি আমার অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির আলােকে বলতে চাই ক্রীতদাস প্রথা ছিল সাদা চামড়া ও কালাে চামড়া উভয়ের জন্যই অভিশাপ । ক্রীতদাস প্রথা শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর অত্যাচারী এবং তাদের পুত্রদেরকে বদমেজাজি ও লম্পট ও তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের জীবনকে বানিয়েছিল দুঃসহ। আর এই চামড়ার পার্থক্যের কারণে মানুষের যে যন্ত্রণা ও কষ্ট ভােগ করতে হয়েছিল এবং তারা যেভাবে অবহেলিত হয়েছিল তা বর্ণনার জন্য আমার চেয়েও শক্তিশালী কোনাে কলমের দরকার।”
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।