লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
‘কুশারী বংশের পঞ্চানন ঠাকুর পাথুরেঘাটা, জোড়াসাঁকো ও কয়লাঘাটের ঠাকুর গােষ্ঠীর আদি পুরুষের অন্যতম। পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম। জয়রামের চার পুত্র এক কন্যা।’
‘কুশারী বংশের জয়রাম ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র গােবিন্দরাম ঠাকুর। এঁর সঙ্গে বিয়ে হয় খুলনার দক্ষিণ ডিহী গ্রামের নন্দরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে রামপ্রিয়া দেবীর। গােবিন্দরামের মৃত্যুর পর রামপ্রিয়া দেবী তার বিষয় আশয় গােবিন্দ রামের অগ্রজদের কাছ থেকে আলাদা করে নেন সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে। রামপ্রিয়া ভ্রাতুস্পুত্র জগন্মােহনকে প্রতিপালন করতে শুরু করেন, তাঁকে কলকাতার হাড়কাটা অঞ্চলে একখানা বাড়ি করে দেন। তিনি জগন্মােহনের বিবাহ দেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামা কেনারাম রায়চৌধুরীর মেয়ে শিরােমণির সঙ্গে। এবার আবার নতুন করে একটা যােগাযােগ ঘটলাে।’ [সূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পুলক চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৮]
জগন্মােহন ভােজন এবং সংগীত রসিক ও সংগীত শিল্পে পারদর্শী ও গুণগ্রাহী ব্যক্তি ছিলেন। জগন্মােহনের ছিল চার পুত্র। দ্বিতীয় পুত্র রসিকালের দুই মেয়ের বিয়ে হয় দ্বারকানাথের ভাগ্নে আর দাদার পৌত্রের সঙ্গে। চতুর্থ সন্তান শ্যামলালের তৃতীয় কন্যা কাদম্বিনীর (Kadambari Devi) জন্ম ১৮৫৯ সালের ৫ই জুলাই। ৯ বছর বয়সে, ১৮৬৮ সালের ৫ই জুলাই কাদম্বিনীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কাদম্বিনী হয় নিরক্ষরা ছিলেন। অনেকের মতে তাঁর সামান্য অক্ষরজ্ঞান ছিলেন।
পাত্র দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) নতুন দাদা। তখন বয়স উনিশ বছর দু’মাস। রবীন্দ্রনাথের বয়স সাত বছর দুই মাস। কাদম্বরী দেবীর বয়স ৯ বছর।
কাদম্বরী দেবীর (Kadambari Devi) শৈশব সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা যায় না। শুধুমাত্র এইটুকুই অনুমান করা যায়, যেহেতু এক সঙ্গীতরসিক পরিবারে জন্মেছিলেন, গান গাইতে না পারুন অন্ততঃ তাঁর ‘গানের কান’ ভাল ছিল।
যাইহােক এই কাদম্বরী দেবীর বিয়ে নিয়ে খানিকটা মতভেদ দেখা যায়। জানা যায় পাত্রী নির্বাচন করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ তখন জোড়াসাঁকোতে ছিলেন না। তাঁর ইচ্ছে ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে তিনি বিলেত নিয়ে যাবেন। তাঁর ধারনা ছিল যে, বিয়ে হয়ে গেলে, জ্যোতিকে আর বিলেত যাওয়া সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়তঃ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত যাবার আগেই নারী জাগরণের পক্ষপাতি ছিলেন। বিলেত থাকাকালীন তাঁর সেই বিশ্বাস আরাে সুদৃঢ় হয়। সুতরাং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় ৯ বছরের শিশু বয়সের কাদম্বরীর সঙ্গে, যার বলতে গেলে অক্ষর জ্ঞানই হয় নি, সেই শিশু বয়সী নাবালিকার সাথে নতুনের অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্রের বিয়ে মানতে পারেন নি। তাছাড়া তিনি এও বলেন, “শ্যাম গাঙ্গুলীর ৮ বৎসরের মেয়ে—আমি যদি নতুন হইতাম’ তবে কখনই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।” সুতরাং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তিনি এই বিয়েতে বেশ বিচলিত হয়েছিলেন এবং অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন। কারণ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি কাদম্বরী দেবীর পিতা শ্যাম গাঙ্গুলীকেও ভাল চোখে দেখেন নি এবং শ্যাম গাঙ্গুলী সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথের ভাল ধারনা ছিল না। তাই শ্যাম গাঙ্গুলীর মেয়ে ভাল মেয়ে হতে পারে না বলে এক পত্রে মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল এবং সেটাও তিনি পত্রের মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন,
“জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এই-ই ভাগ্য। একে ত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেনীর লােকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে যােগ দিতে চাহে না, তাহাতে আবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুষ্ঠানের জন্য পিরালীরা আমাদের ভয় করে। ভবিষ্যৎ তােমাদের হস্তে—তােমাদের সময় এ সঙ্কীর্নতা থাকিবে না। দেবেন্দ্রনাথের কথাতেই স্পষ্ট তাঁর পরিবার ঐ সময় আর্থিক দিয়ে স্বচ্ছল হলেও, সামাজিক দিক দিয়ে একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। বস্তুতঃ তারা ছিলেন এক ঘরে।”
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিয়েতে অমতের আরো একটা কারণ ছিল, সেটা প্রকাশ পায় তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর এক পত্রে, চিঠিতে জ্ঞানদানন্দিনী উল্লেখ করেছেন,
“যে সূর্যকুমার চক্রবর্তীকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ডাক্তারী শেখাতে বিলেত নিয়ে গিয়েছিলেন তার বড় মেয়ে মিস্ কার্পেনটারের সঙ্গে বিলেত থেকে এসেছিল। …সে আমার বড় ছিল। শ্যামলা রঙের উপর তার মুখশ্রী ভাল ছিল। তাকে আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে দিতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল, কলকাতায় এসে তাকে দেখিয়েও ছিলুম।”
এখানে একটা সাধারণ প্রশ্ন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য যদি মেয়ে পাওয়া এতই কঠিন হয়ে থাকে তা হলে সূর্য চক্রবর্তীর মেয়েকে দেবেন্দ্রনাথ পাত্রী হিসাবে নির্বাচন করলেন না কেন?
তাই অনেকে অনুমান করেন যে কাদম্বিনীকে সত্যেন্দ্রনাথেরও অপচ্ছন্দ এই কারণে যে তাঁর সূর্য চক্রবর্তীর মেয়েকে পছন্দ ছিল।
তবে যাইহােক, এত মতান্তর ও প্রতিকূলতা সত্বেও শেষ পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বিনীর (Kadambari Devi) বিয়ে হয়ে গেল।
ঠাকুর পরিবারের এই বিবাহের খবর ১৮৭০ সালের শ্রাবণ সংখ্যার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল—
“গত ২৩ আষাঢ়, ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পঞ্চমপুত্র শ্রীমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত কলিকাতা নিবাসী শ্রীযুক্তবাবু শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যার যথাবিধি ব্রাহ্মধর্মের পদ্ধতি অনুসারে শুভবিবাহ সমারোহপূর্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বিবাহসভায় বহু সংখ্যক ব্রাহ্ম এবং এতদ্দেশীয় প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণ সকল উপস্থিত ছিলেন। দরিদ্রদিগকে প্রচুর তক্ষ্যভোজে পরিতৃপ্ত করিয়া বিস্তর অর্থ প্রদান করাও হইয়াছিল।”
কাদম্বরী দেবী আর জ্যোতিরিন্দ্রের এই বিয়েটা খুব একটা সুখের ছিল না। দু’জনের মধ্যে ছিল দূরত্ব যথেষ্ট দুরত্ব বজায় ছিল। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই কাদম্বরী দেবীকে নিচু চোখে দেখত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রায়ই বলতেন,
“নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কী যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায় ওর বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নীচু হয়, সেই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায় হয়তো, সুখী হওয়া যায় না। নতুন তো সারাক্ষণ আমার কাছেই পড়ে থাকে। গান বাজনা থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের দুঃখটা ভুলে আছে।”
এই বিয়েতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে খুব অখুশি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি পড়লে তা একবারও মনে হয় না। তিনি লিখছেন,
“দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপার রেকাবিতে বেলফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক গ্লাস বরফ দেওয়া জল আর বাটিতে ছাঁচি পান। বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনো তা ফিরিয়ে নেননি। সূর্যডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে।” [সূত্রঃ বর্তমান পত্রিকা, অনলাইন সংস্করণ, শনিবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯]
কাদম্বিনী দেৱী (Kadambari Devi) কিঞ্চিত শ্যামবর্ণা হলেও সুন্দরী ছিলেন। বিশেষ করে তার চুল এবং চোখের প্রশংসা তখন সবাই করত। জ্ঞানদানন্দিনী বলেছেন, আমরা বউয়েরা প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম। শাশুড়ি ননদ সকলেই গৌর বর্ণা ছিলেন। প্রথম বিয়ের পর শ্বাশুড়ি আমাদের রূপটান ইত্যাদি মাখিয়ে রং সাফ করার চেষ্টা করতেন। [সূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পুলক চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩০]
স্বামীর দৃপ্ত পদচারণার তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা নিষ্প্রভই ছিলেন কাদম্বরী (Kadambari Devi)। কিন্তু তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। লোকজন চারপাশে বসিয়ে অনর্গল গল্প করে আসর মাতিয়ে রাখার যে প্রবণতা দেখা যেত সে সময়ের ড্রয়িংরুম কালচারের কর্ণধার সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ভেতর, সেটা তার ভেতর একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। আসরের মধ্যমণি নয়, তিনি স্বস্তি পেতেন নিজের মনে একা একা থেকে- নিজের কল্পনার আকাশে। রাজ্যের বই তার সঙ্গী ছিল একাকীত্বের। দীর্ঘাঙ্গী,গাঢ় ভ্রূ, বড় বড় অক্ষিপল্লব, কৌতুকময় চোখ, পরিমিত বেশভূষা, কথা বলার ভঙ্গী সবকিছু নীরবে জানান দিত তার ব্যক্তিত্বের মহিমা। জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতন না, তার সৌন্দর্য ছিল গ্রীক দেবীর মতন। স্বল্পভাষী, রহস্যময়ী, প্রচণ্ড অভিমানী- জেদী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মায়ের স্নেহপরায়ণা, বালিকার মত উচ্ছল স্বভাবের। কঠিন কোমলের অপূর্ব সমন্বয় এই নারীকে তাই রবি ডাকত গ্রীক দেবী হেকেটি নামে।
তবু কিছুটা নিজের মধ্যে গুটানো এই মানুষটাকে ভুল বোঝেনি এমন খুব কম মানুষই ছিল সে সময়। শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে তিনি ছিলেন দেমাগী, মিশতে পারে না একদমই। এর উপর ছিলেন নিঃসন্তান। রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে ঊর্মিলা ছিল কাদম্বরীর ভারী ন্যাওটা। পরে ঊর্মিলা যখন মারা গেল, আত্মীয়স্বজন, ঝি-ঠাকুর সবাই কানাঘুষা করা শুরু করল কাদম্বরী হল আঁটকুড়ি, হিংসা করে খেয়ে ফেলেছে এত্তটুকুন মেয়েটাকে।
স্বামী দিনরাত ব্যস্ত কাজ নিয়ে, নাহলে নাটক- নভেল নিয়ে। তাদের দুজনের মনের মিলও তেমন ছিল না। তাই স্ত্রীর মর্যাদা পুরোপুরি তিনি কখনো পাননি। যে তলার মানুষের সাথে তার স্বামীর চলাফেরা সেখানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারতেন না কাদম্বরী। তাই তার দিন কাটতো জোড়াসাঁকোর তেতলায়। একা। তার একাকীত্ব আর অবসাদের জীবনে ছোট্ট একটা ছুটির মতন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাত্র দুই বছর ব্যবধান তাদের বয়সের। তাই সেই দশ বছর বয়সে বউ সেজে যে টুকটুকে মেয়েটি এসেছিল, তার সাথে রবির ভাব করে নিতে এতটুকু বেশি সময় লাগেনি। প্রায় সমবয়সী ছিল দেখে বন্ধুত্বও ছিল সমানে সমানে। রবির যত টুকিটাকি আবদার সব সে এসে করত নতুন বৌঠানের কাছে। আর বৌঠান শুনতে চাইতো রবির লেখা নতুন কোন কবিতা অথবা গল্প। পরস্পরের সান্নিধ্যে তারা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল দিনগুলি।
সময়টা তখন সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে প্রবেশের। সময়টা তখন কিছুটা লোখচক্ষুর আড়ালে থাকবার বয়সের। সদ্য যুবক রবি তখনও হয়ে উঠেনি দেশবরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুইবার বিলেত থেকে পড়াশুনা শেষ না করেই ফিরে আসা রবির তখন আত্মীয়স্বজনের বাক্যবাণ থেকে বাঁচতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সে সময় তার ত্রাণকর্তা হিসেবে রঙ্গমঞ্চে এলেন নতুনদা। দাদা-বউদির সাথে সে অবকাশ যাপন করতে লাগল চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির দিনগুলির কথা ঘুরে ফিরে অনেক বার এসেছে তার লেখায়।
নিভৃত সাহিত্যচর্চার এই সময়টি ছিল রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) জীবনের অন্যতম সুন্দর সময়। সে সময় রবির সব লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন কাদম্বরী। কী অসাধারণ সূক্ষই না ছিল তার রুচিবোধ, সৌন্দর্যবোধ আর সাহিত্যজ্ঞান! লেখার প্রশংসা, প্রেরণা কিংবা সমালোচনা- কাদম্বরীর জায়গা নিতে পারেনি পরবর্তীতে কেউই। রবির অসংখ্য লেখায় কিংবা গানে ছায়া পাওয়া যায় শ্রীমতি হে’ এর। একি সাথে তিনি ছিলেন রবির দেবী, হৃদয়ের রাণী, খেলাঘরের সাথী, বিচক্ষণ পাঠিকা। তার রূপের বর্ননা, তাদের কাটানো সময়ের কথা, তাদের খুনসুটি- এসব নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গান। ‘বউঠাকুরানির হাট’ উপন্যাসের পরিকল্পনা তিনি দুপুরবেলা বউঠানের পাশে বসে হাতপাখার বাতাস খেতে খেতেই করেছিলেন।” [রোর মিডিয়া]
রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) ‘ছেলেবেলায় এই বিয়ে সম্পর্কে লেখা আছে,
“এমন সময় বাজল সানাই বারােয়া সুরে। বাড়িতে এল নতুন বৌ, কচি শ্যামল হাতে সরু সােনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফঁাক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনা শােনার বাইরে সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে। ও এসে বসেছে আদরের আসনে, আমি যে হেলাফেলার ছেলে মানুষ।”
দেবেন্দ্রনাথ বিয়ে ঠিক করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি এই বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলেন। কারণ সেই সময় তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের উপস্থিত থাকার কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। বিয়ের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন গণেন্দ্রনাথ। বেশ সমারােহ করেই এই বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছিল। ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও বিয়ে হয়েছিল হিন্দু প্রথায়। বিবাহ উপলক্ষ্যে বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় জুতাে ইত্যাদি উপহারস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল।
এখানে প্রশান্ত কুমার পালের একটি প্রাসঙ্গিক মতামত দেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,
“জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্বন্ধে দেবেন্দ্রনাথের মনে কোন কারণে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। যার জন্যে তিনি বাড়িতে ফিরতে অনিচ্ছুক ছিলেন, ফলে জ্ঞানদানন্দিনীর অন্য কোন বাড়িতে থাকার কথাও চিন্তা করা হচ্ছিল ইত্যাদি এক অনির্দেশ্য পারিবারিক অশান্তির ইঙ্গিত সত্যেন্দ্রনাথের পত্রের মধ্যে পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর বােম্বাই যাত্রার পূর্বেই বাড়িতে ফিরে আসেন।”
দেবেন্দ্রনাথের ছোট ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম ছিল কাদম্বিনী। সেই জন্যেই জ্যোতির বৌ, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান এবং ঠাকুর বাড়ির নতুন বৌ কাদম্বিনীর নাম পালটে করা হল কাদম্বরী।
আগেই বলা হয়েছে যে, কাদম্বরী দেবীর হয় অক্ষর জ্ঞান ছিল না অথবা যদিও ছিল তা খুবই সামান্য। তাই অন্যান্য বধূদের মত কাদম্বরীরও বিদ্যাচর্চা শুরু হল একেবারে প্রথমিক পর্যায় থেকে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল ১৮৪৯ সালের ৪ঠা মে। সেন্ট পলস স্কুল, মন্টেগুস এ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলে পড়াশুনা করে কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ন হন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু নানা কারণে পড়াশুনার ব্যাপারে বেশিদূর এগােতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠার ব্যাপাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। বলা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রজীবনে জ্যোতির্ময়। প্রভাত মুখােপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন,
“জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বহুমুখীনতা রবীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর ভাবে প্রতিফলিত এবং সুন্দর রূপে সার্থক হয়েছিল।”
রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) ছিলেন জ্যৈদা ভক্ত। তেমনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর মেজদা, সত্যেন্দ্রনাথের ভক্ত। এতটাই যে, কলকাতায় পড়াশুনা ছেড়ে মেজদার সঙ্গে বােম্বাই চলে যান। সেখানে দাদা-বৌদির সঙ্গে প্রায় সাত মাস ছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীও তাঁর প্রিয় বৌঠান ছিলেন। বোেম্বাই থাকাকালীন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফরাসি শিখেছেন, ছবি আঁকা এবং সেতার শিক্ষাও করেন। বােম্বাই থাকাকালীনই জ্ঞানদানন্দিনীর মনে আসে সূর্য কুমার চক্রবর্তীর মেয়ের কথা। জ্ঞানদানন্দিনীর একটা স্বভাব ছিল এই যে, তিনি যা চাইতেন, সেটা পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। যদিও দেবেন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তকে পাল্টতে পারেন নি। অবশ্য সূর্যকুমারের স্ত্রীরও জ্ঞানদানন্দিনীর এই প্রচেষ্টার সমর্থন তাে ছিলই না, বরং মেয়েকে না করেছিলেন। আগেই বলেছি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফেরার পর ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহলে পরিবর্তনের হাওয়া আনেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পর্দা প্রথা আমাদের জাতির নিজস্ব নয়, মুসলমান রীতির অনুকরণ। অবরােধ প্রথা আসলে অনিষ্টকর কুপ্রথা। যদিও নিজের স্ত্রীকে অন্দর মহল থেকে হটিয়ে বাইরে আনতে পারেন নি। কিন্তু দুবছর পর যখন বােম্বাই থেকে ফিরলেন, তখন কিন্তু আর পালকিতে চড়ে অন্দরমহলে যেতে হয় নি। বলাই বাহুল্য, স্ত্রীও সত্যেন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ফলে অন্দর মহলে তিনি একঘরে হয়ে পড়েন এবং ভয়ের পাত্রী হিসেবে পরিগণিত হন। [সূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পুলক চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩০/৩১]
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার জীবনে সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,
“…মেজদাদা বিলাত হইতে ফিরিয়া আমাদের পরিবারের যখন আমূল পরিবর্তনের হাওয়া বহাইয়া ছিলেন, তখন আমারও মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। তখন হইতে আর আমি অবরােধ প্রথার সমর্থক নহি; বরং ক্রমে একজন সেরা নব্যপন্থী হইয়া উঠিলাম… স্ত্রী স্বাধীনতার শেষে আমি এতবড় পক্ষপাতী হইয়া পড়িলাম যে, গঙ্গার ধারের কোন বাগান বাড়িতে সস্ত্রীক অবস্থানকালে আমার স্ত্রীকে আমি নিজেই অশ্বারােহন পর্যন্ত শিখাইতাম। তাহার পরে জোড়াসাঁকোতে আসিয়া দুইটি আরব ঘােড়ায় দুইজনে পাশাপাশি চড়িয়া বাড়ি হইতে গড়ের মাঠ পর্যন্ত প্রত্যহ বেড়াইতে যাইতাম। ময়দানে পৌঁছিয়া দুইজনে সবেগে ঘােড়া ছুটাইতাম। প্রতিবেশীরা স্তম্ভিত হইয়া গালে হাত দিত। রাস্তায় লােকেরা হতভম্ব হইয়া থাকিত……..এইরূপে অন্তঃপুরের পর্দাতাে উঠাইলামই, সঙ্গে সঙ্গে চোখের পর্দাটিও একেবারে উঠিয়া গেল।”
‘শ্যামলাল গাঙ্গুলীর ন’ বছরের মেয়ে হলেন ঠাকুর বাড়ির নতুন যুগের অশ্বরােহিনী বীরাঙ্গনা’ (কবি মানসী : জগদীশ ভট্টাচার্য)।
ব্যাপারটা ভাবতে গেলে আমাদের কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে হয় বই কি! কখনাে কখনাে মনে হয়, অতিশয়ােক্তি নয় তাে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলায় লিখেছেন, ঠাকুরবাড়িতে নতুন বৌ-এর আবির্ভাবে অতঃপুরের পুরনাে আইন পালটালাে। বাড়িতে নতুন আইন চালালেন কত্রী। বৌঠাকুরনের জায়গা হল বাড়ির ভিতরের ছাদের লাগাও ঘরে। সেই ছাদে তারি হল পুরাে দখল। …বৌ-ঠাকরুন এলেন, ছাদের ঘরে বাগান দিল দেখা। উপরের ঘরে এল পিয়ানাে, নতুন নতুন সুরের ফোয়ারা ছুটল।..ছাদটাকে বৌঠাকরুন একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন।
আবার কাদম্বরী দেবীর (Kadambari Devi) গৃহিনী মূর্তির বর্ণনার ঐ ‘ছেলেবেলা’তে লিখেছেন,
“বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালাে, খাওয়াতে ভালবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন।”
‘ভারতী’ গােষ্ঠী যখন প্রতিষ্ঠিত হল, কাদম্বরীদেবী হয়ে উঠলেন ভারতী মধুচক্রের মক্ষীরানী। কবি অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী বলেছেন, প্রকৃত পক্ষে ‘ভারতী’ জ্যোতিরীন্দ্রর মানস কন্যা। বস্তুতপক্ষে তিনতলা তখন সর্বদা ভারতী উৎসবে মুখরিত। নাম দেওয়া হয়েছিল নন্দন কানন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, নতুন কাকিমা অর্থাৎ জ্যোতিকার স্ত্রী ছিলেন এই বৈঠকের কত্রী। এখানে চলত গান, বাজনা, কবিতার পর কবিতা পাঠ।
কাদম্বরী দেবীর (Kadambari Devi) এত গুণাবলির কথা জানতে পেরে আমাদের মনে হয় জগদীশ ভট্টাচার্য তাঁর কবিমানসীতে যে মন্তব্য করেছেন তা যথার্থঃ …একটি দেশে একটি যুগে রবীন্দ্রনাথের মত প্রতিভা নিয়ে একটিমাত্র কবিরই যেমন আবির্ভাব হয়, তেমনি সেই পূর্ণ বিকাশের প্রেরণার জন্য যে জ্যোতির্ময়ী দিব্যশক্তির প্রয়ােজন হয় তিনিও হন অনন্যা, অদ্বিতীয়া। [সূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পুলক চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩২]
তথ্যসূত্রঃ
- ১) রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী – পুলক চট্টোপাধ্যায়
- ২) ‘প্রথম আলো’ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
- ৩) রোর বাংলা
- ৪) বর্তমান পত্রিকা
- ৫) রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।