লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
গত বছর ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও সাহায্য জোগানোর জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সম্মাননা জানিয়েছেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে এবং ২০১২ সালে সম্মাননা জানানো হল আরও বিরাশি জন বিদেশি বন্ধুকে। এই উপলক্ষ্যে আমি গিয়েছিলাম অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্য সম্মাননা গ্রহণ করতে। বিদেশি বন্ধুদের জন্য কার্যক্রম শুরু হল ২৫ মার্চ সকালবেলা। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মারক সংগ্রহশালাতে। সংগ্রহশালাতে ঢাকার ঠিক মুখে রাস্তার অপর পারে প্রাচীরের গায়ে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতির পাশে খোদাই করা চারটে পক্তি—
যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা।
গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান ।
এই পদগুলি অন্নদাশঙ্করের একটি কবিতার প্রথম স্তবক। এদিনই বিকেলে আমরা গেলাম সোহরাবর্দি উদ্যানে যেখানে শহিদদের উদ্দেশে সারাক্ষণই জ্বলছে চিরন্তনী অগ্নিশিখা। এই সেই রেসকোর্স ময়দান যেখানে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। এখানে মাটির নীচে গড়ে তোলা হচ্ছে এই বিরাট সংগ্রহশালা।
নির্মীয়মান এই সংগ্রহশালার এক দেওয়ালে আছে সাতই মার্চে ভাষণরত বঙ্গ বন্ধুর প্রমাণমাপের আলোকচিত্র আর তার পাশে লেখা আছে— শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিলো জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিলো জোয়ার সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
এই অনবদ্য পদ্যবন্ধর রচয়িতা নির্মলেন্দু গুণ। যাঁকে নিয়ে এই দুটি উদ্ধৃতি তাঁর নাম নির্মলেন্দু করেননি, কিন্তু ১৯৭০-এর ৭ মার্চ যিনি স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক। দিয়েছিলেন তাঁর নাম সমস্ত বাঙালির জানা উচিত, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান তথা মুজিব। বাংলার তিন হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনাগুলির একটির নায়কও তিনি, পরিচালকও তিনি। বাংলাভাষা ও বাংলাভাষী জাতিকে তিনি রাষ্ট্রসংঘের ইতিহাসে উপস্থাপন করেছেন। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলাভাষাই রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃত ভাষা এবং ১৯৭৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বর মুজিবুর রহমানই প্রথম এই ভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম বাংলা ভাষাতে রাষ্ট্রসংঘে আপন দেশ ও দেশবাসীর কথা বলেন। ১৯১৩ সাল নোবেল পুরস্কার জয় করে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছিলেন তাকে ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং এই স্বীকৃতির দৌলতেই ২০০০ সালে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে আত্মদানের দিনটি লাভ করল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব। ফলে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ইতিহাসে ভারতীয় পরিচয় ছাড়াও আমাদের বাংলাভাষী পরিচয় এক স্বতন্ত্র গৌরব ও মহিমার দ্যোতক।
পৃথিবীর কোণে কোণে সবখানে বসবাসকারী প্রত্যেক বাংলাভাষীর কাছে মুজিব এই বলে সম্মাননীয় ও স্মরণীয় যে তার জন্যই সে বিশ্বসভায় ওই গৌরব ও মহিমার একজন অংশীদার।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ অখণ্ড বাংলার ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া নামে এক অখ্যাত গ্রামে এক মামুলি মধ্যবিত্ত পরিবারে শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন চক্ষু চিকিৎসার জন্য। তখন তিনি নবম কি দশম শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় সুভাষচন্দ্র বসু (তখনও তিনি নেতাজি আখ্যা পাননি) ব্রিটিশ ভারত সরকারের বন্দি হিসেবে চিকিৎসাধীন ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। এই খবর পেয়ে মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল কলেজে যান সুভাষচন্দ্রকে শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে দেখা করতে দেয়নি। এর কিছুদিন পরে সুভাষচন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার বাড়িতে আসতে দিলে ১৯১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সুভাষের রহস্যজনক অন্তর্ধান। এই অন্তর্ধানের আগে শেখ মুজিবুর রহমান আরও একবার এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেবারেও দেখা পাননি। মুজিবুর রহমান যে বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই দু-দুবার সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল চেষ্টা করেছিলেন এ ব্যাপারটা বিশেষ অর্থপূর্ণ। তখনই মুজিবের কাছে সুভাষচন্দ্র আদর্শ নেতা হয়ে উঠেছিলেন। পরে এ প্রসঙ্গে ফিরে আসব।
চক্ষুচিকিৎসার পরে মুজিব ঘরে ফিরে যান এবং ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৪২ সালে আবার কলকাতার কলেজে পড়তে আসেন। ভর্তি হন ইসলামিয়া (বর্তমান মৌলানা আবুল কালাম আজাদ) কলেজে ও থাকেন শিয়ালদা স্টেশনের কাছে বেকার হস্টেলে।
কলেজের ছাত্রাবস্থায় মুজিব তরুণ মুসলমান সমাজের প্রিয় নেতা ও বাংলাদেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিমের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানের থেকে মুসলিম লিগের নেতা। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন বাংলার উর্দুভাষী ধনী শহুরে সম্প্রদায়ের মুসলিম লিগের নেতা এবং আবুল হাশিমের ঘোর বিরোধী (হাশিমকে মুসলিম লিগ থেকে বহিষ্কারের জন্য নাজিমুদ্দিনের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায় মুজিবের তৎপরতার ফলে) এবং এই সুবাদেই মুজিব হয়ে ওঠেন লিগের তরুণ তুর্কি। সম্ভবত তখনই লিগের অপর প্রভাবশালী শহুরে ব্যক্তিত্ব শহিদ সোহরাবর্দির নেকনজরে পড়েন মুজিব এবং তিনি মুজিবকে আপন গোষ্ঠীভুক্ত করে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হন আর মুজিবও আস্তে আস্তে সোহরাবদিব অনুরক্ত ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার জন্য অনেকে দায়ী করে থাকেন সোহরাবর্দিকে। দাঙ্গাটা আকস্মিক ছিল কি পূর্বপরিকল্পিতি ছিল এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিখ্যাত সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ ‘হস্তান্তর’ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে দাঙ্গাটা শুরু হয় আকস্মিকভাবে তাদের মানিকতলা অঞ্চলে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ‘In Calcutta the Hindus had the best of it’ মন্তব্যটি ওই বিতর্ককে উসকে দেয়। বাংলার প্রধানমন্ত্রী (তখন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হত প্রধানমন্ত্রী) সোহরাবর্দি যদি প্ল্যান করে ওই দাঙ্গা বাধিয়ে থাকতেন তা হলে তার পরিকল্পনাতে পূর্বে প্রস্তুত দাঙ্গাবাজবাহিনী ও পুলিশবাহিনী কীভাবে পরাস্ত হল অপ্রস্তুত নিরস্ত্র হিন্দু ও শিখদের হাতে? কীভাবে হিন্দু ও শিখদের চেয়ে মুসলমানরাই নিহত হল বেশি? অসামরিক শিখরা যদি সমরবিদ্যায় এতই পটু হয় যে মুসলমানদের প্রস্তুত হয়ে নামা দাঙ্গাবাহিনীকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল তা হলে ১৯৮৪-র দিল্লির দাঙ্গাতে তারা কেন বিধ্বস্ত হল? তা হলে ১৬ আগস্টের দাঙ্গার আগে হিন্দু ও শিখরা তলে তলে যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল? নাকি দাঙ্গা বাধার পরে হিন্দু ও শিখরা সহসা বীরত্বে মহীয়ান হয়ে ওঠেন?
১৯৪৬-এর দাঙ্গাতে সোহরাবর্দির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে আসি ১৯৪৭-এর ঘটনা পরম্পরাতে। ১৯৪৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করলেন যে ১৯৪৮-এর জুন মাসের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তখন ১৯৪৭-এর ৪, ৫ ও ৬ এপ্রিল তিন দিন ব্যাপী হিন্দ মহাসভার কনফারেন্সে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তারপরে হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ পশিমবঙ্গ জুড়ে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত সভা করে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত সংগঠন করেন। তারকেশ্বরের কনফারেন্সে ৫ এপ্রিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘I can conceive of no other solution of the problem in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.’ এবার দেখা যাক বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাবর্দি কী বলছেন। স্টেটসম্যান দৈনিক পত্রিকার ৯ এপ্রিলের প্রতিবেদনে দেখছি বাংলা ভাগের বিপক্ষে সোহরাবর্দি বলছেন, I have always held the view that Bengal cannot be partitioned. I am in favour of a | united and greater Bengal.’ আবার ২৮ এপ্রিলের স্টেটমস্যান-এ তিনি বলছেন, ‘Partition would be suicidal even from the Hindus point of View.’ ওই একই নিঃশ্বাসে তিনি বলেন, I am visualising an independent, undivided, – sovereign Bengal in a divided India.’ এখানে সোহরাবর্দির কথা এত বিস্তারিতভাবে বলছি এজন্য শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছিলেন সোরাবর্দির অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুগামী। এবং ধরে নেওয়া যায় যে তখন মুজিবুরও অখণ্ড অবিভক্ত সার্বভৌম স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এখানে অখণ্ড বাংলার স্বপ্নবৃত্তান্তের বিষয়ে একটু বলা দরকার। ১৯২৫ সালে প্রথম লালা লাজপত রাই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে এক স্বতন্ত্র দেশ গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন ফজলুল হক। ওই প্রস্তাবে বাংলা পাকিস্তানের বহির্ভূত ছিল। বাংলাকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখার দাবি ওঠে ১৯৪৬এর কলকাতা-নোয়াখালির দাঙ্গার পরে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে ঘোষণার পরে হিন্দু মহাসভা শুরু করে বাংলা ভাগ করার জন্য আন্দোলন। তখন শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯৪৭-এর ২৫ এপ্রিল গঠিত হয় All Bengal Anti Pakistan and Anti Partition Committee, এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন শরৎচন্দ্র বসু, সেক্রেটারি হন কামিনীকুমার দত্ত আর অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অনিল রায়, লীলা রায়, কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, সত্যরঞ্জন বক্সি, জ্যোতিষ জোয়ারদার প্রমুখ। মে মাসের প্রথম দু সপ্তাহে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রবক্তাগণ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দিল্লিতে গিয়ে জিন্নার সঙ্গে সোহরাবর্দি আর সোদপুরে গিয়ে গান্ধিজির সঙ্গে শরৎচন্দ্র আলোচনা করে ২০ মে শরৎচন্দ্র বসুর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে সোহরাবার্দি, আবুল হাশিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়ে অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের প্রস্তাব রচনা করেন ও প্রস্তাবপত্রে স্বাক্ষর করেন শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিম।
এই সময় দিল্লির গরম থেকে সিমলায় গিয়ে নতুন গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টবেটেন দেশভাগের ব্যবস্থাপত্র রচনা করেন। জওহরলাল নেহরু তখন সিমলাতে। নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সূত্রে মাউন্টবেটেন ওই ব্যবস্থাপত্রটি নেহরুকে দেখান। তাতে নেহরু ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও বেঙ্গল এই তিনটে দেশ গঠনের প্রস্তাব দেখে বলেন যে এটা ইন্ডিয়ার বানাইজেশনের ব্যবস্থা, এর পরে দক্ষিণ ভারত চাইবে দ্রাবিড় দেশ, পশ্চিম ভারত চাইবে বৃহৎ মহারাষ্ট্র এবং এভাবে ভারত খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে। বাংলাতেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মৌলানা আক্রাম খাঁ বাংলা ভাগ করার জন্য জোর আন্দোলন শুরু করেন। এই পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানও কলকাতাতে ছিলেন সোহরাবর্দি, হাশিম প্রমুখের সহচর তথা অখণ্ড স্বাধীন বাংলার স্বপ্নকে বাস্তব রূপদানের কাজে আত্মনিবেদিত একজন কর্মীরূপে। বোঝা যায় যে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই মুজিব স্বপ্ন দেখছিলেন অখণ্ড স্বাধীন বাংলার। এ বিষয়ে মুজিবুর রহমান ১৯৭৪-এ নিজেই মনস্বী অন্নদাশঙ্কর রায়কে বলেছিলেন, তখন আমি সুরাবর্দী সাহেবের দলে, তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত ‘They could conquer the world.’
তবু ভাগ হল বাংলা, জন্ম হল পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের আর পাকিস্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের প্রবক্তা মোহম্মদ আলি জিন্না ঘোষণা করলেন যে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান হাসিল করা, সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে, লাভ করা গেছে পাকিস্তান, এই পাকিস্তানে মুসলমানরা আর মুসলমান থাকবে না। হিন্দুরা আর হিন্দু থাকবে না, সবাই হবেন পাকিস্তানি অর্থাৎ পাকিস্তানের নাগরিক। ধর্ম হবে নাগরিকের আপন আপন ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। কিন্তু মাত্র সাত মাস যেতে না যেতে ঢাকায় ১৯৪৮-এর ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় জিন্না আর একটি বিধান ঘোষণা করলেন যে প্রত্যেক পাকিস্তান নাগরিকের ভাষা হবে উর্দু। অথচ পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাকিস্তান মিলিয়ে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হল বাংলা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে জিন্নার ভাষণেই এই ইঙ্গিত ছিল যে উর্দু হল পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশের ভাষা এবং উর্দুকে গ্রহণে আপত্তির অর্থ পাকিস্তানের প্রতি প্রত্যাখ্যান। কিন্তু জিন্নার ভাষণের ন মাস পরেই ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি রূপে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষা বিশেষজ্ঞ ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বললেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজে হাতে আমাদের চেতনায় ও ভাষায়বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে বালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গিদাড়িতে ঢাকবার উপায় নেই। তার এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা। শুধু বাংলা ভাষার প্রবক্তাদের উপরে নয়, পূর্ব পাকিস্তাদের কৃষিজীবী ও কৃষকবন্ধুদের উপরেও সরকার চালায় অকথ্য নির্যাতন। জমিদার গৃহিণী হয়েও কৃষকবন্ধু বলে ইলা মিত্রের উপর অকথ্য অত্যাচার দু বাংলার মানুষের কাছেই হয়ে ওঠে আলোচ্য বিষয়। পাশাপাশি ১৯৪৮-৪৯ সালের বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করা হয় তার দ্বিগুণ টাকা বরাদ্দ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।
মুখের ভাষা হরণ, জাতিগত ভাবে বাঙালি পীড়ন আর অর্থনৈতিকভাবে বাঙালি শোষণ- এই তিনটে কারণের শক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৪৯-এর ২৩ ও ২৪ এপ্রিলে প্রবীণ মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিকে সভাপতি করে শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, শহিদ সোহরাবর্দি প্রমুখ গড়ে তোলেন আওয়ামি মুসলিম লিগ। যেখানে ধর্মীয় আবেগ থেকেই পাকিস্তানের সৃষ্টি সেখানে নামকরণের সময়। মুসলিম শব্দটি গ্রহণ করা স্বাভাবিক ছিল যদিও আওয়ামি মুসলিম লিগের সৃষ্টি মুসলিম লিগের বিরোধিতা করার জন্যই। এই নবজাত দলটির সম্পাদক মনোনীত হন শামসুল হক আর যুগ্ম সম্পাদক করা হয় নবীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে। যেটা কৌতুহলোদ্দীপক সেটা এই যে মুজিব তখন ছিলেন জেলবন্দি। ইতিমধ্যে কর্মী হিসেবে তিনি রাজনৈতিক মহলে এতটা সুপরিচিত হয়ে ওঠেন যে জেলে থাকা সত্ত্বেও তাকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। প্রায় চারমাস কারাবাসের পরে তিনি মুক্তি পান ১৯৪৯-এর ২৭ জুলাই। মুক্তিলাভের পরে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামি মুসলিম লিগের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই কাজের সুবাদেই লালোর যান সোহরাবর্দির সঙ্গে পরামর্শ করতে। ফিরে এসে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এবং সেজন্য তাকে মুসলিম লিগ সরকার গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে তিন মাস আটক রেখে ১৯৫০-এর ১৪ মার্চ আদালতে পেশ করে। আদালত তাকে জামিন দিলে আদালত থেকে বেরিয়েই অঞ্চলের যুবসমাজের উদ্দেশ তিনি এক উদ্দীপক ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পাশাপাশি সরকারি দমননীতির এবং মরক্কোতে ফরাসি উপনিবেশবাদীদের কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। সভাশেষে আবার গ্রেপ্তার হলেন। প্রথমে তাকে পাঠানো হল ফরিদপুর জেলে, তারপর খুলনা জেলে, তারপর বরিশাল জেলে, সবশেষে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি শেখ মুজিবুর রহমান ও সহবন্দি মহিউদ্দিন আহমদ অগণতান্ত্রিকভাবে দীর্ঘকাল আটকে রাখা রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওদিকে জেলের বাইরে তখন ভাষা আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ঢাকার পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছে দেখে সরকার মুজিবকে ফরিদপুর জেলে পাঠাল। সেখানে মুজিব পূর্ব ঘোষণা অনুসারে শুরু করেন অনশন। ইতিমধ্যে ঢাকার রাজপথে ঘটে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষার জন্য তরুণ আন্দোলনকারীদের শাহাদাতের আবেগে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের আর একটা শাহাদাত ঘটিয়ে দেশকে প্রবলতর অশান্তির মুখে ছুঁড়ে ফেলতে চায়নি পূর্ববঙ্গ সরকার। তারা অবশেষে মুজিবকে মুক্তি দিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। শেখ মুজিবুর রহমান তখন এমন দুর্বল যে তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হয় জেলের বাইরে, স্ট্রেচারে করেই নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়াতে নিজেদের বাড়িতে।
অমর একুশের ছায়ায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে ভরাডুবি হল মুসলিম লিগের তথা ধর্মীয় রাজনীতির এবং বিজয়ী হল ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানি, সোহরাবর্দি প্রমুখের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের। মুখ্যমন্ত্রিত্ব পান ফজলুল হক আর মুজিবুর রহমান পান সমবায় ও পল্লি উন্নয়নের মন্ত্রিত্ব। নব নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক এপ্রিল-মে মাসে কলকাতায় এসে আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আজ আমাকে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করিতে হইতেছে। আশাকরি “ভারত” কথাটির ব্যবহার করায় আমাকে আপনারা ক্ষমা করিবেন। আমি উহার দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কেই বুঝাইয়াছি, এই বিভাগকে কৃত্রিম বিভাগ বলিয়াই আমি মনে করিব।’ এর পরে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তান বলিতে প্রকৃতপক্ষে কিছুই বোঝায় না। ইহা বিভ্রান্তি সূচনা করিবার একটি পন্থা মাত্র। ইহা কেবল উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র।’ ফজলুল হকের এই আবেগাপ্লুত ভাষণ স্বভাবতই পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারি ও সাংবাদিক মহলে বিপুল বিক্ষোভ জাগায়। ঢাকাতে ফিরে তিনি ও তার মন্ত্রিসভা ডাক পেলেন করাচি থেকে। ফজলুল হক একা শেখ মুজিবকে নিয়ে করাচিতে গেলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলির ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সঙ্গে মোকাবিলা করতে। প্রত্যাশিত ভাবেই ১৯৪০-এ যিনি পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তাকেই পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মহাসভা ও সংবাদ মাধ্যমে চিহ্নিত করল বিশ্বাসঘাতক বলে। আর ঢাকায় ফিরে এলে তিনি পেলেন বিপুল সংবর্ধনা। সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন যে, কী হল করাচিতে। জবাবে তিনি বললেন ‘নাতি’ শেখ মুজিবের কাছ থেকে সেসব জেনে নিতে। করাচি যাওয়ার আগেই হক সাহেব বুঝেছিলেন যে কী হতে যাচ্ছে, তাই অন্য মন্ত্রীদের না নিয়ে শুধু তরুণ মুজিবকেই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন রাত্রেই হক মন্ত্রিসভা খারিজ করে ৯২ ক ধারা জারি করা হয় এবং মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জাকে পূর্ববঙ্গের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেই সঙ্গে ফজলুল হককে তার কে. এম. দাশ লেনের বাসভবনে অন্তরীণ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় নিরাপত্তা আইনে। এবার মাস ছয়েক তাকে কারারুদ্ধ থাকতে হয়। বাতিল করা হয় ৪৫ দিনের যুক্তফ্রন্ট সরকার। বিবিধ চক্রান্ত সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে বটে, তবে এই প্রত্যাগত সরকারকে আদর্শ ও নীতির সঙ্গে অনেক সমঝোতা করতে হয়। সমঝোতার অন্যতম বিধান হয় এই প্রত্যাগত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সর্ব বিষয়ে অনুগত থাকতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের। পরিবর্তে ফজলুল হকের অন্তরীণ দশার অবসান হয় এবং মাস ছয়েক বাদে কারারুদ্ধ মুজিবও মুক্তি পান। ততদিনে বাংলার মানুষের এক উল্লেখযোগ্য অংশ বুঝতে পেরেছে যে ধর্মের নামে বাংলার মানুষকে শোষণ করাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের আসল উদ্দেশ্য, ধর্মের মুখোশ না খুলে ফেললে এই রাজনীতির খেলাকে জনসমক্ষে আনা যাবে না। তাই ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামি মুসলিম লিগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ হল আওয়ামি লিগ। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধর্মকেই করল তাদের রাজনীতির মূলধন এবং ১৯৫৬ সালে গৃহীত সংবিধানে। পাকিস্তানকে বর্ণনা করা হল ইসলামিক রিপাবলিক এবং পূর্ববঙ্গের নাম বদলে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এটা হল ধর্মকে একটা শাসনবিধি বানিয়ে পূর্ববঙ্গবাসীদের দমিয়ে রাখার কৌশল ও পদ্ধতি।
মধ্যের মাস ছয়েক বাদ দিলে ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি সপরিবার স্বাধীন জীবন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করে প্রথমেই যে পদক্ষেপগুলি নেন। তার একটি হল ১২ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনে মুজিবকে এবং তার পরে মৌলানা ভাসানি, আবুল মনসুর আহমদ, ফয়েজ আহমদ প্রমুখকেও গ্রেপ্তার করা। আবুল মনসুর আহমদ দাবিদাওয়া করে রাজবন্দিদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা আদায় করলেও মুজিব ও মৌলানা ভাসানি সেসব নেননি, তারা অন্যান্য সাধারণ বন্দিদের মতোই কারাজীবন যাপন করেন। আবুল মনসুর আহমদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে ভাসানি ও মুজিব সবজির চাষ করে ও মরশুমি ফুলের বাগান করে বেশ আনন্দেই সময় কাটাতেন। শেখ মুজিবুর রহমান আবার একটা আমের চারা জোগাড় করে ‘নিজের সেলের ছোট আঙিনায় লাগিয়ে ফেলেছেন এবং জেল সুপারকে বলেছেন ওই গাছের আম খেয়ে যাওয়ার জন্য তিনি মনস্থ করেছেন।’ কিন্তু সেটি গাছ হওয়ার আগেই আরও অনেকের সঙ্গে ১৯৫৯-এর ১৭ ডিসেম্বর মুজিব মুক্তি পান। এদিকে এসে যায় ১৯৬১র রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। এই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে একদিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের অধিকাংশের মনে উত্তাল হয়ে ওঠে বাঙালিত্বের আবেগ তেমনই অন্যদিকে ওই আবেগের বিপরীতে অবাঙালি বিশেষত বিহারি মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানি বোধ উগ্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীত হয়ে ওঠে যেন দুই পাকিস্তানের কুরুক্ষেত্র। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের আবেশ কাটতে না কাটতে কাশ্মীরে পবিত্র হজরতের চুল চুরি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই ভীষণ দাঙ্গা শুরু হয়। পরের বছর ১৯৬৫ সালে বেধে গেল ১৭ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধ। যুযুধান দু দেশকে নিরস্ত করতে এগিয়ে এল সোভিয়েট রাশিয়া। অবশেষে ব্রেজনেভের পৌরহিত্যে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতের লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের আইয়ুব খান শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পরদিন ভোর হবার আগে ১১ জানুয়ারি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু। আইয়ুব খানের এই চুক্তি সম্পাদন ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃতদেহ বহনকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও আইয়ুবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো এমন তীব্র সমালোচনা করেন যে লৌহমানব আইয়ুব খানেরও আসন কেঁপে ওঠে। এই সুযোগে পাকিস্তানের মধ্যে আইয়ব-বিরোধীরা লাহোরে একটি কনভেনশন আহ্বান করে মিলিত হন। এই কনভেনশনে শেখ মুজিবুর রহমান তার বিখ্যাত ছয়-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ছয়-দফা কর্মসূচিটির তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘বাঁচার দাবি ৬-দফা’।
এই ৬-দফা দাবিগুলি ছিল
- ১) লালোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে ফেডারেশন অব স্টেটস, সরকার হবে পার্লামেন্টারি প্রথানুসারী এবং পার্লামেন্ট গঠিত হবে , সর্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে;
- ২) দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ব্যতীত অন্য সমস্ত বিষয়ে ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ;
- ৩) মুদ্রা ও অর্থ সম্পর্কিত ক্ষমতা হয় গোটা পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে নয়তো সমস্ত দেশে কেবল একটি মুদ্রা চালু থাকবে তবে সেক্ষেত্র পূর্ব পাকিস্তানে পৃথক ব্যাঙ্কিং রিজার্ভের ব্যবস্থা করতে হবে ও পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক আর্থিক নীতি প্রবর্তন করতে হবে;
- ৪) কর বা শুল্কের ব্যাপারে ফেডারেশনের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে, তবে রাষ্ট্রগুলোর আদায়কৃত করের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে;
- ৫) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বিদেশি বাণিজ্যের পৃথক হিসাবপত্র থাকবে, বিদেশি বাণিজ্য সূত্রে পাওয়া অর্থ স্ব স্ব রাষ্ট্রের আর্থিক হিসাবের অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে পৃথক ভাবে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের স্বাধীনতা থাকবে;
- ৬) ফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্রগুলিতে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের স্বাধীনতা দিতে হবে। এই ছ-দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদকরূপে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর কনভেনশনে মুজিবুর রহমান উপস্থাপন করেন।
মুজিবের এই উদার ছ-দফা দাবি পেশের পেছনে ভুট্টোর সমালোচনাতে উদ্বিগ্ন আইয়ুব খান ফেডারেশনের দাবির আড়ালে পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলে বৃহত্তর বঙ্গ গড়ার চক্রান্ত দেখতে পেলেন এবং ৮ মে দেশরক্ষা আইনে মুজিবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেলে আটকে রাখলেন। মুজিবের এই প্রথম সলিটারি কনফাইনমেন্ট। একেবারে একা, নিঃসঙ্গ, নির্বাক কারাবাস। এরকম কারাজীবন মানুষকে উন্মাদ করে দেয়। কিন্তু আইয়ুব মুজিবকে উন্মাদ করে দিতে চাননি, চেয়েছিলেন উপযুক্ত শিক্ষা দিতে। তাই আট মাস পরে ১৮ জানুয়ারি মুজিবকে সাজানো মুক্তি দিয়ে আবার তখনই জেল গেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরে অনেকদিন ধরে তার আর খোঁজখবর নেই। মাস কয়েক পর জানা গেল তিনি ক্যান্টনমেন্টে আটক আছেন। অবশেষে ২০ জুন সরকারিভাবে জানানো হল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ ট্রাইবুনালে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচার করা হবে—তিনি নাকি আগরতলা গিয়ে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। পূর্ববঙ্গের সমস্ত মানুষ এই মামলার কথা শুনে চমৎকৃত, অনুগামীরা উদ্বিগ্ন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন নিকট অনুগামীও অভিযুক্ত হন। আদালত কক্ষে অল্প কয়েকজন সাংবাদিককে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সালের প্রথমার্ধে মুজিবের সঙ্গে সহবন্দি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমেদ দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে আদালতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তিনি কৌশলে সামরিক নিয়ন্ত্রণ অনুসারে মামলার যে প্রতিবেদন ‘ট্রাইবুন্যাল কক্ষে’ শিরোনামে লিখতেন তাতেই দেশবাসী বুঝতে পারে যে ওই মামলা তাকে কোনোভাবে বিচলিত বা শঙ্কিত করতে পারেনি।
আদালতে ঢুকে আসামীর কাঠগড়া থেকেই তিনি অ্যাডভোকেটবৃন্দ, আত্মীয়স্বজন ও সাংবাদিকদের অভিবাদন করতেন। আসামীদের সঙ্গে কথা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও মুজিব বলতেন এবং একবার ফয়েজ আহমদ অন্যদিকে তাকিয়ে তাঁকে ‘কথা বলা মানা’-র কথা মনে করিয়ে দিলে শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চকণ্ঠে বলেন, ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে। স্তম্ভিত আদালত কক্ষ। প্রধান বিচারপতি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন মাত্র। সেই যে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তারাপর লোকদেখানো ১৯৬৮-র ১৯ জানুয়ারি একটুক্ষণের জন্য মুক্তিলাভ ও মুক্তির পরক্ষণেই আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার উপরে চাপানো হয় গোপনে আগরতলা গিয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা। এই ঘটনা পরম্পরা চলতে থাকে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেটিক পুরো পর্ব পর্যন্ত।
এই সময় পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজও নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকেনি সমস্ত ছাত্রসংগঠন। একত্র হয়ে Democratic Action Committee তথা ডাক নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। জোটের বাইরে ভাসানির National Party বা ন্যাপের ডাকে ১৯৬৮-র ৬ ডিসেম্বর জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। পরদিন অটোরিকশ বা বেবি ট্যাকসির ড্রাইভাররা হরতালের ডাক দেয় এবং হরতালের হামলা সামলাতে পুলিশ গুলি চালায় ও তাতে দুজন দোকান কর্মীর মৃত্যু হয়। ফলে ৮ ডিসেম্বর আবার হরতাল এবং ১৩ ডিসেম্বর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে পুরো পূর্ববঙ্গ জুড়ে ধর্মঘট। সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সরকার বিরোধিতায় ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত পাত্র পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ১৯৬৯ সালে ১৭ জানুয়ারি মিছিল ও সভার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করে। প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি লাগাতার মিছিল ও সভা করে আন্দোলন শুরু করলে ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদজ্জামানের মৃত্যু এবং ২১ জানুয়ারি আসাদের রক্তমাখা শার্টটাকে নিশান করে বিশাল মিছিল বের করে। কবি শামসুর রহমান লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ নামে তার একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। উত্তেজিত জনতা ২৪ জানুয়ারি শহর দখল করে নেয়। আবার গুলি, আবার রুস্তম ও মতিয়ুরের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে।
ঘটে আশ্চর্য গণ-অভ্যুত্থান। কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো হলেও অবস্থা সামলানো যায় না। থানা ও ফাঁড়ি লুঠ হয়ে যায়। ইপিআর ও সেনাবাহিনীর হামলাতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা আরও মজবুত ভাবে কায়েম করার উদ্দেশ্যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান স্বয়ং ঢাকাতে আসেন ৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকা কালো পতাকায় উত্তাল, ‘গো ব্যাক আইয়ুব’ ‘গো ব্যাক আইয়ুব’ গর্জনে বধির। জবাবে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে সরকারি পক্ষ। ঘটনা পরম্পরা আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক ড. শামদুজ্জোহাকে হত্যার ফলে। খবর ঢাকাতে পৌছলে ঢাকা ফেটে পড়ে ক্রোধে ক্ষোভে। এদিকে কারফিউর উদ্দেশ্য বিফল হয়েছে বোঝা গেলে ২০ ফেব্রুয়ারি কারফিউ প্রত্যাহৃত হল। অন্যদিকে ব্যর্থ হল আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলাতে মুজিব ও অন্যান্য রাজবন্দিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি প্রমাণের চেষ্টা, ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি সমস্ত অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া হয়। কারফিউ তুলে নেওয়ার পরই সাফল্যের আনন্দে হাজার হাজার নরনারী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার পথে পথে। এবার রাজবন্দীদের মুক্তির পরদিন ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে পূর্ববঙ্গবাসীদের পক্ষ থেকে বিজয়ী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান কে বিপুল সংবর্ধনা ও ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধা দেওয়া হয়। সেই থেকে তার নতুন নাম হল ‘বঙ্গবন্ধু’।
কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলার অভিযোগ কী সম্পূর্ণ মিথ্যে ছিল? যখন ১৯৭৪-এ বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্করের মধ্যে অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা হয় বঙ্গবন্ধু তখন ওই মামলার বিষয়ে বলেন, “আমার কী প্ল্যান ছিল, জানেন ? হঠাৎ আমরা একদিন পাওয়ার সিজ করব। ঢাকা শহরের সব ক’টা ঘাঁটি দখল করে নেব।… কিন্তু একটা লোকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে সব পণ্ড হয়। নেভির একজন অফিসার বিশ্বাস করে তার অধীনস্থ একজনকে জানিয়েছিলেন। সে ফঁস করে দেয়। তখন আমরা সবাই ধরা পড়ি। সেদিন বঙ্গবন্ধু কমিউনাল পার্টিকে কেমন করে আস্তে আস্তে ন্যাশনাল পাটির্তে রূপান্তরিত করেন তারও বৃত্তান্ত বলেছিলেন অন্নদাশঙ্করকে। তাঁর নেতা সোহরাবর্দির স্বপ্ন ছিল অখণ্ড স্বাধীন বাংলা, মানভূম থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। শরৎচন্দ্র ও সোহরাবার্দির স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি, তার বদলে মুজিব হাসিল করেন বাংলাদেশ। যখন তিনি ‘জয় বাংলা’ ঘোষণা করেন তখন অনেকে বিদ্রুপ করেছিলেন ‘জয় মা কালী’ ধ্বনি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু এসব স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, “আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়।
১৯৭৪ থেকে ফিরে আসি ১৯৬৯-এ। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সামলাবার জন্য অনির্দিষ্টকাল ঢাকাতে বসে থাকতে পারেন না, তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও রক্ষা করতে হবে। ততদিনে সেখানে আর এক ধরনের পটপরিবর্তনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে। তার প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরে মার্চেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি চাইলেন আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির নামে একপ্রকার সামরিক শাসনের থেকে পাকিস্তানবাসীকে সাধারণ নির্বাচনের ভিত্তিতে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ দিতে।
১৯৭০ সালে ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। নির্বাচনের ফল ঘোষিত হল ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেল আওয়ামি লিগ। তা হলে আওয়ামি লিগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এরই পাকিস্তানের জনমনোনীত প্রধানমন্ত্রী হবার কথা। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১১জানুয়ারি ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু যে ভাবী প্রধানমন্ত্রী তা জানিয়েও গেলেন। বিগত তেইশ বছর ধরে বন্দুকের জোরে ও চালাকি করে পশ্চিম পাকিস্তান পীড়ন ও শোষণ চালিয়ে এসেছে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপরে। এবারে তার অবসান হবে। ওদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাওয়ালপিণ্ডি হয়ে লারকানায় জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাগান বাড়িতে গেলেন, আর এদিকে কবে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, কবে প্রধানমন্ত্রীর। নাম ঘোষিত হবে তার জন্য প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় দিন কেটে যেতে লাগল। ভুট্টো বললেন যে কিছুতেই মুজিবুরকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা যাবে না। অথচ নির্বাচনের ফল অনুসারে মুজিবেরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। তখন ভুট্টো বললেন তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের আর মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে। অর্থাৎ এক রাষ্ট্রের দু’জন প্রধানমন্ত্রী। তা কী করে সম্ভব? অগত্যা ইয়াহিয়া খান মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য দিন ক্রমাগত পেছিয়েই যেতে লাগলেন। ওই দিনটি বারবার মুলতুবি করে ইয়াহিয়া বুঝিয়ে দিলেন যে পাকিস্তান’স পিপলস পার্টির তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে বাঙালির হাতে ক্ষমা না দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ আছে। শেষে ১৯৭১-এর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, ৩ মার্চ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। এর অর্থ পরিষ্কার। বাতিল হয়ে গেল নির্বাচনের ফল। তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ৩ মার্চের জনসভায় ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ নামে স্বাধীনতা যুদ্ধের কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘোষণা করা হচ্ছে। ৫৪ হাজার ৫ শত বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এবং শেখ মুজিবুর রহমান হবেন সর্বাধিনায়ক। ভাষণের শেষে নিজের পরিণতি সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। আমি মরে গেলেও ৭ কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে।
অন্যদিকে নবজাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের উপর সামরিক হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে গোপনে প্রস্তুত হতে লাগল। প্রস্তুতির একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশপথে ও জলপথে পূর্ববঙ্গে আরও সৈন্য প্রেরণ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিকরণ এবং অপর অংশ পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্চপদস্থ ও সম্রান্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা।
যদিও ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে সেটাই হয়তো তাঁর শেষ ভাষণ তবু তিনি আরও একটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। এটাই তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্দীপক দশটি ভাষণের একটি। ৩ মার্চের ভাষণে তিনি তিন দিনের জন্য হরতাল ডাকেন যা এক মহান অসহযোগ আন্দোলনের রূপ নেয়। তিন দিনের অসহযোগ আন্দোলনের পরে যখন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সভামঞ্চে আরোহণ করলেন তখন সভাস্থ সবাই এক অজানা আশঙ্কায়, এক উদ্বায়ী উদ্বেগে, এক উজ্জীবক উত্তেজনায় কঁপছিলেন! গণতান্ত্রিক নির্বাচনে দেশবাসীর রায় প্রত্যাখ্যানকারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মারণাস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কীভাবে বাঙালি জনগণ মোকাবিলা করবে? বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করলেন এইভাবে, ‘ভাইয়েরা ‘আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ সেদিনের সভার পটভূমিকায় ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ‘আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে (ইয়াহিয়া খানকে) অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না।’ তারপর দু পাকিস্তানের বাস্তবতাকে সামনে এনে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে।’ এই নিরুপায় অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় হল সংগ্রাম, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সবাই জানতেন সেদিনের ভাষণ হবে এক অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। বিদেশেরও বহু সাংবাদিক সেদিন উপস্থিত ছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। তাদের প্রতিবেদনগুলির মধ্যে মার্কিন সংবাদ-সাপ্তাহিক নিউজ টাইমের প্রতিবেদনটি বিশেষ মুগ্ধতায় পূর্ণ, তার রিপোর্টার এই ভাষণদাতা বঙ্গ বন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে বর্ণনা করেন।
৯ মার্চ মৌলানা আবদুল হামিদ ভাসানি পল্টন ময়দানে জনসভায় ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার জন্য। কোরআনের কুফরিন (কাফেরুন) সূরা থেকে ‘লাকুম দ্বীনিকুন ওয়ালাইয়া দ্বীন’ আয়াতটি মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে পূর্ববাংলার আর পশ্চিম পাকিস্তানের আলাদা আলাদা দুটি পথ এই সত্যটাকে মেনে নিতে হবে। ওই দিনই পূর্ববঙ্গবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল গভর্নর এস এম আহসানকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর রূপে টিক্কা খানের শপথ নেওয়ার কর্মসূচি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও টিক্কা খানকে শপথবাক্য উচ্চারণ করানোতে অক্ষমতা জানান। ঢাকা রেডিওর কর্মীরাও সোৎসাহে যোগ দেন এই অসহযোগ আন্দোলনে। পরদিন ১০ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের এয়ার মার্শাল আসগর খান ঢাকা সফর সেরে করাচিতে ফিরে রিপাের্ট দেন যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও তিনি কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখতে পাননি। সিনেমা হলগুলোতে সিনেমা শুরুর ও শেষের সময় ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলার জয়’ গান বাজানো হতে লাগলো। নদীর মাঝিরাও নৌকা বাওয়ার সময় গাইতে লাগল ‘জয় বাংলা’ গান। সরকার থেকে বাঙালি সৈনিকদের অস্ত্র সমর্পণ করার ফরমান দেওয়া হলে গাজীপুরের সেনা ছাউনিতে ১৯ মার্চ অস্ত্র সমর্পণ করা নিয়ে বাঙালি ও অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে ঝগড়া থেকে গুলি বিনিময় পর্যন্ত গড়াল। জনতা ব্যারিকেড বেঁধে সৈনিকদের যাওয়া-আসার পথে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল। দু-পক্ষেরই হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলল ক্রমশ। এক প্রকার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ৩২ নং ধানমণ্ডি রোডের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ওই বাড়ি কার্যত হয়ে ওঠে অগঠিত ভাবী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর। বোঝাই যাচ্ছিল অচিরে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পূর্ববঙ্গের জনগণের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে সেরে নিচ্ছিল। অস্বাভাবিক থমথমে পরিবেশে দিনভর কাটল ২৪ মার্চ। রাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়িগুলো ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে পুরোদস্তুর আক্রমণের জন্য অবস্থান নিল। ২৫ মার্চ শুরু হল মানব ইতিহাসের এক চরম বর্বর আক্রমণের অধ্যায়। নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রী নিরীহ শিক্ষককূলের ও নাগরিকদের উপরে আধুনিক মারণাস্ত্রে বলীয়ান রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর হামলা।
সেদিন দুপুর পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে আপস-আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে এবং সরকার পক্ষ জানিয়েছে, আন্দোলনকারীদের প্রস্তাবগুলো সম্বন্ধে মতামত জানাবে বিকেলে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাল। সরকার পক্ষ থেকে কোনও জবাব আসছে না দেখে বঙ্গবন্ধু কর্মীদের সংগ্রাম কমিটি গড়ার নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল গোলাগুলির ভারী আওয়াজ। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন যে এবারে তার গ্রেপ্তার হবার সময় এসে গেছে। তার আগে তিনি ইংরেজিতে একটি ঘোষণা তৈরি করে ফেললেন, টেলিপ্রিন্টারে আর ওয়্যারলেসে ঘোষণাটি পাঠিয়ে দিলেন দিকে দিকে। ঘোষণাটি এইঃ
Declaration of Independence
This may be my last message. From today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh whereever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Paskistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
চট্টগ্রাম আওয়ামি লিগের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরি ঘোষণাটি পেয়ে এম এ হান্নানকে দিয়ে বাংলা অনুবাদ করিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে শহরে বিলির ব্যবস্থা করেন।
বাংলাদেশের জেলা ও মহকুমা শহরে শহরে মাইক যোগে সে বাতা ঘোষিত হয়। সারারাত ধরে এবং ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে পড়ে শোনান জহুর আহমদ চৌধুরি। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ‘দ্য টাইমস’ ও ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদটি। ‘দ্য টাইমস’-এর ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পরে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সংবাদও দেওয়া হয়। যাহোক, উপরে উদ্ধৃত ঘোষণাটির পরে পরে ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে পাক ফৌজিদের তাণ্ডবের খবর এসে পৌছতে লাগল ৩২ নং ধানমণ্ডিতে। তখন শেখ মুজিবুর রহমান আর একটি ঘোষণা লিখলেন :
Declaration of the war of Independence
Pak army suddenly attacked EPR base at Peelkhana, Rajarbag Police Line and killing citizens. Street battles are going on in every street of Dhaka and Chittagong. I appeal to the nations of the world for help. Our freedom fighters are gallantly fighting the enemy to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask the police, EPR, Bengal Regiment and the Answars to stand by you and fight. No compromise. Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots. May Allah bless you. Joi Bangla, Mujhbur Rahman.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তখন ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ভারতে নিযুক্ত সংবাদদাতা ডেভিড লোশাকের লেখা পাকিস্তান ক্রাইসিস গ্রন্থটিতে উল্লেখিত একটি ঘটনার বর্ণনা এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য, সেটি হল
“Soon after darkenss fell on March 25 (1971), the voice of Sheikh Mujhbur Rahaman came faintly through on a wavelength close to the official Pakistan radio. In what must have been and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh. He called on Bengalis to go underground tɔ reorganise and to attack the invaders.”
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত বারোটার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তার অব্যবহিত পরে ২৬ মার্চ ভোর রাত্রে ৩২ নং ধানমণ্ডির বাড়ির উপর মেশিনগান চালাতে চালাতে পাকিস্তান বাহিনী আসে এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে নিয়ে যায় করাচি, তারপর লায়ালপুর জেলার জেলে। লায়ালপুর পাকিস্তানের উষ্ণতম জেলা। সেখানকার জেলে তাকে রাখা হয় এক নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে এবং ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীনভাবে দুঃসহ গ্রীষ্মে ও উন্মাদ করা একাকিত্বে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পরে বঙ্গবন্ধুর সামনেই খোঁড়া হচ্ছিল তার কবর। ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে, বঙ্গবন্ধু সামরিক ব্যক্তিত্ব না হলেও সামরিক বিচারালয়ের রায়ে তার ফাঁসির আদেশও হয়ে গিয়েছিল। বাদ সেধেছিলেন ভুট্টো। তিনি ইয়াহিয়াকে বোঝালেন যে মুজিবকে ফাঁসি দিলে বাংলাদেশে আটকে পড়ে থাকা পাকিস্তানের কয়েক হাজার সৈন্যকেও মেরে ফেলবে, তা ছাড়া বাংলাদেশে নানা কাজের সুবাদে তখনও যেসব পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিক ছিলেন তাঁরাও হয়তো বাংলাদেশের জনগণের ক্রোধের শিকার হবেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন এবং তাঁকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে না পাঠিয়ে পাঠালেন ইংল্যান্ডে, লন্ডনে। লন্ডন থেকে তিনি দেশে ফেরেন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি, দেশে ফেরার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্বাগত জানান মুজিবকে এবং প্রত্যুত্তরে মুজিব মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান ভারতের জনগণকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত শুধু সামরিক সাহায্যই দেয়নি, প্রায় নব্বই লক্ষ শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় দেওয়া মানে শুধু ঘুমোবার জন্যে জায়গা দেওয়া নয়, খাদ্য, চিকিৎসা, জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা, পৌর ব্যবস্থা ও সাফাই ব্যবস্থা ইত্যাদিরও বন্দোবস্ত করা। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে পয়লা নম্বরে ছিল ত্রিপুরা। ত্রিপুরার রাজ্যবাসীর সংখ্যা যখন ১৫ লক্ষ ছিল তখন এই রাজ্য আশ্রয় দিয়েছিল ১৭ লক্ষ শরণার্থীকে। শুধু ত্রিপুরার রাজ্য সরকার নয়, রাজপরিবারও এই আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেও এমন পরিবার কমই ছিল যে পরিবারে কোনওনাকোনও অনাত্মীয় শরণার্থীকে আতিথ্য দেয়নি। সুতরাং ভারতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে উপকারীর উপকার স্বীকার করাটা ছিল নিতান্ত মানবিক ও স্বাভাবিক।
লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা ছুঁয়ে ঢাকায় ফেরার একমাস পরেই বঙ্গবন্ধু আবার কলকাতায় এলেন দু দেশের মধ্যে সরকারি কর্মসূচি নির্ধারণ করে। ওই কর্মসূচি অনুসারে ইন্দিরা গান্ধিও এলেন কলকাতায়। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হল এক ঐতিহাসিক বিশাল জনসভা। ইন্দিরা গান্ধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বললেন যে তিনি তঁর ‘দেশবাসীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহন করে এনেছি।’ তারপর কোন্ পটভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলাম যে ভুলে যেও না এ বাংলা তিতুমীরের বাংলা, ভুলে যেও না এ বাংলা সূর্য সেনের বাংলা, ভুলে যেও না এ বাংলা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বাংলা, ভুলে যেও না এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাংলা, ভুলে যেও না সোহরাবর্দির বাংলা।’ তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন যে বক্তৃতা দেওয়াটাকে তিনি একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারির বক্তৃতায় সেই শিল্পগুণ প্রকাশ করতে পারছেন কি না সে সম্বন্ধে তার মনে হয়তো সন্দেহ জেগেছিল। বোধহয় সেই সন্দেহ থেকেই বললেন, ‘বিশ্বাস করেন বক্তৃতা করা আমি সত্যি ভুলে গেছি। এই জন্য ভুলে গেছি, আমি জানতাম না যখন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে—আমার বাংলায় এত সর্বনাশ হয়েছে। এমন কোনও বাড়ি নাই, এমন কোনও সংসার নাই, যে সংসারে একটি-দুটি মানুষকে খুন করা হয় নাই।’ আটই ফেব্রুয়ারি ওই ভাষণের পরে পূর্ব নির্ধারিত সরকারি কর্মসূচির বাইরে বঙ্গবন্ধু দুটি কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন— কাজ দুটি হল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে পুস্পার্ঘ্য প্রদান। তিরিশের দশকের ভারতে সরকারি পর্যায়ে সুভাষচন্দ্র প্রধান দেশনায়ক। হয়তো নেতাজিই ছিলেন তাঁর আদর্শ বাঙালি। ফরিদপুরের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মুজিব যে সুভাষচন্দ্রের দর্শনপ্রার্থী ছিলেন, সে বৃত্তান্ত আগেই বর্ণনা করেছি। এবারে আরও যোগ করি যে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই ‘জয় বাংলা’ বলে যে মন্ত্র দেশবাসীকে দিয়েছিলেন তার প্রেরণা সম্ভবত ছিল নেতাজির দেওয়া ‘জয় হিন্দ’ মন্ত্র। মনে হয় বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন নেতাজির স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকেই স্বাধীনবাংলার ক্ষুদ্র পরিসরে বাস্তব রূপ দেওয়ার। প্রকৃতপক্ষে দুজনেরই দুই স্বপ্ন নিয়ে একটা স্বতন্ত্র গবেষণা কর্ম হতে পারে।
বাংলাদেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। কিছুদিন কার্যসিদ্ধিকর শাসন ব্যবস্থার পরে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে প্রবর্তন করা হল এক ধর্মনিরপেক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র। সেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলেন আর বিখ্যাত আইনজীবী ও বিচারপতি আবু সঈদ চৌধুরি হলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু নতুন সরকার কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদারতার নামে শিথিলতাকে প্রশয় দিল। যারা একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও শত্রুতা করেছিল, বুদ্ধিজীবীদের ও নিরীহ নাগরিকদের যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের সৎকারে বাধা দিয়ে পচা লাশের দূষণে বাংলাদেশের বাতাস বিষাক্ত করেছিল তাদের বিচার না করে শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে তাদের বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেন। আর এই সুযোগে তারা দেশবাসীর মনে এই বিষ ঢুকিয়ে দিতে তৎপর হল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান আত্মসমর্পণ করেছে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধানের কাছে যার তাৎপর্য হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতা বাস্তবে ভারতের কাছে পরাধীনতা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কাছে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ মানুষের হাতে চলে গিয়েছিল নতুন সরকার সেসব উদ্ধারের চেষ্টা না করার ফলে ঘরে ঘরে সেসব অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান ব্যক্তিরা জড়িয়ে পড়ে নানারকম অপরাধ কর্মে, সাধারণ মানুষের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ক্রমশ পরিণত হয় সশস্ত্র দুষ্কৃতী সম্প্রদায়ে, ফলে বাংলাদেশে দ্রুত ভেঙে পড়ে আইনের শাসন, তার জায়গায় কায়েম হয় আত্মঘাতী অরাজকতা। এই সরকারি শিথিলতার সুযোগে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বদলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পুনরুজ্জিবীত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে ধর্মীয় মৌলবাদী ও পাকিস্তানবাদীরা। অন্যদিকে ইসলামি রাষ্ট্রগুলি নানারকম কৌশল করতে লাগল বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রগোষ্ঠীভুক্ত করার জন্য। যখন ১৯৭৪এ একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপিত হচ্ছে তখন আকাশ থেকে ঢাকার মাটিতে নেমে এলেন সাতটি আরব রাষ্ট্রের সার্জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে চাইলেন লাহোরে ইসলামি রাষ্ট্রগোষ্ঠীর বৈঠকে। তিনি একটা সোজা শর্ত দিলেন— আগে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে পাকিস্তানকে, তারপর তিনি যাবেন ইসলামি রাষ্ট্রগুলির শীর্ষ বৈঠকে। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিচ্ছিল না বলে তাদের বন্ধু আমেরিকাও স্বীকৃতি দিচ্ছিল না। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বীকৃতির উপরে নির্ভর করছিল পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর শর্ত নিয়ে চারজন আরব চলে গেলেন লাহোরে, বাকি তিনজন ঢাকাতে থেকে গেলেন, সেদিনই স্বীকৃতি দিল পাকিস্তান আর সেদিন সন্ধ্যাতেই বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে থেকে যাওয়া তিন আরব কূটনীতিক লাহোরে রওনা হলেন। অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে স্বীকৃতি তো আসতে লাগলই আর সেই সঙ্গে, ঘটল রাষ্ট্রসংঘের সদস্যপদ লাভ এবং সেই সুবাদেই ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিলেন রাষ্ট্রসংঘের পূর্ণ অধিবেশনে।
রাষ্ট্রসংঘে তথা বিশ্বসভায় বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল বটে কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রজতন্ত্র ও ইনশাসিত শান্তিশৃঙ্খলার প্রতি প্রত্যাখান ও বিদ্রুপ। দেশবাসীর বেপরোয়া কাজকর্ম দেখে ক্ষুব্ধ বিরক্ত মুজিবুর এক একবার প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে গ্রামে গ্রামে আপন আদর্শের সমাজ নতুন করে গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজন করার কথা ভেবেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়লেন বটে, কিন্তু গ্রামের দিকে গেলেন না, ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধান বদল করে হয়ে বসলেন রাষ্ট্রপতি, প্রবর্তন করলেন পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বদলে প্রেসিডেনশিয়াল ডেমোক্রেসি, বহুদলীয় শাসনের বদলে একদলীয় শাসন, তার জন্য।
একটি নতুন দল গঠন করা হল, দলটির নাম বাংলাদেশ আওয়ামি কৃষক শ্রমিক লিগ অথবা ছোট করে বাকশাল। জনপ্রিয় নেতা হলেন জবরদস্ত শাসক। কিন্তু তাতে শত্রুদের নিষ্ক্রিয় করা গেল না। শত্রুদের সঙ্গে যোগ দিল শঙ্কিতরা। জমির মালিকরা সংশোধিত সংবিধানের মধ্যে সোভিয়েট রাশিয়ার আদর্শ অনুকরণে অর্থাৎ কৃষি ও ভূমি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সমবায় গঠনের প্রস্তুতি দেখে শঙ্কিত হল। সংবাদপত্রগুলি ক্ষুব্ধ হল বাকস্বাধীনতার উপরে সরকারি শাসনে। এদিকে মুজিবুর নিজে সরকারি কর্মচারীদের, কাছের মানুষদের ও সহচরদের আনুগত্য সম্বন্ধে এবং তার প্রতি জাতির আস্থা ও শুভেচ্ছার বিষয়ে বিশ্বাসে অন্ধ, তাই স্বভাবতই নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা আর সুরক্ষা সম্বন্ধে ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন ও নির্বিকার। শোনা যায় ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তাকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু কোনও বাঙালি তাকে ব্যক্তিরূপে আক্রমণ বা হত্যা করতে পারে তা ছিল তার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য। ফলে অতিরিক্ত আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার জন্য তাকে ও তার পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট।।
যিনি ১৯৭১-এ লিখেছিলেন, ‘হবে হবে জয় জয় মুজিবুর রহমান’ তিনি ১৯৭৫এ লিখলেন—নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো করে যদি যারা তাঁর। পুত্রসম বিশ্বাসভাজন জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরই নিধন। নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কোনও সদ্যোজাত জাতির কোনও কুসন্তান তার সন্তানস্নেহে অন্ধ জনককে এভাবে সপরিবারে হত্যা করেনি। স্বাধীন বাঙালি জাতি বলে কোনও জাতির অস্তিত্ব ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগে ছিল না। এই জাতির জন্ম হয় ২৬ মার্চ এবং এর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।