আমরা প্রচলিত ইতিহাস পাঠান্তে একথা জানি, স্বাধীনতা এনে ফল আর বিজয় মাল্য ও পুরস্কারে পূর্ণ অধিকার যেন কংগ্রেস কর্মীদেরই। তাই আমরা প্রচলিত মতে মহাত্মা গান্ধী অর্থাৎ গান্ধীজিকে জাতির জনক বলে আসছি। আর মতিলাল, জওহরলাল, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল প্রমুখ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নেতাদের আর ঐ নেতাদের পথ দেখিয়েছেন যারা সেই রামমােহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, হেয়ার, তিলক, আবদুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমাদ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আসছি। কিন্তু বর্তমান ইতিহাস বিজ্ঞানীরা এগুলি কিছু স্বীকার কিছু কিছু অস্বীকার আর চাপা দেওয়া তথ্যকে তুলে ধরে পুরাতন কঠিন বিশ্বাস বুহ্যকে বাতিল করে নূতন-পুরাতন ধারণার সংমিশ্রণে মিলিত একটা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চান, যেগুলি আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে ও প্রবন্ধে নাতিদীর্ঘাকারেই তুলে ধরছি।
পলাশী যুদ্ধের পর হতে বহু আন্দোলনে মুসলমান প্রজাবৃন্দ বারে বারে ইংরেজকে যারপরনাই ভাবিয়ে তােলে। তাই তারা মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে একদিকে প্রয়ােগ করল সরকারি ব্যবস্থায় ফারসী ভাষাকে সরিয়ে ইংরাজির ‘প্রবর্তন’ অপর দিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ চক্রান্ত। তেমনিভাবে ইংরেজ হিন্দু ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিদের ও কিছু মুসলমানদের নিয়ে শােষণের হাতিয়ার হিসেবে কংগ্রেস পার্টির জন্ম দেয়। ১৮৮৫ সালে ইংরেজ নেতা মিঃ হিউম ছিলেন এর উদোক্তা।
ঐতিহাসিক সত্যেন সেন লিখেছেন,
“ওহাবী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ প্রভৃতির সঙ্গে যে জাতীয় চেতনা ক্রমশ সংঘবদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল তাহা ব্যর্থ করিয়া দেয়ার জন্য শাসনগত ব্যাপারে ভারতে একশ্রেণীর লােকের সহযােগিতা লাভই এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছিল। শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি। এই সময়ে উচ্চ পদস্থ ইংরেজ কর্মচারীগণ কংগ্রেসের অধিবেশনে যােগদান করিতেন। তখনকার দিনের উচ্চ শিক্ষিত ও পদ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ বিশেষ করিয়া ইংরাজি ভাষার মারফত পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সহিত যাহারা ঘনিষ্ঠ সংযােগ স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন তাঁহারাই কংগ্রেসের কর্ণধার ছিলেন। ইহাদের মধ্যে রমেশচন্দ্র দত্ত, স্যার ফিরােজ শাহ মেটা, আনন্দমােহন বসু, দাদা ভাই নৌরােজী, রানাড়ে, স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। বাংলার রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহারাষ্ট্রের গােপাল রাও প্রমুখ মনীষী নব আলােক আন্দোলন প্রবর্তিত করে……………ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করিতে চাহিয়াছিলেন। [দ্রঃ ‘পনেরই আগষ্ট’, সত্যেন সেন পৃঃ ৯৮]
ঐ কংগ্রেস নামে মাত্র জাতীয় কংগ্রেস হলেও জনসাধারণের প্রতিনিধি ছিল। এক কথায় জনসাধারণের সাথে সম্বন্ধবিহীন এক রাজনৈতিক দল। এ কথা উক্ত দলের সদস্য স্যার ফিরােজ শাহ মেটা নিজ মুখে স্বীকার করেছিলেন,
“The Congress was indeed not the voice of the masses.”
অর্থাৎ কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের মুখপাত্র ছিল না। [দ্রঃ পনেরই আগষ্ট, পৃঃ ৯৯]
ঐ কংগেসেরই মধ্যে আবার একটি দল নিজেদের খাঁটি হিন্দু জাতীয়তাবাদীরূপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এঁরা হচ্ছেন,
“মহারাষ্ট্রের গঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায় এবং বাংলার অরবিন্দ ঘােষ ও বিপিন চন্দ্র পাল। ইহারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী অথবা গোড়া জাতীয়তাবাদীপে অভিহিত করিলেন।” [দ্রষ্টব্য পনেরই আগষ্ট, পৃঃ ৯৯]।
এরা লক্ষ্য করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমান জাতি প্রায় একাই লড়াই করে যাচ্ছে এবং এও বুঝতে পারলেন যে ইংরেজরা বেশ ব্রিতবােধ করছে এবং আমাদের দালাল শ্রেণীতে মর্যাদা দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চায়। এঁরা আরও লক্ষ্য করেছিলেন মুসলমানদের সংগ্রাম শুধু ইংরেজ বিতাড়নের উদ্দেশ্যে হলেও সেই সঙ্গে নিজেদের ধরে পুরাতন ধারাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে তারা সমানভাবে সচেষ্ট। অপরদিকে হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় নাস্তিক বা খৃষ্টান হয়েছে, হচ্ছে বা হতে চলেছে, ফলে মুসলমান যখন একাই স্বাধীনতা নিয়ে আসবে তখন হিন্দু জাতির অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। তাই এরাও হিন্দু ধর্মের পুরাতন সব নিয়মনীতিকে আবার পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিতে বদ্ধ পরিকর হলেন। ফলে তখন স্বাভাবিকভাবেই এঁদের সংগ্রামে সাম্প্রদায়িকতা মিশ্রিত হয়। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, এই চরমপন্থী ও নরমপন্থীর বিভাজন চতুর ইংরেজেরই সুদক্ষ ইঙ্গিতে।
সে যাইহােক, আপাতত চরমপন্থী দলের উদ্দেশ্য ও কাজে প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগলাে যে তারা পুরােপুরি মুসলমানবিরােধী দল। অতএব তাদের কার্যকলাপে দলে দলে সহজে জাতীয় কংগ্রেসে মুসলমানদের যােগ দেওয়া নিঃসন্দেহে সম্ভব ছিল না। হিন্দু ধর্ম ধর্মের অনেক কুসংস্কার ও কুৎসিত প্রথাকে বর্জন করে যেমন উন্নত হতে শুরু করেছিল যথা বর্ণাশ্রমের কারণে অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, সীমাহীন প্রাত্যহিক পূজাপার্বণ প্রভৃতি। এই নতুন দলটি সমস্ত কিছু আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে ফলে সহজেই প্রাচীন সংস্কারপন্থী হিন্দুরা ঐ দলকে গ্রহণযােগ্য বলে মনে করেন। সত্যেন সেন মহাশয় লিখেছেন,
“বাল গঙ্গাধর তিলক এই সনাতনপন্থীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে বালিকাদের বিবাহের বয়স দশ হইতে বারাে বছর করার উদ্দেশ্যে আনিত একটি বিলের বিরুদ্ধে তিলক প্রবল আন্দোলন শুরু করিয়া দিলেন। রানাডে প্রমুখ উদারপন্থীগণ এই বিলের সমর্থক ছিলেন। অতঃপর তিলক গােহত্যা নিবারণের উদ্দেশ্যে ‘গাে রক্ষা সােসাইটি’ নামে একটি সমিতি সংগঠন করিলেন। এতদ্বতীত শিবাজী উৎসব, হস্তী মুখাে দেবতা গণেশ প্রভৃতির পুজাও মহা সমারােহে অনুষ্ঠিত হইতে লাগিলাে। বাংলাদেশে শুরু হইল ধ্বংসের দেবতা কালী সাধনা।” “তথাপি হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপরে অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করিবার ফলে জাতীয় আন্দোলনের গতিধারা সম্মুখ গতি অবলম্বন না করিয়া পশ্চাদগামী হইয়া পড়িল। কারণ গাে হত্যা নিবারণ, দেব দেবীর পূজা প্রভৃতি ধর্মানুষ্ঠান কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মসূচি বলে অপরাপর ধর্ম সম্প্রদায় সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রীতির চক্ষে দেখিবে ইহা আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। বলা বাহুল্য, এই গোঁড়া হিন্দু মনােভাবই শেষ পর্যন্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে জাতীয় আন্দোলন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়।” [দ্রঃ পনেরই আগষ্ট, পৃঃ ১০০-১০১]
প্রচলিত স্বাধীনতার ইতিহাসে দেখা যায় মুসলমানগণ সামগ্রিকভাবে যেন হিন্দুদের সঙ্গে যােগ না দিয়ে ইংরেজদের পক্ষই অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু আসল ইতিহাস তা নয়, বরং মুসলমান জাতি প্রথম হতে শেষের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অনাহার আর অত্যাচারকে সানন্দে বরণ করে নিয়ে লড়তে লড়তে মৃত্যুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তখন তারা শত চেষ্টা করেও যােগ দেওয়াতে পারেনি সামগ্রিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে। ভারতের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মত পােষণ করে চলেছে সেই বৃহত্তর সম্প্রদায় আর নানা পত্রপত্রিকায় গদ্য ও পদ্যে মুসলমান বিপ্লবীদের বিপ্লবকে বিদ্রুপ ও উপেক্ষা করা হয়েছে। তথাপিও মুসলমান বিপ্লবী দল চালিয়ে গেছেন তাদের বিপ্লবের চলন্ত ধারা। ১৯০৬ সালে দাদা ভাই নৌরােজী চরমপন্থীদের নিয়ে কলকাতায় কংগ্রেসে সর্ব প্রথমে স্বাধীনতার পরিবর্তে স্বরাজের দাবি করা হয়। স্বাধীনতা আর স্বরাজ এক নয়। স্বরাজ হচ্ছে নিজেদের দাবি দাওয়া ইংরেজের কাছ হতে আদায় করা আর স্বাধীনতা হচ্ছে ইংরেজকে তাড়িয়ে নিজেরা ইচ্ছামতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। যাইহােক মুসলমান বিদ্বেষী এই দলের নীতির সঙ্গে মুসলমানগণ হাত মেলানাের পরিবর্তে স্বভাবতই বিরােধিতা করেছিলেন। [দ্রঃ সত্যেন সেনের রচনা]
স্বাধীনতা বিপ্লবী মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস তথা হিন্দ জনতার নেতার ভূমিকায় কাজ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী প্রকৃতপক্ষে সরল, সহজ ও সৎলােক ছিলেন। তাঁর শ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা নিশ্চয়ই একটা বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে যে বৈশিষ্ট্যের গুণেই দেশবাসী তাঁকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অবশ্য আধুনিক ইতিহাসবিদরা যারা গান্ধীজিকে দেশ বিভাগের জন্য দায়ী করেন তাঁরা তাকে একটা রাজনৈতিক ভ্রান্ত পথিক মনে করে জাতির জনক বলে একবাক্যে স্বীকার করে নিতে দ্বিধা করেন। তাদের এই দ্বিধা যুক্তির মানদণ্ড কতখানি গ্রহণযােগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত বা কিসের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা গান্ধীর ওপর অনাস্থা রাখেন তাই ধারাবাহিকরূপে তুলে ধরা হচ্ছে।
মুসলমান জাতির নায়ক হিসেবে তখন কয়েকজন আলেম এই মনে করলেন যে, যে মুসলিম জাতি যুগ যুগ ধরে ইংরেজের সাথে সংগ্রাম করে তাদের শক্তি, সামর্থ্য ও আশা-ভরসা নিঃশেষ করে এনেছে এই মুহূর্তে হিন্দুদের সাথে তাদের রাগ বা দুঃখ করে সরে দাঁড়ালে মুসলিম জাতির আসল ইতিহাস পাল্টে যাবে। বিশেষ করে মাওলানা মহম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী এই দুই ভায়ের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা গান্ধীজির সঙ্গে বিশেষ এক গােপন বৈঠকে পরামর্শ করে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা প্রস্তাব করেন। তাতে সুফল ফলেছিল। দুই দল আপাতত এক হয়, একটি কংগ্রেস অপরটি খিলাফত কমিটি। খিলাফত নাম আরবী। আরবীয় চিন্তাধারা নামেই বােঝা যায়।
১৯২১ খৃষ্টাব্দে আহমদাবাদে কংগ্রেসের মিটিং-এ খেলাফত নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের ইংরেজ তােষণ, আংশিক স্বাধীনতা, স্বরাজ প্রভৃতি কথার উচ্ছেদ করে মাওলানা হসরত মােহানী পূর্ণ স্বধীনতার দাবি করেন। এটি খুবই উল্লেখযােগ্য এবং অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল এই যে, ভারতে কংগ্রেসের সভায় স্বাধীনতার দাবি এই সর্বপ্রথম সেদিন মুসলমান খিলাফত কমিটির কথায় প্রায় সকলেই যখন চুপচাপ ভাবছিলেন তখন মহাত্মা গান্ধী মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন,
“……..The demand has grived me because it shows lack of responsibility.”
অর্থাৎ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আমাকে বেদনা দিয়েছে। কারণ প্রস্তাবটি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।”
মহাত্মা গান্ধী লােক হিসেবে ভাল হলেও তিনি নেতা হিসেবে একেবারেই অনুপযুক্ত বলে অনেকের ধারণা। তার সন্ন্যাসীর মন রাজনীতির সূক্ষ্ম স্তর উপলব্ধির উপযুক্ত ছিল না। তাই তাঁর মতের কোন দৃঢ়তা ছিল না এবং কোন কথা বললে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আঁচ করতে পারতেন না। অনেকের মতে তার ভুল ভ্রান্তিই দেশ বিভাগের প্রধান কারণ। ১৯২২ সালে পুনরায় লাক্ষ্ণৌতে খিলাফত কমিটি ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ স্বরাজের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে-
“The best interests of India and the Moslems demand that in the Congress creed the term ‘Swaraj’ be substitude hence forth by the term Complete independence”.
অর্থাৎ ভারতবর্ষ এবং মুসলমানদের স্বার্থের খাতিরে এখন হইতে কংগ্রেসের মূলমন্ত্র ‘স্বরাজের’ পরিবর্তে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ হওয়া উচিত।”
এবারও কংগ্রেস মুসলমান সৃষ্ট প্রস্তাব সমর্থন না করে প্রকাশ করে “এতদ্বারা কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের আমূল পরিবর্তন হইবে।” [দ্রঃ পনেরই আগষ্ট, সত্যেন সেন, পৃঃ ১০৬] কিন্তু তবুও হিন্দু-মুসলমানে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়নি। ঐ অবস্থায় ইংরেজ হিন্দু-মুসলমানের আকস্মিক মিলনে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। হঠাৎ গান্ধীজি ঐ ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খিলাফত আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন। গান্ধীজির নিজস্ব মতের কোন স্থায়িত্ব ছিল না, যে পক্ষ যা বােঝাতেন তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাই সঠিক মনে করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এর পর এক কারণ এই যে, তিনি ছিলেন খুব সরল ও সিধা মানুষ।
যখন তিনি মুসলমানদের বিপ্লবী চিন্তাধারা, সারা বিশে তাদের প্রভাব, প্রচারসংখ্যা প্রভৃতি লক্ষ করতেন তখন মুসলিম ও কুরআন-হাদীসের পক্ষে অনেক বড় বড় কথা বলতেন যা মানুষকে চমক লাগাতো। ফলে গোঁড়া হিন্দুর দল তখন রেগে তাঁর সমালােচনা করতাে তখন তিনি আবার এমন মত করতেন যে, স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি অবাক না হয়ে পারতাে না। গান্ধীজির উদারনীতি মুসলমানদের এবং উদারপন্থী হিন্দুদের মনে এক আশার আলাে জ্বালিয়ে তােলে। কিন্তু ১৯২৫ সালে লালা লাজপৎ রায়ের সভাপতিত্বে বাল গঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘােষ প্রমুখ মুসলমানবিদ্বেষী নেতারা হিন্দু মহাসভা গঠন করলেন। এদিকে মহাত্মা গান্ধী -কে মুসলমানের দালাল ইত্যাদি উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয় তখন মহাত্মা গান্ধী দেখলেন যে মুসলমানরা তাে আমাকে হিন্দু বলেই জানেন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় যদি আমাকে অহিন্দু বলে মনে করে তাহলে আমার নেতা হয়ে প্রশংসা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই ১৯২১-২২ সালে যখন তিনি আন্দোলনের পুরােভাগে ভারতের অবিসংবাদিত নেতারূপে সুপ্রতিষ্ঠিত; যখন খিলাফত কমিটির সহযােগিতায় হিন্দু-মুসলমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংহত ও সক্রিয় তখন তিনি গোঁড়া হিন্দুদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করলেন,
“I call myself a Santanist Hindoo because (a) I believe in the vedas, the upanishad, the puranas and all the gose by the name Hindoo Seriphires and therefore in avatars and rebirth; (b) I believe in the Varnasram Dharma, in a sense in my opinion strictly vedic, but not in its present, popular and crude sense; (c) I believe in the protection of the cow in its much larger sense than the popular. (d) I do not disbelieve in idol warship.” [Young India oct, 12, 1921]
অর্থাৎ “আমি নিজেকে প্রাচীনপন্থী সনাতনী হিন্দু বলি যেহেতু (ক) আমি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্র মতে যাহা কিছু বােঝায় সুতরাং অবতার বাদ এবং পুনর্জন্ম বিশ্বাস করি। (খ) বেদের বিধান সম্মত বর্ণাশ্রম ধর্ম আমি বিশ্বাস করি অবশ্য প্রচলিত ব্যবস্থায় আমার আস্থা নেই। (গ) প্রচলিত অর্থে নয় বৃহত্তর অর্থে আমি গােরক্ষানীতি সমর্থন করি। (ঘ) মূর্তি পূজা আমি অবিশ্বাস করি না।”
মহাত্মা গান্ধী অর্থাৎ গান্ধীজির উপর যাঁদের ধারণা ছিল তিনি হিন্দু মুসলমানের মিলনের মিলন সেতু, তাঁদের ঐ ধারণা উপরােক্ত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বদলে যেতে বাধ্য হয়। হিন্দু মহা সভাও তার দুর্বলতা লক্ষ্য করে তার ওপর নূতন আশা আকাঙ্ক্ষা পােষণ করতে থাকে। তাই স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামী সত্যেন সেন বলেন যে,
“ইতিহাসের ইতিহাস ব্রিটিশ সরকারগণ আন্দোলন দমন করিবার জন্য সাম্প্রদায়িক ভেদ বৈষম্যের সুযােগ লইয়াছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই বেদনীতির অন্ত্রকে তিলক ও গান্ধীবাদ তীক্ষ্ণ ধার করিয়াছে তাহাও নিঃসন্দেহ।” [পনেরই আগষ্ট, পৃঃ ১০৯]
এরপর হতেই এক দলের ইঙ্গিতে গান্ধীজির কণ্ঠে ও কর্মে প্রকাশ হতে লাগলাে আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আনুগত্য। এমনকি কোন প্রকার প্রতিবাদ করার উপায়ও বন্ধ হয়ে যায়। “যাহারা ইহার প্রতিবাদ করেন তাহাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বিত হইতে থাকে। এই সম্পর্কে গান্ধীজির মত উল্লেখযােগ্য Those who are insede the Congress, must remain silent and those who will not must go out” [দ্রঃ ঐ পুস্তক, পৃঃ ১০৯, ১ম মুদ্রণ] অর্থাৎ যারা কংগ্রেসের ভেতরে আছেন তারা অবশ্যই মৌনতা অবলম্বন করলেন আর যাঁরা এটা পারবেন না তারা বাইরেই থাকবেন।
মুসলমান বিপ্লবীদের মধ্যে একজন বিচক্ষণ আলেম অনেক দিন হতে চিন্তা করছিলেন যে, কী উপায়ে সৈন্যদের খেপানাে যায়, কী উপায়ে সরকারের শয়তানীর স্বরূপ তাদের কাছে পৌছানাে যায়। যারা ঐ মারাত্মক এবং দুঃসাহসিক কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা হুসাইন আহমাদ (রহ), মাওলানা মহম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় নৌবাহিনী কতৃর্ক বােম্বেকে কেন্দ্র করে মাদ্রাজ ও করাচীতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। ১৯ ফেব্রুয়ারি তলােয়ায় ট্রেনিং স্কুল (বােম্বে) হতে শুরু করে হিন্দু-মুসলমান বিশ হাজার নাবিক ইংরেজের পতাকা নামিয়ে হিন্দু-মুসলমান তথা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করে সারা ভারতে ইংরেজ জাতিকে হতভম্ব করে তােলে এবং মনে করিয়ে দেয় ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের মহা বিপ্লবের আগ্নেয়গীরণের চিত্র। সমগ্র ভারতে যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা খুশির পরশে প্রতীক্ষা করছিলেন ইংরেজের পরাজয় পর্ব অবলােকন করার।
এই নাবিক দলের বিদ্রোহের পূর্বে তাঁদের অভাব-অভিযােগ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দরবারে পৃথকভাবে জানানাে হয়েছিল কিন্তু কোন দল সাধ্য করেনি। তবু তাঁরা নিজেরাই কমিটি গঠন করে এই ধর্মঘট পালন করে। ইংরেজ সরকার বন্দুকের নল দিয়েই ঘুম পাড়াতে চেয়েছিল ঐ বিশ হাজার নৌসেনা এবং তাঁদের সমর্থক হাজার হাজার ভারতবাসীকে। ভারতীয় পদাতিক সৈন্য বাহিনী ইংরেজকে জানিয়ে দিল ভারতীয় হয়ে ভারতবাসীর বুকে গুলি করা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। অগত্যা ব্রিটিশ বাহিনীকে নিয়েই তখন ঝাঁপ মারতে হয় ইংরেজকে। ২১ ফেব্রুয়ারি ক্যাসেল ব্যারাকের বাইরে প্রবল সংগ্রাম শুরু হল।
মিঃ গড ফ্রে ঘােষণা করলেন যদি ভারতবাসী নিরস্ত্র না হয় তাহলে নৌশক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেলেও ইংরেজ শক্তি দিয়ে বিদ্রোহ দমন করবার জন্য সরকার প্রস্তুত। এই সময়ে লীগ ও কংগ্রেস কেউ যােগ দেয়নি, “উপরন্তু কংগ্রেসের পক্ষ হতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ধর্মঘট ও হরতাল পালন করবার জন্য জনসাধারণের নিকট এক পাল্টা নির্দেশ জারি করিলেন।” [ঐ পুস্তক দ্রঃ]। অবশ্য সাধারণ মানুষের গান্ধীজির অহিংসনীতি অবলম্বনের পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ ব্যবস্থা, কিন্তু আসল কথা তা নয়। কংগ্রেস হিংসা ও অহিংসাকে বরাবরই সুবিধা অনুযায়ী গ্রহণ ও বর্জন করিয়া আসিয়াছে।” অবশ্য লীগ ও কংগ্রেস ধর্মঘটীদের আত্মসমর্পণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিল, যাতে আর তাদের ওপর গুলি না চলে বা তাদের সাজা-শাস্তি না হয় তার ব্যবস্থা করা হবে।
এখানে বেশ প্রমাণ হয়, কংগ্রেস ও লীগ আসলে জনগণের কল্যাণে নিয়ােজিত ছিল না বরং গদি ও ক্ষমতার লড়াইয়ে জেতাই তাদের টার্গেট ছিল। এমনকি কংগ্রেস ও লীগ যে সেনাপতি ঐ দল ও সমর্থকদের ধ্বংস করতে সাবধান বাণী করেছিলেন তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি। উপরন্তু কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেল বলেন,
“নৌ-ধর্মঘটীদের অস্ত্র ধারণ করা উচিত হয়নি। এমনকি নৌ-বাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে প্রধান সেনাপতির অভিমতকে অভ্যর্থনা করিলেন।” [১৫ আগষ্ট, পৃঃ ৪২]
আজাদকেও প্যাটেলের নীতি সমর্থন করতে হয়েছিল। তিনিও প্রতিবাদ করা প্রয়ােজন মনে করেননি। হয়তােবা গদিতন্ত্রের কারণ হতে পারে।
মহাত্মা তার স্বভাবসিদ্ধ সুরে ১৯৪৬ সালে ৭ এপ্রিল ‘হরিজন’ পত্রিকায় মন্তব্য করলেন,
“I Migiht have understood it if they had combined from top to bottom, that would of course have meant delivering India over to the rabbe. I would not want ot live up to 125 to witness that consummation, I would ratther berish in the flamws.”
অর্থাৎ আমি এটা উপলব্ধি করতে পারতাম যদি তারা সমগ্র দেশকেই দলে টানতে পারত। উশৃঙ্খল জনতার হস্তেই ভারতের সমর্পণ বুঝাত। ১২৫ বছর বেঁচে থেকে সেই পরিণতি দেখার ইচ্ছা আমার নেই। তারচেয়ে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেওয়াই শ্রেয়। এক কথায় গণঅভ্যুত্থানকে অভিহিত করা হল, “উশৃঙ্খল জনতার উদ্ধত আচরণরূপে।” [দ্রঃ ১৫ আগষ্ট পূঃ ৪৩]
সবচেয়ে বােঝার বিষয় এই যে, ইংরেজের ক্ষতি হলে গান্ধীজির অহিংসনীতি যেমন গর্জে উঠতাে ভারতবাসীর ওপর ইংরেজদের অত্যাচারের ক্ষেত্রে তার ঐ নীতি তুলনামূলকভাবে গর্জে উঠতাে না। দেশ এখন চায় ইংরেজ রাজ তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাক। কিন্তু দয়ালু নেতারা ইংরেজের ওপর বড় মমতা রাখতেন আই এ, আই, সি, সির বােম্বাই অধিবেশনে ৭ জুলাই দেশবাসীকে উগ্রতা ত্যাগ করে শান্ত হওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করলেন,
“ইংরেজরা ভারত ছাড়িবার জন্য নিজেরাই খুব ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের শান্তিতেই যাইতে দেওয়া উচিত, আন্দোলন করিয়া তাহাদের যাইবার পথে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়।”
ঐ সময় কংগ্রেসের মহামান্য সভ্য ও সমর্থকদের মধ্যে মিঃ রাজা গােপালাচারী ছাব্বিশে নভেম্বর স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উদেশ্যে জামসেদপুর অধিবেশনে বােঝাতে চাইলেন ইংরেজের রাজত্বে কোন অসুবিধা নেই। সুতরাং স্বাধীনতার বিপক্ষে তিনি বললেন,
“আমরা তাে ইতিমধ্যেই স্বাধীন হইয়া গিয়াছি। ……..একদল রােগী আছে, যাহারা আরােগ্য লাভ ফলিয়া মনে করে অসুখ সারে নাই এবং তদনুযায়ী ঔষধ সেবন করিতে থাকে।” (এ ঐ পুস্তক) মীরাটের কংগ্রেস অধিবেশনে মিঃ প্যাটেল বলেন, “ইংরেজের সঙ্গে সংগ্রামের আর প্রয়ােজন নাই। তাহারা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেবে বলিয়া স্থির করিয়াছে।” (দ্রঃ ঐ পুস্তুক পৃঃ ৫৮-৫৯)।
এদিকে কলকাতা, নােয়াখালী প্রভৃতি স্থানে হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা এমনভাবে আরম্ভ হলাে, যা পশুত্ব অপেক্ষা ঘৃণ্য। আচার্য নরেন্দ্র দেব মীরাট অধিবেশনে বললেন, “বর্তমান দাঙ্গা কংগ্রেস ও লীগের সংগ্রাম।” ২৪ এপ্রিল নয়া দিল্লীতে মুসলীম লীগের সর্বময় কর্তা মিঃ জিন্নাহ বললেন,
As a result of my talk, I feal that the viceroy is determined to play fair.”
অর্থাৎ আলাপ আলােচনার ফলে আমি বুঝিয়াছি যে, বড়লাট ন্যায়পরায়ণতার সহিতই কাজ করিবেন। [দ্রঃ পনেরই আগষ্ট]
নানা তথ্যের উপর গবেষণা করলে বলা যায় কংগ্রেস যেন ধনী ও চোরাকারবারিদের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ছিল। ভারতে কোটি কোটি অভাবী মানুষ যখন মােটা ভাত আর সামান্য একটুকরাে কাপড়ই বড় বলে জানে তখন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজেদের মধ্যে লড়াই, ইংরেজদের তােষণ, অনুরােধ আর আবেদনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখর। তাই কংগ্রেসের মধ্যে কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নিরপেক্ষ কর্মী কংগ্রেস ভেঙে ফেলার ইচ্ছা পােষণ করেন। এ উক্তির যথার্থতা প্রমাণে কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি শংকর রাও দেও-এর করেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘঘাষণাই যথেষ্ট। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন,
“And yet there were Congressmen who were not only thinking in terms of dissolution of the congress, but were openly advocating it. They thought that either the Congress had no usful role to play or that even it had, it would not be in a position to do so in the future. For, they asserted that the Congress, even if it had not passed into the hands of the capitalists and blackmarketers, was being dominated by them.”
অর্থাৎ অনেক কংগ্রেসসেবীই কংগ্রেসকে ভেঙে দেয়ার কথা বলিতেছেন। তাঁহাদের মতে এই প্রতিষ্ঠানটি ধনিক শ্রেণী ও চোরাবাজারিদের পুরােপুরি কবলস্থ না হইলেও তাহাদের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত।
ভারতীয় কংগ্রেসের সংগ্রাম সম্পর্কে ডাঃ পট্টভী সিতারামিয়া স্পষ্টই বলেছেন,
“The fight of Congressis is the fight of the Indian capitalist against the British capitalist.”
অর্থাৎ কংগ্রেসের সংগ্রাম ব্রিটিশ ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ভারতীয় ধনিক শ্রেণীর সংগ্রাম।
তবুও কংগ্রেসের শ্রেষ্ঠ নেতা গান্ধীজির মতামত অন্তত স্বতন্ত্র হতে পারতাে কিন্তু তাও নয়। যখন সােদপুরে মহাত্মা গান্ধী -কে কংগ্রেসের সঙ্গে ধনিক শ্রেণীর সম্পর্কের স্বরূপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয় তাতে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে হতভম্বই হতে হয়। তিনি বলেন,
“My relation with the capitalist is the relation of Congress with the capitalist.”
অর্থাৎ আমার সঙ্গে ধনকুবেরদের যে সম্পর্ক, কংগ্রেসের সঙ্গে ধনীদের সেই সম্পর্ক। [উপরোক্ত তথ্যগুলাে মিঃ সেনের লেখা ঐ পুস্তকের ১৬১-১৬৩ পৃঃ দ্রঃ]
আগেই বলা হয়েছে যে, মহাত্মা গান্ধী কী কথা বললে কী পরিমাণ ফল দাঁড়াবে তা অনেক ক্ষেত্রে আঁচ করতে পারতেন না। গান্ধীজির কাজকর্ম তার কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তদানীন্তন বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা “হিন্দুস্থান টাইমস”-এর সম্পাদক ছিলেন দেবীদাস গান্ধী, যিনি গান্ধীজিরই পুত্র। আর লক্ষণীয় বিষয়টি এই যে, পত্রিকাটির মালিক ছিলেন তাঁদের পরম প্রিয় ধনকুবের মিঃ জি ডি বিড়লা। কংগ্রেসের সম্বন্ধে আলােচনার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগকেও বােঝা কঠিন নয়, কারণ আজ যারা মুসলিম লীগে গতকাল তারাই ছিলেন বেশির ভাগ কংগ্রেসেরই হাতের পুতুল বা দলের দালাল। আর একথা তাে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, গান্ধীজির অহিংসনীতি একটা পলিসি মাত্র, যা সুবিধামত প্রয়ােগ করা হতো। যুদ্ধে কাটাকাটি-মারামারি যদি অহিংসনীতির বিরুদ্ধেই হয় তাহলে কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের সময় তিনি ঐ নীতি প্রয়ােগ করেননি কেন? পরন্তু বিপরীত মন্তব্য করেছিলেন। যেমন, ২৯ অক্টোবর তিনি তার প্রার্থনা সভায় বলেছিলেন,
“শ্রীনগরে ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট সৈন্য প্রেরণ করা সমীচীন হইয়াছে।”
অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি জাপানীদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে জুলাই মাসের এক বক্তব্যে গান্ধীজির যে মর্মবেদনা ব্যক্ত হয়েছিল তার সাথে কাশ্মীর সম্পর্কিত বিবৃতির কোথাও কোন সামঞ্জস্য বিহিত হয়নি। শুধু তাই নয়, তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ইউনিয়নযুদ্ধ ঘোষণার যৌক্তিকতাও স্বীকার করেছেন।” [১৫ আগষ্ট, পৃঃ ১৬৫ দ্রঃ]
এক কথায় কংগ্রেস ও লীগ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে সত্যি কিন্তু সে লড়াই ইংরেজদের সঙ্গে নয়, লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের লড়াই, হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই। ইংরেজ তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে যাতে কোনরকম অসুবিধা না হয়, তার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি বিলেতি পিস্তল, বন্দুক, গােলা-বারুদ হিন্দু ও মুসলমানদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। পয়লা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন রুয়েদাদ ঘােষিত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন পূর্বে লন্ডনের বিখ্যাত রেগুস নিউজ পত্রিকায় ভারতের বােম্বাইস্থ সংবাদদাতা মিঃ আর্নেস্ট সাটি যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তা ঐ রূপ-
Enough arms and annunitions to equip more than a millionmen have been smuggled into India in the last few years. The arms range from pistol to tommy-guns. It is said that the muslini Leagur have weapons for half a million and Congress. the Hindoo organision, has about the Many Hindus and Muslim are reliably reported to be organizing their own private defence groups, turning their houses into strong points, and preparing for a prolonged stuggle if necessary, by laying in stoods of food.”
অর্থাৎ গত কয়েক বছরে দশ লক্ষ লােককে সুসজ্জিত করার মত পিস্তল ও টমি বন্দুক ভারতবর্ষে গােপনে আমদানি করা হয়েছে। প্রকাশ যে, মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উভয়েই যথাক্রমে এর অর্ধেকের অধিকারী। বিশস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে যে, বহু হিন্দু ও মুসলাম নিজেদের ঘরবাড়ি ঘাঁটি রূপে প্রস্তুত করেছে। এবং দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামের জন্য (প্রয়ােজন হলে) খাদ্য সংগ্রহ করে রাখছে। [দ্রঃ ঐ পুস্তক পৃঃ ১১৮]
উপরােক্ত তথ্যবহুল আলােচনায় কংগ্রেস ও লীগের স্বরূপ বােঝা সম্ভব অর্থাৎ নেতাদের বেশির ভাগের স্বরূপ। কিন্তু হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান সমর্থক অনেকে এমন ছিলেন যাঁরা পরিস্থিতির ঘৃণ্য অবস্থা জেনেও কিছু করতে পারেননি। অথচ উভয় দল হতে নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরে দাঁড়াতেও সক্ষম হননি। প্রকৃত দেশহিতৈষী দরিদ্রর কল্যাণকামী ও ধর্মভীরু মুসলমান পুরানো সংগ্রামীদের মুসলিম লীগের প্রচার প্রসার আর ইংরেজের গােপন ঢালাও সহযােগিতা এমনই রূপ নিয়েছিল যে, তাঁরাও ঐ ইংরেজ সৃষ্ট লীগে নিজেদের যুক্ত করতে বাধ্য হন। হিন্দুদের মধ্যে মহান নেতা অনেকেই কংগ্রেসের লেবেল এঁটে কংগ্রেসে প্রবেশ করতে হয়। যথা-শ্রী সুভাষ চন্দ্র, শ্রী চিত্তরঞ্জন প্রমুখ।
ইংরেজ সৃষ্ট কংগ্রেস ও লীগের লড়াইয়ে কে জয়ী হলাে এই প্রশ্নের উত্তরে সত্যেন সেনের ভাষায় বলা যায়-
“অখণ্ড ভারতের ভিত্তিতে কংগ্রেসের সুদীর্ঘ ষাট বছরের লড়াই যে খণ্ডিত ভারতের দাবির ভিত্তিতে মুসলিম লীগের এক বছরের সক্রিয় প্রচেষ্টার নিকট পরাজিত ইহা সাধারণ মানুষের অনুমানের বাইরে ছিল।”
মিঃ জিন্নার পলিসি কংগ্রেস পলিসির চেয়েও মারাত্মক ছিল। ১৯৪২ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষ যখন উলঙ্গ অধোলঙ্গ অনাহারে হাজারে হাজারে মরতে লাগলাে তখন কংগ্রেসের নেতাদের ‘স্বরাজ’ গবেষণায় ওদিকে দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু লীগ রিলিফ নােঙ্গরখানা খুলে হাজার হাজার মানুষকে খেতে দিয়ে এবং শ্রমিক শ্রেণীতে অনেককে চাকরির ব্যবস্থা করে স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করে। অনেকের মতে গান্ধীজির রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং ডিক্টেটারি বা একনায়কত্ব আর পদ প্রিয়তাই কংগ্রেসকে উন্নত করে জনসাধারণের উপযােগী করে তােলা সম্ভব হয়নি। তাই বিখ্যাত এক সাহিত্যিক এবং প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার একজন নায়ক গান্ধীজির পদত্যাগ চেয়ে মন্তব্য করেছিলেন,
“যেখানে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন উক্তি, স্বাধীন অভিমত বারম্বার প্রতিরুদ্ধ হইয়া জাতীয় মহা সমিতিকে পঙ্গু করিয়া আনিয়াছে, সেখানে মহাত্মা অথবা কাহারও নিরবচ্ছিন্ন সার্বভৌম আধিপত্য কল্যাণকর নয়।” [সত্যেন সেনের পনেরই আগষ্ট’, পৃঃ ৩৩]
এই মূল্যবান বজ্র উক্তিটি ধারাল কলমনবীশ শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
৩৭১ আধুনিক সমীক্ষায় প্রমাণিত হয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জনসাধারণের মুখপাত্র তো ছিলই না, এমনকি সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভাও কংগ্রেসকে অস্বীকার করেছিল। প্রমাণস্বরূপ নিম্নরূপ উক্তি গভীর প্রণিধান যােগ্য-
“হিন্দু মহাসভা দাবি করল যে তারাই ভারতের হিন্দুদের প্রতিনিধি, কংগ্রেস নয়। কংগ্রেস অভিজাত সম্প্রদায়ের, সাধারণ লােকের সাথে তাদের যােগ নেই। কংগ্রসের নীতি শুধু তােষণনীতি।” [দ্রঃ ‘অবিস্মরণীয়’, গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, ১ম প্রকাশ, পৃঃ ৪৪]
ইংরেজ মাঝে মাঝে কিছু ভারতবাসীকে নানা কারণে প্রকাশ্য প্রয়ােজনে বলি করে কারাগারে পাঠালেও তাদের অনেকের ওপর ইংরেজের দারুণ আস্থা ছিল। অনেকে মনে করেন, গান্ধীর ওপরও ইংরেজের খুব ভরসা ছিল কারণ তিনি সব সময় বিপ্লবীদের অন্য পথে অর্থাৎ অহিংস পথে চালাতে চেষ্টা করতেন। তার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য মিস্ উইল কিনসনের কথায়-
“ইংরেজের ভয় গান্ধীকে ততটা নয় যতটা ভয় খেপা ছেলের দলকে। মহাত্মা গান্ধী ইংরেজের সবচেয়ে বড় পুলিশ অফিসার অর্থাৎ আমাদের পােষা লােক।” [অবিস্মরণীয়, গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, ১ম মুদ্রণ, পৃঃ ৪১৮]
মহাত্মা গান্ধী কেন ইংরেজ তােষণনীতি গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে অনেকে এই জন্যই ভাবেন যাকে কেন্দ্র করে ইউরােপের ছায়া ছবিতে দেখানাে হলাে “Every body loves music”। সারা ইউরােপ কি তােলপাড়! কী বিশ্রী ছিল সেই ছবি! যেখানে দেখানাে হয়েছে অর্ধ উলঙ্গ ইংরেজ রমণীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে নেংটি পরা গান্ধীজি উন্মত্ত হয়ে বলড্যান্স করছেন। তবুও তা প্রতিবাদের বিষয়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ভুল-ত্রুটিকে সারা দেশে ফলাও করে দেখিয়ে একটা দেশের জাতির নায়ককে তথা ভারতবাসীকে অপমান করা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। শুধু ওটাই নয় বরং “ইণ্ডিয়া স্পিকস” এবং “বেঙ্গলী” ইত্যাদি ছবিতেও ঐ সমস্ত কুকীর্তি দেখানাে হয়েছে। কংগ্রেসের অনেক নামজাদা লােকই তো তখন ছিলেন কিন্তু প্রতিবাদ কেউ করেননি। যখন জার্মানী ও ভিয়েনায় ঐ সমত ছবি দেখিয়ে ভারতের সম্মান নাশ পর্ব প্রতিপালন করা হচ্ছিল তখন বাংলার বিপ্লবী নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র আপত্তি জানালেন Archbishop cardinal Intizar এর কাছে। ফলে ভিয়েনায় ঐ ছবি দেখানাে হয়। হিটলারকে তিনি অনুরােধ জানালেন ঐ ছবি বন্ধ করতে; সঙ্গে জার্মানীতেও ঐ বই দেখানাে বন্ধ হয়। সুভাষের যােগ্যতাকে অনেকেই ভয় করতেন বিশেষ করে যারা বুঝতেন তিনি থাকলে তার ওপর নেতা হয়ে থাকা মুশকিল।
যাইহােক, ঐ সুভাষ চন্দ্র যিনি গান্ধীর কত বড় বহু প্রতারিত সুনাম ঢেকে ফেললেন সেই সুভাষ চন্দ্রকেই পরে জোর করে প্রকাশ্যে তাড়িয়ে দেওয়া হলাে। প্রমাণস্বরূপ শ্রী গঙ্গানারায়ণ চন্দ্রের লেখা ঐ অবিস্মরণীয় লুকের ১ম সংস্করণের ৪১৯ পৃষ্ঠার তথ্য খুবই স্মরণীয়-
“সেই সুভাষ চন্দ্রকেই পরে মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস থেকে তাড়ালেন তিন বছরের জন্য, অপরাধ বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ। আজও মনে পড়ে দেশের সেই দুর্দিনে যিনি সুভাষ চন্দ্রকে প্রথম আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।”
তাহলে যার বা যাদের মতে বিপ্লবী হওয়ার অপরাধ তাকে বা তাঁদের Father of Nation. বা জাতির জনক বলা হয়-এটা ঠিক না অবশ্যই ভুল তা নিয়ে আজ অনেকেই ভাবছেন। বর্তমানে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাদের নিয়ে মাতামাতি হৈ চৈ করা হয় তাঁদের অধিকাংশই হঠাৎ নেতার দল। বরং তাঁরা অনেকে ইংরেজের পক্ষেই ওকালতি করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের আসল ইতিহাস ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে কথিত ১৮৫৭ খৃঃ মহা বিপ্লবই হচ্ছে আন্দোলন বা সংগ্রাম। আর ঐ সংগ্রামে সংগ্রামীদের আত্মত্যাগ, যােগ্যতা ও বীরত্বের বিচার করে নূতন করে ইতিহাসকে ঢেলে সাজানাে যদি প্রয়ােজনই থাকে তবে তা অবশ্যই সংবর্ধনীয়। কিন্তু তবুও সেই সাধু প্রকৃতির কোমলপ্রাণ মানুষকে বৃদ্ধ বয়সে প্রকাশ্য রাজপথে ক্রোধ চরিতার্থ করার জন্য গুলি করে হত্যা করা ন্যূনতম সভ্যতাকেও অতিক্রম করেছে। আর তাঁর ছবি পােড়ানাে ও মূর্তি চূর্ণ করা অনেকের দৃষ্টিতে বাহুল্য উচ্ছ্বাস প্রবণতা ছাড়া কিছু নয়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।