• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Monday, July 21, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ

মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
June 28, 2025
in সিনেমা
0
বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ

Image Source: Google

Share on FacebookShare on Twitter

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকটায়, যখন দেশের অর্থনীতিতে এক গভীর রূপান্তর আসছে, সেই সময়ই ভারতীয় জীবনযাত্রায় প্রবেশ করে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের নতুন অধ্যায়। ১৯৯২ সালে ‘জি টিভি’-র পথচলা শুরু হয়, তার পরপরই আসতে থাকে স্টার প্লাস, সনি, এমটিভি, চ্যানেল ভি-র মতো দেশি ও বিদেশি নানা চ্যানেল। এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলির হাত ধরে সাধারণ দর্শকের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় ঘটে এক আমূল পরিবর্তন। মানুষ আর শুধু সিনেমা দেখেই থেমে থাকছে না, তারা পরিচিত হয়ে উঠছে ফ্যাশনের নতুন ধারার সঙ্গে, আন্তর্জাতিক পপ সংস্কৃতির ছোঁয়ায়, বিদেশি মিউজিক ভিডিও আর হলিউডি ট্রেলারের ঝলকে। দর্শক হয়ে উঠছে এক অর্থে ‘গ্লোবালাইজড’। আর এই নতুন গ্লোবাল বোধকে আত্মস্থ করতে গিয়ে বলিউডও বাধ্য হয় নিজেকে বদলে নিতে—পরিবর্তিত হয় তার গল্প বলার ধরণ, চরিত্রের রূপরেখা, পোশাকের নকশা, সংগীতের ধারা এমনকি সংলাপের ভাষাও।

Image Source: Google

এই সময় থেকেই বলিউডে আসতে থাকে বড় বাজেটের ছবির ঢেউ—যেখানে প্রেম, সংগীত, অ্যাকশন আর পারিবারিক মূল্যবোধের এক স্বাভাবিক সহাবস্থান তৈরি হয়। Hum Aapke Hain Koun..! কিংবা Dilwale Dulhania Le Jayenge, Dil To Pagal Hai কিংবা Kuch Kuch Hota Hai—এই ছবিগুলির প্রভাব কেবল বক্স অফিসেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজের সাংস্কৃতিক অভ্যন্তরেও তারা গড়ে তুলেছিল এক নতুন ছন্দ। আগে যেখানে সিনেমা ছিল থিয়েটারভিত্তিক এক বিনোদনের মাধ্যম, সেখানে এই সময় সিনেমা রূপ নেয় এক ‘ব্র্যান্ড’-এ, আর তারকারা হয়ে ওঠেন জীবন্ত ‘আইকন’। শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, মাধুরী দীক্ষিত কিংবা কাজলের মতো তারকারা কেবল পর্দার চরিত্রেই আবদ্ধ থাকেন না, তাঁরা হয়ে ওঠেন বিজ্ঞাপনের মুখ, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্টের হাতিয়ার, টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো কিংবা লাইভ ইভেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রভাবে ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি এক নতুন আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে। এই মধ্যবিত্তের ইচ্ছা, স্বপ্ন, রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি বলিউডে ছাপ ফেলে স্পষ্টভাবে। কর্পোরেট জীবনযাপন, বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণী, আভিজাত্যপূর্ণ অভ্যন্তর, ডিজাইনার পোশাকের ছড়াছড়ি, ইংরেজি সংলাপের ছিটেফোঁটা—সবই সিনেমার বয়ানে জায়গা করে নিতে শুরু করে। তবে এই আধুনিকতার ভিড়েও বলিউড তার মূল ভারতীয় আত্মাকে পুরোপুরি বিসর্জন দেয় না। ধর্মীয় উৎসব, পারিবারিক একতার গুরুত্ব, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা প্রেমের নির্মলতা—এইসব চিরায়ত উপাদান এখনও বলিউডের হৃদয়ে থাকে, যদিও তার উপস্থাপনায় আসে এক আধুনিক, শহুরে এবং আন্তর্জাতিক সংবেদন।

এই সময় থেকেই প্রথমবার বড় আকারে বলিউডের ছবি মুক্তি পেতে থাকে বিদেশের বাজারে। ব্রিটেন, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয় দর্শকদের জন্য নির্ধারিত হয়ে ওঠে ছবির রিলিজ ডেট। তাঁদের জীবনযাপন, সংকট এবং সংস্কারও তখন হয়ে ওঠে সিনেমার বিষয়বস্তু। Kabhi Khushi Kabhie Gham, Kal Ho Naa Ho কিংবা Swades—এই ছবিগুলি যেন সেই প্রবাসী মননের এক অন্তরঙ্গ প্রতিচ্ছবি।

অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রযুক্তির বিকাশেও এক বিশেষ গতি এনে দেয়। উন্নতমানের ক্যামেরা, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, টেকসই এডিটিং সফটওয়্যার—এই সব কিছু বলিউডের নির্মাণশৈলীতে আনে এক নতুন জৌলুস। বিদেশে শুটিংয়ের চল শুরু হয়, সিনেমার ভিজ্যুয়াল স্টাইল হয়ে ওঠে আরও নিখুঁত, আরও আকর্ষণীয়। সিনেমার প্রচারপ্রক্রিয়াতেও আসে বিরাট বদল—টেলিভিশনে ট্রেইলার মুক্তি, অ্যালবাম রিলিজ, তারকাদের প্রি-রিলিজ সাক্ষাৎকার—সব মিলিয়ে বলিউড এখন এক সমৃদ্ধ বাণিজ্যপণ্যের রূপ ধারণ করে।

গান ও সংগীতের ক্ষেত্রেও এই সময়টি হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক। নব্বইয়ের দশকে ক্যাসেট ও সিডির বাজার আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। নাদিম-শ্রবণ, অনু মালিক, জতিন-ললিত, এ আর রহমান—এঁদের হাত ধরে বলিউড সংগীত পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিটি পরতে। গানগুলো কেবল সিনেমার অংশমাত্র থাকে না, তারা হয়ে ওঠে সামাজিক আবহের আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বিয়ে বাড়ি হোক বা চায়ের দোকান—উদিত নারায়ণ, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গলায় গাওয়া গান যেন তখন সময়ের সুরধ্বনি।

তবে এই উন্মুক্ত অর্থনীতির হাওয়ায় যেমন আধুনিকতার প্রসার ঘটেছিল, তেমনই দেখা দিয়েছিল এক ধরনের দোদুল্যমানতা। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে শুরু করে, ছোট শহর ও মহানগরের মধ্যেকার ফারাক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিভাজনও প্রতিফলিত হতে থাকে বলিউডের কাহিনিতে। শহুরে গ্ল্যামার ও ফ্যাশনের পাশে পাশাপাশি উঠে আসে গ্রামীণ আবেগ, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও বাস্তব জীবনের টানাপড়েন। Gadar, Lagaan, Vaastav, Sarfarosh—এই ছবিগুলি হয়ে ওঠে বিভিন্ন শ্রেণির জীবনবাস্তবতার মুখপাত্র।

এই দশকের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল তারকাদের ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে ওঠার গল্প। উদারীকরণের যুগ তাঁদের স্টারডমকে শুধু জনপ্রিয়তার নয়, বরং বাণিজ্যিক কৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকেও বহুমাত্রিক করে তোলে। তাঁরা হয়ে ওঠেন অভিনেতা ছাড়াও প্রযোজক, উদ্যোক্তা, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, এমনকি একেকজন নিজস্ব ‘লাইফস্টাইল’ বা জীবনের দর্শনের প্রতিনিধিত্বকারী মুখ। শাহরুখ খান ‘রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট’ শুরু করেন, আমির খান তাঁর প্রতিটি কাজে নিখুঁততার প্রতীক হয়ে ওঠেন, সালমান খান তাঁর ‘ভাইজান’ ইমেজ ব্যবহার করে জনসেবামূলক কাজে যুক্ত হন। তাঁরা হয়ে ওঠেন এক প্রজন্মের ‘আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’—যাদের দেখে মানুষ কেবল মুগ্ধ হয় না, বরং অনুকরণও করতে চায়।

এই সমগ্র রূপান্তরের কেন্দ্রে রয়েছে একটি নীতি—অর্থনৈতিক উদারীকরণ। যার ফলে বলিউড কেবল একটি চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে নয়, বরং এক সামাজিক দলিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে—যেখানে ধরা পড়ে ভারতের আর্থ-সাংস্কৃতিক উত্তরণ, দ্বৈততা এবং বিশ্বায়নের অভিঘাত। নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা হয়ে ওঠে সেই উত্তরণের এক জীবন্ত সাক্ষ্য—যা কেবল প্রেমের গান বা আবেগঘন নাটকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার অন্তর্লিখিত স্তরে জমা থাকে একটি জাতির মনোজাগতিক রূপান্তরের গাথা।

এই দশকের বলিউড ছিল এক নবযুগের প্রতীক। সিনেমা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে তার চেনা কাঠামো থেকে, প্রবেশ করে এক নতুন বাস্তবতায়—যেখানে দর্শক শুধু অনুগামী নয়, হয়ে ওঠে এক সক্রিয় ভোক্তা, যার রুচি ও প্রত্যাশাই স্থির করে দেয় সিনেমার ভবিষ্যৎ অভিমুখ। বলিউডও সেই চাহিদাকে উপলব্ধি করে নেয় এবং গড়ে তোলে এক জটিল অথচ উদ্দীপক বিনোদন-পরিসর।

এই রূপান্তর হঠাৎ করে ঘটেনি। এটি ছিল এক দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রাকৃতিক প্রতিফলন। ভারতীয় সমাজ যে খোলা বাজার, এক নবনির্মিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দিয়ে চলেছিল—সেই চলার ছাপ পড়েছিল ঠিক সিনেমার অন্তরভেদী বয়ানে। ফলে নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা ও ১৯৯১-এর অর্থনৈতিক উদারীকরণ—এই দুইকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। বরং তারা একে অপরের পরিপূরক, যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী।

ঠিক সেই সময়েই ভারতীয় পরিবারে প্রবেশ করে এক অভূতপূর্ব নতুনত্ব—স্যাটেলাইট টেলিভিশন। ১৯৯২ সালে জি টিভি-র সূচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই পর্ব, যার ধারাবাহিকতায় ভারতীয় টেলিভিশনের পর্দায় একের পর এক পা রাখে স্টার প্লাস, সনি, এমটিভি, চ্যানেল ভি-র মতো দেশি-বিদেশি চ্যানেল। এই চ্যানেলগুলির হাত ধরে দর্শকের অভিজ্ঞতায় ঘটে এক গাঢ় রূপান্তর। দর্শকরা সিনেমার বাইরেও পরিচিত হতে শুরু করে ফ্যাশনের আধুনিকতম ধারা, পপ সংস্কৃতির দুনিয়া, বিদেশি মিউজিক ভিডিও আর হলিউডি ছবির ঝলমলে ট্রেলারের সঙ্গে। এক নতুন ধরনের দর্শকসত্তার জন্ম হয়—যা ছিল ‘গ্লোবালাইজড’। আর এই বৈশ্বিক বোধের সঙ্গে সুর মেলাতে গিয়ে বলিউডও নিজের ভঙ্গি পাল্টাতে বাধ্য হয়। বদলে যায় তার গল্প বলার ধাঁচ, চরিত্র গঠনের পদ্ধতি, পোশাকের ভাষা, সংগীতের রূপ আর সংলাপের প্রকাশভঙ্গিও।

এই পরিবর্তনের ঢেউয়ে বলিউডে আসতে শুরু করে বড় বাজেটের ছবি—যেখানে প্রেম, সংগীত, অ্যাকশন আর পারিবারিক মূল্যবোধের অপূর্ব সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। Hum Aapke Hain Koun..!, Dilwale Dulhania Le Jayenge, Dil To Pagal Hai, Kuch Kuch Hota Hai—এই ছবিগুলি কেবল বাণিজ্যিক সাফল্য নয়, বরং গড়ে তোলে এক সাংস্কৃতিক স্রোত, যা রুচি, ভাষা এবং অভিব্যক্তির নতুন মানচিত্র আঁকে। আগের যে সিনেমা ছিল মূলত থিয়েটারনির্ভর গণবিনোদন, তা এই সময় রূপ নেয় এক ‘ব্র্যান্ড’-এ। তারকারাও আর কেবল অভিনেতা থাকেন না—তাঁরা হয়ে ওঠেন ‘আইকন’। শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, মাধুরী দীক্ষিত, কাজল—এঁরা অভিনয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যান বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট এবং লাইভ ইভেন্টের সর্বব্যাপ্ত আলোয়।

অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলস্বরূপ, ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের জীবনে জন্ম নেয় নতুন স্বপ্ন, নতুন রুচি, নতুন অভিলাষ। বলিউড এই শ্রেণির ভেতরকার চাহিদা ও কল্পনাকে প্রতিফলিত করতে শুরু করে। শহুরে জীবনের কর্পোরেট গতি, বিদেশে পড়তে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন, অভিজাততা, ফ্যাশন, ইংরেজি সংলাপের ছিটেফোঁটা—সব কিছু জায়গা করে নেয় মূলধারার সিনেমায়। তবুও এই রূপান্তরের মধ্যেও বলিউড তার ভারতীয় শিকড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। সে ধরে রাখে ধর্মীয় উৎসব, পারিবারিক সংহতি, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেমের নিঃস্বার্থতা—তবে সেগুলিকে তুলে ধরে এক নতুন মোড়কে, যা একইসঙ্গে শহুরে ও আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়।

এই সময় থেকেই শুরু হয় বলিউডের ছবি বিদেশে মুক্তির ধারাবাহিক প্রচলন। ব্রিটেন, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী ভারতীয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখে মুক্তি পেতে থাকে ছবি। সেই সঙ্গে সিনেমার বিষয়বস্তুর মধ্যেও প্রবেশ করতে থাকে প্রবাসী জীবনের টানাপড়েন, সংস্কার আর সম্পর্কের জটিলতা। Kabhi Khushi Kabhie Gham, Kal Ho Naa Ho, Swades—এই ছবিগুলি সেই অভিজ্ঞতারই এক প্রাঞ্জল প্রতিচ্ছবি।

এই অর্থনৈতিক রূপান্তর প্রযুক্তির প্রসারকে আরও গতিশীল করে তোলে। উন্নত মানের ক্যামেরা, অত্যাধুনিক সাউন্ড ডিজাইন, ডিজিটাল এডিটিং—এই সব কিছুর উন্নয়নে বদলে যেতে থাকে সিনেমার দৃষ্টিভঙ্গি। শুরু হয় বিদেশে শুটিংয়ের নতুন ধারা। সিনেমার ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায় আসে এক ঝলমলে আধুনিকতা। প্রচারের কৌশলেও আসে বৈপ্লবিক বদল—টিভি ট্রেইলার, অ্যালবাম রিলিজ, প্রি-রিলিজ সাক্ষাৎকার—সব মিলিয়ে বলিউড হয়ে ওঠে এক সুসংগঠিত বাণিজ্যপ্রণালী।

সংগীতের ক্ষেত্রেও নব্বইয়ের দশকের প্রভাব ছিল সুগভীর। ক্যাসেট ও অডিও সিডির বাজারে বিপুল চাহিদা ছিল। নাদিম-শ্রবণ, অনু মালিক, জতিন-ললিত এবং এ আর রহমানের মতো সুরকাররা এই সময় বলিউড সঙ্গীতকে পৌঁছে দেন জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে। সিনেমার গান তখন আর কেবল দৃশ্যের অনুষঙ্গ নয়, বরং একটি স্বাধীন হিট—যা বাজে বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে চায়ের দোকানের আড্ডায়। উদিত নারায়ণ, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘরের চেনা শব্দ।

তবে এই উন্মুক্ত অর্থনীতির আলোছায়ায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিছু দ্বন্দ্বও। উদারীকরণের ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধরনের বৈষম্য—বড় শহর আর ছোট শহরের ব্যবধান ক্রমেই গভীরতর হয়। এই দ্বৈততা প্রতিফলিত হয় সিনেমার মধ্যেও। একদিকে ঝাঁ-চকচকে শহুরে জীবন, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের লড়াই, গ্রামীণ আবেগ—এই দুইয়ের সংমিশ্রণ এক অনন্য সিনেমা-ভাষা তৈরি করে। Gadar, Lagaan, Vaastav, Sarfarosh—এই ছবিগুলি সেই দুই মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে, এক গভীর সামাজিক বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যায়।

এই পর্বে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে তারকাদের পরিচয়ে। তাঁদের স্টারডম একমাত্র ‘অভিনেতা’ পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। তাঁরা হয়ে ওঠেন উদ্যোক্তা, প্রযোজক, ব্র্যান্ড ফেস, এমনকি একেকটি লাইফস্টাইলের প্রতীক। শাহরুখ খান শুরু করেন ‘রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট’, আমির খান তাঁর প্রতিটি প্রজেক্টে নিখুঁতত্বের এক অনন্য মানদণ্ড স্থাপন করেন, আর সালমান খান তাঁর ‘ভাইজান’ ইমেজ ব্যবহার করে যুক্ত হন নানা সমাজসেবামূলক কার্যকলাপে। তাঁরা হয়ে ওঠেন এমন এক আকর্ষণীয় প্রতিমূর্তি, যাঁদের জীবনের গল্পে সমাজ খুঁজে পায় অনুপ্রেরণা।

এই সমগ্র রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটিমাত্র নীতি—‘উদারীকরণ’। বলিউড আর কেবল বিনোদনের উৎস নয়, হয়ে ওঠে এক সামাজিক প্রতিফলন—যেখানে ধরা পড়ে ভারতের অর্থনৈতিক উত্তরণ, সাংস্কৃতিক দ্বৈততা এবং বিশ্বায়নের তরঙ্গ। নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা কেবল গান, প্রেম, আবেগের বাহুল্যে পূর্ণ এক মাধ্যম নয়, বরং তার অন্তরস্থলে থাকে একটি জাতির মনোজাগতিক বিবর্তনের কাহিনি।

এই দশকের বলিউড ছিল এক অনন্য সময়চিহ্ন, এক নতুন যুগের সূচক। এখানে সিনেমা কেবল একটি শিল্প নয়, বরং একটি বাজার, একটি চিন্তাধারা, একটি চলমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। দর্শক আর কেবল ‘দর্শক’ নয়, সে হয়ে উঠেছে সক্রিয় এক ভোক্তা, যার রুচি ও প্রত্যাশাই নির্ধারণ করছে সিনেমার পরবর্তী দিকচিহ্ন। বলিউড সেই চাহিদাকে ধরতে শেখে, আর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক বৈশ্বিক বিনোদন শিল্প, যা একই সঙ্গে ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক।

এই রূপান্তর কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি ছিল সময়ের স্বাভাবিক অনিবার্যতা। ভারতীয় সমাজ যে পরিবর্তনের পথ ধরে এগোচ্ছিল—বাজারের উন্মুক্ততা, নবগঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি—সেই পরিবর্তনই সিনেমার প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হচ্ছিল। সেজন্যই নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমা বুঝতে হলে, তার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রভাব বিশ্লেষণ করতেই হয়—কারণ, সে ছিল কেবল নীতিগত নয়, সাংস্কৃতিক ও মানসিক রূপান্তরের এক যুগান্তকারী চালিকা শক্তি।

এইভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার শুধু টাকা-পয়সার হিসাব নয়, এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা ছিল। এবং সেই বিপ্লবের সবচেয়ে উজ্জ্বল, জনমানসগাথিত প্রতিফলন আমরা দেখি নব্বইয়ের বলিউডে।

স্যাটেলাইট টিভির আগমন (Zee TV, Sony)

১৯৯০-এর দশকের সূচনালগ্নে ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিসরে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল এক গাঢ় রূপান্তরের রেখাচিত্র। রাষ্ট্রীয় নীতির বদলে আসা ছন্দ, আর্থিক ব্যবস্থার খুলে যাওয়া দরজা, এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছিল এক নতুন অনুভব, এক নতুন চিন্তাবলয়। এই পরিবর্তনের অভিঘাতে শুধু অর্থনীতিই নয়, আমূল বদলে যেতে শুরু করল জনমাধ্যম, গণসচেতনতা এবং বিনোদনের পরিসরও। নব্বইয়ের দশক তাই নিছকই একটি দশক নয়—এটি ছিল ভারতীয় সমাজে গণমাধ্যমের উত্থান ও সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণের এক অন্তর্জাগতিক মুহূর্ত।

হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Image Source: AI Generated

এই যুগান্তরের সূচনায় ভারতীয় ঘরে ঘরে প্রবেশ করল স্যাটেলাইট টেলিভিশন। দূরদর্শনের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক চ্যানেল সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় পা রাখল নিঃশব্দে অথচ প্রবল প্রভাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আবির্ভূত হল জি টিভি ও সনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন—যারা শুধু চ্যানেল নয়, হয়ে উঠল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এক নতুন বিনোদনবোধের ধারক।

১৯৯২ সালে সম্প্রচার শুরু করল জি টিভি—ভারতের প্রথম বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল। সুবাস চন্দ্রর এসসিআইটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে এই প্রয়াস বদলে দিল ভারতীয় টেলিভিশনের মুখচ্ছবি। দূরদর্শনের নির্ধারিত কাঠামোয় আবদ্ধ, গম্ভীর ও মন্থর বিন্যাসের বিপরীতে জি টিভি আনল রঙিন, সজীব এবং বহুস্তরীয় অনুষ্ঠানমালা—যেখানে গানের প্রতিযোগিতা, ধারাবাহিক, কৌতুক, রিয়ালিটি শো—সব মিলিয়ে রচিত হল এক সম্পূর্ণ নতুন দর্শক অভিজ্ঞতা।

জি টিভির বিশেষ কৃতিত্ব ছিল তার ‘পাবলিক কানেক্ট’। দূরদর্শনের ‘মধ্যবিত্ত মার্জিততা’র বদলে এখানে উঠে এল মানুষের ভাষা, চাহিদা ও কল্পনার বাস্তব প্রতিফলন। লোকগীতি, হাস্যরস, দৈনন্দিনতার ছোট ছোট টানাপোড়েন—সবকিছুকে আপন করে নিয়ে জি টিভি পৌঁছাতে পারল সেই বিশাল শ্রেণির দর্শকের কাছে, যাঁদের উপস্থিতি এতদিন অবহেলিতই ছিল। শহরের সীমা অতিক্রম করে গ্রাম ও আধা-শহরের দর্শকদের মধ্যেও এই চ্যানেলের আবেদন ছড়িয়ে পড়ল অভূতপূর্ব গতিতে।

জি টিভির ধারাবাহিকগুলি ছিল যেন বলিউডের আবহে টেলিভিশনের নতুন নির্মাণ। Tara, Banegi Apni Baat, Hasratein, Amanat, Antakshari, Sa Re Ga Ma—এই অনুষ্ঠানগুলি কেবল বিনোদনই নয়, দর্শকের আবেগের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। প্রেম, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের জটিলতা, সমাজে নারীর অবস্থান—এইসব বিষয়কে সাহসের সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরার সাহস দেখাল জি টিভি। এ এক নতুন ভাষা, যা বিনোদনের মধ্যেই সমাজবোধের ছায়া খুঁজে নিতে চেয়েছিল।

এই সাফল্য দেখে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিও পড়ে ভারতীয় মিডিয়া বাজারের দিকে। আর সেই ধারাতেই ১৯৯৫ সালে আত্মপ্রকাশ করল সনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন। শহুরে উচ্চবিত্ত ও কর্পোরেট শ্রেণির রুচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এই চ্যানেল শুরু থেকেই নজর কাড়ে তার নির্মাণশৈলীতে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে এবং উপস্থাপনার ঝকঝকে আধুনিকতায়। সিনেমার সম্প্রচার থেকে শুরু করে গেম শো, কুইজ, কমেডি ও রিয়ালিটি প্রোগ্রামের সমন্বয়ে সনি তৈরি করে এক নিখুঁত বিনোদন-মঞ্চ।

সনির CID, Aahat, Boogie Woogie, Jassi Jaisi Koi Nahin, Indian Idol—এইসব অনুষ্ঠানগুলি শুধু জনপ্রিয়তাই অর্জন করেনি, বরং ভারতীয় টেলিভিশনের ন্যারেটিভ ও ঘরানা গঠনেও রেখেছে সুস্পষ্ট ছাপ। CID ও Aahat ভারতীয় দর্শকের সামনে তুলে ধরল ক্রাইম থ্রিলার ও হররের এক নতুন সম্ভাবনা, আর Boogie Woogie টেলিভিশনে নাচের বাস্তব প্রতিযোগিতার সম্ভাবনাকে প্রথম ছুঁয়ে দেখাল। দর্শকও প্রথমবার উপলব্ধি করল—টেলিভিশন কেবল গল্প বলার মাধ্যম নয়, এ এক আত্মপ্রকাশের মঞ্চ।

এই পর্বে জন্ম নিল এক নতুন ধরনের তারকা—টেলিভিশন সেলিব্রিটি। আগে যেখানে জনপ্রিয়তা মানে ছিল বড়পর্দার নায়কদের নাম, সেখানে এবার টিভির ঘরোয়া চেহারার তারকারাও হয়ে উঠলেন দর্শকের কাছের মানুষ। Smriti Irani, Ronit Roy, Sakshi Tanwar, Mona Singh—তাঁদের পরিচিতি আর গ্রহণযোগ্যতা ঘর থেকে অফিস, শহর থেকে শহরতলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে, অথচ গভীরভাবে।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের এই উত্থান শুধু একটি প্রযুক্তিগত উত্তরণ ছিল না, বরং ছিল এক সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূচনা। সন্ধেবেলা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখছে মেগা সিরিয়াল, কুইজ শো কিংবা সঙ্গীত প্রতিযোগিতা—এ যেন এক নতুন সামাজিক আচার। টিভি সেট হয়ে উঠল পারিবারিক মিলনের কেন্দ্র, আর অনুষ্ঠানগুলি হয়ে উঠল পারস্পরিক গল্প বিনিময়ের উপলক্ষ। কে কোন শো মিস করল না, কে কার প্রিয় তারকা—এইসবের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছিল এক সামাজিক সত্তা।

এই পরিবর্তনের সমান্তরালে বিকাশ লাভ করল বিজ্ঞাপননির্ভর মিডিয়া অর্থনীতি। চ্যানেলগুলির টিআরপি-ভিত্তিক প্রতিযোগিতা বিজ্ঞাপনদাতাদের টেনে আনল। সাবান থেকে বিমা, সফট ড্রিংক থেকে ব্যাঙ্ক—প্রতিটি ব্র্যান্ড টেলিভিশনকে তাদের বিপণনের মুখ্য মাধ্যম করে তুলল। এর ফলেই টিভি তারকারা হয়ে উঠলেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, এবং এক নতুন তারকা-অর্থনীতি জন্ম নিল, যেখানে অভিনয়ের বাইরেও তারকার পরিচয় বহুমাত্রিক।

স্যাটেলাইট চ্যানেলের আরেক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল সিনেমার প্রচারের ক্ষেত্রে। আগে যেখানে পোস্টার ও ট্রেলারের মাধ্যমে ছবির প্রচার চলত, সেখানে জি ও সনি এনে দিল প্রোমোশনাল কনটেন্টের যুগ। গান, নায়কের সাক্ষাৎকার, বিহাইন্ড দ্য সিন—এইসবের মাধ্যমে দর্শকের আগ্রহ জাগানো শুরু হল ছবি মুক্তির অনেক আগেই। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Dil To Pagal Hai, Kuch Kuch Hota Hai, Hum Dil De Chuke Sanam—এইসব ছবির আগেই দর্শক টিভির মাধ্যমে গান শুনে ফেলছেন, চরিত্রদের চিনে ফেলছেন।

জি এবং সনির প্রভাব কেবল বিনোদনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শিক্ষার ক্ষেত্রেও তারা রেখেছিল কিছু অমূল্য অবদান। শিশুদের উপযোগী অনুষ্ঠান, ভাষা শেখার কোর্স, সামাজিক বার্তাবাহী ধারাবাহিক—এইসবের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছিল একটি ‘লোকশিক্ষা’-ভিত্তিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে। যদিও বিনোদনের তুলনায় এই অংশ ছোট ছিল, তবু তা ছিল ভারতীয় টেলিভিশনের বিবর্তনে একটি ইতিবাচক সোপান।

তবে এই পরিবর্তনের সমালোচনাও শোনা গিয়েছিল। বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে পোশাক, ভাষা ও সম্পর্কের ধরণে পশ্চিমা প্রভাবের অভিযোগ উঠেছিল। অতিরিক্ত নাটকীয়তা, অবাস্তব কনটেন্ট এবং চটকদার গল্প বলার ভঙ্গিকে অনেকেই দৃষ্টিকটূ বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু সব কিছুর পরেও এই রূপান্তর যে ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

জি টিভি ও সনি হয়ে উঠেছিল সেই নব্বই দশকের নতুন ভারতের প্রতিচ্ছবি। এই দুটি চ্যানেল কেবল একটি বিনোদনের পরিকাঠামো নয়, বরং এক সমাজ-সচেতন, প্রভাবশালী সংস্কৃতির বাহক। তাদের পথ ধরেই পরে এসেছে অসংখ্য চ্যানেল—স্টার প্লাস, কালারস, এমটিভি, এনডিটিভি, আঞ্চলিক চ্যানেল, সংবাদমাধ্যম ও বিশেষায়িত বিনোদনের এক সমগ্র জগৎ। কিন্তু পথ দেখিয়েছিল তারা—জি ও সনি।

এই পরিবর্তন নিছকই প্রযুক্তির নয়, ছিল এক সামাজিক রূপান্তরের নিখাদ উপাখ্যান। এক অভ্যুদয়ের কাহিনি, যেখানে একটি টিভি সেট হয়ে উঠেছিল পরিবারের আয়না, সমাজের প্রতিফলন, এবং নতুন ভারতের প্রতিজ্ঞা। জি ও সনি—এই দুটি নাম তাই শুধু গণমাধ্যমের নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।

ভিডিও ক্যাসেট, VCR-এর প্রসার এবং পরিবারের মধ্যে সিনেমা দর্শন

সিনেমা, একটি জাতির সম্মিলিত কল্পনা, অভিলাষ ও হতাশার প্রতিচ্ছবি। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা যা চলচ্চিত্র বলে জানি, তা শুধু শিল্প নয়, একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক জটিল বিন্যাস। আর এই বিন্যাসের পরতে পরতে যে মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ, তা একধরনের ‘সমষ্টিগত প্রতিস্মৃতি’ (collective memory)-র ভিত গড়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে, এই অভিজ্ঞতার চরিত্রে এক মৌলিক পরিবর্তন আসে—যেখানে সিনেমা কেবল বৃহৎ প্রেক্ষাগৃহে দেখা এক আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি পারিবারিক চর্চা, ঘরের চৌকাঠের ভিতর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সহযাত্রী হয়ে ওঠে। এই রূপান্তরের কেন্দ্রে ছিল ভিডিও ক্যাসেট এবং VCR-এর প্রসার, যা ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারে সিনেমার নতুন মনস্তাত্ত্বিক পরিসর তৈরি করেছিল।

ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার বা VCR-এর আগমন ভারতের চলচ্চিত্র-দর্শনের অভ্যাসকে এক সম্পূর্ণ অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। এটি শুধু একটি প্রযুক্তি নয়; এটি ছিল সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। সিনেমা আর নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট মূল্যে উপলব্ধ নয়—এখন সিনেমা হলো ঘরে ফেরার পরে, চা খাওয়ার সময়, সন্তানের সঙ্গে বসে, কিংবা রাত জেগে ব্যক্তিগতভাবে উপভোগ করার অবাধ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তরের, যার ধাক্কা শুধু সিনেমা-ভাষায় নয়, পারিবারিক সম্পর্ক, লিঙ্গ পরিচিতি, সামাজিক সাম্য এবং স্মৃতির গঠনে অনুভূত হয়েছিল।

পূর্ববর্তী যুগে সিনেমা ছিল এক প্রকার যৌথানুভব—‘collective spectatorship’। একসঙ্গে হলে বসে অচেনা মানুষদের সঙ্গে হেসে-কেঁদে সিনেমা দেখা, পর্দার দিকে তাকিয়ে মনস্তত্ত্বের যে প্রতিসরণ ঘটত, তা এক প্রকার ‘জনমনস্কতা’র জন্ম দিত। কিন্তু ভিডিও ক্যাসেটের আগমনে এই অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে গৃহকেন্দ্রিক, ব্যক্তিক, এবং অনেকাংশে আত্মসংলগ্ন। একদিকে এটি যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারকে ‘সিনেমা হলে যাওয়ার বাহুল্য’ থেকে মুক্ত করেছিল, তেমনই অন্যদিকে এই ‘প্রাইভেট স্পেস’-এর মাধ্যমে সিনেমা হয়ে উঠেছিল একান্ত নিজের।

এই ‘নিজের সিনেমা দেখা’ মানসিকতা এক ধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক আয়না’ তৈরি করে। সিনেমা এখন আর জনতার মধ্যে একদলীয় আহ্লাদ নয়, বরং নিজের, প্রিয়জনের, কিংবা কখনও কখনও নিঃসঙ্গ চাহিদার পরিপূরণ। বিশেষ করে যৌনতা, প্রেম, পারিবারিক কলহ কিংবা ব্যক্তিগত সংকট—এইসব বিষয়ভিত্তিক সিনেমা যা পরিবারে একত্রে দেখার উপযুক্ত নয়, সেগুলিও VCR-এর মাধ্যমে এককভাবে দেখা সম্ভব হয়ে উঠল। একদিকে একটি সাংস্কৃতিক খোলামেলা অভ্যাস গড়ে উঠল, অন্যদিকে জন্ম নিল গোপনীয়তার এক নতুন পরিসর।

VCR শুধু সিনেমা দেখার মাধ্যম নয়, এটি ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক মুক্তির যন্ত্র। সমাজ যেখানে ব্যক্তিগত চাহিদা, ইচ্ছা, যৌনতা, প্রেম বা প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, সেখানে VCR তৈরি করল এক আত্ম-অভ্যন্তরীণ চতুর্থ প্রাচীর, যার মধ্যে মানুষ নিজস্ব রুচি ও কামনা-বাসনার পরিপূরণ ঘটাতে পারত। একটি নিষিদ্ধ সিনেমা বা বিদেশি চিত্র, যা হলে মুক্তি পেত না কিংবা প্রকাশ্যে দেখাও যেত না, সেটিও VCR-এ দেখা যেত পরিবার বা সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়ে। এইভাবেই ভিডিও ক্যাসেট হয়ে উঠেছিল একান্ত অভিজ্ঞতার অধিকার।

অন্যদিকে, ভিডিও ক্যাসেট এবং VCR যে প্রক্রিয়ায় পারিবারিক যৌথতা তৈরি করেছিল, তাও অনন্য। সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে ‘সান্ধ্যকালীন পারিবারিক রীতির’ অংশ। বাবা-মা, সন্তান, দাদা-দিদি সবাই মিলে বসে দেখা Hum Aapke Hain Koun..!, Dilwale Dulhania Le Jayenge, Raja Hindustani—এইসব ছবিগুলি শুধুই সিনেমা নয়, একধরনের পারিবারিক আচারের পরিণত রূপ। এই চর্চা পারিবারিক বন্ধনকে কখনও শক্ত করত, আবার কখনও তাতে তৈরি করত অস্পষ্ট মতভেদ, যেহেতু প্রত্যেক সদস্যের সিনেমার বোধ, রুচি এবং অভিজ্ঞতা এক ছিল না।

মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক-স্নায়বিক (neuro-cultural) বিন্যাস, যেখানে দৃশ্য-শ্রাব্য অভিজ্ঞতা রূপ নিচ্ছিল একধরনের সম্মিলিত ‘emotional resonance’-এ। একটি সংলাপ, একটি গান, একটি দৃশ্য—পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে সমসাময়িক আবেগগত প্রতিক্রিয়া তৈরি করত। কিন্তু তার মধ্যেও রয়ে যেত অন্তর্লীন বিচ্ছিন্নতা। কে কোন দৃশ্যে কাঁদল, কে মুগ্ধ হল, কে বিরক্ত হল—এই প্রতিক্রিয়াগুলি প্রায়শই প্রকাশিত হত না, কিন্তু তা তৈরি করত পরিবারের অভ্যন্তরীণ মনোজগতে এক অস্পষ্ট অনুভবের স্তর। এইভাবে, সিনেমা হয়ে উঠেছিল নিছক ‘দেখার বিষয়’ নয়, বরং পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলনের এক মানসিক ‘স্ক্রিন’।

এই প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়েছিল লিঙ্গ সম্পর্কেও। ঘরে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অবস্থান ছিল স্পষ্টভাবে ভিন্ন। পুরুষ সদস্য প্রায়শই সিনেমার নির্বাচনে কর্তৃত্ব বিস্তার করত, যেখানে নারীর পছন্দ অনেক সময়ে ছাপিয়ে যেত পারিবারিক সম্মতির বেষ্টনী। তবে এই সীমারেখা ধীরে ধীরে VCR-এর মাধ্যমে মুছে যেতে থাকে। নারী সদস্যরাও ব্যক্তিগতভাবে সিনেমা দেখার সুযোগ পেতে থাকে, বিশেষ করে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে, যখন অন্যান্য সদস্য কর্মস্থলে বা বাইরে। এর ফলে নারীর মনস্তত্ত্বেও একধরনের নতুন স্বাধীনতা ও পরিচিতি তৈরি হতে থাকে, যেখানে সে সিনেমার মাধ্যমে নিজস্ব অনুভব, প্রেম, ক্ষোভ বা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংলাপ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

অন্যদিকে কিশোর ও তরুণ দর্শকের ক্ষেত্রেও VCR একটি বিপ্লব এনেছিল। তারা আর সিনেমার জন্য বড়দের অনুমতির মুখাপেক্ষী নয়। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সিনেমা দেখা, বিশেষত ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ সিনেমা দেখা, কিংবা কোনো নির্দিষ্ট নায়কের সিনেমা একাধিকবার দেখা—এইসব চর্চা একধরনের ‘self-fashioning’-এর ভূমিকা পালন করত। তারা সিনেমার চরিত্র, ভঙ্গি, ভাষা, এমনকি পোশাক অনুকরণ করে নিজেদের ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করতে শুরু করেছিল। সিনেমা তাদের জন্য শুধু বিনোদন নয়, বরং আত্মপরিচয়ের অংশ।

তবে এই রূপান্তর নিছক ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভিডিও ক্যাসেট ও VCR-এর মাধ্যমে যে সিনেমাগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলি প্রায়শই ছিল হল-ভিত্তিক ব্যবসায়িক বিচারের বাইরে থাকা, এমনকি নিষিদ্ধ অথবা প্রান্তিক সিনেমা। উদাহরণস্বরূপ, আঞ্চলিক সিনেমা, বিদেশি শিল্পচলচ্চিত্র, নব্যধারার ছবি কিংবা রাজনৈতিক সিনেমা—এইসব এখন হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত। এর ফলে সাধারণ দর্শকের অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতে থাকে। তারা জানত যে, সিনেমার আরও জগৎ আছে, যা প্রেক্ষাগৃহের বাইরে, যা মূলধারার বাইরে, যা হয়তো প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে, কিংবা নিছক ভাবনার খোরাক জোগায়। এইভাবে VCR হয়ে উঠেছিল একধরনের বিকল্প জ্ঞানের মাধ্যম, এবং মধ্যবিত্ত ঘরে ‘সাংস্কৃতিক ভিন্নতার’ প্রবেশপথ।

VCR-এর মাধ্যমে সিনেমা দেখার অভ্যাস সিনেমার ভাষাকেও প্রভাবিত করে। নির্মাতারা বুঝতে শুরু করলেন যে, একটি সিনেমা যদি VCR-এ অনেকবার দেখা হয়, তবে তাতে সংলাপ, গান, বা ভিজ্যুয়ালের পুনরাবৃত্তি থাকা জরুরি—যাতে তা মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এর ফলে নব্বইয়ের দশকে বহু সিনেমায় গান বা সংলাপ এমনভাবে নির্মিত হত যাতে দর্শক তা মনে রাখতে পারেন, গুনগুন করতে পারেন, কিংবা ব্যবহার করতে পারেন দৈনন্দিন কথোপকথনে।

এই অভ্যাস তৈরি করেছিল একধরনের ‘স্মৃতির বিন্যাস’—যেখানে সিনেমা ছিল শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয়, বরং জীবনের সঙ্গে গাঁথা এক অভিজ্ঞতা। কোনো চরিত্র, সংলাপ বা গান আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে যেত, শুধু দেখার মাধ্যমে নয়, বারবার দেখার, রিওয়াইন্ড করে ফিরে দেখার, বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করার, কিংবা কোনো বিশেষ অনুভূতির সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে। এই স্মৃতি ব্যক্তি বা পরিবারের জীবনে হয়ে উঠত ‘সাংস্কৃতিক চিহ্ন’, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনা, রুচি, এমনকি সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হত।

যেখানে সিনেমা একসময় ছিল নাগরিক অভিজাত অভিজ্ঞতা, সেখানে VCR-এর মাধ্যমে তা হয়ে উঠেছিল জনতার মাধ্যম। একাধিক ভাষায় ডাব করা ছবি, আঞ্চলিক সংস্কৃতির অনুবাদ, এবং সীমান্ত পেরিয়ে ভিডিও-র মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভাবধারা—সব মিলিয়ে এটি একটি সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এই সংমিশ্রণ শুধু ভাষা নয়, দর্শন, রুচি এবং মানসিকতা নির্মাণে এক নতুন স্তর তৈরি করেছিল। ভিডিও ক্যাসেট ছিল যেন এক ভ্রাম্যমাণ আর্কাইভ—যেখানে সিনেমা ছিল একেকটি ‘চিন্তার কার্তুজ’।

সবশেষে, এই প্রক্রিয়া ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস তৈরি করেছিল—‘সংরক্ষণ’। VCR ও ক্যাসেটের মাধ্যমে মানুষ সিনেমাকে নিজের করে রাখতে শিখেছিল। আগে সিনেমা ছিল ক্ষণস্থায়ী, দেখা এবং ভুলে যাওয়া অভিজ্ঞতা। এখন তা ছিল সংগ্রহযোগ্য, বারবার দেখার যোগ্য, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার উপাদান। এটি একধরনের ‘প্রতিস্মৃতি-সংস্কৃতি’ গড়ে তোলে, যেখানে সিনেমা হয়ে ওঠে পারিবারিক, আত্মিক, এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার।

এই মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণের মধ্য দিয়েই ভিডিও ক্যাসেট এবং VCR নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিসরে এক স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। যদিও আজকের ডিজিটাল যুগে তার অস্তিত্ব নেই, তবু স্মৃতির পর্দায় এই অভিজ্ঞতা এক শিকড় ছড়ানো অনুভব হয়ে রয়ে গেছে—যেখানে সিনেমা ছিল ঘরের মধ্যে বসে, একসঙ্গে অথবা একা, জীবনের এক নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী।

পশ্চিমি প্রভাব, গ্লোবালাইজেশন ও মিডিয়া কালচারের উত্থান

একটি সমাজ তার গভীরতম রূপান্তর অনুভব করে তখন, যখন পরিবর্তনগুলি আর কেবল বাহ্যিক থাকে না, বরং চেতনার কাঠামোতেও তা প্রতিফলিত হতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় সমাজ তেমনই এক সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, যখন পশ্চিমি প্রভাব, বিশ্বায়ন এবং মিডিয়া কালচারের অভ্যুত্থান মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। এই পরিবর্তন শুধু নতুন পণ্যের, প্রযুক্তির বা পোশাকের নয়, বরং ছিল নতুন মানসিক কাঠামোর—যেখানে “আমি কে?”, “আমরা কী চাই?”, “আমাদের স্বপ্ন কেমন?”—এইসব মৌলিক প্রশ্ন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে।

বিশ্বায়ন—একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ সীমান্ত ভেঙে দেওয়া, সংস্কৃতি, পণ্য, মানুষ ও ধারণার মুক্ত প্রবাহ। ১৯৯১-এর অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর এই বিশ্বায়ন ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে, কিন্তু তার গভীরতর প্রভাব পড়ে আমাদের মনস্তত্ত্বে। হঠাৎ করেই ভারতীয় শহরের মানুষ বুঝতে থাকে, তার রুচি, ভাষা, সৌন্দর্যবোধ, এমনকি আকাঙ্ক্ষাও কোনও নির্দিষ্ট জাতিগত কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ নয়। বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং পরে ইন্টারনেট—এইসব মাধ্যমের মাধ্যমে আমাদের চেতনায় ঢুকে পড়ে এক “গ্লোবাল সেল্ফ”—যে সত্তা একাধারে ভারতীয়, আবার আন্তর্জাতিকও।

এই গ্লোবাল সেল্ফ-এর অভ্যুত্থান এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সূচনা করে। কারণ পশ্চিমি প্রভাব আমাদের একদিকে মুক্তির সম্ভাবনা দেয়—নারীর স্বাধীনতা, যৌনতার স্বীকৃতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ভোগের অধিকার—আবার অন্যদিকে আমাদের চিরাচরিত মূল্যবোধের সঙ্গে একটি মৌলিক সংঘর্ষ তৈরি করে। এই সংঘর্ষ হয় নিঃশব্দ, কিন্তু প্রবল। উদাহরণস্বরূপ, একজন ভারতীয় তরুণ যখন MTV-তে পশ্চিমি মিউজিক ভিডিও দেখে, তখন সে শুধু গান শুনছে না, সে এক নতুন জীবনদর্শনের মুখোমুখি হচ্ছে—যেখানে শরীর, যৌনতা, প্রেম, বিদ্রোহ এবং ভোগের প্রকাশ এক অনাবৃত রূপে উপস্থিত। এই অভিজ্ঞতা তার নিজের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে একধরনের ভেতরগত সংঘাত তৈরি করে।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতের ব্যাখ্যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কারণ পশ্চিমি মিডিয়া যা আমাদের সামনে তুলে ধরছে, তা কেবল বাহ্যিক অনুকরণ নয়, বরং আত্মপরিচয়ের গভীরে ঢুকে পড়ছে। এই প্রক্রিয়া ফ্রয়েডীয় অর্থে একধরনের ‘identification’—ব্যক্তি তার অবচেতনে সেই ইমেজের সঙ্গে একাত্ম হতে শুরু করে, যা সে পর্দায় দেখে। এইভাবে গ্ল্যামারাস জীবন, ফ্যাশন, খোলামেলা সম্পর্ক, আত্মপ্রকাশ—সব কিছুই একধরনের “আদর্শ আমি” (ideal ego)-তে পরিণত হয়, যাকে পাওয়ার জন্য ব্যক্তি সচেতন এবং অবচেতনে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু বাস্তব সমাজ তার পথে প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি, এবং কখনও হতাশা।

এই দ্বন্দ্ব ভারতীয় পরিবার ব্যবস্থাতেও প্রতিফলিত হয়। একদিকে মিডিয়া দেখাচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতার গল্প—নারী নিজের শরীর, ভালোবাসা, পেশা, এমনকি যৌনতার অধিকার রাখে; তরুণ-তরুণী নিজেদের মতো করে জীবন বেছে নিতে পারে; প্রেম ও সম্পর্ক পরিণয়ের চেয়ে অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভারতীয় পরিবারের মূল্যবোধ চায় নিয়ন্ত্রণ, লজ্জা, কর্তৃত্ব এবং পরম্পরা। ফলে একাধিক প্রজন্মের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়। পিতামাতা বুঝতে পারেন না সন্তানের ‘আধুনিকতা’, সন্তান মেনে নিতে পারে না পরিবারের ‘সংস্কার’। এই দ্বন্দ্ব শুধু কথোপকথনে নয়, মানসিক স্থিতির ভিতরেও ছায়া ফেলে।

এইভাবে পশ্চিমি প্রভাব শুধু পণ্যের ভাষায় নয়, প্রভাব বিস্তার করে ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুভবের ভেতরে। হিন্দি সিনেমা, টিভি সিরিয়াল এবং বিজ্ঞাপনে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে এমন এক ‘হাইব্রিড ভাষা’—যেখানে হিন্দি, ইংরেজি এবং উর্দু মিশে এক নতুন বোধ তৈরি করে। সংলাপে ‘কুল’, ‘ক্রাশ’, ‘হট’, ‘স্মার্ট’, ‘ফিগার’, ‘রিলেশনশিপ’, ‘ফার্স্ট টাইম’ ইত্যাদি শব্দ ঢুকে পড়ে, যা শুধু ভাষা বদলায় না, বদলায় অভিব্যক্তির মানচিত্রও। এই পরিবর্তন একদিকে আধুনিকতা এনেছে, অন্যদিকে তৈরি করেছে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা—বিশেষত যারা এই ভাষা বা অভিজ্ঞতার বাইরে, তারা বঞ্চিত বোধ করে, প্রান্তিক হয়ে ওঠে।

পশ্চিমি মিডিয়া সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর ভোক্তা-নির্ভরতা। পশ্চিমি বাজারব্যবস্থা আমাদের শেখায় ‘তুমি যা, তা নয়—তুমি যা কেনো, পরো, ব্যবহার করো, সেটাই তুমি’। ফলে আত্মপরিচয় ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ব্র্যান্ড, পণ্য ও বাহ্যিক সাজের ওপর। এই মনস্তত্ত্ব ‘পসেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিজম’ গড়ে তোলে, যেখানে ব্যক্তি তার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে যে কতটা আকর্ষণীয়, গ্ল্যামারাস এবং প্রাপ্তবয়স্ক সে হতে পেরেছে। এই অভ্যাস কিশোর ও তরুণ সমাজে প্রবলভাবে দেখা যায়। বিজ্ঞাপন, মিউজিক ভিডিও ও সিনেমা তরুণদের বোঝায়—তুমি যদি আকর্ষণীয় পোশাক না পরো, তাহলে তুমি ‘আউটডেটেড’। যদি নতুন ফোন না থাকে, তুমি পিছিয়ে। এই চাপ একধরনের মনস্তাত্ত্বিক ‘উৎকণ্ঠা সংস্কৃতি’ তৈরি করে, যা আত্মসমালোচনা, আত্মসন্দেহ এবং সামাজিক তুলনার জ্বালায় পুড়তে থাকে।

পাশাপাশি এই গ্লোবাল মিডিয়া আমাদের দেখায় ‘উন্নত জীবন’-এর কল্পনা। বিদেশের শহর, পরিষ্কার রাস্তা, স্বাধীন প্রেম, প্রাইভেসি, বিলাসিতা—সব মিলিয়ে একধরনের ‘স্বপ্ন-জগৎ’ তৈরির চেষ্টা চলে। এই স্বপ্ন আসলে এক প্রকার রূপকথা, যার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক রয়ে যায় বিস্তর। কিন্তু দর্শক বা ভোক্তা এই ফারাক মানতে চায় না। সে ধীরে ধীরে আত্মতুষ্টি ত্যাগ করে, অস্থিরতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবে পশ্চিমি প্রভাব তার চেহারার বাইরে গিয়ে চেতনায় ঢুকে পড়ে—স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যেকার মানসিক দূরত্ব তৈরি করে অসন্তোষ ও বিষণ্ণতা।

তবে এই বিশ্লেষণ যদি একপাক্ষিক হয়, তাহলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ পশ্চিমি প্রভাব কেবল ভোগবাদ নয়, তা ছিল মুক্তির এক সম্ভাবনাও। এই সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়েছে নারীর নিজস্ব চেতনার গুরুত্ব, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা, যৌন পরিচয়ের স্বীকৃতি, শারীরিক সক্ষমতা ও প্রতিবন্ধকতার প্রতি সহানুভূতি, এবং মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা অলাভজনক মানুষের কথাও শোনার প্রয়োজনীয়তা। ভারতীয় মূলধারার সংস্কৃতিতে যেসব বিষয় উপেক্ষিত, পশ্চিমি মিডিয়া সেগুলিকে উন্মোচিত করেছে।

বিশ্বায়নের মাধ্যমে অজস্র ভারতীয় চিন্তক, লেখক, শিল্পী আন্তর্জাতিক মহলে জায়গা পেয়েছেন। ভারতে বসে একজন পাঠক আজ পাশ্চাত্যের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত, চিত্রকলা সম্পর্কে জানতে পারেন, এবং নিজের অভিজ্ঞতাও সেই আলোয় প্রসারিত করতে পারেন। এই সংস্কার একরকম অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে—‘আমি’ শুধু একটি জাতি, ধর্ম বা ভাষার প্রতিনিধি নই, আমি এক বৈশ্বিক চেতনার অংশ।

এই প্রসঙ্গে যদি মনস্তত্ত্বের আরেক স্তরে যাই, দেখা যাবে বিশ্বায়ন আমাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে একধরনের ‘স্প্লিট সেল্ফ’-এর—যেখানে একদিকে আমরা গর্ব করি ভারতীয়ত্বে, আবার অন্যদিকে লুকিয়ে প্রশংসা করি পশ্চিমি আধুনিকতায়। আমরা হয়তো পুজোর ভোগ খাই, কিন্তু রেস্তোরাঁয় গিয়ে পাস্তা অর্ডার করি; আমরা হয়তো রবীন্দ্রসংগীত গাই, আবার ইংরেজি ব্যান্ডের পোস্টার ঝুলিয়ে রাখি ঘরের দেয়ালে; আমরা হয়তো পরম্পরার কথা বলি, কিন্তু স্বাধীন যৌনতার প্রসঙ্গে মাথা ঘামাই না। এই দ্বৈততা এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক ‘ডিসোন্যান্স’ তৈরি করে—যা কখনও আত্মপরিচয়ের সংকট ডেকে আনে, আবার কখনও আত্মনির্মাণের সুযোগ দেয়।

এই স্প্লিট সেল্ফ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমরা ক্রমাগত চেষ্টা করি নিজেকে ‘গ্লোবালি প্রেজেন্টেবল’ করে তোলার। সামাজিক মাধ্যমে নিজস্ব ইমেজ নির্মাণ, লাইফস্টাইলের অভিজাততা তুলে ধরা, বিদেশ ভ্রমণের ছবি পোস্ট করা, কিংবা ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্য দেখানো—এইসবই আমাদের সেই ‘উত্তম সংস্করণ’ প্রকাশের চর্চা, যাকে আমরা বিশ্বাস করি পশ্চিমের চোখে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এর ফলে আমরা নিজের অচেতনেই এক ‘অনুকরণশীল আধুনিকতা’ গড়ে তুলি, যেখানে নিজের স্বতন্ত্রতা চাপা পড়ে যায়।

তবে এই মনস্তাত্ত্বিক দোলাচলের মধ্যেই জন্ম নেয় একটি নতুন ‘হাইব্রিড চেতনা’—যেটি কেবল অনুকরণ নয়, বরং গ্রহণ ও প্রতিরূপ সৃষ্টির এক দ্বন্দ্বময় প্রক্রিয়া। এই চেতনা যেমন বলিউডকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক রূপ (উদাহরণস্বরূপ Dil Se, Swades, My Name is Khan), তেমনই আঞ্চলিক চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও শিল্পকে দিয়েছে একটি নতুন পাঠকের অভিজ্ঞতা। আজকের তরুণ প্রজন্ম আর ‘পশ্চিম’ ও ‘পূর্ব’ বলে ভাবে না; তারা ভাবে—‘আমি কোন গল্পে বিশ্বাস করি?’ এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বিশ্বায়নের মাধ্যমে গঠিত।

এইভাবে, পশ্চিমি প্রভাব ও গ্লোবাল মিডিয়া কালচারের উত্থান ভারতীয় সমাজকে দিয়েছে এক অনন্য সুযোগ এবং এক জটিল চ্যালেঞ্জ। সুযোগ এই অর্থে যে, আমরা জানার, ভাবার, প্রকাশের এক নতুন ভাষা পেয়েছি। চ্যালেঞ্জ এই অর্থে যে, এই নতুন ভাষা যদি আমাদের মূলে আঘাত করে, তবে আমরা নিজেরাই নিজেদের চেনা ছায়া হয়ে উঠি।

এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই শেষপর্যন্ত গড়ে তুলেছে ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিক অবয়ব—যেখানে পশ্চিমের আয়না আর নিজের মুখের সংমিশ্রণে আমরা তৈরি করছি এক নতুন ‘আমি’—না একান্ত দেশি, না একেবারে বিদেশি; বরং একান্ত সেই, যে তার দোলাচলেই খুঁজে পায় নিজস্বতা, গভীরতা, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

হিন্দি সিনেমার একটি ‘ট্রানজিশনাল যুগ’ হিসেবে নব্বই দশকের গুরুত্ব

সিনেমা একটি সময়ের দর্পণ, আবার সেই সময়কে নির্মাণকারী একটি অদৃশ্য হাতও বটে। ভারতীয় উপমহাদেশে সিনেমা কেবলমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং জাতির আত্মপরিচয়ের ইতিহাসও। আর এই ইতিহাসে নব্বইয়ের দশক এক নির্দিষ্ট সংকেতবাহী সময়—যেখানে হিন্দি সিনেমা কেবল বিষয়গত বা কারিগরি পরিবর্তনই নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরেও প্রবল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। এই দশক একটি ট্রানজিশনাল যুগ, যা সিনেমার পর্দায় যেমন প্রতিফলিত, তেমনি দর্শকের মানসিকতা ও সাংস্কৃতিক অনুবর্তিতার দিক থেকেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।

নব্বইয়ের দশক ভারতীয় ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক সময়। একদিকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, অন্যদিকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমন; একদিকে সামাজিক চেতনার উন্মেষ, অন্যদিকে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার পরিসর বৃদ্ধি। এই সকল পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিন্দি সিনেমা দাঁড়িয়েছিল এক সন্ধিক্ষণে—পুরাতনের উত্তরাধিকার বহন করার দায় এবং নতুনের টানে ভেসে যাওয়ার লোভ—এই দুইয়ের টানাপোড়েন। এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই নব্বইয়ের দশকের সিনেমার কেন্দ্রে ছিল, যা একাধারে বাস্তবতার প্রতিবিম্ব এবং ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষার রূপরেখা।

এর পূর্ববর্তী দশক অর্থাৎ আশির দশকের হিন্দি সিনেমা ছিল অনেকাংশেই ম্লান, পুনরাবৃত্ত, ক্লান্ত এবং মূলধারার দর্শকের মনোভাবের সঙ্গে অসঙ্গত। রাজনীতির প্রতিফলন, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব কিংবা অমিতাভ বচ্চন-নির্ভর ‘angry young man’ ঘরানা ধীরে ধীরে জনমানসে ক্লান্তি এনে দিয়েছিল। আশির দশকের শেষে দর্শক নতুন কিছু চাইছিল—বিনোদনের, প্রেমের, আনন্দের, পরিবারের, ব্যক্তিগত জীবনের এক নির্ভার প্রকাশ, যা তাকে বাস্তব থেকে সাময়িক মুক্তি দেবে। নব্বইয়ের দশক সেই দাবির প্রতিক্রিয়া এবং তার বাস্তবায়নের পথপ্রদর্শক।

Amitabh Bacchan
Image: AI Generated

এই সময়েই হিন্দি সিনেমায় এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাস শুরু হয়। প্রথমত, নায়কের চরিত্র বদলাতে থাকে। যে নায়ক আশির দশকে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে লড়ত, নব্বইয়ের দশকে সেই নায়ক হয়ে ওঠে প্রেমিক, পরিবারের আদর্শ সন্তান, বা একজন আবেগপ্রবণ, স্বপ্নবিলাসী যুবক। Dilwale Dulhania Le Jayenge-এর রাজ কিংবা Hum Aapke Hain Koun..!-এর প্রেম—এরা কারও বিরুদ্ধে নয়, বরং ভালোবাসা, সম্পর্ক ও সংস্কারকে আলিঙ্গন করে। এই পরিবর্তন ছিল শুধুমাত্র চিত্রনাট্যের নয়, বরং দর্শকের অভ্যন্তরীণ কামনা, সংবেদন ও নিরাপত্তাবোধের বহিঃপ্রকাশ।

মনোবিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিবর্তন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে ক্লান্ত ভারতীয় দর্শক এই সময় এক ’emotionally safe space’ খুঁজছিল—যেখানে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যাবে এমন ছবি, যেখানে প্রেম থাকবে, কিন্তু বিদ্রোহ নয়; সংস্কৃতি থাকবে, কিন্তু সংঘর্ষ নয়; আধুনিকতা থাকবে, কিন্তু মূল্যবোধের অন্তর্ঘাত নয়। নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা সেই নিরাপদ পরিসর নির্মাণ করেছিল, যাকে ‘সিনেমার মধ্যস্থত মানসিক অঞ্চল’ বলা যেতে পারে।

এই দশকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পরিবারের পরিসরে সিনেমার প্রবেশ। ভিডিও ক্যাসেট ও VCR-এর প্রসারে সিনেমা ঘরের অভ্যন্তরে চলে আসে। সিনেমা আর শুধুই প্রেক্ষাগৃহে দেখা কোনও দূরবর্তী অভিজ্ঞতা নয়, বরং পরিণত হয় পারিবারিক অনুষঙ্গে। এই পারিপার্শ্বিকতা সিনেমার ভাষাকে করে তোলে আরও কোমল, আরও অভ্যন্তরীণ। দৃষ্টিকোণ, সংলাপ, দৃশ্য, এমনকি পোশাক—all become designed to suit the home audience. সিনেমা যেন একটি “পারিবারিক আচারের” অঙ্গ হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মনস্তত্ত্বে ‘দৈনন্দিনতার অভ্যন্তরীণ নাটক’ (the drama of the everyday) একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম, এবং নব্বইয়ের হিন্দি সিনেমা সেই নাট্যপরিসর তৈরি করে দিয়েছিল।

তবে এই পরিবর্তন একরৈখিক ছিল না। প্রেমের ঘরানার পাশাপাশি এই দশকে সমাজের কিছু গোপন স্তরও সিনেমায় উঠে আসতে থাকে। Baazigar, Gupt, Darr, Zakhm বা Satya-র মতো ছবিগুলি মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত, অপরাধ, হিংসা, বিভাজন ও পরিচয়ের সংকট নিয়ে কাজ করেছে। এই ছবিগুলির মধ্যে দিয়ে এক গভীর উদ্বেগ—subliminal anxiety—প্রকাশ পেতে থাকে। এই উদ্বেগ ভারতের আর্থসামাজিক রূপান্তর, নগরায়ন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বা প্রান্তিককরণের প্রতিফলন। নব্বইয়ের দশকের ভারত যতটা উদারীকরণের জয়গান গেয়েছে, ততটাই তার অন্তরে জমে উঠেছে পরিচয়ের সংকট। হিন্দি সিনেমা সেই দ্বৈত চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

এই যুগের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক দিক ছিল স্বপ্নদর্শনের প্যাটার্ন। নব্বইয়ের দশকে যে সিনেমা দর্শক তৈরি হয়েছিল, তারা ছিল “new middle class”—যাদের আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। এই দর্শক নিজেকে পর্দার চরিত্রে দেখতে চায়নি, বরং চেয়েছিল এমন একজনকে, যে তার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে। শাহরুখ, সালমান, আমির—এই তিন খানের মধ্য দিয়ে এক নতুন স্বপ্নপ্রতিমা তৈরি হয়, যারা একাধারে রোম্যান্টিক, পারিবারিক, বুদ্ধিমান, অথচ পৌঁছনো দুষ্কর। দর্শকের মনে এই তারকাদের প্রতি জন্ম নেয় ‘narcissistic identification’—একধরনের আত্মপ্রতিচ্ছায়া, যা পর্দার আকর্ষণকে গভীরতর করে তোলে।

নব্বইয়ের দশক শুধু গল্প বা চরিত্রের রূপান্তর আনেনি, আনছে ‘দর্শনের চেতনাও’। আগে সিনেমা ছিল সমাজের দর্পণ, এখন তা হয়ে উঠছে স্বপ্নের মানচিত্র। দর্শক বাস্তব থেকে পালাতে চায়, সিনেমা সেই সুযোগ দেয়। এই পালিয়ে যাওয়া আবার একধরনের ‘healing mechanism’। বাস্তবের হতাশা, চাপ, দারিদ্র, সহিংসতা—এইসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সিনেমা হয়ে ওঠে এক মনস্তাত্ত্বিক “স্বপ্নকানান”, যার মধ্যে মানুষ তার অতৃপ্তিকে রূপ দিতে পারে।

এই মনস্তাত্ত্বিক ফ্রেমে সিনেমার গান, পোশাক, লোকেশন, নাচ—সবকিছুই হয়ে ওঠে আত্ম-উন্মোচনের অনুষঙ্গ। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়, ডিজাইনার সালোয়ার কামিজ, হেলিকপ্টার থেকে নামা নায়ক, কিংবা কলেজ ক্যাম্পাসের রোমান্টিক ছায়া—সবই সেই স্বপ্নের দুনিয়ার অনুষঙ্গ, যেখানে বাস্তব নেই, কিন্তু কামনা আছে। এই কামনা (desire) আবার নিছক যৌনতা নয়, এটি একধরনের ‘existential longing’—একটি ভালোবাসা, স্বীকৃতি, সৌন্দর্য এবং অভিজাততার মধ্য দিয়ে নিজেকে জেনেবুঝে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।

তবে এই দশকে নারী চরিত্রের ভূমিকা নিয়েও গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সম্ভব। একদিকে সিনেমা নারীকে প্রেমিকা, বোন, কন্যা অথবা স্ত্রী হিসেবে এক আদর্শের প্রতিমূর্তি হিসেবে তুলে ধরেছে, আবার অন্যদিকে তাঁকে স্বাধীন, সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী চরিত্রেও দেখিয়েছে। যেমন Rangeela-এর ঊর্মিলা, Dushman-এর কাজল, Zakhm-এর পূজা ভাট—এইসব চরিত্র নারীর অভ্যন্তরীণ সংকট, দ্বন্দ্ব এবং আত্মনির্ভরতার গল্প বলে। তবে এদের স্বীকৃতি সীমিত, এবং অধিকাংশ সিনেমাই পুরুষচিন্তনের বৃত্তেই নারীকে আবদ্ধ রেখেছে। এই দ্বৈততা ভারতের তৎকালীন নারীচেতনার প্রতিফলন, যেখানে নারীর অগ্রগতি ছিল, কিন্তু তার পরিসর নিয়ন্ত্রিত।

এই দশকে মিডিয়ার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। স্যাটেলাইট টিভির আগমন, চ্যানেল কালচারের বিস্তার, এবং টেলিভিশনে সিনেমা প্রচারের অভ্যাস দর্শকের অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তিক এবং পরিপার্শ্বিকভাবে রূপান্তরিত করে। সিনেমা হয়ে ওঠে ‘অভ্যাসের অভ্যন্তরে’ এক অনিবার্য সঙ্গী—যাকে ঘরে বসে, বারবার দেখা যায়, এবং যার সঙ্গে দর্শকের সম্পর্ক হয়ে ওঠে দীর্ঘমেয়াদি। এই অভ্যাস দর্শকের মানসিক গঠনেও প্রভাব ফেলে। দর্শক এখন সিনেমাকে কেবল ‘দেখে না’, বরং ‘জমায়’, ‘শেয়ার করে’, ‘মনে রাখে’ এবং ‘আত্মীকরণ’ করে। এই মনস্তাত্ত্বিক ঘনিষ্ঠতা আগে খুব কম দেখা গিয়েছিল।

সবশেষে বলা যায়, নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা একটি ট্রানজিশনাল যুগ ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটি শুধু সময় বা প্রযুক্তির নিরিখে নয়—মনস্তত্ত্ব, সংস্কৃতি ও সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তরেও এক গভীর সন্ধিক্ষণ। এই যুগে সিনেমা ছিল জীবনের প্রতিস্ব, আবার স্বপ্নের বিকল্প ভাষাও। দর্শক আর সিনেমার সম্পর্ক শুধুই আর্থ-সামাজিক নয়, হয়ে উঠেছিল গভীরভাবে মানসিক। এই যুগ আমাদের শিখিয়েছে, সিনেমা কেবল শিল্প নয়, এটি অভিজ্ঞতার জৈব পরিক্রমা, যা সমাজকে যেমন রূপ দেয়, তেমনই সমাজের রূপান্তরও ধারণ করে।

স্টারডমের রূপান্তর

অমিতাভ বচ্চনের রাজনৈতিক জীবন ও বিরতির পর প্রভাব হ্রাস

একজন শিল্পী কখনও নিছক শিল্পী থাকেন না; তিনি হয়ে ওঠেন তার সময়ের একটি প্রতীক, একটি মানসিক কাঠামোর আধার, এবং কখনও কখনও একটি জাতির সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। অমিতাভ বচ্চন নামটি শুধু হিন্দি সিনেমার একচ্ছত্র নায়কতন্ত্রের চিহ্ন নয়, বরং ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির দীর্ঘকালিক স্বপ্ন, হতাশা এবং প্রতিশোধস্পৃহার একটি মনস্তাত্ত্বিক উপকথা। কিন্তু এই স্বপ্নের গাথা যেখানে গগনে উঠেছিল, ঠিক সেখান থেকেই যখন তার রাজনৈতিক প্রবেশ ঘটল, তখন সেই গাঁথার ছন্দে এক অজানা ভাঙন অনুভূত হতে লাগল। তারপরে আসে বিরতি—এক দীর্ঘ মৌনতা, এক অন্তর্লীন সংকট—যা অমিতাভ মিথের উপরে ছায়া ফেলতে শুরু করে। এবং এইভাবেই ধীরে ধীরে একসময়কার ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ হয়ে ওঠেন দূরের, ভাবগম্ভীর, এবং কখনও কখনও বিভ্রান্তিকর এক প্রতিমূর্তি।

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস দল একধরনের ‘মরাল রিক্লেমেশন’-এর প্রয়াসে তারকা প্রভাবকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন, ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজীব গান্ধীর আহ্বানে, রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং এলাহাবাদ লোকসভা আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়ী হন। এই প্রবেশ ছিল বহুস্তরীয় অর্থবোধক। একদিকে এক নায়কের বাস্তব জীবনে নায়কোচিত অভিযাত্রা—নাগরিকের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা; অন্যদিকে, এক চলচ্চিত্রিক পরিসর থেকে বাস্তব ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশ। এই ঘটনা সেই সময়কার ভারতীয় নাগরিকদের মনে এক ধরনের বিভ্রম এবং উত্তেজনা জাগিয়েছিল। অমিতাভ শুধু সিনেমায় শোষকের বিরুদ্ধে লড়েননি, তিনি এখন সেই শোষণের কাঠামো বদলাতে বাস্তবে নেমেছেন—এই ভাবনাটি এক প্রকার গণমানসিক উন্মাদনার জন্ম দেয়।

কিন্তু সমস্যা শুরু হয় এখান থেকেই। কারণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে দর্শক বা সাধারণ মানুষ যে ‘নায়ক’-কে পূজা করে, সে নায়ক যতদিন না বাস্তবের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ঘটাচ্ছে, ততদিন তার মাহাত্ম্য অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু যখন সেই প্রতিমা বাস্তবতায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার ত্রুটি, দ্বিধা, দায়িত্ব এবং ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। অমিতাভের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তিনি রাজনীতির গাম্ভীর্য, কূটনীতি, দলগত জটিলতা এবং জনসেবার প্রশাসনিক বাস্তবতায় কখনই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। মাত্র তিন বছরেই তিনি রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেন এবং একে বলেন ‘a cesspool of politics’।

এই পদত্যাগ ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং এক অন্তর্লীন মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। কারণ, অমিতাভ রাজনীতিকে যে মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল নায়কের দৃষ্টিভঙ্গিতে—সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা, নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি ছিল আপসের, সংযমের, এবং জটিল পারস্পরিক সুবিধা-অসুবিধার খেলা। এই বাস্তবতায় অমিতাভ একাকী, বিচ্ছিন্ন এবং অপ্রস্তুত ছিলেন। তার রাজনৈতিক যাত্রা যেন এক ভুল দৃশ্যপটের মধ্যস্থ নায়কসুলভ প্রবেশ।

এই অভিজ্ঞতা অমিতাভ বচ্চনের মানসিকতাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তার আত্মবিশ্বাস, জনমানসের সঙ্গে সংযোগ, এমনকি সিনেমায় ফিরে আসার প্রস্তুতি—সব কিছুতেই এক প্রকার দ্বিধা ও সংকোচ তৈরি হয়েছিল। এই সংকোচের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় আশির দশকের শেষভাগ এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলিতে। যে প্রবল তেজ, সেই বিস্ফোরক ক্যারিশমা, যে বজ্রকণ্ঠ, যে চোখের ভাষায় দর্শক দম বন্ধ করে বসে থাকত—তা ক্রমশ নিস্তেজ, ক্লান্ত এবং পুনরাবৃত্ত হয়ে উঠছিল।

মনোবিশ্লেষণের পরিভাষায় এই অবস্থাকে ধরা যেতে পারে ‘ego collapse’ হিসেবে। এক ব্যক্তি যিনি তার পরিচয় গড়ে তুলেছেন এক নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে—জনসমর্থন, নায়কের ভূমিকা, গর্বিত উচ্চারণ, সমাজ-প্রতিরোধ—তিনি হঠাৎ করে নিজের সত্তার ভিত কেঁপে যেতে দেখলেন। এই অনুভূতি আত্মপরিচয়ের গভীরে একধরনের ফাটল সৃষ্টি করে। ফলে তার পরবর্তী কাজগুলি হয়ে পড়ে আত্মসন্দেহে ভরা, আবেগহীন, এবং অতীতের ছায়া হয়ে থাকা এক পুনরাবৃত্ত প্রচেষ্টা।

নব্বইয়ের দশকে অমিতাভ বচ্চনের এই সঙ্কট সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। এই সময়ের একাধিক চলচ্চিত্র—Mrityudaata, Lal Baadshah, Kohram—প্রত্যেকটিতেই তিনি চেষ্টা করেন সেই পুরোনো ব্যঞ্জনায় ফিরে যেতে, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হন। কারণ, দর্শকের মনস্তত্ত্বও বদলাচ্ছিল। শাহরুখ, আমির, সালমান—এই নতুন তিন খানের আবির্ভাব, প্রেম ও ব্যক্তিত্ব-নির্ভর স্টারডম, এক নতুন মধ্যবিত্ত স্বপ্ন তৈরি করছিল, যেখানে আগের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ স্টাইল আর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল না।

অমিতাভ এখানে হয়ে পড়েন এক যুগের প্রতিনিধি, যা অতিক্রান্ত। তার পরবর্তী কেরিয়ার যেন সেই অতীতকে ধরার এক ব্যর্থ প্রয়াস। তিনি বড় বাজেটের ছবিতে কাজ করেন, বড় ব্যানারের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, কিন্তু দর্শকের সঙ্গে সেই মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ আর তৈরি হয় না। এই বিচ্ছিন্নতা শুধুই ব্যবসায়িক নয়, এটি ছিল অস্তিত্বগত (existential)। তিনি যেন এক পুরনো মানচিত্রের মানুষ, যিনি নতুন বাস্তবতায় এসে নিজের অবস্থান খুঁজে পাচ্ছেন না।

এই সংকট আরও গভীর হয় যখন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি, ABCL (Amitabh Bachchan Corporation Limited), ১৯৯৬ সালে এক ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি সিনেমা প্রযোজনার পাশাপাশি অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও বিনোদন জগতে এক বৈপ্লবিক মডেল গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু বাজে পরিকল্পনা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে সংস্থাটি প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই ঘটনার ফলে অমিতাভের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থান চূড়ান্তভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই ব্যর্থতা ছিল এক চূড়ান্ত ‘narcissistic wound’। কারণ অমিতাভ বচ্চন নামটাই ছিল এক পরিপূর্ণতার প্রতীক। তার কণ্ঠ, গর্ব, দৃঢ়তা, পরিণত ব্যক্তিত্ব—সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক ‘অনুচারিত পর্বতশৃঙ্গ’। কিন্তু সেই ব্যক্তিত্ব যখন আর্থিক দেউলিয়াপনার মুখে পড়ে, তখন তা শুধু বাহ্যিক পতন নয়, বরং তার ভিতরের একটি প্রতিরক্ষা কাঠামোরও বিপর্যয়। এই সময়ে তাকে প্রায় ছায়া হয়ে বেঁচে থাকতে দেখা যায়—সাধারণ বিজ্ঞাপন, অপরিচিত ব্র্যান্ড, ছোটখাটো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে একধরনের লজ্জাজনক উপস্থিতি, যা তার আগেকার অহংকারের সঙ্গে অসঙ্গত।

তবে এখানেই অমিতাভ বচ্চনের জীবনের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক স্তর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তা হলো পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা শুধুই পেশাদার না, এটি ছিল ‘self reconstitution’-এর প্রয়াস—নিজেকে নতুন করে তৈরি করা, নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা। এই পুনর্রচনার সূচনা হয় Kaun Banega Crorepati অনুষ্ঠান দিয়ে। ২০০০ সালে স্টার প্লাসে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠান অমিতাভ বচ্চনকে প্রথমবার টেলিভিশনের পর্দায় নিয়ে আসে। একসময় সিনেমা যাঁর রাজ্য ছিল, তিনি এবার ছোট পর্দায়, মধ্যবিত্ত ঘরের সন্ধ্যাবেলার অতিথি হয়ে ওঠেন।

KBC শুধুই একটি কুইজ শো ছিল না, এটি ছিল অমিতাভের আত্মপ্রত্যাবর্তনের মহাকাব্য। এই শোতে তার কণ্ঠ, তার ধীরগতি, তার সংযম, তার পরিণত হিউমার—সবকিছু এক ভিন্নতর ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করে। তিনি আর আগেকার হিংস্র নায়ক নন; তিনি পরিণত, অনুপ্রেরণাদায়ী, স্নেহশীল এক গুরুসুলভ ব্যক্তিত্ব। এই রূপান্তর ছিল জনমানসে এক প্রকার শান্তি, এবং অমিতাভের নিজস্ব আত্মদ্বন্দ্বে এক প্রকার পুনর্মিলন।

 

KBC
চিত্রঃ কেবিসি শোতে অমিতাভ বচ্চন, Image Source: Google

এই মনস্তাত্ত্বিক ‘integration’ বা আত্মসমন্বয়ের মধ্য দিয়েই অমিতাভ আবার সিনেমায় ফিরে আসেন—এক নতুন পরিচয়ে। Mohabbatein-এ তিনি গুরু, Black-এ তিনি শিক্ষক, Paa-তে তিনি অসুস্থ সন্তান, Piku-তে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত অথচ জেদি পিতা। এইসব চরিত্র অমিতাভের মিথকে পুনর্গঠন করে—তিনি আর যুবকের প্রতীক নন, তিনি পরিণতির, গভীরতার, অভিজ্ঞতার এক নতুন মূর্তি।

এইভাবে আমরা দেখতে পাই, অমিতাভ বচ্চনের রাজনৈতিক যাত্রা, তার ফলশ্রুতির অবসাদ, এবং তার পুণরাবির্ভাব একটি দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রা। এই যাত্রা শুধুই তার ক্যারিয়ারের রূপরেখা নয়, বরং এক প্রতীকী সত্তার আত্মপরিচয়ের সংকট এবং পুনর্গঠনের আখ্যান। তার প্রভাব হ্রাস তাই নিছক স্টারডমের হ্রাস নয়; এটি ছিল এক যুগের অনুভবের বদল, দর্শকের মনস্তত্ত্বের বিবর্তন, এবং একজন কিংবদন্তির অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের দৃশ্যমান রূপ।

একজন শিল্পীর মাপকাঠি কেবল তার উত্থান নয়, বরং তার পতনের প্রতি তার মনোভাব, এবং পতনের পর তার ফিরে আসার ধরণ। অমিতাভ সেই মানে, যিনি পতনের গভীর থেকে উঠে এসে নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করেছেন—এক ভিন্নতর, অধিক পরিপক্ব এবং বহুমাত্রিক চেতনায়। এবং এই অভিজ্ঞতা, এই দ্বন্দ্ব, এই আত্মপ্রতিফলনই তাঁকে কেবল সিনেমার নয়, ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অনন্য মনস্তাত্ত্বিক প্রতিমূর্তিতে পরিণত করেছে।

“তিন খান”-এর অভ্যুদয়

শাহরুখ খান: Anti-hero থেকে Romantic King

মানুষের মনস্তত্ত্বে নায়কতার ধারণা কখনো একরৈখিক নয়। একজন নায়কের মধ্যে যেমন থাকে আদর্শ, সাহস, নৈতিকতা, তেমনই দর্শক প্রত্যাশা করে তার চরিত্রে একটি অদৃশ্য প্রতিস্পর্ধা, আবেগ, এবং এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা তাঁকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। হিন্দি সিনেমায় এই নায়কের ধারাবাহিক বিবর্তনে নব্বইয়ের দশক এক অদ্ভুত পালাবদলের সূচক। আর এই পালাবদলের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন শাহরুখ খান—একজন বহুরূপী অভিনেতা, যিনি Anti-hero হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এক রোমান্টিক কিংবদন্তির পরিসর। এই রূপান্তর নিছক ক্যারিয়ারের ঘটনাবলি নয়, বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ভাঙাগড়া, যেখানে সমাজ, দর্শক, সিনেমা এবং ব্যক্তিত্বের জটিল মিথস্ক্রিয়া সক্রিয়।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Image: AI Generated

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যখন শাহরুখ খান বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন হিন্দি সিনেমার নায়ক-সংজ্ঞা ছিল এক সুপ্রতিষ্ঠিত কাঠামোয় বাঁধা। সে কাঠামোর কেন্দ্রে ছিল ন্যায়পরায়ণতা, আত্মত্যাগ, পরিবারের প্রতি নিষ্ঠা এবং সামাজিক দায়িত্ব। এই কাঠামোয় যারা বিচ্যুত, তারা ‘খলনায়ক’। কিন্তু শাহরুখ খান এই দ্বৈততার মধ্যে এক নতুন ছায়া নিয়ে প্রবেশ করেন—একজন নায়ক, যিনি হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিভ্রান্ত, এবং কখনও কখনও নৈতিকতার পরিধির বাইরেও অবস্থান করছেন। Baazigar (১৯৯৩) সেই ছায়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ, যেখানে তিনি একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি।

এই চরিত্র দর্শকের মনে এক গভীর প্রশ্ন তোলে—নায়ক কীভাবে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? অথবা, আমরা কেন এই অন্ধকার সত্তাকেও ভালোবাসি? মনোবিশ্লেষণের ভাষায় বললে, এই ভালোবাসা ছিল একধরনের ‘sublimation of aggression’—দর্শক নিজের ভেতরের ক্ষোভ, দমন, সামাজিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা শাহরুখের চরিত্রে উপস্থাপিত দেখে তার প্রতি একধরনের সহানুভূতি গড়ে তোলে। তিনি খুনি হলেও তার অতীতের যন্ত্রণাবোধ, পরিবারের ক্ষতি, এবং সামাজিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিক্রিয়া—এইসব মিলিয়ে সে হয়ে ওঠে ‘বিচারকের ভূমিকায়’ এক উগ্র প্রতিবাদী।

এই বৈপরীত্যই শাহরুখ খানকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি ‘শুদ্ধ’ নায়ক নন, বরং তিনি দর্শকের অচেতন আবেগ, দমনকৃত ক্রোধ ও স্বপ্নের সম্মিলিত রূপ। Darr (১৯৯৩)-এর ওভসেসিভ লাভার রাহুল চরিত্রটি তারই আরেক বিপজ্জনক দিক। এখানে তিনি নিছক প্রেমিক নন, তিনি একধরনের মানসিক বিকারের প্রতীক। প্রেম এখানে আরাধনার সঙ্গে সীমানা ঘেঁষে একধরনের আক্রমণাত্মক অধিকারচেতনায় পরিণত হয়। “I love you K-K-K-Kiran”—এই সংলাপটি যতটা প্রবাদপ্রতিম, ততটাই ভীতিকর। কিন্তু তার চোখ, গলার স্বর, এবং আত্মসমর্পণের মধ্যে দর্শক আবিষ্কার করে এক অদ্ভুত কষ্ট, এক নিঃসঙ্গতা, এক অস্বীকারের যন্ত্রণা। এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই তাঁকে ‘অপরাধী প্রেমিক’-এর এক অনন্য প্রতীক করে তোলে।

তবে শাহরুখের এই অ্যান্টি-হিরো ইমেজ বেশিদিন স্থায়ী থাকেনি। এবং এখানেই আমরা দেখতে পাই তাঁর চরিত্রের অভ্যন্তরে এক নিরন্তর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিল তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা—দিল্লির এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মুম্বইয়ের সেলুলয়েড জগতে প্রবেশ, পিতৃহীন শৈশব, মঞ্চনাটকের বাস্তবতা এবং টেলিভিশনের পর্দা থেকে রূপালী পর্দায় উত্তরণ। শাহরুখ আসলে একজন ‘outsider’—যিনি বলিউডের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বলয় ভেঙে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে তার অ্যান্টি-হিরো ইমেজ ছিল এক প্রতিক্রিয়াশীল রূপ, এবং তার রোমান্টিক হিরো হয়ে ওঠার যাত্রা ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় অধ্যায়।

এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয় Dilwale Dulhania Le Jayenge (১৯৯৫)-এর রাজ চরিত্র দিয়ে। এই চরিত্র আর আগের সেই ঠাণ্ডা প্রতিশোধপরায়ণ নয়; বরং সে প্রাণবন্ত, আবেগপ্রবণ, গৃহসংস্কারমুখী এবং চূড়ান্তভাবে ভালোবাসার পক্ষে এক আদর্শ পুরুষ। কিন্তু এই রাজ চরিত্রও দ্বৈততা বহন করে। একদিকে সে স্বাধীনভাবে প্রেম করতে চায়, অন্যদিকে সে প্রেমের স্বীকৃতি চায় পিতার অনুমতিতে। সে বিয়ে করে পালিয়ে যায় না, বরং অপেক্ষা করে—‘বাবা রাজি হো জায়েঙ্গে’। এই দ্বৈততা—বিদ্রোহ আর সংস্কার—এই দুইয়ের সম্মিলন শাহরুখ খানকে গড়ে তোলে নব্বইয়ের দশকের মধ্যবিত্ত ভারতের রোমান্টিক প্রতিমূর্তি।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Image Source: Google

এই রূপান্তরের গভীর মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে। কেননা, ভারতে প্রেমচর্চা বহুদিন ধরে সামাজিক নিয়ম, বর্ণ, ধর্ম, পরিবারের বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণ, স্যাটেলাইট টিভি এবং মিডিয়া সংস্কৃতির প্রভাবে প্রথমবার ‘স্বাধীন প্রেম’ চিন্তার জায়গা পায়। কিন্তু সেই প্রেম সরাসরি বিদ্রোহ করে না; বরং এক ‘Negotiated Romance’ গড়ে তোলে। DDLJ-এর রাজ সেই নতুন প্রেমের প্রতিনিধি—যিনি পরিবার ভাঙে না, বরং রক্ষা করে, কিন্তু প্রেমের স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করে। এই চরিত্র দর্শকের মনে একধরনের নিরাপদ স্বপ্নের প্রতিমূর্তি গড়ে তোলে।

এইভাবে শাহরুখ খান হয়ে ওঠেন এক ‘Romantic King’—কিন্তু তা কেবল আবেগপ্রবণ সংলাপ বা হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নয়; বরং তার চরিত্রের গভীরে ছিল এক প্রবল মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কলন। তিনি কখনও পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, বরং বারবার অস্থির, আবেগতাড়িত, সন্দিগ্ধ, এবং কখনও কখনও আত্মদ্বন্দ্বে আক্রান্ত। এই দ্বন্দ্বই তাঁকে মানুষের কাছে আরও কাছের করে তোলে। শাহরুখের প্রেমিক হয়ে ওঠা মানে ছিল না কোনও নিখুঁত দেবদূতের অবতরণ; বরং একজন মানুষের যন্ত্রণার মধ্যে প্রেম খুঁজে পাওয়ার সান্ত্বনা। তিনি নিখুঁত ছিলেন না—সেই জন্যেই দর্শক তাঁর সঙ্গে আত্মপরিচয়ের যোগসূত্র স্থাপন করতে পেরেছিল।

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এখানে লক্ষণীয়—শাহরুখের ‘রোমান্টিক’ পর্ব কখনই নিছক একরৈখিক ছিল না। Dil Se, Kuch Kuch Hota Hai, Mohabbatein, Kal Ho Naa Ho—এইসব ছবিতে তাঁর চরিত্র গভীরভাবে layered। Dil Se-এ প্রেম এক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহননের দিকে গড়ায়; Kal Ho Naa Ho-তে প্রেম এক নিরাময়হীন যন্ত্রণার দান; Mohabbatein-এ প্রেম বিদ্রোহ, Kuch Kuch Hota Hai-তে প্রেম সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বিশ্বাস করে। এইসব চরিত্র তাকে শুধু প্রেমিক নয়, বরং এক প্রেম-চিন্তক করে তোলে—যিনি প্রেমকে নিছক অনুভূতির জায়গায় না রেখে তাকে আত্মপরিচয়ের নির্ণায়ক বলে বিশ্বাস করেন।

শাহরুখ খানের এই মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ভারতীয় মধ্যবিত্তের আত্মপরিচয়ের বিনির্মাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে সমাজ একদিকে আধুনিকতা চাইছিল, আবার অন্যদিকে সংস্কারের শিকড় ছাড়তে ভয় পাচ্ছিল, সেই সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব শাহরুখের চরিত্রে প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি একাধারে দুঃসাহসী এবং সংবেদনশীল, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় দণ্ডায়মান হলেও নারীর অনুভবকে সম্মান করেন, আবেগতাড়িত হলেও যুক্তির সম্মুখীন হন। এইসব বৈপরীত্য তাঁকে বাস্তবের কাছাকাছি এনে দেয়।

শাহরুখ খানের আত্মপরিচয় গঠনে এক ধরণের নিরব কান্না লুকিয়ে থাকে, যা তাঁর পর্দার হাসির নিচে বারবার উঁকি মারে। তাঁর চোখে যেন কোনও গভীর হারিয়ে যাওয়ার অনুভব থাকে—এক শূন্যতা, এক বেদনা, যা হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও উৎসারিত। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে দেয় এক মানবিক অনুরণন, যা তাঁকে ‘রোমান্টিক কিং’ নয়, বরং ‘রোমান্টিক মানব’ করে তোলে।

এইভাবে শাহরুখ খান একজন স্টার নন, তিনি এক ‘affective phenomenon’—এক আবেগতাড়িত অবস্থান, যার মাধ্যমে দর্শক শুধু প্রেম নয়, বরং অস্তিত্ব, আকাঙ্ক্ষা, সমাজ ও সময়কে অনুভব করতে পারে। Anti-hero থেকে Romantic King হয়ে ওঠা তাঁর যাত্রা তাই কেবল পর্দার নয়, বরং এক যুগের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের বয়ান।

সালমান খান: “ভাইজান” ইমেজ

একজন চলচ্চিত্র তারকা কেবল তাঁর অভিনয়ের গুণেই স্মরণীয় হয়ে ওঠেন না, বরং তিনি হয়ে ওঠেন একটি সময়ের মানসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী চাহিদার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিচ্ছবি। তারকা আসলে এক ‘অ্যাক্টিভ স্ক্রিন’—যার মধ্যে দিয়ে দর্শক নিজের আকাঙ্ক্ষা, সংকট, হতাশা এবং স্বপ্নের প্রতিফলন খুঁজে পায়। সালমান খান এই নিরিখে হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য ও জটিল অবস্থানে অধিষ্ঠিত। Maine Pyar Kiya (১৯৮৯) থেকে শুরু করে Hum Aapke Hain Koun..! (১৯৯৪) এবং পরবর্তীতে ‘ভাইজান’ ইমেজে পরিণত হওয়া সালমান আসলে এক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রাপথ, যা ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মপরিচয়, পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, পরিবার এবং গ্ল্যামার-চেতনার দ্বৈততা বহন করে।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Image: AI Generated

সালমান খানের আত্মপ্রকাশ ঘটে এমন এক সময়ে, যখন হিন্দি সিনেমা নব্বইয়ের দশকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতে চলেছে। আশির দশকের শেষভাগের সিনেমা যেমন ক্লান্তিকর, পুনরাবৃত্ত ও অ্যাংরি হিরো-নির্ভর হয়ে উঠছিল, তেমনই নতুন প্রজন্ম এক নতুন ধরনের আবেগ, রোমান্স এবং আত্মীয়তার ভাষা খুঁজছিল। Maine Pyar Kiya-তে প্রেমের যে বালকসুলভ উচ্ছ্বাস, সরলতা, এবং নির্ভরতার অনুভব আমরা দেখতে পাই, তা ছিল ভারতীয় প্রেমবোধের এক মৌলিক রূপায়ণ। সালমান এখানে একেবারে ভিন্ন ঘরানার প্রেমিক—তিনি প্রতিবাদ করেন, ভালোবাসেন, কাঁদেন, কাতর হন, কিন্তু কোনও সময়েই অতি-পুরুষসুলভ হয়ে উঠেন না। বরং, তার চোখে মুখে যে আবেগ, তা তাকে বানায় এক কোমল ও সংবেদনশীল পুরুষপ্রতিমা।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Poster of Maine Pyar Kiya, Image Source: Google

এই সংবেদনশীলতা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রেমিক পুরুষের ধারণাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়। সালমানের প্রেম এখানে কোনো নারীবিজয়ের ভাষা নয়; বরং ভালোবাসা এখানে একধরনের পারিবারিক স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা। Maine Pyar Kiya ছবিতে “Dosti ka ek usool hai Madam – no sorry, no thank you”—এই সংলাপ দর্শকের মনে গেঁথে যায়, কারণ এতে এক গভীর আকর্ষণীয় সারল্য ছিল, যা আগের দশকের জটিল সামাজিক দ্বন্দ্বের বাইরে এসে এক নতুন ধরণের পারস্পরিক সম্পর্কের ভাষা নির্মাণ করে।

Hum Aapke Hain Koun..! সিনেমাটি সালমান খানের ‘পারিবারিক রোমান্টিকতা’র চূড়ান্ত প্রকাশ। এখানে তিনি আর শুধুই প্রেমিক নন, তিনি ভাই, বন্ধু, পুত্র, পরিবারের প্রাণকেন্দ্র। তার চরিত্রে কোনও উত্তেজনা নেই, নেই বাহ্যিক নাটকীয়তা। তবু তার উপস্থিতি হয়ে ওঠে অনিবার্য, এবং এই অনিবার্যতা তার ‘আন্তরিক পুরুষতন্ত্র’-এর একটি নতুন প্রকার গড়ে তোলে। মনোবিশ্লেষণের পরিভাষায় বলা যায়, এই চরিত্র আমাদের দেখায় এমন এক পুরুষসত্তা, যিনি কর্তৃত্বে নয়, স্নেহে বিশ্বাসী। এইরূপ নায়ক ভারতীয় দর্শকের হৃদয়ে গভীরভাবে স্থান করে নেয়, কারণ এতে ছিল ভরসা, সহানুভূতি, নির্ভরতা—যা ছিল বহুবছরের ‘ম্যাচো হিরো’-এর বিপরীতে এক স্বস্তির বাতাস।

এই রোমান্টিক, পারিবারিক ও কোমল ইমেজ-নির্মাণের পর সালমান খান ক্রমশ রূপ নিতে থাকেন এক ভিন্ন পরিসরে—যা আমরা পরে ‘ভাইজান’ নামে চিহ্নিত করি। এই রূপান্তর সহজ বা আকস্মিক ছিল না; বরং এটি ছিল এক ধীর-স্থির মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক পরিপাকের ফসল। সালমানের ব্যক্তিজীবনের নানা বিতর্ক, আইনত সমস্যা, মিডিয়ায় নানান ভাঙাগড়ার গল্প—এইসব কিছু তার ব্যক্তিত্বের ভেতর এক ধরনের বিভাজন তৈরি করে। তিনি দর্শকের কাছে আর নিছক একজন রোমান্টিক নায়ক নন, তিনি হয়ে ওঠেন এক ‘সংকটাপন্ন পুরুষ’, যিনি নিয়ম ভাঙেন, পথে বেরিয়ে যান, আবার ফিরে আসেন—আর তার এই ঘুরে ফিরে আসাটাই তাকে এক রহস্যময় ও ক্ষমতাশালী প্রতীক করে তোলে।

‘ভাইজান’ শব্দটি নিছক ডাকনাম নয়, এটি এক প্রতীকি অভিভাবকসুলভ অবস্থান। সালমান খান হয়ে ওঠেন এমন একজন, যিনি ভাইয়ের মতো, রক্ষকের মতো, বন্ধুর মতো, যিনি কড়া হতে পারেন, আবার সহানুভূতিশীলও। Wanted, Dabangg, Kick, Sultan, Bajrangi Bhaijaan—এইসব ছবিতে তার চরিত্র একদিকে শক্তিমান, অন্যদিকে আবেগপ্রবণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং বহুলাংশে জনমানসের নৈতিক কাঠামোর মধ্যে ‘অপরাধী হয়েও নির্দোষ’-এর প্রতিমূর্তি।

এই বৈপরীত্যই তার ‘ভাইজান’ ইমেজকে নির্মাণ করে। দর্শক জানে, সালমান ভুল করতে পারে, আইন ভাঙতে পারে, কিন্তু তবু সে ‘আপনজন’। এই আপনত্ব নির্মাণে মিডিয়ার ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই তার শরীরী ভাষা, চোখের দৃষ্টি এবং নির্ভরযোগ্যতা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখা যায়, এই চরিত্রটি আসলে ভারতীয় সমাজের এক গভীর আকাঙ্ক্ষার প্রতীক—একজন পুরুষ, যিনি সুরক্ষার প্রতীক, কিন্তু আধিপত্যবাদী নন; যিনি নিয়ম মানেন না, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নন; যিনি হিংস্র, কিন্তু হৃদয়বান।

সালমান খানের এই বহুস্তরীয় চরিত্র নির্মাণ তাকে অন্য সব তারকার থেকে স্বতন্ত্র করে। তিনি শ্রেণি-সংস্কৃতি-রাজনৈতিক অবস্থান—সব জায়গাতেই গ্রহণযোগ্য। কারণ, তার মধ্যে একধরনের জেনেরিক ভারতীয়তা আছে—তিনি হিন্দু নাম নিয়ে মুসলিম, পশ্চিমি পোশাক পরে দেশি মাটির ঘ্রাণ বহন করেন, শরীরী-চর্চায় মগ্ন অথচ মায়ের ছেলে। এইসব দ্বৈততা তাকে এক অভূতপূর্ব সত্তায় পরিণত করে, যার মধ্যে জনতার চেতনাগত দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা, এবং দুঃস্বপ্নের নিঃসঙ্গতা প্রতিফলিত হয়।

তার স্টারডম তাই নিছক সিনেমা নির্ভর নয়, বরং একধরনের সংবেদনশীল সামাজিক চরিত্রের প্রতীক। সালমান কখনোই ‘পারফেকশনিস্ট’ নন; বরং তিনি এমন একজন, যিনি নিজের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভালোবাসা অর্জন করতে পারেন। এই গ্রহণযোগ্যতা তাকে অনন্য করে তোলে। কারণ, ভারতীয় দর্শক তার মধ্যে দেখে নিজের দোষ, ভুল, এবং আশা—সবকিছুর এক কোলাজ, এক ‘প্রতিবিম্বিত আত্মপরিচয়’।

তবে তার ইমেজ শুধু পুরুষতন্ত্রের পুনর্গঠন নয়, বরং এক ধরনের আধুনিক পুরুষভাবনারও উপস্থাপন। Bajrangi Bhaijaan-এ যেমন তার চরিত্র এক নীরব মানবিক বিপ্লবের প্রতিনিধি—একজন মুসলিম পুরুষ, যিনি পাকিস্তানের বালিকাকে নিজের প্রাণ দিয়ে উদ্ধার করেন, রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে। এই চরিত্র ভারতীয় সিনেমায় ‘পুরুষত্ব’ এবং ‘রাষ্ট্রনীতি’-র সংজ্ঞাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আর এখানেই সালমান খান হয়ে ওঠেন এক ‘মানবিক হিরো’—যিনি শক্তি দিয়ে নয়, সহানুভূতি দিয়ে জিতে নেন।

এইসব মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্যই সালমান খানের স্টার পার্সোনাকে এত বিস্তৃত করে তোলে। তিনি প্রেমিক, রক্ষক, অভিভাবক, সহচর, এবং বিদ্রোহী—সব একসঙ্গে। তার মধ্যে কোনো ‘একরৈখিকতার’ সংকেত নেই। বরং তার দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, অস্থিরতা, এবং কামনার রূপরীতিই তাকে যুগ-ধারণকারী প্রতীকে পরিণত করেছে।

মনোবিশ্লেষক কার্ল ইয়ুং যে ‘collective unconscious’-এর কথা বলেন—সালমান খান তার অন্যতম আধুনিক প্রতীক। তিনি একাই বহন করেন জনতার লুকানো আবেগ, ট্যাবু, কামনা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আশ্রয়ের প্রয়োজন। তিনি হয়ে ওঠেন এমন একজন, যাকে দেখে নিজের বেদনা ভুলে থাকা যায়, আবার নিজের বিপন্নতা উপলব্ধি করাও সম্ভব হয়।

এইভাবে সালমান খান একজন তারকা নন কেবল, তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের নাগরিক মানসিকতার এক জীবন্ত প্রতিফলন। Maine Pyar Kiya-র প্রেমিক থেকে Hum Aapke Hain Koun..!-এর পারিবারিক মুখ, এবং পরে ‘ভাইজান’-এর জাতীয় প্রতিমূর্তি—এই রূপান্তর কেবল সময়ের নয়, এটি চেতনার, এটি দর্শকের, এটি এক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ইতিহাস।

এই ইতিহাসে সালমান খান এক আত্মবিরোধী অথচ সমন্বয়ী চরিত্র—যার মধ্যে বয়ে চলে ভারতীয়তার বহতা স্রোত: আবেগ, হিংসা, ভালবাসা, ক্ষমাশীলতা এবং ন্যায়বোধ। এবং সেইজন্যই, তিনি কেবল পর্দার ‘হিরো’ নন, তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় জনগণের এক মনস্তাত্ত্বিক আত্মীয়—ভাইজান।

আমির খান: অভিনয়ঘন সিনেমা, নিরীক্ষাধর্মী বেছে নেওয়া

তারকাদের মধ্যে কিছু মানুষ থাকেন, যারা কেবল জনপ্রিয় নন, বরং এক সময়কে ব্যাখ্যা করার ভাষা হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিছক বিনোদন দেন না, বরং আত্মসন্ধান, সমাজভাবনা, এবং আভ্যন্তরীণ পরিপক্বতার সূচক হয়ে ওঠেন। আমির খান হলেন তেমনই এক বিরল উদাহরণ—যিনি হিন্দি সিনেমার প্রথাগত রীতিকে মানেন, আবার ভেঙেও দেন; যিনি অভিনেতা, নির্মাতা, চিন্তক এবং দর্শকের বিবেক। তাঁর সিনেমার প্রতিটি নির্বাচনে থাকে এক স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক উচ্চারণ—যা ভারতীয় মধ্যবিত্তের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গে মিলে যায়।

Amir Khan
Image: Image: AI Generated

আমির খানের চলচ্চিত্রজীবনের শুরু হয় আশির দশকের শেষভাগে Qayamat Se Qayamat Tak দিয়ে, যেখানে তিনি একজন প্রেমিকের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেন—সাহসী, সরল, সংবেদনশীল। এই চরিত্র ভারতীয় তরুণদের মনে দোলা দেয়, কারণ এতে ছিল প্রেমের শুদ্ধতা, আত্মত্যাগ এবং একধরনের ‘অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো’-র স্পর্ধা। কিন্তু এই সফলতাকে ধরেই তিনি থেমে থাকেননি। নব্বইয়ের দশকে একের পর এক বাণিজ্যিক সফল ছবি—Dil, Jo Jeeta Wohi Sikandar, Hum Hain Rahi Pyar Ke, Rangeela—তাঁর জনপ্রিয়তা ও স্টারডমকে প্রতিষ্ঠিত করলেও, আমির খান সেখানেই তাঁর আসল যাত্রা শুরু করেননি। বরং, এই সময় থেকেই তিনি গড়ে তুলতে থাকেন এমন এক অভিনয়-ভিত্তিক শিল্পীসত্তা, যার ভিত্তি ছিল নিরীক্ষা, পরিশ্রম এবং নান্দনিক আত্মদায়িত্ব।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, আমির খান নিজেকে একজন ‘আত্মসচেতন অভিনেতা’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন—যিনি নিছক আবেগপ্রবণ নয়, বরং অনুভবের গভীর কাঠামোকে নির্মাণ করেন। তাঁর চরিত্রগুলি কেবল সংলাপ নির্ভর নয়, বরং দেহভাষা, চোখের দৃষ্টি, উচ্চারণের টেম্পো—সবকিছু দিয়ে চরিত্রকে গড়ে তোলেন। এই পদ্ধতি স্টারডমকে আলোকিত করে না, বরং ত্যাগের দাবি রাখে, যা একধরনের আত্মান্বেষণের ফল। আমির কখনও ‘রোল প্লে’ করেন না, বরং চরিত্রে প্রবেশ করেন, তাকে আত্মস্থ করেন। এই ‘method acting’-এর মধ্যেই তাঁর চিন্তাভাবনার পরিণত রূপ দেখা যায়।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমির খান যে ধরনের সিনেমা বেছে নিতে থাকেন, সেগুলি ছিল অনেকটাই ‘সচেতন’ নির্বাচন। তাঁর প্রতিটি ছবির বিষয়, নির্মাণরীতি, পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্ক—সবই বিবেচিত ও পরিকল্পিত। অন্যদিকে শাহরুখ যখন রোমান্টিক স্টার হিসেবে জনপ্রিয়তার শিখরে, সালমান যখন পারিবারিক ও অ্যাকশন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তখন আমির খান নিজের পথে হেঁটেছেন—যা অনেক সময় দর্শকের প্রত্যাশা বিরুদ্ধ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শিল্পের অভ্যন্তরীণ বিবর্তনের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এই নিরীক্ষার পথ তাঁকে নিয়ে যায় এমন ছবির দিকে, যেগুলি নিছক ‘হিট’ নয়, বরং স্মৃতিময়, প্রাসঙ্গিক এবং চিন্তনমূলক। Lagaan (২০০১)-এর মতো সিনেমা—যেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গ্রামের প্রতিরোধ একটি ক্রিকেট খেলায় প্রতিফলিত হয়—এটি কেবল দেশপ্রেম নয়, এটি একটি সমাজভাবনার ভাষা। আমির এখানে শুধু অভিনয় করেননি, বরং প্রযোজক হিসেবে এই প্রকল্পে ঝুঁকি নিয়েছেন। এই ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা তার শিল্পীসত্তার ভিতরেই নিহিত—যেখানে জনপ্রিয়তা নয়, বরং ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে, সময়ের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা থাকে।

আমিরের এই রূপান্তর গভীর মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা বহন করে। তিনি নিজেকে ক্রমাগত নতুন চ্যালেঞ্জে ঠেলে দেন। Dil Chahta Hai-তে তিনি শহুরে যুবকের আত্মচিন্তাকে নতুন ভাষা দেন; Rang De Basanti-তে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রজন্মগত বিষণ্ণতাকে সামনে আনেন; Taare Zameen Par-এ একজন শিক্ষকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মমতা ও বোঝার জগৎকে উন্মোচিত করেন। এই সিনেমাগুলিতে আমির নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলেন, যেন তিনি একজন নায়ক নন, বরং সমাজের গভীরে ঢুকে সেই অভ্যন্তরীণ স্তরগুলো তুলে আনছেন, যা দর্শক অনুভব করে, কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না।

মনোবিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একধরনের ‘সচেতন সংবেদনশীলতার’ বহিঃপ্রকাশ। আমির খান জানেন, একজন শিল্পীর কাজ শুধুই বিনোদন নয়, বরং জনচেতনায় আলোড়ন তোলা। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই তিনি জনপ্রিয় স্টার হয়েও নিজেকে ‘পণ্য’ বানাতে চান না। তিনি বিজ্ঞাপন বেছে নেন, ব্র্যান্ড নির্বাচন করেন তাঁর সমাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে। Satyamev Jayate অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এক সামাজিক বক্তা—যিনি শুধুই সত্য তুলে ধরেন না, বরং দর্শকের মধ্যকার নিষ্ক্রিয় বিবেককে সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেন।

এই ধরণের দায়িত্বশীল তারকা মানসিকতা আজকের দিনে বিরল। আমির খান বুঝেছিলেন, ভারতের মতো একটি সমাজে স্টারডম আসলে একটি ক্ষমতা, এবং এই ক্ষমতা কিভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটাই তারকা হওয়ার প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করে। তিনি যখন PK বানান, তখন ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ব্যঙ্গ করেন, কটাক্ষ করেন, কিন্তু তাতে কখনও কদর্যতা থাকে না; থাকে একদম নিরীহ শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি। এই শিশুসুলভ নিরীক্ষণক্ষমতা আমিরের চরিত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য, যার ফলে তিনি দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় ভয় পান না, বরং তাকে ভাবতে বাধ্য করেন।

এটি একধরনের ‘চিন্তাশীল অভিনয়’—যেখানে সিনেমা একটি দার্শনিক প্রকল্প হয়ে ওঠে। Dangal-এ তিনি শরীর বদলান, বয়স বদলান, ভাষা বদলান, শুধুমাত্র চরিত্রের জন্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয়, তিনি সেই সমাজগত কাঠামো বদলাতে চান, যেখানে মেয়েদের স্বপ্নকে পায়ের নিচে ফেলে দেওয়া হয়। এখানে তিনি এক ‘মেয়ের বাবা’, যিনি প্রথমে কর্তৃত্ববাদী, পরে আত্মসংশয়ে আক্রান্ত, এবং শেষে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে ফেলতে বাধ্য হন। এই চরিত্রটি আমিরের নিজস্ব মানসিক পথচলার অনুরূপ, কারণ আমির নিজেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পাল্টে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

এই ‘রিফ্লেক্সিভ অ্যাক্টর’ হবার জন্য যে ধৈর্য, আত্মসংযম এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, তা আমির খান ছাড়া বলিউডে অন্য কারও মধ্যে এত সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় না। তিনি সিনেমাকে ‘লেভেল অফ অ্যাওয়ারনেস’ বা আত্মজ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে দেখেন। এবং এজন্যই তার সিনেমা ‘বারবার দেখার’ উপযোগী হয়ে ওঠে। কারণ একবারে তা শেষ হয় না, প্রতিবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়। দর্শকের মনস্তত্ত্বে এই ধরণের প্রভাব স্থায়ী ছাপ রেখে যায়—যা কেবল তাৎক্ষণিক আনন্দ নয়, বরং জীবনবোধে এক ধরনের জিজ্ঞাসার বীজ বপন করে।

আমির খানের এই রূপান্তর এক বিশেষ ধরনের তারকা তৈরির দিকনির্দেশ দেয়। বলিউডে যেখানে অধিকাংশ তারকা নিজের ইমেজ রক্ষা করার জন্য, বাজার ধরে রাখার জন্য একধরনের স্বস্তিকর রুটিন মেনে চলেন, সেখানে আমির নিজের প্রতিটি ছবিকে নতুন পরীক্ষায় ফেলে দেন। এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যে ঝুঁকি আসে, তা তিনি গ্রহণ করেন। তাঁর ক্যারিয়ারে দীর্ঘ বিরতি থাকে, বারবার ছবি বন্ধ করেন, শুটিং বিলম্বিত হয়—সবকিছুই এই গভীর দায়বদ্ধতা থেকে।

এই মনস্তাত্ত্বিক দায়বদ্ধতা তাকে ‘তারকা’ থেকে এক ‘অভিনয়চিন্তক’ হিসেবে তুলে আনে। তিনি নিজেকে একজন পারফর্মার হিসেবে ভাবেন না কেবল, বরং সিনেমাকে দেখে একটি সামগ্রিক শিল্পমাধ্যম হিসেবে, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য একটি ভাবনার প্রসার। তাঁর পারফেকশনিজম কোন অহংকার নয়, বরং এটি একধরনের আত্মশৃঙ্খলা—যা দর্শকের প্রতি দায় থেকে উদ্ভূত।

এভাবে আমির খান হয়ে ওঠেন এক ধরনের ‘অন্য স্টার’। যিনি শুধু নিজেই স্বতন্ত্র নন, বরং বলিউডের তারকা সংস্কৃতির ভেতর নতুন পথচিহ্ন আঁকেন। এই পথ চলায় তিনি অনেক সময় জনপ্রিয়তার বাইরে থেকেছেন, ট্রেন্ডের বিরুদ্ধে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ক্রমাগত দর্শকের চিন্তার মানচিত্রকে পুনর্গঠন করে এসেছে। এই মানচিত্রে ‘তারকা’ মানে কেবল আকর্ষণ নয়, বরং আত্মপ্রশ্নের উৎস।

এইভাবে আমির খান একজন অভিনেতা নন কেবল; তিনি হয়ে ওঠেন একটি যুগের আত্মস্মৃতি—যেখানে অভিনয় ছিল প্রশ্ন, এবং সিনেমা ছিল তার উত্তর খোঁজার যাত্রা।

নতুন তারকাদের (অক্ষয় কুমার, সাইফ, অজয়) আবির্ভাব ও ভিন্ন ভিন্ন ধারা

১৯৯০-এর দশকে হিন্দি সিনেমা এক দারুণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে অমিতাভ বচ্চনের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজ তখন ক্ষয়িষ্ণু, অন্যদিকে তিন খানের (শাহরুখ, সালমান, আমির) অভ্যুদয় ঘটছে। এই দুই মহাশক্তির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে আবির্ভূত হন কয়েকজন তরুণ অভিনেতা—অক্ষয় কুমার, সাইফ আলি খান এবং অজয় দেবগন—যাঁরা একে অপরের থেকে অভিনয়শৈলী, শরীরী ভাষা, নায়কত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক গঠনে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পার্থক্যই নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমাকে বহুস্তরীয় করে তোলে। এই তারকারা কেবল নতুন মুখ ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন দর্শকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ অক্ষয় কুমার, Image Source: Google

এই বিশ্লেষণের শুরুতেই অক্ষয় কুমারকে আলাদা করে দেখতে হয়। তারকাজগতে তাঁর আগমন যেন এক আত্মবিশ্বাসী, শরীরনির্ভর, এবং অ্যাকশন-ভিত্তিক বিকল্প নায়কের আবির্ভাব। Khiladi সিরিজের মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাঁর একটি আলাদা ব্র্যান্ড—যেখানে গ্ল্যামার নেই, অতিনাটকীয়তা নেই, কিন্তু আছে চটপটে শরীরী উপস্থিতি, অ্যাথলেটিক দক্ষতা এবং একধরনের ঘরোয়া মেজাজ। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অক্ষয় সেই পুরুষ-প্রতিমা যিনি নায়কত্বকে ‘অ্যাচিভ’ করেন—জন্মগতভাবে পাওয়া নয়, বরং পরিশ্রম, নিয়ম, শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা এক অর্জন। তাঁর এই ঘরানাটি মধ্যবিত্ত দর্শকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের উদ্রেক করে।

অক্ষয়ের জনপ্রিয়তা ছিল একধরনের ‘working class hero’-র সংস্করণ, যেখানে জিম করা শরীর, মার্শাল আর্টে দক্ষতা, এবং সৎ কিন্তু মজাদার ব্যক্তিত্ব একধরনের আত্মনির্ভরতার আদর্শ তুলে ধরে। এটি ছিল অমিতাভের ধ্বংসাত্মক অভিমান থেকে বেরিয়ে আসার পথ—যেখানে বিদ্রোহ নেই, আছে নিয়মতান্ত্রিক পরিশ্রম, সহিষ্ণুতা এবং কর্মফলবাদ। নব্বই দশকের দর্শক, যিনি তখন সমাজে উঠে আসা, চাকরি, পরিশ্রম, জীবনসংগ্রামে লিপ্ত—তিনি অক্ষয়কে নিজের প্রতিবিম্ব হিসেবে দেখতে পান। এই কারণে অক্ষয়ের ‘মাস অ্যাপিল’ তৈরি হয় এবং পরে সেটি আরও বিস্তৃত হয় তাঁর সামাজিক বার্তাধর্মী ও দেশপ্রেমভিত্তিক সিনেমার মধ্য দিয়ে।

অন্যদিকে, সাইফ আলি খান ছিলেন একেবারেই ভিন্ন ঘরানার প্রতিনিধি। তাঁর অভিজাততা, শহুরে স্টাইল, ইংরেজি উচ্চারণ, এবং আধুনিক জীবনদর্শন তাঁকে দিল এক অনন্য ধাঁচ। সাইফ কখনওই প্রথাগত নায়ক ছিলেন না। বরং, তিনি এক ‘আন্তঃসংস্কৃতি’র প্রতীক—যিনি simultaneously ভারতীয় এবং পশ্চিমি। Main Khiladi Tu Anari, Yeh Dillagi, Hum Tum, Dil Chahta Hai—এইসব ছবিতে তাঁর উপস্থিতি একধরনের শহুরে, আত্মসচেতন, আত্মসন্দিহান পুরুষের ছবি তুলে ধরে, যে প্রেমিক হলেও নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং বন্ধু।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ সাইফ আলি খান, Image Source: Google

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই চরিত্রে একধরনের ‘emotional vulnerability’ কাজ করে। সাইফের চোখে-মুখে, শরীরী ভাষায় সেই অনিশ্চয়তা, দোদুল্যমানতা প্রতিফলিত হয়, যা নব্বই দশকের উত্তর-আধুনিক যুবকের চারিত্র্য। এই যুবক নিজেকে নিয়ে নিঃসন্দেহ নয়; সে বারবার নিজের অবস্থান পর্যালোচনা করে। ফলে, সাইফের নায়কত্ব একধরনের বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসচেতন পুরুষত্বের জন্ম দেয়—যা বলিউডে খুবই বিরল ছিল। এর ফলে তিনি একটি ভিন্নধর্মী ‘soft masculinity’-এর প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।

অজয় দেবগন এক তৃতীয় মেরুতে দাঁড়ানো চরিত্র। তিনি ছিলেন নিঃশব্দ, অন্তর্মুখী, এবং এক রহস্যময় আবরণে মোড়া। Phool Aur Kaante দিয়ে তাঁর প্রবেশ, কিন্তু পরে Zakhm, Company, The Legend of Bhagat Singh প্রভৃতিতে তাঁর সংযত অথচ তীব্র অভিনয় তাঁকে নিয়ে যায় এক ভিন্ন উচ্চতায়। অজয়ের চরিত্রগুলি কখনোই মুখর নয়, বরং তা দৃষ্টি, নীরবতা ও হাবভাব দিয়ে আবেগপ্রবাহ নির্মাণ করে।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ অজয় দেবগন, Image Source: Google

মনোবিশ্লেষণের দিক থেকে অজয় এক ‘traumatized masculinity’-র প্রতিনিধি, যেখানে চরিত্রটি নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা ও লড়াইকে চিৎকার করে বলে না, বরং চুপচাপ বহন করে। এই রকম পুরুষকে ভারতীয় সমাজে প্রায়ই ‘strong silent type’ বলা হয়। অজয়ের সাফল্য ছিল এই ভাবমূর্তিকে এমনভাবে পর্দায় নিয়ে আসা, যাতে তা ক্লান্ত নয়, বরং উদ্বেল, গভীর এবং প্রভাবসঞ্চারী হয়ে ওঠে।

এই তিন তারকার ভিন্ন ভিন্ন পথ, ভিন্ন ভিন্ন দর্শকসম্ভার গড়ে তোলে। অক্ষয় যেখানে কর্মঠ, সোজাসাপটা এবং অ্যাকশন-ভিত্তিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী, সাইফ সেখানে স্টাইলিশ, আত্মসচেতন এবং সম্পর্কের জটিলতায় নিমজ্জিত; আর অজয় আত্মগত, ভারী, এবং এক গভীর অনুভবের চরিত্রনির্মাণে বিশ্বাসী। এই পার্থক্যগুলো নব্বই দশকের ভারতীয় দর্শকের ভেতরের পরিবর্তনগুলিকেও প্রকাশ করে।

নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রথমবার বৃহৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরণ দেখেছে। গ্লোবালাইজেশন, স্যাটেলাইট টেলিভিশন, নগরায়ন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা দর্শকের মানসিক কাঠামো বদলে দিয়েছিল। অক্ষয়, সাইফ ও অজয়ের মতো তারকারা সেই নতুন দর্শকের মানসিক প্রতিফলন—তাঁরা সেই অন্তর্গত পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ, যা আগের স্টারদের মাধ্যমে বলা যেত না।

এই তারকাদের মধ্যে কমন ছিল—তাঁরা কেউই তাত্ত্বিকভাবে একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন না। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন আংশিক, অসম্পূর্ণ, এবং সেইজন্যই বাস্তব। এঁদের ভেতর দিয়ে বলিউড ‘হারোইক আদর্শ’ থেকে সরে এসে ‘ম্যান উইথ ফ্ল’—অর্থাৎ ত্রুটিসম্পন্ন কিন্তু মানবিক পুরুষের দিকে এগিয়ে যায়। এই রূপান্তর নিছক ন্যারেটিভ কৌশল নয়, এটি একটি মানসিক অভ্যুত্থান, যেখানে দর্শকও চাইছে এমন নায়ক, যে পুণ্যবান নয়, তবে উপলব্ধিযুক্ত।

এই রূপান্তরের একটা ফলশ্রুতি হলো, এই তিনজনই ধীরে ধীরে ভিন্ন ভিন্ন ধারা গড়ে তোলেন। অক্ষয় সামাজিক বার্তাধর্মী ও দেশাত্মবোধক সিনেমার মুখ হয়ে ওঠেন—Toilet: Ek Prem Katha, Padman, Airlift, Kesari প্রভৃতি ছবি এর প্রমাণ। সাইফ ক্রমশ ওটিটি যুগে মনস্তাত্ত্বিক, অপরাধভিত্তিক, হাইব্রিড চরিত্রে প্রবেশ করেন—Sacred Games, Tandav ইত্যাদি সিরিজে তাঁকে দেখা যায় দ্বন্দ্বপূর্ণ, বহুস্তরীয় চরিত্রে। আর অজয় নিজের সংযত, ভারী অভিনয় দিয়ে একদিকে Drishyam, Raid, Tanhaji-র মতো বাস্তবধর্মী চরিত্র গড়ে তোলেন, আবার প্রযোজক হিসেবেও নিজেকে স্থাপন করেন।

এইসব রূপান্তর প্রমাণ করে, নব্বই দশকে যারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ন্যারেটিভ ও ঘরানা নির্মাণে সফল। তাঁরা কেউ শাহরুখ, সালমান বা আমির নন—তাঁরা নিজেরাই একেকটি পরিপূর্ণ ধারার নির্মাতা।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই তিনজন তারকা আমাদের শেখান, তারকা মানে নিছক গ্ল্যামার নয়; বরং তিনি হলেন এক চলমান আত্মপরিচয়ের নির্মাতা। অক্ষয় তাঁর কর্মমুখরতার মধ্যে দর্শকের শৃঙ্খলা ও আত্মনির্ভরতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন; সাইফ তাঁর অন্তর্গত সন্দেহ ও স্টাইলের মধ্যে মধ্যবিত্তের আত্মসংস্কৃতির সংকট তুলে ধরেন; আর অজয় তাঁর নীরবতার মধ্যে শোক, সহিষ্ণুতা ও স্মৃতি বহন করেন।

এই তিন তারকার মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের দশকের বলিউড পায় এক মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনার পরিসর—যেখানে পুরুষত্ব মানে আর কেবলই শক্তি বা দম্ভ নয়, বরং অনুভব, দ্বন্দ্ব এবং আত্মনির্মাণের প্রক্রিয়া। এই বহুমাত্রিকতা বলিউডকে শুধু আলাদা করে না, বরং গভীরতর করে তোলে। আর এই গভীরতার শুরু হয়েছিল এই তিন ভিন্নধর্মী তারকার পা ফেলার শব্দে।

মাধুরী, জুহি, কাজল, ঊর্মিলা, করিশমার মধ্যে প্রতিযোগিতা ও চরিত্রের বৈচিত্র্য

এই তারকাদের মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের দশকের বলিউড পায় এক মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনার পরিসর—যেখানে পুরুষত্ব মানে আর কেবলই শক্তি বা দম্ভ নয়, বরং অনুভব, দ্বন্দ্ব এবং আত্মনির্মাণের প্রক্রিয়া। এই বহুমাত্রিকতা বলিউডকে শুধু আলাদা করে না, বরং গভীরতর করে তোলে। আর এই গভীরতার শুরু হয়েছিল এই তিন ভিন্নধর্মী তারকার পা ফেলার শব্দে।

একই দশকে হিন্দি সিনেমার নারী চরিত্রেও শুরু হয় এক নতুন প্রতিযোগিতা ও বহুমাত্রিক চরিত্রনির্মাণ। মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, কাজল, ঊর্মিলা মাতণ্ডকর ও করিশমা কাপুর—এই পাঁচ অভিনেত্রী নব্বইয়ের দশকে নারীনির্ভর চরিত্র ও তার পারফরম্যান্সের বৈচিত্র্য গড়ে তোলেন, যা শুধু জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা নয়, বরং ছিল এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের দিকচিহ্ন। তাঁদের প্রত্যেকের চরিত্রে এক ভিন্ন নারীত্ব, ভিন্ন আত্মপ্রকাশ এবং দর্শকের কল্পনার এক বিশেষ দিক প্রকাশ পেয়েছে।

মাধুরী দীক্ষিত এই যুগের সম্ভবত সর্বাধিক পরিণত ও জনপ্রিয় নারীচরিত্রের প্রতীক। Dil, Beta, Hum Aapke Hain Koun..! বা Dil To Pagal Hai—প্রত্যেকটি ছবিতে মাধুরীর শরীরী ভাষা, হাসি, চোখের নীরবতা একাধারে কামনা, শ্রদ্ধা এবং আকর্ষণের সুষমা প্রকাশ করে। মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, মাধুরীর নারীত্ব ছিল ‘idealized femininity’—একদিকে ঘরোয়া, অন্যদিকে আত্মপ্রকাশে পূর্ণ। তিনি কখনওই একরৈখিক প্রেমিকা নন; তিনি মায়ের, কন্যার, স্ত্রীর, সহচরীর এবং কামনার অদ্ভুত মিশেল। তাঁর অভিব্যক্তি ছিল একধরনের ‘ভিজুয়াল কাব্য’—যেখানে শরীর ছিল নৃত্যরতা, কিন্তু দৃষ্টি ছিল সংযত।

এই সংযম-সম্পন্ন আকর্ষণই তাঁকে হিন্দি সিনেমার নারীদর্শনের কেন্দ্রে স্থাপন করে। মাধুরী যেন ভারতীয় সমাজের সেই কাম্য নারী, যিনি সবকিছু জানেন, কিন্তু উচ্চারণ করেন না; যিনি স্বাধীন, কিন্তু সংসার-ভিত্তিক; যিনি কামনা জাগান, কিন্তু কখনও তা প্রকাশে উদ্দীপ্ত নন। এই দ্বৈততা দর্শকের মানসিকতায় একধরনের জটিল আকর্ষণ তৈরি করে।

জুহি চাওলা সেই বিপরীত মেরুর প্রতিনিধি—তাঁর চরিত্র ছিল প্রাণবন্ত, দুষ্টু, সরল, এবং একধরনের কিশোরীসুলভ উচ্ছ্বাসে ভরা। Qayamat Se Qayamat Tak, Bol Radha Bol, Yes Boss, Ishq—এইসব ছবিতে জুহির মুখভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি, হাসি, এমনকি রাগ—সবই ছিল একধরনের নির্ভেজাল আবেগের প্রকাশ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে জুহি সেই নারীত্বের প্রতীক, যাকে দেখে দর্শক আর কামনা করে না, বরং ভালোবেসে

গান ও সুরের জাদু

মিউজিক ডিরেক্টরদের স্বর্ণযুগ

নাদিম-শ্রবণ, অনু মালিক, রাজেশ রোশন, জতিন-ললিত

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার যে আবেগঘন, প্রেমনির্ভর, শ্রোতাবান্ধব আবহ তৈরি হয়েছিল, তার পেছনে পরিচালকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সুরকারেরা। সেই সময়ের সংগীতজগত একদিকে মেলোডির পুনর্জাগরণ, অন্যদিকে আধুনিক ইন্সট্রুমেন্টেশনের সংমিশ্রণে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে। এই ধারা নির্মাণে চারটি নাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—নাদিম-শ্রবণ, অনু মালিক, রাজেশ রোশন এবং জতিন-ললিত। তাঁরা কেবল সুর দিয়েছিলেন না, তাঁদের সুরের ভেতর দিয়ে এক জাতিগত মনস্তত্ত্ব, প্রেমের নতুন ব্যঞ্জনা এবং শ্রোতার অবচেতনে ঢুকে থাকা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল।

নাদিম-শ্রবণ জুটি নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার সঙ্গীতজগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম। তাঁদের সুরে ছিল একধরনের সরল, হৃদয়গ্রাহী মেলোডি—যা সহজেই শ্রোতার মনে স্থান করে নিত। Aashiqui (১৯৯০) ছবির মাধ্যমে তাঁরা একধরনের “মেলোডি রিভাইভাল মুভমেন্ট” শুরু করেন। এই ছবির গানগুলি যেমন “Nazar Ke Saamne,” “Dheere Dheere Se”—সবকিছুই যেন ভারতীয় প্রেমের অবচেতনের এক সংগীতরূপ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই গানগুলি একধরনের ‘safe desire’ প্রতিষ্ঠা করে—যেখানে প্রেম আছে, আকুলতা আছে, কিন্তু কাম নেই; যেখানে ভালোবাসা পবিত্র, এবং তার প্রকাশ নরম, ব্যাকুল কিন্তু সংযত।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ নাদিম-শ্রাবন, Image Source: Google

নাদিম-শ্রবণের সুরচর্চা মূলত নির্ভর করে ছিল সহজ লাইন, আরবি প্রভাবযুক্ত মেলোডি, এবং পিয়ানোর ব্যবহার। কিন্তু এই সরলতা আসলে এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রতিফলন। কারণ, এই সুরগুলি এমন শ্রোতার জন্য তৈরি, যে প্রেম চায়, কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পায়; যে ব্যথা চায়, কিন্তু তার ভাষা চায় না। এই দ্বৈততার মধ্যেই তাঁদের সুর গড়ে তোলে এক আবেগের আত্মস্মৃতি। ফলে তাঁদের গানগুলো শুধু শোনা যেত না, অনুভব করা যেত।

অনু মালিক ছিলেন একেবারে বিপরীত ধরণের সুরকার। তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, এক্সপেরিমেন্টাল এবং রীতিনির্ভরতার বাইরে যাওয়া সাহসী স্রষ্টা। Baazigar, Main Khiladi Tu Anari, Border, Refugee, Fiza—এইসব ছবির সংগীত তাঁর বহুমাত্রিক ক্ষমতার প্রমাণ। অনুর সুরে ছিল নাটকীয়তা, অপ্রত্যাশিততা এবং একধরনের উগ্রতা, যা শ্রোতাকে চমকে দিত, এবং সেইসঙ্গে আকৃষ্ট করত।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ অনু মালিক, Image Source: Google

মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে অনু মালিকের সংগীত একধরনের অস্থিরতা ও ‘non-conformist impulse’-এর বহিঃপ্রকাশ। তিনি শ্রোতার চেনা অভ্যেসে আঘাত করতেন—অদ্ভুত বেসলাইন, আকস্মিক মেজর থেকে মাইনরে যাওয়া, বা হঠাৎ করে লোকগীতি বা সুফির সংমিশ্রণ। তাঁর সুর শ্রোতার মধ্যে ‘anxiety of expectation’ তৈরি করত, এবং ঠিক সেই অস্থিরতার মধ্যেই গড়ে উঠত তাঁর স্টাইল। ফলে, অনুর গান কদাচিৎ সবার পছন্দ হতো, কিন্তু তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতো, কারণ সে শ্রোতার মনে প্রশ্ন তৈরি করত।

রাজেশ রোশন ছিলেন এক ক্লাসিক ধারার উত্তরাধিকারী, যাঁর সুরে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতীয় স্নিগ্ধতা, পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের মাধুর্য, এবং ভারতীয় রসনাবোধের নিঃশব্দ ভারসাম্য। Kaho Naa… Pyaar Hai, Karan Arjun, Papa Kehte Hain, Koyla, King Uncle—প্রতিটি ছবিতেই তাঁর সুর ছিল অনন্যসাধারণ।

রাজেশ রোশনের সুরের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সংবেদনশীলতা—তাঁর গান দর্শক বা শ্রোতাকে আবেগে ভাসিয়ে দেয় না, বরং একধরনের নৈঃশব্দ্য তৈরি করে, যা গভীর উপলব্ধির দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর সুরে ছিল একটি ‘lingering emotion’—যা গান শেষ হয়ে গেলেও মনের মধ্যে রয়ে যায়। মনোবিশ্লেষণে একে বলা যেতে পারে ’emotional aftertaste’। রাজেশ রোশনের সংগীত শ্রোতার ভেতরে থাকা স্মৃতি, বেদনা, এবং প্রেমের সংবৃত আকুতি জাগিয়ে তোলে।

অন্যদিকে জতিন-ললিত ছিলেন এই সময়ের সবচেয়ে ‘popular yet soulful’ সুরকার জুটি। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Kuch Kuch Hota Hai, Yes Boss, Kabhi Haan Kabhi Naa, Jo Jeeta Wohi Sikandar, Raju Ban Gaya Gentleman—এইসব ছবির গান আজও স্মৃতির ভেতরে মিশে থাকে। তাঁদের সুরে ছিল মেলোডি, ছন্দ, এবং এক অনবদ্য ‘urban innocence’।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে জতিন-ললিত সেই ‘nostalgic modernity’-র নির্মাতা, যারা নতুন প্রজন্মের প্রেমকে পুরনো সুরের কোমলতায় বাঁধতে পেরেছিলেন। তাঁদের গান ছিল সহজ, মিষ্টি, এবং একধরনের স্কুলজীবনের প্রেমের সারল্য। “Pehla Nasha,” “Tujhe Dekha To,” “Kuch Kuch Hota Hai”—এইসব গানে প্রেম মানে ছিল চোখের আড়াল থেকে দেখা, চিঠি লেখা, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, আবার স্বপ্ন দেখার সাহস।

এই গানগুলোতে যৌবনের যে অলীকতাকে প্রকাশ করা হয়েছিল, তা ছিল দর্শকের অবচেতনে থাকা ‘ideal love’-এর প্রতিনিধিত্ব। জতিন-ললিত সেই প্রেমের এক ব্যাকরণ তৈরি করেছিলেন—যা কোনও নিয়ম মানে না, কিন্তু প্রতিটি হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে।

এই চারজন সুরকার/সুরকার-জুটির ভেতরকার পার্থক্য শুধু সুরের রীতিতে নয়, বরং দর্শকের মানসিক কাঠামোর প্রতিফলনেও। নাদিম-শ্রবণ আমাদের নিঃশব্দ প্রেমে নিমগ্ন করে; অনু মালিক আমাদের অস্থির করে তোলে; রাজেশ রোশন আমাদের উপলব্ধি করতে শেখান; জতিন-ললিত আমাদের স্বপ্ন দেখান। এই চার ধরণের সুরের অভ্যন্তরীণ আবেগ, স্ট্রাকচার, মেজাজ এবং শ্রোতার প্রতিক্রিয়ার ধরণ মিলিয়েই নব্বই দশকের বলিউড সঙ্গীত তার সোনালি যুগে প্রবেশ করেছিল।

এই সুরকারদের চরিত্র শুধু একজন কম্পোজার নয়; তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন শ্রোতার আত্মার সংগীতজ্ঞ। তাঁদের কাজ ছিল একধরনের ‘emotional curation’—শ্রোতার অজস্র আবেগ, স্মৃতি, ক্ষুধা, আশা এবং স্বপ্নকে সুরে বাঁধা। তাঁরা কেবল গান লেখেননি; তাঁরা আমাদের অনুভবের ব্যাকরণ তৈরি করেছেন।

এই কারণেই তাঁদের অবদান কোনও একটি দশকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাসের এক চিরস্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলন।

পপ ও রোমান্টিক ধারার গান

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার সংগীতচর্চায় এক অনন্য সংযোজন ঘটে রোমান্টিক ও পপ ধারার গানের ক্ষেত্রে, যা মূলত যুব সমাজের অবচেতন অভিপ্রায়, স্বপ্ন এবং কামনার সৌম্য অথচ কল্পনাবিলাসী প্রকাশ হয়ে ওঠে। এই ধারার গান শুধু ছন্দ বা সুরের আনন্দ নয়, বরং মানসিক জগতে একধরনের নস্টালজিয়া, আকর্ষণ, এবং আত্মপরিচয়ের ইঙ্গিত বহন করে। এই প্রসঙ্গে যেসব গান উল্লেখযোগ্য: “Pehla Nasha”, “Tujhe Dekha To”, “Dekha Hai Pehli Baar”, “Chura Ke Dil Mera”—এই গানগুলিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল একটি মানসিক সাংস্কৃতিক পরিসর, যা ভারতীয় রোমান্টিকতার পুনর্নিমাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।

“Pehla Nasha” গানটি শুধু নব্বই দশকের নয়, বরং ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাসে প্রেমের প্রথম অনুভবকে কেন্দ্র করে রচিত এক কালজয়ী সংগীত। এই গানটির প্রতিটি শব্দ, সুর, আবহ এবং পরিবেশ যেন একটি ‘first love’-এর স্বপ্নময় জগত নির্মাণ করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি একটি ‘idealized memory’—যেখানে প্রথম প্রেম কেবল বাস্তব নয়, বরং এক রূপকথার অভিজ্ঞতা। জতিন-ললিতের সুর ও উdit narayan এবং Sadhana Sargam-এর কণ্ঠের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস, তা একটি ‘floating affect’-এর জন্ম দেয়—যেখানে শ্রোতা নিজের হারানো অনুভূতি ফিরে পায়।

“Pehla Nasha” আসলে প্রেমের উন্মত্ততা নয়, এটি প্রেমে পড়ার মানসিক মুহূর্তের এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি। এই গানটির অনবদ্য ব্যবহার ‘slow motion’-এর মাধ্যমে গানকে যেন শ্রোতার অবচেতন মনেই চিত্রায়িত করে। মনোবিশ্লেষণে এই গান একধরনের ‘libidinal dreamscape’—যেখানে কামনা নিষ্কলুষ রূপ নেয়, দেহ থাকে না, থাকে কেবল আবেগের স্নিগ্ধতার খেলা। এই প্রেম, এই আকর্ষণ বাস্তব নয়, বরং তা শ্রোতার মনের এক ‘inner utopia’।

“Tujhe Dekha To” গানটি প্রেমের আরেক স্তরের প্রতিনিধি—যেখানে মিলন, স্বপ্ন এবং বিরহ মিশে একধরনের লোকগাঁথার গঠন নেয়। এটি সেই গান, যা একদিকে প্রেমের প্রত্যাশা, অন্যদিকে তার অর্জনের পর আত্মবিশ্বাস ও তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ। গানটির মূল আকর্ষণ শুধু সুরে নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গিতে। এটি যে ছবিতে ব্যবহৃত (Dilwale Dulhania Le Jayenge), সেই প্রেক্ষাপটেই গানটি হয়ে ওঠে এক ‘neo-traditional romance’-এর প্রতীক।

এই গানটির মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘cultural nostalgia’—একদিকে ইউরোপীয় লোকেশন, অন্যদিকে ভারতীয় মূল্যবোধ, পোশাক, গীতধ্বনি। ফলে, এটি আধুনিকতার মধ্যেও শিকড়ের টান অনুভব করায়। শ্রোতার মধ্যে একধরনের দ্বৈত চেতনা কাজ করে—আমি আধুনিক, কিন্তু ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন নই। গানটি প্রেমকে তুলে ধরে একটি ‘দর্শনীয়’ বা ‘বর্ণনাত্মক কামনা’র কাঠামোতে, যেখানে প্রেম কেবল অনুভব নয়, একধরনের সামাজিক ও নৈতিক শুদ্ধতারও প্রতিফলন।

“Dekha Hai Pehli Baar” গানটি অন্যরকম। এটি প্রেমের আকস্মিকতা, আকর্ষণের আচমকা অভিঘাত এবং ‘love at first sight’-এর সেই ঘূর্ণি-মুহূর্তকে ধরেছে, যেখানে যৌবন, কামনা, এবং আকাঙ্ক্ষার আবেগ একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়। গানটির ভেতরে একধরনের গতিশীলতা, উত্তেজনা, এবং যৌবনের উল্লাস আছে। এর সুরচিত্র এবং রিদম একধরনের ‘erotic pulse’ তৈরি করে, যা শ্রোতাকে আবেগতাড়িত করে।

এই গানের মনস্তাত্ত্বিক মূল্য এই যে, এটি প্রেমকে কোনও গভীর দার্শনিক আবেগ হিসেবে না দেখিয়ে, বরং শরীরী অভিজ্ঞতার প্রাথমিক অভ্যুত্থান হিসেবে তুলে ধরে। এইভাবে এটি সেই শ্রোতার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, যার প্রেমের ধারণা নৈতিকতাভিত্তিক নয়, বরং আকর্ষণভিত্তিক—অর্থাৎ প্রেমের মধ্যে যৌনতা ও চোখের কামনাও একধরনের বৈধতা পায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নব্বই দশকের মাঝামাঝি ভারতে এক নতুন ‘modern romance’-এর ভাষা নির্মাণ করে।

“Chura Ke Dil Mera” গানটি প্রেমের খেলাচ্ছলে বলা একটি উষ্ণ ও ছলনাময় অভিব্যক্তি। গানটিতে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যকার টানাপোড়েন, অভিমান, আহ্লাদ ও উস্কানি এক অনবদ্য রসায়নে ধরা পড়ে। এই গানটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটি ‘performative desire’-এর প্রকাশ, যেখানে প্রেম কেবল অনুভব নয়, বরং একটি প্রকাশ্য মঞ্চ—যেখানে চুম্বন নেই, কিন্তু তার ইঙ্গিত রয়েছে; যেখানে ছোঁয়া নেই, কিন্তু তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

এই গানের ভেতরে কামনা সরাসরি নয়, বরং ইশারার ভাষায়। এই ‘রোমান্টিক টিজিং’-এর ধরন ভারতীয় সমাজের সেই সংকোচ-সংযম-সংবরণ-এর অভ্যন্তরে থেকেও একধরনের সাহসী স্বীকৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে। “Chura Ke Dil Mera” গানে প্রেম এক প্রকার ‘game of gaze’—চাহনির খেলা, যেখানে প্রেমিক ও প্রেমিকা সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপত্তি ভাগ করে নেয়। এটি একধরনের ‘erotic equality’-র প্রতীক—যেখানে নারী কেবল অবজেক্ট নয়, বরং সাবজেক্ট-ও।

এই গানগুলো একত্রে আমাদের জানায়, নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার সংগীত কেবল আবেগের নয়, বরং মানসিক কাঠামোর প্রতিফলন। ‘Pehla Nasha’ প্রেমকে রূপকথা করে তোলে; ‘Tujhe Dekha To’ প্রেমকে সামাজিক ধারায় গ্রহণযোগ্য করে তোলে; ‘Dekha Hai Pehli Baar’ প্রেমকে কামনার ভাষা দেয়; আর ‘Chura Ke Dil Mera’ প্রেমকে একধরনের খেলায় রূপ দেয়, যেখানে লজ্জা ও উষ্ণতা একসঙ্গে বাস করে।

এই চারটি গান একটি সামগ্রিক রোমান্টিক অভিজ্ঞতার ধাপ নির্মাণ করে—প্রথম দেখার বিস্ময়, স্বপ্ন দেখা, সাহসী কামনা, এবং অনুভবের পারফর্মেন্স। এই গানগুলো একধরনের যৌথ চেতনা নির্মাণ করে—যেখানে প্রেম মানে শুধু দুটি মানুষ নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতা, একটি মানসিক খেলা, একটি সাংস্কৃতিক নাটক।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই গানগুলো ‘interpersonal fantasy’-কে সংগীতের মাধ্যমে আত্মস্থ করার সুযোগ দেয়। শ্রোতা, গান শোনার মধ্য দিয়ে, নিজের অতৃপ্তি, আকাঙ্ক্ষা, প্রেমের অভিজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতাকে একধরনের কাঠামো দেয়। এই কাঠামো কল্পিত হলেও মানসিকভাবে আরামদায়ক এবং আত্মগঠনমূলক। কারণ এতে ব্যক্তির নিজস্ব প্রেমধারণা সামাজিকভাবে অনুমোদিত রূপ পায়।

এই গানগুলোর জনপ্রিয়তা কেবল চার্টবাজারে নয়, বরং স্মৃতির ভেতর। কারণ, এগুলোর ভেতরে ছিল এমন এক আবেগ, যা সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারায় না। এই আবেগ-ভাষার মধ্য দিয়েই নব্বই দশক ভারতীয় প্রেমচেতনার অভ্যন্তরে এক অনবদ্য, বহুমাত্রিক, ও অন্তরঙ্গ যাত্রা শুরু করে।

প্লেব্যাক শিল্পীদের শক্তিশালী উপস্থিতি

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার সংগীতচর্চায় কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে আবেগের ভাষা, আত্মপরিচয়ের উৎস এবং শ্রোতার সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মাধ্যম। এই দশকের সংগীতজগৎ এমন কিছু কণ্ঠশিল্পীর জন্ম দেয়, যাঁদের কণ্ঠ নিজেই হয়ে ওঠে প্রেম, বিরহ, আকাঙ্ক্ষা ও নস্টালজিয়ার প্রতীক। সেই প্রসঙ্গে তিনটি নাম বিশেষভাবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন—উদিত নারায়ণ, কুমার শানু এবং সোনু নিগম। এই তিনজন কেবল কণ্ঠশিল্পী নন, বরং ছিলেন এক একটি আত্মিক অভিজ্ঞতার দিকচিহ্ন। তাঁদের কণ্ঠ নব্বইয়ের দশকের ভারতীয় মধ্যবিত্তের আবেগচর্চাকে সাংস্কৃতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

উদিত নারায়ণ, তাঁর সরলতা, হাসিমাখা সুর এবং কোমল উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এমন এক প্রেমিক পুরুষের কণ্ঠ নির্মাণ করেছিলেন, যার প্রেম স্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী, এবং প্রাণবন্ত। তাঁর কণ্ঠে ছিল ‘youthful brightness’—একধরনের আনন্দে ভরা আকাঙ্ক্ষা। “Pehla Nasha”, “Papa Kehte Hain”, “Tujhe Dekha To”, “Mehndi Laga Ke Rakhna”—এইসব গানে উদিতের কণ্ঠ যেন এক আশাবাদী প্রেমিকের, যে নিজের ভালোবাসা নিয়ে কখনো সংকোচ করে না।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ উদিত নারায়ণ, Image Source: Google

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, উদিতের কণ্ঠ শ্রোতার অবচেতনে একধরনের নিরাপত্তা তৈরি করে। তাঁর গায়কিতে প্রেম ছিল সরল, অগভীর নয়; বরং এমন প্রেম যা কোনো ক্লান্তি ছাড়াই প্রকাশ পায়। উদিত নারায়ণ প্রেমকে নিছক দেহাত্মক অভিপ্রায় হিসেবে নয়, বরং একধরনের জীবনের উৎসাহ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাঁর কণ্ঠ শ্রোতাকে আত্মবিশ্বাস দেয়—ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, গেয়ে ফেলা যায়, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদযাপন করা যায়।

এই উচ্ছ্বাসশীলতা নব্বই দশকের পরিবর্তনশীল ভারতীয় সমাজের মধ্যবিত্ত তরুণের মানসিক কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। যারা প্রথমবার স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, প্রেমে পড়েছিল, এবং নিজের অনুভূতিকে কবিতা বা চিঠিতে নয়, বরং গানে খুঁজছিল। উদিত সেই তরুণের কণ্ঠস্বর। তাঁর কণ্ঠে প্রেম পাওয়া যায়, হারানো নয়; অপেক্ষা নয়, বরং একত্রতা।

অন্যদিকে, কুমার শানুর কণ্ঠ নিয়ে আসে এক অন্যমাত্রিক গভীরতা। তার গায়কিতে ছিল একধরনের বিষণ্ণতা, নরমতা, এবং দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। “Jab Koi Baat Bigad Jaye”, “Do Dil Mil Rahe Hain”, “Tum Mile Dil Khile”, “Tujhe Bhula Diya”—এইসব গানে কুমার শানুর কণ্ঠ আবেগের গভীরে প্রবেশ করে।

মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, কুমার শানুর গলা একধরনের ‘empathic pain’ বহন করে। তিনি যেভাবে গান, তাতে মনে হয় তিনি শুধু গাইছেন না, বরং শ্রোতার অন্তর্জগতে ঢুকে গাইছেন। তাঁর গান একাকীত্বের, ক্ষুধার্ত আবেগের, এবং এক এমন প্রেমের যা কখনো সম্পূর্ণ হয় না। কুমার শানুর কণ্ঠে প্রেম আছে, কিন্তু সে প্রেম চিৎকার করে বলে না; সে শুধু জানায়—’তুমি না বুঝলেও আমি জানি, আমি ভালোবাসি।’

এই কণ্ঠের মধ্য দিয়ে কুমার শানু হয়ে ওঠেন সেই প্রেমিকের প্রতীক, যে ভেতর থেকে ভালোবাসে, কিন্তু বলার ভাষা পায় না। ভারতীয় সমাজে, বিশেষত পুরুষের আবেগপ্রকাশ যেখানে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত, সেখানে শানুর কণ্ঠ এক ‘licensed vulnerability’ তৈরি করে দেয়—একটা নিরাপদ পরিসর, যেখানে পুরুষও কাঁদতে পারে, ভালোবাসতে পারে, এবং অপেক্ষা করতে পারে।

তাঁর সুরগুলি খুব প্রায়ই দীর্ঘশ্বাসে ভরা, ধীর, করুণ। এই ধীরতা একটি ‘emotional anticipation’ তৈরি করে—শ্রোতা জানে না গান কোথায় যাবে, কিন্তু প্রতিটি নোটে সে ধরা দেয়, হারিয়ে যায়। শানুর কণ্ঠ ‘absence’-কে অর্থপূর্ণ করে তোলে—প্রেমিক অনুপস্থিত, তবু তার ছায়া রয়ে গেছে, তার অভাবেই যেন প্রেমের অস্তিত্ব।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ কুমার শানু, Image Source: Google

এই দুই শিল্পীর মধ্য দিয়ে যখন নব্বইয়ের বলিউড প্রেমের দুটি মেরুতে দাঁড়িয়ে—একদিকে উজ্জ্বল আনন্দ (উদিত), আর অন্যদিকে বিষণ্ণ গভীরতা (শানু)—ঠিক সেই সময় এক তৃতীয় কণ্ঠে আত্মপ্রকাশ ঘটল, যার মধ্যে ছিল উভয়ের সংমিশ্রণ, আর সেই কণ্ঠ সোনু নিগমের।

সোনু নিগমের কণ্ঠে ছিল সংগীতশিক্ষার শৃঙ্খলা, ক্লাসিক ধাঁচ, আর আধুনিক আবেগের নিখুঁত সমন্বয়। তাঁর গায়কিতে আবেগ কখনো অতিরঞ্জিত নয়, আবার কখনো ঠাণ্ডাও নয়। “Sandese Aate Hain”, “Suraj Hua Maddham”, “Kal Ho Naa Ho”, “Abhi Mujh Mein Kahin”—এইসব গানে সোনুর কণ্ঠ যেন শ্রোতাকে মনে করায়—আবেগ মানে ভারসাম্য, সংযম, এবং শব্দের ভেতরে অনুভবের পরিপক্বতা।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে সোনু নিগমের গান একধরনের ‘conscious emotional intelligence’-এর বহিঃপ্রকাশ। তাঁর গায়কিতে এক ধরণের আত্মসচেতনতা আছে—তিনি জানেন কীভাবে গানকে অনুভব করানো যায়, কিন্তু তা যেনো কখনো ন্যাকামোতে পরিণত না হয়। তাঁর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বিরতি, প্রতিটি স্পর্শ থাকে নির্মিত, পরিমিত, এবং অত্যন্ত আন্তরিক।

সোনুর কণ্ঠ শ্রোতাকে বলে—তোমার অনুভূতি সত্য, তোমার স্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা নিয়ে ভেসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং, তা নিয়ে বাঁচো, বেড়ে ওঠো, আত্মস্থ হও। এই দৃষ্টিভঙ্গি সোনুকে এক পরিণত আবেগের শিল্পী করে তোলে—যার প্রেম শুধু তারুণ্যের নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সহমর্মিতারও।

এই তিন শিল্পীর কণ্ঠ একত্রে নব্বইয়ের দশকের আবেগ-জগতের মানচিত্র নির্মাণ করে। উদিত নারায়ণ প্রেমের উচ্ছ্বাস, কুমার শানু প্রেমের যন্ত্রণা, আর সোনু নিগম প্রেমের পরিণত অভিজ্ঞতা। তাঁরা যেন এক প্রেমিকের তিনটি মনস্তাত্ত্বিক স্তর—প্রথম প্রেমের আনন্দ, প্রণয়ের ব্যর্থতা ও অপেক্ষা, আর শেষে প্রেমের শুদ্ধ সংবেদন।

এই কণ্ঠগুলি শুধুই শিল্পের নয়, বরং শ্রোতার আত্মপরিচয়ের অংশ। এই গায়করা আমাদের কণ্ঠ দিয়েছিলেন, যখন আমরা নিজের অনুভূতির ভাষা খুঁজে পেতাম না। তাঁরা আমাদের হয়ে গেয়েছেন, কেঁদেছেন, ভালবেসেছেন। এ কারণেই এই কণ্ঠ আজও শুধু গান নয়, স্মৃতি—এক মানসিক আবেশ, যা সময় অতিক্রম করে হৃদয়ে স্থায়ী হয়।

এই তিন শিল্পীর গায়কির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, সংগীত কেবল বিনোদন নয়; এটি আত্মা-ছোঁয়ার ভাষা, যা প্রেমকে, বিরহকে, কামনাকে, স্বপ্নকে ও নৈঃশব্দ্যকে অর্থ দেয়।

অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুধেশ ভোসলে

এই তিন শিল্পীর গায়কির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, সংগীত কেবল বিনোদন নয়; এটি আত্মা-ছোঁয়ার ভাষা, যা প্রেমকে, বিরহকে, কামনাকে, স্বপ্নকে ও নৈঃশব্দ্যকে অর্থ দেয়।

তবে এই আবেগভিত্তিক গায়কির পটভূমিতে কেবল পুরুষ কণ্ঠশিল্পীদের আলোচনাই যথেষ্ট নয়; নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার সংগীতচর্চায় নারীকণ্ঠ যে গভীর আবেগ, বর্ণময়তা ও সাংগীতিক পরিপক্বতা এনে দিয়েছিল, তা আলোকপাতযোগ্য। সেই প্রেক্ষিতে অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি এবং সুধেশ ভোসলে—এই তিনজন কণ্ঠশিল্পী এক অনন্য স্তরে উঠে আসেন। তাঁদের গান শুধু সিনেমার নয়, বরং এক যুগের আত্মিক ভাষা হয়ে উঠেছিল। মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনায়, তাঁদের কণ্ঠ শ্রোতার অভ্যন্তরীণ জগতে একধরনের আত্মবিশ্বাস, সহানুভূতি ও রোমান্টিক ব্যঞ্জনার উন্মোচন ঘটিয়েছে।

অলকা ইয়াগনিক সম্ভবত নব্বইয়ের দশকের সর্বাধিক প্রভাবশালী নারীকণ্ঠ। তাঁর কণ্ঠের সৌন্দর্য ছিল নরম, ভেজা, মেলোডিক এবং গভীর আবেগে পরিপূর্ণ। “Ek Do Teen”, “Tip Tip Barsa Pani”, “Kuch Kuch Hota Hai”, “Taal Se Taal”—এই গানগুলোতে অলকার কণ্ঠ যেন একসঙ্গে কামনা, অনুভব, আবেগ এবং বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কণ্ঠে নারীর যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়, তা কখনো কামনীয়, কখনো মমতাময়ী, আবার কখনো দার্শনিকও।

মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, অলকার কণ্ঠ নারীসত্তার এক ‘auditory embodiment’—শ্রোতা তাঁর কণ্ঠ শুনে একপ্রকার আত্মীয়তা অনুভব করে। তাঁর কণ্ঠে প্রেমিকাও আছে, স্ত্রীও আছে, মাতৃত্বও আছে। অলকা ইয়াগনিক একধরনের অন্তরঙ্গ আবেগের রূপায়ণ ঘটান—যেখানে কণ্ঠ নরম, কিন্তু দুর্বল নয়; সুর কোমল, কিন্তু অসম্পূর্ণ নয়। এই ব্যালান্স-ই তাঁকে একটি মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয় করে তোলে। তাঁর গানে শ্রোতা প্রেম পায়, কিন্তু নিরাপত্তাও পায়; আবেগ পায়, কিন্তু ভারসাম্যও পায়।

অন্যদিকে, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ছিলেন অনেক বেশি ভারী, আত্মপ্রত্যয়ী, এবং শাস্ত্রীয়ভাবে পরিণত। তাঁর কণ্ঠে ছিল একধরনের নৈতিক দৃঢ়তা, গাম্ভীর্য এবং জ্ঞানের অনুরণন। “Bole Chudiyan”, “Aaj Main Upar”, “Nimbooda”, “Hum Dil De Chuke Sanam”—এইসব গানে তাঁর কণ্ঠ অভিজাত, আত্মস্থ এবং এক গভীর আবেগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, কবিতার কণ্ঠ একধরনের ‘disciplinary emotion’ তৈরি করে—যেখানে আবেগ থাকে, কিন্তু তা ছলনাহীন, সংযত, এবং উদ্দেশ্যমূলক। তাঁর কণ্ঠে শ্রোতা আবেগের তীব্রতা অনুভব করে, কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। এ কারণে, কবিতার গান শোনার সময় শ্রোতা নিজের আবেগকে উপলব্ধি করে, তাতে ভেসে যায় না; বরং আত্মসচেতন হয়। কবিতা এক আত্মপ্রত্যয়ী নারীর কণ্ঠস্বর—যিনি নিজে জানেন তিনি কী অনুভব করছেন, এবং তাঁর প্রকাশ কেমন হবে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, অলকার কণ্ঠ যেখানে সম্পর্কনির্ভর, সেখানে কবিতার কণ্ঠ স্ব-নির্ভর। অলকা প্রেমিকের আকাঙ্ক্ষায় কথা বলেন, কবিতা নিজেকে জানার প্রক্রিয়ায়। এই পার্থক্য দুজনকেই এক আলাদা স্তরে প্রতিষ্ঠিত করে।

সুধেশ ভোসলে এই আলোচনায় যেন এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। যদিও তিনি কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এতখানি প্রধান নন যেমন অলকা বা কবিতা, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ নব্বইয়ের বলিউডের পুরুষ চরিত্রের ‘ভয়েস ডাবলিং’ বা মিমিক্রির এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে তাঁর অনবদ্য দক্ষতা, এবং পাশাপাশি হিউমার, ড্রামা ও থিয়েট্রিক্যাল ইফেক্ট তৈরি করার ক্ষমতা তাঁকে একটি অনন্য পরিসরে স্থান দেয়।

সুধেশ ভোসলের কণ্ঠ ছিল বহুরূপী। তিনি শুধু গায়ক নন, বরং ছিলেন একধরনের ভয়েস-অ্যাক্টর। তাঁর গান যেমন “Jumma Chumma De De”, “Sona Sona”, “Na Na Na Re” ইত্যাদিতে যে ছন্দ, উদ্দীপনা এবং মঞ্চময়তা পাওয়া যায়, তা শ্রোতাকে শুধুই আনন্দ দেয় না, বরং একধরনের পারফরমেটিভ উল্লাসে ভরিয়ে তোলে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, সুধেশের গান শ্রোতার মধ্যে একধরনের ছেলেমানুষি, উচ্ছ্বাস এবং সামাজিক নিষেধের বাইরে গিয়েও হাসার সাহস তৈরি করে।

তাঁর কণ্ঠের বহুবিধতা শ্রোতাকে একটি ‘emotional relief zone’ প্রদান করে—যেখানে গুরুগম্ভীর প্রেমের বাইরে বেরিয়ে এসে হালকা, মজাদার, কিংবা শরীরী অভিব্যক্তিরও স্থান আছে। সুধেশ যেন শ্রোতার জন্য একধরনের ‘comic catharsis’ নির্মাণ করেন। তাঁর গান শুনে মানুষ শুধু নাচে না, বরং সামাজিক চাপে জমে থাকা আবেগকে হালকাভাবে প্রকাশ করার সাহস পায়।

এই তিন শিল্পীর গায়কি, তাঁদের কণ্ঠের বৈশিষ্ট্য, তাঁদের দ্বারা নির্মিত আবেগজগৎ—সবকিছু মিলে নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমায় সংগীতকে শুধুই সুরের নয়, বরং মানসিক মুক্তির একটি ভাষায় রূপান্তরিত করে। অলকা, কবিতা ও সুধেশ—তাঁরা প্রত্যেকেই কণ্ঠ দিয়েছিলেন সেই আবেগের, যা অনেক সময় সামাজিকভাবে উচ্চারণযোগ্য নয়, কিন্তু সংগীতে প্রকাশ করা যায়।

এই কণ্ঠশিল্পীরা আমাদের শুধু গান দেননি, তাঁরা আমাদের ‘শোনার অভিজ্ঞতা’ দিয়েছেন—যেখানে আমরা শুধু শুনিনি, বরং অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি এবং আত্মিকভাবে অংশগ্রহণ করেছি। তাঁদের কণ্ঠ আমাদের ভেতরের অনুভবকে ভাষা দিয়েছে, যা বহুক্ষেত্রে অনুচ্চারিত থেকে যেত।

এই কারণেই অলকা, কবিতা ও সুধেশ বলিউড সংগীতের ইতিহাসে কেবল এক সময়ের প্রতিনিধি নন; বরং তাঁরা মানসিক কাঠামোর এক অপার ব্যাখ্যাকারী। তাঁদের কণ্ঠ শুধুই শোনা যায় না—তা অনুভব করা যায়, স্মরণ করা যায়, এবং আবারও নিজের ভেতরে ফিরে গিয়ে আবিষ্কার করা যায়।

অ্যালবাম বিক্রির বিপুল চাহিদা (T-Series, Venus ইত্যাদির বাজার দখল)

এই কারণেই অলকা, কবিতা ও সুধেশ বলিউড সংগীতের ইতিহাসে কেবল এক সময়ের প্রতিনিধি নন; বরং তাঁরা মানসিক কাঠামোর এক অপার ব্যাখ্যাকারী। তাঁদের কণ্ঠ শুধুই শোনা যায় না—তা অনুভব করা যায়, স্মরণ করা যায়, এবং আবারও নিজের ভেতরে ফিরে গিয়ে আবিষ্কার করা যায়।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সংগীতের ইতিহাসে একটি বিস্ফোরক সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ঘটনাক্রম ছিল অডিও অ্যালবাম বিক্রির অভাবনীয় চাহিদা ও তার কেন্দ্রস্থলে T-Series, Venus, Tips প্রভৃতি অডিও প্রযোজনা সংস্থাগুলোর বিপুল বাজারদখল। এটি কেবল এক ব্যবসায়িক প্রসার নয়, বরং ভারতীয় শ্রোতার মানসিক কাঠামোয় সংগীতের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতার গভীর মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর। এই প্রবন্ধ সেই সাংস্কৃতিক প্রবাহের অন্তর্লীন মনস্তাত্ত্বিক স্রোতগুলো অনুসন্ধান করে।

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে ক্যাসেট প্রযুক্তির প্রসার সংগীতভোগের অভিজ্ঞতাকে গণতান্ত্রিক করে তোলে। রেডিও ও সিনেমা হলে নির্ভরশীল শ্রোতা হঠাৎ নিজ ঘরে গান শোনার অধিকার অর্জন করে। এই অধিকার কেবল প্রবেশাধিকার নয়, বরং একধরনের আবেগীয় ‘অপনত্ব’—যেখানে গান শোনার অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। ঠিক এই জায়গাতেই অডিও কোম্পানিগুলো, বিশেষত T-Series ও Venus, এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক বাজারে প্রবেশ করে।

T-Series-এর প্রতিষ্ঠাতা গুলশন কুমার এই সময়কালকে শুধু অডিও বিপ্লব হিসেবে দেখেননি, বরং এক সাংস্কৃতিক অধিকারচর্চার প্রকল্প হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান যে সংখ্যায় ক্যাসেট প্রকাশ করত, তার মধ্যে হিন্দি ফিল্ম গান, ভজন, কাওয়ালি, লোকসংগীত এবং ধর্মীয় সংগীত একযোগে সহাবস্থান করত। এর মাধ্যমে সংগীত শ্রোতার আত্মার কাছে পৌঁছাত। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, T-Series একধরনের ‘সংগীতিক পরিচয়’ গড়ে তুলেছিল—যেখানে শ্রোতা শুধু গান শোনে না, বরং নিজেকে খুঁজে পায়।

এই সময় বাজারে অ্যালবাম বিক্রির চাহিদা হঠাৎ করে এতটা বেড়ে যায়, যা ভারতীয় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে পশ্চিমি সঙ্গীতপ্রেমী সমাজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো অবস্থানে নিয়ে যায়। যেভাবে ক্যাসেট দোকানের সামনে ভিড় জমত, নতুন রিলিজের জন্য রিকশা চালক থেকে কলেজ পড়ুয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত, তা নিছক সংগীতপ্রেম ছিল না—তা ছিল একধরনের ‘cultural hunger’। মানুষ গান চায়, কারণ গান তার আবেগের ভাষা, তার না-বলা কথা।

Venus এবং Tips কোম্পানিগুলো এই চাহিদাকে আরও বাণিজ্যিক দক্ষতায় রূপান্তরিত করে। বিশেষত Venus-এর রোমান্টিক অ্যালবাম, যেমন “Baazigar”, “Main Khiladi Tu Anari”, বা Tips-এর “Raja Hindustani”, “Tere Naam”—এইসব অ্যালবাম শুধু গান নয়, সময়ের নির্যাস হয়ে উঠেছিল। এগুলো এমন কিছু আবেগ ও স্মৃতির বাহক, যা মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মনোবিশ্লেষণে একে বলা যেতে পারে ‘aural nostalgia’—যেখানে গান শোনা মানেই সময়ভ্রমণ, মনে ফিরে যাওয়া, আবেগের পুনর্জন্ম।

T-Series-এর অ্যালবামগুলি একটি বিশেষ শ্রেণির অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাত। উদাহরণস্বরূপ, ভজন বা কাওয়ালি—এই গানগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধর্মীয় অনুরাগ, আত্মিক প্রশান্তি ও বিশ্বাসভিত্তিক আশ্রয়চর্চার অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছিল। এখানেও ছিল গভীর মনস্তাত্ত্বিক শিকড়। ভারতীয় শ্রোতা তাঁর ‘ক্লান্ত জীবনে’ প্রশান্তির খোঁজে সংগীতকে আশ্রয় করত, এবং T-Series তার জন্য বিপুল পরিমাণে গান তৈরি করেছিল।

অন্যদিকে, ভক্তিগীতি ও লোকগানের মাধ্যমে T-Series শহর-গ্রাম বিভাজন ভেঙে ফেলে। মানুষ তার ভাষা, আঞ্চলিকতা, এমনকি ধর্মীয় পরিচয়কে এই অডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে উদযাপন করত। এটা কেবল শ্রোতার আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক অধিকারচর্চাও ছিল। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এটি ছিল ‘ritualistic consumption’—অর্থাৎ প্রতিদিন সকালে বা রাতে কোনও বিশেষ অ্যালবাম শোনা, যা শুধুই অভ্যাস নয়, আত্মগঠনমূলক অভিজ্ঞতা।

Venus-এর অ্যালবামগুলো বরং একটু অন্য পরিসরের প্রতিনিধিত্ব করত। এখানে ছিল নগর-ভিত্তিক রোমান্টিকতা, নতুন প্রেমের মেলোডি, এবং যৌবনের টানাপোড়েন। শ্রোতারা এই গানে তাদের ‘প্রথম প্রেম’, ‘হারানোর অনুভব’, অথবা ‘চোখের ইশারা’ খুঁজে পেত। গানগুলি তাদের হয়ে কথা বলত। এটি একধরনের ‘empathetic representation’—যেখানে গায়ক যা গাইছেন, শ্রোতা তা কেবল শোনে না, বরং অনুভব করে—যেন গানটি তার নিজের লেখা।

সাম্প্রতিক সময়ের মানদণ্ডে অ্যালবাম বা ক্যাসেট প্রযুক্তি হয়ত অপ্রচলিত হয়ে গেছে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে নব্বইয়ের দশকের এই অভিজ্ঞতা ছিল একধরনের ‘aural intimacy’—গানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের সূচনা। একদিকে কণ্ঠস্বর, অন্যদিকে মিউজিক ভিডিও—যেগুলো T-Series প্রাথমিকভাবে বাজারে ছাড়ে—মানুষের ‘দৃষ্টিশ্রাব্য’ জগতে প্রেম, শোক, আকাঙ্ক্ষা ও উৎসবের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে।

এইসব অ্যালবামের জনপ্রিয়তা দেখে বোঝা যায়, গান কখনো একা থাকে না; সে সঙ্গে নিয়ে আসে স্মৃতি, সংস্কৃতি, আচার এবং আত্মা। মনোবিশ্লেষণে এই সময়ের অ্যালবামগুলি মানুষের অবচেতন আবেগকে সচেতন অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করেছিল। গান মানে ছিল ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ, কিন্তু একইসঙ্গে একটি সামষ্টিক অনুভবেরও অংশগ্রহণ।

এভাবেই, T-Series, Venus এবং Tips-এর মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকের ভারতীয় সংগীতশিল্প শুধু বিনোদন ছিল না, বরং তা ছিল শ্রোতার আত্মার আয়না। গান শুনে মানুষ কাঁদত, হাসত, প্রেমে পড়ত, ধর্মে মন দিত, প্রতিবাদ করত—এই বহুবিধ আবেগের স্তর একমাত্র সম্ভব হয়েছিল এই বিপুল অ্যালবাম সংস্কৃতির কারণেই।

তাই অ্যালবাম বিক্রির সেই ‘স্বর্ণযুগ’ ছিল কেবল ক্যাসেটের না, বরং মানুষের আত্মজগতে সংগীতের একটি স্থায়ী আবাসস্থল নির্মাণের ইতিহাস।

ধারা ও জনরার বিবর্তন

তাই অ্যালবাম বিক্রির সেই ‘স্বর্ণযুগ’ ছিল কেবল ক্যাসেটের না, বরং মানুষের আত্মজগতে সংগীতের একটি স্থায়ী আবাসস্থল নির্মাণের ইতিহাস।

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার একটি প্রধান ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটে—রোমান্টিক চলচ্চিত্র। এই ধারার কিছু সিনেমা শুধু বাণিজ্যিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে এমন এক প্রভাব বিস্তার করে, যা এক প্রজন্মের স্বপ্ন, প্রেমের কল্পনা এবং আত্মপরিচয় নির্মাণে মুখ্য হয়ে ওঠে। Dil (১৯৯০), Dilwale Dulhania Le Jayenge (১৯৯৫), Raja Hindustani (১৯৯৬) ও Kuch Kuch Hota Hai (১৯৯৮)—এই চারটি ছবি রোমান্টিকতার চারটি ভিন্ন মানসিক বিন্যাসকে উপস্থাপন করে। এই প্রবন্ধ সেই চিত্রগুলির ভেতরে থাকা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মনির্মাণের পাঠ খোঁজে।

Dil সিনেমাটি প্রেমকে একধরনের বিদ্রোহ এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার গল্প হিসেবে তুলে ধরে। আমির খান ও মাধুরীর চরিত্রে প্রেম আসে বংশগরিমা, সামাজিক শ্রেণিবিভাগ ও পারিবারিক স্বার্থের বিপরীতে। এই প্রেম কেবল আবেগ নয়; এটি নিজের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই ছবি ভারতীয় তরুণ-তরুণীর ভেতরের দমন ও প্রত্যাঘাতের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। প্রেম এখানে ‘against the system’—নিজের পছন্দকে সমাজের নিয়মের মুখে ছুঁড়ে দেওয়ার এক চূড়ান্ত পদক্ষেপ।

এই প্রেমিক-প্রেমিকা রোমান্সের কোনও নিঃশব্দ, সংযত সংস্করণ নয়; বরং উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা এবং সংঘাতের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। দর্শক এই সম্পর্কে নিজের মনস্তাত্ত্বিক কনফ্লিক্ট খুঁজে পায়—আমি কী চাই, আর সমাজ কী চায়? এই দ্বৈততার মধ্যে Dil প্রেমকে এক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সংগ্রাম হিসেবে উপস্থাপন করে।

অন্যদিকে, Dilwale Dulhania Le Jayenge রোমান্টিক সিনেমার ভাষা আমূল বদলে দেয়। রাজ ও সিমরানের প্রেম যেন এক ‘নতুন আদর্শ প্রেম’—যা একদিকে আধুনিক, অন্যদিকে প্রথাগত। এই সিনেমায় প্রেমিকা পালিয়ে যায় না, প্রেমিক জোর করে বিয়ে করে না—বরং অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষা মনস্তাত্ত্বিকভাবে একধরনের সামাজিক সমঝোতা, যেখানে প্রেম শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

DDLJ দর্শকের মধ্যে একধরনের ‘nostalgic modernity’ তৈরি করে—বিদেশে থেকেও ভারতীয়তা ধরে রাখা; ভালোবাসলেও ঘর-সংসার, সমাজ ও অভিভাবকের সম্মান রাখা। রাজ চরিত্রটি আত্মপ্রত্যয়ী, রোমান্টিক, কিন্তু এক্ষেত্রে সামাজিক নিয়মকে সম্মান করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই চরিত্র সেই দর্শকের প্রতিনিধি, যে স্বাধীনতা চায়, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা নয়; প্রেম চায়, কিন্তু বিদ্রোহে নয়। এই সমঝোতা প্রেমকে বাস্তবতাবাদী ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

Raja Hindustani সিনেমা প্রেমকে উপস্থাপন করে একটি রুঢ় বাস্তবের নিরিখে—শ্রেণিচেতনা, অর্থনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। রাজা একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার, আর আরতি ধনী পরিবারের মেয়ে। এই অসম সম্পর্ক মানসিকভাবে একধরনের প্রেম-আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষা। এই ছবিতে প্রেম প্রথমে মোহ, তারপর সংঘর্ষ, তারপর পুনর্মিলন—এই তিন ধাপে বিভক্ত। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই প্রেম একধরনের ‘class transcendence fantasy’—যেখানে ভালোবাসা শ্রেণি ভাঙে, পরিচয় গড়ে তোলে।

রাজা চরিত্রটি সামাজিকভাবে নিচু, কিন্তু আবেগে, সততায়, সাহসে উচ্চতর। আরতির মধ্যে দ্বন্দ্ব—সে ভালোবাসে, কিন্তু নিজের আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়তে চায় না। এই দ্বন্দ্ব ভারতীয় দর্শকের অন্তরে থাকা ‘সামাজিক নিরাপত্তা বনাম আবেগ’ দ্বৈততাকে স্পষ্ট করে তোলে। Raja Hindustani এই দ্বৈততার উত্তরণ ঘটায় আবেগের বিজয়ে, যা দর্শকের কাছে একধরনের ‘emotional wish fulfilment’ হয়ে দাঁড়ায়।

Kuch Kuch Hota Hai সিনেমাটি প্রেমের সংজ্ঞা নিয়ে এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা। এখানে প্রেম নিছক মুহূর্ত নয়, বরং সময়, উপলব্ধি এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের ফসল। রাহুল, অঞ্জলি ও টিনার চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রেমের যে দ্বান্দ্বিকতা তৈরি হয়—তা হিন্দি সিনেমায় নতুন। অঞ্জলি রাহুলকে ভালোবাসে, কিন্তু প্রকাশ করে না; রাহুল টিনাকে পায়, কিন্তু অঞ্জলিকে বোঝে না; পরে সে অনুভব করে, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। এই গল্প সেই শ্রোতার অনুভব—“যাকে চেয়েছিলাম, তাকে বলতে পারিনি”—এই অতৃপ্তির আত্মপ্রতিকৃতি।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই প্রেম ছিল এক ‘delayed recognition of love’। প্রেম এখানে কামনা নয়, বরং উপলব্ধির জন্য সময় প্রয়োজন। KKHH এর মাধ্যমে হিন্দি সিনেমা প্রেমকে একটি পরিবর্তনশীল অনুভব হিসেবে উপস্থাপন করে—যা সময়, স্মৃতি, হারানো ও পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। এটি এক ‘emotional evolution’-এর কাহিনি।

এই চারটি সিনেমা যৌথভাবে নব্বইয়ের দশকে প্রেমকে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিসরে স্থাপন করে। Dil প্রেমকে আত্মপ্রতিষ্ঠা; DDLJ প্রেমকে সামাজিক সম্মতির; Raja Hindustani প্রেমকে শ্রেণিসীমার অতিক্রমণ; আর Kuch Kuch Hota Hai প্রেমকে আত্মোপলব্ধির অন্তর্মুখী ভ্রমণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

এইসব সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকারা নিখুঁত নয়, বরং ত্রুটিপূর্ণ, দ্বিধাগ্রস্ত, আবেগপ্রবণ, এবং সেই কারণেই বাস্তবসম্মত। তাঁদের মধ্যে দর্শক নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। ফলে এই সিনেমাগুলোর সাফল্য কেবল স্ক্রিপ্ট, গান বা অভিনয়ে নয়; তা ছিল এক ‘empathic identification’-এর ফল—যেখানে চরিত্র হয়ে ওঠে দর্শকের আত্মীয়, আর প্রেম হয়ে ওঠে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এইসব সিনেমা একেকটি মনস্তাত্ত্বিক চিত্ররূপ—যেখানে প্রেম নিছক অনুভব নয়, বরং আত্ম-অন্বেষণ, আত্ম-প্রতিষ্ঠা এবং আত্ম-স্বীকারোক্তির এক দীর্ঘপথ।

পারিবারিক মেলোড্রামা

এইসব সিনেমা একেকটি মনস্তাত্ত্বিক চিত্ররূপ—যেখানে প্রেম নিছক অনুভব নয়, বরং আত্ম-অন্বেষণ, আত্ম-প্রতিষ্ঠা এবং আত্ম-স্বীকারোক্তির এক দীর্ঘপথ।

তবে নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা কেবল রোমান্টিকতার পুনরুত্থানেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সেই সময়ই জন্ম নেয় এমন এক ঘরানা, যাকে বলা যেতে পারে “পারিবারিক মেলোড্রামা”র স্বর্ণযুগ। Hum Aapke Hain Koun..! (১৯৯৪) এবং Hum Saath Saath Hain (১৯৯৯)—এই দুটি ছবি কেবলমাত্র সিনেমা নয়, বরং ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির পারিবারিক কল্পনাকে চিত্ররূপে রূপায়িত করা এক দীর্ঘ আবেগানুভূতির যাত্রা। এই প্রবন্ধে আমরা এই সিনেমাগুলোর অন্তর্নিহিত মনস্তাত্ত্বিক গঠন, আবেগীয় কাঠামো এবং দর্শকের সঙ্গে এর আত্মিক সম্পর্ক অনুসন্ধান করব।

Hum Aapke Hain Koun..! ছবিটি যেন এক ধরনের পারিবারিক ইউটোপিয়া। এখানে পরিবার মানে কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়; এটি একসঙ্গে থাকার, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার, এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক স্বপ্নময় পৃথিবী। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই ছবি ভারতীয় মধ্যবিত্ত দর্শকের অবচেতন বাসনার প্রতিফলন—একটি পরিবার, যেখানে কেউ কাউকে দুঃখ দেয় না, যেখানে বিবাদ নেই, হিংসা নেই, কেবল নিরন্তর উৎসব ও মিলনের বর্ণময়তা।

সুরজ বরজাতিয়ার পরিচালনায় গঠিত এই সিনেমা এক ধরনের ‘emotional excess’-এর আধার। পুরো সিনেমা যেন একটি ক্রমাগত রীতিনিষ্ঠ, আবেগঘন পারিবারিক রীতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। গান, রিচুয়াল, হাসি-ঠাট্টা, খেলাধুলা, উৎসব—সবকিছুই একধরনের আবেগীয় পরিবেশ নির্মাণ করে, যেখানে দর্শক নিজের অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষা, ক্ষুধা ও একাকীত্বের প্রতিপূরণ খুঁজে পায়।

মনোবিশ্লেষণের ভাষায়, এই সিনেমাটি একপ্রকার ‘wish-fulfillment fantasy’—দর্শক বাস্তবে যে সম্পর্কহীনতা, বিচ্ছিন্নতা বা বিরোধ অনুভব করে, তার এক পূর্ণাঙ্গ ‘reparation’ এই ছবিতে ঘটে। এখানে মৃত্যু আছে, কিন্তু তা-ও আবেগের ভেতরে মিশে যায়। কেউ কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। সবাই ক্ষমাশীল, সহানুভূতিশীল এবং আত্মীয়।

এই সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকারা এমন এক আবেগচর্চা করে, যা অশ্লীল নয়, বরং রুচিশীল, মর্যাদাপূর্ণ এবং ‘পারিবারিকভাবে গ্রহণযোগ্য’। প্রেম এখানে চুম্বনের নয়, চোখের ভাষার। শরীরী স্পর্শ নয়, সামাজিক অনুরণন। এই প্রেম মধ্যবিত্ত সমাজের অবচেতনে থাকা ‘সংযত প্রেম’-এর প্রতীক—যা কামনাহীন নয়, তবে লজ্জাহীনও নয়।

Hum Saath Saath Hain এই ধারা আরও বিস্তৃত করে। এখানে কেবল এক পরিবারের নয়, বরং একটি বড় যৌথ পরিবারের গল্প বলা হয়—যেখানে ভাইয়ের সম্পর্ক, বোনের আত্মত্যাগ, মা-বাবার কর্তৃত্ব, এবং আত্মীয়তার বহুস্তরীয় কাঠামো দৃশ্যমান হয়। এই সিনেমায় রয়েছে দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি—তবে সবই আবেগ ও আত্মিক শক্তির মাধ্যমে সুরাহা হয়।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই সিনেমা ‘family as emotional nation’-এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে। পরিবার যেন এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, যার অভ্যন্তরে আছে নিয়ম, সাংস্কৃতিক বিধি, সম্পর্কের রাজনীতি, আবার আন্তরিকতা ও করুণার মনস্তত্ত্ব। দর্শক এই পরিবারকে দেখে নিজের পারিবারিক সমস্যার জন্য বিকল্প এক স্বপ্ন দেখেন—যেখানে ভুল হলেও ক্ষমা আছে, দুঃখ হলেও একতা আছে।

এই সিনেমার চরিত্রগুলি নিছক মানুষ নয়, তারা যেন প্রতীক। বাবা মানে কর্তৃত্ব নয়, মমতা; মা মানে শুধু রান্নাঘর নয়, আবেগের কেন্দ্রবিন্দু; ভাই মানে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সমর্থনকারী; বউ মানে কেবল সুন্দরী নয়, সংস্কারবোধ সম্পন্ন। এই প্রতীকীকরণ দর্শকের অবচেতন ‘role expectation’-কে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করে।

এই দুই সিনেমায় মিল রয়েছে—দুটি ছবিই ‘পরিবার’কে একটি আদর্শ পরিসরে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে সবাই সুখী, সবাই একত্রে থাকে, এবং সম্পর্ক মানেই উষ্ণতা, স্নেহ, এবং পারস্পরিক সহানুভূতি। কিন্তু এই মিলের মধ্যেও সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। Hum Aapke Hain Koun..! যেখানে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যেও প্রেমকে অগ্রাধিকার দেয়, Hum Saath Saath Hain সেখানে পারিবারিক সম্পর্ককে প্রেমের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই পার্থক্য দুটি দর্শক মানসিকতার মধ্যে ভেদরেখা টানে—একটি যেখানে প্রেম কেন্দ্রীয়, অন্যটি যেখানে কর্তব্য কেন্দ্রীয়।

এই দুই ছবির প্রেক্ষিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘ritualisation of emotions’। গান, বিয়ের রীতিনীতি, খেলার সময়ের আনন্দ—এসবই যেন আবেগকে একটি ‘নিরাপদ কাঠামো’র মধ্যে উপস্থাপন করে। এই কাঠামো আবেগকে অবাধ নয়, বরং রূপক—একটি নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করে, যাতে আবেগের প্রকাশ থাকে, কিন্তু বিশৃঙ্খলা না হয়। এই নিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রকাশ ভারতীয় সামাজিক মনস্তত্ত্বে গভীরভাবে প্রোথিত।

এছাড়া, এই সিনেমাগুলিতে নারী চরিত্রের সংযম, নীরব ত্যাগ, এবং পারিবারিক সুখের জন্য আত্মবিসর্জন একধরনের আদর্শ নারীত্ব নির্মাণ করে। মনোবিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ‘sublimation of female desire’—যেখানে নারীর প্রেম, আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন পরিবারকে কেন্দ্র করেই ধাবমান হয়। এতে করে সিনেমা একধরনের সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে—যেখানে নারী পুরুষের সহচর, সন্তানের মা, এবং পরিবারের সংহতির প্রতীক।

এই দুই সিনেমার আবেগীয় পরিসর এবং তার মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা নব্বই দশকের ভারতীয় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকট, কামনা এবং নৈতিক কল্পনাকে রূপ দেয়। তারা প্রেম চায়, তবে শালীন; পরিবার চায়, তবে দ্বন্দ্বমুক্ত; আত্মত্যাগ চায়, তবে পুরস্কারযুক্ত। Hum Aapke Hain Koun..! এবং Hum Saath Saath Hain এইসব মনোবাসনার চিত্ররূপ।

এই জন্যেই এই সিনেমাগুলি শুধুই দর্শকপ্রিয় নয়, বরং তারা হয়ে ওঠে ‘cultural archetype’—যেখানে ভারতীয় পরিবার নিজের আদর্শ প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

অ্যাকশন থ্রিলার ও মাফিয়া ড্রামা

এই জন্যেই এই সিনেমাগুলি শুধুই দর্শকপ্রিয় নয়, বরং তারা হয়ে ওঠে ‘cultural archetype’—যেখানে ভারতীয় পরিবার নিজের আদর্শ প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

তবে নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা আবেগ, প্রেম ও পারিবারিকতার বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিস্তার ঘটায়—অ্যাকশন থ্রিলার ও মাফিয়া ড্রামার জগৎ। এই ঘরানায় যে ছবিগুলো একদিকে বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল, অন্যদিকে ভারতীয় দর্শকের মনস্তত্ত্বে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে Mohra (১৯৯৪), Karan Arjun (১৯৯৫) এবং Vaastav (১৯৯৯) বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই সিনেমাগুলির মাধ্যমে বলিউডে ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, প্রতিশোধের মনস্তত্ত্ব এবং সমাজে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে আত্ম-প্রতিষ্ঠার সংকল্প একটি আবেগীয় অভিব্যক্তির রূপ নেয়।

Mohra ছিল এক ক্লাসিক ‘vigilante justice’ থ্রিলার। এতে একজন সাবেক পুলিশ অফিসার, এক সাংবাদিক ও এক প্রতিশোধপরায়ণ যুবক একত্র হয়ে অপরাধ জগতের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই সিনেমার আবহ, গান, চরিত্রচিত্রণ এবং অ্যাকশন সিকোয়েন্স—সব মিলিয়ে তা এক উচ্চচাপযুক্ত আবেগের বিস্ফোরণ। মনোবিশ্লেষণে এই ছবির জনপ্রিয়তা একধরনের ‘retributive fantasy’—যেখানে আইনের ব্যর্থতার জায়গায় একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বিচার করে।

এই সিনেমায় প্রতিশোধ একটি নৈতিক কর্তব্য। অক্ষয় কুমারের চরিত্রকে যে পদ্ধতিতে রূপায়িত করা হয়, তা দেখে বোঝা যায়, দর্শকের ভেতরে জমে থাকা অসহায়তা, ক্রোধ এবং প্রতিবাদের ইচ্ছা এই চরিত্রের মাধ্যমে রূপ পায়। একেবারে সাধারণ মানুষ যখন অপরাধের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তার ‘অভ্যন্তরীণ বিচারক’ জেগে ওঠে। Mohra সেই গোপন বিচারকের কণ্ঠস্বর।

এই সিনেমার গান, বিশেষত “Tu Cheez Badi Hai Mast Mast”, একদিকে শরীরী কামনা, অন্যদিকে অন্ধকার রাজনীতির প্রতীক। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই গান ও দৃশ্যাবলী একধরনের ‘desire displacement’—যেখানে যৌনতা ও হিংসা একত্রে উপস্থাপিত হয়ে দর্শকের অবচেতন আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভের একত্র অভিব্যক্তি ঘটায়।

Karan Arjun ছিল বলিউডে পুনর্জন্ম থিমের অন্যতম সফল উপস্থাপন। এটি ছিল দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে এসে প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি। এই সিনেমার মূল থিম ছিল মা ও ছেলের সম্পর্ক, বিশ্বাস, ধর্মীয় পুনর্জন্ম ধারণা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এই ছবি একধরনের ‘mythic reassurance’—যেখানে অন্যায়, অপমান ও মৃত্যু কখনও চূড়ান্ত নয়; ন্যায়ের বিজয় এক অবধারিত ঐশ্বরিক বিধান।

এই সিনেমায় রাখি গুলজারের ‘Mere Karan Arjun Aayenge’ সংলাপ ভারতীয় সমাজের মায়ের অবচেতনে থাকা বিশ্বাস ও প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এটি শুধু সংলাপ নয়, বরং একধরনের পারিবারিক আস্থার সংস্কার—যেখানে সন্তান ফিরে আসবেই, অন্যায় পরাজিত হবেই, এবং পরিবার পুনরুদ্ধার হবেই। এই রকম একধরনের ‘emotional absolutism’ ভারতীয় মনস্তত্ত্বে গভীরভাবে প্রোথিত, যা এই সিনেমাকে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে দেয়।

Karan Arjun-এর অ্যাকশন দৃশ্যাবলি, গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, কুসংস্কার বনাম সাহসের সংঘাত, সবকিছু মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে একধরনের ‘epic emotion’—যেখানে দর্শক নিজেকে চরিত্রে নয়, বরং তাদের নিয়তির অংশ মনে করে। এই সম্মিলিত আবেগীয় সম্পৃক্ততা সিনেমাকে এক ধর্মীয় ও নৈতিক আখ্যানের পর্যায়ে তুলে নিয়ে যায়।

Vaastav সিনেমাটি এই ধারার এক পরিণত, অন্ধকার, এবং বহুবিধ মনস্তাত্ত্বিক স্তরের অধিকারী চলচ্চিত্র। এটি বাস্তব মাফিয়া-জগতের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠলেও, মূলত এটি একজন সাধারণ যুবকের ধীরে ধীরে অপরাধী হয়ে ওঠার করুণ কাহিনি। সঞ্জয় দত্তের অভিনয়ে গঠিত রঘু চরিত্রটি একধরনের ‘tragic anti-hero’। সে চায় স্বাভাবিক জীবন, কিন্তু পরিস্থিতি, দারিদ্র্য, প্ররোচনা এবং সমাজের দ্বিচারিতা তাকে ঠেলে দেয় অপরাধের পথে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে Vaastav এক ধরণের ‘identity crisis’ কাহিনি—যেখানে ব্যক্তি নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। রঘু চায় ভালো থাকতে, কিন্তু অপরাধী হয়ে ওঠে। তার ভেতরে নৈতিকতা, অপরাধ, পরিবার এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন একসঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। Vaastav এই সংঘর্ষকে নায়কোচিত করে তোলে না; বরং তা করে তোলে ট্র্যাজিক। দর্শক এই চরিত্রের মধ্যে নিজের মধ্যবিত্ত যন্ত্রণা, আত্মবিরোধ, ও সমাজের মুখোশ তুলে দেখতে পায়।

Vaastav-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য তার মায়ের সামনে আত্মসমর্পণ—“Maa, main gangster ban gaya”। এটি একটি সমাজের মুখোমুখি হওয়া—যেখানে মা মানে নৈতিকতার প্রতীক, আর সন্তান হয়ে গেছে সামাজিক বিচ্যুতির প্রতিনিধি। এই দ্বন্দ্ব ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের গভীর ব্যথা—যেখানে জীবনযুদ্ধে পড়ে গিয়ে স্বপ্ন ভেঙে যায়, নীতি হারিয়ে যায়।

এই তিনটি সিনেমা যৌথভাবে নব্বই দশকের অ্যাকশন ও মাফিয়া ঘরানাকে মানসিক ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ করে। Mohra প্রতিশোধের ফ্যান্টাসি, Karan Arjun ন্যায়ের মহাকাব্যিক বিশ্বাস, এবং Vaastav সামাজিক ব্যর্থতার ট্র্যাজেডি—এই তিনটি স্তর ভারতীয় দর্শকের আবেগ, রাগ, আশা ও আত্মপরিচয়ের বিচিত্র দিককে তুলে ধরে।

এই ঘরানার সিনেমাগুলো কেবল দর্শককে উত্তেজনা দেয়নি, বরং তার ভেতরের বিক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা এবং অপরাধচেতনার সঙ্গে মুখোমুখি করেছে। এটি ছিল একধরনের ‘cinematic catharsis’—যেখানে দর্শক সিনেমা দেখে শুধু আনন্দিত হয়নি, বরং মুক্তি পেয়েছে—নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, হতাশা ও আকাঙ্ক্ষার একটি সুরেলাভাবে নির্মিত প্রকাশ পেয়ে।

সাইকোলজিকাল থ্রিলার ও এক্সপেরিমেন্টাল

এই ঘরানার সিনেমাগুলো কেবল দর্শককে উত্তেজনা দেয়নি, বরং তার ভেতরের বিক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা এবং অপরাধচেতনার সঙ্গে মুখোমুখি করেছে। এটি ছিল একধরনের ‘cinematic catharsis’—যেখানে দর্শক সিনেমা দেখে শুধু আনন্দিত হয়নি, বরং মুক্তি পেয়েছে—নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, হতাশা ও আকাঙ্ক্ষার একটি সুরেলাভাবে নির্মিত প্রকাশ পেয়ে।

নব্বইয়ের দশকের বলিউড যেখানে একদিকে পারিবারিক মেলোড্রামা, অ্যাকশন থ্রিলার এবং রোমান্টিক ফ্যান্টাসির মাধ্যমে দর্শকের আবেগকে আশ্রয় দিয়েছিল, ঠিক সেই সময়েই আরেকটি ছোট কিন্তু গভীর প্রভাবশালী ধারার উত্থান ঘটেছিল—সাইকোলজিকাল থ্রিলার ও এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা। এই ধারার তিনটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—Baazigar (১৯৯৩), Gupt (১৯৯৭), ও Kaun (১৯৯৯)—শুধু চিত্রনাট্যের চমক বা থ্রিলের দিক থেকে নয়, বরং দর্শকের মানসিক অভ্যন্তরে ঢুকে থাকা অস্পষ্ট ভয়, সন্দেহ, অপরাধবোধ ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বকে রূপ দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা এই সিনেমাগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনা, চরিত্রগত গঠন এবং আবেগীয় স্তরের বিশ্লেষণ করব।

Baazigar ছবিটি বলিউডের রোমান্টিক নায়কের স্টিরিওটাইপকে চূর্ণ করে দেয়। শাহরুখ খানের অভিনীত চরিত্র অজয় শর্মা একদিকে রোমান্টিক, আবেগপ্রবণ এবং দয়ালু; অন্যদিকে হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ এবং ঠান্ডা মাথার খুনি। এই দ্বৈত চরিত্র নির্মাণ একধরনের ‘split personality’-র প্রতীক নয়, বরং সামাজিক এবং ব্যক্তিগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাংগঠনিক অভ্যুত্থান। মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, অজয় চরিত্রটি একটি ট্রমার ফসল। তার অতীতের দুঃসহ অভিজ্ঞতা তার মধ্যে এক ‘psychic rupture’ তৈরি করেছে, যার ফলে সে প্রেমিকের মুখোশ পরে খুন করতে পারে।

এই সিনেমা দর্শকের কাছে একটি দ্বৈত অভিজ্ঞতা তৈরি করে—একদিকে তারা চরিত্রের প্রেমিক রূপে মুগ্ধ হয়, অন্যদিকে খুনির রূপ দেখে স্তম্ভিত হয়। এই দ্বৈততা দর্শকের অবচেতনের দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। আমরা নিজেরাও বাস্তব জীবনে নানা সময় দ্বিধায় ভুগি—আমরা ভালো, কিন্তু আমাদের মধ্যে ক্ষোভও আছে; আমরা প্রেমিক, কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণও হতে পারি। Baazigar এই অভ্যন্তরীণ ‘ambivalence’কে রূপ দেয়।

Gupt সিনেমাটি থ্রিলার হিসেবে তার কাহিনির চমক এবং অসাধারণ আবহসঙ্গীতের জন্য স্মরণীয়, তবে এর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাও উপেক্ষণীয় নয়। এখানে খলনায়ক একজন নারী—ইশা (কাজল), যে প্রেমিককে পাওয়ার জন্য খুন করে। এটি একধরনের ‘female obsessive pathology’-র নিদর্শন, যা বলিউডে আগে কখনো এত তীব্রভাবে উঠে আসেনি। কাজলের চরিত্র সমাজে তৈরি হওয়া সেই ধারণার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়—যে নারী কেবল ভালোবাসে, সহ্য করে, মাফ করে। বরং সে ভালোবাসে, দাবি করে, না পেলে ধ্বংস করে।

মনোবিশ্লেষণে এই চরিত্র একধরনের ‘disrupted femininity’—যেখানে প্রেমিকাকে শুধু কামনা নয়, বরং অধিকার করে নিতে চায়, যেভাবেই হোক। এই ধ্বংসাত্মক প্রেম দর্শকের মধ্যে আতঙ্ক তো জাগায়ই, কিন্তু সেইসঙ্গে এক ধরণের অস্বস্তিকর আত্মপরিচয়ের মুখোমুখিও করে তোলে। এই সিনেমা নারী চরিত্রকে প্যাসিভ অবজেক্ট নয়, বরং অ্যাক্টিভ সাবজেক্ট করে তোলে, যার ইচ্ছা, দখল, এবং আক্রমণ করার ক্ষমতা আছে।

Gupt-এর বাকি চরিত্রগুলোর চিত্রনাট্যিক স্তর এবং প্লট-টুইস্টগুলি দর্শকের সঙ্গে একধরনের ‘mind game’ খেলে। দর্শক বিশ্বাস করতে শেখে, এবং সেই বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে সিনেমা একটি ‘psychological destabilization’ ঘটায়। এই রকম থ্রিলার কেবল টানটান উত্তেজনা তৈরি করে না, বরং দর্শককে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—কে নির্দোষ, কে দোষী? ন্যায় ও অন্যায়ের ভেদরেখা কোথায়?

Kaun সিনেমাটি সম্ভবত নব্বই দশকের বলিউডের সবচেয়ে অ্যাবস্ট্রাক্ট, এক্সপেরিমেন্টাল এবং ক্লস্ট্রোফোবিক সাইকোলজিকাল থ্রিলার। রাম গোপাল ভার্মার প্রযোজনায় অনুরাগ কাশ্যপের লেখা এই সিনেমা কেবল তিনটি চরিত্র, একটি বাড়ি, এবং এক রাতের ঘটনা ঘিরে গড়ে উঠেছে। উর্মিলা মাতণ্ডকর অভিনীত প্রধান চরিত্রটি আমাদের এমন এক নারীর মুখোমুখি করে, যার মনস্তত্ত্বের ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। সিনেমার শেষে যখন জানা যায় তিনিই সিরিয়াল কিলার, তখন দর্শকের নিজস্ব ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

এই সিনেমা একধরনের ‘psychosis on screen’—যেখানে সত্য-মিথ্যা, ভয়-আকর্ষণ, এবং বাস্তব-ভ্রান্তির ভেদরেখা চূর্ণ হয়ে যায়। দর্শক প্রথমে মহিলাকে ভিকটিম ভাবে, পরে তার পক্ষে হয়ে যায়, শেষমেশ বুঝতে পারে সে-ই আসলে অপরাধী। এই বারবার বিশ্বাস ভাঙা, সংশয় তৈরি করা, এবং শেষে এক তীব্র মানসিক ধাক্কা দেওয়া—এইসবই Kaun-এর সাইকোলজিকাল শক্তি।

মনোবিশ্লেষণে Kaun একধরনের ‘paranoid cinema’—যেখানে প্রত্যেক চরিত্রই সন্দেহজনক, এবং দর্শক নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কার ওপর বিশ্বাস করবে। এই সিনেমা কেবল গল্প নয়, বরং এক ‘mind experiment’। এটি ভয় তৈরি করে, কিন্তু ভয়টা মনস্তাত্ত্বিক—না দেখা, না বোঝা, এবং নিজেই ভুল ধারণা তৈরি করার ভয়।

এই তিনটি সিনেমা নব্বই দশকের বলিউডে থ্রিলার ঘরানাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। Baazigar দেখায় প্রতিশোধ কীভাবে প্রেমের মধ্যেই ছদ্মবেশে বাস করে; Gupt দেখায় নারী-চরিত্রের অন্ধ প্রেম কেমনভাবে হিংসায় রূপ নেয়; Kaun দেখায় মন কীভাবে বিভ্রম তৈরি করে, এবং বাস্তবতা ভেঙে পড়ে।

এই সিনেমাগুলি একধরনের ‘cinematic psychoanalysis’—দর্শকের নিজের ভেতরের অনুভব, দ্বন্দ্ব ও অন্ধকারকে আলোকিত করে। এগুলো কেবল গল্প নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি—যেখানে আমরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজেদেরই খুঁজে পাই।

কপ ড্রামা ও প্যাট্রিয়টিক সিনেমা

এই সিনেমাগুলি একধরনের ‘cinematic psychoanalysis’—দর্শকের নিজের ভেতরের অনুভব, দ্বন্দ্ব ও অন্ধকারকে আলোকিত করে। এগুলো কেবল গল্প নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি—যেখানে আমরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজেদেরই খুঁজে পাই।

নব্বইয়ের দশকের বলিউডে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারাগুলির উত্থান দেখা যায়, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল “কপ ড্রামা ও প্যাট্রিয়টিক সিনেমা”। এই ধারার চলচ্চিত্রগুলো শুধু রাষ্ট্রীয় বা বাহ্যিক চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে না, বরং ব্যক্তি, কর্তব্য, আত্মপরিচয় এবং আত্মত্যাগের অন্তর্মুখী মানসিক জগতে প্রবেশ করে। Sarfarosh (১৯৯৯), Border (১৯৯৭), এবং Ghatak (১৯৯৬)—এই তিনটি সিনেমা এই ঘরানার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, যা একদিকে অ্যাকশন-নাট্য, অন্যদিকে গভীর মনস্তাত্ত্বিক চিত্ররূপ। এই প্রবন্ধে আমরা এই সিনেমাগুলির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মানসিক গঠন, দেশপ্রেমের অন্তর্জগত এবং ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত বিশ্লেষণ করব।

Sarfarosh সিনেমাটি পুলিশের পেশার ভিতরে যে আত্মদ্বন্দ্ব, দায়িত্ববোধ, ও ব্যক্তি-রাষ্ট্র সম্পর্কের জটিলতা রয়েছে, তাকে এক সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিতে স্থাপন করে। আমির খানের অভিনীত এসিপি অজয় সিং রাঠোর চরিত্রটি একাধারে কঠোর, নিষ্ঠাবান, আবার ভেতরে গভীর আবেগপ্রবণ। তাঁর ভাই সন্ত্রাসের শিকার হওয়ায় তিনি পুলিশ পেশায় প্রবেশ করেন—অর্থাৎ, তাঁর কর্তব্যবোধ এক ব্যক্তিগত ট্রমার প্রতিফলন।

মনোবিশ্লেষণে এটি একধরনের ‘trauma-induced vocation’—যেখানে ব্যক্তি কর্তব্যকে নিজের ভেতরের শূন্যতা পূরণের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। এই সিনেমায় সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই শুধুই বাহ্যিক নয়; এটি একজন মানুষের আত্মসম্মান, বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের যন্ত্রণাময় উন্মোচন। Sarfarosh এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো—এটি দেশপ্রেমকে শ্লোগানে নয়, বরং আত্ম-অভিজ্ঞতায় রূপ দেয়।

এই সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মির্জা (নাসিরুদ্দিন শাহ), যিনি কবি, দেশপ্রেমিক, কিন্তু পরে এক প্রকার বিপথগামী হয়ে যান। মির্জা চরিত্রটি “disillusioned idealist”-এর প্রতিচ্ছবি। তিনি শিল্প ও ভালোবাসায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু বাস্তবের নিষ্ঠুরতায় তাতেই আঘাত পান। এই দ্বন্দ্ব ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণির মানসিক বাস্তবতা—যেখানে আদর্শ থাকে, কিন্তু বাস্তবতা তাকে বিকৃত করে।

Border সিনেমাটি যুদ্ধকে ঘিরে নির্মিত, তবে এর মূল থিম যুদ্ধ নয়, বরং এক ‘collective emotion’। এই ছবিতে প্রতিটি সৈনিকের পেছনে থাকে এক একটি গল্প—কারও প্রেমিকা, কারও মা, কারও ভাই। এই ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো শুধু চরিত্র নির্মাণ নয়, বরং যুদ্ধের ভেতরকার মানবিক ব্যঞ্জনা তুলে ধরার কৌশল। মনস্তাত্ত্বিকভাবে Border একটি ‘empathetic war narrative’—যেখানে শত্রুও মানুষ, সৈনিকও মানুষ, এবং মৃত্যু একধরনের সর্বজনীন বাস্তবতা।

এই সিনেমায় দেশপ্রেম আবেগীয়, কিন্তু তা হিংসাত্মক নয়। সৈনিকরা কাঁদে, হাসে, গান গায়—এবং তারপর যুদ্ধে যায়। এই স্বাভাবিকীকরণ যুদ্ধকে বাস্তব এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এতে করে দর্শক যুদ্ধকে ‘abstract nationalism’ হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিগত ত্যাগ ও সম্পর্কের ভিত্তিতে উপলব্ধি করে। Border এই আবেগপ্রবণ বাস্তবতাই তুলে ধরে—দেশপ্রেম মানে কেবল বিজয় নয়, আত্মত্যাগ, শোক এবং বন্ধুত্ব।

সানি দেওলের “Sandese Aate Hain” গানের সময় কাঁদা, চিঠি পড়া, ফেলে আসা বাড়ির কথা মনে করা—এইসব দৃশ্য যুদ্ধের বাইরের মনস্তাত্ত্বিক আঘাত প্রকাশ করে। এটা একধরনের ‘emotional collateral damage’—যেখানে যুদ্ধ শরীরকে যতটা ভাঙে, তার চেয়ে বেশি ভাঙে আত্মা।

Ghatak সিনেমাটি প্যাট্রিয়টিক ঘরানার এক অন্যমাত্রিক রূপ, যেখানে দেশের অর্থ ছোট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং দেশপ্রেম মানে স্থানিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। সানি দেওল অভিনীত কাশিনাথ চরিত্রটি একদিকে অসুস্থ, অন্যদিকে প্রতিবাদী, নির্ভীক এবং নীতিবান। এই চরিত্রে শরীর দুর্বল, কিন্তু মন অদম্য। তিনি যেভাবে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তা একধরনের ব্যক্তিগত বিপ্লব।

মনোবিশ্লেষণে কাশিনাথের প্রতিবাদ একধরনের ‘moral compulsion’—তিনি কোনও সুপারহিরো নন, কিন্তু সমাজের অন্যায় দেখতে না পারা তাঁর মানসিক বৈশিষ্ট্য। এই সিনেমায় শহরের গলি, পাড়ার লোক, গরীবের অপমান—সবকিছু মিলে এক ধরনের লৌকিক দেশপ্রেম তৈরি হয়। এখানে জাতীয় পতাকা নেই, গান নেই, কিন্তু প্রতিবাদ আছে, আত্মসম্মান আছে, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর আছে।

Ghatak-এর সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত যখন কাশিনাথ নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েও গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করেন। এটি এক ‘moral catharsis’—যেখানে দর্শক নিজের অপমান, দৈনন্দিন অসহায়তা এবং সামাজিক হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক প্রতীক পায়। এই সিনেমা বুঝিয়ে দেয়, দেশপ্রেম কেবল সীমানা রক্ষা নয়; বরং ঘরের ভিতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলাও দেশপ্রেম।

এই তিনটি সিনেমা—Sarfarosh, Border, Ghatak—ভারতীয় দর্শকের মধ্যে দেশপ্রেম, আত্মপরিচয়, দায়িত্ববোধ এবং মানবিক শোকের গভীর অনুরণন তৈরি করে। একদিকে সরকারি পেশায় যুক্ত মানুষের মানসিক কাঠামো (Sarfarosh), অন্যদিকে যুদ্ধের ব্যক্তিগত ব্যথা (Border), আবার কখনো প্রতিবাদী একক কণ্ঠের নৈতিক শক্তি (Ghatak)—এই সবই দেশপ্রেমের ভিন্ন চেহারা।

এই সিনেমাগুলি একরৈখিক দেশাত্মবোধ নয়, বরং বহুস্তরীয় আত্মানুসন্ধান। এগুলি আমাদের শেখায়—দেশ কেবল মানচিত্র নয়, বরং মানুষ; দেশপ্রেম কেবল শ্লোগান নয়, বরং আত্মত্যাগ; এবং কর্তব্য কেবল চাকরি নয়, বরং এক অন্তর্জাগতিক নৈতিক দায়।

সংলাপ ও ভাষার পরিবর্তন

এই সিনেমাগুলি একরৈখিক দেশাত্মবোধ নয়, বরং বহুস্তরীয় আত্মানুসন্ধান। এগুলি আমাদের শেখায়—দেশ কেবল মানচিত্র নয়, বরং মানুষ; দেশপ্রেম কেবল শ্লোগান নয়, বরং আত্মত্যাগ; এবং কর্তব্য কেবল চাকরি নয়, বরং এক অন্তর্জাগতিক নৈতিক দায়।

হিন্দি সিনেমায় সংলাপ একসময় নিছক তথ্যপ্রদানের মাধ্যম ছিল না; বরং তা হয়ে উঠেছিল চরিত্র, সমাজ ও দর্শকের মধ্যকার এক শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক সেতু। নব্বইয়ের দশকে এই সংলাপধর্মী প্রবণতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়, যখন সংলাপ হয়ে ওঠে চরিত্রের আবেগের বিস্ফোরণ, সমাজের প্রতিবাদ এবং নাটকীয় বাস্তবতার ভাষা। Damini (১৯৯৩), Deewana (১৯৯২), ও Zakhm (১৯৯৮)—এই তিনটি সিনেমা সংলাপের বলিষ্ঠতা, নাট্যপ্রবণতা ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতের দৃষ্টান্ত। এই প্রবন্ধে আমরা এই সংলাপভিত্তিক সিনেমাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।

Damini ছবিটি নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির নৈতিক দ্বন্দ্বের কাহিনি। মীনাক্ষী শেশাদ্রির অভিনীত দমিনি চরিত্রটি একজন সাধারণ গৃহবধূ, যিনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের শিকার এক গৃহপরিচারিকার পক্ষে আদালতে লড়াই করেন। এই ছবির সংলাপ যেন তার নিজস্ব অস্ত্র। “Tareekh pe tareekh, tareekh pe tareekh, lekin insaaf nahi mila my lord!”—সানি দেওলের উচ্চারণে এই সংলাপ কেবল আবেগ নয়, বরং দর্শকের ন্যায়বিচার না-পাওয়ার অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই সংলাপ একধরনের ‘cathartic release’—যেখানে দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা হতাশা, ক্ষোভ ও অসহায়তা মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে। এই সংলাপগুলো চরিত্রের নয়, বরং শ্রোতার। কারণ, এই সংলাপ সমাজের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা কখনও সাহস করে বলে উঠতে পারেনি। দমিনির কণ্ঠ যেন সেই নীরব নারীদের আত্মপ্রকাশ—যাদের জীবনে অন্যায় ছিল, কিন্তু ভাষা ছিল না।

এই ছবিতে সংলাপ শুধুই কথোপকথন নয়; এটি এক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আদালতের দৃশ্য, ঘরোয়া সংঘর্ষ, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব—সবকিছুতে সংলাপ মানে একটি অবস্থান, একটি বিবৃতি। সংলাপ নাটকীয়, কারণ সত্য আর মিথ্যার মাঝে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিবাদের ভাষা।

Deewana ছবিটি রোমান্স ও সম্পর্কের ভেতরে থাকা আবেগ ও টানাপোড়েনের কাহিনি হলেও, শাহরুখ খানের উপস্থিতির পর এর সংলাপচর্চা এক নতুন মাত্রা পায়। “Kya tum mere saath zindagi bhar rehogi?”—এই সরল প্রশ্ন হয়ে ওঠে এক বিস্তৃত আবেগের শিখর। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই সংলাপ একধরনের ’emotional reassurance’-এর খোঁজ, যা নব্বইয়ের দশকের দর্শক বিশেষ করে নারীদের গভীরভাবে নাড়া দেয়।

এই সিনেমার সংলাপগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবেগীয় অভ্যাসের প্রতিনিধিত্ব করে—প্রেমে সরলতা, সাহস, প্রত্যয় এবং নির্ভরতা। প্রেমিক কেবল প্রেম করছে না, সে নিজের অস্তিত্ব দিয়ে সেই প্রেমকে প্রশ্ন করছে, প্রমাণ করছে। এই সংলাপ দর্শকের ভেতরের সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন—একজন, যে শুধু ভালোবাসে না, বরং সেই ভালোবাসার দায় নিতে জানে।

মনোবিশ্লেষণে Deewana-র সংলাপ একধরনের ‘verbal emotional validation’—যেখানে চরিত্র নিজের আবেগ শুধু অনুভব করে না, প্রকাশ করতেও সাহসী হয়। এই সাহসিকতা, এই মুখোমুখি দাঁড়ানোর ভাষা নব্বইয়ের দশকের প্রেমিক দর্শকের কাছে আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

Zakhm ছিল মহেশ ভাটের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের চলচ্চিত্র। এখানে সংলাপ ছিল শান্ত, অথচ বেদনাবিধুর। “Main Hindu hoon, lekin meri maa Musalman thi”—এই একটিমাত্র সংলাপ সিনেমাটির সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক পরিধি খুলে দেয়। এই বক্তব্য নিছক পরিচয়ের নয়, বরং আত্মসম্মান, সমাজের চোখে বিচার, এবং নিজের অস্তিত্বের দ্বন্দ্বের ভাষা।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এই সংলাপ একধরনের ‘identity fracture’-এর স্বীকারোক্তি। একজন ব্যক্তি যখন ধর্ম, পরিবার এবং সমাজের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান খুঁজে পায় না, তখন তার প্রতিটি কথা হয়ে ওঠে তার মানসিক ক্লান্তির, ক্ষোভের এবং আত্মবিশ্বাসের সূক্ষ্ম মানচিত্র। Zakhm সিনেমার প্রতিটি সংলাপ যেন দর্শককে বলে—তুমি একা নও, আমিও তোমার মতোই ভেঙে পড়েছিলাম।

এই ছবির সংলাপের নাটকীয়তা নাটকীয় ভঙ্গিতে নয়, বরং সংযমের মধ্যে। এখানে সংলাপ কম, কিন্তু প্রতিটি কথা দীর্ঘ প্রতিধ্বনি তৈরি করে। এটি ‘subtle theatricality’—যেখানে উচ্চারণের নিচে রয়েছে স্তব্ধতা, আর স্তব্ধতার নিচে রয়েছে দীর্ঘশ্বাস। এই স্তরচর্চা Zakhm-কে একটি গভীর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দলিল করে তোলে।

এই তিনটি সিনেমা, তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট, কিন্তু সংলাপকে ঘিরে একটি মিল—সংলাপ শুধু কথা নয়, তা একটি অবস্থান, একটি মানসিক দ্বন্দ্বের ফাটল, একটি আবেগের চূড়ান্ত রূপ। Damini যেখানে সমাজের সামনে দাঁড়ায়; Deewana যেখানে সম্পর্কের আবেগকে রোমান্টিক দৃঢ়তায় প্রকাশ করে; Zakhm যেখানে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার ব্যথা হয়ে ওঠে—তিনটি ছবিই সংলাপকে আত্মার প্রকাশ করে তোলে।

সংলাপ, এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে, হয়ে ওঠে দর্শকের নিজস্ব কণ্ঠ। সিনেমা হলে বসে তারা কাঁদে, চমকে ওঠে, হাততালি দেয়—কারণ তারা বুঝতে পারে, এই সংলাপ তাদেরই না বলা কথা। মনোবিশ্লেষণের ভাষায় একে বলা যায় ‘emotional transfer through articulation’—যেখানে চরিত্র শুধু কথা বলে না, বরং দর্শকের হয়ে বলে।

এই জন্যেই নব্বইয়ের দশকে সংলাপের নাট্যপ্রবণতা শুধুই চমক নয়; এটি ছিল আত্মার নাটক, বাস্তবের ভাষা, এবং দর্শকের অবচেতন কণ্ঠ।

উর্দু ছায়াপাত: “আশিকি”, “ইশক”, “মহব্বত” ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার

এই জন্যেই নব্বইয়ের দশকে সংলাপের নাট্যপ্রবণতা শুধুই চমক নয়; এটি ছিল আত্মার নাটক, বাস্তবের ভাষা, এবং দর্শকের অবচেতন কণ্ঠ।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমায় উর্দু ভাষার ব্যবহারে এক অনন্য ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়, যা কেবল ভাষার অলঙ্কার ছিল না, বরং দর্শকের অবচেতন প্রেম, বেদনা ও কামনার সাংস্কৃতিক প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। “আশিকি”, “ইশক”, “মহব্বত”, “তামান্না”, “চাহত”, “হিজর”, “বেফানা”, “শায়রি”—এইসব শব্দ শুধু কবিতার অংশ ছিল না, তারা সিনেমার আবেগের গঠনেও বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। এই শব্দগুলো উচ্চারণে যেমন কোমল, তেমনি গভীর, এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে তারা এক ধরনের ভাষাহীন অনুভবকে শব্দে বাঁধার প্রয়াস। এই প্রবন্ধে আমরা উর্দু শব্দসমূহের ছায়াপাতের সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করব।

“আশিকি”—এই শব্দটি শুধুই প্রেম নয়, একধরনের আত্মনিবেদন, যেখানে প্রেমিক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোমান্টিক অ্যালবাম ‘Aashiqui’ (১৯৯০) এই শব্দকে একটি সাংগঠনিক আবেগের ভাষায় রূপ দিয়েছিল। গানগুলি যেমন “Nazar Ke Saamne”, “Dheere Dheere Se”—প্রতিটি শব্দে “আশিকি” ছিল একধরনের ‘romantic submission’।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে “আশিকি” শব্দ দর্শকের ভেতরের সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যেখানে প্রেম আত্মসমর্পণ। এই শব্দে ছিল একধরনের কোমলতা, যেটি বাংলা বা সংস্কৃত ঘরানার “প্রেম” বা “ভালবাসা”-র চেয়ে বেশি অনুভবনির্ভর, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। “আশিকি” প্রেমের না বলা অভ্যন্তরীণ আকুতি, যেখানে শরীর অনুপস্থিত, কিন্তু হৃদয়ের তীব্রতা অক্ষুণ্ণ।

“ইশক” শব্দটি উর্দু ও ফারসি ঘরানার গভীরতম প্রেমবোধের প্রতীক। এর মধ্যে রয়েছে একধরনের তীব্রতা, প্রায় আত্মবিসর্জনের প্রবণতা। “ইশক”-এ যেমন কামনা আছে, তেমনি আত্মত্যাগ, অন্ধতা, আকুলতা—সব মিলিয়ে একটি সত্তা-দহন। Ishq (১৯৯৭) সিনেমার হাস্যরসের আড়ালেও এই শব্দের অন্তরস্থ আবেগ দর্শককে স্পর্শ করে।

মনোবিশ্লেষণে “ইশক” একধরনের ‘total emotional possession’—যেখানে প্রেমিক প্রেমে নিজেকে ভুলে যায়। এই শব্দ ব্যবহারে একধরনের গাঢ় বেদনা থাকে, যেন ভালোবাসা মানে নিঃশেষ হওয়া। হিন্দি সিনেমা এই শব্দের মাধ্যমে প্রেমিকের অবচেতনে থাকা আকস্মিক, বিপর্যয়কর ও মৌন অভিজ্ঞতাকে রূপ দিয়েছে।

“মহব্বত”—এই শব্দটি প্রেমের এক বিশুদ্ধ, আত্মিক রূপ, যা কামনা ও সংযমের সংমিশ্রণে তৈরি। “Mohabbat Ki Jhuthi Kahani Pe Roye”—এইরকম শায়েরি শুধু প্রেম নয়, প্রেমে প্রতারণা, অশ্রু ও নিঃশব্দ যন্ত্রণার ভাষাও। Mohabbatein (২০০০)-এর আগে থেকেই এই শব্দ হিন্দি সিনেমার একটি আবেগীয় ইকোসিস্টেম নির্মাণ করেছিল।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে “মহব্বত” শব্দ দর্শকের মনে নিরাপদ আশ্রয়ের মতো। এটি প্রেমের কাঠিন্য নয়, বরং কোমলতার খোঁজ। এই শব্দে দর্শক খুঁজে পায় সেই প্রেম, যা হারিয়ে গেছে, কিন্তু স্মৃতিতে রয়েছে। একে বলা যায় ‘nostalgic ideal love’—যেখানে বাস্তব প্রেম ব্যর্থ হলেও শব্দের মধ্য দিয়ে তার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ থাকে।

এই শব্দগুলোর ব্যবহার হিন্দি সিনেমাকে একটি বিশেষ সেমান্টিক ও আবেগীয় পরিসরে নিয়ে গিয়েছিল, যাকে আমরা বলতে পারি “উর্দু রোমান্টিসিজম”। এই রোমান্টিসিজমে প্রেম কেবল শরীরী নয়, বরং শব্দনির্ভর, উচ্চারণনির্ভর। শব্দের ভেতরে যে রেশ, যে ধ্বনি, যে অনুভব—সেই মুহূর্তিক সংবেদনার প্রকাশ এই সিনেমাগুলিকে একধরনের ‘aural intimacy’ প্রদান করে।

উর্দু শব্দে ধ্বনিগতভাবে থাকে স্নিগ্ধতা, ব্যঞ্জনা, এবং একধরনের শ্বাসপ্রশ্বাসের সৌন্দর্য। “মহব্বত” শব্দ যেমন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো উচ্চারিত হয়; “ইশক” শব্দ যেন হৃদপিণ্ডের ধাক্কা—ছোট, কিন্তু গভীর; “আশিকি” শব্দ যেন এক কোমল ঘূর্ণি—মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই শব্দগুলি শব্দের গঠন বা অর্থের চেয়ে বেশি কাজ করে শ্রোতার ইন্দ্রিয়-আবেগ-স্মৃতির জগতে।

হিন্দি সিনেমায় এই উর্দু শব্দগুলোর প্রবেশ কেবল একটি ভাষিক প্রভাব নয়; বরং এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন—যেখানে প্রাক-আধুনিক রোমান্টিক ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এই শব্দগুলো সিনেমার গান, সংলাপ, শায়েরি, এমনকি সিনেমার শিরোনামেও বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে—“Mohabbat Zindagi Hai”, “Ishq Vishk”, “Aashiq Banaya Aapne” ইত্যাদি।

এই শব্দগুলো সিনেমার আবেগকে ‘linguistic texture’ প্রদান করে। দর্শক শুধু সিনেমা দেখে না; তারা শব্দের মধ্য দিয়ে আবেগে প্রবেশ করে। এই শব্দগুলো একধরনের শব্দানুভব তৈরি করে—যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে আবেগের মাধ্যম, ও শব্দ হয়ে ওঠে চরিত্রের আত্মপ্রকাশের উপায়।

উর্দু শব্দের এই ছায়াপাত হিন্দি সিনেমার সংলাপে একধরনের কবিতা যুক্ত করে। “Dil ko chura liya tumne”—এই বাক্যে “chura liya” শব্দদ্বয় প্রেমকে চুরির রূপ দেয়, এটি বাংলা বা হিন্দির অনুবাদে ম্লান হয়ে যায়। “Dil de diya hai, jaan tumhe denge”—এইরকম সংলাপে “de diya”, “denge”—এইসব সরল ক্রিয়াপদ উর্দু ছায়ায় গভীর অর্থ বহন করে।

এই কারণেই নব্বইয়ের দশকের সিনেমাগুলি এখনো হৃদয়ের কাছাকাছি—তারা কেবল গল্প নয়, তারা আবেগের ভাষা। তারা সেই শব্দ ব্যবহার করে, যেগুলো আমাদের ভাষার অংশ নয়, কিন্তু অনুভবের গভীর উৎস। মনোবিশ্লেষণে একে বলা যায় ‘language of longing’—যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে এক অন্তর্জাগতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

এই উর্দু ছায়াপাত হিন্দি সিনেমাকে শুধু রোমান্টিক নয়, বরং সৌন্দর্যমণ্ডিত, পরিমিত এবং সাংস্কৃতিকভাবে গভীর করে তোলে। এটি এক ভাষিক শৈলীর পুনর্নিমাণ, যা দর্শকের মানসিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করে, তাদের অনুভবকে শব্দে পরিণত করে, এবং এক গভীর আত্মিক সংযোগ তৈরি করে।

শহরকেন্দ্রিক বনাম মফস্বল-কেন্দ্রিক সংলাপ ও উপস্থাপনা

এই উর্দু ছায়াপাত হিন্দি সিনেমাকে শুধু রোমান্টিক নয়, বরং সৌন্দর্যমণ্ডিত, পরিমিত এবং সাংস্কৃতিকভাবে গভীর করে তোলে। এটি এক ভাষিক শৈলীর পুনর্নিমাণ, যা দর্শকের মানসিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করে, তাদের অনুভবকে শব্দে পরিণত করে, এবং এক গভীর আত্মিক সংযোগ তৈরি করে।

হিন্দি সিনেমার সংলাপ, ভাষা ও উপস্থাপনার কাঠামো নব্বইয়ের দশকে এক গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতামূলক রূপ পরিগ্রহ করে—যেখানে শহরকেন্দ্রিক ও মফস্বল-কেন্দ্রিক চিত্রায়ন এবং সংলাপভঙ্গিমার মধ্যে এক স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন তৈরি হয়। এই বিভাজন শুধুই ভৌগোলিক নয়; বরং এটি ছিল শ্রেণি, মানসিক গঠন, উচ্চারণ, ভাবপ্রকাশ ও সামাজিক পরিচয়ের এক প্রতিফলন। এই প্রবন্ধে আমরা এই দুই রীতির সংলাপ ও উপস্থাপনার গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করব।

শহরকেন্দ্রিক সংলাপ মানে এক প্রকার “urbane consciousness”—যেখানে চরিত্রের ভাষা হয় আত্মপ্রত্যয়ী, যুক্তিনির্ভর, এবং অনেক সময় ‘cool’ ভঙ্গিতে পরিবেশিত। এই ধরনের সংলাপে একধরনের আত্মবিশ্বাস থাকে, কিন্তু তা অনেক সময়েই আবেগের থেকে বিচ্ছিন্ন। Dil Chahta Hai, Yes Boss, Kabhi Haan Kabhi Naa—এইসব ছবির সংলাপে দেখা যায়, প্রেম বা বিরহকে নিয়েও সংলাপ যেন একধরনের পরিহাস বা আত্মসচেতন ব্যঙ্গের মোড়কে বলা হয়।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে শহরকেন্দ্রিক সংলাপ দর্শকের মধ্যে একধরনের “emotional distance” তৈরি করে। কারণ এই সংলাপ বাস্তব, যুক্তিপূর্ণ হলেও আবেগপ্রবণ নয়। এটি বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শহুরে শ্রোতাদের পরিচয়, চিন্তা ও ভাবনার প্রতিচ্ছবি। এমন দর্শক যারা নিজেকে “emotionally restrained” ভাবতে ভালবাসে, তারা এই সংলাপের মধ্যে আত্মপরিচয়ের ভাষা খুঁজে পায়।

অন্যদিকে, মফস্বল-কেন্দ্রিক সংলাপ অনেক বেশি আবেগতাড়িত, উচ্ছ্বসিত এবং সরাসরি। Ghatak, Deewana, Raja Babu, Sarfarosh, Tere Naam—এইসব সিনেমায় সংলাপ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে। উচ্চারণে থাকে স্থানিক টান, শব্দচয়ন হয় অনাড়ম্বর, কিন্তু তাতে একধরনের “visceral honesty” থাকে। এই সংলাপ দর্শকের অনুভূতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে।

মনোবিশ্লেষণে মফস্বল সংলাপ একধরনের ‘raw emotional authenticity’ প্রকাশ করে—যেখানে ভালোবাসা মানে দখল, দুঃখ মানে কান্না, প্রতিবাদ মানে চিৎকার। এতে একধরনের “emotional catharsis” হয়—যেখানে চরিত্রের ভাষা হয়ে ওঠে দর্শকের নিজের কণ্ঠ। শহরের সংলাপে যেখানে সংযম, এখানে সেখানে অবলম্বনহীন উন্মুক্ততা।

উল্লেখযোগ্য যে, শহরকেন্দ্রিক সংলাপে প্রায়শই ইংরেজি শব্দ, আধুনিক উপমা এবং বুদ্ধিদীপ্ত রসের সংমিশ্রণ দেখা যায়। “Let’s move on”, “It’s complicated”, “I need some space”—এইসব বাক্যাবলি অনেক সময়েই এমন এক মানসিক অবস্থান প্রকাশ করে, যা আবেগকে ধারণ করে, কিন্তু প্রকাশ করে না। এই সংলাপ একধরনের “emotional sophistication”-এর প্রতিনিধি।

অন্যদিকে, মফস্বলীয় সংলাপে এই পরিশীলিত সংযম থাকে না। বরং তার জায়গায় থাকে সরল বাক্য, বোলচালভাষা, এবং উচ্চারিত আবেগ—“Main tujhe bhool nahi paunga”, “Maa, main badla lunga”—এইরকম সংলাপ দর্শকের মনের গভীরে গেঁথে যায়, কারণ এদের মধ্যে কৌশল নেই, আছে আত্মিক সত্য।

এই দ্বৈতধারা চরিত্র নির্মাণেও প্রভাব ফেলে। শহরের চরিত্রেরা অনেক সময় আত্মবিশ্লেষণ করে—তারা বলে “I am confused”, “I don’t know what I feel”—এখানে দর্শক একধরনের “psychological complexity” দেখে। অথচ মফস্বলের চরিত্র নিজেকে প্রশ্ন করে না, তারা বলে “Main jo mehsoos karta hoon wahi sach hai”—এটি একধরনের “instinctive emotion”-এর বহিঃপ্রকাশ।

এই দুই ঘরানার মধ্যে নাটকীয়তার ব্যবধানও স্পষ্ট। শহুরে সংলাপ নাটকীয় হলেও অনেক সময় শুষ্ক; তারা ‘পাঞ্চ লাইন’ তৈরি করে, কিন্তু হৃদয় ছুঁতে পারে না। মফস্বলীয় সংলাপ কখনো কখনো অতিরঞ্জিত হলেও, তাতে থাকে এক অন্তরঙ্গ আবেগের নির্যাস। দর্শক এই সংলাপে কাঁদে, হাসে, চিৎকার করে। মনোবিশ্লেষণে, এটি একধরনের ‘auditory projection of affect’।

উল্লেখযোগ্য যে, নব্বইয়ের দশকে এই দ্বৈতধারার মধ্যে একধরনের মেলবন্ধনের চেষ্টাও দেখা যায়। যেমন Dilwale Dulhania Le Jayenge-এ রাজ চরিত্রটি শহুরে, কিন্তু সংলাপে প্রায়ই আবেগপ্রবণ, সরল। “Bade bade deshon mein aisi chhoti chhoti baatein hoti rehti hai”—এই সংলাপ শহরের হিউমার এবং মফস্বলের সরলতার এক মিশেল।

এই সংলাপভঙ্গি দর্শকের মানসিক পরিসরেও প্রভাব ফেলে। শহরের দর্শক সংলাপে নিজের আত্মসচেতনতা খোঁজে, মফস্বলের দর্শক সংলাপে নিজের আবেগকে প্রকাশিত হতে দেখে। ফলে সংলাপ হয়ে ওঠে কেবল ভাষা নয়, বরং আত্মপরিচয়ের আয়না।

এই জন্যেই নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা সংলাপকে শহর-মফস্বলের দ্বন্দ্বে না রেখে, বরং এক সংলগ্ন আবেগের অন্বেষণে পরিণত করে। সংলাপ কখনো শহরের নির্লিপ্ততা নিয়ে আসে, কখনো মফস্বলের তীব্রতা। তবে প্রতিবারই দর্শকের ভেতরকার কণ্ঠকে তারা ভাষা দেয়। মনোবিশ্লেষণে এই সংলাপচর্চা একধরনের ‘dialogic self-representation’—চরিত্র যেমন বলে, দর্শকও তেমনি নিজের কথা শুনে নেয়।

কবিতা, গান ও প্রেমভাষ্যের মিলন

এই জন্যেই নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা সংলাপকে শহর-মফস্বলের দ্বন্দ্বে না রেখে, বরং এক সংলগ্ন আবেগের অন্বেষণে পরিণত করে। সংলাপ কখনো শহরের নির্লিপ্ততা নিয়ে আসে, কখনো মফস্বলের তীব্রতা। তবে প্রতিবারই দর্শকের ভেতরকার কণ্ঠকে তারা ভাষা দেয়। মনোবিশ্লেষণে এই সংলাপচর্চা একধরনের ‘dialogic self-representation’—চরিত্র যেমন বলে, দর্শকও তেমনি নিজের কথা শুনে নেয়।

হিন্দি সিনেমার আবেগ-ভাষ্য শুধু দৃশ্য ও সংলাপে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বিস্তৃত হয়ে পড়ে গান ও কবিতার অলক্ষ্য এক শৈলীকাঠামোর মধ্য দিয়ে, যার সবচেয়ে সুষম ও গভীর মিলন ঘটে প্রেমের পরিসরে। নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমা এই মিলনের এমন এক উচ্চারণ নির্মাণ করে, যেখানে কবিতা, সুর ও প্রেম একে অপরকে ধারণ করে এবং এক বহুমাত্রিক মানসিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। এই প্রবন্ধে আমরা এই মিলনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা অন্বেষণ করব।

প্রেম, গান ও কবিতা—এই তিনটি পরিসরই আত্মাকে ছুঁয়ে যাওয়ার উপাদান। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমা এই উপাদানগুলিকে নিছক অলংকারের স্তরে না রেখে, বরং তা আত্মপরিচয়ের নির্যাস করে তোলে। “Tujhe Dekha To”, “Pehla Nasha”, “Baahon Ke Darmiyan”, “Chupana Bhi Nahi Aata”—এইসব গানের মধ্য দিয়ে এক গভীর ‘lyrical consciousness’ তৈরি হয়, যা কবিতার আভাস, সুরের গতি এবং আবেগের অনুরণনকে একত্র করে।

মনোবিশ্লেষণে এই মিলন একধরনের ‘aesthetic intimacy’—যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে শরীর, সুর হয়ে ওঠে মন, এবং আবেগ হয়ে ওঠে দৃষ্টির অভিপ্রায়। কবিতা এই গানে আসে শব্দের স্তর থেকে, গান তা বয়ে আনে শ্রবণের সত্তায়, আর প্রেম তার অর্থবহন করে হৃদয়ের পরিসরে।

নব্বইয়ের প্রেমগানগুলোতে উচ্চারণ, শব্দচয়ন ও অলংকারে এক বিশিষ্ট কবিতাভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়—যেমন “Nazar ke saamne, jigar ke paas”—এই ধরনের চরণগুলো শুধুই গানের কথা নয়, বরং তা অন্তরঙ্গ কবিতার চেতনা বহন করে। এই চেতনাটি শ্রোতাকে নিজের অভ্যন্তরস্থ প্রেম-সত্তার দিকে টেনে নেয়।

এই গানগুলোতে প্রেম মানে কেবল আকর্ষণ নয়, বরং এক ধরনের অনুভব-ভাষ্য—যেখানে ‘চোখের ভাষা’, ‘স্পর্শের সম্ভাবনা’, ‘হৃদয়ের ধ্বনি’ এক একটি পঙ্‌ক্তির মতো উচ্চারিত হয়। কবিতা এই গানের মধ্যে আসে—আকাশ, রাত, চাঁদ, নদী, হাওয়া, নিঃশব্দতা, অপেক্ষা, নীরবতা—এইসব চিহ্ন নিয়ে। এই চিহ্নগুলো প্রেমকে কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা করে তোলে না, বরং তা হয়ে ওঠে একটি সাংস্কৃতিক স্মৃতি।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রেমগান-কবিতার এই সংমিশ্রণ ‘internalized affective speech’-এর সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, শ্রোতা গান শুনে কেবল সুর গ্রহণ করে না; বরং নিজের ভেতরে থাকা না-বলা অনুভবগুলিকে শব্দে অনুবাদ করার উপায় খুঁজে পায়। এই জন্যেই এই গানগুলো বহু বছর পরেও মানুষ গুনগুন করে, আবৃত্তি করে—কারণ এগুলোর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের মনের এক অদৃশ্য ভাষা খুঁজে পায়।

“Baahon ke darmiyan, do pyaar mil rahe hain”—এই চরণের মধ্যে যেমন আছে শরীরী উপস্থিতির কবিতাময় ইঙ্গিত, তেমনি রয়েছে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য-আবৃত ‘existential tenderness’। এমন একটি সুরেলা ধ্বনি-সংযোগ, যেখানে শ্রোতা শুধু প্রেমিক নয়, বরং প্রেমের ভাষাও অনুভব করে।

এই গানে কবিতা কখনো রূপক, কখনো অলংকার, আবার কখনো নির্জনতার ভাষা। “Chupana bhi nahi aata, jatana bhi nahi aata”—এই ধরনের গানে অভিব্যক্তিহীনতারও এক চিত্রায়ণ ঘটে, যা কবিতার এক অনুপম গুণ—নিঃশব্দতা দিয়েও অনেক বলা যায়।

কবিতা, গান ও প্রেমভাষ্যের এই মিলন একধরনের ‘musical psychoanalysis’—শ্রোতা নিজের অজান্তেই নিজের ভিতরের অনুভবগুলো শনাক্ত করতে শেখে। এই কারণেই নব্বইয়ের গানগুলো আবেগঘন হয়ে ওঠে—এরা কেবল চমৎকার সুর নয়, বরং এক গভীর আবেগীয় স্পন্দনের মানসিক প্রতিস্বর।

এইসব গানে শব্দ ও সুরের ব্যবহার একধরনের ললিত অনুরণন তৈরি করে। যেমন “Tumse milne ko dil karta hai”—এই বাক্যে যেমন সরলতা, তেমনি গভীর অন্তঃস্থ আকাঙ্ক্ষা, যার প্রকাশ হয় আবৃত্তির মতো ছন্দে। এটি শুধুই প্রেমের নয়, বরং অস্তিত্বের আকুলতা—যেখানে অন্যকে পাওয়া মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।

এই মিলনের সাংস্কৃতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। উর্দু-হিন্দি কবিতার ঐতিহ্য, গজল-শায়রি-ভজন-লোকসুরের সংমিশ্রণ হিন্দি সিনেমার প্রেমগানকে একধরনের বহুভাষিক, বহুরুচির রসায়ন দেয়। কবিতা এখানেই এক ভাষা নয়, বরং বহু ভাষার এক আত্মস্বর। গান এই আত্মস্বরকে ছড়িয়ে দেয় শ্রোতার হৃদয়ে।

এই প্রেমভাষ্যগুলোতে নারীর অভিব্যক্তি, পুরুষের কামনা, সম্পর্কের দ্বিধা, বিরহের অপেক্ষা—সব কিছুই কবিতার মাধ্যমে সংগঠিত হয়। গান হয়ে ওঠে সেই কবিতার কণ্ঠস্বর, আর প্রেম হয়ে ওঠে সেই কণ্ঠের অনুরণন। এই ঘনিষ্ঠতা দর্শক-শ্রোতার মনে একটি আত্মিক সেতুবন্ধ গড়ে তোলে।

এই জন্যেই বলা যায়—নব্বইয়ের হিন্দি সিনেমার গান শুধুই বিনোদন নয়, বরং একধরনের ‘lyrical therapy’। প্রেম এখানে একটি অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি ভাষা। আর এই ভাষা তৈরি হয় কবিতা ও সুরের সম্মিলনে। এই সম্মিলনেই জন্ম নেয় এমন এক প্রেমভাষ্য, যা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে চিরকালীন হয়ে থাকে।

নির্মাতা ও পরিচালকদের হাতে বলিউড

সুরজ বরজাতিয়া (HAHK, HSKKH)—রুচিশীল পরিবারবাদের নির্মাতা

এই জন্যেই বলা যায়—নব্বইয়ের হিন্দি সিনেমার গান শুধুই বিনোদন নয়, বরং একধরনের ‘lyrical therapy’। প্রেম এখানে একটি অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি ভাষা। আর এই ভাষা তৈরি হয় কবিতা ও সুরের সম্মিলনে। এই সম্মিলনেই জন্ম নেয় এমন এক প্রেমভাষ্য, যা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে চিরকালীন হয়ে থাকে।

সুরজ বরজাতিয়া, নব্বইয়ের দশকের বলিউডের পারিবারিক ধারার অন্যতম নির্মাতা, এমন এক সিনেমার ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে সম্পর্ক ছিল নায়ক, পারিবারিক সৌহার্দ্য ছিল ন্যারেটিভ, এবং সৌজন্য ছিল আবেগপ্রকাশের পরিমার্জিত রূপ। Hum Aapke Hain Koun..! (১৯৯৪) ও Hum Saath Saath Hain (১৯৯৯)—এই দুটি সিনেমা কেবল মেলোড্রামা নয়, বরং ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাঙ্ক্ষিত সম্পর্কবোধ, সংস্কারচর্চা এবং রুচিশীল পারিবারিক কাঠামোর একটি আদর্শ অভিপ্রায়। এই প্রবন্ধে সুরজ বরজাতিয়ার পারিবারিক দর্শন, তাঁর চলচ্চিত্রভাষার মনস্তত্ত্ব, এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হবে।

সুরজ বরজাতিয়ার সিনেমায় পরিবার নিছক সামাজিক সংগঠন নয়, বরং এক স্নিগ্ধ আবেগিক পরিসর। সেখানে বাবা কেবল কর্তৃপক্ষ নয়, মমতাময় প্রতিভূ; মা কেবল ঘরের দায়িত্বে নয়, পারিবারিক সংগতি ও সংস্কারবোধের ধারক। ভাইয়েরা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহানুভূতিশীল; বোনেরা শুধু বিয়ের বস্তু নয়, বরং আবেগের বন্ধন। এই পারিবারিক চিত্রায়ন হিন্দি সিনেমার পূর্ববর্তী বয়ান থেকে আলাদা—যেখানে পরিবারের ভাঙন ছিল ট্র্যাজেডির উৎস। বরজাতিয়ার সিনেমায় পরিবার ভাঙে না, বরং জোড়ে।

মনোবিশ্লেষণে সুরজ বরজাতিয়ার সিনেমা একধরনের ‘emotional idealism’—যেখানে প্রতিটি চরিত্র এক ‘preferred self’-এর প্রতিচ্ছবি। দর্শক এই পরিবারে থাকতে চায়, এই সম্পর্কের ভেতর নিজেকে কল্পনা করে। এই পরিবার কখনো বাস্তব না হলেও, তার অস্তিত্ব একধরনের আবেগিক আশ্রয় তৈরি করে।

Hum Aapke Hain Koun..! সিনেমাটি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমের আখ্যান। কিন্তু এখানে প্রেমিক-প্রেমিকার গল্প অপেক্ষাকৃত গৌণ; মুখ্য হয়ে ওঠে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক আন্তরিকতা, খেলাধুলা, গান, এবং সর্বোপরি, এক ‘ritualised emotional bonding’। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই সিনেমাটি একধরনের ‘collective fantasy’—যেখানে জীবন উৎসবমুখর, সম্পর্ক সংঘাতমুক্ত, এবং আবেগ সর্বজনগ্রাহ্য।

এই সিনেমায় প্রতিটি গানে, প্রতিটি সংলাপে থাকে সৌজন্য, পরিমিতি এবং রুচির ছাপ। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলে না, কারও চোখে হিংসা নেই, বরং সবার চাহনিতে থাকে ভালোবাসার ব্যঞ্জনা। এই সৌন্দর্যচর্চা নিছক নান্দনিক নয়, বরং একটি মানসিক কাঠামোর প্রতিফলন—যেখানে দর্শক শৃঙ্খলা ও সৌহার্দ্যকে নিরাপত্তা হিসেবে কল্পনা করে।

বরজাতিয়ার সিনেমায় গান কেবল বিনোদন নয়, বরং আবেগ প্রকাশের সাংস্কৃতিক রূপ। “Didi Tera Devar Deewana” গানটি যেমন কৌতুকপূর্ণ, তেমনি সম্পর্কের লঘু উত্তেজনা প্রকাশের একটি পরিশীলিত উপায়। গান এখানে আবেগের শরীর, সম্পর্কের ছন্দ, এবং ভাষার রূপক।

Hum Saath Saath Hain সিনেমা বরজাতিয়ার পারিবারিক দর্শনকে আরও বিস্তৃত করে। এখানে এক যৌথ পরিবারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের রাজনীতি, ভুল বোঝাবুঝি এবং তা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া দেখানো হয়। কিন্তু তাতেও উত্তেজনা নেই; আছে সংযম, দুঃখ নেই, আছে সহানুভূতি। এই সংলাপ, দৃশ্য ও আচরণ একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি তৈরি করে।

এই সিনেমাগুলোকে বলা যায় এক প্রকার ‘cultural utopia’—যেখানে ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজের মানসিক কাঠামো, সমাজ-সংসারের কাঙ্ক্ষিত সংস্করণ খুঁজে পায়। এই পরিবার বাস্তবে নেই, কিন্তু তার অস্তিত্ব দর্শকের কল্পনায় অত্যন্ত জীবন্ত। এটি একধরনের ‘emotional archetype’—যেখানে সকল দ্বন্দ্বের সমাধান আছে, সকল সম্পর্কের ভেতরে সৌহার্দ্য আছে।

বরজাতিয়ার সিনেমা সমালোচকদের চোখে অনেক সময় অতিমাধুর্য ও অবাস্তব বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিনেমাগুলো আসলে ছিল একধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিপূরণ—যেখানে বাস্তব জীবনের কঠিনতা থেকে বেরিয়ে এসে দর্শক এক আবেগিক স্বপ্নলোক খুঁজে নেয়।

সুরজ বরজাতিয়া ছিলেন সেই স্থপতি, যিনি পারিবারিক সম্পর্ককে রুচিশীল, মার্জিত এবং নান্দনিক রূপে উপস্থাপন করেন। তিনি পরিবারকে নির্মাণ করেন, টুকরো করেন না। তাঁর সিনেমায় দর্শক শুধু বিনোদন খুঁজে পায় না, বরং এক ধরনের মানসিক পুনর্গঠনের সুযোগ পায়—যেখানে সম্পর্কের মধ্যে সৌজন্য, শ্রদ্ধা, এবং নীরব ভালোবাসা নতুন অর্থ পায়।

এই জন্যেই বলা যায়, সুরজ বরজাতিয়া কেবল সিনেমা নির্মাতা নন, তিনি ছিলেন এক “emotional designer”—যিনি রুচিশীল পরিবারবাদের এক আদর্শ কল্পচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, যা এখনো ভারতীয় সিনেমার আবেগভাষায় প্রতিধ্বনিত হয়।

আদিত্য চোপড়া ও করণ জোহর—নতুন যুগের সূচনা

এই জন্যেই বলা যায়, সুরজ বরজাতিয়া কেবল সিনেমা নির্মাতা নন, তিনি ছিলেন এক “emotional designer”—যিনি রুচিশীল পরিবারবাদের এক আদর্শ কল্পচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, যা এখনো ভারতীয় সিনেমার আবেগভাষায় প্রতিধ্বনিত হয়।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
চিত্রঃ আদিত্য চোপড়া, Image Source: Google

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে হিন্দি সিনেমা এক মনস্তাত্ত্বিক ও শৈল্পিক মোড় ঘোরানো পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যায়। এই পরিবর্তনের দুই প্রধান পুরোধা হলেন আদিত্য চোপড়া ও করণ জোহর। একজন Dilwale Dulhania Le Jayenge (১৯৯৫) নির্মাণ করে ভারতীয় প্রেমের ভাষাকে নতুন রূপ দেন, অন্যজন Kuch Kuch Hota Hai (১৯৯৮)-এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব, আবেগ ও সম্পর্কের এক আধুনিক সংলাপ নির্মাণ করেন। এই দুজন চলচ্চিত্রকার শুধু কিছু হিট ছবি উপহার দেননি, বরং ভারতীয় মধ্যবিত্ত ও প্রবাসী দর্শকের মানসিক গঠনের অন্দরমহলে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। এই প্রবন্ধে আমরা তাঁদের নির্মিত কাহিনির মনস্তাত্ত্বিক পাঠ ও সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা অন্বেষণ করব।

আদিত্য চোপড়ার DDLJ সিনেমাটি কেবল প্রেমের নয়, বরং পরিচয়েরও আখ্যান। এখানে রাজ চরিত্রটি আধুনিক, কিন্তু শিকড় ভুলে না; সিমরান আবেগপ্রবণ, কিন্তু দায়িত্বপরায়ণ। এই সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকা ছুটে পালায় না, বরং অনুমতি চায়। এই শৈলী ভারতীয় মধ্যবিত্ত দর্শকের এক গভীর মানসিক বাসনার প্রতিচ্ছবি—স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলার একসঙ্গে সহাবস্থান।

মনোবিশ্লেষণে, DDLJ একধরনের ‘romantic idealism with cultural containment’—যেখানে প্রেম স্বাধীন, কিন্তু পরিবারবদ্ধ। এই দ্বৈততা ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে থাকা স্ববিরোধী আকাঙ্ক্ষারই প্রতিচ্ছবি। তারা চায় প্রেম, কিন্তু সম্মতিও চায়; চায় যাত্রা, কিন্তু গৃহফেরতা-ও চায়। DDLJ এই দ্বৈত আকাঙ্ক্ষাকে একটি আনন্দময় কাঠামো দেয়।

এই সিনেমায় সংলাপ, গান, লোকেশন, এমনকি পোশাক—সবকিছুই একধরনের সংস্কৃতি-সন্ধানী আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ইউরোপের মাঠে দাঁড়িয়ে “Mehndi Laga Ke Rakhna” গান গাওয়া যেন এক নস্টালজিক সাংস্কৃতিক চেতনার প্রকাশ। এটি শুধুই গল্প নয়, বরং প্রবাসী দর্শকের মানসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

অন্যদিকে করণ জোহরের Kuch Kuch Hota Hai সিনেমাটি প্রেম, বন্ধুত্ব, স্মৃতি ও বিকল্প সম্ভাবনার এক মনস্তাত্ত্বিক জগৎ। এখানে রাহুল ও অঞ্জলির সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, বরং দুটি স্বতন্ত্র সত্তার বিকাশের কাহিনি। টিনা চলে যায়, অঞ্জলি চলে যায়, কিন্তু রাহুলের আবেগ পরিণত হয়। এই পরিণতি সময়ের সঙ্গে আবেগের অভিযোজন।

মনোবিশ্লেষণে KKHH একধরনের ‘delayed emotional realization’—যেখানে প্রেম শুধু মুহূর্ত নয়, বরং ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয়। এটি আত্মবিকাশের গল্প, প্রেমের নয়। অঞ্জলি প্রথমে পরাজিত হয়, পরে পূর্ণতা পায়—এই পূর্ণতা হলো স্বীকৃতি ও প্রাপ্তির। করণ জোহরের সিনেমায় সম্পর্ক সমীকরণ নয়, বরং অনুভূতির জটিল গ্রাফ।

এই সিনেমায় স্টাইল, পপ কালচার, পোশাক, গান—সবই চরিত্রের মানসিক গঠনের প্রকাশ। “Tujhe Yaad Na Meri Aayi”, “Ladki Badi Anjaani Hai”—এইসব গানে প্রেম হয় অভিমান, দুঃখ ও নস্টালজিয়ার ভাষা। এইসব গান শ্রোতাকে তার নিজের স্মৃতি ও না বলা কথা মনে করিয়ে দেয়।

আদিত্য চোপড়া ও করণ জোহরের সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল—এরা প্রেমকে নিছক আকর্ষণ বা কামনার জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সম্পর্কের মানসিক ভেতর দিকটি আবিষ্কার করেন। এরা দর্শকের মনকে বোঝেন এবং সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, সংশয় ও সম্ভাবনাকে দৃশ্যত করে তোলেন।

করণ জোহর
চিত্রঃ করণ জোহর, Image Source: Google

তাঁদের সিনেমায় মা-বাবা, বন্ধু, শিক্ষক, আত্মীয়—সব চরিত্রের মধ্যেই থাকে আবেগীয় গভীরতা। এই আন্তঃসম্পর্ক গঠনের ফলে প্রেমের বৃত্ত সম্প্রসারিত হয়—তাতে শুধু দুইজন নয়, পুরো সামাজিক কাঠামো জড়িয়ে পড়ে। মনোবিশ্লেষণে একে বলা যায় ‘relational romanticism’—যেখানে প্রেম একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা।

এই দুই নির্মাতা হিন্দি সিনেমার পুরনো নাট্যরীতিকে নতুন সময়, নতুন মন এবং নতুন ভাষার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আদিত্য চোপড়ার প্রেমিক ধীর, গভীর ও সংস্কারময়; করণ জোহরের প্রেমিক আবেগপ্রবণ, দ্বিধাগ্রস্ত, কিন্তু সাহসী। এই দুই বৈশিষ্ট্য মিলেই নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী প্রেম-ভাষ্য গড়ে ওঠে।

এইজন্য বলা যায়—আদিত্য চোপড়া ও করণ জোহর কেবল গল্পকার নন, তাঁরা ছিলেন যুগপ্রবর্তক। তাঁরা দর্শকের মনে সুর তৈরি করেছেন, সেই সুরে প্রেম, বিরহ, আত্মদ্বন্দ্ব ও প্রাপ্তির নৈঃশব্দ্য বুনেছেন। তাঁদের হাতে হিন্দি সিনেমা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে—যেখানে হৃদয় শুধু ভালোবাসে না, বরং নিজেকে বোঝে।

রাজকুমার হিরানি, রাজকুমার সান্তোষী, অনুরাগ বসু—সামাজিক দায়বদ্ধতার চিন্তা

এইজন্য বলা যায়—আদিত্য চোপড়া ও করণ জোহর কেবল গল্পকার নন, তাঁরা ছিলেন যুগপ্রবর্তক। তাঁরা দর্শকের মনে সুর তৈরি করেছেন, সেই সুরে প্রেম, বিরহ, আত্মদ্বন্দ্ব ও প্রাপ্তির নৈঃশব্দ্য বুনেছেন। তাঁদের হাতে হিন্দি সিনেমা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে—যেখানে হৃদয় শুধু ভালোবাসে না, বরং নিজেকে বোঝে।

যেখানে বলিউড নব্বইয়ের দশকে রোমান্টিকতা, পারিবারিকতা এবং স্টার-সিস্টেম ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই কয়েকজন নির্মাতা—রাজকুমার হিরানি, রাজকুমার সান্তোষী এবং অনুরাগ বসু—সিনেমাকে শুধুই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে, একধরনের সামাজিক ও নৈতিক প্রতিক্রিয়ার প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করেন। তাঁদের সিনেমায় বিনোদন এবং বক্তব্য একসঙ্গে চলে, হাসির আড়ালে থাকে ব্যঙ্গ, এবং আবেগের নিচে লুকিয়ে থাকে গভীর দায়বদ্ধতা। এই প্রবন্ধে তাঁদের চলচ্চিত্র-চিন্তার মনস্তাত্ত্বিক পাঠ এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হবে।

রাজকুমার হিরানি এমন এক নির্মাতা যিনি মানবিকতার মৌলিক প্রশ্নগুলোকে সহজভাষায়, বিনোদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেন। Munna Bhai M.B.B.S., Lage Raho Munna Bhai, 3 Idiots কিংবা PK—প্রত্যেকটি সিনেমাই একধরনের ‘didactic entertainment’—যেখানে দর্শক হাসে, আবার ভাবেও। এই সিনেমাগুলোর সংলাপ, চরিত্র ও আবহে থাকে একধরনের ‘moral cognitive dissonance’—যেখানে দর্শক নিজের দৈনন্দিন মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে শেখে।

মনোবিশ্লেষণে হিরানির সিনেমা একধরনের ‘empathetic realism’—যেখানে নিখুঁত চরিত্র নেই, কিন্তু প্রত্যেক চরিত্র সংশোধনের পথে যায়। মুন্না ভাই চরিত্রটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাঠামোর বিরুদ্ধে ভালোবাসা ও সংবেদনার পক্ষে দাঁড়ায়। এখানে চিকিৎসা মানে কেবল প্রেসক্রিপশন নয়, বরং শ্রবণ, স্পর্শ, এবং মনোযোগ। Lage Raho Munna Bhai-এ গান্ধীবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় নিছক বক্তৃতার মাধ্যমে নয়, বরং আন্তরিক আচরণে। এই পুনর্ব্যাখ্যা একধরনের ‘values through behavior’-এর পথ নির্মাণ করে।

3 Idiots-এ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা এবং আত্মনির্ভরতা ও আবেগকে কেন্দ্র করে ক্যারিয়ার ভাবনার নির্মাণ—এগুলি কেবল কাহিনি নয়, বরং হাজার হাজার ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীর মানসিক কাঠামোতে এক স্থায়ী পরিবর্তন আনে। হিরানির এই সব ছবিই ‘institutional critique with emotional healing’-এর দৃষ্টান্ত।

অন্যদিকে রাজকুমার সান্তোষী তাঁর সিনেমায় আরও বেশি স্পষ্ট ও আবেগতাড়িত রাজনৈতিক ও সামাজিক বক্তব্য রাখেন। Damini, Ghayal, Ghatak, The Legend of Bhagat Singh—প্রত্যেকটিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একক মানুষের কাহিনি। এই চরিত্রগুলো নিছক সুপারহিরো নয়, বরং তারা সাধারণ, আবেগপ্রবণ, ভীত, কিন্তু ন্যায়ের জন্য অটল। মনোবিশ্লেষণে এই চরিত্রগুলো একধরনের ‘moral surrogacy’—দর্শকের মধ্যে যেসব প্রতিবাদ জমা থাকে, তা চরিত্রের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়।

Damini সিনেমাটি এক নারীর প্রতিবাদের গল্প, যেখানে আইন, সমাজ এবং পরিবার সকলেই অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, কিন্তু দমিনি নিজের ভেতরের নৈতিক শক্তির ওপর ভরসা করে লড়ে যায়। এই সিনেমা দর্শকের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিবাদের এক ‘visceral template’ তৈরি করে।

রাজকুমার সান্তোষীর সিনেমায় সংলাপ, আবেগ, সাউন্ড, এমনকি অ্যাকশন—সবকিছুই একধরনের থেরাপি। দর্শক সেখানে কেবল গল্প দেখে না; সে তার নিজের অবদমন, অবিচার ও রাগকেও চরিত্রের মধ্য দিয়ে মুক্তি দেয়। একে বলা যায় ‘cinematic catharsis through confrontation’—যেখানে সান্তোষীর সিনেমা একধরনের মানসিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে সক্রিয় সত্তার জাগরণ ঘটায়।

অনুরাগ বসুর সিনেমায় যদিও সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য নেই, কিন্তু তাঁর সিনেমাগুলো আত্মিক জটিলতা, সম্পর্কের অনির্ধারিততা এবং ভঙ্গুরতার মধ্য দিয়ে একধরনের নীরব সামাজিক পাঠ নির্মাণ করে। Life in a… Metro, Barfi!, Jagga Jasoos—এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে তিনি দর্শককে শেখান—প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে থাকে অসম্পূর্ণতা, প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে থাকে অসম্পূর্ণ প্রেম, কিন্তু তার মধ্যেও সৌন্দর্য রয়েছে।

মনোবিশ্লেষণে অনুরাগ বসুর সিনেমা একধরনের ‘existential emotionality’—যেখানে ভালোবাসা মানে না পাওয়া, আশা মানে একা থাকা, কিন্তু তার মধ্যেও একধরনের করুণা, ধৈর্য এবং সহানুভূতি বিকশিত হয়। Barfi! সিনেমায় বাকপ্রতিবন্ধী প্রেমিক-প্রেমিকা আমাদের বোঝায়—প্রেম ভাষার নয়, অনুভবের; আর অনুভবের সমাজ-নির্ধারিত কাঠামো নেই।

এই নির্মাতারা প্রত্যেকেই সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সিনেমার ভাষার অন্তর্গত করেছেন। কেউ করেন শ্লোগানহীন মানবিকতায় (হিরানি), কেউ করেন ধ্বংসাত্মক প্রতিবাদে (সান্তোষী), কেউ করেন নিঃশব্দ অসহায়তার আবেশে (বসু)। তাঁদের সিনেমা কেবল ন্যারেটিভ নয়, বরং একধরনের মানসিক সঞ্চার, সামাজিক বিকার, এবং নৈতিক প্রতিচিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে।

এই কারণেই বলা যায়—রাজকুমার হিরানি, রাজকুমার সান্তোষী ও অনুরাগ বসু হিন্দি সিনেমায় এমন এক ধারার জন্ম দিয়েছেন, যেখানে দর্শক শুধু দেখে না, বরং উপলব্ধি করে; কেবল সময় কাটায় না, বরং নিজেকে প্রশ্ন করে। তাঁদের নির্মিতি হয়ে ওঠে এক সামাজিক আয়না, এক মনস্তাত্ত্বিক আর্তনাদ, এবং এক নৈতিক আহ্বান।

মহেশ ভাট ও তার রিয়েলিস্টিক ঘরানা (Zakhm, Sir)

এই কারণেই বলা যায়—রাজকুমার হিরানি, রাজকুমার সান্তোষী ও অনুরাগ বসু হিন্দি সিনেমায় এমন এক ধারার জন্ম দিয়েছেন, যেখানে দর্শক শুধু দেখে না, বরং উপলব্ধি করে; কেবল সময় কাটায় না, বরং নিজেকে প্রশ্ন করে। তাঁদের নির্মিতি হয়ে ওঠে এক সামাজিক আয়না, এক মনস্তাত্ত্বিক আর্তনাদ, এবং এক নৈতিক আহ্বান।

মহেশ ভাট হিন্দি সিনেমায় এক অনন্য রিয়েলিস্টিক ঘরানার রূপকার, যার মূল ভিত্তি ছিল আত্মজৈবনিক বেদনাবোধ, সম্পর্কের জটিলতা এবং সমাজ-ধর্ম-মানসিক বিভাজনের অন্তরালে থাকা নিঃশব্দ আর্তনাদ। নব্বইয়ের দশকে তাঁর দুটি অন্যতম সৃষ্টি—Zakhm (১৯৯৮) ও Sir (১৯৯৩)—এই ঘরানার গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তবতামূলক রূপরেখা বহন করে। এই প্রবন্ধে আমরা মহেশ ভাটের নির্মাণশৈলী, ন্যারেটিভ বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্রগত মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করব।

Zakhm সিনেমাটি যেন এক ব্যক্তিগত আত্মজিজ্ঞাসার উপাখ্যান। এখানে প্রধান চরিত্রের (অজয়) ভেতরে রয়েছে এক গভীর ফাটল—ধর্মীয় পরিচয়, পারিবারিক সংকট এবং সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে বিভক্ত হয়ে থাকা এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মা ছিলেন মুসলমান, বাবা হিন্দু, কিন্তু সমাজ তাঁদের সম্পর্ককে মেনে নেয়নি। এই সিনেমার কেন্দ্রে রয়েছে সেই দীর্ঘকালীন বেদনাবোধ, যাকে সিনেমা নির্মাতা মহেশ ভাট নিজেই ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছেন।

মনোবিশ্লেষণে Zakhm একধরনের ‘trauma narrative’—যেখানে অতীতের অব্যক্ত ব্যথা বর্তমানের আত্মস্মৃতি হয়ে ফিরে আসে। এই সিনেমার প্রতিটি সংলাপ, দৃশ্য, এমনকি নীরবতাও যেন একধরনের মানসিক কষ্টের নিঃশব্দ রূপ। “Main Hindu hoon, lekin meri maa Musalman thi”—এই সংলাপ কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের নয়, বরং আত্মপরিচয়ের সংকটের এক বেদনা-বিধুর স্বীকারোক্তি।

এই সিনেমার মায়ের চরিত্র একাধারে যন্ত্রণাময়, স্নেহময় এবং অসহায়। তাঁর মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু চোখে থাকে একধরনের নৈঃশব্দ্যপূর্ণ প্রতিবাদ। এই চরিত্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সকল নারীর কথা, যারা সমাজের কঠোরতার আড়ালে নিজেদের ব্যথা চেপে রাখে। মনোবিশ্লেষণে, এই মা চরিত্র ‘silent resilience’-এর প্রতীক।

Sir সিনেমাটি এক তরুণ শিক্ষকের ও তাঁর ছাত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্কের মাঝে সমাজের শ্রেণিবিভাজন, অপরাধ ও অরাজকতার অবস্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এখানে অনু কাপুরের চরিত্রে আমরা দেখি এক শিক্ষক, যিনি শিক্ষাকে নিছক পেশা হিসেবে নয়, বরং মানবিক মুক্তির উপায় হিসেবে দেখেন। শিক্ষার্থী পূজার (অতীতা) চরিত্র তার প্রেমে পড়ে, কিন্তু সেই প্রেম ‘সমান অবস্থান’-এর মধ্যে নয়। শিক্ষক তা প্রত্যাখ্যান করেন—শ্রেণিগত পার্থক্য এবং নৈতিক চেতনার কারণে।

এই সিনেমায় শিক্ষকের চরিত্র নিছক আদর্শবাদী নয়; বরং তাঁর মধ্যে দ্বন্দ্ব, আবেগ ও দায়িত্ববোধের সংঘাত চলে। তিনি চায় ভালোবাসতে, কিন্তু ভয় পায় সমাজ, নিজের অবস্থান এবং ছাত্রীর ভবিষ্যতের জন্য। এই দ্বন্দ্ব মনোবিশ্লেষণে একধরনের ‘ethical repression’—যেখানে নৈতিকতা নিজের আবেগকে দমন করে।

Sir সিনেমায় প্রেম নিছক আকর্ষণ নয়, বরং এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষণ। পূজার প্রেম তার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা এবং ভালোবাসার খোঁজের প্রতিফলন। এই প্রেম একধরনের ‘emotional compensation’—যেখানে মেয়েটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একমাত্র শিক্ষকের মধ্যেই নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।

মহেশ ভাটের সিনেমার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো—সাউন্ড ও নীরবতার মধ্যকার দ্বৈততা। তাঁর সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কখনও উচ্চকণ্ঠ নয়; বরং সংবেদনশীল, বিষণ্ণ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করে। এই নীরবতা চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে আরও প্রগাঢ় করে তোলে।

এই নির্মাতা কোনো রকম অলংকারে বিশ্বাস করেন না। তাঁর সিনেমায় চিত্রগ্রহণ, আলো, পোশাক, মেকআপ—সব কিছু থাকে ‘understated’। তিনি দর্শককে চমকে দিতে চান না, বরং ধীরে ধীরে এক গভীর আবেগে নিমজ্জিত করতে চান। এই নির্মাণশৈলী একধরনের ‘empathic realism’—যেখানে দর্শক কাঁদে না দৃশ্য দেখে, বরং নিজের ভেতরের অস্পষ্ট কষ্টগুলিকে দৃশ্যপটে খুঁজে পেয়ে কাঁদে।

মহেশ ভাট হিন্দি সিনেমায় সম্পর্ক, আত্মপরিচয়, ধর্মীয় সংঘাত ও সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা—এই সব কিছুকে এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন—সবচেয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-ই সবচেয়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে, যদি তা যথার্থভাবে বলা যায়।

এই জন্যেই বলা যায়—মহেশ ভাটের সিনেমা নিছক রিয়েলিজম নয়, বরং একধরনের ‘psycho-emotional realism’—যেখানে সমাজ মানসিকতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, আর সম্পর্ক হয়ে ওঠে সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাঁর নির্মাণে দর্শক শুধু চরিত্র দেখে না, বরং নিজের জীবনের কিছু না বলা অধ্যায় দেখতে পায়।

প্রযোজনা হাউজের প্রসার: YRF, Dharma, Tips, T-Series

এই জন্যেই বলা যায়—মহেশ ভাটের সিনেমা নিছক রিয়েলিজম নয়, বরং একধরনের ‘psycho-emotional realism’—যেখানে সমাজ মানসিকতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, আর সম্পর্ক হয়ে ওঠে সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাঁর নির্মাণে দর্শক শুধু চরিত্র দেখে না, বরং নিজের জীবনের কিছু না বলা অধ্যায় দেখতে পায়।

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমা কেবল বিষয়বস্তু বা নায়কনির্ভর ছিল না; বরং সিনেমার বাণিজ্যিক, শৈল্পিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিল প্রযোজনা হাউজগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রসার। Yash Raj Films (YRF), Dharma Productions, Tips Films ও T-Series—এই চারটি প্রযোজনা সংস্থা কেবলমাত্র সিনেমা নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা গড়ে তুলেছিল একেকটি আবেগীয় ব্র্যান্ড, যার ভিতর দিয়ে ভারতীয় দর্শকের রুচি, আকাঙ্ক্ষা ও সাংস্কৃতিক কল্পনা নির্মিত হতে থাকে। এই প্রবন্ধে আমরা এই প্রযোজনা হাউজগুলোর মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত ও সাংগঠনিক প্রভাব বিশ্লেষণ করব।

YRF বা Yash Raj Films-এর উত্থান হিন্দি সিনেমায় এক নতুন ঘরানার জন্ম দেয়—যেখানে প্রেম, পারিবারিকতা এবং চমৎকারিত্ব মিশে তৈরি হয় এক ধরনের পরিশীলিত আবেগীয় বাস্তবতা। যশ চোপড়া ও পরে আদিত্য চোপড়ার হাত ধরে YRF শুধু সিনেমা নির্মাতা নয়, বরং ‘sentiment stylist’ হয়ে ওঠে। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Mohabbatein, Dil To Pagal Hai—এই ছবিগুলো শুধুই কাহিনি নয়, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে প্রেম নিছক আকর্ষণ নয়, বরং আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান।

মনোবিশ্লেষণে YRF-এর সিনেমা ‘emotional branding’-এর প্রতীক—যেখানে প্রতিটি চরিত্র এক একটি আত্মিক প্রতিমা, প্রতিটি গান এক একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি, এবং প্রতিটি দৃশ্য এক একটি কল্পনার প্রতিস্বর। দর্শকের হৃদয় YRF-এর চলচ্চিত্রভাষায় একধরনের আশ্রয় খুঁজে পায়। তারা সেই পরিবার চায়, সেই প্রেম চায়, সেই জীবন চায়—যা পর্দায় দেখা যায়।

Dharma Productions, যেটি যশ জোহরের হাতে শুরু হলেও করণ জোহরের নির্মাণশৈলীতে নব্বইয়ের দশকে এক মৌলিক সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ নির্মাণ করে। Kuch Kuch Hota Hai থেকে Kabhi Khushi Kabhie Gham—এই সিনেমাগুলো পরিবার, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়ের এক আধুনিক উপাখ্যান রচনা করে। করণ জোহরের নির্মিতি একদিকে পশ্চিমী স্টাইল, অন্যদিকে ভারতীয় আবেগের এক স্বতন্ত্র সংমিশ্রণ।

মনোবিশ্লেষণে Dharma-র সিনেমা একধরনের ‘aesthetic catharsis’—যেখানে পোশাক, দৃশ্য, আবহসঙ্গীত—সবকিছু এক বিলাসিতার পরিসর তৈরি করে, যার মধ্যে দর্শক তার নিজস্ব অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ খুঁজে পায়। করণ জোহরের সিনেমা কেবল আবেগকে উৎসব করে তোলে না, বরং আবেগকে প্রদর্শনের একটি সুরুচিপূর্ণ পরিসর দেয়। এ যেন এক ‘designer emotion’।

Tips Films-এর আবির্ভাব মূলত সংগীতনির্ভর সিনেমা এবং স্টার-কেন্দ্রিক বিন্যাসের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। Soldier, Tere Naam, Ajab Prem Ki Ghazab Kahani—এইসব সিনেমায় গল্পের থেকে গান ও রোমান্টিক দৃশ্য বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু এই গানের মধ্যেই থাকে দর্শকের একধরনের অন্তর্লীন মানসিক আর্তনাদ। Tips সিনেমা নির্মাণকে সরল রাখে, কিন্তু আবেগে ভারী করে।

মনোবিশ্লেষণে Tips একটি ‘melodic escapism’-এর নির্মাতা—যেখানে প্রেম মানে দুঃখ, বিরহ মানে সৌন্দর্য, আর গান মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সুর। এই নির্মাণশৈলী মধ্যবিত্ত দর্শকের অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনা ও আত্মপ্রতিচ্ছবির ভাষা নির্মাণ করে। গান হয়ে ওঠে সেই পরিসর, যেখানে দর্শক নিজের অভ্যন্তরীণ ভালোবাসা প্রকাশের স্থান খুঁজে পায়।

T-Series মূলত সংগীত প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে শুরু হলেও নব্বইয়ের দশকে সিনেমা প্রযোজনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। Aashiqui, Dil Hai Ke Manta Nahin, Jeet, Pardes—এইসব সিনেমা মূলত সংগীতনির্ভর আবেগপ্রবণ সম্পর্কের ওপর নির্মিত। T-Series যে কেবল হিট গান দিয়েছিল তা-ই নয়, বরং একধরনের ‘emotional mass accessibility’ তৈরি করেছিল—যেখানে দর্শক নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে সহজেই।

মনোবিশ্লেষণে T-Series-এর সিনেমা ছিল একধরনের ‘emotional democratization’—যেখানে আবেগ কোনো উচ্চবিত্ত নান্দনিক অভিজ্ঞান নয়, বরং প্রতিটি দর্শকের অভ্যন্তরস্থ ভাষা। এই সংস্থার গান ও দৃশ্য সাধারণের মনস্তত্ত্বের খুব কাছাকাছি চলে আসে—বিনিময়ে দর্শক পায় আবেগের সহজ, গ্রহণযোগ্য কাঠামো।

এই সব প্রযোজনা সংস্থার প্রসার কেবল বিনিয়োগ বা বিতরণের ক্ষেত্রেই নয়; বরং দর্শকের মানসিক কাঠামো ও সাংস্কৃতিক কল্পনার ওপর একটি সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে। YRF আত্মপরিচয়ের আভিজাত্য রূপ, Dharma আধুনিক সম্পর্কের নান্দনিকতা, Tips আত্মানুভবের গীতিময়তা, এবং T-Series গণমানুষের অন্তর্লীন আবেগ—এই চারটি ধারা মিলে হিন্দি সিনেমার একটি বহুমাত্রিক সংবেদন নির্মাণ করে।

এই সংস্থাগুলো কেবল গল্প বলেনি; তারা আবেগ সাজিয়েছে, অনুভব নির্মাণ করেছে, এবং একধরনের মানসিক স্টাইল তৈরি করেছে—যেখানে দর্শক আবেগভিত্তিক ‘aesthetic consumption’ উপভোগ করে। এইসব নির্মাণ আমাদের শেখায়—সিনেমা কেবল বিনোদন নয়, বরং আত্মিক পরিসরের এক ভাষা, এবং প্রযোজনা সংস্থা সেই ভাষার রূপকার।

সমাজ, বলিউড ও বাস্তবতা

মুসলিম চরিত্রের রূপায়ণ (ইতিবাচক ও নেতিবাচক)

এইসব নির্মাণ আমাদের শেখায়—সিনেমা কেবল বিনোদন নয়, বরং আত্মিক পরিসরের এক ভাষা, এবং প্রযোজনা সংস্থা সেই ভাষার রূপকার।

হিন্দি সিনেমায় মুসলিম চরিত্রের উপস্থাপন বহুমাত্রিক ও জটিল। এই উপস্থাপনা একদিকে কখনো সহমর্মিতা, নায়কোচিত গুণাবলি ও আত্মত্যাগের সৌন্দর্যে উজ্জ্বল; অন্যদিকে আবার অনেক সময়েই তা একরৈখিক, নেগেটিভ এবং স্টেরিওটাইপড। নব্বইয়ের দশক ও তার পরবর্তী সময় এই দ্বৈত উপস্থাপনাকে আরও স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসে। এই প্রবন্ধে আমরা হিন্দি সিনেমায় মুসলিম চরিত্রের ইতিবাচক ও নেতিবাচক রূপায়ণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করব।

ইতিবাচক মুসলিম চরিত্রের ঐতিহ্য রয়েছে হিন্দি সিনেমায়। নব্বইয়ের দশকে এই উপস্থাপনাকে আমরা দেখি Dil Se, Zakhm, Fiza, Mission Kashmir, Sarfrosh ইত্যাদি ছবিতে। এই চরিত্রগুলো সমাজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে এলেও, তাদের মনস্তত্ত্ব জটিল, আবেগঘন এবং মানবিক। তারা শুধুই ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ নয়; বরং এক বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে আত্ম-সংগ্রামী চরিত্র।

উদাহরণস্বরূপ, Zakhm-এ মুসলিম মা চরিত্রটি একাধারে স্নেহময়ী, ভীত, অথচ আত্মসম্মানবোধে দীপ্ত। এই চরিত্রে দেখা যায়—ধর্ম একজন নারীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতায় কীভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মনোবিশ্লেষণে এই চরিত্র ‘culturally silenced subject’-এর প্রতিনিধিত্ব করে, যে তার কণ্ঠ হারায় কিন্তু আত্মমর্যাদা হারায় না।

একইভাবে Sarfrosh-এ মির্জা চরিত্র (নাসিরুদ্দিন শাহ) প্রথমে একজন প্রেমময় শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও পরে তিনি পরিণত হন এক ‘betrayed nationalist’-এ। এই দ্বৈততা একদিকে তার আদর্শবাদী ইতিহাস, অন্যদিকে প্রতিক্রিয়ার বাস্তবতা—দুটি মনস্তাত্ত্বিক স্তরকে উপস্থাপন করে। মির্জা নিছক খলনায়ক নন; বরং তিনি এক বিপর্যস্ত আত্মা, যার মধ্যে রয়েছে প্রেম, হতাশা ও প্রতিবাদ।

মনোবিশ্লেষণে এই ধরনের চরিত্রগুলো দর্শকের ভেতরকার দ্বিধা ও সামাজিক সংশয়কে স্পর্শ করে। তারা প্রশ্ন তোলে—আমরা কাকে খলনায়ক বলি? ধর্ম, জাতি নাকি প্রতিক্রিয়া কি কাউকে অপরাধী করে তোলে?

অন্যদিকে, নেতিবাচক মুসলিম চরিত্রের উপস্থাপনাও হিন্দি সিনেমায় দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছে—বিশেষ করে যখন বিষয় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অথবা সীমান্ত সংক্রান্ত। Roja, Mission Kashmir, Fanaa, Phantom—এইসব সিনেমায় অনেক সময় মুসলিম চরিত্রকে একমাত্রিকভাবে ‘the other’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই চরিত্রগুলিতে ‘visual markers’—যেমন কালি পাথানী কাপড়, দাড়ি, টুপি, উর্দু উচ্চারণ—ব্যবহৃত হয় যেন এক ভৌগোলিক নয়, বরং মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে। এই ধরনের স্টিরিওটাইপিক চরিত্রগুলো মনোবিশ্লেষণে একধরনের ‘projective anxiety’-র প্রতিচ্ছবি—যেখানে সংখ্যাগুরু সমাজ নিজের ভয়, অপরিচিতি এবং অনিরাপত্তাকে এক ‘চেনা শত্রু’র রূপে বিন্যস্ত করে।

এই নেতিবাচক রূপায়ণ শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক মনোভাবও প্রতিফলিত করে। এই মনোভাব মুসলিম চরিত্রকে হয় শত্রু নয়তো নিস্ক্রিয় আত্মবিসর্জনের প্রতীক হিসেবে দেখে। তারা হয় আত্মঘাতী, নয় আত্মত্যাগী। এই দুটি চরমপন্থা দর্শকের মধ্যে একদলীয় আবেগ তৈরি করে, যা বহুত্ববাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তবে এমন কিছু নির্মাতা ছিলেন, যারা এই স্টিরিওটাইপকে চ্যালেঞ্জ করেন। My Name is Khan সিনেমায় রিজওয়ান চরিত্র একজন মুসলিম অটিস্টিক পুরুষ, যিনি শুধু বলেন “My name is Khan, and I am not a terrorist”। এই একমাত্র সংলাপ পুরো ভারতীয় সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে এক ব্যতিক্রমী মানবিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। মনোবিশ্লেষণে রিজওয়ানের চরিত্র ‘vulnerable ethics’-এর প্রতিনিধি—যেখানে দুর্বলতা আত্মরক্ষা নয়, বরং প্রতিবাদ।

ইতিবাচক মুসলিম চরিত্রের আরেক নিদর্শন হলো বন্ধু ও প্রতিবেশী চরিত্র—যেমন Lagaan-এর ইসমাইল বা Chak De India-র কবীর খান। এইসব চরিত্রে ধর্মীয় পরিচয় থাকে, কিন্তু তা নিছক পটভূমি হিসেবে। মূল চরিত্র নির্ধারিত হয় তাদের আচরণ, নৈতিকতা ও আদর্শ দিয়ে। এটি একধরনের ‘inclusive realism’, যা ভারতীয় সমাজের অন্তরনিহিত বহুত্ববাদকে প্রতিফলিত করে।

তবে একই সময়েই দেখা যায়—যে সিনেমাগুলিতে মুসলিম নারীদের উপস্থাপন হয়, তা প্রায়ই নিঃশব্দ, আত্মত্যাগী, এবং আড়ালভিত্তিক। তাদের প্রেম হয় অসমাপ্ত, জীবন হয় পরনির্ভর, এবং সিদ্ধান্ত হয় অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব নির্ভর করে ‘structured silencing’ এর ওপর—যেখানে নারীর মুখ আছে, কিন্তু কণ্ঠ নেই।

এই প্রবন্ধের আলোকে স্পষ্ট হয় যে, মুসলিম চরিত্র রূপায়ণের ভেতরে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈততা বিদ্যমান। তারা কখনও সহানুভূতির প্রতীক, আবার কখনও অনিরাপত্তার ‘আধার’। এই দ্বৈততা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। কিন্তু একইসঙ্গে এই দ্বৈততার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সম্ভাবনা—যেখানে সিনেমা হতে পারে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ, ভয়ের ভাষার বদলে সহমর্মিতার ব্যাকরণ।

এই জন্যেই প্রয়োজন আরও সংবেদনশীল নির্মাতা, যারা মুসলিম চরিত্রকে স্টিরিওটাইপ নয়, বরং বহুবাচনিক বাস্তবতায় উপস্থাপন করবেন। যারা ধর্মকে কেবল পরিচয় নয়, বরং অভিজ্ঞতা হিসেবে ভাববেন। এবং যারা দর্শককে কেবল ‘ভিন্ন’ নয়, বরং ‘সমান’-এর চোখে দেখার ভাষা শেখাবেন।

নারী চরিত্রের পরিণত রূপ (Dil To Pagal Hai, Dushman, Zakhm)

এই জন্যেই প্রয়োজন আরও সংবেদনশীল নির্মাতা, যারা মুসলিম চরিত্রকে স্টিরিওটাইপ নয়, বরং বহুবাচনিক বাস্তবতায় উপস্থাপন করবেন। যারা ধর্মকে কেবল পরিচয় নয়, বরং অভিজ্ঞতা হিসেবে ভাববেন। এবং যারা দর্শককে কেবল ‘ভিন্ন’ নয়, বরং ‘সমান’-এর চোখে দেখার ভাষা শেখাবেন।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা নারী চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের সাক্ষী হয়। এই সময়ের নারী কেবল প্রেমিকের প্রত্যাশায় অপেক্ষারত নয়; বরং তিনি হয়ে ওঠেন সংবেদনশীল, সিদ্ধান্তগ্রহণকারী এবং আত্মপরিচয়ের সন্ধানী এক পরিপূর্ণ ব্যক্তি। Dil To Pagal Hai, Dushman, Zakhm—এই তিনটি সিনেমা হিন্দি চলচ্চিত্রে নারীর পরিণত রূপের ব্যতিক্রমী উদাহরণ, যেখানে প্রতিটি নারী চরিত্রের অভ্যন্তরে বিরাজ করে এক জটিল আবেগ, দ্বন্দ্ব এবং বিকাশমান সত্তা। এই প্রবন্ধে আমরা এই চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক স্তর ও সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা বিশ্লেষণ করব।

Dil To Pagal Hai সিনেমার মায়া (মাধুরী দীক্ষিত) চরিত্রটি প্রেম, শিল্প ও আত্মবিশ্বাসের এক সম্মিলিত প্রতীক। তিনি একজন ড্যান্সার এবং থিয়েটার পারফর্মার—যিনি বিশ্বাস করেন যে কোথাও একজন মানুষ আছেন যিনি শুধুমাত্র তার জন্যেই সৃষ্টি। এই বিশ্বাস একধরনের রোমান্টিক ইউটোপিয়া হলেও, মায়ার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও মানসিক দৃঢ়তায়। তিনি কেবল প্রেমিকা নন, বরং একজন শিল্পী—নিজস্ব স্বপ্ন, পছন্দ ও চিন্তাচর্চার অধিকারী।

মনোবিশ্লেষণে মায়া একধরনের ‘internal romantic subject’—যিনি নিজেই নিজের আবেগের নিয়ন্তা। তার প্রেম কোনও পুরুষের করুণা নয়, বরং একটি চেতনা, একটি অপেক্ষার নান্দনিকতা। এমনকি শেষ পর্যন্ত প্রেম স্বীকৃত হলেও, মায়ার আকাঙ্ক্ষা কখনো আত্মসমর্পণের পথে যায় না; বরং নিজের মূল্যবোধে দাঁড়িয়ে থাকে। তার নীরবতা হয়ে ওঠে আত্মসম্মানের ভাষা।

Dushman সিনেমায় কাজল অভিনীত দুই যমজ বোন—সোনিয়া ও নয়না—দুই বিপরীত মানসিক কাঠামোর প্রতিচ্ছবি। সোনিয়া প্রাণবন্ত, প্রেমিক, হাস্যোজ্জ্বল; নয়না অন্তর্মুখী, সুশৃঙ্খল, ভীত। সোনিয়ার ধর্ষণ ও হত্যা নয়নার চরিত্রকে এক বিপর্যয় থেকে পরিণতিতে নিয়ে যায়। সে ভয় থেকে ক্রমে সাহসে উত্তীর্ণ হয়, প্রেম থেকে ক্রোধে রূপান্তরিত হয়, এবং অবশেষে প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হয়।

এই চরিত্ররূপান্তর একধরনের ‘traumatic individuation’—যেখানে এক নারীর অস্তিত্ব আর আবেগ তার বোনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত হয়। নয়না যে সাহস অর্জন করে, তা কোনো পুরুষ দ্বারা প্ররোচিত নয়, বরং নিজের ভেতরের শোক, ক্রোধ ও ভয়কে গ্রহণ করার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এই নারী-নির্মাণে পুরুষ এক সঙ্গী, পথপ্রদর্শক হতে পারেন, কিন্তু নায়িকা তার নিজের মুক্তির দায় নিজেই নেয়।

মনোবিশ্লেষণে নয়না হয়ে ওঠেন এক ‘trauma-processed warrior’—যিনি দুর্বলতা থেকে নয়, শক্তির উৎস খুঁজে পান নিজের অতীত যন্ত্রণায়। এই সিনেমা নারী চরিত্রকে নিছক ভুক্তভোগী নয়, বরং সক্রিয় প্রতিরোধকারী হিসেবে উপস্থাপন করে।

Zakhm সিনেমায় পুজা ভাট অভিনীত মুসলিম মা চরিত্রটি নিঃশব্দ যন্ত্রণার এক পরিপূর্ণ রূপ। তিনি সমাজের চোখে অপরাধী, কারণ তিনি ভালোবেসেছেন একজন হিন্দু পুরুষকে। তিনি সামাজিক স্বীকৃতি পাননি, সন্তানের চোখে মর্যাদা পাননি, কিন্তু তবুও তিনি ভালোবেসে যান, সহ্য করে যান, লড়াই করেন। এই চরিত্র কোনও বীরাঙ্গনা নন, কিন্তু তিনি ‘silent agency’-র প্রতীক।

এই মা চরিত্রের মুখে কোনও তীব্র সংলাপ নেই, কিন্তু তার চোখ, মুখের রেখা, এবং মৌনতায় একধরনের প্রজ্ঞা রয়েছে। তিনি সামাজিক অসম্মানকে মুখ বুজে সয়ে নেন, কিন্তু সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেন না। মনোবিশ্লেষণে এই চরিত্র এক ‘passive resistance’-এর রূপ, যেখানে প্রতিবাদ উচ্চস্বরে নয়, বরং অনড় নীরবতায়।

এই তিনটি সিনেমার নারী চরিত্র—মায়া, নয়না, নামহীন মা—তাঁরা প্রত্যেকে নিজের জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, নিজেদের সিদ্ধান্ত নেন, এবং সমাজের সুনির্দিষ্ট নারী-চিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁরা কেবল নায়িকার ভূমিকায় নন, বরং চরিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তাঁদের আবেগে আছে পরিণতি, দ্বিধায় আছে প্রশ্ন, এবং প্রেমে আছে আত্মমর্যাদার পরিচয়।

এই চরিত্রগুলো হিন্দি সিনেমার সেই পুরনো নারী-কাঠামোকে অস্বীকার করে, যেখানে নারী ছিল পুরুষের অপেক্ষায়, তার জন্য কাঁদে, অথবা আত্মত্যাগে গৌরবান্বিত হয়। বরং এই নারী চরিত্রগুলো নিজের দুঃখ, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, এবং প্রতিরোধের অধিকার নিজেদেরই হাতে নেয়।

এই জন্যেই বলা যায়—Dil To Pagal Hai, Dushman, ও Zakhm—এই সিনেমাগুলোর নারীচরিত্র হিন্দি সিনেমার ‘evolving feminine consciousness’-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা প্রেম করে, ভয় পায়, কাঁদে, কিন্তু অবশেষে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে উপলব্ধি করে—এবং নিজস্ব পরিণতির নির্মাতা হয়ে ওঠে।

শহর বনাম গ্রাম, অভিজাত বনাম মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন

এই জন্যেই বলা যায়—Dil To Pagal Hai, Dushman, ও Zakhm—এই সিনেমাগুলোর নারীচরিত্র হিন্দি সিনেমার ‘evolving feminine consciousness’-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা প্রেম করে, ভয় পায়, কাঁদে, কিন্তু অবশেষে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে উপলব্ধি করে—এবং নিজস্ব পরিণতির নির্মাতা হয়ে ওঠে।

হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে শহর ও গ্রামের টানাপোড়েন, কিংবা অভিজাত ও মধ্যবিত্ত জীবনের দ্বন্দ্ব, শুধুই ভৌগোলিক বা অর্থনৈতিক বাস্তবতা নয়—বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিভাজনের প্রতিফলন। নব্বইয়ের দশকের বলিউডে এই দ্বন্দ্ব একদিকে আধুনিকতার আগ্রাসন, অন্যদিকে শিকড়ের টান হিসেবে, আবার একদিকে বৈভবের আকর্ষণ, অন্যদিকে আত্মমর্যাদার সঙ্কট হিসেবে ধরা দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা শহর বনাম গ্রাম, অভিজাত বনাম মধ্যবিত্ত জীবনের মনস্তাত্ত্বিক গঠন, আকর্ষণ, দ্বন্দ্ব ও প্রতিনিধিত্ব বিশ্লেষণ করব।

নব্বইয়ের দশকে শহর হয়ে ওঠে ‘aspiration’—যেখানে সুযোগ, স্বপ্ন এবং আত্মপ্রকাশের পরিসর থাকে। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Kabhi Haan Kabhi Naa, Rangeela, Yes Boss—এইসব সিনেমায় শহর মানে ভালোবাসার স্বাধীনতা, পেশাগত প্রতিষ্ঠা এবং পরিচয়ের অনুসন্ধান। শহর যেন এক মানসিক মুক্তিক্ষেত্র, যেখানে ব্যক্তি নিজের মতো করে জীবন গড়তে পারে।

মনোবিশ্লেষণে শহর একধরনের ‘psychological possibility’—যেখানে আগত মানুষ বাস্তব জীবনের অভাব থেকে পালিয়ে নিজের কল্পনার বিকল্প নির্মাণ করে। শহরে আসা চরিত্রদের ভেতরে থাকে দুঃসাহস, কিন্তু সঙ্গে দ্বিধাও। তারা চায় বদলাতে, কিন্তু শিকড়কে মুছে ফেলতে পারে না। ফলে শহুরে চরিত্র অনেক সময় ‘identity crisis’-এ ভোগে।

অন্যদিকে গ্রাম মানে শৃঙ্খলা, ঐতিহ্য, পারিবারিক কাঠামো ও সংহতির প্রতীক। Hum Aapke Hain Koun..! অথবা Lagaan, Pardes—এই সিনেমায় গ্রাম বা ছোট শহর মানে সম্পর্কের আন্তরিকতা, মূল্যবোধের স্থায়িত্ব এবং সামাজিক অনুশাসন। গ্রাম যেন হৃদয়ের ভাষা, যেখানে জীবনের গতি ধীর, কিন্তু আবেগ গভীর।

মনোবিশ্লেষণে গ্রাম একধরনের ‘emotional homeland’—যেখানে ব্যক্তি মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করে। কিন্তু এই নিরাপত্তার বিনিময়ে তাকে ছাড়তে হয় স্বাধীনতা, আত্মপরিচয়ের সন্ধান। ফলে গ্রাম কখনো আশ্রয়, কখনো অচলায়তন।

এই দ্বৈততার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ Swades সিনেমায় পাওয়া যায়। একদিকে এনআরআই মহারাজা রাম, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও গ্রাম-ভারতের অসহায়তা দেখে ভিতরে ভিতরে তীব্র অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। তার মধ্যে শুরু হয় ‘reverse aspiration’—যেখানে শহর ছেড়ে গ্রামকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে ফেরার আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। এই মানসিক বিপর্যয় একধরনের ‘guilt-induced belonging’—যা আধুনিক দর্শকের মনে গভীর সাড়া ফেলে।

শহুরে জীবনে অভিজাত শ্রেণির চরিত্র প্রায়শই দৃশ্যগত আভিজাত্য, গ্ল্যামার, ভাষা ও জীবনচর্যায় উচ্চমানের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তার মধ্যে থাকে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ খালি জায়গা—যেমন Kabhi Alvida Naa Kehna, Dil Chahta Hai, Kal Ho Naa Ho—এইসব সিনেমায় দেখা যায় যে অভিজাত জীবন যতটাই ঝলমলে, তার ভেতরে ততটাই নিঃসঙ্গতা, সম্পর্কের জটিলতা ও আত্মপরিচয়ের সঙ্কট।

মনোবিশ্লেষণে অভিজাত জীবন একধরনের ‘aesthetic detachment’ তৈরি করে—যেখানে সম্পর্ক, বন্ধন ও অনুভবের বাস্তবতা নয়, বরং তার রূপ বা ছাঁচটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অভিজাত চরিত্রের মধ্যে একধরনের ‘emotional distancing’ দেখা যায়—তারা ভালোবাসে, কিন্তু বলতে পারে না; থাকে, কিন্তু মিশতে পারে না।

মধ্যবিত্ত জীবন, বিশেষ করে ছোট শহর ও গ্রামকেন্দ্রিক চরিত্রদের জীবন যতটা সরল, ততটাই বেদনাবিধুর। Do Bigha Zamin, Tere Naam, Iqbal, Masoom—এইসব সিনেমায় মধ্যবিত্ত মানে সংগ্রাম, পারিবারিক জটিলতা এবং স্বপ্নের ত্যাগ। কিন্তু এইসব চরিত্রের আবেগ থাকে নিখাদ, সিদ্ধান্ত থাকে গাঢ় এবং আত্মত্যাগ থাকে মহৎ।

মনোবিশ্লেষণে মধ্যবিত্ত জীবন একধরনের ‘affective integrity’ বহন করে—যেখানে আবেগের গভীরতা আছে, অথচ তা আত্মপ্রদর্শনের নয়; বরং আত্মসংযমের। এই চরিত্ররা দর্শকের মনে জায়গা করে নেয় কারণ তাদের অনুভব বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি।

এই শহর-গ্রাম, অভিজাত-মধ্যবিত্ত দ্বন্দ্ব কেবল চরিত্র বা চিত্রনাট্যগত নয়, বরং সিনেমার দৃশ্যতাত্ত্বিক নির্মাণেও প্রতিফলিত হয়। শহরের দৃশ্য চকমকে, স্থির, কৃত্রিম; গ্রাম বা মধ্যবিত্ত জীবন খোলা প্রান্তর, ধুলো, হকার, ট্রেনের শব্দে নির্মিত। এই ভিজ্যুয়াল স্টাইলই দর্শকের মানসিক মানচিত্রে এক স্পষ্ট শ্রেণিবিভাজন এঁকে দেয়।

তবে নব্বইয়ের দশক থেকে হিন্দি সিনেমায় এই দ্বন্দ্বের মধ্যে মেলবন্ধনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। যেমন Rab Ne Bana Di Jodi বা Band Baaja Baaraat-এ শহুরে চরিত্ররা মফস্বলের আবেগ নিয়ে আসে; আবার Highway-এর মতো ছবিতে শহরের মেয়ে গ্রাম্য পটভূমিতে নিজের ভেতরের যন্ত্রণার মুক্তি খুঁজে পায়। এইসব সিনেমা একধরনের ‘emotional reconciliation’ ঘটায়।

এই কারণে বলা যায়, শহর বনাম গ্রাম কিংবা অভিজাত বনাম মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন শুধু শ্রেণি নয়, বরং এক মানসিক বিন্যাসের দ্বন্দ্ব। শহর আকাঙ্ক্ষা, গ্রাম স্মৃতি; অভিজাততা নান্দনিকতা, মধ্যবিত্ততা সততা; এইসব বিপরীত দ্বন্দ্বে গড়ে ওঠে হিন্দি সিনেমার মানুষের মানসিক ভূগোল।

“সাধারণ মানুষ”-এর প্রতিনিধি চরিত্র (Sunny Deol, Govinda ইত্যাদি)

এই কারণে বলা যায়, শহর বনাম গ্রাম কিংবা অভিজাত বনাম মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন শুধু শ্রেণি নয়, বরং এক মানসিক বিন্যাসের দ্বন্দ্ব। শহর আকাঙ্ক্ষা, গ্রাম স্মৃতি; অভিজাততা নান্দনিকতা, মধ্যবিত্ততা সততা; এইসব বিপরীত দ্বন্দ্বে গড়ে ওঠে হিন্দি সিনেমার মানুষের মানসিক ভূগোল।

হিন্দি সিনেমায় “সাধারণ মানুষ” চরিত্রের নির্মাণ কখনো নিছক শ্রেণিচিহ্ন নয়; বরং এটি এক সামাজিক-মানসিক বাস্তবতা, যা দর্শকের আত্মপরিচয়, ন্যায়বোধ, এবং আবেগীয় চাহিদার প্রতিচ্ছবি। নব্বইয়ের দশকে এই “সাধারণ” চরিত্ররা—বিশেষত সানি দেওল, গোবিন্দ, এবং তাঁদের মতো আরও অভিনেতারা—দর্শকের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, হাসি, প্রতিবাদ, এবং বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে পর্দায় ভাষা দেন। এই প্রবন্ধে এই চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো, সামাজিক গুরুত্ব এবং শ্রোতা-সংযোগ বিশ্লেষণ করা হবে।

সানি দেওল হিন্দি সিনেমার এমন এক মুখ, যিনি “common man”-এর রাগ, ন্যায়ের খোঁজ এবং নীরব সহ্যশক্তিকে এক ধ্বনিরূপ দেন। তাঁর সংলাপ “Tareekh pe tareekh…” শুধুমাত্র সংলাপ নয়, বরং ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে এক মনস্তাত্ত্বিক আর্তনাদ। সানি দেওলের চরিত্র প্রায়ই নিপীড়িত, কিন্তু অন্তর্নিহিতভাবে সংগ্রামী। তিনি কারও ভাই, কারও ছেলে, একজন শ্রমিক, একজন সৈনিক—যিনি ক্রমাগত অন্যায় দেখেন এবং একদিন বিস্ফোরিত হন।

মনোবিশ্লেষণে সানি দেওলের চরিত্র একধরনের ‘suppressed rage of the masses’—যেখানে দর্শক নিজের মুখে যা বলতে পারে না, সেই উচ্চারণের পরিসর খুঁজে পায় পর্দার সেই হুঙ্কারে। এই রাগ অকারণ নয়; বরং একধরনের ন্যায্যতা-অন্বেষণ, যেখানে সমাজ তাকে সব দিয়েছে—শ্রম, কর্তব্য, আত্মত্যাগ—কিন্তু ফেরত দেয়নি ন্যায়, সম্মান বা শ্রবণ।

Ghayal, Damini, Ghatak, Arjun—এইসব সিনেমায় সানি দেওলের চরিত্ররা রক্তাক্ত, কিন্তু ন্যায়ের জন্য দৃঢ়। তাঁর উচ্চারিত সংলাপ, শরীরী ভাষা এবং বিস্ফোরণ—সবকিছু একধরনের ‘emotional catharsis’ তৈরি করে, যেখানে দর্শক নিজের সংবরণকে চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করে।

অন্যদিকে গোবিন্দ “সাধারণ মানুষ”-এর আরেক রূপ—যিনি প্রতিদিনের বাঁচা, হাসা, ঠকানো এবং তবুও ভালোবাসার রূপকার। গোবিন্দের চরিত্র হয়তো একজন ট্যাক্সি চালক, ছোটখাটো চাকুরিজীবী, বা ঠেলাওয়ালা—কিন্তু তাঁর অভিব্যক্তি, সংলাপ এবং নাচের ভঙ্গিমা একজন শ্রমজীবী মানুষের আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তির প্রকাশ।

মনোবিশ্লেষণে গোবিন্দের চরিত্র একধরনের ‘comic resilience’—যেখানে হাস্যরস হয়ে ওঠে অস্তিত্বের হাতিয়ার। তাঁর চরিত্র কখনও কাঁদে না, কিন্তু প্রতিটি মজার সংলাপের নিচে লুকিয়ে থাকে বঞ্চনার ব্যথা। Coolie No. 1, Hero No. 1, Raja Babu, Deewana Mastana—এইসব ছবির নায়ক শ্রেণিগতভাবে নিচুতে হলেও আত্মসম্মানে উঁচুতে। দর্শক তাঁর মধ্যে নিজের অপমানের প্রতিক্রিয়া, নিজের হাস্যকর পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল দেখতে পায়।

গোবিন্দের নাচ, পোষাক, উচ্চারণ—সবই একধরনের আত্মপ্রকাশ। এটা নিছক বিনোদন নয়; বরং মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেই থাকা রং, সুর, ও উচ্ছ্বাসের স্বীকৃতি। তাঁর চরিত্র বলে—আমিও বাঁচতে পারি, আমিও হাসতে পারি, আমিও প্রেম পেতে পারি। এটা একধরনের ‘aesthetic of inclusion’—যেখানে গ্ল্যামার কেবল অভিজাতের নয়, “আমার”ও হতে পারে।

সানি দেওলের চরিত্র যেখানে সিস্টেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, গোবিন্দের চরিত্র সিস্টেমকে ঠকিয়ে হাসে। উভয়েই প্রতিরোধের রূপ, কিন্তু একটিতে থাকে তীব্রতা, অন্যটিতে কৌশল। এই দুই রূপ “common man”-এর দুটি মানসিক কৌশল—একটি সক্রিয়, আরেকটি প্রতিক্রিয়াশীল।

এই চরিত্রগুলো কেবল একক ব্যক্তি নয়, বরং একটি শ্রেণির, একটি মানসিক অবস্থানের প্রতীক। ভারতের সেই বিরাট জনসংখ্যা, যারা শ্রম দেয়, কিন্তু শ্রোতা নয়; যারা শহর গড়ে, কিন্তু শহরের ভেতরে ঠাঁই পায় না—তারা এই চরিত্রে নিজেদেরই এক উত্তরণ খুঁজে পায়।

এছাড়া এইসব চরিত্রের শরীরী উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ। সানি দেওলের স্থূল, কঠোর দেহ গঠন তাঁকে একধরনের “protector archetype” করে তোলে; যেখানে শক্তি মানেই ন্যায়। অপরদিকে গোবিন্দের লাবণ্যময় দেহভঙ্গি, চটুলতা, মঞ্চীয় সপ্রতিভতা—তাঁকে “survivor with style” রূপে চিত্রিত করে। এই দুই শারীরিক স্টাইল দর্শকের মানসিক আদর্শ নির্মাণেও ভূমিকা রাখে।

এই সাধারণ চরিত্রগুলো একদিকে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, অন্যদিকে দর্শকের আবেগ, সংকট এবং স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা “heroic in ordinariness”—কারণ তাঁরা রক্ত-মাংসের মানুষ, ঈশ্বর নয়; কিন্তু তবুও দর্শকের ঈশ্বরের বিকল্প হয়ে ওঠেন। তাঁরা যে শুধু সিনেমার নায়ক নন, বরং দর্শকের মনের নায়ক।

এইজন্য বলা যায়—সানি দেওল, গোবিন্দ প্রমুখ “সাধারণ মানুষ”-এর চরিত্রের মধ্যে হিন্দি সিনেমা একধরনের জনসত্তা নির্মাণ করে। এক সত্তা, যে কাঁদে, প্রতিবাদ করে, ঠকে, আবার জিতে যায়। এই সত্তা সিনেমার পর্দা থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের সমাজ-মনস্তত্ত্বের গভীরে গেঁথে থাকে।

প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক রূপান্তর

ক্যাসেট থেকে CD, থিয়েটার থেকে মাল্টিপ্লেক্স

এইজন্য বলা যায়—সানি দেওল, গোবিন্দ প্রমুখ “সাধারণ মানুষ”-এর চরিত্রের মধ্যে হিন্দি সিনেমা একধরনের জনসত্তা নির্মাণ করে। এক সত্তা, যে কাঁদে, প্রতিবাদ করে, ঠকে, আবার জিতে যায়। এই সত্তা সিনেমার পর্দা থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের সমাজ-মনস্তত্ত্বের গভীরে গেঁথে থাকে।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে পরবর্তী দশকে ভারতীয় সিনেমা জগতে এক বিপুল প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটে—যা ক্যাসেট থেকে CD, থিয়েটার থেকে মাল্টিপ্লেক্স পর্যন্ত এক প্রবল মনস্তাত্ত্বিক স্থানান্তর নির্দেশ করে। এই রূপান্তর কেবলমাত্র মাধ্যমগত পরিবর্তন ছিল না, বরং দর্শকের অভ্যাস, শ্রোতা-মানসিকতা এবং সংস্কৃতি ভোগের ধরণে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই প্রবন্ধে আমরা এই রূপান্তরের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তার গভীর সাংস্কৃতিক অভিঘাত অন্বেষণ করব।

ক্যাসেট যুগ ছিল এক “rewind culture”—যেখানে শ্রোতা গান শোনার সময় বারবার ‘পেছনে ফিরে যেত’, সেই অংশগুলো খুঁজত, যা তার হৃদয়কে স্পর্শ করত। ক্যাসেট মানে ছিল স্পর্শ, টেপ-চেনা, এক কায়িক অভিজ্ঞতা। একটি গান মানে ছিল এক নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে শ্রবণ-অনুশীলন। এর মধ্যে ছিল একধরনের ‘temporal intimacy’—যেখানে গান বা সিনেমা কেবল একটি দ্রব্য নয়, বরং সময়ের এক সহচর।

মনোবিশ্লেষণে ক্যাসেট মানে এক ‘slow memory consumption’—যেখানে একটি অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠত। শ্রোতা গান জমানো, সাজানো, ধার দেওয়া, চুপিচুপি রেকর্ড করাকে এক আবেগীয় জগৎ হিসেবে ধারণ করত। সেই ক্যাসেটের গায়ে লেখা হাতের লেখা, ছোট্ট স্টিকার, অথবা উপহার দেওয়া ক্যাসেট—সবকিছু একধরনের ‘sentimental memorabilia’।

কিন্তু CD-এর আগমন এই সময়ধর্মী শ্রবণ অভিজ্ঞতাকে ভেঙে দেয়। CD ছিল ঝকঝকে, দ্রুত, টেকসই এবং বেশি গান ধারণক্ষম। এখানে rewind নয়, বরং ‘skip’—অর্থাৎ অভিজ্ঞতা আর ধীরে ধীরে গড়ায় না, বরং এক ক্লিকেই এগিয়ে যায়। CD সংস্কৃতি ‘attention fragmentation’-এর শুরু করে, যেখানে একটি গান শুরু হওয়ার আগেই পরেরটির কৌতূহল জেগে ওঠে।

এই প্রযুক্তিগত রূপান্তর শ্রোতার মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলে। মনোবিশ্লেষণে CD একধরনের ‘curated desire’ তৈরি করে—যেখানে শ্রোতা আর শুধু আবেগপ্রবণ নয়, বরং সচেতনভাবে নির্বাচন করতে চায়। অভিজ্ঞতা এখানে ইমারসিভ নয়, বরং ব্যবচ্ছেদমূলক। এটি শ্রোতাকে একটি নতুন ‘consumer-listener’-এ পরিণত করে।

একইভাবে সিনেমা দেখার অভ্যাসেও ঘটে এক বিপ্লব—সাধারণ থিয়েটার থেকে মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতিতে রূপান্তর। পুরনো একক স্ক্রিন থিয়েটার মানে ছিল এক সামাজিক অভিজ্ঞতা। পাড়ার ছেলেমেয়ে, পিচ্ছি থেকে বৃদ্ধ, একসঙ্গে অন্ধকার হলে বসে হাসত, কাঁদত, শিস দিত, হাততালি দিত। সিনেমা ছিল ‘collective affective event’।

মনোবিশ্লেষণে থিয়েটার ছিল ‘ritual of shared emotion’—যেখানে ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ দলগত হতো। সিনেমা ছিল শুধুই দৃশ্য নয়, বরং শারীরিকতা, শব্দ, গন্ধ, চিৎকার এবং সমবেত প্রতিক্রিয়ার এক সাংস্কৃতিক নাট্যভূমি।

অন্যদিকে মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি তৈরি করে এক ‘individualised viewing habit’। এখানে টিকিট কেটে নির্দিষ্ট সিটে বসা, নীরবে সিনেমা দেখা, ক্লাস বিভাজনের পরিসর—সবকিছুই একধরনের নতুন শ্রেণিচেতনার জন্ম দেয়। মাল্টিপ্লেক্স হয় এক ‘controlled emotional zone’—যেখানে দর্শক চিৎকার করে না, বরং অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়।

এই স্থানান্তর শুধু আচরণের নয়, বরং মননেরও। থিয়েটারে সিনেমা ছিল বিনোদনের পূজা, মাল্টিপ্লেক্সে তা হয় রুচির প্রসাদ। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান সিনেমা নির্মাণেও প্রভাব ফেলে—চিত্রনাট্য হয়ে ওঠে শৃঙ্খলিত, দৃশ্যতত্ত্ব হয় পরিশীলিত, চরিত্র হয় মধ্যবিত্ত-আধুনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী।

এই রূপান্তরের মধ্যে শ্রোতা ও দর্শক একধরনের ‘aesthetic displacement’-এর মধ্য দিয়ে যায়। ক্যাসেট ও থিয়েটার যে আবেগ তৈরি করত—তার স্থান দখল করে দক্ষতা, গতিময়তা ও নির্জনতা। নতুন প্রযুক্তি যেমন স্বাধীনতা দেয়, তেমনি তা একাকিত্বও তৈরি করে। দর্শক তখন পর্দায় একা, ইমোশনে নিঃশব্দ।

তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু অদৃশ্য সংহতি থাকে। দর্শক তার পছন্দসই গান আজও প্লেলিস্টে সাজায়, স্মৃতি অনুযায়ী খোঁজে, থিয়েটারের অভিজ্ঞতা মনে করে। পুরনো অভ্যাস নতুন রূপে ফিরে আসে—nostalgic curation-এর মাধ্যমে। মাল্টিপ্লেক্সে বসে ক্যাসেটের গান শুনে মনে পড়ে সেই পুরনো ছেলেবেলার কথা—এটাই এই রূপান্তরের গভীরতর মনস্তত্ত্ব।

এইজন্য বলা যায়—ক্যাসেট থেকে CD, থিয়েটার থেকে মাল্টিপ্লেক্স—এই রূপান্তর শুধুই প্রযুক্তি নয়, বরং এক আবেগীয় সংস্কৃতির রূপান্তর। এটি নতুন শ্রোতা, নতুন দর্শক তৈরি করে; কিন্তু পুরনো অনুভবকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারে না। স্মৃতি রয়ে যায়, ফিরে আসে, এবং সেই স্মৃতি দিয়েই আমরা বুঝি—পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু স্থায়ী থেকে যায়।

বিদেশে মুক্তি ও NRI দর্শকদের টার্গেট

এইজন্য বলা যায়—ক্যাসেট থেকে CD, থিয়েটার থেকে মাল্টিপ্লেক্স—এই রূপান্তর শুধুই প্রযুক্তি নয়, বরং এক আবেগীয় সংস্কৃতির রূপান্তর। এটি নতুন শ্রোতা, নতুন দর্শক তৈরি করে; কিন্তু পুরনো অনুভবকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারে না। স্মৃতি রয়ে যায়, ফিরে আসে, এবং সেই স্মৃতি দিয়েই আমরা বুঝি—পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু স্থায়ী থেকে যায়।

নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে বলিউড এক নতুন বাজারের সন্ধান পায়—বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় দর্শক, অর্থাৎ NRI (Non-Resident Indian) জনগোষ্ঠী। এই শ্রেণি কেবল ভারতীয় সিনেমার প্রবাসী শ্রোতা নয়; বরং এক নতুন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির ভোক্তা, যাঁদের আবেগ, আত্মপরিচয় ও স্মৃতির বিন্যাস ভারতের প্রতি এক ধরনের নস্টালজিক সম্পর্ক তৈরি করে। বলিউড এই শ্রোতাদের আবেগ বুঝতে শেখে এবং বিদেশে মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমাগুলোর মধ্যে দিয়ে তাদের সঙ্গে এক নতুন ধরনের মানসিক সংলাপ স্থাপন করে। এই প্রবন্ধে আমরা বলিউডের আন্তর্জাতিক মুক্তি ও NRI দর্শকদের টার্গেটিংয়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।

প্রথমত, বিদেশে মুক্তির বিষয়টি কেবল ব্যবসায়িক কৌশল নয়, বরং ভারতীয় সিনেমার আত্মপরিচয়ের বিস্তার। Dilwale Dulhania Le Jayenge (১৯৯৫) এই ধারার পথপ্রদর্শক—যেখানে ইউরোপের ভূখণ্ডে ভারতীয় সংস্কৃতির স্মৃতি, ভালোবাসা, এবং পারিবারিক মূল্যবোধ তুলে ধরা হয়। রাজ ও সিমরানের প্রেম কেবল একটি গল্প নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন—যেখানে বিদেশে বসে থাকা ভারতীয় যুবক নিজেকে খুঁজে পায় তার রোমান্সে, দায়বদ্ধতায় এবং অভিবাসী অভিজ্ঞতায়।

মনোবিশ্লেষণে, NRI দর্শক একধরনের ‘dislocated identity’ বহন করে—যারা শারীরিকভাবে বিদেশে, কিন্তু মানসিকভাবে ভারতীয়। তারা দেশে ফিরে যেতে চায় না, কিন্তু দেশের স্মৃতি ও সংস্কৃতিকে পর্দায় দেখতে চায়। এই স্মৃতি তাদের আত্মপরিচয়ের একধরনের মনস্তাত্ত্বিক নোঙর—যার মধ্যে থাকে ভাষা, উৎসব, গান, খাবার, এবং বিশেষত পারিবারিক সম্পর্কের ‘Indianised’ ব্যাকরণ।

এই কারণেই Kabhi Khushi Kabhie Gham, Kal Ho Naa Ho, Veer-Zaara, Namastey London—এইসব সিনেমায় বিদেশে থাকা ভারতীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে থাকে একধরনের ‘cultural duality’। তারা একদিকে আধুনিক, পশ্চিমীকৃত; অন্যদিকে আবেগপ্রবণ, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ। এই দ্বৈততা তাদের মনস্তত্ত্বকে জটিল করে তোলে এবং বলিউড সেই জটিলতাকে আবেগীয় পরিপূর্ণতায় রূপ দেয়।

বলিউড জানে—এই দর্শক চোখে শুধু গল্প খোঁজে না, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক যাপন খোঁজে। তাই সিনেমার দৃশ্যতাত্ত্বিক ভাষা বদলায়—লোকেশন হয় সুইজারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন; কিন্তু সংলাপ থাকে “Maa ke haath ka khana”, “Pyar mein sab kuch maaf hota hai”, “Parivaar ke liye kuch bhi karenge”। এটি একধরনের ‘emotional localisation’—যেখানে বিদেশের মধ্যে ভারতীয় আবেগকে স্থাপন করা হয়।

মনোবিশ্লেষণে, এই কৌশল ‘emigrant melancholia’-কে রূপ দেয় ‘cinematic nostalgia’-য়। অভিবাসী দর্শক সিনেমার পর্দায় নিজের হারানো শিকড় খুঁজে পায় এবং সেই শিকড়কে রূপান্তরিত করে ‘cultural pride’-এ। সে অনুভব করে, ভারত এখন শুধু একটি দেশ নয়, বরং একটি ‘sentimental identity’, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বহনযোগ্য।

এই সিনেমাগুলোর গানে, পোশাকে, বিয়ের দৃশ্যে, উৎসব উদযাপনে থাকে একধরনের ‘hyper-indianism’। বিদেশের মাটিতে আরও বেশি করে ঘটা করে দীপাবলি, হোলি, মেহেন্দি, সঙ্গীত—এইসব দৃশ্য যেন একধরনের ‘cultural reaffirmation’। এটি কেবল শিকড়ের স্মৃতি নয়, বরং এক প্রকার সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস, যা অভিবাসী দর্শকের মানসিক কাঠামোয় সাহস জোগায়।

সিনেমার এই রূপান্তর নির্মাণের পেছনে রয়েছে এক সুক্ষ্ম শ্রেণি বিশ্লেষণও। NRI দর্শক অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, সিনেমা হলের টিকিটের উচ্চমূল্য পরিশোধে সক্ষম, এবং প্রযুক্তিনির্ভর। তাই সিনেমার গ্ল্যামার বাড়ে, পোশাক হয় ব্র্যান্ডেড, গান হয় ‘fusion’, গল্প হয় একাধিক ভাষার মিশ্রণে। এই কৌশল ‘aesthetic assimilation’-এর মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতিকে গ্লোবাল স্টাইলের মোড়কে উপস্থাপন করে।

তবে এই লক্ষ্যবস্তুীকরণ সবসময়েই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অনেকসময়েই দেখা গেছে যে এই সিনেমাগুলো ভারতীয় বাস্তবতাকে রোমান্টিসাইজ করে তোলে, এবং গ্রাম-ভারতের বা নিম্নবিত্ত ভারতের যন্ত্রণাকে অদৃশ্য করে দেয়। এই ধরনের সিনেমা হয় একধরনের ‘selective nostalgia’—যেখানে কেবল সেই ভারত চিত্রিত হয়, যা স্মরণযোগ্য, নয় যে বাস্তব, তা কঠিন।

এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান বিদেশে বেড়ে ওঠা ভারতীয়দের মধ্যে একটি ‘identity crisis’ তৈরি করে। তারা বুঝতে পারে, সিনেমার ভারত তাদের বাস্তব ভারত নয়। কিন্তু তবুও তারা সেই সিনেমা দেখে, কারণ সিনেমা একটি আত্মিক আশ্রয়স্থল, যেখানে তারা বাস্তবের প্রতিকূলতা ভুলে যেতে পারে। একে বলা যায় ‘cinematic compensation’।

সিনেমার বিদেশে মুক্তি কেবল প্রবাসীদের জন্য নয়, বরং দেশে থাকা দর্শকের জন্যও একধরনের গ্লোবাল কল্পনা তৈরি করে। যে দর্শক মুম্বইয়ে বসে Kabhi Alvida Naa Kehna দেখে, সে নিউ ইয়র্কের প্রেম, স্যুট-টাই, স্কাইলাইন এবং আধুনিক সম্পর্কের জটিলতাকে দেখে নিজেকে আধুনিক বলে কল্পনা করে। এটি একধরনের ‘vicarious cosmopolitanism’।

এইসব সিনেমা দুই শ্রেণির দর্শকের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সেতুবন্ধন ঘটায়—একজন বিদেশে বসে ভারত খোঁজে, অন্যজন ভারতে বসে বিদেশ খোঁজে। বলিউড এই দ্বৈত আবেগের ভাষ্য রচনা করে এবং তার মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক ‘transnational emotional culture’।

এইজন্য বলা যায়, NRI দর্শকদের টার্গেট করে নির্মিত সিনেমাগুলো শুধু বাজার ধরার কৌশল নয়, বরং একটি মানসিক সঞ্চালন, যেখানে দেশপ্রেম, শিকড়, আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক গর্ব মিলেমিশে এক গভীর মানবিক চেতনার প্রতিচ্ছবি তৈরি করে।

মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ও মিউজিক রাইটস বিক্রি

এইজন্য বলা যায়, NRI দর্শকদের টার্গেট করে নির্মিত সিনেমাগুলো শুধু বাজার ধরার কৌশল নয়, বরং একটি মানসিক সঞ্চালন, যেখানে দেশপ্রেম, শিকড়, আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক গর্ব মিলেমিশে এক গভীর মানবিক চেতনার প্রতিচ্ছবি তৈরি করে।

নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বলিউডে সিনেমা শুধুই শিল্প নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ মার্কেটিং প্রকল্প হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে সিনেমার মুক্তি আর কেবল প্রেক্ষাগৃহে নির্ভর করে না; বরং তার সাফল্য নির্ধারিত হতে থাকে বিজ্ঞাপন, মিডিয়া প্রেজেন্স, মিউজিক রাইটস, ব্র্যান্ড টাই-আপ এবং বিভিন্ন প্রচার কৌশলের ওপর। এই পরিসরে মিউজিক রাইটস বিক্রি হয়ে ওঠে একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক কাঠামো, যা সিনেমা মুক্তির আগেই বিপুল অঙ্কে রাজস্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এই প্রবন্ধে আমরা বলিউডের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এবং মিউজিক রাইটস বিক্রির মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিক বিশ্লেষণ করব।

মার্কেটিং হল সিনেমার অদৃশ্য প্রেক্ষাগৃহ—যেখানে গল্পের আগেই দর্শক চরিত্রকে চিনে ফেলে, গান শুনে ফেলে, এবং সিনেমার ভাবমূর্তিকে গড়ে তোলে। এটি কেবল প্রোডাক্ট প্রচার নয়; বরং একধরনের ‘affective anticipation’—যেখানে দর্শক সিনেমার অভিজ্ঞতার আগেই আবেগগতভাবে নিজেকে সংযুক্ত করে ফেলে।

মনোবিশ্লেষণে মার্কেটিং একধরনের ‘emotional priming’—যার মাধ্যমে সিনেমা মুক্তির আগেই দর্শক তার পছন্দ, প্রতীক্ষা ও পরিচয় নির্ধারণ করে। সিনেমার ট্রেলার, টিজার, ফার্স্ট লুক পোস্টার—এসব কেবল প্রচার উপাদান নয়; বরং দর্শকের মনে একধরনের পূর্বানুভূতির বীজ রোপণ করে।

এই আবেগগঠনের কেন্দ্রীয় উপাদান হয়ে ওঠে মিউজিক। নব্বইয়ের দশকে এবং তার পরে, সিনেমার গানের সাফল্য অনেক সময়েই সিনেমার সাফল্য পূর্বনির্ধারিত করে। Dil Se, Taal, Kal Ho Naa Ho, Aashiqui 2—এইসব সিনেমার গানের অ্যালবাম মুক্তির অনেক আগেই জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং সেই জনপ্রিয়তা সিনেমা দেখার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে।

এই প্রসঙ্গে মিউজিক রাইটস বিক্রি একধরনের ‘pre-release revenue security’ হিসেবে কাজ করে। প্রযোজকরা সিনেমা তৈরির খরচ আংশিক বা পুরোপুরি তুলতে পারেন শুধুমাত্র গানের কপিরাইট বিক্রি করেই। T-Series, Sony Music, Venus-এর মতো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রাইটস কেনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের লাভের পূর্বনির্ধারণ করে নেয়।

মনোবিশ্লেষণে, গান হল ‘emotional index’—যা দর্শকের স্মৃতি, প্রেম, প্রত্যাশা এবং আত্মপরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। একটি গান যদি জনপ্রিয় হয়, তবে সেই সিনেমা দর্শকের কাছে একটি আবেগীয় মানচিত্রে স্থান পায়। সে সিনেমার সংলাপ না জানলেও গান মুখস্থ থাকে। এই গীতিসত্তা সিনেমার স্থায়ীতা নির্ধারণ করে।

মার্কেটিং-এর আরেকটি স্তম্ভ হলো ব্র্যান্ড টাই-আপ। সিনেমার চরিত্রদের সঙ্গে শ্যাম্পু, ঘড়ি, মোবাইল ফোন বা গৃহস্থালি পণ্যের সংযোগ তৈরি হয়। এই সংযোগ আবার সিনেমার “image ecology”-র অংশ। Krrish, Ra.One, Chennai Express—এই সিনেমাগুলোর মার্কেটিং কৌশল ছিল এক প্রকার সামাজিক ঢেউ, যেখানে সিনেমা কেবল একটি গল্প নয়, বরং ‘experience’।

মনোবিশ্লেষণে এই কৌশল একধরনের ‘identity embedding’—যেখানে দর্শক শুধুই দর্শক থাকে না, বরং চরিত্রের ভোক্তা হয়ে ওঠে। সে শ্যাম্পু কেনে কারণ সিনেমার নায়িকা তা ব্যবহার করে, গান শোনে কারণ তা ট্রেন্ডিং, এবং সিনেমা দেখে কারণ সে আগে থেকেই সেই জগতের অংশ।

এই মার্কেটিং পরিবেশ দর্শককে একটি ‘curated emotional landscape’ দেয়। তারা নিজের অনুভবকে সিনেমার অংশ মনে করে। এটি কেবল বিনোদন নয়, বরং একটি ব্যক্তিগত সামাজিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।

মিউজিক রাইটস বিক্রি এখানে কাজ করে একধরনের ‘affective currency’ হিসেবে—যেখানে আবেগের বিক্রয় হয় স্বত্বাধিকার আকারে। একটি গান কেবল শোনার জন্য নয়, বরং তার মালিকানা হয় একটি সংস্থার, যেটি সেই গানকে অ্যাপে, বিজ্ঞাপনে, লাইভ কনসার্টে, ইউটিউবে বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করে। গান হয়ে ওঠে “commodity of emotion”—যা সংবেদনশীলতা ও লাভের সংমিশ্রণে তৈরি।

তবে এই মার্কেটিং ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত বিভ্রান্তিও থাকে। গান হিট হলেও সিনেমা ফ্লপ হয়—এই দ্বন্দ্ব ‘aesthetic misalignment’-এর পরিচায়ক। দর্শক হয়তো গান শুনে এক ধরনের সিনেমার কল্পনা করে, কিন্তু পর্দায় তা না পেয়ে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে। এই কারণেই আজকের মার্কেটিং ক্রমেই বেশি ‘hyper-narrativised’—যেখানে গান, ট্রেলার, পোস্টার, ইন্টারভিউ—সব এক কল্পনার খাঁচায় দর্শককে বন্দি করে।

এইজন্যেই বলিউডের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ও মিউজিক রাইটস বিক্রি শুধুমাত্র আর্থিক কৌশল নয়, বরং একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্প। এখানে আবেগ, স্মৃতি, প্রত্যাশা, এবং পরিচয়—সব একসঙ্গে মিশে তৈরি করে একটি নতুন দর্শক-সিনেমা সম্পর্ক। যেখানে সিনেমা কেবল দেখা হয় না, বরং আগেভাগেই অনুভব করা হয়।

সিনেমার ট্রেইলার প্রথমবার টিভিতে মুক্তি

এইজন্যেই বলিউডের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ও মিউজিক রাইটস বিক্রি শুধুমাত্র আর্থিক কৌশল নয়, বরং একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্প। এখানে আবেগ, স্মৃতি, প্রত্যাশা, এবং পরিচয়—সব একসঙ্গে মিশে তৈরি করে একটি নতুন দর্শক-সিনেমা সম্পর্ক। যেখানে সিনেমা কেবল দেখা হয় না, বরং আগেভাগেই অনুভব করা হয়।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে হিন্দি সিনেমার প্রচারে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটে—যখন সিনেমার ট্রেইলার প্রথমবার টেলিভিশনে মুক্তি পেতে শুরু করে। আগে ট্রেইলার দেখা যেত শুধুমাত্র প্রেক্ষাগৃহে, আর এখন দর্শক নিজের ঘরে বসেই টিভির পর্দায় সিনেমার প্রথম ঝলক দেখতে পায়। এটি নিছক মাধ্যম পরিবর্তন নয়; বরং এক মনস্তাত্ত্বিক সংস্কৃতির রূপান্তর, যা সিনেমাকে নতুনভাবে অনুভব করার অভ্যেস তৈরি করে। এই প্রবন্ধে আমরা সিনেমার ট্রেইলার টিভিতে প্রথমবার মুক্তি পাওয়ার সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও দর্শক-ভোক্তা সম্পর্কের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।

প্রেক্ষাগৃহে ট্রেইলার দেখার অভিজ্ঞতা ছিল এক সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা। কোনো একটি সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শক ‘পরের সিনেমা’র ট্রেইলার দেখে কৌতূহলী হত, হাততালি দিত, মাঝেমধ্যে নামটাও ভুলে যেত। সেই অভিজ্ঞতা ছিল যৌথ—একটি হলে, একটি স্ক্রিনে, একসঙ্গে বহুজন।

টিভিতে প্রথমবার ট্রেইলার মুক্তি এই অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তিগত করে তোলে। এখন দর্শক একা বা পরিবার নিয়ে ট্রেইলার দেখে, আর নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া দেয়। এটি একধরনের ‘emotional individualisation’—যেখানে প্রত্যেক দর্শক নিজের কল্পনার ওপর ভিত্তি করে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সে আর ‘হল’-এর অংশ নয়, সে নিজেই হয়ে ওঠে একক শ্রোতা।

মনোবিশ্লেষণে, ট্রেইলার টিভিতে মুক্তি পাওয়া মানে একধরনের ‘anticipatory ownership’—যেখানে দর্শক সিনেমাটি মুক্তির আগেই ‘নিজের’ বলে ভাবতে শুরু করে। যে দর্শক ট্রেইলার প্রথম টিভিতে দেখে, সে মনে করে—সে আগেই জানে সিনেমাটি কেমন হবে, আর এই জানার ভেতর থাকে একধরনের নিয়ন্ত্রণ ও আত্মতৃপ্তি।

এই নতুন রীতি সিনেমার বাজারকেও রূপান্তরিত করে। এখন সিনেমা মুক্তির বহু আগেই দর্শকের মনে সেই সিনেমার ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে—কাস্ট, গান, অ্যাকশন, সংলাপ—সব কিছুই আগেভাগেই প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। এটি ‘pre-release emotional framing’-এর নিদর্শন। ট্রেইলার দর্শককে সিনেমার পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা দেয় না, বরং আংশিক অনুভব দিয়ে একধরনের আবেগীয় অন্বেষণ তৈরি করে।

টিভিতে ট্রেইলার মুক্তির ফলে সিনেমা হয়ে ওঠে ঘরোয়া সংস্কৃতির অংশ। আগে সিনেমা মানে ছিল বাইরে যাওয়া, আজ সিনেমার প্রথম অভিজ্ঞতা শুরু হয় ঘর থেকেই। এই স্থানান্তর একধরনের ‘emotional domestication’—যেখানে সিনেমা কেবল বিনোদন নয়, বরং ঘরের ভেতরের অনুভব।

এই ঘরোয়া অভিজ্ঞতা আবার শ্রেণি-ভিত্তিক অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। যাঁরা থিয়েটারে যেতে পারতেন না, কিংবা মফস্বল বা গ্রামে বসবাস করতেন, তাঁরাও এখন টিভিতে বসে সিনেমার ট্রেইলার দেখতে পান। এটি একধরনের ‘democratic access’—যা দর্শকের আত্মমর্যাদা ও সংস্কৃতি অংশগ্রহণে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

মনোবিশ্লেষণে এই ট্রেইলার দেখা একধরনের ‘micro-narrative engagement’—যেখানে দর্শক একটি ট্রেইলার দেখেই কল্পনায় পুরো সিনেমা তৈরি করে নেয়। তারা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে, সামাজিক মাধ্যমে মত দেয়, এমনকি সিনেমা দেখার সিদ্ধান্তও ট্রেইলার দেখে নিয়ে নেয়। এই কল্পনা ও আলোচনা সিনেমাকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আগেই মানসিক বাস্তবতা বানিয়ে তোলে।

টেলিভিশনে ট্রেইলার মুক্তির প্রভাব বিজ্ঞাপন জগতেও পড়ে। ট্রেইলার হয়ে ওঠে একধরনের হাইব্রিড ফর্ম—সংবাদ, বিনোদন এবং বিজ্ঞাপনের সমন্বয়। দর্শক একটি সিনেমার টিজার দেখে, সঙ্গে খবর পায়, আবার গান বা সংলাপও শুনে ফেলে। এটি একধরনের ‘aesthetic hybridity’—যা শ্রোতা-দর্শকের মনস্তত্ত্বে স্থায়ী ছাপ ফেলে।

এই রূপান্তর প্রযোজকদের কাছে নতুন সুযোগও এনে দেয়। ট্রেইলার টিভিতে মুক্তি পেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়—TRP, ফোন কল, সংবাদপত্রের আলোচনা, চিঠি বা ই-মেইলের মাধ্যমে। এই প্রতিক্রিয়া আবার মার্কেটিংয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করে।

ট্রেইলার দেখার সময় দর্শক সবচেয়ে বেশি কী খোঁজে? মুখ্য চরিত্র, সংলাপ, আবহসঙ্গীত, অ্যাকশন দৃশ্য, রোমান্স—এইসব উপাদান একটি ট্রেইলারে একসঙ্গে থাকে। এটি দর্শকের ‘emotional preview menu’। তিনি এখান থেকে ঠিক করেন—এই সিনেমা আমার না অন্য কারও। এটি একধরনের আগাম প্রত্যাখ্যান বা গ্রহণ।

তবে ট্রেইলার টিভিতে মুক্তি পাওয়া মানেই সফলতা নয়। অনেক সময়েই দেখা যায়—টিভিতে দেখা ট্রেইলার সিনেমার ভুল ধারণা দেয়, প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়, এবং সিনেমা মুক্তির পর সেই প্রত্যাশা ভেঙে পড়ে। এই ফাঁককে বলা যায় ‘emotional dissonance’—যেখানে ট্রেইলার ও সিনেমার অভিজ্ঞতা মেলেনা। দর্শক তখন প্রতারিত বোধ করে।

এইজন্যেই ট্রেইলার নির্মাণ নিজেই একটি শিল্প হয়ে দাঁড়ায়—যেখানে একটি দেড় বা দুই মিনিটের ক্লিপ সিনেমার সারমর্ম নয়, বরং দর্শকের আবেগের টার্গেট পয়েন্ট নির্ধারণ করে। এই নির্ধারণ একধরনের ‘manipulated authenticity’—যেখানে সত্যিকারের সিনেমা নয়, বরং এর অভিজ্ঞান উপস্থাপন করা হয়।

এই প্রেক্ষাপটে, ট্রেইলার টিভিতে প্রথম মুক্তি পাওয়ার ঘটনা শুধুই প্রচার নয়; বরং দর্শকের মনোজগতে সিনেমা প্রবেশের এক নতুন দরজা খোলা। এটি সিনেমার আগে দর্শকের মনে এক আবেগীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, যার মধ্যে সিনেমা মুক্তির অনেক আগেই অভিজ্ঞতা শুরু হয়।

এইজন্য বলা যায়, সিনেমার ট্রেইলার যখন প্রথম টিভিতে মুক্তি পায়, তখন একটি নতুন ‘emotional technology’ চালু হয়—যেখানে অনুভব, প্রতীক্ষা এবং কল্পনা একসঙ্গে মিশে গিয়ে সিনেমাকে করে তোলে ব্যক্তিগত, পূর্বানুভূত এবং প্রায় বাস্তব।

দর্শক মনস্তত্ত্ব ও রুচির পরিবর্তন

নব্বই দশকের দর্শক কোন সিনেমায় সাড়া দিচ্ছিল

এইজন্য বলা যায়, সিনেমার ট্রেইলার যখন প্রথম টিভিতে মুক্তি পায়, তখন একটি নতুন ‘emotional technology’ চালু হয়—যেখানে অনুভব, প্রতীক্ষা এবং কল্পনা একসঙ্গে মিশে গিয়ে সিনেমাকে করে তোলে ব্যক্তিগত, পূর্বানুভূত এবং প্রায় বাস্তব।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা জগৎ ছিল এক সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের যুগ। এই সময়কালে ভারতীয় সমাজ অভ্যন্তরীণভাবে নানা সংকট, আকাঙ্ক্ষা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল—অর্থনৈতিক উদারীকরণ, মিডিয়ার প্রসার, উপভোক্তা সংস্কৃতির আগমন, এবং সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব। এই বহুবিধ পরিবর্তনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলিউডও নতুন নতুন ভাষা, নায়ক, সম্পর্ক, এবং চিত্রনাট্য খুঁজে নিচ্ছিল। দর্শক তখন কেবলমাত্র বিনোদন নয়, বরং নিজের মানসিক কাঠামোর প্রতিধ্বনি খুঁজছিল পর্দায়। এই প্রবন্ধে আমরা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অন্বেষণ করব—নব্বই দশকের দর্শক ঠিক কোন ধরনের সিনেমায় সাড়া দিচ্ছিল এবং কেন।

প্রথমত, প্রেম ও সম্পর্ককেন্দ্রিক রোমান্টিক সিনেমাগুলিতে ছিল দর্শকের বিপুল আবেগীয় সম্পৃক্ততা। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Hum Aapke Hain Koun..! , Dil To Pagal Hai, Kuch Kuch Hota Hai, Raja Hindustani—এইসব সিনেমায় প্রেম কেবল দু’জনের সম্পর্ক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মপ্রকাশের যুদ্ধ। মনোবিশ্লেষণে বলা যায়—দর্শক এখানে “idealised love under constraint” খুঁজে পেত। অর্থাৎ, একদিকে প্রেমকে সে স্বাধীন চেয়েছিল, অন্যদিকে সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিল। এই দ্বৈততা দর্শকের মানসিক কাঠামোরই প্রতিফলন।

এই সময়ে সাড়া পাওয়া সিনেমার আরেকটি ধারা ছিল পারিবারিক মেলোড্রামা—যেমন Hum Saath Saath Hain, Raja Babu, Dil Hai Ki Manta Nahin, Kabhi Khushi Kabhie Gham (যদিও এটি ২০০১ সালে মুক্তি পায়, তার প্রস্তুতি নব্বইয়ের দশকে শুরু)। এইসব সিনেমায় পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, আত্মত্যাগ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ‘আদর্শ সংস্করণ’ তৈরি হয়। দর্শক, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও গৃহস্থালি সংস্কৃতিতে আবদ্ধ শ্রেণি, এই সিনেমাগুলিতে নিজের আকাঙ্ক্ষিত পারিবারিক কাঠামোর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

মনোবিশ্লেষণে, এই ধারা ছিল ‘emotional reassurance’—যেখানে পারিবারিক সহানুভূতি ও সৌহার্দ্য একধরনের মানসিক নিরাপত্তা তৈরি করে। দর্শক সিনেমা দেখতে গিয়ে অনুভব করে—সে একটি এমন পরিবারের অংশ, যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু বিচ্ছেদ নেই; ভুল আছে, কিন্তু ঘৃণা নেই। এটি তার বাস্তব জীবনের অসংগতি থেকে মানসিক অবকাশ।

নব্বইয়ের দশকের দর্শক একদিকে যখন প্রেম ও পরিবারের নিরাপত্তা খুঁজছিল, অন্যদিকে তখনই তারা ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নায়ক’কেও সাদরে গ্রহণ করছিল। Ghayal, Damini, Ghatak, Mohra, Karan Arjun—এইসব সিনেমায় সানি দেওল, সুনীল শেঠি, অক্ষয় কুমার, সালমান খান, শাহরুখ খান—সবাই একের পর এক সমাজ, রাষ্ট্র, এবং পারিবারিক শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

এইসব সিনেমায় দর্শক নিজের অন্তর্গত ক্ষোভ, বঞ্চনা, এবং শোষণের অভিজ্ঞতাকে চরিত্রের মধ্য দিয়ে বেঁচে নিতে চায়। মনোবিশ্লেষণে, এই চরিত্রগুলো ‘vicarious vengeance’-এর প্রতীক। দর্শক নিজে প্রতিবাদ করতে পারে না, কিন্তু এইসব চরিত্র দেখে তার মনে হয়—“আমি চাইলে পারতাম”। এই কল্পনাগত প্রতিশোধের অভিজ্ঞতা দর্শককে আত্মবিশ্বাস ও মানসিক মুক্তি দেয়।

আরও একটি প্রবণতা দেখা যায়—“সাধারণ মানুষের নায়ক” গোবিন্দ, জনি লিভার, রাজু শ্রীবাস্তবদের জনপ্রিয়তা। Coolie No. 1, Hero No. 1, Dulhe Raja—এইসব সিনেমায় হাস্যরসের ভেতরে থাকে শ্রেণিসংগ্রাম, আত্মসম্মান, এবং মধ্যবিত্তীয় চাতুর্য। দর্শক নিজের আর্থিক সীমাবদ্ধতা, হাস্যকর পরিস্থিতি এবং দৈনন্দিন অনিশ্চয়তাকে এসব চরিত্রের হাসির মধ্যে গলিয়ে দেয়। এটি একধরনের ‘comic catharsis’।

আরও লক্ষণীয় বিষয়—নব্বই দশকে গান হয়ে ওঠে সিনেমা দেখার সিদ্ধান্ত নির্ধারণকারী উপাদান। Taal, Dil Se, Gupt, Pardes, Rangeela—এইসব সিনেমার গান আগে জনপ্রিয় হয়, পরে দর্শক হলে যায়। গান মানে কেবল মেলোডি নয়, বরং একধরনের ‘pre-experienced emotion’। গান যদি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবে দর্শক মনে করে—সিনেমাটিও তারই অভ্যন্তরীণ চেতনার সম্প্রসারণ হবে।

মনোবিশ্লেষণে এই গানভিত্তিক প্রতিক্রিয়া হলো ‘affective resonance’—যেখানে আবেগের প্রাক-প্রতিসংবেদন সিনেমার সিদ্ধান্তে রূপ নেয়।

তবে শুধুমাত্র রোমান্স, মেলোড্রামা বা অ্যাকশন নয়—নব্বইয়ের দশকের দর্শক মননশীল সিনেমাতেও সাড়া দিচ্ছিল। Zakhm, Dushman, Satya, Bandit Queen, 1947: Earth—এইসব সিনেমায় সম্পর্ক, ইতিহাস, জাতি, লিঙ্গ ও সমাজবোধের এক নতুন ভাষা নির্মিত হচ্ছিল। এইসব দর্শক সংখ্যায় কম হলেও মানসিক গভীরতায় অনন্য। তারা সিনেমায় খুঁজছিল প্রশ্ন, টানাপোড়েন, এবং সুনির্দিষ্ট মতাদর্শগত অবস্থান।

এই শ্রেণির দর্শকের মনোবিশ্লেষণ ‘cognitive activation’—যেখানে সিনেমা তার চিন্তা, নৈতিকতা ও আদর্শকে আলোড়িত করে। তারা কেবল গল্প দেখে না, বরং বিশ্লেষণ করে, আত্মসমীক্ষা করে।

এইভাবে, নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার দর্শক এক বহুমাত্রিক চরিত্র—যিনি প্রেম খোঁজেন, পরিবার চান, প্রতিবাদে বিশ্বাস করেন, মেলোডি উপভোগ করেন এবং গভীর প্রশ্নও তোলেন। এইসব প্রতিক্রিয়ার পেছনে রয়েছে এক অস্থির সময়, একটি পরিবর্তনশীল সমাজ এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় রক্ষার আকুতি।

এইজন্য বলা যায়, নব্বই দশকের দর্শক কেবল সিনেমা ‘দেখে’ নি; সে সিনেমার ভেতরে নিজের ‘মন’ খুঁজেছে—ভুলের মধ্যে মুক্তি, আঘাতের মধ্যে প্রেম, এবং কল্পনার মধ্যে সাহস।

প্রেম, পরিবার, দেশপ্রেম ও একশন—এই চার স্তম্ভ

এইজন্য বলা যায়, নব্বই দশকের দর্শক কেবল সিনেমা ‘দেখে’ নি; সে সিনেমার ভেতরে নিজের ‘মন’ খুঁজেছে—ভুলের মধ্যে মুক্তি, আঘাতের মধ্যে প্রেম, এবং কল্পনার মধ্যে সাহস।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার বুনন এক আশ্চর্য চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল—প্রেম, পরিবার, দেশপ্রেম ও অ্যাকশন। এই চারটি উপাদান ছিল কেবলমাত্র চিত্রনাট্যের কাঠামো নয়; বরং দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা, সাংস্কৃতিক অভ্যেস এবং পরিচয়ের বহুবিধ সংকটের এক সুর সমাধান। এই স্তম্ভগুলির প্রত্যেকটি আলাদাভাবে যেমন শক্তিশালী, তেমনি সম্মিলিতভাবে এক অপরিহার্য আবেগীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করত। এই প্রবন্ধে আমরা এই চারটি স্তম্ভকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে অনুধাবন করব।

প্রথম স্তম্ভ—প্রেম। নব্বইয়ের দশকে প্রেম ছিল নিছক আকর্ষণ নয়, বরং নিয়ত পরিপক্ব হয়ে ওঠা এক আত্মসন্ধান। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Raja Hindustani, Kuch Kuch Hota Hai, Dil To Pagal Hai—এইসব সিনেমায় প্রেম ছিল সামাজিক নিয়মের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয়ের একধরনের সংগ্রাম। প্রেমের প্রশ্ন কেবল কে কাকে ভালোবাসল না, বরং কে কার জন্য কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত, এই উত্তরের মধ্যে নিহিত ছিল দর্শকের আবেগীয় জড়তা।

মনোবিশ্লেষণে, নব্বই দশকের প্রেমের সিনেমা একধরনের ‘emotional individuation’—যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার আলাদা পরিচয়, সংকট ও স্বপ্ন থাকে, কিন্তু মিলনের মুহূর্তে তারা এক ‘ethical commitment’-এ পৌঁছে যায়। দর্শক এই প্রেমে নিজের দীর্ঘশ্বাস, অপেক্ষা, অসমাপ্ত চিঠি, না বলা সংলাপকে দেখতে পেত। এটি কেবল ফ্যান্টাসি নয়, বরং একধরনের আত্মনিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষা।

দ্বিতীয় স্তম্ভ—পরিবার। Hum Aapke Hain Koun..! , Hum Saath Saath Hain, Kabhi Khushi Kabhie Gham—এইসব সিনেমা আমাদের শেখায় যে সম্পর্ক যতই টানাপোড়েনময় হোক, পরিবার শেষ পর্যন্ত আশ্রয়স্থল। এই পরিবার কেবল আত্মীয়তার কাঠামো নয়, বরং এক ‘emotional refuge’। মনোবিশ্লেষণে বলা যায়—এইসব সিনেমায় পরিবার একধরনের ‘idealised collectivity’—যেখানে ভুল ক্ষমাযোগ্য, সম্পর্ক পুনর্নির্মাণযোগ্য, এবং একত্রবাস মানেই নিরাময়ের প্রতীক।

দর্শক এইসব ছবিতে নিজের খণ্ডিত বাস্তবতার বদলে এক পরিপূর্ণ পারিবারিক কাঠামো খুঁজে পায়—যেখানে বাবা হয় স্নেহময়, মা হয় ত্যাগময়ী, ভাই হয় রক্ষাকর্তা, এবং বোন হয় বিশ্বাসের মূর্ত রূপ। এই পারিবারিক বুননের মধ্যে রয়েছে একধরনের ‘aspirational intimacy’—যা বাস্তব নয়, কিন্তু কাম্য।

তৃতীয় স্তম্ভ—দেশপ্রেম। Border, Sarfarosh, Roja, 1942: A Love Story—এইসব সিনেমায় দেশ কেবল একটি ভৌগোলিক সত্তা নয়; বরং এক অন্তর্জাগতিক দায়। দেশপ্রেম এখানে যুদ্ধ নয়, বরং আত্মত্যাগ। দেশপ্রেমিক চরিত্ররা তাদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন বিসর্জন দেয়, পরিবারকে পিছনে রেখে দেশরক্ষায় এগিয়ে যায়। মনোবিশ্লেষণে, এই দেশপ্রেম একধরনের ‘sublimated loyalty’—যেখানে ব্যক্তির ভেতরের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও আত্মসম্মান এক বৃহৎ চেতনায় বিলীন হয়ে যায়।

এই দেশপ্রেমের সিনেমা দর্শকের মধ্যে একধরনের গৌরব তৈরি করে—“আমি ভারতের সন্তান”—এই বোধ কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং আত্মিক। এটি সেইসব দর্শকের কাছে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলত, যারা নিজেকে সমাজে উপেক্ষিত মনে করত, কিন্তু পর্দায় দেখে যে সেও দেশরক্ষার অংশীদার। এটি একধরনের ‘compensatory pride’।

চতুর্থ স্তম্ভ—অ্যাকশন। নব্বই দশকের অ্যাকশন সিনেমা কেবল মারধর নয়, বরং ন্যায়ের খোঁজে এক ব্যক্তিগত যুদ্ধ। Ghayal, Ghatak, Mohra, Karan Arjun, Baazi—এইসব সিনেমায় নায়ক কেবল শারীরিকভাবে শক্তিশালী নয়, বরং নৈতিকভাবে সুসংগঠিত। তার রাগ যুক্তিসংগত, তার প্রতিশোধ সুশৃঙ্খল। দর্শক তার মাধ্যমে নিজের অসহায়তা দূর করতে চায়।

মনোবিশ্লেষণে এইসব সিনেমা ‘repressed rage articulation’—যেখানে দর্শক নিজের জীবনের বঞ্চনা, চাকরির অনিশ্চয়তা, দুর্নীতির শিকার হওয়া, কিংবা রাষ্ট্রীয় অবহেলাকে সিনেমার নায়কের প্রতিশোধে রূপান্তর করে। এই প্রতিশোধ কল্পনাপ্রসূত হলেও, মানসিকভাবে নিরাময়মূলক। এটি একধরনের ‘cinematic justice fantasy’।

এই চার স্তম্ভ আলাদা আলাদা হলেও, নব্বইয়ের দশকের বেশিরভাগ সিনেমায় তারা একত্রিতভাবে কাজ করত। যেমন Dil Se—যেখানে প্রেম ও দেশপ্রেম এক হয়ে যায়; Karan Arjun—যেখানে পরিবার ও প্রতিশোধ একে অপরকে চালিত করে; Roja—যেখানে প্রেম, দেশপ্রেম ও অ্যাকশন এক সুত্রে বাঁধা পড়ে। এইসব সংমিশ্রণ তৈরি করে একধরনের ‘holistic emotional ecology’—যেখানে দর্শকের প্রতিটি আবেগের খিদে পূরণ হয়।

এইজন্যেই নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমা শুধুই বিনোদন ছিল না; বরং এক মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয়স্থল। দর্শক এই সিনেমাগুলিকে দেখে শুধু সময় কাটায়নি, বরং নিজের ভেতরের প্রেম, পরিবার, দেশ, এবং ক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। এই চার স্তম্ভ ছিল তার মানসিক ভারসাম্যের স্তম্ভ।

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার চার স্তম্ভ—প্রেম, পরিবার, দেশপ্রেম ও অ্যাকশন—ভারতীয় দর্শকের মনোজগৎকে একত্রে ধারণ করেছিল। এই উপাদানগুলো তার বাস্তবের থেকে বড়, কিন্তু বাস্তবের মতোই গভীর। এই সিনেমাগুলো ছিল তার আত্মার মানচিত্র—যেখানে সে পথ খুঁজে পেত, দিশা পেত, এবং হয়তো কোথাও নিজেকেও খুঁজে পেত।

নস্টালজিয়া এবং “ফ্যামিলি ওয়াচ” কালচারের আবির্ভাব

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার চার স্তম্ভ—প্রেম, পরিবার, দেশপ্রেম ও অ্যাকশন—ভারতীয় দর্শকের মনোজগৎকে একত্রে ধারণ করেছিল। এই উপাদানগুলো তার বাস্তবের থেকে বড়, কিন্তু বাস্তবের মতোই গভীর। এই সিনেমাগুলো ছিল তার আত্মার মানচিত্র—যেখানে সে পথ খুঁজে পেত, দিশা পেত, এবং হয়তো কোথাও নিজেকেও খুঁজে পেত।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার একটি গভীরতর মানসিক প্রবণতা ছিল ‘Nostalgia’—অতীতের প্রতি আবেগঘন টান, এবং তার সঙ্গে জড়িত একধরনের স্থিতিশীলতার আকুতি। এই সময়ে ‘ফ্যামিলি ওয়াচ’ কালচারের আবির্ভাব এই নস্টালজিয়াকেই সাংস্কৃতিক আচার করে তোলে। সিনেমা কেবল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং পারিবারিক সমবেততার অংশ হয়ে ওঠে। এই প্রবন্ধে আমরা ‘nostalgia’ ও ‘family watch’ কালচারের উত্থানকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে পর্যালোচনা করব।

নস্টালজিয়া কোনো সময়কাল নয়; এটি একটি মানসিক অবস্থা—যেখানে দর্শক অতীতের কোনো অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের সংকট থেকে রক্ষা হিসেবে অনুভব করে। নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় সমাজ অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বৈশ্বিক সংস্কৃতির আগমন এবং সামাজিক চেতনায় দ্রুত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়। এর ফলে মানুষের মনে জন্ম নেয় ‘instability anxiety’। এই অনিশ্চয়তার ভিতরে দাঁড়িয়ে মানুষ সিনেমায় খোঁজে সেই চেনা, নির্ভরযোগ্য, অতীতমুখী জগত—যেখানে পরিবার ছিল একত্র, প্রেম ছিল নির্মল, দেশ ছিল শ্রদ্ধার প্রতীক।

এই অতীতকেন্দ্রিক আকর্ষণ নব্বইয়ের দশকের বহু সিনেমায় প্রকাশিত হয়। Hum Aapke Hain Koun..!, Dilwale Dulhania Le Jayenge, Kabhi Khushi Kabhie Gham, Dil To Pagal Hai—এইসব ছবিতে অতীতের মূল্যবোধ, পরিবারে একত্র বাস, সম্মান, প্রেমে সংযম, এবং ভাষায় নম্রতা—সবকিছু যেন এক আদর্শ সময়ের পুনর্নিমাণ। দর্শক এইসব সিনেমায় নিজেকে একটি “safe emotional zone”-এ স্থানান্তরিত করতে পারে।

মনোবিশ্লেষণে বলা যায়—এই নস্টালজিয়া একধরনের ‘affective defense mechanism’—যেখানে ব্যক্তি বর্তমান জটিলতা থেকে পালিয়ে এমন এক মানসিক স্থানে আশ্রয় নেয়, যেখানে সবকিছু ছিল সহজ, মধুর এবং নিশ্চিত। এই পলায়ন মানসিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশল, বিশেষত একটি পরিবর্তনশীল সমাজে।

এই পলায়নের মধ্যেই জন্ম নেয় ‘ফ্যামিলি ওয়াচ’ কালচার। টিভিতে সাপ্তাহিক সিনেমা, ভিডিও ক্যাসেটে ভাড়া করে একসঙ্গে দেখা, বা রবিবারের প্রাতঃরাশের সময় পুরো পরিবার মিলে কোনো সিনেমা দেখা—এইসব ছিল নিছক বিনোদন নয়, বরং একধরনের পারিবারিক আচার। এই আচার আবেগ নির্মাণ করত, সম্পর্ক সংহত করত, এবং একধরনের ‘emotional synchronization’ ঘটাত।

মনোবিশ্লেষণে পরিবার মিলে সিনেমা দেখা মানে কেবল দৃশ্য দেখা নয়, বরং একত্র হাওয়া, একত্র প্রতিক্রিয়া করা, একত্র স্মৃতি তৈরি করা। এই ‘joint viewing’ পারিবারিক মানসিকতার একটি ‘shared narrative structure’ তৈরি করে—যেখানে প্রতিটি সদস্য একটি অভিজ্ঞতার সঙ্গী হয়ে ওঠে।

এই সংস্কৃতি বিশেষত মফস্বল ও মধ্যবিত্ত পরিবারে গভীর প্রভাব ফেলে। যেখানে বাইরে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য কম, কিংবা একক অভিজ্ঞতা গ্রহণের পরিসর সীমিত, সেখানে ফ্যামিলি ওয়াচ হয়ে ওঠে একমাত্র বিনোদন, আর সেই বিনোদনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে পারিবারিক সংহতি। সিনেমা হয় পারিবারিক আদর্শ, পরামর্শ, আনন্দ ও শোকের একত্র অভিজ্ঞতা।

এই দর্শনীয় অভ্যাস পরবর্তী সময়েও থেকে যায়। এখনও অনেক পরিবার নব্বইয়ের সিনেমা দেখলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তারা বলে—“এই সিনেমা আমরা একসঙ্গে দেখেছিলাম”, “মায়ের খুব প্রিয় গান ছিল”, “বাবা এই সংলাপে হাসতেন”—এইসব মন্তব্য শুধুই স্মৃতি নয়, বরং একধরনের ‘emotional continuity’—যা প্রজন্মান্তরে রয়ে যায়।

নস্টালজিয়া কেবল পুরনো সিনেমার প্রতি আকর্ষণ নয়; বরং সেই সময়ের আবেগ, সম্পর্ক ও ভাষার প্রতি আকর্ষণ। দর্শক যখন Dilwale Dulhania Le Jayenge আবার দেখে, সে শুধু রাজ-সিমরনের প্রেম দেখে না, বরং নিজের কৈশোর, নিজের প্রথম প্রেম, কিংবা বাবার সঙ্গে সিনেমা হলে যাওয়ার স্মৃতি খোঁজে। এই স্মৃতি তাকে আবার তার শিকড়ে ফিরিয়ে দেয়। এটি একধরনের ‘emotional homecoming’।

সিনেমা নির্মাতারাও এই আবেগ বুঝতে শেখেন। তাই তারা পরে Main Prem Ki Diwani Hoon, Vivah, Kabhi Khushi Kabhie Gham, Baghban, Dil Dhadakne Do ইত্যাদিতে পরিবারকেন্দ্রিক আখ্যান ও সংবেদনশীল সম্পর্ককে সামনে আনেন। এর ফলে ফ্যামিলি ওয়াচ সংস্কৃতি শুধু বজায় থাকে না, বরং নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নস্টালজিয়া ও ফ্যামিলি ওয়াচ কালচার একে অপরের পরিপূরক। একদিকে অতীতের প্রতি আকর্ষণ, অন্যদিকে সমবেত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন—দুটোই মিলে নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমাকে করে তোলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দর্শক শুধুই সিনেমা দেখে না, বরং দেখে সেই সময়টাকে, যেটা হারিয়ে গেছে, অথচ মনে গেঁথে আছে।

এইজন্যেই বলা যায়—নব্বইয়ের দশকের সিনেমা কেবল একটি সময়ের শিল্প নয়; বরং একটি মানসিক আশ্রয়, একটি পরিবারিক বৃত্ত, এবং একটি প্রজন্মের যৌথ অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান। নস্টালজিয়া এখানে ইতিহাস নয়, বরং হৃদয়ের এক অনিবার্য টান।

সিনেমা দর্শনের স্থানীয় সংস্কৃতির উপর প্রভাব

এইজন্যেই বলা যায়—নব্বইয়ের দশকের সিনেমা কেবল একটি সময়ের শিল্প নয়; বরং একটি মানসিক আশ্রয়, একটি পরিবারিক বৃত্ত, এবং একটি প্রজন্মের যৌথ অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান। নস্টালজিয়া এখানে ইতিহাস নয়, বরং হৃদয়ের এক অনিবার্য টান।

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার একটি গভীর প্রভাব পড়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় সিনেমা-দর্শন সংস্কৃতির ওপর। সিনেমা কেবল একটি মাধ্যম ছিল না; বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুশীলন, যার অভ্যন্তরে দর্শকের নিজস্ব অঞ্চল, ভাষা, রুচি ও সমাজতাত্ত্বিক অবস্থান একাধিকভাবে প্রতিফলিত হতো। এই প্রবন্ধে আমরা নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার প্রভাবে স্থানীয় সিনেমা দর্শনের অভ্যাস, চিন্তা ও অভিব্যক্তির উপর কী প্রভাব পড়েছে, তার একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ করব।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সিনেমা দেখার নিজস্বতা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। বাংলা, মারাঠি, তামিল, মালায়ালম বা ভোজপুরি সিনেমার দর্শকরা নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে যে পরিসর গড়ে তুলেছিলেন, নব্বইয়ের হিন্দি সিনেমা তার সঙ্গে এক নতুন প্রলোভনের পরিসর তৈরি করে। বিশেষত যখন DDLJ, HAHK, Raja Hindustani, Kuch Kuch Hota Hai জাতীয় হিন্দি সিনেমা গ্রামাঞ্চল, মফস্বল এমনকি আঞ্চলিক শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানকার মানুষ নিজের সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এক ‘নতুন অভিজ্ঞতা’ লাভ করতে শুরু করে।

এই অভিজ্ঞতা ছিল ‘visual aspiration’-এর অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ, স্থানীয় দর্শক হিন্দি সিনেমার ঝলমলে পোশাক, শহুরে ভাষা, পারিবারিক নাটক ও গ্ল্যামার দেখে এক ধরনের মানসিক আকর্ষণ অনুভব করে, যা তাদের নিজস্ব অভ্যস্ত জগতের থেকে পৃথক হলেও কাম্য হয়ে ওঠে। মনোবিশ্লেষণে, এই আকর্ষণ এক ধরনের ‘aesthetic alienation’—যেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ধীরে ধীরে কম আকর্ষণীয় মনে হয়।

ফলে, আঞ্চলিক সিনেমাগুলোর কাহিনি নির্মাণেও বদল আসতে থাকে। বাংলায় যেমন শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, বাবুর বাড়ি, ভালোবাসা ভালোবেসে প্রভৃতি সিনেমায় হিন্দি স্টাইলের গান, প্রেম, বিদেশযাত্রা ও বিত্তের উপস্থাপন দেখা যায়। এই প্রবণতা কেবল অনুকরণ নয়, বরং দর্শকের মানসিক কাঠামোর এক বিবর্তন, যেখানে তারা ‘নিজস্ব সংস্কৃতির ভেতরে হিন্দি অভিজ্ঞান’-কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

এই ধারা গ্রামীণ অঞ্চলেও গভীর প্রভাব ফেলে। VHS ক্যাসেট বা VCR-এর মাধ্যমে হিন্দি সিনেমা প্রবেশ করে চায়ের দোকান, কাঁচাবাজার, বা ছোটো দোকানের মধ্যে। লোকেরা রাত জেগে সিনেমা দেখে, গান মুখস্থ করে, সংলাপ অনুকরণ করে। এইসব আচরণ স্থানীয় জীবনের একধরনের ‘popular performance’-এ পরিণত হয়।

মনোবিশ্লেষণে এই অভ্যাস এক ধরনের ‘symbolic migration’—যেখানে ব্যক্তি স্থানচ্যুত না হয়েও মানসিকভাবে এক ভিন্ন জগতে স্থানান্তরিত হয়। সে তখন নিজের স্থানিক অভিজ্ঞতার মধ্যে হিন্দি সিনেমার শৈলী, ভাষা ও আচার মিশিয়ে নেয়।

এই প্রভাব শুধু জীবনধারায় নয়, ভাষাতেও পড়ে। আঞ্চলিক কথোপকথনে হিন্দি সংলাপ, ‘অভি আমি জিন্দা হুঁ’, ‘ম্যায় আপনে পিতাজি কা গুনাহগার নেহি হুঁ’ জাতীয় বাক্য ব্যবহার শুরু হয়। এটি এক ধরনের ‘linguistic incorporation’—যা দর্শকের ভাষা-চর্চাকে পরিবর্তন করে দেয়।

‘ফ্যাশন’ এবং ‘শরীরী ভঙ্গিমা’-তেও আসে প্রভাব। হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো সালোয়ার কামিজ পরা, নায়কদের মতো চুল ছাঁটা, চশমা পরা বা হাঁটার ভঙ্গিমা অনুকরণ—এইসব হয়ে ওঠে স্থানীয় যুব সমাজের মধ্যে ‘সিনেমা-নির্ভর আত্মপরিচয়ের অভিব্যক্তি’। এই আচরণ দর্শকের মধ্যে ‘embodied cinephilia’ সৃষ্টি করে—যেখানে সিনেমা শুধু দেখা হয় না, বরং শরীরেও প্রকাশিত হয়।

স্থানীয় মেলার মাঠে, বিয়ের মঞ্চে, স্কুল-কলেজে, এবং নাট্যমঞ্চেও হিন্দি সিনেমার গান ও সংলাপ ঢুকে পড়ে। আঞ্চলিক সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে ঢুকে পড়ে এক হিন্দিভাষিক চেতনা। এই সংমিশ্রণ অনেকসময় স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য চাপ তৈরি করে।

তবে এই পরিবর্তন সবসময় নেতিবাচক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে হিন্দি সিনেমার ভাষা ও শৈলী স্থানীয় নির্মাতাদের কাছে একধরনের ‘technological model’ হিসেবে কাজ করেছে। তারা হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, আবহসঙ্গীত, সংলাপ, ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের নতুন নতুন ধরন শিখেছে এবং নিজেদের সিনেমায় প্রয়োগ করেছে। এটি একধরনের ‘cultural hybridization’—যেখানে আঞ্চলিক সিনেমা হিন্দির স্টাইল গ্রহণ করেও নিজস্ব চেতনা বজায় রাখার চেষ্টা করে।

দর্শকের মানসিক অভ্যাসেও আসে বদল। আগে যেখানে সিনেমা দেখার সময় হাসাহাসি, গায়ে হাত দিয়ে চিৎকার, শিস দেওয়া স্বাভাবিক ছিল, হিন্দি সিনেমা সেই অভ্যাসে নিরবতা, সংযম ও ‘দর্শক-শৃঙ্খলা’ আনে। এই পরিবর্তন একধরনের ‘aesthetic behavioural shift’। সিনেমা দেখা শুধু উপভোগ নয়, বরং ‘আভিজাত্য’র অংশ হয়ে ওঠে।

এইজন্যেই বলা যায়, নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার প্রভাব স্থানীয় সিনেমা দর্শনের উপর এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনে। এটি কেবল অনুকরণ নয়, বরং একধরনের মানসিক অভিযোজন, যেখানে স্থানীয় দর্শক নিজের সংস্কৃতির ভেতরেই নতুনত্ব, আধুনিকতা এবং ‘প্যান-ইন্ডিয়ান আবেগ’ খুঁজে নেয়। এই পরিবর্তন দ্বৈত—একদিকে আগ্রাসন, অন্যদিকে অভিযোজন। আর এই দ্বৈততার ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে নব্বই দশকের ভারতীয় সিনেমার এক যৌথ সাংস্কৃতিক মানচিত্র।

নব্বইয়ের উত্তরাধিকার

কিভাবে নব্বই দশক ২০০০-এর সিনেমাকে তৈরি করল

এইজন্যেই বলা যায়, নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার প্রভাব স্থানীয় সিনেমা দর্শনের উপর এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনে। এটি কেবল অনুকরণ নয়, বরং একধরনের মানসিক অভিযোজন, যেখানে স্থানীয় দর্শক নিজের সংস্কৃতির ভেতরেই নতুনত্ব, আধুনিকতা এবং ‘প্যান-ইন্ডিয়ান আবেগ’ খুঁজে নেয়। এই পরিবর্তন দ্বৈত—একদিকে আগ্রাসন, অন্যদিকে অভিযোজন। আর এই দ্বৈততার ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে নব্বই দশকের ভারতীয় সিনেমার এক যৌথ সাংস্কৃতিক মানচিত্র।

নব্বই দশক শুধু একটি দশক ছিল না, বরং ভারতীয় হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এক ‘foundation moment’—যা পরবর্তী ২০০০-এর দশকের সিনেমা ও দর্শক-মনস্তত্ত্বকে গড়ে তোলে। এই দশককে বোঝা মানে শুধু DDLJ বা HAHK বোঝা নয়, বরং সেই সময়কার সংস্কার, আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অভিঘাত এবং ভেতর থেকে তৈরি হওয়া এক নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার আবিষ্কার। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব—নব্বইয়ের দশক কিভাবে সিনেমার আঙ্গিক, ভাষা, দর্শক, প্রযোজনা এবং ভাবনার ক্ষেত্রে এমন এক ভূমিকা রাখল, যা ২০০০-এর সিনেমাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্মাণ করল।

নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তার দ্বৈততা—একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিকতা। এই দ্বৈততাই পরবর্তী দশকে এসে মিলিয়ে যায় একধরনের hybrid sensibility-তে, যাকে আমরা ২০০০-এর সিনেমার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, Kabhi Khushi Kabhie Gham (২০০১) একই সঙ্গে এক রাজকীয়, পারিবারিক নস্টালজিয়ার প্রতীক এবং একটি গ্ল্যামারাইজড, ওয়েস্টার্নাইজড ভারতীয় মধ্যবিত্ত স্বপ্ন। এই বৈপরীত্যের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল নব্বইয়ের সিনেমাগুলোর ভেতর দিয়ে।

নব্বইয়ের প্রেমের সিনেমাগুলো যেমন Dilwale Dulhania Le Jayenge, Dil To Pagal Hai, Kuch Kuch Hota Hai—এসবই ২০০০-এর প্রেমকে একধরনের স্থির, একান্ত অভিজ্ঞতার জায়গা করে দেয়, যেখানে প্রেম ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের আগেও ছিল এক গভীর সংবেদনের চর্চা। মনোবিশ্লেষণে, নব্বইয়ের প্রেম ছিল ‘delayed gratification’—যেখানে প্রেম মানে অপেক্ষা, সংকোচ, সংযম। এই মানসিক কাঠামো পরবর্তী সময়েও বহাল থাকে, যদিও প্রযুক্তি ও ভিজ্যুয়াল স্টাইল বদলায়।

নব্বইয়ের দশকের পরিবারচিন্তা, বিশেষত HAHK, Hum Saath Saath Hain, Raja Hindustani জাতীয় সিনেমাগুলো ২০০০-এর দশকে এসে Baghban, Vivah, Kabhi Alvida Naa Kehna বা Paa সিনেমার মাধ্যমে এক নতুন দৃষ্টিকোণ পায়—এখন পরিবার কেবল একটি স্থির কাঠামো নয়, বরং একধরনের আলোচ্য, প্রশ্নযোগ্য সম্পর্ক। নব্বইয়ের দশক এই ‘সংবেদনশীলতা’ ও ‘রিলেশনশিপ টেমপ্লেট’ নির্মাণ করে দিয়েছিল।

মনোবিশ্লেষণে, নব্বইয়ের দশকের পরিবার ধারণা ছিল ‘idealised collectivism’—যা পরবর্তী দশকে গিয়ে একধরনের ‘negotiated intimacy’-তে রূপ নেয়। অর্থাৎ পরিবার আর কেবল আদর্শ নয়, বরং তা হুমকির মুখে, এবং সেই হুমকি থেকে তা রক্ষার নৈতিক ও আবেগীয় প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়।

দেশপ্রেম, যে ধারণাটি নব্বইয়ে Roja, Border, Sarfarosh-এর মাধ্যমে এক উচ্চ আবেগে উপনীত হয়েছিল, ২০০০-এর দশকে এসে Rang De Basanti, Swades, Chak De India, Lakshya-র মাধ্যমে এক ‘reflective patriotism’-এ রূপ নেয়। আগের সিনেমাগুলোয় দেশপ্রেম ছিল উৎসবের মতো, নতুন সিনেমাগুলোয় তা প্রশ্নবোধক। এই রূপান্তরের বীজও নব্বইয়ের সিনেমা বপন করে দেয়।

অ্যাকশন সিনেমাও একইভাবে রূপান্তরিত হয়। নব্বইয়ে যেখানে সানি দেওলের ধ্বংসাত্মক রাগ ছিল মূল, ২০০০-এর দশকে তা হয়ে ওঠে ‘stylised vengeance’—যেমন Dhoom, Don, Ghajini, Singham ইত্যাদি। মনোবিশ্লেষণে, নব্বইয়ের রাগ ছিল ‘organic resistance’, পরবর্তী দশকের অ্যাকশন হয়ে যায় ‘aestheticised assertion’। এটি আবেগের থেকে বেশি স্টাইলের; প্রতিবাদের থেকে বেশি কোরিওগ্রাফির।

নব্বইয়ের দশকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান—তার গান ও সাউন্ডস্কেপ। নাদিম-শ্রবণ, অনু মালিক, জতিন-ললিত, এ আর রহমান—এইসব সুরকারদের তৈরি করা ‘emotionally resonant melody’ ২০০০-এর গানে এক নতুন গ্ল্যামার, ডিজিটাল বিট, এবং ফিউশন সংবেদনার জন্ম দেয়। Taal, Dil Se, Pardes ইত্যাদির গানে যে আত্মিক আবেগ ছিল, তা পরবর্তীতে Kal Ho Naa Ho, Veer-Zaara, Jab We Met-এ রূপান্তরিত হয়, যেখানে সেন্টিমেন্টের সঙ্গে থাকে urbane modernity।

সবচেয়ে গভীর মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটে দর্শকের মধ্যে। নব্বইয়ের দশকে দর্শক সিনেমার কাছে আশ্রয় খুঁজত—পরিবার, প্রেম, প্রতিবাদ, গান। ২০০০-এর দর্শক সিনেমার কাছে খোঁজে ‘reflection’, ‘inquiry’, ‘engagement’। এই পরিবর্তনের মনস্তত্ত্ব হলো—‘passive affection’-এর জায়গায় এসেছে ‘active introspection’। তবে এই introspection-এর অভ্যাস তৈরি হয়েছিল সেই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে, যেগুলো দর্শককে ধীরে ধীরে চর্চার মধ্যে নিয়েছিল।

এইভাবে বলা যায়, নব্বইয়ের দশক একটি ‘emotional rehearsal space’—যেখানে দর্শক, পরিচালক, প্রযোজক, এবং অভিনেতারা নিজেদের নতুন করে চিনতে শেখে। এই চেনা থেকেই ২০০০-এর সিনেমা পায় তার জটিলতা, দ্বিধা, নান্দনিকতা এবং এক নতুন ভারতীয় আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা।

এইজন্যেই নব্বই দশক ছিল একটি ‘incubation period’—যেখানে আবেগ, প্রতিষ্ঠান, সম্পর্ক, দর্শকতা—সব এক জায়গায় এসে ভবিষ্যতের সিনেমার আত্মাকে প্রস্তুত করেছিল।

আজকের OTT প্ল্যাটফর্মেও নব্বইয়ের সিনেমার পুনরুজ্জীবন

এইজন্যেই নব্বই দশক ছিল একটি ‘incubation period’—যেখানে আবেগ, প্রতিষ্ঠান, সম্পর্ক, দর্শকতা—সব এক জায়গায় এসে ভবিষ্যতের সিনেমার আত্মাকে প্রস্তুত করেছিল।

নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমা শুধু একটি যুগের শিল্প নয়, বরং একটি আবেগীয় পরম্পরা, যা সময়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও আজও দর্শকের মনে বেঁচে আছে। এই প্রেক্ষাপটে আজকের OTT প্ল্যাটফর্ম—যেমন Netflix, Amazon Prime Video, Disney+ Hotstar, Zee5 ইত্যাদি—নব্বই দশকের সিনেমাকে পুনরুজ্জীবনের এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর করে তুলেছে। এই পুনরুজ্জীবন কেবল পুরনো সিনেমা দেখার নস্টালজিক অভ্যাস নয়, বরং একধরনের মনস্তাত্ত্বিক আত্ম-অন্বেষণ, যা স্মৃতিকে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্তমানের অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কিভাবে OTT প্ল্যাটফর্মে নব্বই দশকের সিনেমা নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং তার মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ভোক্তা-আচরণগত গুরুত্ব কী।

OTT প্ল্যাটফর্মে নব্বই দশকের সিনেমার প্রবাহের পেছনে রয়েছে একাধিক স্তরের আকর্ষণ। প্রথমত, এই সিনেমাগুলোর গঠন, সংলাপ, চরিত্র এবং গান—সবকিছুই আজকের জটিলতা, বিরক্তি ও ছুটে চলার সংস্কৃতির বিপরীতে একধরনের ‘emotional simplicity’ এনে দেয়। Dilwale Dulhania Le Jayenge, Hum Aapke Hain Koun..! , Kuch Kuch Hota Hai, Raja Hindustani ইত্যাদি সিনেমা পুনরায় দেখা মানে শুধু গল্প দেখা নয়, বরং একটি যুগের অনুভব, পরিবারের বন্ধন, অপেক্ষার সৌন্দর্য এবং আত্মসংযমের চর্চা ফিরিয়ে আনা।

বলিউডের নব্বইয়ের দশক — হিন্দি সিনেমার এক যুগ সন্ধিক্ষণ
Image Source: Google

মনোবিশ্লেষণে, এই প্রবণতা একধরনের ‘nostalgic recentering’—যেখানে দর্শক বর্তমানের অনিশ্চয়তা থেকে দূরে গিয়ে এমন একটি সময়ের আশ্রয় খোঁজে, যেখানে আবেগ সৎ ছিল, সম্পর্ক ছিল দীর্ঘস্থায়ী, এবং ভালোবাসা ছিল শুদ্ধ। OTT-এর মাধ্যমে এই যাত্রা হয় ব্যক্তিগত, নিরিবিলি এবং গভীরতর।

OTT-এর অ্যালগরিদমভিত্তিক রিকমেন্ডেশন, পুনঃপ্রচলিত গান বা সিনেমার ক্লিপ, ট্রেন্ডিং দৃশ্য—এসব কিছু দর্শককে এক বিশেষ ধরণের পুরনো স্মৃতির দিকে টেনে নেয়। অনেকেই বলেন, “একদিন হঠাৎ করে দেখে ফেললাম Dil To Pagal Hai, আর মনটা অদ্ভুত হয়ে গেল।” এই অভিজ্ঞতা শুধু দেখার নয়, বরং ‘আত্ম-অভিব্যক্তি’র। দর্শক মনে করে, সে ফিরে গেছে তার নিজস্ব কালের মধ্যে।

এই আত্ম-ফিরে-যাওয়া অনেক সময় ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। আজকের প্রজন্ম, যারা নব্বই দশকে জন্মালেও সেসময়ের সিনেমা বড় হয়ে দেখে, তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার ভেতরে এক ‘transgenerational continuity’ খোঁজে। তারা বুঝতে চায়, বাবা-মা কী দেখতেন, কী গানে কাঁদতেন, কী সংলাপে হাসতেন। OTT এই সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করে—নিরবচ্ছিন্নভাবে, সীমাহীনভাবে, এবং ব্যক্তিগতভাবে।

মনোবিশ্লেষণে, এই অভ্যাস একধরনের ‘familial memory exploration’—যেখানে দর্শক শুধু নিজের নয়, বরং পারিবারিক আবেগের ইতিহাসে প্রবেশ করে। এই কারণে আজও Baghban, Kabhi Khushi Kabhie Gham, Saajan, Dil Se, Rangeela—এইসব সিনেমা OTT-তে সাড়া ফেলে। দর্শক শুধুই আবেগ নয়, বরং ‘নিজের অতীতকে’ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে চায়।

OTT এই সিনেমাগুলিকে পুনর্গঠনের সুযোগও দেয়। এখন অনেক সিনেমা নতুনভাবে রিমাস্টার করা হয়, সাবটাইটেল যোগ হয়, নানান ভাষায় ডাব করা হয়। এর ফলে এই সিনেমা শুধুই নস্টালজিয়া নয়, বরং ‘কনটেম্পোরারি ভিউয়িং এক্সপেরিয়েন্স’-এ পরিণত হয়। এক তরুণ যখন HAHK দেখে, সে শুধু ‘পুরনো ছবি’ দেখে না, বরং দেখে—‘সম্পর্ক মানে কী ছিল’, ‘বিয়ে মানে কেমন একটা পারিবারিক উৎসব ছিল’। এই তুলনা সে নিজের জীবনের সাথে করে এবং সেখানে তৈরি হয় ‘comparative cultural positioning’।

এছাড়া OTT-র ব্যক্তিগত পরিসর নব্বইয়ের সিনেমাকে নতুনভাবে অনুভব করতে সাহায্য করে। থিয়েটারে যেখানে চিৎকার, হাততালি, বা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থাকত, OTT-তে দর্শক একা, নিজের সময়মতো, নিজের আবেগ অনুযায়ী সিনেমা দেখে। এই অভিজ্ঞতা আরও গভীরতর, আরও নির্জন। মনোবিশ্লেষণে, এটি একধরনের ‘emotional soliloquy’।

তবে এই পুনরুজ্জীবন শুধু দর্শকের আবেগ নয়, বরং প্রযোজক ও প্ল্যাটফর্মের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। ‘Old is Gold’ মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে OTT প্ল্যাটফর্মগুলি তাদের লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করে। অনেক সময় নব্বই দশকের সিনেমার ৩০-৪০ সেকেন্ডের দৃশ্য ভাইরাল হয়, সংলাপ নিয়ে meme হয়, এবং সেখান থেকে নতুন প্রজন্ম সিনেমা দেখে ফেলতে উৎসাহী হয়। এটি একধরনের ‘nostalgia marketing’।

এই বিপুল পুনঃআবিষ্কারের মধ্যে অনেক সময় নতুন নির্মাতারাও নব্বই দশকের স্টাইল, গল্প বা আবেগকে ব্যবহার করে নতুন সিনেমা নির্মাণ করেন। Student of the Year, Humpty Sharma Ki Dulhania, Kalank, Ae Dil Hai Mushkil—এইসব ছবিতে নব্বইয়ের সিনেমার গ্ল্যামার, প্রেম, সংলাপের ছায়া স্পষ্ট। এমনকি গানও কখনও কখনও রিমিক্স আকারে ফিরে আসে। এটি একধরনের ‘aesthetic recycling’।

তবু যত রিমিক্সই হোক, OTT-তে মূল নব্বইয়ের সিনেমা দেখার যে আবেগ, তা অমলিন। কারণ, এই সিনেমা কেবল একটি গল্প নয়, বরং সময়ের স্মারক, সম্পর্কের অনুশীলন, এবং দর্শকের মানসিক বিকাশের প্রাথমিক অনুরণন।

এইজন্য বলা যায়—OTT প্ল্যাটফর্ম নব্বই দশকের সিনেমাকে পুনরুজ্জীবিত করে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করছে। এই কাঠামো দর্শকের আত্মপরিচয়, পারিবারিক সংযোগ, এবং আবেগীয় শুদ্ধতার প্রতি এক অন্তরঙ্গ চর্চা। OTT এখানে শুধু প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং স্মৃতি-ভিত্তিক আত্মসন্ধানের পর্দা।

“Retro” হয়ে ওঠা সিনেমার প্রভাব

এইজন্য বলা যায়—OTT প্ল্যাটফর্ম নব্বই দশকের সিনেমাকে পুনরুজ্জীবিত করে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করছে। এই কাঠামো দর্শকের আত্মপরিচয়, পারিবারিক সংযোগ, এবং আবেগীয় শুদ্ধতার প্রতি এক অন্তরঙ্গ চর্চা। OTT এখানে শুধু প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং স্মৃতি-ভিত্তিক আত্মসন্ধানের পর্দা।

‘রেট্রো’—এই একটি শব্দে ধরা পড়ে সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের একটি বিশেষ প্রকৃতি, যেখানে অতীত শুধু স্মরণীয় নয়, বরং পুনর্নির্মিত, পুনর্ব্যাখ্যাত এবং পুনঃব্যবহৃত হয়। যখন কোনো সিনেমা ‘রেট্রো’ হয়ে ওঠে, তখন তা কেবল পুরনো হয় না; বরং একটি কালোত্তীর্ণ অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্তমান সময়ের সঙ্গে এক নৈঃসঙ্গিক সংলাপ গড়ে তোলে। এই সংলাপে থাকে স্মৃতি, শৈলী, প্রতীক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর রূপান্তর। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কিভাবে ‘রেট্রো’ হয়ে ওঠা সিনেমা সমকালীন সমাজে আবেগীয়, নন্দনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।

‘রেট্রো’ শব্দটির অভ্যন্তরে রয়েছে দ্বৈত মানসিকতা—একদিকে নস্টালজিয়া, অন্যদিকে আধুনিক অনুরাগ। এটি এমন এক অনুভব, যেখানে পুরনোর ভেতরেও নতুন কিছু খোঁজা হয়। নব্বই দশক কিংবা তার পূর্ববর্তী সিনেমাগুলি যখন আবার ফিরে আসে—OTT, রিমিক্স গান, থিম পার্টি, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, কিংবা ফ্যাশনের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে—তখন এগুলোর নান্দনিক কাঠামো হয়ে ওঠে একধরনের ‘stylised memory’।

মনোবিশ্লেষণে, রেট্রো সিনেমা হল একধরনের ‘aestheticized longing’। দর্শক যখন পুরনো সিনেমা দেখে—Guide, Pakeezah, Amar Prem, Kabhi Kabhie, DDLJ, HAHK, এমনকি Rangeela—তখন সে কেবল গল্প দেখে না, বরং দেখার মধ্য দিয়ে একটি কালচিন্তার ছাঁচে প্রবেশ করে। সেখানে সময় ধীর, প্রেম সংযত, রঙ পরিপূর্ণ, সম্পর্ক স্থায়ী, এবং শৃঙ্খলা একটি মূল্য। এইসব উপাদান বর্তমান সময়ের দ্রুত পরিবর্তনশীল, ফ্র্যাগমেন্টেড সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে একধরনের মানসিক আশ্রয়স্থল তৈরি করে।

এই আশ্রয় মানসিক হলেও তার বহিঃপ্রকাশ হয় পোশাকে, ভাষায়, ছবির কম্পোজিশনে, এমনকি ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের অনুকরণে। বর্তমান সিনেমায় যখন রেট্রো অনুষঙ্গ দেখা যায়—যেমন Lootera, Om Shanti Om, Rocket Boys, Gangubai Kathiawadi, Qala—তখন বোঝা যায়, রেট্রো মানে শুধু পুনরুৎপাদন নয়; বরং আবেগীয় পুনর্নির্মাণ। এই সিনেমাগুলো দর্শককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এমন এক সময়ের অভিজ্ঞতায়, যেখানে আবেগ নিখাদ ছিল, কিন্তু প্রকাশ ছিল শৈল্পিক।

এই রেট্রো চেতনার ভেতর থাকে একধরনের ‘mourning for the unrepeatable’—যেখানে দর্শক জানে এই সময় আর ফিরে আসবে না, তবুও সে সেই সময়কে দেখতে চায়, স্পর্শ করতে চায়, নিজের মতো করে অনুভব করতে চায়। এটি একধরনের ‘temporal intimacy’—যেখানে সময় ও অনুভব একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

রেট্রো সিনেমার প্রভাব কেবল দর্শকের আবেগে নয়, বরং সমাজের মূল্যবোধে, ভাষায় এবং নান্দনিকতাতেও পড়ে। যেমন, পুরনো সিনেমার গানের কথা, শুদ্ধ উর্দু-হিন্দির সংলাপ, কবিতার ধাঁচে লেখা দৃশ্যরচনা, ক্লাসিকাল মেলোডি—এসবই বর্তমানে আবার ফিরে আসে নতুন সিনেমায়, বিজ্ঞাপনে, এমনকি ইনস্টাগ্রাম রিল-এ। এই ‘return of retro’ একধরনের সাংস্কৃতিক স্মৃতি-চর্চা, যা একটি প্রজন্মকে অতীতের সঙ্গে সংযুক্ত করে, আবার নতুন প্রজন্মকে তা শেখার সুযোগ দেয়।

মনোবিশ্লেষণে, এই চর্চা একটি সমাজের ‘collective unconscious’-এর অংশ। অর্থাৎ, রেট্রো সিনেমা আমাদের ভেতরে এমন কিছু তুলে আনে, যা হয়তো আমরা সচেতনভাবে জানি না, কিন্তু যা আমাদের মানসিক কাঠামোর গভীরে গাঁথা। এইজন্যই পুরনো সিনেমার গান, সংলাপ, দৃশ্য শুনলে আমাদের মন অভিব্যক্ত হয়—কখনও কাঁদে, কখনও হাসে, কখনও নিঃশব্দে ভাবনার মধ্যে ডুবে যায়।

বর্তমান ডিজিটাল সংস্কৃতি রেট্রো সিনেমাকে নতুনভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। YouTube, Instagram Reels, Facebook Nostalgia Group—এসব প্ল্যাটফর্মে রেট্রো দৃশ্য, গান, সংলাপ, পোস্টার, মেকিং—সবই নতুন করে দেখা হয়, শেয়ার করা হয়, এবং ঘিরে গড়ে ওঠে একধরনের ‘sentimental digital community’। এই কমিউনিটির সদস্যরা কখনও নিজেদের কৈশোরের গল্প বলেন, কখনও বাবার প্রিয় সিনেমার স্মৃতি ভাগ করে নেন, কখনও পুরনো গানের কথায় নতুন কবিতা লেখেন।

এই অভ্যাস আমাদের সমাজকে একধরনের ‘inter-generational emotional bridge’ দেয়। যেখানে নানা বয়স, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাধারার মানুষ এক সিনেমাকে কেন্দ্র করে আবেগ ভাগ করে নেয়। এটি শুধু সংস্কৃতি নয়, বরং সম্পর্ক নির্মাণের কৌশলও।

তবে রেট্রো সিনেমা নিয়ে কাজ করার সময় একধরনের ঝুঁকিও থাকে। অনেকে এটিকে নিছক কসমেটিক অনুকরণে রূপান্তরিত করেন—স্টাইল নেন, কিন্তু আবেগের মূলে পৌঁছান না। ফলে, অনেক রিমেক বা রিমিক্স হতাশ করে। এটি ‘superficial nostalgia’—যেখানে অতীত শুধু সাজানো হয়, অনুভব করা হয় না।

এইজন্য সত্যিকারের রেট্রো পুনরুজ্জীবন তখনই সম্ভব, যখন নির্মাতা বা দর্শক সেই সময়ের সমাজ, সম্পর্ক, ও মনস্তত্ত্বকে বুঝে নিতে চান। সেই বোঝা থেকেই জন্ম নেয় নতুন ব্যাখ্যা, নতুন উপস্থাপনা, এবং নতুন অভিজ্ঞতা।

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়—‘রেট্রো’ হয়ে ওঠা সিনেমা আমাদের সময়, সমাজ ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে এক সূক্ষ্ম সংলাপ তৈরি করে। এটি কেবল অতীতের পুনরুৎপাদন নয়; বরং বর্তমানের অভ্যন্তরে এক ‘আত্মবিশ্লেষণের ভাষা’। আর সেই ভাষা কখনও সংলাপে, কখনও সুরে, কখনও চোখের ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। রেট্রো মানে পুরনো নয়; বরং এমন কিছু, যা বারবার নতুন হয়ে ওঠে—আমাদের স্মৃতির ভেতর, এবং আমাদের স্বপ্নের মধ্যে।

সংস্কৃতি, গান ও সংলাপের উত্তরাধিকার

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়—‘রেট্রো’ হয়ে ওঠা সিনেমা আমাদের সময়, সমাজ ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে এক সূক্ষ্ম সংলাপ তৈরি করে। এটি কেবল অতীতের পুনরুৎপাদন নয়; বরং বর্তমানের অভ্যন্তরে এক ‘আত্মবিশ্লেষণের ভাষা’। আর সেই ভাষা কখনও সংলাপে, কখনও সুরে, কখনও চোখের ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। রেট্রো মানে পুরনো নয়; বরং এমন কিছু, যা বারবার নতুন হয়ে ওঠে—আমাদের স্মৃতির ভেতর, এবং আমাদের স্বপ্নের মধ্যে।

হিন্দি সিনেমা শুধুমাত্র একটি শিল্প নয়, বরং একটি বহমান সংস্কৃতি। এর ভেতর দিয়ে এক প্রজন্মের থেকে আরেক প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় নির্দিষ্ট মানসিকতা, নান্দনিক বোধ, শব্দচয়ন এবং সংগীতচেতনা। এই উত্তরাধিকারে সিনেমার গান, সংলাপ এবং চিত্রভাষা হয়ে ওঠে এক ধরনের ‘cultural memory’—যা শুধুমাত্র দর্শনের বিষয় নয়, বরং আত্মপরিচয়ের নির্মাতা। এই প্রবন্ধে আমরা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে অনুধাবন করব কিভাবে হিন্দি সিনেমা সংস্কৃতির উত্তরাধিকার গড়ে তোলে, এবং গান ও সংলাপের ভেতর দিয়ে সেই উত্তরাধিকার সংরক্ষিত, রূপান্তরিত ও পুনরুজ্জীবিত হয়।

প্রথমত, হিন্দি সিনেমার গান কেবল বিনোদনের উপকরণ নয়, বরং এক জাতির ‘emotional vocabulary’। Mera Joota Hai Japani, Ae Mere Watan Ke Logon, Pyaar Hua Iqraar Hua, Tujhe Dekha To, Tera Mujhse Hai Pehle Ka Naata Koi—এইসব গান শুধুই প্রেম, দেশপ্রেম, বা আবেগ প্রকাশ করে না, বরং শ্রোতার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক অবস্থান তৈরি করে।

মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, গান এখানে এক ধরনের ‘affective archive’—যেখানে একটি প্রজন্ম তার অনুভবের ভাষা খুঁজে পায়। যখন কেউ বলে, “এই গানটা শুনলেই বাবার মুখ মনে পড়ে”, তখন সে কেবল গান শুনছে না, বরং একটি ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক স্তর অতিক্রম করে যাচ্ছে।

এই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে সময়। যখন পুরনো গান নতুনভাবে রিমিক্স হয়, বা OTT-তে নতুন প্রজন্ম তার ইউটিউব প্লেলিস্টে Lag Jaa Gale বা Abhi Na Jao Chhod Kar যোগ করে, তখন তা শুধু ‘পুরনো গান শোনা’ নয়, বরং একটি প্রজন্ম অন্য একটি প্রজন্মের আবেগে প্রবেশ করছে। এই প্রবেশ একধরনের ’empathic cultural transmission’।

সিনেমার সংলাপও এই উত্তরাধিকারের অনুরূপ বাহক। Mogambo Khush Hua, Bade Bade Deshon Mein Aisi Chhoti Chhoti Baatein, Pushpa, I hate tears, Mere paas maa hai—এইসব সংলাপ শুধুমাত্র কথোপকথন নয়, বরং আবেগ, আত্মপরিচয় এবং সময়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রতীক।

মনোবিশ্লেষণে, সংলাপ একটি জাতির ‘collective idiom’। আমরা অনেক সময় নিজের অনুভব প্রকাশ করি কোনো সিনেমার সংলাপ ধার করে। এই ধার করা মানে নিছক অনুকরণ নয়; বরং নিজের অনুভবকে সমাজিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষায় প্রকাশ করা। এটি ‘borrowed authenticity’—যেখানে সংলাপের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের প্রকৃত করে তুলি।

এই গান ও সংলাপই সিনেমাকে সাংস্কৃতিক স্তরে দীর্ঘস্থায়ী করে। কোনো একটি সিনেমা হয়তো সময়ের হিসেবে পুরনো, কিন্তু তার একটি গান বা একটি সংলাপ এখনো জীবন্ত। এটি একধরনের ‘aesthetic resilience’—যেখানে শিল্পকর্ম তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা হারিয়ে ফেললেও, তার আবেগীয় মূল সার্বজনীন হয়ে ওঠে।

এই উত্তরাধিকার কেবল সংরক্ষণের বিষয় নয়, বরং সামাজিকভাবে ‘পুনরাবিষ্কারের’ প্রক্রিয়া। যেমন আজকের বিজ্ঞাপন, মিম, ইনস্টাগ্রাম রিল—সবখানেই দেখা যায় পুরনো গান, সংলাপ ব্যবহার হচ্ছে। এটি একধরনের ‘performative homage’। বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের ভাষায় অতীতকে ব্যক্ত করছে। এই চর্চা অতীতকে সংরক্ষণের চেয়ে বেশি, এটি অতীতের সঙ্গে সমসাময়িক সংলাপ।

সংস্কৃতির এই উত্তরাধিকার প্রজন্মান্তরে যেভাবে পরিবর্তিত হয়, তাতে আবার নতুন ব্যাখ্যা তৈরি হয়। যেমন Pakeezah বা Umrao Jaan-এর গান একসময় ছিল পারিজনের আকাঙ্ক্ষা, এখন তা নারীর আত্মমর্যাদা ও কবিতার চেতনায় অনুপ্রাণিত করে। Dil Se–র Jiya Jale তখন ছিল প্রণয়ের উন্মত্ততা, এখন তা শরীরী স্বাধীনতার প্রতীক। এই রূপান্তর এক ধরনের ‘emotional re-contextualisation’।

তবে এই উত্তরাধিকার তখনই শক্তিশালী হয়, যখন তা শুধুমাত্র পুনরুৎপাদন নয়, বরং আত্মস্থ চর্চা। নতুন প্রজন্ম যদি কেবল গান শোনে বা সংলাপ উচ্চারণ করে, কিন্তু তার প্রেক্ষাপট, সাহিত্যিকতা বা আবেগ না বোঝে, তাহলে তা হয়ে দাঁড়ায় নিছক পণ্য। এইজন্য উত্তরাধিকার মানে শুধু সংরক্ষণ নয়, বরং আত্মস্থ স্মৃতি ও সংস্কার।

এই উত্তরাধিকারের সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়ে আমাদের দৈনন্দিন ভাষা, আচরণ ও চিন্তায়। অনেক সময় আমরা বুঝতেও পারি না, আমাদের জীবনের অভিব্যক্তি কতটা সিনেমা-প্রভাবিত। মা যখন বলেন—“মা তো आखिर माँ होती है”, কিংবা প্রেমিক বলে—“বড় বড় देश, ছোট ছোট बातें”—তখন আমরা আসলে সিনেমার ভিতরেই বাঁচি। এই বাঁচা বাস্তবতার অংশ নয়, বরং বাস্তবেরই এক ভাষ্য।

এইজন্য বলা যায়—হিন্দি সিনেমার সংস্কৃতি, গান ও সংলাপ শুধু শিল্প নয়; বরং আমাদের সমষ্টিগত আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উত্তরাধিকার আমাদের শেখায়, কীভাবে শব্দ, সুর ও চিত্র আমাদের বেঁধে রাখে, আমাদের গড়ে তোলে, এবং আমাদের সংবেদনশীলতা রক্ষা করে।

নব্বইয়ের দশকের ৫০টি বিখ্যাত সিনেমা তালিকা

এইজন্য বলা যায়—হিন্দি সিনেমার সংস্কৃতি, গান ও সংলাপ শুধু শিল্প নয়; বরং আমাদের সমষ্টিগত আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উত্তরাধিকার আমাদের শেখায়, কীভাবে শব্দ, সুর ও চিত্র আমাদের বেঁধে রাখে, আমাদের গড়ে তোলে, এবং আমাদের সংবেদনশীলতা রক্ষা করে।

নব্বইয়ের দশক হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে একটি রূপান্তরমূলক পর্ব—যেখানে আবেগ, শিল্প, বাণিজ্যিকতা ও সামাজিক বাস্তবতা একত্র হয়ে এক অনন্য যুগ গড়ে তোলে। এই দশকে নির্মিত সিনেমাগুলি শুধুমাত্র জনপ্রিয়তাই পায়নি, বরং একাধিক স্তরে দর্শকের মনোজগতে গভীর ছাপ ফেলে গেছে। প্রেম, পরিবার, দেশপ্রেম, সমাজচেতনা, গ্ল্যামার, অ্যাকশন—সব মিলিয়ে নব্বইয়ের সিনেমাগুলি একধরনের ‘emotional mapping’ হয়ে ওঠে, যা আজও বারবার স্মরণ করা হয়। এই প্রবন্ধে আমরা নব্বইয়ের দশকের ৫০টি উল্লেখযোগ্য সিনেমার একটি তালিকার ভেতর দিয়ে সময়টির মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবিম্ব অনুধাবনের চেষ্টা করব।

এই তালিকা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক সাফল্য বা পুরস্কারের ভিত্তিতে নয়, বরং সিনেমাগুলির মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, সাংস্কৃতিক অভিঘাত, সংলাপের স্থায়িত্ব, সংগীতের জনপ্রিয়তা এবং প্রজন্মান্তরের আবেগীয় প্রভাবের ভিত্তিতে গঠিত।

  1. Dilwale Dulhania Le Jayenge (1995) – প্রেম ও শিকড়ের দ্বৈততা।
  2. Hum Aapke Hain Koun..! (1994) – পারিবারিক আবেগের উৎসবায়ন।
  3. Raja Hindustani (1996) – শ্রেণি-বৈষম্যের ভেতর প্রেম।
  4. Kuch Kuch Hota Hai (1998) – বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে প্রেমের সন্ধান।
  5. Dil To Pagal Hai (1997) – প্রেমে নিয়তি ও নৃত্যের মিলন।
  6. Dil Se (1998) – প্রেমের মাধ্যমে রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুধ্যান।
  7. Border (1997) – দেশপ্রেমের সংবেদনশীল উপস্থাপনা।
  8. Satya (1998) – নগর-অপরাধ ও আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন।
  9. Rangeela (1995) – মধ্যবিত্ত স্বপ্ন বনাম গ্ল্যামার জগত।
  10. Darr (1993) – অবসেশন ও প্রেমের মধ্যেকার ভয়াবহতা।
  11. Baazigar (1993) – প্রতিশোধ, প্রতারণা ও সাসপেন্সের আবেগ।
  12. Hum Dil De Chuke Sanam (1999) – প্রেম বনাম কর্তব্য।
  13. Ghatak (1996) – অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভাষা।
  14. Ghayal (1990) – বিচারহীন সমাজে আত্ম-প্রতিশোধ।
  15. Jo Jeeta Wohi Sikandar (1992) – আত্মসম্মান, পরাজয় ও বিজয়ের সংগ্রাম।
  16. Taal (1999) – সংগীত, শ্রেণি ও আত্মমর্যাদার সংঘাত।
  17. Pardes (1997) – দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি দ্বন্দ্ব।
  18. Karan Arjun (1995) – পুনর্জন্ম ও পারিবারিক প্রতিশোধ।
  19. Damini (1993) – নারী ও ন্যায়বিচারের লড়াই।
  20. Andaaz Apna Apna (1994) – কমেডির মধ্য দিয়ে সমাজ-আবেগ।
  21. Dil (1990) – প্রেমের মধ্যে যৌবনের বিদ্রোহ।
  22. Aashiqui (1990) – সংগীতময় প্রেমের নির্যাস।
  23. Deewana (1992) – প্রেম, প্রতারণা ও আত্মদানের কাহিনি।
  24. Agneepath (1990) – পিতৃ-মর্যাদা ও নৈতিক প্রতিশোধ।
  25. Khiladi (1992) – থ্রিলার ও রহস্যের শুরু।
  26. Mohra (1994) – আইন, বিচার ও সংবাদপত্রের সংবেদনশীলতা।
  27. Dushman (1998) – ট্রমা ও নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা।
  28. Zakhm (1998) – সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আত্মজিজ্ঞাসা।
  29. Judaai (1997) – পরিবার, লোভ ও অনুশোচনার নাটকীয় সংঘর্ষ।
  30. Ishq (1997) – প্রেম ও শ্রেণি সংযোগে কমেডির ভাষ্য।
  31. Saajan (1991) – কবিতা, প্রেম ও আত্মত্যাগের সুর।
  32. Lamhe (1991) – বয়সের সীমা ছাড়িয়ে অনুভবের গভীরতা।
  33. Bombay (1995) – ধর্মীয় সহাবস্থান ও প্রেমের বিপরীতে হিংসা।
  34. Phool Aur Kaante (1991) – পরিবারে দ্বৈত ভূমিকা ও সাহসিকতা।
  35. Hum (1991) – ভাইদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পুনর্মিলনের গাঁথা।
  36. Beta (1992) – মা ও স্ত্রীর মধ্যেকার নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধ।
  37. Anjaam (1994) – শক্তিশালী নারী চরিত্র ও প্রতিশোধ।
  38. Coolie No. 1 (1995) – সমাজ-সম্পর্কে কমেডির ব্যঙ্গ।
  39. Hero No. 1 (1997) – পরিচয় গোপনের মাধ্যমে প্রেম ও সততার প্রকাশ।
  40. Raja Babu (1994) – গ্রাম্যতার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের সিঁড়ি।
  41. Virasat (1997) – শহর বনাম গ্রামের দ্বন্দ্বে শিক্ষার দায়িত্ব।
  42. Khamoshi: The Musical (1996) – মৌনতার মধ্যে সংগীতের উচ্চারণ।
  43. Doli Saja Ke Rakhna (1998) – প্রেমের মধ্যে শালীনতা ও আত্মসংযম।
  44. Yeh Dillagi (1994) – আধুনিকতা ও আদর্শের প্রেম-ত্রিভুজ।
  45. Major Saab (1998) – শৃঙ্খলা ও ভালোবাসার বিরোধ।
  46. Hameshaa (1997) – পুনর্জন্ম ও চিরন্তন প্রেমের কল্পনা।
  47. Gupt (1997) – থ্রিলার, সাইকোলজি ও নাটকীয় উন্মোচন।
  48. Kaun (1999) – অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গতার ভয়।
  49. Sarfarosh (1999) – দেশপ্রেম ও সন্ত্রাসের অন্তর্গত চেতনা।
  50. Vaastav (1999) – শহুরে অপরাধজগত ও একটি মানুষের পতনের অন্তর্দৃষ্টি।

এই তালিকাটি শুধুমাত্র একটি তথ্যভিত্তিক স্মরণ নয়; বরং প্রতিটি সিনেমা এক একটি যুগের অভ্যন্তরীণ মানসিক অভিব্যক্তি—যা প্রেম, ক্রোধ, প্রতিবাদ, সমর্পণ, অনুশোচনা ও গর্বের মধ্য দিয়ে দর্শককে গড়ে তোলে। এইসব সিনেমা আজও দেখলে বোঝা যায়, এক দশকের ভিতরে কত বৈচিত্র্য, গভীরতা ও মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এইজন্য বলা যায়, নব্বইয়ের এই ৫০টি সিনেমা কেবল ‘স্মরণীয়’ নয়, বরং এক প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের মানচিত্র।

টপ মিউজিক অ্যালবাম ও হিট গান তালিকা

এইজন্য বলা যায়, নব্বইয়ের এই ৫০টি সিনেমা কেবল ‘স্মরণীয়’ নয়, বরং এক প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের মানচিত্র।

নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার গান এবং মিউজিক অ্যালবাম যে পরিমাণ আবেগ, স্মৃতি এবং সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততা তৈরি করেছিল, তা ভারতীয় জনস্মষ্টির মানসিক কাঠামো গঠনে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এই সময়ের গান ছিল কেবল সিনেমার অংশ নয়, বরং একটি প্রজন্মের আবেগীয় অভিধান। এমনকি অনেক সময় সিনেমার জনপ্রিয়তা নির্ধারিত হতো তার মিউজিক অ্যালবামের সাফল্যের ভিত্তিতে। গান হয়ে উঠেছিল প্রেম নিবেদন, বিচ্ছেদ, আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মপরিচয়ের এক ভাষ্য। এই প্রবন্ধে আমরা নব্বই দশকের সেরা মিউজিক অ্যালবাম এবং হিট গানের তালিকার মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের মনস্তাত্ত্বিক, নন্দনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত অনুধাবনের চেষ্টা করব।

গান একধরনের ‘auditory memoryscape’—যেখানে সময়, স্থান, ব্যক্তি ও আবেগ মিলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের গান, যখন ভিডিও ক্যাসেট, টেপ রেকর্ডার, অলংকৃত কভার সহ অ্যালবাম, এবং সাপ্তাহিক টিভি চ্যানেলে গান শুনে-দেখে আবেগে ডুবে থাকার অভ্যেস গড়ে ওঠে।

এই সময়ে কিছু মিউজিক অ্যালবাম কেবল সুপারহিট ছিল না, বরং সামাজিক-সংবেদনশীল অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠে। নিচে আমরা নব্বইয়ের দশকের এমন কিছু অ্যালবাম এবং তাদের গানের তালিকা দিচ্ছি, যেগুলি মানসিক আবেগ, নান্দনিকতা এবং স্মৃতিচারণের প্রেক্ষিতে অনন্য।

  1. Aashiqui (1990) – Nadeem-Shravan
    • “Nazar Ke Saamne”
    • “Dheere Dheere Se”
    • “Jaane Jigar Jaaneman”
    • এই অ্যালবাম ছিল প্রেমের পরিণত মেলোডির মানচিত্র।
  2. Saajan (1991) – Nadeem-Shravan
    • “Mera Dil Bhi Kitna Pagal Hai”
    • “Dekha Hai Pehli Baar”
    • “Bahut Pyar Karte Hain”
    • প্রেম ও কাব্যিক আকুলতার অভিজ্ঞান।
  3. Dilwale Dulhania Le Jayenge (1995) – Jatin-Lalit
    • “Tujhe Dekha To”
    • “Mere Khwabon Mein”
    • “Ho Gaya Hai Tujhko”
    • গানগুলি হয়ে ওঠে প্রেমের নান্দনিক নকশা।
  4. Raja Hindustani (1996) – Nadeem-Shravan
    • “Pardesi Pardesi”
    • “Aaye Ho Meri Zindagi Mein”
    • বিচ্ছেদের ভেতরে আবেগের স্থায়িত্ব।
  5. Dil To Pagal Hai (1997) – Uttam Singh
    • “Are Re Are”
    • “Dholna”
    • “Bholi Si Surat”
    • সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আত্মার অন্তর্গত নাচ।
  6. Kuch Kuch Hota Hai (1998) – Jatin-Lalit
    • “Tujhe Yaad Na Meri Aayi”
    • “Koi Mil Gaya”
    • “Ladki Badi Anjaani Hai”
    • বন্ধুত্ব ও প্রেমের মধ্যবর্তী অনুভব।
  7. Hum Aapke Hain Koun..! (1994) – Raam Laxman
    • “Didi Tera Devar Deewana”
    • “Pehla Pehla Pyar”
    • “Joote Do Paise Lo”
    • পরিবারকেন্দ্রিক মেলোডির উৎসব।
  8. Taal (1999) – A. R. Rahman
    • “Ishq Bina”
    • “Taal Se Taal Mila”
    • “Ramta Jogi”
    • ক্লাসিকাল ও আধুনিকতার সম্মিলন।
  9. Rangeela (1995) – A. R. Rahman
    • “Tanha Tanha”
    • “Yaaro Sun Lo Zara”
    • “Rangeela Re”
    • নতুন যুগের সুরতন্ত্র।
  10. 1942: A Love Story (1994) – R. D. Burman
  • “Ek Ladki Ko Dekha”
  • “Kuch Na Kaho”
  • শেষ বয়সেও অনবদ্য রোমান্টিক সংগীত।
  1. Pardes (1997) – Nadeem-Shravan
  • “Do Dil Mil Rahe Hain”
  • “Yeh Dil Deewana”
  • বিদেশ-বাংলা প্রেমের মিলন।
  1. Jeet (1996) – Nadeem-Shravan
  • “Yaara O Yaara”
  • “Dil Ka Kya Karein”
  1. Mohra (1994) – Viju Shah
  • “Tip Tip Barsa Pani”
  • “Tu Cheez Badi Hai Mast”
  • শরীরী সুরের বাণিজ্য ও জনপ্রিয়তা।
  1. Gupt (1997) – Viju Shah
  • “Mushkil Bada Yeh Pyar Hai”
  • “Duniya Haseenon Ka Mela”
  • থ্রিলারের মাঝে মিউজিকাল কোরিওগ্রাফির সার্থকতা।
  1. Kabhi Haan Kabhi Naa (1994) – Jatin-Lalit
  • “Aana Mere Pyar Ko”
  • “Deewana Dil Deewana”

এই তালিকা আরো দীর্ঘতর হতে পারে। তবে এই অ্যালবামগুলির উল্লেখযোগ্য দিক হলো—তাদের প্রতিটি গান আজও শোনা হয়, গাওয়া হয়, এবং অনুভব করা হয়। এই গানগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনুভূতির সঙ্গী—চিঠি লেখার সময়, দূরত্বে কান্নার সময়, একলা বিকেলে, কিংবা ভালোবাসার অঙ্গীকারে।

মনোবিশ্লেষণে বলা যায়, নব্বই দশকের গান আমাদের ‘affective identity’-এর অংশ—যেখানে আমাদের ভালোবাসা, প্রতীক্ষা, আশা এবং ভাঙন—সব কিছুই সংগীতের মাধ্যমে রূপ পায়।

এইজন্য নব্বইয়ের মিউজিক অ্যালবাম এবং হিট গানগুলো শুধুই শ্রুতিমধুরতা নয়; বরং আত্মপরিচয়ের বুনন, আবেগের সুরেলা পাঠ এবং সময়ের রূপায়িত স্মারক।

প্রযোজক-পরিচালকদের পোর্টফোলিও

এইজন্য নব্বইয়ের মিউজিক অ্যালবাম এবং হিট গানগুলো শুধুই শ্রুতিমধুরতা নয়; বরং আত্মপরিচয়ের বুনন, আবেগের সুরেলা পাঠ এবং সময়ের রূপায়িত স্মারক।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার ভেতরে একাধিক প্রযোজক ও পরিচালক এমনভাবে কাজ করেছেন, যাঁদের শিল্প-ভাবনা, আবেগচর্চা, ও দর্শক-মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ এই দশকের সিনেমাকে নির্মাণ করেছিল এক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায়। তারা শুধু কাহিনি বলেননি; বরং গড়ে তুলেছেন একেকটি আবেগীয়, নান্দনিক ও বাণিজ্যিক জগৎ—যাকে আমরা পোর্টফোলিও হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এই প্রবন্ধে আমরা মনস্তাত্ত্বিক ও নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কিছু প্রযোজক ও পরিচালকের কাজ এবং তাদের আবেগ-সিনেমার গভীর সম্পর্ক অনুধাবনের চেষ্টা করব।

যশ চোপড়া ও আদিত্য চোপড়া (Yash Raj Films)

যশ চোপড়ার হাতে গড়া ‘Yash Raj Films’ ছিল প্রেম, প্রকৃতি, করুণা ও করুণার সংবেদনশীল মঞ্চ। নব্বইয়ে Lamhe, Darr এবং পরে আদিত্য চোপড়ার Dilwale Dulhania Le Jayenge—সব সিনেমায় প্রেম একটি জটিল, অথচ কোমল বাস্তবতা। পিতা-পুত্রের এই সৃষ্টিশীল সংলাপ ‘emotional legacy’ গড়ে তোলে, যেখানে প্রেম কখনও সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে, কখনও স্মৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। দর্শক এই সিনেমাগুলিতে প্রেমকে অনুভব করে সময় ও শিকড়ের দ্বিধায় দাঁড়িয়ে।

সূরজ বরজাতিয়া (Rajshri Productions)

সূরজ বরজাতিয়ার পরিচালনায় Maine Pyar Kiya, Hum Aapke Hain Koun..! এবং Hum Saath Saath Hain—এই সিনেমাগুলি একটি আদর্শ পরিবারভিত্তিক ভারতবর্ষকে পুনর্নিমাণ করে, যেখানে সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও আচার-অনুষ্ঠানই আবেগীয় আত্মস্থতা গড়ে তোলে। দর্শকের পরিবারচিন্তা ও আত্মীয়তার বোধ এই সিনেমাগুলিতে একধরনের ‘sentimental utopia’ খুঁজে পায়। মনোবিশ্লেষণে, বরজাতিয়ার পোর্টফোলিও একধরনের ‘cultural reassurance’।

মহেশ ভাট (Vishesh Films)

মহেশ ভাটের সিনেমাগুলি একাধারে বেদনাবোধ, ট্রমা, সম্পর্কের জটিলতা এবং আত্মোপলব্ধির নাট্যশৈলীতে নির্মিত। Aashiqui, Dil Hai Ki Manta Nahin, Sadak, Zakhm—এইসব সিনেমায় একধরনের বাস্তবতার নির্মোহ ভাষ্য থাকে, যা দর্শকের গোপন ক্ষতগুলিকে প্রকাশ করে দেয়। ভাটের পোর্টফোলিও একরকম ‘emotional catharsis’—যেখানে দর্শক নিজের ব্যথাকে অন্য এক চরিত্রের চোখে দেখে এবং মুক্তি পায়।

রাম গোপাল ভার্মা

Rangeela, Satya, Kaun—এইসব সিনেমায় রাম গোপাল ভার্মা বলিউডে ‘নিও-নোয়ার’, ‘সাইকোলজিকাল থ্রিলার’, এবং শহুরে বাস্তবতাকে নতুনভাবে চিত্রায়ন করেন। তার সিনেমায় রয়েছে ‘disoriented intensity’—যেখানে নায়ক অস্থির, বাস্তবতা কুয়াশাচ্ছন্ন, আর সম্পর্ক গভীর ও জটিল। ভার্মার সিনেমা দর্শককে ভাবায়, চমকে দেয়, অস্থির করে তোলে। তার পোর্টফোলিও হল একধরনের ‘cognitive jolt’।

সঞ্জয় লীলা বনসালি

নব্বইয়ের শেষদিকে Khamoshi: The Musical দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বনসালির গ্ল্যামার, সংগীত, সংবেদন, এবং চিত্ররচনার দৃষ্টিকোণ পরে Hum Dil De Chuke Sanam পর্যন্ত প্রসারিত হয়। তিনি আবেগকে চিত্রকলায় পরিণত করেন। বনসালির পোর্টফোলিও একধরনের ‘visualised sentiment’—যেখানে প্রতিটি দৃশ্য অনুভবের চেয়ে বেশি অনুভূতিযোগ্য। দর্শক এই সিনেমা দেখে কাঁদে, তবে তা বাস্তবতার জন্য নয়; বরং সৌন্দর্যের তীব্রতায়।

ডেভিড ধবন ও গোবিন্দ জুটি

কমেডি, ব্যঙ্গ, সমাজ-সচেতনতা ও গণ-মনোরঞ্জনের একত্র অভিজ্ঞান গড়ে তোলেন এই জুটি। Coolie No. 1, Hero No. 1, Raja Babu—এইসব সিনেমায় এক সাধারণ মানুষের জয়, হাস্যরসের আবরণে একধরনের শ্রেণি-উন্নয়নকামী মনোভাব থাকে। দর্শক এই সিনেমায় নিজের অক্ষমতাকে হাসির মাধ্যমে উপহাস করে। ডেভিড ধবনের পোর্টফোলিও হল ‘comic subversion’।

প্রিয়দর্শন ও মালায়ালম ঘরানার রূপান্তর

যদিও মূলত ২০০০ পর্বে তিনি পুরো রূপে সক্রিয় হন, নব্বইয়ের পরিসরে Muskurahat, Gardish, Virasat ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দক্ষতা দেখান। আঞ্চলিকতার গভীরতাকে হিন্দি ভাষায় আত্মস্থ করেন। তার পোর্টফোলিও একধরনের ‘regional sincerity’।

প্রযোজক: গুলশন কুমার ও টি-সিরিজ

সিনেমার বাইরে থেকে সংগীতকে মূলধারার বাজারে প্রতিষ্ঠিত করেন। Aashiqui, Jeet, Saajan, Dil Hai Ke Manta Nahin প্রভৃতি অ্যালবামের পৃষ্ঠপোষকতা করে সংগীতকে সিনেমার আগেই বাজারে ছেড়ে দেন। তার পোর্টফোলিও একধরনের ‘musical entrepreneurship’।

ধর্মা প্রোডাকশন (যশ জোহর থেকে করণ জোহর)

নব্বইয়ের শেষদিকে Duplicate, Kuch Kuch Hota Hai-এর মাধ্যমে করণ জোহরের হাতে ‘emotional glossiness’ আসে। এই ঘরানায় আবেগ নরম, সম্পর্ক উজ্জ্বল, ফ্যাশন সাহসী, আর গানগুলো অতিরঞ্জিতভাবে স্মারক। তার পোর্টফোলিও একধরনের ‘romantic sheen’।

এইসব পোর্টফোলিও দেখায়—প্রতিটি প্রযোজক ও পরিচালক একেকটি আলাদা অভিজ্ঞতার ভাষা নির্মাণ করেছেন। কেউ প্রেমে, কেউ প্রতিবাদে, কেউ সংগীতে, কেউ নৈঃশব্দ্যে। নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার বিশাল মানসিক পরিসর তৈরিতে এই পোর্টফোলিও-ভিত্তিক চিন্তাভাবনাই চলচ্চিত্রকে করে তোলে এক সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক পাঠশালা।

বক্স অফিস ট্রেন্ড (প্রতি বছর)

এইজন্য নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার বিশাল মানসিক পরিসর তৈরিতে এই পোর্টফোলিও-ভিত্তিক চিন্তাভাবনাই চলচ্চিত্রকে করে তোলে এক সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক পাঠশালা।

নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার বক্স অফিস ট্রেন্ড কেবল ব্যবসায়িক পরিসংখ্যান নয়, বরং সমাজের পরিবর্তমান মানসিকতা, আবেগচর্চা এবং শ্রোতার সাংস্কৃতিক চাহিদার মানচিত্র। প্রতি বছর যে সিনেমাগুলি সর্বাধিক আয় করত বা জনপ্রিয়তা অর্জন করত, তা সেই সময়ের দর্শকের স্বপ্ন, সংশয় ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এই প্রবন্ধে আমরা নব্বইয়ের দশকের প্রতিটি বছরের বক্স অফিস ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করব কিভাবে দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক রূচি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাজারচিন্তা মিলে সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করেছিল।

1990 – এই বছর Dil, Ghayal, Aashiqui বক্স অফিসে শীর্ষে ছিল। প্রেম, প্রতিশোধ ও সংগীত—এই তিনধরনের আবেগ মিলিয়ে দর্শক একধরনের আভ্যন্তরীণ সংকটের নিরসন খুঁজছিল।

1991 – Saajan, Phool Aur Kaante, Hum, Sadak ইত্যাদি সিনেমা প্রাধান্য পায়। এখানে পরিবার, প্রেম ও শহরজীবনের বাস্তবতা একত্রিত হয়ে দর্শককে আবেগী স্থিতি দেয়।

1992 – Beta, Khiladi, Deewana–র মতো সিনেমায় একদিকে নারী প্রশ্ন, অন্যদিকে অ্যাকশন-থ্রিলারের আকর্ষণ ছিল। দর্শক তখন আত্মবিশ্বাস খুঁজছিল সামাজিক সংকোচের মধ্যেও।

1993 – Baazigar, Darr, Khalnayak, Damini ছিল বছরের হিট। এই সময় দর্শক ‘অ্যান্টি-হিরো’ ও সামাজিক ন্যায়ের টানাপোড়েনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এটি একধরনের ‘moral anxiety’ প্রকাশ করে।

1994 – Hum Aapke Hain Koun..!, Mohra, Raja Babu, Main Khiladi Tu Anari—বিভিন্ন ঘরানার মিলনে বছরটি ছিল বহুমাত্রিক। পরিবার, অ্যাকশন ও কমেডি—সব একসঙ্গে চলছিল, যা ছিল দর্শকের মনোজগতের বৈচিত্র্যময় চাহিদার প্রতিফলন।

1995 – Dilwale Dulhania Le Jayenge, Karan Arjun, Coolie No. 1, Rangeela ইত্যাদি সিনেমায় প্রেম, পুনর্জন্ম, কমেডি ও গ্ল্যামার মিলিয়ে দর্শক আবেগীয় পুষ্টি লাভ করে। বিশেষত DDLJ প্রেমকে এক নতুন আধ্যাত্মিক আবরণ দেয়।

1996 – Raja Hindustani, Jeet, Ghatak, Loafer প্রভৃতিতে একদিকে শ্রেণিগত টানাপোড়েন, অন্যদিকে ন্যায়ের দাবী উঠে আসে।

1997 – Border, Dil To Pagal Hai, Gupt, Ishq—এইসব সিনেমা প্রমাণ করে দেশপ্রেম, প্রেম এবং সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার দর্শকের চেতনায় একত্রিত হয়েছে।

1998 – Kuch Kuch Hota Hai, Pyaar To Hona Hi Tha, Satya, Dulhe Raja ইত্যাদি সিনেমায় দর্শকের কাছে বন্ধুত্ব, শহরের হিংস্র বাস্তবতা ও রসবোধ—সবই জায়গা করে নেয়।

1999 – Hum Dil De Chuke Sanam, Taal, Sarfarosh, Biwi No. 1, Vaastav—প্রেম, সংগীত, দেশপ্রেম ও অপরাধজগত—সবকিছু মিলিয়ে দশকের শেষ বছরটি এক সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

মনোবিশ্লেষণে দেখা যায়—প্রতি বছর দর্শকের মানসিক চাহিদা পরিবর্তিত হয়েছে, কখনও তীব্র সংবেদনশীলতা চেয়েছে (Hum Aapke Hain Koun..!), কখনও গ্ল্যামার ও মুক্তির অনুভব (Rangeela, Taal), কখনও সন্ত্রাস ও প্রতিবাদের সাহস (Sarfarosh, Satya)।

এই প্রবণতা বোঝায় যে বক্স অফিস ট্রেন্ড কেবল হিসেবের খাতা নয়, বরং দর্শকের মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাতের সূচক। প্রতিটি সফল সিনেমা সেই বছরে দর্শকের অন্তর্জগতের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নের একটি প্রতিক্রিয়া।

এইজন্য বলা যায়—নব্বই দশকের বক্স অফিসের রূপরেখা মানে ভারতীয় সমাজের আত্ম-প্রতিবিম্ব, আবেগের আন্দোলন, এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এক প্রজন্মের মানসিক ক্যানভাস।

গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ও উদ্ধৃতি

এইজন্য বলা যায়—নব্বই দশকের বক্স অফিসের রূপরেখা মানে ভারতীয় সমাজের আত্ম-প্রতিবিম্ব, আবেগের আন্দোলন, এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এক প্রজন্মের মানসিক ক্যানভাস।

নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমা শুধু সংলাপ, গান, কাহিনি বা ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য নয়, বরং এক প্রজন্মের মানসিক গঠন, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি এবং আত্মচেতনার নির্মাণের জন্যও স্মরণীয়। এই সময়ের নির্মাতা, অভিনেতা, সুরকার, সংলাপলেখক এবং বিশ্লেষকরা যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিংবা যেসব মন্তব্য রেখেছেন, তা কেবল তথ্য নয়—বরং আত্মপ্রকাশ, শিল্পদর্শন এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার পরোক্ষ দলিল। এই প্রবন্ধে আমরা নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাক্ষাৎকার ও উদ্ধৃতিকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে পড়ার চেষ্টা করব।

প্রথমত, নব্বইয়ের দশকে যে সাক্ষাৎকারগুলি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তার অনেকটাই চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন—যেমন Filmfare, Stardust, Screen, Cine Blitz—এ প্রকাশিত হয়। এইসব সাক্ষাৎকারে অনেক সময় আবেগের গভীর ভাষা থাকে, যা নিরাবরণভাবে শিল্পীর মনস্তত্ত্ব উন্মোচন করে।

শাহরুখ খান (Filmfare Interview, 1995) তিনি বলেছিলেন—“I am not a lover boy, I am a survivor. Love is a costume, pain is permanent.” এই বক্তব্যে শাহরুখের একান্ত জীবনসংগ্রামের ছায়া যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রেম-ছবির নায়ক হয়ে ওঠার এক পরিহাসমূলক মনোভাব। এটা কেবল স্টারডম নয়, এক ধরণের ‘existential shield’।

সালমান খান (Stardust, 1994) “Main janta hoon ki log mujhe pasand karte hain, kyunki main unke jaise hoon. Mujhmein hero ka glamour nahi, aadmi ki vulnerability hai.” এই বক্তব্যে সালমান নিজের স্টার ইমেজকে এক সাধারণ মানুষের চেতনায় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ‘empathic projection’।

আমির খান (India Today, 1999) “I want to be relevant even when I’m not visible. Cinema is not my vanity, it’s my mirror.” এই বক্তব্য একজন ‘reflective actor’ হিসেবে আমিরকে প্রতিষ্ঠা করে, যিনি জনপ্রিয়তা নয়, অন্তরঙ্গতা খোঁজেন।

অমিতাভ বচ্চন (The Sunday Observer, 1991) “After politics, I stopped understanding applause. I preferred silence.” এটি আত্মমর্যাদার সঙ্গে সংযুক্ত নিঃসঙ্গতার স্বীকারোক্তি, যা তার কামব্যাকের ভেতর একটি দ্বিধা ও introspection-এর রূপ দেয়।

সূরজ বরজাতিয়া (Rajshri Archives, 1994) “I wanted to make films that my grandmother could watch without turning her eyes away.” এখানে সিনেমা কেবল শিল্প নয়, বরং পারিবারিক মূল্যবোধের নান্দনিক চর্চা। এটি একধরনের ‘emotional ethics’।

মহেশ ভাট (Screen, 1998) “When my mother died, I realised I had never made a film about silence. Zakhm is that film.” এই বক্তব্য আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্রের মনস্তত্ত্ব বোঝায়—‘personal grief as cinematic language’।

সঞ্জয় লীলা বনসালি (Filmfare, 1999) “I want my frames to sing, and my characters to whisper.” এটি চিত্রশৈলীকে একধরনের সংগীতায়িত অনুভবে রূপান্তরিত করার উচ্চারণ।

উদিত নারায়ণ (Doordarshan Interview, 1996) “People say I sound romantic, but I sing with tears in my throat.” এই স্বীকারোক্তি সংগীতকে রোমান্টিকতা নয়, বরং আত্মব্যথার একটি প্রকাশ হিসেবে দেখায়।

নাদিম সাইফি (T-Series Interview, 1997) “Our melodies are not tunes. They are letters we never posted.” এটি একটি প্রজন্মের অপ্রকাশিত ভালোবাসার আত্মচেতনার সুর।

রাম গোপাল ভার্মা (The Hindu, 1998) “Fear is not in darkness, it’s in what you think might be there.” এই বক্তব্যে সাসপেন্স ও সাইকো-থ্রিলারের ন্যারেটিভ কৌশলের গভীর মনস্তত্ত্ব রয়েছে।

এইসব উদ্ধৃতি একত্রে নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমাকে বোঝার একটি অক্ষরগ্রন্থ। এগুলো শুধু বক্তব্য নয়, বরং ‘aesthetic self-portraits’। প্রত্যেকটি সাক্ষাৎকার, প্রত্যেকটি উচ্চারণ শিল্পীর ভেতরের দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা, অথবা গভীর আবেগের দলিল।

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়—নব্বইয়ের দশকের সাক্ষাৎকার ও উদ্ধৃতিগুলি কেবল তথ্য নয়; বরং মনস্তত্ত্বের খোলা দরজা। এই দরজাগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই কীভাবে সিনেমা নির্মাণের চেয়ে অনেক গভীরতর এক আত্মপ্রতিক্রিয়ার প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে—সেই মানুষদের মধ্যে, যারা পর্দার সামনে যেমন ছিলেন, তেমনি পর্দার আড়ালেও এক নিঃসঙ্গ যাত্রায় ছিলেন চিরকাল।

Post Views: 611
Tags: 90s Bollywood90s Hindi MoviesBollywood 1990s eranostalgic Bollywoodold Hindi filmsনব্বইয়ের বলিউডনব্বইয়ের সিনেমার জাদুনয়ের দশকের হিট সিনেমাবলিউড কালচারবলিউড গোল্ডেন এরাবলিউড নস্টালজিয়াবলিউড ফ্যাশনবলিউড মিউজিক 90sবলিউড রেট্রোবলিউড রোমান্স যুগবলিউড হিরোইন 90sরোমান্টিক হিন্দি সিনেমাশাহরুখ সালমান আমিরহিন্দি সিনেমা ইতিহাসহিন্দি সিনেমার বদল
ADVERTISEMENT

Related Posts

মোহাম্মাদ রফিঃ ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব
সিনেমা

মোহাম্মাদ রফিঃ ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব

আপনি কি কখনও ভেবেছেন, একটি কণ্ঠস্বর কীভাবে কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করতে পারে? ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এমনই এক...

by নবজাগরণ
July 18, 2025
সলমন খান ও কৃষ্ণ হরিণ শিকারঃ সলমন খানের এক বিতর্কিত অধ্যায়
সিনেমা

সলমন খান ও কৃষ্ণ হরিণ শিকারঃ সলমন খানের এক বিতর্কিত অধ্যায়

বলিউডের 'ভাইজান' সলমন খান - যার নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে তাঁর বক্স অফিস হিট সিনেমা, দানশীলতা, এবং বিতর্কিত...

by নবজাগরণ
July 18, 2025
রাজ কাপুর: বলিউডের কিংবদন্তী ও শো ম্যান
সিনেমা

রাজ কাপুর: অভিনেতা ও বলিউডের কিংবদন্তী শো ম্যান

বলিউডের স্বর্ণযুগে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম - রাজ কাপুর । চার্লি চ্যাপলিনের মতো হাসি-কান্নার দোলায় দুলিয়ে দিতেন দর্শকদের। কিন্তু...

by নবজাগরণ
November 7, 2024
ক্যামেরার দিব্যদৃষ্টি : ইওরােপীয় চলচ্চিত্রের শিল্পনিরিখ
সিনেমা

ক্যামেরার দিব্যদৃষ্টি : ইওরােপীয় চলচ্চিত্রের শিল্পনিরিখ

লিখেছেনঃ সােমেন ঘােষ চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক আন্দ্রে বাজা তার সাড়া জাগানাে গ্রন্থে বলেছিলেন “All the arts depend on the presence...

by অতিথি লেখক
April 5, 2022

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (28)
  • ইসলামিক ইতিহাস (23)
  • ইহুদী (3)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (26)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (196)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (70)
  • সিনেমা (18)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply