লিখেছেনঃ সুপ্রতিম দাশ
প্রাচীন পৃথিবীর দাস বিদ্রোহ গুলির দিকে ফিরে তাকালে কি হবে আমাদের মূল্যায়ন? ফলাফল বিচার করলে সমস্ত বিদ্রোহই ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্রোহী নায়করা সকলেই প্রাণ দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী রাষ্ট্রও বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু ইতিহাসে নিছক তাৎক্ষণিক ফলাফল দিয়ে সব কিছুর বিচার হয় না। দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে দেখলে অনেক ঘটনারই বৃহত্তর অর্থ পাওয়া যায়। সিসিলির দুটি অভ্যুত্থান এবং স্পার্টাকাসের বিদ্রোহকেও কোনাে সংকীর্ণ ছাঁচে ফেলে নিছক সমকালীন মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক হবে না। ট্রাজিক পরিণতি স্বত্ত্বেও দাস বিদ্রোহগুলির অন্যতর ব্যঞ্জনা ছিল। আমরা এখানে এই প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু কথা বলব। তবে তার আগে আরাে দুচার কথা লেখা প্রয়ােজন।
স্পার্টাকাসের অভ্যুত্থান চূর্ণ হওয়ার প্রায় একশ বছর পরে খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে স্টোইক দার্শনিক সেনেকা দাসত্ব সম্পর্কে যে কথা লিখেছিলেন তাকে বলা যেতে পারে রােমের এ যাবৎকালের ইতিহাসে সবচেয়ে উদার ও মানবিক। সেনেকা লিখেছিলেন, দাসদের প্রতি প্রভুদের ব্যবহার হওয়া উচিত সদয় ও নমনীয়। উৎস এবং নৈতিকতার দিক থেকে সব মানুষ সমান। তাই ক্রীতদাস এবং স্বাধীন মানুষের মাঝখানে কোনাে কৃত্রিম ভেদরেখা থাকতে পারে না। সামাজিক মর্যাদা জিনিসটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। মানুষের আসল মূল্য নির্ভর করে নৈতিকতার উপর। দাসত্ব প্রকৃতপক্ষে একটি শারীরিক অবস্থা। মানব মনের পক্ষে এই শারীরিক বন্ধন অতিক্রম করা সম্ভব। কি ক্রীতদাস, কি অক্রীতদাস-হৃদয়ের স্বাধীনতার উপর সব মানুষের সমান অধিকার। তাই একজন দাসের পক্ষেও তার প্রভুর মত নৈতিক চরিত্র অর্জন করা সম্ভব।
সেনেকার এই বক্তব্য বিচার করলে বােঝা যায়, এই দার্শনিক মানব জাতির সাম্যে বিশ্বাস করতেন। ক্রীতদাসের মধ্যেও মনুষ্যত্ব আছে বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু এমন কি তিনিও দাস ব্যবস্থার অবসান চান নি। তার উদ্দেশ্য ছিল দাস মালিকের মনে স্টোইক উদারতা সঞ্চারিত করে দাসদের আনুগত্য ও বাধ্যতাকে সুনিশ্চিত করা। এর ফলে দাসও প্রভুরমধ্যে যে সামাজিক সৌহার্দ্য গড়ে উঠবে তা দাস ব্যবস্থাকে মসৃণভাবে চলতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ সৌহার্দ ও মানবিকতার কথা বললেও সেনেকা ক্রমবিন্যস্ত সামাজিক কাঠামাে ভেঙে যাক এটা চান নি।
মানবজাতির সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শটি সেনেকার একান্ত নিজস্ব কোনাে ভাবনা ছিল না। দীর্ঘকাল ধরে এটা ছিল স্টোইক দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয়। সেনেকা এই ঐতিহ্যকে আরাে ঘষা মাজা করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেও এই ভাবনা সমাজে দাসপ্রথার প্রয়ােজনীয়তা বা উপযােগিতা নিয়ে কোনাে মৌলিক প্রশ্ন তােলেনি বা দাসপ্রথা দুর্বল হয়ে পড়ে এমন কিছু প্রচার করেনি তাই অনেকে মনে করেন, রােমের দাস বিদ্রোহগুলির পিছনে বৈপ্লবীক দর্শন বা মতাদর্শের কোনাে প্রভাব ছিল না। বিদ্রোহের যুগটি ছিল প্রবল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং পৌর অসন্তোষের যুগ। রােমান রিপাবলিকের আমলে দাস ব্যবস্থার বিপুল সম্প্রসারণ ঘটেছিল। ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে যে টানাপােড়েন শুরু হয়েছিল তা চূড়ান্ত রাজনৈতিক নৈরাজ্যের জন্ম দিয়েছিল।
তাই ১৩৩ খ্রিঃ পূর্বাব্দ নাগাদ রােমের বহু অভিজাত রাজনীতিক ইতালিতে জমি পুনর্বণ্টনের প্রস্তাব করেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম টাইবেরিয়াম গ্র্যাক্কাস (Gracchus)। একদিকে গ্রামীণ এটুরিয়াতে অসংখ্য বিদেশী ক্রীতদাসের উপস্থিতি এবং অন্যদিকে সিসিলির প্রথম দাস যুদ্ধের ভয়াবহতা — এই দুটি বিষয় গ্র্যাক্কাসকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়। তবে আর একটি আনুষঙ্গিক যুক্তিও ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তা হল, জমি পুনর্বণ্টন করলে জমিতে কাজ করা দাসদের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং দাস বিদ্রোহের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। লক্ষ্য করার বিষয় হল, গ্র্যাক্কাসের মত যেসব রাজনীতিবিদ রােমান রিপাবলিকের এই শেষ পর্বে কৃষি সংস্কারের কথা বলছিলেন তারা কেউই চান নি সমাজ থেকে দাসপ্রথা উঠে যাক। এতটা বিপ্লবীয়ানা কেউই দেখাতে চান নি।
নিজেদের শ্রেণী স্বার্থ থেকেই রােমের শাসকবর্গ এবং অন্যান্য অভিজাতরা চেয়েছিলেন দাসব্যবস্থা, সামাজিক ক্ৰমবিন্যাস এবং শােষণেরউপর গড়ে ওঠা ক্ষমতাতন্ত্র অটুট থাকুক। স্বভাবতই দাসরা এই ক্ষমতাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত কর্তৃত্ব এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধায় ফুঁসে উঠেছিল। তারা হয় পালিয়ে গিয়ে আর নইলে সরাসরি বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ফিরে পেতে চেয়েছিল। একবার বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবার পর দাসদের বেপরােয়া মনােভাব এবং অকুতােভয় প্রতিরােধ তাদের তীব্র স্বাধীনতা স্পৃহা এবং পুষে রাখা ঘৃণা প্রমাণ করে। প্রশ্ন উঠেছে, দাসরা কি চেয়েছিল? দাসত্ব থেকে মুক্তি, না দাসত্বের অবসান ? প্রচলিত মাজব্যবস্থা এবং ক্ষমতাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার কোনাে পূর্ব পরিকল্পনা বা আদর্শ কি তাদের ছিল? নাকি যা ঘটেছিল সবই আপতিক বা নিছক দুর্ঘটনা! একটি বহুল প্রচলিত মত হল, দাস বিদ্রোহগুলি নিছক মুক্তির লড়াই। সমাজ বদলের স্বপ্ন আদৌ ছিল বলে মনে হয় না।
দাসরা ঠিক কি চেয়েছিল তা তারা নিজেরা কোথাও বলে নি। তাদের আশা আকাঙক্ষা, লক্ষ্য বা অভিপ্রায় সম্পর্কে তাদের কোনাে জবানবন্দি বা বিবৃতি পাওয়া যায় নি। বিদ্রোহের সময়কার বিভিন্ন ঘটনাকে দাসরা কি নজরে দেখত, দাসত্ব সম্পর্কেই বা তাদের অভিজ্ঞতা কি ছিল তা জানার উপায় নেই। যে সব গ্রীক এবং রােমান লেখক বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছিলেন তারা দাসপ্রথাকে সমর্থন করতেন, বিদ্রোহী দাসদের দস্যু বা অপরাধী বলে মনে করতেন। দাস বিদ্রোহ গুলিকে তারা তাদের একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা শ্রেণি চেতনা থেকে বিচার করেছিলেন। তাই যাঁরা দাস বিদ্রোহকে আধুনিককালে নিছক প্রতিশােধ নেওয়া এবং স্বাধীনতা অর্জনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন, তারাও স্বীকার করেছেন যে, তাত্ত্বিকভাবে অন্তত এমন একটি সম্ভাবনার কথা মেনে নিতে হবে যে তিনটি বড় বিদ্রোহেই দাসরা সমস্ত শােষিত মানুষকে নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানাের পূর্ব পরিকল্পনা করেছিল। আর প্রচলিত সাক্ষ্যপ্রমাণ মেনে নিয়ে যদি আমরা ধরে নিই যে সমস্ত দাস বিদ্রোহই ছিল অপরিকল্পিত এবং অপ্রত্যাশিত, সেগুলি আংশিকভাবে “ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা” ছাড়া কিছু নয়—তাহলেও দাস বিদ্রোহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিপুল সম্ভাবনা এবং ইতিবাচক শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না কোনােমতেই। যে মুহূর্তে বিদ্রোহের সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত হত সেই মুহূর্ত থেকেই বিদ্রোহী দাসদের সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে বাড়তে থাকত। এই পরিস্থিতি দাসদের কাছ থেকে ইতিবাচক মনােভাব দাবি করত। তিনটি দাস বিদ্রোহেই এই দাবি বিদ্রোহীরা মেটাতে পেরেছিল। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে দাসরা গড়ে তুলেছিল। নিজেদের সংগঠন এবং শৃঙ্খলাবােধ। মতাদর্শ থাক বা না থাক, বিদ্রোহী চেতনা এবং প্রতিস্পর্ধা অচিরেই ঝলসে উঠেছিল।
দাস বিদ্রোহ এর এই বিপুল ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মত একটি ঘটনা। আধুনিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্রোহীদের বিপুল সংখ্যাই তাদের কূটনৈতিক ঐক্য বা সংহতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছােটখাটো স্থানীয় প্রতিরােধের সংবাদ পৌঁছানাে মাত্র সেই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে হাজার হাজার ক্রীতদাস সিসিলি এবং ইতালিতে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তারা প্রমাণ করেছিল যে রােমান দাসব্যবস্থার মধ্যে গণ-বিদ্রোহের যে শক্তি ও সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার যােগ্যতা এবং আকাঙক্ষা তাদের আছে। বিদ্রোহ করে দাসরা তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল এবং রােমের প্রত্যাঘাত সামলে এই স্বাধীনতা ধরে রাখার সাহস ও ক্ষমতা তাদের ছিল। দাসদের বিদ্রোহকালীন আচার-আচরণ খুঁটিয়ে দেখলে বােছা যায় তাদের মধ্যে যে বিদ্রোহী চৈতন্য ছিল তা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইকে দীর্ঘ সময় ধরে বজায় রেখেছিল। তবে দুভার্গ্যবশত দাসদের মধ্যে কোনাে সার্বিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। তখনকার পরিস্থিতিতে তা সম্ভবও ছিল না। দাসদের মধ্যে নানা জাতির মানুষ ছিল।
তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক পরিচয় সবই ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এই বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যে সাধারণ ঐক্য গড়ে ওঠা সহজ ছিল না।
তবু তারই মধ্যে একটা চমকপ্রদ ব্যাপার হল দাস যুদ্ধের সময় ধারাবাহিকভাবে একগুচ্ছ নায়কের আবির্ভাব। প্রথমে হয়ত এঁদের নিজেদেরও বিশাল মাপের অভ্যুত্থান ঘটানাের কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু বিদ্রোহের প্রাথমিক সাফল্য আসা মাত্রই এঁরা চেষ্টা করতেন হাজার হাজার বন্দি ক্রীতদাসের পুঞ্জিভূত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক মহা প্লাবনের জন্ম দিতে। বিদ্রোহীদের সদ্য অর্জিত স্বাধীনতা ধরে রাখার জন্য এঁরা পুরােদস্তুর সামরিক পদ্ধতিতে বিদ্রোহী বাহিনীকে পরিচালনা করতেন। দাস নায়করা সকলেই ছিলেন গণমােহিনী ব্যক্তিত্ব, নিজেদের স্থানীয় সমাজে বিপুলভাবে জনপ্রিয়। অনুগামীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করার যােগ্যতা এঁদের যথেষ্ট ছিল। তাঁদের অসামান্য নেতৃত্বে প্রতিরােধের ছােটখাটো ঘটনাই পরিণত হত এক একটি ভয়ংকর বিদ্রোহে। প্রাচীন পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। যুদ্ধের এই স্বাভাবিক চরিত্র বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করত। বেশির ভাগ মানুষ সেই যুগে। প্রত্যাশা করত জীবনের কোনাে না কোনাে পর্বে তাদের কিছুনা কিছু সামরিক উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাস্তবিক স্পার্টাকাসের মত বহু প্রথম প্রজন্মের ক্রীতদাস হয়। রােমের সেনাবাহিনীতে আর নয়ত হেলেনিক রাজাদের ফৌজে ইতিপূর্বে কাজ করেছিলেন। তাই এঁদের কাছে যুদ্ধ করাটা কোনাে সমস্যা ছিল না। এক্ষেত্রে একজন উপযুক্ত নেতার আবির্ভাব ছিল যথেষ্ট।
তাই দাস বিদ্রোহের পিছনে কোনাে বৈপ্লবিক আদর্শ বা কর্মসূচী ছিল না, বিদ্রোহীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা চায় নি, নিছক ব্যক্তিগত মুক্তি চেয়েছিল—দাস বিদ্রোহের মূল্যায়ন করতে বসে এভাবে দেখলে বড় বেশি সাদায় কালােয় বিচার করা হবে। রােম এবং ইতালির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং টানাপােড়েনের সুযােগ বিদ্রোহীরা নিয়েছিল। বিদ্রোহী নেতারা সকলকে নিয়ে চলার মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে অসংখ্য স্বাধীন গরিব মানুষ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিল। স্পার্টাকাসের মত নেতারা সম্পদের সমবন্টন: চেয়েছিলেন। অন্তত কিছুকালের জন্য দক্ষিণ ইতালিতে বৈপ্লবিক রাষ্ট্রের একটা সুস্পষ্ট আদল গড়ে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় শস্যাগার, অস্ত্রের কারখানা, আঁটসাট যৌথ শৃঙ্খলা – সবই এখানে ছিল। এই সবই কি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা?
স্বভাবতই স্পার্টাকাসের প্রসঙ্গ এসে পড়ে আরাে একবার। প্রাচীন পৃথিবীর দাসদের কাছে তিনি অকারণে বীরের মর্যাদা পান নি। কার্ল মার্কসের কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ইতিহাসে তার প্রিয় চরিত্র কে? মার্কস বলেছিলেন, রােমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে লড়াই করে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া দাস নায়ক স্পার্টাকাস।
মার্কসের চোখে এই বিদ্রোহী হলেন “গােটা প্রাচীন ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ চরিত্র”। সেই থেকে কয়েক শতাব্দী ধরে বামপন্থীদের কাছে স্পার্টাকাস অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। তার নেতৃত্ব ও যুদ্ধকৌশলের ফলে অন্তত কিছুকালের জন্য পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে পিছু হঠতে হয়েছিল। থেরেসা উরবেনচিকের কথা পাঠক আগেই জেনেছেন। এই প্রসঙ্গেতার মত প্রচলিত মতের সম্পূর্ণ বিরােধী। যাঁরা মনে করেন দাস বিদ্রোহগুলি সাম্যের লড়াই নয় কারণ দাসরা কখনাে সামাজিক বিপ্লব ঘটানাের জন্য লড়াই করেনি তাঁদের মতামতকে উরবেনচিক বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি লিখেছেন,এমন কি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবও সমাজবাদের চেয়ে বেশি করে রুটি, শান্তি এবং জমির দাবি জানিয়েই শুরু হয়েছিল।
যাঁরা দাস বিদ্রোহগুলিকে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা বলে মনে করেন তারা ভুলে যান ক্রীতদাসরা কখনােই তাদের দুর্ভাগ্যকে নিছক নিয়তি বলে মেনে নেয় নি। কি সেকালে, আর কি একালে। প্রাচীন গ্রীসের ড্রিমাকাস থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে হাইতির তুসা লুভের্তার (Toussaint L’Ouverture) পর্যন্ত প্রতিস্পর্ধা ও প্রতিরােধের ধারাবাহিকতা সে কথাই প্রমাণ করে। আমরা দেখেছি প্রাচীন গ্রীক বিদ্রোহী ড্রিমাকাস পালিয়ে আসা দাসদের নিয়ে একটি স্থায়ী এবং ‘স্বনির্ভর গােষ্ঠী’ তৈরি করেছিলেন। এরা ক্রমাগত নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রভুদের ঘরবাড়ি লুঠ করত। অন্য অনেক বিদ্রোহী নায়কের মত ড্রিমাকাসকেও হয়ত শেষ পর্যন্ত আপস করতে হয়েছিল ধনিক শ্রেণীগুলির সঙ্গে। কিন্তু এই আপসের শর্ত দাসদের শক্তির পরিচয় দেয়। স্থির হয়েছিল, ক্রীতদাসরা লুঠতরাজ করবে, তবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মেনে! আর ফরাসি বিপ্লবের আমলে ১৭৯১ সালে হাইতির সেন্ট ডােমিঙ্গোতে ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে তুসা যে বিদ্রোহ করেছিলেন তা আধুনিক দাস বিদ্রোহের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
খুব তাৎক্ষণিক অর্থে দেখলে ক্রীতদাসদের বিদ্রোহগুলি ব্যর্থ হয়েছিল। বহু ক্রীতদাস কেবল স্বাধীনতা নয় প্রাণ হারিয়েছিল। শুধু যুদ্ধের রক্তপাত নয়, অসুখ-বিসুখ এবং অনাহারে মৃত্যুও ছিল। ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিকল্পের প্রয়ােজন হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে দাস নায়কদের উদ্যোগ এবং সাফল্য প্রমাণ করে বড় মাপের বিদ্রোহের বিকাশ ঘটেছিল সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিরােধের আকার ও ব্যাপ্তি এতটাই প্রকান্ড হয়ে উঠেছিল যে সবচেয়ে প্রতিভাবান নেতাদের পক্ষেও তার উপর রাশ ধরে রাখা কঠিন ছিল। প্রতিরােধ ও বিদ্রোহের এই ব্যাপক মাত্রা রােমের ক্রীতদাসদের পরবর্তীকালের ইতিহাসকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। রােমান শাসকদের নানা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এই প্রভাব সবচেয়ে আগে ধরা পড়ে।
তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রতিক্রিয়া ছিল দমনমূলক। সিসেরাে লিখেছেন, অ্যাকুইলিয়াস (Aquillius) এর পরবর্তী সমস্ত সিসিলিয় গভর্নররা এই মর্মে আদেশনামা জারি
করেছিলেন যে ক্রীতদাসরা কোনাে অস্ত্র রাখতে পারবেনা। আরাে নানা সর্তকতা জারি হয়েছিল। তবে বাস্তবে ঠিক কিভাবে সিসিলির গভর্নরদের আদেশ প্রয়ােগকরা হয়েছিল তা বলা কঠিন। স্পার্টাকাসের মৃত্যু থেকে রােমের প্রথম সম্রাট হিসাবে অগাস্টাসের উত্থান পর্যন্ত সময়কালটিতে নিঃসন্দেহে ভূমধ্যসাগরীয় জগতটি নানা বিশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক হিংসায় আলােড়িত হয়েছিল। উঁচুতলার রাজপুরুষরা নিজেদের রাজনৈতিক এবং সামরিক উচ্চাশা মেটানাের জন্য সহজেই ক্রীতদাসদের ভিতরকার হিংস্রতাকে কাজে লাগাতেন। তবে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে দেখলে, রােমান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ের ফলে। রােমান সমাজে দাস ও তার প্রভুর সম্পর্কের মধ্যে আরাে বেশি স্থায়িত্ব এসেছিল। অবশ্য তার ফলে দাসদের বােঝা কিছুমাত্র কমে নি। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে বিভিন্ন দাস যুদ্ধের স্মৃতি একটা নতুন আবহ তৈরি করেছিল। অগাস্টাসের যুগে দাসদের মুক্তির নানা আইন এই আবহের ফসল। দাসত্বের নিয়মকানুন বদলানাে হয়েছিল এবং এই বদলের কৃতিত্ব অনেকটাই ক্রীতদাসদের নিজেদের।
দাস নায়কদের বীরত্বের স্মৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছিল। এই স্মৃতিই আবার দাস প্রভুদের দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে বেড়াত। তাঁদের শঙ্কা ছিল, এমন ঘটনা যদি আবার ঘটে! সাম্রাজ্যের আমলের শেষ দিক পর্যন্ত ইউনাস নামটাই একটি বার্তা বহন করে আনত : প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে দাসরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যে কোনাে মুহূর্তে নিয়তির চালে পদানত দাস স্বাধীন মানুষের উপর তার। আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। ইউনাস যেন ক্ষমতার এই ওলটপালটেরই প্রতীক। আবার সিসিলির দ্বিতীয় দাস বিদ্রোহের পরবর্তী বছরগুলিতে উচ্চবর্গীয় সমাজে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অসম্মান করার জন্য অ্যাথেনিয়ন-এর নামটি ব্যবহার করা হত। যেন “অ্যাথেনিয়ন” একটি রাজনৈতিক গালিগালাজ। এবং তার ব্যাখ্যাও কাউকে দিতে হত না। এই বিদ্রোহী রাজার পরিচয় এবং কার্যকলাপ সবার জানা ছিল!
তবে মুক্ত সমাজের কাছে সবচেয়ে বড় অশনি সংকেত ছিলেন স্পার্টাকাস। তার নামটাই শাসকদের চৈতন্যে নিরন্তর সাবধানতার তাগিদ সৃষ্টি করত। রােমের উগ্র, হিংস্র রাজনীতিক ক্লডিয়াসকে ভর্ৎসনা করার জন্য কিংবা বিশ্বাসঘাতক অ্যান্টোনিনাসের নিন্দা করার জন্য সিসেরাে সহসাই যেন স্পার্টাকাসের জাদু সৃষ্টি করেন। আবার সামরিক অ্যাডভেঞ্চারার অক্টাভিয়াসের বিরুদ্ধে অ্যান্টোনিনাস একই কৌশল গ্রহণ করেন। হােরেসেরআমলে স্পার্টাকাস রােমের এক বিধিবদ্ধ, প্রামাণ্য শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। তার স্থান হয়েছিল কুখ্যাত পাের্সেনা (Porsenna) এবং হ্যানিবলের পাশে। ২২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকাতে একজন বিদ্রোহী প্রধান নানা দাবিদাওয়া জানালে তৎক্ষণাৎ তুলনা হিসাবে স্পার্টাকাসের নাম উঠেছিল। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে একদল গ্ল্যাডিয়েটর যখন অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে তখনও পুনরায় স্পার্টাকাসের সঙ্গে এদের তুলনা করা হয়। লুকান থেকে শুরু করে ক্লডিয়ান পর্যন্ত সমস্ত রােমান কবি ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি হিসাবে প্রায় পাঁচালির মত স্পার্টাকাসের নাম আউড়েছিলেন। কালে কালে স্পার্টাকাসের এই সঞ্চরমান ভাবমূর্তির উপরে কিছু ইতিবাচক প্রলেপও পড়েছিল। তাই দেখি প্লিনি অ্যান্টোনিনাসের সঙ্গে প্রতিতুলনা করতে গিয়ে সংযমের দৃষ্টান্ত হিসাবে স্পার্টাকাসকেই স্মরণ করেছিলেন। তাঁর বিলাস-বিমুখতা এবং সামরিক খ্যাতি নিয়েও কেউ কখনাে প্রশ্ন তােলেন নি। তবে এইসব প্রশংসা নেহাতই আপতিক। স্পার্টাকাসের নেতিবাচক মূল্যায়নই সর্বদা প্রবলভাবে নজরে আসে। সম্ভাব্য দাস বিদ্রোহের অশনি সংকেতের মধ্যে স্পার্টাকাসের স্মৃতি রােমান সংস্কৃতিকেই অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল।
স্পার্টাকাসের মৃত্যুর অল্পকাল পরে রােমে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক ভেরেস (Verres) এর বিচার শুরু হয়। স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের সময় তিনিই সিসিলির গভর্নর ছিলেন। তার দাবি ছিল, ইতালির দাসদের আক্রমণের মুখে সিসিলিকে তিনিই রক্ষা করেছিলেন। সিসেরাে এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ভেরেসের এই দাবি নস্যাৎ করে দেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয় দাসযুদ্ধের সময় থেকেই সিসিলিতে কড়া প্রহরা এবং শক্তপােক্ত প্রশাসন ছিল। তাই স্পার্টাকাসের কারণে এই দ্বীপ কখনােই বিপন্ন হয় নি। সিসিলির উপর স্পার্টাকাস কোনাে আক্রমণ চালান নি। অতএব ভেরেস বিশেষ কোনাে কৃতিত্ব দাবিকরতে পারেন না যেহেতু তাকে আদৌ কিছু করতে হয়নি। এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সিসেরাে সিসিলিতে স্পার্টাকাসের প্রকৃত অভিযানের দোষ ত্রুটি আড়াল করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন ভেরেস কিভাবে স্থানীয় দাসদের অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রের অভিযােগ করে সিসিলির দাস-প্রভুদের থেকে অর্থ আদায় করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এইভাবে কিছুটা অনবধানেই সিসেরাে একথা প্রকাশ করেছেন যে খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ দিকে সিসিলিতে কৃষিজদাসদের মধ্যে লাগাতার বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিল। এটা কেবল সিসিলিরই প্রশ্ন নয়। সিসেরাে এমন ইঙ্গিতও করেছেন যে স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে ক্রাসাসের জয় দক্ষিণ ইতালিতে যাবতীয় দাস প্রতিরােধকে মােটেই নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। স্পার্টাকাসের মৃত্যুর পরও এই অধ্যায়টি পুরােপুরি বন্ধ হতে আরাে দশ বছর লেগেছিল। আমাদের কাছে এই তথ্যটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ভেরেসকে ভৎসনা করতে গিয়ে সিসেরাে খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, প্রশাসনের এতটুকুও শ্লথ ও আত্মসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। কারণ দাস বিদ্রোহের বিপদ তখনাে বর্তমান। উচ্চবর্গের চৈতন্যে দাস বিদ্রোহ কি ছাপ ফেলেছিল তা বােঝা যায় সিসেরাের এই সব মন্তব্য থেকে।
তবে বড় মাপের দাস বিদ্রোহ আর ঘটেনি। বরং প্রভুদের কাছ থেকে পালিয়ে আসা, ছােটখাটো অভ্যুত্থান এবং অন্য নানাভাবে ক্রীতদাসরা তাদের পরাধীনতাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিল। এর একটি কারণ হল, ইউনাস এবং তাঁর উত্তরসূরীদের মত বড় নায়ক আর আসেন নি। তাছাড়া দাস জনতার কোনাে একশিলা, নিটোল অস্তিত্ব ছিল না। তা ছিল ভৌগােলিকভাবে খন্ডিত, বিচ্ছিন্ন। এই টুকরাে টুকরাে অস্তিত্বের ফলে সার্বিক ঐকমত্য কোনােদিনই গড়ে ওঠেনি। এটাই ছিল গণবিদ্রোহের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বিদ্রোহী নায়করা নিজেদের কৃতিত্বে এই বাধা অনেকটা দূর। করতে পেরেছিলেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে খুব বড় মাপের বিদ্রোহ তাই আর ঘটেনি। তবে সাম্রাজ্যের যুগে প্রভু এবং দাসের সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি স্থিতিশীলতা এসেছিল। এই ঘটনা বুঝিয়ে দেয় উচ্চবর্গীয় সমাজবাস্তবকে মেনে নিয়ে নানা সামাজিক আপসের পথে পা বাড়িয়েছিল। ক্রীতদাসদের স্বার্থ যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না তা উপলব্ধি করেছিল রােমের উচ্চ কোটির সমাজ। এর পরিণামে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাঠামােয় কিছু অদলবদল করা হয়েছিল। এইসব বােঝাপড়ার মধ্যে দাসদের স্বার্থরক্ষারও একটা তাগিদ ছিল। দীর্ঘ মেয়াদি ফলাফল বিচার করলে দাস বিদ্রোহকেতাই ব্যর্থবলা যাবে না।
এহো বাহ্য! ঐক্যের অভাবে দাস বিদ্রোহীরা প্রতিবার শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু শােষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা পরাজিত হয় নি। কোনদিনই হয় না। হলিউডের কমিউনিস্ট চিত্রনাট্যকার ডাল্টন ট্রাম্বাে স্পার্টাকাস ছবিতে বিদ্রোহী নায়ককে দিয়ে বলিয়েছিলেন, “যখন মাত্র একজন মানুষও বলে, না, আমি মানব না”, তখনই রােম ভয় পেতে শুরু করে।” ছবির শেষে সব বিদ্রোহীকেই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরতে দেখা গিয়েছিল। তাই অনেকে ছবিটিকে বলেছেন পরাজয়বাদী। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দুনিয়া জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের ঠান্ডা যুদ্ধের কথা মাথায় রাখলে খােদ হলিউডে এমন একটি ছবি তৈরির ঘটনাকেই ঐতিহাসিক মনে হয়। বিদ্রোহীদের বার্তা খুব পরিষ্কার ও বিদ্রোহকে চূর্ণ করা যায়, বিদ্রোহ-মনস্কতাকে নয়। আজকের নব্য উপনিবেশবাদও যুদ্ধের ভুবনে দাঁড়িয়ে দাস বিদ্রোহ গুলি কে ফিরে দেখলে মনে হয়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হলে দুনিয়া জুড়ে সেই লড়াইকে ছড়িয়ে দিতে হবে। হারানাের তাে সত্যিই কিছু নেই!
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।