ঋকবেদে সোমরস নামে একটি পাণীয়ের উল্লেখ আছে। সোমরস হল লতা-পাতার নির্যাস। মানসিক গঠনে অনেক সময় বিভিন্ন পানীয়ের বিভিন্নরকম ভূমিকা থাকে। সোমরসও এই ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে। উচ্চকোটির মানুষজন, যাঁরা ইংরেজি বলতে কইতে পারেন, সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত তাৃরা বলেন বেদোক্ত পানীয়টি ও বর্তমান সুরায় কোনও পার্থক্য নেই। দুটিতেই নেশাচ্ছন্নতা এবং কথাবার্তায় অসংলগ্নতা আসে। বিদেশি আচরণের দেশি মুখোশের আড়াল। এখানে বেদ হল সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুখোশ। দেশজ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সোমরসকে মনে করেন নির্দোষ। চা পাতাকে যেমন গরমজলে ফেলে নির্দোষ পানীয় হিসাবে প্রস্তুত করা হয়। তেমনই সোমরস নাকি লতাপাতার নির্দোষ নির্যাস। মাদক দ্রব্য ও তার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের কথা বলতে গিয়ে সোমরসের কথা এইজন্য এসে পড়ল যে, সোমরসই হল স্বীকৃত মহাগ্রন্থে উল্লেখিত সর্বপ্রথম কোন পানীয়।
ঋগ্বেদীয় পুরোহিত কিভাবে অগ্নিতে সোমরসের আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করবেন তার একটি বর্ণনা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম ১৬ টি অধ্যায়ে রয়েছে। সোমলতা অত্যন্ত দুর্লভ বিধায় শতপথ ব্রাহ্মণে ‘পুতিকা’ নামক লতার কথাও বলা হয়েছে। দুর্গম স্থান থেকে সোমলতা কোন বনচারী শূদ্র দ্বারা আহৃত হলে দুগ্ধবতী গাভী, ছাগী, বাছুর, বলদ ও বস্ত্র এই ধরনের বস্তুর বিনিময় পুরোহিতরা সংগ্রহ করতেন। পঞ্চমদিনে পুরোহিতগণ অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে সোমলতা বেঁটে তিন বার রস তৈরি করতেন- প্রাতে, মধ্যাহ্নে, সন্ধ্যায়। এরপর অগ্নিতে রস আহুতি দেওয়া হত। বেদোক্ত সোমযাগের এই পদ্ধতি থেকে জানা যায় সোম রস যেমন যজ্ঞর অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার প্রথা ছিল, তেমনই অবশিষ্ট রস পুরোহিতগণ পানও করতেন। নির্দোষ পানীয় অগ্নিতে আহুতি দিলে অগ্নি নির্বাপিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সম রসে সামান্য বা বৃহৎ পরিমাণে সূরাসার বা অ্যালকোহল থাকত বলেই অগ্নিতে আহুতি দেওয়া মাত্রই জ্বলে উঠত। সোমরসে নেশাদ্রব্য থাক বা না থাক পুরোহিতরা রস পান থেকে বিরত থাকতে পারতেন না।
সমস্ত সেমিটিক ধর্মে মাদক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে- নিষেধাজ্ঞার মান্যতা দেয় না যারা তাদের কথা ভিন্ন। প্রাচীন আমেরিকাবাসীরা খ্রিস্টজন্মের ১১০০ পূর্বে কাকাও (থিওব্রোমা ক্যাকাও) ফলের মিষ্টি শাঁস গেঁজিয়ে এক প্রকার মাদক দ্রব্য প্রস্তুত করত। এই ফলের চাষ হত সমস্ত মধ্য আমেরিকা জুড়ে। হন্ডুরাস থেকে কাকাও গাছের চাষ এবং গাঁজানোর পাত্রের বহু নমুনা পাওয়া গিয়েছে।
ইসলামের আবির্ভাবকাল থেকেই সবরকম মাদক দ্রব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞা এসেছিল রয়ে সয়ে, সময় নিয়ে। যেমন প্রথমে বলা হল নামাজরত অবস্থায় মাদকের প্রভাবে মাতাল হওয়া চলবে না। পরবর্তী সময়ে ২৪ ঘন্টা মাদক সেবনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও উগ্র শিয়া আন্দোলন হাশাশিন বা অ্যাসাসিন মাদক ও রাজনীতির মধ্যে একটি সরল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সম্ভবত প্রথমবার মাদক ও রাজনীতি একত্রিত হয়। এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাসান আস সাবা। তিনি বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও কবি ওমর খৈয়াম এবং সেলজুক সুলতান, বাগদাদের খলিফার প্রধানমন্ত্রী নিযাম উল মুলকের বাল্যবন্ধু ও সমসাময়িক ছিলেন। যৌবনপ্রাপ্তির পর নিজাম উল মুলক প্রবল প্রতাপান্বিত প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলে অপর দুই বন্ধুর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। ওমর খৈয়াম বিজ্ঞান সাধনা ও শান্ত নিরুদ্বিগ্ন জীবনের পাথেয় জোগাড় করে নেন। হাসান সাব্বা আরও বড় লক্ষ্য নিয়ে এলবুর্জ পর্বত শীর্ষে আলামুত কেল্লায় আশ্রয়গ্রহণ করেন। সেইসময় ক্রুসেড ও বাগদাদের খলিফার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য অশান্তির আগুনে জ্বলছিল। এর আগে মিসরে শিয়া ফাতেমি ও স্পেনে উমাইয়াদের শাসন শুরু হয়। শিয়া ফাতেমী দলছুট হাসানের মতবাদ হাসাসিন প্রভাব বিস্তারে ব্যাপৃত হয়। এদের নিজারি-ও বলা হত। এরা হাসিসের নেশাগ্রস্ত গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে ভিন্নমতের বহু উচ্চপদস্থ মানুষকে হত্যা করে। সুন্নি মতাবলম্বী বাগদাদের খলিফা আব্বাসীদের পৃষ্ঠপোষক সেলজুকদের বিরুদ্ধে এরা ছিল অতি সক্রিয়। এই অতি সক্রিয়তার বলি ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে নিজাম উল মুলক। পরে চেঙ্গিস খানের বিধ্বংসী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী নাসিরউদ্দিন আততুসি আলামুত দুর্গে আশ্রয় নেন। সম্ভবত হাসাসিনদের কট্টরপন্থায় বিরক্ত হয়ে নিজে শিয়া হয়েও তিনি হালাকু খানের সহায়তায় আলামুত থেকে এদের উৎখাত করেন। হাসান আস সাব্বা ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সবরকম নেশার ঊর্ধ্বে। কিন্তু হাসিসের নেশা ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। যদিও ভিন্ন জাতির উপর এর কোনও প্রভাব ছিল না। হাসাসিন থেকেই ইংরেজি অ্যাসাসিন শব্দের উদ্ভব বলে মনে করা হয়। হাসাসিন মতবাদের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের অতিরঞ্জনও থাকতে পারে।
প্রায় ২০০ বছর ধরে হাসান সাব্বার মতবাদ ইসলামী জগতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে একটি ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য গড়ে তোলে-অনেকসময় তা ছিল সাম্রাজ্যের মধ্যে সাম্রাজ্য। জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসত গাঁজা থেকে প্রস্তুত মাদক বিক্রি করে নেশা সাধারণ মানুষকে অকেজো করে হাশাশিন দের প্রভূত সাহায্য করেছিল শব্দটিও এসেছে হাসান নামটি থেকে। ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে মার্কো পোলো এর বর্ণনা দিলেও প্রভাব ছিল কমার দিকে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে নেশাদ্রব্যের গান্ধারী তথাকথিত মুসলিমদের কীর্তি বলে মনে করা হলো এই রাজনীতির পুরোপুরি ছিল ভাতৃঘাতী আরবদের বিরুদ্ধে আরও প্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল নিজামুল হক ছিলেন দরসে নিজামী পাঠক্রমের মূল রচয়িতা বাঙালির নামে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় নিজামিয়া মাদ্রাসা যেখানে শিক্ষকতা করতেন হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি হত্যা করে ইসলামের উন্নয়নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।
কে ভিন্ন সংস্কৃতি ধর্ম বা দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে ইউরোপীয়দের আরো নির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয় ইংরেজি ভাষীদের। ২৭৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভেষজ ঔষধ হিসাবে চিনে গাঁজার ব্যবহার ছিল। তবে মাদক আফিমের নেশা সম্বন্ধে তাদের জানা ছিল না। বিশাল চৈনিক সাম্রাজ্যকে বল প্রয়োগে দখল করতে না পেরে আফিমের নেশা ধরিয়ে ইংরেজরা পরোক্ষ শাসনের দিকে ঝুঁকেছিল।
ভারতে রাজ্যপাটের প্রবর্তন ও তাকে ধরে রাখার জন্যে ইংরেজরা বর্ণহিন্দু ও দলিত হিন্দু-মুসলিম লড়িয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা সম্পূর্ণভাবে বর্ণহিন্দুদের দিকে প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে ভারত সাম্রাজ্যের পত্তন ও লালন পালনে ব্রতী হয়েছিল। অন্যান্য ব্যবসার মত ভারতীয় আফিমকেউ ইংরেজরা ব্যবহার করেছিল তাদের ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য। সহায়ক হিসাবে পেয়েছিল ভুঁইফোড় নব্য জমিদার শ্রেণীকে। দেখা যাচ্ছে ঠাকুর (দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ-খ্যাত) পরিবারের গোপীমোহন ঠাকুরের পুত্র চন্দ্রকুমারকে আফিম ব্যবসায় লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা ও পরিবহন যোগ্য নিজস্ব জাহাজ না থাকায় ভাড়া করা জাহাজে চীনসহ বহু দেশে আফিম পাঠাতেন। ভারতবর্ষে আফিম চাষ ও ব্যবসা বহু প্রাচীন। মোগলদের সময় আফিম চাষিরা নিজের নিজের জমি চাষ করত এবং নিজেরাই আফিম বাজারজাত করত। পলাশী পূর্ব ইংরেজরা এই ব্যবসাতে ঢোকার চেষ্টা করলেও শক্তিশালী চাষীদের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর অন্যান্য ব্যবসার মত মাদক আফিম চাষ ও ব্যবসায়েও বলপ্রয়োগে প্রবেশ করে। ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর প্রিয়জনদের বাংলা ও বিহারের আফিম ব্যবসাতে একচেটিয়া অধিকার দান করেন। এরপর দেশীয় ব্যবসায়ীরা আফিম চাষে লাভ করতে না পেরে আফিম চাষ বন্ধ করতে গেলে তাদের বল প্রয়োগে চাষ করতে বাধ্য করা হয়। অবশেষে আফিম চাষিরাও প্রতিবাদ প্রতিরোধে অবতীর্ণ হয়। এর ফল হল আফিম চাষ ও ব্যবসায় ইংরেজ সরকারের নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণরেও ফল হল দুর্নীতি। অবশেষে আফিম চাষ কমতে কমতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজরা বাজার বৃদ্ধিকল্পে উত্তর-পূর্ব ভারতের মঙ্গলয়েড শ্রেণীর মানুষদের ও চীনের মানুষদের আফিমের নেশা হাতেনাতে শিক্ষা দিতে লাগল। ধীরে ধীরে এই দুই এলাকার মানুষ আফিমের মৌতাতে বুঁদ হতে থাকে এবং কোম্পানির নতুন বাজারে কোম্পানিকে মুনাফার পাহাড়ে চড়িয়ে দিল। ইংরেজদের সহায়তা দিয়েছিল নব্য বর্ণ হিন্দু জমিদার শ্রেণী, আফিম চাষে দালালি ও চন্দ্রকুমার ঠাকুরের ন্যায় আফিমের রপ্তানিকারক রূপে। তবে শেষোক্ত ক্ষেত্রে ইংরেজরাই ছিল সংখ্যাগুরু। বলাইবাহুল্য, বর্ণহিন্দুরাও ইংরেজদের মত আফিম চাষে দাদন দিত। এই প্রসঙ্গে কলকাতা তথা ভারতের প্রথম পাশ্চাত্য ধরনের শিল্পোদ্যোগী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম এসে যায়। যদিও রবীন্দ্রনাথ ‘চীনে মারণের ব্যবসায়’ (ভারতী পৃ. ৯৩-১০০) প্রবন্ধে ইংরেজ সরকারের নিন্দা করে বলেছিলেন, ইংরেজ অহিফেনের হীন ব্যবসায়ীকে কূটনীতি ও ষড়যন্ত্রের সাহায্যে চীনদেশে কায়েম করে। তিনি প্রকৃতপক্ষে জেনে বা না জেনে পিতামহের বিরুদ্ধে বলেছেন। দ্বারকানাথ খিদিরপুর ডকে ওয়ারউইক নামে একটা ৩৬৩ টনের দ্রুতগামী জাহাজ নির্মাণ করান। তাঁর আরও কয়েকটি জাহাজ চীনের সঙ্গে আফিম ব্যবসায় লিপ্ত ছিল।কলকাতা-ক্যান্টন, ক্যান্টন-কলকাতা পথে পার্সি ব্যবসায়ী রুস্তমজী কাওয়াসজির সঙ্গে দ্বারকানাথের প্রতিযোগিতা চলত।
অচিরেই ইংরেজরা চীনদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার রূপে আফিমের নেশার মত নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। তারা চীনাদের শুধুমাত্র আফিমের নেশাই ধরিয়ে দেয়নি, আমদানিকারক মুষ্টিমেয় ইংরেজ মধ্যবর্তী চীনদেশীয় দালালশ্রেণী তৈরী করে স্থানীয় বাজারে আফিম ছড়িয়ে দেয়। এক সময় এমন হয় আফিম নেশাকারী, দালাল এবং ইংরেজরা মিলিত হয়ে প্রথমে স্থানীয় প্রশাসন অবশেষে সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। এর ফল হয়েছিল দুটি যুদ্ধ যা আফিম যুদ্ধ নামে খ্যাত। প্রথম আফিম যুদ্ধ হয়েছিল (১৮৩৯-১৮৪২) ৩ বছর ধরে, দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ হয় (১৯৫৬-৬০) চার বছর ধরে। যুদ্ধ দুটিতে চীন সম্রাট পরাজিত হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আরো বহুবিধ বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে বাধ্য হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান শক্তি- যে সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। এরপর চাকা ঘুরতে থাকে, নতুন বিশ্ব শক্তিরূপে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠে আসতে থাকে। এখন তো বিশ্ব মার্কিনময়।
প্রাচীন আমেরিকা মহাদেশে পানের মত কোকো পাতা চিবিয়ে নেশা করা হত। আদি আমেরিকা বাসী (যাঁরা ভুল করে রেড ইন্ডিয়ান নামে অভিহিত হন) নেশাদ্রব্য হিসাবে বর্তমানেও কোকো পাতা চেবায়। কোকোতে থাকে কোকেন। কোকো পাতা তুলে, ভিজিয়ে রেখে, চুন মিশিয়ে ফেলে রাখা হয়। এরপর এর সঙ্গে কেরোসিন ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের একটি মিশ্রণ মেশান হয়। ফলে শক্ত এক ধরনের পদক্ষেপ পড়ে থাকে। এটাই হল কোকেনের প্রাথমিক রূপ। এই কোকেনের সঙ্গে ইথার মেশানো হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড মিশ্রিত করলে বিশুদ্ধ কোকেন হাইড্রক্লোরিক পাওয়া যায়। কোকেনের বিশুদ্ধ রূপটি উচ্চবিত্ত নেশাড়ুদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। উৎপাদনের বাহুল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোকেনের নেশা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে উভয় আমেরিকায় কোকেনই প্রধান নেশাদ্রব্য হয়ে দাঁড়ায়। কোকেনই হল যুক্তরাষ্ট্রের তুরুপের তাস।
নেশাদ্রব্য মাদক হিসাবে গাঁজার স্থান দ্বিতীয়স্থানে। গাঁজা গাছ জন্মায় উষ্ণ আবহাওয়ায়। গাঁজা গাছ হল লোমশ। এই লোমশ গাত্র থেকেই বাদামী রঙের আঠালো রস নির্গত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই রস থেকেই নেশার বস্তু তৈরি হয়।
অনেক সময় সমস্ত চারা শুকিয়ে নেওয়া হয় বা রস শুকিয়ে মারিজুয়ানা পাওয়া যায়। হাসিস হল এই রসের শুষ্ক কেকের মতো রূপ। হাসিসের ব্যবহার হাসান সাব্বার মধ্যযুগীয় হাসিস সাম্রাজ্য ছাড়াও প্রাচীন গ্রিস, ভারত, চীনেও জানা ছিল।
৬০ ও ৭০ দশকের আমেরিকা ইউরোপ এবং ক্রমে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপ্ত হিপি সংস্কৃতির সঙ্গে মারিজুয়ানা ওতপ্রোত জড়িত ছিল। এই দশক গুলিতে মারিজুয়ানা, এল এস ডি, রক সঙ্গীত, আলুথালু মার্কা আপাত নিস্পৃহ সংস্কৃতি সমস্ত বিশ্বের ফরাসি ও ইংরেজি জানা মার্কিন ও ইউরোপ ঘেঁষা চেতনা ও ভাবনাকে আগামী কয়েক দশক ধরে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথম সোপান ছিল।
এরই হাত ধরে এসেছে গণতান্ত্রিক চেতনা, পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, সকলকে নিয়ে বাঁচার প্রেরণা, ব্যক্তি স্বাধীনতার চিন্তা। একইসঙ্গে এসেছে পপ ও রক সঙ্গীত, লিভ টুগেদার, সমকামিতা, এইডস, হেপাটাইটিস বি ইত্যাদি দুরাচার ও অসংযত জীবনযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাবধারা।
হিপি সংস্কৃতির মধ্যে ছিল যুব সম্প্রদায়ের মগজ ধোলাই ও মার্কিন ইউরোপীয় নির্ভরশীলতা এবং কমিউনিজম ও পরবর্তী ইসলাম বিরোধিতার মূল ভিত্তি। মগজ ধোলাই এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে প্যালেস্টাইনের উপর মার্কিন মদতে ইসরাইলি নিপীড়ন, আফগানিস্তানের উপর ন্যাটোর আধিপত্য, ইরাকের উপর হামলা, ইসলামী যুব সম্প্রদায়ের একাংশ ছাড়া বাকি বিশ্বের যুব সম্প্রদায়কে সেভাবে আলোড়িত করতে পারেনি, যেমন করেছিল ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে। এই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এলএসডি, মারিজুয়ানা ইত্যাদি নেশাদ্রব্যের সম্পর্ক ছিল গভীর।
জেনারেল অ্যান্টোনিও নরিয়েগা ছিলেন পানামার প্রেসিডেন্ট। পানামা হল উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগকারী যে সরু যোজকটি রয়েছে সেখানকার ক্ষুদ্রাকার একটি দেশ। দেশটি ক্ষুদ্র হলেও গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ দেশটির মধ্য দিয়ে গিয়েছে পানামা খাল। খালটি উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলবর্তী আটলান্টিক ও মেক্সিকো খাড়িসংলগ্ন দেশগুলির সাথে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন দেশ গুলির যোগাযোগের সোজা সমুদ্র পথ। খালটি যখন ছিল না তখন উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকুলের জাহাজ সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকুল ধরে টিয়েরা ডেল ফুয়েগা বেড় দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দেশগুলিতে পৌছাত। স্বাভাবিকভাবেই খালটি হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা কমিয়ে দিয়েছে। কমেছে জ্বালানি খরচ, তাই কমেছে পরিবাহিত পণ্যের দাম। পানামা দেশটির সঙ্গে চুক্তি বলে খালের পরিচালন কর্তৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
নরিয়েগা এক সময়, ১৯৬০ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি দেশের সামরিক বিভাগে দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন এবং দেশের যাবতীয় গোপন খবর যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করতেন। বিপরীত দিকে নরিয়েগাও যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ও সামরিক বিভাগের বহু গোপন তথ্য জানতেন। নরিয়েগা দ্রুত উন্নতি করে (সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের অদৃশ্য হাত ছিল) পানামার প্রেসিডেন্ট হলে, যুক্তরাষ্ট্র নব্য পানামিয়ান রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পানামা খাল পরিচালন চুক্তির নবীকরণের দিন শেষ হাওয়ার প্রহর যত ঘনিয়ে আসতে লাগল ততই নরিয়েগা যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে স্বাধীন আচরণ করতে লাগলেন। যুক্তরাস্ট্র সংশয়ে পড়ল খাল ছাড়া হল কিনা? তারও উপর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নরিয়েগা স্বয়ং আস্তিনের সাপ ছাড়া আর কিছু নয়। যাই হোক, তখন ১৯৮৯, যুক্তরাষ্ট্র শাসন করতেন স্বনামধন্য (?) জর্জ বুশ বড়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পানামা খাল তাকে রাখতে হবে আর শত্রুরও শেষ রাখতে নেই। বড় বুশরা যা আগেও করেছেন এবং এই ঘটনার পরও করেছেন, তাই করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ ও শক্তিশালী মিডিয়া আসরে নেমে পড়ল। প্রচার শুরু হল, নরিয়েগা কলম্বিয়ার মেডেলিনের কোকেন মাফিয়াদের সাথে যুক্ত এবং প্রায় প্রতিদিনই মেডেলিন থেকে পানামার পথে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোকেন চোরাচালানে মদদ দিচ্ছেন। এই জন্য ড্রাগ মাফিয়ারা নরিয়েগাকে সাড়ে চার মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছে। ওই কোকেন যুক্তরাষ্ট্রের সুবোধ, শান্তশিষ্ট কিশোর ও যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
মার্কিন দেশের হর্তাকর্তারা আন্তর্জাতিক মত অপেক্ষা নিজের দেশের মতকে বেশি গুরুত্ব দেয়। নোরিয়েগা কত ভয়ঙ্কর তা প্রমাণের উদ্দেশ্যে গান ও বাঁধা হল। সেখানে নরিয়েগা বর্ণিত হলো প্রায় দানব হিসাবে। সরকারি উদ্যোগে তা ছড়িয়ে পড়ল দেশের আনাচে-কানাচে। জনমত তৈরি হল নরিয়েগাকে শেষ করার পক্ষে। সেই সময় আফগানিস্থান থেকে সোভিয়েত রাশিয়া সরে এসেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির উপর থেকে সোভিয়েত তার দখলদারিত্ব ছেড়ে দিয়ে সরে আসছে, সোভিয়েত রাশিয়ার নিজেরই ভগ্নদশা, চীন এখনকার মত তখনও নিজের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মার্কিন তাঁবে, দেশের জনমতও ক্রমশ পক্ষে। অতএব জর্জ বুশরা যে কাজে সিদ্ধহস্ত- পানামায় মার্কিন বাহিনী প্রবেশ করল। নরিয়েগা সামান্য বাধা দিয়ে রণেভঙ্গ দিলেন, আশ্রয় পেলেন ভ্যাটিকান দূতাবাসে।
মার্কিনীরা যার শত্রু তার জন্য এই ধরাধামও সংকীর্ণ। পানামার ভ্যাটিকান দূতাবাস কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। ভিতরে দানব নরিয়েগা, বাইরে বাজানো হতো সেই গান যাতে রয়েছে শয়তান ও সাধু আর নোরিয়েগার দানবত্বর ধুয়ো। অবশেষে নরিয়েগা নিজেও হয়তো ভাবতে শুরু করেছিলো সে বুশদের থেকেও নিকৃষ্ট। ভাবল সে যখন এতটাই নিকৃষ্ট তখন তার স্থান প্রেসিডেন্টের গদি ছেড়ে মার্কিন জেলেই হওয়া উচিত। ফল হল আত্মসমর্পণ। অবশ্য দিবারাত্র এই গান শুনলে যে কোনও মানুষের স্নায়ু অকেজো হয়ে যাবে। পানামা ও যুক্তরাষ্ট্র নরিয়েগা মুক্ত হল। পানামা খাল রাহুমুক্ত হল তবে এটা ভাবা ইতিবাচকই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাগ চোরাচালান বাড়ল বই কমল না। ড্রাগ চোরাচালানের মিথ্যা অজুহাতে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট লুট হয়ে যায়। পরবর্তীতে এইরকম মিথ্যা অজুহাতে তালিবান ও সাদ্দাম মুক্ত করার জন্য আফগানিস্তান, ইরাক লুঠ শুরু হয়।
মাদক ও সাম্রাজ্যবাদ এই দুইয়ের সম্পর্ক এরপর বৃহদাকারে ও উল্লেখযোগ্যভাবে আপতিত হল আফগানিস্থানে। এক্ষেত্রে মাদক হলো পুরাতন বিশ্বের পুরাতন বস্তু- আফিম ও গাঁজা। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ওসামা বিন লাদেনকে ধরার নাম করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানকার জনপ্রিয় তালিবান সরকারকে উচ্ছেদ করে। দেশটি ১৯৭৯-তে সোভিয়েত রাশিয়া কব্জা করে। রাশিয়ানরা সশস্ত্র জিহাদের সামনে পড়ে লেজেগোবরে হয়ে হাজার ১৯৮৯-এ আফগানিস্থান ত্যাগ করে। এই জিহাদে পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্য দেশগুলো মদত দিয়েছিল। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত আফগানিস্তানকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য বাহিনী নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এই প্রচেষ্টার অঙ্গরূপে ১৯৯৫ থেকে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসা তালিবানদের যে সকল অপবাদ শুনতে হয়েছিল তা হল- আফিম চাষ ও হেরোইন ব্যবসায় উৎসাহ দান নারীদের অবরোধ ও অত্যাচার, ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় ও উৎসাহ দান এবং একটি সত্য ঘটনা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে ১১-ই সেপ্টেম্বর ২০০১-এর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস কার্যের ঘটনার পর লাদেনকে ধরার নামে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী ঢুকিয়ে দেওয়া হয়- এই কুকীর্তির হোতা ছিলেন জর্জ বুশ জুনিয়র।
বর্তমানে নেশাড়ুরা আফিমের মৃদু নেশার মৌতাতে আর তুরীয় আনন্দ পায় না। তাদের নেশার প্রয়োজন মেটায় পাতা বা হেরোইন বা ব্রাউন সুগার। আফিমের ফল চিরে বার হওয়া আঠালো চটচটে রস সংগ্রহ করে শুকোতে দিলেই একটি কেকের মত আকৃতি পাওয়া যায়। এটিই হল আদি অকৃত্রিম আফিম।
আফিমকে জলে ভিজিয়ে পরিস্রুত করলেই পাওয়া যায় মরফিন। মরফিন হল বেদনা নাশক। মরফিনকে অ্যাসিটোন দিয়ে কিছুক্ষণ গরম করে আরও পরিস্রুত করা হয়। এরপর অ্যালকোহল, অ্যাসিটোন ও কাঠ কয়লা দিয়ে গরম করে পুনরায় পরিশুদ্ধ করা হয়। এরপর প্রাপ্ত কঠিন বস্তুটিকে শুকনো করে হেরোইনের টুকরো পাওয়া যায়। এই টুকরোগুলিকে গুঁড়ো করে পাউডারে পরিণত করে পলিপ্যাক করার পর ব্রাউন সুগার নামে বাজারে আনা হয়।
আফিম থেকে হেরোইন প্রস্তুত করতে গেলে দরকার আস্ত একটি রসায়নাগার ও বহু রাসায়নিক বস্তু। সুলতান মাহমুদ ও তাঁর বংশধরদের রাজত্বের পর বিগত হাজার বছর ধরে আফগানিস্থান এই ধরনের রসায়নাগার তৈরীর কোনও উৎকর্ষতার প্রমাণ দেয়নি যা চরম নেশাদ্রব্য হেরোইন প্রস্তুত করতে পারে। তাহলে হেরোইন পাচার ও আফগানিস্তানের নাম সমার্থক হল কেন? ১৯৯১-এ বিপুল পরিমাণ আফিম উৎপাদনের দুটি এলাকা ছিল- ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্থান নিয়ে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অপরদিকে মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে ছিল গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। মনে করা হত পাঞ্জাবের শিখ উগ্রপন্থার টাকা আসত গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এর আফিম থেকে এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে সরাসরি এই কারবারে জড়ানো হত। অনুমান সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান যোদ্ধারাও আফিম বিক্রির টাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র কিনেছিল। কিন্তু এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৮৬ নাগাদই পাকিস্তান আফিম চাষ প্রভূত পরিমাণে কমিয়ে এনেছে। এইসব ঘটনা অনুমান সাপেক্ষ- ঘটতে পারে, নাও ঘটতে পারে।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানগেট কেলেঙ্কারি নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সাহায্য করেছিল ওই দেশের কমিউনিস্ট মনভাবাপন্ন সরকারকে উচ্ছেদের জন্যে। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যেও ছিল পণবন্দি উদ্ধার ও ইরানকে ইজরায়েলে মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোনাল্ড রিগান। প্রকাশ্যে হচ্ছে ইরান তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র আর অপ্রকাশ্য হচ্ছে ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন-ইজরায়েল অস্ত্র ব্যবহৃত হবে।
সময়টি হল ১৯৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দ। নিকারাগুয়ার সরকারকে উচ্ছেদের জন্য রেগান সিআইএ-কে হুকুম করে কন্ট্রা বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিতে। প্রশিক্ষণের টাকা আসত ইরানকে অস্ত্র বিক্রির টাকা থেকে। ইরাক- ইরান যুদ্ধের মধ্যে ইরান বাধ্য হয় আফিম বিক্রির টাকা থেকে ওই অস্ত্র কিনতে। এইভাবে আমেরিকা-ইসরাইল ও তাদের আপাত শত্রু লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইরান জড়িয়ে পড়েছিল পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায়, যার একটি অংশে আফিমও জড়িয়ে পড়েছিল। ভাবনার বিষয়, এই দলটি ইরাককে অস্ত্র সরবরাহ করত আবার তলে তলে ইরানকেও আফিমের বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ করত।
১৯৯১-এর হিসাব থেকে জানা যায়, ইরান ইরাকের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বাঁচার জন্য কিভাবে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯১-এ এক কিলো হেরোইনের দাম ছিল ১.৪ থেকে ২.৩ মিলিয়ন ডলার। ভারতে এক কিলোর দাম ছিল আট থেকে দশ লক্ষ টাকা। অপরদিকে প্রতি কিলোগ্রামের উৎপাদন খরচ ছিল ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ লাভের দিকে সাধারণ মানুষ কেন, তাবড় সরকারি আমলা ও সরকার আকৃষ্ট হয় তার একটি উদাহরণ দেওয়া গেল।
সাইয়েদ রহমতউল্লাহ হাসমি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া (দক্ষিণ) বিশ্ব বিদ্যালয়ে ১০-ই মার্চ ২০০১-এ একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতার সারমর্ম হল আফগানিস্থান বিশ্বের ৭৫% আফিম উৎপাদন করত। ২০০১-এর মার্চে ইউনাইটেড নেশনস ড্রাগ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (ইউএনডিসিপি)-এর প্রধান বারনার্ড এফ আফগানিস্তানকে শংসাপত্র দেন সেখানে আফিম চাষের পরিমাণ 0%। হাশমি সাহেব এটাও আশঙ্কা করেন ইউএনডিসিপি-এর কিছু কর্মচারী বেকার হওয়ার ভয়ে পুনরায় আফিম চাষ ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। আব্দুস সালাম জায়িফ, এক তালেবান মুখপাত্র বলেন-২০০০ খ্রিষ্টাব্দে আমির-উল-মুমেনিন মোল্লা ওমর আফগানিস্তানে আফিম চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা আনেন, এর ফলে তিন ভাগের এক ভাগ আফিম চাষ বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০০১-এ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ইউএনডিসিপি-র অফিসারদের উপস্থিতিতে জমানো হেরোইন ও হাসিস ধ্বংস করে দেওয়া হয়। নঙ্গারদারের কানিওয়ার জেলায় এবং হেলমান্দ প্রদেশের কয়েকটি হেরোইন প্রস্তুতির রসায়নাগার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এতসব পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের উপর আফিম চাষের অপবাদ নিরন্তর চালু রাখা হয়। এরা কোন দিনই আফিম চাষ বন্ধ করতে চায়নি। একদিকে তারা আফিম, হেরোইন, গাঁজা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে অপরদিকে গোপনে এর উৎসাহ দেয়। অপবাদ দিয়ে দেশগুলি দখল করা হয়। উৎসাহ দিয়ে অর্থবলে বলিয়ান হয়।
পরবর্তী ঘটনা হাল আমলের ভেনেজুয়েলা নামক দেশটির ক্ষেত্রে ঘটেছে। দক্ষিণ আমেরিকা নামক মহাদেশটির উত্তর অংশে রয়েছে তৈল সমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলা। রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজকে গদিচ্যুত করার লক্ষ্যে এই দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর ষড়যন্ত্র চলছে। ভেনেজুয়েলাকে বেছে নেওয়ার কারণ হল এই দেশটির তৈল সম্পদ এবং লাতিন আমেরিকার মধ্যে এই দেশটিতে সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী ধনী মানুষ থাকায় এক বৃহৎ বাজারের লালসা।
১৯৯৮ থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে লাতিন আমেরিকায় গদিলাভ করেছে মার্কিন স্বার্থবিরোধী বামপন্থী বা মধ্যপন্থী সরকার। ১৯৯৮-এ ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ, ২০০০-এ চিলিতে রিকার্ডো লাগোজ, ২০০২ ও ২০০৬- এর দুটি নির্বাচনে ব্রাজিলের গদিতে বসেছেন লউলা, ২০০৩-এ আর্জেন্টিনায় জিতেছেন নেস্টর কিউনার, ২০০৪- এ উরুগুয়ের রেমন রজার্স, ২০০৫-এ জিতে এলেন বলিভিয়ার আদিবাসী ইভো মোরালেস, ২০০৬-এ নিকারাগুয়ায় জিতে এলেন ড্যানিয়েল অর্তেগা, এল সালভাদরে ২০০৯ এ জেতেন মরিসিও বুনেস। দেখেশুনে মনে হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিনীদের পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের পা রাখার আর কোন জায়গাই নেই। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী মানুষজনের হাত ধরে ফিরে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
টমাস গুইয়েন দাভিল্লা ছিলেন ভেনেজুয়েলার সেনাপ্রধান। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথোপকথন করাকালীন শ্যাভেজ বিরোধী কথা বলেন। তিনি ও তাঁর পিতা রেমন দাভিল্লা ষড়যন্ত্র করেছিলেন স্যাভেজকে সরিয়ে দেওয়ার। ১৯৬৭ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের এক কুখ্যাত সেনা প্রশিক্ষণ শিবির থেকে স্নাতক হন। ১৯৮০ নাগাদ তিনি ও সি আই এ সমার্থক হয়ে ওঠেন। তিনি সেই সময় প্রকাশ্যে সিআইএ-র হয়ে কোকেন বিরোধী প্রোগ্রামে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এই ব্যক্তিই ১৯৯৩-এ ২২ কিলো কোকেন সিআইএ-র হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্মাগলিং করাকালীন ধরা পড়েন। যদিও রেমনের কোনরকম শাস্তি হয়নি। স্যাভেজকে হটানোর ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান, সিআই-এর প্রাক্তন এজেন্ট ও কোকেন পাচারকারী পিতার যোগাযোগে এ কথায় প্রমাণ করে এখনও ড্রাগের টাকা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের খেলা চলছে।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত, যে সকল জনকল্যাণমুখী সরকারের নাম আমি দিয়েছি সেখানে কিন্তু কলম্বিয়া নামক দেশটির নাম নেই। অথচ মার্কিনীরা যে সকল দেশকে মাদক চোরাচালানের অভিযুক্ত করে এবং বলে থাকে এই সকল দেশ মাদক চালান করে তাদের দেশের যুবশক্তির নৈতিকতা বিগড়ে দিচ্ছে তাদের মধ্যে কলম্বিয়া হলো মধ্য পর্যায়ের দেশ।
বস্তুত কলম্বিয়া হল সেই দেশ যেখানে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে মার্কিনীদের পছন্দসই সরকার বসে আছে। বলা যেতে পারে মৌরসিপাট্টা। মার্কিনীদের ছত্রছায়ায় বসে থাকা রাষ্ট্রপতি আলভেরো উরিবো মাঝে মাঝে মেডেলীনের ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান তারপর যে কে সেই। এই দেশটির অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কোকেনের উৎপাদন ও চোরাচালানের অর্থ দিয়ে, আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দারা সেই দেশের সঙ্গে যারাই যোগাযোগ করে তাদেরই ড্রাগ চোরাচালানকারী ছাপ মেরে উচ্ছেদের নোটিশ ধারায়। শাঁখের করাত যেতেও কাটে আসতেও কাটে।
‘সেনেট সাব কমিটি অন টেরোরিজম নারকটিকস এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স’ ১৯৮৮ নাগাদ একটি সভা করে। সেই বক্তা বলেছিলেন আই এ আজুরে ট্রাক বিক্রির টাকা দিয়ে প্রতি বিপ্লব ঘটিয়ে নির্বাচিত জনপ্রিয় সরকার গুলিকে প্রতিশ্রুত করছে। এন্টি ড্রাগ অপারেশন্স পিয়ারা নিয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে তুলেছে সমন্তরাল প্রশাসন যা শুধুই অন্যদেশে দখলদারিত্বের সাহায্য করেছে মাদক চোরাচালান দ্বারা অর্জিত টাকাপয়সা বাহির করা হচ্ছে বিরুদ্ধে চোখ রাঙানোর থেকে অস্ত্র প্রদর্শন এমনকি যুদ্ধ ও গণহত্যার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে রয়েছে আমাদের ঘরের ছেলেগুলির নেশার জগতে হারিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক কাহিনী।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১) বিনিসুতোয়- সমরেশ মজুমদার- দেশ ‘৯১
২) দ্বারকানাথ ঠাকুর- এনবিটি
৩) বেদের পরিচয়-যোগিরাজ বসু- ফার্মা কে এফস তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১২৮-১২৯
৪) ল্যাটিন আমেরিকা-সাম্রাজ্যবাদের কাছে চ্যালেঞ্জ, রবি কুশারী, সমন্বয় শারদ সংখ্যা, ২০০২
৫) সি আই এ-র লক্ষ্য ভেনেজুয়েলা, সুমিত বন্দোপাধ্যায়, তোমার ছেলে সকালবেলা উঠে কি বলছে আমাকে আদালত, ঈদসংখ্যা ২০০৯
৬) ইসলামি সংস্কৃতি, বর্ষ-২, সংখ্যা-৬, ২০০১
৭) ড্রাগ মাফিয়া ও রাজনীতি-রঞ্জিত গুপ্ত, দেশ, ১৩-ই মে, ২০০৯