লিখেছেনঃ আশরাফ উল ময়েজ
সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানবসমাজে প্রবেশ করে ক্রীতদাস প্রথা। আদি মানুষ যখন শিকার করে জীবন ধারণ করত কিংবা আদিযুগের কৃষক সমাজে ক্রীতদাসের কোনাে প্রয়ােজন হয়নি। কারণ তারা খুব সহজেই শিকার করতে পারত কিংবা অল্প পরিশ্রমেই প্রয়ােজনের জন্য যতটুকু খাবার দরকার তা জন্মাতে পারত। তখন মানুষের জীবনধারণের জন্য দুটি হাতই যথেষ্ট ছিল। তখন অপর কোনাে মানুষকে ক্রীতদাস বানানাের কোনাে বাড়তি সুবিধা ছিল না।
একসময় মানুষ শহর ও বড় বড় নগরীতে বসতি স্থাপন করতে লাগল । কিন্তু তখন বড় শহরগুলােতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপন্ন হতাে না যদিও গ্রামাঞ্চলে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতাে এবং তা অতিরিক্ত পরিমাণে। এই অতিরিক্ত শস্য তখন শহরগুলােতে সরবরাহ করা হতাে। তা ছাড়া শহরগুলোতে নানা ধরনের পণ্য উৎপন্ন হতাে, যার জন্য প্রয়ােজন হতাে শ্রমিকের। একটি কৃষিখামারে কিংবা পণ্য উৎপাদন ফ্যাক্টরিতে যত সস্তায় শ্রম পাওয়া যেত লাভের পরিমাণ হতাে তত বেশি। তাই কত সস্তায় শ্রমিক জোগাড় করা যায়, তার প্রতিযােগিতা শুরু হয়। আর এ অবস্থাতেই ক্রীতদাস প্রথার শুরু হয়।
প্রত্যেক সভ্যতার আদিযুগেই ক্রীতদাস ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তা ছাড়া সহজে যুদ্ধ জয়ের জন্যও প্রয়ােজন হতাে ক্রীতদাস যােদ্ধা। ক্রীতদাস প্রথা প্রচলন হওয়ার এটিও অন্যতম বড় কারণ। আদিযুগের যুদ্ধগুলােও ছিল খুব নির্মম। কোনাে একটি বাহিনীর হাতে কোনাে শহরের পতন হওয়ার পর সেখানকার কর্মক্ষম মানুষদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হতাে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করানাের জন্য আর বাকিদের হয়তাে বা মেরে ফেলা হতাে।
ক্রীতদাস প্রথা শুরু হওয়ার আরাে কারণ রয়েছে যেমন- দস্যুরা অপহৃত ব্যক্তিদের নিকট হতে মুক্তিপণ পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা না থাকলে তাদেরকে বিক্রয় করে দিত। আবার অনেক সময় মুক্তিপণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করার জন্য তাদেরকে বিক্রয় করা হতাে কিংবা নিজেরাই তাদেরকে ক্রীতদাসের মতাে ব্যবহার করত। সভ্যতার একটি সময়ে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ক্রীতদাসের মতাে শ্রম দিতে বাধ্য করা হতাে। অনেক সময় ঋণ পরিশােধ করতে না পারলে নির্দিষ্ট সময় শ্রম দিয়ে ঋণ পরিশােধ করার সুযােগ দেওয়া হতাে যা বর্তমান যুগেও কোনাে কোনাে স্থানে প্রচলিত। দরিদ্র পরিবার অনেক সময় তাদের সন্তানদেরকে বিক্রয় করে দিত। আর স্বাভাবিকভাবেই ক্রীতদাসের সন্তানও ক্রীতদাস হবে- এটিই ছিল নিয়ম। এভাবেই সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানবসমাজে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন হয়।
ক্রীতদাস প্রথা : আদিযুগ
অনেক সংস্কৃতিতেই দাস প্রথার লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ বৎসর পূর্বে, মিশরের নিমাঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কবরে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় তৎকালীন লিবিয়ার অধিবাসীরা সান (San Tribe : আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে বসবাসকারী এক উপজাতি) উপজাতিসহ আরাে অনেক গােত্রের লােকজনকে ক্রীতদাস হিসেবে রাখত।
শিকারি ও গাছের ফলফলারি খেয়ে জীবন ধারণ করে (Hunter-Gathere) এমন শ্রেণির মধ্যে ক্রীতদাস প্রথার তেমন একটা প্রচলন ছিল না। আবার একটি সময়ে যখন প্রচুর পরিমাণে আবাদি জমি ছিল তখন কৃষিকাজ করে অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়ােজন হয়। এর ফলে তখন গণহারে ক্রীতদাস নিয়ােগ করার প্রয়ােজন হয়েছিল। ঠিক এ কারণেই ১১,০০০ বৎসর পূর্বে নিওলিথিক বিপ্লবের পর দাস প্রথা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ক্রীতদাস প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি তখন অনেক সমাজই দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব ১৭৬০ অব্দের কোড অব হামমুরাবি (Code of Hammrabi)’র আইনকে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যেখানে বলা হয়েছে যদি কেউ কোনাে ক্রীতদাসকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে কিংবা পালিয়ে যাওয়া কোনাে ক্রীতদাসকে আশ্রয় দিলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। বাইবেলেও দাস প্রথার স্বীকৃতি রয়েছে।
ক্রীতদাস প্রথা মােটামুটিভাবে সব সভ্যতার সমাজেই হিল যেমন সুমের (Sum), প্রাচীন মিশর (Ancient Egypt), প্রাচীন (Ancient China), আক্কাদিন সাম্রাজ্য (Akkadian Empire), আসিরিয়া সাম্রাজ্য (Assyria), প্রাচীন ভারত (Ancient India), প্রাচীন গ্রিস (Ancient Greece), রােমান সাম্রাজ্য (Roman Empire), আরবের খলিফা শাসনামল (Islamic Caliphate), ইহুদি সাম্রাজ্যের প্যালেস্টাইন (Hebrew kingdoms in Palestin), আমেরিকার কলম্বাস-পূর্ব (Pre-Columbian Civilizations) সভ্যতা ইত্যাদি।
এ সকল সভ্যতার সময় দাস প্রথা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার কারণ ছিল ঋণের পরিশােধে ব্যর্থতা, অপরাধের শাস্তি, যুদ্ধবন্দি ও শিশু পরিত্যক্ত করা। উল্লেখ্য যে, ক্রীতদাসের সন্তানও মালিকের ক্রীতদাস হয়ে যেত আপনাআপনি ভাবেই।
ব্যাবিলনের ক্রীতদাস : খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতক
ক্রীতদাস প্রথা সম্পর্কে আদি সমাজেও জানা যায় তা হল ক্রীতদাস ছিল মালিকের মূল্যবান সম্পত্তির একটি। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫৪ অব্দের প্রাচীন মেসােপটামিয়ার সাম্রাজ্যের যে আইন ছিল তা ব্যাবিলনের আইন কোড বা কোড অব হামমুরাবি (Code of Hammurabi) নামে পরিচিত। ব্যাবিলনের ষষ্ঠ সম্রাট হামবুরাবি এই আইনের প্রতিষ্ঠাতা। তাই এই আইনগুলােকে কোড বা কোড অব হামমুরাবি বলা হয়। হামমুরাবি কোডে মােট ২৮২টি আইন রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে হামমুরাবি কোডে শৈল্য চিকিৎসকদের ক্রীতদাস ও মুক্ত ক্রীতদাসদের চিকিৎসার প্রদানের ওপর শাস্তি ও পুরস্কারের কথা বর্ণনা আছে। হামিমুরাবি কোডে দেখা যায় ক্রীতদাসদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ সহনশীল পর্যায়ে ছিল এবং সে আমলের ক্রীতদাসরা নিজস্ব সম্পত্তির মালিকও ছিল। কিন্তু আদি সভ্যতার মধ্যে গ্রিক সমাজে ক্রীতদাসদের বিস্তারিত জানা যায় এবং প্রাচীন গ্রিস সমাজ গঠনে ক্রীতদাসদের ভূমিকাও ছিল যথেষ্ট।
গ্রিক ক্রীতদাস : খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতক
প্রাচীন গ্রিসের দুই শীর্ষ রাষ্ট্র স্পার্টা (Sparta) ও এথেন্স (Athens) সম্পূর্ণ শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল ছিল যদিও তা ছিল জোরপূর্বক বাধ্যতামূলক শ্রম। স্পার্টাতে ক্রীতদাসরা ছিল মূলত ভূমিদাসের মতাে। এথেন্সের ক্রীতদাসের সাথে পার্থক্য ছিল এই যে, স্পার্টার হেলট (Helot) যােদ্ধা জাতি নিজস্ব পরিচয় নিয়ে থাকলেও তারা তাদের মালিকদের শ্রম দিতে বাধ্য ছিল; আর তাদের মালিকরা ছিল স্পার্টার প্রকৃত অধিবাসী। তারা মূলত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতেন।
স্পার্টার লেকোনিয়া (Laconia) ও মেসেনিয়া (Messenia) অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীই ছিল হেলট এবং তারা ক্রীতদাস হলেও তাদের বেশ অধিকারও ছিল।
এথেন্সের ক্রীতদাস প্রথায় ক্রীতদাসদের কোনাে স্বীকৃত অধিকারই ছিল, যা ছিল রােমের বিপরীত। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অনেকটাই নির্ভর করত তারা কোনাে ধরনের কাজ করছে তার ওপর। ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে হতভাগ্য ছিলেন ক্রীতদাস, যাঁরা খনিতে কাজ করতেন তাঁরা। মালিকের নির্দেশে তাদেরকে জীবন বাজি রেখে খনিতে কাজ করতে হতো। তখন খনিগুলাে সরকারি মালিকানার হলেও এথেন্সের সরকার তা ব্যক্তিমালিকানায় লিজ দিয়ে দিতেন।
আবার অপর শ্রেণির ক্রীতদাস রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিলেন যেমন সিথিয়ান আর্চার (Scythian Archers) বা সিথিয়ান তীরন্দাজ বাহিনী (Scythian : ইরানের বংশােদ্ভূত যাযাবর সম্প্রদায়, যারা সেন্ট্রাল এশিয়াতে বসবাস করত)। এই সিথিয়ান তীরন্দাজরা এথেন্সের পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিল এবং তারা ক্রীতদাস হলেও বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
এথেন্সের ক্রীতদাসদের অধিকাংশই গৃহশ্রমিক হিসাবে কাজ করত। তাদের জীবনযাপন ও ভাগ্য পুরােপুরি নির্ভর করত মালিকের সাথে তার সম্পর্ক কত গভীর তার ওপর। নারী ক্রীতদাসদের সাধারণত মালিকের বাড়ির শিশুদের লালন-পালন ও দেখভাল করতে হতাে এবং একই সাথে মালিকের কনকুবাইন হিসেবেও থাকতে হতাে। পুরুষ ক্রীতদাসদের ভূমিকা ছিল অনেকটাই স্টুয়ার্ডদের মতো, যাকে বিশেষ করে বাড়ির বাইরের সকল ধরনের কাজই করতে হতাে।
এথেন্সের তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় কোনাে পুরুষের জন্য গৃহস্থালি কাজ করা খুব লজ্জার বিষয় ছিল, ক্রীতদাসদের বেলায়ও অনেকটা তাই ছিল। তাই পুরুষ ক্রীতদাসদের সাধারণত মালিকের সেক্রেটারি ধরনের কাজগুলাে করতে হতাে। এককথায় বলা যায়, তারা ছিল মালিকের ব্যক্তিগত সচিবের মতাে, যাকে ব্যাকিংসহ মালিকের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখতে হতাে।
ক্রীতদাস প্রথা : ক্লাসিক আদিযুগ
প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্য
গ্রিসের ক্রীতদাস ইতিহাস অনেক পুরনাে। ব্রোঞ্জ যুগের সময় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০১১০০ অব্দে গ্রিসে ক্রীতদাস ছিল, দক্ষিণ গ্রিসের প্রত্নতাত্ত্বিক শহর মাইসিনা (Mycenae) খননকালে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ঠিক কবে থেকে গ্রিসে ক্রীতদাস প্রথা শুরু হয়েছে তা জানা না গেলেও গ্রিক সাম্রাজ্যের অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ক্রীতদাস এবং ধীরে ধীরে নগরীগুলাে গড়ে উঠতে থাকলে ক্রীতদাস থাকাটা অত্যাবশকীয় হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয় যে, এথেন্সের নাগরিকদের একটা বড় অংশেরই অন্তত একজন করে ক্রীতদাস ছিল।
প্রাচীনকালের অধিকাংশ লেখনীতেই দেখা যায় প্রয়ােজনের কারণেই ক্রীতদাস প্রথার জন্ম হয়েছে। পরবর্তীতে সক্রেটিসের ডায়ালগে (Socratic Dialogues) বিচ্ছন্নভাবে ক্রীতদাস প্রথার বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু স্টয়িকই (Stoic) প্রথম দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী, যিনি ক্রীতদাস প্রথাকে অভিযুক্ত করেছেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৮ম ও ৭ম শতকে স্পার্টা (Sparta) ও মেসিনিয়ার (Messenia) মধ্যকার দুই যুদ্ধে স্পার্টানরা মেসিনিয়ার প্রায় সকল অদিবাসীকেই বিশেষ ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত করে, যা হেলট (Helot : লেসােনিয়া ও মেসিনিয়ার অধিবাসী যা এবং স্পার্টানরা এই অঞ্চল শাসন করতেন) নামে পরিচিত। গ্রিক দার্শনিক ও পণ্ডিত হেরােডােটাসের (Herodotus) মতে, হেলটদের সংখ্যা স্পার্টানদের সংখ্যার ৭ গুণ ছিল। পরবর্তীকালে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে হেলট ক্রীতদাসদের বেশ কিছু বিদ্রোহের কারণে সেখানে বিদ্রোহ দমন ও হেলটদের নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানকার হেলট নেতাদের বিশেষ সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ করে হেলট বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রাচীন অনেক গ্রিক শহরে ক্রীতদাসদের সংখ্যা মােট জনসংখ্যার প্রায় ৩০%-এর মত ছিল। এই ক্রীতদাসদের তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতাে এবং তাদের বেশ আর্থিক সুবিধাও দেওয়া হতাে। এই হেলট ক্রীতদাসদের স্ট্যাটাস ছিল মুক্ত ও ক্রীতদাসের মাঝামাঝি পর্যায়ের।
ক্রীতদাস প্রথা : প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্য
গ্রিক ও ফোনেসিয়ান সভ্যতা (Phoenicians : বর্তমান লেবানন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক সভ্যতা যা খ্রিস্টপূর্ব ১২৪০-৫৩৯ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল) থেকে উত্তরাধিকার হিসেবেই ক্রীতদাস প্রথাকে পেয়েছে রােমানরা। রােমান রিপাবলিক বাইরের দিকে যতই বিস্তৃতি লাভ করার সাথে সাথেই সেখানকার সকল অধিবাসীকে তারা ক্রীতদাস বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে রােমের কৃষিকাজ ও গৃহস্থালি কাজ করাতে বাধ্য করত। রােমে যারা ক্রীতদাস হিসেবে ছিল তারা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল হতে আসত। এলিট রােমানরা এভাবে ক্রীতদাস আনতে থাকায় একসময় নিজেরাই সংখ্যালগিষ্ঠ জাতি হয়ে ওঠে এবং এক সময় শুরু হয় ক্রীতদাস বিদ্রোহ। স্পার্টাকসের (Spartacus) নেতৃত্বে তৃতীয় সারভিল যুদ্ধ (Third Servile War) ছিল তেমনি এক ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ। তখন গ্রিক (Greek), বারবার (Berbers), জার্মান (Gemms), ব্রিটন (Britons), le (Slavs), TINTA (Thracians), CPM (Celt), sofa (Jews), আরব (Arabs) নানা প্রকার আদি অধিবাসীদেরকে কেবল শ্রম দেওয়ার জন্যই ক্রীতদাস হতে হয় নি তাদেরকে মালিক শ্রেণিকে আনন্দ দিতে হতাে, যেমন তাদেরকে হতে হতাে গ্লাডিয়েটর কিংবা যৌনদাসী (Sex Slave)।
(Gladiator: গ্লাডিয়েটর সাধারণত একজন ক্রীতদাস পারফর্মার। একজন গ্লাডিয়েটর তরবারি নিয়ে আরেকজন গ্লাডিয়েটরের সাথে লড়াই করে দর্শকদের আনন্দ দিত। রােমান সাম্রাজ্যের রিপাবলিক শাসনামলে গ্লাডিয়েটর শো খুব জনপ্রিয় ছিল। গ্লাডিয়েটররা কেবল আরেকজন গ্লাডিয়েটরের সাথেই যুদ্ধ করত না, তারা হিংস্র পশু যেমন সিংহ ইত্যাদির সাথেও লড়াই করত এবং দর্শকরা তা উপভােগ করত। তবে এই গ্লাডিয়েটর শোয়ের পরিণতি ছিল খুব করুণ অধিকাংশ সময়ই দেখা যেত কোনাে না কোনাে গ্লাডিয়েটর মারা যেত। গ্লাডিয়েটরদের অধিকাংশই ছিল ক্রীতদাস। তবে কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও গ্লাডিয়েটরের পেশা গ্রহণ করত।)
রিপাবলিক রােমান যুগে ক্রীতদাস প্রথা কেবল রােমের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভই ছিল না তা তৎকালীন রােমান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে। প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যের অন্তত ২৫ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল ক্রীতদাস। অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে সে সময় ইতালির ৩৫% জনসংখ্যাই ছিল ক্রীতদাস।
রােমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উন্নত শহর রােমে বসবাস করত অন্তত ৪০০,০০ ক্রীতদাস। রােমান সাম্রাজ্যের শুরু হতে এর পতনের সময় পর্যন্ত অন্তত ১০০ মিলিয়ন মানুষকে ক্রীতদাস হিসাবে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও অন্য সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলােতে বিক্রয় করা হয়েছে। যদি কোনাে ক্রীতদাস পালিয়ে যেত তবে ধরা পড়ার পর তাকে ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করা হতাে। রিপাবলিক যুগের শেষ দিকে ক্রীতদাস প্রথা রােমের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ছিল। তখন রােমের মােট জনসংখ্যা ২৫%-এর বেশি ছিল ক্রীতদাস এবং ইতালির মােট জনসংখ্যার প্রায় ৪০%ই হিল ক্রীতদাস।
ক্রীতদাস প্রথা : রােমান সাম্রাজ্য; খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে
এ সময়ে এসে ক্রীতদাস যারা খুব দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন তাঁদের জন্য সুযােগ আসে, তাদেরকে রাজকীয় রােমান সাম্রাজ্যের কোর্টে সেক্রেটারিয়েল কাজ করার সুযােগ দেওয়া হয়। তারা হতেন সম্রাটের কর্মচারী। এ-জাতীয় কোনাে কোনাে ক্রীতদাসের ক্ষমতা এথেন্সের সাধারণ নাগরিকদের চেয়েও ক্ষেত্রবিশেষে বেশি ছিল।
রােম রাজতন্ত্র শুরু হওয়ার দুই শতক পূর্বে রােমানরা খুব বেশি সংখ্যায় ক্রীতদাস নিয়ােগ করা শুরু করে এবং উল্লেখ্য সে সময়ে ক্রীতদাসদের সাথে বব্রতাও বাড়তে থাকে। খনিতে ওভারসিয়ারগণ তাদেরকে আরাে বেশি কাজ করানাের জন্য চাবুক দিয়ে প্রহার করত, এক কথায় বলতে গেলে এ হতভাগ্য ক্রীতদাসগণ সারাক্ষণই চাবুকের ওপর থাকতেন। কৃষি খামারে কর্মরত ক্রীতদাসদের অবস্থাও অনেকটা খনিতে কর্মরত ক্রীতদাসদের মতােই ছিল। ক্রীতদাসদের সবচেয়ে ভয়ানক যে কাজটি করতে হতাে তা হলাে গ্লাডিয়েটর হিসেবে কাজ করা। রাজার শাসন শুরু হওয়ার পূর্বের দুই শতক সময় ধরে ক্রীতদাসের সংখ্যা বেড়ে যায় যেমন- খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের প্রাচীন এথেন্সে অন্তত ৮০,০০০ ক্রীতদাস ছিল। এ হিসাবে বলা যায় তৎকালীন এথেন্সের মােট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগের চারভাগই ছিল ক্রীতদাস। রােমান সাম্রাজ্য যতই বিস্তৃতি লাভ করছিল বিজিত দেশগুলাের প্রায় সকল অধিবাসীকেই ক্রীতদাস হিসেবে ইউরােপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিক্রয় করা হতাে।
ক্রীতদাস প্রথা : মধ্যযুগ; ৬ষ্ঠ ১৫ শতক
পশ্চিমে রােমান সাম্রাজ্যের পতন হলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ক্রীতদাস প্রথা চালু থাকে। কিন্তু তখন ক্রীতদাসদের বিশেষ কয়েকটি কাজ যেমন গৃহস্থালি কাজ, অফিস ও বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে যােদ্ধা হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া এ-জাতীয় কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কাজে নিয়ােগ দেওয়া হতাে। তৎকালীন আমেরিকার কলােনিগুলােতে বিশাল বাণিজ্যিক আকারে তামাক ও তুলা চাষের প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত বড় বড় রােমান এস্টেটে বিশালকারে ক্রীতদাস নিয়ােগ দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়নি। তবে আমেরিকার কলােনিতে বিশালকারে তুলা ও তামাক চাষ শুরু হওয়ার অনেক পূর্ব থেকেই সাহারার লবণ খনিতে ক্রীতদাসের বিশাল বহর কাজ করত।
ক্রীতদাস প্রথা আরাে বিকশিত হতে থাকে এবং এর একটি বড় কেন্দ্র হয়ে ওঠে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। অন্য যে কোনাে স্থানের চেয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ভৌগােলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক কারণে ক্রীতদাস ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তােলে। ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রবর্তী অঞ্চলগুলাে ছিল শিক্ষিত ও সভ্যসমাজের বসবাস। অন্যদিকে এর উত্তর ও দক্ষিণে তীরবর্তী অঞ্চলে ছিল অপেক্ষাকৃত কম সভ্য ও বিভিন্ন আদিবাসীদের বসবাস। এই রাজ্যগুলোর সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে বিজয়ীরা লুটপাট শেষে যুদ্ধবন্দিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস বানাত।
১০ শতকের দিকে জার্মানরা পূর্ব দিকে তাদের রাজ্য বিস্তার করতে থাকলে এত অধিকসংখ্যক শ্লাভের (Slav) নাগরিককে ধরে ক্রীতদাস বানানাে হয় যে তাদের নামেই ক্রীতদাসদের নাম হয়ে যায় সেভ (Slave)। একই সময়ে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ক্রীতদাসদের চালান দেওয়া হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়ার একটি বড় আয়ের পথ এবং এর ওপর রাশিয়ার অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করত।
ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণে আরব রাজবংশগুলাে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে ক্রীতদাস আফ্রিকান ক্রীতদাস ব্যবসায় উদ্দীপনা এনে দেয়। ৭০০ সালের দিকে সাহারা অঞ্চলের জাউইলা (Zawila) শহর ক্রীতদাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। চাদের হ্রদ অঞ্চলে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বিক্রয় করে দেওয়া হতো মুসলমানদের নিকট, যা পরবর্তীতে স্পেন থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
ইসলাম ধর্ম নারী-পুরুষের অধিকারের ব্যাপারে খুব উদার হলেও ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে যায়নি বরং এর বৈধতাই দিয়েছিল। তবে এটাও ঠিক ইসলাম ধর্মে নারী ক্রীতদাসের সাথে যথার্থ আচরণের নির্দেশও দেয়। অনেক খ্রিস্টান কমিউনিটিতে ক্রীতদাসরা বর্বরের আচরণ পেলেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সমাজে ততটাই ভালাে ব্যবহার পেয়েছেন।
খ্রিস্টীয় গসপেলে (Gospel) ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে কোনাে কিছুই বলা নেই। দারিদ্রতার কারণে ক্রীতদাস প্রথা হতে পারে এ-জাতীয় বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত দেওয়া হয়েছে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে রোমান ক্যাথলিক বিশপ ও মিশনারিরা উদীয়মান রাজবংশগুলাের নিকট উত্তর ইউরােপের ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে বলেছে। ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে তারা বেশ এগিয়ে যায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম ইউরােপে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও সেখানে ভূমিদাস ও সামন্তবাদী প্রথার মাধ্যমে তা নতুন ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন শুরু হতে থাকে।
কিন্তু ১৫ শতকে পশ্চিম আফ্রিকাতে পর্তুগিজদের আগমনের পর সেখানকার অধিবাসীদের ওপর এক মহাবিপর্যয় নেমে আসে। পর্তুগিজরা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ক্রীতদাস ব্যবসায়। এরই মধ্যে মুসলমানরা যারা ক্রীতদাসদের সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ দিয়েছিল সে সকল ক্রীতদাস সেনাবাহিনী অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে।
মামলুক জাতি ও ক্রীতদাস
১২৫০ সালে মিসরের সেনাবাহিনীর অফিসার যারা মূলত ক্রীতদাস ছিলেন তাঁরা সুলতানকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন। এই ক্রীতদাস সেনাবাহিনীই মামলুক (Mamuk) নামে পরিচিত। মামুলুকদের একজন যিনি শাসক হয়েছিলেন তিনি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং মামলুক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই মামলুক রাজবংশ ৩০০ বৎসরের অধিক সময় ধরে শাসন করেছিল। ৯ শতকে আব্বাসিদ সাম্রাজ্যে মামলুকরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় বসে। ১৬ শতকে অটোমানদের নিকট মামলুকরা পরাজিত হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবারাে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করে।
মামলুকা ছিল মূলত সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস। পরবর্তীতে তারা ১২-১৪ বৎসরের কিশাের ক্রীতদাসদের সেনা প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদেরকে ক্রীতদাস সৈন্য হিসেবে আব্বাসিদ সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ দেয়। মামলুক শব্দের অর্থ মালিকানাধীন। এই সৈন্যরা কখনােই মুক্ত মানুষ ছিল না অর্থাৎ তারা তাদের অর্জিত অর্থ-সম্পদ তাদের সন্তানদের দিতে পারত না।
তারা মুক্ত না হলেও তারা ছিল পেশাদার সৈনিক এবং তাদের বিশেষ মর্যাদায় ছিল। এই মামলুক সৈন্যরা সব সময়ই ইসলামিক রীতি মেনে চলত তাদের মালিকের প্রতি অনুগত ছিল। ১৩ শতকে এসে মামলুকরা তাদের মালিকের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নিজেরাই শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। তারা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তারা আর ক্রীতদাস ছিল না এবং নিজেরাই মামলুক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে।
কিশাের মামুলক সৈন্যরা যখন সাবালক হতাে এবং এবং রাজ্যের কোনাে দপ্তর পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করত তখন এই ক্রীতদাস সৈন্যদের মুক্ত করে দেওয়া হতাে এবং তাদেরকে দাড়ি রাখার অনুমতি দেওয়া হতাে। এদেরকে যােগ্যতা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর উচ্চপদেও নিয়ােগ দেওয়া হতাে এবং তাদের নেতৃস্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নিতেন তারা কোনাে প্রাক্তন ক্রীতদাসের কন্যাকে বিয়ে করবে। এভাবেই মামলুকরা একে অপরের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে নিজেদের শক্তিকে আরাে দৃঢ় করে এবং ১২৫০ থেকে ১৫১৭ পর্যন্ত ২৬৭ বৎসর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য শাসন করে।
ক্রীতদাস প্রথা: মধ্যযুগের ইউরােপ
মধ্যযুগের প্রথম দিকে গােলযােগের সুযােগ নিয়ে ঘেরাও দিয়ে ইউরােপের অধিবাসীদেরকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করে দেওয়া হতো। খ্রিস্টীয় ধর্মীয় নেতা সেন্ট প্যাট্রিককেও (St. Patrick) এ রকম ঘেরাও দিয়ে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করে দেওয়া হয়। তার কারণ ছিল তিনি আয়ারল্যান্ডে করােটিকাস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় না করার জন্য তিনি সম্রাট করােটিকাস (Coroticus) এর সেনাবাহিনীর নিকট চিঠি দিয়েছিলেন।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সমুদ্রের যাযাবর উপজাতি যারা পুরনাে নর্স ভাষায় কথা বলত তারাই ভাইকিং নামে পরিচিত। তারা তাদের মাতৃভূমি স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে সমুদ্রপথে তারা ব্যবসার পাশাপাশি দস্যুবৃত্তি করত। ৮ম-১১ শতক পর্যন্ত এই ভাইকিং জলদস্যুদের বিস্তৃতি ছিল ইউরােপ, এশিয়া ও উত্তর আটলান্টিক দ্বীপগুলােতে। এরা সমুদ্রের যাযাবর জাতি বা জিপসি নামেও পরিচিত। ভাইকিংরা সুযােগ পেলেই ইউরােপ আক্রমণ করে সেখান থেকে লােকজন ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করে দিত। ভাইকিংদের আক্রমণ খুব বেশি হতাে ব্রিটিশ দ্বীপ ও পূর্ব ইউরােপে।
ভাইকিংরা চাকর হিসেবে কাজ করানাের কিছু ক্রীতদাস রেখে দিত জন্য এবং অবশিষ্টদেরকে প্রধানত বাইজেন্টাইন ও তৎসংলগ্ন মুসলিম এলাকার ক্রীতদাস বাজারে বিক্রয় করে দিত। পশ্চিমে তারা ইংরেজ, আইরিশ, স্কটিশদেরকে আক্রমণ করলেও পূর্বে তারা প্রধানত স্লাভদেরকেই টার্গেট করেছিল। ১১ শতকের দিকে এসে ভাইকিং ক্রীতদাস ব্যবসা আস্তে আস্তে গুটিয়ে আসে এবং তারা ইউরােপের বিভিন্ন টেরিটরিতে বসতি স্থাপন করে একসময় তাদের সাথে মিশে যায়।
মধ্যযুগীয় ইউরােপের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের দেশগুলাে খুব বড় আকারের ক্রীতদাস ব্যবসায় লিপ্ত ছিল। তারা মূলত বাইজেন্টাই সাম্রাজ্য, মুসলিম বিশ্বে ক্রীতদাস সরবারাহ করত এবং তারা সেন্ট্রাল পাগান সাম্রাজ্য ও পূর্ব ইউরােপ হতেই ক্রীতদাস সংগ্রহ করত। এ সময় ইউরােপের এই অঞ্চল ব্যতীত ভাইকিং (Viking), আরব, গ্রিক ও ইহুদি ব্যবসায়ীরা ক্রীতদাস ব্যবসায় নিয়ােজিত ছিল। ১০ শতকে ক্রীতদাস ব্যবসা তার চরমে পৌঁছে এবং জাঞ্জি বিদ্রোহের কারণে আরব বিশ্বে আফ্রিকান ক্রীতদাস ব্যবহার করা কমতে থাকলে ক্রীতদাস ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়া শুরু হয়।
মধ্যযুগের স্পেন ও পর্তুগাল প্রায় সব সময়ই মুসলমানদের দখলে ছিল যদিও এ অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণই ছিল খ্রিস্টান। আল আন্দুলাস (Al-Andalus) থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই এই খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাজ্যগুলােতে মুসলমানরা সেনা অভিযান পরিচালনা করত মূলত দুটি উদ্দেশ্যে যার একটি হলাে ধনসম্পদ লুটতরাজ করা ও দ্বিতীয়টি হলাে যাবার সময় এখানকার নারীপুরুষ এমনকি শিশুদের বিশেষ করে কন্যাশিশুদের জোরপূর্বক নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার অথবা বিক্রয় করা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আলমােহদ (Almohad)-এর খলিফা ইয়াকুব আল মনসুর (Yaqub al-Mansur) ১১৮৯ সালে লিসবন ও পর্তুগালে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং যাবার সময় ৩,০০০ নারী ও শিশুকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। এর ঠিক দুই বৎসর পর ইয়াকুব আল মনসুরের গভর্নর দোভা (Cordoba) আরেকবার পর্তুগালের সিলভেস (Silves) আক্রমণ করে আরাে ৩,০০০ খ্রিস্টানকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস পরিণত করে। ১১ শতক হতে ১৯ শতক পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার বার্বারিয়ান জলদস্যুরা ইউরােপের সমুদ্রতীরবর্তী শহরগুলাে থেকে অসংখ্যবার মানুষ জোর করে ধরে নিয়ে আলজেরিয়া ও মরােক্কোর ক্রীতদাস বাজারে বিক্রয় করে দিত ক্রীতদাস হিসাবে।
রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পরও ব্রিটেনে ক্রীতদাস ব্যবসা জমজমাট ছিল এবং মধ্যযুগের ওয়েলসে প্রচলিত আইন অনুসারেই তখন ওয়েলসে ক্রীতদাস ব্যবসা পরিচালিত হতাে। বিশেষ করে ভাইকিং (viking Invasions) অনুপ্রবেশের পর চেষ্টার ও ব্রিস্টলে ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা তখন তুঙ্গে ওঠে। আর তখন ডেনিস, মার্সিয়ান ও ওয়েলস একে অপরের বর্ডার লাইন আক্রমণ করে জোরপূর্বক মানুষ ধরে নিয়ে যেত এবং চেস্টার ও ব্রিস্টলের বাজারে তাদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা হতাে।
১০৮৬ সালের Domesday Book-এ উল্লেখ করা হয়েছে তখন ব্রিটেনের অন্তত ১০% জনগােষ্ঠীই ছিল ক্রীতদাস। মধ্যযুগের প্রথমদিকে ইউরােপে ক্রীতদাস ব্যবসা এতই সাধারণ হয়ে গিয়েছিল যে, রােমান ক্যাথলিক চার্চ বেশ কয়েকবার এটি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল কিংবা অন্তত খ্রিস্টান ক্রীতদাসকে অখ্রিস্টান দেশে বিক্রয় বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৫২ সালে পােপ পঞ্চম নিকোলাস পাপাল বুল (Papal Bull; কোনাে ক্যাথলিক চার্চের পােপের চিঠি) এর মাধ্যমে স্পেন ও পর্তুগালের রাজার হাতে ক্ষমতা প্রদানের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন যেখানে বলা হয়েছিল যুদ্ধে বিশেষ করে মুসলিম যােদ্ধা যারা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত, পাগল ও খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী নয় এমন কোনাে যুদ্ধবন্দিকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত কেবল রাজাই নিতে পারবেন। তার এই পাপাল বুলের ক্ষমতায় যুদ্ধবন্দি অখ্রিস্টানদের ক্রীতদাস বানানাের বিষয়টি ১৪৫৫ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। পােপ তৃতীয় পল ১৫৩৭ সালে আরেকটি পাপাল বুলের মাধ্যমে আদিবাসী আমেরিকানদের ক্রীতদাস বানানােকে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
এর কয়েক কসর পর বিখ্যাত উপন্যাস Don Qixote এর রচয়িতা কারভেন্টেস (Cervantes) ক্রোয়েশিয়ার জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং আলজেরিয়াতে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করে। সেখান থেকে তিনি পলায়নের চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, তাতার সৈন্যরা নিয়মিতভাবে পূর্ব ইউরােপ আক্রমণ করত এবং এর উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট করা এবং মানুষ ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা। ১৭৭৪-১৫৯ সালের মধ্যে পােল্যান্ড-লিথুনিয়াতে অন্তত ৭৫ বার তাতার দস্যুরা আক্রমণ করেছিল। ১৫৫১ সালে কাজান খানেতে (Kazam Khamate) অন্তত ১০০,০০০ রাশিয়ান ক্রীতদাস ছিল। কারােলিনজিয়ান ইউরোপের (Carolingian Europe) গ্রামাঞ্চলের প্রায় ১০-২০% অদিবাসীই ছিল ক্রীতদাস। মধ্যযুগের শেষ দিকে পশ্চিম ইউরােপে ক্রীতদাস প্রথা ও ব্যবসা এক রকম নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
১১০২ সালে ইংল্যান্ডে ক্রীতদাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও পরবর্তী অনেককাল ১৭ শতক থেকে ১৯ শতকের প্রথম ভাগে পর্যন্ত আটলান্টিক রুটে লােভনীয় ক্রীতদাস ব্যবসায় ইংল্যান্ড খুবই সক্রিয় ছিল। তৎকালীন স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ থ্রালডোমে (Thralldom) থ্রালরা ছিল সমাজের সবচেয়ে নিচু জাতের। এরা মূলত ছিল উত্তর ইউরােপের, যাদেরকে ঋণের দায়ে যুদ্ধে হেরে গিয়ে ক্রীতদাস হতে হয়েছিল। আর স্বাভাবিকভাবেই থ্রালদের সন্তানরাও ছিল ক্রীতদাস।।
এই থ্রালদের কোনাে অধিকারই ছিল না এবং তাদের জীবনযাত্রার মান নির্ভর করত মালিকের সাথে সম্পর্কের ওপর। ভাইকিং অর্থনীতির অন্যতম জোগানদাতা ছিল থ্রাল ক্রীতদাসরা। এক তথ্যে জানা যায়, তখন অধিকাংশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পরিবারগুলােতেই এক থেকে দুইজন থ্রাল ক্রীতদাস থাকলেও ৩০ জন ক্রীতদাস ছিল এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়। ১৪ শতকের মধ্য ভাগে থ্রালডােম ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করে। পূর্ব ইউরােপে ক্রীতদাস প্রথা ও ব্যবসা আরাে অনেক সময় ধরে চলে। ১৫ শতকের প্রথম দিকে পােল্যান্ড ও ১৫৮৮ সালে লিথুনিয়া ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করে। এই অঞ্চলে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ হলেও নতুন আঙ্গিকে তা শুরু হয় সাফডম (Serfdom) বা ভূমিদাস নামে। কেইভান রুশ (Kievan Rus) ও মাসকোভিতে (Muscovy) ক্রীতদাসরা কোহলােপস holops) নামে পরিচিত ছিল। ১৫ শতকে পােল্যান্ডে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।